আরবদের ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মীয় মতবাদ
হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের দাওয়াত ও তাবলীগের কারণে আরবের সাধারণ মানুষ দ্বীনে ইবরাহীমীর অনুসারী ছিল। তারা একমাত্র আল্লাহর এবাদত করত এবং তাওহীদ বা একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু যতোই দিন যেতে লাগলো ততোই তারা দ্বীনের শিক্ষা ভুলে যেতে থাকলো। তবুও তাদের মধ্যে তাওহীদের আলো এবং হযরত ইবরাহীমের শিক্ষা কিছু কিছু অবশিষ্ট ছিল। ইতিমধ্যে বনু খোযাআ গোত্রের সদার আমর ইবনে লোহাই দৃশ্যপটে এলো। ছোটবেলা থেকে এ লোকটি ধর্মীয় পুণ্যময় পরিবেশ প্রতিপালিত হয়েছিল। ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল অসামান্য। সাধারণ মানুষ তাকে ভালোবাসার চোখে দেখতো। নেতৃস্থানীয় ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ মনে করে তারা তার অনুসরণ করতো। এক পর্যায়ে এই লোকটি সিরিয়া সফর করে। সেখানে যে মূর্তিপূজা করা হচ্ছে সে মনে করলো এটাও বুঝি আসলেই একটা ভালো কাজ। সিরিয়ায় অনেক নবী আবির্ভাব হয়েছেন এবং আসমানী কেতাব নাযিল হয়েছে। কাজেই সিরিয়ার জনগণ যা করছে সেটা নিশ্চয়ই ভালো এবং পুণ্যের কাজ। এরূপ চিন্তা করে সিরিয়া থেকে ফেরার পথে সে হোবাল নামের এক মূর্তি নিয়ে এলো। এবং সেই মূর্তি কাবা ঘরের ভেতর স্থাপন করলো। এরপর সে মক্কাবাসীদের সেই মূর্তিপূজার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে শেরেক করার আহবান জানালো। মক্কার লোকেরা ব্যাপকভাবে তার ডাকে সাড়া দিল। মক্কার জনগণকে মূর্তিপূজা করতে দেখে আরবের বিভিন্ন এলাকার লোক তাদের অনুসরণ করলো। কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণ কারদের বৃহত্তর আরবের লোকেরা মরে করতো ধর্মগুরু। (মুখতাছারুস সীরাত শেখ মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব নজদী, পৃ ১২)। এ কারণে তারা মূর্তিপূজায় মক্কার লোকদের অনুসরণ করলো। এমনি করে আরবের মূর্তিপূজার প্রচলন শুরু হলো।
হোবল ছাড়াও আরবের প্রাচীন মূর্তি ছিল মানাত। এ মূর্তি লোহিত সাগরের ঊপকুলে কোদাইদ এলাকার মুসল্লাল নামক জায়গায় স্থাপন করা হয়েছিল । (সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-২২২) এরপর তায়েফ লাত নামে একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়। নাখলা নামক স্থানে ওযযা নামে একটি মূর্তি রেখে তার পূজা করা হয়। এ তিনটি ছিল আরবের সবচেয়ে বড় মূর্তি।
এসব মূর্তির অনুসরণ অল্পকালের মধ্যে হেজাযের শেরকের আধিক্য এবং মূর্তি স্থাপনের হিড়িক পড়ে যায়। বলা হয়ে থাকে যে, একটি জিন আমর ইবনে লোহাইয়ের অনুসারী ছিল। সে আমরকে জানালো যে, নুহের জাতির মূর্তি অর্থাৎ ওয়াদ্দা, সুয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক এবং নাসর জেদ্দায় প্রোথিত রয়েছে।
এ খবর জানার পর আমর ইবনে লোহাই জেদ্দায় গেল এবং এ সকল মূর্তি খুড়ে বের করলো। এরপর সে সব মূর্তি মক্কায় নিয়ে এলো। হ্জ্জ মৌসুমে সেসব মূর্তি বিভিন্ন গোত্রের হাতে তুলে দেয়া হলো। গোত্রগুলো নিজ নিজ এলাকায় সেসব মূর্তি নিয়ে গেল। এমনিভাবে প্রত্যেক গোত্রে এবং পর্যায়ক্রমে প্রত্যেক ঘরে মূর্তি স্থাপিত হলো।
পালাক্রমে পৌত্তলিকরা কাবাঘরকে মূর্তির ঘড়ে পরিপূর্ণ করলো। মক্কা বিজয়ের ঘটনার সময় কাবাঘরে তিনশত ষাটটি মতি ছিল। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম নিজ হাতে সেসব মূর্তি ভাঙ্গন। তিনি একটি ছড়ি দিয়ে গুঁতো দিতেন, সাথে সাথে সে মূর্তি নীচে পড়ে যেতো। এরপর তাঁর নির্দেশ সব মূর্তি কাবাঘর থেকে বাইরে বের করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। (মুখতাছারুস সীরাত, শেখ মোহাম্মদ ইবনে আব্দুলওয়াহাব নজদী, পৃ-১৩, ৫০, ৫১, ৫২, ৫৪) মোটকথা শেরক এবং মূর্তিপূজা ছিল আইয়ামে জাহিলিয়াতে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় কাজ। মূর্তিপূজা করে তারা মনে করতো যে, তারা হযরত ইবরাহীমের দ্বীনের ওপর রয়েছে।
পৌত্তলিকদের মধ্যে মূর্তিপূজার বিশেষ কিছু নিয়ম কানুন প্রচলিত ছিল। এর অধিকাংশই ছিল আমর ইবনে লোহাই এর আবিষ্কার। আমরের এ সকল কাজকে মক্কার লোকেরা প্রশংসার চেখে দেখতো। ইবরাহীমের দ্বীনে পরিবর্তন নয় বরং এ সবকে তারা মনে করতো বেদআতে হাসানা। নীচ পৌত্তলিকদের মূর্তি পূজার কয়েকটি রেওয়াজ তুলে ধরা হচ্ছে-।
এক) আইয়ামে জাহিলিয়াতে পৌত্তলিকরা মূর্তির সামনে নিবেদিত চিত্তে বসে থাকতো এবং তাদের কাছে আশ্রয় চাইতো। তাদের জোরে জোরে ডাকতো এবং প্রয়োজন পূরণের জন্য, মুশকিল আসান বা সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের কাছে সাহায্য চাইতা। তারা বিশ্বাস করতো যে, মূর্তিরা আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে তাদের উদ্দেশ্যে পূরণ করিয়ে দেবে।
দুই) মূর্তিগুলোর উদ্দেশ্যে হ্জ্জ এবং তাওয়াফ করা হতো। তাদের সামনে অনুনয় বিনয় করা হতো তাদের সেজদা করা হতো।
তিন) মূর্তিগুলোর জন্য উপঢৌকন এবং নযরানা পেশ করা হতো। কোরবানীর পশু অনেক সময় মূর্তির আস্তানায় নিয়ে জবাই করা হতো। তবে সেটা করা হতো মূর্তির নামে। জবাইয়ের এই উভয় রকমের কথা কোরআনে আল্লাহ পাক উল্লেখ করেছেন। সেই পশুও হারাম করা হয়েছে যা মূর্তি পূজার বেদীর উপর বলি দেয় হয়।
আল্লাহ পাক আরো বলেন, ওসব পশুর গোশত খেয়োনা যার ওপর আল্লাহর নাম নেয়া হয়নি অর্থাৎ গায়রুল্লাহর নামে জবাই করা হয়েছে এমন কিছুই আহার করো না।
চার) মূর্তির সন্তুষ্টি লাভের একটা উপায় এটাও ছিল যে পৌত্তলিকরা তাদের পানাহারের জিনিস, উৎপাদিত ফসল এবং চতুষ্পদ জন্তুর একাংশ মূর্তির জন্য পৃথক করে রাখতো। মজার বিষয় হচ্ছে তারা আল্লাহর জন্যও একটা অংশ রাখতো। এরপর বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে আল্লাহর জন্য রাখা অংশ মূর্তির কাছে পেশ করতো কিন্তু মূর্তির জন্য রাখা অংশ কোন অবস্থায়ই আল্লাহর কাছে পেশ করতো না।
যেমন আল্লাহ পাক বলেন, আল্লাহ যেসব শস্য ও পশু সৃষ্টি করেছেন তার মধ্যে থেকে তারা আল্লাহর জন্য এক অংশ নিদিষ্ট করে এবং নিজেদের ধারণা অনুযায়ী বলে, এটা আল্লাহর জন্য এবং এটা আমাদের দেবতাদের জন্য। যা তাদের দেবতাদের অংশ তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে না এবং আল্লাহর অংশ তা তাদের কাছে পৌছায়। তারা যা মীমাংসা করে তা বড়ই নিকৃষ্ট।
পাঁচ) মূর্তিদের সন্তুষ্টি পাওয়ার একটা উপায় তারা নির্ধারণ করেছিল যে, পৌত্তলিকরা উৎপাদিত ফসল এবং চতুষ্পদ পশুর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মানত করতো। যেমন আল্লাহ পাক বলেন, তারা তাদের ধারনা অনুসারে বলে, এসব গবাদি পশু ও শস্যক্ষেত্র নিষিদ্ধ, আমরা যাকে ইচ্ছা করি সে ছাড়া কেউ এসব আহার করতে পারবে না এবং কতক গবাদি পশুর পিঠে আরোহণ নিষিদ্ধ করার সময় তারা আল্লাহর নাম নেয়া না।
ছয়) এসব পশুর মধ্যে ছিল বাহিরা, সায়েবা, ওয়াসিলা এবং হামী। ইবনে ইসহাক বলেছেন, বাহিরা সায়েবার কন্যা শাবককে বলা হয়। সাবেরা সেই উটনীকে বলা হয় যার পর্যায়ক্রমে দশবার মাদী বাচ্চা হয়। এর মধ্যে কোন নর বাচ্চা হয় না। এ ধরনের উটনীকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হয়। সেই উটনীর পিঠে সওয়ার করা হয় না। তার পশম কাটা হয় না। মেহমান ছাড়া অন্য কেউ তার দুধ পান করে না। এগারবারের সময় এই উটনী যে বাচ্চা দেয় সেই বাচ্চাকে মায়ের সাথে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হয়। তার পিঠে আরোহণ করা হয় না। তার বাচ্চা হলে সায়েবা।
ওয়াছিলা সেই বকরিকে বলা হয় যে বকরি দুটি করে পাঁচবার পর্যায়ক্রমে মাদী বাচ্চা প্রসব করে। অর্থাৎ পাঁচবার দশটি মাদী বাচ্চা দেয় এর মধ্যে কোন নর বাচ্চা না দেয়। এরপর এসব বকরি ষষ্ঠবারে যে বাচ্চা প্রসব করে সে বাচ্চা শুধু পুরুষরা পাবে, মহিলাদের জন্য সবাই খেতে পারে।
হামী সেই পুরুষ উটকে বলা হয় যার বীর্য থেকে পরপর দশটি মাদী বাচ্চা জন্ম নেয়। এর মাঝে কোন নর বাচ্চা জন্ম নেয় না। এ ধরনের উটের পিঠে সংরক্ষিত করে রাখা হয়। এদের পিঠে কাউকে আরোহণ করতে দেয়া হয় না, গায়ের পশম কাটা হয় না। উটের পালের মধ্যে এ উটকে স্বাধীনভাবে বিচরণের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়। এছাড়া এদের দিয়ে অন্য কোন প্রকার কাজ নেয়া হয় না। আইয়ামে জাহিলিয়াতে প্রচলিত এসব প্রকারের মূর্তি পূজার এবং রীতিনীতির প্রতিবাদ করে আল্লাহ পাক কোরআনে বলেন, ‘বাহিরা, সায়েব ওয়াসিলা এবং হামী আল্লাহ স্থির করেননি কিন্তু কাফেররা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে এবং তাদের অধিকাংশ উপলব্ধি করে না।
আল্লাহ পাক কোরআনে আরো বলেন, ওরা আরো বলে, এসব গবাদি পশুর যা রয়েছে তা আমাদের পুরুষদের জন্য নিদিষ্ট এবং সেটা আমাদের স্ত্রীদের জন্য অবৈধ, আর সেটি যদি মৃত হয় তবে নারী পুরুষ সবাইই ওতে অংশীদার। তাদের এরূপ বলার প্রতিফল তিনি তাদের দেবেন। তিনি প্রজ্ঞানয় ও সর্বজ্ঞ।
চতুষ্পদ পহুদের উল্লিখিত শ্রেণী বিন্যাস অর্থাৎ বাহিরা, সায়েরা, প্রভৃতির অন্য অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, ৮৯-৯০)। ইবনে ইসহাকের ব্যাখ্যায় উল্লেখিত ব্যাখ্যার সাথে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে।
হযরত সাঈদ ইবনে মাসাইয়াব রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, এ সব পশু হচ্ছে ওদের তাগুদদের জন্য। (সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৪৯৯)। সহীহ বোখারীতে বর্ণিত হয়েছে যে, মূর্তির নামে পশু সর্বপ্রথম আমর ইবনে লোহাই ছেড়েছিল। (ঐ)
আরবের লোকেরা এ বিশ্বাসের সাথে এসব আচার অনুষ্ঠান পাল করতো যে, মূর্তি তাদেরকে আল্লাহর কাছাকাছি পৌঁছে দেবে এবং তাদের জন্য আল্লাহ কাছে সুপারিশ করবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, পৌত্তলিকরা বলতো, আমরাতো এদের পূজা এজন্য করি, যে এরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্য এনে দেবে।
আল্লাহ পাক কোরআনে আরো বলেন, ওরা আল্লাহ ছাড়া যার ইবাদত করে তা ওদের ক্ষতিও করে না উপকারও করেনা। ওরা বলে এগুলো আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য সুপারিশকারী। (১৮,১০)
মক্কার পৌত্তলিকরা আযলাম অর্থাৎ ফাল এর তীর ব্যবহার করতো। আযলাম হচ্ছে যালামুন শব্দের বহুবচন। যালাম সেই তীরকে বলা হয় যে, তীরে পালক লাগানো থাকেনা। ফালগিরির জন্য ব্যবহার করা এই তীর তিন প্রকারের হয়ে থাকে। এক প্রকারের তীরে হ্যাঁ এবং না লেখা থাকে। এ ধরনের তীর সফর, বিয়ে ইত্যাদি কাচে ব্যবহার করা হয়। ফালে যদি হ্যাঁ প্রকাশ পায় তবে পরিকল্পিত কাজ করা হয় যদি না লেখা থাকে তবে এক বছরের জন্য স্থগিত রাখা হয়। পরের বছর পুনরায় সে কাজ করার জন্য ফাল এর তীর ব্যবহার করা হয়। ফালগিরির দ্বিতীয় শ্রেণীর তীরে মধ্যে পানি, দীয়ত বা ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি শব্দ উৎকীর্ণ থাকতো।
তৃতীয় প্রকারের তীরের মধ্যে লেখা থাকতো তোমাদের মধ্যে থেকে অথবা তোমাদের বাইরে থেকে। এ ধরনের তীরের কাজ ছিল যে, কারো বংশ পরিচয়ের ক্ষেত্রে সন্দেহ থাকলে তাকে একশত উটসহ হোবাল মূর্তির সামনে হাযির করা হতো।
সেসব উট তীরের মালিক সেবায়েতকে দেয়া হতো। সে এসব তীর একসাথে মিলিয়ে ঘোরাতো। এলোমেলো করতো। এরপর একটি তীর বের করতো। যদি সেই লেখা থাকতো যে, তোমাদের মধ্যে থেকে, তবে সেই ব্যক্তি গোত্রের একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসাবে পরিগণিত হতো। যদি সেই তীরে লেখা থাকতো যে, তোমাদের বাইরের লোক। তবে সেই ব্যক্তিকে শত্রুপক্ষের লোক মনে করা হতো না। তাকে গোত্রের মধ্যে পুবের মধ্যে পুবের মতোই সাধারণভাবে জীবন যাপনের অধিকার দেয়া হতো। (মোহাদেরাতে খাযরামি, ১ম খন্ড, পৃ-৫৬, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ১০২, ১০৩)
পৌত্তলিকদের মধ্যে প্রয় একই ধরনের আরো একটি রেওয়াজ চালু ছিল। সেটা হচ্ছে জুয়া খেলা এবং জুয়ার তীর। এ তীরের চিহ্নিতকরণ অনুযায়ী উট জবাই করে সেই উটের গোশত বণ্টন করা হতো। (এই নিয়ম ছিল এবং যে ব্যক্তি জুয়া খেলতো সে একটি উট জবাই করে দশ অথবা আটাশ ভাগ করতো। এরপর তীর দিয়ে লটারী করা হতো। কোন তীরে জয়ের চিহ্নই থাকত না। যার নামের ওপর জয় সূচক তীর বের হতো তাকে বিজয়ী করা হতো এবং উটের গোশত সে বিনামূল্যে পেতো। যে ব্যক্তির নামে চিহ্ন বিহীন তীর উঠতো তাকে গোশতের মূল্য দিতে হতো। )
আরব পৌত্তলিকরা যাদুকর জ্যোতিষীদের কথার ওপর বিশ্বাস রাখতো। এরা ভবিষ্যতের ভালোমন্দ সম্পর্কে কথা বলতো। কেউ দাবী করতো যে, তার অনুগত একটি জ্বীন রয়েছে সেই জিন তাকে খবর এনে দিচ্ছে। কেউ দাবী করতো যে, তার মধ্যে খোদা প্রদত্ত মেধা এবং বিচক্ষণতা রয়েছে, এই মেধা বিচক্ষণতার কারণে সে নির্ভুল ভবিষ্যৎ বাণী করতে পারে। এদের মধ্যে আররাফ নামে একটা শ্রেণী ছিল। এরা চুরির ঘটনা সম্পর্কে কথা বলতো। চোরাই মাল উদ্ধার এবং চুরির জায়গা এরা সনাক্ত করতো। জ্যোতিষী সেসব লোককে বলা হতো যারা নক্ষত্রের গতি সম্পর্কে গবেষণা করতো এবং হিসাব নিকাশ করে বিম্বের ভবিষ্যৎ ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করতো। (মেরাতুল মাফাতিহ, শরহে মেশকাতুল মাছাবিহ ২য় খন্ড, পৃ২.৩, লাক্ষ্নৌর সংস্কার। )
জ্যোতিষীর কথার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা প্রকৃতপক্ষে নক্ষত্রের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের শামিল। মক্কার পৌত্তলিকরা নক্ষত্রের ওপর বিশ্বাস রাখতো এবং বলতো অমুক অমুক নক্ষত্র থেকে আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়। (সহীহ মোসলেহ, শরহে নববী, কিতাবুল ঈমান। ১ম খন্ড পৃ-৯৫)
একই ধরনের অন্য কাজ তারা ভালোমন্দ নিরূপণের জন্য করতো। সেটা হচ্ছে খরগোশের হাঁটুর একখানি হাড় ঝুলিয়ে দিতো। কিছুদিন, মাস, কিছু নর এবং কিছু নারীকে তারা অশুভ মনে করতো। অসুস্থ লোকদের স্পর্শ থেকে তারা দুরে থাকতো এবং তার দেখাকে ক্ষতিকর মনে করতো। রুহ বেরিয়ে যাওয়ার পর উল্লুকে পরিণত হয় বলে তারা ধারনা করতো। নিহত ব্যক্তির আততায়ীর নিকট থেকে বদলা নেয়া না হলে নিহত ব্যক্তির রুহ শান্তি পায় না বলে তারা বিশ্বাস করতো। নিহত ব্যক্তির আত্মা পাহাড়ে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায় এবং পিপাসা আমাকে পান করাও বলে চিৎকার করতে থাকে বলে তারা বিশ্বাস করতো। হত্যার ক্ষতিপূরণ নেয়া হলে নিহত ব্যক্তির রুহ শান্তি পায় বলে তারা বিশ্বাস করতো। (সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৮৫১, ৮৫৭)।
দ্বীনে ইবরাহীমীতে কোরাইশদের বিবাদ
আইয়ামে জাহেলিয়াতে লোকদের চিন্তা বিশ্বাস কাজ সম্পর্কে মোটামুটি আলোকপাত করা হলো। এসব কিছুর পাশাপাশি দ্বীনে ইবরাহীমীও তারা আংশিকভাবে পালন করতো। অর্থাৎ ইবরাহীমী দ্বীন তারা পুরোপুরি পরিত্যাগ করেনি। তারা কাবাঘর তাওয়াফ করতো, কাবাঘরের সম্মান করতো, হজ্জ এবং ওমরাহ পালন করতো, আরাফাহ এবং মোযদালেফায় অবস্থান করতো এবং হাদীর পশু কোরবানী করতো। তবে দ্বীনে ইবরাহীমীতে তারা বেশ কিছু বেদয়াত যুদ্ধ করেছিল। নীচে কিছু উদাহরণ উল্লেখ করা যাচ্ছে।
কোরাইশদের একটি বেদয়াত ছিল এই যে, তারা বলতো, আমরা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সন্তান। কাবার পাসবান বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, কাবাঘরের তত্বাবধায়ক এবং মক্কার বাসিন্দা, আমাদের সমমর্যাদার কেউ নেই। আমাদের সমতুল্য অধিকার কারো নেই। এ কারণে তারা নিজেদের নামকরণ করতো হুস্ম। অর্থাৎ বাহাদুর এবং গরমজোশ। তারা বলতো, আমাদের এত অসাধারণ মর্যাদা রয়েছে, কাজেই কাবাঘরের সীমানার বাইরে যাওয়া আমাদের শোভনীয় নয়। হজ্জের সময়ে তারা আরাফাতে যেতো না এবং নিয়ম অনুযায়ী সেখানে থেকে প্রত্যাবর্তন করতো না। বরং মোযদালেফায় অবস্থান করে সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করতো। আল্লাহ পাক এই বেদয়াতকে সংশোধন করে বলেন, অতঃপর অন্যান্য লোক যেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করে তোমরাও সেই স্থান থেকে প্রত্যাবর্তন করবে। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৯৯, সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ-২২৬)
পৌত্তলিকদের একটি বেদয়াত ছিল এইযে, তারা বলতো, হুমস অর্থাৎ কোরাইশদের জন্য এহরাম বাঁধা অবস্থায় পনির এবং ঘি তৈরি করা বৈধ নয়। পশমওয়ালা ঘরে অর্থাৎ কম্বলের তাবুতে প্রবেশ হওয়া বৈধ নয়। এটাও নয় যে, ছায়া চামড়ার তাঁবু ছাড়া অন্য কোথাও ছায়া লাভ করবে। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-২০২)
তাদের একটি বেদয়াত এটাও ছিল যে, মক্কার বাইর থেকে যারা হজ্জ বা ওমরাহ করার জন্য আসবে তাদের নিয়ে আসা খাদ্য পানীয় খাওয়া বৈধ নয়। (ঐ)
একটি বেদয়াত এই ছিল যে, তারা মক্কার বাইরে অধিবাসীদের আদেশ দিয়ে রেখেছিল যে, তারা হরমে আসার পর প্রথম যে তাওয়াফ করবে সেই তওয়াফ হুমসে অর্থাৎ কোরাইশদের থেকে নেয়া কাপড় করতে হবে। যদি কাপড় না পেতো তবে পুরুষেরা উলঙ্গ হয়ে তওয়াফ করতো এবং মহিলারা সব পোশাক খুলে ফেলে একটি ছোট খোলা জামা পরিধান করে তওয়াফ করতো। তওয়াফের সময় তারা এ কবিতা আবৃত্তি করতো,
‘লজ্জাস্থানের কিছুটা বা সবটুকু খুলে যাবে আজ। যেটুকু যাবে দেখা ভাবব না অবৈধ কাজ।
এই অশ্লীল আচরণ বন্ধ করার জন্য আল্লাহ পাক এই আয়াত নাযির করেন, হে বনি আদম, প্রত্যেক নামাযের সময় সুন্দর পরিচ্ছেদ পরিধান করবে। (৩১, ৭)
যদি মক্কার বাইরে থেকে আসা কোন পুরুষ বা নারী মক্কার বাইরে থেকে নিয়ে আসা পোশাক তওয়াফ করতো তবে তওয়াফ শেসে সেই পোশাক ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হতো। সে পোশাক নিজেও ব্যবহার করতো না অন্য কেউ ও ব্যবহার করতো না (ঐ ১ম খন্ড, পৃ২০২, ২০৩, সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড পৃ-২২৬)।
কোরাইশদের একটি বেদয়াত এই ছিল যে, তারা এহরাম বাঁধা অবস্থায় ঘরের দরোজা দিয়ে প্রবেশ করতো না বরং ঘরের পেছনের দিকে একটা ছিদ্র করে নিয়ে, সেই ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করতো এবং বাইরে বের হতো।
এ ধরনের উদ্ভট কাজকে তারা পুণ্যের কাজ মনে করতো। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক তাদেরকে এরূপ করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ পাক বলেন, পেছন দিক দেয় তোমাদের গৃহে প্রবেশ করতে কোন পুণ্য নেই। কিন্তু পুণ্য আছে কেউ যদি তাকওয়া অবলম্বন করে। সুতরাং তোমরা দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করো। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাতে সফলকাম হতে পার।
এই ছিল পৌত্তলিকদের ধর্মীয় জীবনের রূপরেখা।
এছাড়া জাযিরাতুল আরবের বিভিন্ন ইহুদী, খৃস্টান, মাজুসিয়াত বা অগ্নিপূজক এবং সাবেয়ী মতবাদের ব্যাপক প্রচলন ছিল। নীচে এসব মতবাদ সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু আলোকপাত করা যাচ্ছে। জাযিরাতুল আরবে ইহুদীদের ছিল দুটি যুগ। প্রথম যুগ ছিল সেই সময় যখন বাবেল ও আশুর সরকার ফিলিস্তিন জয় করেছিল। এ সময় ইহুদীরা স্বদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সেই সরকারের কঠোর নির্যাতন নিষ্পেষণ এবং ইহুদী জনবসতির ধ্বংস সাধনের ফলে বহুসংখ্যক ইহুদী হেজায ছেড়ে ফিলিস্তিনের উত্তরাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল (কলবে জাযিরাতুল আরব পৃ ২৫১)।
দ্বিতীয় যুগ ছিল সেই সময় যখন ৭০ ঈসায়ী সালে টাইটাস রুমীর রোমকরা ফিলিস্তিন অধিকার করে। সেই সময় রোমকদের ইহুদী নির্যাতন এবং তায়মাসে বসতি গড়ে তোলে এবং দুর্গ নির্মাণ করে। এ সব দেশত্যাগী ইহুদীদের সাথে মেলামেশার ফলে আরব অধিবাসীদের মধ্যে ইহুদী ধর্ম চিন্তার প্রসার ঘটে। এর ফলে ইসলামের আবির্ভাবের আগে এবং পরে বিভিন্ন সময়ে ইহুদীরা ও উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত হয়। ইসলামের আবির্ভাবের সময় বিখ্যাত যেসব ইহুদী গোত্র ছিল সে গুলো হচ্ছে খয়বর, নাযির, মোস্তালেক, কোরায়যা, কায়নুকা সামহুদী। অফা ওয়া অফা গ্রন্থের ১১৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন যে, এসময় ইহুদী গোত্রর সংখ্যা ছিল বিশ এর বেশী। (ঐ)
ইয়েমেনও ইহুদীরা ছিল বেশ শক্তিশালী। তাবান আসাদ আবু কারাব নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে ইয়েমেন ইহুদী মতবাদ প্রসার লাভ করে। যুদ্ধ করতে করতে এই ব্যক্তি ইয়াসরেব পৌঁছে।
ইয়াসরেব যাওয়ার পর সে ইহুদী মতবাদের দীক্ষা নেয় এবং বনু কোরায়যার দুজন ইহুদী ধর্ম বিশেষজ্ঞকে সঙ্গে নিয়ে ইয়েমেন পৌঁছে। এদের মাধ্যমে ইয়েমেনে ইহুদী মতবাদ প্রচার প্রসার লাভ করে। আবু কারারের পর তার পুত্র ইউসুফ জুনুয়াস ইয়েমেনের শাসন ক্ষমতা অধিকার করে। ইহুদী মতবাদের জোশে এই ব্যক্তি নাযরানের খৃস্টানদের ওপর হামলা চালায় এবং জোর করে তাদেরকে ইহুদী ধমে দীক্ষিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু এতে তারা অস্বীকৃতি জানায় ক্রুদ্ধ জুনুয়াস বিরাট গত খনন করিয়ে সে গতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় তারপর দাউ দাউ করে প্রজ্জ্বলিত আগুনে নারী পুরু, শিশু-বৃদ্ধ ইত্যাদি সব শ্রেণীর মানুষকে সেই গর্তে ফেলে দেয়। এ ঘটনায় বিশ থেকে চব্বিশ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। ৫২৩ ঈসায়ী সালের অক্টোবর মাসে এ ঘটনা ঘটে। পবিত্র কোরআনের সুরা বুরুজে এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে ( ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ২০, ২১, ২২, ২৭, ৩১, ৩৫, ৩৬)।
আরব দেশসমুহে ঈসায়ী বা খৃষ্টধর্ম আবিসিনীয় এবং রোমক বিজয়ীদের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল। ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইয়েমেনের ওপর আবিসিনিয়রা প্রথমবার ৩৪০ সালে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। ৩৭৮ সাল পর্যন্ত এ অবস্থা বজায় ছিল। এ সময়ে ইয়েমেনে খৃস্টান মিশনারি কাজ করতে থাকে। সেই সময়ে ফেমিউন নামে একজন বিশিষ্ট সাধক নাযরান পৌঁছেন এবং স্থানীয় লোকদের মধ্যে ঈসায়ী বা খৃষ্টান ধর্ম প্রচার করেন। নাযরানের অধিবাসীরা খৃস্টান ধমে সত্যতার প্রমাণ পাওয়ার পর খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪)
জুনুয়াসের হত্যাকাণ্ডের ক্ষতচিহ্ন মুছে যায়নি। এ মর্মান্তিক ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসাবে হাবশীরা পুনরায় ইয়েমেন অধিকার করে এবং আবরাহা ক্ষমতা দখল করে। এই ব্যক্তি ইয়েমেনে একটি মন্দির তৈরি করে। সে চাচ্ছিল যে, ধর্মপ্রাণ মানুষরা মক্কার কাবাঘরে না গিয়ে তার তৈরি মন্দিরে যাবে। এ দুরাচার এ উদ্দেশ্যে মক্কায় কাবাঘর ধ্বংস করে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ ঘৃণ্য দুঃসাহস দেখানোর ফলে আল্লাহ পাক তাকে এমন শাস্তি দিলেন যে সে ঘটনা পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সকলের জন্য ঘটনা হয়ে রইল।
অন্যদিকে রোমকরা অধিকৃত এলাকার প্রতিবেশী হওয়ার কারণে আলে গাসসান, বনু তাগলাব, বনু তাঈ প্রভৃতি আরব গোত্রের মধ্যে খৃষ্টান ধর্ম বিস্তার লাভ করে। হীরার কয়েকজন আরব শাসক ও খৃষ্টান ধমে দীক্ষিত হন।
মাজুসী ধর্ম বা অগ্নিপুজকদের অধিকাংশ বসবাস করতো পারস্যের প্রতিবেশী আরব দেশসমুহে। যে, ন ইরাক, বাহরাইন ও আরব উপসাগরের উপকূলীয় এলাকা। এ ছাড়া ইয়েমেনে পারস্য আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর বিচ্ছিন্নভাবে বহু লোক মাজুসী ধর্ম গ্রহণ করেছিল।
সাবী বা সাবেয়ী ধর্ম। ইরাক এবং অন্যান্য স্থানে প্রাচীন নিদর্শনসমুহ খনন করে উদ্ধার করার সময় প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায়, সাবী ছিল কালদানি জাতির ধর্ম। এরা ছিল হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বংশধর। প্রাচীনকালে সিরিয় এবং ইয়েমেনের বহু অধিবাসী এ ধমের অনুসারী ছিল। কিন্তু ইহুদী এবং খৃস্টান ধর্মের জয় জয়জয়কার শুরু হলে এ ধমের বিলুপ্তি ঘটে। তবুও মাজুসিদের সাথে মিশ্রিতভাবে বা তাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে ইরাক এবং আরব উপসাগরীয় এলাকায় এ ধমের কিছু অনুসারী অবশিষ্ট ছিল। (তারীখে আরদুল কোরআন, ২য় খন্ড, পৃ ১৯৩-২০৮)
সাধারণ ধর্মীয় অবস্থা
ইসলামের আবির্ভাবের সময় উল্লেখিত কয়েকটি ধর্ম আরবে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এ সকল ধর্মমত ছিল ভাঙ্গনের মুখে। পৌত্তলিকরা যদিও নিজেদের দ্বীনে ইবরাহীমের অনুসারী মনে করতো কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা দ্বীনে ইবরাহীমের আদেশ নিষেধ থেকে বহু দরে অবস্থান করতো।
দ্বীনে ইবরাহীমী উন্নত চরিত্র গঠনের লক্ষে যেসব শিক্ষা দিয়েছিল তার সাথে পৌত্তলিকদের দূরতম সম্পর্ক ও ছিল না। তারা পাপের পাঁকে ছিল নিমজ্জিত। দীর্ঘকাল থেকে তাদের মধ্যে মূর্তিপূজার মাধ্যমে সৃষ্ট পাপাচার অনাচার কদাচার বিদ্যমান ছিল। এসব কারণে তাদের সম্মিলিত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবন দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
ইহুদী ধমের অনুসারীদের ছিল আকাশছোঁয়া অহংকার। ইহুদী পুরোহিতরা আল্লাহ তায়ালাকে বাদ দিয়ে নিজরাই প্রভু হয়ে বসেছিল। তারা মানুষের ওপর নিজেদের ইচ্ছে জোর করে চাপিয়ে দিতো। তারা মানুষের চিন্তা ভাবনা ধ্যান ধারণা এবং মুখের কথা নিজেদের মজির অধীন করে দিয়েছিল। তারা সর্বতোভাবে ক্ষমতা এবং অর্থ সম্পদ উপার্জনে নিয়োজিত ছিল। যে কোন মূল্যে এসব কিছু করায়ত্ত করতেই তারা ছিল সতত উদগ্রীব। ধর্ম নষ্ট করে হলেও ক্ষমতা এবং ধন সম্পদ তারা পেতে চাইতো। পৌত্তলিকরা কুফুরী, খোদাদ্রোহিতায় লিপ্ত ছিল। এসব অপকর্ম তাদের ইচ্ছা পূরণের সঙ্গী ছিল। আল্লাহ পাকের নির্দেশ তারা উপেক্ষা করতে এতটুকু ইতস্তত করতো না।
খৃষ্টধর্ম ছিল এক উদ্ভট মূর্তিপূজার ধর্ম। তারা আল্লাহ তায়ালা এবং মানুষকে বিষ্ময়করভাবে একাকার করে দিয়েছিল। আরবের যেসব লোক এ ধমের অনুসারী ছিল তাদের ওপর এ ধর্মের প্রকৃত কোন প্রভাব ছিল না। কেননা দ্বীনের শিক্ষার সাথে তাদের ব্যক্তি জীবনের কোন শিল ছিল না। কোন অবস্থায়ই তারা নিজেদের ভোগ সর্বস্ব জীবন-যাপন পরিত্যাগ করতে রাজি ছিল না। পাপের পঙ্কে ছিল তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবন নিমজ্জিত।
আরবের অন্যান্য ধমের অনুসারীদের জীবন ছিল পৌত্তলিকদের মতো। কেননা তাদের ধমের মধ্যে বিভিন্নতা থাকলেও মনের দিক থেকে তারা ছিল একই রকম। শুধু মনের দিকে থেকেই নয় জীবনাচার এবং রেওয়াজের ক্ষেত্রেও তারা ছিল অভিন্ন।