অমুসলিমদের শ্রেনী বিভাগ
অমুসলিমদের যে শ্রেণী বিভাগ উপরে বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের জিম্মীদের সম্পর্কে তো সকলেরই জানা আছে যে, মদ, শূকরের মাংস, নিষিদ্ধ ব্যক্তিদের সাথে বিবাহ এবং আল্লাহ ব্যতীত অপর কিছুর ইবাদত উপাসনা ছাড়া, অন্যান্য ব্যাপারে তাদের অবস্থা মুসলমানদের মতোই। ইসলামের যাবতীয় রাষ্ট্রীয় আইন (LAWS OF THE LAND) তাদের উপর প্রযোজ্য হবে। যেসব বিষয় থেকে মুসলমানদেরকে বিরত রাখা হয়, তাদেরকেও সেসব থেকে বিরত রাখা হবে। জান-মাল, ইজ্জত-আবরু রক্ষার অধিকার তাদের থাকবে, যেমন মুসলমানদের থাকবে। নিরাপত্তাপ্রাপ্ত অমুসলিমদের ব্যাপারেও জিম্মীদের থেকে পৃথক নয়। কারণ তাদের উপরেও ইসলামী রাষ্ট্রের বিধানসমূহ প্রযোজ্য হবে এবং দারুল ইসলামে থাকার কারণে তাদের জান-মাল ও ইজ্জতের অধিকার থাকবে। এদেরকে বাদ দিলে, শুধু সেসব অমুসলিমদের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে যারা দারুল কুফরে বসবাস করে।
একঃ করদাতা— যেসব অমুসলিম ইসলামী রাষ্ট্রকে কর দেয় এবং নিজেদের দেশে যারা কুফরী বিধান জারী করার স্বাধীনতা রাখে, তাদের দেশ যদিও দারুল কুফর, কিন্তু দারুল হরব নয়। কারণ মুসলমানগণ যখন কর নিয়ে তাদেরকে নিরাপত্তা দিয়েছে তখন তাদের হরবীয়ত (হরবী হওয়া) বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কুরআনে আছেঃ
(আরবী********)
“যদি তারা যুদ্ধ থেকে বিরত হয় এবং সন্ধির প্রস্তাব পেশ করে তাহলে আল্লাহ তাদের প্রতি হস্তক্ষেপ করার পথ তোমাদের জন্যে খোলা রাখেনি।”
এর ভিত্তিতে ফকীহগণ বলেন যে, তাদের জান-মাল ও ইজ্জতের উপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না।
(আরবী********)
“যদি তাদের সাথে এ বিষয়ে সন্ধি হয়ে থাকে যে, তারা প্রতি বছর একশ গোলাম দিবে, আর এ একশ গোলাম যদি তাদের দলের হয় অথবা তাদের সন্তান-সন্ততি হয়, তাহলে তা নেয়া দুরস্ত হবে না। কারণ, সন্ধি তাদের সম্পূর্ন দলের উপর বর্তাবে। তারা নিরাপত্তাপ্রাপ্ত এবং নিরাপত্তা প্রাপ্তকে গোলাম বানানো জায়েয হবে না।”
– (আল মাবসুত ইমাম সারাখসী-খন্ড ১০০, পৃঃ৮৮)
(আরবী********)
“যদি তাদের কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো দারুল হরবে বসবাস করে এবং ইসলামী সেনাবাহিনী সেখানে প্রবেশ করে তাহলে তাদের উপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না। কারণ তারা মুসলমানদের পক্ষ থেকে নিরাপত্তাপ্রাপ্ত।” – (আল মাবসুত ইমাম সারাখসী-খন্ড ১০০, পৃঃ৮৯)
(আরবী********)
“মুসলমানদের কোনো দল যদি তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের লোককে গোলাম বানায়, তাহলে মুসলমানদের জন্যে সেসব গোলাম খরিদ করা নাজায়েয হবে। খরিদ করলে তা বাতিল হয়ে যাবে। কারণ তারা মুসলমানদের নিরাপত্তার অধীন ছিল।”
– (আল মাবসুত ইমাম সারাখসী-খন্ড ১০০, পৃঃ৯৭)
এ ধরনের অমুসলিমগণ যদিও দৃষ্টিভংগীর দিক দিয়ে হরবীই থাকে।১ [১. (আরবী********)
কারন তারা এ সন্ধি ও চুক্তির জন্যে ইসলামী বিধান মানতে বাধ্য নয়। এজন্য তারা হরবীত্বের গন্ডি থেকে বের হতে পারে না। -(আল মাবসুত-১ পৃঃ ৮৮)]
কিন্তু তাদের সম্পদ বৈধ নয় এবং তাদের সংগে অবৈধ চুক্তির কোনো কারবার করা যেতে পারে না, তারা সুদখোর হোক না কেন। কিন্তু তারা যদি নিজেদের ভূখন্ডে না থাকে এবং এমন এক ভূখন্ডে থাকে যেখানে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ চলছে, তথাপি তাদের সাথে অবৈধ চুক্তির কারবার করা মুসলমানদের জন্যে জায়েয হবে না।
দুইঃ চুক্তিবদ্ধ— যেসব অমুসলিমদের সাথে দারুল ইসলামের চুক্তি হয়েছে তাদের সম্পর্কে কুরআন বলেঃ
(আরবী********)
“যেসব মুশরিকদের সাথে তোমরা চুক্তি সম্পাদিত করেছ এবং তারা তোমাদের সাথে চুক্তি পালনে ত্রুটি করেনি, আর না তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করেছে, তাহলে চুক্তির মেয়াদ পর্যন্ত তাদের চুক্তি পূরণ করো।” –(সূরা আত তাওবাঃ ৪)
(আরবী********)
“যতোক্ষণ তারা চুক্তিতে অবিচল থাকে, তোমরাও তাই থাক।”
–(সূরা আত তাওবাঃ ৪)
“এবং যেসব মুসলমান দারুল কুফরে থাকে, তারা যদি দীনের সত্যতার ভিত্তিতে তোমাদের সাহায্য প্রার্থনা করে, তাহলে তাদের সাহায্য কর। কিন্তু এমন কোনো দলের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য করো না যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি হয়েছে।”
–(সুরা আল আনফালঃ ৭২)
(আরবী********)
“যদি নিহত ব্যক্তি এমন এক দলের লোক হয়, যাদের এবং তোমাদের মধ্যে চুক্তি হয়েছে, তাহলে তাঁর ওয়ারিশদেরকে রক্তপণ দিতে হবে।”
-(সূরা আন নিসা ৯২)
এ আয়াতগুলো থেকে জানা যায় যে, চুক্তিকারী কাফের যদিও মতবাদের দিক দিয়ে হরবী এবং তাদের দেশকে দারুল হরব বলা যেতে পারে, কিন্তু যতোদিন পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্র তাদের সাথে চুক্তির সম্পর্ক বজায় রাখবে ততোদিন তাদের খুন ও মাল বৈধ হবে না এবং তাদের জান-মালের উপর হস্তক্ষেপ করা শরীয়তে নিষিদ্ধ। যদি কোনো মুসলমান তাদেরকে খুন করে তাহলে রক্তপণ দিতে হবে। তাদের সম্পদে হস্তক্ষেপ করলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অতএব তাদের সম্পদ যখন বৈধ নয়, তখন তাদের সাথে অবৈধ চুক্তিতে কারবার কিরূপে করা যাবে? কারণ তার বৈধতা তো বৈধতার ভিত্তির উপরেই প্রতিষ্ঠিত।
তিনঃ বিশ্বাসঘাতক — যেসব কাফের চুক্তি সূত্রে আবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও শত্রুতাচরণ করে তাদের সম্পর্ক কুরআন বলেঃ
(আরবী********)
“যদি তোমরা কোনো জাতির পক্ষ থেকে বিশ্বাসঘাতকতার আশংকা কর তাহলে সমতার প্রতি লক্ষ্য রেখে তাদের চুক্তি তাদের উপর নিক্ষেপ কর।”১ –(সূরা আল আনফালঃ ৫৮) [১. অর্থাৎ প্রকাশ্যভাবে চুক্তি ভংগের ঘোষণা তাদেরকে শুনিয়ে দাও, যাতে করে চুক্তি যে আর বলবৎ নেই একথা জানতে তারা এবং তোমরা যেন সমান হয়ে যাও।]
ইমাম শ্রেষ্ঠ সারাখসী এ মাসয়ালাটির ধরন বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ
(আরবী********)
“(এ অবস্থায় চুক্তি ভংগ করা জায়েয), তবে চুক্তি ভংগ যেন সমতার ভিত্তিতে হয়। অর্থাৎ তোমাদের মতো তারাও যেন জানতে পারে যে, তোমরা চুক্তি বাতিল বলে ঘোষনা করেছ। এ বিধানের অর্থ আমরা এই বুঝি যে, চুক্তি ভংগের ঘোষণা ব্যতীত তাদের সাথে যুদ্ধ করা বৈধ হবে না”-(মাবসুত খৃঃ ১০০, পৃ ৮৭)
এ আয়াত এবং তাঁর উপরোক্ত ব্যাখ্যা একথাই প্রকাশ করে যে, চুক্তি সম্পাদনকারী দল যদিও বিশ্বাসঘাতকতা করে তথাপি যুদ্ধ ঘোষণার পূর্বে তাদের জান ও মাল বৈধ হবে না।২ [২. এ বিধানের শুধুমাত্র সেই অবস্থাই ব্যতিক্রম হবে যখন চুক্তি সম্পাদনকারী জাতি ঘোষণা করে তাদের চুক্তি ভংগ করেছে, প্রকাশ্যে আমাদের অধিকারসমূহের উপর হস্তক্ষেপ করেছে এবং আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। এমতাবস্থায় আমাদের অধিকার থাকবে ঘোষণা ব্যতিরেকে যুদ্ধ করার। নবী করীম (স)-এর একটি পদক্ষেপকে ফকীহগণ প্রমাণ স্বরূপ পেশ করেন। ঘটনাটি এই যে, করাইশগণ যখন বনী খুযায়ার ব্যাপারে হুদায়বিয়ার সন্ধি প্রকাশ্যে ভংগ করে, তখন নবী (সঃ) চুক্তি বাতিল ঘোষণার কোনো প্রয়োজন বোধ করলেন না। বরঞ্চ কোনো প্রকার খবর না দিয়েই মক্কা আক্রমণ করেন। কিন্ত এই দৃষ্টান্তের সুযোগ গ্রহণ করতে হলে প্রয়োজন হবে, যেসব অবস্থা ও পরিস্থিতিতে নবী (স) চুক্তি বাতিল ঘোষণা করার প্রয়োজন বোধ করেননি, তা সামনে রাখা এবং যে পদ্ধতি এ অবস্থায় তিনি গ্রহণ করেছিলেন তা অনুসরণ করা। প্রথমত, কুরাইশদের চুক্তি ভংগ এতই সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য ছিল যে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশই ছিল না। স্বয়ং কুরাইশগণ একথা স্বীকার করে যে, তাদের পক্ষ থেকে চুক্তি ভংগ করা হয়েছিল। এজন্য তারা নতুন করে চুক্তি করার জন্যে আবু সুফিয়ানকে মদীনা পাঠায়। এর পরিষ্কার অর্থ এই যে, তাদের মতেও চুক্তি অক্ষুণ্ণ ছিল না। তবে চুক্তি ভংগকারী জাতির পক্ষ থেকে চুক্তি ভংগের স্বীকৃতি নিতে হবে এমন কোনো প্রয়োজন নেই। অবশ্যি চুক্তি ভংগ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।
দ্বিতীয়ত,তাদের পক্ষ থেকে চুক্তি ভংগ হবার পর নবী করিম (সঃ) প্রকাশ্যে, আকারে-ইংগিতে অথবা পরোক্ষভাবে এমন কিছু করেননি যার থেকে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, চুক্তি ভংগ হওয়া সত্ত্বেও তিনি কুরাইশদের একটি চুক্তিবদ্ধ জাতি মনে করেন এবং তাদের সাথে চুক্তির সম্পর্ক এখনো বিদ্যমান আছে। সর্বসম্মত বর্ণনা এই যে, আবু সুফিয়ান মদীনায় এসে যখন নতুন করে চুক্তির আবেদন করে, নবী করীম (সঃ) তখন তা প্রত্যাখ্যান করেন। তৃতীয়ত, কুরাইশদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ তিনি স্বয়ং নেন এবং প্রকাশ্যে নেন। তার কার্যকলাপে ধোঁকা-প্রতারনার কোনো লেশমাত্র ছিল না যে, তিনি বাইরে চুক্তির কথা বলেন এবং গোপনে যুদ্ধের পন্থা অবলম্বন করেন। এ হচ্ছে এ ব্যাপারে নবীর একটি উতকৃষ্ট আদর্শ।অতএব কুরআন মজিদের নির্দেশ ****** এর থেকে সরে গিয়ে যদি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে, তাহলে ঠিক সেই অবস্থায় এবং সেইভাবে, যে অবস্থায় এবং যেভাবে নবী করীম (সঃ)পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।]
চারঃ অচুক্তিবদ্ধ জাতি— অচুক্তিবদ্ধ ঐসব কাফেরদের বলা হয়, যাদের সাথে কোনো চুক্তি হয়নি। এ এমন এক অবস্থা যাকে সর্বদা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুদ্ধের অগ্রগামী বলা হয়। কূটনৈতিক সম্পর্কের অবসানের (RUPTURE OF DEPLOMATIC RELATIONS) প্রকৃত অর্থ এই যে, উভয় জাতি এখন পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শনের দায়িত্ব থেকে মুক্ত। এমন অবস্থায় যদি এক জাতি অন্য জাতির লোক হত্যা করে, অথবা লুন্ঠন করে তাহলে রক্তপণ অথবা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। এ অর্থে বলা যায় যে, উভয় জাতির জন্যে পরস্পরের জান ও মাল বৈধ। কিন্ত কোনো সভ্য রাষ্ট্রই দস্তুরমতো যুদ্ধ ঘোষণা না করে কোনো মানব গোষ্ঠীর রক্ত প্রবাহিত করা, ধন-সম্পদ লুন্ঠন করা পছন্দ করতে পারে না। এ ব্যাপারে ইসলামী বিধান হচ্ছে এইঃ
(আরবী********)
“যদি মুসলমানগণ দাওয়াত১ [১ ‘দাওয়াত’ অর্থ এই যে তাদেরকে এই বলে চরমপত্র (Ultimatum) দিতে হবে যে, তোমরা সন্ধি বা চুক্তি কর, জিযিয়া দাও অথবা মুসলমান হয়ে আমাদের জাতির মধ্যে শামিল হয়ে যাও। এ তিনটি শর্তের মধ্যে যদি একটিও গ্রহণ না কর, তাহলে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ছাড়া উপায় নেই।] ব্যতিরেকে যুদ্ধ করে তাহলে গোনাহগার হবে। কিন্তু এতে যে ধন-প্রাণ বিনষ্ট হয় তাঁর জন্যে হানাফী মতে কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না।”
-(মাবসুত খঃ১০, পৃঃ১৩)
ইমাম শাফেয়ী বলেন যে, ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কারণ যতোক্ষণ পর্যন্ত না তারা চরমপত্র প্রত্যাখ্যান করে। ততোক্ষণ তাদের জান-মালের বৈধতা বলবত থাকবে। কিন্তু হানাফীগণ বলেনঃ
(আরবী********)
“যে রক্ষণ-ব্যবস্থার ভিত্তিতে তাদের জান-মালের মূল্য নির্ধারিত হয়, তাতো দারুল ইসলামের রক্ষণাবেক্ষণের অধীনে হবার কারণে। আর এ জিনিস তাদের সপক্ষে নেই।——– বৈধতার জন্যে চরমপত্র দেয়াটা অবশ্যই শর্ত। তা ব্যতিরেকে বৈধতা প্রমাণিত হয় না। কিন্তু হত্যার অবৈধতার জন্যে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, এমন কথা বলা যায় না।”
-(মাবসুত খঃ১০, পৃঃ ৩০-৩১)
এর থেকে জানা গেল যে, যেসব হরবী কাফের জিম্মী নয়, যাদের সাথে কোনো চুক্তি সম্পাদিত হয়নি, যাদের আবাস ভূমি আমাদের আবাসভূমি থেকে পৃথক, যাদের রক্ষণ ব্যবস্থা আমাদের আইন স্বীকার করে না, তাদের জান-মাল ততোক্ষণ পর্যন্ত বৈধ হবে না, যতোক্ষণ না চরমপত্র দেয়া হয় এবং তাদের সাথে আমাদের রীতিমত যুদ্ধ শুরু না হয়। নবী করীম (সঃ) এ বিষরে হযরত মায়ায ইবনে জাবালকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা প্রনিধানযোগ্যঃ
(আরবী********)
“তাদের সাথে যুদ্ধ করো না যতোক্ষণ না তাদেরকে চরমপত্র দিয়েছ। অতপর যদি তারা প্রত্যাখ্যান করে তথাপি যুদ্ধ করো না যতোক্ষণ না তারা প্রথমে অগ্রসর হয়। যদি তারা প্রথমে অগ্রসর হয়, তথাপি যুদ্ধ করো না যতোক্ষণ না তারা তোমাদের কাউকে হত্যা করে। অতপর সে নিহত ব্যক্তিকে দেখিয়ে তাদেকে বলবে এর চেয়ে কোনো ভাল কিছু তোমরা করতে পারতে না? হে মায়ায এতখানি ধৈর্যের শিক্ষা এজন্য দেয়া হচ্ছে যে, যদি আল্লাহ তোমার দ্বারা কাউকে হেদায়েত করেন, তাহলে সমস্ত প্রাচ্য ও প্রতিচ্যের সম্পদ তোমার হস্তগত হওয়া থেকে তা হবে অতি উত্তম।”
পাচঃ যুদ্ধরত কাফেরগণ— এখন শুধু সেসব কাফেরদের কথা বলা যাক, যারা প্রত্যক্ষ মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। প্রকৃত হরবী এরাই, এদের আবাস ভূমিকে — বৈদেশিক সম্পর্কের আইনে- দারুল হরব বলে। তাদের জান-মাল বৈধ। তাদেরদে হত্যা করা, গ্রেফতার করা, লুন্ঠন করা প্রভৃতি শরীয়ত জায়েয বলে ঘোষণা করেছে। কিন্তু তাই বলে সকল হরবীর হরবীত্ব(ENEMY CHARACTER) এক রকম নয়, আর না হরবীর সকল সম্পদ একই বিধানের অধীন। হরবী কাফেরদের নারী, শিশু, রুগ্ন, বৃদ্ধ, পংগু প্রভৃতি যদিও হরবী, কিন্তু শরীয়ত তাদেরকে বৈধ বলেনি। বরঞ্চ হত্যার বৈধতা শুধুমাত্র যুদ্ধকারী (COMBATANTS) পর্যন্ত সীমিত রেখেছে।
(আরবী********)
“হত্যা শুধু তাকেই করা যাবে, যে আমাদের সাথে যুদ্ধ করছে। কারণ আল্লাহ **** বলেছেন। আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী মুকাবিলা (যুদ্ধ) দু পক্ষ থেকে হয়, এক পক্ষ থেকে নয়।”
-(মাবসুত খঃ ১, পৃঃ ৬৪)
এভাবে হরবীদের মালের মধ্যেও শরীয়ত শ্রেণী পার্থক্য করে দিয়েছে এবং প্রত্যেক শ্রেণীর জন্যে পৃথক পৃথক বিধান রয়েছে।
হরবীদের সম্পদের শ্রেণী বিভাগ ও তার বিধান
যেসব ধন-সম্পদ ও বিষয়-সম্পত্তি দুশমন এলাকায় পাওয়া যাবে, তার সবটাই নীতিগতভাবে বৈধ (CONFISCABLE)। কিন্তু শরীয়তে ইসলামী সেগুলোকে দু ভাগে বিভক্ত করছে— গনীমত ও ফাই।
গনিমতঃ ঐ সকল অস্থাবর সম্পদ (MOVEABLE PROPERTIES) যা যুদ্ধের সময় ইসলামী সেনাবাহিনী অস্ত্রবলে হস্তগত করে, তাহলো গনিমতের মাল। তার এক-পঞ্চমাংশ রাষ্ট্রের এবং ৫.৪ অংশ ঐসব সৈনিকদের যারা তা হস্তগত করেছে। ইমাম আবু ইউসুফ তাঁর কিতাবুল খেরাজ গ্রন্থে গনিমতের সংজ্ঞা নিম্নরূপ বর্ণনা করেছেনঃ
(আরবী********)
“ঐ সমস্ত সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ যা মুসলমানগ্ণ মুশরেক সৈনিকদের নিকট থেকে হস্তগত করেছে এবং যা কিছু হস্তগত করেছে তাদের সাজ-সরঞ্জাম, অস্থশস্ত্র এবং পশুর মধ্যে (অর্থাৎ অস্থাবর সম্পদ)।”
এর থেকে একথা সুস্পষ্ট হয় যে, গনিমত শুধুমাত্র ঐসব সম্পদকে বুঝাবে যা (১)অস্থাবর (২) যুদ্ধকালীন অবস্থায় (WAR LIKE OPERATIONS) (৩) শত্রু পক্ষের সৈন্য থেকে হস্তগত করা হবে। সৈনিকদের আওতার বাইরে সাধারণ বেসামরিক জনপদ লুন্ঠন করে বেড়ানো শরীয়তের দৃষ্টিতে দুরস্ত নয়। যদিও দারুল হরবের যাবতীয় সম্পদ বৈধ এবং যদি কেউ বেসামরিক লোকের সম্পদের হস্তক্ষেপ করে, তাহলে তার ক্ষতিপুরণ দিতে হবে না এবং লুন্ঠিত দ্রব্যাদি ফেরত দিতে হবে না, তথাপি এ ধরনের লুটতরাজ বাঞ্চনীয় নয়। মুসলিম বাহিনীর অধিনায়ক তার সেনাবাহিনীকে এ ধরনের কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখবে। কারণ নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ
(আরবী********)
“যে ব্যক্তি অহংকার বশত নিজের ক্ষমতা ও বীরত্ব দেখাবার জন্যে এবং খ্যাতি লাভের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করে, নেতার অবাধ্যতা করে এবং দুনিয়ায় অশান্তি সৃষ্টি করে, তার সওয়াব লাভ করাতো দূরের কথা, সে তার কাজের সমান পারিশ্রমিক নিয়েও (আল্লাহর দরবারে) ফিরতে পারবে না।”
ফাইঃ দ্বিতীয় প্রকারের ঐসব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ যা শত্রুর সাথে যুদ্ধ করে হস্তগত করা হয়নি, বরঞ্চ বিজয় লাভের ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের অধিকারে আসে, ইসলামী পরিভাষায় তাকে ‘ফাই’ নামে অবিহিত করা হয়। এ সম্পদ বিজিত শত্রুর জনগণের হোক অথবা শত্রু রাষ্ট্রের সম্পদ হোক। গনিমত থেকে এ সম্পূর্ণ এক পৃথক বস্তু।
(আরবী********)
“শত্রুসেনাদের নিকট থেকে কেড়ে নেয়া মালে গনিমত এক বস্তু আর দুশমনের জনপদ থেকে অধিকৃত ‘ফাই’ এর মাল আর এক বস্তু। উভয়ের বিধান পৃথক পৃথক।”
-(কিতাবুল খেরাজ পৃঃ ৩৮)
সূরা হাশরে এ বিষরে ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে যে, এ ‘ফাই’ কোনো ব্যক্তির মালিকানায় দেয়া হবে না। তা বায়তুলমালে জমা থাকবে এবং জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয়িত হবে।
(আরবী********)
“আল্লাহ তাদের নিকট থেকে তাঁর রসূলকে ‘ফাই’ হিসেবে যা দান করেছেন তা অর্জন করার জন্যে তোমরা উট এবং ঘোড়া পরিচালনা করনি, অর্থাৎ যুদ্ধ করনি।” –(সূরা হাশরঃ ৬)
এছাড়া ‘ফাই’ শব্দের আর কোনো অর্থ হতে পারে না। লোকে ইচ্ছামত ‘ফাই’ লাভ করে নিজের ব্যবহারে লাগিয়েছে, ফেকাহর গ্রন্থে এমন কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। কোথাও কোথাও **** (মুসলমানদের জন্যে ‘ফাই’) ********(‘ফাই’ মুসলমানদের বায়তুলমালে রাখা হয়) ******(মুসলিম দলের জন্য ‘ফাই’) প্রভৃতি কথাগুলো দেখতে পাওয়া যায়। এর থেকে মনে হয় যে, পূর্ববর্তী শাস্ত্রবিদগণ শুধু ঐসব ‘ফাই’ সম্পর্কে ওয়াকেফহাল ছিলেন যা মুসলিম দলের মালিকানায় হতো এবং তা থাকতো রাষ্ট্রের আয়ত্তাধীন।
গনীমত ও লুণ্ঠিত দ্রব্যের মধ্যে পার্থক্য
শরীয়তের গনীমত লাভ করার অধিকার শুধু তাদেরকে দেয়া হয়েছে যারা ইসলামী রাষ্ট্রের রক্ষণাধীন এবং যাদেরকে মুসলিমগণের নেতা বা ইমাম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অনুমতি দিয়েছে। নতুবা যদি মুসলিম জনসাধারণ ব্যক্তিগত ভাবে অথবা দলবদ্ধ হয়ে ইচ্ছামতো লুটতরাজ করা শুরু করে তাহলে তারা লুণ্ঠনকারী বলে গণ্য হবে। তাদের গনীমত, গনীমত না হয়ে হবে লুটের মাল। এজন্য তার মধ্য থেকে এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহর অংশ গ্রহণ করা হবে না। অবশ্য তা তাদের কাছেই থাকতে দেয়া হবে। কারণ দুশমনকে তা ফেরত দেয়া সম্ভব নয়।
فان كان دخول القوم الذين لامنعة لهم بغير اذن الامام علي سبيل التلصص فلا خمس فيما اصابوا عندنا ولكن من اصاب منهم شيأ فهوله خاصة-
(আরবী********)
“ইমামের সাহায্য ও অনুমতি ব্যতিরেকে এমন কোনো লোক যদি শত্রু এলাকায় দায়িত্বহীনের ন্যায় প্রবেশ করে সম্পদ লুণ্ঠন করে, তাহলে আমাদের মতে তার থেকে এক-পঞ্চমাংশ গ্রহণ করা হবে না। বরঞ্চ তা হবে তাদেরই জন্যে নির্দিষ্ট।”- (আল মাবসুত খঃ পৃঃ ৭৪)
আল্লামা সারাখসী এর যা কারণ বর্ণনা করেছেন তা নিম্নরূপঃ
والمعني مل بينا ان الغنيمة اسم لمال مصاب باشرف الجهات وهو ان يكون فيه اعلاء كلمة الله تعالي واعزاز الدين ولهذا جعل الخمس منه لله تعالي وهذا المعني لايحصل فيما ياخذه الواحد علي سبيل التلصص فيتمحض فعله اكتسابا للمال-(ايضاص 74 )
(আরবী********)
“আসল কথা হলো এই, যেমন আমরা পূর্বে বলেছি যে, গনীমত এমন মালকে বলা হবে যা অতিমাত্রায় পাক এবং সম্মানিত উপায়ে হস্তগত করা হয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, তাতে আল্লাহর বাণী সমুন্নত করা এবং দীনকে মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। এজন্য তার মধ্যে এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহর জন্যে নির্ধারিত করা হয়েছে। এ মর্যাদা সে মালের হতে পারে যা চোরের মতো হস্তগত করা হয়েছে, কারণ তার উদ্দেশ্য তো শুধু সম্পদ অর্জন করা।”-(আল মাবসুত, পৃঃ৭৪)
দৃষ্টান্ত স্বরূপ ইমাম সারাখসী এমন একটি হাদীস পেশ করেন যার মধ্যে উল্লেখ আছে যে, মুশরেকগন একটি মুসিলম বালককে ধরে নিয়ে যায়। কিছুদিন পর সে তাদের হাত থেকে পালিয়ে আসে এবং আসার সময়ে কিছু ছাগল ধরে নিয়ে আসে। নবী করীম (স) এ ছাগলগুলো তার কাছেই রাখতে দিলেন এবং তার কাছ থেকে এক পঞ্চমাংশ গ্রহন করলেন না। মুগীরাহ বিন শোবা (রা) এর ঘটনা থেকে্ও এ বিষয়ের সর্মথন পা্ওয়া যায়। তিনি তাঁর সাথীদের মাল লুট করে নিয়ে মদীনায় হাজীর হন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি যখন তাঁর লুটের মাল হুজুর (স)-এর খেদমতে পেশ করলেন তখন তিনি বললেন- “তোমার ইসলাম কবুল করা হলো, কিন্তু মাল কবুল করা হবে না।”
দারুল হরবে কাফেরদের মালিকানার অধিকার
গনীমতের উপরে তৃতীয় বাধা-নিষেধ এই আরোপ করা হয়েছে যে, গনীমত লাভকারীরা যতদিন দারুল হরবে অবস্থান করবে, ততোদিন তারা গনীমতের মাল ব্যবহার করতে পারবেন না। ব্যতিক্রম শুধু পানাহারের সামগ্রী এবং পশুর খাদ্য। অর্থাৎ যুদ্ধ চলাকালীন যত পরিমাণ খাদ্য দ্রব্য ও পশু খাদ্য মুসলিম সেনাবাহিনীর হস্তগত হবে, তার থেকে প্রত্যেক মুজাহিদ তার প্রয়োজন পরিমাণ দ্রব্যাদি প্রহণ করতে পারে। এতদ্ব্যতীত সমুদয় গনীমতের মাল সেনাধ্যক্ষের নিকট জমা দিতে হবে। গনিমত লাভকারীদেরকে দারুল ইসলাম অভিমুখে রওনা করে না দেয়া পর্যন্ত তাদের মধ্যে গনীমতের মাল বন্টন করা যাবে না। তার কারণ এই যে, হানাফীদের মতে যতোদিন পর্যন্ত গনীমতের মাল দারুল হরবে থাকবে ততোদিন তার উপর গনীমত লাভকারীদের মালিকানা বর্তাবে না। ইমাম শাফেয়ী (র) এর অভিমত তার বিপরীত। তিনি বলেন যে, হরবী যুদ্ধকারীদের মাল বৈধ। এজন্য যখনই মুসলিম মুজাহিদগন তা অধিকার করবে, তখনই তারা তার মালিক হয়ে পড়বে। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (র) এবং তার সহকর্মীগণ বলেন যে, এ মালিকানা দুর্বল। গনীমত যদিও আমদের কিন্তু ভূখন্ড তো তাদের। যতোক্ষণ পর্যন্ত মাল তাদের ভূখন্ড থেকে আমাদের ভূখন্ডে স্থানান্তরিত না হয়েছে, ততোক্ষণ আমরা পুরোপুরি তার মালিক হতে পারি না। অতএব পরিপূর্ণ মালিকানার জন্যে শুধুমাত্র্র অধিকার লাভই (OCCUPATION) যতেষ্ট নয়। ইমাম সারাখসী এ বিষয়ে হানাফী মতের ব্যাখ্যা নিম্নরূপ করেনঃ
فاما عندنا الحق يشبت بنفس الاخذ ويتاكد بالاحراز وتيمكن بالقسمة كحق الشفيع يشبت بالبيع ويتم الملك بالاخذ وما دام الحق
ضعيفا لا تجوز القسمة………بالاخذ يملك الارضي كما يفلك الاموال ثم لايتاكد الحق في الارض التي نزلوا فيها اذا لم يصيروها دار الاسلام-
“আমাদের মতে দখল দ্বারা শুধু অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, দারুল ইসলামে নিয়ে যাবার পর অধিকার সুদৃঢ় হয় এবং গনীমত বন্টনের পর অধিকার পূর্ণ হয়। এর দৃষ্টান্ত হলো প্রতিবেশীর হকের মতো। বিক্রয়ের মাধ্যমে প্রতিবেশীর হক প্রমাণিত হয়, দাবীর দ্বারা সে হক মজবুত হয় এবং দখলের দ্বারা হক পরিপূর্ণ হয়। অতএব যতোক্ষণ হক বা অধিকার দুর্বল থাকে, বন্টন জায়েয হয় না। — যেমন ধারা অস্থাবর সম্পত্তির উপর দখলের দ্বারা মালিকানা প্রমাণিত হয়, তেমনি জমিজমা তথা স্থাবর সম্পত্তির উপর দখল দ্বারা মলিকানা প্রমাণিত হয়। কিন্তু যে ভূখন্ডে মুসলিম সৈন্য প্রবেশ করে, তার উপর তাদের অধিকার ততোক্ষণ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত যতোক্ষণ না তা দারুল ইসলামে শামিল করে নেয়া হয়।”
-(আল মাবসুত খঃ১, পৃঃ৩৩)
এ ব্যাখ্যা দ্বারা প্রমানিত হয় যে, শুধুমাত্র গনীমতই নয়, বরঞ্চ ফাই ব্যবহরের অধিকারও ইসলামী রাষ্ট্রের ততোক্ষণ পর্যন্ত হয় না, যতোক্ষণ দখলকৃত অঞ্চলকে (OCCUPIED TERRITORY) দারুল ইসলামে পরিণত করা না হয়েছে। অথবা আধুনিক পরিভাষায় দখলকৃত এলাকাকে রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত (ANNEXATION) করার যথরীতি ঘোষণা করা না হয়েছে। নবী করীম (সাঃ) এর কার্যপদ্ধতি এর সমর্থন করে। মকহুল বলেনঃ
ماقسم رسول الله صلي الله عليه وسلم الغناؤم الا في دار الاسلام-
“নবী করীম (সাঃ) গনীমতের মাল দারুল ইসলাম ব্যতীত অন্য কোথাও বন্টন করেননি।”
মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক এবং কালবী বলেন যে, নবী করীম (সাঃ) হোনায়েনের গনীমত প্রত্যাবর্তন কালে জিয়িররানা নামক স্থানে বন্টন করে ছিলেন। এ স্থানটি ছিল দারুল ইসলাম সীমান্তে অবস্থিত। পথে বেদুইন আরবগন গনীমত বন্টনের জন্যে এতো পীড়াপীড়ি করে যে, নবী করীম (সাঃ) অত্যন্ত বিব্রত হয়ে পড়েন যে, তার গায়ের চাদর ছিড়ে যায়। কিন্তু এতটা হৈচৈ সত্ত্বেও দারুল ইসলাম সীমান্তে না পৌছা পর্যন্ত তিনি মালে গনীমতের একটি দানাও বন্টন করেননি।
আল্লাহর নবীর এ কার্যপ্রণালী এবং ইসলামী শাস্ত্রবিদগণের ব্যাখ্যা চিন্তা- ভাবনা করে দেখুন, এর কারণ এ ছাড়া আর কিছুই মনে না যে, ইসলামী আইন যেভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের অধিকৃত অঞ্চলের উপরে মুসলমানদের মালিকানার অধিকার স্বীকার করে, তেমনিভাবে অধিকৃত অনৈসলামী অঞ্চলের উপর হারবীদের পর্যন্ত মালিকানা অধিকার স্বীকার করে। যদিও যুদ্ধ তাদের সম্পদ আমাদের জন্যে বৈধ করে দেয়, তথাপি এ বৈধতার সুযোগ গ্রহণ করার জন্যে শরীয়ত সাধারণ ও শর্তহীন কোনো অনুমতি দেয় না। বরঞ্চ তাদের মালিকানা থেকে আমাদের মালিকানায় হস্তান্তরের জন্যে সম্পদ স্থানান্তরের কিছু আইনানুগ পন্থা নির্ধারিত করে দিয়েছে। তা এমন যে তার মধ্যে কাফেরদের ও আমাদের মধ্যে সমতার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। হানাফী আইন বলে যে, আমরা তাদের সম্পদের মালিক তখনই হতে পারি যখন রীতিমতো যুদ্ধের সাহায্যে তা হস্তগত করে আমাদের ভুখন্ডে (ইসলামী রাষ্ট্রে) নিয়ে আসবো। এভাবে যুদ্ধে তারা আমাদের সম্পদ হস্তগত করে, তাদের ভূখন্ডে নিয়ে গেলে, তারাও এসবের মালিক হয়ে যাবে। তাদের ভুখন্ডে তাদের মালিকানার অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আমাদের কর্তব্য।
এ ব্যাপারে ফকীহগণের অধিকতর ব্যাখ্যা প্রনিধানযোগ্যঃ
نفس الاخذ سبب لملك المال اذا تم بالاحراز وبيننا وبينهم مساوات في اسباب اصابة الدميا بل حظهم اوفر من حظنا لان الدنيا لهم ولانه لامقصود لهم في هذه الاخذ سوي اكتساب المال ونحن لانقصد بالاخذ اكتساب المال-
“সম্পদ হস্তগত করার পর যখন তা স্বীয় ভূখন্ডে পৌছিয়ে দেয়া হলো তখন সে সম্পদের উপর পূর্ণ মালিকানার কারণ হয়ে গেলে। ইহলৌকিক সম্পদ লাভের ব্যাপারে আমাদের ও কাফেরদের পূর্ণ সমতা বিদ্যমান। বরঞ্চ ইহলৌকিক ব্যাপারে আমাদের অপেক্ষা তাদের অংশ কিছুটা বেশী। কারণ তাদের জন্যে তো শুধু দুনিয়া এবং সম্পদ অর্জন করা ব্যতিত তাদের জীবনের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। পক্ষান্তরে আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য সম্পদ অর্জন নয়।”- (আল মাবসুত খঃ ১, পৃষ্ঠাঃ ৫৩)
واذا دخل المسلم دار الحرب بامان وله قي ايديهم جارية ماسورة كرهت له غصبها ووطيها لانهم ملكوها عليه والتحقت بساؤر املاكهم-
“কোনো মুসলমান নিরাপত্তাসহ দারুল হরবে প্রবেশ করলো এবং সেখানে সে তার দাসীকে হাতের নাগালে পেলো, এমতাবস্থায় তার দাসীকে হস্তগত এবং তার সাথে সহবাস করা তার জায়েয হবে না। কারণ কাফেরগন এখন তার মালিক এবং সে তাদের মালিকানার অধীন।”-(ঐ পৃঃ ৬৫)
ولو خرج الينا بامان ومعه ذالك المال فانه لايتعرض له فيه-(ايضا ص 63)
”যদি কোনো হরবী কাফের নিরাপত্তাসহ আমাদের রাষ্ট্রে প্রবেশ করে এবং তার কাছে যদি আমাদের নিকট থেকে লুণ্ঠিত মাল পাওয়া যায়, তাহলে তা আমরা তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারি না।”- (ঐ পৃঃ ৬৩)
فان غلب العدو على مال المسلمين فاحرزوه وهناك مسلم تاجر مستامن حل له يشتريه منهم فياكل الطعام من ذالك وبطاء الجلرة لانهم ملكوها بالاحراز فا لتحقت بساؤر املاكهم وهذا بخلاف مالو دخل اليهم تاجر بامان فسرق منهم جارية واخجها لم يحل المسلم ان يشتريها منه لانه احرزها عى سبيل الغدر وهو مامور بردها عليهم فيما بينه وبين ربه وان كان لايجبره الامام على ذالك-(ايضاص 31)
“যদি দুশমন মুসলমানদের মাল হস্তগত করার পর তা আপন আবাসভুমিতে নিয়ে যায় আর সেখানে যদি নিরাপত্তা প্রাপ্ত কোনো ব্যবসায়ী মুসলমান থাকে তাহলে সে মাল খরিদ করা ও ব্যবহার করা তার হালাল হবে। সে দুশমনের নিকট থেকে খরিদ করা দাসীর সাথে সহবাসও করতে পারে, কারণ আপন ভূখন্ডে নিয়ে যাবার পর সে ওসব মালের মালিক হয়ে গেছে এবং সবকিছুই এখন তার মালিকানাধীন। পক্ষান্তরে যদি কোনো ব্যবসায়ী নিরাপত্তসহ দারুল হরবে যায় এবং তাদের অধিকার থেকে কোনো দাসীকে চুরি করে নিয়ে দারুল ইসলামে আসে, তাহলে সে দাসী খরিদ করা মুসলমানের জন্যে হালাল হবে না। কেননা সে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে এনেছে। আল্লাহ ও তার মধ্যে যে সম্পর্ক তার জন্যে তাকে সে দাসী ফেরত দিতে হবে। অবশ্য ইমাম তাকে ফেরত দিতে বাধ্য করবে না।”- (ঐ পৃঃ৬১)
এ কর্মপদ্ধতি ঠিক হাদীসেরই অনুরূপ। মক্কা বিজয়ের দিনে হযরত আলী (রাঃ) নবী করীম (স)-কে অনুরোধ করে বললেন, হিজরতের আগে আপনি যে বাড়ীতে ছিলেন, সেখানে গিয়ে উঠে পড়ুন না কেন?” নবী করীম (সাঃ) বললেন, هل ترك لنا عقيل من ربع “আকীল কি আমাদের জন্যে কিছু ছেড়ে দিয়েছে?
তার অর্থ এই যে, নবী করীম (স) যখন তা ছেড়ে দিয়ে চলে যান, তখন আকীল ইবনে আবি তালেব তা দখল করে। তখন তাঁর মালিকানা চলে যায় এবং আকীলের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন যদিও তিনি মক্কা জয় করেছেন, তথাপি তিনি তাঁর পূর্ববর্তী মালিকানার ভিত্তিতে সে বাড়ী নিজের বলে ঘোষণা করতে অস্বীকার করেন।