আধুনিক ব্যাংকিং
সুদের বিভীষিকার আলোচনা এখনো শেষ হয়নি। বর্তমান যুগে সুদের আভ্যন্তরীন ক্ষতিকর ক্ষমতা আগের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। এর মূলে রয়েছে আগের মহাজনী সুদের পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক ব্যাংকিং পদ্ধতির অবতারণা। এ নতুন সংগঠনটি প্রাচীন মহাজনের গদিতে আধুনিক কালের ব্যাংকার ও ধনিক গোষ্ঠীকে বসিয়ে দিয়েছে। এদের সুযোগ্য হাতের স্পর্শে সুদের অস্ত্র সকল যুগের চেয়ে অধিকতর ধ্বংসকর ক্ষমতা লাভ করেছে।
প্রাথমিক ইতিহাস
সুদের এ আধুনিক পদ্ধতিটির অন্তর্নিহিত প্রকৃতি জানতে হলে এর প্রাথমিক ইতিহাস জানা থাকা প্রয়োজন।
পাশ্চাত্য দেশের সুদের প্রারম্ভকাল সম্পর্কে নিম্মোক্ত তথ্যাদি জানা যায়। প্রথমদিকে দেশে কাগজের নোটের প্রচলন ছিল না। কাজেই অধিকাংশ লোক স্বর্ণের আকারে নিজেদের অর্থ সঞ্চয় করে রাখত। এ অর্থ গৃহে রাখার পরিবর্তে নিরাপত্তার খাতিরে স্বর্ণকারের নিকট গচ্ছিত রাখা হতো। স্বর্ণকার যে পরিমাণ অর্থ জমা নিতো প্রত্যেক ব্যক্তিকে সে পরিমাণ স্বর্ণের হিসেব করে রসিদ লিখে দিতো। রসিদে একথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতো যে, “এ রসিদ বাহকের এ পরিমাণ স্বর্ণ অমুক স্বর্ণকারের নিকট গচ্ছিত ও সংরক্ষিত রয়েছে”। ধীরে ধীরে এ রসিদগুলো ক্রয়-বিক্রয়, ঋণ আদায় ও দেনা-পাওনা মীমাংসা করার ব্যাপারে একজনের থেকে অন্য জনের নিকট স্থানান্তরিত থাকে। লোকেরা প্রতিটি লেনদেনের ক্ষেত্রে স্বর্ণকারের নিকট থেকে স্বর্ণ উঠিয়ে তার মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করার চেয়ে স্বর্ণের রসিদের আদান-প্রদানের মাধ্যমে ব্যবসায়িক লেনদেন করাটা অধিকতর সহজ মনে করতো। একজনের নিকট রসিদ সোপর্দ করা তাকে স্বর্ণ সোপর্দ করার অর্থ বুঝাতো। এভাবে সব রকমের ব্যবসায়িক লেনদেনে এ রসিদগুলো ধীরে ধীরে যর্থাথ স্বর্ণের স্থলাভিষিক্ত হতে থাকে। একটি রসিদের স্থলে স্বর্ণকারের নিকট যে পরিমাণ স্বর্ণ সংরক্ষিত থাকে তা বের করে আনার প্রয়োজন কোন রসিদ বাহকের অতি অল্পই দেখা দিতো। কোন ব্যক্তির যখন কাঁচা স্বর্ণের প্রয়োজন দেখা দিতো একমাত্র তখনই স্বর্ণকারের নিকট থেকে ঐ স্বর্ণ বের করা হতো। নচেৎ বিনিময় মাধ্যম হিসেবে স্বর্ণের সাহায্যে যতগুলো কাজ চলা সম্ভব তা সবই ঐ রসিদের সাহায্যে চলতো। ঐ রসিদ কারোর নিকট থাকার অর্থই হচ্ছে সে তাতে উল্লেখিত পরিমাণ স্বর্ণের মালিক।
এ অভিজ্ঞতা থেকে স্বর্ণকাররা জানতে পারলো যে, তাদের নিকট যে স্বর্ণ জমা আছে তা বড় জোর এক-দশমাংশ মালিকেরা নিয়ে যায় অবশিষ্ট নয় ভাগ তাদের অর্থ ভাণ্ডারে অযথা পড়ে থাকে। তারা এ নয় ভাগ স্বর্ণ ব্যবহার করার কথা চিন্তা করলো। এ জন্য তারা ঐ স্বর্ণগুলো থেকে লোকদেরকে ঋণ দিতে লাগলো এবং তারা বিনিময়ে তাদের নিকট থেকে সুদ গ্রহণ করতে থাকলো। এগুলো তারা এমনভাবে ব্যাবহার করতে লাগলো যেন মনে হচ্ছিল তারাই এগুলোর মালিক। অথচ তারা এর মালিক ছিলনা, মালিক ছিল অন্য লোক। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, তারা ঐ স্বর্ণ সংরক্ষণের বিনিময়ে একদিকে মালিকদের নিকট থেকে অর্থ আদায় করতো আবার অন্যদিকে ঐ স্বর্ণ ঋন দিয়ে লোকদের নিকট থেকে সুদ উসুল করতো।
স্বর্ণকাররা এখানেই ক্ষান্ত হলো না। তাদের চালবাজী ও প্রতারণা আরো এগিয়ে চললো। তারা আসল স্বর্ণ ঋণ দেয়ার পরিবর্তে পরিমিত পরিমাণ স্বর্ণ উল্লেখ করে ঋণদাতাদেরকে কাগজের রসিদ লিখে দিতে লাগলো। কারণ তারা দেখেছিল তাদের কাগজী রসিদ বাজারে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে স্বর্ণের সমস্ত কাজ করে যাচ্ছিল। উপরন্তু তারা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানতে পেরেছিল যে, মালিকদের পক্ষ থেকে সাধারণত দশ ভাগের এক ভাগ স্বর্ণ ফেরত চাওয়া হচ্ছে এবং বাকি ৯ ভাগ তাদের হাতে অব্যবহৃত অবস্থায় থেকে যাচ্ছে। এ অবস্থায় তারা ৯ ভাগের উপর ভিত্তি করে কেবলমাত্র ৯ ভাগের নয় বরং ৯০ ভাগের জাল রসিদ তৈরী করে কাগজী মুদ্রা হিসেবে বাজারে ছাড়তে ও ঋণ দিতে লাগলো। একটা দৃষ্টান্ত দিলে ব্যাপারটা বুঝা আরো সহজ হবে। মনে করুন, এক ব্যক্তি একশো টাকার স্বর্ণ এক স্বর্ণকারের নিকট গচ্ছিত রাখলো। স্বর্ণকার একশো’ টাকার দশটি রসিদ তৈরী করলো এবং ঐ দশটি রসিদের প্রত্যেকটিতে লিখলোঃ এ রসিদের স্থলে একশো টাকার স্বর্ণ আমার নিকট গচ্ছিত আছে। এ দশটি রসিদের একটি (যার স্থলে যথার্থই একশো টাকার স্বর্ণ গচ্ছিত রয়েছে) সে স্বর্ণ জমাকারীকে দিল এবং অবশিষ্ট ৯টি রসিদ ( যেগুলোর স্থলে আসলে কোনো স্বর্ণ জমা ছিলনা) অন্য লোকদেরকে ঋণ দিল এবং তা থেকে সুদ গ্রহণ করতে থাকলো।
নিঃসন্দেহে এটা ছিল একটা বড় রকমের প্রতারণা। এভাবে প্রবঞ্চনা ও জালিয়াতির মাধ্যমে তারা সম্পূর্ণ ভুয়া মুদ্রার আকারে শতকরা ৯০ ভাগ জাল টাকা তৈরী করে তার মালিক সেজে বসলো। উপরন্তু সমাজের মাথায় সেগুলোকে ঋণ হিসেবে চাপিয়ে দিয়ে সেগুলো থেকে সুদ উসুল করতে লাগলো। অথচ এ অর্থ তাদের উপার্জিত নয়। কোনো বৈধ পদ্ধতিতে তারা এগুলোর মালিকানা অধিকারও লাভ করেনি। এগুলো আসল মুদ্রাও ছিলনা, যার ফলে এগুলোকে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে বাজারে চালানো এবং এর বিনিময়ে বস্তু ও সেবা লাভ করা নৈতিকতা, আইন ও অর্থনীতির দিক থেকে বৈধ হবার কোনো সঙ্গত কারণ ছিলনা। কোনো সরল প্রাণ ব্যক্তি যখন তাদের কীর্তি-কলাপের এ বিশদ বিবরণী শোনে তখন তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রতারণা, প্রবঞ্চনা ও জালিয়াতি সম্পর্কিত অপরাধ দণ্ডবিধির ধারা-উপধারা গুলো একের পর এক। সে আশা করতে থাকে বোধহয় এর পরে সে শোনবে ঐ প্রতারক স্বর্ণকারদের বিরুদ্ধে মামলা চালানো হয়েছে। কিন্তু না ব্যাপারটি তা হয়নি। অবস্থা বরং সেখানে একেবারে উল্টোটাই হয়েছে। এতদিন ক্রমাগত জাল মুদ্রার ব্যবসা চালিয়ে এ স্বর্ণকারেরা দেশের শতকরা ৯০ ভাগ অর্থের মালিক হয়ে বসেছিল। দেশের রাজা, মন্ত্রী, আমীর-উমরাহ সবাই তাদের ঋণের জালে আটকে পড়েছিল। এমনকি যুদ্ধকালে এবং অভ্যন্তরীণ সংকট উত্তরণের জন্যে বিভিন্ন দেশের সরকার তাদের নিকট থেকে বড় বড় ঋণ নিয়েছিল। কাজেই এ অবস্থায় তারা এত বিপুল অর্থের মালিক হল কিভাবে এ কথা বলার মতো বুকের পাটা কারোর ছিলনা। উপরন্তু ইতিপূর্বে আমার ‘ইসলাম ও আধুনিক অর্থনৈতিক মতবাদ’ গ্রন্থেও আমি একথা বলেছিলাম যে, ইউরোপীয় রেনেসাঁর যুগে চিন্তার মুক্তি এবং স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের শক্তিশালী অস্ত্র নিয়ে পুরাতন জায়গীরদারীর মোকাবিলায় যে নতুন বুর্জোয়া সভ্যতার উদ্ভব হচ্ছিল তার নেতা ও অগ্রবাহিনী ছিল এ মহাজন ও বড় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। তাদের পিছনে দর্শন, সাহিত্য ও শিল্পকলার বিপুল শক্তি কাজ করছিল। এ স্বর্ণকার সাহেবদের বিশাল ধন ভাণ্ডারের উৎস সন্ধান প্রয়াসী যে কোনো দুঃসাহসিক অভিযাত্রীর উপর তারা বাজ পাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সর্বদা প্রস্তুত ছিল। এভাবে যে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে তারা এ সম্পদ আহরণ করেছিল তা আইনের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে, এমনকি আইন তাকে সম্পূর্ণ বৈধ বলে স্বীকার করে নিয়েছে এবং বিভিন্ন দেশের সরকার বর্তমান ব্যাংক মালিক ও ফাইন্যান্সয়ারে পরিণত এ স্বর্ণকারদের নোট চালু করার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের কাগজের নোট ব্যবসা জগতে চালু হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় পর্যায়
যে মূলধনের ভিত্তিতে পুরাতন যুগের স্বর্ণকাররা আধুনিক পুঁজিপতি ও অর্থনৈতিক জগতের প্রতিপত্তিশালী প্রভুতে পরিণত হলো উপরের আলোচনায় তার আসল চেহারা তুলে ধরা হয়েছে। অতঃপর তারা আর এক পা অগ্রসর হলো, যা ছিল আগের চেয়েও মারাত্মক ক্ষতিকর। ভুয়া মূলধনের ভিত্তিতে আধুনিক পুঁজিবাদের এ শক্তিশালী আত্মপ্রতিষ্ঠায় যুগটি ছিল পাশ্চাত্য সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
এ সময় পশ্চিম ইউরোপ থেকে একদিকে শিল্প ও বাণিজ্য বন্যার বেগে অগ্রসর হয়ে সমগ্র বিশ্ব জয় করতে উদ্যত হয়েছিল এবং অন্যদিকে সভ্যতা ও সংস্কৃতির একটি নতুন ভিত গড়ে উঠেছিল -বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়ে মিউনিসিপ্যালিটি পর্যন্ত জন জীবনের সর্বক্ষেত্রকে সে নতুন করে গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছিল। এ সময় সব রকমের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজে অর্থের প্রয়োজন ছিল। নতুন নতুন শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিজেদের যাত্রা শুরু করার জন্য পুঁজি চাচ্ছিল। যেসব ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান আগে থেকেই প্রতষ্ঠিত ছিল তারা নিজেদের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য বড় রকমের পুঁজির সন্ধানে ছিল। সাংস্কৃতিক ও তামাদ্দুনিক উন্নতি বিষয়ক বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পরিকল্পনার কাজ শুরু করার ও সাফল্যের সাথে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যও অর্থের প্রয়োজন ছিল। এসব কাজের সাথে যারা জড়িত ছিল তাদের নিজেদের পুঁজি ও অর্থ এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট ছিলনা। কাজেই আধুনিক সভ্যতার এ নবজাত শিশুটিকে জীবন রসে সমৃদ্ধ করার জন্য মাত্র দু’টি উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভবপর ছিল? প্রথমত পূর্বতন স্বর্ণকার ও আধুনিক পুঁজিপতিদের সংগৃহীত অর্থ থেকে এবং দ্বিতীয়ত সমাজের মধ্যবিত্ত ও সচ্ছল শ্রেণীর নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত সঞ্চিত অর্থ থেকে।
এর প্রথম শ্রেণীর ধন-সম্পদগুলো একমাত্র পুঁজিপতিদেরই করতলগত ছিল। তারা আগে থেকেই সুদ গ্রহনে অভ্যস্ত ছিল। কাজেই অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে তাদের এ ধনের একটি পাই পয়সাও কোনো কাজে লাগার উপায় ছিলনা। এ উৎস থেকে শিল্পকার ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কর্মরত ব্যাক্তিবর্গ ঋণ বাবদই এ শর্তে অর্থ লাভ করে যে, তাদের লাভ-লোকসান যাই হোক না কেন এবং লাভের অংক যত বেশী বা কম হোক না কেন পুঁজিপতিদেরকে অবশ্যি একটি নির্ধারিত হার অনুযায়ী সুদ দিতে হবে।
অতঃপর দ্বিতীয় উৎসটিই ছিল একমাত্র আশা-ভরসা। একমাত্র এখান থেকেই অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কাজ-কারবারের যথার্থ নীতি সম্মত পদ্ধতিতে পুঁজি সরবরাহ হতে পারতো। কিন্তু পূর্বোল্লিখিত পুঁজিপতিগণ এমন কৌশল ও পদ্ধতি অবলম্বন করলো যার ফলে পুঁজির এ উৎসটিও তাদের করায়ত্ব হলো। এখান থেকেও সুদের পথ ছাড়া অন্য সমস্ত পথ দিয়ে অর্থনৈতিক ও তামাদ্দুনিক উন্নয়নমূলক কাজ-কারবারে পুঁজি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলো। পুঁজিপতিদের কৌশলটি ছিলঃ যারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত আয় সঞ্চয় করতো অথবা প্রয়োজন অপূর্ণ রেখে কিছুটা সঞ্চয় করতে অভ্যস্ত ছিল সুদের লোভ দেখিয়ে পুঁজিপতিদেরকে তাদের সঞ্চিত ধন নিজেদের দিকে টানতে লাগলো। আগেই আলোচিত হয়েছে যে, এ স্বর্ণকার পুঁজিপতিরা এ শ্রেণীর লোকদের সাথে পূর্ব থেকেই সম্পর্কিত ছিল এবং তাদের সঞ্চিত অর্থ এসব স্বর্ণকার পুঁজিপতিদের নিকট আমানাত স্বরূপ জমা থাকতো। পুঁজিপতিরা যখন দেখলো এসব অর্থ তাদের নিকট আসার পরিবর্তে ব্যবসায়ে খাটতে শুরু হয়েছে এবং বিভিন্ন কোম্পানীর শেয়ার ক্রয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে তখন তারা প্রমাদ গুণলো। তারা এ শ্রেণীর লোকদেরকে বুঝাতে লাগলো, আপনারা টাকা দিয়ে বিপদ কিনে আনছেন কেন? এভাবে তো আপনাদেরকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। শেয়ার সম্পর্কিত বিষয়াদি আপনাদের নিজেদের মিমাংসা করতে হবে, কোম্পানীর হিসেব রাখতে হবে এবং সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার হচ্ছে, এভাবে আপনাদের লোকসানের ঝুঁকিও নিতে হবে। আর মুনাফার জোয়ার-ভাটার প্রভাব আপনাদের আয়ের ওপর পড়তে বাধ্য হবে। এর চেয়ে ভালো ও সহজ পথ হচ্ছে, আপনাদের অর্থ আমাদের নিকট জমা রাখুন, আমরা তা সংরক্ষণ করবো এবং এজন্য কোনো পারিশ্রমিক নেবো না। আমরা বিনা পারিশ্রমিকেই অর্থের পূর্ণ হিসেব রাখবো। আপনাদের নিকট থেকে কিছু নেয়ার পরিবর্তে বরং আমরা আপনাদেরকে নিয়মিত সুদ দিতে থাকবো।
এ কৌশল অবলম্বিত হবার ফলে সঞ্চিত অর্থের শতকরা ৯০ ভাগ বরং এর চেয়েও বেশী অর্থ সরাসরি অর্থনৈতিক ও তামাদ্দুনিক কাজে ব্যবহৃত হবার পরিবর্তে পুঁজিপতিদের হাতে চলে গেল। এভাবে সম্ভাব্য সকল প্রকার ব্যবসায়ে লগ্নিযোগ্য পুঁজি পুঁজিপতিদের হস্তগত হলো। অবস্থা এ পর্যায়ে এসে দাঁড়ালো যে, পুঁজিপতিরা পূর্ব থেকেই তাদের ভুয়া পুঁজি সুদী ব্যবসায়ে খাটিয়ে আসছিল, এখন অন্যদের পুঁজিও তারা সস্তা সুদে গ্রহণ করে চড়া সুদে ঋণ দিতে লাগলো। এর ফলে কোথাও কোনো কাজের জন্য তাদের নির্ধারিত সুদের হার ছাড়া অন্য কোনো হারে বা শর্তে পুঁজি সংগ্রহ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। পুঁজিপতিদের মাধ্যম ও সহযোগিতা ছাড়াই সরাসরি ব্যবসায় পুঁজি খাটাতে আগ্রহী যে স্বল্প সংখ্যক লোক থেকে গিয়েছিল একটি নির্ধারিত হারে মুনাফা অর্জন করার স্বাদ তাদেরকেও পাগল করে তুলেছিল এবং তারা সরাসরি কোম্পানীর শেয়ার কেনার পরিবর্তে ঋণপত্র (DEBENTURES) কেনাকে অগ্রাধিকার দিতে লাগলো যেহেতু এর মধ্যে একটি নির্ধারিত হারে মুনাফা লাভের নিশ্চয়তা ছিল।
এ কর্মপদ্ধতি অবলম্বিত হবার ফলে সমাজ পরিপূর্ণরূপে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে থাকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রসমূহে কর্মরত সমাজের সমগ্র জনবসতি, যাদের পরিশ্রম, প্রচেষ্টা ও যোগ্যতার উপর সমস্ত সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উৎপাদন নির্ভরশীল। আর অন্যদিকে থাকে মুষ্টিমেয় জনবসতি যাদের উপরে থাকে এ সমস্ত ক্ষেত্রে পানি সিঞ্চন করার কাজ। পানি সিঞ্চনকারীরা ক্ষেত মজুরদের সাথে ইনসাফ ভিত্তিক সহযোগিতা করতে অস্বীকার করে। তারা সমগ্র পানি সম্পদকে সামষ্টিক স্বার্থের পরিবর্তে কেবলমাত্র ব্যাক্তিগত স্বার্থে এবং তাও আবার নিছক অর্থনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার স্থায়ী নীতি গ্রহণ করে।
এ কর্মপদ্ধতি স্থীরিকৃত করে দেয় যে, সমগ্র দুনিয়ার ওপর ভাবী কর্তৃত্বশালী পাশ্চাত্যের এ নবজাত সভ্যতা হবে একটি নির্ভেজাল বস্তুবাদী সভ্যতা। সেখানে সুদের হার এমন একটি মৌলিক মানদণ্ড হিসেবে গণ্য হবে যার মাধ্যমে সমস্ত জিনিসের মূল্যমান নির্ধারিত হবে। কারণ ধন হচ্ছে সভ্যতার জীবনীশক্তি দানকারী পানির পর্যায়ভুক্ত এবং এ পানি ছাড়া সভ্যতার চাষ সম্ভব নয় কিন্তু সুদের হার অনুযায়ী এ পানির প্রতিটি বিন্দুর একটি আর্থিক মূল্য নির্ধারিত হয়েছে। কাজেই সভ্যতার সমগ্র ক্ষেত্রে যদি কোনো শস্য বীজ বপন করা হয় এবং কোনো উৎপন্ন ফসল মূল্যবান বিবেচিত হয় তাহলে তা হতে হবে এমন কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অর্থনৈতিক লাভ, যা কমপক্ষে বুর্জোয়া সভ্যতার প্রধান পরিচালক পুঁজিপতি নির্ধারিত সুদের হারের সমপরিমাণ হবে।
এ কর্মপদ্ধতি লেখনী ও তরবারি উভয়ের কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়েছে এবং এর স্থলে প্রতিষ্ঠিত করেছে খাতার কর্তৃত্ব। দরিদ্র কৃষক -মজুর থেকে শুরু করে বড় বড় শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এবং বৃহত্তম ও শক্তিশালী রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্য পর্যন্ত সবার নাকের ছিদ্র দিয়ে একটি অদৃশ্য দড়ি চালিয়ে দেয়া হয়েছে। এ দড়ির প্রান্তভাগ এসে গেছে পুঁজিপতির হাতে।
তৃতীয় পর্যায়
অতঃপর এ দলটি তৃতীয় পদক্ষেপ উঠালো। এবার তারা এ ব্যবসাকে আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করলো। প্রথমে তারা ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাজ চালাচ্ছিল। অনেক পুঁজিপতি পরিবারের অর্থনৈতিক কাজ-কারবার বৃদ্ধি পেতে পেতে বিরাট প্রতিষ্ঠানের রূপ নিয়েছিল এবং বিভিন্ন দূরবর্তী এলাকায় এগুলোর শাখা-প্রশাখা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বড় বড় প্রতিষ্ঠান হলেও এগুলো ছিল পৃথক পৃথক পরিবারের এবং এরা নিজেদের নামে কাজ করছিল। তারপর তারা চিন্তা করলো, ব্যবসায়ে বিভিন্ন শাখার যেমন যৌথ পুঁজির ভিত্তিতে কোম্পানী গঠিত হচ্ছে অনুরূপভাবে ধন ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও কোম্পানী গঠন করতে হবে এবং এজন্য বড় বড় সংগঠন কায়েম করতে হবে। এভাবেই আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার উৎপত্তি। এই ব্যাংক আজ সারা দুনিয়ার অর্থব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করছে।
এ আধুনিক সংগঠনটির গঠন পদ্ধতির পরিচয় সংক্ষেপে এভাবে দেয়া যায় যে, কয়েকজন পুঁজিপতি মিলে একটি সুদী প্রতিষ্ঠান কায়েম করে, তার নাম হচ্ছে ব্যাংক। এ প্রতিষ্ঠানে দু’ধরনের পুঁজি ব্যবহৃত হয়। এক, অংশীদারের পুঁজি, এর সাহায্যে কাজের সূচনা করা হয়। দুই,আমানতকারীদের (DEPOSITOR) পুঁজি। ব্যাংকের কাজ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে এ পুঁজির পরিমাণ বেড়ে যেতে থাকে এবং এরই কারণে ব্যাংকের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও শক্তি বেড়ে যেতে থাকে। একটি ব্যাংকের সাফল্যের যথার্থ মানদন্ড হচ্ছে এই যে, তার নিকট তার নিজস্ব পুঁজি (অর্থাৎ অংশীদারদের পুঁজি) হবে সবচেয়ে কম কিন্তু আমানতকারীদের পুঁজি হবে সবচেয়ে বেশী। দৃষ্টান্তস্বরূপ পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের কথাই ধরুন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পূর্বে এ ব্যাংকটি সফল ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। এ ব্যাংকটির নিজের পুঁজি ছিল মাত্র এক কোটি টাকা। এর মধ্য থেকে ৮০ লাখের কিছু বেশি টাকা অংশীদাররা কার্যত আদায় করেছিল। কিন্তু ১৯৪৫ সালে এ ব্যাংকটি আমানতকারীদের সরবরাহকৃত যে পুঁজি ব্যবহার করছিল তার পরিমাণ ছিল প্রায় ৫২ কোটি টাকা।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, আমানতকারীদের টাকায় ব্যাংক তার সমস্ত কাজ চালায়, এ টাকার পরিমাণ ব্যাংকের সমুদয় পুঁজির শতকরা ৯০/৯৫ ভাগ বরং ৯৮ ভাগেও পৌঁছে যায় কিন্তু ব্যাংকের সংগঠন-শৃঙ্খলা ও পরিচালনা ব্যবস্থায় এবং তার নীতি-পদ্ধতিতে এ আমানতকারীদের কোনো অংশ থাকে না। এ ব্যবস্থাপনা ও নীতি-পদ্ধতি নির্ধারণের পরিপূর্ণ অধিকারী হয় ব্যাংক মালিকগণ -যাদের পুঁজি হয় সমগ্র পুঁজির মাত্র দু’ থেকে পাঁচ ভাগ। আমানতকারীদের কাজ হচ্ছে, তারা কেবল নিজেদের টাকা ব্যাংকে জমা করে দেয় এবং তা থেকে একটি নির্দিষ্ট হারে সুদ গ্রহণ করে। তাদের জমাকৃত টাকা ব্যাংক কোথায় কিভাবে খাটাচ্ছে এসব দেখার কোনো অধিকার তাদের নেই। এ অধিকার আছে কেবল অংশীদারদের। পরিচালকবৃন্দ নির্বাচন, নীতি ও পলিসি নির্ধারণ এবং সংগঠন,পরিচালনা ও হিসেব-নিকেশ তত্বাবধান সবকিছুই তাদের হাতে ন্যস্ত। পুঁজি কোন দিকে যাবে এবং কোন দিকে যাবে না এ সিদ্ধান্তও তারাই করে। আবার অংশীদারদেরও সবার মর্যাদা সমান হয় না। ব্যাংক ব্যবস্থায় একাধিক ক্ষুদ্র অংশীদারদের প্রভাব হয় অতি সামান্য নামকা ওয়াস্তে। আসলে কতিপয় বৃহৎ অংশীদারই পুঁজির এ বিরাট সরোবরটি দখল করে রাখে এবং তারাই এর পানি ইচ্ছা মতো ব্যবহার করে।
ব্যাংক যদিও বড় ছোট অনেক কাজ করে, এর মধ্যে কোনো কোনোটা অবশ্যি কল্যাণকর,প্রয়োজনীয় ও বৈধ বলে বিবেচিতও হয়, কিন্তু এর আসল কাজ হচ্ছে সুদের ভিত্তিতে পুঁজি বিনিয়োগ। ব্যবসায়িক ব্যাংক, শিল্প ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক বা অন্য যে কোনো ব্যাংক হোক না কেন, এরা নিজেরা কোনো ব্যবসায় শিল্প বা কৃষি করে না বরং ব্যবসায়ীদেরকে পুঁজির যোগান দেয় এবং তাদের নিকট থেকে সুদ আদায় করে। আমানতকারীদের নিকট থেকে কম সুদে পুঁজি নিয়ে ব্যবসায়ীদেরকে বেশি সুদে ঋণ দেয়াই হচ্ছে এ ব্যাংকগুলোর মুনাফার আসল ও বৃহত্তম উৎস। এভাবে যে লভ্যাংশ অর্জিত হয় তা অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অংশীদারদের মধ্যে লভ্যাংশ বন্টনের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী যথাযথভাবে অংশীদারদের মধ্যে বন্টিত হয়।
এ প্রসঙ্গে ব্যাংকগুলোর কর্মপদ্ধতির একটু বিস্তারিত বর্ণনা দিতে চাই। ব্যাংক ব্যবসায়ের যথার্থ চেহারা এতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।
ব্যাংকে যেসব আমানত রাখা হয় তাকে বড় বড় দুটো ভাগে বিভক্ত করা যায়ঃ মেয়াদী (FIXED) ও চলতি (CURRENT)। প্রথম শ্রেনীর আমানতটি কমপক্ষে তিন মাস বা এর ঊর্ধ সময়ের জন্য ব্যাংকে রাখা হয় এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর আমানতটি থেকে আমানতকারী সর্বদা টাকা উঠাতে থাকে এবং তাতে জমাও করতে থাকে। ব্যাংকের সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, যতদীর্ঘ সময়ের জন্য আমানত ব্যাংকে রাখা হয় সুদের হার হয় ততবেশী, আর যত অল্প সময়ের জন্য রাখা হয় সুদের হার তত অল্প। কোনো কোনো ব্যাংক চলতি হিসেবে (CURRENT ACCOUNT) নামকাওয়াস্তে সামান্য সুদ দেয়। কিন্তু বর্তমানে সাধারনভাবে এ হিসেবে কোনো সুদ দেয়ার নিয়ম নেই। বরং যারা চলতি হিসেব থেকে বারবার এবং বহুবার টাকা উঠায় তাদের নিকট থেকে ব্যাংক তাদের হিসেব রাখার পারিশ্রমিক আদায় করে অথবা তাদের অর্থের কিছু অংশ স্থায়ীভাবে ব্যাংকে জমা রাখার দাবি জানায়। এ স্থায়ী আমানতের সুদ থেকে ব্যাংক তার হিসেব রক্ষার ব্যয় উঠিয়ে নেয়।
প্রাত্যহিক লেনদেনের জন্য ব্যাংক নিজের পুঁজির একটি অংশ (শতকরা প্রায় ১০ থেকে ২৫ ভাগ) নগদ নিজের কাছে রেখে দেয়। আর একটি অংশ টাকার বাজারে (MONEY MARKET) ঋণ হিসেবে ছাড়ে। এ অর্থটি প্রায় নগদ, টাকার ন্যায় সর্বদা লভ্য ও ব্যবহারযোগ্য (LIQUID) থাকে। এর ওপর শতকরা ১/২ থেকে ১ ভাগ সুদ পাওয়া যায়। অতপর একটি অংশ হুন্ডির কারবারে এবং অন্যান্য স্বল্প মেয়াদী ঋণে ব্যবহৃত হয়। এগুলো যেহেতু স্বল্প সময়ের মধ্যে ফেরত দিতে হয় তাই এগুলোতেও সুদ কম। যেমন শতকরা ২ থেকে ৪ ভাগ বা এর চেয়ে কম-বেশি থাকে। এরপর পুঁজির একটি অংশ এমন কাজে লাগানো হয় যেখানে একদিকে পুঁজির সংরক্ষণের সর্বাধিক নিশ্চয়তা থাকে এবং অন্যদিকে প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট বস্তুগুলো বিক্রি করেও পুঁজি উঠিয়ে নেয়া যেতে পারে। এর সাথে এর ওপর শতকরা দুই তিন ভাগ সুদও উসুল করা হয়। যেমন সরকারী জামানত (GOVERNMENT SECURITIES) এবং নির্ভরযোগ্য কোম্পানির শেয়ার ও ঋণপত্র (DEBENTURES) সমূহে এ পুঁজি খাটানো হয়। প্রত্যেক ব্যাংক অর্থ রাখার পর এ তিনটি খাত আবশ্যিক রূপে নিজের কারবারের অন্তর্ভুক্ত করে কারণ তার নিরাপত্তার জন্য এ তিনটি অপরিহার্য। এর ফলে ব্যাংকের কোমর শক্ত হয় এবং বিপদ বা প্রয়োজনকালে তার কাজে লাগে।
অতপর পুঁজির একটি বিরাট অংশ ব্যবসায়ী ও সম্পদশালী ব্যক্তিদেরকে এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দেয়া হয়। এটিই হচ্ছে ব্যাংকের আয়ের বৃহত্তম উৎস। এখান থেকে সর্বাধিক হারে সুদ লাভ করা হয়। প্রত্যেক ব্যাংক তার সঞ্চিত পুঁজির বৃহত্তম অংশ এ খাতে ব্যবহার করার সুযোগ পেতে চায়। সাধারণভাবে ব্যাংকগুলো এ খাতে ৩০ থেকে ৬০ ভাগ পর্যন্ত পুঁজি খাটায় এবং প্রধানত দেশের ও বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে এর মধ্যে কমবেশী হতে থাকে।
এ বিস্তারিত আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ব্যাংক আমানতকারীদের ও নিজেদের পক্ষ থেকে প্রদত্ত পুঁজি বিভিন্ন সুদ গ্রহণকারী ঋণের খাতে খাটায়। এ সুদগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমাজের সাধারণ মানুষদের মাথায় চাপিয়ে দেয়া হয়। অতপর আমানতকারীদেরকে ‘মুনাফা’ নামক যে বস্তুটি দেয়া হচ্ছে তা তাদেরই ঋণ বাবদ সমাজের পকেট থেকে আদায়কৃত সুদের একটি অংশ বৈ আর কিছুই নয়। নিসন্দেহে ব্যাংক বৈধ পযায়ে কিছু কাজও করে থাকে এবং এর মাধ্যমে যে পারিশ্রমিক বা কমিশন লাভ করা হয় তা তার আয়ের মাধ্যমগুলোর অন্যতম। কিন্তু এ পথে ব্যাংক যা আয় করে তা তার সমগ্র আয়ের বড় জোর ৫ ভাগ হতে পারে।
ফলাফল
এভাবে পুঁজিপতিদের সংগঠন কায়েম হবার পর প্রথম যুগের একক ও বিক্ষিপ্ত মহাজনদের তুলনায় বর্তমানের একত্রীভূত ও সংগঠিত পুঁজিপতিদের মর্যাদা, প্রভাব ও আস্থা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে এবং এর ফলে সারা দেশের ধন-সম্পদ তাদের নিকট কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। আজকের দিনে এক একটি ব্যাংকে শত শত কোটি টাকা জমা হয়। মুষ্টিমেয় কয়েকজন প্রভাবশালী পুঁজিপতি এগুলো নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। এ পদ্ধতিতে তারা কেবল নিজের দেশের নয় বরং সারা দুনিয়ার অর্থনৈতিক, তমদ্দুনিক ও রাজনৈতিক জীবনের উপর চরম স্বার্থান্ধতা সহকারে কর্তৃত্ব করতে থাকে।
এদের শক্তিমত্তা আন্দাজ করার জন্য কেবল এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে,১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভাগের পূর্বে ভারতের বড় বড় ব্যাংকগুলোর অংশীদারদের সংগৃহীত পুঁজির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৭কোটি টাকা কিন্তু আমানতকারীদের গচ্ছিত পুঁজির পরিমাণ ছ’শ কোটি টাকায় পৌঁছে গিয়েছিল। এ ব্যাংকগুলোর সমগ্র শাসন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল বড়জোর দেড় দু’শ পুঁজিপতির হাতে কিন্তু একমাত্র সুদের লোভে দেশের লাখো লাখো লোক এ বিপুল পরিমাণ অর্থ তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল এবং এ শক্তিশালী অস্ত্র তারা কখন কোথায় কিভাবে ব্যবহার করে, সে ব্যাপারে কারোর কোনো চিন্তাই ছিল না। যে কোনো ব্যক্তি অনুমান করতে পারে, যেসব পুঁজিপতির হাতে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা হয়ে গেছে তারা দেশের শিল্প, ব্যবসায়, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতি সভ্যতার উপর কত ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে। এ প্রভাব দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থে কাজ করছে, না এসব স্বার্থান্ধ পুঁজিপতিদের নিজেদের স্বার্থদ্ধারে ব্যয়িত হচ্ছে তাও সহজেই অনুমেয়।
এ পর্যন্ত এমন এক দেশের অবস্থা বর্ণনা করলাম যেখানে পুঁজিপতিদের সংগঠন এখন সম্পূর্ণ প্রাথমিক পর্যায়ে অবস্থান করছে এবং ব্যাংকগুলোর মোট আমানত সমগ্র জনসংখ্যার উপর মাথাপিছু মাত্র ৭ টাকা করে পড়ে। এখন এই প্রেক্ষিতে অন্যান্য দেশের কথা চিন্তা করুন যেখানে এ হার মাথাপিছু হাজার দু হাজার টাকা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। চিন্তা করুন সেখানে পুঁজি কেন্দ্রীয়করণের কি অবস্থা। ১৯৩৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী কেবলমাত্র ব্যবসায়িক ব্যাংকগুলোর আমানতের হার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু ১৩১৭ পাউন্ড, ইংল্যান্ডে ১৬৬৪ পাউন্ড, সুইজারল্যান্ডে ২৭৫ পাউন্ড, জার্মানীতে ২১২ পাউন্ড ও ফ্রান্সে ১৬৫ পাউন্ড ছিল। এ দেশগুলোর অধিবাসীরা এত ব্যাপক হারে ও বিপুল পরিমানে নিজেদের অতিরিক্ত আয় ও সঞ্চিত পুঁজি তাদের পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিয়েছিল। প্রতিটি গৃহ থেকে সংগৃহীত এ বিপুল পরিমাণ অর্থ মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকটি হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল। যাদের নিকট এগুলো কেন্দ্রীভূত হচ্ছে তাদেরকে কারো নিকট জবাবদিহি করতে হয় না, নিজেদের প্রবৃত্তি ছাড়া অন্য কারো নির্দেশও তারা গ্রহণ করে না এবং নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আর কোনো দিকে তাদের দৃষ্টিও নেই। তারা কেবলমাত্র সামান্য সুদের আকারে এ বিরাট বিশাল ধনাগারের ‘ভাড়া’ আদায় করে যাচ্ছে এবং বাস্তবে তারাই এর মালিকে পরিণত হচ্ছে। অতপর এ শক্তির জোরে তারা বিভিন্ন দেশের ও জাতির ভাগ্য নিয়ে খেলা করে, তারা ইচ্ছামতো যে কোনো দেশে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে। তারা ইচ্ছামতো দু দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধায় আবার ইচ্ছামত যে কোনো সময় সন্ধি স্থাপন করায়। নিজেদের অর্থ লিপ্সার দৃষ্টিতে যে জিনিসটিকে তারা বান্ছনীয় মনে করে তার প্রচলন বাড়ায় ও বিকাশ সাধন করে, আবার যেটিকে অবান্ছনীয় মনে করে তার বিকাশ লাভের সমস্ত পথই বন্ধ করে দেয়। তাদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা কেবল বাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সাহিত্য ও জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র, বৈজ্ঞানিক গবেষনাগার, সাংবাদিক প্রতিষ্ঠান, ধর্ম চর্চা কেন্দ্র ও রাষ্ট্রীয় পার্লামেন্ট -সর্বত্রই তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। কারণ দেশের ও জাতির অর্থ সমুদয় তাদের ‘পায়ের ভৃত্যে’ পরিণত হয়েছে।
এ মহা বিপর্যয়ের ধ্বংসলীলা দেখে পাশ্চাত্য চিন্তাবিদগণই শিউরে উঠেছেন। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চ কলস্বরে ধ্বনি উত্থিত হচ্ছে; একটি অতি ক্ষুদ্র দায়িত্বহীন স্বার্থান্ধ শ্রেনীর হাতে ধনের এ বিপুল শক্তি কেন্দ্রীভূত হওয়া সমগ্র সমাজ ও জাতীয় জীবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো বলা হচ্ছে সুদের কারবার তো ছিল পুরোনো আমলের আড়তদার মহাজনদের অপবিত্র ও হারাম কারবার। আজকের যুগের উন্নত, রুচিশীল ও সুসভ্য ব্যাংকারগন অত্যন্ত পুত-পবিত্র কারবার করছেন। তাদের ব্যবসায়ে অর্থ খাটানো এবং তা থেকে নিজের অংশ নেয়া হারাম হবে কেন? অথচ পুরনো মহাজন ও আজকের এ ব্যাংকারদের মধ্যে যদি সত্যিই কোনো পার্থক্য সূচিত হয়ে থাকে, তাহলে তো কেবল এতটুকু যে, তারা একা একা ডাকাতি করত আর এরা দলবল জুটিয়ে ডাকাতদের বড় বড় দল গঠন করে, দলবদ্ধভাবে ডাকাতি করছে। এদের মধ্যে দ্বিতীয় পার্থক্যটি হচ্ছে, পুরোনো ডাকাতদের প্রত্যেকেই দরজা ও দেয়াল ভাঙ্গার যন্ত্রপাতি এবং মানুষ মারার অস্ত্র-শস্ত্র নিজেরাই আনতো কিন্তু আজ সমগ্র দেশবাসী নিজেদের নির্বুদ্ধিতা, মুর্খতা ও আইনের শৈথিল্যের কারনে অসংখ্য যন্ত্র ও অস্ত্র তৈরী করে, ‘সামান্য ভাড়ায়’ সংঘবদ্ধ ডাকাতদের হাতে তুলে দিচ্ছে। দিনের বেলায় তারা জনগনকে ‘ভাড়া’ আদায় করে আর রাতের আঁধারে ঐ জনগনের ওপর তাদের প্রদত্ত যন্ত্র ও অস্ত্রের সাহায্যে ডাকাতি করে।
এহেন ‘ভাড়া’-কে হালাল ও পবিত্র গণ্য করার জন্য আমাকে বলা হচ্ছে।
————