খন্দক ও কোরায়যার যুদ্ধের পর সামরিক অভিযান
এক) সালাম ইবনে আবুল হাকিকের হত্যাকান্ড
সালাম ইবনে আবুল হাকিকের কুনিয়ত ছিলো আবু রাফে। এই লোকটি ছিলো ইহুদীদের সেইমব নিকৃষ্ট অপরাধীদের অন্যতম, যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ধন-সম্পদ এবং খাদ্য-সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করেছিলো। এছাড়া রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামতেও সে কষ্ট দিয়েছিলো। এসব কারণে মুসলমানরা বনু কোরায়যা থেকে মুক্ত হওয়ার পরে খাযরাজ গোত্রের কয়েজন সাহাবা আবু রাফেকে হত্যার অনুমতি চাইলেন। এর আগে কা’ব ইবনে আশরাফের হত্যাকান্ডে আওস গোত্রের কয়েকজন সাহাবা অংশগ্রহণ কছিলেন, কারণে খাযরাজ গোত্রের সাহাবাদের আগ্রহ ছিলো যে, তারাও ওই ধরনের কোন কৃতিত্বের পরিচয় দেবেন। তাই, তারা আবু রাফেকে হত্যার জন্যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুমতি চাইলেন।[ ফতহুল বারী, সপ্তম খন্ড, পৃ. ৩৪৩]
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের অনুমতি দিলেন বটে তবে তাকিদ দিলেন যে, নারী ও শিশুদের হত্যা করো না। এরপর পাঁচজন সাহাবার সমন্বয়ে গঠিত একটি দল নিজেদের অভিযানে রওয়ানা হলেন। এ সকল সাহাবা খাযরাজ গোত্রের বনু সালমা শাখার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আর তাদের কমান্ডার নিযুক্ত হলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আতিক।
এই ক্ষুদ্র দল খয়বর অভিমুলে রওয়ানা হলেন। কেননা আবু রাফের দুর্গসদৃশ বাসভবন সেখানেই ছিলো। সাহাবারা কয়বর গিয়ে যখন পৌছুলেন, তখন সূর্য ডুবে গেছে। সবাই নিজের জিনিসপত্র নিয়ে ঘরে ফিরছে। আবদুল্লাহ ইবনে আতিক তার সঙ্গীদের বললেন, তোমরা এখানেই অপেক্ষা করো, আমি যাচ্ছি। দরজার প্রহরীর সাথে কোন বাহান করে আমি ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করছি। এরপর তিনি গেলেন। দরজার কাছাকাছি গিয়ে মাথায় কাপড় ঢাকা দিয়ে এমনভাবে বসে পড়লেন যে, দেখে মনে হয় কেউ প্রস্রাব করতে বসেছে। প্রহরী আওয়ায দিলো, ওহে আল্লাহর বান্দ, ভেতরে যেতে চাইলে যাও, আমি দরজা বন্ধ করছি।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আতিক বলেন, আমি ভেতরে প্রবেশ করে আত্মগোপন করে রইলাম। সব লোক ভেতরে গেছে মনে করে প্রহরী দরজা বন্ধ করে একটি খুঁটির সাথে চাবি ঝুলিয়ে রাখলো। বেশ কিচুক্ষণ পর চারিদিকে নীরব নিঝুম হয়ে এলে আমি উঠে চাবি নিলাম এবং দরজা খুলে দিলাম। আবু রাফে দোতলায় একটি কামরায় থাকতো। সেখানে আমোদ-প্রমোদের মজলিস হতো। মজলিসের লোকেরা চলে গেলে আমি ওপরের দিকে উঠতে লাগলাম। কোন দরজা খুললেই সেটি ভেতর থেকে বন্ধ করে দিতাম। মনে মনে ভাবলাম কেউ যদি আমার আগমন টের পেয়েও যায় তবু তার আসার আগেই আমি রাফেকে হত্যা করবো। এক সময়ে আবু রাফের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম, কিন্তু ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটা ঘরে শুয়েছিলো। সে ঘর ছিল অন্ধকার। আবু রাফে কোন জায়গায় ছিলো সেটা বোঝা যাচ্ছিলো না। আবু রাফেকে আওয়ায দিলাম। সে বললো, কে ডাকে? আমি দ্রুত আওয়ায লক্ষ্য করে অগ্রসর হলাম এবং তরবারি দিয়ে আঘাত করলাম। কিন্তু খুব উত্তেজনার মধ্যে থাকায় কিছু করতে পারিনি। আঘাত লক্ষ্যচ্যুত হলো। এদিকে আবু রাফে চিৎকার করে উঠলো। আমি দ্রুত কামরা থেকে বেরিয়ে কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করে বললাম, আবু রাফে, কিসের আওয়ায শুনলাম? সে বললো তোমার মা বরবাদ হোক, একজন লোক এখনই আমাকে এক কামরায় তরবারি দিয়ে আঘিাত করেছে।
আবদুল্লাহ ইবনে আতিক বলেন, এবার আমি কাফে গিয়ে আবু রাফেকে পুনরায় আঘাত করলাম। এ আঘাত লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো না। ফলে আবু রাফে রক্তাক্ত হয়ে গেলো। কিন্তু তখনো তাকে আমি হত্যাত করতে পারিনি। এ কারণে তলোয়ারের মাথা তার পেটে ঢুকিয়ে দিলাম। তলোয়ারের ধারালো মাথা তার পেট ভেদ করে পিঠ পর্যন্ত ঢুকে গেলো। মনে মনে ভাবলাম, তাকে হত্যা করতে পেরেছি। এরূপ চিন্তার পর বাইরে বেরোতে শুরু করলাম। একটা দরজা খুলছি আর বেরুচ্ছি। একটা দরজা খুলে সিঁড়ির কাফে রাখলাম। ভেবেছিলাম যে, নীচে পৌছে গেছি। কিন্তু সেটা ছিলো ভুল । অতর্কিতে নীচে পড়ে গেলাম। জোৎস্না রাত ছিলো। পায়ের গোড়ালি মচেকে গেলো। পাগড়ি খুলে ভালোভাবে পা বাঁধলাম। এরপর দরজায় এসে বসে রইলাম। মনে মনে ভাবলাম, আবু রাফেকে প্রকৃতই হত্যা করতে পেরেছি কিনা, এটা না জানা পর্যন্ত এখান থেকে যাবো না।
ভোররাতে মোরগ ডাকার পর একজন লোক বাড়ীর ছাদে উঠে উচ্চস্বরে বলতে লাগলো যে, হেজাযের অধিবাসী, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবু রাফের মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করছি।
আবদুল্লাহ ইবনে আতিক বলেন, আমি তখন সঙ্গীদের কাফে গিয়ে বললাম, পালাও আল্লাহর ইচ্ছায় আবু রাফে তার কৃতকর্মের ফল লাভের জায়গায় পৌছে গেছে। এরপর আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌঁছে আমি সব ঘটনা খুলে বললাম। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, পা বাড়িয়ে দাও, আমি পা বাড়িয়ে দিলাম। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের হাত একটুখানি ছুঁয়ে দিলেন। সাথে সাথে মনে হলো যে, আমার পায়ে কোন ব্যথা ছিলোই না।[ সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৭৭]
এটি সহীহ বোখারীর বর্ণনা। ইবনে ইসাহাকে বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে, আবু রাফের ঘরে পাঁচজন সাহাবাই প্রবেশ করেছিলেন এবং সবাই হত্যার কাজে অংশ গ্রহণ করেন। যিনি আবু রাফের দেহে আঘাত করেছিলেন তাঁর নাম ছিলো আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস। এ বর্ণনায় একথাও উল্লেখ রয়েছে যে, রাত্রিকালে আবু রাফেকে হত্যা করার পর আবদুল্লাহ ইবনে আতিকের গোড়ালির হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিলো। অন্য সাহাবারা তাঁকে তুলে নিয়ে এসে দুর্গের দেয়াল সংলগ্ন একটি জলাশয়ের কাছে লুকিয়ে রইলেন। এদিকে ইহুদীরা আগুন জ্বালালো এবং চারিদিক থেকে ছুটে এলো। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কাউকে না পেয়ে তারা নিহত লোকটির কাফে ফিরে গেলো। সাহাবায়ে কেরাম ফিরে আসার সময় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আতিককে ধরাধরি করে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে এলেন।[ ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ২৮৪, ২৮৫]
পঞ্চম হিরীর জিলকত অথবা জিলহজ্জ মাসেই এই সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়। [ রহমতুল লিল আলামীন, ২য় খন্ড, পৃ. ২২৩]
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খন্দক ও কোরায়যার যুদ্ধের পর এবং যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদগন্ড কার্যকর করার পর নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। সেইসব গোত্র এবং লোকদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলেন, যারা শান্তি ও স্তিতিশীলতার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ব্যতীয় শান্তির আশা ছিলো সুদূল পরাহত।
দুই) ছারিয়্যা মোহাম্মদ ইবনে মোসলামা
খন্দক ও কোরায়যার যুদ্ধের পর এটি ছিলো প্রথম সামরিক অভিযান। ত্রিশজন সাহাবার সমন্বয়ে গঠিত একটি দল এই অভিযানে অংশ নেন।
নজদের অভ্যন্তরে বাকরাত এলাকার রিয়ায় এই সেনাদল প্রেরণ করা হয়। হিজরীর ১০ই মহররম এই সেনাদল প্রেরিত হয়। যারিয়া এবং মদীনার মধ্যে সাত রাতের দুরত্ব। লক্ষ্য ছিলো বনু বকর ইবনে কেলাব গোত্রের একটি শাখা। মুসলমানরা ধাওয়া করলে শত্রুরা সকলেই পালিয়ে যায়। মুসলমানরা বকরিসহ বেশ কিছু চতুষ্পদ জন্তু অধিকার করে এবং মহররমের একদিন বাকি থাকতেই মদীনায় এস পৌঁছেন। এরা বনু হানিফা গোত্রের সর্দার ছামামা ইবনে আছাল হানাফীকেও গ্রেফতা করে নিয়ে আসেন। ছামামা ভন্ড নবী মোসায়লামা কাযযাববের নির্দেশে ছদ্মবেশ ধারণ করে রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করতে বেরিয়েছিলো।[ সীরাতে হালাবিয়াড, ২য় খন্ড, পৃ. ২৯৭]
কিন্তু মুসলমানরা ছামামাকে গ্রেফতার করে মসজিদে নববীর একটি খুঁটির সাথে বেঁধে রাখেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ছামামা, তোমার কাছে কি আছে? সে বললো, হে মোহাম্মদ, আমার কাছে আছে কল্যাণ। যদি আপনি আমাকে হত্যা করেন তবে এমন একজন লোককে হত্যা করবেন যার দেহে প্রচুর রক্ত আছে। যদি অনুগ্রহ করেন, তবে এমন একজনকে অনুগ্রহ করবেন যে অকৃতজ্ঞ নয়। যদি ধন-সম্পদ চান, তবে বলুন কি পরিমাণ প্রয়োজন। এসব কথা শোনার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে সেই অবস্থাই ফেলে রাখলেন, দ্বিতীয়বার এসে তিনি একই প্রশ্ন করলেন এবং ছামামা একই জবাব দিলো। এরপর তৃতীয়বা এসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একই প্রশ্ন করলেন এবং সেই একই জবাব দিলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর নির্দেশ দিলেন যে, ছামাকে মুক্ত করে দাও। তাকে মুক্ত করে দেয়া হলো। ছামামা তখন মসজিদে নবনীর কাফে একটি খেজুর বাগানে গিয়ে গোসল করে পবিত্র হলো এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করলো। ইসলাম গ্রহণের পর সে বললো, আল্লাহর শপথ, সমগ্র পৃথিবীতে কোন মানুষের চেহারা আমার দৃষ্টিতে আপনার চেহারার চেয়ে অপ্রিয় ছিলো না। কিন্তু আজ কোন মানুষের চেহারা আপনার চেহারার চেয়ে প্রিয় নয়। আল্লাহর শপথ, বিশ্ব জগতে আপনার দ্বীনের চেয়ে অপ্রিয় দ্বীনের চেয়ে প্রিয়। আপনার সওয়াররা আমাকে এমতাবস্থায় প্রেফতা করেছে যে, আমি ওমরাহ পালনের ইচ্ছা করছিলাম। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে সুসংবাদ দিলেন এবং পালনের নির্দেশ দিলেন। কোরায়শদের কাছে পৌঁছার পর তারা বললো, ছামামা, তুমি বেদ্বীন হয়ে গেছো। তিনি বললেন, না আমি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে মুসলমান হয়েছি। শোনো, তোমাদের কাছে ইমামার কোনো গম আসবে না যতক্ষণ না রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুমতি প্রদান করেন। ইয়ামামা হচ্ছে মক্কাবাসীদের কাছে ক্ষেতের মতো। হযরত ছামামা (রা) দেশে পৌঁছে মক্কায় গম রফতানী বন্ধ করে দিলেন। এতে কোরায়শারা ভীষণ মুশকিলে পড়ে গেলো। তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিকচাত্মীয়তার সম্পর্কের দোহাই দিয়ে লিখলো যেন তিনি ছামামাকে মক্কায় গম রফতানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার অনুরোধ জানান। দয়াল নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাই করলেন।[ যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ১১৯, মোখতাছারুস সিয়ার শেখ আবদুল্লাহ পৃ. ২৯২,২৯৩]
তিন) গোযওয়ায়ে বনু লেহইয়ান
বনু লেইয়ান গোত্রের লোকেরাই রাজিঈ নামক জায়গায় দশজন সাহাবাকে ধোঁকা দিয়ে নিয়ে আটজনকে হত্যা এবং দুইজরকে মক্কাবাসীদের হাতে বিক্রি ছিলো। সেখানে তারা সেই দুইজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। কিন্তু বনু লেহইয়ানদের এলাকা যেহেতু মক্ক্র কাছাকাছি, অথচ কোরায়শ ও মুসলমানদের সাথে চরম বিরোধ চলছিলো। তাই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শত্রুদের অতো কাছাকাছি যাওয়অ সমীচীন মনে করছিলেন না। ইতিমধ্যে কোরায়শদের বিভিন্ন দলের মধ্যে ফাটল ধরেছে, মুসলমানদের বিরোধিতার ক্ষেত্রে তাদের সঙ্কল্পের জোর অনেকটা কমে গেছে এবং পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতও তারা মেনে নিয়েছে। এ কারণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মনে করলেন যে, বনু লেহইয়ানের কাছ থেকে রাজিঈ-এর শহীদদের হত্যার প্রতেোধ গ্রহণের সময় এসেছে। য়ষ্ট হিজরীর রবিউল আউয়াল অথবা জমাদিউল আউয়াল মাসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুইশত সাহাবাসহ বনু লেহইয়ান গোত্র অভিমুখে রওয়ানা হলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে। অন্যদের বলা হলো, তিনি সিরিয়া যাবেন। রসূল প্রথমে উমায এবং উসফান স্থলদ্বয়ের মধ্যখানে অবস্থিত বাতনে গাররান নামক উপত্যকায় পৌঁছেন। সাহাবাদের সেখানেই হত্যা করা হয়। রসূল সেখানে সাহাবাদের জন্যে আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন। এদিকে বনু লেহইয়ান গোত্রের লোকেরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের খবর শুনে পাহাড়ী এলাকায় পালিয়ে গেলো। তাই তাদের কাউকেই আটক করা সম্ভব হলো না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে দুইদিন অবস্থান করেন। বিভিন্ন এলাকায় খন্ড খন্ড দলে বিভক্ত করে সাহাবাদের প্রেরণ করেন। কিন্তু কারো হদিস পাওয়া যায়নিফ পরে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উসফান নামক জায়গায় গিয়ে সেখান থেকে দশজন ঘোড় সওয়ার সাহাবাকে কোরাউল গামীম নামক জায়গায় প্রেরণ করেন। কোরায়শদের তাঁর আগমন সংবাদ জানাতেই তাদের প্রেরণ করা হয়। মোট চৌদ্দদিন বাইরে অবস্থঅনের পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় ফিরে আসেন।
এ অভিযান থেকে ফিরে এসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যায়ক্রমের কয়েকটি সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। এখঅনে সেসব সংক্ষেপে তুলে ধরা হচ্ছে।
চার) ছ্যারিয়্যা গামর
ষষ্ঠ হিজরীর রবিউল আউয়াল বা রবিউস সানিতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চল্লিশজন সাহাবাকে গামর নামক জায়গায় এক অভিযানে প্রেরণ করেন। গামার বনু আছাদ গোত্রের একটি জলাশয়ের নাম। হযরত মুহম্মদ বিন মাসলামা (রা) এর নেতৃত্ব দেন। মুসলমানদের আগমনের খবর পেয়ে শত্রুরা পালিয়ে যায়। মুসলমানরা তাদের দুইশত উট মদীনায় নিয়ে আসে।
পাঁচ) ছ্যারিয়া যুল কেস্সা (১)
ষষ্ঠ হিজরীর রবিউল আউয়াল বা রবিউস সানিতে মোহাম্মদ ইবনে মোসলামার নেতৃত্বে দশজন সাহাবার একটি সেনাদল যুল কেস্সা নামক স্থান অভিমুখে রওয়ানা হন। এই স্থান বনু ছালাবা গোত্রের বসতি এলাকায় অবস্থিত। শত্রুদের সংখ্যা ছিলো একশত। তারা পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করে। সাহাবায়ে কেরাম ঘুমিয়ে পড়লে শত্রুরা আকস্মিক হামলা করে তাদের নয় জনকে হত্যা করে। একমাতা দল নেতা মোহাম্মদ ইবনে মোসলমা বেঁচে যান। তিনি আহত অবস্থায় মদীনায় ফিরে আসেন।
ছয়) ছারিয়্যা যুল কেস্সা (২)
মোহাম্মদ ইবনে মোসলমার (রা) নেতৃত্বে প্রেতির সেনাদলের শাহাদাদের পর ষষ্ঠ হিজরীর রবিউস সানিতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু ওবায়দা (রা)-কে সেনাপতির দায়িত্ব দিয়ে একদল সাহাবাকে যুল কেস্সায় প্রেরণ করেন। চল্লিশ জন সাহাবার এই সেনাদল পূর্বোক্ত নয় জন সাহাবার শাহাদাতের জায়গা অভিমুখে রওয়ানা হন। সারারাত পায়ে হেঁটে তাঁরা যুল কেস্সায় পৌঁছেন। সেখানে যাওয়ার পরই শত্রুদের খুঁজতে শুরু করেন। বনু ছালাবা গোত্রের এই শত্রু দল খুব দ্রুত পাহাড়ী এলাকায় পালিয়ে যায়। মুসলমানরা কিছুতেই তাদের হদিস করতে পারেননি। শুধুমাত্র একজন লোককে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়। সেও ইসলাম গ্রহণ করে। এ অভিযানে বেশ কিছু বকরিসহ পশুপাল মুসলমানদের অধিকারে আসে।
সাত) ছারিয়্যা জামুম
এই সামরিক অভিযান হযরত যায়েদ ইবন হারেছা (রা)-এর নেতৃত্বে ষষ্ঠ হিজরীর রবিউস সানিতে জামুম নামক এলাকায় প্রেরণ করা হয়। জামুম মাররাজ জাহরান বর্তমান ফাতেমা প্রান্তরে বনু ছুলাইম গোত্রের একটি জলাশয়ের নাম। হযরত যায়েদ (রা) সেখানে পৌঁছার পর মুজাইনা গোত্রের হালিমা নামের এক মহিলাকে গ্রেফতার করেন। সেই মহিলা বনু ছুলাইমের একটি জায়গার নাম মোজাহেদদের জানিয়ে দেন। সেখান থেকে বকরিসহ বহু পশু এবং কয়েদী মুসলমানদের অধিকারে আসে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই মেয়েটিকে মুক্ত করে বিয়ে দেন।
আট) ছারিয়্যা গাইছ
এই অভিযানে সৈন্য সংখ্যা ছিলো ১১৭। এই অভিযানও হযরত যায়েদ ইবনে হারেছার (রা) নেতৃত্বে ষষ্ঠ হিজরীর জমাদিউল উলায় এই একই উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়। এতে কোরায়শদের একটি বাণিজ্য কাফেলার মালামাল মুসলমানদের হাতে আসে। সেই কাফেলা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জামাত হযরত আবুল আসের নেতৃত্বে সফর করছিলো। আবুল আস তখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। তাঁকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তিনি দ্রুত পলায়ন করে মদীনা এসে স্ত্রী যয়নবের (রা) কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এরপর নিজ স্ত্রীকে অনুরোধ করেন তিনি যেন তাঁর আব্বা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলে অধিকৃত কাফেলার মালামালগুলো ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করেন। হযরত যয়নব (রা) আব্বাকে স্বামীর অনুরোধের কথা জানান। হযরত যয়নব (রা)-এর অনুরোধের প্রেক্ষিতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের মালামাল ফেরত দেয়ার ইঙ্গিত করেন। কোন চাপ সৃষ্টি করেননি। সাহাবায়ে কেরাম সব ধন-সম্পদ ফেরত দেন। এসব মালামালসহ আবুল আস মক্কায় চলে যান এবং কোরায়শদের সব মালামাল তাদের বুঝিয়ে দিয়ে পুনরায় মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতপূর্বেকার বিবাহ অনুযায়ীই হযরত যয়নবকে (রা) হযরত আবুল আসের হাতে তুলে দেন।[ছুনানে আবু দাউদ, দ্রষ্টব্য]
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কন্যা-জামাতার বিবাহ নবায়ন করাননি যেহেতু তখনো মুসলমান মহিলাদের জন্যে কাফের স্বামীর সাথে বসবাস করা হারাম হওয়ার আয়াত নাযিল হয়নি। তবে একটি হাদীসে আছে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত যয়নব ও আবুল আস-এর বিবাহ নতুন করে দিয়েছিলেন। এই হাদীসটি অর্থ ও ছনদের দিক থেকে সঠিক নয়।[ তোহফাতুল আহওয়াজি, ২য় খন্ড, পৃ. ১৯৫, ১৯৬] উভয় দিক থেকেই দুর্বল। যারা এই যয়ীফ হাদীসের বরাত নে, তারা আশ্চর্য রকমের বিপরীতধর্মী কথা বলেন। তারা বলেন যে, আবুল আস অষ্টম হিজরীর শেষদিকে মক্কা বিজয়ের কিছুদিন আগে ইসলাম গ্রহণ করেন। তারা এও উল্লেখ করেন যে, অষ্টম হিজরীর প্রথমদিকে হযরত যয়নব (রা) ইন্তেকাল করেন। অথচ বিপরীতধর্মী এ দু’টি বক্তব্য মেনে নেয়া যায়না। কারণ, এরূপ অবস্থায় আবুল আস-এর ইসলাম গ্রহণ এবং হিজরত করে মদীনায় পৌঁছার সময় হযরত যয়নব তো (রা) জীবিতই ছিলেন না। এমতাবস্থায় পূর্বতন বিয়ে বা নতুন বিবাহের মাধ্যমে কিভাবে তাঁকে আবুল আরস-এর হাতে তুলে দেয়া হয়েছিলো?
প্রখ্যাত লেখক হযরত মূসা ইবনে ওকবা (রা) উল্লেখ করেছেন যে, এই ঘটনা সপ্তম হিজরীতে আবুল বাছির এবং তার বন্ধতের হাতে ঘটেছিলো। কিন্তু এ তথ্য সহীহ বা যঈফ কোন হাদীস অনুযায়ীই নির্ভুল নয়।
নয়) ছ্যারিয়্যা তরফ বা তরক
এই অভভিযান হযরত যায়েদ ইবনে হারেছার (রা) নেতৃত্বে জমাদিউস সানিতে তরফ বা তরক এলাকায় পাঠানো হয়। এটি বনু ছালাবা এলাকায় অবস্থিত। হযরত যায়েদ (রা)-এর সাথে পনের জন সাহাবা ছিলেন। বেদুনরা খবর পেয়েই পালিয়ে যায়। তারা আশঙ্কা করছিলো যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আসছেন। হযরত যায়েদ (রা) চারটি উট অধিকার করেন এবং চারদিন পর মদীনায় ফিরে আসেন।
দশ) ছারিয়্যা ওয়াদিউল কোরা
এ অভিযানে সৈন্যসংখ্যা ছিলো বারো। এরও নেতা ছিলেন হযরত যায়েদ ইবনে হারেছা (রা)। ষষ্ঠ হিজরীর রজব মাসে তিনি ওয়াদিউল কোরা অভিমুখে রওয়ানা হন। শত্রুদের গতিবিধির প্রতি লক্ষ্য রাখাই ছিলো উদ্দেশ্য। কিন্তু ওয়াদিউল কোরার অধিবাসীরা তাঁদের ওপর হামলা করে। এতে নয়জন সাহাবা শহীদ হন। হযরত যায়েদসহ তিনজন সাহাব বেঁচে যান।[ রহমতুল লিল আলামীন, ২য় খন্ড, পৃ. ২২৬, যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. ১২০, ১২১,১২২ এবং তালকিহুল ফুহুমি আললিল আছার-এর হাশিয়া, ২৮, ২৯, দ্রষ্টব্য]
এগার) ছারিয়্যা খাবাত
অষ্টম হিজরীর রযব মাসে এটি পরিচালিত হয়। তবে ঘটনা প্রবাহে লক্ষ্য করলে মনে হয় যে, হোদায়বিয়ার সন্ধির আগে তা পরিচালিত হয়েছিলো। হযরত জাবের (রা) বলেন, হযরত আবু ওবায়দা ইবনে জাররাহর নেতৃত্বে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনশহ সওয়ারীকে প্রেরণ করেন। কোরায়শদের একটি বাণিজ্য কাফেলার সন্ধানই ছিলো এর উদ্দেশ্য। এ অভিযানের সময় আমরা ভীষণ ক্ষুধার্ত ছিলাম। এমনকি গাছের পাতা পর্যন্ত খেয়েছি। একারণে এ অভিযানের নামকরণ করা হয়েছে খাবাত। গাছ থেকে পেড়ে নেয়া পাতাকে বলা হয় খাবাত। এরপর চরম ক্ষুধায় অতিষ্ঠ হয়ে তিনটি করে পর্যায়ক্রমে নয়টি উট যবাই করা হয়। আবু ওবায়দা (লা) এরপর আর কোন উট যবাই করতে দেননি। পরে সমুদ্র থেকে আম্বর নামক একটি নদীর কিনারায় এসে ধরা দেয়। সেই মাঝ থেকে আমরা পনের দিন যাবত আহার এবং এর তেল ব্যবহার করেছি।
এতে আমাদের স্বাস্থ্য স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। হযরত আবু ওবায়দা (রা) সেই বিশাল মাছের পিঠে একটা কাঁটা তুলে নেন। সৈন্যদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা এবং উটের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু উট একপাশে নেয়া হয়। এরপর লম্বা লোকটিকে উটের পিঠে বসিয়ে কাঁটার নিচু দিয়ে যেতে বলা হয়। উটের পিঠে সওয়ার হয়ে সেই লোকটি অনায়াসে কাঁটার নিচু দিয়ে পেরিয়ে যায়। আমরা সেই মাছের কিছু অংশ রেখে দিয়েছিলাম। মদীনায় পৌঁছার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এ বিষয়ে আলোচনা করেছি। তিনি বললেন, এটি হচ্ছে আল্লাহর সেযেক। এই রেযেক তিনি তোমাদের বন্যে ব্যবস্থা করেছেন। এই মাছের অংশ যদি তোমাদের কাছে থাকে তবে আমাকেও খাওয়াও। আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাসায় কিছু মাছ পাঠিয়ে দিলাম। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এখানেই সমাপ্ত।[ সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ. ৬২৫, ৬২৬, সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড. পৃ. ১৪৫, ১৪৬]
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঘটনা প্রবাহে বোঝা যায়, এটি হোদায়বিয়ার সন্ধির আগের ঘটনা। কারণ, এই সন্ধির পরে মুসলমানরা কোরায়শদের বাণিজ্য কাফেলা অধিকারের চেষ্টা করেনি।
গোযওয়া বনি মুস্তালেক
এ অভিযান সামরিক দৃষ্টিতে বড় কিন্তু ছিলো না। তবে এ অভিযানের প্রাক্কালে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যার করণে ইসলামী সমাজে অস্থিরতা এবং হৈ চৈ পড়ে যায়। এ কারণে একদিকে মোনাফেকদের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে অন্যদিকে এমন কিছু আইন-কানুন নাযিল হয়েছে যেসব কারণে ইসলামী সমাজ মর্যাদার ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র লাভ করে। ইসলামী সমাজ একটি বিশেষ রূপরেখা ও অবয়ব অর্জন করে। প্র্রথমে আমরা গোযওয়া বা সামরিক অভিযানের কথা উল্লেখ করবো পরে বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করবো।
সীরাত রচয়িতার বিবরণ অনুযায়ী পঞ্চম বা ষষ্ঠ হিজরীর শাবান মাসে এ অভিযান পরিচালিত হয়।[ যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই সামরিক অভিযান থেকে ফেরার পথেই ‘ইফ্কের’ ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ হযরত আয়েশা (রা)-এর নামে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়েছিলো। হযরত যয়নব (রা)-এর সাথে আল্লাহর রসূলের বিয়ে এবং মুসলিম মহিলাদের জন্য পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পরে এ ঘটনা ঘটেছিলো। হযরত যয়নব (লা) এর বিয়ে হয়েছিলো পঞ্চম হিজরীর শেষদিকে অর্থাৎ জিলকত বা জিলহজ্জে মাসে। একথা সর্বসম্মত যে, এ সামরিক অভিযান শাবান মাসে পরিচালিত হয়েছিলো। কাজেই পঞ্চম হিজরীর শাবান নয় বরং ষষ্ঠ হিজরীর শাবান মাস হতে পারে। পক্ষান্তরে যারা এ সামরিক অভিযানের সময়কাল পঞ্চম হিজরীর শাবান মাস বলে উল্লেখ করেছেন, তাদের যুক্তি এই যে, ‘ইফক’ বিষয়ক হাদীসে এই ঘটনার বিবরণীতে হযরত সা’দ ইবনে মা’য ইবনে মা’য (রা) পঞ্চম হিজরীর শেষদিকে বনু কোরায়যার সামরিক অভিযানের পরে ইন্তেকাল করেন। এ কারণে ‘ইফূকের’ ঘটনা সময় তাঁর উপস্থিত থাকর যক্তি এই যে, এ ঘটনা এ সামরিক অভিযান ষষ্ঠ হিজরীতে বরং পঞ্চম হিজরীতে পরিচালিত হয়েছিলো।
প্রথম পক্ষ এর জবাবে বলেছেন যে, ইফূকের হাদীসে হযরত সা’দ ইবনে মা’য এর উল্লেখ রাবীর অর্থাৎ বর্ণনাকারীর ভুল। কেননা এ হাদীসই হযরত আয়েশা থেকে ইবনে ওতবা বর্ণনা করেছেন। সনদ হচ্ছে হযরত আয়েশা (রা) থেকে আবদুল্লাহ ইবনে ওতবা এবং আবদুল্লাহ ইবনে ওতবা থেকে যুহরী। এতে সা’দ ইবনে মা’য-এর পরিবর্তে উছাইদ ইবনে খুযাইর-এর উল্লেখ রয়েছে। ইমাম আবু মোহাম্মদ ইবনে হাযম বলেন, নিঃসন্দেহে এটিই সহীহ, সা’দ ইবনে মা’য-এর উল্লেখ কল্পনাপ্রসূত। (দ্রষ্টব্য যাদুল মায়দ, ২য় খন্ড, পৃ. ১১৫) যদিও প্রথম পক্ষের বক্তব্য যথেষ্ট জোরালো মনে হয় এবং সে কারণে প্রথমে আমিও তার সাথে একমত হয়েছিলাম, কিন্তু চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, এ ব্যখ্যার মূলকথা হচ্ছে, আল্লাহর রসূলের সাথে হযরত যয়নবের (রা) বিয়ে পঞ্চম হিজরীর শেষদিকে হয়েছিলো। ইঙ্গিতধর্মী কিছু কথা ছাড়া এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। অথচ উফুকের ঘটনায় এবং পরে হযরত সা’দ ইবনে মা’য-এর (ইন্তেকাল পঞ্চম হিজরী) বিদ্যমান থাকার ঘটনা বিভিন্ন সহীহ বর্ণনা থেকে প্রমাণিত থাকার ঘটনা বিভিন্ন সহীহ বর্ণনা থেকে প্রমাণিত। সেসব থাকার ঘটনা বিভিন্ন সহীহ বর্ণনা থেকে প্রমাণিত থাকার ঘটনা বিভিন্ন সহীহ বর্ণনা থেকে প্রমাণিত। সেসব বর্ণনাকে বল্পনাপ্রসূত বলে আখ্যায়িত করা মুশকিল। কাজেই এটাই সত্য যে, হযরত যয়নবের (রা) বিয়ে চতুর্থ হিজরীর শেষ বা পঞ্চম হিজরীর প্রথমদিকে হয়েছিলো। পরবর্তীতে সেকথাই বলা হয়েছে। উফুকের ঘটনা এবং বনু মুস্তলিকের সামরিক অভিযান পঞ্চম হিজরীর শাবান মাসে পরিচালিত হয়েছিলো।] ঘটনাক্রমে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতে পারেন যে, বনু মোস্তালিক এর সরদার হারেস বিন আবি যারার নিজ গোত্র ও অন্যান্য আরব গোত্রের সাথে নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসছে। এ খবরের সত্যতা যাচাইয়ের জন্যে হযরত বুরাইদা ইবনে হাছাইব আসলামি(রা)-কে প্রেরণ করেন। তিনি গিয়ে হারেছ ইবনে আবি যেরারের সাথে আলোচনা করেন। ফিরে আসার পর তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সবকিছু অবহিত করেন।
রসূল সব কিছু জেনে নিশ্চিত হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরামকে প্রস্তুতির নির্দেশ দেন। অবিলম্বে এ অভিযান পরিচালিত হয়। শাবান মাসেই দুই তারিখে সাহাবারা রওয়ানা হন। এ অভিযানে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কিছু সংখ্যক মোনাফেকও ছিলো, যারা এর আগে অন্য কোন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি। মদীনার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রসূল হযরত যায়েদ ইবনে হরেছা মতান্তরে হযরত আবু যর মতান্তরে নুমাইল ইবনে আবদুল্লাহ লাইছি (রা)-কে অর্পণ করেন। হারেছ ইবনে আবি ওযরার এবং তার সঙ্গীরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওয়ানা হওয়ার খবর পেয়ে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো। তারা এ খবরও পেয়েছিলো যে, তাদরে প্রেরিত গুপ্তচরতে হত্যা করা হয়েছে। হারেছের সঙ্গী বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোরিসিঈ জলাশয়ের [মোরিসিঈ কাদিদ এলাকার সমুদ্র উপকূলে বনি মুস্তালিক গোত্রের একটি জলাশয়ের নাম। দেখু সহীহ বোখারীর কিতাবুল আতাক ১ম খন্ড, পৃ. ৩৪৫, ফতহুল বারী, ৭ম খন্ড, পৃ. ৪৩১ ] সামনে উপস্থি হলে বনু মুস্তালিক গোত্র যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবারাও প্রস্তুত হন।
সমগ্র ইসলামী সৈন্যের অধিনায়ক ছিলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক ( রা)। আনসারদরে পতাকা হযরত সা’দ ইবনে ওবাদার (রা) হাতে দেয়া হয়। কিচুক্ষণ যাবত তীর বিনিময় হয়। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লারেম নির্দেশে সাহাবায়ে কেরাম একযোগে হামলা করে জয়লাভ করেন। পৌত্তলিকদের কিছুসংখ্যক নিহত য়। মহিলা ও শিশুদের বন্দী করা হয়। বকরিসহ পশুপালও মুসলমানদের অধিকারে আসে। মুসলমানদের মধ্যে শুধু একজন নিহত হন। তাও একজন আনসার তাকে ভুলে শত্রুপক্ষের লোক মনে করে আঘাত করেছিলেন।
এ যুদ্ধ সম্পর্কে সীরাত রচয়িতারা এটুকুই লিখেছেন। আল্লামা ইবনে কাইয়েম এসব বিবরণ কল্পনাপ্রসূত বলে বাতিল করে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, এ অভিযানে লড়াই হয়নি বরং শত্রুদের ওপর হামলা করে নারী শিশু এবং পশুপাল অধিকার করা হয়। সহীহ বোখরীতে উল্লেখ রয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনু মুস্তালেকের ওপর যখন হামলা করেন, সেই সময় তারা গাফেল ছিলো। অর্থাৎ এ ধরনের হামলার জন্যে তারা প্রস্তুত ছিলো না। হাদীস দ্রষ্টব্য।[সহীহ বোখার, কিতাবুল আতাক ১ম খন্ড, পৃ. ৩৪৫, ফতহুল বারী, সপ্তম খন্ড, পৃ. ৪৩১]
বন্দীদের মধ্যে হযরত জুয়াইরিয়াহও (রা) ছিলেন। ইনি বনি মুস্তালেক গোত্রের সর্দার হারেস ইবনে আবি যেরারের কন্য ছিলেন। তিনি ছাবেত ইবনে কায়েসের মালিকানাধীন ছিলেন। হযরত ছাবে জুয়াইরিয়াহকে মাকাতের করে নেন।[‘মাকাতের’ সেই ক্রীতদাস বা দাসীকে বলা হয়, যারা মালিকের সাথে এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয় যে, নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করে মুক্তি অর্জন করবে।] এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে তাঁকে মুক্ত করে বিয়ে করেন। এই বিয়ের কারণে মুসলমানরা বনু মুস্তালেক গোত্রের একশত পরিবারকে মুক্ত করে দেন। এরা সবাই ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্বশুরকূলের লোক হিসাবে তাদের মুক্তি প্রদান করা হয়।[যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ১১২, ১১৩, ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ২৮৯, ২৯০, ২৯৪, ২৯৫]
এই হচ্ছে যুদ্ধের বিবরণ। এই যুদ্ধের সময়ের অন্যান্য ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন। সেই ঘটনাবলীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য উফুকের ঘটনা। এই ঘটনার জন্যে মোনাফেক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই দায়ী। এইা মোনাফেক এবং তার বন্ধু-বান্ধবরা এই ঘটনা রটিয়েছিলো। কাজেই প্রথমে ইসলামী সমাজে তাদের ন্যক্কারজনক ভূমিকার ওপর সংক্ষেপে আলোকপাত করে পরে ঘটনার বিবরণ বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হবে।
বনি মুস্তালেকের যুদ্ধের আগে মোনাফেকেদের ভূমিকা
ইতিপূর্বে একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি সাধারণভাবে এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রত বিশেষভাবে শত্রুতা ছিলো। আওস ও খাযরাজ গোত্র তার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো। তার অভিষেকেরও আয়োজন করা হয়েছিলো। আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মাথায় পরানোজ জন্যে মুং-এর মুকুট তৈরী করা হচ্ছিলো। এমনি সময়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিপ্লবী আলোর আভা নিয়ে মদীনায় আগমন করেন। এর ফলে মদীনর সর্বস্তরের জনসাধারণের দৃষ্টি আবদুল্লাহর ওপর থেকে সরে যায়। এই লোকটি অতপর ভাবতে শুরু করে যে, আল্লাহর রসূলই তার বাদশাহী কেড়ে নিয়েছেন।
আবদুল্লাহ ইবনে উবাই-এর জিঘাংসা ও ক্রোধের প্রকাশ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের শুরুতেই ঘটেছিলো। সে তখনো ইসলামের প্রতি বাহ্যিক আনুগত্য প্রকাশ করেনি। পরবর্তী সময়ে ইসলারেম প্রতি বাহ্যিক আনুগত্য প্রকাশ করলেও তার মনোভাবে কোন পরিবর্তন ঘটেনি। ইসলামের প্রতি বাহ্যিক আনুগত্য প্রকাশের আগে একদিন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গাধার পিঠে ওসয়ার হয়ে হযরত সা’দ ইবনে ওবাদার সেবার জন্যে যাচ্ছিলেন।
পথে এক জনসমাবেশের কাঠে দিয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাচ্ছিলেন। সে ভবিষ্যতের মোনাফেক আবদুল্লাহ ইবনে উবাইও ছিলো। সে চাদরে নিজের নাক ঢেকে বললো, আমাদের উপর ধুলো উড়িও না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমাবেশের লোকদের উদ্দেশ্যে আল্লাহর পাক কালাম তেলাওয়াত করছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বললো, আপনি নিজের ঘরে বসে থাকুন, আমাদের মজলিসে এসে বিরক্ত করবেন না।[ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৮৪, ৫৮৭, সহীহ বোখারী ২য় খন্ড, পৃ. ৯২৪, সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ. ১০৯]
এটা হচ্ছে ইসলারেম প্রতি তার বাহ্যিক আনুগত্যের আগের কথা। বদরের যুদ্ধের পর বাতাসের গতিবেগ লক্ষ্য করে আবদুল্লাহ উবাই ইসলাম গ্রহণ করে। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পরও এই ঘৃণীত লোকটি ছিলো আল্লাহ তায়ালা, তাঁর প্রিয় রসূল এবং মুসলমানদের শত্রু। ইসলামী সমাজে বিশ্রঙ্খলা সৃষ্টি এবং ইসলামের আওয়ায দুর্বল করার কাজে সে বিন্দুমাত্র কসুর করেনি। সে পর্যায়ক্রমে ইসলামবিরোধী কাজ চালিয়ে যায়। ইসলামের শত্রুদের সাথে তার নির্ভেজাল ও আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। বনু কায়নুকা গোত্রের ব্যাপারে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই অত্যন্ত আপত্তিকরভাবে নাক গলিয়েছিলো। এ সম্পর্কে পূর্বে আলোকপাত করা হয়েছে। একইভাবে এই দুর্বৃত্ত ওহুদের যুদ্ধেও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ, বিশ্রঙ্খলা, হতাশা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলো। এ সম্পর্কেও পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে।
এই মোনাফেক ইসলাম গ্রহণের পর প্রতি শুক্রবর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খোতবা দেয়ার আগে মসজিদে নববীতে উঠে দাঁড়িয়ে বলতো, হে লোক সকল, তিনি তোমাদের মাঝে আল্লাহর রসূল, আল্লাহ তায়ালা তাঁর মাধ্যমে তোমাদের মর্যাদা ও সম্মান প্রদান করেছেন। কাজেই তাঁকে সাহায্য করো, তাঁর হাতকে শক্তিশালী করো, তাঁর কতা শোনো এবং মানো। এসব কথা বলে সে বসে পড়তো। এরপর তার বেহায়াপনা এবং হঠকারিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলো যে, ওহুদের যুদ্ধের পর প্রথম জুমার সময়েও সে একই রকম কথা বলতে শুরু করলো। অথচ ওহুদের যুদ্ধে তার ইসলাম বিরোধী ভূমিকা সম্পর্কে সকলেই ছিলেন অবহিত। এবার কথা বলার সময়ে বিভিন্ন দিক থেকে মুসলমানরা তার কাপড় টেনে ধরে বললেন, হে আল্লাহর দুশমন বসে যাও। তুমি যে কাজ করেছ এরপর তোমার মুখে এ ধরনের কথা শোভা পায় না। এ ধরনের প্রতিকূলতার মুখে সে লম্বা লম্বা পা ফেলে উদ্ধতভাবে বাইরে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় বিড়বিড় করে বলছিলো, আমি ওদরে সহযোগিতা জন্যে দাঁড়ালাম, মনে হয় যেন অপরাধ করে ফেলেছি। আমি কি কোন দোষের কথা বলেছি? দরজায় একজন আনসারের সাথে দেখা হলো। তিনি বললেন, তোমার ধ্বংস হোক, ফিরে চলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমার মাগফেরাতের জন্যে দোয়া করবেন। সে বললো, খোদার কসম, আমি চাই না যে তিনি আমার জন্যে মাগফেরাতের দোয়া করুন।[ ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ১০৫]
এছাড়া আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বনু নাযির গোত্রের সাথেও সম্পর্ক স্থাপন করে এবং তাদের সাথে মিলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র করতে থাবে।
একইভাবে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার বন্ধুরা খন্দরেক যুদ্ধে মুসলমানদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং তাদেরকে প্রভাবিত করার নানারকম ষড়যন্ত্র করতে থাকে। আল্লাহ তায়ালা সূরা আহযাবে এস সম্পর্কে বলেন, ‘এবং ওদের এক দল বলেছিলো, হে ইয়াসরেববাসী, এখানে তোমাদের কোন স্থান নেই, তোরা ঠিরে চলো এবং ওদরে একদন নবীর কাছে অব্যাহতি প্রার্থনা করে বলছিলো, আমাদের বাড়ীঘর অরক্ষিত অথচ সেগুলো অরক্ষিত ছিলো না। আসলে পলায়ন করাই ছিলো ওদের উদ্দেশ্য। যদি শত্রুরা নগরীর বিভিন্ন দিক হতে প্রবেশ করে ওদরে বিদ্রোহের জন্যে প্ররোচিত করতো, ওরা অবশ্যই তাই করে বসতো। ওরা এতে কালবিলম্ব করতো না। এরা তো পূর্বেই আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করেছিলো যে, এরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে না। আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার সম্পর্কে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা হবে। বল, তোমাদের কোন লাভ হবে না, যদি তোমরা মৃত্যু বা হত্যার ভয়ে পলায়ন কর এব সেই ক্ষেত্রে তোমাদেরকে সামান্যই ভোগ করতে দেয়া হবে। বল, কে তোমাদেরকে আল্লাহ থেকে রক্ষা করবে, যদি তিনি তোমাদের অমঙ্গল ইচ্ছা করেন এবং তিনি যদি তোমাদেরকে অনুগ্রহ করতে ইচ্ছা করেন, কে তোমাদের ক্ষতি করবে? ওরা আল্লাহ ব্যতীত নিজেদের কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না। আল্লাহ অবশ্যই জানেন, তোমাদের মধ্যে কারা তোমাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধা দেয় এবং তাদের ভাইদের বলে, আমাদের সঙ্গে এসো। ওরা অল্পই যুদ্ধে অংশ নেয়, (নিলেও তা নেয়) তোমাদের ব্যাপারে কৃপণতাবশত। যখন বিপদ আসে তখন তুমি দেখবে, মৃত্যভয়ে মূর্চ্ছাতুর ব্যক্তির মত চোখ উল্টিয়ে ওরা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু যখন বিপদ চলে যায়, তখান ওরা ধনের লালসায় তোমাদের তীক্ষ্ণ ভাষায় বিদ্ধ করে। ওরা ঈমান আনেনি, এ জন্যে আল্লাহ ওদের কার্যাবলী নিষ্ফল করেছেন এবং আল্লাহর পক্ষে এটা সহজ। ওরা মনে করে, সম্মিলিত বাহিনী হতো যদি ওরা যাযাবর মরুবাসীদের সঙ্গে থেকে তোমাদের সংবাদ নিত। ওরা তোমাদের সঙ্গে অবস্থান করলেও ওরা অল্পই যুদ্ধ করতো।’ (সূরা আহযাব, আয়াত ১৩-২০)
উল্লিখিত আয়াতগুলোতে মোনাফেকদের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-ভাবনা, কাজকর্ম, মানসিক অবস্থা, স্বার্থপরতা মোটকথা সুযোগ সন্ধানী চরিত্রের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা তলে ধরা হয়েছে।
এসব কিছু সত্তেও ইহুদী, মোনাফেক এবং পৌত্তলিক অর্থাৎ ইসলামের সকল শত্রুরা একথা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলো যে, ইসলামের বিজয়ের কারণ বস্তুগত শক্তি এবং অস্ত্রশস্ত্রের আধিক্য নয়। এই বিজয় প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর আনুগত্য এবং চারিত্রক মূল্যবোধের মধ্যে নিহিত। এর দ্বারা সমগ্র ইসলামী সমাজ এবং ইসলামের সাথে সম্পর্কিত সকল মানুষই সাফল্য লাভ করে। ইসলারেম এসব শত্রু একথাও জানতো যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যক্তিত্বেই এ সকল সাফল্যের উৎস, যাঁর চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব হচ্ছে তুলনাবিহীন আদর্শ।
ইসলামের এ সকল শত্রু পাঁচ বছর যাবত চেষ্টা করার পর বুঝেছিলো যে, এই দ্বীনের অনুসারীদের অস্ত্রের দ্বারা নাস্তানাবুদ করা সম্ভব নয়। এ কারণে তারা সম্ভবত এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলো যে, চারিত্রক ক্ষেত্রে কলঙ্ক আরোপের মাধ্যমে এই দ্বীনের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা চালানো যাবে। এ উদ্দেশ্যে তারা আল্লাহর রসূলকেই বেছে নিয়েছিলো। মোনাফেকরা যেহেতু মুসলমানদের মধ্যেই থাকতো এবং মদীনায় বসবাস করতো, তাই মুসলমানদের সাথে অনায়াসে মেলামেশার সুযোগ পেতো। এর কারণে মুসলমানদের অনুভূতিতেহ তারা সহজেই আঘাত দিতে সক্ষম ছিলো। সুতরাং এ প্রোপাগান্ডাপর দায়িত্ব মোনাফেকরা নিজেদের ওপরেই নিয়েছিলো। মোনাফেক সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এ প্রোপাগান্ডার দায়িত্ব নিজের ওপর তুলে নিয়েছিলো।
এ পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র একবার সেই সময় প্রকাশ পেয়েছিলো, যখন হযরত যায়েদ ইবনে হারেছা (রা) হযরত যয়নবকে (রা) তালাক দিলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বিয়ে করেছিলেন। আরবের নিয়ম ছিলো যে, পালক পুত্রকে তারা নিজ সন্তানের মতোই মনে করতো এবং তার স্ত্রীকে ও আপন পুত্র বধূর মতোই হারাম মনে করতো। এ কারণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত যয়নব (রা)-কে বিবাহ করার পর মোনাফেকরা তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারণায় লিপ্ত হয়। এতে তারা অপপ্রচারের দু’টি মোক্ষম বিষয় খুঁজে পায়।
প্রথমত হযরত যয়নব (লা) ছিলেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লারেম পঞ্চম স্ত্রী। অথচ পবিত্র কোরআনে একজন মুসলমানের জন্যে চারজনের বেশী স্ত্রী রাখার অনুমতি ছিলো না। কাজেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বিবাহ কিভাবে বৈধ হতে পারে?
দ্বিতীয়ত হযরত যয়নব (রা) ছিলেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পালক পুত্র হযরত যায়েদ (রা)-এর স্ত্রী। এ কারণে আরবদের রীতি অনুযায়ী পালকপুত্রের স্ত্রীকে বিবাহ করা ছিলো গুরুতর অপরাধ এবং মহাপাপ। অপপ্রচারকারীরা এক্ষেত্রে অনেক প্রোপাগান্ডাপ চালালো এবং নানারকম কথাও রটালো। তারা এমনও বলাবলি করছিলো যে, মোহাম্মদ যয়নবকে হঠাৎ দেখেছিলেন এবং তার রূপসৌন্দর্য দেখে এতোই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তখনই যয়নবকে ভালোবেসে ফেলেন। তাঁর পালকপুত্র যায়েদ একথা জানার পর যয়নবের পথ মোহাম্মদের জন্যে পরিষ্কার করে দেন।
মোনাফেকরা এ কাহিনী এমনভাবে প্রচার করেছিলো যে, এ সম্পর্কিত আলোচনা সমালোচনা তখনো অব্যাহত রয়েছে। সরল সহজ মুসলমানদের মনে এ প্রচারণা এতো প্রভাব বিস্তার করেছিলো যে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে আয়াত নাযিল করেন। তাতে এতদ বিষয়ের সমুচিত জবাব দেয়া হয়। বিষয়টির গুরুত্ব এটা থেকেই বোঝা যায় যে, সূরা আহযাবের শুরুতেই আল্লাহ রব্বুল আলামীন এ বিষয়ে উল্লেখ করে বলেন, ‘হে নবী, আল্লাহকে ভয় করো এবং কাফের ও মোনাফেকদের আনুগত্য করবে না। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা আহযাব, আয়াত ১)
মোনাফেকদের কর্মতৎপরতার প্রতি এখানে ইঙ্গিত করে তাদের রূপরেখা সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোনাফেকদের এসব কর্মতৎপরতা ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও নম্রতার সাথে সহ্য করছিলেন। সাধারণ মুসলমনারাও মোনাফেকদের কর্মতৎপরতা থেকে আত্মরক্ষা করে ধৈর্যের সাথে দিন কাটাচ্ছিলেন। কেননা তারা জানতেন যে , মোনাফেকদের আল্লাহ তায়ালা নানাভাবে অপনানিত ও লাঞ্ছিত করবেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ওরা কি দেখে না যে, প্রতি বছর দুই একবা বিপর্যয় হয়? এরপরও ওরা তাওবা এবং উপদেশ গ্রহণ করে না (সূরা তাওবা, আয়াত ১২৬)
বনু মোস্তালেকের গোযওয়ায় মোনাফেকদের কর্মকান্ড
বনু মোস্তালেকের সামরিক অভিযানের সময় মোনাফেকরাও অংশগ্রহন করেছিলো। এ অভিযানের সময় তারা যা করেছিলো, আল্লাহ তায়ালা পাক কালামে তার পরিচয় তুলে ধরেছেন, ‘ওরা তোমাদের সাথে বের হলে তোমাদের বিভ্রান্তিই বৃদ্ধি করতো এবং তোমাদের মধ্যে ফেতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তোমাদের মধ্যে ছুটাছুটি করতো।’ (সূরা তাওবা, আয়াত ৪৭)
এই অভিযানে মুসলনমানদের বিরুদ্ধে মনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশের জন্যে তাদের দু’টি সুযোগ এসেছিলো। তারা মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক অস্থিরতা ও বিশ্রঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলো এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অপপ্রচার চালিয়েছিলো। ঘটনা দু’টির মোটামোটি বিবরণ এই –
এক) নিকৃষ্টতম ব্যক্তিকে বহিষ্কারের কথা
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনু মোস্তালেকের সামরিক অভিযান শেষে মোরিসিঈ জলাশয়ের পাশে অবস্থান করছিলেন। এমন সময় কিছু লোক সেই জলাশয়ে পানি তোলার জন্যে গেলো। তাদের মধ্যে হযরত ওমর (রা)-এর একটি কাজের লোকও ছিলো। তার নাম যাহজা গেফারী। পানি আনতে গিয়ে ছেনান ইবনে অবর জুহানির সাথে তার প্রথমে কথা কাটাকাটি এবং উভয়ের হাতাহাতি শুরু করলো। এরপর জুহানি বললো, হে আনসাররা, সাহায্য করো। যাহজাও চিৎকার করে বললো, হে মোহাজেররা সাহায্য করো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খবর পাওয়ার সাথে সাথে গিয়ে বললেন, আমি তোমাদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছি, অথচ তোমরা আইয়ামে জাহেলিয়াতের মতো আওয়ায দিচ্ছো? ওকে ছেড়ে দাও, সে দুর্গন্ধময়।
এ ঘটনার খবর পেয়ে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ক্রোধে ফেটে পড়লো। সে বললো, ওরা বুঝি এমন কাজ করেছে? আমাদের এলাকায় সে আমাদের প্রতিপক্ষ এবং শত্রু হয়ে গেছে? আমাদের এ অবস্থা দেখে তো প্রাচীনকালের প্রবাদের সত্যতাই প্রমাণিত হয়, নিজের কুকুরকে লালন-পালন করে মোটাতাজা করো যাতে, সে তোমাকে কামড়ে ছিন্ন ভিন্ন করতে পারে। শোনো, মদীনায় পৌঁছানোর পর আমাদের মধ্যেকার সম্মানিত ব্যক্তি নিকৃষ্টতম ব্যক্তিকে মদীনা থেকে বের করবে। পরে উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ্যে বললো, এ বিপত তোমরাই ডেকে এনেছো। তোমরা তাকে নিজের শহরে থাকতে এবং নিজেদের ধন-সম্পদের অংশ দিয়েছ। দেকো, তোমাদের কাছে যা কিছু আছে, সেসব দেয়া যদি বন্ধ করো, তবে সে তোমাদের শহর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে।
সেই সময় একজন উঠতি বয়সের সাহাবা হযরত যায়েদ ইবনে আরকামও সেখানে ছিলেন। তিনি এসে তার চাচার কাছে সব কথা বললেন। তার চাচা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবহিত করলেন। সেই সময় হযরত ওমরও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রসূল, ওব্বাদ ইবনে বিশরকে বলুন, ওকে হত্যা করে ফেলুক। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ওমর এটা কি করে সম্ভব? মোহাম্মদ তার সঙ্গীদের হত্যা করবে। তুমি বরং আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা ঘোষণা করো। সেই সময় কখনো কোথাও রওয়ানা হওয়ার সময় নয়। এরূপ সময়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোথাও রওয়ানা হতেন না। সাহাবারা যাত্রা শুরু করলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে তাঁকে সালাম জানিয়ে বললেন, আজ আপনি অসময়ে রওয়ানা হয়েছেন? তিনি বললেন, তোমাদের সঙ্গী যা কিছু বলেছে, সে সব কিছু কি তুমি জানো? হযরত উসাইদ বললেন, কি বলেছে? তিনি বললেন, সে বলেছে, মদীনায় যাওয়ার পর মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি নিকৃষ্টতম ব্যক্তিকে মদীনা থেকে বের করবে। হযরত উসাইদ বললেন, হে আল্লাহর রসূল, যদি আপনি চান তবে তাকে মদীনা থেকে বের করে দিন। আল্লাহর শপথ, সে নিকৃষ্ট এবং আপনি সম্মানিত। এরপর তিনি বললেন, হে আল্লাহর রসূল, ওর সাথে নরম ব্যবহার করুণ। আল্লাহর শপথ, আল্লাহ তায়ালা আপনাকে আমাদের মধ্যে এমন সময় এনেছিলেন, যখন স্বজাতীয়রা ওর অভিষেক অনুষ্ঠানের জন্যে মনিমুক্তার মুকুট তৈরী করেছিলো। এ করণে সে মনে করে যে, আপনিই তার বাদশাহী কেড়ে নিয়েছেন।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অতপর সেদিন সকাল থেক বিকেল পর্যন্ত এবং পরদিন সূর্য অনেক ওপরে উঠে আসা পর্যন্ত একাধারে হাঁটতে চলতে লাগলেন। এরপর যাত্র বিরতি দেয়ার সাথে সাথে সবাই মাটিতে শরীর রাখার পরই বেখবর হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটাই চেয়েছিলেন। সাহাবারা আরামে বসে গালগল্প৪ করবেন, এটা তিনি চাননি।
এদিকে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই খবর পেলো যে, যায়েদ ইবনে আরকাম সব কথা ফাঁস করে দিয়েছে, তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হাযির হয়ে কসম খেতে লাগলো। সে বলতে লাগলো যে, আপনি যা শুনেছেন, তা সত্য নয়, ওসব কতা কস্মিনকালেও আমি বলিনি। আমি ওরকম কথা মুখেও আনিনি। সেই সময় উপস্থিত আনসাররা বললেন, হে আল্লাহর রসূলণ, যায়েদ এখনো ছেলে মানুষ। হয় সে ভুল শুনেছে। আবদুল্লাহ যা বলেছে, যায়েদ তা ভালোভাবে মনে রাখতে পারেনি। তাই আপনি আবদুল্লাহ িইবনে উবাই সম্পর্কে যা শুনেছেন, সব বিশ্বাস করেছেন।
হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা) বলেন, এরপর আমি এতো ব্যথিত হয়েছি যে, ওরকম ব্যথিত আর কখনো হইনি। মনের দুঃখে আমি ঘরে বসে রইলাম। এরপর আল্লাহ তায়ালা সূরা মোনাফেকুন নাযিল করেন। আল্লাহ তায়ালা সেই সূরায় সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, ‘ওরা বলে, আল্লাহ রসূলের সহচরদের জন্যে ব্যয় করো না, যতক্ষণ না ওরা সরে পড়ে।’
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘ওরা বলে, আমরা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলে সেখানে থেকে প্রবল দুর্বলকে বহিষ্কৃত করবো।’
হযরত যায়েদ (রা) বলেন, এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর আল্লাহর রসূল লোক পাঠিয়ে আমকে ডেকে নিলেন এবং অবতীর্ণ আয়াত পাঠ করে শোনালেন, এরপর বললেন, আল্লাহ তায়ালা তোমার কতার সত্যতার সাক্ষী দিয়েচেন।[ সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৯৯ , ২য় খন্ড, পৃ. ২২৭, ২২৮, ২২৯, ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, ২৯০, ২৯১, ২৯২,]
এই মোনাফেরেক এক পুত্রের নামও ছিলো আবদুল্লাহ। তিনি ছিলেন পিতার সম্পূর্ণ বিপরীত। অত্যন্ত পুণ্যশীল, সৎস্বভাব একজন সাহাবা ছিলেন তিনি। পিতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে মদীনার ফটকে এসে তিনি তরবারি হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার পিতাপ আবদুল্লা ইহনে উবাই সেখানে এলে তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ, যতোক্ষণ না রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুমতি দেবেন, ততক্ষণ আপনি সামনে এক পাও এগুতে পারবেন না। কেননা আল্লাহর রসূল সম্মানিত এবং আপনি অপমানিত। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে গিয়ে মোনাফেক সর্দারকে মদীনায় প্রবেশের অনুমতি দান করেন। এই আবদুল্লাহই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেছিলেন, হে আল্লাহর রসূল, আপনি যদি তাকে হত্যা করতে চান তবে আমাকে বলুন, আল্লাহর শপথ, আমি তার মাথা কেচে এনে আপনার সামনে হাযির করবো।[ ইবনে হিশাম, মুখতাছারুস সিরাত, শেখ আবদুল্লাহ পৃ. ২৭৭]
দুই) ইফ্কের ঘটনা
এ অভিযানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, ‘ইফক’ অর্থাৎ চারিত্রিক অপবাদের ঘটনা। এই ঘটনার বিবরণ এই যে, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোথাও সফরে যাওয়ার সহধর্মিনীদের নাম লিখে লটারি করতেন। যার নাম উঠতো, তাকে সফরসঙ্গিনী করতেন। এ যুদ্ধে যাওয়ার সময় হযরত আয়েশার (রা) নাম উঠেছিলো।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে সঙ্গে নিয়ে যান। ফেরার পথে এক জায়গায় যাত্রাডিবরতি ফেলেন। এই হারখানি তিনি তার বোনের কাছ থেকে ধার হিসাবে নিয়েছিলেন। হার নেই দেখে সাথে সাথে খুঁজতে যান। ইতিমধ্যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবারা মদীনার পথে রওয়ানা হয়ে যান। হযরত আয়েশার (রা) হাওদাজ যারা উটের পিঠে রেখে দিতেন, তারা ভেবেছিলেন যে, তিনি হাওদাজের ভেতরেই রয়েছেন। এ কারণে হাওদাজ উটের পিঠে তুলে বেঁধে দেন। হাওদাজ যে বেশী ভারি ছিলো না, একথা তাঁদের মনে আসেনি। কেনা অল্পবয়স্কা হযরত আয়েশা (রা) ছিলেন হালকা পাতলা। কয়েকজন ধরে হাওদাজ তুলেছিলেন, এ কারণে বুঝতে পারেননি যে, ভেতরে মানুষ নেই। দুই একজন হাওদাজ তুললে হালকা হওয়ার ব্যাপারটি হয়তো বুঝতে পারতেন।
মোটকথা, হযরত আয়েশা (রা) হার খুঁজে অবস্থান স্থলে এসে দেখেন সকলেই চলে গেছে, ময়দান খালি। তিনি তখন এই ভেবে বসে পড়লেন যে, তাকে না পেয়ে নিশ্চয়ই কেউ খুঁজতে আসবে। আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই যা ইচ্ছা করেন তাই হয়ে থাকে। হযরত আয়েশা (রা) শুয়ে পড়লেন এবং এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন। ‘ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহধর্মিণী?’ একথা শুনে হযরত আয়েশা (ররা)-এর ঘুম ভেঙ্গে গেলো। একথা বলেছিলেন, হযরত সাফওয়ান ইবনে মোয়াত্তাল (রা)। তাঁর ঘুম ছিলো বেশী। ঘুমকাতুরে এই সাহাবাও পিছিয়ে পড়েছিলেন। তিনি হযরত আয়েশা (রা)-কে দেখেই চিনে ফেললেন। কেননা পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার আগেই তিনি হযরত আয়েশা (রা)-কে দেখেছিলেন। তিনি ইন্নালিল্লাহে পড়ে নিরেজ সওয়ারী হযরত আয়েশা (রা)-এর কাছে নিয়ে বসিয়ে দিলেন। হযরত আয়েশা (রা) সওয়ারীতে আরোহণ করলেন। হযরত সফওয়ান ইন্নালিল্লাহ ব্যতীত একটি কথাও বলেননি। তিনি হযরত আয়েশা (রা)- কে কিছু জিজ্ঞাসাও করেননি। চুপচাপ উটের রশি ধরে হেঁটে হেঁটে কাফেলার কাছে এসে পৌঁছেন।
তখন ছিলো ঠিক দুপুর। কাফেলার সক সেই সময় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হযরত সফওয়ানকে এভাবে আসতে দেখে সাহাবাদের মধ্যে আলোচনা সমালোচনা হতে লাগলো। আল্লাহর দুশমন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মনের ক্লেদ প্রকাশের একটা সুযোগ পেয়ে গেলো। তার অন্তরে ঘৃণা ও হিংসার যে ধিকি-ধিকি আগুন জ্বলছিলো সেই আগুন আরো উস্কে দেওয়ার সে সুযোগ পেলো। সে আল্লাহর রসূলের সহধর্মিনীর নামে অপবাদ রটাতে শুরু করলো। তার সঙ্গী সাথীরাও তার কাছে প্রিয় হওয়ার ন্যে নানা কথা রটনা শুরু করলো। মদীনায় আসার পর ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অপবাদের পত্রপল্লব বিস্তার করা হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব শুনে চুপচাপ রইলেন। তিনি কোন কথাই এ প্রসঙ্গে বললেন না। বেশ কিছুদিন যাবত ওহীও আসেনি। এ অবস্থা দেখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশা (রা)-এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা সম্পর্কে ঘিনিষ্ঠ সাহাবাদের সাথে আলোচনা করলেন। হযরত আলী (রা) ইশারা ইঙ্গিতে বললেন যে, আপনি তাঁর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে অন্য কাউকে বিয়ে করুন। হযরত উসামা (রা) এবং অন্য কয়েকজন সাহাবা বলেন যে, হে আল্লাহর রসূল, হযরত আয়েশাকে তালাক দেবেন না, আপনি শত্রুদের কথায় কান দেবেন না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন মসজিদে নববীর মিম্বরে দাঁড়িয়ে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের দেয়া যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে সাহাবাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। আল্লাহর রসূলের েএকথা শুনে হযরত সা’দ ইবনে মায়া’য আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে হত্যা করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। হযরত সা’দ ইবনে ওবাদা (রা)-এর একথা ভালো লাগল না। তিনি খাযরাজ গোত্রেরর সর্দাম। আবদুল্লাত তাঁরই গোত্রের লোক। এ কারণে তাঁর মনে গোত্রপ্রীতি চাঙ্গা হয়ে উঠলো। এতে সা’দ ইবনে মায়া’য এবং সা’দ ইবনে ওবাদার মধ্যে কথা কাটাকাটি হলো। ফলে উভয় গোত্রের লোকেরা গর্জে উঠলো। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক বুঝিয়ে উভয় পক্ষ কে শান্ত করলেন, এরপর নিজ চুপ রইলেন।
এদিকে হযরত আয়েশা (রা) সফর থেকে এসেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি একমাস শয্যাশায়ী রইলেন। তাঁর নামে রটনা করা অপবাদ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না। তবে, মাঝে মাঝে ভাবছিলেন যে, ইতিপূর্বে অসুস্থতার সময়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সমবেদনাপূর্ণ ব্যবহার করতেন, এবার তা করছেন না। রোগ মুক্তির পর হযরত আয়েশা এক রাতে উম্মে মেসতাহের সাথে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ময়দানে গিয়েছিলেন। ঘটনাক্রমের উম্মে মেসতাহ নিজের চাদরে পা জড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। এতে তিনি নিজের পুত্রকে বদদোয়া করলেন।
হযরত আয়েশা (রা) এতে উম্মে মেসতাহর সমালোচনা করলে তিনি বললেন, আমার পুত্র প্রোপাগান্ডার অপরাধের অংশীদার। একথা বলেই তিনি হযরত আয়েশা (রা)-কে কাঁর নামে রটিত অপবাদের ঘটনা শোনালেন। হযরত আয়েশা (রা) সবকিছু ভালোভাবে জানতে আব্বা আম্মার কাছে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। অনুমতি পেয়ে তিনি নিজের বাড়ীতে গেলেন। সেখানে সব কিছু শোনার পর অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলেন। দুই রাত একদিন কেঁদে কাটালেন। এ সময়ে তিনি চোখও মুছলেন না, ঘুমুতেও গেলেন না। তিনি অনুভব করছিলেন যে, কাঁদতে কাঁদতে যেন বুক ফেটে যাবে। সেই অবস্থায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগমন করলেন। তিনি কালেমা শাহাদাত পাঠ করে এক ভাষণে বললেন, হে আয়েশা, তোমার সম্পর্কে আমার কানে এ ধরনের কথা এসেছে। যদি তুমি এসব থেকে মুক্ত থাকো তবে শীঘ্রই আল্লাহ তায়ালা সেকতা প্রকাশ করবেন। যদি আল্লাহ না করুন, তুমি কোন পাপ করে থাকো, তবে তুমি আল্লাহর কাছে মাগফেরাত চাও, তওবা করো। বান্দা যখন নিজের পাপের কথা স্বীকার করে এবং আল্লাহর কাছে তওবা করে, তখন আল্লাহ তায়ালা সেই তওবা কবুল করেন।
একথা শোনার সাথে সাথে হযরত আয়েশার কান্না থেমে গেলো। একফোটা পানিও তাঁর চোখে এলো না। তিনি তাঁর আব্বা-আম্মাকে জবাব দিতে বললেন। কিন্ত তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না যে, কি জবাব দেবেন। পরে হযরত আয়েশা (রা) নিজেই বললেন, আল্লাহর শপথ, আমি জানি, শুনতে শুনতে একথা আপনাদের মনে গেঁথে গেছে। আপনারা একথা সত্য বলেই মনে করছেন। এখন যদি আমি নির্দোষ হওয়ার কথা বলি, তাহলেও আপনারা বিশ্বাস করবেন না। পক্ষান্তরে যদি আমি দোষ স্বীকার করি, তবেচ আপনারা সেটাই বিশ্বাস করবেন। আল্লাহ তায়ালা ভালোই জানেন যে, আমি নির্দোষ। কাজেই এমতাবস্থায় আমার এবং আপনার অবস্থা হচ্ছে সেই রকম, যেমন হযরত ইউসুফের (রা) পিতা হযরত ইয়াকুযব (রা) বলেছিলেন, সুতরাং পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়, তোমরা বলছো, সে বিষয়ে আল্লাহ তায়ালাই আমার একমাত্র সাহায্যস্থল।
একথার পর হযরত আয়েশা (রা) একপাশে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। ঠিক তখনই রসূলের ওপর ওহী নাযিল হতে শুরু করলো। ওহী নাযিলের কষ্টকর অবস্থা শেষ হওয়ার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিটিমিটি হাসছিলেন। তিনি প্রথমেই বললেন, হে আয়েশা, আল্লাহ তায়ালা তোমার নির্দোষ হওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। তাঁর আম্মা খুশীর সাথে বললেন, আয়েশা, আল্লাহর রসূলের কাছে যাও। হযরত আয়েশা (রা) কৃত্রিম অভিমানের সুরে বললেন, আমি যাব না, আমি তো শুধু আল্লাহর প্রশংসা করবো।
এই ঘটনা সম্পর্কে যেসব আয়াত নাযিল হয়েছে, সেগুলো সূরা নূর-এর অন্তর্ভুক্ত। উক্ত সূরায় দশম আয়াত থেকে শুরু হয়েছে।
এরপর অপবাদ রটানোর অভিযোগে মেসতাহ ইবনে আছাছা, হাস্সান ইবনে ছাবেত এবং হামনা এই তিনজন সাহাবার প্রত্যেককে ৮০টি করে বেত্রাঘাত করা হয়।[কারো ওপর ব্যভিচারের অভিযোগ দিয়ে তা প্রমাণ করা না গেলে তবে অপবাদ রটনাকারীকে ৮০টি বেত্রাঘাত করা ইসলামী শরীয়তের আইন।]
মোনাফেক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের পিঠ সাজা থেকে রক্ষা পায়। অথচ এই অপবাদ রটনায় সে ছিলো শর্ষস্থানে। এ ব্যাপারে সে দুর্বৃত্তই প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলো। তাকে কোন প্রকার শাস্তি দেয় কেন হয়নি?
এর কারণ যাদেকে শাস্তি দেয়া হয়, সেই শাস্তির পরিবর্তে তারা পরকালে ক্ষমা পেয়ে যায়। এই শাস্তি তাদের জন্যে কাফফারা স্বরূপ। আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে যেহেতু আল্লাহ তায়ালা পরকালে কঠোর শাস্তি দেবেন বলে ঘোষণা করেছেন তাই তাকে কোন শাস্তি দেয়া হয়নি। অথবা যে কারণে তাকে হত্যা করা হয়নি, সে কারণেই তাকে কোন শাস্তি দেয়া হয়নি।[ সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৬৪, ২য় খন্ড, পৃ. ৬৯৬, ৬৯৭. ৬৯৮ যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ১১৩, ১১৪, ১১৫, ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ২৯৭-৩০৭]
এমনি করে এক মাস পর মদীনার পরিবেশ থেকে সন্দেহ, সংশয় ও মানসিক অস্থিরতার কালোমেষ কেটে গেলো। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এমনভাবে অপমানিত তলো যে, এই দুর্বৃত্ত পরে আর কখনো মাথা তুলতে পারেনি। ইবনে ইসহাক বলেন, সে এরপর বাড়াবাড়ি করলে তার কওমের লোকেরাই তাকে নাজেহাল করতো। এ অবস্থা দেখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন হযরত ওমর (রা)-কে বললেন, ওমর, তোমার কি মনে হয়? দেখো, সেদিন তুমি যদি ওকে হত্যা করতে, তবে অনেক নাক উঁচু লোকই সমালোচনায় মুখর হতো। আর আজ? এখন যতি ওদেরকেই হত্যার নির্দেশ দেয়া হয় তবে ওসব সমালোচকরাই তাকে হত্যা করবে। হযরত ওমর (রা) বললেন, আল্লাহর শপথ, আমি বুঝেছি যে, আল্লাহর রসূলের বিবেচনা আমার বিবেচনার চেয়ে উত্তম।[ ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ২৯৩]