ইসলামী অর্থব্যবস্থা ও তার মূলনীতি
পুঁজিবাদ ও কমিউনিজমের মধ্যবর্তী পর্যায়ে ইসলাম যে ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক মতাদর্শ অবলম্বন করেছে তার ভিত্তিতে একটি কার্যকর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সে নৈতিক শক্তি ও আইন উভয়ের সাহায্য নিয়েছে। নৈতিক শিক্ষার সাহায্যে সে সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির মন-মানসকে এ ব্যবস্থার স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্য করার জন্য তৈরী করে। অন্যদিকে আইনের বলে তাদের ওপর এমন সব বিধি-নিষেধ আরোপ করে যার ফলে তারা এ ব্যবস্থার চৌহদ্দীর মধ্যে নিজেদেরকে আটকে রাখতে বাধ্য করে এবং এর সুদৃঢ় প্রাচীর ভেদ করতে সক্ষম হয় না। এ নৈতিক বিধি-বিধান ও আইনসমূহ হচ্ছে ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূল স্তম্ভ। এগুলো এবং এই ব্যবস্থার প্রকৃতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করার জন্য এ সবের বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন।
একঃ উপার্জন মাধ্যমে বৈধ-অবৈধের পার্থক্য
এ প্রসঙ্গে প্রথম কথা হচ্ছে, ইসলাম তার অনুসারীদেরকে অর্থ উপার্জন করার অবাধ সুযোগ দেয় না। বরং উপার্জনের পন্থা ও উপায়ের ক্ষেত্রে সামাজিক স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে বৈধ ও অবৈধতার পার্থক্য সৃষ্টি করে। এ পার্থক্যের একটা মূলনীতি রয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, ধন উপার্জনের যেসব পন্থা ও উপায় অবলম্বিত হলে এক ব্যক্তির লাভ ও অন্য ব্যক্তির বা ব্যক্তিবর্গের ক্ষতি হয় তা সবই অবৈধ। অন্যদিকে যেসব উপায় অবলম্বন করলে ধন-উপার্জন প্রচেষ্টার সাথে জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তিই তার ন্যায়সংগত সুফল ভোগ করতে পারে তা সবই বৈধ। এ মূলনীতিটে কুরআন মজীদে নিম্নোক্তভাবে বিবৃত হয়েছেঃ
(আরবী টেক্সট ————————————————————————– আরবী টেক্সট)
“হে ঈমানদার গন! তোমরা পরস্পরের ধন-সম্পদ অবৈধ উপায়ে ভক্ষণ করো না। তবে পারস্পরিক সম্মতি অনুযায়ী ব্যবসায়িক লেনদেন করেতে পারো। আর তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে (অথবা পরস্পর পরস্পরকে) ধ্বংস করো না। আল্লাহ তোমাদের অবস্থার প্রতি করুণাশীল। যে ব্যক্তি সীমা অতিক্রম করে যুলুম সহকারে এরূপ করবে তাকে আমি অগ্নির মধ্যে নিক্ষেপ করবো। -(সূরা আন নিসাঃ ২৯-৩০)
এ আয়াতে পারস্পরিক লেনদেনকে ব্যবসায় বলা হয়েছে। পারস্পরিক সম্মতিকে এর সাথে শর্ত হিসেবে সংযুক্ত করে এমন সব লেনদেনকে অবৈধ গণ্য করা হয়েছে যার মধ্যে চাপ সৃষ্টি ও প্রতারণার কোনো উপকরণ থাকে অথবা এমন কোনা চালবাজী থাকে যা দ্বিতীয় পক্ষ জানতে পারলে এ লেনদেনে নিজের সম্মতি প্রকাশে কোনো দিনই প্রস্তুত হবে না। এরপর আরো জোর দেয়ার জন্য বলা হয়েছে, “তোমরা পরস্পরকে ধ্বংস করো না।” এর দুটি অর্থ হতে পারে। এ দুটি অর্থই এখানে প্রযোজ্য। একটি অর্থ হচ্ছে, তোমরা একে অন্যকে ধ্বংস করো না এবং দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে ধ্বংস করো না। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, যে ব্যক্তি নিজের লাভের জন্য অন্যের সর্বনাশ করে সে যেন তার রক্তপান করে এবং পরিণামে সে এভাবে নিজের ধ্বংসের পথ উন্মুক্ত করে।
এ নীতিগত নির্দেশটি ছাড়াও কুরআনের বিভিন্ন স্থানে অর্থ উপার্জনের নিন্মোক্ত পদ্বতিগুলোকে হারাম গণ্য করা হয়েছেঃ
O উৎকোচ (আল বাকারা ১৮৮ আয়াত)।
O ব্যক্তি সমষ্টি নির্বিশেষে সবার সম্পদ আত্মসাৎ (আল বাকারা ২৮৩ ও আলে ইমরান ১৬১ আয়াত)।
O চুরি (আল মায়েদা ৩৮ আয়াত)।
O এতিমের অর্থ অন্যায়ভাবে তসরুফ (আন নেসা ১০ আয়াত)।
O ওজনে কম করা (আল মুতাফফিফীন ৩ আয়াত)।
O চারিত্রিক নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী উপকরণসমূহের ব্যবসায় (আন নূর ১৯ আয়াত)।
O বেশ্যাবৃত্তি ও দেহ বিক্রয় লব্ধ অর্থ (আন নূর ২, ৩৩ আয়াত)।
O মদ উৎপাদন, মদের ব্যবসায় ও মদ পরিবহন (আলা মায়েদা ৯ আয়াত)।
O জুয়া ও এমন সব উপায়-উপকরণ যেগুলোর মাধ্যমে নিছক ঘটনাচক্রে ও ভাগ্যক্রমে একদল লোকের সম্পদ অন্য একদল লোকের নিকট স্থানান্তরিত হয় (আল মায়েদা ৯০ আয়াত)।
O মূর্তিগড়া, মূর্তি বিক্রয় ও মূর্তি উপাসনালয়ের সেবা (আল মায়েদা ৯০ আয়াত)।
O ভাগ্য গণনা ও জ্যোতিষির ব্যবসায় (আল মায়েদা ৯০ আয়াত)।
O সুদ খাওয়া (আল বাকারা ২৭৫, ২৭৮ থেকে ২৮০ এবং আলে ইমরান ১৩০ আয়াত)।
দুইঃ ধন সঞ্চয়ের নিষেধাজ্ঞা
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ হচ্ছে এই যে, বৈধ উপায়ে যে ধন উপার্জন করা হবে তা পূঞ্জীভূত করে রাখা যাবে না। কারণ এর ফলে ধনের আবর্তন বন্ধ হয়ে যায় এবং ধন-বন্টনে ভারসাম্য থাকে না। যে ব্যক্তি ধন সঞ্চয় করে রাশীকৃত ও পুঞ্জীভূত করে রাখে সে নিজে যে কেবল মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয় তাই নয় বরং মূলত সে সমগ্র মানব সমাজের বিরুদ্ধে একটি জঘন্যতম অপরাধ করে। এর ফল তার নিজের জন্যও খারাপ হয়। এজন্য কুরআন কার্পণ্য এবং কারুনের ন্যায় সম্পদ কুক্ষিগত ও পুঞ্জীভূত করে রাখার কঠোর বিরোধিতা করেছে। কুরআন বলেঃ
(আরবী টেক্সট ————————————————————————- আরবী টেক্সট)
“যারা আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহে কৃপণতা করে, তারা যেন একথা মনে না করে যে, তাদের এ কাজ তাদের জন্য মঙ্গলজনক বরং প্রকৃতপক্ষে এটা তাদের জন্য ক্ষতিকর।” -(সূরা আলে ইমরানঃ ১৮০ আয়াত)
(আরবী টেক্সট ————————————————————————- আরবী টেক্সট)
“যারা স্বর্ণ-রৌপ্য সঞ্চয় করে রাখে এবং আল্লাহ পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও।” – (সূরা আত তাওবাঃ ৩৪)
একথা পুঁজিবাদের ভিত্তিতে আঘাত হানে। উদ্বৃত্ত অর্থ জমা করে রাখা এবং জমাকৃত অর্থ আরো অধিক পরিমাণ অর্থ সংগ্রহে খাটানো — এটাই হচ্ছে পুঁজিবাদের মূল কথা। কিন্তু ইসলাম আদতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমা করে রাখা পছন্দ করে না।
তিনঃ অর্থ ব্যয় করার নির্দেশ
সঞ্চয় করার পরিবর্তে ইসলাম অর্থ ব্যয় করার শিক্ষা দেয়। কিন্তু ব্যয় করার অর্থ বিলাসিতা ও আয়েশ-আরামের জীবনযাপন করে দু’হাতে অর্থ লুটানো নয়। বরং ব্যয় করার ক্ষেত্রে আল্লাহর পথের শর্ত আরোপ করে। অর্থাৎ সমাজের কোনো ব্যক্তির নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকে সমাজের জন্য কল্যাণমূলক কাজে তা ব্যয় করতে হবে। এটিই হবে আল্লাহর পথে ব্যয়।
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করছে যে, তারা কি ব্যয় করবে? তাদেরকে বলে দাও, যা তোমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত (তাই ব্যয় করো)।” – (সূরা আল বাকারা ২১৯ )
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“আর সদ্ব্যবহার করো নিজের মা-বাপ, আত্মীয়-স্বজন, অভাবী-মিসকীন, আত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, নিজের মোলাকাতি বন্ধুবর্গ, মুসাফির ও মালিকানাধীন দাস-দাসীদের সাথে। – (সূরা আন নিসাঃ ৩৬)
(আরবী টেক্সট ————————————————————————– আরবী টেক্সট)
“তাদের অর্থ সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার আছে।” – (সূরা আয যারিয়াতঃ ১৯)
এখানে ইসলাম ও পুঁজিবাদের দৃষ্টিকোণ সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যায়।
বিত্তবান মনে করে, অর্থ ব্যয় করলে দরিদ্র হয়ে যাবে এবং সঞ্চয় করলে বিত্তশালী হবে। কিন্তু ইসলাম বলে, অর্থ ব্যয় করলে কমে যাবে না বরং বরকত ও বৃদ্ধি হবে।
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্রের ভয় দেখায় এবং কার্পণ্যের ন্যায় লজ্জাকর কাজের হুকুম দেয় কিন্তু আল্লাহ তোমাদের নিকট মাগফেরাত ও অতিরিক্ত দানের ওয়াদা করেন।” – ( সূরা আল বাকারাঃ ২৬৮)
বিত্তবান মনে করে কোনো কিছু ব্যয় করা হলে তা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ইসলাম বলে, না, তা নষ্ট হয়ে যায়নি বরং তার সর্বোত্তম লাভ তোমাদের নিকট ফিরে আসবে।
(আরবী টেক্সট —————————————————————————- আরবী টেক্সট)
“সৎকাজে তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে তা তোমরা পুরোপুরি ফেরত পাবে এবং তোমাদের ওপর কোনোক্রমেই যুলুম করা হবে না।” -( সূরা আল বাকারাঃ ২৭২)
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“যারা আমার প্রদত্ত রেজেক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে তারা এমন একটি ব্যবসায়ের আশা রাখে, যাতে কোনাক্রমেই লোকসানের সম্ভবনা নেই। আল্লাহ তাদেরকে এর বিনিময়ে পুরোপুরি ফল প্রদান করবেন বরং মেহেরবানী করে তাদেরকে কিছু বেশী দান করবেন।” – (সূরা আল ফাতিরঃ ২৯-৩০)
বিত্তবান মনে করে, সম্পদ আহরণ করে সুদী ব্যবসায়ে নিয়োগ করলে সম্পদ বেড়ে যায়। কিন্তু ইসলাম বলে, না, সুদের মাধ্যমে বরং সম্পদ কমে যায়। সৎকাজে অর্থ নিয়োগ করলেই সম্পদ বেড়ে যায়।
(আরবী টেক্সট —————————————————————————- আরবী টেক্সট)
“আল্লাহ সুদ নির্মূল করেন ও দান-সাদকাকে প্রতিপালন ও ক্রমবৃদ্ধি করেন”। -(সূরা আল বাকারাঃ ২৭৬)
(আরবী টেক্সট —————————————————————————- আরবী টেক্সট)
“তোমরা এই যে সুদ দাও মানুষের ধন-সম্পদ বৃদ্ধির আশায়, জেনে রাখো, আল্লাহর নিকট তা কখনো বৃদ্ধি লাভ করে না। তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যাকাত বাবদ যে অর্থ দান করে থাকো একমাত্র তার মধ্যেই ক্রমবৃদ্ধি হয়ে থাকে।” -সূরা আর রূমঃ৩৯)
পুঁজিবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী এটি আর একটি নতুন মতবাদ। ব্যয় করলে অর্থ বেড়ে যাবে এবং ব্যয়িত অর্থ কেবল নষ্টই হবে না বরং কিছুটা অতিরিক্ত লাভ ও কল্যাণসহ পূর্ণ মাত্রায় ফিরে আসবে, অন্যদিকে সুদী ব্যবসায় অর্থ বৃদ্ধির পরিবর্তে অর্থ হ্রাস ও লোকসানের সূচনা করবে এবং যাকাত ও সাদকার মাধ্যমে অর্থ হ্রাসের পরিবর্তে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হবে – এ মতবাদটি আপাত দৃষ্টিতে অদ্ভূত ও বিস্ময়কর মনে হবে। শ্রোতা মনে করে সম্ভবত এগুলো নিছক আখেরাতের সওয়াবের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাপার। নিসন্দেহে আখেরাতের সওয়াবের সাথে এসব কথার সম্পর্ক রয়েছে এবং ইসলামের দৃষ্টিতে এটিই আসল গুরুত্বের অধিকারী। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, এ দুনিয়াতেও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এ মতাদর্শটি একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ধন সঞ্চয় করে সুদী ব্যবসায়ে নিয়োগ করার অবশ্যম্ভাবী ফল স্বরূপ চতুর্দিক থেকে ধন আহরিত হয়ে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে চলে আসবে। সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতা প্রতিদিন কমে যেতে থাকবে। কৃষি, শিল্প ও ব্যবসায় সর্বত্র মন্দাভাব দেখা দেবে। জাতীয় অর্থনৈতিক জীবন ধ্বংসের শেষ সীমায় পৌছে যাবে। অবশেষে এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে যার ফলে পুঁজিপতিরাও নিজেদের সঞ্চিত ধন-সম্পদ অর্থ উপার্জনের কাজে লাগাবার সুযোগ পাবে না।১
[টিকা ১. রসুলে করীম (স) নিম্নোক্ত হাদিসটিতে একথার প্রতি ইংগিত করেছেনঃ
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
অর্থাৎ “সুদের পরিমান যত বেশিই হোক না কেন অবশেষে তা কম হতে বাধ্য।”
বিপরীত পক্ষে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করলে এবং যাকাত ও সদকা দান করলে পরিণামে জাতির সকল ব্যক্তির হাতে এ সম্পদ ছড়িয়ে পড়ে, প্রত্যেক ব্যক্তি যথেষ্ট ক্রয়-ক্ষমতার অধিকারী হয়, শিল্পোৎপাদন বেড়ে যায়, সবুজ ক্ষেতগুলো শস্যে ভরে ওঠে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়, হয় তো কেউ লাখপতি-কোটিপতি হয় না কিন্তু সবার অবস্থা সচ্ছল হয় এবং পরিবারই হয় সমৃদ্ধশালী। এ শুভ পরিনাম সম্পন্ন অর্থনৈতিক মতাদর্শটির সত্যতা যাঁচাই করতে হলে আমেরিকার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে।২
[টিকা – ২. এ গ্রন্থ প্রণয়নের সময় আমেরিকাতে যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দাভাব দেখা দিয়েছিল সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।]
সুদ ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থার কারনে সেখানে ধন বন্টনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে এবং শিল্প ও বাণিজ্যের মন্দাভাব জাতির অর্থনৈতিক জীবনকে ধ্বংসের প্রান্তসীমায় পৌঁছে দিয়েছে। এর তুলনায় ইসলামী যুগের প্রথম দিকের অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যখন সেখানে পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠিত করা হয় তখন মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে জাতীয় সচ্ছলতা ও সমৃদ্ধি এমন পর্যায় পৌছে যায় যার ফলে লোকেরা যাকাত গ্রহীতাদেরকে খুঁজে বেড়াতো কিন্তু কোথাও তাদের সন্ধান পাওয়া যেত না। এমন একজন লোকের সন্ধান পাওয়া যেত না যে, নিজেই যাকাত দেয়ার যোগ্যতা ও ক্ষমতা অর্জন করেনি। এ দু’টি অবস্থাকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করলে আল্লাহ সুদকে কিভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং সাদকাকে ক্রমোন্নতি ও ক্রমবৃদ্ধি দান করেন তা দ্ব্যর্থহীনভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে।
ইসলাম পুঁজিবাদী মানসিকতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর এক মানসিকতা সৃষ্টি করে। পুঁজিপতি একথা কল্পনাই করতে পারে না যে, সুদ ছাড়া এক ব্যক্তি তার অর্থ সম্পদ আর এক ব্যক্তিকে কেমন করে দিতে পারে। সে অর্থ ঋণ দিয়ে তার বিনিময়ে কেবল সুদই আদায় করে না, বরং নিজের মূলধন ও তার সুদ আদায় করার জন্য ঋণগ্রহীতার বস্ত্র ও গৃহের আসবাবপত্রাদি পর্যন্ত ক্রোক করে নেয়। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, অভাবীকে কেবল ঋণ দিলে হবেনা বরং তার আর্থিক অনটন যদি বেশি থাকে তাহলে তার নিকট কড়া তাগাদা করা যাবেনা, এমনকি ঋণ আদায়ের ক্ষমতা না থাকলে তাকে মাফ করে দিতে হবে।
(আরবী টেক্সট —————————————————————————- আরবী টেক্সট)
“ঋণ গ্রহীতা যদি অত্যধিক অনটন পীড়িত হয় তাহলে তার অবস্থা স্বচ্ছল না হওয়া পর্যন্ত তাকে সুযোগ দাও আর যদি তাকে মাফ করে দাও তাহলে তা হবে তোমাদের জন্য উত্তম। যদি তোমরা কিছু জ্ঞান রাখতে, তাহলে এর কল্যাণকারিতা উপলব্ধি করতে পারতে।” – (সুরা বাকারা: ২৮০)
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পারস্পরিক সাহায্যের অর্থ হচ্ছে এই যে, প্রথমে পারস্পরিক সাহায্য সমিতির তহবিলে অর্থ দাখিল করে আপনাকে তার সদস্য হতে হবে, তারপর আপনার যদি কখনো অর্থের প্রয়োজন হয়, তাহলে সমিতি বাজারে প্রচলিত সাধারন সুদের হারের তুলনায় কিছু কম হারে আপনাকে সুদী ঋণ দেবে। যদি আপনার কাছে অর্থ না থাকে তাহলে পারস্পরিক সাহায্য সমিতি থেকে আপনি কোনই সাহায্য পেতে পারেন না। বিপরীত পক্ষে ইসলাম যে পারস্পরিক সাহায্যের পরিকল্পনা রাখে তা হচ্ছে এই যে, অর্থ ও সামর্থবান লোকেরা প্রয়োজনের সময় কেবল তাদের কম সামর্থবান ভাইদেরকে ঋণ দেবেনা বরং তাদের ঋণ আদায় করার ব্যাপারেও সামর্থ অনুযায়ে তাদেরকে সাহায্য করবে। তাই ‘আলগারেমীনা’ অর্থাৎ ঋণগ্রস্তদের ঋণ আদায় করে দেয়াকেও যাকাতের অন্যতম ব্যয় ক্ষেত্র হিসাবে গণ্য করা হয়েছে।
পুঁজিপতি কখনো সৎপথে কোনো অর্থ ব্যয় করলে নেহাত লোক দেখানোর উদ্দেশ্যেই তা করে থাকে। কারন এ সংকীর্ণচেতা ব্যক্তি মনে করে যে, এ অর্থ ব্যয়ের বিনিময়ে কমপক্ষে সুনাম ও সুখ্যাতি তার অবশ্যই প্রাপ্য। কিন্তু ইসলাম বলে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় করা উচিত নয় এবং প্রকাশ্যে বা গোপনে যা-ই ব্যয় করা হোক না কেন অবিলম্বে কোনো না কোনো আকারে এর প্রতিদান পাওয়া যাবে এ ধরনের কোনো উদ্দেশ্য এর পিছনে যেন না থাকে। বরং কাজের পরিণতির প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে। এ দুনিয়া থেকে আখেরাত পর্যন্ত যতদুর দৃষ্টি প্রসারিত করা যাবে সর্বত্রই দেখা যাবে এ ব্যয়িত অর্থ সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং একের পর এক মুনাফা দিয়েই চলছে।
“যে ব্যক্তি লোক দেখাবার উদ্দেশ্যে নিজের অর্থ ব্যয় করে তার এ কাজকে এমন একটি প্রস্তর খন্ডের সাথে তুলনা করা যেতে পারে যার উপর ছিল মাটির আস্তরণ, সে এ মাটির মধ্যে বীজ বপন করেছিল কিন্তু পানির একটি প্রবাহ আসলো এবং সমস্ত মাটি ধুয়ে নিয়ে চলে গেল। আর যে ব্যক্তি নিজের নিয়ত ঠিক রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় করে তার এ কাজকে এমন একটি উৎকৃষ্ট জমির সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যেখানে একটি উদ্যান রচনা করা হয়েছে, বৃষ্টি হলে সেখানে দ্বিগুন ফল উৎপন্ন হয় আর বৃষ্টি না হলে নিছক ছোটখাটো একটি স্রোতধারা তার জন্য যথেষ্ট।” – (সুরা আল বাকারা: ৩৬ রুকু)
(আরবী টেক্সট ————————————————————————– আরবী টেক্সট)
“যদি প্রকাশ্যে সাদকা দাও তাও ভালো কিন্তু যদি গোপনে দাও এবং দরিদ্রদের নিকট পৌঁছিয়ে দাও, তাহলে এটিই উত্তম হবে।” – (সুরা আল বাকারা: ২৭১)
পুঁজিপতি যদি কখনো সৎকাজে কোনো অর্থ ব্যয় করে তাহলে তার পিছনে তার হৃদয়িক আবেগ ও সদিচ্ছা থাকে না বরং অনিচ্ছাকৃতভাবেই করে থাকে এবং এজন্য সে সবচেয়ে নিকৃষ্টমানের সম্পদ ব্যয় করে, তারপর নিজের শাণিত বাক্যবাণে বিদ্ধ করে অর্থ গ্রহীতার অর্ধেক প্রাণ বের করে নেয়। বিপরীত পক্ষে ইসলাম সবচেয়ে ভালো সম্পদ ব্যয় করার এবং ব্যয় করার পর নিজের অনুগ্রহ প্রকাশ না করা এমন কি প্রতিদানে কেউ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে এ আশাও পোষণ না করার শিক্ষা দেয়।
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“তোমরা যাকিছু উপার্জন করেছ আর যাকিছু আমি জমি থেকে তোমাদের জন্য বের করেছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করো, যেন বাছাই করে নিকৃষ্টতর বস্তু ব্যয় করো না।” – (সুরা আল বাকারা: ২৬৭)
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“অনুগ্রহ প্রকাশ করে ও কষ্ট দিয়ে তোমাদের সদকাসমূহ ধ্বংস করো না।” – (সুরা আল বাকারা: ২৬৪)
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“আর তারা আল্লাহর প্রতি ভালবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মিসকিন, এতিম ও কয়েদীকে আহার করায় এবং বলে, আমরা তোমাদেরকে খাওয়াচ্ছি আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে, (এজন্য) আমরা তোমাদের নিকট থেকে কোনো প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রত্যাশী নই।” – (সুরা দাহর : ৮-৯)
নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ দু’টি মানসিকতার মধ্যে যে বিপুল ব্যবধান দেখা যাচ্ছে এ প্রশ্ন না হয় বাদই দিলাম। তবুও আমার বক্তব্য হচ্ছে, নিছক অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলেও কল্যাণ ও ক্ষতির এ দু’টি মতাদর্শের মধ্যে কোনটি অধিক শক্তিশালী, নিরেট ও সুদূরপ্রসারী ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকতর নির্ভুল। অতপর কল্যাণ ও ক্ষতি প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে আমি ইসলামের যে আদর্শ তুলে ধরেছি সেসব সামনে রেখে ইসলাম কোনো অবস্থায় সুদী কারবারকে বৈধ গণ্য করতে পারে, একথা চিন্তা করার কোনো অবকাশ আছে কি?
চার: যাকাত
ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলাম যে দৃষ্টিভঙ্গী পেশ করেছে তার সারমর্ম হচ্ছে এই যে, ধন একস্থানে পুঞ্জিভূত ও জমাটবদ্ধ হয়ে থাকতে পারবে না; ইসলামী সমাজের যে কয়জন লোক তাদের উচ্চতর যোগ্যতা ও সৌভাগ্যের কারনে নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন-সম্পদ আহরন করেছে ইসলাম চায় তারা যেন এ সম্পদ পুঞ্জিভূত করে না রাখে বরং এগুলো ব্যয় করে এবং এমন সব ক্ষেত্রে ব্যয় করে যেখান থেকে ধনের আবর্তনের ফলে সমাজের স্বল্পবিত্ত ভোগীরাও যথেষ্ট অংশ লাভ করতে সক্ষম হবে। এ উদ্দেশ্যে ইসলাম একদিকে উন্নত নৈতিক শিক্ষা প্রদান এবং উৎসাহ দান ও ভীতি প্রদর্শনের শক্তিশালী অস্ত্র প্রয়োগ করে দানশীলতা ও যথার্থ পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার প্রবণতা সৃষ্টি করে। এভাবে লোকেরা নিজেদের মনের স্বাভাবিক ইচ্ছা-আকাংখা অনুযায়ী ধন-সম্পদ সঞ্চয় করাকে খারাপ জানবে এবং তা ব্যয় করতে উৎসাহী ও আগ্রহী হবে। অন্যদিকে ইসলাম এমন সব আইন প্রণয়ন করে, যার ফলে বদান্যতার এ শিক্ষা সত্ত্বেও নিজেদের অসৎ মনোবৃত্তির কারনে যেসব লোক সম্পদ আহরণ করতে ও পুঞ্জিভূত করে রাখতে অভ্যস্ত হয় অথবা যাদের নিকট কোনো না কোনভাবে সম্পদ সঞ্চিত হয়ে যায়, তাদের সম্পদ থেকে সমাজের কল্যাণ ও উন্নতি বিধানার্থে কমপক্ষে একটি অংশ অবশ্যই কেটে নেয়া হবে। একেই যাকাত বলা হয়। ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এ যাকাতকে অত্যধিক গুরুত্ব দান করা হয়েছে, এমনকি একে ইসলামের একটি মূল স্তম্ভের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নামাজের পরে এ যাকাতের ওপরই সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে এবং দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করা হয়েছে: যে ব্যক্তি অর্থ-সম্পদ সঞ্চয় করে, যাকাত না দেয়া পর্যন্ত তার ঐ সম্পদ হালাল হতে পারে না।
(আরবী টেক্সট ————————————————————————- আরবী টেক্সট)
“(হে নবী!) তাদের ধন-সম্পদ থেকে একটি সাদকা গ্রহণ করো, যা ঐ ধন-সম্পদকে পাক-পবিত্র ও হালাল করে দেবে।” – (সুরা তাওবা: ১০৩)
এখানে ‘একটি সাদকা’ শব্দটি থেকে সাদকার একটি বিশেষ পরিমান বুঝা যায়। এ সঙ্গে রসূলে করীম (স)-কে এটি আদায় করার নির্দেশ দেয়ার ফলে একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সাধারণ স্বেচ্ছা প্রদত্ত সাদকা থেকে আলাদা এটি একটি ওয়াজিব ও ফরজ সাদকা অর্থাৎ যাকাত এবং বিত্তশালী লোকদের নিকট থেকে এ সাদকাটি অবশ্যই আদায় করতে হবে। কাজেই এ নির্দেশ অনুযায়ী রসূলে করীম (স) বিভিন্ন প্রকার সম্পদের জন্য নেসাবের ( যে সর্বনিম্ন পরিমানের ওপর যাকাত অপরিহার্য) একটি পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন। অতপর নেসাব পরিমাণ বা তদুর্ধ বিভিন্ন প্রকার সম্পদের উপর যাকাতের বিভিন্ন হার নির্ধারণ করেছেন সোনা, রূপা ও নগদ টাকা-পয়সার ওপর শতকরা আড়াই ভাগ এবং কৃষি উৎপাদনের ওপর সেচ ব্যবস্থার আওতাধীন জমি হলে শতকরা ৫ ভাগ ও সেচ ব্যবস্থার আওতা বহির্ভূত জমি হলে শতকরা ১০ ভাগ, ব্যবসায় পণ্যের উপর শতকরা আড়াই ভাগ, খনিজ দ্রব্যাদি (নিজস্ব মালিকানাধীন) ও গুপ্ত ধনের উপর শতকরা ২০ ভাগ যাকাত ধার্য করেছেন। এভাবে ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত গবাদি পশু প্রভৃতি চতুস্পদ প্রাণীর ওপর বিভিন্ন হারে যাকাত ধার্য করেছেন।
আয়াতের শেষ শব্দটি থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, বিত্তশালী ব্যক্তির নিকট যে অর্থ সম্পদ সঞ্চিত হয় ইসলামের দৃষ্টিতে তা অপবিত্র এবং তার মালিক তা থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে একটি বিশেষ পরিমাণ আল্লাহর পথে ব্যয় না করা পর্যন্ত তা পবিত্র হতে পারে না। ‘আল্লাহর পথে’ শব্দটির অর্থ কি? আল্লাহ কারোর মুখাপেক্ষী নন। তাঁর অর্থ-সম্পদের প্রয়োজন নেই, তিনি অভাবীও নন। কাজেই তাঁর পথ বলে একথাই বুঝানো হয়েছে যে, বিত্তশালীদের সম্পদ ব্যয় করে জাতির দরিদ্র ও অভাবী লোকদেরকে সচ্ছল করার চেষ্টা করতে হবে এবং এমন সব কল্যানমূলক কাজে এ সম্পদ নিয়োগ করতে হবে- যা থেকে সমগ্র জাতি লাভবান হতে পারবে।
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“মূলত সাদকা-যাকাত হচ্ছে ফকির¬¬¬¬¬১ ও মিককিনদের২ জন্য এবং তাদের জন্য যাদেরকে সাদকা আদায়ের কাজে নিযুক্ত করা হয়,তাদের জন্য যাদের হৃদয়কে শক্তিশালী করার প্রয়োজন হয়৩,লোকদেরকে বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য,ঋণগ্রস্তদের ঋণমুক্ত করার জন্য আল্লাহর পথে ব্যয় করার জন্য এবং মুসাফিরদের ৪ জন্য।” (সূরা আত তাওবাঃ ৬০)
[টিকা:১.ফকির এমন সব লোকদেরকে বলা হয় যারা নিজেদের প্রয়োজনের চেয়ে কম অন্ন সংস্থান করার কারণে অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী।-(লিসানুন আবর)
টিকা:২.মিসকিনের সংজ্ঞা বর্ণনা করে হযরত ওমর (রা) বলেছেন: যারা অর্থ উপার্জন করতে পারে না অথবা অর্থ উপার্জনের সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত। এ সংজ্ঞার প্রেক্ষিতে যে দরিদ্র শিশু এখনো অর্থ উপার্জনের যোগ্যতা রাখে না এবং যেসব বেকার ও রুগ্নব্যক্তি সাময়িকভাবে উপার্জনের যোগ্যতা বঞ্চিত তারা সবাই মিসকিন।
টিকা:৩.এ দলের অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে এমন সব নও-মুসলিম যারা কুফর থেকে ইসলামে প্রবেশ করার কারণে সংকটে জর্জরিত।
টিকা:৪.মুসাফির ব্যক্তির গৃহে সম্পদের প্রাচুর্য থাকলেও সফর অবস্থায় অর্থ সংকটে পড়লে অবশ্যই যাকাত গ্রহণের হকদার।]
এটিই মুসলমানদের কো-অপারেটিভ সোসাইটি, তাদের ইনস্যুরেন্স কোম্পানী এবং প্রভিডেন্ট ফান্ডও। এখান থেকেই মুসলিম সমাজের বেকারদেরকে সাহায্য করা হয়। তাদের অক্ষম,বিকলাংগ,রুগ্ন,এতিম,বিধবা ও কর্মহীনদেরকে এ ব্যবস্থার মাধ্যমেই প্রতিপালন করা হয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই যে,এ বস্তুটি মুসলমানদেরকে ভবিষ্যৎ অন্ন সংস্থানের চিন্তা থেকে সম্পুর্ণরূপে মুক্ত করে। এর সহজ-সরল নীতি হচ্ছে,আজ এক ব্যক্তি বিত্তবান কাজেই সে অন্যকে সাহায্য করবে,আগামীকাল যখন সে অভাবী হয়ে পড়বে তখন অন্যরা তাকে সাহায্য করবে। দরিদ্র হয়ে পড়লে আমার অবস্থা কি হবে,একথা চিন্তা করার আমার কোনো প্রয়োজন নেই। মরে গেলে স্ত্রী ও ছেলে-পেলেদের কি অবস্থা হবে? কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনার কবলে পড়লে,পীড়িত হয়ে পড়লে ঘর-বাড়ীতে আগুন লেগে গেলে, বন্যা কবলিত হয়ে পড়লে, দেউলিয়া হয়ে গেলে তখন কি অবস্থা দাঁড়াবে এবং এসব বিপদের হাত থেকে উদ্ধারের কি উপায় হবে-এসব চিন্তা করার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। সফর অবস্থায় টাকা-পয়সা শেষ হয়ে গেলে জীবিকা নির্বাহের কি উপায় হবে? একমাত্র যাকাত ব্যবস্থাই এ সমস্ত চিন্তা থেকে মানুষকে চিরন্তন মুক্তি দান করে। এ ক্ষেত্রে ইসলামী সমাজের একজন সদস্যের কাজ কেবল এতটুকুই থাকে যে, সে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ- সম্পদের একটি অংশ আল্লাহর ইনস্যুরেন্স কোম্পানীতে জমা দিয়ে বীমা করে নেবে। প্রকৃতপক্ষে এ সময় এ অর্থের তার কোনো প্রয়োজন নেই। এ অর্থ এখন যাদের প্রকৃত প্রয়োজন তাদের কাজে লাগবে। কাল যখন তার বা তার সন্তান-সন্ততিদের প্রয়োজন দেখা দেবে তখন কেবল তার নিজের প্রদত্ত সম্পদই নয় বরং তার চাইতে অনেক বেশী সম্পদ ফেরত পাবে।
এখানে আবার দেখা যায়, পুঁজিবাদ ও ইসলামের নীতি ও পদ্ধতির মধ্যে পরিপূর্ন বৈপরীত্য। পুঁজিবাদের দাবী হচ্ছে, অর্থ সঞ্চয় করতে হবে এবং তার পরিমাণ বাড়াবার জন্য সুদ নিতে হবে। যার ফলে এ নালা দিয়ে গড়িয়ে আশে-পাশের লোকদের সবার টাকা-পয়সা এ পুকুরে এসে পড়বে। বিপরীত পক্ষে ইসলাম নির্দেশ দেয়, প্রথমত টাকা-পয়সা জমা করে বা আটকে রাখা যাবে না আর যদি কখনো জমা হয়ে যায় তাহলে এ পুকুর থেকে নালা কেটে দিতে হবে,যাতে শুকিয়ে যাওয়া ক্ষেতগুলোতে পানি পৌঁছে যায় এবং আশেপাশের সমস্ত জমি তরতাজা ও সবুজে শ্যামলে ভরে উঠে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ধন আবদ্ধ ও জমাটবদ্ধ হয়ে থাকে কিন্তু ইসলামী ব্যবস্থায় তা মুক্ত, স্বাধীন ও অবাধ গতিশীল। পুঁজিবাদের পুকুর থেকে পানি নিতে হলে প্রথমে আপনার পানি সেখানে অবশ্যই থাকতে হবে, নয় তো এক কাতরা পানি আপনি সেখান থেকে পেতে পারেন না। কিন্তু ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার পুকুরের নিয়ম হচ্ছে এই যে, যার নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি থাকবে সে তার বাড়তি পানি ঐ পুকুরে ঢেলে দিয়ে যাবে এবং যার পানির প্রয়োজন হবে সে ওখান থেকে নিয়ে যাবে। বলাবাহুল্য মৌলিকত্ব ও স্বভাব-প্রকৃতির দিক দিয়ে এ দুই বিপরীতধর্মী মতাদর্শকে একত্রিত করা কোনো ক্রমেই সম্ভবপর নয়। কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি এ ধরনের বিপরীতধর্মী মতাদর্শের একত্র সমাবেশের কথা কল্পনাই করতে পারে না।
পাঁচঃ মীরাসী আইন
নিজের ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রয়োজনের অর্থ ব্যয়, আল্লাহর পথে ব্যয় ও যাকাত আদায় করার পরও যে অর্থ-সম্পদ কোনো একস্থানে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাবে তাকে বিকেন্দ্রীভূত করার জন্য ইসলাম আর একটি পন্থা অবলম্বন করেছে। একে বলা হয় মীরাসী আইন। এ আইনটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে ব্যক্তি অর্থ-সম্পদ রেখে মৃত্যুবরণ করবে তা যতো কম বা বেশী হোক না কেন, তা কেটে টুকরো টুকরো করা হবে এবং নিকট-দূরের সকল আত্মীয়ের মধ্যে ক্রমানুসারে বন্টন করা হবে। যদি এমন কোনো ব্যক্তি থাকে, যার কোনো ওয়ারিস নেই তাহলে তাকে পোষ্যপুত্র গ্রহণ করার অধিকার দানের পরিবর্তের তার সম্পদ মুসলমানদের বায়তুলমালে জমা করে দিতে হবে। তাহলে সমগ্র জাতি এ থেকে লাভবান হতে পারবে। মীরাস বণ্টনের এ আইনের অস্তিত্ব একমাত্র ইসলামেই দেখা যায়, অন্য কোনো অর্থব্যবস্থায় এর অস্তিত্ব নেই। অন্যান্য অর্থব্যবস্থা এ ব্যাপারে যে নীতি নির্ধারণ করেছে তা হচ্ছে, এক ব্যক্তি যে অর্থ সঞ্চিত করে রেখে যায় তার মৃত্যুর পর তা এক বা একাধিক ব্যক্তির নিকট কেন্দ্রীভূত থাকে।১ কিন্তু ইসলাম অর্থ কেন্দ্রীভুত করার পরিবর্তে তার বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষপাতি, এর ফলে অর্থের আবর্তন সহজতর হয়।
[টিকা:১. জ্যেষ্ঠ পুত্রের স্থলাভিষেক (Primogeniture) এবং একান্নবর্তী পরিবার (Joint Family System) প্রথা এ নীতির উপরই প্রতিষ্ঠিত।]
ছয়: গনীমত লব্ধ সম্পদ ও বিজিত সম্পত্তি বণ্টন
এ ক্ষেত্রেও ইসলাম একই দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী। যুদ্ধে সেনাবাহিনী যে গনীমতের অর্থ (শত্রুপক্ষের পরিত্যক্ত সম্পদ) হস্তগত করে সে সম্পর্কে ইসলাম একটি বিশিষ্ট আইন প্রণয়ন করেছে। এ অর্থ-সম্পদ পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়। চারভাগ সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয় এবং অবিশিষ্ট এক ভাগ সাধারণ জাতীয় কল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করার জন্য রেখে দেয়া হয়।
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“জেনে রাখো, গনীমত হিসেবে তোমরা যাকিছু হস্তগত করো তার এক পঞ্চমাংশ হচ্ছে আল্লাহ, তার রাসূল, রাসূলের নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকিন ও মুসাফিরদের জন্য।” – (সূরা আল আনফাল: ৪১)
আল্লাহ ও রসূলের অংশ বলে এমন সব কাজকে বুঝানো হয়েছে যেগুলো আল্লাহ ও রসূলের নির্দেশের আওতাধীন ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীনে দেয়া হয়েছে।
যাকাতে রসূলের নিকটাত্মীয়দের কোন অংশ ছিল না বলে এখানে তাদের অংশ রাখা হয়েছে।
অতপর এ পঞ্চমাংশে আরো তিন শ্রেণীর অংশ বিশেষভাবে রক্ষিত হয়েছে। জাতির এতিম শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করা এবং তাদেরকে জীবন সংগ্রামের অংশ নেয়ার যোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য এতে তাদের অংশ রক্ষিত হয়েছে। মিসকিনদের অংশ রাখা হয়েছে-বিধবা মহিলা, বিকলাঙ্গ, অক্ষম, রুগ্ন ও অভাবী প্রভৃতি যার অন্তর্ভুক্ত। আর রাখা হয়েছে ইবনুস সাবীল অর্থাৎ মুসাফিদের অংশ। নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে ইসলাম মুসলামানদের মধ্যে মুসাফিরকে আপ্যায়ন করার প্রবণতা সৃষ্টি করেছে। এ সঙ্গে যাকাত, সাদকা ও যুদ্ধলব্ধ গনীমতের সম্পদেও তার অংশ রেখেছে। এ ব্যবস্থার কারণে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা-বানিজ্য, ভ্রমণ-পর্যটন, শিক্ষা-অধ্যয়ন, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাবলী পরিদর্শন ও অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য যাতায়াত সহজতর হয়েছে।
যুদ্ধের ফলে ইসলামী রাষ্ট্র যেসব সম্পদ-সম্পত্তির মালিক হয় ইসলাম সেগুলোকে সম্পূর্ণরূপে ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীন রাখার বিধান দিয়েছে।
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“জনপদের অধিবাসীদের নিকট থেকে আল্লাহ, ‘ফায়’ (বিনা যুদ্ধে শত্রুপক্ষের যেসব সম্পদ হস্তগত হয়) হিসেবে যা কিছু দান করেছেন তা আল্লাহ, তার রাসূল, রসূলের নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকিন ও মুসাফিরদের জন্য, যাতে এগুলো কেবলমাত্র তোমাদের ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়। ……..আর এর মধ্যে অভাবী মুহাজিরদেরও অংশ রয়েছে, যাদেরকে নিজেদের ঘর-বাড়ী ও সহায় সম্পদ থেকে বেদখল করে নির্বাসিত করা হয়েছে। ……..আর তাদের অংশ রয়েছে যারা মুহাজিরদের আসার আগে মদীনায় ঈমান এনেছিল। …….আর তাদের ভবিষ্যত আগমনকারী বংশধরদেরও অংশ রয়েছে।” -(সুরা আল হাশর:৭-১০)
এ আয়াতগুলোতে কেবলমাত্র ‘ফায়’ লব্ধ অর্থের ব্যয় ক্ষেত্রগুলোর বিশদ বর্ণনা করা হয়নি বরং এই সঙ্গে যে উদ্দেশ্যে ইসলাম ফায়লব্ধ অর্থ-সম্পদ বণ্টন তথা সমগ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালনা করেছে সেদিকেও সুস্পষ্ট ইংগিত করা হয়েছে। অর্থাৎ অর্থ-সম্পদ যেন কেবলমাত্র তোমাদের ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়। কুরআন মজীদ ছোট একটি বাক্যের মধ্যে যে বিষয়বস্তু বর্ণনা করেছে সেটিই হচ্ছে সমগ্র ইসলামী অর্থব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর।
সাতঃ মিতব্যয়ীতার নির্দেশ
ইসলাম একদিকে ধন-সম্পদ সমগ্র দেশবাসীর মধ্যে আবর্তন করার ও ধনীদের সম্পদ থেকে নির্ধনদের অংশ লাভ করার ব্যবস্থা করেছে, অন্যদিকে প্রত্যেক ব্যক্তিকে অর্থ ও সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হবার নির্দেশ দিয়েছে। এভাবে অর্থনৈতিক উপায়-উপকরণ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ব্যক্তি কখনো প্রান্তিকতার আশ্রয় নিয়ে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করবে না। এ ক্ষেত্রে কুরআনের মৌলিক শিক্ষা হচ্ছেঃ
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“আর নিজের হাত না একেবারে গলায় বেঁধে রাখো আর না একেবারে তাকে খুলে দাও, যার ফলে পরবর্তীকালে আক্ষেপ করে বসে থাকার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়।”-(সূরা বনী ইসরাঈলঃ ২৯)
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“আর আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দারা যখন ব্যয় করে,অমিতব্যয় করে না আবার কার্পণ্যও করবে না বরং এ দুটির মধ্যবর্তী ভারসাম্যপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করে।”-(সূরা আল ফুরকানঃ৬৭)
এ শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রত্যেক ব্যক্তি যেন নিজের আর্থিক সঙ্গতির মধ্যে থেকেই অর্থ ব্যয় করে। তার অর্থ ব্যয় যেন কখনো এমন পর্যায়ে না পৌঁছায় যার ফলে তা তার আয়ের অংককে ছাড়িয়ে যায় এবং নিজের আজেবাজে খরচের জন্য তাকে অন্যের দ্বারে হাত পাততে হয় অথবা অন্যের উপার্জনে ভাগ বসাতে হয় এবং যাথার্থ প্রয়োজন ছাড়াই অন্যের নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। অতপর গায়ের জোরে সে ঋণদাতাকে কাঁচকলা দেখিয়ে ফিরবে অথবা ঋণ আদায় করার জন্য নিজের সব রকমের অর্থনৈতিক উপকরণ ব্যবহার করে অবশেষে ফতুর হয়ে ফকির ও মিসকিনদের খাতায় নিজের নাম লেখাবে। আবার সে যেন নিজের অর্থনৈতিক সামর্থের তুলনায় অনেক কম খরচ করার মতো কার্পণ্যও না দেখায়। নিজের আয় ও অর্থনৈতিক উপায়-উপকরণের সীমার মধ্যে থেকে ব্যয় করার অর্থ এ নয় যে, সে ভালো আয়-উপার্জন করলে নিজের সব টাকা-পয়সা কেবলমাত্র ব্যক্তিগত আয়েশ-আরাম ও ভোগ বিলাসীতায় উড়িয়ে দেবে আর অন্যদিকে তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীরা চরম সংকটের মধ্যে দিন যাপন করবে। এ ধরনের স্বার্থান্ধ ব্যয় বাহুল্যকে ইসলাম অমিতব্যয়িতার মধ্যে গন্য করেছে।
(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)
“নিজের নিকটাত্মীয়কে তার অধিকার পৌছিয়ে দাও এবং মিসকিন ও মুসাফিরদেরকেও তাদের অধিকার দান করো। বাজে খরচ করো না। যারা অযথা ও বাজে খরচ করে তারা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রব-প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ না-ফরমান।” -(সূরা বনী ইসরাঈলঃ ২৬-২৭)
ইসলাম এ ক্ষেত্রে কেবলমাত্র নৈতিক শিক্ষা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বরং এ সঙ্গে কার্পণ্য ও অমিতব্যয়িতার চূড়ান্ত অবস্থা প্রতিরোধের জন্য আইনও প্রণয়ন করেছে। ধন বণ্টনের ভারসাম্য বিনষ্টকারী সমস্ত পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। জুয়াকে হারাম ঘোষণা করেছে। মদ্যপান ও ব্যভিচারের পথ রোধ করেছে। অনর্থক ফুর্তিবাজী, তামাশা ও কৌতুকের এমন ব্যয়বহুল অভ্যাস নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, যেগুলোর অনিবার্য পরিণতি অর্থ ও সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। সঙ্গীতের স্বাভাবিক প্রবণতাকে এমন পর্যায়ে উপনীত হতে দেয়নি যেখানে সঙ্গীত প্রিয়তা ও সঙ্গীতের মধ্যে ঐকান্তিক মগ্নতা মানুষের মধ্যে বহুবিধ নৈতিক ও আত্মিক ত্রুটি সৃষ্টির সাথে সাথে তার অর্থনৈতিক জীবনেও বিপর্যয় ও বিশৃংখলা সৃষ্টির কারণ হয়। সৌন্দর্য পিপাসার স্বাভাবিক প্রবণতাকেও একটি সীমার মধ্যে নিয়ন্ত্রিত করে। বহু মূল্য, পরিচ্ছদ, হীরা ও মণি-মানিক্যের অলংকার, সোনা ও রূপার তৈজস পত্রাদি, চিত্র ও ভাস্কর মূর্তি সম্পর্কে রসূলে করীম (সা)-এর যে নির্দেশাবলী বিধৃত হয়েছে তার মধ্যে বহুতর কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এ সমস্ত কল্যাণের মধ্যে একটি মহত্তর কল্যাণ হচ্ছে এই যে, যে ধন-সম্পদ বহুসংখ্যক দরিদ্র ও অভাবী ভাইদের জীবনের নিম্নতম অপরিহার্য প্রয়োজনাদি পূর্ণ করতে পারে এবং তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে দিতে পারে, তাকে নিছক নিজের দেহ ও গৃহ সজ্জায় ব্যয় করা সৌন্দর্যপ্রীতি নয় বরং নিকৃষ্ট পর্যায়ের হৃদয়হীনতা ও স্বার্থপরতার পরিচায়ক।
মোটকথা ইসলাম একদিকে নৈতিক শিক্ষা ও অন্যদিকে সুনির্দিষ্ট আইন-কানুনের মাধ্যমে মানুষকে সহজ-সরল-অনাড়ম্বর জীবনযাপনের নির্দেশ দেয়। এ অনাড়ম্বর জীবনে মানুষের প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষা সীমানা কোনোক্রমেই এতটা ব্যাপকতর হতে পারে না, যার ফলে মধ্যম মানের আয়-উপার্জনের সংসার চালানো তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং নিজের স্বাভাবিক সীমার বাইরে গিয়ে তাকে অন্যের উপার্জনে ভাগ বসাতে হবে অথবা যদি সে মধ্যম মানের অধিক আয় করতে সমর্থ হয়, তাহলে নিজের উপার্জিত সমস্ত অর্থ-সম্পদ নিজেই ভোগ করবে এবং নিজের অপারগ ভাইদের সাহায্য করবে না, যারা মধ্যম মানের কম উপার্জন করে থাকে।
একটি প্রশ্ন
এ সংক্ষিপ্ত আলোচনায় ইসলামের সমগ্র অর্থব্যবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। এ আলোচনাটি পড়ার ও বারবার বিশ্লেষণ করার পর বিবেচনা করুন এ ব্যবস্থার কোনখানে সুদকে বসানো যায়? এ ব্যবস্থার যথার্থ প্রাণবস্তু, এর গঠনাকৃতি, এর বিভিন্ন অংশ ও তাদের মধ্যকার পারস্পারিক সম্পর্ক এবং এর অন্তর্নিহিত অর্থ ও উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করে বলুন, এর মধ্যে সুদী লেন-দেনের কোনো অবকাশ বা প্রয়োজন আছে কি? এখানে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কোনো স্থান বা প্রয়োজন আছে কি? এসব প্রশ্নের জবাব অবশ্যই নেতিবাচক হতে বাধ্য। তাহলে এ ক্ষেত্রে পুর্নবার গভীর দৃষ্টিতে আলোচনাটি পর্যালোচনা করে বলুন, এর মধ্যে নৈতিক, তমদ্দুনিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোথাও কোনো ত্রুটি দেখা যায় কি? নৈতিকতা ও তমদ্দুনের উন্নততর নীতি ও আদর্শের কথা না হয় বাদই দিলেন। যদি মনে করেন, মানুষের জীবনে অর্থনীতির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশী, তাহলে আসুন, নির্ভেজাল অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করুন। এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূলনীতি ও বিভিন্ন খুটিনাটি বিষয়ের মধ্যে কোনো ত্রুটি আছে কি? যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে এর মধ্যে কি এমন কোনো সংশোধনী পেশ করা যায়, যা গ্রহণ না করলে এ ব্যবস্থা অসম্পূর্ন বা ত্রুটিপূর্ণ থেকে যাবে? এর চেয়ে উন্নততর এমন কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পেশ করা যেতে পারে কি, যেখানে ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যকার অধিকার ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে এর চেয়েও অধিক নির্ভুল ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক কল্যাণের সমান সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে এর চেয়ে উন্নত পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছে? যদি এটিও সম্ভবপর না হয় এবং আমরা বিশ্বাস করি, এটি কোনোক্রমেই সম্ভবপর হতে পারে না, তাহলে আপনার মতে বুদ্ধি-বিবেচনা কি একথাই দাবী করে যে, নিজের দুর্বলতার কারণে দুনিয়ার এ সর্বোত্তম অর্থব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে আপনি দুনিয়ার নিকৃষ্টতম, সর্বাধিক ভ্রান্তিপূর্ণ ও ফলাফলের দিক থেকে সবচেয়ে বেশী ধ্বংসকর অর্থব্যবস্থা গ্রহণ করবেন? উপরন্তু এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করার পর আপনি লজ্জিতও হবেন না, নিজের বিবেককে পাপের বোঝা বইতেও প্রস্তুত করবেন না এবং পাপকে পুণ্য, ফাসেকি ও সীমালংঘনকে আনুগত্য গণ্য করার জন্য কুরআন ও হাদীসের নির্দেশের মনগড়া ব্যাখ্যা করতে থাকবেন এবং ভ্রান্ত অর্থব্যবস্থার যাবতীয় গলিত নীতি ইসলামের পবিত্র-পরিচ্ছন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে জুড়ে দেবার চেষ্টা করবেন, এ ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি, প্রাণসত্তা ও প্রকৃতির সাথে ঐ বস্তুগুলোর যতই বৈসাদৃশ্য থাক না কেন আপনি তার কোনো পরোয়াই করবেন না। প্রথমে আপনি ডাক্তার প্রদত্ত ব্যবস্থাপত্র ফেলে দেন, তার বিধৃত স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মাবলী অবহেলা ও অস্বীকার করেন, যেসব বস্তু-বিষয় থেকে তিনি সতর্ক থাকতে ও আত্মরক্ষা করতে বলেছেন সেগুলো থেকে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করেন না। অবশেষে যখন রোগ বেড়ে যায় এবং মৃত্যু নিকটবর্তী হয় তখন আবার ঐ ডাক্তারকেই বলতে থাকেন, যে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র আমাকে রোগগ্রস্ত করেছে আপনি নিজের হাতে আমাকে সে ব্যবস্থাপত্রটি লিখে দেন, যেসব অনিয়ম, অনাচার ও অখাদ্য আমার সর্বনাশ করেছে আপনি আমাকে সেগুলোর অনুমতি দেন, যে বস্তুটিকে আপনি হলাহল গণ্য করেছিলেন সেটিকে আবেহায়াত বলে ঘোষণা করে দেন। মূলত এটি চূড়ান্ত পর্যায়ের বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।
_ _ _ _ _ _ _ _
সুদ হারাম কেন
১ -নেতিবাচক দিক
ইসলামী অর্থব্যবস্থা ও তার ভিত্তিসমূহের মধ্যে চারটি বিষয় মৌলিক গুরুত্বের অধিকারীঃ
এক: কতিপয় সীমা ও নিয়ন্ত্রণ সহকারে স্বাধীন অর্থনীতি,
দুই: যাকাতের অপরিহার্যতা,
তিন: উত্তরাধিকার আইন ও
চার: সুদ নিষিদ্ধকরণ।
নিয়ন্ত্রণহীন পুঁজিবাদের ধ্বংসকারিতা এবং কমিউনিজম ও ফ্যাসিবাদের অপকীর্তি যাদের সম্মুখে উন্মোচিত হয়েছে তারা বর্তমানে উপরোল্লিখিত চারটি বিষয়ের মধ্যে কমপক্ষে প্রথমটিকে নীতিগতভাবে সত্য বলে মেনে নিতে শুরু করেছেন। অবশ্য এর বিস্তারিত অবস্থা সম্পর্কে মনে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। কিন্তু আমি আশা করি আমার “ইসলাম ও আধুনিক অর্থনৈতিক মতবাদ” ও “ভূমির মালিকানা বিধান” গ্রন্থ দু’টি পাঠ করলে তারা এ প্রশ্নগুলোর জবাবও পেয়ে যাবেন।
যাকাতকে কেন ফরয করা হয়েছে এ বিষয়টি বর্তমানে দুনিয়ার সম্মুখে অনেকটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আজ পর্যন্ত কমিউনিজম, ফ্যাসিবাদ ও পুঁজিবাদী গণতন্ত্র সামাজিক ইনস্যুরেন্সের যে ব্যাপক ব্যবস্থার কথা চিন্তা করেছে যাকাত তার চেয়ে অনেক ব্যাপক আকারে সামাজিক ইনস্যুরেন্স ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে, একথা কোনো চিন্তাশীল, বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লোকের নিকট অবিদিত নেই। কিন্তু যাকাতের বিস্তারিত বিধান না জানার কারণে এখানেও কিছু সংকট দেখা দেয়। একটি আধুনিক রাষ্ট্রের অর্থব্যবস্থায় যাকাত ও খুমুসকে (গনীমতের মালের এক-পঞ্চমাংশ) কিভাবে সংস্থাপিত করা যেতে পারে, এ ব্যাপারে মানুষের মনে বিরাট প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ প্রশ্নের সমাধানের জন্য ইনশাআল্লাহ যাকাতের বিধানসমূহ সম্পর্কে সংক্ষিপ্তকারে একটি পুস্তিকা লেখার চেষ্টা করবো।
উত্তরাধিকার আইনের ক্ষেত্রে দুনিয়ার অন্যান্য উত্তরাধিকার আইন থেকে আলাদা হয়ে ইসলাম যে পথ অবলম্বন করেছে পূর্বে তার কারণ ও অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য সম্পর্কে অধিকাংশ লোক অনবহিত ছিল এবং তারা এর বিরুদ্ধে নানান প্রশ্ন উত্থাপন করতো। কিন্তু বর্তমানে ক্রমান্বয়ে সারা দুনিয়া এদিকে ধাবিত হচ্ছে। এমনকি রাশিয়ার কমিউনিষ্ট সমাজ ব্যবস্থাও ইসলামের এ উত্তরাধিকার আইনের অংশবিশেষ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে।
[ টিকা: হালে সোভিয়েট ইউনিয়নের উত্তরাধিকার আইনের সন্তান, স্ত্রী, স্বামী, পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও পালিত পুত্রকে উত্তরাধিকারী গণ্য করা হয়েছে। উপরন্তু এজন্য যে নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, নিজের অভাবী নিকটাত্মীয় ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যেও পরিত্যক্ত সম্পত্তি বণ্টন করার অসিয়াত করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আত্মীয়দের অধিকারকে অগ্রাধিকার দান করা হয়েছে। এ সংগে এমন অসিয়াত নিষিদ্ধ করা হয়েছে যার মধ্যে নাবালক সন্তান বা দরিদ্র আত্মীয়দেরকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্য কার্যকর থাকে। এ আইন দৃষ্টে সহজেই অনুমান করা যায় যে, ‘কমিউনিষ্ট প্রগতিবাদীরা’ ১৯৪৫ সালে এমন একটি আইনের দিকে পশ্চদপসরণ করেছে যা ৬২৫ সালে প্রণীত হয়েছিল। ]
কিন্তু এ নকশার চতুর্থ অংশটি অনুধাবন করা আধুনিক যুগের মানুষের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। বিগত শতাব্দীগুলোতে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা মানুষের মনে এ বদ্ধমূল ধারণ সৃষ্টি করেছে যে, সুদকে নিছক আবেগের বশবর্তী হয়ে হারাম গণ্য করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে সুদবিহীন ঋণ দান করা একটি নৈতিক সুবিধা দান ছাড়া আর কিছুই নয় এবং ধর্ম সুদকে হারাম গণ্য করে মানুষের প্রতি অযথা বাড়াবাড়ি করেছে। অন্যথায় ন্যায়ত সুদ সম্পূর্ণ যুক্তিসংগত এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তা কেবল আপত্তিহীনই নয় বরং কার্যত উপকারী ও অপরিহার্য। এ ভ্রান্ত মতবাদটির স্বপক্ষে জোরেশোরে প্রচার অভিযান চালানোর ফলে আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার যাবতীয় ত্রুটির প্রতি সবার দৃষ্টি পড়েছে কিন্তু তার এ বৃহত্তম মৌলিক ত্রুটিটি সবার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। এমনকি রাশিয়ার কমিউনিষ্ট ও সমাজতন্ত্রীরাও নিজেদের দেশে বৃটেন ও আমেরিকার ন্যায় সযত্নে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এ বৃহত্তম ও কেন্দ্রীয় অনিষ্টকর বস্তুটি লালন করে চলেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যেখানে মুসলমানদের সুদের প্রধানমত শত্রু হওয়া উচিত ছিল সেখানে তারা পাশ্চাত্যের এ বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। আমাদের পরাজিত মানসিকতার অধিকারী মুসলিম ভাইদের মনে সাধারণভাবে সুদ সর্ম্পকে একটি ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করেন, যারা নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যয় নির্বাহের জন্য ঋণ গ্রহণ করে একমাত্র তাদের নিকট থেকে সুদ নেয়া আপত্তিকর হতে পারে। আর ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করার জন্য যে ঋণ গ্রহণ করা হয় তার উপর সুদ ধার্য করা সম্পূর্ণ বৈধ, যুক্তিসংগত ও হালাল এবং দ্বীন, নৈতিকতা, বুদ্ধি, বিবেক ও অর্থ বিজ্ঞানের নীতি অনুসারে এতে কোনো দোষ থাকতে পারে না। উপরন্তু এ ব্যাপারে এমন একটা সুধারণা পোষণ করা হয় যার ফলে পুরাতন আমলের বেনিয়া ও মহাজনদের সুদের কারবার থেকে আধুনিক ব্যাংকিং-কে আলাদা মনে করা হয় এবং এসব ব্যাংকের ‘পরিচ্ছন্ন’ ব্যবসায়কে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ও পবিত্র মনে করে এর সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক স্থাপন করাকে বৈধ গণ্য করা হয়। এজন্য বর্তমানে সুদের শরীয়াত নির্ধারিত সংজ্ঞা বদলাবার চেষ্টা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কুরআনে যে সুদকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে আধুনিক ব্যাংকের সুদ তার আওতাভুক্ত নয়। এ সমস্ত বিভ্রান্তিকর গোলক ধাঁধাঁ পেরিয়ে যারা বাইরে আসতে পেরেছেন তাদের পক্ষেও সুদকে আইনত নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর আধুনিক অর্থব্যবস্থা কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তা উপলব্ধি করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
আমার পরবর্তী আলোচনায় এ বিষয়গুলো সুস্পষ্ট করার চেষ্টা করবো।
সুদের যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা
সুদ কি যথার্থই একটি যুক্তিসংগত বিষয়? কোনো ব্যক্তি ঋণ বাবদ প্রদত্ত অর্থের উপর সুদ দাবী করলে তাকে কি বুদ্ধিসম্মত বলা যেতে পারে এবং তার এ দাবীটি কি ন্যায়সংগত বলে বিবেচিত হবার যোগ্য। কোনো ব্যক্তি একজনের নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করলে সে ঋণ বাবদ গৃহীত আসল অর্থ ফেরত দেবার সাথে সাথে তাকে কিছু সুদও প্রদান করবে এটা কি ইনসাফের দাবী? সর্বপ্রথম এ প্রশ্নগুলোর মীমাংসা হওয়া উচিত। এ প্রশ্নগুলোর মীমাংসা হয়ে গেলে আমাদের আলোচনার অর্ধেক বিষয় আপনা-আপনি মীমাংসিত হয়ে যাবে। কারণ সুদ একটি যুক্তিসংগত বিষয় বলে বিবেচিত হলে সুদ হারাম হবার ব্যাপারটি নিষ্প্রাণ হয়ে পড়বে। আর যদি বুদ্ধি ও ইনসাফের দৃষ্টিতে সুদ যুক্তিসংগত প্রমাণিত না হয়, তাহলে মানব সমাজে এ অযৌক্তিক বিষয়টিকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন কোথায়-এ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে।
প্রথম ব্যাখ্যা
এ প্রশ্নের জবাবে আমরা সর্বপ্রথম যে যুক্তিটির সম্মুখীন হই তা হচ্ছে, যে ব্যক্তি নিজের সঞ্চিত ধন-সম্পদ অন্যকে ঋণ দেয় সে বিপদ বরণ করে, ত্যাগ স্বীকার করে, নিজের প্রয়োজন অপূর্ণ রেখে অন্যের প্রয়োজন পূর্ণ করে এবং যে সম্পদ থেকে সে নিজে উপকৃত হতে পারতো তা অন্যের হাতে সোপর্দ করে। ঋণ গ্রহীতা নিজের কোনো ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করলে তাকে অবশ্যি ঐ সম্পদের ভাড়া আদায় করা উচিত। যেমন বাড়ী, গাড়ী বা আসবাবপত্রের ভাড়া আদায় করা হয়ে থাকে। ঋণদাতা নিজের শ্রমোপার্জিত অর্থ নিজে ব্যবহার না করে তাকে প্রদান করে যে বিপদ বরণ করে নিয়েছে এ ভাড়া তার বিনিময় হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। আর ঋণগ্রহীতা এ অর্থ কোনো মুনাফা সৃষ্টিকারী কাজে খাটাবার জন্য গ্রহণ করে থাকলে ঋণদাতা অবশ্যি তার নিকট সুদ দাবী করার অধিকার রাখবে। ঋণগ্রহীতা যেখানে অন্যের অর্থ থেকে লাভবান হচ্ছে সেখানে ঋণদাতা ঐ লাভের ন্যায্য অংশ পাবে না কেন?
ঋণদাতা নিজের অর্থ অন্যেও হাতে সোপর্দ করার ব্যাপারে বিপদ বরণ করে নেয় এবং ত্যাগ স্বীকার করে, একথা সত্য কিন্তু এ বিপদ বরণ ও ত্যাগ স্বীকারের মূল্য হিসেবে বছরে, ছ’ মাসে বা মাসে শতকরা পাঁচ বা দশ ভাগ আদায় করার যৌক্তিকতা কোথায়? বিপদ বরণ করে নেয়ার কারণে সে যুক্তিসংগতভাবে যে অধিকার লাভ করে তা হচ্ছে, সে ঋণগ্রহীতার নিকট থেকে কোনো জিনিস বন্ধক স্বরূপ রেখে দিতে পারে বা তার নিকট থেকে জামানত তলব করতে পারে। এসব কিছুতে সম্মত না হলে তার আদতে বিপদ বরণ না করা এবং ঋণদানে অস্বীকার করা উচিত। কিন্তু বিপদ কোনো ব্যবসায় পণ্য নয়, যার কোনো মূল্য দান করা যেতে পারে বা কোনো গৃহ, আসবাবপত্র ও যানবাহন নয়, যার কোনো ভাড়া আদায় করা যেতে পারে। অবশ্য ত্যাগ স্বীকারের ব্যাপারে বলা যেতে পারে যে, ব্যবসায়ে পরিণত না হওয়া পর্যন্তই তা ত্যাগ বলে গণ্য হতে পারে। ত্যাগ স্বীকারের উদ্দেশ্য থাকলে যথার্থ ত্যাগ স্বীকারই করা উচিত এবং এ নৈতিক কাজটির নৈতিক লাভের উপরই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আর যদি বিনিময় ও পারিশ্রমিকের প্রশ্ন তোলা হয় তাহলে ত্যাগের কথা না উঠনোই সংগত বরং সরাসরি ব্যবসায়িক ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই তাকে জানাতে হবে যে, ঋণের ব্যাপারে আসল অর্থের বাইরে মাসিক বা বার্ষিক সে যে আর একটি অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে তার অধিকারী সে হলো কিসের ভিত্তিতে?
এটা কি তার ক্ষতিপূরণ? কিন্তু সে ঋণ বাবদ যে অর্থ দিয়েছে তা ছিল তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত। সে নিজেও এ অর্থটি ব্যবহার করছিল না। কাজেই এখানে আসলে কোনো ক্ষতি অনুষ্ঠিত হয়নি এবং এ ঋণদানের জন্য কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণ লাভের অধিকারীও সে হতে পাওে না।
এটা কি ভাড়া বাবদ প্রাপ্য অর্থ? কিন্তু ভাড়া এমন সব জিনিসের হয়ে থাকে যেগুলোকে ভাড়াটের উপযোগী ও তার জন্য ব্যবহারযোগ্য করার জন্য মানুষ নিজের সময়, অর্থ ও শ্রম নিয়োজিত করে। ভাড়াটের ব্যবহারের কারণে সেগুলো নষ্ট হয়, ভেঙ্গে-চুরে যায়, যার ফলে সেগুলোর মূল্য কমে যেতে থাকে। ব্যবহার্য দ্রব্যাদি যেমন, আসবাবপত্র, গৃহ ও যানবাহনের ক্ষেত্রে এ সংজ্ঞা যথার্থ এবং এ বস্তুগুলোর ভাড়া আদায় করাও যুক্তিসংগত কিন্তু খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে এ সংজ্ঞা যথার্থ নয়, যেমন গম, ফল ইত্যাদি এবং টাকা-পয়সাও এ একই গোত্রভুক্ত। কারণ টাকা-পয়সা নিছক বস্তু ও সেবা ক্রয় করার একটি মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই নয়। কাজেই এসব বস্তুর ভাড়ার প্রসঙ্গ অর্থহীন।
কোনো ঋণদাতা বড়জোর এতটুকু বলতে পারেঃ আমার নিজের অর্থ থেকে আমি অন্যকে লাভবান হবার সুযোগ দিচ্ছি, কাজেই এ লাভে আমারও অংশ রয়েছে। এটা অবশ্যি যুক্তিসঙ্গত কথা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে অভাবী ও বুভুক্ষ ব্যক্তি নিজের অভুক্ত সন্তানদের পেটে দু’মুঠো আহার যোগাবার জন্য আপনার নিকট থেকে ৫০ টাকা হাওলাত নিয়েছে সে কি সত্যিই ঐ টাকা থেকে এমনভাবে ‘লাভবান’ হচ্ছে যার ফলে আপনি তা থেকে নিজের অংশ হিসেবে মাসে মাসে শতকরা ২ টাকা বা ৫ টাকা হারে পাওয়ার অধিকারী হতে পারেন? লাভবান সে অবশ্যি হচ্ছে এবং তাকে এ সুযোগটি নিসন্দেহে আপনিই দিয়েছেন কিন্তু বুদ্ধি-বিবেক, ইনসাফ, অর্থনীতি বিজ্ঞান, ব্যবসায় নীতি কিসের দৃষ্টিতে এ লাভ বা লাভবান হবার সুযোগকে এমন পর্যায়ে আনা যেতে পারে যার ফলে আপনি তার একটি আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করতে পারেন? ঋণগ্রহীতার বিপদ যতই কঠিন হবে এ মূল্যও ততই বাড়তে থাকবে, তার বিপদকাল যত দীর্ঘ হতে থাকবে আপনার প্রদত্ত এ ‘লাভবান হবার সুযোগের’ মূল্যও তত মাস ও বার্ষিক হারে বাড়তে থাকবে? একজন অভাবী ও বিপদগ্রস্তকে নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থদান করার মত বিরাট হৃদয়বত্তার অধিকারী যদি আপনি না হয়ে থাকেন তাহলে আপনার ঐ অর্থ তার নিকট থেকে ফেরত পাবার ব্যপারে সর্বপ্রকারে নিশ্চিন্ত হয়ে নিন তারপরই তাকে ঐ অর্থ ঋণ দিন। এটাই আপনার জন্য যুক্তিসঙ্গত পন্থা। আর যদি ঋণ দিতেও আপনার মন সায় না দেয় তাহলে তাকে কোনো প্রকারে সাহায্য করবেন না, এও একটা যুক্তিসঙ্গত কথা। কিন্তু কোনো ব্যক্তির বিপদ-দুঃখ-কষ্ট আপনার জন্য মুনাফা সংগ্রহের সুযোগরূপে গণ্য হবে এবং অভুক্ত পেট ও মৃত্যু পথযাত্রী রোগী আপনার জন্য অর্থ খাটাবার (Investment) ক্ষেত্রে বিবেচিত হবে; উপরন্তু মানুষের বিপদ বাড়ার সংগে সংগে আপনার লাভের সম্ভাবনাও বেড়ে যেতে থাকবে এটা কোন্ ধরনের যুক্তিসঙ্গত ব্যবসা?
‘লাভবান হওয়ার সুযোগ দেওয়া’ যদি কোনো অবস্থায় কোনো আর্থিক মূল্যের অধিকারী হয় তাহলে তা কেবলমাত্র এমন এক অবস্থায় হতে পারে যখন অর্থ গ্রহণকারী তা কোনো ব্যবসায়ে খাটায়। এ অবস্থায় অর্থদানকারী একথা বলার অধিকার রাখে যে, তার অর্থ থেকে অন্য ব্যক্তি যে লাভ কুড়াচ্ছে তার মধ্যে তার ন্যায্য অংশ রয়েছে এবং এ অংশ তার পাওয়া উচিত। কিন্তু বলাবাহুল্য পুঁজি একাকী কোনো মুনাফা সৃষ্টির যোগ্যতা রাখে না। মানুষের শ্রম ও যোগ্যতা তার সাথে যুক্ত হলে তবেই সে মুনাফা দানের যোগ্যতা অর্জন করে। আবার মানুষের শ্রম ও যোগ্যতা তার সাথে যুক্ত হবার সাথে সাথেই সে মুনাফা দান করতে শুরু করে না বরং মুনাফা দানের জন্য তার একটি মেয়াদের প্রয়োজন হয়। উপরন্তু তার মুনাফা দান নিশ্চিতও নয়। সেখানে ক্ষতি ও দেউলিয়া হবার সম্ভাবনাও থাকে। আর লাভজনক হবার ক্ষেত্রেও কোন্ সময় কি পরিমাণ মুনাফা দেবে তা পূর্বাহ্নে বলাও সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে মানুষের শ্রম ও যোগ্যতা যখন পর্যন্ত ঐ অর্থের ধারে-কাছেও পৌঁছাতে পারেনি তখন থেকেই বা কেমন করে অর্থদানকারীর মুনাফা শুরু হয়ে যেতে পারে? উপরন্তু মুনাফার হার ও পরিমাণও বা কেমন করে নির্দিষ্ট করা যেতে পারে, যখন পুঁজির সাথে মানুষের মেহনত ও যোগ্যতার মিলনে মুনাফা সৃষ্টি নিশ্চিত নয় এবং কি পরিমাণ মুনাফা সৃষ্টি হবে তাও জানা নেই?
যে ব্যক্তি নিজের অতিরিক্ত সঞ্চিত অর্থ কোনো মুনাফা সৃষ্টিকারী কাজে লাগাতে চায় তার শ্রম বিনিয়োগকারীদের সাথে অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে চুক্তি সম্পাদন করা এবং একটি স্থিরীকৃত হার অনুযায়ী লাভ ও লোকসানের অংশীদার হওয়া উচিত, এ ক্ষেত্রে এটিই একমাত্র যুক্তিসংগত পদ্ধতি হতে পারে। বিপরীত পক্ষে আমি যদি এক ব্যক্তির ব্যবসায়ে অংশীদার হবার পরিবর্তে তাকে একশো টাকা ঋণ দিয়ে থাকি এবং তাকে বলি, যেহেতু তুমি এ অর্থ থেকে লাভবান হবে তাই আমার টাকা যতদিন তোমার ব্যবসায়ে খাটবে ততদিন পর্যন্ত তুমি প্রতিমাসে আমাকে এক টাকা হারে মুনাফা দিতে থাকবে, এটা কোন্ ধরনের যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি হতে পারে? প্রশ্ন হচ্ছে যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ পুঁজির পিছনে পরিশ্রম খাটিয়ে তা থেকে মুনাফা অর্জিত হতে শুরু না হয় ততক্ষণ সেখানে কোন্ ধরনের সঞ্চিত মুনাফা থাকে যা থেকে আমি নিজের অংশ দাবি করার অধিকার রাখি? যদি ঐ ব্যক্তি তার ব্যবসায়ের লাভের পরিবর্তে ক্ষতির সম্মুখীন হয় তাহলে কোন্ বিবেক ও ইনসাফের প্রেক্ষিতে আমি তার নিকট থেকে মাসিক মুনাফা আদায় করার অধিকার রাখতে পারি? যদি তার মুনাফা মাসিক এক টাকার চেয়ে কম হয় তাহলে আমার মাসিক এক টাকা আদায় করার কি অধিকার আছে? আর তার সমগ্র মুনাফাই যদি হয় এক টাকা তাহলে এ ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি সারা মাস নিজের সময়, শ্রম, যোগ্যতা, বুদ্ধি, সামর্থ ও নিজের ব্যক্তিগত পুঁজি সবকিছু খাটালো সে কিছুই পেলো না অথচ আমি কেবলমাত্র একশো টাকা তাকে দিয়ে চুপচাপ বসে ছিলাম কিন্তু মুনাফার সবটুকু আমি লুটেপুটে নিয়ে গেলাম, এটা কোন্ ধরনের ইনসাফ? কলুর বলদও যদি সারাদিন ঘানি টানে তাহলে কলুর নিকট কমপক্ষে সে নিজের আহার চাইবার দাবী রাখে, কিন্তু এ সুদী ঋণ মানুষকে এমন এক বলদে পরিণত করে যে কলুর জন্য সারাদিন ঘানি টানবে কিন্তু আহার তাকে বাইরে কোথাও থেকে সংগ্রহ করতে হবে।
তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেয়া যায় যে, কোনো ব্যবসায়ী ব্যক্তির মুনাফা ঐ নির্ধারিত অর্থের চাইতে বেশী হয়, যা ঋণদাতা সুদের আকারে তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়, তাহলেও বুদ্ধিবৃত্তি, ইনসাফ, ব্যবসায় নীতি ও অর্থনৈতিক রীতিনীতি কোনো কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে একথা যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ করা যেতে পাওে না যে, যারা আসল উৎপাদনকারী, যারা সমাজের প্রয়োজন প্রস্তুত ও সংগ্রহ করার জন্য নিজেদের সময় ব্যয় করে, পরিশ্রম করে, মস্তিষ্ক পরিচালনা করে এবং নিজেদের শরীর ও মস্তিষ্কের সমুদয় শক্তি ব্যবহার করে তাদের সবার লাভ সংশয়যুক্ত ও অনির্দিষ্ট থেকে যাবে, কিন্তু যে ব্যক্তি নিজের অতিরিক্ত সঞ্চিত অর্থ ঋণ দিয়েছে একমাত্র তার লাভ নিশ্চিত ও নির্ধারিত হবে। তাদের সবার জন্য ক্ষতির আশংকা রয়েছে কিন্তু তার জন্য রয়েছে লাভের গ্যারান্টি। সবার লাভের হার বাজারের দামের সাথে উঠানামা করে কিন্তু সে একাই এমন এক সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যে নিজের জন্য লাভের যে অংক নির্ধারণ করে নিয়েছে মাসের পর মাস বছরের পর বছর তা কোনো প্রকার রদবদল ছাড়াই যথানিয়মে পেয়ে যেতে থাকে।*
[* এখানে অবশ্যি আপত্তি উত্থাপন করা যেতে পারে যে, তাহলে টাকার বিনিময়ে জমি বর্গা দেয়াকে কেমন করে বৈধ গণ্য করা যায়? তার অবস্থা ও সুদের সমপর্যায়ভুক্ত। কিন্তু এ আপত্তি আসলে তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয় যারা আগাম টাকা নির্ধারিত করে জমি বর্গা দেয়। যেমন বিঘে প্রতি ২০ টাকা বা একর প্রতি ৫০ টাকা হিসেবে নির্ধারিত করে নেয়াকে যারা বৈধ গণ্য করে তাদের বিরুদ্ধে এ আপত্তি উত্থাপন করা যেতে পারে। আমি এ নীতির সমর্থক নই। আমি নিজেও একে সুদের সাথে সামঞ্জস্যশীল মনে করি। কাজেই এ আপত্তির জবাব দেয়া আমার দায়িত্ব নয়। এ ব্যাপারে আমার নীতি হচ্ছে, জমির মালিক ও কৃষকের মধ্যে ভাগ-চাষের সম্পর্কই যথার্থ। অর্থাৎ উৎপন্ন শস্যের কত অংশ কৃষকের ও কত অংশ জমি-মালিকের সে ব্যাপারে উভয়ের মধ্যে একটি চুক্তি অনুষ্ঠিত হবে। যৌথ কারবারের অংশীদারিত্বের সাথে এর সাদৃশ্য রয়েছে। এ ধরনটিকে আমি বৈধ মনে করি। আর জমির ভাড়া সংক্রান্ত বিষয়ে যে অবস্থাটিকে আমি বৈধ মনে করি আমার ‘ভূমির মালিকানা বিধান’ গ্রন্থে তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছি। তার বিরুদ্ধে এ আপত্তি উত্থাপিত হয় না।]
দ্বিতীয় ব্যাখ্যা
এ সমালোচনা থেকে একটি কথা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। অর্থাৎ সুদকে একটি যুক্তিসঙ্গত বস্তু গণ্য করার জন্য প্রথম পর্যায়ে যেসব যুক্তিকে যথেষ্ট মনে করা হয় একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে সেগুলোর দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য যে ঋণ গ্রহন করা হয় তার উপর সুদ আরোপ করার স্বপক্ষে কোনো বুদ্ধিসম্মত যুক্তিই থাকতে পারে না। এমনকি সুদের সমর্থকগণও এ দুর্বল মামলাটির ব্যাপারে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। তবে ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে যে ঋণ গ্রহণ করা হয় তার ব্যাপারেও সুদ সমর্থকদের সম্মুখে এ জটিল প্রশ্ন দেখা দেয় যে, এ সুদকে মূলত কোন্ বস্তুর মূল্য মনে করা হচ্ছে? ঋণদাতা নিজের অর্থের সাথে ঋণগ্রহীতাকে এমন কি বাস্তব সত্ত্বামূলক (Substential) জিনিস দেয় যার একটি আর্থিক মূল্যও থাকে এবং মাসের পর মাস বছরের পর বছর যে ঋণ গ্রহীতার নিকট থেকে ঐ মূল্য লাভ করার অধিকারী হয়? এ জিনিসটি চিহ্নিত করার জন্য সুদ সমর্থকগণকে যথেষ্ট বেকায়দায় পড়তে হয়েছে।
একদল বলে সে জিনিসটি হচ্ছে ‘লাভবান হবার সুযোগ’। কিন্তু উপরের পর্যালোচনা থেকে আপনি বুঝতে পেরেছেন এ ‘সুযোগ’ কোন নির্দিষ্ট, নিশ্চিত ও নিত্যকার বুদ্ধিপ্রাপ্ত মূল্যের স্বত্ব সৃষ্টি করে না বরং এটি এমন এক অবস্থায় আনুপাতিক লাভের স্বত্ব দান করে যখন প্রকৃতপক্ষে ঋণ গ্রহণকারী লাভের মুখ দেখে।
দ্বিতীয় দল সামান্য হেরফের করে বলে, সে জিনিসটি হচ্ছে ‘অবকাশ’ ঋণদাতা নিজের অর্থের সাথে এ ‘অবকাশ’ ব্যবহারের জন্য ঋণগ্রহীতাকে দান করে। এ অবকাশের একটি মূল্য রয়েছে এবং এটি দীর্ঘ ও দীর্ঘতর হবার সাথে সাথে এর মূল্যও বেড়ে যেতে থাকে। কোনো ব্যক্তি যেদিন থেকে অর্থ নিয়ে কাজে লাগায় সেদিন থেকে শুরু করে যেদিন ঐ অর্থের সাহায্যে প্রস্তুত দ্রব্য বাজারে পৌঁছে যায় এবং মূল্য আনে ঐদিন পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত ব্যবসায়ীর নিকট থেকে অর্থ ফেরত নেয়া হয় তাহলে আদতে তার ব্যবসা চলতে পারে না। কাজেই যে ব্যক্তি অর্থ ঋণ নিয়ে ব্যবসায় খাটাচ্ছে তার নিকট এ সময়টি অবশ্যি একটি মূল্য রাখে এবং সে এ মূল্য থেকে লাভবান হচ্ছে। কাজেই অর্থদানকারীও লাভের অংশ পাবে না কেন? আবার এ সময়ের কমবেশীর কারণে ঋণগ্রহীতার লাভের সম্ভাবনাও কমবেশী হতে থাকে। কাজেই সময়ের দীর্ঘতা ও স্বল্পতার ভিত্তিতে ঋণদাতা এর মূল্য নির্ধারণ করবে কেন?
কিন্তু এখানেও আবার ঐ একই প্রশ্ন দেখা দেয়। অর্থাৎ যে ব্যক্তি অর্থ দাতার নিকট থেকে ব্যবসায় খাটাবার জন্য অর্থ নিচ্ছে সে নিশ্চিতরূপে ব্যবসায় লাভ করবে, ক্ষতি করবে না-একথা সে কেমন করে জানালো? উপরন্তু তার লাভও নিশ্চিতরূপে শতকরা একটি নির্দিষ্ট হারে হতে থাকবে কাজেই তা থেকে অর্থদানকারীকে অবশ্যই শতকরা একটি নির্দিষ্ট হারে অংশ আদায় করা উচিত-একথাই বা সে জানলো কেমন করে? এছাড়া যে সময় সে ঋণগ্রহীতাকে নিজের অর্থ ব্যবহারের অবকাশ দিচ্ছে ঐ সময় প্রতি বছর ও প্রতিমাসে নিশ্চিতরূপে একটি বিশেষ পরিমাণ মুনাফা অর্জিত হবে কাজেই এর একটি নির্দিষ্ট বার্ষিক বা মাসিক মূল্য স্থিরিকৃত হওয়া উচিত-এ হিসেব জানার জন্য কোন ধরনের যন্ত্রই বা তার নিকট আছে তা আমাদের অবশ্যই জানা উচিত? সুদ সমর্থকদের নিকট এ প্রশ্নগুলোর কোনো সঠিক ও সংগত জবাব নেই। কাজেই আবার সে আগের কথায়ই ফিরে আসতে হয়। অর্থাৎ ব্যবসায়িক ব্যাপারে যদি কোনো জিনিস যুক্তিসঙ্গত হয়ে থাকে তাহলে তা হচ্ছে একমাত্র লাভ ও লোকসানের ভিত্তিতে অংশিদারিত্ব, নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্দিষ্ট হারে যে সুদ চাপিয়ে দেয়া হয় তা নয়।
তৃতীয় ব্যাখ্যা
আর একদল বলে, মুনাফা অর্জন হচ্ছে অর্থের নিজস্ব গুণ। কাজেই কোনো ব্যক্তি যখন অন্যের সংগৃহীত অর্থ ব্যবহার করে তখন ঐ অর্থই এমন অধিকার সৃষ্টি করে যার ফলে অর্থদাতা সুদ চাইতে পারে এবং ঋণগৃহীতা তা আদায় করতে বাধ্য। প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি উৎপাদন ও সংগ্রহে সাহায্য করার শক্তি অর্থের রয়েছে। অর্থের সাহায্যে যে পরিমাণ দ্রব্য উৎপন্ন হয় তার সাহায্য ব্যতিরেকে সে পরিমাণ উৎপন্ন হতে পারে না। অর্থের সাহায্যে উন্নত ধরনের দ্রব্যাদি বেশী পরিমাণে তৈরী হয় এবং তা অধিক মূল্যে বাজারে বিক্রি হয় অন্যথায় দ্রব্যও কম উৎপন্ন হয়, তার মানও হয় নিম্নমুখী এবং বাজারে ভালো দামে বিক্রিও হয় না। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, মুনাফা অর্জনের গুণ অর্থের মধ্যে সন্নিহিত রয়েছে। কাজেই কেবল অর্থের ব্যবহারই অর্থদাতার জন্য সুদ লাভের অধিকার সৃষ্টি করে।
কিন্তু অর্থ মুনাফা দানের নিজস্ব গুণে গুণান্বিত প্রথমত এ দাবীটিই দ্ব্যর্থহীনভাবে ভ্রান্ত। যখন কোনো ব্যক্তি অর্থ নিয়ে কোনো ফলদায়ক কাজে লাগায় একমাত্র তখনই তার মধ্যে এ শক্তি সৃষ্টি হয়। একমাত্র তখনই একথা বলা যেতে পারে যে, অর্থগ্রহণকারী ব্যক্তি যেহেতু অর্থ ব্যবহার করে মুনাফা অর্জন করছে কাজেই এ মুনাফা থেকে অর্থদাতাকে অংশ দেয়া উচিত। কিন্তু যে ব্যক্তি রুগীর চিকিৎসা বা মৃতের কাফন-দাফনের অর্থ গ্রহণ করে তার এ অর্থ কোন্ ধরনের অর্থনৈতিক মূল্য সৃষ্টি করে, যা থেকে ঋণদাতা অংশগ্রহণ করতে পারে?
উপরন্তু মুনাফাজনক কাজে যে অর্থ লাগানো হয় তা সব ক্ষেত্রেই নিশ্চিতরূপে অধিক মূল্য দান করে না। কাজেই মুনাফাদান অর্থের নিজস্ব গুণ এ দাবী অর্থহীন। অনেক সময় কোনো কাজে বেশী অর্থ লাগানো হয় কিন্তু এর ফলে মুনাফা বাড়ার পরিবর্তে কমে যায়। এমনকি অবশেষে তাতে লোকসান দেখা দেয়। আজকাল কিছুদিন পর পর ব্যবসা জগতে যে অচলাবস্থার (CRISIS) সৃষ্টি হচ্ছে এর কারণ স্বরূপ একথাই বলা যায় যে, পূঁজিপতিরা নিজেদের ব্যবসায়ে যখন অজস্র অর্থ ঢেলে দিতে থাকে এবং উৎপাদন বেড়ে যেতে থাকে তখন দাম কমতে থাকে, ফলে উৎপন্ন দ্রব্যের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে দাম এত বেশী কমে যেতে থাকে যে, পুঁজি বিনিয়োগে কোনো প্রকার লাভের সম্ভাবনা থাকে না।
এছাড়াও পুঁজির মধ্যে মুনাফাদানের কোনো শক্তি যদি থেকে থাকে তাহলে তা বাস্তব রূপ লাভ করার জন্য আরো কয়েকটি জিনিসের উপর নির্ভরশীল হয়। যেমন পুঁজি ব্যবহারকারীদের পরিশ্রম, যোগ্যতা, বুদ্ধি-বৃদ্ধি ও অভিজ্ঞতা, ব্যবহারকালীন অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার আনুকূল্য এবং সমকালীন বিপদ আপদ থেকে নিরাপত্তা লাভ। এ বিষয়গুলো এবং এ ধরনের আরো বহু বিষয় মুনাফাদানের পূর্বশর্ত। এ গুলোর মধ্য থেকে কোনো একটি শর্ত না পাওয়া গেলে অনেক সময় পুঁজির সমস্ত মুনাফাদানের ক্ষমতাই শেষ হয়ে যায় বরং উলটো লোকসানও দেখা যায়। কিন্তু সুদী ব্যবসায়ে পুঁজি দানকারী ব্যক্তি এসব শর্ত পূর্ণ করার দায়িত্ব গ্রহণ করে না এবং একথাও স্বীকার করে না যে, ঐ শর্তগুলোর কোনোটির অনুপস্থিতির কারণে তার পুঁজি মুনাফাদানে অক্ষম হলে সে সুদ গ্রহণ করবে না। সে বরং উলটো দাবী করে, তার পুঁজি ব্যবহার করলেই সে একটি নির্দিষ্ট হারে সুদ লাভের অধিকারী হয়। তার পুঁজি বাস্তবে কোনো প্রকার মুনাফা লাভে সক্ষম হোক বা না হোক তার এ অধিকারে কোনো পার্থক্য সূচিত হবে না।
অবশেষে যদি একথা মেনেও নেয়া যায় যে, পূঁজির মধ্যে মুনাফা দান করার ক্ষমতা রয়েছে, যার ভিত্তিতে পুঁজিদানকারী মুনাফার অংশীদার হবার অধিকার লাভ করে তাহলেও প্রশ্ন দেখা দেয়, আপনার নিকট এমন কোন্ হিসেব আছে যার ভিত্তিতে আপনি বর্তমানে পুঁজির মুনাফাদান করার ক্ষমতা নির্দিষ্ট করতে পারেন এবং যারা পুঁজি বিনিয়োগ করে সেই ভিত্তিতে তাদের সুদের হার নির্ধারিত করতে পারেন? আর বর্তমান সময়ের জন্য কোনো হিসেবের ভিত্তিতে সুদের হার নির্ধারণ করা সম্ভবপর বলে যদি মেনে নেয়া হয় তাহলেও আমরা একথা বুঝতে সম্পূর্ণ অক্ষম যে, ১৯৪৯ সালে যে পুঁজিপতি কোনো ব্যবসা সংস্থাকে ১০ বছর মেয়াদে এবং অন্য একটি সংস্থাকে ২০ বছর মেয়াদে তৎকালীন প্রচলিত হারে সুদী ঋণ দিয়েছিলেন তিনি কিসের ভিত্তিতে একথা জানতে পেরেছিলেন যে, পরবর্তী ১০ ও ২০ বছরে পুঁজির মুনাফা দানের ক্ষমতা অবশ্যই ঐ ১৯৪৯ সালের পর্যায়েই থাকবে? বিশেষ করে যখন ১৯৫৯ সালে বাজারে সুদের হার ১৯৪৯ সালের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং ১৯৬৯ সনে তার থেকেও আলাদা হতে বাধ্য। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি একটি সংস্থার সাথে দশ বছরের এবং অন্য একটি সংস্থার সাথে বিশ বছরের চুক্তি করে তাদের নিকট থেকে ১৯৪৯ সনের হার অনুযায়ী নিজের পুঁজির সম্ভাব্য মুনাফার অংশ চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করে নিয়েছিলেন তাকে আমরা কোন্ যুক্তির ভিত্তিতে এ অধিকার দান করবো?
চতুর্থ ব্যাখ্যা
সর্বশেষ ব্যাখ্যায় একটু বেশী বুদ্ধি প্রয়োগ করা হয়েছে। এর সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছেঃ মানুষ প্রকৃতিগতভাবে দূরের ও ভবিষ্যতের লাভ ও আনন্দের উপর নিকটেরও উপস্থিত লাভ, আনন্দ, স্বাদ ও তৃপ্তিকে অগ্রাধিকার দান করে। ভবিষ্যত যতই দূরবর্তী হয় তার লাভ ও স্বাদ ততই সংশয়পূর্ণ হয় এবং সে অনুপাতে মানুষের দৃষ্টিতে তার মূল্যও কমে যায়। এ নিকটবর্তীর অগ্রাধিকার ও দূরবর্তীর পিছিয়ে পড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। যেমনঃ
একঃ ভবিষ্যত অন্ধকারের গর্ভে জীবন অনিশ্চিত। কাজেই ভবিষ্যতের লাভ সংশয়পূর্ণ। এর কোনো চিত্রও মানুষের চিন্তাজগতে সুস্পষ্ট নয়। বিপরীত পক্ষে আজকের নগদ লাভ নিশ্চিত। মানুষ স্বচক্ষে তা প্রত্যক্ষও করছে।
দুইঃ যে ব্যক্তি বর্তমানে কোনো বিষয়ের অভাব অনুভব করছে বর্তমানে তা পূর্ণ হওয়া ভবিষ্যতে কোনো এক সময় পূর্ণ হওয়ার চেয়ে অনেক বেশী মূল্যবান বিবেচিত হবে, যখন হতে পারে সে ঐ বিষয়ের অভাব অনুভব করবে না বা হয়তো অনুভব করতেও পারে।
তিনঃ যে অর্থ বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে তা কার্যত প্রয়োজনীয় ও কার্যোপযোগী। এ প্রেক্ষিতে তা ঐ অর্থের উপর অগ্রাধিকার রাখে যা আগামীতে কোনো সময় অর্জিত হবে।
এ সমস্ত কারণে আজকের নগদ লাভ ভবিষ্যতের অনিশ্চিত লাভের উপর অগ্রাধিকার রাখে। কাজেই যে ব্যক্তি আজ কিছু অর্থ ঋণ নিচ্ছে তা অনিবার্যরূপে আগামীকাল সে ঋণদাতাকে যে অর্থ আদায় করবে তার চেয়ে বেশী মূল্যের অধিকারী। ঐ বাড়তি মূল্যটুকুই হচ্ছে সুদ। ঋণ দেবার সময় ঋণদাতা তাকে যে অর্থ দিয়েছিল, আদায় করার সময় বাড়তি মূল্য স্বরূপ ঐ সুদ আসল অর্থের সাথে মিশে তার সমান মূল্যে পৌঁছিয়ে দেয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ এ বিষয়টিকে নিম্নোক্তরূপে অনুধাবন করা যায়ঃ এক ব্যক্তি মহাজনের নিকট গিয়ে একশো টাকা ঋণ চাইলো। মহাজন তার সাথে চুক্তি করলো যে, আজ সে যে ১০০ টাকা দিচ্ছে এক বছর পর এর পরিবর্তে তাকে ১০৩ টাকা দিতে হবে। এ ব্যাপারে আসলে বর্তমানের ১০০ টাকার বিনিময় হচ্ছে ভবিষ্যতের ১০৩ টাকার সাথে। বর্তমানের অর্থ ও ভবিষ্যতের অর্থের মনস্তাতিক (অর্থনৈতিক নয়) মূল্যের মধ্যে যে পার্থক্য দেখা যায় তা এ বাড়তি ৩ টাকার সমান। যতক্ষণ পর্যন্ত এ ৩ টাকা এক বছর পর আদায়কৃত ১০০ টাকার সাথে যুক্ত হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত তার মূল ঋণ প্রদান কালে ঋণদাতা প্রদত্ত ১০০ টাকার সমান হবে না।
যে সতর্কতা ও বুদ্ধিমত্তা সহকারে এ ব্যাখ্য করা হয়েছে তার তারিফ না করে পারা যায় না। কিন্তু এখানে বর্তমান ও ভবিষ্যতের মনস্তাত্তিক মূল্যের যে পার্থক্য বর্ণনা করা হয়েছে তা আসলে একটি বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।
সত্যিই কি মানব প্রকৃতি বর্তমানকে ভবিষ্যতের তুলনায় বেশী গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান মনে করে? তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে অধিকাংশ লোক তাদের সমস্ত উপার্জন আজই ব্যয় করা সংগত মনে করে না কেন? বরং তার একটি অংশ ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করা পছন্দ করে কেন? সম্ভবত শতকরা একজন লোকও আপনি পাবেন না যে ভবিষ্যতের চিন্তা শিকেয় তুলে রেখে বর্তমানের আয়েশ-আরাম ও স্বাদ-আহলাদ পূরণ করার জন্য সমুদয় অর্থ দু’হাতে খরচ করাকে অগ্রাধিকার দেবে। অন্ততপক্ষে শতকরা ৯৯জন লোকের অবস্থা এই যে, তারা আজকের প্রয়োজন অপূর্ণ রেখে আগামীকালের জন্য কিছু না কিছু সঞ্চয় করে রাখতে চায়। কারণ ভবিষ্যতে যে সব ঘটনা সংঘটিত হবে এবং মানুষকে যে সব প্রয়োজনের সম্মুখীন হতে হবে তম্মধ্যে অনেক সম্ভাব্য ঘটনা ও প্রয়োজনের কাল্পনিক চিত্র মানুষের মানস চোখে ভাসতে থাকে। বর্তমানে সে যে পয়োজন মিটিয়ে চলছে ও যে অবস্থার সাথে কোনো না কোনোক্রমে যুঝছে সেগুলোর চেয়ে ঐ সম্ভাব্য ঘটনা ও প্রয়োজনগুলো তার নিকট অনেক বেশী বড় ও গুরুত্বপূর্ণ রূপে প্রতীয়মান হয়। উপরন্তু বর্তমানেও মানুষ যেসব প্রচেষ্টা ও সাধনা চালিয়ে যাচ্ছে এগুলোরও উদ্দেশ্য তার নিজের উন্নততর ও অধিকতর ভালো ভবিষ্যত ছাড়া আর কি-ই বা হতে পারে? মানুষ আগামী দিনে ভালোভাবে জীবন যাপন করার উদ্দেশ্যেই তো আজ শ্রম-মেহনত করে যাচ্ছে। এমন কোনো নিরেট বোকার সন্ধান পাওয়ারও কষ্টকর হবে যে নিজের ভবিষ্যতকে শ্রীহীন ও দুঃখ-দারিদ্র পর্যুদস্ত অথবা কমপক্ষে বর্তমানের তুলনায় শ্রীহীন করার বিনিময়ে নিজের বর্তমানকে সুখী-সমৃদ্ধিশালী করা পছন্দ করবে। মূর্খতা ও অজ্ঞতার কারণে মানুষ এমনটি করতে পারে অথবা কোনো সাময়িক ইচ্ছ-কামনার আবেগে অভিভূত হয়ে এহেন পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভবপর কিন্তু ভেবে-চিন্তে, বিচার-বিবেচনা করে কেউ এ কাজ করতে পারে না, অন্তুত একে নির্ভুল ও যুক্তিসংগত বিবেচনা করতে পারে না।
মানুষ বর্তমানের নিশ্চয়তার বিনিময়ে ভবিষ্যতের ক্ষতি বরদাশত করে নেয়। কিছুক্ষণের জন্য এ দাবীর যথার্থতা স্বীকার করে নিলেও এ দাবীর ভিত্তিতে যে কথা প্রমান করার চেষ্টা করা হচ্ছে তা কোনোক্রমেই যথার্থ প্রমাণিত হয় না। ঋণ গ্রহণ কালে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল তাতে বর্তমানের ১০০ টাকার দাম এক বছর পরের ১০৩ টাকার সমান ধার্য করা হয়েছিল। কিন্তু আজ এক বছর পর ঋণগ্রহীতা যখন ঋণ আদায় করতে গেলো তখন প্রকৃত অবস্থা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে? এখন বর্তমানের ১০৩ টাকা অতীতের ১০০ টাকার সমান হয়ে গেছে। আর যদি প্রথম বছর ঋণগ্রহীতা ঋণ আদায় করতে সক্ষম না হয় তাহলে দ্বিতীয় বছরের শেষে দু’ বছর আগের ১০০ টাকার দাম বর্তমানের ১০৬ টাকার সমান হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে অর্থের মূল্য ও মান নিরুপণের ক্ষেত্রে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে এ অনুপাত কি যথার্থ ও নির্ভুল? সত্যিই কি অতীত যতই পুরাতন হতে থাকে বর্তমানের তুলনায় তার দাম ততই বাড়তে থাকে? সত্যিই কি অতীতের প্রয়োজনগুলোর পূর্ণতা এতবেশী মূল্যবান যার ফলে দীর্ঘকাল পূর্বে আপনি যে অর্থ পেয়েছিলেন এবং যা খরচ করার পর বিস্তৃতির গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে তা কালের প্রতিটি মুহূর্ত অতিক্রান্ত হবার সাথে সাথে বর্তমানের অর্থের চেয়ে বেশী মূল্যবান হয়ে যাচ্ছে,এমনকি একশো টাকা খরচ করার পর যদি পঞ্চাশ বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে বর্তমানে তার দাম হবে আড়াইশো টাকার সমান?
ন্যায়সঙ্গত সুদের হার
বুদ্ধি ও ন্যায়নীতির দিক থেকে সুদকে বৈধ ও সংগত প্রমাণ করার জন্য সর্বসাকুল্যে উপরোক্ত যুক্তিগুলোই পেশ করা হয়। আমাদের ইতিপূর্বেকার আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে,যুক্তির সাথে এ নাপাক বস্তুটির কোনো দূরবর্তী সম্পর্কও নেই। সুদ দেয়া-নেয়ার স্বপক্ষে কোনো শক্তিশালী যুক্তিও পেশ করা যেতে পারে না। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এমনিতর একটি অযৌক্তিক বস্তুকে পাশ্চাত্যের পন্ডিত-প্রবর ও চিন্তাশীলগণ সম্পূর্ণ স্বীকৃত ও সুস্পষ্ট বস্তু হিসেবে গণ্য করে নিয়েছেন এবং সুদের যৌক্তিকতাকে যেন একটি স্থিরীকৃত ও সর্বজন স্বীকৃত সত্য মনে করে সমস্ত আলোচনা সুদের ন্যায়সঙ্গত হার নির্ধারণের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করেছেন। আধুনিক পাশ্চাত্য সাহিত্যে সুদ সম্পর্কিত আলোচনার কোথাও সুদ দেয়া-নেয়ার যৌক্তিকতা ও অযৌক্তিকতার প্রসঙ্গ দেখা যাবে না বরং সুদের অমুক হারটি অযৌক্তিক ও সীমাতিরিক্ত কাজেই তা আপত্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য এবং অমুক হারটি ন্যায়সঙ্গত কাজেই তা গ্রহণযোগ্য এ বিতর্কের মধ্যেই সমস্ত আলোচনা আবর্তিত।
কিন্তু সত্যিই কি কোন ন্যায়সঙ্গত হার আছে? যে বস্তুটির নিজের ন্যায়সঙ্গত হবার কোন প্রমাণ নেই তার হার যুক্তিসঙ্গত না অযৌক্তিক এ প্রসঙ্গ অবতারণার অবকাশ কোথায়? কিছুক্ষণের জন্য আমরা এ আলোচনা না হয় স্থগিতই রাখলাম। এ প্রশ্ন বাদ দিয়ে আমরা মাত্র এতটুকু জানতে চাই, সুদের স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গত হার কোনটি? কোন হারের ন্যায়সঙ্গত ও অন্যায় হবার মাপকাঠি কি? সত্যিই কি বিশ্বজোড়া সুদী ব্যবসায়ে কোনো যুক্তিসঙ্গত (Rational) ভিত্তিতে সুদের হার নির্ধারণ করা হচ্ছে?
এ প্রশ্নের ব্যাপারে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে আমরা আবিষ্কার করেছি দুনিয়ায় ন্যায়সঙ্গত সুদের হার নামক কোনো জিনিসের অস্তিত্বই কোনোদিন ছিল না। বিভিন্ন হারকে বিভিন্ন যুগে ন্যায়সঙ্গত গণ্য করা হয়েছে এবং পরে আবার সেগুলোকেই অন্যায় ও অসঙ্গত ঘোষণা করা হয়েছে। বরং একই যুগে বিভিন্ন স্থানের ন্যায়সঙ্গত হারের মধ্যে পার্থক্য দেখা গেছে। প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ হিন্দু অর্থনীতিবিদ কৌটিল্যের বর্ণনা অনুযায়ী প্রাচীন হিন্দুযুগে বছরে শতকরা ১৫ থেকে ৬০ ভাগ সুদ ন্যায়সঙ্গত মনে করা হতো এবং বিপদাশংকা অত্যধিক বলে এ হার আরও বাড়ানো যেতো। অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে ও ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতীয় করদ রাজ্যগুলো একদিকে নিজেদের দেশীয় মহাজনবৃন্দ ও অন্যদিকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সরকারের সাথে যে আর্থিক লেনদেন করতো তাতে সাধারণত বার্ষিক শতকরা ৪৮ ভাগ সুদের হারের প্রচলন ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে (১৯১৪-১৮) ভারত সরকার বার্ষিক শতকরা সাড়ে ৬ ভাগ সুদের ভিত্তিতে যুদ্ধ ঋণ লাভ করেছিল। ১৯২০ ও ১৯৩০ এর মধ্যবর্তী সময়ে সমবায় সমিতিগুলোর সাধারণ সুদের হার ছিল শতকরা ১২ থেকে ১৫ ভাগ। ১৯৩০ ও ১৯৪০ এর আমলে দেশের আদালতগুলো বার্ষিক শতকরা ৯ ভাগের কাছাকাছি সুদকে ন্যায়সঙ্গত গণ্য করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাছাকাছি সময়ে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ডিসকাউন্ট রেট বার্ষিক শতকরা ৩ ভাগ নির্ধারিত হয়েছিল এবং সমগ্র যুদ্ধকালে এ হার বর্তমান ছিল বরং শতকরা পৌনে তিন ভাগ সুদেও ভারত সরকার ঋণ লাভ করেছিল।
এতো গেলো আমাদের উপমহাদেশের অবস্থা। ইউরোপের দিকে তাকালে সেখানেও প্রায় একই ধরণের চিত্র দেখা যাবে। ষোল শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডে শতকরা ১০ ভাগ সুদের হারকে সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত গণ্য করা হয়েছিল। ১৯২০ সালের কাছাকাছি সময়ে ইউরোপের অনেক সেন্ট্রাল ব্যাংক শতকরা ৮/৯ ভাগ সুদ নির্ধারণ করতো। এ আমলে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের (LEAGUE OF NATIONS) মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যে ঋণ লাভ করেছিল,তার হারও ছিল অনুরূপ। কিন্তু আজ আমেরিকা ও ইউরোপের কোনো ব্যাক্তির নিকট সুদের এ হারের কথা বললে সে চীৎকার করে বলতে থাকবে,এটা সুদ নয়,লুটতরাজ। আজ যেদিকে তাকান শতকরা আড়াই ও ৩ ভাগ সুদের পসরা দেখতে পাবেন। শতকরা ৪ ভাগ হচ্ছে আজকের সর্বোচ্চ হার। আবার কোনো কোনো অবস্থায় ১ ও ১/২ বা ১/৪ ভাগ সুদও দেখা যায়। কিন্তু অন্যদিকে দরিদ্র জনসাধারণকে সুদী ঋণদানকারী মহাজনদের জন্য ইংল্যান্ড ১৯২৭ সালে মানি ল্যান্ডারস এ্যাক্টের মাধ্যমে শতকরা ৪৮ ভাগ সুদ বৈধ গণ্য করেছে। আমেরিকার আদালতগুলো সুদখোর মহাজনদের জন্য বার্ষিক শতকরা ৩০ থেকে ৬০ ভাগ সুদ গ্রহণ করার অনুমতি দান করেছে। এখন আপনি নিজেই বলুন, এর মধ্যে কোন হারটি স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গত?
আর একটু অগ্রসর হয়ে আমরা জিজ্ঞেস করতে চাই,সত্যিই কি সুদের কোনো স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গত হার হতে পারে? এ প্রশ্নটি পর্যালোচনা করলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন যে,সুদের হার কেবলমাত্র এমন অবস্থায় সঙ্গতভাবে নির্ধারিত হতে পারে, যখন ঋণগ্রহীতা তার ঋণলব্ধ অর্থ থেকে যে মুনাফা অর্জন করে, তার মূল্য নির্ধারিত থাকতো (বা করা যেতো)। যেমন এক বছর পর্যন্ত ১০০ টাকা ব্যবহার করলে – তা থেকে ২৫ টাকার ন্যায় মুনাফা লাভ করা যায়,একথা যদি নির্ধারিত হয়ে যায়, তাহলে এ সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয় যে, যে ব্যক্তির অর্থ সারাটা বছর ব্যবহার করে এ মুনাফা অর্জিত হলো সে এ মুনাফা থেকে ৫ টাকা বা আড়াই টাকা অথবা সোয়া এক টাকা পাওয়ার স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার রাখে। কিন্তু বলাবাহুল্য, এভাবে যে অর্থ ব্যবহার করা হয়, তার মুনাফা কোনোদিন নির্ধারিত হয়নি এবং হতেও পারে না। উপরন্তু বাজারে সুদের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে কখনো ঋণগ্রহীতা ঋণলব্ধ অর্থ থেকে কি পরিমাণ মুনাফা লাভ করছে, এমনকি কোনো মুনাফা লাভ করবে কিনা,সেদিকে দৃষ্টি রাখা হয় না। এক্ষেত্রে কার্যত যা কিছু হয় তা হচ্ছে,মহাজনী ব্যবসায়ে ঋণগ্রহীতার অলসতার প্রেক্ষিতে ঋণের মূল্য নির্ধারিত হয়। অন্যদিকে বাণিজ্যিক সুদের বাজারে অন্যতর ভিত্তিতে সুদের হারের উঠানামা হতে থাকে। বুদ্ধি,যুক্তি ও ন্যায়নীতির সাথে এর কোনো দূরতম সম্পর্কও থাকে না।
মহাজনী ব্যবসায়ে একজন মহাজন সাধারণত দেখে, যে ব্যক্তি ঋণ নিতে এসেছে, সে কত গরীব, ঋণ না পেলে তার দুঃখ ও দুর্দশা কি পরিমাণ বাড়বে? সাধারণত এসবের ভিত্তিতে সে তার সুদের হার পেশ করে। যদি সে কম গরীব হয়, কম টাকা চায় এবং তাকে বাহ্যত বেশী পেরেশান ও চিন্তাকুল না দেখায়। তাহলে তার সুদের হার হবে কম। বিপরীত পক্ষে সে যতই দুর্দশাগ্রস্ত ও বেশী অভাবী হবে,ততই তার সুদের হার বাড়তে থাকবে। এমনকি,কোনো অর্ধাহারে অনাহারে দিন যাপনকারী ব্যক্তির পুত্র যদি কঠিন রোগাক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পর্যায়ে উপনীত হয়, তাহলে তার জন্য সুদের হার শতকরা চার-পাঁচশো তো পৌঁছে যাওয়া মোটেই অস্বাভাবিক বা বিস্ময়কর নয়। এ ধরণের অবস্থায় সুদের স্বাভাবিক হার প্রায়ই এ ধরণের হয়ে থাকে। এর একটি চরমতম দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে ১৯৪৭ সালে অমৃতসর ষ্টেশনের একটি ঘটনায়। ঐ বছর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভীতিপ্রদ দিনগুলোতে একদা অমৃতসর ষ্টেশনে জনৈক শিখ একজন মুসলমানের নিকট থেকে এক গ্লাস পানির স্বাভাবিক মূল্য হিসেবে ৩০০ টাকা আদায় করে। কারণ ঐ মুসলমানের পুত্র পিপাসায় মরে যাচ্ছিল এবং কোনো মুসলমান শরণার্থীর পক্ষে ট্রেন থেকে নিচে নেমে পানি আরহণ করা সম্ভবপর ছিল না।
মহাজনী ব্যবসায় ছাড়া অর্থনীতির অন্যান্য বাজারে সুদের হার নির্ধারণ ও তা কমবেশী করার ব্যাপারে যেসব ভিত্তির আশ্রয় নেয়া হয়, সেগুলো সম্পর্কে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞগণ দু’টি ভিন্ন মতের অনুসারী।
একদল বলেন, চাহিদা ও সরবরাহের নীতিই হচ্ছে এর ভিত্তি। যখন অর্থ বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কম হয় ও ঋণ দেয়ার মতো অর্থের পরিমাণ বেড়ে যায়, তখন সুদের হার নেমে যায়। এভাবে সুদের হার অনেক বেশী কমে গেলে লোকেরা একে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে এবং বেশী সংখ্যক লোক ঋণ নিতে এগিয়ে আসে। অতপর যখন অর্থের চাহিদা বাড়তে থাকে এবং ঋণ দেয়ার মতো অর্থের পরিমাণ কমে যেতে থাকে, তখন সুদের হার বাড়তে থাকে, অবশেষে তা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যার ফলে ঋণ গ্রহণের চাহিদা খতম হয়ে যায়।
এর অর্থ কি? পুঁজিপতি সোজাসুজি ও যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতিতে ব্যবসায়ীর সাথে ব্যবসায়ে অংশীদার হয় না এবং তার যথার্থ মুনাফার ন্যায়সঙ্গত অংশগ্রহণেও তৎপর হয় না। বিপরীতপক্ষে সে এ ক্ষেত্রে আন্দাজ-অনুমান করে দেখে, এ ব্যবসায়ে ব্যবসায়ী কি পরিমাণ মুনাফা অর্জন করবে, সে প্রেক্ষিতে সে নিজের সুদ নির্ধারণ করে এবং মনে করে, এ নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদ তার পাওয়া উচিত। অন্যদিকে ব্যবসায়ীও আন্দাজ-অনুমান করে দেখে যে, পুঁজিপতির নিকট থেকে সে যে অর্থ নিচ্ছে, তা থেকে সর্বাধিক কি পরিমাণ মুনাফা লাভ করা সম্ভব হবে, কাজেই সে প্রেক্ষিতে সে একটি বিশিষ্ট পরিমাণের অধিক সুদকে অসংগত মনে করে। উভয় পক্ষই আন্দাজ-অনুমানের (SPECULATION) ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়। পুঁজিপতি হামেশা ব্যবসায়ে মুনাফার অংক বেশী করেই ধরে আর ব্যবসায়ী লাভের সাথে সাথে লোকসানের আশংকাও সামনে রাখে। এ কারণে উভয়ের মধ্যে একটি চিরস্থায়ী দ্বন্দ্ব বিরাজ করে। ব্যবসায়ী যখন মুনাফা লাভের আশায় পুঁজি বিনিয়োগ করতে চায় পুঁজিপতি তখন নিজের পুঁজির দাম বাড়াতে থাকে। এভাবে দাম বাড়াতে বাড়াতে অবশেষে তা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যখন এ ধরণের চড়া সুদে অর্থ ঋণ নিয়ে কোনো ব্যবসায় খাটালে তাতে কোনো প্রকারেই মুনাফার সম্ভাবনা থাকে না। এ পর্যায়ে পৌঁছে পুঁজি বিনিয়োগের পথ বন্ধ হয়ে যায় এবং অর্থনৈতিক উন্নতির গতিধারায় অকস্মাৎ ভাটা পড়ে। অতপর যখন সমগ্র ব্যবসায় জগত পরিপূর্ণ মন্দাভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং পুঁজিপতি নিজের ধ্বংস প্রত্যক্ষ করতে থাকে, তখন সে সুদের হার এতদূর কমিয়ে দেয়, যার ফলে ঐ হারে অর্থ বিনিয়োগে ব্যবসায়ী লাভের আশা করে। এ সময় শিল্প-বাণিজ্যের বাজারে পুনর্বার অর্থ সমাগম হতে থাকে। এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে, পুঁজি ও ব্যবসায়ের মধ্যে যদি ন্যায়সঙ্গত শর্তে অংশীদারীত্বমূলক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে দুনিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একটি সুসামঞ্জস্য পদ্ধতিতে পরিচালিত হতো। কিন্তু আইন যখন পুঁজিপতির জন্য সুদের ভিত্তিতে ঋণদান করার পথ প্রশস্ত করলো, তখন পুঁজি ও ব্যবসায়ের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে জুয়াড়ি মনোবৃত্তির অনুপ্রবেশ ঘটলো এবং এমন জুয়াড়ি পদ্ধতিতে সুদের হার উঠানামা করতে থাকলো, যার ফলে সারা দুনিয়ার অর্থনৈতিক জীবনে একটা চিরস্থায়ী অচলাবস্থার সৃষ্টি হলো।
দ্বিতীয় দলটি নিম্নোক্তভাবে সুদের হারের যৌক্তিকতা প্রদর্শন করে। তাদের বক্তব্য হলোঃ পুঁজিপতি যখন পুঁজি নিজের কাজে লাগানো অধিক পছন্দ করে, তখন সুদের হার বাড়িয়ে দেয়, আবার যখন তার এ ইচ্ছায় ভাটা পড়ে, তখন সুদের হারও কমে যায়। তবে পুঁজিপতি নগদ অর্থ তার নিজের কাছে রাখাকে অগ্রাধিকার দেয় কেন? এর জবাবে তারা বিভিন্ন কারণ দর্শায়। নিজের ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক প্রয়োজনের খাতে কিছু অর্থ রাখার প্রয়োজন হয়। আবার আকস্মিক প্রয়োজন ও অপ্রত্যাশিত অবস্থার মোকাবিলা করার জন্যও কিছু অর্থ সংরক্ষিত রাখতে হয়। যেমন ব্যক্তিগত ব্যাপারে কোনো অস্বাভাবিক খরচ অথবা হঠাৎ সুবিধাজনক সওদার সুযোগ সৃষ্টি হওয়া। এ দু’টি কারণ ছাড়া তৃতীয় একটি এবং অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে এই যে, ভবিষ্যতে কোনোদিন যখন দাম হবার জন্য পুঁজিপতি তার নিকট যথেষ্ট পরিমাণ নগদ টাকা সঞ্চিত রাখতে চায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কারণে অর্থকে নিজের ব্যবহার উপযোগী রাখার জন্য পুঁজিপতির মনে যে আকাঙ্ক্ষার উদ্রেক হয়, তা কি বাড়ে-কমে? সুদের হার উঠানামা করার সময় কি তার প্রভাব সুস্পষ্ট হয়?
এর জবাবে তারা বলেঃ অবশ্যি বিভিন্ন ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে কখনো এ আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়, ফলে পুঁজিপতি সুদের হার বাড়িয়ে দেয় এবং ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যেতে থাকে। আবার কখনো এ আকাঙ্ক্ষা কমে যায়, তখন পুঁজিপতি সুদের হার কমিয়ে দেয়, ফলে শিল্প-বাণিজ্যে পুঁজি বিনিয়োগ করার উদ্দেশ্যে লোকেরা বেশী করে ঋণ নিতে থাকে।
এ মনোহর যুক্তি ও ব্যাখ্যাটির অন্তরালে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যাবে, ঘরোয়া প্রয়োজন বা ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক প্রয়োজন স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক সব ধরণের অবস্থায় পুঁজিপতি নিজের জন্য যে পরিমাণ পুঁজিকে ব্যবহার উপযোগী রাখতে চায় তার পরিমাণ হতে পারে বড়জোর শতকরা পাঁচ ভাগ। কাজেই প্রথম কারণ দুটিকে অযথা গুরুত্ব দেয়ার কোনো অর্থ হয় না। পুঁজিপতি যে কারণে নিজের শতকরা ৯৫ ভাগ পুঁজিকে কখনো সিন্দুকে ভরে রেখে আবার কখনো ঋণ দেয়ার জন্য বাজারে ছাড়ে, তা অবশ্যি তৃতীয় একটি কারণ। এ কারণটি বিশ্লেষণ করলে যে সত্য উপলব্ধি হয়, তা হচ্ছে, পুঁজিপতি নিজের দেশ ও জাতির অবস্থাকে অত্যন্ত স্বার্থপরতার দৃষ্টিতে অবলোকন করতে থাকে। এ সময় নিজের স্বার্থ চরিতার্থতার কিছু লক্ষণ তার সম্মুখে পরিস্ফুট হয়ে উঠলে তার ভিত্তিতে সে এমন সব অস্ত্র নিজের কাছে সর্বদা প্রস্তুত রাখতে চায়, যেগুলোর সাহায্যে সমাজের বিভিন্ন সঙ্কট, সমস্যা ও বিপদ-আপদকে ব্যবহার করে সেগুলো থেকে অবৈধ সুবিধা ভোগ করা যায় এবং সমাজের উদ্বেগ –আকুলতা বৃদ্ধি করে নিজের সমৃদ্ধি ও স্বচ্ছলতা বাড়ানো সম্ভব হয়। এজন্য জীবন-জুয়ায় একটা বড় রকমের দাঁও মারার উদ্দেশ্যে সে পুঁজি নিজের জন্য আটক রাখে, সুদের হার বাড়িয়ে দেয়, শিল্প ও ব্যবসা ক্ষেত্রে অর্থের প্রবাহ হঠাৎ বন্ধ করে দেয় এবং সমাজের জন্য ডেকে আনে এক মহাবিপদ যাকে মন্দা (Depression) বলা হয়ে থাকে। অতঃপর যখন সে দেখে, এ পথে তার পক্ষে হারাম উপায়ে যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করা সম্ভব তা সে করে ফেলেছে এবং এভাবে অর্থ উপার্জন তার পক্ষে আর কোনভাবেই সম্ভব নয় বরং এখন তার ক্ষতির পালা শুরু হয়ে যাবে, তখন তার নীচ মনের অভ্যন্তরে অর্থকে নিজের জন্য ব্যবহার উপযোগী রাখার ইচ্ছা নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং কম সুদের লোভ দেখিয়ে সে ব্যবসায়ীদেরকে তার নিকট অর্থ সম্পদ কাজে লাগাবার জন্য ব্যাপকভাবে আহবান জানায়।
আধুনিক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞগণ সুদের হারের এই দুইটি কারণই দেখিয়ে থাকেন। অবশ্য স্ব স্ব পরিমণ্ডলে এই দুইটি কারণই যথার্থ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এর মধ্যে যে কারণটিই যথার্থ হোক না কেন, তা থেকে সুদের ন্যায়সংগত ও স্বাভাবিক হার নির্ধারিত হয় বা হতে পারে কেমন করে? এক্ষেত্রে হয় আমাদেরকে বুদ্ধি, জ্ঞান, ন্যায়্যানুগতা ও স্বাভাবিকতার অর্থ ও ধারণা বদলাতে হবে, নতুবা একথা মেনে নিতে হবে যে, সুদ জিনিসটি নিজেই যে ধরণের অন্যায় তার হারও তার চেয়ে বেশি অন্যায় ও অসংগত কারণের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় ও ওঠানামা করে।
সুদের অর্থনৈতিক লাভ ও তার প্রয়োজন
সুদ সমর্থকগণ সুদকে একটি অর্থনৈতিক প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন এবং ধারণা পোষণ করেছেন যে, এর সাহায্য ব্যতিরেকে আমরা অনেক কিছু অর্থনৈতিক লাভ থেকে বঞ্চিত থেকে যাই। এ দাবীর সমর্থনে যেসব যুক্তি পেশ করা হয়, সেগুলোর সারাংশ নিচে প্রদত্ত হলোঃ
একঃ অর্থনীতির সমস্ত কাজ-কারবার পুঁজি সংগ্রহের উপর নির্ভরশীল। আর নিজেদের প্রয়োজনের ও আশা-আকাঙ্ক্ষার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং আয়ের সমগ্র অংশকে নিজেদের জন্য ব্যয় না করে কিছু অংশ সঞ্চয় করা ছাড়া এ পুঁজি সংগ্রহ সম্ভবপর নয়। পুঁজি সংগ্রহের এ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই। কিন্তু কোনো ব্যাক্তি যদি তার ইচ্ছা-বাসনা ত্যাগ করার ও আত্মসংযমের কোনো প্রতিদান না পায়, তাহলে সে নিজের প্রয়োজন অপূর্ণ রাখতে ও সম্পদের স্বল্প ব্যবহার করতে উদ্যোগী হবে কেন? এ সুদই তার সেই প্রতিদান। এরই আশায় বুক বেঁধে মানুষ অর্থ বাঁচাতে ও সঞ্চয় করতে প্রবৃত্ত হয়। কাজেই এ সুদকে হারাম গণ্য করা হলে আসলে উদ্বৃত্ত অর্থ সংরক্ষণের পথই রুদ্ধ হয়ে যাবে। অথচ এটিই হচ্ছে পুঁজি সংগ্রহ ও সরবরাহের আসল মাধ্যম।
দুইঃ সকল মানুষের জন্য নিজের সঞ্চিত সম্পদ সুদের ভিত্তিতে ব্যবসায়ে খাটাবার পথ উন্মুক্ত থাকাই অর্থনৈতিক কায়-কারবারের দিকে পুঁজি প্রবাহিত হওয়ার সহজতর উপায়। এভাবে সুদের লোভেই তারা অর্থ সঞ্চয় করতে থাকে, আবার সুদের লালসাই তাদেরকে নিজেদের সঞ্চিত অর্থ অযথা জমা না রেখে উৎপাদনশীল করার জন্য ব্যবসায়ীর হাতে সোপর্দ করে একটি নির্ধারিত হার অনুযায়ি সুদ আদায় করতে উদ্বুদ্ধ করে। এ দুয়ারটি বন্ধ করার অর্থ হবে কেবল মাত্র পুঁজি সঞ্চয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেরণা শক্তিরই বিলুপ্তি নয় বরং সামান্য যা কিছু সংগৃহীত হবে তাও ব্যবসায়ে খাটানো যাবে না।
তিনঃ সুদ কেবল পুঁজি সংগ্রহ করে তাকে ব্যবসায়ের দিকে টেনে আনে না বরং তার অলাভজনক ও অনুপকারী ব্যবহারের পথরোধ করে। আর সুদের হার এমন একটি বস্তু যা সর্বোত্তম পদ্ধতিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন প্রস্তাবিত ব্যবসায়ের মধ্য থেকে সবচেয়ে লাভজনক ও মুনাফাদায়ক ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগের ব্যবস্থা করে। এছাড়া দ্বিতীয় এমন কোনো ব্যবস্থার সন্ধান পাওয়া যায়নি যা বিভিন্ন কার্যকর পরিকল্পনার মধ্য থেকে লাভজনক অলাভজনক থেকে এবং অধিক লাভজনককে কম লাভজনক থেকে আলাদা করে অধিক লাভজনকের দিকে পুঁজিকে পরিচালিত করতে পারে। কাজেই সুদের বিলোপ সাধনের ফলে প্রথমত লোকদের অত্যন্ত বেপরোয়াভাবে পুঁজি ব্যবহার করতে দেখা যাবে, অতঃপর লাভ-ক্ষতির বাছ বিচার না করে লাভজনক-অলাভজনক সব রকম কাজে তারা পুঁজি বিনিয়োগ করতে থাকবে।
চারঃ ঋণ মানুষের জীবনের অপরিহার্য প্রয়োজনের অংগীভূত। ব্যক্তির নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারে এর প্রয়োজন দেখা দেয়, ব্যবসায়ী প্রায়ই এর মুখাপেক্ষী থাকে এবং সরকারী কাজ-কর্মও এর সাহায্য ছাড়া চলতে পারে না। নিছক দান-খয়রাত হিসেবে এত ব্যাপকভাবে ও বিপুলাকারে ঋণ সরবরাহ করা কেমন করে সম্ভব? যদি পুঁজিপতিদেরকে সুদের লোভ দেখানো না হয় এবং মূলধনের সাথে সাথে সুদটাও তারা নিয়মিতভাবে পেতে থাকবে, এ নিশ্চয়তা তাদেরকে দান না করা হয় তাহলে তারা খুব কমই ঋণ দিতে উদ্বুদ্ধ হবে। এভাবে ঋণ দেয়া বন্ধ হয়ে গেলে সমগ্র অর্থনৈতিক জীবনের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। এক দরিদ্র ব্যক্তি নিজের দুঃসময়ে মহাজনের নিকট থেকে ঋণ লাভ করে। এক্ষেত্রে সুদের লোভ না থাকলে তার আত্মীয়ের লাশ বিনা কাফনে-দাফনে পড়ে থাকবে এবং কেউ তার দিকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করবে না। এক ব্যবসায়ী নিজের দৈন্য ও সংকটকালে প্রয়োজনের সাথে সাথেই সুদে ঋণ লাভ করে এবং এভাবে তার কাজ চলতে থাকে। এ দুয়ারটি বন্ধ হয়ে গেলে কতবার যে সে দেউলিয়া হবে তা কল্পনাই করা যায় না। রাষ্ট্রের ব্যাপারেও একই কথা বলা যায়। সুদী ঋণের সাহায্যেই রাষ্ট্রের প্রয়োজন পূর্ণ হয়। অন্যথায় প্রতিদিন তাকে কোটি কোটি টাকা ঋণ দান করবে এমন দাতা হাতেম কোথায় পাওয়া যাবে?
সুদ কি যথার্থই প্রয়োজনীয় ও উপকারী?
এবার আমরা উপরোল্লিখিত লাভ ও প্রয়োজনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখবো, এগুলো যথার্থই লাভ ও প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত কিনা অথবা নিছক শয়তানী প্রতারণা।
এ ব্যপারে প্রথম ভুল ধারণা হচ্ছে, অর্থনৈতিক জীবনের জন্য ব্যক্তির স্বল্প ব্যয় ও অর্থ সঞ্চয়কে একটি প্রয়োজনীয় ও লাভজনক বিষয় মনে করা হয়েছে। অথচ আসল ব্যাপার এর সম্পূর্ণ উল্টো। প্রকৃতপক্ষে অর্থনৈতিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির মূল অন্যত্র প্রোথিত রয়েছে। মানুষের একটি দল সমষ্টিগতভাবে জীবনযাপনের যেসব উপকরণ তৈরী করতে থাকবে তা অতি দ্রুত বিক্রি হতে থাকবে, এর ফলে পণ্য উৎপাদন ও বাজারের চাহিদা পূরণের কাজ চক্রাকারে ভারসাম্য বজায় রেখে দ্রুততার সাথে চলতে থাকবে। এভাবেই অর্থনৈতিক উন্নতি ও সমৃদ্ধি আসতে পারে। এ অবস্থা কেবল তখনই সৃষ্টি হতে পারে যখন লোকেরা সাধারণভাবে অর্থনৈতিক প্রচেষ্টা ও কর্মরত অবস্থায় যে পরিমাণ ধনসম্পদ তাদের অংশে আসে তা ব্যয় করতে অভ্যস্ত হয় এবং এতটা প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী হয়, যার ফলে তাদের নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ জমা হয়ে গেলে দলের অপেক্ষাকৃত কম ভাগ্যবান লোকদের নিকত তা স্থানান্তর করে, ফলে তারাও অনায়াসে প্রচুর পরিমাণে নিজেদের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে পারে। কিন্তু এর বিপরীত পক্ষে এখানে যা শিখানো হচ্ছে তা হচ্ছে এই যে, যার নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ পৌঁছে গেছে তাকে কৃপণতা অবলম্বন করতে হবে (যাকে আত্মসংযম ও ইচ্ছা-বাসনার কুরবানী প্রভৃতি শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে) নিজের সংগত প্রয়োজনের একটা বড় অংশ পূর্ণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং এভাবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে বেশী বেশী করে অর্থ সঞ্চয় করার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু আসলে এর ফলে একটি বড় রকমের ক্ষতি হবে। তাহচ্ছে এই যে, বর্তমানে বাজারে যে পণ্য মওযুদ রয়েছে তার একটি বড় অংশ অবিক্রীত থেকে যাবে। কারণ যাদের মধ্যে পূর্ব থেকেই ক্রয় ক্ষমতা কম ছিল তারা অক্ষমতার কারণে অনেক পণ্য কিনতে পারেনি আর যারা প্রয়োজন পরিমাণ পণ্য কিনতে পারত তারা সক্ষমতা সত্ত্বেও উৎপাদিত পণ্যের একটি বড় অংশ ক্রয় করেনি। আবার যাদের নিকট প্রয়োজনের চাইতে বেশী ক্রয়ক্ষমতার পৌঁছে গিয়েছিল তারা তা অন্যের নিকট স্থানান্তর করার পরিবর্তে নিজের নিকট আটক রেখেছিল। এখন যদি প্রতিটি অর্থনৈতিক আবর্তনের ক্ষেত্রে এ ধারা অব্যাহত থাকে এবং প্রয়োজন পরিমাণ ও প্রয়োজনের অধিক পরিমাণ ক্রয় ক্ষমতার অধিকারীরা নিজেদের এ ক্ষমতার বৃহত্তর অংশ উৎপাদিত পণ্য ক্রয়-ব্যবহার না করে এবং কম ক্রয় ক্ষমতার অধিকারীদেরকেও না দেয় বরং একে আটক করে সঞ্চয় করতে থাকে তাহলে এর ফলে প্রতিটি আবর্তনে দলের অর্থনৈতিক উৎপাদনের বিরাট অংশ অবিক্রীত থেকে যেতে থাকবে। পণ্যের চাহিদা কম হবার কারণে উপার্জনও কমে যাবে। উপার্জন কম হলে আমদানীও কমে যাবে। আর আমদানী কম হয়ে গেলে ব্যবসায় পণ্যের চাহিদা আরো বেশী কমে যেতে থাকবে। এভাবে কয়েক ব্যাক্তির অর্থ সঞ্চয় প্রবণতা বহু ব্যক্তির অর্থনৈতিক দূরবস্থার কারণে পরিণত হবে। অবশেষে এ অবস্থা ঐ অর্থ সঞ্চয়কারীদের জন্যও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে। কারণ যে অর্থের সাহায্যে উৎপন্নজাত দ্রব্যাদি কেনার পরিবর্তে সে তাকে যক্ষেরধনের মতো আগলিয়ে রেখাছে এবং তিলে তিলে বাড়িয়ে চলছে পণ্যদ্রব্য তৈরী করার জন্য, অবশেষে ঐ পণ্যদ্রব্য তৈরী হলে তা কিনবে কে?
এ বিষটি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করলে বুঝা যাবে, যে সমস্ত কারণে ব্যক্তি নিজের উপার্জিত অর্থ ব্যয় না করে সঞ্চয় করে রাখতে উদ্যোগী হয় সে কারণগুলো দূর করাই হচ্ছে আসল অর্থনৈতিক প্রয়োজন। সমগ্র সমাজের অর্থনৈতিক কল্যাণার্থে একদিকে এমন ব্যবস্থা করা প্রয়োজন যার ফলে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের দুঃসময়ে আর্থিক সাহায্য লাভ করতে পারে; এভাবে লোকেরা নিজেদের উপার্জিত অর্থ জমা করার প্রয়োজন অনুভব করবে না, অন্যদিকে সঞ্চিত অর্থের উপর যাকাত আরোপ করতে হবে, এর ফলে মানুষের মধ্যে অর্থ জমা করার প্রবণতা কমে যাবে। এরপরও যে অর্থ-সম্পদ সঞ্চিত হতে থাকবে তা থেকে অবশ্যই অর্থের আবর্তনে যারা কম অংশ পেয়েছে তাদেরকে একটি অংশ দিতে হবে। কিন্তু এর বিপরীত পক্ষে এখানে সুদের লোভ দেখিয়ে মানুষের প্রকৃতিগত কার্পণ্যকে উস্কানী দেয়া হচ্ছে এবং যারা কৃপণ নয় তাদেরকেও অর্থ ব্যয় করার পরিবর্তে সঞ্চয়ের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। অতঃপর এ ভুল পদ্ধতিতে সামষ্টিক স্বার্থের বিরুদ্ধে যে পুঁজি একত্রিত হয় তাকে অর্থ উৎপাদনকারী ব্যবসায়ের দিকে আনা হলেও সুদের ভিত্তিতে আনা হয়। সামষ্টিক স্বার্থের উপরে এটি দ্বিতীয় দফা অত্যাচার। এ সঞ্চিত অর্থ যদি এমন এক শর্তে ব্যবসায়ে খাটানো হত যেখানে অর্জিত মুনাফার হার অনুযায়ী পুঁজিপতিও তার অংশ লাভ করতো তাহলেও কোনো প্রশ্ন ছিলনা। কিন্তু এ সঞ্চিত অর্থ এমন এক শর্তে বাজারে ছাড়া হচ্ছে যার ফলে ব্যবসায়ে লাভ হোক বা না হোক এবং কম মুনাফা বা বেশী মুনাফা-তাতে পুঁজিপতির কিছু আসে যায় না, সে তার নির্ধারিত হার অনুযায়ী মুনাফা অবশ্যি পেতে থাকবে। এভাবে সামষ্টিক অর্থব্যবস্থাকে দুদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। একদিকে টাকা উপার্জন করে তা ব্যয় না করার ও জমা করে রাখার ক্ষতি এবং অন্যদিকে যে টাকা জমা করে রাখা হয়েছিল তা সামষ্টিক অর্থব্যবস্থার সাথে যুক্ত হলেও অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসায় শামিল না হয়ে ঋণ আকারে সমগ্র সমাজের শিল্প ও ব্যবসায়ের ঘাড়ে চেপে বসেছে এবং প্রচলিত আইন তাকে নিশ্চিত মুনাফার জামানত দান করেছে। এ ভ্রান্ত ব্যবস্থাপনা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যার ফলে সমাজের বিপুলসংখ্যক লোক তাদের ক্রয়ক্ষমতা সামগ্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যাদি ক্রয়ের কাজে ব্যবহার করার পরিবর্তে তা সঞ্চিত করে ক্রমান্বয়ে সুদ ভিত্তিক ঋণের আকারে সমাজের মাথায় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ পরিস্থিতি সমাজকে মহাসংকটের সম্মুখীন করেছে। প্রতি মুর্হূতে তার সুদ ও ঋণের বোঝা বেড়ে যাচ্ছে। যে ক্ষেত্রে বাজারে তার উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা কম,ক্রেতার সংখ্যা কম,লাখো লাখো কোটি কোটি লোক নিজেদের অক্ষমতা ও অর্থ না থাকার দরুন তা কিনতে পারছে না। আবার হাজার হাজার লোক নিজেদের ক্রয়ক্ষমতাকে বেশী সুদে ঋণ দেয়ার জন্য সঞ্চিত রেখে তা কেনার ব্যাপারে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে,সে ক্ষেত্রে এ বর্ধিত ঋণ ও সুদ সে কিভাবে আদায় করবে?
সুদের উপকারিতা ও লাভজনক দিক সর্ম্পকে বলা হয়ে থাকে, এর চাপে ব্যবসায়ী পুঁজির যত্রতত্র অযথা ও অলাভজনক ব্যবহার না করে অধিকতর লাভজনক কাজে তা ব্যবহার করে। বলা হয়ে থাকে সুদের হার তার অলৌকিক ক্ষমতার সাহায্যে নীরবে ব্যবসায়ের পথ নির্দেশ করার মহাদায়িত্ব পালন করে এবং এরি বদৌলতইে পুঁজি তার চলার সম্ভাব্য সকল পথের মধ্য থেকে ছাঁটাই-বাছাই করে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসায়ে নিজেকে নিয়োজিত করে। কিন্তু এ সুন্দর কথার পর্দা সরিয়ে ভিতরে উঁকি দিলে এর আসল উদ্দেশ্য ধরা পড়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে সুদের প্রথম কৃতিত্ব হচ্ছে এই যে,তার বদৌলতে উপকার ও লাভ এর সমস্ত ব্যাখ্যাই পরিত্যক্ত হয়েছে এবং ঐ শব্দগুলোর কেবল একটিমাত্র অর্থই রয়ে গেছে,তা হচ্ছে ‘অর্থনৈতিক উপকার’ ও ‘বস্তুগত লাভ’। এভাবে পুঁজি বিরাট একাগ্রতা লাভে সক্ষম হয়েছে। প্রথমে অর্থনৈতিক লাভ ছাড়া অন্য ধরনের লাভের পথেও পুঁজির আনাগোনা হতো। কিন্তু এখন তার লক্ষ্য একটি মাত্র পথের দিকে। অর্থাৎ যে পথে অর্থনৈতিক লাভ ও সুবিধা নিশ্চিত একমাত্র সে পথেই তার গতি নিয়ন্ত্রিত। অতপর তার দ্বিতীয় কৃতিত্ব হচ্ছে যে, সমাজের লাভ বা স্বার্থোদ্বার নয় বরং কেবলমাত্র পুঁজিপতির লাভ ও সীমিত স্বার্থোদ্ধারকেই সে পুঁজির লাভজনক ব্যবহারের মানদন্ডে পরিণত করেছ। পুঁজির হার স্থির করে দেয় যে,পুঁজি এমন একটি কাজে ব্যবহৃত হবে যা পুঁজিপতিকে বার্ষিক শতকরা ৬ বা এর চেয়ে বেশী হারে মুনাফা দিতে সক্ষম। এর চেয়ে কম মুনাফাদানকারী কোনো কাজে পুঁজি খাটানোর কোনো যৌক্তিকতাই নেই। এখন মনে করুন,পুঁজির সামনে দুটো পরিকল্পনা পেশ করা হলো। একটা পরিকল্পনা হলো এমন কতকগুলো আবাসিক গৃহ নির্মানের, যেগুলো আরামদায়ক হবার সাথে সাথে গরীব লোকেরা কম ভাড়ায় নিতে পারবে। দ্বিতীয় পরিকল্পনাটি হলো একটি বিরাট জাঁকালো প্রোক্ষাগৃহ নির্মাণের। প্রথম পরিকল্পনাটি শতকরা ৬ ভাগের কম মুনাফাদানের আশা দেয় আর দ্বিতীয়টি দেয় এর চেয়ে বেশী। অন্য কোনো অবস্থায় অজ্ঞতাবশত প্রথম পরিকল্পনাটির দিকে পুঁজির প্রবাহিত হবার সম্ভাবনা ছিল বা অন্তত:পক্ষে এ দুটোর মধ্যে কোনটার দিকে সে ঝুঁকবে তা নিয়ে তাকে যথেষ্ঠ সংশয় দোলায় দুলতে হতো। কিন্তু সুদের হারের এমনি মাহাত্ম যে তার নির্দেশে পুঁজি কোনো প্রকার দ্বিধা না করে সুড়সুড় করে দ্বিতীয় পরিকল্পনার দিকে অগ্রসর হয় এবং প্রথম পরিকল্পনাটিকে নির্দয়ভাবে পিছনে নিক্ষেপ করে। তার দিকে একবার ফিরেও তাকায় না। উপরন্তু সুদের হার ব্যবসায়ীকে এমনভাবে বাধ্য করে যার ফলে সে নিজের মুনাফাকে সমসময় পুঁজিপতি নির্ধারিত মুনাফার সীমারেখা থেকে উচ্চে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। এজন্য সে যে কোন নৈতিকতা বিরোধী পদ্ধতি অবলম্বন করতে কুন্ঠিত হয় না। যেমন, মনে করুন এক ব্যক্তি একটি চলচ্চিত্র কোম্পানী গঠন করলো। এ কোম্পানীতে সে যে পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ করেছে তার সুদের হার হচ্ছে বছরে শতকরা ৬ ভাগ। এ ক্ষেত্রে তাকে অবশ্যি এমন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে যার ফলে তার লাভের হার ঐ শতকরা ৬ ভাগের চেয়ে বেশী হয়। নৈতিক পবিত্রতার অধিকারী ও তত্ত্ব-জ্ঞান সমৃদ্ধ নির্মাণে যদি তার এ উদ্দেশ্য সফল না হয় তাহলে অবশ্যি সে উলংগ ও অশ্লীল চিত্র নির্মাণে উদ্যোগী হবে এবং এমনভাবে এর বিজ্ঞাপন ছড়াতে ও প্রপাগান্ডা করতে থাকে যার ফলে মানুষ আবেগে ফেটে পড়বে এবং যৌন উত্তেজনার প্রবল স্রোতে প্রবাহিত হয়ে হাজার হাজার লাখো লাখো মানুষ পেক্ষাগৃহের দিকে ছুটবে।
সুদের সাহায্য ছাড়া যেসব লাভ ও উপকার সাধিত হওয়ার কোনো উপায় নেই সেগুলোর আসল চেহারা উপরে বিবৃত হলো। এখন সুদের সাহায্য ছাড়া যেসব প্রয়োজন পূর্ণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই সেগুলোর কিছু বিশ্লেষণ আমরা করতে চাই। নিসন্দেহে ঋণ মানুষের জীবনের অপিরিহার্য প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত। মানুষের নিজের ব্যক্তিগত অভাব পূরণে ঋণের প্রয়োজন হয় আবার শিল্প,ব্যবসায়,কৃষি প্রভৃতি কাজ-কারবারেও সবসময় এর প্রয়োজন দেখা দেয় এবং রাষ্ট্রসহ সমস্ত সামাজিক প্রতিষ্ঠান এর মুখাপেক্ষী থাকে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও একথা ঠিক নয় যে, সুদ ছাড়া ঋণ সংগ্রহ করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। আসলে সুদকে আইনসংগত গন্য করার কারণে ব্যক্তি থেকে নিয়ে রাষ্ট্র পর্যন্ত সকল পর্যায়ে সুদ ছাড়া এক পয়সাও ঋণ লাভ করা কারোর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। সুদকে হারাম গণ্য করে অর্থনীতির সাথে সাথে ইসলাম নির্দেশিত নৈতিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করলে আজই দেখা যাবে ব্যক্তিগত অভাব, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামাজিক প্রয়োজনের সকল ক্ষেত্রে সুদ বিহীন ঋণ পাওয়া যাচ্ছে বরং অনেক ক্ষেত্রে দানও পাওয়া যাবে। ইসলাম কার্যত এর প্রমাণ পেশ করেছে। শত শত বছর ধরে মুসলমান সমাজ সুদ ছাড়াই উত্তম পদ্ধতিতে নিজেদের সমস্ত অর্থনৈতিক কাজ-কারবার চালিয়ে এসেছে। সুদ ব্যবস্থা লাঞ্ছিত আজকের এ ঘৃণিত যুগের পূর্বে মুসলমান সমাজ কোনদিন কল্পনাই করতে পারত না যে, সুদ বিহীন ঋণ লাভ করা কোনোক্রমেই সম্ভব না হওয়ার কারণে কোনো মুসলমানের লাশ কাফন-দাফন করা হয়নি বা ব্যবসায়িক প্রয়োজন অনুযায়ী কর্জে হাসানা না পাওয়ার কারণে মুসলমানদের শিল্প-ঋণ দিতে রাজী না হওয়ায় কোনো মুসলিম সরকার কল্যাণমূলক কাজে বা জিহাদে অর্থ ব্যয় করতে সক্ষম হয়নি। কাজেই কর্জে হাসানার পরিকল্পনা কার্যকর করার যোগ্য নয় এবং ঋণের সমগ্র প্রাসাদটিই সুদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, দাবী কোনো প্রকার যুক্তি ভিত্তিক প্রতিবাদের মুখাপেক্ষী নয়। আমরা নিজেদের শত শত বছরের কার্যধারার মাধ্যমে একে ভ্রান্ত প্রমাণ করে এসেছি।
আধুনিক যুগের অর্থনৈতিক প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে কার্যত সুদ বিহীন ঋণ লাভের জন্য কি পদ্ধতি অবলম্বিত হবে তা আমাদের এ অধ্যায়ের আলোচনা বহির্ভূত বিষয়। পরবর্তী এক অধ্যায়ে আমরা এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
———–