সুদ সম্পর্কে ইসলামের বিধান
এ পর্যন্ত আমরা যুক্তি ও তথ্যের মধ্যে আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখেছিলাম।এবার কুরআন ও হাদিসের আলোকে সুদের পর্যালোচনা করতে চাই। সুদ কি? এর সীমানা কি? সুদ হারাম হবার যেসব বিধান ইসলাম দিয়েছে তা কোন কোন ব্যাপারে ও কোন কোন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? সুদের বিলোপ সাধন করে মানব জীবনের অর্থনৈতিক বিষয়াবলীকে ইসলাম কিভাবে পরিচালনা করতে চায়? এগুলোই হবে আমাদের পরবর্তী আলোচনার বিষয়বস্তু।
রিবার অর্থ
কুরআন মজীদে সুদের প্রতিশব্দ হিসেবে ‘রিবা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এর মূলে রয়েছে আরবী ভাষায় ر ب و তিনটি হরফ। এর অর্থের মধ্যে বেশী, বৃদ্ধি, বিকাশ, চড়া প্রভৃতি ভাব নিহিত। যেমন, ربا (রাবা)অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া ও বেশী হওয়া। ******** অর্থ,সে টিলায় চড়লো। ********** অর্থ সে ছাতুর মধ্যে পানি ঢাললো আর ছাতু ফুলে উঠলো। ************* অর্থ সে অমুকের কোলে লালিত পালিত হয়েছে। ****** অর্থ জিনিসটি বৃদ্ধি করেছে। **** (রাবওয়াতুন)অর্থ উচ্চতা। *** অর্থ এমন স্থান বা জমি যা ধরা পৃষ্ঠে থেকে উঁচু। কুরআন মজীদে এই শব্দটির মূল থেকে নির্গত শব্দাবলী যেখানে ব্যবহৃত হয়েছে সেখানেই উচ্চতা, বৃদ্ধি ও বিকাশ অর্থ পাওয়া যায়। যেমনঃ
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“আমি যখন তার উপর পানিবর্ষন করলাম তখন তা সবুজ শ্যামল হয়ে উঠলো,এবং শষ্য ও ফল দান করতে লাগলো।” – (সুরা আল হাজ্জঃ ৫)
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“আল্লাহ সুদ কে নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং সদকাকে বৃদ্ধি দান করেন।” – (সুরা আল বাকারাহঃ ২৭৬)
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“যে ফেনাপুঞ্জ উপরে উঠে এসেছিল বন্যা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।” -(সুরা আর রাআদঃ ১৭)
“সে তাদেরকে আর শক্ত করে ধরলো।”-(সুরা আল হাক্কাহঃ ১০)
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“যাতে এক জাতি অন্য জাতি থেকে অগ্রসর হয়ে যায়।”-(সুরা আন নাহলঃ ৯২)
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“আমি মরিয়ম ও ঈসাকে একটি উচ্চস্থানে আশ্রয় দান করলাম।”–(সুরা আল মুমেনুনঃ ৫০)
এ ধাতু থেকেই রিবা (***)শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে ধন বৃদ্ধি পাওয়া এবং আসল থেকে বেড়ে যাওয়া। কুরআনেও এ অর্থটি সুস্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। যেমন বলা হয়েছেঃ
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“আর লোকদের নিকট তোমাদের যাকিছু সুদ অবশিষ্ট (পাওনা)রয়ে গেছে তা ছেড়ে দাও।——আর যদি তোমরা তওবা করে নাও তাহলে তোমাদের মূলধনটাই (অর্থাৎ প্রদত্ত আসল অর্থ)ফেরত পাবার অধিকার তোমাদের আছে”।-(সুরা আল বাকারাহঃ ২৭৮-২৭৯)
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“যে সুদ তোমরা দিয়েছো এই উদ্দেশ্যে যে,মানুষের ধন বৃদ্ধি পাবে আল্লাহর নিকট তার সাহায্যে ধন বৃদ্ধি হয় না।” – (সুরা আর রূমঃ ৩৯)
এ আয়াতগুলো থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে,আসল অর্থের উপর যা কিছু বাড়তি হবে তা ‘রিবা’ আখ্যা পাবে। কিন্তু কুরআন মজীদ ঢালাওভাবে সব রকম বৃদ্ধিকে হারাম গন্য করেনি। বৃদ্ধি ব্যবসায়েও হয়। কুরআন একটি বিশেষ ধরনের বৃদ্ধিকে হারাম গন্য করেছে এবং এ বৃদ্ধিকে ‘রিবা’ নামকরন করেছে। ইসলাম পুর্ব যুগে আরবী ভাষায় এ বিশেষ পর্যায়ের লেনদেন টিকে একই নামে অভিহিত করা হতো। কিন্তু তৎকালে লোকেরা ‘রিবা’-কে ব্যবসায়ের ন্যায় বৈধ মনে করা হত যেমনটা আধুনিক জাহেলীয়াতে মনে করা হয়। ইসলাম এসে জানিয়ে দিলো যে,ব্যবসায়ের ফলে মূলধনে যে বৃদ্ধি হয় তা ‘রিবা”র মাধ্যমে বৃদ্ধি থেকে আলাদা। প্রথম ধরনের বৃদ্ধিটি হালাল এবং দ্বিতীয় ধরনের বৃদ্ধিটি হারাম।
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“সুদখোর এহেন পরিনতি হবার কারন হচ্ছে এই যে,তারা বলেছে,ব্যবসা রিবা (সুদ)সদৃশ্য অথচ আল্লাহ ব্যবসা কে হালাল এবং রিবাকে হারাম গন্য করেছেন।” – (সুরা আল বাকারাঃ ২৭৫)
যেহেতু রিবা ছিল একটি বিশেষ ধরনের বৃদ্ধির নাম এবং তা সর্বজন পরিচিত ও প্রসিদ্ধ ছিলো তাই কুরআন মজিদে এর কোন ব্যাখা দেয়া হয়নি। কুরআন এ ব্যাপারে কেবল এতটুকু বলাই যথেষ্ঠ মনে করেছে যে,আল্লাহ রিবা কে হারাম গন্য করেছেন কাজেই তোমরা এটিই পরিহার কর।
জাহেলী যুগের রিবা
জাহেলী যুগে যে সমস্ত লেনদেনের ক্ষেত্রে ‘রিবা’ শব্দটি ব্যবহার হতো হাদিসে তার বিভিন্ন বর্ননা উদ্ধৃত হয়েছে।
কাতাদাহ বলেন,জাহেলী যুগের রিবা ছিলো নিম্নরূপঃ এক ব্যক্তি অন্য জনের হাতে কোন জিনিস বিক্রি করত এবং মুল্য আদায়ের জন্য তাকে নির্দ্দিষ্ট সময় দিত। এ সময় অতিক্রান্তের পর যদি সে মুল্য আদায় না করতো,তাকে আরো সময় দিতো আর মূল্য বাড়িয়ে দিতো।
মুজাহিদ বলেন,জাহেলী যুগের রিবা ছিলো নিম্নরুপঃ এক ব্যক্তি অন্যের নিকট থেকে ঋন গ্রহন করে তাকে বলতো,যদি তুমি আমাকে অমুক দিন থেকে অমুক দিন পর্যন্ত সময় দাও তাহলে আমি তোমাকে এই পরিমান বেশী দিবো। (ইবনে জারীর,৩য় খন্ড,৬২ পৃঃ)
আবু বকর জাসসাস তার নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে বলেন,জাহেলী যুগে লোকেরা ঋন গ্রহন করার সময় ঋন দাতা ও ঋনগ্রহীতার মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হতো। তাতে বলা হতো,একটি নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আসল মূলধন থেকে একটি নির্দ্দিষ্ট পরিমান বেশী অর্থ ঋনগ্রহীতাকে আদায় করতে হবে।–(আহকামুল কুরআন,১ম খন্ড)
এ ব্যাপারে ইমাম রাযীর অনুসন্ধান হচ্ছে, জাহেলী যুগে লোকদের মধ্যে একটি বিশেষ নিয়ম প্রচলিত ছিল। তারা এক ব্যক্তিকে একটি নির্দ্দিষ্ট সময়ের জন্য অর্থ দিতো এবং তার নিকট থেকে প্রতিমাসে নির্দ্দিষ্ট পরিমান সুদ আদায় করতো। মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলে ঋনগ্রহীতার নিকট আসল মূলধন চাওয়া হয়। যদি সে আদায় করতে না পারতো তাহলে আরো একটি সময়ের জন্য অবকাশ দেয়া হতো এবং সুদ বাড়িয়ে দেয়া হতো।–(তাফসীরে কবীর,২য় খন্ড,৩৫১ পৃঃ)
তদানীন্তন আরবে প্রচলিত এ ধরনের ব্যবসাকে আরববাসীরা নিজেদের ভাষায় ‘রিবা’ নাম দিয়েছিল এবং কুরআন মজীদ একেই হারাম ঘোষনা করেছিলো। [(এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য এ গ্রন্থের পরিশিষ্ট দেখুন)]
ব্যবসায় ও রিবার মধ্যে নীতিগত পার্থক্য
ব্যবসায় ও রিবার মধ্যে নীতিগত পার্থক্য কি? রিবার বৈশিষ্ট কি,যে কারনে তার চেহারা ব্যবসায়ের থেকে ভিন্ন প্রকার দেখায় আর ইসলাম কেনইবা তাকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছে -এ ব্যাপারগুলো এবার গভীরভাবে চিন্তা করুন।
ব্যবসা বলতে বুঝায় যেখানে ক্রেতা বিক্রেতা দু’টি পক্ষ আছে। বিক্রেতা একটি বস্তু বিক্রির জন্য পেশ করে। ক্রেতা ও বিক্রেতা মিলে বস্তুটির একটই মূল্য স্থির করে। এ মূল্যের বিনিময়ে ক্রেতা বস্তুটি কিনে নিয়ে নেয়। এ ক্ষেত্রে বিক্রেতা নিজে পরিশ্রম করে এ অর্থ ব্যয় করে ঐ বস্তুটি তৈরী করেছে অথবা সে কোথাও থেকে বস্তুটি কিনে এনেছে-এ দুটির যে কোন একটি অবস্থার অবশ্যিই সৃষ্টি হয়। এ উভয় অবস্থায়ই সে বস্তুটি কেনার বা সংগ্রহ করার ব্যাপারে নিজের যে মুলধন খাটিয়েছে,তার সাথে নিজের পরিশ্রমের অধিকার সংযুক্ত করে এবং এটিই তার মুনাফা।
অন্য দিকে রিবা বলতে বুঝায়,এক ব্যক্তি নিজের মূলধন অন্য একজনকে ঋন দেয়। এ সংগে শর্তে আরোপ করে যে,একটি নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋন গ্রহীতাকে মূলধনের চেয়ে একটি নির্দ্দিষ্ট পরিমান বেশী অর্থ আদায় করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মূলধনের বিনিময়ে বাড়তি অর্থ লাভ করা হয়—পূর্বাহ্নে একটি শর্ত হিসেবে যেটিকে নির্দ্দিষ্ট করা হয়ে থাকে। এ বাড়তি অর্থের নাম সুদ বা রিবা। এটি কোনো বিশেষ অর্থ বা বস্তুর বিনিময় নয় বরং নিছক অবকাশের বিনিময়। যদি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারিত হবার পর ক্রেতার নিকট শর্ত পেশ করা হয় যে, মূল্য আদায় করতে (মনে করুন) এক মাস দেরী হলে মূল্য একটি নির্দ্দিষ্ট হারে বেড়ে যাবে,তাহলে এ বৃদ্ধি সুদের পর্যায়ভুক্ত হবে।
কাজেই নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মোকাবেলায় শর্ত সাপেক্ষে মূলধনের উপর যে নির্দ্দিষ্ট পরিমান বাড়তি অর্থ গ্রহন করা হয় তাকেই সুদ বলা হয়। সুদের সংজ্ঞা এভাবেই নিরূপিত হয়। তিনটি অংশের একত্র সংযোজনই সুদের উদ্ভব। এক,মূলধন বৃদ্ধি। দুই,সময়ের অনুপাতে বৃদ্ধির সীমা নির্ধারন। তিন,এগুলোকে শর্ত হিসেবে গ্রহন করা। ঋন সংক্রান্ত যে কোনো লেনদেনের মধ্যে এ তিনটি অংশ পাওয়া গেলে তা সুদী লেনদেনে পরিনত হয়। কোনো সৃষ্টিশীল ও গঠনমূলক কাজে লাগাবার অথবা কোনো ব্যক্তিগত প্রয়োজন পুর্ন করার জন্য এ ঋন গৃহীত হলেও এবং ঋনগ্রহীতা দরিদ্র বা ধনী যাই হোক না কেন তাতে এর আসল চরিত্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য সুচিত হয় না।
ব্যবসা ও সুদের মধ্যে নীতিগত পার্থক্য হচ্ছে নিম্নরূপঃ
একঃ ব্যবসায়ে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে মুনাফার বিনিময় হয় সমান পর্যায়ে। কারন ক্রেতা বিক্রেতার নিকট থেকে যে বস্তুটি ক্রয় করে তা থেকে লাভবান হয়। অন্যদিকে বিক্রেতা ঐ বস্তুটি ক্রেতার জন্য সংগ্রহ করার ব্যাপারে যে পরিশ্রম,বুদ্ধি ও সময় ব্যয় করে তার পারিশ্রমিকই সে লাভ করে। বিপরীতপক্ষে সুদী লেনদেনে সমান পর্যায়ে মুনাফা বিনিময় হয় না। সুদগ্রহীতা ধনের একটি নির্ধারিত পরিমান লাভ করে,যা তার জন্যে অব্যশি লাভজনক হয়। কিন্তু সুদদাতা কেবলমাত্র সাময়িক অবকাশ লাভ করে,এর লাভজনক হবার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ঋনগ্রহীতা ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূর্ন করার জন্য ঋন গ্রহন করে থাকলে সাময়িক অবকাশ তার জন্য লাভজনক হয় না বরং নিশ্চিত ক্ষতিকর হয়। আর ব্যবসা,শিল্প,কারিগরী বা কৃষিতে খাটাবার উদ্দেশ্যে ঋন গ্রহন করে থাকলে অবকাশ তার জন্য একদিকে যেমন লাভের সম্ভাবনা নিয়ে দেখা দেয় তেমনি অন্যদিকে ক্ষতির সম্ভাবনা নিয়েও উপস্থি্ত হয়। কিন্তু ব্যবসায়ে লাভ-লোকসান যাই হোক না কেন ঋনদাতা সর্বাবস্থায় তা থেকে নির্দ্দিষ্ট পরিমান মুনাফা লাভ করে। কাজেই দেখা যাচ্ছে,সুদী কারবারে এক পক্ষে লাভ ও অন্য পক্ষের লোকসান হয় অথবা এক পক্ষের নিশ্চিত ও নির্দ্দিষ্ট লাভ অন্যপক্ষের অনিশ্চিত ও অনির্ধারিত লাভ হয়।
দুইঃ ব্যবসায়ে বিক্রেতা ক্রেতার নিকট থেকে যতবেশী মুনাফা অর্জন করুক না কেন মাত্র একবারই সে তা অর্জন করে। কিন্তু সুদী কারবারে মূলধন দানকারী অনবরত নিজের ধনের বিনিময়ে মুনাফা অর্জন করতে থাকে এবং সময় অতিক্রান্তের সাথে সাথে এ মুনাফার পরিমান বেড়ে যেতেই থাকে। তার ধন থেকে ঋনগ্রহীতা যতই লাভবান হক না কেন তা একটি বিশেষ সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে। কিন্তু এ মূলধনের বিনিময়ে ঋনদাতা যে মুনাফা অর্জন করে তার কোনো সীমা নাই। তার এ সীমাহীন মুনাফা তার সমস্ত উপার্জন,সমস্ত উপায়-উপকরণ ও ধন-দৌলত এবং তার যাবতীয় প্রয়োজনকে ছাপিয়ে যাবার পরও শেষ নাও হতে পারে।
তিনঃ ব্যবসায়ে পণ্য ও তার মূল্যের বিনিময় হবার সাথে সাথেই কারবার শেষ হয়ে যায়। এর পরে ক্রেতা কোনো পন্য বা বস্তু বিক্রেতাকে ফেরত দেয় না। কিন্তু সুদী কারবারে ঋণগ্রহীতা মূলধন গ্রহণ করার পর তা ব্যয় করে ফেলে অতপর এ ব্যয়িত বস্তু পুনর্বার লাভ করে তার সাথে সুদের বাড়তি অংশ সংযুক্ত করে তাকে ফেরত পাঠাতে হয়।
চারঃ ব্যবসা,শিল্প, কৃষি ও কারিগরীতে মানুষ পরশ্রিম করে ও বুদ্ধি খাটিয়ে তার ফল লাভ করে। কিন্তু সুদী কারবারে সে নিছক নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন খাটিয়ে কোনো প্রকার পরিশ্রম না করে,চিন্তা ও বুদ্ধি শক্তি ব্যবহার না করে অন্যের উর্পাজনের সিংহভাগ দখল করে বসে। পারিভাষিক অর্থে যাকে অংশীদার বলা হয়, যে ব্যক্তি লাভ-লোকসান উভয়তেই অংশীদার থাকে এবং লাভের আনুপাতিক হারে তা থেকে অংশ নেয় সে তেমন ধরনের অংশীদার নয়। বরং সে হয় এমন একজন অংশীদার যে লাভ-লোকসান এবং লাভের আনুপাতিক হারের পরোয়া না করে নিজের নির্ধারিত ও শর্তাবদ্ধ মুনাফার দাবীদার হয়।
হারাম হবার কারণ
এ সমস্ত কারণে আল্লাহ ব্যবসা হালাল ও সুদ হারাম করছেনে। এ কারণগুলো ছাড়া সুদ হারাম হবার আরো অনেক কারণ আছে, ইতিপূর্বে আমরা সেগুলো আলাোচনা করেছি। সুদ কার্পণ্য, স্বার্থান্ধতা, হৃদয়হীনতা, নিষ্ঠুরতা ও অর্থগৃধ্নুতার অসৎ গুণাবলী মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে। বিভিন্ন জাতির মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক ছিন্ন করে। মানুষের মধ্যে ধন সঞ্চয় করে নিছক নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রবণতা সৃষ্টি করে। সমাজে ধনের অবাধ গতি ও আবর্তনে বাধা দেয়। বরং ধনের আবর্তনের গতি ঘুরিয়ে বিত্তহীনদের থেকে বিত্তবানদের দিকে ফিরিয়ে দেয়। তার কারণে সমগ্র দেশবাসীর ধন সমাজের একটি শ্রেণীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। এর ফলে সমগ্র সমাজ ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। অর্থনীতি বিশেষজ্ঞগণের নিকট এ ব্যাপারটি মোটেই প্রচ্ছন্ন নেই। সুদের এ সকল প্রভাব অনস্বীকার্য। কাজেই এ সত্যটিও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, যে কাঠামোর ভিত্তিতে ইসলাম মানুষের নৈতিক প্রশিক্ষণ, তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সুসংহত ও তার অর্থনৈতিক জীবন সংগঠন করতে চায় সুদ তার প্রতিটি অংশের পূর্ণ পরিপন্থী। নগণ্যতম সুদী কারবার ও তার আপত সর্বাধিক নিষ্কলুষ অবস্থা ও ইসলামের সমগ্র কাঠামোটা নষ্ট করে দেয়। এ কারণেরই আল্লাহ কুরআন মজীদে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় সুদ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“আল্লাহকে ভয় করো আর লোকদের নিকট তোমাদের যে সুদ পাওনা বাকি রয়ে গেছে সেগুলো ছেড়ে দাও, যদি তোমরা ঈমান রেখে থাকো। আর যদি তোমরা এমনটি না করো, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা গ্রহণ করো।” – (সূরা আল বাকারাঃ ২৭৮-২৭৯)
সুদ হারামের ব্যাপারে কঠোর নীতি
কুরআন মজীদে বহুবিধ গোনাহের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে এবং সেগুলোর জন্য কঠোর শাস্তি ও ভীতি প্রদর্শন করাও হয়েছে। কিন্তু সুদের ন্যায় এতো কঠোর ভাষায় অন্য কোনো গোনাহের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়নি।১ [এক হাদীসে বলা হয়েছে, সুদের গোনাহ নিজের মায়ের সাথে যিনা করার চেয়েও সত্তর গুণ বেশী। – ইবনে মাজা] এজন্য ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বত্র সুদ বন্ধ করার জন্য রাসূলুল্লাহ (স) চরম প্রচেষ্টা চালান। তিনি নাজরানের খৃষ্টানদের সাথে যে চুক্তি করেন তাতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখে পাঠান, যদি তোমরা সুদী কারবার করো, তাহলে তোমাদের সাথে চুক্তি ভেঙ্গে যাবে এবং আমাদেরকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। বনু মুগীরার সুদী লেনদেন আরবে প্রসিদ্ধ ছিল। মক্কা বিজয়ের পর রসূলুল্লাহ (স) তাদের সমস্ত পাওনা সুদ বাতিল করে দেন এবং মক্কায় তাঁর নিযুক্ত তহশীলদারদেরকে লিখে পাঠালেন, যদি তাঁরা (বনু মুগীরা) সুদ গ্রহণ করা বন্ধ না করে তাহলে তাদের সাথে যুদ্ধ করো। রসূলে করীম (স)-এর চাচা হযরত আব্বাস (রা)-ও একজন বড় মহাজন ছিলেন। বিদায় হজ্জে রসূলে করীম (স) ষোষণা দিলেনঃ জাহেলী যুগের সমস্ত সুদ বাতিল করে দেয়া হলো। সর্বপ্রথম আমি আমার চাচা আব্বাস (রা) -এর সুদ বাতিল করলাম। তিনি এতদূরও বললেন, সুদগ্রহীতা, সুদদাতা, সুদের চুক্তিপত্র লেখক এবং এর ওপর সাক্ষ্যদাতা সবার ওপর আল্লাহর লানত!
এ সমস্ত বিধানের উদ্দেশ্য কি ছিল? নিছক একটি বিশেষ ধরনের সুদ অর্থাৎ (usury) (মহাজনী সুদ) বন্ধ করে দিয়ে বাদবাকি সব রকমের সুদ চালু রাখা এ বিধানগুলোর উদ্দেশ্য ছিল না। বরং এর আসল উদ্দেশ্য ছিল, পুঁজিবাদী নৈতিকতা ও চরিত্র, পূঁজিবাদী মানসিকতা, পূঁজিবাদী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা এবং পূঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পূর্ণ উচ্ছেদ সাধন করে এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে থাকবে কার্পণ্যের পরিবর্তে বদান্যতা, স্বার্থান্ধতার পরিবর্তে সহানুভ’তি ও পারষ্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা, সুদের পরিবর্তে যাকাত এবং ব্যাংকের পরিবর্তে থাকবে জাতীয় বায়তুলমাল। এ ক্ষেত্রে এমন অবস্থার সৃষ্টিই হবে না যার ফলে কো-অপারেটিভ সোসাইটির ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী ও প্রভিডেন্ড ফান্ড প্রভৃতির প্রয়োজন দেখা দেয় এবং সর্বশেষ কমিউনিজমের প্রকৃতি বিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।
আমাদের নিজেদের নির্বুদ্ধিতা, দুর্বলতা ও দুর্ভাগ্যের কারণে ইসলামে এ নৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। পূঁজিবাদী ব্যবস্থা আমাদের ওপর চেপে বসেছে। যাকাত আদায় ও তা যথার্থ ব্যয় ক্ষেত্রে ব্যয় করার মতো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব আজ বিলুপ্ত। আমাদের ধনিক সমাজ স্বার্থপর ও ইন্দ্রিয়লিপ্সু হয়ে পড়েছে। আমাদের অভাবী ও দরিদ্র সমাজ সহায়-সম্বলহীন। আমরা ইসলামী চরিত্র হারিয়ে ফেলেছি এবং তার সীমানাগুলো ভেঙে ফেলেছি। আমরা মদ পান, জুয়া খেলা ও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছি। বিলাসিতা ও অমিতব্যয়ীতার দোষে আমরা দুষ্ট। অমিতব্যয়ীতার যাবতীয় অনুসঙ্গকে আমরা নিজেদের জীবনের অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত করেছি। সুদী ঋণ ছাড়া বিবাহ, মোটর ক্রয়, গৃহ নির্মাণ এবং সৌন্দর্য, আয়েশ-আরাম ও বিলাস দ্রব্য সম্ভার ক্রয় করা আমাদের জন্য অকল্পনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু পারষ্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার প্রবণতা ও বাস্তব সংগঠন আমাদের মধ্য থেকে উধাও হয়ে গেছে। ফলে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত নড়ে উঠেছে। আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তির জীবন পুরোপুরি তার নিজের আর্থিক উপকরণাদির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এবং ভবিষ্যতকে সংরক্ষিত করে তোলার জন্য সে ইসলামী নীতিসমূহ বর্জন করে পূঁজিবাদী নীতি অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছে। সে ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে বীমা করাতে কোঅপারেটিভ সোসাইটির সদস্য হতে এবং প্রয়োজনের সময় পূঁজিপতিদের নিকট থেকে সুদে ঋণ নিয়ে নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করতে বাধ্য হয়েছে। নি:সন্দেহে আজ এ সবকিছুই আমাদের জন্যে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কিন্তু এসব অবস্থা সৃষ্টি করার জন্য কি ইসলাম দায়ী? যদি ইসলাম দায়ী না হয়ে থাকে এবং আমরা নিশ্চিত রূপে জানি ইসলাম দায়ী নয়, বরং আমাদের আজকের এ দুর্বিসহ অবস্থার জন্যে আমরা নিজেরাই দায়ী। ইসলাম আমাদেরকে এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার শিক্ষা দিয়েছিল তার স্তম্ভগুলোকে আমরা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছি, এ কারণে আমরা অনভিপ্রেত অবস্থার শিকারে পরিণত হয়েছি। এ ক্ষেত্রে ভেবে দেখবার বিষয় ইসলামী আইনের বিরুদ্ধাচারণ করে আমরা নিজেদের জন্য যে সংকট সৃষ্টি করেছি, তা নিরসনের জন্যে ইসলামের আর একটি আইন ভঙ্গ করার পথ অনুসন্ধান করা এবং এ আইনটি অমান্য করার জন্য ইসলামেরই নিকট অনুমতি চাওয়া কতদূর ন্যায়সঙ্গত ও বৈধ বিবেচিত হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, যাকাত ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে কে আমাদেরকে বাধা দিচ্ছে? ইসলামী শিক্ষার মধ্যে পারষ্পরিক সহযোগিতার যে ক্ষেত্র রয়েছে তাকে পরিপুষ্ট করার পথে বাধা কোথায়? ইসলামের মীরাস আইন বাস্তবায়নের পথ কে রুদ্ধ করে দিয়েছে? সরল, অনাড়ম্বর, অমিতব্যয়ী, প্রাচুর্যবিহীন স্বাবলম্বী ও আল্লাহভীরু মুসলমানদের জীবনযাপন করতে আমাদেরকে কে বাধা দিচ্ছে? কে আমাদেরকে নিজের চাদরের চেয়ে পা-টা লম্বা করতে এবং পাশ্চাত্য সমাজ জীবনের ভোগবাদী নীতি অবলম্বনে বাধ্য করেছে? অর্থ উপার্জনের বৈধ পদ্ধতি অবলম্বন না করে বিপুল ধন-ঐশ্বর্যের মালিক হবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে হারাম উপার্জনের পথ অবলম্বন করতে কে আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করছে? আমাদের ধনিক সমাজকে নিজেদের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব এবং জাতির বিধবা, এতিম, অক্ষম পঙ্গু ও অভাবীদেরকে সাহায্য ও সহায়তা দানে অগ্রসর না হয়ে ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানের কারখানা মালিকদেরকে নিজেদের ধন-দৌলত উজাড় করে দিতে কে বাধ্য করছে? আমাদের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সমাজের লেকদেরকে বিয়ে-শাদী ও আনন্দ-শোকানুষ্ঠানে সীমাতিরিক্ত ব্যয় করতে কে বাধ্য করেছে? তাদেরকে ধনীদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে নিজেদের আর্থিক সামর্থের বাইরে ব্যয় বাহুল্য করে অর্থের জৌলুশ দেখাতে এবং নিজেদের এসব অযথা অপব্যয়ের জন্য সুদী ঋণ নিতে কে উদ্বুদ্ধ করেছে? এসব কাজ আমরা স্বেচ্ছায় করেছি। ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলো সুস্পষ্ট অপরাধ। যদি আজ আমরা এসব অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত থাকি এবং পুনর্বার ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত করি তাহলে যে সমস্ত অর্থনৈতিক সংকট আমাদেরকে সুদী লেনদেনের ন্যায় মারাত্মক অপরাধে জড়িত হতে বাধ্য করেছে সেগুলোর হাত থেকে মুক্তি পেতে পারি। কিন্তু যেহেতু এ অপরাধমূলক কাজগুলো থেকে আমরা বিরত থাকতে চাই না, সেহেতু এগুলোর কারণে যে সুদী লেনদেনের অপরাধে আমরা লিপ্ত হয়েছি তার সম্পর্কে আমাদের মনে সুস্পষ্ট অপরাধবোধ জাগ্রত থাকা উচিত নয় কি? যে ব্যক্তি পবিত্র ও হালাল খাদ্য ত্যাগ করে নিজেকে এমন স্থানে পৌঁছিয়ে দিয়েছে যেখানে অপবিত্র ও হারাম খাদ্য ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না, সে পেট ভরে অপবিত্র ও হারাম খাদ্য খেতে পারে এবং অন্যকে খাওয়াতে পারে কিন্তু ঐ অপবিত্র ও হারাম খাদ্যকে পবিত্র ও হালাল বলে জোর গলায় প্রচার চালাতে পারে না।
ইতিপূর্বেই আমরা আলোচনা করেছি যে, সুদী লেনদেনের ব্যাপারটি হচ্ছে পরবর্তী পর্যায়ের ব্যাপার, তার পূর্বে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও পূঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্য থেকে কোনটি আপনি গ্রহণ করবেন সে প্রশ্ন ওঠে। যদি আপনি ইসলামী অর্থব্যবস্থা গ্রহণ করেন তাহলে সেখানে সুদী লেনদেনের প্রয়োজন ও অবকাশ কোনটিই নেই। কারণ সুদী লেনদেনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাহায্য-সহায়তা ছাড়াই ইসলামী অর্থব্যবস্থার সমস্ত কাজ-কারবার চলে। শুধু তাই নয়, বরং সুদী কারবার করে যারা ইসলামী অর্থব্যবস্থার সংগঠন ও শৃংখলায় ব্যাঘাত ঘটাতে চায় ইসলাম তাদেরকে অপরাধী গণ্য করে। এ অবস্থায় আপনাকে পূঁজিবাদী নীতির বিরোধী ইসলামী অর্থব্যবস্থার যাবতীয় বিধান ও নীতি ভঙ্গ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আপনি একদিকে ইসলামী আইনের বিরুদ্ধাচারণ করতে চান অন্যদিকে পূঁজিবাদের অনুগামী হতে চান, আবার এ সংগে ইসলামের দৃষ্টিতে গোনাহগার হতেও চান না – এ সব কিছু মিলিয়ে এ অর্থ দাঁড়ায় যে, আপনি নিজে ইসলামের অনুসারী না হয়ে ইসলামকে আপনার অনুসারী বানাতে চান। কেবলমাত্র আপনাকে ইসলামের গন্ডীর মধ্যে ধরে রাখার জন্যে আপনি ইসলামকে তার নীতি পরিত্যাগ করে পূঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করতে চান।
__________