মাওলানার দ্বিতীয় প্রবন্ধ
(মাওলানা গিলানীর উপরোক্ত প্রবন্ধ প্রকাশিত হবার পর কোনো কোন আলেম যে প্রতিবাদ জানান তার জবাবে মাওলানা নিম্নের প্রবন্ধটি লিখেন-সংকলক।)
একঃ বিষয়টির ব্যাখ্যায় কিছু অসতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে যার জন্যে ভুল বুঝাবুঝির আশংকা আছে। লিখা হয়েছে যে, অনৈসলামী রাষ্ট্রে সুদ আর সুদ থাকে না ইত্যাদি। তার অর্থ দাঁড়ায় যে, হানাফী ফিকাহ অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে- সে মুসলিম হোক অথবা অমুসলিম- এ ধরনের কারবার জায়েয এবং তাদের ধন-সম্পদ রক্ষিত ও হালাল হয়ে যায়। অথচ বলার উদ্দেশ্য তা নয়। বরঞ্চ এ বিধান শুধু অমুসলিম জাতি যথা ইয়াহুদী, নাসারা, অগ্নি উপাসক, হিন্দু প্রভৃতির জন্যে নির্দিষ্ট যাদের দায়িত্ব কোনো ইসলামী রাষ্ট্র গ্রহণ করেনি। আমি আমার দাবীর সমর্থনে ইমাম মুহম্মদের সিয়ারে কবীরের বিখ্যাত ফতোয়া উদ্ধৃত করেছি। চূড়ান্ত নিশ্চয়তার জন্যে এ আইনের নিম্নলিখিত ধারা উদ্ধৃত করছিঃ
(আরবী********)
“এ কারবার যদি দুজন মুসলমানের মধ্যে হয়, যারা নিরাপত্তা চুক্তির মাধ্যমে দারুল হরবে বসবাস করে, অথবা যদি তারা কয়েদী হয়ে, তাহলে তা বাতিল ও পরিত্যক্ত হবে। কারণ তারা উভয়েই সর্বত্র ইসলামী আইন মেনে চলার জন্যে দায়ী।”১.[এর দ্বারা শুধু এতটুকু প্রমাণিত হয় যে, ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক অপর রাষ্ট্রে একে অপরের কাছ থেকে সুদ নিতে পারবে না। কিন্তু দারুল ইসলামের নাগরিকদের মধ্যে কোনো মুসলমান যদি নিরাপত্তা সহ দারুল হরবে যায়, তাহলে সে দারুল হরবের মুসলিম অধিবাসীর কাছ থেকে সুদ নিতে পারবে। কেননা হানাফী ফেকাহের মতে কাফের হরবীর মতো ঐ মুসলমানের সম্পদও রক্ষিত নয়। যাহরুর রায়েতে আছেঃ
(আরবী***********)
“দারুল হরবে যে ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং হিজরত করেনি সে আবু হানিফার মতে হরবী সমতুল্য। কারণ তাঁর মাল অরক্ষিত। সুতরাং তার কাছ থেকে সুদ নেয়া মুসলিমের জন্য জায়েয।”
এ দিক দিয়ে মাওলানার ব্যাক্যা অনুযায়ী যদি ভারত দারুল হরব হয়, তাহলে সীমান্তের পাঠানদের জন্যে ভারতে শুধু হিন্দুর নিকট থেকে নয়। বরঞ্চ মুসলমানের নিকট থেকে সুদ নেয়াও হালাল ও পবিত্র হবে। শুধু তাই নয়, বরঞ্চ তারা এখানে মুসলমানদের সাথে জুয়াও খেলতে পারে এবং হারাম জিনিস তাদরে কাছে বিক্রী করতে পারে।–(মওদূদী)]
কয়েদী অথবা বন্দীর জন্যে ফেকাহর দৃষ্টিতে এমন প্রয়োজন যে, তাকে জেলখানায় থাকতে হবে। কিন্তু কোন দেশে বিনা অনুমতিতে বা পাসপোর্টে যেতে পারে না।– এমর প্রত্যেক ব্যক্তিই বন্দি।২.[বন্দীর সংজ্ঞা যদি মাত্র এতটুকু হয়, তাহলে ভারতের সকল মুসলসানই নিরাপত্তাপ্রাপ্ত নয়, বরঞ্চ বন্দী বলেই পরিগণিত হবে। আর যুদ্ধ বন্দীদের জন্যে দেশের আইন মেনে চলাও অপরিহার্য নয়। সে চুরী, হত্যা এবং ঘুষ প্রদানের কাজ করতে পারে।] যথাসময়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
দুইঃ দ্বিতীয় কথা এই যে, নিসন্দেহে আমি তাড়াহুড়ার মধ্যে এ প্রবন্ধ লিখেছি এবং প্রকাশিত হবার আগে কারো সাথে পরামর্শও করতে পারিনি। আমার এ ত্রুটি আমি স্বীকার করছি। কিন্তু আমি যেসব চিন্তা ও ধারণায় অনুপ্রাণিত হয়ে এ প্রবন্ধ লিখেছিলাম তা সর্বজ্ঞ আল্লাহ তায়ালা অবগত আছেন। এছাড়া বিষয়টির বুনিয়াদ যেসব ক্ষেত্রের উপর তাহলো দুটি। এক. ভারত দারুল কুফর, দ্বিতীয়. দারুল কুফরে অবৈধ উপায়ে অরক্ষিত সম্পদ ইসলাম অনুযায়ী হালাল। এ দুটোর মধ্যে প্রথমটি সম্পর্কে আমি ভারতের অধিকাংশ নির্ভরযোগ্য আলেম, মনীষী, ও ধর্মভীরু, ব্যক্তিগণকে একমত পেয়েছি। অবশ্য দ্বিতীয় বিষয়টি সম্পর্কে ঐ সকল প্রসিদ্ধ আলেমের সাথে বিশদভাবে আলোচনা করতে পারিনি, যাঁদের নাম আপনি উল্লেখ করেছেন এবং যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই আমার ওস্তাদ এবং ওস্তাদ শ্রেণীর। শুধু মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেবের অভিমত আমি জানতে পেরেছি।
তিনি এ মাসয়ালাটির ব্যাপারে হানাফি ফেকাহর এসব খুঁটিনাটি সম্পর্কে নিশ্চিত নন। তিনি ফতোয়া ও তাফসীরে দ্বিতীয়টির নির্ভুল হওয়া সম্পর্কে হাদিস থেকে এবং নীতিগতভাবে আলোচনা করেছেন। কিন্তু যতদূর আমার জানা আছে, ইমাম আবু হানিফা (র)-এর অভিমতকেই আমি কুরআন ও সুন্নাহর সাথে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ পেয়েছি। ইমাম সাহেব উপলব্ধি করেছেন যে, (আরবী******) (নিজেদেরকে হত্যা করো না)-এর প্রকাশ্য বিধান শুধু মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নতুবা জিহাদের বিধান অর্থহীন হয়ে পড়ে। এভাবে, (আরবী******) (তোমাদের ধন-সম্পদ নিজেদের মধ্যে অবৈধ উপায়ে ভক্ষণ করো না) এবং তারই উপ-তপসীল (আরবী******) (সুদ খেয়ো না)-এর প্রকাশ্য সাধারণ বিধান শুধু মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট। ১.[মাওলানার একথায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, রক্তের সম্মান, অর্থ-উপার্জনে হালাল-হারামের পার্তক্য এবং সুদের অবৈধতা প্রভৃতি সবকিছুই মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যেই সীমিত। ইসলামের গণ্ডির বাইরে অমুসলিমদের রক্তের না কোনো মর্যাদা আছে, আর না তাদের সাথে আর্থিক লেনদেনে হালাল-হারামের ভেদাভেদ। এর চেয়ে ইসলামী আইনের অপব্যাখ্যা আর কিছু হতে পারে না।
কুরআনে এরশাদ করা হয়েছেঃ
(আরবী**********)
“আল্লাহ যে প্রাণ হত্যা হারাম করেছেন হক ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে তা হত্যা করো না।” এ আয়াত অনুযায়ী, প্রত্যেক মানুষের জীবন সম্মানযোগ্য। তা হত্যা করা বৈধ একমাত্র তখনই হতে পারে যদি ‘হকের’ উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। জিহাদের সময় এ হারাম হকের জন্যে হালাল হয়ে যায়, যেমন ধারা ‘কিসাসে’ স্বয়ং মুসলমানের খুদ হালাল হয়ে যায়। যদি নীতিগতভাবে ইসলাম কাফের গায়ের জিম্মীকে ‘হরবী’ ঘোষনা করে থাকে, তাহলে তার অর্থ এই নয় যে, ইমাম এবং জামায়াত থেকে আলাদা হয়ে প্রতিটি মুসলমান প্রতিটি গায়ের জিম্মী কাফেরকে যখন খুশী তখন হত্যা করে ‘হক’ কায়েম করবে এবং ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করবে। যদি এমন হয় তাহলে একজন মুসলমান ও একজন রক্ত পিপাসু দস্যুর (Anarchist) মধ্যে কি পার্থক্য থাকে? এমনিভাবে অর্থ ইপার্চন এবং ব্যয়ের যে পন্থাসমূহ ইসলাম হারাম করেছে, তা সবই অকাট্য হারাম। এর মধ্যে এ ধরনের কোনো পার্থক্য হতে পারে না যে, মুসলমানদের নিকট থেকে সম্পদ গ্রহণের যে পন্থা হারাম, কাফেরের নিকট থেকে সম্পদ গ্রহণের সেই পন্থা হালাল। আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী*********)
“তোমাদের মাল তোমরা তোমাদের মধ্যে অবৈধ উপায়ে ভক্ষণ করো না এবং অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদের কিছুটা লাভ করার জন্যে বিচারকের কাছে (মিথ্যা) মামলা দায়ের করো না। অথচ তোমরা জান (যে এ মামলা অন্যায়ভাবে করা হচ্ছে)।”-(সূরা আল বাকারাঃ ১৮৮)
(আরবী***********)
“আল্লাহ কেনা-বেচা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।”
এবং আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী*********)
“নিশ্চয় মদ, জুয়া, দেবমূর্তি, তীরের সাহায্যে জুয়া প্রভৃতি অপবিত্র কাজ এবং শয়তানের কাজের মধ্যে শামিল।”-(সূরা আল মায়েদাঃ ৯০)
এসব বিধানের মধ্যে কোনটিকে শুধুমাত্র মুসলমানদের কায়-কারবারের সাথে নির্দিষ্ট করা যেতে পারে? মুসলমানদের রীতিনীতি যদি এই হয় যে, মদকে হারামও বলবে, ওদিকে অমুসলিমদের কাছে তা বিক্রিও করবে, জুয়া হারাম বলবে আর অমুসলিম জাতির সাথে জুয়া খেলবে, শূকর হারামও বরবে, শূকর ভক্ষণকারীদের কাছে কা বিক্রিএ করবে, একদিকে সুদ হারাম হবার কথা বক্তৃতার মাধ্যমে বলে বেড়াবে, আর অন্যদিক থেকে অমুসলিম জাতির সাথে সুদী লেনদেনকে হালাল এবং পবিত্র বলবে, তাহলে দীন ইলাম একটি হাস্যষ্পদ বস্ততে পরিণত হবে এবং কোনো বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি এমন ধর্ম গ্রহণ করতে অগ্রসর হবে না। দুঃখের বিষয় এই যে, মাওলানা এ ধরনের অপব্যাখ্যঅকে ইমাম আবু হানিফার উপর আরোপ করেছেন। অথচ এসব সাধারণ বিধানের মধ্যে তিনি যে ব্যতিক্রম নির্ধারণ করেছেন, তা শুধু বিশেষভাবে সামরিক প্রয়োজনে শুধু ওদের জন্যে যারা যুদ্ধে লিপ্ত। এর উদ্দেশ্য এটা কথনই নয় যে, মুসলমানদের সকল জনপদগুলো স্থায়ীভাবে অপর জাতির সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে হালাল হারামের পার্থক্য মিটিয়ে দেবে এবং বংশানুক্রমে এই হারামখুরীতে জীবন কাটিয়ে দেবে।–(মওদূদী)]
বিশেষ করে যখন নিষিদ্ধ মালের বিধান নিষিদ্ধ জ্ঞাপক শব্দে (আরবী****) শব্দ দ্বারা ব্যাখ্যা করা
হয়েছে, তখন সে আইন হত্যা আইনের ব্যাপকতার চেয়ে আরও
অধিকতর নির্দিষ্ট হয়ে গেল। এ সত্য কথা যে, সুদের বিধানটি বড় কঠোর। কুরআন এক ব্যক্তির হত্যাকে মানব জাতির হত্যার সমতুল্য বলে বর্ণনা করেছে যার শাস্তিস্বরূপ চিরকাল জাহান্নামের অগ্নির ভীতি প্রদশূন করা হয়েছে। কিন্তু কে জানে না যে, এ কঠোর আইনের একটা দিক [ইমাম আবু হানিফা (র)-এর মতে থাহলো সম্পত সম্পর্কিত।] বড় সওয়াবের বলে উল্লেখ করা হয়েছে?
ইমাম সাহেবই বা করবেন কি? কুরআনে বলা হয়েছেঃ
(আরবী************)
“আল্লাহ তোমাদেরকে বহু গণিমতের মালের ওয়াদা করেছেন যা তোমরা পাবে।-(সূরা আল ফাতহঃ ২০)”
এর অর্থ কি এই যে, এসব সম্পদ মুসলমানগণ খরিদ করে নিবে? অথবা তা কি উত্তরাধিকার সুত্রে পাবে, না তাদেরকে কেউ ‘হেবা’ করে দেবে?
তারপর বলপ্রয়োগ নয়,বিনা বলপ্রয়োগেই যে সম্পদ পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে বিধান এই যে,তা এমন বস্তু যেমনঃ
(আরবী***********)
“আল্লাহ তাঁর রসূলকে তাদের নিকট থেকে ‘ দান করেছেন যা কিছু হিসেবে ‘ফাই’ তাঁর জন্যে তোমরা উট অথবা ঘোড়া (যুদ্ধের আকারে) ব্যবহার করনি। আল্লাহ তাঁর রাসুলগণকে যাদর উপর ইচ্ছা করেন বিজয়ী করে দেন।“ –(সুরা আল হাশরঃ ৬)
শুধু যুদ্ধকালেই এ প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়নি। বরঞ্চ সকলেরই জানা আছে যেঃ
(আরবী***********)
“যখন আল্লাহ তায়ালা দুটো দলর মধ্যে একটি সম্পর্কে এ ওয়াদা করেছিলেন যে, এ তোমাদের জন্য।’
কে না জানে যে এ দুটো দলের মধ্যে আল্লাহ ঐ দলটির ওয়াদা করে ছিল যা (আরবী**) অর্থাৎ বানিজ্য কাফেলা ছিলো? কি ওয়াদা করেছিলেন? তাই এ (আরবী*****)অর্থাৎ তা তোমাদের জন্য।ব্যবসা বানিজ্য ‘হেবা’ দান,সদকাখয়রাত অথবা অন্য কোনো উপায়ে কি তা হস্তগত করার জন্যে মুসুলমানদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল?১.[এ কাফেলা ছিল একটি যুদ্ধরত জাতির,যদিও কাফেলাটি যুদ্ধ করছিল না। শত্রুর বানিজ্যে বাধা সৃষ্টি করা,তাদের বানিজ্য জাহাজ অথবা কাফেলা আটক করা,তাদের ধন-সম্পদ হস্তগত করা যুদ্ধ আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ জায়েয। রসূলুল্লাহ (স) এর সময়ে একমাত্র যুদ্ধের অবস্থা ব্যতীত অন্য সময়ে গায়ের জিম্মী কাফেরদের রক্ত ও মাল হালাল করা হয়েছে এবং ব্যক্তিগত ভাবে প্রত্যেক মুসুলমানকে এ অধিকার দেয়া হয়েছে যে,যেখানে যে গায়েব জিম্মীকে পাওয়া যাবে সেখানেই তাকে লুন্ঠন করা হবে। এমন কোনো দৃষ্টান্ত মাওলানার জানা থাকলে তা পেশ করুন। – মওদুদী]
মুসুলমানদের জন্যে সম্পদ লাভের এই পন্থাই যদি নির্ধারণ করে দেয়া হয়,তাহলে তাকি অবৈধ পন্থা এবং ****র অন্তর্ভুক্ত হবে না? বুখারীতে আছে যে হুদায়বিয়ার সন্ধি অনুযায়ী,সাহাবী আবু বাসীর (রা)-
কে যখন মদিনায় থাকার অনুমতি দেয়া হলোনা, তখন তিনি করেকজন সংগী সাথীসহ সমুদ্র তীরে অবস্থান করতে লাগলেন। তার কাজ কি ছিলো? ইমাম বুখারী বর্ণনা করেনঃ
(আরবী*************)
“আল্লাহর কসম যখনই তারা শুনতেন যে, কুরাইশদের কোনো বানিজ্য কাফেলা সিরিয়ার দিকে যাচ্ছে, তখন তা আক্রমন করতেন,কাফেলার লোকদের হত্যা করতেন এবং তাদের ধন সম্পদ হস্তগত করতেন”
এর চেয়ে অধিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে কি? কুরআনে তো শুধু (**) কাফেলার ওয়াদা করা হয়েছে। কিন্তু এখানে তো বাস্তবে পরিণত করা হয়েছে। এ বিধান কি হানাফী ফিকাহর,না কুরআনে প্রকাশ্য দলিলের দাবী? আশ্চর্য কথা এই যে,ইমাম সাহেব যে আইনের অধীনে এ ধারা প্রণয়ন করলেন (অর্থাৎ গণিমতের আইন) তা নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েত অনুসারে শুধু মুসুলমানদের জন্যে নির্দিষ্ট মনে করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও লোকে বলে যে যদি সুদের কারবার অন্য জাতির সাথে জায়েয হতো, তাহলে ইয়াহুদীদের সম্পর্কে কুরআনে কেন বলা হয়েছেঃ *********আরবী()’
“এবং ইয়াহুদীদের সুদ নেয়ার কারনে, অথচ তা নিতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল এবং লোকের মাল তাদের অবৈধভাবে ভক্ষণ করার কারনে”।
যখন ইয়াহুদীদের জন্যে গনিমতই হারাম ছিল,তখন কি কারনে তাদের জন্যে সুদ জায়েজ হবে?১.[ইয়াহুদূদের জন্যে গনিমত হালাল হোক বা না হোক,কিন্তু ফাই হওয়াতে কোনো সন্দেহ নাই। কুরআন একথার সাক্ষী— একটা গোটা দেশ আল্লাহ তাদের দেবার ওয়াদা করেছিলেন। একথা সুস্পষ্ট যে, সমুদয় মাল তাদের জন্যে ফাই হবে। নতুবা বলুন প্রতিশ্রুতি দেশের মালের উপর তাদের অধিকার কি করে জায়েয হলো? ক্রয়-বিক্রয়, সদকা অথবা দান তো ছিল না।- (মওদুদী)]
আর যখন এটা প্রমানিত হবে যে,তারা শুধু এমন লোকের সাথে কারবার করতো যারা ইয়াহুদী নয়,তখনই একথা বলা যাবে।২.[এর প্রমানের প্রয়োজন কী? কুরআন তো সাধারনভাবে ******** বলা হয়েছে। আপনার নিজের বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ী যখন ******** বলা হয়নি, তখন তাঁর অর্থ এই হয় যে, তারা ইয়াহুদী অ-ইয়াহুদী সকলের নিকট সুদ খেতো, যেমন ধারা আজ পর্যন্ত খেয়ে আসছে।]]মওদুদী মাওলানা শিবলী তাঁর সীরাত গ্রন্থে আবু দাউদের বর্ণনা বারবার উল্লেখ করছেন। তাঁর থেকে ভুল ধারনা পোষন করা উচিত হবে না। কেননা এ কঠোরগপ্ত ভিত্তি হলো ‘গলুল'(বন্টনের পূর্বেই গনীমতের মাল আত্নসাত করা)। হযরত সামরাহ বিন জুন্দব কাবুলের যুদ্ধে এর বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। আবু লবীদ বর্ণনা করেন- আমরা কাবুলে যুদ্ধে সামরাহ বিন জুন্দবের সাথী ছিলাম। গণিমতের মাল হস্তগত হবার সাথে সাথে লোকে তা লুট করা শুরু করলো। হযরত সামরাহ (রা) বক্তৃতা বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়ে বললেন,আমি নবী (স) এর নিকট শুনেছি,তিনি আত্নসাত করতে নিষেধ করেছেন। তারপর সকলে লুন্ঠিত মাল ফিরিয়ে দিল। অতপর শরীয়ত অনুযায়ী তিনি (জুন্দব) বন্টন করে দিলেন (জমাউলফাওয়ায়েদ)। এতে একথা নেই যে,আসল মালিকদের ফেরত দেওয়া হল। বরঞ্চ বন্টনের পূর্বে আত্নসাত করতে নিষেধ করা হয়। যাকে বলা হয় গুলুল।
“রিবার’বিধান কখন নাযিল হয়েছিল এ বিষয়ে মতভেদ আছে। (আরবী********) অনেক পূর্বে নাযিল হয়েছিলো। কিন্তু একে মদের মো ্রেরণা মূলক নির্দেশ মনে করা যেতে পারে। অতপর সুদের খুঁটিনাটি হারাম কার্যকর করা হয়েছিল সপ্ত হিজরী থেকে। ইমাম মালেরকের মুয়াত্তায় আছে,রসূলুল্লাহ (স) খয়বরে চাঁদির একটি পাত্র বিক্রির ব্যাপারে বলেন,তোমরা উভয়ে সুদী কারবার করেছ। অতপর তা ফেরত দিল।
এর থেকে প্রমানিত হ্য় যে,দারুল ইসলামের এ বিধান সপ্তম হিজরী থেকে কার্যকর হয়েছিল। কিন্তু সমগ্র আরবে কখন কার্যকর হয়েছিল? সকলেই জানেন যে,মক্কা বিজয়ের সময়ে নয়,বরঞ্চ বিদায় হজ্জে জাহেলিয়াত যুগের সুদ বন্ধের ঘোষনা নবী (স) এর পক্ষ থেকে করা হয়েছিলো। এর থেকে কি একথা জানা যায় যে, যে দেশে ইসলামী শাসন কায়েম হয়নি,সেখানে সুদী লেনদেন সে ধরনের হতে পারে না; যেমন হয় ইসলামী শাসন কায়েম হবার পর। ১.[এর থেকে শুধু এতটুকু প্রমানিত হয় যে,মুসুলমানদের কোন দেশে সুদী কারবার বন্ধের সাধারন নির্দেশ একমাত্র তখনি জারী হতে পারে। যখন তারা সে দেশের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার পর অমুসলিমদের প্রতিও তাদের বিধান সমূহ প্রয়োগ করতে সমর্থ হবে। প্রত্যেক বিজ্ঞ ব্যাক্তিই বুঝতে পারেন যে,কোনো দেশের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার পূর্বে সেখানে আইন কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হবে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। নবী (স) এর নিকটে কি করে এ আশা করা যেতে পারে যে,জাহেলিয়াত যুগে সুদী লেনদেনকারীরা তাঁর অধীনতা স্বীকার করার পূর্বেই সে সুদ বন্ধের ঘোষনা করবেন? অবশ্য যারা তাঁর আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন অরথ্যাত মুসুলমান হয়েছিলেন,তাদেরকে তিনি সুদী লেনদেন করতে নিষেধ করেছিলেন, সমগ্র আরব দেশে সুদী কারবার বন্ধ হবার পূর্বেই। -(মওদুদী)] নতুবা,হযরত আব্বাস (রা) তো বিদায় হজ্জের পূর্বেই মুসলমান হয়েছিলেন এবং অন্তত পক্ষে তার সুদ বিদায় হজ্জ বন্ধ হবার পরিবর্তে সপ্তম হিজরীর আগেই বন্ধ হওয়া উচিত ছিলো।২.[হযরত আব্বাস (রা) সম্পর্কে জানা যায় যে,তিনি ইসলাম গ্রহন করার মক্কায় ফিরে যান এবং মুসলমান হবার পরও সেখানে তিনি সুদী কারবার করতেন এটা নবী (স) এর জানা ছিল না।(ইমাম সারাখসীর কিতাবুল মাবসুত ১৪;৫৭ দ্রঃ)নবী (স) কখন তা জানতে পারেন তা বলা যায়না মোটকথা বিদায় হজ্জের সময় যখন আল্লাহর নির্দেশে সুদ নিদ্ধ করার সাধারণ ঘোষণা করেন, তখন সকলের সাথে হযরত আব্বাস (রা)- এর বকেয়া সুদও রহিত করা হয়। এ ঘটণা অকাট্যরুপে প্রমাণ করে না যে, রসুলুল্লাহ (স) আব্বাস (রা) সুদী কারবার জায়েজ রেখেছিলেন।] -(মওদুদী) আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কতিপয় মুসলিম মনীষী বিদায় হজ্জের রেওয়ায়েতের প্রতি সন্দেহ পোষন করে বলেন যে,যদি অমুসলিমগনের নিকট সুদ নেয়া জায়েজ হতো,তাহলে ইসলাম পূর্ব যে বকেয়া সুদ ছিল,তা শরীয়াতের বিধানদাতা কেন রহিত করলেন?
নিশ্চিতরূপে সমস্যা যদি এই হতো যে,শুধু সুদের চুক্তি দ্বারাই সুদের অধিকারী সুদখোর হয়ে যায়,তাহলে প্রশ্ন হতে পারতো যে,একটি প্রতিষ্ঠিত অধিকার রহিত করার অর্থ কী হতে পারে? কিন্তু সমস্যার ভিত্তি এটা নয় যে,সুদের মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। অতএব বৈধতার বিধান বলবৎ থাকবে। দেশ যখন ইসলামী হয়ে যাবে,তখন অরক্ষিত সম্পদ রক্ষিত হয়ে যাবে। তারপর এ রক্ষিতকে কীভাবে অরক্ষিত বলা যাবে?১.[ আর এই কারনেই,নাজরানবাসী ইসলামী রাষ্টের আনুগত্য স্বীকার করার পর এ সুদী কারবার বন্ধ করার নির্দেশ তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল। কারন তাদের দায়িত্ব গ্রহনের চুক্তির পর তাদের সম্পদ রক্ষিত হয়ে গিয়েছিল।
লোক জিজ্ঞাসা করে যে,সাহাবায়ে কেরামের কার্যপ্রানালীর দ্বারা এমন কোন বিশেষ প্রতিক্রিয়া জানতে পারা যায় কি যে,তাঁরা অমুসলিমদের সাথে সুদের কোনো বিশেষ কারবার করেছেন? তার জবাবে ইমাম মুহাম্মদ তাঁর সিয়ারে কবীর গ্রন্থে হযরত আব্বাস (রা) কার্যকলাপ বর্ণনা করেছে,তিনি বলেন, হযরত আব্বাস (রা) মক্কা বিজয়ের পূর্বে এ সুদী কারবারের জন্যে মদীনা থেকে মক্কায় যেতেন এবং তখন পর্যন্ত মক্কা দারুল ইসলামে পরিণত হয়নি।১.[মনে করুন,হযরত আব্বাস (রা) -এর সুদী কাওরবার সম্পর্কে নবী (স) পরিজ্ঞাত ছিলেন,তথাপি মক্কা বিজয়ের পূর্বে পর্যন্ত মক্কা ও তার চতুষ্পারশের সকল গোত্রগুলো মুসুলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। মক্কা বিজয়ের পর যদিও মক্কা ইসলামি রাষ্ট্রের মধ্যে শামিল হয়েছিল,তথাপি তাঁর পার্সবর্তী অঞ্চলসমূহের যে সকল মুশরিক বাস করতো তাদের সাথে যুদ্ধ চলছিল। এ দৃষ্টান্ত বড়জোর একথা প্রমানের জন্যে পেশ করা যেতে পারে যে, যুদ্ধাবস্থায় দুশমনের সাথে অবৈধ চুক্তিতে কাজ চলতে পারে।]-(মওদুদী) এরূপ হাদীসে আছে যে,হযরত আবু বকর (রা) সুদের নয়,জুয়ার কারবার করেছেন এবং বদর যুদ্ধের পর জুয়া লব্দ অর্থ গ্রহন করেন। একথা বলা মুস্কিল যে,তাঁর এ কাজ জুয়ার বিধান নাযিল হওয়ার পূর্বে হয়েছিল২.[এ ‘কাজের অর্থ কি?এর দুতো অংশ—এক,বাজী ধরা। দ্বিতীয়, বাজীর মাল আদায় করা। প্রথম অংশতো নিশ্চয়ই জুয়া হারাম হবার পূর্বেকার। কেননা তাহলো হিজরতের ছয় বছর পূর্বেকার ঘটনা। আজ জুয়া হারাম হবার আয়াত নাযিল হয় হিযরতের পর। এখন রইলো দ্বিতীয় অংশ অরথ্যাত বাজীর উট আদায় করা। এগুলো বদর যুদ্ধের পরের ঘটনা। সম্ভবত জুয়া হারামের বিধান নাযিল হবার পরে রা হয়েছিল। কিন্তু একথার কি জবাব আছে যে, নবী করীম (স) এ মাল আবু বকর (রা) -এর ব্যবহারের অনুমতি না দিয়ে সদকা করে দেয়ার নির্দেশ দেন।] (মওদুদী) কারন একথা ঠিক যে, ইরান রোমের নিকটে পরাজিত হয় সেই সময়ে,যখন কুরাইশগন মসুলমানদের হাতে পরাজিত হয়। এ বাজীর ব্যাপারে হযরত আবু বকর এর প্রতিপক্ষ ছিল উমাইয়া বিন খালফ যে বদর যুদ্ধে নিহত হয়। বাজী ধরা হয়েছিলো একশ উটের। হযরত আবু বকর (রা) নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশদের নিকটে বাজীর উট দাবী করলে তা মেনে নেয়া হয়। তারপর আবু বকর (রা) একশ উট নিয়ে মদীনায় প্রতাবর্তন করেন। একথা ঠিক যে,বদর যুদ্ধের কত পরে এই বাজীর উট আদায় করা হয়েছিল তা সঠিক ভাবে জানা নেই। কিন্তু এটা ধারনার অতীত যে,শোকাবিভূত ও বিক্ষুদ্ধ কুরাইশদের বদরের পরেই এতটা সুবিচার করবে যে,যে বাজী ধরেছিল তাঁর নিকটে নয় বরঞ্চ তাঁর উত্তরাধিকারীর নিকট থেকে একশ উট আদায় করে হযরত আবু বকর কে দিবে। স্পষ্ট মনে হচ্ছে যে,এ বিষয়ে যদি সিন্ধান্ত হয়ে থাকে তাহলে হুদাবিয়ার সন্ধির পরে হয়ে থাকবে। আর এ কথা সর্বজন স্বিকৃত যে মদ ও জুয়া হারামের বিধান নাজিল হয়েছিল ওহোদ যুদ্ধের কাছাকাছি সময়ে। বুখারী থেকে এ কথা প্রমানিত। অতএব বাজীর উট আদায়ের ঘটনা জুয়া হারামের বিধান নাযিলের পরে সংঘটিত হয়েছে বলেই অধিকতর ধারনা করা যায়। ঐতিহাসিক নিরিখে যদি এ ঘটনার অনুসন্ধান কারো অভিপ্রেত হয়,তাহলে মাওলানা শিবলী নোমানীর সিরাতুন্নবী গ্রন্থ থেকে আমার বর্ণনা সত্যতা যাচাই করতে পারেন,বিশেষ করে আরবী ভাষায় যাদের দক্ষতা নাই। মোটকথা সাহাবীদের জীবন চরিত ও কথায় যদি এ নাও থাকে,তবে কি সাহাবীদের কথা থেকে নবী (স) -এর কাজ নয় বরঞ্চ আইন সম্পর্কিত বানী কী অধিকতর শক্তিশালী হবেনা যার বর্ণনাকরী স্য়ং আবু হানিফা (র)? ইমাম শাফেয়ী কাযী আবু ইউসুফের মধ্যস্থতায় ইমাম আবু হানিফা (র) থেকে বর্ণনা করেন
(আরবী**********)
“মকহুল থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী (স) বলেন, মুসলিম ও হরবীর মধ্যে সুদ হয় না।”
আমি স্বীকার করি যে, এ রেওয়ায়েত মুরসাল। কিন্তু সাহাবীদের কথা অনুসন্ধানকারীদের জন্যে মুরসাল হাদীস কি যথেষ্ট নয়? আশ্চর্য কথা এই যে, ইবনে সাদ অথবা ইসাবা থেকে যদি সাহাবীর কোন উদ্ধৃত করা হয় তাহলে লোকে তার মর্যাদা দেয়। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা নিজ বিশ্বাস মতে একটি মরফু-মুরসাল কওলী হাদীস পেশ করলে তা শুধু মুরসাল বলে উড়িয়ে দিতে চায়। এ রেওয়ায়েত সম্পর্কে একথাও বলা হয় যে, এ খবরে ওয়াহেদ। এর দ্বারা কুরআনে সমর্থন নির্দিষ্ট করা জায়েয নয়। কিন্তু কুরআনের সমর্থনও কি এর দ্বারা পাওয়া যায় না? এর মর্যাদা বা গুরুত্ব কি সাহাবাদের কথার সমানও নয়? সম্ভবত এ ব্যাখ্যার পর, এ মাসয়ালাটি শুধু হানাফী ফেকাহর রয়ে যায় না। মোটের উপর আমি আরও বিশদ আলোচনা করতাম, কিন্তু এখন তার সময় নেই। এখন একটু তাদের অপেক্ষায় রয়েছি যারা আবু হানিফা (র)-এর ফতোয়াকে এ মাসয়ালার সাথে মিশ্রিত করতে চায়।
এরপর শাহ্ আবদুল আজীজ দেহলভী (র) তাঁর ফতোয়াসমূহের মধ্যে একাধিক স্থানে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ফতোয়া প্রকাশ করেছেন। যদি তাঁর ফতোয়ার উপর কথা বলা চলে, তাহলে ভারতে কারো কাছে হাদীসের সূত্র সংরক্ষিত থাকতে পারে? জমিয়তুল ওলামার মুখপত্র আল জমিয়তেও এর ফতোয়া প্রকাশিত হয়েছে। দেওবন্দ দারুল উলমের মুফতী সাহেব যে কোন কারণেই হোক ব্যাংকের সুদ গ্রহণ করার ফতোয়া দিয়েছেন। হারাম মাল দিয়ে সদকা করার অনুমতি কে দিতে পারে? যতদূর আমার ধারণা এদের নিকটেও এ মাসায়ালার ব্যাপকতা বিদ্যমান ছিল। অন্তত আমি তাঁদের এ ফতোয়ার কারণ নির্ণয়ে অক্ষম। মাওলানা আবদুল হাই মরহুম তাঁর ফতোয়ায় যদি ভারতের বিশ্লেষণ করেননি, তথাপি দারুল কুফরে এ বস্তু জায়েয হবার কথা বলেছেন এবং বারবার বলেছেন। বেরেলী এবং বাদাউনের আলেমগণেরও এ ব্যাপারে আমার জ্ঞানমতে কোনো মতভেদ নেই। এতদসত্ত্বেও আমি আমার প্রবন্ধে ফতোয়ার রূপ দেইনি, বিষয়টির বিশ্লেষণ করে ফতোয়া দিয়েছি। আলেমগণকে জিজ্ঞাসা করেছি যে, ভারতে এ মাসয়ালা কার্যকর করার সময় এসেছে কিনা।
কিন্তু সত্য কথা বলতে আমি ব্যক্তিগতভাবে এ সন্দেহের কারণে, যা আপনি উত্থাপন করেছেন, এসব লিখতে ইতস্তত করছিলাম। কিন্তু কি বলব, কোন অত্যাচার-অবিচার শেষ পর্যন্ত আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়ে লিখনি ধরতে বাধ্য করেছিল। মুসলমানদেরকে জ্বালানো হলো, লুট করা হলো ধ্বংস করা হলো এবং এখনো হচ্ছে।১.[পরবর্তী পর্যায়ে মাওলানা নিজেই তাঁর একথার জবাব দিয়েছেন।- (মওদূদী)] আমি এসব দেখে দেখে অধীর হয়ে পড়েছিলাম। কোনো উপায়ন্তর না দেখে অর্থনৈতিক আত্মরক্ষা অথবা অর্থনৈতিক আক্রমণের পথই সামনে ছিল। তাই পেশ করলাম এবং এ জন্য আমি এর নাম রেখেছি ‘ফাই’। শামী গ্রন্থে এর খুঁটিনাটি বিবরণ আছেঃ (আরবী*********)
“বিনা যুদ্ধে অথবা বিনা বলপ্রয়োগে তাদের কাছ থেকে নেয়া হয় যেমন, সন্ধিসূত্র প্রাপ্ত মাল। গনীমত নয়, ‘ফাই’ও নয়। তবে তার বিধান ‘ফাই’-এর বিধানের অনুরূপ।”
অতএব যার বিধান হলো ফাই-এর। তাকে ফাই বললে দোষ কি? আর অনুমতি হলে কি বলতে পারি যে অত্যাচারের ভয়ে কি বিবাহ ত্যাগ করার ফতোয়া দেয়া যেতে পারে? প্রকৃতপক্ষে মুসলমান যে পরস্পর গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হলো, তা কি যুদ্ধনীতির ফলোশ্রুতি? সত্য সত্যই কি এ আশংকা আছে?
কিন্তু এতদসহ আমি ঐসব মৌলভীদেরকে অবশ্যই ভয় করি যারা ইসলামী শাসনের অবসানের পর ছোটখাটো ব্যাপারে কুফরী ফতোয়া দিয়ে বিবাহ বাতিল ও সন্তানের অবৈধতার হুকুম জারী করে। এ অবস্থায় এটাই সম্ভব যে, প্রত্যেক মুসলমান অপরের কুফরী ফতোয়া নিয়ে পরস্পর এমন কুকর্ম শুরু করবে যা অবশ্যম্ভাবীরূপে তাদের জন্যে জাহান্নামের আযাবের কারণ হবে। কিন্তু কত ভালো হতো, যদি এ ফতোয়াকে বাস্তব রূপ দেবার জন্যে এসব আলেম এসব ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন করা থেকে বিরত থাকতেন। নতুবা প্রত্যেকে তার নিয়তের জন্যে দায়ী হবে।
(আরবী*********)
“প্রত্যেক মানুষের জন্যে তাই হবে সে যার নিয়ত করে, অর্থাৎ কার্যের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সন্তুষ্টির জন্যে হিজরত করবে, যে হিজরত করবে পার্থিব স্বার্থের জন্যে অথবা কোন নারীর জন্যে, তারা প্রত্যেকে তাই পাবে যার জন্য সে হিজরত করেছে।”
নামাযও তো জাহান্নামের চাবিকাঠি হতে পারে। এমনিভাবে যদি ফতোয়া বাজি করে লোক একে অপরের ঘাড় ভাঙে, তাহলে এ কারণে কি জিহাদ আইন হারাম করার ফতোয়াটি সঠিক হবে?
আর একটি সন্দেহ আছে তা হচ্ছে এই যে, সেভিংস ব্যাংক নয়, সাধারণ ব্যাংক এবং কো-অপারেটিভ ব্যাংকের মালিকদের মধ্যে কিছু মুসলমানও আছে এ অবস্থায় কি করা যায়? একথা ঠিক যে, লোক যাদের সাথে ব্যাংকের লেনদেন করে এমনসব কর্মচারী সাধারণতঃ অমুসলিম হয়ে থাকে। কিন্তু মালিকদের মধ্যে যখন মুসলমানও আছে তখন কাজের উপায় কি হতে পারে?
এ ব্যাপারে আলেম সমাজ চিন্তা করলে কত ভালো হতো! শাসকদের জন্য বৈধ বিষয়গুলোর ব্যাপারে ফকীহগণ কি বলেছেন? শুধু একটি মাসয়ালা সম্পর্কে আলেমদেরকে সজাগ করে দিতে চাই। সুদ বন্ধ করার জন্যে তাঁরা মাদক নিবারনী সমিতির মতো জোরদার আন্দোলন করবেন। নতুবা অন্ততপক্ষে আইনানুগ পন্থায় এতটুকু করবেন যতোটুকু করেছে ‘গো-রক্ষা’ সমিতি। হয় তো সরকার এদিকে দৃষ্টি দিবেন অথবা দেশবাসী কিছু মেহেরবানী করবেন। এমনও হতে পারে যে, কুরবানীর পশুকে (মুসলমান) কুরবানী করার দ্বারাই সুদের মীমাংসা হয়ে যাবে। নতুবা পুঁজিপতি মুসলমানদেরকে কোন আইনানুগ ব্যবস্থাপনার অধীন এ কাজের জন্যে উৎসাহিত করতে হবে যে, যে আচরণ অমুসলিমগণ মুসলমানদের সাথে করে তারাও (মুসলমানগণও) অন্যের সংগে অনুরূপ আচরণ করবে।
(আরবী*********)
“যারা তোমাদের উপর অত্যাচার করে, তোমরাও তাদের উপর ততটা অত্যাচার কর যতটা তারা তোমাদের উপর করেছে।”- (বাকারাঃ ১৯৪)
উদ্দেশ্য শুধু এতটুকুই। নতুবা যারা পেটপূজা ও ধন লিপ্সার জন্যে এ মাসয়ালার বৈধতার চিন্তায় এতটা উন্মত্ত হয়ে পড়েছেন যে, সত্য-মিথ্যা যে কোনো পন্থায় কুরআনের একটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত বিধান রদ করার জন্যে বদ্ধপরিকর। তাদের জেনে রাখা উচিত যে, ইসলামের বুনিয়াদ রাষ্ট্রক্ষমতা ও ধন-সম্পদ নয়। বরঞ্চ যিনি দারিদ্রকে গৌরব মনে করতেন সেই মহান নবীই ইসলামের বুনিয়াদ বা স্তম্ভ কায়েম করেছেন। তাহলো এই যে, সকল মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঈমানের উপর নির্ভরশীল। (আরবী********) (তোমরাই সর্বশ্রেষ্ঠ)-এর প্রতিশ্রুতি (আরবী*******) (যদি তোমরা ঈমানদার হও)-এ নীতির শর্তাধীন। ধনবান ও বিত্তশালী এখন যারা আছে, তারা আগেও ছিল। তখনো কুরআনের এ পথনির্দেশই ছিলঃ
(আরবী************)
“তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদেরকে যেন মুগ্ধ না করে। আল্লাহ তায়ালা এসবের দ্বারা দুনিয়ায় তাদেরকে আযাবে লিপ্ত করতে চান এবং তাদের প্রাণ জরাজীর্ণ অবস্থায় কাফের হয়ে (দেহ থেকে) বহির্গত হবে।”- (সূরা আত তাওবাঃ ৮৫)
এর মধ্যে এখনো আমাদের জন্য শক্তি নিহিত আছে। আমাদের মতো উম্মতকে কেন স্বয়ং নবী (স)-কেই আদেশ করা হয়েছেঃ-
(আরবী*********)
“(হে নবী) তাদের দিকে বিস্ময় বিস্ফোরিত নেত্রে তাকিও না যাদেরকে পরীক্ষা করার জন্যে নানাবিধ সম্পদ দিয়ে ভূষিত করেছি। তোমার প্রভু তোমাকে যে রেজেক দান করেছেন তাই তোমার জন্য উৎকৃষ্ট এবং স্থায়ী।”
আজ যারা ইউরোপের (বাতিল) খোদাদেরকে দেখে চিৎকার করে বলছে, আমাদেরও এরূপ খোদা থাকা দরকার। তাদেরকে একথা বলে দেয়া দরকার, যাঁর উম্মতের জন্যে তোমরা কাঁদছ, তিনিই কসম করে বলেছেনঃ
(আরবী********)
“খোদার কসম আমি তোমাদের জন্যে দারিদ্রের ভয় করি না। কিন্তু আমি ভয় করি তোমাদের ঐরূপ পার্থিব ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের যা দেয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে। তারপর তারা যেমন এ সবের জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা- প্রতিযোগিতা করেছিল তোমরাও তাই না কর। আর এসব ঐশ্বর্য ও প্রতিযোগিতা তাদেরকে যেমন আল্লাহ থেকে ভুলিয়ে রেখেছিল, তেমনি তোমাদেরকে যেন না রাখে।”-(বুখারী)
তোমরা বলছো যে, মুসলমানদের কাছে অর্থ নেই, ভালো পোশাক পরিচ্ছদ নেই, এটা নেই, সেটা নেই। কিন্তু মুসলমানদের অস্তিত্বের সার্থকতা যাঁর জন্যে, তিনি বলেন, ওরে পাগল! তোমরা খবরই রাখ না।
বুখারীতে আছেঃ-
(আরবী*********)
“দীনার-দিরহাম তথা অর্থ-সম্পদের মালিক, জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরিধানকারী, চাকচিক্যময় হোব্বা-জোব্বা পরিধানকারী-সকলেই ধ্বংস হয়েছে।”
তোমরা বল যে, দরিদ্র জাতি ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু তোমরা যাঁর উম্মত তিনি বলেন, বিত্তশালী ধ্বংস হয়েছে। এখন তোমরা বল, আমরা কার কথা শুনব? সত্য কথা এই যে, যে জাতির মধ্যে দারিদ্রের হাহাকার আছে তারা যখন সুদ খেলো এবং পেট ভরে খেলো, তের বছরের মধ্যে বাইশ টাকাকে বাইশ লাখে পরিণত করলো, তাদের দারিদ্রের মর্সিয়া গাইবার জন্যে লোকদের অভাব নেই। যে জাতি সুদের ময়দানে অগ্রগামী, তাদের সকলেই কি পেট ভরে খেতে পায়? মাথা পিছু তিন পয়সা আয় কোন জাতির? তাদের কথা ছেড়ে দিলেও, সরকারের সাহায্যে যারা সুদ খায় তাদের মজুরদের দুরবস্থা কি সংবাদপত্রে তোমাদের নজরে পরে না? নবী মুস্তফা (স) সত্যিই বলেছেনঃ
(আরবী******)
“আদম সন্তানদের কাছে যদি দুটো উপত্যকাপূর্ণ সম্পদ থাকতো, তবু তারা তৃতীয় একটির জন্যে ব্যস্ত হয়ে পরতো। আর মানব সন্তানের পেট (বা চোখ) মাটি ছাড়া আর কিছু দিয়ে পূর্ণ করা যাবে না।”-(বুখারী)
(আরবী******)
“সুতরাং অল্পে তুষ্টির জন্যে মনজিল ত্যাগ করা যায় না। হে রাষ্ট্র চালক! দাঁড়াও, এ পথের (সম্পদ লাভের) শেষ নেই।”
আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে মুসলমানদের জন্যে যে সুর ঝংকৃত হয়েছিল তাই যথেষ্টঃ (আরবী*******)
“হে খোদা! আখেরাতের আরাম আয়েশ ছাড়া আর আমাদের জন্যে কিছুই চাই না।”
– (তরজুমানুল কুরআন-শাবান-রমযান-১৩৫৫ হিজরী, নভেম্বর-ডিসেম্বর-১৯৭৬ খৃঃ)