৩
কোন বংশে সেই সোনার মানুষঃ আল আমীন থেকে আর রাসূল
নবী পরিবারের পরিচয়
নবী করিম সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশধারাকে তিনভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথম অংশের নির্ভুলতার ব্যাপারে সীরাত রচয়িতা এবং বংশধারা বিশেষজ্ঞরা একমত। দ্বিতীয় অংশ সম্পর্কে সীরাত রচয়িতার মাঝে কিছু মতভেদ রয়েছে। কেউ সমর্থন করেছেন কেই বিরোধিতা করেছেন কেউ আবার ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। এটি আদনার থেকে ওপরের দিকে হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম পর্যন্ত। তৃতীয় অংশে নিশ্চিত কিছু ভুল রয়েছে, এটি হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম থেকে হযরত আদম আলাইহিস সালাম পর্যন্ত। এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে ইঙ্গিত করা হয়েছে। নীচে তিনটি অংশ সম্পর্কে মোটামুটি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা যাচ্ছে।
প্রথম অংশ
মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ, ইবনে আবদুল মোত্তালেব (শায়বা) ইবনে হাশেম(আমর) ইবনে আবদ মান্নাফ (মুগীরা) ইবনে কুসাই(যায়েদ) ইবনে কেলার ইবরে মাররা, ইবনে কাব ইবনে লোয়াই ইবনে গালেব ইবনে ফাহার, (এর উপাধিই ছিল কোরাইশ গোত্র নামেই পরিচিত) ইবনে মালেক ইবনে নযর কায়েস ইবনে কেনানা ইবনে খোযায়মা ইবনে মাদরেকা(আমের) ইবনে ইলিয়াস ইবনে মোদান ইবনে নাযার ইবনে মাআদ ইবনে আদনান। (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ২০, তালকীহে ফুহমে আহলুল আছার পৃ-৫, ৬, রহমাতুললিল আলামিন ২য় খন্ড, পৃ-১১, ১৪, ৫২)
দ্বিতীয় অংশ
আদনান থেকে ওপরের দিকে। অর্থাৎ আদনান ইবনে হামিছা ছালামান ইবনে আওছ ইবনে পোজ, ইবনে কামোয়াল ইবনে উবাই আওয়ায ইবনে নাশেদ ইবনে হাজা ইবনে বালদাস ইবনে ইয়াদলাফ ইবেন তারেখ ইবনে জাহেম ইবনে নাহেশ, ইবনে মাখি, ইবনে আয়েয, ইবনে আকবার, ইবনে ওবায়েদ, ইবনে আদদায়া, ইবনে হামদান, ইবনে সুনবর, ইবনে ইয়াসরেবী, ইবনে ইয়াহাজান, ইবনে ইয়ালহান ইবনে আরউই ইবনে আই ইবনে যায়শান ইবনে আইশার ইবনে অফনাদ ইবনে আইহাম ইবনে মাকছার ইবনে নাহেছ ইবনে জারাহ ইবনে সুমাই ইবনে মাযি ইবনে আওযা ইবনে আরাম ইবনে কায়দার ইবনে ইসমাইল ইবনে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। (আল্লামা মনুসরপুরী গবেষণার পর এ অংশ ঐতিহাসিক কালবি এবং ইবনে সাদ এর বর্ণনা থেকে সংযোজিত করেছেন। রহমাতুল্লিল আলামিন, ২য় খন্ড, পৃ-১৪-১৭। এ অংশের ব্যাপারে ঐতিহাসিক তথ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। )
তৃতীয় অংশ
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম থেকে ওপরের দিকে। ইবরাহিম ইবনে তারাহ (আযর) ইবনে নাহুর ইবনে ছবেদা (সারুগ) ইবনে রাউ ইবনে ফালেজ ইবনে আবের ইবনে শালেখ ইবনে আরফাখশাদ ইবনে সাম ইবনে নুহ আলাইহিস সালম ইবনে লামেক ইনে মাতুশালাখ ইবনে আখনুখ (মতান্তরে হযরত ইদরিস আলাইহিস সালাম) ইবনে মাহলায়েল ইবনে কায়নান ইবনে আনুশা, ইবনে শীশ ইবনে আদম আলাইহিস সালাম। (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ ২, ৪. তালাকীহুল ফুহুম পৃ-৬ খোলাছতিুছ সীয়ার. পৃ-৬.)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম তাঁর পরদাদা হাশেম ইবনে আবদে মান্নাফের পরিচয়ে হাশেমী বংশোদ্ভূত হিসাবে পরিচিত। কাজেই হাশেম এবং পরবর্তী কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় উল্লেখ করা জরুরী।
এক) হাশেম, ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি বে বনু আবদে মান্নাফ এবং বনু আবদুদ দায়ের মধ্যে পদমর্যাদা বণ্টনের ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছিল। এই সমঝোতার প্রেক্ষিতে আবদে মান্নাফের বংশধররা হাজীদের পানি পান করানো এবং মেহমানদের আতিথেয়তার মেজবানি লাভ করেন। হাশেম বিশিষ্ট সম্মানিত এবং সম্পদশালী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মক্কার হাজীদের সুরুয়া রুটি খাওয়ানের প্রথা চালু করেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল আমর কিন্তু রুটি ছিড়ে সুরুয়ায় ভেজানোর কারণে তাঁকে বলা হতো হাশেম। হাশেম অর্থ হচ্ছে যিনি ভাঙ্গেন। হাশেমেই প্রথম মানুষ যিনি কোরাইশদের গ্রীষ্ম এবং শীতে দুবার বাণিজ্যিক সফরের ব্যবস্থা করেন। তাঁর প্রশংসা করে কবি লিখেছেন, তিনি সেই আমর যিনি দুর্ভিক্ষ পীড়িত দুর্বল স্বজাতিকে মক্কায় রুটি ভেঙ্গে ছিঁড়ে সুরুয়ায় ভিজিয়ে খাইয়েছিলেন এবং শীত ও গ্রীষ্মে সফরের ব্যবস্থা করেছেন।
হাশেম বা আমরেরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই যে, তিনি ব্যবসার জন্য সিরিয়া সফরে গিয়েছিলেন। যাওয়ার পথে মদিনায় পৌঁছে বনি নাজ্জার গোত্রের সালমা বিনতে আমরের সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং কিছুদিন সেখানে অবস্থান করেন। গর্ভবতী হওয়ার পর স্ত্রীকে পিত্রালয়ে রেখে তিনি সিরিয়ায় রওয়ানা হন। ফিলিস্তিনের গাযা শহরে গিয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন। এদিকে সালমার গর্ভ থেকে একটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। এটা ৪৯৭ ঈসায়ী সালের ঘটনা। শিশুর মাথার চুলে ছিল শুভ্রতার ছাপ, এ কারণে সালমা তার নাম রাখেন শায়রা (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড. পৃ-১৩৭, রহমাতুললিল আলামিন, ১ম খন্ড, পৃ.২৬, ২য় খন্ড পৃ-২৪)। ইয়াসরেব বা মদিনায় সালমা তার পিত্রালয়েই সন্তানের প্রতিপালন করেন। পরবর্তীকালে এই শিশুই আব্দুল মোত্তালেব নামে পরিচিত হন। দীর্ঘকাল যাবত হাশেমী বংশের লোকেরা এ শিশুর সন্তান পায়নি। হাশেমের মোট চার পুত্র পাঁচ কন্যা ছিল। এদের নাম নিম্নরূপ : আসাদ, আবু সায়ফি, নাযলা, আবদুল মোত্তালেব। কন্যাদের নাম, শাফা, খালেদা, যঈফা, রোকাইয়া এবং যিন্নাত। (ঐ ১ম খন্ড, পৃ-১০৭)।
(দুই) আব্দুল মোত্তালেব, ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, হাজীদের পানি পান করানো এবং মেহমানদারী করার দায়িত্ব হাশেমের পর তাঁর ভাই মোত্তালেব পেয়েছিলেন। তিনিও ছিলেন তাঁর পরিবার ও কওমের অত্যন্ত মর্যাদা সম্পন্ন। তিনি কোন কথা বললে সে কথা কেউ উপেক্ষা করতো না। দানশীলতার কারণে কোরাইশরা তাঁকে ফাইয়ায উপাধি দিয়েছিলেন। শায়বা অর্থাৎ আব্দুল মোত্তালেব এর বয়স যখন দশ বারো বছর হয়েছিল তখন মোত্তালেব তার খবর পেয়েছিলেন। তিনি শায়বাকে নিয়ে আসার জন্য মদিনায় গিয়েছিলেন। মদিনায় অর্থাৎ ইয়াসরেবের কাছাকাছি পৌছার পর শায়বার প্রতি তাকালে তাঁর দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। তিনি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এরপর নিজের উটের পেছনে বসিয়ে মক্কার পথে রওয়ানা হলেন। কিন্তু শায়বা তার মায়ের অনুমতি না নিয়ে মক্কায় যেতে অস্বীকার করলেন। মোত্তালেব যখন শায়বার মায়ের কাছে অনুমতি চাইলেন তখন শায়বার মা সালমা অনুমতি দিতে অস্বীকার করলেন। মোত্তালেব বললেন ওতো তার পিতার হুকুমত এবং আল্লাহর ঘরের দিকে যাচ্ছে। একথা বলার পর সালমা অনুমতি দিলেন। মোত্তালেব তাকে নিজের উটের পেছনে বসিয়ে মক্কায় নিয়ে এলেন। মক্কায় নিয়ে আসার পর প্রথমে যারা দেখলো তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলো ভ্রাতুষ্পুত্র, হাশেমের ছেলে। এরপর থেকে শায়বা মোত্তালেব কাছে বড় হতে থাকেন এবং এক সময় যুবক হন। পরবর্তীকালে মোত্তালেব ইয়েমেনে মারা যায়। তাঁর পরিত্যক্ত পদমর্যাদা শায়বা লাভ করেন। আব্দুল মোত্তালেব তাঁর স্বজাতীয়দের মধ্যে এতো বেশী সম্মান ও মর্যাদা লাভ করেছিলেন যে, ইতিপূর্বে অন্য কেউ এতোটা লাভে সক্ষম হয়নি। স্বজাতির লোকেরা তাঁকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো এবং তাঁকে অভূতপূর্ব সম্মান দিতো। (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ-১৩৭-১৩৮)
মোত্তালেবের মৃত্যুর পর নওফেল আবদুল মোত্তালেবের কিছু জমি জোর করে দখল করে নেই। আব্দুল মোত্তালেব কোরাইশ বংশের কয়েকজন লোকের সাহায্য জান। কিন্তু তারা এই বলে অক্ষমতা প্রকাশ করেন যে, আপন চাচার বিরুদ্ধে আমরা আপনার পাশে দাঁড়াতে পারব না। অবশেষ আব্দুল মোত্তালেব বনি নাজ্জার গোত্রে তাঁর মামার কাছে কয়েকটি কবিতা লেখে পাঠান। সেই কবিতায় সাহায্যের আবেদন জানানো হয়েছিল। জবাবে তাঁর মামা আবু সাদ ইবনে আদী আশি জন সওয়ান নিয়ে রওয়ানা হয়ে মক্কার নিকটবর্তী আবতাহ নামক জায়গায় অবতরণ করেন। আবদুল মোত্তালেব তাঁতে ঘরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু আবু সাদ বললেন, না আমি আগে নওফেলের সাথে দেখা করতে চাই। এরপর আবু সাদ নওফেলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। নওফেল সে সময় মক্কার কয়েকজন বিশিষ্ট কোরাইশ এর সাথে বসে কথা বলছিলেন। আবু সাদ তলোয়ার কোষমুক্ত করে বললেন, এই ঘরের প্রভুর শপথ, যদি তুমি আমার ভাগ্নের জমি ফিরিয়ে না দাও তবে এই তলোয়ার তোমার দেহে ঢুকিয়ে দেব। নওফেল বললেন, আচ্ছা নাও, আমি ফিরিয়ে দিচ্ছি। আবু সাদ কোরাইশ নেতৃবৃন্দকে সাক্ষী রেখে আব্দুল মোত্তালেবকে তাঁর জমি ফিরিয়ে দিলেন। এরপর আবু সাদ আব্দুল মোত্তালেবের ঘরে গেলেন এবং সেখানে তিনদিন অবস্থানের পর ওমরাহ পালন করে মদিনায় ফিরে গেলেন।
এর পর নওফেল বনি হাশেমের বিরুদ্ধে বনি আবদে শাসমের সাথে সহায়তার অঙ্গীকার করলো।
এদিকে বনু খোজায়া গোত্র লক্ষ করলো যে, বনু নাজ্জার আবদুল মোত্তালেবকে এভাবে সাহায্য করলো, তখন তারা বলল, আবদুল মোত্তালেব তোমাদের যেমন তেমনি আমাদেরও সন্তান। কাজেই আমাদের ওপর তার সাহায্য করার অধিক অধিকার রয়েছে। এর কারণ ছিল এই যে, আবদে মান্নাফের মা বনু খোজায়া গোত্রের সাথে সম্পর্কিত ছিল। এ কারণে বনু খোজায়া দারুন নাদওয়ায় গিয়ে বনু আবদে শামস এবং বনু নওফেলের বিরুদ্ধে বনু হাশেমের নিকট সাহায্যের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলো। এই প্রতিশ্রুতিই পরবর্তী সময়ে ইসলামী যুগে মক্কা বিজয়ের কারণ হয়েছিল। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পরে উল্লেখ করো হবে। (মুখতাছার সীরাতে রাসূল, শায়খুল ইসলাম মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব নজদী, পৃ-৪১-৪২)
কাবাঘরের সাথে সম্পর্কিত থাকার কারণে আবদুল মোত্তালেব সাথে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। একটি যমযম কুপ খনন অন্যটি হাতী যুদ্ধের ঘটনা।
যমযম কুপের খনন কাজ
এই ঘটনার সারমর্ম এই যে, আব্দুল মোত্তালেব স্বপ্নে দেখলেন যে, তাঁকে যমযম কুপ খননের জন্য আদেশ দেয়া হচ্ছে। স্বপ্নের মধ্যেই তাকে জায়গাও দেখিয়ে দেয়া হলো। ধুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর তিনি যমযম কুপ খনন শুরু করলেন। পর্যায়ক্রমে দুটি জিনিস আবিষ্কৃত হলো। এগুলো হচ্ছে জোরহাম গোত্র মক্কা থেকে চলে যাওয়ার সময় যমযমের ভেতর ফেলে দিয়েছিল। এগুলো হচ্ছে তলোয়ার, অলংকার এবং সোনার দুটি হরিণ। আবদুল মোত্তালেব উদ্ধারকৃত তলোয়ার দিয়ে দরোজা লাগালেন। সোনার দুটি হরিণও দরোজার ফিট করলেন এবং হাজীদের যমযম কুপের পানি পান করানোর ব্যবস্থা করলেন।
যমযম কূপ আবিষ্কৃত হওয়ার পর কোরাইশরা আবদুল মোত্তোলেবের সাথে ঝগড়া করতে শুরু করলো। তারা দাবী করলো যে, আমাদেরও খনন কাজের সাথে যুক্ত করা হোক। আব্দুল মোত্তালেব বললেন, আমি সেটা করতে পানি না। আমাকেই এ কাজের জন্য নিদিষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু কোরাইশরা মানতে চাইলো না। অবশেষে ফয়সালার জন্য সবাই বনু সাদ গোত্রের একজন জ্যোতিষী মহিলার নিকট গেলো। কিন্তু যাওয়ার পথে তারা কিছু বিস্ময়কর নিদর্শন দেখলো। এতে তারা বুঝতে পারলো যে, কুদরতী ভাবেই যমযম কুপ খননের দায়িত্ব আবদুল মোত্তালেবকে দেয়া হয়েছে। এ কারণে বিবাদকারী কোরাইশরা পথ থেকেই ফিরে এলো। এই সময় আব্দুল মোত্তালেব মানত করেছিলেন যে, আল্লাহ পাক যদি তাকে দশটি পুত্র দেন এবং তার নিজেদের রক্ষা করার মতো বয়স উন্নীত হয় তবে একজন সন্তানকে আল্লাহর নামে কাবার পাশে কোরবাণী করবেন। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৪২-১৪৭)
হস্তী যুদ্ধের ঘটনা
দ্বিতীয় ঘটনার সারমর্ম এই যে, আবিসনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশীর পক্ষ থেকে আবরাহা সাবাহ হাবশী ইয়েমেনের গভর্নর জেনারেল ছিল। আবরাহা লক্ষ্য করলো যে, আরবের লোকেরা কাবাঘরে হজ্জ পালনের জন্য যাচ্ছে। এটা দেখে সে সনয়ায় একটি গীজা তৈরী করলো। সে চাচ্ছিল যে, আরবের লোকেরা হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় না গিয়ে সনয়ায় যাবে। এ খবর জানার পর বনু কেনানা গোত্রের একজন লোক আবরাহার নির্মিত গির্জার ভেতরে প্রবেশ করে গির্জায় মেহরাবে পায়খানা করে এলো। আবরাহা এ খবর পেয়ে ভীষণ ক্রুদ্ধ হলো এবং ষাট হাজার দুর্ধর্ষ সৈন্য নিয়ে কাবাঘর ধ্বংস করার জন্য অগ্রসর হলো। নিজের জন্য সে একটি বিশাল হাতী ব্যবস্থা করলো। তার বাহিনীতে মোট নয়টি অথবা তেরোটি হাতী ছিল। আবরাহা ইয়েমেন থেকে মোগাম্মাস নামক জায়গায় পৌছলো এবং সেখানে বিন্যস্ত করলো। মক্কায় প্রবেশের পর মোযদালেফা এবং মিনার মধ্যবর্তী মোহাসসের প্রান্তরে পৌছলে হাতী সব বসে পড়লো। অনেক চেষ্টার পরও কাবার দিকে যাওয়ার জন্য হাতীকে উঠানো সম্ভব হলো না। চেষ্টা করলেই হাতি বসে পড়তো। এ সময় আল্লাহ পাক এক পাল চড়ুই পাখি প্রেরণ করলেন। পাখিরা মুখে ছোট ছোট পাথর বহন করেছিল। এ সব পাথর তারা সৈন্যদের ওপর নিক্ষেপ করলো। এর মাধ্যমে আবরাহার সেনাদল ভুষির মতো নাস্তানাবুদ হয়ে গেল। চড়ুই পাখিগুলো ছিল আবাবিলের মতো। প্রতিটি পাখি তিনটি পাথর বহন করেছিল। একটি মুখে অন্য দুটি দুই পাখার নীচে। পাথরগুলি ছিল মটর শুটির মত। যার গায়ে সে পাথর পড়তো তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ খসে পড়তে গুরু করতো এবং সে মরে যেতো। প্রত্যেকের গায়ে এ পাথর পড়েনি। সেনাদলের মধ্যে এমন আতঙ্ক এবং বিভীষিকা সৃষ্টি হলো যে সবাই এলোপাতাড়ি পালাতে শুরু করলো। এরপর তারা এখানে সেখানে পড়ে মরতে লাগলে। এদিকে আবরাহার ওপর গযব নাযিল হরলেন যে তার হাতের আঙ্গুল খসে পড়তে শুরু করলো। সনয়ায় পৌছতে পৌছুতে তার মৃত্যু ঘনিয়ে এলো। কলিজা ফেটে বাইরে এসে মর্মান্তিকভাবে সে মৃত্যুবরণ করলো।
আবরাহার এ হামলার সময় মক্কার অধিবাসীরা প্রাণভয়ে পাহাড়ে প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়লো এবং পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন করলো। সেনাদলের ওপর আল্লাহর আযাব অবতীর্ণ হলে তারা নিশ্চিন্তে নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে গেল। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-৪৩, ৫৬)
উল্লিখিত ঘটনা অধিকাংশ সীরাত রচয়িতার অভিমত অনুযায়ী রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের পঞ্চাশ অথবা পঞ্চান্ন দিন আগে ঘটেছিল। সে সময় ছিল মহররম মাস। ৫৭১ ঈসায়ী সালের ফেব্রুয়ারি শেষ দিকে অথবা মার্চের শুরুতে এ ঘটনা ঘটেছিল। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহপাক তাঁর নবী এবং পবিত্র ঘর কাবা শরীফকে কেন্দ্র করে এর ভূমিকা স্বরূপ এ ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। যেমন ৫৮৭ সালে বখতে নসর মাকদেস দখল করে তা অধিকার করেছিল। এর আগে ৭০ সালে রোমকরা বায়তুল মাকদেস অধিকার করেছিল। পক্ষান্তরে কাবার ওপর খৃষ্টানরা কখনোই আধিপত্য বিস্তার করতো পারেনি। অথচ সে সময় ঈসায়ী বা খৃস্টানরা ছিল আল্লাহর বিশ্বাসী মুসলমান এবং কাবার অধিকারীরা ছিল পৌত্তলিক।
হস্তীযুগের ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরপরই অল্প সময়ে মধ্যেই তদানীন্তন উন্নত দেশ হিসাবে পরিচিতি রোম এবং পারস্য এ খবর পৌঁছে গিয়েছিল। কেননা মক্কার সাথে রোমকদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। অন্যদিকে রোমকদের ওপর পারসিকদের সব সময় নযর থাকতো । রোমক এবং তাদের শত্রুদের যাবতীয় ঘটনা পারস্য বা পারসিকরা পর্যবেক্ষণ করতো। এ কারণেই দেখা যায় য়ে, আবরাহার পতনের পর পরই পারস্যবাসীরা ইয়েমেন দখল করে নেয়। সে সময়কার বিশ্বে পারস্য এবং রোম যেহেতু উন্নত ও সভ্য দেশ হিসাবে পরিচিত ছিল এ কারণে বিশ্ব মানবের দৃষ্টি কাবার প্রতি নিবদ্ধ হলো। কাবাঘরের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ তারা প্রত্যক্ষ করলো। তারা বুঝতে পারলো যে, এই ঘরকে আল্লাহ পাক পবিত্র ঘর হিসাবে মনোনীত করেছেন। কাজেই মক্কার জনপদ থেকে নবুয়তের দাবীসহ কারো উত্থান অবশ্য সমীচীন। এদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারী পৌত্তলিকদের আল্লাহ কেন সাহায্য করেছিলেন। আল্লাহ রসূলের আবির্ভাবের কথা চিন্তা করলে সে কথা বুঝতে মোটেও অসুবিধা হয় না।
আবদুল মোত্তালেবের পুত্র সংখ্যা ছিল দশজন। তাদের নাম ছিল হারেস, যোবায়ের, আবু তালেব, আবদুল্লাহ, হামযা, আবু লাহাব, গাইদাক, মাকহুম, সাফার এবং আব্বাস। কেউ কেউ বলেছেন, এগারোজন। একজনের নাম ছিল কাছাম। কেউ বলেছেন, তেরোজন। একজনের নাম ছিল আবদুল কাবা অন্যজনের নাম ছিল হোজাল। যারা দশজন পুত্র বলে উল্লেখ করেছেন তারা বলেন, মুকাওআমের আরেক নাম ছিল আবদুল কাবা আর গাইদাকের আরেক নাম ছিল হোজাল। কাছাম নামে আবদুর মোত্তালেবের কোন পুত্র ছিল না। আবদুল মোত্তালেবের কন্যা ছিল ছয়জন। তাদের নাম উম্মুল হাকিম, এর অন্য নাম ছিল বায়জা, বায়রা , আতেকা, সাফিয়া, আরোয়া, উমাইমা। (তালকিহুল ফুহুম, পৃ-৮, ৯, রহমাতুল লিল আলামিন ২য় খন্ড, পৃ-৫৬, ৬৬)
তিন) আবদুল্লাহ ছিলেন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতা। আবদুল্লাহর মায়ের নাম ছিল ফাতেমা। তিনি ছিলেন আমর ইবনে আবেদ ইবনে এমরান ইবনে মাখযুম ইবনে ইয়াকজা ইবনে মাররার কন্যা। আবুর মোত্তালেবের সন্তানদের মধ্যে আবদুল্লাহ ছিলেন সুদর্শন, সচ্চরিত্রে এবং স্নেহভাজন। তাঁকে বলা হতো যবীহ বা যবাইকৃত। এরূপ বলার কারণ ছিল এই যে, আবদুল মোত্তালেবের পুত্রদের সংখ্যা দশ হয়ে যাওয়ার পর এবং তারা নিজেদের রক্ষায় সমর্থ মতো বয়সে উন্নীত হওয়ার পর আবদুল মোত্তালেব তাদেরকে নিজের মানতের কথা জানান। এরপর আবদুল মোত্তালেব ভাগ্য পরীক্ষার তীরের গায়ে তাদের সকলের নাম লিখলেন। লেখার পর হোবাল মূর্তির তত্বাবধায়কের হাতে দিলেন। তত্বাবধায়ক লটারি করার পর আবদুল্লাহর নাম উঠলো। আবদুল মোত্তালেব আবদুল্লাহর হাত ধরলেন, ছুরি নিলেন এবং যবাই করার জন্য কাবাঘরের পাশে নিয়ে গেলেন। কিন্তু কোরাইশ বিশেষত আবদুল্লাহর ভাই আবু তালেব বাধা দিলেন। আবদুল মোত্তালেব বললেন, তোমরা যদি বাধা দাও তবে আমি মানত পূর্ণ করব কিভাবে? তারা পরামর্শ দিলেন যে, আপনি কোন মহিলা সাধকের কাছে গিয়ে এর সমাধান চান। আবদুল মোত্তালেব এক মহিলা সাধকের কাছে গেলেন। সেই সাধক আবদুল্লাহর এবং দশটি উটের নাম লিখে লটারি করার পরামর্শ দিলেন। তবে বললেন যে যদি আবদুল্লাহ নাম না উঠে তবে দশটি করে উট বাড়াতে থাকবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ খুশি না হন। এরপর যতোটি উটের নাম লটারিতে উঠবে ততটি উট যবাই করবেন। আবদুল মোত্তালেব ফিরে গিয়ে কোরা অর্থাৎ লটারি করতে শুরু করলেন। প্রথম দশটিতে আবদুল্লাহর নাম এলো না। এরপর দশটি করে বাড়তে লাগলো। একশত উট হওয়ার পর আবদুল্লাহর নাম উঠলো। আবদুল মোত্তালেব একশত উট যবাই করলেন এবং সেখানেই ফেলে রাখলেন। মানুষ এবং পশু কারো জন্য বাধা ছিল না। এ ঘটনার আগে পর্যন্ত কোরাইশ এবং আরবদের মধ্যে রক্ত ঋণের পরিমাণ ছিল দশটি উট। কিন্তু এই ঘটনার পর তার পরিমাণ বাড়িয়ে একশত উট করা হলো। ইসলামও এই পরিমাণ অব্যাহত রাখে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি দুইজন যবীহের সন্তান । একজন হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম অন্যজন আমার পিতা আবদুল্লাহ। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৫১-১৫৫, রহমাতুল্লিল আলামিন, ২য় খন্ড, পৃ-৮৯, ৯০, মুখতাছার সীরাতে রাসুল শেখ আবদুল ওয়াহাব নজদী, পৃ-২২, ২৩)
আবদুল মোত্তালেব তাঁর পুত্র আবদুল্লাহর বিয়ের জন্য আমেনাকে মনোনীত করেন। আমেনা ছিলেন ওয়াহাব ইবনে আবদে মান্নাফ ইবনে যোহরা ইবনে কেলাবের কন্যা। এরা বংশ মর্যাদার দিক থেকে কোরাইশদের মধ্যে সর্বোত্তম বলে বিবেচিত হতো। আমেনার পিতা বংশ মর্যাদা এবং অভিজাত্যের দিক থেকে বনু যোহরা গোত্রের সদার ছিলেন। বিবি আমেনা বিয়ের পর পিত্রালয় থেকে বিদায় নিয়ে স্বামীগৃহে আগমন করেন। কিছুদিন পর আবদুল মোত্তালেব আবদুল্লাহকে খেজুর আনয়নের জন্য মদিনায় পাঠান। আবদুল্লাহ সেখানে ইন্তেকাল করেন।
কোন কোন সীরাতে রচয়িতা লিখেছেন যে, আবদুল্লাহ ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া গিয়েছিলেন। কোরাইশদের একটি বাণিজ্য কাফেলার সাথে মক্কায় ফিরে আসার সময় অসুস্থ হয়ে মদিনায় অবতরণ করেন এবং সেখানে ইন্তেকাল করেন। নাবেগা যাআদীর বাড়িতে তাঁকে দাফন করা হয়। সে সময় তাঁর বয়স ছিল পঁচিশ বছর। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে আল্লাহর রসুল তখনো জন্মগ্রহণ করেননি। কারো কারো মতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়া সাল্লামের জন্ম তার পিতার ইন্তেকালের দুই মাস আগে হয়েছিল। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৫৬, ১৫৮, ফেকহুস সিয়ার মোহাম্মদ গাযালী, পৃ-৪৫, রহমাতুল লিল আলামিন, ২য় খন্ড, পৃ-৯১)
স্বামী মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর আমেনা বেদনা মথিত কণ্ঠে আবৃত্তি করলেন, বাতহার যমীন হাশেমের বংশধর থেকে খালি হয়ে গেছে। মৃত্যু তাকে এক ডাক দিয়েছে এবং তিনি আমি হাযির বলেছেন। তিনি রাঙ্গ ও খুরুশের মধ্যবর্তী এক জায়গায় শায়িত রয়েছেন। মৃত্যু এখন ইবনে হাশেমের মতো কোন লোক রেখে যায়নি। সেই বিকেলের কথা মনে পড়ে যখন তাঁকে লোকেরা খাটিয়ায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল। মৃত্যু যদিও তাঁর অস্তিত্ব মুছে দিয়েছে কিন্তু তাঁর কীর্তি মুছে দিতে পারবে না। তিনি ছিলেন বড় দাতা এবং দয়ালু (তাবাকাতে ইবনে সাদ ১ম খন্ড, পৃ-৬২)।
মৃত্যুকালে যেসব জিনিস রেখ গিয়েছিলেন সেসব হচ্ছে পাঁচটি উট, এক পাল বকরি, একটি হাবশী দাসী। সেই দাসীর নাম ছিল বরকত, কুনিয়াত ছিল উম্মে আয়মন। তিনি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লামকে দুধ খাইয়েছিলেন (মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আব্দুল্লাহ, পৃ-১২ তালকিহুল ফুহুম, পৃ-১৪, সহীহ মুসলিম ২য় খন্ড পৃ-১৬)।