সংশোধনের কার্যকর পদ্ধতি
বর্তমান যুগের একটি উন্নতিশীল সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক প্রয়োজন পূরণে সক্ষম এমন একটি সুদ বিহীন অর্থব্যবস্থা বাস্তবে গড়ে তোলা সম্ভব কিনা, এ প্রশ্নটিই এখন আমাদের আলোচ্য বিষয়।
কয়েকটি বিভ্রান্তি
এ ব্যাপারে বরং বাস্তব সংশোধনের প্রত্যেকটি ব্যাপারে যেসব বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন মানুষের মনকে আলোড়িত করে এ প্রসঙ্গে আলোচনার পূর্বে সেগুলোর জবাব দেয়া প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে প্রথম ও প্রধান বিভ্রান্তিটি থেকেই আমাদের পূর্বোল্লেখিত প্রশ্নটি দেখা দিয়েছে। এ বইতে আমাদের ইতিপূর্বেকার যুক্তিভিত্তিক আলোচনায় সুদের ভ্রান্তি ও ক্ষতিকারক দিকটি সুস্পষ্ট করা হয়েছে। অন্যদিকে কুরআন ও হাদীসের উদ্ধৃতি থেকে একথা প্রমাণ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তাঁর রসূল সব রকমের সুদকে হারাম ঘোষণা করেছেন। এ দুটো কথা স্বীকার করে নেয়ার পর- “সুদ ছাড়া অর্থনৈতিক কাজ-কারবার পরিচালনা করা কি সম্ভব?” এবং “সুদ বিহীন অর্থব্যবস্থা কি বাস্তবে গড়ে তোলা যায়?”- এ জাতীয় প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর। এ থেকে তো পরোক্ষভাবে একথা বলারই চেষ্টা করা হয় যে, আল্লাহর উলুহিয়াতের মধ্যে ভুল হওয়া একটি অনিবার্য ব্যাপার এবং এমন সত্যও আছে, যা কার্যকর ও বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভবপর নয়। এভাবে আসলে প্রকৃতি ও তার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করা হয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, আমরা এমন একটি পচনশীল বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে বাস করছি যেখানে আমাদের অনেক প্রকৃত প্রয়োজনকে জুড়ে দেয়া হয়েছে ভুল ও দুষ্কর্মের সাথে এবং অনেক কল্যাণের দরজা জেনে বুঝেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অথবা এর চেয়েও আরো এক ধাপ অগ্রসর হয়ে আমরা এর এ অর্থ গ্রহণ করতে পারি যে, প্রকৃতির বক্রতা এমন পর্যায়ে পৌছে গেছে যার ফলে প্রকৃতির নিজের বিধান যাকে ভুল বলে তার প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থায় তা কল্যাণকর অপরিহার্য ও কার্যকর হয় এবং তার বিধান যাকে নির্ভুল বলে তার প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থায় তা অকল্যাণকর ও অকার্যকর হয়।
সত্যই কি আমরা নিজেদের বুদ্ধি, জ্ঞান ও ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার আলোকে প্রকৃতির স্বভাব ও মেযাজ সম্পর্কে এ ধরনের কুধারণা সৃষ্টির কোনো অবকাশ পাই? প্রকৃতি ভাঙার সহায় ও গড়ার শত্রু, একথা কি সত্য? একথা সত্য হলে বস্তুর ভালো ও মন্দ, কল্যাণকর ও অকল্যাণকর এবং ভুল ও নির্ভুলের সমস্ত আলোচনা শিকেয় তুলে দিতে হবে। সোজা কথায় আমাদের জীবন ক্ষেত্র থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। কারণ এরপর এ দুনিয়ায় আমাদের জন্য আর কোনো আশার আলো থাকে না। কিন্তু আমাদের এবং এ বিশ্বজগতের প্রকৃতি যদি এ কুধারণার শিকার হতে না চায়, তাহলে আমাদের অবশ্যি এ বিশেষ চিন্তা-পদ্ধতি পরিহার করতে হবে যে, “অমুক বস্তুটি খারাপ হলেও তার সাহয্যেই কার্যোদ্ধার হয় এবং অমুক বস্তুটি সত্য ও ন্যায়সঙ্গত হলেও তা কার্যকর হওয়া সম্ভব নয়।”
আসলে দুনিয়ায় যে পদ্ধতি একবার প্রচলিত হয়ে যায় মানুষের সমস্ত কাজ-কারবার লেনদেন তার সাথে জড়িত হয়ে পড়ে এবং ঐ পদ্ধতি পরিবর্তন করে অন্য পদ্ধতি প্রচলন করা কঠিন বলে মনে হতে থাকে। ভালো-মন্দ, ভুল-নির্ভুল যাই হোক না কেন প্রত্যেকটি প্রচলিত পদ্ধতির এ একই অবস্থা। প্রচলিত পদ্ধতিটি প্রচলিত বলেই সহজ মনে হয়। অন্যদিকে অপ্রচলিত পদ্ধতিটি অপ্রচলিত এবং প্রচলিত পদ্ধতি পরিবর্তন করে তাকে প্রচলিত করতে হবে বলেই তা কঠিন মনে হয়। কিন্তু অবুঝ লোকেরা এটা না বুঝে মনে করে, প্রচলিত ভুলটাই সহজ ও স্বাভাবিক, মানুষের যাবতীয় কাজ-কারবার এরই ভিত্তিতে সহজে চলতে পারে এবং এছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতির বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
এ ব্যাপারে দ্বিতীয় বিভ্রান্তিটি হচ্ছে, পরিবর্তন কঠিন হবার আসল কারণগুলো লোকেরা বুঝে না। ফলে তারা পরিবর্তনের পরিকল্পনা অবাস্তব ও কার্যকর যোগ্য নয় বলে উড়িয়ে দেয়। প্রচলিত কোনো ব্যবস্থা পরিবর্তনের পরিকল্পনাকে অবাস্তব ও কার্যকরযোগ্য নয় বলে উড়িয়ে দেয়া আসলে মানবিক প্রচেষ্টাবলীর সম্ভাবনাসমূহ সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষনেরই ফলশ্রুতি এ দুনিয়ারই কোনো কোনো এলাকায় ব্যক্তিগত মালিকানা খতম করে রাষ্ট্রীয় মালিকানা কায়েম করার ন্যায় চরম বিপ্লবাত্মক পরিকল্পনাও কার্যকর করা হয়েছে। কাজেই এ ক্ষেত্রে সুদ রহিত করে যাকাতের সংগঠন কায়েম করার ন্যায় ভারসাম্যপূর্ণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, একথা বলা কোনো ক্রমেই শোভা পায় না। তবে একথা ঠিক প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করে নতুন ব্যবস্থায় জীবন গড়ে তোলা রহিম করিমের ন্যায় যে কোনো সাধারণ লোকের কাজ নয়। এ কাজ কেবল তারাই করতে পারে যাদের মধ্যে দুটো শর্ত পাওয়া যায়ঃ
একঃ যারা যথার্থই পুরাতন ব্যবস্থা পরিহার করেছে এবং যে পরিকল্পনা অনুযায়ী জীবনের সমগ্র ব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধন করার লক্ষ্য গৃহীত হয়েছে তার ওপর আন্তরিকভাবে বিশ্বাস স্থাপন করেছে।
দুইঃ যারা অনুকরণ প্রবৃত্তির পরিবর্তে ইজতিহাদী প্রবৃত্তির অধিকারী। যারা নিছক প্রয়োজনীয় বুদ্ধির বৃত্তিটুকুর অধিকারী নয়, যা পুরাতন ব্যবস্থাকে তার পূর্বের পরিচালকদের ন্যায় দক্ষতা সহকারে পরিচালনা করার জন্য যথেষ্ট, বরং এমন বিশেষ পর্যায়ের বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী যা বিধ্বস্ত পথরেখাগুলো পরিহার করে নতুন পথরেখা তৈরী করার জন্য প্রয়োজন।
এ দুটো শর্ত যাদের মধ্যে পাওয়া যায় তারা কমিউনিজম, নাৎসীবাদ ও ফ্যাসীবাদের ন্যায় চরম বিপ্লবাত্মক মতবাদগুলোর একদেশদর্শী পরিকল্পনাসমূহও কার্যকর করতে পারে। আর যাদের মধ্যে এই শর্ত দুটো পাওয়া যায় না তারা ইসলামের একান্ত ভারসাম্যপূর্ণ পরিকল্পনাও কার্যকর করতে পারে না।
এ ব্যাপারে আরো একটি ছোটখাটো বিভ্রান্তির অপনোদন হওয়া উচিত। গঠনমূলক সমালোচনা ও সংস্কারমূলক পরিকল্পনার জবাবে যখন কাজের নীল নকশা চাওয়া হয় তখন অবস্থা দেখে মনে হয় যেন কাগজের পিঠেই পরিকল্পনা সীমাবদ্ধ এবং লোকেরা খাতার পাতাকেই কাজের ক্ষেত্র বলে মনে করে। অথচ কাজের আসল ক্ষেত্র হচ্ছে জমিন। কাগজের ওপর করার মতো কাজ নিতান্ত সীমাবদ্ধ। তা হচ্ছে, কেবল যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে প্রচলিত ব্যবস্থার গলদ, ক্ষতি ও অকল্যাণসমূহ দ্ব্যর্থহীনভাবে তুলে ধরা এবং এর স্থলে যে ব্যবস্থা আমরা কার্যকর করতে চাই তার যৌক্তিকতা বলিষ্ঠভাবে সপ্রমাণ করা। এরপর কাজের সাথে যেসব বিষয়ের সর্ম্পক, কাগজের পিঠে সেগুলো সম্পর্কে বড়জোর এতটুকুন করা যেতে পারে যে, পুরনো ব্যবস্থার ভুল পদ্ধতিগুলো কিভাবে নির্মূল করা যেতে পারে এবং সে স্থলে নতুন পরিকল্পনাগুলো কিভাবে কার্যকর করা যেতে পারে, সে সম্পর্কে মানুষের সামনে একটা সাধারণ চিন্তা ও ধারণা তুলে ধরা যেতে পারে। তবে এ ব্যাপারটির বিস্তারিত রূপ কি হবে, এর ছোটখাটো ও খুঁটিনাটি পর্যায়গুলো কি হবে এবং প্রত্যেক পর্যায়ে উদ্ভূত সমস্যাবলী সমাধানের উপায় কি হবে—এসব বিষয় কোনো ব্যাক্তি পূর্বাহ্নে অবহিত হতে পারে না এবং এ প্রশ্নগুলোর জবাব দেয়াও কারোর পক্ষে সম্ভব নয়। বর্তমান ব্যবস্থার ভ্রান্তি সম্পর্কে যদি আপনি সম্পূর্ণ নিঃশংশয় হয়ে থাকেন এবং মনে করে থাকেন যে, সংশোধনের প্রস্তাব যথার্থই ন্যায়সঙ্গত তাহলে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে আসুন এবং এমন সব লোকের হাতে কাজের দায়িত্বভার অর্পণ করুন যারা ঈমানী শক্তি ও ইজতিহাদী বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী। তারপর বাস্তব ক্ষেত্রে যেখানে যে সমস্যা দেখা দেবে সেখানেই তার সমাধানও হয়ে যাবে। যে কাজ কার্যক্ষেত্রে হাতে কলমে করার মতো তা কাগজের পিঠে আঁচড় কেটে কেমন করে করা যেতে পারে?
এ বিস্তারিত আলোচনার পর একথা বলার কোনো প্রয়োজন থাকে না যে, এ অধ্যায়ে আমি যাকিছু পেশ করবো তা সুদবিহীন অর্থনীতির কোনো বিস্তারিত রূপরেখা হবে না বরং তা হবে সুদকে সামগ্রিক অর্থনীতি থেকে রহিত করার বাস্তব কাঠামো কি হতে পারে এবং সুদ রহিত করার চিন্তার উদয়ের সাথে সাথে আপাত দৃষ্টিতে মানুষের সামনে যেসব বড় বড় সমস্যা দেখা দেয় সেগুলো কিভাবে সমাধান করা যেতে পারে তার একটা সাধারণ চিন্তা।
সংস্কারের পথে প্রথম পদক্ষেপ
আগের অধ্যায়গুলোয় সুদ সম্পর্কে যে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে, তা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সুদের প্রচলন আইনগতভাবে বৈধ হবার কারণেই সামগ্রিক অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যাবতীয় গলদ ও অনিষ্টকারিতা সৃষ্টি হয়েছে। সুদের দুয়ার ঋণ উন্মুক্ত থাকার পর কোনো ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে কর্জে হাসানা বা সুদমুক্ত ঋণ দেবে কেন? সে একজন ব্যবসায়ীর সাথে লাভ-লোকসানে শরীক হতে যাবে কেন? সে তার জাতির প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য আন্তরিক সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে যাবে কোন স্বার্থে? কেনই বা সে নিজের সঞ্চিত পুঁজি মহাজন ও পুঁজিপতির নিকট সোপর্দ করবে না- যেখান থেকে ঘরে বসে বসেই সে একটি নির্দিষ্ট হারে মুনাফা লাভের আশা রাখে? মানুষের অসৎ প্রবৃত্তি ও প্রবণতাগুলোকে উদ্দীপিত ও উদগ্র করার পথ উন্মুক্ত করে দেবার পর নিছক বক্তৃতা, উপদেশ ও নৈতিক আবেদনের মাধ্যমে সে সবের অগ্রগতি ও অনিষ্টকারিতা বন্ধ করার আশা করা যেতে পারে না। আবার এখানে কেবল একটি অসৎ প্রবণতাকে অবাধ স্বাধীনতা দেয়ার মধ্যেই ব্যাপারটি সীমাবদ্ধ নয়। বরং এর থেকেও অগ্রসর হয়ে আমাদের প্রচলিত আইন তার সাহায্যকারীর দায়িত্ব নিয়েছে এবং আমাদের রাষ্ট্র ও সরকার স্বয়ং এ অসৎ প্রবণতাটির ভিত্তিতে সমগ্র অর্থব্যবস্থা পরিচালনা করেছে। এ অবস্থায় কিছু আংশিক পরিবর্তন ও ছোটখাটো সংশোধনের মাধ্যমে এর যাবতীয় অনিষ্টকারিতার গতিরোধ কেমন করে সম্ভবপর হতে পারে? একটি মাত্র পথেই এর গতি রোধ করা যেতে পারে, তা হচ্ছে, যে পথে অনিষ্টকারিতা আসছে প্রথমে সে পথটিই বন্ধ করতে হবে।
যারা মনে করে প্রথমে একটি সুদ বিহীন অর্থব্যবস্থা তৈরী হয়ে যাবে তারপর সুদ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যাবে অথবা আইন করে বন্ধকরা হবে, তারা আসলে ঘোড়ার আগে গাড়ী জুড়ে দিতে চায়। যতদিন আইনগতভাবে সুদের প্রচলন থাকবে, দেশের আদালতগুলো সুদী চুক্তিপত্রের স্বীকৃতি দিয়ে বলপূর্বক সেগুলো প্রবর্তন করবে এবং পুঁজিপতিদের জন্য সুদের লোভ দেখিয়ে – প্রতি গৃহ থেকে অর্থ সঞ্চিত করার, অতপর সুদের ভিত্তিতে তা ব্যবসায়ে খাটাবার পথ উন্মুক্ত থাকবে, ততদিন কোনো সুদবিহীন অর্থব্যবস্থার অস্তিত্ব লাভ ও অগ্রগতি কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। কাজেই সুদ রহিত হবার ব্যাপারটি যদি প্রথমে একটি অর্থব্যবস্থা তৈরী হয়ে যথেষ্ট উন্নত, শক্তিশালী ও সংগঠিত হয়ে যাবার এবং বর্তমান সুদী অর্থব্যবস্থার স্থলাভিষিক্ত হবার যোগ্যতা অর্জন করার শর্ত সাপেক্ষ হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে যে, কিয়ামত পর্যন্ত সুদ রহিত হবার কোনো উপায়ই দেখা দেবে না। এ কাজ করতে গেলে প্রথম পদক্ষেপেই আইনগতভাবে সুদ রহিত করতে হবে। অতপর স্বতঃস্ফূর্ত-ভাবে সুদ বিহীন অর্থব্যবস্থার সৃষ্টি হয়ে যাবে এবং যেহেতু আবশ্যকতা আবিষ্কারের জননী সেহেতু স্বতঃস্ফূর্তভাবে এর জন্যে সবদিকে ও সবক্ষেত্রে অগ্রসর হবার ও ছড়িয়ে পড়ার পথ প্রশস্ত হতে থাকবে।
মানব প্রকৃতির যেসব অসৎ প্রবণতা সুদের জন্ম দিয়েছে সেগুলোর শিকড় এত গভীরে প্রবেশ করে আছে এবং তাদের দাবী এতই শক্তিশালী যে অসম্পূর্ণ ও খাপছাড়া কার্যক্রম এবং সাদামাটা কৌশল অবলম্বন করে কোনো সমাজ থেকে এ আপদটি দূর করা সম্ভব হয় না। এজন্য ইসলাম যে সমস্ত কৌশল ও উপায় অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছে সেসব পুরোপুরি অবলম্বন করতে হবে এবং যে ধরনের তৎপরতা সহকারে এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম মুখর হতে বলেছে সে ধরনের তৎপরতা অবলম্বন করতে হবে। ইসলাম সুদী ব্যবসায়ের কেবলমাত্র নৈতিক নিন্দাবাদ করেই ক্ষান্ত থাকেনি বরং এই সাথে একদিকে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী তাকে হারাম গণ্য করে তার বিরুদ্ধে চরম ঘৃণা সৃষ্টি করে এবং অন্যদিকে যেখানে ইসলামের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয় সেখানে দেশীয় আইনের সাহায্যে তাকে নিষিদ্ধ করে, সমস্ত সুদের চুক্তি বাতিল করে, সুদ দেয়া-নেয়া, সুদের দলিল লেখা ও তাতে সাক্ষী হওয়াকে ফৌজদারী অপরাধ ও পুলিশের হস্তক্ষেপযোগ্য গণ্য করে এবং কোথাও সামান্য শাস্তির মাধ্যমে এ কারবার বন্ধ না হলে অপরাধীকে হত্যা ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করারও শাস্তি দেয়। তৃতীয় দিকে ইসলাম যাকাতকে ফরয তথা অবশ্যি পালনীয় কর্তব্য হিসেবে গণ্য করে এবং সরকারী পরিচালনাধীনে তা উসুল ও বন্টনের ব্যবস্থা করে একটি নতুন অর্থ ব্যবস্থার ভিত গড়ে তোলে। এসব উপায় অবলম্বন করার সাথে সাথে সে শিক্ষা, অনুশীলন ও প্রচার-প্রপাগান্ডার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের চিন্তা ও কর্মের সংশোধনও করে। এর ফলে তাদের মনের সুদখোরী প্রবণতা স্তিমিত হয়ে যায় এবং এর পরিবর্তে এমন সব প্রবণতা ও গুণাবলী সে স্থান অধিকার করে, যেগুলোর মাধ্যমে সমাজের অভ্যন্তরে সহানুভুতি ও বদান্যতাপূর্ণ সহযোগিতার প্রবণতা অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার ন্যায় প্রবাহিত হতে থাকে।
সুদ রহিত করার সুফল
যথার্থ গুরুত্ব ও আন্তরিকতা সহকারে সুদকে রহিত করতে চাইলে এ পথে এবং এভাবেই সবকিছু করতে হবে। সুদকে আইনগতভাবে রহিত করে দিলে এবং এই সাথে যাকাত উসুল ও বণ্টনের সামগ্রিক ব্যবস্থা গৃহীত হলে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনটি বড় বড় সুফল দেখা দেবে।
এর প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুফল হবে, ধন সংগৃহীত হবার বর্তমান বিপর্যয়মূলক অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে একটি সঠিক, সুস্থ ও কল্যাণকর অবস্থার সৃষ্টি হবে।
বর্তমান অবস্থায় নিম্নোক্তভাবে ধন সংগৃহীত হয়ঃ আমাদের সমাজ ব্যবস্থা প্রত্যেক মানুষের স্বভাবজাত কার্পণ্য ও ধন সঞ্চয় প্রবণাতাকে কৃত্রিম উপায়ে চরম পর্যায়ে বাড়িয়ে দেয়। অতপর ভীতি ও লোভের অস্ত্র ব্যবহার করে তাদের আয়ের স্বল্পতম অংশ ব্যয় করতে ও সর্বাধিক অংশ সঞ্চয় করতে উদ্বুদ্ধ করে। তাদেরকে এই বলে ভয় দেখায় যে, যদি তোমরা এখন সঞ্চয় না করো না করো তাহলে দুর্দিনে সমগ্র সমাজে তোমাদের সাহায্যকারী কেউ থাকবে না, তখন এ সঞ্চিত ধন তোমাদের কাজে লাগবে। তাদেরকে এই বলে লোভ দেখায় যে, ধন সঞ্চয় করলে এর বিনিময়ে তোমরা সুদ পাবে। এ দ্বিমুখী আন্দোলনের মুখে সমাজের প্রায় সকল ব্যক্তিই যারা নিজেদের প্রয়োজনের চেয়ে সামান্য পরিমাণ বেশী আয় করে তারা ব্যয় কমিয়ে সঞ্চয় বাড়াতে ভীষণভাবে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। ফলে বাজারে পণ্য দ্রব্যাদী বিক্রয় ও চাহিদা সম্ভাব্য পরিমাণ থেকে অনেক কমে যায়। পণ্য দ্রব্যের আমদানী যে পরিমাণ কমে যায় শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নতির সম্ভাবনাও ঠিক সেই পরিমাণ কমে যায় এবং ধন ও পুঁজি সংগৃহীত হবার সুযোগও কমে যেতে থাকে। এভাবে কয়েক ব্যক্তির সঞ্চয় বেড়ে যাবার কারণে সামগ্রিক ধনের পরিমাণে কমে যায়। এক ব্যাক্তি এমন পদ্ধতিতে নিজের সঞ্চিত ধনের পরিমাণ বাড়াতে থাকে যার ফলে হাজার হাজার লোকের ধন উপার্জনের যোগ্যতাই খতম হয়ে যায়, এ ক্ষেত্রে তাদের সঞ্চয়ের প্রশ্নই ওঠে না।
বিপরীত পক্ষে যখন সুদ রহিত করা হবে এবং যাকাত সংগঠন কায়েম করে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সমাজের প্রত্যেক ব্যাক্তিকে এ মর্মে নিশ্চয়তা দান করা হবে যে, দুর্দিনে তার সাহায্যের যথাযোগ্য ব্যবস্থা রয়েছে, তখণ কার্পণ্য ও ধন সঞ্চয়ের প্রকৃতি বিরোধী কারণ, প্রবণতা ও উদ্যম খতম হয়ে যাবে। লোকেরা নিজেরা মুক্ত হস্তে ব্যয় করবে এবং অভাবীদেরকে যাকাতের মাধ্যমে দান করে তাদের ক্রয় ক্ষমতা এমন পর্যায়ে পৌছাবে যার ফলে তারা অর্থ ব্যয় করতে সক্ষম হবে। ফলে শিল্প-বাণিজ্য বেড়ে যাবে, কাজ-কর্ম ও উপার্জন বেড়ে যাবে এবং কাজ-কর্ম ও উপার্জন বেড়ে গেলে আয় বেড়ে যাবে। এ পরিবেশে শিল্প ও ব্যবসায়ের নিজস্ব মুনাফা এতবেশী বেড়ে যাবে যার ফলে আজকের ন্যায় তাদের বাইরের পুঁজির এতবেশী মুখাপেক্ষী হতে হবে না। উপরন্তু তারা যে পরিমাণ পুঁজির অভাব অনুভব করবে বর্তমান অবস্থার তুলনায় তা অনেক বেশী সহজে সংগৃহীত হতে পারবে। কারণ তখন সঞ্চয়ের কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে না, যেমন কেউ কেউ মনে করে থাকেন। বরং তখনো কিছু সংখ্যক লোক নিজেদের জন্মগত স্বভাবসিদ্ধ কারণে অর্থ সঞ্চয় করে যেতে থাকবে। আবার অনেক লোক বরং বেশীর ভাগ লোক আয় বৃদ্ধি ও সমাজের সাধারণ সমৃদ্ধির কারণে উদ্বৃত্ত অর্থ সঞ্চয় করতে বাধ্য হবে। তখন এ সঞ্চয়ের পেছনে কোনো প্রকার কার্পণ্য, লোভ বা ভয় কার্যকর থাকবে না বরং তার একমাত্র কারণ হবে এই যে, লোকেরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করবে। ইসলামের বিভিন্ন বৈধ ব্যয় ক্ষেত্রে মুক্ত হস্তে ব্যয় করার পরও তাদের নিকট বিপুল পরিমান অর্থ উদ্বৃত্ত থাকবে। এ উদ্বৃত্ত অর্থ গ্রহণ করার মতো কোনো অভাবী লোকও থাকবে না। কাজেই এ অবস্থায় তারা ওগুলো ঘরে ফেলে রাখবে এবং ভালো ও উপযুক্ত শর্তে নিজেদের রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন ও প্রকল্পে দেশের শিল্পে ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে এবং প্রতিবেশী দেশেও বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত হবে।
এর দ্বিতীয় সুফল এই দেখা যাবে যে, সঞ্চিত ধন জমাটবদ্ধ হবার পরিবর্তে আবর্তিত হতে থাকবে এবং সামাজিক অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী অনবরত সাহায্য পৌছাতে থাকবে। বর্তমান ব্যবস্থায় ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগের পেছনে একমাত্র সুদের লোভই কার্যকর থাকে। কিন্তু এ জিনিসটিই আবার তার জমাটবদ্ধ হবার কারণেও পরিণত হয়। কারণ ধন সাধারণত সুদের হার অধিক হবার অপেক্ষায় বসে থাকে। উপরন্তু এ জিনিসটিই আবার ধনের প্রকৃতি ও মেজাজকে কারবারের প্রকৃতি ও মেজাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। যখন কারবার পুঁজির চাহিদা পেশ করে, তখন পুঁজি অসম্মতি প্রকাশ করে, আর বিপরীত অবস্থায় পুজি কারবারের পেছনে দৌড়াতে থাকে এবং নিম্নতম শর্তে যে কোনো ভালো-মন্দ কাজে লাগতে প্রস্তুত হয়। কিন্তু তখন আইনগতভাবে সুদের দুয়ার বন্ধ হয়ে যাবে বরং উল্টো সমস্ত সঞ্চিত ধনের ওপর বছরে শতকরা আড়াই ভাগ হিসেবে যাকাত আদায় করা হবে, তখন ধনের এ অপ্রকৃতিস্ততার অবসান ঘটবে। সে নিজেই কোনো যুক্তিসঙ্গত শর্তে দ্রুত কোনো কারবারে লাগবার এবং জমাটবদ্ধ হয়ে থাকার পরিবর্তে হামেশা কোনো না কোনো কারবারে লাগার ইচ্ছা প্রকাশ করবে।
এর তৃতীয় সুফলটি হবে এই যে, ব্যবসায়িক অর্থ ও ঋণ বাবত অর্থ উভয়ের খাত সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাবে। বর্তমান ব্যবস্থায় পুঁজির অধিকাংশ বরং প্রায় সমগ্র অংশই সংগৃহীত হয় ঋণের আকারে। অর্থ গ্রহণকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো মুনাফাজনক কাজের জন্যে বা অমুনাফাজনক কাজের জন্যে এবং কোনো সাময়িক প্রয়োজনে বা দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পে অর্থ গ্রহণ করুক না কেন, সর্বাবস্থায় একটি নির্ধারিত সুদভিত্তিক ঋণের শর্তেই তা লাভ করা সম্ভব হয়। কিন্তু সুদ নিষিদ্ধ হয়ে যাবার পর ঋণের খাত কেবলমাত্র অমুনাফাজনক কাজ বা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে নিছক সাময়িক প্রয়োজনের জন্যে নির্দিষ্ট থাকবে। এ অবস্থায় কর্জে হাসানার নীতির ভিত্তিতে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হবে। আর অন্যান্য খাত যেমন শিল্প-বাণিজ্য প্রভৃতি বা সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান- সমূহের লাভজনক প্রকল্পগুলোতে ঋণের পরিবর্তে মুযারিবাত বা লাভ ভিত্তিক অংশীদারীত্বের (PROFIT SHARING) নীতির ভিত্তিতে পুঁজি বিনিয়োগ করা হবে।
সুদ বিহীন অর্থব্যবস্থায় এ দুটো বিভাগ কিভাবে কাজ করবে এখন আমি সংক্ষেপে এ আলোচনা করবো।
সুদ বিহীন অর্থ ব্যবস্থায় ঋণ সংগ্রহের উপায়
প্রথমে ঋণের ব্যাপারে আসা যাক। কারণ লোকেরা সবচেয়ে বেশী ভয় করছে যে, সুদ নিষিদ্ধ হয়ে গেলে ঋণ পাওয়া যাবে না। কাজেই আমরা প্রথমে একথা প্রমাণ করবো যে, এ অপবিত্র প্রতিবন্ধকতাটি (সুদ) দূর হয়ে যাবার পর ঋণ লাভের পথ কেবল অনিরুদ্ধই থাকবে না বরং বর্তমানের তুলনায় তা অধিকতর সহজ ও উন্নততর হবে।
ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ
বর্তমান ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণের একটিই মাত্র পথ আছে। যে পথটি হচ্ছে, দরিদ্র ব্যক্তি পুঁজিপতি ও মহাজনের নিকট থেকে এবং সম্পদশালী ব্যক্তি ব্যাংক থেকে সুদী ঋণ গ্রহণ করতে পারে। এ অবস্থায় তারা যে কোনো উদ্দেশ্যে যে কোনো পরিমাণ ঋণ পেতে পারে। তবে মহাজন ও ব্যাংকারকে নিয়মিত সুদ আদায় ও আসল প্রত্যর্পণের গ্যারান্টি দিতে হবে। সে কোনো পাপ কাজ করার জন্যে, কোনে অপ্রয়োজনীয় কাজে অথবা বিপুল ব্যয়ের জন্যে বা যথার্থই কোনো প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে ঋণ নিয়ে থাক না কেন। বিপরীতপক্ষে কোনো ব্যক্তির গৃহে যদি অর্থাভাবে কোনো মৃতের দাফন-কাফনও আটকে থাকে, তাহলেও পুঁজিপতি ও ব্যাংকারকে নিয়মিত সুদ আদায় ও আসল প্রত্যর্পণের নিশ্চয়তা বিধান না করা পর্যন্ত সে কোথা থেকেও একটি পয়সা ঋণ লাভ করতে পারবে না। উপরন্তু বর্তমান ব্যবস্থায় দরিদ্রের বিপদ ও ধনী পুত্রদের বখাটেপনা উভয়টাই পুঁজিপতিদের আয়ের উত্তম সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। এ ক্ষেত্রে স্বার্থপরতার সাথে সাথে এমন চরম হৃদয়হীনতার পরিচয় দেয়া হয় যার ফলে সুদী ঋণের জালে আটকা পড়া ব্যক্তি সুদ পরিশোধ বা আসল প্রত্যর্পণের ব্যাপারে সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। যার কাছ থেকে সুদ ও আসল আদায় করার দাবী জানানো হচ্ছে, সে প্রকৃতপক্ষে কোন বিপদের মধ্যে অবস্থান করছে, তা তলিয়ে দেখার মতো মানসিকতা কারোর নেই। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঋণ লাভ করার জন্যে বর্তমান ব্যবস্থা যে সুযোগ-সুবিধা দান করেছে, এ হচ্ছে তার আসল রুপ। এবার ইসলাম সুদ বিহীন যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে কিভাবে এ প্রয়োজন পূর্ণ করার ব্যবস্থা করবে তা অনুধাবন করা যায়।
প্রথমে এ ব্যবস্থায় অমিতব্যয়িতা ও পাপবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্যে ঋণ গ্রহণের দুয়ার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকবে। কারণ এখানে সুদের লোভে অপ্রয়োজনীয় ঋণ দানকারীর কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। এ অবস্থায় ঋণ সম্পর্কিত যাবতীয় লেনদেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেবলমাত্র সঙ্গত প্রয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং বিভিন্ন সময় ব্যক্তিগত প্রয়োজনের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ অর্থ গ্রহণ সঙ্গত মনে হবে, কেবল সেই পরিমানই দেয়া-নেয়া হবে।
উপরন্তু এ ব্যবস্থায় যেহেতু ঋণগ্রহীতার নিকট থেকে ঋণদাতার কোনো প্রকার লাভ বা সুবিধা গ্রহণের অবকাশ থাকবে না। তাই ঋণ বাবদ গৃহীত অর্থ প্রত্যর্পণের পথও অধিকতর সহজ হবে। সর্বনিম্ন আয়ের অধিকারী লোকেরাও ছোট ছোট কিস্তিতে অতি সহজে ও দ্রুত ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হবে। যে ব্যক্তি কোনো জমি, গৃহ বা সহায় সম্পত্তি বন্ধক রাখবে, তার এ বন্ধকী সম্পত্তি ছাড়িয়ে নেয়া অধিকতর সহজ ও দ্রুত হবে। কারণ তার এ সম্পত্তির খাতে লব্ধ আয় সুদের খাতে জমা না হয়ে ঋণ বাবদ গৃহীত অর্থ পরিশোধের খাতে জমা হবে। এভাবে অতি দ্রুত ও সহজে তার ঋণ পরিশোধ হয়ে যাবে। এতগুলো সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও যদি ঘটনাক্রমে করোর ঋণ পরিশোধ সম্ভব না হয় তাহলে রাষ্ট্রের বায়তুলমাল তার সাহায্যে এগিয়ে আসবে এবং বায়তুলমাল থেকে তার ঋণ পরিশোধ করে দেয়া হবে। এমন কি কোনো ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি নিজের কোনো সহায়-সম্পত্তি না রেখেই মারা যায় তাহলেও তার ঋণ পরিশোধ করার দায়িত্ব বায়তুলমালের ওপর বর্তাবে। এসব কারণে সচ্ছল ও ধনী লোকদের জন্যে নিজের অভাবী প্রতিবেশীদেরকে সাহায্য করা বর্তমান ব্যবস্থায় ন্যায় এতটা কঠিন ও বিরক্তিকর ঠেকবে না।
এরপরও কোনো ব্যক্তি তার পাড়া-প্রতিবেশীদের নিকট থেকে ঋণ লাভের সক্ষম না হলে বায়তুলমালের দুয়ার তার জন্যে অবশ্যি খোলা থাকবে। সেখান থেকে সে সহজে ঋণ লাভ করতে সক্ষম হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বায়তুলমালের সাহায্য গ্রহণ করা যেতে পারে সর্বশেষ উপায় হিসেবে। ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত প্রয়োজনের ক্ষেত্রে পরস্পরকে ঋণ দেয়া ইসলামী সমাজে ব্যক্তিবর্গের জন্যে অপরিহার্য কর্তব্য রূপে চিহ্নিত। কোনো সমাজের ব্যক্তিবর্গের নিজেদের এ ধরনের নৈতিক দায়িত্বসমূহ নিজেরাই উপলব্ধি করা ও তা পালন করতে উদ্যোগী হওয়াই সংশ্লিষ্ট সমাজের সুস্থতার লক্ষণ। যদি দেখা যায়, কোনো গ্রাম, পল্লী বা জনবসতির কোনো অধিবাসী তার প্রতিবেশীদের নিকট থেকে ঋণ পাচ্ছে না বলে বাধ্য হয়ে বায়তুলমালের স্মরণাপন্ন হয়েছে, তাহলে বুঝতে হবে সেখানকার নৈতিক পরিবেশ বিকৃত হয়ে গেছে। কাজেই এ ধরনের কোনো কেস বায়তুলমালে পৌছার পর কেবলমাত্র ঋণ গ্রহণেচ্ছু ব্যক্তির প্রয়োজন পূর্ণ করলেই চলবে না বরং সাথে সাথেই নৈতিক স্বাস্থ্য সংরক্ষণ বিভাগকে এ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে এবং কাল বিলম্ব না করে ওই জরাগ্রস্ত জনবসতিকে রোগমুক্ত করার প্রতি নজর দিতে হবে, যেখানকার অধিবাসীরা প্রয়োজনের সময় তাদের এক প্রতিবেশী ভাইকে কোনো প্রকার সাহায্য করতে সক্ষম হয়নি। এ ধরনের কোনো ঘটনার খবর একটি সৎ সুস্থ নৈতিক ব্যবস্থায় এমন আলোড়ন ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে, যেমন একটি বস্তুবাদী ব্যবস্থায় কলেরা বা মহামারীর ঘটনা অস্থিরতা ও আলোড়ন সৃষ্টি করে।
ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঋণ সংগ্রহ করার জন্যে ইসলামী ব্যবস্থায় আর একটি পদ্ধতি অবলম্বিত হতে পারে। তা হচ্ছে সমস্ত ব্যবসায়ী কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিদের জন্যে যেসব আইনগত অধিকার নির্ধারিত থাকবে, অপরিহার্য প্রয়োজনের সময় তাদেরকে ঋণ দেয়ার অধিকারটিও তার অন্তর্ভুক্ত হবে। উপরন্তু সরকার নিজেও নিজের ওপর এ অধিকারটি চাপিয়ে নেবেন এবং উন্মুক্ত হৃদয়ে তাদের এ অধিকার আদায়ের চেষ্টাও করবেন। এ ব্যাপারটির কেবল নৈতিক চরিত্রটাই মূখ্য নয় বরং এর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চরিত্রও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। নিজের কর্মচারী ও শ্রমিকদের জন্যে সুদবিহীন ঋণের ব্যবস্থা করলে কেবলমাত্র যে একটি নেকী অর্জিত হলো তা নয় বরং যেসব কারনে কর্মচারীরা দুশ্চিন্তা, পেরেশানি, দুরবস্থা, শারীরিক কষ্ট ও বস্তুগত ক্ষতি ও ধ্বংসের সম্মুখীন হয় সে গুলোর মধ্যে থেকে একটি বড় কারণ দূরীভূত হয়। এসব বিপদ থেকে তাদেরকে রক্ষা করতে পারলে তারা নিশ্চিন্ত হবে। এর ফলে তাদের কর্মক্ষমতা বেড়ে যাবে। তাদের নিশ্চিন্ততা তাদেরকে অনিষ্টকর ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী জীবন দর্শন থেকেও বাঁচাবে। স্থুল দৃষ্টিতে হয়ত এর ফল কিছুই নাও দেখা যেতে পারে। কিন্তু সুক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করলে যে কেউ অতি সহজেই অনুধাবন করতে পারবে যে, সামগ্রিকভাবে কেবল সমগ্র সমাজই নয় বরং ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক পুঁজিমালিক ও কারখানামালিক এবং প্রত্যেকটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যে পরিমান লাভবান হবে তা সুদের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান হবে, যা আজকের বস্তুবাদী ব্যবস্থায় নিছক নির্বুদ্ধিতাজনিত সংকীর্ণমনতার কারনে গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
বাণিজ্যিক প্রয়োজনে
এরপর ব্যবসায়ীদের নিত্যকার প্রয়োজন মেটাবার জন্যে যেসব ঋণের প্রয়োজন হয় তার আলোচনায় আসা যাক। বর্তমানে এ উদ্দেশ্যে ব্যাংক থেকে সরাসরি স্বল্প মেয়াদী ঋণ (SHORT TERM LOAN) নেয়া হয় অথবা হুন্ডি (BILLS OF EXCHANGE) ভাঙানো হয়।১ [১. ইসলামী ফিকাহে এ বস্তুটির জন্য ‘সাফাতাজ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। এই একটি পারিভাষিক শব্দ। এর পদ্ধতি হচ্ছে, যেসব ব্যবসায়ী পরস্পরের মধ্যে লেনদেন করে এবং ব্যাংকের সাথেও কারবার করে তারা নগদ অর্থ আদায় না করেও বিপুল পরিমাণ পণ্য পরস্পর থেকে ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে এবং এক মাস, দু মাস বা চার মাসের জন্যে দ্বিতীয় পক্ষকে হুন্ডি লিখে দেয়। যদি দ্বিতীয় পক্ষ নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে, তাহলে অপেক্ষা করে এবং যথাসময়ে ঋণ আদায় হয়ে যায়। কিন্তু মেয়াদকালের মধ্যে যদি তার অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তাহলে ওই হুন্ডিটি ব্যাংকে জমা দেয়, যে ব্যাংকের সাথে তাদের উভয়ের লেনদেন আছে। ব্যাংক থেকে অর্থ উঠিয়ে সে নিজের কাজ সমাধা করে। একে হুন্ডি ভাঙানো বলা হয়।] উভয় অবস্থায় ব্যাংক তার উপর সামান্য পরিমান সুদ নিয়ে থাকে। এটি ব্যবসায়ের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন যাকে বাদ দিয়ে আজ কোনো কাজই চলতে পারে না। তাই ব্যবসায়ীরা সুদ রহিত করার কথা শুনে সর্বপ্রথম যে দুশ্চিন্তা কবলিত হয়, তা হচ্ছে এ অবস্থায় নিত্যকার প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য ঋণ পাবো কোথা থেকে? সুদের লোভ না দেখালে ব্যাংক আমাদেরকে ঋণ দেবে কেন আর আমাদের হুন্ডিই বা ভাঙিয়ে দেবে কেন?
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে, ব্যাংকে সমস্ত আমানত (DEPOSIT) বিনা সুদেই জমা থাকে এবং যেখানে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও তাদের লাখ লাখ টাকা বিনা সুদেই জমা রাখে সে তাদেরকে বিনা সুদে ঋণ দেবে না কেন এবং তাদের হুন্ডিই বা ভাঙিয়ে দেবে না কেন? সে যদি সোজা পথে এতে সম্মত না হয়, তাহলে ব্যবসা আইনের সাহায্যে তার নিজের গ্রাহকদেরকে (CUSTOMERS) এ সুবিধা দেবার জন্যে তাকে বাধ্য করা হবে। এটি তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।
আসলে এ কাজের জন্যে কেবলমাত্র ব্যবসায়ীদের নিজেদের গচ্ছিত রাখা অর্থই যথেষ্ট হতে পারে। তবুও প্রয়োজন হলে অন্য খাত থেকেও ব্যাংক এজন্য কিছু অর্থ ব্যবহার করতে পারে। মোটকথা নীতিগতভাবে একথা স্বীকার করে নিতেই হবে যে, যে ব্যক্তি সুদ নিচ্ছে না, সে সুদ দেবে না। তাছাড়া নিত্যকার প্রয়োজনের ক্ষেত্রে বিনা সুদে ঋণ পেতে থাকা সামগ্রিক অর্থনীতির দৃষ্টিতে ব্যবসায়ীদের জন্যে লাভজনকও বটে।
তবে এ লেনদেনের বিনিময়ে সুদ না পেলে ব্যাংক তার খরচপত্র চালাবে কিভাবে? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, চলতি হিসেবের (CURRENT ACCOUNT) সমস্ত অর্থই যে ক্ষেত্রে ব্যাংকের নিকট বিনা সুদে জমা থাকবে, সে ক্ষেত্রে ওই অর্থের একটা অংশ বিনা সুদে দেয়াটা মোটেই ক্ষতিকর হবে না। কারন এ অবস্থায় হিসেব-নিকেশে ও খাতাপত্র ঘাঁটাঘাটির জন্যে ব্যাংককে যে সামান্য খরচপত্র বহন করতে হবে তা তার নিকট যে পরিমাণ অর্থ জমা হবে তা থেকে গৃহীত লাভের তুলনায় বহুলাংশে কম। তবুও যদি ধরে নেয়া যায় এ পদ্ধতি কার্যকর করা সম্ভব নয়, তাহলে সকল ব্যবসায়ী গ্রাহকদের নিকট থেকে একটি মাসিক বা ষান্মাসিক ফী আদায় করতে পারে, যা দিয়ে তার খরচপত্র চালানো সম্ভব। সুদের পরিবর্তে এ ফী হবে তাদের জন্যে অনেক সস্তা। কাজেই তারা সানন্দে এটা আদায় করে দেবে।
সরকারের অলাভজনক প্রয়োজনের ক্ষেত্রে
ঋণের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ খাতটি সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট। সরকারকে সাময়িক দুর্ঘটনার জন্যে কখনো অমুনাফাজনক রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে আবার কখনো যুদ্ধের জন্যে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। বর্তমান অর্থব্যবস্থায় এসব উদ্দেশ্যে প্রায় সব ক্ষেত্রে ঋণ এবং তাও আবার সুদী ঋণের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু ইসলামী অর্থব্যবস্থায় এর সম্পূর্ণ উল্টোটাই সম্ভব হবে। সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রয়োজনের কথা প্রকাশ করার সাথে সাথেই দেশের জনসাধারণ ও প্রতিষ্ঠানসমূহ স্বতস্ফুর্তভাবে নিজেদের অর্থ ও সম্পদরাশি চাঁদা স্বরূপ এনে সরকারের তহবিলে জমা করে দেবে। কারন সুদ রহিত করে যাকাত পদ্ধতির প্রচলনের কারনে তারা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এতবেশী সমৃদ্ধ ও দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে যাবে যে, নিজেদের উদ্বৃত্তের একটি অংশ সরকারকে দান করার ব্যাপারে তারা মোটেই ইতস্তত করবে না। এরপরও প্রয়োজন পরিমাণ অর্থ না পাওয়া গেলে সরকার ঋণ চাইবে এবং লোকেরা ব্যাপক হারে সরকারকে সুদমুক্ত ঋণ দেবে। কিন্তু এতেও যদি প্রয়োজন পূর্ণ না হয়, তাহলে নিজের কাজ সমাধা করার জন্যে ইসলামী রাষ্ট্র নিম্নোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারে:
এক: যাকাত ও খুমুসের (যুদ্ধ ক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের নিকট থেকে সংগৃহীত মালে গনীমতের পঞ্চমাংশ) অর্থ ব্যবহার করবে।
দুই: সরকারী নির্দেশের মাধ্যমে সমস্ত ব্যাংক থেকে তাদের আমানত লব্ধ অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ ঋণ হিসেবে গ্রহণ করবে। এভাবে জবরদস্তি ঋণ গ্রহণ করার অধিকার অবশ্যি সরকারের আছে, যেমন প্রয়োজনের সময় সরকার জনগনকে বাধ্যতামূলক সেনাদলে ভর্তি করার (CONSCRIPTIONS) এবং তাদের বাড়ি, গাড়ী ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস জোরপূর্বক লাভ করার (REQUISITION) অধিকার রাখে।
তিন: সর্বশেষ উপায় হিসেবে নিজের প্রয়োজন অনুপাতে নোট ছাপিয়েও সরকার কাজ চালাতে পারে। এটি আসলে জনগনের নিকট থেকে ঋণ গ্রহণেরই নামান্তর হবে। তবে এটি হবে অবশ্যি সর্বশেষ উপায়। সমস্ত উপায় ও পথ বন্ধ হয়ে গেলে অগত্যা এ পথ অবলম্বন করা যেতে পারে। কারণ এ পথে ক্ষতির ফিরিস্তি দীর্ঘতর।
আন্তর্জাতিক প্রয়োজনের ক্ষেত্রে
আন্তর্জাতিক ঋণের ক্ষেত্রে একথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, বর্তমান সুদভিত্তিক অর্থনীতির দুনিয়ায় নিজেদের জাতীয় প্রয়োজনের ক্ষেত্রে কোথাও থেকে আমরা বিনা সুদে ঋণ পাবো না। এ ক্ষেত্রে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে, যাতে বাইরে থেকে আমাদের কোনো ঋণ গ্রহণ করতে না হয়। অন্তত ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কোনো বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ না করা উচিত, যতক্ষণ না আমরা নিজেদের প্রতিবেশীদেরকে বিন সুদে ঋণ দিয়ে দুনিয়ার সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারি। আর ঋণ দেয়ার ব্যাপারে বলা যেতে পারে, ইতিপূর্বে আমরা যে আলোচনা করে এসেছি তারপর সম্ভবত কোনো বিচক্ষণ ব্যক্তি একথা স্বীকার করতে ইতস্তত করবেন না যে, একবার যদি আমরা সাহস করে নিজেদের দেশে সুদমুক্ত ও যাকাতভিত্তিক সুস্থ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হই তাহলে নিসন্দেহে অতি অল্প দিনের মধ্যে আমাদের আর্থিক অবস্থা এতই সচ্ছল হবে এবং আমরা এতই সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠবো, যার ফলে আমাদের কেবল বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজনই হবে না বরং চারপাশের অভাবী দেশগুলোকে বিনা সুদে ঋণ দিতেও আমরা সক্ষম হবো। যেদিন আমরা দুনিয়ায় এ আদর্শ স্থাপন করতে সক্ষম হবো সেদিনটি আধুনিক যুগের ইতিহাসে কেবল অর্থনৈতিক দিক দিয়েই নয় বরং রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক দিক দিয়েও হবে একটি বৈপ্লবিক দিন। সেদিন অন্য জাতির সাথে আমাদের সমস্ত লেনদেন হবে সুদ বিহীন অর্থব্যবস্থার ভিত্তিতে। এমনকি সম্ভবত অন্যান্য দেশও একের পর এক নিজেদের মধ্যে সুদ না নেয়ার জন্য চুক্তি সম্পাদন করতে থাকবে। এমনও হতে পারে, বিশ্ব জনমত সুদখোরীর বিরুদ্ধে এক বাক্যে ঘৃণা প্রকাশ করবে, যেমন ১৯৪৫ সালে ব্রিটেন উড্রসের ব্যাপারে ইংল্যান্ডের জনগণ করেছিল। এটা নিছক কোনো আকাশ কুসুম কল্পনা নয়। বরং আজো দুনিয়ার চিন্তাশীল লোকদের মতে আন্তর্জাতিক ঋণের ওপর সুদ চাপিয়ে দেয়ার কারনে দুনিয়ায় রাজনীতি ও অর্থনীতি উভয় ক্ষেত্রে অত্যন্ত মন্দ ও ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে। এ পথ পরিহার করে সমৃদ্ধশালী দেশগুলো যদি নিজেদের উদ্বৃত্ত অর্থ অনুন্নত ও দুর্দশাগ্রস্ত দেশগুলোকে আত্মনির্ভরশীল করার জন্যে ব্যয় করে এবং এজন্য আন্তরিক ও সহানুভূতিপূর্ণ প্রচেষ্টা চালায়, তাহলে এর দ্বিবিধ ফল পাওয়া যাবে। রাজনৈতিক ও তমদ্দুনিক দিক দিয়ে আন্তর্জাতিক তিক্ততা বৃদ্ধি পাবার পরিবর্তে প্রীতি ও বন্ধুত্ব বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে একটি দুর্দশাগ্রস্ত ও দেউলিয়া দেশের রক্ত শোষণ করার তুলনায় একটি ধনী দেশের সাথে ব্যবসা করা অনেক বেশি লাভজনক প্রমাণিত হবে। চিন্তাশীল ব্যক্তিরা এ জ্ঞান ও বুদ্ধি-বিবেচনার কথা চিন্তা করছেন এবং যাদের বলার ক্ষমতা আছে তারা বলেও যাচ্ছেন। কিন্তু কেবল চিন্তা ও বলতেই কাজ হবে না। এজন্য এমন একটি প্রজ্ঞা সম্পন্ন জাতির প্রয়োজন, যে প্রথমে নিজের ঘরে সুদের অস্তিত্ব বিলোপ করে দেবে অতপর সামনে অগ্রসর হয়ে আন্তর্জাতিক লেনদেনকেও এ অভিশাপের হাত থেকে মুক্ত করার জন্যে নিজের প্রচেষ্টা শুরু করবে।
লাভজনক কাজে পুঁজি বিনিয়োগ
ঋণের পর আর একটি বিষয়ের পর্যালোচনা প্রয়োজন। সে বিষয়টি হচ্ছে, আমাদের অভিপ্রেত অর্থব্যবস্থায় ব্যবসায়িক অর্থনীতির স্বরূপ কি দাঁড়াবে। এ ব্যাপারে আমি পূর্বেই কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছি। তা হচ্ছে, সুদ রহিত করার কারণে লোকদের জন্যে পরিশ্রম ও ঝুঁকি উভয়টিকে এড়িয়ে নিরাপত্তা ও নির্দিষ্ট মুনাফার গ্যারান্টি সহকারে কোনো কাজে নিজেদের পুঁজি বিনিয়োগ করার পথ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে। অনুরূপ যাকাত প্রবর্তনের কারণে তাদের জন্যে নিজেদের ধন-সম্পদ কোনো কাজে না লাগিয়ে সিন্দুকে আবদ্ধ রাখার এবং যক্ষের ন্যায় তা আগলে বসে থাকারও পথ বন্ধ হয়ে যাবে। উপরন্তু একটি যথার্থ ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকার বর্তমান থাকার কারণে লোকদের বিলাসিতা ও অমিতব্যয়িতার কোনো সুযোগ থাকবে না। তাদের উদ্বৃত্ত আয় তারা এভাবে নষ্ট করতে পারবে না। অতপর যারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত আয় করে তাদেরকে অবশ্যি নিম্নোক্ত তিনটি পথের মধ্যে থেকে যে কোনো একটি বেছে নিতে হবে।
এক: যদি সে আরো বেশী অর্থ উপার্জনের প্রত্যাশী না হয় তাহলে তার আয়ের উদ্বৃত্তাংশ কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে নিয়োগ করবে। এজন্য সে নিজে কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে ঐ অর্থ ওয়াকফ করবে, অথবা জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাঁদা দেবে বা কোনো প্রকার স্বার্থোদ্ধারের প্রত্যাশা না করে ইসলামী সরকারের হাতে তুলে দেবে। ইসলামী সরকার উন্নয়নমূলক বা জনসেবা ও জাতীয় চরিত্র পুনর্গঠনের কাজে তা ব্যয় করবে। বিশেষ করে রাষ্ট্রের পরিচালক ও প্রশাসকগণের আমানতদারী, বিশ্বস্ততা ও বুদ্ধিমত্তার ওপর যদি জনগণের আস্থা থাকে, তাহলে শেষোক্ত পন্থাটিকে অবিশ্য অগ্রাধিকার দিতে হবে। এভাবে সমাজ সংস্কার ও জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য সরকার ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিনা চেষ্টায় ও বিনা অর্থ ব্যয়ে হামেশা বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ লাভ করতে থাকবে। এজন্য তাদের কোনো সুদ বা মুনাফা আদায় তো দূরের কথা আসল আদায় করার জন্যেও জনগণের ঘাড়ে ট্যাক্সের বোঝা চাপিয়ে দিতে হবে না।
দুই: সে আরো বেশী অর্থ উপার্জনের প্রত্যাশী নয় ঠিকই কিন্তু নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ সে নিজের জন্যে সংরক্ষিত রাখতে চায়। এ অবস্থায় ঐ অর্থ সে ব্যাংকে আমানত রাখবে। ব্যাংক তা আমানত রাখার পরিবর্তে নিজের ওপর ঋণ হিসেবে গণ্য করবে। ব্যাংক তার গচ্ছিত অর্থ যখন সে চাইবে বা চুক্তিতে উল্লেখিত সময়ে ফেরত দেয়ার জামানত দেবে। এ সাথে ঋণ হিসেবে গৃহীত এ অর্থ ব্যবসায়ে খাটিয়ে তা থেকে মুনাফা অর্জন করার অধিকারও তার থাকবে। এ মুনাফার কোনো অংশ অবশ্যি আমানতদারদেরকে দিতে হবে না বরং তা পুরোপুরি ব্যাংকের নিজস্ব সম্পত্তি হবে। ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহ আলাইহের ব্যবসায় মূলত এ ইসলামী নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হতো। তাঁর আমানতদারী, বিশ্বস্ততা ও অস্বাভাবিক সুনামের কারণে লোকেরা নিজেদের অর্থের নিরাপত্তা বিধানের জন্যে তা তাঁর নিকট জমা রাখতো। ইমাম সাহেব এ অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ করার পরিবর্তে ঋণ হিসেবে গ্রহণ করতেন এবং তা নিজের ব্যবসায় খাটাতেন। তাঁর জীবনীকারদের বর্ণনা মতে তাঁর ইন্তেকালের সময় হিসেব করে দেখা গেছে, তাঁর ফার্মে পাঁচ কোটি দেরহাম পরিমাণ অর্থ এভাবেই অন্য লোকদের ঋণ বাবদ রক্ষিত অর্থ হিসেবে জমা ছিল। ইসলামের নীতি হচ্ছে, কোনো ব্যক্তি কারো নিকট কিছু আমানত রাখলে আমানত রক্ষাকারী তা ব্যবহার করতে পারবে না। কিন্তু আমানত নষ্ট হয়ে গেলে তার ওপর কোনো খেসারতও আরোপিত হয় না।
বিপরীাত পক্ষে ঐ অর্থ যদি ঋণ হিসেবে দেয়া হয় তাহলে ঋণগ্রহীতা তা ব্যবহার করতে ও তা থেকে লাভবান হবার অধিকার রাখে এবং যথা সময়ে ঋণ আদায় করার দায়িত্বও তার ওপর আরোপিত হয়। এ নিয়ম অনুসারে আজো ব্যাংক পরিচালিত হতে পারে।
তিন: যদি সে নিজের উদ্বৃত্ত অর্থ কোনো মুনাফা অর্জনকারী কাজে খাটাতে চায়, তাহলে তা করার একটি মাত্র পথ আছে। তা হচ্ছে, তার উদ্বৃত্ত অর্থ মুযারিবাত (অর্ধাৎ লাভ ও লোকসানে সমানভাবে অংশ গ্রহণ) ভিত্তিক মুনাফাজনক কাজে খাটানো। সরকার বা ব্যাংক যে কারোর তত্ত্বাবধানে এ কাজ বা ব্যবসায় চলতে পারে।
সে নিজে যদি এ অর্থ খাটাতে চায়, তাহলে তাকে কোনো ব্যবসায়ে অংশ গ্রহনের শর্তাবলী স্থির করতে হবে। সে ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের মধ্যে লাভ ও লোকসান কি হারে বণ্টিত হবে আইনগতভাবে তা নির্ধারণ করতে হবে। এভাবেই যৌথ মূলধন ভিত্তিক কোম্পানীতে (JOINT STOCK COMPANY) অংশ গ্রহণেও এর একটি মাত্র পথ রয়েছে, অর্থাৎ সোজাসুজি সেখানে কোম্পানীর শেয়ার কিনতে হবে। বন্ড, ডিবেঞ্চার ও এ ধরনের অন্যান্য বস্তু – যেগুলোর ক্রেতা কোম্পানী থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পেতে থাকে – সেগুলোর আসলে কোনো অস্তিত্বই থাকবে না।
সরকারের মাধ্যমে অর্থ খাটাতে চাইলে তাকে সরকারের কোনো মুনাফাজনক স্কীমে অংশীদার হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ মনে করুন সরকার কোনো পানি বিদুৎ পরিকল্পনা কার্যকর করতে চায়। সরকার তার এ পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করে জনগণকে তাতে অংশ গ্রহণের জন্যে আহ্বান জানাবে। যেসব লোক, প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক এতে পুঁজি সরবরাহ করবে তারা সরকারের সাথে এতে অংশীদার হয়ে যাবে এবং একটি নির্ধারিত ও স্থিরকৃত হারে এতে লব্ধ ব্যবসায়িক মুনাফার অংশ পেতে থাকবে। লোকসান হলে তার অংশও স্থিরকৃত হার অনুযায়ী সরকার ও অন্যান্য অংশীদারদের মধ্যে বণ্টিত হবে। একটি ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সরকার ক্রমান্বয়ে লোকদের অংশ নিজে কিনে নেয়ার অধিকারও রাখবে। এমন কি চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের মধ্যে পানি বিদ্যুতের সমস্ত কাজ পুরোপুরি সরকারী মালিকানাধীন এসে যাবে।
কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থার ন্যায় এ ব্যবস্থায়ও সবচেয়ে বাস্তবানুগ ও উপযোগী হবে তৃতীয় পথটি। অর্থাৎ লোকেরা ব্যাংকের মাধ্যমে নিজেদের পূঁজি মুনাফাজনক কাজে বিনিয়োগ করবে। তাই সে সম্পর্কে আমি একটু বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই। এর ফলে সুদ রহিত করার পর ব্যাংকিং-এর কারবার কিভাবে চলবে এবং মুনাফা প্রত্যাশী লোকেরা তার থেকে কিভাবে লাভবান হবে তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।
ব্যাংকিং-এর ইসলামী পদ্ধতি
ইতিপূর্বে আমি ব্যাংকিং সম্পর্কে যে আলোচনা করেছি তাতে ব্যাংকিং ব্যবস্থাটি সম্পূর্ণ অবৈধ ও ক্রুটিপূর্ণ একথা বলা আমার উদ্দের্শ ছিল না এবং উদ্দেশ্য হতেও পারে না। আসলে ব্যাংকিংও আধুনিক সভ্যতা লালিত বহুবিধ বস্তুর মধ্যে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী বস্তু। এর মধ্যে কেবলমাত্র একটি অনিষ্টকর শয়তানী বস্তুর অনুপ্রবেশের কারণে এ সমগ্র ব্যবস্থাটিই পুতিগন্ধময় হয়ে উঠেছে। এতদসত্ত্বেও এব্যবস্থাটি বর্তমান যুগে বৈধ পথে মানবতার বহুবিধ সেবা করে যাচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এবং ব্যবসায়িক প্রয়োজনের ক্ষেত্রে এর উপকারিতা ও অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। যেমন, অর্থ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠানো ও তা আদায়ের ব্যবস্থা করা, বিদেশের সাথে লেনদেনের সুযোগ-সুবিধা দান করা, মূল্যবান বস্তু সংরক্ষণ করা, আস্থাপত্র (LETTERS OF CREDIT), ট্রাভেলারস চেক, ড্রাফট প্রভৃতি জারী করা, কোম্পানীর অংশ বিক্রির ব্যবস্থা করা এবং বহুবিধ এজেন্সি সার্ভিস চালু করা, যার ফলে ব্যাংকে সামান্যতম কমিশন দেয়ার ব্যবস্থা করে আজকের যুগের একজন অতি ব্যস্ত ব্যক্তি বহু রকমের ঝামেলা থেকে মুক্তি পায়। এসব কাজ অবশ্যি অব্যাহত থাকতে হবে এবং এজন্য একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব থাকতে হবে। উপরন্তু সমাজের উদ্বৃত্ত অর্থ-সম্পদ চর্তুদিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকার পরিবর্তে একটি কেন্দ্রীয় রক্ষণাগারে (RESERVOIR) সঞ্চিত থাকা এবং সেখান থেকে জীবনের সব ক্ষেত্রে, সর্বত্র সবসময় সহজভাবে পৌঁছে যাওয়া, শিল্প, কৃষি এবং তমদ্দুন ও অর্থনীতির জন্যে অত্যন্ত কল্যাণকর ও আজকের অবস্থার প্রেক্ষিতে একান্ত অপরিহার্য বিবেচিত হবে। এই সাথে সাধারণ লোকদের জন্যেও এটাই সহজতর ব্যবস্থা বলে মনে হয়। তাদের প্রয়োজন পূর্ণ হবার পরও যে সামান্য পরিমাণ অর্থ উদ্বৃত্ত থাকবে তাকে কোনো মুনাফাজনক কাজে খাটাবার জন্যে তারা নিজেরা পৃথক পৃথকভাবে সুযোগ অনুসন্ধান করার পরিবর্তে এসব অর্থ একটি কেন্দ্রীয় ভান্ডারে জমা করে দেবে এবং সেখানে একটি সন্তোষজনক পদ্ধতিতে সামগ্রিকভাবে তাদের সবার অর্থ কাজে লাগাবার এবং তা থেকে লব্ধ মুনাফা যথাযথভাবে বণ্টন করার ব্যবস্থা হবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই যে, এক নাগাড়ে এবং স্থায়ীভাবে অর্থনৈতিক কাজে ব্যাপৃত থাকার কারণে ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ও কর্মীবৃন্দ এ বিভাগে এমন একটি দক্ষতা ও সূক্ষ্মদর্শীতা লাভ করে, যা ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে জড়িত অন্যান্য কর্মীরা লাভ করতে সক্ষম হয় না। এ দক্ষতাপূর্ণ সূক্ষ্মদর্শীতা অবশ্যি একটি অতি মূল্যবান সম্পদ। যদি তা নিছক পুঁজিপতির স্বার্থ সিদ্ধির অস্ত্রে পরিণত না হয়ে ব্যবসায়ীদের সাহায্য-সহযোগিতায় ব্যবহৃত হয় তাহলে অত্যন্ত উপকারী ও কল্যাণকর প্রমাণিত হতে পারে। কিন্তু ব্যাংকিং-এর এ সমস্ত কল্যাণ ও সুফলকে বিশ্ব মানবতার জন্যে অকল্যাণ, অন্যায়, অনিষ্ট ও বিপর্যয়ে পরিণত করছে যে বস্তুটি, তা হচ্ছে সুদ। এই সাথে আর একটি অনিষ্টকর বস্তু এর সাথে মিশে এ বিপর্যয় ও অনিষ্টকে ভয়াবহ রূপ দিয়েছে। তা হচ্ছে, সুদের চুম্বক আকর্ষণে যেসব পুঁজি বিভিন্ন স্থান থেকে এসে ব্যাংকে কেন্দ্রীভূত হয়, তা কার্যত কতিপয় স্বার্থ শিকারী পুঁজিপতির সম্পদে পরিণত হয়ে যায় এবং তারা অত্যন্ত গর্হিত মানবতা বৈরী ও সমাজ বিরোধী পদ্ধতিতে সেগুলো ব্যবহার করে। ব্যাংকিংকে এ দুটো দোষ মুক্ত করতে পারলে তা একটি পবিত্র কাজে পরিণত হয়ে যাবে এবং মানব সমাজ ও সভ্যতার জন্যে বর্তমান অবস্থার তুলনায় অনেক বেশী উপকারী ও কল্যাণকর হবে। সুদখোরীর পরিবর্তে এ পবিত্র পদ্ধতিটি যদি পুঁজিপতি ও সুদখোর মহাজনদের জন্যেও আর্থিক দিক দিয়ে অধিকতর লাভজনক প্রমাণিত হয় তাহলেও আশ্চর্যের কিছু নেই।
যারা মনে করে সুদ রহিত হবার পর ব্যাংকের অর্থ সংগ্রহ বন্ধ হয়ে যাবে, তারা বিরাট ভুলের শিকারে পরিণত হয়েছে। তারা মনে করে সুদ পাবার আশা যখন নেই তখন লোকেরা তাদের আয়ের উদ্বৃতাংশ ব্যাংকে জমা রাখবে কেন? অথচ তখন সুদ না পেলে কি হবে, মুনাফা পাবার আশা তো থাকবে। আর যেহেতু মুনাফার অংশ অনির্ধারিত ও সীমাহীন থাবে, তাই সাধারণ সুদের হারের তুলনায় কম মুনাফা পাবার সম্ভাবনা যে পরিমাণ থাকবে ঠিক সে পরিমাণ সম্ভাবনা থাকবে বেশী এবং যথেষ্ট মোটা অংকের মুনাফা পাবার আশাও। এই সাথে ব্যাংক তার সাধারণ কাজগুলো করে যাবে, যেগুলোর জন্যে বর্তমানে লোকেরা তার শরণাপন্ন হয়ে থাকে। কাজেই নিশ্চিত বলা যায় যে, বর্তমানে যে পরিমাণ ধন ব্যাংকের নিকট আমানত রাখা হয়, সুদ রহিত হবার পরও একই পরিমাণ ধন আমানত রাখা হবে। বরং সে সময় সব রকম ব্যবসায়ের ব্যাপক প্রসারের কারণে মানুষের কাজ-কারবার বেড়ে যাবে, আমদানী আরও বেড়ে যাবে। কাজেই বর্তমান অবস্থার তুলনায় আরো অনেক বেশী পরিমাণ আয়ের উদ্বৃত্তাংশ ব্যাংকে জমা হবে।
এ পুঁজির যে পরিমাণ অংশ কারেন্ট একাউন্ট বা চলতি হিসেবের খাতায় জমা হবে, তাকে ব্যাংক কোনো মুনাফাজনক কাজে লাগাতে পারবে না, যেমন বর্তমানেও পারে না। তাই এ পুঁজির মূলত দুটো বড় বড় কাজে ব্যবহৃত হবে। এক. প্রতিদিনকার নগদ লেনদেন এবং দুই. ব্যবসায়ীদেরকে বিনা সুদে স্বল্প মেয়াদী ঋণ দান এবং বিনা সুদে হুন্ডী ভাঙানো।
ব্যাংকে যেসব দীর্ঘ মেয়াদী আমানত রাখা হবে, তা অবশ্যি দু ধরনেরই হবে। এক ধরনের আমানতের মালিকের উদ্দেশ্য কেবল নিজের অর্থের সংরক্ষণ। এ ধরনের লোকদের অর্থ ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে ব্যাংক নিজেই ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করবে, যেমন ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় ধরনের মালিকেরা তাদের অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যবসায়ে খাটাতে চায়। তাদের অর্থ আমানত হিসেবে রাখার পরিবর্তে ব্যাংক-কে তাদের সাথে একটি সাধারণ অংশীদারীত্বের চুক্তিনামা সম্পাদন করতে হবে। অতপর ব্যাংক এ পুঁজিকে তার অন্যান্য পুঁজিসহ মুযারিবাত (লাভ-লোকসানে সমভাবে অংশ গ্রহণ ভিত্তিক) নীতির ভিত্তিতে ব্যবসায়ে, শিল্প প্রকল্পে, কৃষি ফার্মে, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ও সরকারের বিভিন্ন মুনাফাজনক কাজে খাটাতে পারবে। এর থেকে সামগ্রিকভাবে দুটো বড় বড় উপকার সাধিত হবে। প্রথমত, পুঁজিপতি ও পুঁজি বিনিয়োগকারীর স্বার্থে ব্যবসায়ের স্বার্থের সাথে একাকার হয়ে যাবে। কাজেই ব্যবসায়ের প্রয়োজন অনুযায়ী পুঁজি তার পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকবে এবং যেসব কারণে বর্তমান দুনিয়ার সুদ ভিত্তিক অর্থব্যবস্থায় দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধগতি ও চড়ামূল্যের উত্তাল তরঙ্গ সৃষ্টি হয় তা প্রায় সবই খতম হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, পুঁজিপতির অর্থনৈতিক দূরদৃষ্টি ও ব্যবসায়ীর ব্যবসায়িক ও শৈল্পিক বিচক্ষণতা যা বর্তমান বিশ্বে পারস্পরিক সংঘর্ষ ও বিরোধে মত্ত রয়েছে। সে সময় অবশ্যি তা পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলবে এবং তাতে সবারই উপকার হবে। অতপর এ পদ্ধতিতে ব্যাংক যে মুনাফা অর্জন করবে, তা দিয়ে নিজের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা ব্যয় নির্বাহের পর যা অবশিষ্ট থাকবে তা নির্দিষ্ট অনুপাতে নিজের অংশীদার ও আমানতদারীদের মধ্যে বণ্টন করবে। এ ব্যাপারে পার্থক্য কেবল এতটুকুন হবে যে, বর্তমান অবস্থায় অংশীদারদের মধ্যে মুনাফা (DIVIDENDS) বণ্টন হয় এবং আমানতকারীদেরকে সুদ দেয়া হয়, আর তখন উভয়কেই মুনাফার অংশ দেয়া হয়। বর্তমানে আমানতকারীরা একটি নির্ধারিত হারে সুদ পেয়ে থাকে আর তখন কোনো নির্দিষ্ট হার থাকবে না। বরং কমবেশী যে পরিমাণ মুনাফা অর্জিত হবে সবই একই অনুপাতে বণ্টিত হবে। বর্তমানে যে পরিমাণ লোকসান ও দেউলিয়া হবার ভয় রয়েছে তখনও তাই থাকবে। বর্তমানে বিপদ এবং এর মোকাবিলায় সীমাহীন মুনাফার সম্ভাবনা উভয়টিই কেবলমাত্র ব্যাংকের অংশীদারের জন্যে নির্দিষ্ট। কিন্তু তখন এ দুটো সম্ভাবনা আমানতকারী ও অংশীদার উভয়ের জন্যে সমভাবে বর্তমান থাকবে।
ব্যাংকিং পদ্ধতির আর একটি ক্ষতি নিরসনের জন্যে আমাদেরকে বিশেষ ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। মুনাফার আকর্ষণে যে অর্থ ব্যাংকে সঞ্চিত হয়, তার সুসংবদ্ধ শক্তির কর্তৃত্ব কার্যত মাত্র গুটিকয়েক ব্যাংকারের হাতে চলে যায়। এ ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার জন্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং (CENTRAL BANKING)-এর সমস্ত কাজ বায়তুলমাল বা ষ্টেট ব্যাংকের হাতে সোপর্দ করতে হবে। অন্যদিকে আইনের মাধ্যমে সমস্ত প্রাইভেট ব্যাংকের ওপর সরকারী দখল ও কর্তৃত্ব এমনভাবে সুদৃঢ় করতে হবে যার ফলে ব্যাংকাররা নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তির অপ্রিয় ব্যবহারের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
সুদ বিহীন অর্থনীতির যে সংক্ষিপ্ত নকশাটি আমি পেশ করলাম, তা পর্যালোচনা করার পর সুদ রহিত করে সুদমুক্ত অর্থনীতির ভিত্তিতে কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারটি আদৌ বাস্তবানুগ নয়, একথা বলার কোন অবকাশই থাকে না।
———–