দ্বিতীয় পর্যায়ঃ প্রকাশ্য তাবলীগ
দাওয়াতের প্রথম নির্দেশ
এ সম্পর্কে সর্বপ্রথম আল্লাহ পাক এ নির্দেশ নাযিল করেছিলেন যে, হে নবী তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দের আল্লাহর আযাব সম্পর্কে ভয় প্রদান করো। এটি হচ্ছে সুরা শোয়াবার একটি আয়াত। এ সূরায় সর্ব প্রথম হযরত মুসা আলাইহিস সালামের ঘটনা ব্যক্ত করা হয়। অর্থাৎ বলা হয়, কিভাবে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম নবুয়ত পেয়েছিলেন এবং বনি ইসরাইলসহ হিজরত করে ফেরাউন এবং ফেরাউনের জাতি এবং তার সঙ্গী সাথীদের নীল নদে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল। অন্য কথায় এ সূরায় হযরত মুসা আলাইহিস সালাম, ফেরাউন এবং বনি ইসরাইলীদের নিকট যেভাবে দাওয়াত দিয়েছিলেন সেই দাওয়াতের বিভিন্ন পর্যায় তুলে ধরা হয়েছে।
আমার ধারণা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর কওমের মধ্যে প্রকাশ্য তাবলীগের নির্দেশ বলে দেয়ার পর হযরত মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘটনা এ কারণেই বলা হয়েছে যাতে একটা উদাহরণ তার সামনে থাকে। প্রকাশ্যে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার পর হযরত মুসা আলাইহিস সালামকে যেভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছিল এবং যে ধরনের বাড়াবাড়ি তাঁর সাথে করা হয়েছিল রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামের সামনে যেন তার একটা নমুনা সব সময় বিদ্যমান থাকে। অন্যদিকে এ সূরায় যেসব সম্প্রদায় নবীদের মিথ্যাবাদী বলেছিল, যেমন ফেরাউন ও তার সম্প্রদায়, নূহের সম্প্রদায়, আদ, সামুদ, ইবরাহীমের সম্প্রদায়, লুতের সম্প্রদায়, আইকার অধিবাসীসহ এদের সবার পরিণাম কিরূপ হয়েছিল সে সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। সম্ভবত এর উদ্দেশ্য ছিল এই যে যেসব লোক আল্লাহর রসূলকে মিথ্যাবাদী বলবে তারা যেন বুঝতে পারে যে, এ ধরনের আচরণের ওপর অবিচল থাকলে তাদের পরিণাম কিরূপ হবে। তারা আল্লাহর কিরূপ পাকড়াও এর সম্মুখীন হবে। এছাড়া ইমানদাররাও বুঝতে পারবে যে, উত্তম পরিণাম তাদেরই জন্য রয়েছে। পক্ষান্তরে যারা নবীকে মিথ্যাবাদী বলে তাদের পরিণাম ভালো হবে না।
নিকটাত্মীয়দের মধ্যে তাবলীগ
এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে বনু হাশেমদের সমবেত করলেন। তাদের সাথে বনু মোত্তালেব ইবনে আবদে মান্নাফের একটি দলও ছিল। তারা ছিল মোট পঁয়তাল্লিশ জন। আবু লাহাব কথা লুফে নিয়ে বলল, দেখো এরা তোমার চাচা এবং চাচাতো ভাই। কথা বলো তবে মূর্খতার পরিচয় দিয়োনা এবং মনে রেখো তোমার খান্দান সমগ্র আরবের সাথে মোকাবিলা করতে পারবে না। আমই তোমাকে পাকড়াও করার বেশী হকদার। তোমার জন্য তোমার পিতৃকুলের লোকেরাই যথেষ্ট। যদি তুমি তোমার কথার ওপর অটল থাকো তাহলে কোরাইশদের সমগ্র গোত্র ও তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। এরপর কি হবে ? তোমার পিতৃকুলের মধ্যে তুমিই হবে সবচেয়ে বেশী ধ্বংসাত্মক কাজের মানুষ। এ সব কথা শুনে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর পুনরায় তাদের সমবেত করলেন এবং বললেন, আল্লাহ পাকের জন্য সকল প্রশংসা। আমি তাঁর প্রশংসা করছি এবং তাঁর কাছেই সাহায্য চাচ্ছি। তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করছি। তাঁর ওপর ভরসা করছি। আমি এ সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত এবাদতের উপযুক্ত কেউ নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয় তাঁর কোন শরিক নেই। এরপর আল্লাহর রসুল বললে, পথ প্রদর্শক তার পরিবারের লোকদের নিকট মিথ্যা কথা বলতে পারেনা। সেই আল্লাহর শপথ যিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই, আমি তোমাদের প্রতি বিশেষভাবে এবং অন্য সব মানুষের প্রতি সাধারণভাবে আল্লাহর রসূল। আল্লাহর শপথ, তোমরা যেভাবে ঘুমিয়ে থাকো সেভাবে একদিন মৃত্যুমুখে পতিত হবে। ঘুম থেকে যেভাবে তোমরা জাগত হও, সেভাবে একদিন তোমাদের উঠানো হবে। এরপর তোমাদের থেকে তোমাদের কৃতকর্মের হিসাব নেয়া হবে। এরপর রয়েছে চিরকালের জন্য হয়তো জান্নাত অথবা জাহান্নাম।
একথা শুনে আবু তালেব বললেন, তোমাকে সহায়তা করা আমার কতো যে পছন্দ সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তোমার উপদেশ গ্রহণ যোগ্য। তোমার কথা আমি সত্য বলে বিশ্বাস করি। এখানে তোমার পিতৃকুলের সকলে উপস্থিত রয়েছে আমিও তাদের একজন। কাজেই তুমি আমার মন আবদুল মোত্তালেবের দ্বীন ছাড়ার পক্ষপাতী নয়। আবু লাহাব বলল, আল্লাহর শপথ এটা মন্দ কাজ। অন্যদের আগে তুমি তার হাত ধরেছ? আবু তালেব বললেন, আল্লাহর শপথ, যতদিন বেঁচে থাকি ততদিন আমি তার হেফাজত করতে থাকব (ফেকহুছ সীরাত পৃ. ৭৭, ৮৮,ইবনুল আছির রচিত)।
সাফা পাহাড়ের ওপর তাবলীগ
নবী আরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলেন যে,আল্লাহর দ্বীনের তাবলীগের ক্ষেত্রে আবু তালেব তাঁকে সহায়তা করবেন তখন তিনি একদিন সাফা পাহাড়ের ওপর উঠে আওয়ায দিলেন যে, ইয়া সাবাহ অর্থাৎ হায় সকাল (তখনকার দিনে কোন ভয়াবহ সংবাদ দেয়ার দরকার হলে মানুষরা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ইয়া সাবাহ ইয়া সাবাহ হায় সকাল বলে চীৎকার করতে থাকতো)। এই আওয়ায শুনে কোরাইশ গোত্রসমূহ তাঁর কাছে সমবেত হলো। তিনি তাদেরকে আল্লাহ পাকের তাওহীদ, তাঁর রেসালত এবং রোজ কেয়ামতের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের দাওয়াত দিলেন। এ ঘটনার একটি অংশ সহীহ বোখারীতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রা) থেকে এভাবে বর্ণিত হয়েছে।
হে নবী তোমার নিকটাত্মীয়দেরকে আল্লাহর আযাব সম্পর্কে ভয় প্রদর্শন করো। কোরআনের এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাফা পাহাড়ের ওপর আরোহণ করে আওয়ায দিলেন, হে বনি ফিহর, হে বনি আদী, এই আওয়ায শুনে কোরায়েশদের সকল নেতৃস্থানীয় লোক একত্রিত হলো। যিনি যেতে পারেননি তিনি একজন প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন কি ব্যাপার সেটা জানার জন্য। কোরাইশরা এসে হাজির হল, আবু লাহাবও তাদের সাথে ছিলেন। এরপর তিনি বললেন, তোমরা বলো যদি আমি তোমাদের বলি যে, পাহাড়ের ওদিকের প্রান্তরে একদল ঘোড় সওয়ার আত্মগোপন করে আছে, ওরা তোমাদের ওপর হামলা করতে চায়, তোমরা কি সে কথা বিশ্বাস করবে ? সবাই বলল, হ্যাঁ বিশ্বাস করব, কারণ আপনাকে আমরা কখনো মিথ্যা বলতে শুনিনি। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, শোনো আমি তোমাদেরকে এক ভয়াবহ আযাবের ব্যাপারে সাবধান করার জন্য প্রেরিত হয়েছি। আবু লাহাব বলল, তুমি ধ্বংস হও। তুমি আমাদেরকে একথা বলার জন্য এখানে ডেকেছ ? আবু লাহাবের একথা বলার পর আল্লাহ পাক সূরা লাহাব নাযিল করেন। এতে বলা হয় আবু লাহাবের দুটি হাত ধ্বংস হোক এবং সে নিজেও ধ্বংস হোক ( সহীহ বোখারী ২য় খন্ড, পৃ. ৭০৬, ৭৪৩ সহীহ মুসলিম ১ম খন্ড.পৃ. ১১৪)।
এই ঘটনার আরেক অংশ ইমাম মুসলিম তাঁর সহীহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। হযরত আবু হোরায়রা রাদি আল্লাহু আনহু এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, নিকটাত্মীয়দের আল্লাহর আযাব সম্পর্কে ভয় প্রদর্শন করো, এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আওয়ায দিলেন। সাধারণভাবে এবং বিশেষভাবে। তিনি বললেন, হে কোরাইশ দল, তোমরা নিজেদের জাহান্নাম থেকে রক্ষা করো। হে বিন কাব, নিজেদের জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর। হে মোহাম্মদের মেয়ে ফাতেমা, নিজেকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করো। আমি তোমাদেরকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষার ব্যাপারে আদিষ্ট হয়েছি। যেহেতু তোমাদের সাথে আমার আত্মীয়তা রয়েছে, কাজেই এ সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে যথাসম্ভব সজাগ করবো (সহীহ মুসলিম ১ম খন্ড পৃ. ৩৮৫)।
দাওয়াতের প্রকাশ্য ঘোষণা
এই আওয়াযের স্পন্দন এখনো মক্কার আশে পাশে শোনা যাচ্ছিল এমন সময় আল্লাহ পাক এই আয়াত নাযিল করেন, তোমাকে যে আদেশ দেয়া হয়েছে সেটা খোলাখুলি তুমি ঘোষণা করো এবং মোশরেকদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও (১৫, ৯৪)।
এরপর রসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৌত্তলিকতার নোংরামি ও অকল্যাণসমূহ প্রকাশ্যে তুলে ধরেন এবং মিথ্যার পর্দা উন্মোচিত করেন। তিনি মূর্তিসমূহের অন্তঃসারশূন্যটা, মূল্যহীনতা তুলে ধরেন এবং তাদের স্বরূপ উদঘাটন করেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে দিয়ে বোঝাতে থাকেন যে, মূর্তিসমূহ নিরর্থক এবং শক্তিহীন। তিনি আরো জানান যে, যারা এসব মূর্তিপূজা করে এবং নিজের ও আল্লাহর মধ্যে এদেরকে মাধ্যম হিসাবে স্থির করে তারা সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যে রয়েছে।
পৌত্তলিকদের এবং মূর্তির উপাসকদের পথভ্রষ্ট বলা হয়েছে একথা শোনার পর মক্কার অধিবাসীরা ক্রোধে দিশেহারা হয়ে পড়লো। তাদের ওপর যেন বজ্রপাত হলো, তাদের নিরুদ্বেগ শান্তিপূর্ণ জীবনে যেন ঝড়ের তাণ্ডব দেখতে পেলো। এ কারণ কোরাইশরা অকস্মাৎ উৎসারিত এ বিপ্লবের শেকড় উৎপাটনের জন্য উঠে দাঁড়াল। কেননা এ বিপ্লবের মাধ্যমে তাদের পৌত্তলিক রসম রেওয়াজ নির্মূল হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
কোরাইশরা কোমর বেঁধে উঠে দাঁড়ালো। কারণ তারা জানতো যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে মাবুদ হিসাবে অস্বীকার কারা এবং রেসালাত ও আখিরাতের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের অর্থ হচ্ছে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে রেসালাতের হাতে ন্যস্ত করা এবং তার কাছে নিঃশর্ত-ভাবে আত্মসমর্পণ। এতে করে অন্যদের তো প্রশ্নই আসে না নিজের জানমাল সম্পর্কে পর্যন্ত নিজের কোন স্বাধীন অধিকার থাকেনা। এর অর্থ হচ্ছে যে, আরবের লোকদের ওপর মক্কার লোকদের ধর্মীয় ক্ষেত্রে যে শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ব ছিল সেটা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এর পলে আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের ইচ্ছা ও মর্জিই হবে চূড়ান্ত, নিজেদের ইচ্ছা মতো তারা কিছুই করতে পারবেনা। নিচু শ্রেণীর লেকদের ওপর তারা যে অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে আসছিল, সকাল সন্ধ্যা তারা যেসব ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত ছিল সে সব থেকে তাদের দুরে থাকতে হবে। কোরাইশরা এর অর্থ ভালোই বুঝতে পারছিল, এ কারণ তাদের দৃষ্টিতে অবমাননাকর এরূপ অবস্থা তারা মেনে নিতে পারছিলরা। কিন্তু এটা কোন কল্যাণের বা মঙ্গলের প্রত্যাশায় নয় বরং আরো বেশী মন্দ কাজে নিজেদের জড়িত করাই এর উদ্দেশ্য। আল্লাহ পাক বলেন, বরং এ জন্য যে মানুষ চায় ভবিষ্যতেও মন্দ কাজে তারা লিপ্ত হবে (৫,৭৫)।
কোরাইশরা এসব কিছুই বুঝতে পারছিল, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে, তাদের সামনে এমন এক ব্যক্তি ছিলেন যিনি ছিলেন সত্যবাদী এবং বিশ্বাসী। তিনি ছিলেন আদর্শের উত্তম দৃষ্টান্ত। দীর্ঘকাল যাবত মক্কার অধিবাসীরা পূর্ব পুরুষদের মধ্যে এ ধরনের দৃষ্টান্ত দেখেনি শোনেওনি, এমন এক ব্যক্তিত্বের সাথে তারা কিভাবে মোকাবেলা করবে সেটাও ভেবে ঠিক করতে পারছিলনা। তারা ছিল অবাক তারা ছিল বিস্মিত, এভাবে বিস্মিত হওয়ার মূলত কিছু কারণও ছিল।
কোরাইশরা অনেক চিন্তা ভাবনার পর এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, তারা প্রিয় নবীর চাচা আবু তালেবের কাছে যাবে এবং তাকে অনুরোধ করবে, তিনি যেন নিজের ভ্রাতুষ্পুত্রকে তাঁর কাজ থেকে বিরত রাখেন। নিজেদের দাবীকে যুক্তিগ্রাহ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য তারা এ দলিল তৈরী করলো যে, তাদের উপাস্যদের পুরিতৗাগ করার দাওয়াত দেয়া এবং তারা যে ভালো মন্দ কোন কিছুই করার শক্তি রাখেনা এ কথা বলা প্রকৃত পক্ষে তাদের উপাস্যদের প্রতি অবমাননা এবং মারাত্মক গালি।
তাছাড়া এটা হচ্ছে আমাদের পিতা ও পিতামহ অর্থাৎ আমাদের পূর্ব পুরুষদের নির্বোধ এবং পথভ্রষ্ট আখ্যায়িত করার শামিল। কেননা বর্তমানে আমরা যে ধর্ম বিশ্বাসের ওপর রয়েছি তারাও এই ধর্ম বিশ্বাসের ওপর জীবন যাপন করেছিলেন। কোরাইশদের এসব কথা বোঝানোর পর তারা সহজে বুঝাতে পারছিলো এবং দ্রুত এতে সাড়া দিল।
আবু তালেব সমীপে কোরাইশ প্রতিনিধি দল
ইবনে ইসহাক লিখেছেন, কোরায়েশদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় কয়েকজন লোক আবু তালেবের নিকট গেল এবং বলল যে আবু তালেব, আপনার ভ্রাতুষ্পুত্র আমাদের উপাস্যদের গালাগাল করছে, আমাদের দ্বীনকে পথভ্রষ্টতা বলছে এবং আমাদের বিবেককে নির্বুদ্ধিতা বলে অভিহিত করছে। আমাদের পিতা ও পিতামহদের পথভ্রষ্ট বলে আখ্যায়িত করছে। কাজই হয়তো আপনি ডাকে বাধা দিন, অথবা তাঁর এবং আমাদের মাঝখান থেকে আপনি সরে দাঁড়ান। কেননা আপনিও আমাদের মতোই একই ধর্মে বিশ্বাসী। তার সাথে বোঝাপড়ার জন্য আমরা নিজেদের যথেষ্ট মনে করি।
এ আবেদনের জবাবে আবু তালেব নরম ভাষায় কথা বললেন এবং মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করলেন। ফলে তারা ফিরে গেল। আল্লাহর রসূল একই নিয়মে অব্যাহতভাবে দ্বীনের তাবলীগ করতে লাগলেন এবং দ্বীনের প্রচার প্রসারে মনোনিবেশ করলেন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ২৬৫)।
হাজীদের বাধা দেয়ার জন্যে জরুরী বৈঠক
সেই সময়ে কোরায়েশদের সামনে আরো একটি সমস্যা এসে উপস্থিত হলো। প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এসে পড়লো হজ্জের মৌসুম। কোরাইশরা জানতো যে, আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিনিধিদল এ সময় মক্কায় আসবে। এ কারণে তারা দরকার মনে করলো যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে এমন কথা বলবে যাতে আরবের লোকদের মনে আল্লাহর রসুলের তাবলীগের কোন প্রভাব না পড়ে। এ বিষয়ে আলোচনার জন্য তারা ওলীদ ইবনে মুগীরার কাছে গিয়ে একত্রিত হলো। ওলীদ বললো, প্রথমে তোমরা সবাই একমত হবে, একজনের কথা অন্যজন মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে এমন অবস্থা যেন না হয়। তোমাদের মধ্যে কোন প্রকার মত পার্থক্য থাকতে পারবেনা। আগন্তুকগণ বলল আপনি আমাদের বলে দিন, আমরা কি বলব। ওলীদ বলল, তোমরা বলো, আমি শুনব। এরপর কয়েকজন বলল, আমরা বলব যে, তিনি একজন জ্যোতিষী। ওলীদ বলল, না তিনি জ্যোতিষী নন, আমি জ্যোতিষীদের দেখেছি, তার মধ্যে জ্যোতিষীদের মতো বৈশিষ্ট্য নেই, জ্যোতিষীরা যেভাবে অন্তঃসারশূন্য কথা বলে থাকে তিনি সেভাবে বলেন না। এ কথা শুনে আগন্তুকরা বলল, তাহলে আমরা বলব যে, তিনি একজন পাগল। ওলীদ বলল, না তিনি পাগলও নন। আমি পাগলও দেখেছি, পাগলের প্রকৃতিও দেখেছি। তিনি পাগলের মতো আচরণও করেন না পাগলের মতো উল্টাপাল্টা কথাও বলেন না। লোকেরা বলল, তাহলে আমরা বলব যে, তিনি একজন কবি। ওলীদ বলল, তিনি কবিও নন। কবিত্বের বিভিন্ন রকম আমার জানা আছে তাঁর কথা কবিতা নয়। লোকরা বলল, তাহলে আমরা বলব যে, তিনি একজন যাদুকর। ওলীদ বলল, না তিনি যাদুকরও নন। আমি যাদুকর এবং তাদের যাদু দেখেছি। তিনি ঝাড়ফুঁক করেননা এবং যাদু-টোনাও করেননা। আগুন্তুকরা বলল, তাহলে আমরা কি বলব ? ওলীদ বলল, আল্লাহর শপথ তার কথা বড় মিষ্টি। তার কথার তাৎপর্য অনেক গভীরতাপূর্ন। তোমরা যে কথা বলবে শ্রোতারা সবাই মিথ্যা মনে করবে। তবে তার সম্পর্কে একথা বলতে পারো যে, তিনি একজন যাদুকর। তিনি যে সব কথা পেশ করেছে সেসব কথা স্রেফ যাদু। তাঁর কথা শোনার পর পিতা পুত্রের মধ্যে, ভাই ভাইয়ের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে মত পার্থক্য দেখা দেয়। পরিশেষে কোরাইশ প্রতিনিধিদল একথার ওপর একমত হয়ে ওলীদের নিকট থেকে ফিরে এলো (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ২৭১)।
কোন কোন বর্ণনায় বিস্তারিত ভাবে একথাও উল্লেখ রয়েছে যে, ওলীদ যখন আগন্তুকদের সব কথা প্রত্যাখ্যান করলো তখন তারা বলল, তাহলে আপনি সুচিন্তিত মতামত পেশ করুন। এ কথা শুনে ওলীদ বলল, আমাকে একটুখানি চিন্তা করার সময় দাও। কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর ওলীদ উপরোক্ত মন্তব্য করেছিল (তাফসীর ফি যিলাযিল কোরআন, সাইয়েদ কুতুব শহীদ, পারা,২৯, পৃ.১৮৮)।
উল্লিখিত ঘটনার প্রেক্ষিতে ওলীদ সম্পর্কে আল্লাহ পাক সূরা মুদ্দাসসেরের ষোলটি আয়াত নাযিল করেন। এসব আয়াতে ওলীদের চিন্তার প্রকৃতির চিত্ররূপ লক্ষ্য করা যায়। আল্লাহ পাক বলেন, সে তো চিন্তা করলো এবং সিদ্ধান্ত করলো। অভিশপ্ত হোক সে কেমন করে সে এ সিদ্ধান্ত করলো। আরো অভিশপ্ত হোক, সে কেমন করে সে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। সে আগে চেয়ে দেখলো। অতঃপর সে ভ্রু-কুঞ্চিত করলো এবং মুখ বিকৃত করলো। অতঃপর সে পেছন ফিরলো এবং দম্ভ প্রকাশ করলো এবং ঘোষণা করলো, এটাতো লোক পরস্পরায় প্রাপ্ত যাদু ভিন্ন আর কিছু নয়, এটাতো মানুষেই কথা ( আয়াত ১৮- ২৫)।
উল্লিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কয়েকজন পৌত্তলিক হ্জ্জ যাত্রীদের আসার বিভিন্ন পথে অবস্থান নেয় এবং নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে তাদের সতর্ক করে (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড,২৭১ পৃ)।
এ কাজে সবার প্রথম ছিল আবু লাহাব। হজ্জের সময়ে সে হজ্জ-যাত্রীদের ডেরায়, ওকায, মাজনা এবং যুল মায়াযের বাজারে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেছনে লেগে থাকে। নবী (সা:) আল্লাহর দ্বীনের তাবলীগ করছিলেন, আর আবু লাহাব পেছনে থেকে বলছিল, তোমরা ওর কথা শুনবে না, সে হচ্ছে মিথ্যাবাদী এবং বেদ্বীন (তিরমিযি মোসনাদে আহমদ তৃতীয় খন্ড ৪৯২)।
এ ধরনের ছুটোছুটি র ফল এই হলো যে, হজ্জ যাত্রীরা ঘরে ফিরে যাওয়ার সময় জানতে পারলো যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুয়ত দাবী করেছেন। মোটকথা হজ্জ-যাত্রীদের মাধ্যমে সমগ্র আরব জাহানে আল্লাহর রসূলের আলোচনা ছড়িয়ে পড়ল।
সম্মিলিত প্রতিরোধ
কোরাইশরা যখন লক্ষ্য করলো যে, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে তাবলীগে দ্বীন থেকে ফিরিয়ে রাখার কৌশল কাজে আসছে না তখন তারা নতুন করে চিন্তা করলো। দ্বীনের দাওয়াত চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার জন্য ভিন্ন পদ্ধতি ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করলো। সে পন্থা ও পদ্ধতির সারমর্ম নিম্নরূপ,
প্রতিরোধের প্রথম ধরন
এক হাসি ঠাট্টা, বিদ্রূপ উপহাস এবং মিথ্যাবাদী বলে তাকে অভিহিত করা। এর উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের মনোবল নষ্ট করা। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য পৌত্তলিকরা নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে অহেতুক অপবাদ এবং গালাগাল দিতে শুরু করে। কখনো তারা প্রিয় নবীকে পাগল বলতো। যেমন আল্লাহপাক বলেন, ওসব কাফেররা বলল, যার ওপর কোরআন নাযিল হয়েছে নিশ্চয়ই সে একটা পাগল (৬-১৫)।
কখনো তাঁর ওপর যাদুকর এবং মিথ্যাবাদী হওয়ার অপবাদ দেওয়া হতো। যেমন আল্লাহ পাক বলেন, ওরা বিস্ময় বোধ করছে যে, ওদের কাছে ওদের মধ্য থেকে একজন সতর্ককারী এলেন এবং কাফেররা বলে এতো এক যাদুকর, মিথ্যাবাদী (৪-৩৮)।
কাফেররা আল্লাহর রসূলের সামনে দিয়ে পেছনে দিয়ে ক্রুদ্ধভাবে চলাচল করতো এবং রোষ কষায়িত চোখে তাঁর প্রতি তাকাতো। এ সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন, কাফেররা যখন কোরআন শ্রবণ করে তখন তারা যেন ওদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দ্বারা তোমাকে আছড়িয়ে ফেলে দেবে এবং বলে এতো পাগল ( ৫১-৬৮)।
নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোথাও যেতেন এবং তাঁর সামনে পেছনে দুর্বল ও অত্যাচারিত সাহাবায়ে কেরাম থাকতেন তখন পৌত্তলিকরা ঠাট্টা করে বলতো, আল্লাহ কি তোমাদের ওপর অনুগ্রহ করলেন? (৫৩, ৬)
তাদের এ উক্তির জবাবে আল্লাহ বলেন, আল্লাহ কি কৃতজ্ঞ লোকদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত নন? (৫৩,৬)
সাধারণভাবে কাফেরদের অবস্থা যেরূপ চিল কোরআনে আল্লাহ পাক তার চিত্র এভাবে অঙ্কন করেছেন, যারা অপরাধী তারা তো মোমেনদের উপহাস করতো এবং ওরা যখন মোমেনদের কাছ দিয়ে যেতো তখন চোখ টিপে ইশারা করতো এবং যখন ওদের কে দেখতো তখন বলতো এরা তো পথভ্রষ্ট। এদেরকে তো তাদের তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠানো হয়নি (২৯,৩৩,৮৩)।
প্রতিরোধের দ্বিতীয় ধরন
আল্লাহর রসূলের শিক্ষাকে বিকৃত করা, সন্দেহ অবিশ্বাস সৃষ্টি করা, মিথ্যা প্রোপাগান্ডা করা,দ্বীনের শিক্ষা এবং দ্বীন প্রচারকারীদের ঘৃণ্য সমালোচনা করা ছিল তাদের নৈমিত্তিক কাজ। এসব কাজ তারা এতো বেশী করতো যাতে জনসাধারণ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করার সুযোগ না পায়। পৌত্তলিকরা পবিত্র কোরআন সম্পর্কে বলতো, ওরা বলতো, এগুলোতো সে কালের উপকথা, যা সে লিখিয়ে নিয়েছে, এগুলো সকাল সন্ধ্যা তার নিকট পাঠ করা হয় (৫, ২৫)।
কাফেররা বলে, এটা মিথ্যা ব্যতীত কিছুই নয়, সে এটা উদ্ভাবন করেছে এবং ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছে (৪,২৫)।
পৌত্তলিকরা এ কথাও বলে যে, তাকে শিক্ষা দেয় এক মানুষ (১০৩, ১৬)।
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর তাদের অভিযোগ ছিল এই, ওরা বলে, এ কেমন রসূল যে আহার করে এবং হাটে বাজারে চলাফেরা করে (৭, ২৫)।
কোরআন শরীফের বহু জায়গায় পৌত্তলিকদের অভিযোগসমূহ খণ্ডন করা হয়েছে, কোথাও তাদের অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে কোথাও করা হয়নি।
প্রতিরোধের তৃতীয় ধরন
পূর্ববর্তী লোকদের ঘটনাবলী এবং কাহিনী উল্লেখ করে কোরআন তার অবিশ্বাসীদের মোকাবেলা করেছে। নযির ইবনে হারেসের ঘটনা এই যে, একবার সে কোরায়েশদের বলল, হে কোরাইশরা, আল্লাহর শপথ, তোমাদের ওপর এমন আপদ এসে পড়েছে যে, তোমরা এখনো তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোন উপায় বের করতে পারোনি। মোহাম্মদ তোমাদের মধ্যে বড় হয়েছেন, তোমাদের সবচেয়ে পছন্দনীয় মানুষ ছিলেন, সবার চেয়ে বেশী সত্যবাদী এবং সবচেয়ে বড় আমানতদার ছিলেন। আজ তাঁর কানের কাছে চুল যখন সদা হয়েছে তখন তিনি তোমাদের কাছে কিছু কথা নিয়ে এসেছেন অথচ তোমরা বলছো তিনি যাদুকর। আল্লাহর শপথ তিনি যাদুকর নন। আমি যাদুকর দেখেছি এবং তাদের যাদু টোনাও দেখেছি। তাদের উল্টাপাল্টা কথাও শুনেছি। তোমরা বলছো তিনি কবি, আল্লাহর শপথ তিনি কবিও নন।। আমি কবিদের দেখেছি এবং তাদের কবিতা শুনেছি। তোমরা বলছো তিনি পাগল, না, আল্লাহর শপথ তিনি পাগলও নন। আমি পাগল দেখেছি, পাগলের পাগলামিও দেখেছি। তাঁর মধ্যে কোন প্রকার পাগলামির চিহ্ন নেই। কোরাইশদের লোকরা, তোমরা গভীরভাবে চিন্তা করো, তোমাদের ওপর বিরাট আপদ এসে পড়েছে।
এরপর নযর ইবনে হারেস হীরায় গেল এবং সেখানে বাদশাহদের বিভিন্ন ঘটনা বিশেষত রুস্তম এবং আলেকজান্ডারের কাহিনী শিখলো। এরপর সে মক্কায় ফিরে এলো। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন মজলিসে বসে আল্লাহর কথা বলতেন এবং তাঁর শাস্তি সম্পর্কে লোকদের ভয় দেখাতেন তখন সে সেখানে যোত এবং বলতো, আল্লাহর শপথ, মোহাম্মদের কথা আমার খতার চেয়ে ভালো নয়। এরপর বলতো, মোহাম্মদের কথা আমার কথার চেয়ে কি কারণে ভালে হবে? (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ.২৯৯, ৩০০, ৩৫৮, মুখতাছুছ ছিয়ার, শেখ আবদুল্লাহ, পৃ. ১১৭, ১১৮)।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের বর্ণনা থেকে এ কথাও জানা যায় যে, নযর ইবনে হারেস কয়েকজন দাসী ক্রয় করে রেখেছিল। যখন সে শুনতো যে কোন মানুষ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে তখন তার ওপর একজন দাসীকে লেলিয়ে দিতো। সেই দাসী সেই লোককে পানাহার করাতো, তাকে গান শোনাতো। একপর্যায়ে সেই লোকের ইসলামের প্রতি কোন আকর্ষণ অবশিষ্ট থাকতো না। এ সম্পর্কে আল্লাহ পাক এই আয়াত নাযিল করেন, কিছু লোক এমন রয়েছে যারা ক্রীড়ার কথাবার্তা ক্রয় করে যাতে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরানো যায় (ফাতহুল কাদির, ৪র্থ খন্ড, পৃ. ২৩৬)।
প্রতিরোধের চতুর্থ ধরন
কোরাইশরা একপর্যায়ে এ রকম চেষ্টা করেছিল যে, ইসলাম এবং জাহেলিয়াতের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন রচনা করবে। অর্থাৎ পরস্পর পরস্পরকে কিছু ছাড় দিবে। আল্লাহর রসুল পৌত্তলিকদের কিছু গ্রহণ করবেন এবং পৌত্তলিকরা আল্লাহর রসূলের কিছু আদর্শ গ্রহণ করবে। আল্লাহ পাক কোরআনে এ সম্পর্কে বলেন, ওরা চায় যে, আপনি নমনীয় হবেন তাহলে তারাও নমনীয় হবে (৯, ৬৮) ইবনে জরির এবং তিবরানির একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, পৌত্তলিকরা আল্লাহর রসলের নিকট এ মর্মে প্রস্তাব দিল যে, এক বছর আপনি আমাদের উপাস্যদের উপাসনা করুন, আর এক বছর আমরা আপনার প্রভুর উপাসনা করবো। আবদ ইবনে হোমায়েদের একটি বর্ণনায় রয়েছে, যে পৌত্তলিকরা বললো, আপনি যদি আমাদের উপাস্যদের মেনে নেন, তবে আমরাও আপনার খোদার এবাদত করবো (ফাতহুল কাদির, শাওকানি রচিত, ৫ম খন্ড, পৃ. ৫০৮)।
ইবনে ইসহাক বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবাঘরের তওয়াফ করছিলেন এমন সময় আসওয়াদ ইবনে মুত্তালিব ইবনে আসাদ ইবনে আবদুল ওযযা, ওলীদ ইবনে মুগীরা, উমাইয়া ইবনে খালফ ও আসা ইবনে ওয়ায়েল ছাহমী তাঁর কাছে এলো। এরা ছিল নিজ নিজ গোত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তি। এরা বললো এসো মুহাম্মদ, তুমি যার পূজা করছো, আমরা তার পূজা করবো। আর আমরা যাকে পূজা করছি, তুমিও তার পূজা করবে। এতে আমরা উভয়ে সমপর্যায়ে উন্নীত হবো। যদি তোমাদের মাবুদ আমাদের মাবুদের চেয়ে ভালো হন তবে আমরা তার কাছ থেকে কল্যাণ লাভ করবে আর যদি আমাদের মাবুদ তোমাদের মাবুদের চেয়ে ভালো হন তবে তোমরা তার কাছ থেকে কল্যাণ লাভ করবে। তাদের এ হাস্যকর কথার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা সূরা কাফেরূন নাযিল করেন। এতে ঘোষণা করা হয় যে, তোমরা যাদের উপাসনা আমি তাদের উপাসনা করতে পারি না (ইবনে হাশিম ১ম খন্ড, পৃ. ৩৬২)।
এ সিদ্ধান্তমূলক জবাবের মাধ্যমে পৌত্তলিকতার হাস্যকর বক্তব্যের মূলোৎপাটন করা হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনার সম্ভাব্য কারণ এই যে, এ ধরনের চেষ্টা সম্ভবত বার বার করা হয়েছে।
যুলুম নির্যাতন
নবুয়তের চতুর্থ বছরে ইসলামের প্রকাশ্য দাওয়াত বন্ধ করতে পৌত্তলিকরা যেসব কাজ করেছে তার বিবরণ ইতোপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। এসব অপ-তৎপরতা পৌত্তলিকরা পর্যায়ক্রমে এবং ধীরে ধীরে চালিয়েছে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ এমনকি মাসের পর মাস অতিরিক্ত কিছু করেনি। কিন্তু তারা যখন লক্ষ্য করলো যে, তাদের তৎপরতা ইসলামের দাওয়াতের পথে বাধা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হচ্ছে তখন তারা পুনরায় সমবেত হয়ে পঁচিশজন কাফেরের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করলো। এরা ছিল কোরাইশ বংশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। এ কমিটির প্রধান ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চাচা। পারস্পরিক পরামর্শ ও চিন্তা ভাবনার পর কমিটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবাদের বিরুদ্ধে একটি সিদ্ধান্তমূলক প্রস্তাব অনুমোদন করলো। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, ইসলামের বিরোধিতা করতে যেয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দেওয়া এবং ইসলাম গ্রহণকারীদের নির্যাতন করার ব্যাপারে কোন প্রকার শিথিলতার পরিচয় দেওয়া হবে না।(রহমাতুল্লিল আলামিন ১ম খন্ড, পৃ. ৫৯-৬০)
পৌত্তলিকরা এ প্রস্তাব গ্রহণ করার পর সর্বাত্মকভাবে তা বাস্তবায়নের দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করলো। মুসলমান বিশেষত দুর্বল মুসলমানদের ক্ষেত্রে পৌত্তলিকতার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সহজ ছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষেত্রে ছিলো কঠিন। কেননা তিনি ছিলেন অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী এক অসাধারণ মানুষ। সবাই তাকে সম্মানের চোখে দেখতো। তাঁর কাছে সম্মানজনকভাবেই যাওয়া সহজ ছিলো। তাঁর বিরুদ্ধে অবমাননাকর ও ঘৃণ্য তৎপরতা বর্ব ও নির্বোধদের জন্য ছিল মানানসই। ব্যক্তিত্বের এবং স্বাতন্ত্র্য এবং প্রখরতা ছাড়াও আবু তালিবের সাহায্য তিনি পাচ্ছিলেন। মক্কায় আবু তালিবের প্রভাব ছিল অনতিক্রম। ব্যক্তিগত বা সম্মিলিতভাবে এ প্রভাব অতিক্রম করা এবং তার সাথে কৃত অঙ্গিকার ভঙ্গ করার সাহস কারো ছিল না। এ পরিস্থিতিতে কুরাইশরা দারুণ মর্মপীড়ার মধ্যে দিয়ে দিন যাপন করছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে, দিনের প্রচার প্রসার তাদের ধর্মীয় আধিপত্য এবং পার্থিব নেতৃত্ব কর্তৃত্বের শিকড় কেটে দিচ্ছিলো। সে দ্বীনের ব্যাপারে আর কতকাল তারা ধৈর্য্যধারন করবে। পরিশেষে পৌত্তলিকরা আবু লাহাবের নেতৃত্বে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নির্যাতন শুরু করলো। প্রকৃতপক্ষে প্রিয় নবীর সাথে আবু লাহাবের শত্রুতামূলক আচরণ আগে থেকেই ছিল। কোরাইশরা আল্লাহর রাসূলের উপর নির্যাতনের কথা চিন্তা করারও আগে আবু লাহাব চিন্তা করছিলো। বনি হাশেমের মজলিস এবং সাফা পাহাড়ের পাদদেশে এই দূর্বৃত্ত্ব যা বলেছিল, ইতিপূর্বে সেসব কথার উল্লেখ করা হয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে, সাফা পাহাড়ের পাদদেশে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার পর নবী মোহাম্মদ (সঃ) মারার জন্য আবু লাহাব একটি পাথর তুলেছিলো। (তিরমিযি)
রসূলের নবুয়ত পাওয়ার আগে আবু লাহাব তার দুই পুত্র ওতবা ও ওতাইবাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুই কন্যা রোকাইয়া ও উম্মে কুলসুমের সাথে বিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুয়ত পাওয়ার পর এবং দ্বীনের দাওয়ার প্রচারের শুরুতে আবু লাহাব নবীর দুই কন্যাকে তালাক দিতে তার দুই পুত্রকে বাদ্য করেছিলো। (তাফসীর ফি জিলালিল কোরআন, সাইয়েদ কুতুব শহীদ ৩য় খন্ড, পৃ, ২৮২ তাফসীর তাফহীমূল কোরআন, মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী ষষ্ট খন্ড, ৫৫২(উর্দু সংস্করণ))
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বিতীয় পুত্র আবদুল্লাহ ইন্তেকালের পর আবু লাহাব এতো খুশি হয়েছিলো যে, তার বন্ধুদের কাছে দৌড়ে গিয়ে গদ গদ করে বলছিলো যে, মোহাম্মদ অপুত্রক হয়ে গেছে।[তাফসীর তাফহীমূল কোরআন, ষষ্ট খন্ড, পৃ.৪৯০ (উর্দু সংস্করণ)]
ইতিপূর্বে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, হজ্জ মৌসুমে আবু লাহাব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করতে বাজার এবং বিভিন্ন জনসমাবেশে তাঁর পেছনে লেগে থাকতো তারেক ইবনে আবদুল্লাহ মুহাবেরীর বর্ণনা থেকে জানা যায় আবু লাহাব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা মিথ্যা প্রমাণ করতেই শুধু ব্যস্ত থাকত না বরং তাঁকে পাথরও নিক্ষেপ করতো এতে তার পায়ের গোড়ালি রক্তাক্ত হয়ে যেতো (জামে তিরমিযি)।
আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিলের প্রকৃত নাম ছিলো আবওয়া সে ছিলো হারব ইবনে উমাইয়ার কন্যা এবং আবু সুফিয়ানের বোন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি শত্রুতার ক্ষেত্রে সে তার স্বামীর চেয়ে কোন অংশে কম ছিলোনা নবী (সা) যে পথে চলাফেরা করতেন, ঐ পথে এবং তার দরজায় সে কাঁটা বিছিয়ে রাখতো অত্যন্ত অশ্লীল ভাষী এবং ঝগড়াটে ছিলো এ নোংরা মহিলা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালাগাল দেয়া এবং কুটনামি নানা ছুতোয় ঝগড়া, ফেতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি এবং সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করা ছিলো তার কাজ, এ কারণে কোরআন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, এবং তার স্ত্রীও সে ইন্ধন বহন করে।
আবু লাহাবের স্ত্রী যখন জানতে পারলো যে, তার এবং তার স্বামীর নিন্দা করে আয়াত নাযিল হয়েছে, তখন সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খুঁজে খুঁজে কাবা শরীফের কাছে এলো, প্রিয় নবী সে সময় কাবাঘরের পাশে অবস্থান করছিলেন, তার সাথে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা)ও ছিলেন, আবু লাহাবের স্ত্রীর হাতে ছিলো এক মুঠি পাথর, আল্লাহ রাসূলের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছুলে আল্লাহ তায়ালা তার দৃষ্টি কেড়ে নেন, সে আল্লাহর রাসূলকে দেখতে পায়নি, হযরত আবু বকরকে দেখতে পাচ্ছিলো, হযরত আবু বকরের সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো যে, তোমার সাথী কোথায়? আমি শুনেছি তিনি আমার নামে নিন্দা করেছেন, আল্লাহর শপথ, যদি আমি তাকে পেয়ে যাই তবে তার মুখে এ পাথর ছুড়ে মারব, দেখো আল্লাহর শপথ, আমিও একজন কবি, এরপর সে এ কবিতা শোনালো, মোযাম্মাম (পৌত্তলিকরা নবী করিম (স.) কে মোহাম্মাদ না বলে মোযাম্মাম বলতো। মোহাম্মদ অর্থ প্রশংসিত, অথচ মোযাম্মাম শব্দের অর্থ এর বিপরীত অর্থাৎ নিন্দিত) আছাইনা ওয়া আমরাহ আবাইনা ওয়া দ্বীনাহু কালাইনা, অর্থাৎ মোযাম্মামের অবাধ্যতা করেছি, তার কাজকে সমর্থন করিনি এবং তার দ্বীনকে ঘৃণা ও অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করেছি, তার কাজকে সমর্থন করিনি এবং তার দ্বীনকে ঘৃণা ও অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করেছি, এরপর সে চলে গেলো।
আবু বকর সিদ্দিক (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সে কি আপনাকে দেখতে পায়নি? তিনি বললেন, না দেখেতে পায়নি, আল্লাহ তায়ালা আমার ব্যাপারে তার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিলেন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৩৫-৩৩৬)।
আবু বকর রাযযারও এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন, তিনি এটুকু সংযোজন করেছেন যে, আবু লাহাবের স্ত্রী হযরত আবু বকরের সামনে গিয়ে একথাও বলেছিলো যে, আবু বকর, আপনার সঙ্গী আমার নিন্দা করেছেন, আবু বকর বললেন, একথা ঠিক নয়, এই ঘরের প্রভুর শপথ, তিনি কবিতা রচনা করেন না এবং কবিতা মুখেও উচ্চারণ করেন না, আবু লাহাবের স্ত্রী বললো, আপনি ঠিকই বলেছেন।
আবু লাহাব ছিলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিবেশী এবং চাচা, তার ঘর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরের কাছাকাছি ছিলো, অন্য প্রতিবেশীরাও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দিতো।
ইবনে ইসহাক বলেন, যেসব লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঘরের মধ্যে কষ্ট দিতো তাদের নাম হলে আবু লাহাব, হাকাম ইবনে আবুল আস ইবনে উমাইয়া, ওকবা ইবনে আবু মুঈত, আদী ইবনে হামরা, ছাকাফি ইবনুল আছদা হুজালি প্রমুখ, এরা সবাই ছিলো তার প্রতিবেশী।
এদের মধ্যে হাকাম ইবনে আবুল আস (তিনি ছিলেন উমাইয়া খলিফা মারওয়ান ইবনে হাকামের পিতা) ব্যতীত অন্য কেউ মুসলমান হয়নি এদের কষ্ট দেয়ার পদ্ধতি ছিলো এ রকম যে, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায আদায় করতেন তখন এদের কেউ বকরির নাড়িভুঁড়ি এমনভাবে ছুড়ে মারতো যে সেসব গিয়ে তার গায়ে পড়তো, আবার উনুনের ওপর হাড়ি চাপানো হলে বকরির নাড়ি ভুড়ি এমনভাবে নিক্ষেপ করতো যে, সেগুলো গিয়ে সেই হাড়িতে পড়তো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরে নিরাপদে নামায আদায়ের জন্যে ঘরের ভেতর একটি জায়গা করে নিয়েছিলেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর এসব নাড়িভুঁড়ি নিক্ষেপের পর তিনি সেগুলো একটি কাঠির মাথায় নিয়ে দরজায় দাড়িয়ে বলতেন, হে বনি আবদে মান্নাফ, এটা কেমন ধরনের প্রতিবেশী সুলভ ব্যবহার? এরপর সেসব নাড়িভুঁড়ি ফেলে দিতেন(ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪১৬)।
ওকবা ইবনে আবু মুঈত ছিলো জঘন্য দূর্বৃত্ত্ব ও দুস্কৃতিতে ওস্তাদ সহীহ বোখারিতে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবাঘরের পাশে নামায আদায় করছিলেন আবু জেহেল এবং তার কয়েকজন বন্ধু সেখানে বসেছিলো, এমন সময় একজন অন্যজনকে বললো, সক আছো অমুকের উটের নাড়িভুঁড়ি এনে মোহাম্মাদ যখন সেজদায় যাবে, তখন তার পিঠে চাপিয়ে দিতে পারবে? এরপর ওকবা ইবনে আবু মুঈত (বোখারী শরীফের অন্য এক বর্ণনায় এ ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৩৪ দেখুন) উটের নাড়িভুঁড়ি এনে অপেক্ষা করতে লাগলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেজদায় যাওয়ার পর সেই নাড়িভুঁড়ি তার উভয় কাঁধের দুদিকে ঝুলিয়ে দিল আমি সব কিছু দেখছিলাম, কিন্তু কিছু বলতে পারছিলাম না কি যে ভালো হতো হায় যদি আমার মধ্যে তাকে রক্ষা করার শক্তি থাকতো।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, এরপর দুর্বৃত্তরা হাসতে হাসতে একজন অন্যজনের গায়ে ঢলে পড়ছিলো, এদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেজদায় পড়ে রইলেন, মাথা তুললেন না হযরত ফাতেমা (রা.) খবর পেয়ে ছুটে এসে নাড়িভুঁড়ি সরিয়ে ফেললেন এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেজদা থেকে মাথা তুললেন এরপর তিনবার বললেন, আল্লাহুমা আলাইকা বে কোরাইশ অর্থাৎ হে আল্লাহ তায়ালা কোরাইশদের দায়িত্ব তোমার ওপর এই বদদোয়া শুনে তারা নাখোশ হলো, কেননা তারা একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতো যে, এই শহরে তার দোয়া কবুল হয়ে থাকে, এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নাম ধরে বদদোয়া করলেন, হে আল্লাহ আবু জেহেলকে পাকড়াও করো, ওতবা ইবনে রবিয়া, শায়বা ইবনে রাবিয়া, ওলীদ ইবনে ওতবা, উমাইয়া ইবনে খালফ এবং ওকবা ইবনে আবু মুঈতকেও পাকড়াও করো।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্ভবত আরো কয়েকজনের নাম বলেছিলেন, কিন্তু বর্ণনাকারী সেই নাম ভুলে গেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেসব কাফেরের নাম উচ্চারণ করে বদদোয়া করেছিলেন, আমি দেখেছি বদরের কুয়োয় তাদের সবার লাশ পড়ে আছে (সহীহ বোখারী কিতাবুল ওযু ১ম খন্ড, পৃ. ৩৭)।
উমাইয়া ইবনে খালফ এর অভ্যাস ছিলো যে, সে যখনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখতো তখনই নানা কটূক্তি করতো এবং অভিশাপ দিতো, আল্লাহ তায়ালা তার সম্পর্কে এই আয়াত নাযিল করেন, ওয়ায়লুল লেকুল্লি হুমাযাতিল লুমাযাহ, অর্থাৎ সেই ব্যক্তিকে বলা হয়, যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে গালাগাল নিন্দা করে, ইবনে হিশাম বলেন, হুমাযা সেই ব্যক্তিকে বলা হয়, যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে গালাগাল দেয় এবং চোখ বাঁকা করে ইশারা করে, লুমাযা সেই ব্যক্তিকে বলা হয় যে, পশ্চাতে মানুষের নিন্দা করে এবং কষ্ট দেয় (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৫৬, ৩৫৭)।
উমাইয়ার ভাই উবাই ইবনে খালফ ছিলো ওকবা ইবনে আবু মুঈতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ওকবা একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বসে ইসলামের কিছু কথা শুনেছিলো, উবাই একথা শুন ওকবাকে সমালোচনা করলো এবং নির্দেশ দিলো যে, যাও, তুমি গিয়ে মোহাম্মাদের গায়ে থুথু দিয়ে এসো। ওকবা তাই করলো। উবাই ইবনে খালফ একবার একটি পুরনো হাড় গুড়ো করলো, এরপর সেই গুড়ো বাতাসে ফু দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি উড়িয়ে দিল (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৬১-৩৬২)
আখলাস ইবনে শোরাইক ছাকাফিও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দেয়ার কাজে উৎসাহী ছিলো, কোরআনে করিমে তার নয়টি বদঅভ্যাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, এ থেকেই তার কর্মতৎপরতা সম্পর্কে ধারনা করা যায়, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, এবং অনুসরণ করো না তার, যে কথায় কথায় শপথ করে, পশ্চাতে নিন্দাকারী, একজনের কথা অন্যজনের কাছে লাগিয়ে বেড়ায়, কল্যাণের কাজে বাধা প্রদান করে, সীমা লঙ্ঘনকারী, পাপিষ্ঠ, রূঢ়স্বভাব এবং তদুপরি কুখ্যাত, (১০-১৩, ৬৮)।
আবু জেহেল কখনো কখনো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে কোরআন শুনতো, কিন্তু শোনা পর্যন্তই, সে ঈমানও আনতো না ইসলামের শিক্ষাও গ্রহণ করতো না এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি আনুগত্যের পরিচয়ও দিতো না, বরং সে নিজের কথা দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দিতো এবং আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করতো, এরপর নিজের এ কাজের জন্যে গর্বের সাথে বুক ফুলিয়ে নিতো, মনে হতো যে বড় ধরনের কোন কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে ফেলেছে, পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ আল্লাহ তায়ালা তার সম্পর্কে নাযিল করেছেন (তাফসীরে ফী যিলালিল কোরআন, ২৯ খন্ড) আল্লাহ বলেন, যে বিশ্বাস করেনি এবং নামায আদায় করেনি, বরং যে সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিলো এবং মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো এরপর সে তার পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে গিয়েছিলো দম্ভ ভরে, দুর্ভোগ তোমার জন্য দুর্ভোগ (৩১-৩৫, ৭৫)।
আবু জেহেল প্রথম দিনেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামায আদায় করতে দেখে তাকে নামায থেকে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে, একবার নবী (সা.) মাকামে ইবরাহীমের কাছে নামায আদায় করছিলেন, আবু জেহেল সে পথ দিয়ে যাচ্ছিল, সে বললো, মোহাম্মাদ আমি কি তোমাকে এ কাজ করতে নিষেধ করিনি? সাথে সাথে সে হুমকিও দিলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ও হুমকি দিয়ে জবাব দিলেন এরপর আবু জেহেল বললো, মোহাম্মাদ আমাকে কেন ধর্মক দিচ্ছো? দেখো এই মক্কায় আমার মজলিস হচ্ছে সবচেয়ে বড়, আবু জেহেলের এর উদ্ধত কথায় আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাযিল করেন, আচ্ছা সে যেন মজলিসকে ডাকে (তাফসীরে ফী যিলালিল কোরআন, সাইয়েদ কুতুব শহীদ, পারা ৩০, পৃ.২০৮) আমিও শাস্তি দেয়ার ফেরেশতাদের ডাক দিচ্ছি।
এক বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু জেহেলের চাদর গলার কাছে ধরে বললেন, দুর্ভোগ, তোমার জন্য দুর্ভোগ, আবার দুর্ভোগ, তোমার জন্য দুর্ভোগ (ঐ)
একথা শুনে আল্লাহর দুশমন আবু জেহেল বললো, হে মোহাম্মাদ আমাকে হুমকি দিচ্ছো? খোদার কসম, তুমি এবং তোমার পরওয়ারদেগার আমার কিছুই করতে পারবে না, মক্কার উভয় পাহাড়ের মাঝে চলাচলকারীদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে বেশী সম্মানিত মানুষ।
পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হুমকি সত্বেও আবু জেহেল তার নির্বুদ্ধিতামূলক আচরণ থেকে বিরত থাকেনি, বরং তার দুস্কৃতি আরো বেড়ে গিয়েছিলো, সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, কোরাইশ সর্দারের কাছে একদিন আবু জেহেল বললো, মোহাম্মাদ আপনাদের সামনে নিজের চেহারা ধুলায় লাগিয়ে রাখে কি? কোরাইশ সর্দাররা বললো, হাঁ, আবু জেহেল বললো, লাত এবং ওযযার শপথ, আমি যদি তাকে এ অবস্থায় দেখি, তবে তার ঘাড় ভেঙ্গে দেবো, তার চেহারা মাটিতে হেচড়াবো, এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামায আদায় করতে দেখে তার ঘাড় মটকে দেয়ার জন্য সে অগ্রসর হলো, কিন্তু সবাই দেখলো যে, আবু জেহেল চিৎকার হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে এবং চিৎকার করে বলছে, বাচাও, বাচাও, পরিচিত লোকেরা জিজ্ঞাসা করলো, আবুল হাকাম, তোমার কি হয়েছে? আবু জেহেল বললো, আমি দেখলাম যে, আমার এবং মোহাম্মাদের মাঝখানে আগুনের একটি পরিখা, ভয়াবহ সে আগুনের পরিখায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথা শুনে বললেন, যদি সে আমার কাছে আসতো, তবে ফেরেশতা তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছিড়ে ফেলতো (সহীহ মুসলিম)।
একদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে এ ধরনের যুলুম অত্যাচারমূলক ব্যবহার করা হচ্ছিলো অন্যদিকে তার প্রতি মক্কার যে সাধারণ মানুষের গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা ছিলো, তারা তাকে তার মহান ব্যক্তিত্বের কারণে অসাধারণ মর্যাদা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতো, উপরন্তু তারা চাচা আবু তালিবের সমর্থন ও সহায়তা তার প্রতি ছিলো, তা সত্ত্বেও তার প্রতি এসব অত্যাচার করা হচ্ছিল, ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণকারী মুসলমানদের প্রতি, বিশেষত দুর্বল মুসলমানদের প্রতি পৌত্তলিকদের অত্যাচার নির্যাতন ছিলো আরো ভয়াবহ, প্রত্যেক গোত্র তাদের গোত্রের ইসলাম গ্রহণকারীদের শাস্তি দিচ্ছিল, যারা মক্কার গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলো না তাদের ওপর উচ্ছৃঙ্খল এবং নেতৃস্থানীয় লোকেরা নানা প্রকার অত্যাচার নির্যাতন চালাতো, সেসব অত্যাচারের বিবরণ শুনলে শক্ত মনের মানুষও অস্থির হয়ে উঠতো।
কোন সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত মানুষের ইসলাম গ্রহণের কথা শুনলে আবু জেহেল তাকে গালমন্দ ও অপমান করতো, এছাড়া সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত কারার হুমকি দিতো, কোন দুর্বল মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে ধরে প্রহার করতো এবং অন্যদেরও প্রহার করতে অন্যদের উৎসাহিত করতো (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩২০)।
হযরত ওসমান ইবনে আফফান (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর তার চাচা তাকে খেজুরের চাটাইয়ের মধ্যে জড়িয়ে ধুয়ো দিত (রহমাতুল লিল আলামীন ১ম খন্ড, পৃ.৫৭)।
হযরত মাসয়াব ইবনে ওমায়ের (রা.) এর মা তার ইসলাম গ্রহণের খবর শোনার পর পুত্রের পানাহার বন্ধ করে দেয় এবং তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়, হযরত মাসয়াব ছোট বেলা থেকে স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে আরাম-আয়েশে জীবন কাটিয়েছেন, পরিস্থিতির কারণে তিনি এমন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন যে, তার গায়ের চামড়া খোলস ছাড়ানো সাপের গায়ের মতো হয়ে গিয়েছিলো (ঐ পৃ. ৫৮)।
হযরত বেলাল (রা.)ছিলেন উমাইয়া ইবনে খালফের ক্রীতদাস, ইসলাম গ্রহণের পর উমাইয়া হযরত বেলাল (রা.)কে গলায় দড়ি বেধে উচ্ছৃঙ্খল বালকদের হাতে তুলে দিত, বালকেরা তাকে মক্কার বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতো, এ রকম করায় তার গলায় দড়ির দাগ পড়ে যেতো, উমাইয়া নিজেও তাকে বেধে নির্মম প্রহারে জর্জরিত করতো, এরপর উত্তপ্ত বালির ওপর জোর করে শুইয়ে রাখতো, এ সময়ে তাকে অনাহারে রাখা হতো, পানাহার কিছুই দেয়া হতো না, কখনো কখনো দুপুরের রোদে মরু বালুকার ওপর শুইয়ে বুকের ওপর ভারি পাথর চাপা দিয়ে রাখতো, এ সময় বলতো, তোমার মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত এভাবে ফেলে রাখা হবে তবে বাচতে চাইলে মোহাম্মাদের পথ ছাড়ো, কিন্তু তিনি এমনি কষ্টকর অবস্থাতেও বলতেন, আহাদ, আহাদ, তার ওপর নির্যাতন চলতে দেখে হযরত আবু বকর (রা.) একদিন খুবই ব্যথিত হলেন, তিনি হযরত বেলাল (রা.)কে একটি কালো ক্রীতদাসের পরিবর্তে মতান্তরে দুশো দিরহামের পরিবর্তে ক্রয় করে মুক্তি দেন (রহমাতুল লিল আলামীন ১ম খন্ড, পৃ. ৫৭, তালাকিহে ফুহুম, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৩১৮)।
হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসের (রা.) ছিলেন বনু মাখযুমের ক্রীতদাস, তিনি এবং তার পিতামাতা ইসলাম গ্রহণের পর তাদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন শুরু করা হলো, আবু জেহেলের নেতৃত্বে পৌত্তলিকরা তাদেরকে উত্তপ্ত রোদে বালুকাময় প্রান্তরে শুইয়ে কষ্ট দিতো, একবার তাদের এভাবে শাস্তি দেয়া হচ্ছিলো, এমন সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি বললেন, হে ইয়াসের পরিবার, ধৈর্যধারণ করো, তোমাদের ঠিকানা হচ্ছে জান্নাত।
অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হযরত ইয়াসের (রা.) ইন্তেকাল করেন, তার স্ত্রী হযরত আম্মারের মা হযরত ছুমাইয়া (রা.) এর লজ্জাস্থানে দুর্বৃত্ত আবু জেহেল বর্শা নিক্ষেপ করে, এতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন, তিনি ছিলেন ইসলামের প্রথম শহীদ, হযরত আম্মারের ওপর তখনো অব্যাহতভাবে অত্যাচার চালানো হচ্ছিল, তাকে কখনো উত্তপ্ত বালুকার ওপর শুইয়ে রাখা হতো, কখনো বুকের ওপর ভারি পাথর চাপা দেয়া হতো, কখনো পানিতে চেপে ধরা হতো, পৌত্তলিকরা তাকে বলতো যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি মোহাম্মাদকে গালি না দেবে এবং লাত ওযযা সম্পর্কে প্রশংসনীয় কথা না বলবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা তোমাকে ছাড়তে পারব না, হযরত আম্মার (রা.) বাধ্য হয়ে তাদের কথা মেনে নেন, এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কাঁদতে কাঁদতে হাযির হন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তখন পবিত্র কোরআনের এই আয়াত নাযিল করেন, কেউ তার ঈমান আনার পর আল্লাহকে অস্বীকার করলে এবং কুফুরির জন্যে হৃদয় উন্মুক্ত রাখলে তার ওপর আপতিত হবে আল্লাহর গযব এবং তার জন্যে আছে সহজ শাস্তি কিন্তু তার জন্যে নয়, যাকে কুফুরির জন্যে বাধ্য করা হয়, কিন্তু তার চিত্ত ইমানে অবিচলিত থাকে (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৩২০, ফেকহুছ সীরাত, মোহাম্মাদ গাযযালি, পৃ.৮২, আওফি হযরত ইবনে আব্বাস থেকে এর কিছু অংশ বর্ণনা করেছেন, দেখুন তাফসীরে ইবনে কাসির)।
হযরত খাব্বাব ইবনে আরত (রা.) খোজায়া গোত্রের উম্মে আনসার নামে এক মহিলার ক্রীতদাস ছিলেন পৌত্তলিকরা তার ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালাতো তাকে মাটির ওপর টানতো (রহমাতুল লিল আলামীন, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৭. এজাযুত তানযিল পৃ. ৫৩) তার মাথার চুল ধরে টানতো এবং ঘাড় মটকে দিতো, কয়েকবার জ্বলন্ত কয়লার ওপর তাকে শুইয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিলো যাতে তিনি উঠতে না পারেন (ঐ, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৭, তালকিহুল ফহুম পৃ. ৬০)।
যিন্নীরাহ (যিন্নিরাহ মিসকিনার ওবনে অর্থাৎ ওই শব্দের মতোই হবে এ শব্দের উচ্চারণ) নাহদিয়া এবং তাদের কণ্যা এবং উম্মে উবাইস ছিলেন ক্রীতদাসী, এরা ইসলাম গ্রহণ করে পৌত্তলিকদের হাতে কঠোর শাস্তি ভোগ করেন, শান্তির কিছু দৃষ্টান্ত ওপরে তুলে ধরা হয়েছে বনু আদী গোত্রের একটি পরিবার বনু মোযাম্মেলের একজন দাসী ইসলাম গ্রহন করেছিলেন, হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) তখনো ইসলাম গ্রহন করেননি, তিনি সেই দাসীকে অস্বাভাবিক প্রহার করে বিরতি দিয়ে বলতেন, তোমার প্রতি দয়ার কারণে নয় বরং নিজে ক্লান্ত হয়েই ছেড়ে দিলাম (রহমাতুল লিল আলামিন, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৭, ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ.৩১৯)
পরিশেষে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হযরত বেলাল এবং আমের ইবনে ফোহায়রার মতোই এসব দাসীকেও ক্রয় করে মুক্ত করে দিয়েছিলেন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩১৮-৩১৯)।
পৌত্তলিকরা বীভৎস উপায়েও ইসলাম গ্রহণকারীদের শাস্তি দিতো, তারা কোন কোন সাহাবীকে উট এবং গাভীর কাচা চামড়ার ভেতর জাড়িয়ে বেধে রোদে ফেলে রাখতো, কাউকে লোহার বর্ম পরিয়ে তপ্ত পাথরের ওপর শুইয়ে রাখতো, কারো ইসলাম গ্রহণের খবর পেলে দুর্বৃত্ত পৌত্তলিকরা নানা উপায়ে তার ওপর অত্যাচার এবং নির্যাতন চালাতো, মোট কথা আল্লাহর মনোনীত দ্বীন গ্রহণকারীদের ওপর যে সব নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতন করা হয়েছিলো তার তালিকা খুবই দীর্ঘ এবং বড়োই বেদনাদায়ক (রহমাতুল লিল আলামিন, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৮)।
দারে আরকাম
অত্যাচারের এবং নির্যাতনের ভয়াবহ এ অবস্থায় কৌশল হিসাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের বলেছিলেন যে, প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণের কথা নতুন মুসলমানরা যেন প্রচার না করেন, তাছাড়া দেখা সাক্ষাত এবং মেলামেশার ব্যাপারে মুসলমানরা যেন গোপনীয়তার আশ্রয় নেন, কেননা আল্লাহর রাসূলের সাথে মুসলমানদের দেখা সাক্ষাতের কথা যদি অমুসলিমরা শোনে তাহলে তারা ইসলামের শিক্ষা দীক্ষার প্রসারে বাধা সৃষ্টি করবে, ফলে উভয়ের পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কা তীব্র হয়ে উঠবে, নবুয়তের চতুর্থ বছরে এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছিল, ঘটনাটি হচ্ছে, সাহাবায়ে কেরাম ঘাটিতে একত্রিত হয়ে নামায আদায় করতেন, একবার সে অবস্থায় তাদের একদল পৌত্তলিক দেখে ফেলে, এ সময় তারা মুসলমানদের গালাগাল করতে শুরু করে এবং লড়াই ঝগড়া শুরু করে, এ পর্যায়ে হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.)একজন লোককে এমনভাবে প্রহার করলেন যে তাতে, রক্ত গড়িয়ে গেলো, ইসলামে এটা ছিলো রক্তপাতের প্রথম ঘটনা (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ২৬৩ মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ মোহাম্মাদ আবদুল ওয়াহাব)।
এ ধরনের সংঘর্ষ বারবার ঘটলে এবং দীর্ঘায়িত হলে মুসলমানদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো, এ কারণে গোপনীয়তার কৌশল অবলম্বন করা ছিলো অত্যাবশ্যক, এই কৌশল অনুযায়ী সাধারণ সাহাবায়ে কেরাম তাদের ইসলাম গ্রহণ, এবাদত বন্দেগী, তাবলীগ, পারস্পরিক দেখা সাক্ষাৎ মেলামেশা সবই গোপনভাবে করতেন, তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাবলীগে দ্বীন এবং এবাদত সব কিছুই প্রকাশ্যে করতেন, কোন বাধাই তাকে এ কাজ থেকে বিতর রাখতে পারেনি, তবুও তিনি মুসলমানদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ এবং আলাপ আলোচনার ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করতেন, আরকাম ইবনে আবুল আরকাম মাখযমীর ঘর সাফা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ছিলো, এখানে পৌত্তলিক বিদ্রোহীরা আসত না একারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুয়তের পঞ্চম বছর থেকে দারে আরকামকে দ্বীনের দাওয়াত এবং মুসলমানদের সাথে মেলামেশার কেন্দ্র রূপে নির্ধারণ করেন (মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ মোহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব নজদী পৃ. ৬১)।