সমালোচনা
(সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী)
মাওলানা মানাযের আহসান গিলানী সাহেবের মতের সাথে যে যে বিষয়ে আমি একমত হতে পারিনি,তা সংক্ষেপে টীকায় সন্নিবেশিত করেছি। কিন্তু যে মৌলিক বিষয়ের উপর ভিত্তি করে মাওলানা তার যুক্তি প্রদর্শন করেছেন,তার উপরে আলকপাত করার জন্যে নিছক ইশারা ইঙ্গিত যথেষ্ট নয়। তাই এ বিশদ আলোচনার প্রয়োজন বোধ করছি।
নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে মাওলানা তাঁর যুক্তি পেশ করেছেনঃ
মাওলানার যুক্তির সংক্ষিপ্ত সার
একঃ তাঁর দাবী এই যে,নিছক সুদ হারামের বিধানই নয়,বরঞ্চ সকল অবৈধ চুক্তি ও নাজায়েয অর্থনৈতিক উপায় –উপাদন হারাম করার বিধান দুজন মুসলমানের পারস্পরিক লেনদেনের মধ্যেই সীমিত থাকবে। তার অর্থ এই যে,অমুসলিম জাতির সাথে যেসব আর্থিক কারবার হবে তাতে হালাল-হারাম ও জায়েয-নাজায়েযের কোন ভেদাভেদই থাকবে না।
দুইঃ তার মতে জিম্মি নয় এমন মুসলমানের রক্ত ও সম্পদ শরীয়তে হালাল করা হয়েছে। অতএব এ ধরনের অমুসলিমদের ধনসম্পদ যেভাবেই নেয়া হোক,তা জায়েয।তা সুদ হোক, জুয়া হোক অথবা তাদের কাছে মদ, শুকরের মাংস মৃত জীব প্রভৃতি বিক্রি করা হোক না কেন। অথবা ন্যান্য এমন কোন পন্তা অবলম্বন করা হোক যা মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে হারাম করা হয়েছে। মুসলমানগন যেভাবেই তাদের সমপদ হস্তগত করুক না কেন তা মালে গণিমত বা ‘ফাই’ বলে বিবেচিত হবে। আর তা হবে তাদের জন্য হালাল ও পবিত্র।
তিনঃ তাঁর মতে ইসলামী রাষ্ট্র নয় এমন প্রত্যেকটি দেশই দারুল হরব এবং তার অমুসলিম অধিবাসী দারুল হরবী। তিনি দারুল কুফরকে দারুল হরবের এবং কাফের গায়েব জিম্মিকে হরবীর সম অর্থবোধক মনে করেন। এজন্য তার নিকটে যেসব যেসব দেশে অমুসলিম শাসক অধিষ্ঠিত আছে টা সত্যিকার অর্থে দারুল হরব আর সেখানে চিরকাল মুসলমানদের জন্যে সেসব বিধানই জারী থাকা উচিত যা দারুল হরব সম্পর্কে ফেকাহর গ্রন্থসমুহে বর্ণিত আছে।
চারঃ পূর্ববর্তী ফকিহগন দারুল হরবের যে সংজ্ঞা বর্ণনা করেছেন। মাওলানার মতে তা ভারতের বেলায় খাটে।আর এ দেশের মুসলমানদের পজিশন ফেকাহের দৃষ্টিতে ‘নিরাপত্তাপ্রাপ্ত’– এর ন্যায়। অন্য কথায় মুসলমান এ দারুল হরবে এ অবস্থায় বসবাস করে যেন তারা এখানকার হারবি শাসকদের কাছে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা লাভ করেছে
পাচঃ ‘নিরাপত্তাপ্রাপ্তদের’ সম্পর্কে ইসলামি আইন হচ্ছে এই যে, তারা যে অনৈসলামিক রাষ্ট্রের নিরাপত্তা লাভ করে বসবাস করছে, সে রাষ্ট্রের কোন আইন লংঘন করতে পারবে না। অতএব মাওলানার মতে ভারতের মুসলমানদের জন্য অনৈসলামী রাষ্ট্রের আইনের আনুগ্য এতাটা অপরিহার্য যে চুল পরিমানে তা অমান্য করলে জাহেননামের যোগ্য হয়ে পড়বে। কিন্তু ইসলামের অধিকাংশ নির্দেশ ও আইন পালনের ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন। তার কারণ এই যে, তারা দারুল হারবে বসবাস করে। হত্যা, ধ্বংসাত্মক কাজ, চুরি-ডাকাতি, ঘুষ, শঠতা এবং এ ধরনের অন্যান্য পন্থায় হরবি কাফেরদের ক্ষতি সাধন করা এবং তাদের সম্পদ হস্তগত করা মুসলমানদের জন্যে এ জন্য নাজায়েজ যে, দেশীয় আইন তা অন্যায় বলে ঘোষণা করে। এজন্য নয় যে, এ কাজগুলো ইসলামী শরীয়তে হারাম। কারণ তামাদ্দুন, অর্থনীতি এবং নৈতিকতার অধিকাংশ ব্যাপারে ভারত ভূমিতে ইসলামী শরীয়ত ততদিন পর্যন্ত মানসুখ থাকবে যতদিন এখানে অনৈসলামিক রাষ্ট্র কায়েম থাকবে। এখন শরীয়তের আইনের মধ্যে শুধুমাত্র চুক্তি আইন এখানে মুসলমানদের পালনীয় এবং তার দৃষ্টিতে লেনদেন ও জীবিকা অর্জনের জেসব উপায়- উপাদান শরীয়ত হারাম করেছে, কিন্তু দেশীয় আইন হালাল করেছে, তার সবই আইনগত হালাল এবং শরীয়তের দিক দিয়েও হালাল। তার জন্যে দুনিয়াতেও কোনো শাস্তি নেই এবং আখিরাতেও নেই কোনো জবাবদিহি।
বর্ণিত যুক্তিসমূহের উপর সামগ্রিক মন্তব্য
আমার মতে এর একটি কথাও ঠিক নয়। যে হানাফি আইনের প্রতিনিধি হিসাবে মাওলানা যেসব কথা বলেছেন, সে আইনও এসব সমর্থন করে না। এ প্রবন্ধে মাওলানা ইসলামী আইনের যে চিত্র এঁকেছেন, তা শুধু ভ্রান্তিই নয়, কুৎসিতও বটে। এসব দেখে মুসলমান সম্পর্কে কেউ কখনোই কোনো ভাল ধারণা পোষণ করতে পারেনা। যদি কোনো অজ্ঞ ব্যক্তি এ চিত্র দেখে তাহলে সে ইসলামকে দুনিয়ার মধ্যে একটি অতি নিকৃষ্ট ধর্ম এবং মুসলমানদেরকে একটি মারাত্মক জাতি মনে করবে। অতঃপর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে যে অমুসলিম রাষ্ট্রের আইন–কানুন এসব নিরাপত্তা প্রাপ্তদের হাত থেকে অন্যান্য জাতির জান-মাল, ইজ্জত-আবরু সংরক্ষিত করে রেখেছে। অন্যদিক দিয়ে যদি শরীয়তের এ ব্যাখ্যা মেনে নিয়ে ভারতের মুসলমানগন এ দেশে বসবাস শুরু করে তাহলে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তাদের ভিতর ইসলামের নামটুকুও বাকী থাকবে না। আল্লাহ না করুন, যদি অমুসলিম শাসনের প্রথম থেকেই ভারতের এসব মূলনীতির উপরে কাজ করা হত, তাহলে আজ যতটুকু ইসলামিয়াত মুসলমানদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তাও দেখা যেতো না। বিগত দেড়শ বছরে ভারতের মুসলমান একেবারে বিকৃত হয়ে পড়তো। এটা অবশ্যই হতে পারত যে, তাদের বিষয়-সম্পত্তির একটা অংশ সংরক্ষিত থাকতো এবং তাদের মধ্যে মাড়োয়ারি, বেনিয়া ও শেঠদের মত একটা শ্রেণীর উদ্ভব হতো।
একথা বলার উদ্দেশ্য কক্ষনো এই নয় যে মাওলানা স্বেচ্ছায় ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তিনি ইসলামী আইন যেভাবে বুঝেছেন তিনি ইসলামী আইন যেভাবে বুঝেছেন, পরিপূর্ন ঈমানদারী ও সদিচ্ছাসহ,ঠিক তেমনি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আমার আপত্তি তার বর্ণিত মর্ম ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে। ইসলামী আইন যতুকু আমি অধ্যয়ন করেছি, তার আলোকেই একথা বলার সাহস করছি যে, বিশেষ করে উপরে বর্ণিত বিষয়গুলো সম্পর্কে মাওলানা শরীয়তের মূলনীতি ও বিষয়সমূহ ঠিকমত বুঝতে পারেননি। এ ভুল ধারনার দুটো কারণ অনুমান করা যেতে পারে।
প্রথমঃ যে সময়ে মুজতাহিদ ঈমামগণ ইসলামী রাষ্ট্রের শাসনতান্ত্রিক আইন (CONSTITUTIONAL LAW) ও আন্তর্জাতিক আচরণ সম্পর্কে কিতাব ও সুন্নাহর হেদায়াত অনুযায়ী এবং স্বীয় ইজতিহাদের ভিত্তিতে এসব বিধান প্রণয়ন করেছিলেন, সে সময়ে এসব ফকিহগন শুধু কুরআন-হাদিস -ফেকাহর শিক্ষাদাতাই ছিলেন না, বরঞ্চ তারাই ছিলেন রাষ্ট্রের আইণ সম্পর্কে পরামর্শদাতা এবং বিচারালয়গুলোর প্রধান বিচারক। ইসলামী রাষ্ট্রের দৈনন্দিন শাসনতান্ন্ত্রিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যার সম্মুখীন হতো। তখন এসব মনীষীদের মতামত গ্রহন করা হতো। প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্ক সম্বন্ধের বিভিন্ন রুপ প্রকাশ পেতো এবং তার থেকে যে আইনগত সমস্যার উদ্ভব হতো,তার মীমাংসা এসব মনীষীগণই করতেন। তারা তাদের সিদ্ধান্ত ও প্রস্তাবে যেসব আইন সংক্রান্ত পরিভাষা ও বাক্য ব্যবহার করতেন তার মর্ম শুধু শাব্দিক ব্যাখ্যার উপরই সীমিত ছিলনা। বরঞ্চ তার প্রকৃত ব্যাখ্যা সেসব অবস্থা ও পরিস্থিতি, যার উপর এসব পরিভাষা ও বাক্য প্রযোজ্য হতো। অথবা যদি কোনো পরিভাষা ও বাক্যে অস্পষ্টতা রয়ে যেতো,অথবা একই বিষয়ের বিভিন্ন স্তরে একই পরিভাষা ব্যবহৃত হতো এবং প্রকাশ শব্দের স্তরসমূহের পার্থক্য নির্ণয়কারী কিছু থাকতো না, অথবা ব্যাপক অর্থে একটি শব্দ বলা হতো এবং শুধু অবস্থাভেদে তার বিভিন্ন অর্থের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হতো তাহলে এর দ্বারা বাস্তবে আইন প্রয়োগ ও ব্যবহারে কোন অনিষ্ট ঘটবার আশংকা থাকতো না। এ আশংক ও ছিলনা যে, কোন আইনজ্ঞ ব্যক্তি নিছক শব্দগুলো সুস্পষ্ট না হবার কারণে কোন বিধানকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থার উপর প্রয়োগ করবে। এজন্য যে, সে সময়ে ইসলামী আইনের পরিভাষা এবং বিশেষ আইন সংক্রান্ত বাক্যগুলোর মর্যাদা ছিল তৎকালে প্রচলিত মুদ্রার মত। বাস্তব জগতে তার প্রচলন ছিল না। এদের মর্ম উপলব্ধি করতে, যথাস্থানে ব্যবহার করতে ও প্রত্যেকটির সঠিক সংজ্ঞা জানতে কোনোই অসুবিধাই ছিলনা। প্রত্যেক আইনজ্ঞ ব্যক্তিকে দিবা-রাত্রি পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষভাবে ঐসব অবস্থার সম্মুখীন হতে হতো যাতে এ ভাষা প্রয়োগ করা হতো। কিন্তু এখন কিছুকাল যাবত সে অবস্থা আর নেই। শাসনতান্ত্রিক সমস্যাবলী ও ন্তর্জাতিক ব্যাপারের সাথে কার্যত আলেমদের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ বিলুপ্ত হয়েছে এবং যেসব রাষ্ট্র এখনো আছে সেখানেও এসব সমস্যা শরীয়তের আলেমদের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। ব্যবহারিক জগতে ইসলামী আইনের পরিভাষা ও বাক্যগুলোর ব্যবহার বহুকাল যাবত বন্ধ হয়ে গেছে। এখন প্রাচীন ঐতিহাসিক মুদ্রায় পরিনত হয়েছে। এখন তার মূল্যের আর সে অবস্থা নেই যে, প্রচলিত থাকার কারণে বাজারে সবার কাছে সে এক পরিচিত বস্তু। কিন্তু তার পুরাতন বাজার দর ( MARKET VALUE ) জানার জন্যে পুরানো নথি –পত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা কা এবং বর্তমান যুগের কার্যকরী অবস্থার উপর অনুমান ক সে সময়ের প্রকৃত অবস্থা বুঝবার চেষ্টা করা প্রয়োজন। এ কারণেই রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সম্পর্কে ইসলামী ফিকাহর বিধানগুলোর উপলব্ধি করা, বিবাহ, উত্তরাধিকার আইন প্রভৃতির তুলনায় অধিকতর কষ্টকর।১.[এর একটি মজার দৃষ্টান্ত মাওলানার প্রবন্ধে উপরে বর্ণিত হয়েছে। শামী গ্রন্থের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে এ বিধানের উল্লেখ করেছেন যে, গতা সমুদ্র চিরকালের জন্যে অনৈসলামিক রাষ্ট্রের অধিকারে থাকবে। যে সময়ে প্রথম প্রথম কোনো মুজতাহিদ একথা বলেন, তখনকার অবস্থার প্রেক্ষিতে তা হয়ত ঠিক ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালের লোকেরা যখন একথা কোনো কিতাবে লিখিত আকারে দেখলো, তখন অন্ধ অনুকরন করে তাকে ইসলামী আইনের একই স্থায়ী সিদ্ধান্ত মনে করলো। অথচ সমুদ্র হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্বন্ধের বৃহত্তম উপায়। কোন রাষ্ট্রই বিশ্বব্যাপী প্রভাব ও ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না, সমুদ্রের উপর যদি তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হয়। ইসলামী ফিকাহর অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা যদি মাদ্রাসাগুলো পর্যন্ত সীমিত না হতো, আলেমদের বাস্তব সম্পর্কে যদি দুনিয়ার রাজনীতির সাথে হতো, তাহলে তারা অনুভব করতেন যে, সমুদ্র কাফেরদের অধিকারে ছেড়ে দিয়ে নিজের জন্যে স্থলেই আবদ্ধ থাকার সিদ্ধান্ত করা কত মারাত্মক ভুল।] কারণ এখন তার শুধু শব্দগুলো রয়ে গেছে। গ্রন্থের মুল পঠিতব্যও শাব্দিক এবং তার ব্যাখ্যাও শাব্দিক।
দ্বিতীয়ঃ যার দিকে স্বয়ং মাওলানা ইংগিত করেছেন, বিগত এক দেড় শতাব্দী যাবত মুসলমানদের উপরে যে আর্থিক দুর্গতি নেমে এসেছে, যেভাবে দেখতে দেখতে তাদের কোটি কোটি টাকার বিষয় সম্পত্তি হাতছাড়া হয়েছে,এবং যেভাবে মুসলমানদের সচ্ছল পরিবার-গুলো অন্নের ভিখারী হয়ে পড়েছে, তা দেখে দেখে প্রত্যেক দরদী মুসলমানের মতো মাওলানার হৃদয়ও দুঃখে ভেঙে পড়েছে এবং প্রাণপণ চেষ্টা করে দেখেছেন শরীয়তে এ বিপদের কোন সমাধান খুজে বের করা যায় কিনা। এ অনুপ্রেরণার দ্বারা বশীভূত হয়ে অধিক ক্ষেত্রে তাদের লিখনী ভারসাম্য এবং ফকীহসুলভ সতর্কতা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। যেমন ধরুন তাদের সিদ্ধান্ত যে ভারতে সুদ না নেয়া গুনাহ। অথবা তাদের এ বিবৃতি যে ‘অবৈধ চুক্তির’ অবৈধতার যাবতীয় বিধান শুধুমাত্র মুসলমানদের পারস্পারিক কায়কারবার পর্যন্তই সীমিত। ভারতীয় মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা দেখলে কোন মুসলমানের হৃদয় দুঃখে ভারাক্রান্ত হয় না? আর কে চায়না যে, তারা এ দুর্দশা থেকে মুক্তি লাভ করুক? এ বিষয়ে আমাদের ও তাদের মধ্যে তিল পরিমান মতানৈক্য নেই। রাজী নই যে কিন্তু আমি একথা স্বীকার করত ভারতের মুসলমানদের অর্থনৈতিক অধঃপতন হয়েছে, পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষ ভাবে সুদ না খাবার কারণে। আর এঅবস্থার পরিবর্তন সুদ হালাল হবার উপর নির্ভরশীল। উপরন্তু আমি মানতে রাজী নই যে, সুদের অবৈধতা সামান্যতম পরিমানেও মুসলমানদের অর্থনৈতিক উন্নতির প্রতিবন্ধক। যে ব্যক্তি (আরবী********) (আল্লাহ সুদ ধ্বংস করেন ও সদকা বর্ধিত করে দেন)- এর উপর ঈমান রাখে এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর এ বাণীকে জীবিকা ও পরকাল উভয়ের মধ্যে এক অটল সত্য বলে জানে, তার মনে এধরনের কোন সন্দেহের উদ্রেক হওয়া উচিত নয়। মাওলানা চিন্তা করলেন তার কাছে এসত্য উদ্ঘাটিত হবে যে, মুসলমানদের অর্থনৈতিক অধঃপতনের প্রকৃত কারণ সুদ না খাওয়া নয়। বরঞ্চ প্রকৃত কারণ হচ্ছে সুদ দেয়া, যাকাত দিতে অবহেলা করা এবং ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একেবারে রহিত করে দেয়া। যেসব পাপের শাস্তি মুসলমানদের ভগ করতে হচ্ছে তা হচ্ছে এই। তারা যদি এ পাপের উপর অবিচল থাকে এবং তার উপরে সুদখোরীর পাপ যোগ করা হয়, তাহলে কতিপয় লোক হয়তো বিত্তশালী হবে এবং কিছু সরলচেতা মুসলমান প্রতারিত হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সামগ্রিক দিক দিয়ে জাতির আর্থিক অবস্থার কোনই পরিবর্তন হবে না। অন্যদিকে মুসলমানদের নৈতিক অবস্থা, তাদের পারস্পারিক ভালবাসা, সৌহার্দ,দয়া-দাক্ষিণ্য, সাহায্য, সহানুভুতি প্রভৃতির চরম অধঃপতন ঘটবে। এমনকি তাদের জাতীয়তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
আপনি সুদের নাম ‘ফাও’ রাখুন অথবা ‘মায়েদাতুম মিনাস সামায়ে’-_আকাশ থেকে অবতীর্ণ খাদ্যপূর্ণ (দস্তরখান) বলুন,তাতে করে তাঁর আসল তত্ত্ব ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্টে চুল পরিমাণ পার্থক্য সূচিত হবে না। সুদ তাঁর প্রকৃতিগত দিক দিয়ে যাকাতের বিপরীত এবং এর মনস্তাত্ত্বিক প্রকৃতিতে কোনো রাষ্ট্রের দারুল হরব অথবা দারুল ইসলাম হওয়াতে কোনোই পার্থক্য হয় না। এ কিছুতেই সম্ভব নয় যে, একই অর্থনৈতিক জীবনে এ দুটো (সুদ ও যাকাত) একত্র হতে পারে। এক মানসিকতা হচ্ছে টাকা গণনা করাতে, গণনা করে করে তা জমা করে রাখাতে, সপ্তাহ ও মাসের হিসেবে তা বাড়াতে এবং উত্তরোত্তর বৃদ্ধির হিসেব করতে আনন্দ লাভ করা। দ্বিতীয় মানসিকতা আনন্দ লাভ করে-_মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জীবিকা অর্জন করতে, অর্জন করে তা নিজে খেতে ও অপরকে খাওয়াতে এবং আল্লাহর পথে বিলিয়ে দিতে। কোনো বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি কি ধারণা করতে পারে যে, এ উভয় মানসিকতা একই মন-মস্তিষ্কে একত্র হতে পারে? একি কখনো আশা করা যেতে পারে যে, যখন কোনো মুসলমান সুদে টাকা খাটাতে লাগবে এবং মাঝে-মধ্যে তাঁর বুদ্ধির প্রতি নজর রাখতে মজা পাবে, তারপর তাঁর পকেট থেকে যাকাত ও সদকার জন্যে একটি পয়সাও বেরুবে? এর পরেও কি কোনো মুসলমান কোনো মুসলমানকে কর্জে হাসানা (বিনা সুদে কর্জ) দেয়া সহ্য করবে? এরপরে মুসলমানদের অবস্থা কি সেই জাতির মতো হবে না যাদের সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছেঃ
(আরবী********)
“অতঃপর তোমাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেল, প্রস্তরের ন্যায় অথবা তাঁর চেয়েও কঠিন এবং তোমরা নিশ্চয় তাদেরকে জীবন ধারনে মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা লোভী দেখতে পাবে।”
কয়েকজন কারুণ এবং শাইলক সৃষ্টি করার জন্যে গোটা জাতি কেন আত্নহত্যা করবে? আর এ আত্নহত্যা জায়েয প্রমাণ করার জন্যে আল্লাহ ও রাসূলের(সঃ) বিধানের কেন অপব্যাখ্যা করা হবে? তারপর ইমাম আযম আবু হানিফা (রঃ)এর মত মনীষীকে এ কাজের অংশীদার কেন করা হবে?
তারপর আমি বলতে চাই যে, দুনিয়ার মধ্যে মুসলমানই এমন এক জাতি যারা বিগত তেরশ বছর ধরে পুজিবাদী অর্থনীতির বিরোধিতা করে আসছে এবং যারা কার্যত এ ভ্রান্ত ব্যবস্থার মূলোচ্ছেদের জন্যে চেষ্টা করছে। যে বস্তু চিরদিনের জন্যে এ জাতিকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শত্রু হিসেবে অবিচল রেখেছে এবং তাঁর মধ্যে মিশে যাওয়া থেকে থেকে রক্ষা করেছে তাহলো যাকাতের অপরিহার্যতা এবং সুদের অবৈধতা। সমাজতান্ত্রিক, কমিউনিষ্ট এবং নিহিলিষ্ট সকলেই পুজিবাদীর সাথে আপোষ করতে পারে, কিন্তু যতোক্ষণ পর্যন্ত এ দুটো প্রতিবন্ধকতা কায়েম আছে, মুসলমান কখনো তাঁর সাথে আপোষ করতে পারে না। এ কারণেই ঐসব জাতি পুঁজিবাদে মিশে একাকার হয়ে গেছে, যাদের ধর্ম সুদ খেতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু মুসলমানগণ তেরশ বছর ধরে এ মুকাবিলায় অটল হয়ে আছে। এখন যখন দুনিয়াবাসীগণ চক্ষু খুলেছে এবং তারা এ ব্যবস্থার মূলোচ্ছেদের জন্যে দলে দলে একত্র হচ্ছে, তখন এ কেমন দুর্ভাগ্যের কথা যে, মুসলমান এ সংগ্রাম থেকে পশ্চাৎপদ হবে এবং আপন হাতে নিজ দুর্গের সুদৃঢ় গম্বুজগুলো ধ্বংস কর এপুজিবাদের দিকে সন্ধির হস্ত প্রসারিত করবে?
এ প্রয়োজনীয় ভূমিকার পর এখন আমরা আইনগত আলোচনায় প্রবৃত্ত হচ্ছি।
অবৈধ চুক্তি কি শুধু মুসলমানদের মধ্যেই নিষিদ্ধ?
মাওলানার প্রথম দাবীর ভিত্তি এই যে, কুরআন মজিদের যেখানে জীবিকার্জনের অবৈধ উপায়সমূহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেখানে (আরবী***) (তোমাদের মধ্যে) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁর অর্থ এই যে, মুসলমান পরস্পরে অবৈধ চুক্তিতে কোনো কারবার করবে না। বলা হচ্ছেঃ
(আরবী********)
“হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের মধ্যে অবৈধ উপায়ে তোমাদের মাল ভক্ষণ করো না। তবে তোমাদের উভয়ের সম্মতিক্রমে ব্যবসা করতে পারো।”- (সূরা আন নিসাঃ ২৯)
এখন একথা ঠিক যে, সুদও ধন অর্জনের অবৈধ পন্থাগুলোর একটি। এজন্য কুরআনে বলা হয়েছে যে, (আরবী*********) (আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন) – এ যদিও প্রকাশ্য শব্দের দিক দিয়ে সাধারন বিধান, কিন্তু এটা যে মূল বিধানের শাখা তাঁর সাথে একেও তাঁর অনুসরণে শুধু মুসলমানদের পারস্পরিক আচরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করা উচিৎ। এর সমর্থনে পাওয়া যায় মকহুলের বর্ণিত হাদীস থেকেঃ (আরবী********) অর্থাৎ মুসলিম ও অমুসলিম হরবীর মধ্যে আধিক্যের শর্তে যে লেনদেন হবে তাঁর উপরে ‘সুদ’ শব্দ আরোপ করা যাবে না। অন্য কথায় (***) এর অর্থ এই যে, গায়ের জিম্মী কাফেরের নিকট হতে যে সুদ নেয়া হবে তা মোটেই সুদ নয়। তাহলে তা হারাম কি করে হলো?
এ হলো মাওলানার যুক্তির সারাংশ। এ বিষয়ে প্রথম এবং মৌলিক ভুল এই যে, কুরআনের উদ্দেশ্যের প্রতি প্রতি লক্ষ্য না রেখে শুধু বাহ্যিক শব্দগুলো থেকে মর্ম উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়েছে। কুরআনের সাধারণ বর্ণনাভংগী এই যে, সে নৈতিকতা ও আচার-আচারণ সম্পর্কে যত উপদেশ দেয় তা সব মুমিনদের উদ্দেশ্যেই দেয় এবং বলে তোমরা এরূপ করো অথবা এরূপ করো না। এ বর্ণনাভংগীর মধ্যে অন্যান্য তাৎপর্যও রয়েছে যার আলোচনার ক্ষেত্র এটা নয়। এখানে শুধু এতটুকু বলতে চাই যে, এ ধরনের বাচনভংগীতে নৈতিকতা এবং আচার-আচরণ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা যত নির্দেশ দিয়েছেন ফকীহগণের মধ্যে কেউই সেগুলোকে শুধুমাত্র মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলেননি। কেউ একথা বলেননি যে, দুজন মুসলমানের মধ্যে যে জিনিস হারাম, তাই মুসলমান এবং অমুসলমানের মধ্যে হালাল অথবা মুস্তাহাব। এমন হলে প্রকৃতপক্ষে ইসলামী নৈতিকতা ও ইসলামী তামাদ্দুনিক আইনের মূল উৎপাটিত হবে। যেমন আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী*******)
অর্থাৎ এর অর্থ কি এরূপ মনে করা হবে যে, মুসলমান শুধু মুসলমানের নিকটেই মিথ্যা কসম করবে না? আর অমুসলিমদের বেলায় মিথ্যা কসম করতে কোনো দোষ নেই?
আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী******)
অর্থাৎ এর অর্থ কি এই যে, মুসলমান কি শুধু ঐসব আমানতের রক্ষণাবেক্ষণ করবে যা মুসলমানের সাথে সম্পর্কিত? আর কাফেরের গচ্ছিত আমানত অবাধে খেয়ানত করা যাবে?
আল্লাহ আরও বলেনঃ
(আরবী******)
অর্থাৎ এর ব্যাখ্যা কি এই হবে যে, মুসলমানের পরিবর্তে কোনো কাফের যদি কোনো মুসলমানকে বিশ্বাস করে বিনা লেখা-পড়ায় তাঁর কাছে কিছু মাল জমা রাখে,তাহলে তাকে ‘ফাও’ মনে করে আত্নসাৎ করা যাবে?
(আরবী*******)
তাহলে কি এসব নির্দেশ বা বিধান শুধু কি মুসলমানদের পারস্পরিক ব্যাপারসমূহের জন্যে? কাফেরের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করা অথবা সত্য সাক্ষ্য গোপন করে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া অথবা দলিল-পত্রের অমুসলিম লেখক ও সাক্ষ্য দাতাকে ভয় দেখানো প্রভৃতি কি জায়েয কাজ?
এরপর যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলঃ
(আরবী*******)
এর থেকে কি এটা বলা যেতে পারে যে, অন্য জাতির মধ্যে অশ্লীলতা ও ব্যভিচার ছড়ানো মুসলমানদের জন্যে জায়েয? (সুরা নূর)
(আরবী********)
এর কি এ ব্যাখ্যা করা হবে যে, কাফের নারীদের বিরুদ্ধে প্রাণ খুলে মিথ্যা অপবাদ রটানো যাবে?(নুর-২৩)
(আরবী*********)
এর অর্থ কি এই হবে যে, কাফের নারীদেরকে ব্যভিচারে বাধ্য করা এবং তাদের উপার্জনের অর্থ ভোগ করা জায়েয? এধরনে ব্যাখ্যা করে প্যারিসে সরকারী লাইসেন্স গ্রহণ করে কোনো বেশ্যালয় খোলা কি মুসলমানের জন্য হালাল হবে?(নুর-৩৩)
(আরবী*********)
শুধু মুসলমানদের গীবত করা নাজায়েয — উপরোক্ত আয়াতের কি এরূপ ব্যাখ্যা করা যাবে? কাফেরদের বদনাম করাতে কি কোনো দোষ নেই?- (হুজরাত-১২)
যদি এ মূলনীতির ভিত্তিতে কুরআন সুন্নাহর বিধানের ব্যাখ্যা করা হয় এবং মুসলমান তা মানতে শুরু করে তাহলে অনুমান করুন যে, এ জাতির কি পরিনাম হতে পারে।
যদি ধরেই নেয়া যায় যে, (আরবী********) এর বিধান মুসলমানদের পারস্পরিক ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ, আর এ নীতি অন্যান্য বিধানগুলোতে প্রযোজ্য হবে না, তাহলে প্রশ্ন জাগে যে, জিম্মী কাফেরদেরকে সুদী লেনদেন করতে নিষেধ কেন করা হয়েছে? আর নবী বা কেন অমুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে এমন চুক্তি করলেন যে, তাদেরকে সুদী কারবার ছেড়ে দিতে হবে। নতুবা চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে। ফেকাহর গ্রন্থগুলোতে এ কথাই বা কেন বলা হলো যে, যদি কোনো হরবী কাফের নিরাপত্তাসহ দারুল ইসলামে আসে তাহলে তাঁর সঙ্গে সুদের লেনদেন করা হারাম?
এখন রইলো (আরবী ********) হাদীসটি। এ সম্পর্কে কথা এই যে, প্রথমত, ‘হরবী’ শব্দের অর্থ শুধু গায়ের জিম্মী কাফের নয়। বরঞ্চ যুদ্ধরত জাতির এক ব্যক্তি। হানাফী ফকীহগণের ব্যাখ্যা দ্বারা তা সামনে প্রমাণ করা হবে।
দ্বিতীয়ত,(আরবী***) এর এ অর্থ নয় যে, হরবী কাফের থেকে যে সুদ নেয়া যাবে, তা সুদই নয়। বরঞ্চ তাঁর অর্থ এই যে, যদিও তা আকৃতি ও প্রকৃতিতে সুদ, কিন্তু তাকে আইনে হারাম হওয়া থেকে ব্যাতিক্রম করা হয়েছে এবং তা এমন এক বস্তু যেন তা সুদই নয়। নতুবা কোনো সুদ সম্পর্কে একথা বলা যে, তা সুদই নয়, এমন অর্থহীন বেহুদা কথা যে তা নবী (সঃ) এর প্রতি আরোপিত করাকে আমি গোনাহ মনে করি। এ অত্যন্ত যুক্তিসংগত কথা যে, কোনো বিশেষ অবস্থায় সুদকে শাস্তি ও অবৈধতা থেকে ব্যাতিক্রম করে রাখা হবে, যেমন স্বয়ং কুরআনে অনিবার্য কারণে মৃত জীব, শূকর এবং এরূপ অন্যান্য হারাম জিনিস খাওয়া ব্যতিক্রম করেছেন। কিন্তু এ এক অত্যন্ত অযৌক্তিক কথা যে, সুদের প্রকৃতি হুবহু রইলো। আর তাকে আমরা কোথাও সুদ বলে আখ্যায়িত করবো এবং অন্যস্থানে তার সুদ হওয়াটাই অস্বীকার করবো। এভাবে তো প্রতিটি হারাম কাজকে নাম পরিবর্তন করে হালাল করা যেতে পারে। খেয়াল খুশী মতো যে কোনো খিয়ানতকে বলে দিলেই হলো যে, এ খিয়ানতই নয়। যে মিথ্যাকে জায়েয করতে হবে, তা শুধু বলে দিলেই হবে মিথ্যা শব্দটি এর উপর প্রযোজ্য নয়। কোনো গীবত, অশ্লীলতা ও হারামখোরীর প্রতি মন আকৃষ্ট হলে, তাঁর নামটা পরিবর্তন করে মনে করুন যে, তাঁর প্রকৃতি বদলে গেছে। আল্লাহর রসূল তাঁর উম্মতকে এ ধরনের শাব্দিক ছলনা শিক্ষা দিবেন এ তাঁর মর্যাদার পরিপন্থী।
তৃতীয়ত, এ হাদীসটিতে যে বিধান বর্ণিত হয়েছে, তা একটি অনুমতি ও সুযোগ মাত্র, তাকে মুসলমানের সাধারন কর্মপদ্ধতি বানানো উদ্দেশ্য নয়। এ হাদীসটি কোন পর্যায়ের তা আলোচনা করা আমি নিষ্প্রয়োজন মনে করি। কারণ হাদীস গ্রহণ ও বর্জন করার ব্যাপারে ফকীহগণের নীতি মুহাদ্দিসগণের নীতি থেকে আলাদা। ইমাম আযম ও ইমাম মুহাম্মদ (রঃ)- এর মতো মুজতাহিদগণ যে হাদীসকে গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন, তাকে অবিশ্বাসযোগ্য মনে করা ঠিক হবে না। কিন্তু সংক্ষিপ্ত, অস্পষ্ট ও বিতর্কিত খবরে ওয়াহেদকে১.[একথা উপেক্ষা করা উচিৎ হবে না যে, ইমাম আবু ইউসুফ,ইমাম শাফেয়ী,ইমাম মালেক,ইমাম আহমদ এবং অধিকাংশ মুহাদ্দিস এ রেওয়াতকে বর্জন করেছেন।] এতটা ফলাও করাও ঠিক নয় যে, কুরআন, হাদিস ও সাহাবীদের কার্যকলাপের সর্বসম্মত সাক্ষ্য একদিকে আর অপরদিকে রাখতে হবে এ হাদীসটি এবং এ হাদীসটির ব্যাখ্যা ঐসবের সাথে সামঞ্জস্যশীল করার পরিবর্তে, ঐগুলোকে হাদীসটির ছাঁচে ঢালবার চেষ্টা করত হবে। কুরআন এবং সমস্ত সহীহ হাদীসগুলোতে ‘রিবা’কে হারাম বলা হয়েছে। তার অর্থ এই যে, মুসলমানগণ পরস্পরেও এর লেনদেন করতে পারবে না এবং অন্য জাতির সাথেও এ কারবার জায়েয হবে না। রাসুলুল্লাহ (সঃ) নাজরানবাসীদের সাথে যে চুক্তি করেছিলেন তাঁর থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, মুসলমানগণ শুধু নিজেরাই সুদী লেনদেন থেকে বিরত থাকবে না। বরঞ্চ যে সকল অমুসলিমদের উপর তাদের ক্ষমতা চলে তাদেরকেও জোর করে এ কাজ থেকে বিরত রাখবে। সুদ হারাম হবার পর এমন একটি ঘটনাও ঘটেনি যে, নবীর অজ্ঞাতসারে বা তাঁর অনুমতিতে কোনো মুসলমান কোনো জিম্মী অথবা গায়ের জিম্মী কাফেরের সাথে সুদী কারবার করেছে। খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও এর কোনো নজীর পেশ করা যাবে না। শুধু সুদের ব্যাপারই নয়, অবৈধ চুক্তিসমূহের মধ্যে এমন একটিও নেই যার হারাম হবার বিধান নাযিল হবার পর তা সম্পাদন করার জন্যে নবী (সঃ)কাউকে অনুমতি দিয়েছেন। দৃষ্টিভংগী ও নীতির দিক দিয়ে যারা হরবী তারা তো দূরের কথা, যারা কার্যত যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, তারা ঠিক যুদ্ধের সময় নবী (সঃ)এর সাথে একটি অবৈধ চুক্তির উপরে কাজ করতে চাইলো এবং মোটা টাকা দিতে চাইলো, কিন্তু তিনি তা নিতে অস্বীকার করলেন।১.[এ ঘটনা ঘটে খন্দকের যুদ্ধের সময়।বর্ণনা করেছেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)।মুশরেকদের এক সম্ভ্রান্ত লোকের লাশ খন্দকে পড়ে যায়।তারা মুসলমানদেরকে টাকা দিয়ে সে লাশ খরিদ করতে চায়।নবী (সঃ)কে একথা জানানো হলে তিনি এরূপ করতে নিষেধ করেন।(ইমাম আবু ইউসুফের কেতাবুল খেরাজ-দ্রষ্টব্য)এর থেকে জানা গেছে যে,যুদ্ধের সময় দুশমনের সাথে অবৈধ চুক্তির উপর কারবার করার অনুমতি যদি দেয়া হয়ে থাকে,তথাপি তা ছিল অপছন্দনীয়।চরম অনিবার্য প্রয়োজন ছাড়া এরূপ চুক্তির সুযোগ গ্রহণ করা মুসলমানদের মর্যাদার খেলাপ।হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)এর সাথে জড়িত ঘটনা থেকেও একথার প্রমাণ মেলে।জুয়া হারাম হবার পূর্বে তিনি মক্কায় মুশরেকদের সাথে একটি বাজি ধরেছিলেন।এ বাজির টাকা তিনি এমন সময়ে নিয়েছিলেন,যখন মুশরেকদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল।শুধু সাময়িকভাবে যুদ্ধ বিরতি হয়েছিল।কিছু নবী(সঃ) এ টাকাও হালাল ও পবিত্র করেননি।সে জন্যে তিনি হযরত আবু বকর (রাঃ)কে বাজির মাল সদকা করে দিতে বলেন।]
একদিকে রয়েছে কুরআনের আয়াত, নবীর বিভিন্ন সহীহ হাদীস, নবী (সঃ)এর জামানার প্রমাণিত কার্যকলাপ, যার থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, মুসলমানদের শুধু সুদই নয়, যাবতীয় অবৈধ চুক্তি নিরংকুশভাবে নাজায়েয এবং এতে মুসলিম অমুসলিম অথবা হরবী ও জিম্মীর কোনো পার্থক্য নেই। অপর দিকে রয়েছে একটি মুরসাল হাদীস যা এ সবের মতের বিরুদ্ধ হরবী এবং মুসলমানের শুধু লেনদেন হালাল বলছে। আপনি এ হাদীসটির প্রতি এতখানি গুরুত্ব দিয়েছেন যে, তাঁর উপর ভিত্তি শুধু সুদই নয়, যাবতীয় অবৈধ চুক্তি সকল গায়ের জিম্মী কাফেরের সাথে সাধারনভাবে হালাল করে দিয়েছেন। আমি তাকে সঠিক মনে করে শুধু এতটুকু অবকাশ বের করতে পারি যে, যুদ্ধের অনিবার্য জরুরী অবস্থায় যদি কোনো মুসলমান দুশমনের নিকট থেকে সুদ গ্রহন করে অথবা অবৈধ চুক্তির উপর কারবার করে তাহলে তাঁর জন্যে জবাবদিহি করতে হবে না।
এ শুধুমাত্র একটি অনুমতি যার সুযোগ কোনো উন্নত ধরনের মুসলমান কখনো গ্রহণ করেনি। ইসলামের আত্মসম্মানবোধ এটাই দাবী করে যে, মুসলমান যেন কোনো অবস্থাতেই অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ গ্রহণে আগ্রহান্বিত না হয়। বিশেষ করে কাফের এবং দুশমনদের বিরুদ্ধে তো তাদের জাতীয় চরিত্রের মহত্ব অধিকতর শান-শাওকতের সাথে প্রকাশ করা উচিত। কারণ মুসলমানের যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে তীর-ধনুকের যুদ্ধ নয়- আদর্শ ও চরিত্রের যুদ্ধ। তার উদ্দেশ্য সম্পদ ও ভূখন্ড অর্জন করা নয়, বরঞ্চ সে চায় দুনিয়ায় তাঁর আদর্শের প্রচার ও প্রসার করতে। যদি সে তাঁর চারিত্রিক মহত্বই হারিয়ে ফেলে এবং যে আদর্শ প্রচারের জন্যে সে দাড়িয়েছিল, তা যদি স্বহস্তে সে ধ্বংস করে তাহলে অপর জাতির উপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব রইলো কোথায়? কিসের ভিত্তিতে সে অন্যের উপর জয়ী হবে এবং কোন শক্তি বলে সে অন্যের হৃদয়-মন জয় করবে?
দারুল হরবের আলোচনা
এখন আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্নটির দিকে মনোনিবেশ করা উচিত। তা হচ্ছে এই যে, দারুল ইসলাম ও দারুল হরবের পার্থক্যের ভিত্তিতে সুদ এবং যাবতীয় অবৈধ চুক্তির বিধানসমূহের পার্থক্য কি। আর একথারই বা মূলতত্ত্ব কি যে, সকল গায়ের জিম্মী কাফেরের রক্ত ও সম্পদ বৈধ, অতএব সকল সম্ভাব্য উপায়ে তাদের সম্পদ হস্তগত করা জায়েয? এ ফতোয়ার জন্যে শরীয়তে কতটুকু অবকাশ আছে যে, যে কোনো রাষ্ট্রের উপর যে কোনো অর্থে দারুল হরবের পরিভাষা প্রয়োগ করা যাবে। সেখানকার অধিবাসীদের উপর চিরকাল সেসব বিধান জারী হওয়া উচিৎ যা দারুল হরবের সাথে সম্পর্কিত।
ইসলামী আইনের তিনটি বিভাগ
এ ব্যাপারে একথা মনের মধ্যে বদ্ধমূল করে নিতে হবে যে, শরীয়ত তহা ইসলামী আইনের তিনটি বিভাগ আছেঃ
একঃ বিশ্বাসমূলক আইন। এ সকল মুসলমানের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
দুইঃ শাসনতান্ত্রিক আইন। এ শুধু ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
তিনঃ আন্তর্জাতিক আইন। সঠিক অর্থে বৈদেশিক সম্পর্কের আইন।
এ মুসলমান অমুসলমান নির্বিশেষে সকলের সম্পর্কে আলোচনা করে। আমাদের ফেকাহর গ্রন্থগুলোতে এ আইনগুলোকে পৃথক পৃথকভাবে প্রণয়ন করা হয়নি। তাদেরকে পৃথক পৃথক নামেও অভিহিত করা হয়নি। কিন্তু কুরআন ও হাদীসে এমন সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যার থেকে স্বভাবিকভাবে তিনটি পৃথক পৃথক পথে ইসলামী আইনের ক্রমবিকাশ ঘটেছে। বিশেষ করে যে মহান ইসলামী শাস্ত্রবিদের আইন সম্পর্কিত দূরদর্শিতা এবং ফেকাহ শাস্ত্রের সূক্ষ জ্ঞান সর্বাধিক পরিমানে এসব ইঙ্গিত করতে পেরেছে ও তাঁর ভিত্তিতে এ তিনটি বিভাগের সীমারেখার সঠিক পার্থক্য নির্ণয় করেছে এবং জটিল জটিল সমস্যায় এ পার্থক্য অক্ষুন্ন রেখেছে, তিনিই হলেন ইমাম আবু হানিফা (রঃ)। ইসলামী শাস্ত্রবিদগণের মধ্যে কাউকেই এ ব্যাপারে তাঁর সমকক্ষ দেখা যায় না। এমনকি ইমাম আবু ইউসুফের মতো দূরদর্শী ফকীহও তাঁর স্থান পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি। ইমাম আযমের গভীর পান্ডিত্যের একটি নগন্য প্রমাণ এই যে, বারোশ বছর পূর্বে তিনি কুরআন হাদীস মন্থন করে শাসনতান্ত্রিক ও আন্তর্জাতিক আইনের যে বিধানগুলো রচনা করেন, বর্তমান জগতের আইন সম্পর্কিত চিন্তাধারার ক্রমবিকাশ তাঁর থেকে এক ইঞ্চিও সামনে অগ্রসর হতে পারেনি। বরঞ্চ অধিকতর সত্য কথা এই যে, আসলে এ ক্রমবিকাশ হয়েছিল সেইরূপরেখার উপরেই যা বারোশ বছর পূর্বে কুফার জনৈক বস্ত্র ব্যবসায়ী অংকিত করেছিলেন। আধুনিক যুগের আইন-কানুনে হানাফী মতাদর্শের তুলনায় বাহ্যত যে ক্রমোন্নতি পরিলক্ষিত হয়, তা কিয়দাংশ তামাদ্দুনিক অবস্থার পরিবর্তন ও বহুলাংশে আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহের ফলশ্রুতি। তথাপি নীতিগত দিক দিয়ে আধুনিক যুগের আইন-কানুন বহুলাংশে হানাফী ফেকাহরই চর্বিত-চর্বন। এসব অধ্যায়নের দ্বারা হানাফী ফেকাহ অনুধাবন করা বড় সহজ হয়।
বিশ্বাসমুলক আইন
আকীদাহ-বিশ্বাসমূলক আইন অনুযায়ী পৃথিবী দুটো জাতিতে বিভক্ত-ইসলাম ও কুফর। সমস্ত মুসলমান এক জাতি এবং সমস্ত কাফের মিলে অন্য জাতি। ইসলাম অবলম্বনকারী সকলে ইসলামী জাতীয়তার অন্তর্ভুক্ত এবং ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে সকলেই একে অপরের উপর অধিকার রাখে।
(আরবী*******)
“তারপর যদি তারা কুফর থেকে তওবা করে নামায কায়েম করে এবং যাকাত দেয়, তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই।”-(সূরা তওবাঃ ১১)
মুসলমানের জান-মাল ইজ্জত-আবরু সবকিছুই মুসলমানের জন্যে হারাম।
(আরবী******)
“তোমাদের জন্যে একে অপরের খুন, মাল ও ইজ্জত হারাম (বিদায় হজ্জ)।”
ইসলামে যাবতীয় বিধান মেনে চলা প্রত্যেক মুসলমানের ওয়াজিব, তা সে দুনিয়ার যে কোনো স্থানেই থাকুক না কেন, যা কিছু ফরজ করা হয়েছে, তা সকলের জন্যে। যা কিছু হালাল করা হয়েছে তা সকলের জন্যে এবং যা কিছু হারাম করা হয়েছে, তা সকলের জন্যে। কারণ প্রত্যেক বিধানের লক্ষ্যই হলো (আরবী*****) তারা যারা ঈমান এনেছে। কোনো অবস্থা ও স্থানের শর্ত তাতে নেই।
পক্ষান্তরে, কুফর একটি অন্য জাতি। যাদের সাথে আমাদের মতভেদ হলো আদর্শ, বিশ্বাস ও জাতীয়তার।১.[প্রকাশ থাকে যে, এখানে আমরা জাতীয়তা, শব্দটি বংশীয় ও ভৌগলিক জাতীয়তার অর্থে বলছি না, বরঞ্চ বলছি কৃষ্টিগত জাতীয়তার স্বার্থে। কৃষ্টিগত জাতীয়তার উপরেই ইসলাম তামাদ্দুনিক ও রাজনৈতিক জাতীয়তার প্রাসাদ নির্মাণ করে। এক মায়ের দুটো সন্তান জন্মগতভাবে এক জাতীয়তার অন্তর্ভুক্ত।এক মহল্লার দুজন বাসিন্দা ভৌগলিক দিক দিয়ে এক জাতীয়তার লোক। কিন্তু তাদের একজন যদি মুসলমান এবং অন্যজন কাফের হয়,তাহলে তাদের কৃষ্টিগত জাতীয়তা হবে পৃথক পৃথক এবং আদর্শ ও নীতির দিক দিয়ে এমন এক মতানৈক্য সৃষ্টি হয়, যার আলোচনা আমরা এখানে করতে চাই।] মূলত তাদের ও আমাদের মধ্যে সংগ্রাম হচ্ছে এ মতভেদের ভিত্তিতে। তবে যদি সন্ধি, চুক্তি অথবা দায়িত্ব গ্রহনের কোনো অবস্থা দাঁড়ায়, তাহলে সেটা হবে এর ব্যতিক্রম। অতএব ইসলাম ও কুফর, মুসলমান ও কাফেরের মধ্যে সন্ধি আসল বস্তু নয়, আসল বস্তু যুদ্ধ এবং সন্ধি সাময়িকভাবে তারপর এসে দাঁড়ায়। কিন্তু এ যুদ্ধ বাস্তব নয়। চিন্তা ও আদর্শমূলক। তাঁর অর্থ এই যে, যতোক্ষন পর্যন্ত আমাদের ও তাদের জাতীয়তা আলাদা এবং আমাদের উভয়ের আদর্শ পরস্পর সংঘর্ষশীল, ততোক্ষন আমাদের এবং তাদের মধ্যে সত্যিকার এবং স্থায়ী সন্ধি ও বন্ধুত্ব হতে পারে না।
(আরবী*******)
“হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কাফেরদের বলেন, তোমাদের সাথে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব মাবুদগণের তোমরা ইবাদত কর তাদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের থেকে পৃথক হয়ে গেছি এবং আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরদিনের জন্যে শত্রুতা হয়ে গেল। যতোক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর উপর ঈমান এনেছো।” (মুমতাহিনাঃ ৪)
এ বিষয়টিকে নবী করীম (সঃ) একটি সংক্ষিপ্ত হাদীসে পরিপূর্ণরূপে বর্ননা করেনঃ
(আরবী******)
“আমাদের আদেশ করা হয়েছে যে, আমি লোকের সাথে ততোক্ষণ পর্যন্ত সংগ্রাম করি, যতোক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর বান্দাহ ও রসূল এবং যতোক্ষণ না আমাদের কেবলার দিকে মুখ করে। আমাদের যবেহ করা পশু খায় এবং আমাদের মতো নামায পড়ে। তারা যখন এরুপ করবে, তখন আমাদের জন্যে তাদের খুন ও মাল হারাম হয়ে যাবে। তবে হকের জন্যে কোনো প্রাণ হত্যা করলে সে অন্য কথা। এরপর তাদের অধিকার তাই হবে যা মুসলমানদের এবং সেসব দায়িত্বই আরোপিত হবে যা মুসলমানদের উপর।”(আবু দাউদ মুশরিকদের সাথে সংগ্রাম সম্পর্কিত অধ্যায়)
এ বিশ্বাসমূলক আইনের দৃষ্টিতে ইসলাম ও কুফরের মধ্যে চিরন্তনের সংগ্রাম। কিন্তু এ সংগ্রাম নিছক চিন্তাধারামূলক (THEORETICAL) প্রত্যেক কাফের হরবী (ENEMY)। কিন্তু এ অর্থে যে, যতোক্ষণ আমাদের ও তাদের জাতীয়তা পৃথক ততোক্ষণ তাদের সঙ্গে সংগ্রামের ভিত্তি বর্তমান থাকবে। প্রতিটি দারুল কুফরই দারুল হরব। কিন্তু তাঁর অর্থ শুধু এই যে, যতোক্ষণ তা দারুল কুফর থাকবে ততোক্ষণ তা যুদ্ধের ক্ষেত্র থাকবে। অথবা অন্য কথায় যুদ্ধাবস্থার সামগ্রিক বিলুপ্তি হতে পারে জাতীয়তার বিভিন্নতা দূর হবার পর। এ আইন শুধু একটি মতবাদ এবং মৌলিক নীতি সুস্পষ্ট করে মুসলমানদের সামনে তুলে ধরেছে। যার উপর তাদের বাস্তব কর্ম্পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত। এখন রইলো অধিকার ও দায়িত্ব এবং যুদ্ধ সন্ধির বাস্তব সমস্যাবলী। তা এ আইনের সাথে তার কোনোই সম্পর্ক নেই। তার সম্পর্ক হলো শাসনতান্ত্রিক ও আন্তর্জাতিক আইনের সাথে।