জুমার নামাযের বিবরণ
জুমার দিনের ফযীলত
আল্লাহর নিকটে জুমার দিন সমস্ত দিনের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম এবং বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এ দিনের মধ্যে ছয়টি এমন বিশিষ্ট গুণের সমাবেশ রয়েছে যা অন্য দিনগুলোর মধ্যে নেই, এ জন্যে দিনটিকে বলা হয় জুমা (বহুর সমাবেশ(। প্রথম বিশিষ্ট গুণ এই যে, এ দিনে মুসলমানদের বিরাট সমাবেশ হয়। কোন কেন্দ্রীয় স্থানে তারা আল্লাহর যিকির ও এবাতদের জন্যে একত্র হয় এবং বিরাট জামায়েত জুমার নামায আদায় করে। এ জন্যে নবী (স) এ দিনকে মুসলমানদে ঈদের দিন বলে আখ্যায়িত করেছেন। ***১ জাহেলিয়াতের যুগে আরববাসী এ দিনটেকে ‘ইয়াওমে আরোবা’ বলতো। ইসলামে যখন এ দিনটি মুসলমানদের সম্মেলনের দিন নির্ধারণ করা হলো তখন তার নাম রাখা হলো ‘জুময়া’। জুময়া আসলে একটি ইসলামী পরিভাষা। ইহুদীদের শনিবার ছিল এবাদতের জন্যে নির্দিষ্ট। কারণ ঐদিন আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে ফেরাউনের গোলামী থেকে রক্ষা করেন। ঈসায়ীগণ নিজেদেরকে ইহুদীদের থেকে আলাদা করার জন্যে রবিবার দিনকে নিজেরাই নির্ধারণ করে। অথচ এর কোন নির্দেশ হযরত ঈসা (আ) দিয়েছেন, আর না ইঞ্জিলে এর কোন উল্লেখ আছে। ঈসায়ীদের আকীদাহ এই যে, শুলে জীবন দেয়ার পর হযরত ঈসা (আ) কবর থেকে উঠে আসমানে চলে যান। সেটা ছিল রবিবার। অতপর ৩২১ খৃস্টাব্দে রোমীয় সাম্রাজ্য এক সরকারী ঘোষণার মাধ্যমে এ দিনটিকে ছুটির দিন বলে নির্ধারিত করে। ইসলাম এ দু’টি মিল্লাত থেকে মুসলিম মিল্লাতকে আলাদ করার জন্যে এ দু’টি দিন বাদ দিয়ে জুমার দিনকে সামষ্টিক এবাদতেরে জন্যে গ্রহণ করে। এর ভিত্তিতেই এ দিনটিকে মুসলমানকে ঈদের দিন বলা হয়। এছাড়া অন্য পাঁচটি গুণ বা সৌন্দর্যের কাথা বর্ণা করতে গিয়ে নবী (স) বলেন-
***১ [একবার জুমার খুৎবা দেয়া কালে নবী (স) বলেন- মুসলমানগণ! আজ এমন একদিন যাকে আল্লাহ তোমারেদ জন্যে ঈদের দিন বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ জন্যে তোমরা এদিনে গোসল কর, যার খুশবু সংগ্রহ করা সম্ভব, সে তা ব্যবহার করবে। এদিনে তোমরা অবশ্যই মিসওয়াক করে দাঁত-মুখ পরিষ্কার করবে- (মোয়াত্তা, ইবনে মাজাহ)।]
জুমার দিন সকল দিনগুলার মধ্য উৎকৃষ্টতম এবং বৈশিষ্টপূর্ণ। আল্লাহর নিকটে সকল দিনগুলো থেকে এর মর্যাদ অধিক। এমন কি এ দিনের মর্যাদা ঈদুল আযহা এবং ঈদুল ফেতের থেকেও বেশী। এ দিনের পাঁচটি এমন বৈশিষ্ট্য আছে যা অন্য দিনগুলোর মধ্যে নেই। তা হলো:-
১. এদিন আল্লাহ আদম (আ) কে পয়দা করেন।
২. এ দিনে আল্লাহ হযরত আদম (আ) কে দুনিয়ায় তাঁর খলীফা করে পাঠান।
৩. এ দিনে তাঁর এন্তেকাল হয়।
৪. এ দিনে এমন এস বিশিষ্ট সময় আছে যখন বান্দাহ আল্লাহর কাছে যে এবং পাক জিনিস চায় তা তিনি অবশ্যই তাকে দেন
৫. আর এ দিনেই কেয়ামত সংঘটিত হবে। আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী ফেরেশতাগণ, আসমান, যমীন, বায়ু, পাহাড়, পর্বত, নদী, সমুদ্র এমন কিছু নেই যা জুমার দিনের জন্যে ভীত ও কম্পিত হয় না- (ইবনে মাজাহ্)
নবী (স) আরও বলেন-
দুনিয়অতে আমাদের আগমন সকলের শেষে হয়, কিন্তু কেয়ামতের দিনে আমরা সকলের আগে বেহেশতে যাব। এসব ইহুদী নাসারাদেরকে আমাদের পূর্বে কেতার ও হেদায়াত দেয়া হয়েছিল এবং আমাদেরকে পরে। তাদের সকলের উপরেই জুমার শ্রদ্ধা ফরয করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এতে মতভেদ করলো এবং আল্লাহ আমাদেরকে এর উপর অটল থাকার তওফীক দেন। এ জন্যে তারা সকলে আমাদের পিছনে থাকবে। ইহুদী আগামীকালকে (শনিবার) শ্রদ্ধা করে এবং নাসারা আগামী পরশু দিনের (রবিবার) প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে- (বুখারী, মুসলিম)।
নবী (স) জুমার আয়োজন বৃহস্পতিবার থেকেই শুরু করতেন এবং বলতেন-
জুমার রাত সাদা রাত এবং জুমার দিন উজ্জ্বল দিন (মিশকাত)।
ইমাম গাজ্জালী (র) বলেন, জুমার দিনের প্রেরণা ও বরকত তারাই লাভ করে যারা তার প্রতীক্ষার সময় কাটাতে থাকে। আর অবহেলাকারীগণ বড়ই হতভাগ্য যাদের এ কথা জানা নেই যে, কখন জুমা এলো, তারা মানুষকে জিজ্ঞেস করে, ‘আজ কোন দিন?’ –(এহইয়াউল উলুম)।
জুমার নামাযের অপরিহার্যতা
জুমা ফরয হওয়ার হুকুম হিজরতের পূর্বে মক্কায় হয়েছিল। কিন্তু সেখানকার প্রতিকূল পরিস্থিাতে মুসলমানদের জন্যে সামষ্টিক এবাদত করা সম্ভব ছিল না। সুতরাং নবী (স) তার উপর আমল করতে পারেন নি। অবশ্যি তাঁর পূর্বে যারা হিজরত করে মদীনায় পৌঁছেছিলেন, তাঁদের সরকার হযরত মাসয়াত বিন উমাইর (রা) কে নবী (স) লিখিত নির্দেশ দেন-
(আরবী******************)
জুামার দিন যখন বেলা দুপুর গড়ে যায়, দু’রাকয়াত নামায পড়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভ কর। এ হুকুমনামা পেয়ে মাসয়াব বিন উমাইর (রা) বার জন লোক নিয়ে মদীনায় প্রথম জুমা পড়েন। -(দারে –কুতনী)।
হযরত কা’ব বিন মাকেল (রা) এবং ইবনে সিরীন (রা) বলেন, তারও পূর্বে মদীনার আনসারগণ নিজেরাই পরামর্শ করে স্থির করেন যে, সপ্তাহে একদিনে মিলে সামষ্টিক এবাদত করবেন। এ উদ্দেশ্যে তাঁরা ইহুদীদের শনিবার এবং নাসারাদের রোববার বাদ দিয়ে জুমার দিন নির্বাচর করেন। এবং মদীনায় প্রথম জুমা আসয়াদ বিন যেরারাহ (রা) বিয়াযা অঞ্চলে ১৪০ জন লোক নিয়ে আদায় করেন- (মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)।
তারপর নবী (স) যখন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন, তখন পথে চারদিকে কুবা নামক স্থানে অবস্থান করেন। পঞ্চম দিনে সেখান থেকে মদীনার দিকে রওয়ানা হন। যখন তিনি বনী সালেম বিন আওফের স্থানে পৌছেন তখন জুমার ওয়াক্ত হয়। সেখানে তিনি প্রথম জুমা পড়েন –(ইবনে হিশাম)।
জুমার নামাযের হুকুম, ফযীলত ও গুরুত্ব
জুমার নামায ফরযে আইন। কুরআন, হাদীস এবং ইজমায়ে উম্মতের দ্বারা ইহার ফরয হওয়া অকাট্যভাবে প্রমাণিত। উপরন্তু ইসলামের প্রতীক হিসেবেও তার বিরাট মর্যাদা। এর ফরয হওয়াকে অস্বীকারকারী ইসলামের গণ্ডির বহির্ভূত। অবহেলা করে তা পরিত্যাগ করলে সে ফাসেক হয়ে যাবে।
কুরআন বলে- (আরবী*******************)
মুনেমনগণ, যখন জুমার দিনে জুমার নামাযের জন্যে আযান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর যিকিরের জন্যে দৌড়াও এবং বেচা-কেনা বন্ধ করে দাও। এ তোমারেদ জন্যে ভালো, যদি তোমরা বুঝে সুঝে কাজ কর।
আল্লাহর যিকির বলতে খোতবা এবং নামায বুঝানো হয়েছে। দৌড়ানো অর্থ পূর্ণ নিয়মতান্ত্রিকতার সাথে এবং মনোনিবেশ সহকারে যত শীঘ্র সম্ভব মসজিদে পৌছাবার চেষ্টা করা। এ অসাধারণ তাকীদের মর্ম এই যে, অন্যান্য নামায তো জামায়াত ব্যতীতও হতে পারে, ওয়াক্ত চলে গেলে কাযা করা যেতে পারে। কিন্তু বিনা জামায়াতে জুমার নামায হবে না এবং সময় চলে গেলেও এর কাযাও নেই। এ জন্যে আযান শুনার পর যাদেরকে মুমেন বলে সম্বোধন করা হচ্ছে তাদের কোন বেচা-কেনার অথবা অন্য কোন কাজে লিপ্ত তাকা কিছুতেই জায়েয নয়। প্রকৃতপক্ষে এ সময়টুকু আল্লাহর দরবারে দাঁড়ানো ও সিজদা করা এবং আল্লাহর যিকিরে মশগুল থাকার চিরন্তন ফায়দা দুনিয়ার ব্যস্তাতর সাময়িক ও স্থিতিহীন ফায়দার চেয়ে লক্ষ্য গুণে বেশী। তবে শর্ত এই যে, মানুষ জেনে বুঝে পূর্ণ অনুভূতির সাথে যেন এ কাজ করে।
নবী পাক (স) বলেন-
**জুমার নামায জামায়াতসহ প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে ফরয। শুধু গোলাম, স্ত্রীলোক, নাবালেগ এবং রোগীর জন্যে নয়- (আবু দাঊদ)।
** যে আল্লাহ এবং আখেরাতের উমার ঈমান রাখে তার উপর জুমার নামায অপরিহার্য। তারপর সে যদি কোন খেলা-ধুলা তামাসা অথবা ব্যবসা বাণিজ্যের খাতিরে এ নামায থেকে বেপরোয়া হয় তাহলে আল্লাহ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন কারণ তিনি পাক ও অমুখাপেক্ষী।– (দগারে-কুতনী)।
** যদি কেউ বিনা কারণে জুমার নামায ত্যাগ করে তার নাম মুনাফেক হিসাবে এমন এক কেতাবে লিপিবদ্ধ করা হবে যা কিছুতেই মিটানো যাবে না। আর না পরিবর্তন করা যাবে –(মিশকাত)।
** আমার মন বলছে যে, আমার বদলে আর কাউকে নামায পড়াতে দেই আর নিজে ঐসব লোকের বাড়ীতে আগুন লাগিযে দেই যারা জুমার নামাযে না এসে বাড়ী বসে আছে-(মুসলিম)।
** হযরত ইবনে ওমর (রা) এবং হযরত আবু হুরায়রা (রা) বলেছেন যে, তাঁরা নবী (স) কে মিম্বারের উপর দাঁড়িয়ে এ কথা বলতে শুনেছেন-
লোকের উচিত যে, তারা যেন জুমার নামা ত্যাগ করা থেকে বিরত থাকে; নতুবা আল্লাহ তাদের দিলে মোহর মেরে দেবেন। তারপর তারা অবহেলায় মগ্ন হয়ে থাকবে। -(মুসলিম)।
** যে ব্যক্তি জুমার নামাযের আযান শুনলো অতপর নামাযে এলো না, তারপর দ্বিতীয় জুমার আযান শুনেও এলো না এবং এভাবে ক্রমাগত তিন জুমায় এলো না তার দিলে মোহর দেয়া হয় এবং তার দিলকে মুনাফিকের দিলে পরিণত করা হয় –(তাবারানী)।
আল্লামা সারাখসী বলেন-
জুমা কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে ফরয এবং ফরয হওয়ার ব্যাপারে উম্মতের এজমা প্রতিষ্ঠিত- (মবসূত, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২২(।
আল্লামা ইবনে হাম্মাম বলেন-
জুমা এমন এক ফরয যা ফরয করেছে কুরআন এবং সুন্নাহ। যে ব্যক্তি এ অস্বীকার করবে তার কুফরীর উপর উম্মতের এজমা রয়েছে- (ফতহুল কাদীর, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৮০৭)।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন-
যে ব্যক্তি অবহেলা করে ক্রমাগত কয়েক জুমা ত্যাগ করবে সে ইসলামকে পিছনে নিক্ষেপ করলো-(এলমুল ফেকাহ)।
নবী (স) জুমার প্রেরণা দিতে গিয়ে তার ফযিলত বর্ণনা করে বলেন-
যে ব্যক্তি জুমার দিনে গোসল করলো, তার পাক পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার পুরাপুরি ব্যবস্থা করলো, তারপর তেল এবং খুশবু লাগালো এবং বেলা গড়ার সাথে সাথে আউয়াল ওয়াক্তে মসজিদে গিয়ে পৌঁছলো এবং দু’জনকে পরস্পর থেকে হটিয়ে দিল না অর্থাৎ তাদের কাঁধ ও মাথার উপর দিয়ে কাতার ডিঙ্গিয়ে অথবা দু’জন বসে থাকা লোকের মাঝখানে গিয়ে বসে পড়ার ভুল করলো না, বরঞ্চ যেখানে জায়গা পেলো সেখানেই চুপচাপ বসে পড়লো এবং সুন্নাত নামায প্রভৃতি পড়লো যা আল্লাহ তার অংশে লিখে রেখেছেন, তারপর খতীপ যখন মিম্বরে এলেন তখন নীরবে বসে খোতবা শুনতে লাগলো তাহলে এমন ব্যক্তির ঐ সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে যা সে বিগত জুমা থেকে এ জুমা পর্যন্ত করেছে- (বুখারী)।
হযরত ইবনে ওমর (রা) বলেন যে, নবী (স) বলেছেন জুমার আগমনাকরীদের তিন প্রকার ভূমিকা হয়ে থাকে-
১. একদল ঐসব লোক যারা বেহুদা কথা-বার্তায় লেগে যায়। তাদের অংশে এসব বেহুদা কথা-বার্তা ব্যতীত আর কিছুই পড়ে না।
২. দ্বিতীয় ঐসব লোক যারা এসে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকে। আল্লাহ চাইলে তাদের দোয়া কবুল করবেন আর না চাইলে করবেন না।
৩. তৃতীয় ঐসব লোক যারা এসে চুপচাপ বসে যায়, না তারা মুসলমানদের ঘাড় ডিঙিয়ে সামনে যায়, আর না তারা কারো মনে কোন কষ্ট দেয়, তাহলে এদের এ নেক আমল আগামী জুমা এবং তারপর তিন দিন পর্যন্ত করা সকল গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়- (আবু দাউদ)।
যেমন আল্লাহ বলেন- (আরবী****************)
যে ব্যক্তি নেক আমল করে সে তার দশগুণ প্রতিদান পায়।
নবী (স) আরও বলেন-
যে ব্যক্তি জুমার দিন ভাল করে গোসল করে, সকাল সকাল মসজিদে যায়, পায়ে হেঁচে যায়, কোন বাহনে চড়ে নয়, তারপর নিশ্চিত মনে খোতবা শুনে এবং খোতবা চলাকালে কোন বাজে কাজ করে না, তাহলে এমন ব্যক্তি তার প্রতি কদমের পরিবর্তে এক বছরের এবাদতের প্রতিদান পাবে- এক বছরের নামাযের এবং এক বছরের রোযার –(তিরমিযী)।
জুমার নামাযের শর্ত
জুমার নামায সহীহ এবং ওয়াজেব হওয়ার জন্যে শরীয়ত কিছু শর্ত আরোপ করেছে। যদি এসব শর্ত পাওয়া না যায়, তাহলে জুমা ওয়াজেব হবে না। এসব শর্ত আবার দু’প্রকারের। কিছু শর্ত এমন যা নামাযের মধ্যেই থাকা জরুরী। তাকে ‘শারায়েতে ওজুব’ বলে। কিছু শর্ত এমন যা বাইরে পাওয়া জরুরী। এসবকে বলে ‘শারায়েতে সেহ্হাত’।
শারায়েতে ওজুব
জুমার নামায ওয়াজেব হওয়ার জন্যে পঁচটি শর্ত।
১. পুরুষ হওয়া। নারীরেদ জন্যে জুমা ওয়াজেব নয়।
২. স্বাধীন হওয়া। গোলামের উপর ওয়াজেব নয়।
৩. বালেগ এবং জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া। নাবালেগ এবং পাগলের উপর ওয়াজেব নয়।
৪. মুকীম হওয়া। মুসাফিরের জন্যে ওয়াজেব নয়।
৫. সুস্থ হওয়া। রোগী ও অক্ষমের জন্যে ওয়াজেব নয়। রোগী হওয়অর অর্থ এই যে, যে মসজিদ পর্যন্ত যেতে পারে না। কিন্তু যারা চলাফেরা করে এবং মসজিদ পর্যন্ত যেতে সক্ষম তার উপর জুমার নামায ওয়াজেব।
অক্ষম দু’প্রকারের। প্রথমত যারা দৈহিক কোন অক্ষমতা রয়েছে। যেমন, অন্ধ, খঞ্জ, এমন বৃদ্ধ যে চলতে পারে না। দ্বিতীয়ত ঐসব লোক যাদের বাহির থেকে কোন অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ঝড়-তুফান, বৃষ্টি, বাদল, পথে কোন হিংস্র জানোয়ার, শত্রু প্রবৃতির ভয় হওয়া।
শারায়েতে ওজুব পাওয়া না গেলে জুমার নামাযের হুকুম
জুমার নামায তো এমন ব্যক্তির জন্যে ওয়াজেব যার মধ্যে উপরের পাঁচটি শর্ত পাওয়া যাবে। কিন্তু কোন ব্যক্তির মধ্যে যদি এসব শর্ত বা কিছু পাওয়া না যায় এবং সে যদি জুমার নামায পড়ে তাহলে তার নামায দুরস্ত হবে। অর্থাৎ জুমার নামায পড়ার পর তাকে আর যোজর নামায পড়ার দরকার হবে না। যেমন কোন মহিলা মসজিদে গিয়ে জুমার নামায পড়লো, অথবা মুসাফির বা অক্ষম ব্যক্তি জুমার নামায পড়লো, তাহলে তার নামায দুরস্ত হবে এবং সে যদি জুমার নামায পড়ার পর তাকে আর যোহর নামায পড়ার দরকার হবে না। যেমন কোন মহিলা মসজিদে গিয়ে জুমার নামায পড়ার দরকার হবে না। যেমন মহিলা মসজিদে গিয়ে জুমার নামায পড়লো, অথবা মুসাফির বা অক্ষম ব্যক্তি জুমার নামায পড়লো, তাহলে তার নামায দুরস্ত হবে এবং যোহর নামায পড়তে হবে না।
শারায়েতে সেহহাত (*****)
জুমার নামায সহীহ হওয়ার জন্যে পাঁচটি শর্ত। এসব শর্ত পূরণ ব্যতিরেকে কেউ জুমা পড়লে তার যোহর নামায পড়ার প্রয়োজন হবে। শর্তগুলো নিম্নরূপ-
১. মেসরে জামে’ হওয়া।
২. যোহরের ওয়াক্ত হওয়া।
৩. খোতবা হওয়া ।
৪. জামায়াত হওয়া।
৫. সর্ব সাধারণের জন্যে নামাযে অনুমতি থাকা।
শর্তগুলোর ব্যাখ্যা
১. মেসরে জামে’
বন জংগল, পল্লীগ্রাম, সাময়িক অবস্থানের জায়গায় জুমার নামায দুরস্ত হবে না।
হযরত আলী (রা) বলেন-
জুমা এবং ঈদাইনের নামায মেসরে জামে’ ব্যতীত অন্য কোন স্থানে দুরস্ত হবে না।
মেসরে জামে’ বলতে বুঝায় এমন এক শহর অথবা বড়ো বস্তি যেখানে এত সংখ্যক মুসলমান আছে যাতে উপর জুমা ওয়াজেব, তারা যদি ঐ বস্তির কোন মসজিদে জমা হয় তাহলে তাদের স্থান সংকুলান হবে না [সাধারণত : মেসরে জামে’ উপরোক্ত সংজ্ঞা হচ্ছে হানাফী ফকীহদের। এ ছাড়াও আরও বহু সংজ্ঞা বর্ণিত আছে। যেমন:
১. যে স্থানে লোকসংখ্যা দশ হাজার, তার মেসর।
২. অথবা মেসর (শহর) তাকে বলে যেখানে সকল পশার লোক জীবিকা অর্জন করে।
৩. সমকালীন ইমাম যে স্থানকে মেসর বলে উল্লেখ করে জুমা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেবেন তা মেসর।
৪. মেসর ঐ স্থানকে বলে যেখানে বাজার, সড়ক এবং মহল্লা আছে এবং সেখানে এমন একজন পরিচালক থাকবে যে যালেমদের হাত থেকে মযলুমদের অধিকার আদায় করত পারে এবং এমন একজন আলেম থাকবে যার নিকটে লোক মাসয়ালা-মাসায়েল শিখতে আসবে।
এসব ছাড়াও ফকীহগণ আরও অনেক সংজ্ঞা বর্ণনা করেছেন। এর থেকে জানা যায় যে, মেসরে জামে’র কোন সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই যাঁর দ্বারা নিসন্দেহে এ সিদ্ধান্ত করা যায় যে, জুমার নামায শুধু শহরেই পড়া যায় গ্রামে পড়া যায় না। প্রকৃতপক্ষে ফকীহগণ মেসরে জামে’র শর্তের আসল উদ্দেশ্যকেই গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সে উদ্দেশ্যকে আপন আপন দৃষ্টিভঙ্গীতে যতদূর সম্ভব সুস্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। তার মধ্যে তাঁরা দু’টি বিষয়ের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রেখেছেন। এক এই যে, জুমার নামায যেহেতু খুবই গুরুত্বপূর্ণ ফরয, যার জন্যে খুবই তাকীগ করা হয়েছে, সে জন্যে যত বেশী সংখ্যাক মুসলমান তা আদায় কারা জন্যে জমায়েত হয় এবং এ বিরাট ফরযটির সৌভাগ্য থেকে যথাসম্ভব কেউ বঞ্চিত না হয়। দ্বিতীয় এই যে, জুমার নামায লোক বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে যেন আদায় না করে। বরঞ্চ কোন একটি কেন্দ্রীয় স্থানে আদায় করে যেখানে মুসলমানদের বিরাট সমাবেশ হতে পারে। আল্লামা মওদূদী মেসরে জামে’র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন-
আমি শরীয়তের হুকুমগুলো যতদূর চিন্তা-ভাবনা করে দেখেছি তাতে তার উদ্দেশ্যই মনে হয় যে, জুমার নামায বিচ্ছিন্নভাবে ছোট ছোট গণ্ডির মধ্যে পৃথক পৃথকভাবে আদায় করা জুমার উদ্দেশ্যের পরিপূরক নয়। এ জন্যে শরীয়ত প্রণেতা নির্দেশ নে যে, জুমা মেসলে জামে’তে পড়তে হবে। মেসরে জামে’ শব্দটি স্বয়ং এ কথার দিকে ইংগিত করে যে, এর অর্থ এমন এক বস্তি যা ছোট ছোট জামায়াতকে একত্র করে অর্থাৎ অনেক ছোট ছোট বস্তির লোক একত্র হয়ে জুমার নামায আদায় করে। এ উদ্দেশ্যে দোকন-পাট, বাজার এবং বস্তির সংখ্যা এবং এ ধরনের অন্য কিছু মেসরের কেন্দ্রীয়তার কিছু যায় আসে না। না জুমা জামায়াতের সাথে মেসরের এ অংশগুলার কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে যে জুমার নামায সহীহ হওয়ার জন্যে বাজার এবং বহু দোকান পাটের প্রয়োজন। এর জন্যে শুধু এমন এক বস্তির প্রয়োজন যা কেন্দ্রীয় মর্যাদাসম্পন্ন। যাতে করে চার ধারের মুসলমান সেখানে জমায়েত হতে পারে। যদি কোন বড়ো শহর হয় যা তামাদ্দুনিক দিক দিয়ে কেন্ত্রীয় মর্যাদা রাখে তাহলে খুবই ভালো। নতুবা সমকালীন ইমাম যে বস্তিকে ন্যায়সংগত মনে করবে তাকেই মেসরে জামে’ বলে নির্ধারিক করবে। চারপাশের লোকজনকে সেখানে জমায়েত হওয়ার নির্দেশ দেবে। আল্লামা ইবনে হাম্মাম বলেন- (আরবী****************)
অর্তাৎ যদি ইমাম কোন স্থানকে মেসর বলে ঘোষণা করেন এবং লোকদেরকে সেখানে জুমা ‘কায়েম করার হুকুম দেন তাহলে সেখানে নামায জায়েয হবে। আর যদি কেন স্থানের বাসিন্দা জুমা কায়েমকরতে নিষেধ করেন, তাহলে সেখানে জুমা কায়েম করা উচিত হবে না। (ফতহুল কাদীর ১ম খণ্ড, পৃঃ ৪০৯)। তবে যদি ইমাম না থাকে, তাহলে যেভাবে মুসলমানদের মতামতের ভিত্তিতে জুমা কায়েম হতে পারে। এবং তাদের সিদ্ধান্ত কাযী নিযুক্ত হতে পারে। সেভাবে তাদের সিদ্ধান্তে ইমামের স্থলাভিষক্ত নিযুক্ত হয়ে যে কোন বস্তিকে ‘মেসরে জামে’ ঘোষণা করতে পারে।
অতপর তিনি একটা ন্যায়সঙ্গত এবং বাস্তব প্রস্তাব পেশ করতে গিয়ে বলেন-
এমনকি বাস্তুহারা মুসলমানদের জন্যে শরীয়তের সঠিক পন্থায় জুমার নামায আদায় করা সম্ভব হবে। সে পন্থা এই যে, পল্লী অঞ্চলকে ছোট ছোট মৌজায় বিভক্ত করতে হবে যাদের মধ্যে স্থানীয় অবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখে দুরত্ব হবে চার পাঁচ মাইল থেকে আট নয় মাইল পর্যন্ত। এসব মৌজার মধ্যে একটি কেন্দ্রীয় স্থানকে মুসলমান বাসিন্দাদের সম্মতিক্রমে মেসরে জামে’ ঘোষণা করতে হবে। তারপর পার্শ্ববর্তী পল্লীগুলোকে মেসরের অধীন ঘোষণা করতে হবে এবং ঐ সব মুসলমান বাসিন্দা সেখানে গিয়ে জুমার নামায আদায় কারবে। এ ব্যবস্থাপনা শুধুমাত্র সহীহ হাদীসগুলোর দৃষ্টিতেই দুরস্ত হবে তা নয়, বরঞ্চ হানাফী ফকীহদের বিচার বিশ্লেষণের পরিপন্থীও হবে না। ফকীহগণ মেসরের অধীন গ্রাম বা পল্লীগুলোর বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন কেউ মেসরের অধীন আবাসগুলোর দুরত্ব নয় মাইল নির্ধারণ করেছেন, কেউ দু’মাইল এবং কেউ ছ’মাইল। আবার কেউ বলেন, যে স্থান থেকে মেসরে জুমার নামায আদায় করে রাত হওয়ার পূর্বে বাড়ী ফেরা যায় তাকে মেসরের অধীন গণ্য করা হবে। ‘বাদায়ের’ গ্রন্থকার এ শেষোক্ত সংজ্ঞাই পছন্দ করেছেন। হাদীসেও তার সমর্থন পাওয়া যায়। তিরমিযীতে হযরত আবু হুরায়রাহ (রা) থেকে বর্ণিত আছে- (আরবী*************)
অর্থাৎ নবী (স) বলেন, জুমা তার উপর পরয, যে জুমার নামায পড়ে রাত হওয়র পূর্বে বাড়ীতে পৌঁছতে পারে।
অন্যত্র হযরত আবু হুরায়রাহ (রা) বলেন যে, নবী (স) বলেছেন-(আরবী***************)
অর্থাৎ নবী (স) বলেন, শুনো, তোমাদের মধ্যে কেউ ছাগলের পাল নিয়ে ঘাসের সন্ধানে এক মাইল দু’মাইল করে চলে গেল। কিন্তু যখন জুমা এলো তখন এখানে ফিরে এলো না। ( একথা তিনি তিন বার বললেন) তাহলে এমন ব্যক্তির দিলে মোহর মেরে দেয়া হবে।
এসব হাদীস এবং ফকীহদের বিশ্লেষণে জানা যায় যে, মেসরের অধীন স্থানগুলোর দুরত্ব ছ’-সাত মাইল অথাবা তার কাছাকাছি যার বাসিন্দাগণ নামায পড়ে সন্ধার আগেই বাড়ী ফিরতে পারে। এমন দুরত্বের মধ্যে যারা বাস করবে, তারা স্থায়ী পল্লীবাসী হোক অথবা বাস্তুহারা (Nomads) তাদের জন্যে মেসরে জামাতে হাযির হয়ে জুমার নামায আদায় করা ফরয। ইবনে হাম্মাম ফতহুল কাদীরে বলেন-
পল্লী গ্রামে জুমার নামায
মেসরে জামে’ এর শর্তগুলো উপেক্ষা করে প্রত্যেক ছোটো বস্তিতে এবং প্রত্যেক ছোট বড়ো পল্লীগ্রামে স্থানে স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে জুমা আদায় সহীহ নয়। ***১ বরঞ্চ মুসলমানদের উপর ওয়াজেব যে, তারা মিলিতভাবেই পরামর্শক্রমে কোন একটি কেন্দ্রীয় স্থানকে জুমার জন্যে নির্ধারিত করবে এবং আশে পাশের মুসলমান সেখানে জমায়েত হয়ে জুমার নামায আদায় করবে।
আল্লামা ইবনে হাম্মাম ফতহুল কাদীরে বলেন- (আরবী************)
যে ব্যক্তি মেসরের অধীনে যে কোন স্থানেই থাক না কেন, তার জন্যে আহলে মেসরের মতোই জুমা ওয়াজেব। মেসরে হাযির হয়ে জুমার নামায আদায় করা তার উচিত- (ফতহুল কাদীর প্রথম খণ্ড, পৃঃ ৪১১)।
এবং যারা শহরের উপকন্ঠে বাস করে তাদের উপরেও শহরবাসীর মতো জুমা ফরয। তাদেরও সেখানে গিয়ে জুমা আদায় করা অপরিহার্য (ফতহুল কাদীর, ১ম খণ্ড পৃঃ ৪১১)।
শহরের উপকণ্ঠ বলতে আশেপাশের ঐ সকল বস্তি বুঝায় যেখান থেকে জুমার নামাযে অংশগ্রহণকারী সন্ধ্যার আগে নামায শেষে বাড়ী ফিরতে পারে।
***১ আহলে হাদীসের মতে শহরে অথবা কোন বড়ো বস্তিতে হওয়া জুমার জন্যে শর্ত নয়। যেখানেই জামায়াতের জন্যে কিছু লোক জমায়েত হবে সেখানেই জুমা পড়া ফরয। তাদের দলীল এই যে, হযরত আবু হুরায়রা (রা) বাহরাইন থেকে হযরত ওমর (রা)-এর নিকটে একটি পত্রের মাধ্যমে জানতে চান যে, বাহরাইনে জুমা পড়া যাবে কিনা? আমীরুল মুমেনীন উত্তরে বলেন )(************) তোমরা যেখানেই থাক না কেন জুমা পড়- (ইবনে হুযায়মা)। আল্লামা ইবনে হাযম বলেন, গ্রামে জুমা সহীহ হওয়ার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ এই যে, নবী (স) যখন মদীনায় তশরীফ আনলেন, তখন মদীনার ছোট ছোট বস্তির আকারে আলাদা আলাদা বস্তি হিসাবে মসজিদ তৈরী করেন এবং ঐ বস্তিতে জুমার নামায পড়েন। আর এটা না কোন বড়ো গ্রাম ছিল, আর না শহর। (ইসলামী তালীম, আওনুল মা’বুদ-শরহে আবু দাউদ দ্রঃ)
নবী (স) বলেন-
জুমা তার উপর ফরয যে রাত পর্যন্ত তার সন্তান-সন্ততির কাছে পৌঁছতে পারে- (তিরমীযী)।
হযরত আয়েশা (রা) বলেন-
লোক তাদের বাসস্থান এবং মদীনার উপকণ্ঠ থেকে জুমার নামাযের জন্যে আসতো। তাদের শরীর ধূলা বালিতে ভরে যেতো এবং গা দিয়ে ঘাম ছুটতো। একবার নবী (স) আমার নিকটে ছিলেন এবং তাদের মধ্যে একজন নবীর খেদমতে হাযির হলো। তিনি বললেন, তোমরা আজকার দিনে গোসল করে আসলে কত ভালো হতো- (বুখারী)।
২. যোহরের ওয়াক্ত
যোহরের ওয়াক্তের পূর্বে এবং পরে জুমার নামায আদায় জায়েয নয়। জুমান নামায পড়াকালে যদি যোহরের ওয়াক্ত চলে যেতে থাকে, তাহলে নামায নষ্ট হয়ে যাবে-যদিও শেষ বৈঠকে আত্তাহিয়্যাত পড়ার পরিমাণ সময়ও বসা হয়ে থাকে। এ জন্যে যে, জুমার নামাযের কাযা নেই।
৩. খুতবা
জুময়ার নামাযের আগে ওয়াক্তের মধ্যেই খুতবা পড়াও জরুরী। ওয়াক্তের পূর্বে খুতবা পড়া হলে নামায হবে না। এমনিভাবে নামযের পর খুতবা হলেও নামায হবে না।
৪. জামায়াত
খুতবা শুরু হওয়া থেকে নামাযের শেষ পর্যন্ত ইমাম ব্যতীত আরও অন্তত তিন জন এমন হতে হবে-যারা ইমামতি করতে পারে। যদি নারী অথবা নামালেগ ছেলে হয় তাহলে নামায হবে না।
৫. ইযনে আম (সর্ব সাধারণের অবারিত দ্বার)
অর্থাৎ এমন সাধারণ স্থানে ঘোষণা করে নামায পড়া যায় যেখানে প্রত্যেকের অসার এবং নামায পড়ার অবাধ অনুমতি থাকবে এবং কারো জন্যেই কোন প্রকারের বাধা নিষেধ থাকবে না। যদি এমন স্থানে জুমার নামায পড়া হয় সেখানে সাধার মানুষের জন্যে প্রবেশ নিষেধ অর্থাৎ দরজা বন্ধ করে নামায পড়া হয়, তাহলে জুমার নামায দুরস্ত হবে না। যেমন কোন জমিাদর অথবা উচ্চপদস্ত ব্যক্তির কুঠী বা বাংলোতে জুমার নামাযের ব্যবস্থা করে যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ, সেখানে জুমা জায়েয হবে না।
জুমার নামাযের জন্যে মুসলমান শাসকের শর্ত
ফেকাহর কেতাবগুলোতে জুমার জন্যে শাসকের শর্ত আরোপ করা হয়েছে। ***১ অর্থাৎ মুসলমান শাসক নিজে অথবা তাঁর প্রতিনিধি জুমা কায়েম করবেন। এ শর্তের উদ্দেশ্য এই যে, মুসলমান শাসকদের অপরিহার্য দায়িত্বের মধ্যে অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে এই যে, তিনি জুমার নামায প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করবেন এবং এ বিরাট সম্মেলনের দেখা শুনার ব্যবস্থা করবেন যাতে করে শান্তি-শৃংখলা বজায় থাকে এবং কোন প্রকার বিশৃংখলা না হয়। এখন যেখানে অমুসলিম শাসক রয়েছে, সেখানে এ শর্ত পাওয়া না যাওয়ার কারণে মুসলমানদের থেকে জুমা রহিত হয়ে যায় না। বরঞ্চ তাদের কর্তব্য হয়ে পড়ে পরস্পর মিলে মিসে জুমার নামায পড়া। ফকীহগণ এ শর্তটি গুরুত্ব এভাবে উপলব্ধি করেছেন। তারপর সুস্পষ্ট ফতোয়া দিয়েছেন যে, যেখানে অমুসলমান শাসিক থাকবে সেখানে মুসলমানদের নিজেদেরই পক্ষ থেকে জুমার নামাযের ব্যবস্থা করবে। ফেকার বিখ্যাত কেতাব শামীতে আছে-
(আরবী****************)
যেসব দেশে কাফের শাসক হসে সেখানে মুসলমানদের নিজেদের পক্ষ থেকে জুমা এবং দু’ঈদের নামাযের ব্যবস্থা করা দুরস্ত হবে। সেখানে মুসলমানদের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে যাকে কাযী বানানো হবে তিনি কাযী হবেন এবং তার জন্যে ওয়াজেব হবে মুসলিম শাসকের দাবী এবং তার জন্যে সংগ্রাম করা।
***১ হোদয়াতে আছে- (আরবী****************)
অর্থাৎ জুমার প্রতিষ্ঠা কোন শাসনে বা শাসকের প্রতিনিধি ব্যতীত জায়েয নয়।]
মাওলানা আবদুল হাই ফিরিংগী মহল্লী তো এতোখানি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, যেসব দেশে অমুসলমান শাসক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় সেখানকার মুসলমানদের উপরেও জুমা ওয়াজেব। মোগল শাসনের পর যখন ভারতে ইংরেজ শাসন কায়েম হয়, তখন এ প্রশ্ন ওঠে যে, এখানে জুমা জায়েজ কিনা। কিছু স্থবীর ধরনের লোক মনে করলেন যে, যেহেতু জুমার জন্যে মুসিলম শাসন হওয়া শর্ত সে জন্যে ভারতে জুমার নামায না পড়াই উচিত। কিন্তু মাওলানা আবদুল হাই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন যে, মুসলিম শাসক না থাকলেও মুসলমানদের উপর জুমা ফরয।
(আরবী******************)
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ভারতে যেখানে খৃস্টানদের প্রাধ্যান্য স্থাপিত হয়েছে এবং তারা কাফের শাসক নিযুক্ত করেছে, জুমা ওয়াজেব এবং মুসলমানদের পারস্পরিক ঐক্যমেতের ভিত্তিতে তা আদায় করা দুরস্ত হবে, যে কেউ জুমা রহিত হওয়ার ফতোয়া দেবে সে নিজেও গোমরাহ এবং অপরকেও গোমরাহ করবে-(তাফহীমাত, ২য় খন্ড, পৃঃ ৪১০, আল্লামা মওদূদী (র)।
জুমার সুন্নাতসমূহ
জুমার সুন্নাত আট রাকয়াত এবং সব সুন্নাতে মুয়াক্তাদাহ। ফরযের পূর্বে এক সালামে চার রাকয়াত এবং ফরযের পর এক সালামে চার রাকায়াত। এ হচ্ছে ইমাম আবু হানীফা (র)-এর মত।
সাহেবাইন (র) (ইমাম সাহেবের দু’শাগরেদ) বলেন, জুমার দশ সুন্নাত। ফরযের পূর্বে চার রাকয়াত এবং পরে ছ’রাকয়াত। চার রাকয়াত এক সালামে, পরে দু’রাকয়াত এক সালামে।
জুযমার আহকাম ও আদব
১. জুমার দিন পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা করা, চুল এবং নখ কাটা, সাধ্যমত ভালো পোশাক পরিধান করা, খুশবু লাগানো এবং প্রথমে জামে মসজিদে গিয়ে হাযির হওয়া সুন্নাত।
নবী (স) বলেন-
যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করবে, ভালো কাপড় পরবে, সুযোগ হলে খুশবু লাগাবে, জুমার নামাযে আসবে, লোকের ঘাড়ের উপরে দিয়ে যিঙিয়ে যাবে না, অতপর নামায পড়বে যা আল্লাহ ভাগ্যে লিখে রেখেছেন, ইমাম আসার পর থেকে নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত চুপ চাপ থাকবে, তাহলে আগের জুমা থেকে এ জুমা পর্যন্ত তার সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে-(ইলমুল ফেকাহ, ২য় খণ্ড)।
২. ব্যবস্থা সত্ত্বেও ভুলে অথবা কোন কারণে জুমা পড়তে না পারলে যোহরের চার রাকয়াত ফরয পড়তে হবে এবং কিছু সদকা খয়রাত করে দেয়া উচিত। এমনি কোন রোগীর সেবা শুশ্রুষার কারণে, অথবা ঝড় তুফান অথবা শত্রুর ভয়ে জুমার নামায পড়তে না পারলে যোহর আদায় করতে হবে।
৩. যে খুতবা দেয় তারই নামায পড়ানো ভালো। কিন্তু কোন কারণে অন্য কেউ নামায পড়িয়ে দিলেও দুরস্ত হবে- (দুররে মুখতার)।
তবে জুমার নামায সেই পড়াবে যে খুতবা শুনেছে। এমন ব্যক্তি যদি নামায পড়ায় যে খুতবা শুনেনি তাহলে নামায হবে না।
৪. বস্তির সকল লোকের একই জামে’ মসজিদে একত্র হয়ে জুমার নামায আদায় করা ভালো। তবে শহরে কয়েক মসজিদে নামায পড়াও জায়েয- (বাহরুর রায়েক)।
৫. শহরে অথবা এমন বস্তিতে যেখানে জুমার নামায হয়, সেখানে জুমার নামায আগে যোহর নামায পড়া হারাম (ইলমুল ফিকাহ)।
৬. রোগী এবং অক্ষম ব্যক্তিগণ-যাদের উপর জুমা ওয়াজেব নয়, জুমার দিন যোহর নামায পৃথক ভাবে পড়বে। এ ধরনের লোকের জুমার দিন যোহর নামায জামায়াতে পড়া মাকরুহ তাহরীমি-(দুররে মুখতার)।
৭. খুতরবার তুলনায় জুমার নামায দীর্ঘ হওয়া উচিত।
জুমার নামায লম্বা এবং খুতবা সংক্ষিপ্ত হওয়া এ কথারই নিদর্শন যে, খতীব দ্বীনের গভীর জ্ঞান এবং দূরদর্শিতা রাখেন- (মুসলিম)।
৮. যদি কোন মসবুক শেষ বৈঠকে এসে জামায়াতে শামিল হয়ে যায় অথবা সহু সিজদার পর তাশাহহুদে এসে শরীক হয়, তবুও তার জুমার নামায দুরস্ত হবে। ইমাম সালাম ফেরার পর দাঁড়িয়ে দু’রাকয়াত আদায় করবে।
৯. জুমার আয়োজন বৃহস্পতিবার থেকেই শুরু করা উচিত। নবী (স) বৃহস্পতিবার থেকেই আয়োজন শুরু করে দিতেন-(মিশকাত)।
১০. জুমার দিন, যিকির, তাসবীহ, তেলাওয়াতে কুরআন, দোয়া, এস্তেগফার, দান-খায়রাত, রোগীর সেবা, জানাযায় শরীক হওয়া, কবরস্থান যিয়ারত এবং অন্যান্য নেক কাজ করার বেশী আয়োজন করা উচিত। হযরত আবু সাইদ খুদরী (রা) বলেন যে, নবী (স) বলেছেন- পাঁচটি নেক আমল এমন যে, কেউ যদি একদিনে তা করে তাহলে আল্লঅহ তাকে বেহেশতবাসী করবেন-
১-রোগীর সেবা-শুশ্রুষা করা
২- জানাযায় শরীক হওয়া
৩-রোযা রাখা
৪-জুমার নামায পড়া
৫-গোলাম আযাদ করা
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা)-এর আর একটি বর্ণনা আছে যে, নবী (স) বলেন-
যে ব্যক্তি জুমার দিনে সূরা কাহাফ তেলাওয়াত করবে, তার জন্যে আগামী জুমা পর্যন্ত একটি নূর উজ্জ্বল হয়ে থাকবে- (নাসায়ী)।
হযরত আবু হুরায়রাহ (রা) বলেন যে, নবী (স) বলেছেন- যে ব্যক্তি জুমার রাতে সুরায়ে দোখান’ তেলাওয়াত করবে তার জন্যে ৭০ হাজার ফেরেশতা এস্তেগফার করে এবং তার গুনাহ মাফ করে দেয়া হয় (তিরমিযী)।
উপরন্তু নবী (স) বলেন-
জুার দিনে একটি সময় এমন আছে যে, বান্দাহ তখন যে দোয়াই করে তা কবুল হয়- (বুখারী)।
এ সময়টি কখন সে বিষয়ে আলেমদের কয়েক প্রকার উক্তি আছে, যার মধ্যে দু’টি অধিকতর সহীহ বলে স্বীকার করা হয়েছে। একটি হচ্ছে যখন ইমাম খুতবার জন্যে মিম্বরে আসবেন তখন থেকে নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত। দ্বিতীয় জুমার দিনের শেষ মুহূর্তগুলো যখন সূর্য ডুবতে থাকে। এ দু’সয়ে দোয়অর ব্যবস্থা করা সমীচীন।
১১. জুমা নামাযের অনেক আগে মসজিদে যাওয়া মুস্তাহাব। নবী (স) বলেন-
যেমন করে পাক হওয়ার জন্যে লোক গোসল করে তেমনিভাবে কেউ যদি জুমার দিন ভালোভাবে গোসলের ব্যবস্থা করলো এবং প্রথম ওয়াক্তে মসজিদে পৌঁছলো, সে যেন একটি উট কুরবানী করলো। তারপর যে পৌঁছলো সে যেন একটি উট কুরবানী করলো, তারপর যে পৌঁছলো সে যেন একটি শিং ওয়ালা মেষ কুরবানী করলো, তারপর যখন খতীব খুতবার জন্যে বেরিয়ে আসে, তখন ফেরেশতাগণ দরজা ছেড়ে দেন এবং হাজিরা বই বন্ধ করে খুতবা শুনার জন্যে এবং নামায পড়ার জন্যে মসজিদের ভেতরে বসে পড়েন- (বুখারী, মুসলিম)।
১২. জুমার দিনে ফজরের নামাযে সূরা (****) এবং সূরা (****) পড়া সুন্নাত।
১৩. জুমার নামাযে সূরা (***) এবং সূরা (****) অথবা সূরা (***) এবং সূরা (***) পড়া সুন্নাত।
১৪. মসজিদে যেখানে স্থান পাওয়া যায় সেখানেই বসা উচিত, কারো মাথা ও ঘাড় ডিঙিয়ে যাওয়া মাকরুহ। এতে লোকের কষ্ট হয়, শরীরে এবং মনেও। তাদের একাগ্রতাও নষ্ট হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন যে, নবী (স) বলেছেন- যে ব্যক্তি প্রথম কাতার ছেড়ে দ্বিতীয় কাতারে এ জন্যে দাঁড়ায় যে তার মুসলমান ভাইদের কোন কষ্ট না হয় তাহলে আল্লাহ তাকে প্রথম কাতারের লোকের দ্বিগুণ সওয়াব দেবেন- (তাবারানী)।
১৫. জুমার দিনে বেশী বেশী নবী (স)-এর উপর দরুদ পড়া মুস্তাহাব। নবী (স) বলেন-
তোমাদের দিনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম দিন জুমার দিনে আদম (আ) পয়দা হন এবং এই দিনেই তার ইন্তেকাল হয়। এ দিনে কেয়ামত হবে। এ জন্যে এদিনে তোমরা বেশী বেশী করে আার উপর দরুদ পাঠাও। কারণ তোমাদের দরূদ ও সালাম আমার কাছে পেশ হয়। সাহাবীগণ বলেন, ইয়অ রাসূলাল্লাহ! আপনার দেহ তো পচে গলে বিলীন হয়ে যাবে। নবী (স) বলেন, আল্লাহ নবীদের দেহ ভক্ষণ করা মাটির জন্যে হারাম করে দিয়েছেন –(আবু দাউদ)।
খুতবার আহকাম ও আদব
১. খতীব দু’টি খুতবা দেবেন। প্রথম কুতবায় শ্রোতাদেরকে দ্বীনের নির্দেশ এবং তার উপর আমল করা শিখাবেন [ কুতবার এ বুনিয়াদী উদ্দেশ্য তখনই পূরণ হতে পারে যখন খতবি শ্রোতাদেরকে তাদের নিজস্ব ভাষায় সম্বোধন করবেন যাতে করে শ্রোতাগণ বুঝতে পারেন। কিন্তু আরবী ভাষিা ব্যতীত অন্যবাষায় খুতবা দেয়ার ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে।
আসল কথা এই যে, প্রথম খুতবা প্রকৃতপক্ষে ওয়াজ-উপদেশ, দ্বীনের মর্মকথা। মানুষকে বুঝানো প্রভৃতি বিষয়ে দেয়া হয় এবং আরবী ভাষা ব্যতীত অন্যান্য ভাষায়ও দেয়া যায়। অবশ্য দ্বিতীয খুতবা আরবীতেই হওয়া উচিত। আর যেখানে মুসলমানদের কোন আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয় সেখানে দুটি কুতবাই আরবীতে হওয়া উচিত। আল্লামা মওদূদী (র) এ বিষয়ে তাঁর মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন-
এই হওয়া উচিত যে, খুতবার এক অংশ (দ্বিতীয় অংশ) অবশ্য আরবী ভাষায় হবে। এ অংশ আল্লাহ তায়ালার হামদ ও সানা, আল্লাহর রসূল (স) তাঁর আসহাব, আল-আওলাদ প্রবৃতির উপর সালাত ও সালাম এবং কুরআনের আয়াত তেলাওয়াতের জন্যে নির্দিষ্ট থাকবে। তারপর দ্বিতীয় অংশে (প্রথম খুতবা) ওয়াজ নসীহত এবং যুগের চাহিদা অনুযায়ী ইসলামী শিক্ষা এসব কথা এমন ভাষায় হওয়া উচিত যা সকল শ্রোতা অথবা তাদের অধিকাংশ বুঝতে পারেন। এ উদ্দেশ্যে বেশীর ভাগ এমন ভাষা ব্যবহার করা উচিত যা মুসলমানদের নিকটে আন্তর্জাতিক বা আনাত প্রাদেশিক মর্যাদা রাখে। যেমন ভারতে (বৃটিশ ভারত) প্রাদেশিক ভাষা অথবা স্থানীয় কথ্যভাষায় পরিবর্তে উর্দু খুতবা হওয়া উচিত। কারণ উর্দু প্রায় প্রত্যেক প্রদেশের লোক বুঝতে পারে, অবশ্যি দূর দূরান্তের স্থানগুলোতে যেখানে লোক উর্দু বুঝতে পারে না স্থানীয় ভাষায় খুতবা দেয়া যেতে পারে। কিন্তু যেখানে মুসলমানদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন হবে সেখানে আরবী ছাড়া অন্য কোন বাষায় কুতবা দেওয়া উচিত নয়- (তাফহীমাত, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৩৪২)।] এবং দ্বিতীয় খুতবায় কুরআনের কিছু আয়াত পড়বেন, নবীর উপর দরুদ পড়বেন এবং আসহাবে রসূল (স) এবং সাধারণ মুসলমানদের জন্যে দোয়া করবেন।
২. খতীবের দায়িত্ হচ্ছে প্র্রত্যেক জুমার জন্যে সময় ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে উপযোগী ভাষণ তৈরী করা এবং দেশ ও মিল্লাতের অবস্থা, মুসলিম জাতি যেসব সমস্যার সম্মুখীন সে সব সম্পর্কে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে উপদেশ দেয়া। দ্বীনের দৃষ্টিতে সকল সমস্যা সমাধানের প্রেরণা দান এবং তদনুযায়ী উপায় অবলম্বন করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করা। মুসলমানদেরকে তাদের দ্বীনি দায়িত্ব ও কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং তাদের মধ্যে দ্বীন ও মিল্লাতের জন্যে দরদ সৃষ্টি করা কেতাব দেখে কোন তৈরী খুতবা পড়ে শুনানো যেমন জায়েয, তেমনি তাবারুক স্বরূপ স্বয়ং নবী (স)-এর কোন নির্ভরযোগ্য খুতবা পড়ে শুনানোও জায়েয। কিন্তু জুমার খুতবার আসল উদ্দেশ্য হলো। যিনি মুসলমানদের দায়িত্বশীল তিনি স্বাভাবিক পদ্ধতিতে প্রতি সপ্তাহে ধারাবাহিকতা ও শৃঙ্খলার সাথে মুসলমানদেরকে দ্বীনের নির্দেশাবলী শুনিয়ে দেবেন, তাদের দায়িত্ব সুস্পষ্ট করে তুলে ধরবেন এবং উদ্ভূত সমস্যাবলী সম্পর্কে কেতাব ও সুন্নাতের আলোকে দিক নির্দেশনা করবেন। এ জন্যে উৎকৃষ্ট পন্থা এই যে, খুতবার উদ্দেশ্য পূরণের জন্যে খতীব প্রয়োজনবোধে শরীয়তের মাসয়ালা বয়ান করবেন এবং হেদায়াত দান করবেন। শুধু বই পড়ে শুনানো যথেষ্ট হবে না। [আহলে হাদীস আলেমগণও আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষায় খুতবা দেয়া জায়েয বরঞ্চ উত্তম মনে করেন। মাওলানা আবদুস সালাম বাস্তবী বলেন-
খুতবার অর্থ হলো উপস্থিত লোকদেরকে সম্বোধন করে ওয়াজ নসীহত করা। নসীহত তখনই কাজে লাগে, যখন তা করা হয় শ্রোতাদের ভাষায়। অতএব শ্রোতাদের ভাষায় খুতবা দেয়া উচিত। শ্রোতা যদি আরবী বাষাভাষী হয় তাহলে আরবী ভাষায় খুতবা এবং অন্যভাষী হলে সে ভাষায় খুতবা দেয়া উচিত। শুধু আরবী ভাষার খুতবা দেয়া ফরয নয়। বরং আরবী মূল বচন পড়ে পড়ে তার অনুবাদ করে শ্রোতাদেরকে বুঝিয়ে দেয়া উচিত –(ইসলামী তালীম, চতুর্থ খণ্ড, পৃঃ ১৩০)।
১. খুতবার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আল্লামা মওদূদী (র) বলেন-
আসলে খুতবার ব্যবস্থা এ জন্যে করা হয়নি যে, লোক সপ্তাহে একদিন গতানুগতিকভাবে এমন এক জিসি শুনবে যেমন খৃষ্টান গির্জাগুলোতে Serman বা সদুপদেশ শুনানো হয়ে থাকে। বরঞ্চ এ খুতবাকে মুসলমানদের সামষ্টিক জীবনের একটা সক্রিয় অংশ বানিয়ে দেয়া হয়েছে। তার উদ্দেশ্য ছিল এই যে, সপ্তাহে একবার অনিবার্যভাবে সকল মুসলমানকে একত্র করে আল্লাহর নির্দেশবালী শুনিয়ে দিতে হবে, দ্বীনের শিক্ষা তাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল করে দিতে হবে। ব্যক্তি বা জামায়াতের মধ্যে কিছু অনাচার দেখা দিলে তা সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে, সমাজ কল্যাণমূলক কাজে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। উপরন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান () সরাসরি সরকারের পলিসি জনসাধারণের সামনে পেশ করবেন এবং প্রত্যেকের প্রশান করার অথবা নিজের বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দিতে হবে। -(তাফহীমাত, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৩৫)।]
৩. খতীব প্রথম খুতবা দেয়ার পর মিম্বরে এতটুকু সময় পরিমাণ বসবেন। যে সময়ে ছোট তিনটি আয়াত তেলাওয়াত করা যায় অথবা তিনবার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলা যেতে পারে। তারপর দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় খুতবা দিবেন। প্রথম খুতবায় প্রাণস্পর্শী ভাষায় উৎসাহ উদ্দীপনা সহকারে জাতিকে দ্বীনের হুকুম আহকাম জানিয়ে দেবেন। খুতবায় উৎসাহ উদ্দীপনা ও ভাবাবেগ সৃষ্টিকারী ভাষণ দেয়া মুস্তাহাব।
দ্বিতীয় খুতবায় কুরআনের কিছু আয়া, দরূদ, সালাম এবং আসহাবে রসূল (স) ও সাধারণে মুসলমানের জন্যে দোয়া করতে হবে।
৪. নামাযের তুলনায় খুতবা সংক্ষিপ্ত হওয়ার দরকার। নামায থেকে খুতবা দীর্ঘ করা মাকরুহ। নবী (স) বলেন- নামায দীর্ঘ করা এবং খুতবা সংক্ষিপ্ত করা খতীবের বিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার পরিচায়ক। অতএব তোমরা নামায দীর্ঘ কর এবং খুতবা সংক্ষিপ্ত কর। -(মুসলিম)।
৫. খুতবার সময় চুপচাপ বসে মনোযোগ দিয়ে খুতবা শুনা ওয়াজেব- শ্রোতা খতীবের নিকটে থাক অথবা দূরে।
৬. খুতবার সময়ে খতীবের নিকটে বসা এবং তার দিকে মুখ করা মুস্তাহাব। হাদীসে আছে খুতবায় হাযির থাক এবং ইমামের নিকটে থাক-(মিশকাত)।
৭. খতীব খুতবার জন্যে দাঁড়ালে নামায পড়া এবং কথাবার্তা বলা ঠিক নয় খুতবার সময় নামায পড়া, কথা বলা, যিকির ও তাসবীহতে মশগুল হওয়া, খানাপিনা করা, সালাম করা, সালামর জবাব দেয়া। এমন কোন কাজ করা যা খুতবা শুনতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে, মাকরুহ তাহরীমি। খুতবার সময়ে কাউকে শরীয়তের হুকুম শিখানো, নেক কাজের উপদেশ দেয়াও নিষিদ্ধ। নবী (স) বলেন-
যখন ইমাম খুতবা দেয় তখন যে কথা বলে তার দৃষ্টান্ত, যে কেতাবের বোঝা বহন করে তার মতো এবং যে ব্যক্তি খুতবার সময় অপরকে বলে, ‘চুপ কর,’ তার জুমা হলো না-(মুসনাদে আহমদ, তাবারানী)।
অবশ্য খুতবার সময় কাযা নামায পড়া শুধু জায়েয নয় বরঞ্চ ওয়াজেব।
৮. খুতবার সময় নবীর নাম উচ্চারিত হলে মনে মনে দরূদ পড়া জায়েয।
৯. দ্বিতীয খুযতবায় নবীর আওলাদ, আসহাব বিশেষ করে খুলাফায়ে রাশেদীন, হযরত হামযা (রা) এবং হযরত আব্বাস (রা)-এর জন্যে দোয়া করা মুস্তাহাব। ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলের জন্যে দোয়া করাও জায়েয। তবে অসংগত এবং অতিরঞ্জিত প্রশংসা করা মাকরুহ তাহরীমি- (ইলমুল ফেকাহ দ্বিতীয খণ্ড পৃঃ ১৪৮ বরাত দুররে মুখতার)।
১০. রমযানের শেষ জুমার (জুময়াতুল বেদা) খুতবায় বিদায় ও বিরহের বিষয় বলা বা পড়া যদিও নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু নবী (স) সাহাবায়ে কেরাম থেকে এমন কিছু বর্ণিত নেই। ফেকাহার কোন প্রমাণ্য কেতাবেও এ সম্পর্কে কোন উল্লেখ নেই। অতএব স্থায়ীভঅবে এ ধরনের প্রবন্ধ পাঠ করা ঠিক নয়। এভাবে যে জিনিসটি শুধু মোবাহ পর্যায়ের তাকে মানুষ ধুমধামের সাথে পড়া হয়ে থাকে এবং যারা বিদায়ী খুতবা পড়ে না, তাদেরকে ভালো মনে করা হয় না এবং সাধারণ মানুষ জুমাতুল বেদাকে একটা শরয়ী মর্যাদা দিয়ে বসে আছে। এ জন্যে এর থেকে দূরে থাকা ভালো-(ইলমুল ফেকাহ, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৪৮)।
১১. খুতবা শেষ হওয়ার সাথে সাথে একমাত দিয়ে নামায শুরু করা উচিত। খুতবা এবং নামাযের মাঝখানে কোন দুনিয়াবী কাজে লিপ্ত হওয়া মাকরুহ তাহরীমি। আর যদি এ বিরতি দীর্ঘ হয়, যেমন খতীব খানা খেতে বসে গেলেন, অথবা কারো কারবারের বিষয় মীমাংসা করতে বসলেন, তাহলে দ্বিতীয়বার খুতবা পড়তে হবে। তবে যদি কোন দ্বীনি প্রয়োজন হয়, যেমন কাউকে শরীয়তের হুকুম বলতে হলো অথবা অযুর প্রয়োজন হলো, অথবা খুতবার পর মনে হলো যে, গোসলের প্রয়োজন ছিল [প্রকাশ থাকে যে, খুতবার জন্যে তাহারাত শর্ত নয়। এমন কি কেউ যদি ভুলে জানাবাতের অবস্থায় খুতবা দিয়ে ফেলে তাহলে পুনরায় দেয়ার প্রয়োজন নেই।
(আরবী****************)
খতীব যদি বসে অথবা পাক না থাকা অবস্থায় খুতবা দেন তাহলে তা জায়েয হবে- (হেদায়া)।] তাহলে এ বিরতিতে কোন দোষ নেই। দ্বিতীয়বার খুতবা পড়ার প্রয়োজন হবে না।
নামায এবং খুতবায় মাইকের ব্যবহার
খুতবার সময়ে প্রয়োজনে মাইক ব্যবহার জায়েয।
নামাযেও প্রয়োজন হলে মাইক ব্যবহার করতে দোষ নেই। ****১
জুমার আযানের পরে বেচা-কেনা নিষিদ্ধ
জুমার আযান শুনার সাথে সাথে সব কারবার বেচা-কেনা খত করে খুতবা মুনার জন্যে এবং নামাযের জন্যে সেজেগুজে রওয়ানা হওয়া উচিত। এ জন্যে যে, জুমার আযানের পর বেচা কেনা হারাম হয়ে যায়। কুরআনে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে-
(আরবী****************)
হে মুমেনগণ! জুমার দিন যখন নামাযের জন্যে আযান দেয়া হবে তখন আল্লাহর যিকিরের জন্যে দ্রুত অগ্রসর হও এবং কেনা-বেচা বন্ধ করে দাও। (আল-জুমুয়াহ: ৯)
তাফসীরকারগণ এ ব্যাপারে একম যে, (****) এর অর্থ খুতবা অথবা খুতবা এবং নামায উভয়ই। এবং (****) বলতে যে আযান বুঝায় তা হলো সেই আযান যা খুতবার আগে দেয়া হয়। অনেক পূর্বে যে আযান দেয়া হয় তা নয়। হযরত সায়েব বিন ইয়াযীদ (রা) বলেন যে, নবী (স)-এর যমানায় শুধু একই আযান দেয়া হতো এবং তা দেয়া হতো যখন খতীব মিম্বরে গিয়ে
****১ মুফতী মুহাম্মদ শফী সাহেব এ ব্যাপারে তাঁর মতামত ব্যক্ত করে বলেন- ফকীহগণের বর্ণিত বিশ্লেষণ এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা)-এর কেবলা পরিবর্তনের আমল থেকে সুস্পষ্ট যুক্তি পাওয়া যায় যে, এতে নামায নষ্ট হওয়ার হুকুম দেয়া যায় না- (আধুনিক যন্ত্রাদি সম্পর্কে শরীয়তের হুকুম, পৃ:৮৯)।
আল্লামা মওদূদী (র) মাইকে নামায শুধু জায়েযই নয় বরং তা উত্তম হওয়া সম্পর্কে দলীল দিতে গিয়ে বলেন- এসব যুক্তি প্রমাণের ভিত্তিতেই আমি নামাযে মাইক ব্যবহার মুধু জায়েযই য় বরং উত্তম মনে করি। আমার মন সাক্ষ্য দেয় যে, যদি নবী (স)-এর যমানায় এসব যন্ত্র থাকতো তাহলে তিনি অবশ্যই নামায, আযান এবং খুতবায় তা ব্যবহার করতেন। মেযন তিনি খন্দকের যুদ্ধে ইরানী পদ্ধতিতে খন্দক খনন করাকে বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করেছিলেন-(তাফহীমাত, ২য় খন্ড, পৃঃ ৩৮০)।]
বসতেন, তারপর হযরত আবু বকর (রা) এবং হযরত ওমরের সময় যখন লোকসংখ্যা বেশ বেড়ে গিয়েছিল, তখন তাঁরা অতিরিক্তি আর একটা আযান চালু করেন। সে আযান মদীনার বাজারে তাঁদের বাসগৃহ ‘যাওয়া’ থেকে দেয়া হতো(বুখারী, আবু দাউদ, নাসায়ী)।
আল্লামা শাব্বীর আহমদ ওসমানী তাঁর তাফসীরে বলেন, (***) বলতে সেই আযান বুঝায় যা ইমামের সামনে দেয়া হয়। তার আগের আযান হযরত ওসমান (রা)-এর যমানায় সাহাবায়ে কেরাম (রা)-এর ঐক্যমত্যে দেয়ার রীতি চালু হয়।
খুতবায় মসনূন পদ্ধতি
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সহকারে খতীব শ্রোতাদের দিকে মুখ করে বসবেন এবং মুয়াযযিন খতীবের সামনে আযান দিবেন।
আযান শেষ হওয়ার সাথে সাথে খতীব মেম্বরে উঠবেন এবং মনে মনে আউযুবিল্লাহ মিনাশ শায়তানির রাজীম পড়ে খুতবা করবেন।
প্রথমে আল্লাহর হামদ ও সানা, তারপর তাওহীদ ও রেসোলাতের সাক্ষ্য দেবেন। তারপর উৎসাহ উদ্দীপনা ও গুরুত্ব সহকারে সংক্ষিপ্ত অথচ সার্বিক ভাষণ দেবেন। তারপর কিছুক্ষণের জন্যে বসে পড়বেন তিনবার সুবহানাল্লাহ পড়ার সময় পর্যন্ত।
তারপর দ্বিতীয় বার উঠে দ্বিতীয় খুতবা দেবেন। এ খুতবাতেও হামদ-সানা এবং শাহাদাতের পুনরাবৃত্তি করবেন। কুরআন পাকের কিছু আয়াত পড়বেন নবীর (স) উপর দরুদ ও সালাম পড়বেন। সাহাবায়ে কেরাম, খোলাফায়ে রাশেদীন এবং বিশেষ করে হযরত হামযা (রা) এবং হযরত আব্বাস ()রা)-এর জন্যে দোয়া করবেন। তারপর সাধারণ মুসলমানদের জন্যে দোয়া করে খুতবা শেষ করবেন। খুতবা শেষ করার পর পরই নামাযের জন্যে সকলে দাঁড়াবেন।