তবুকের যুদ্ধ
মক্কা বিজয় ছিলো সত্য ও মিথ্যার মধ্যে এক সিদ্ধান্ত মূলক অভিযান। এ অভিযানের পর মক্কা বাসীদের মনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত ও রেসালাত সম্পর্কে কোন প্রকার সন্দেহ অবশিষ্ট ছিলো না। তাই পরিস্থিতির বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটেছিলো। জনগণ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করছিলো। প্রতিনিধি দল প্রেরণ শীর্ষক অধ্যায়ে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করবো। বিদায় হজ্জের সময়ে উপস্থিত মুসলমানদের সংখ্যা থেকে ও এ বিষয়ে আন্দাজ করা যায়। মোট কথা অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান প্রায় হয়েগিয়েছিলো বিধায়, মুসলামনর ইসলামী শরীয়তের শিক্ষা সার্বজনীন করা এবং ইসলমের প্রচার প্রসারে ঐকান্তিকভাবে মনোযোগী হয়ে পড়েছিলো।
যুদ্ধের কারণ
ওই সময়ে এমন একটি শক্তি মদীনার প্রতি দৃষ্টি দিয়েছিলো, যারা কোন প্রকার উস্কানি ছাড়াই মুসলামনদের গায়ে বিবাদ বাধাতে চাচ্ছিলো। এরা ছিলো রোমক শক্তি। সমকালীন বিশ্বে এরা ছিলো সর্ববৃহৎ ও শ্রেষ্ঠ শক্তি। ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ বিবাদের ভূমিকা তৈরী হয়েছিলো শেরহাবিল ইবনে আমর গাস্সানির হাতে। এই ব্যক্তি নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দূত হারেস ইবনে আযদিকে হত্যা করেছিলো। বসরা গভর্নরের কাছে সে দূত পাঠানো হয়েছিলো। এরপর হযরত যায়েদ ইবনে হারেসার নেতৃত্বে নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি সৈন্যদল প্রেরণ করেন। ফলে রোমক ভূমিতে মূতার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু মুসলিম বাহিনী শত্রুদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি। তবু এ অভিযান কাছে ও দূরবর্তী আরব অধিবাসীদের মনে সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিলো।
কায়সারে রোম এ সকল প্রভাব প্রতিক্রিয়া এবং এর পরিমাণ উপেক্ষা করতে পারেনি। মুসলিম অভিযানের ফলে আরেবের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে স্বাধীনতা চেতনা মাথাচড়া দিয়ে উঠেছিলো। এটা ছিলো তার জন্যে একট বিপজ্জনক অবস্থা। অথচ জনগণের স্বাধীনতার চেতনা সীমান্তবর্তী এলাকায় রোমকদের জন্যে চ্যলেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। বিশেষ করে সিরিয়ার সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এ কারণে কায়সারে রোম ভাবলো যে, মুসলমানদের শক্তি বিপজ্জনক হয়ে ওঠার আগেই দমন ও নিশ্চিহ্ণ করে দিতে হবে। এতে করে রোমের সাথে সংশ্লিষ্ট আরব এলাকাসমূহে ফেতনা ও হাঙ্গামা মাথাচড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পাবে না।
এসব যুদ্ধের কারণে মূতার যুদ্ধের পর এক বছর যেতে না যেতেই কায়েসারে রোম, রোমের অধিবাসী এবং রোমের অধীনস্ত আরব এলাকাসমূহ থেকে সৈন্য সমাবেশ শুরু করলেন। এটা ছিলো মুসলমানদের সাথে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পূর্ব প্রস্তুতি।
রোম ও গাসসানের প্রস্তুতির সাধারণ খবর
এদিকে মদীনায় পর্যায়ক্রমে খবর আসছিলো যে, রোমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক সিদ্ধান্তমূলম যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। এ খবর পেয়ে মুসলমানরা অস্বস্তি এবং উৎকন্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। হঠাৎ কোন শব্দ শুনলেই তারা চমকে উঠতেন। তারা ভাবতেন, রোমকরা বুঝি এসে পড়েছে। নবম হিজরীতেস একটি ঘটনা ঘটলো। এ ঘটনা থেকেই মুসলমানদের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার পরিচয় যায়। এ সময়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের সাথে ঈলা১[নারীর কাছে না যাওয়ার কসম করা। এই কসম চার মাস বা তার চেয়ে কম মেয়েদের জন্যে শরীয়ত অনুযায়ী এর জন্যে কোন বিধান প্রযোজ্য হবে না। আর যদি চার মাসের বেশী মেয়াদের জন্যে কসম করা হলে চার মাস পুরো হওয়ার সাথে সাথে শরয়ী আদালতে বিষয়টি রুজু হবে এবং আদালত বলবে যে, আপনি হয় স্ত্রীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিন অথবা তাকে তালাক দিন। অবশ্য কোন কোন সাহাবার মতে চার মাস কেটে যাওয়ার পর আপন আপনি তালাক হয়ে যায়।] করে তাঁদের ছেড়ে একটি পৃথক ঘরে উঠেছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম প্রথম দিকে কিছু বুঝে উঠতে পারেননি। তারা ভেবেছিলেন, নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন। এতে সহাবাদের মধ্যে গভীর চিন্তা ও মনোবেদনা ছড়িয়ে পড়েছিলো। হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) এ ঘটনা করতে গিয়ে বলেন, আমার একজন আনসার সঙ্গী ছিলো। নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে আমি অনুপস্থিত থাকলে তিনি আমার কাছে খবর নিয়ে আসতেন, যখন তিনি অনুপস্থিত থাকতেন, তখন আমি তার কাছে খবর নিয়ে আসতাম। এরা দু’জন মদীনার উপকন্ঠে বসবাস করতেন। একজন অন্যজনের প্রতিবেশী ছিলেন। পর্যায়ক্রমে নবী (আ.)-এর খেদমতে হাযির হতেন। হযরত ওমর বলেন, সেই সময়ে গাস্সান অধিপতির ব্যাপারে আমরা আশঙ্কা করছিলাম। আমাদের বলা হয়েছিলো যে, গাস্সান রাজ আমাদরে ওপর হামলা করতে পারেন। এ কারণে সব সময় উদ্বেগ উৎকন্ঠার মধ্যে দিন কাটাতাম। আমার আনসার সাথী একদিন হঠাৎ এসে দরজায় করাঘাত করে বললেন, খোলো খোলো। আমি বললাম, গাস্সানী কি এসে পড়েছে? তিনি বললেন, না, বরং তার চেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তাঁর স্ত্রীদের থেকে আলাদ হয়ে গেছেন। ২[সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৭৩০]
অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, হযরত ওমর (রা.) বলেন, আামদের মধ্যে এ মর্মে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, গাস্সান সম্রাট আমাদের ওপর হামলা করতে ঘোড়া প্রস্তুত করেছেন। আমার সাথে নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে একদিন এসে দরজায় জোরে জোরে আঘাত করতে লাগলেন। তিনি বাইরে থেকে বললেন, ঘুমিয়ে পড়েছ নাকি? আমি উৎকন্ঠিতভবে বাইরে এলাম। তিনি বললেন, বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আমি বললাম, কি হয়েছে? গাস্সান কি এসে পড়েছে? তিনি বললেন, না এর চেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন। ৩[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৩৩৪]
এ ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, সে সময় মুসলমানদের ওপর রোমকদের হামলার হুমকি ছিলো কতো মারাত্মক। নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম মদীনায় পৌঁছার পর মোনাফেকরা রোমকদের যুদ্ধ প্রস্তুতির অতিরঞ্জিত খবর মুসলমানদের মধ্যে প্রচার করছিলো। কিন্তু মোনাফেকরা লক্ষ্য করছিলো যে, সব ক্ষেত্রেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম সফল হচ্ছেন এবং তিনি বিশ্বের কোন শক্তিকেই ভয় পান না। তাঁর সামনে যে কোন বাধা এলেই তা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। এসব সত্তেও মোনাফেকরা মনে মনে আশা করছিলো যে, মুসলমানরা এবার আর রক্ষা পাবে না, তারা নাকানি চুবানি খাবেই। সেই প্রত্যাশিত তামাশা দেখার দিন আর বেশী দূরে নয়। এরূপ চিন্তা-ভাবনার প্রেক্ষিতে তারা একটি মসজিদ তৈরী করলো, যা ‘মসজিদে দেরার’ নামে পরিচিত।। উক্ত মসজিদে মোনাফেকরা বসে আড্ডা দিত এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা প্রকার ষড়যন্ত্র করতো। মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, মুসলিম উম্মার ঐক্যে ফাটল ধরানো এবং শত্রুদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে প্রস্তুত করার লক্ষ্যেই এটি তৈরী করা হয়েছিলো। অসৎ উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত সেই মসজিদে তারা শুধু ইসলাম বিরোধী কাজে লিপ্ত থেকেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং সে মসজিদে নামায আদায়ের জন্যে নবী (স.)-কে আবেদন জানিয়েছিলো। এর মাধ্যমে মোনাফেকরা সরল প্রাণ মুসলমানদের ধোঁকা দিতে চাচ্ছিল। নবী (স.) যদি একবার নামায আদায় করেন, তাহলে সাধারণ মুসলমানরা মোনাফেকদের প্রতিষ্ঠিত সেই মসজিদের ঘৃণ্য উদ্দেশ্য বুঝতে পারবে না। তাঁরা ধারণাও করতে পারবেন না যে, মসজিদ নামের এ ঘরে বসে তাদের বিরুদ্ধে কিরূপ ভয়ানক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করা হচ্ছে। তাছাড়া এ মসজিদে কারা যাতায়াত করছে মুসলমানরা সেদিকেও লক্ষ্য রাখবে না। এ মসজিদ এমনি করে মোনাফেক এবং তাদের বাইরের মিত্রদের ষড়যন্ত্রের একটা আখড়ার পরিণত হবে। কিন্তু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম সেই মসজিদে সাথে সাথে নামায আদায় করতে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, ইনশাআল্লাহ যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে সেই মসজিদে নামায আদায় করবো। সে সময়ে তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু মোনাফেকরা তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে পারেনি। আল্লাহ তায়ালা তাদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে এস নবী শ্রেষ্ঠ সেই মসজিদে নামায আদায়ের পরিবর্তে সেটি ধ্বংস করে দেন।
রোম ও গাস্সানের প্রস্তুতির বিশেষ খবর
এ সময়ে সিরিয়া থেকে তেল আনতে যাওয়া নাবেতিদের ৪[এরা নাবেত ইবনে ইসমাইল (আ.)-এর বংশধর। এক সময় এরা পাটরা এবং হেজাযের উত্তরাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেছিলে। কিন্তু কালক্রমে শক্তিহীন হয়ে কৃষক ও ব্যবসায়ীতে হয় পরিণত হয়] কাছে হঠাৎ জানা গেলো যে, হিরাক্লিয়াস ৪০ হাজার দুর্ধর্ষ সৈন্যের এক বহিনী তৈরী করেছেন এবং রোমের এক বিখ্যাত যোদ্ধা সেই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব করছেন। সেই কমান্ডার তার অধীনে খৃষ্টান গোত্র লাখাম জাযাম প্রভৃতিকে সমভেত করেছে এবং অগ্রবর্তী বাহনিী বালকা নামক জায়গায় পৌঁছে গেছে। এমনিভাবে এক গুরুতর সমস্যা মুসলমানদের সামনে দেখা দিলো ।
পরিস্থিতির নাযুকতা
সেই সময় প্রচন্ড গরম পড়েছিলো। দেশে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা এবং দুর্ভিক্ষপ্রায় অবস্থা বিরাজ করছিলো। এ কারণে অনেকেই ছায়ায় এবং ফলের কাছাকছি থাকতে চাচ্ছিলো। তারা তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধ যেতে চাচ্ছিলেন না। তদুপরি পথের দূরত্ব ছিলো, পথ ছিলো দুর্গম ও বন্ধুর। সব কিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি ছিলো বড়োই নাযুক।
তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত
আল্লাহর নবী এ পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, এমন সঙ্কট সময়ে যদি রোমকদের সাথে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে শৈথিল্য ও অলসতার পরিচয় দেয়া হয় তাহলে রোমকরা মুসলিম অধিকৃত ও অধ্যুষিত এলাকাসমূহে প্রবেশ করবে। ফলে ইসলামের দাওয়াত, প্রচার এবং প্রসারে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। মুসলমানরা সামরিক শক্তির স্বাতন্ত্র হারাবে। হোনায়েনের যুদ্ধে পর্যুদস্ত, বাতিল ও কুফুরী শক্তি পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠবে। বাইরের শক্তির সাথে গোপনে যোগাযোগ রক্ষাকারী মোনাফেকরা যারা সময় ও সুযোগের অপেক্ষা করছিলো তারা মুসলমানদের পিঠে ছুরিকাঘাত করবে। পেছনে থাকবে শত্রুদল মোনাফেক আর সামনে থাকবে বিধর্মী রোমক সৈন্যদল। এতে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে নিয়োজিত শ্রম-সাধনা ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়ে পড়বে। নবী এবং সাহাবাদের দীর্ঘদিনের কষ্ট বিফলে যাবে। অনেকক কষ্টে অর্জিত সাফল্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। অথচ এই সাফল্যের পেছনে মুসলমানদের ত্যাগ তিতিক্ষার ইতিহাস বড়োই দীর্ঘ।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসব সম্ভাবনা ভালোভাবে অনুধাবন করছিলেন। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, মুসলিম অধিকৃত ও অধ্যুষিত এলাকায় বিধর্মীদের প্রবেশের সুযোগ দেয়ার তো দূরে থাক বরং ওদের এলাকায় গিয়েই আঘাত করা হবে।
রোমকদের সাথে যুদ্ধ প্রস্তুতির ঘোষণা
উল্লিখিত বিষয়সমূহ পর্যালোচনার পর নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের মধ্যে যুদ্ধ প্রস্তুতির নির্দেশ দিলেন। মক্কাবাসী এবং আরবের বিভিন্ন গোত্রকেও যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হলো। অন্য সময়ে নবী শ্রেষ্ঠ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধের ক্ষেত্রে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতেন গন্তব্যের কথা গোপন রাখতেন। কিন্তু এবার তা করলেন না। প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন যে, রোমকদের সাথে যুদ্ধ হবে।
মুসলমানরা যেন যুদ্ধের জন্যে ভালোভাবে প্রস্তুত হতে পারেন। এ জন্যেই প্রকাশ্যে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো। যুদ্ধের জন্যে মুসলামনদের প্রস্তুতিতে উদ্ধুদ্ধ করতে সূরা তাওবার একাংশও নাযিল হয়েছিলো। সাথে সথে তিনি সদকা খয়রাত করার ফযিরত বর্ণনা করেন এবং আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয়ে মুসলমানদের অনুপ্রাণিত করেন।
যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্যে মুসলামনদের প্রচেষ্টা
সাহাবায়ে কেরাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ পাওয়ার পরই যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি শুরু করেন। মদীনার চারিদিক থেকে আগ্রহী মুসলমানরা আসতে থাকেন। যাদের মনে মোনাফেকী অর্থাৎ নেফাকের অসুখ রয়েছে, তারা ছাড়া কেউ এ যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার কথা ভাবতেই পারেননি। তবে তিন শ্রেণীর মুসলামন ছিলেন পৃথক। তাদের ঈমান ও আমলে কোন প্রকার ত্রুটি ছিলো না। গরীব ক্ষুধাতুর মুসলামনরা আসছিলেন এবং যানবাহনের ব্যবস্থা করার আবেদন জানাচ্ছিলেন। কিন্তু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অক্ষমতা প্রকাশ করছিলেন। সূরা তাওবায় এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ওদের কোন অপরাধ নেই, যারা তোমার কাছে বহনের জন্যে এলে তুমি বলেছিলে, ‘তোমাদের জন্যে কোন বাহন আমি পাচ্ছি না। ওরা অর্থ ব্যয়ে অসামর্থতাজনিত দুঃখে অশ্রু বিগলিত চোখে ফিরে গেলো।’
মুসলমানরা সদকা-খয়রাতের দিক থেকে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন । হযরত ওসমান (রা.) সিরিয়ায় ব্যবসার জন্যে প্রেরণের উদ্দেশ্যে একটি কাফেলা তৈরী করেছিলেন। এতে সুসজ্জিত দুইশত উট ছিলো। দুশো উকিয়া অর্থাৎ প্রায় সাড়ে উনত্রিশ কিলো রৌপ্য ছিলো তিনি এইসবই সদকা করে দিলেন। এরপর পুনরায় একশত উট সুসজ্জিত অবস্থায় দান করলেন। তিনি এক হাজার দীনার অর্থাৎ প্রায় ৫ কিলো সোনা নিয়ে এলেন এবং তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেসব উল্টেপাল্টে দেখছিলেন আর বলছিলেন, আজকের পর থেকে ওসমান যা কিছুই করুক না কেন, তার কোন ক্ষতি হবে না। ৫[জামে তিরিমিয, মানাকের ওসমান ইবনে আফফান, ২য় খন্ড, পৃ-২১১] এরপরও হযরত ওসমান (রা.) সদকা করেন। সব মিলিয়ে দেখা গেলো যে, তাঁর সদকার পরিমাণ নগদ অর্থ ছাড়াও ছিলো নয়শত উট এবং একশত ঘোড়া।
এদিকে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) দু’শো উকিয়া অর্থাৎ প্রায় সাড়ে উনত্রিশ কিলো চাঁদি নিয়ে আসেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তাঁর ঘরের সবকিছু নিয়ে আসেন এবং ঘরে শুধু আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলকে রেখে আসেন। তাঁর সদকার পরিমাণ ছিলো চার হাজার দিরহাম। তিনিই প্রথমে তার সদকা নিয়ে হাযির হয়েছিলেন। হযরত ওমর (রা.) তার অর্ধেক ধন-সম্পদ নিয়ে হাযির হন। হযরত আব্বাস (রা.) তাঁর বহু ধন-সম্পদ নিয়ে আসেন। হযরত তালহা হযরত সা’দ ইবনে ওবাদা এবং মোহাম্মদ ইবনে মোসলমাও অনেক ধন-সম্পদ নিয়ে হাযির হন। হযরত আসেম ইবনে আদী নব্বই ওয়াসক অর্থাৎ সাড়ে ১৩ হাজার কিলো বা সোয়া তের টন খেজুর নিয়ে আসেন। অন্যান্য সাহাবারাও সাধ্যমত সদকা নিয়ে আসেন। কেউ এক মুঠো কেউ দুই মুঠোও দেন, তাদের এর বেশী দেয়ার সামর্থ ছিলো না।
মহিলারা তাদের হার, বজুবন্দ, ঝুমকা, পা-জেব, বালি, আংটি ইত্যাদি সাধ্যমাফিক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কেদমতে প্রেরণ করেন। কেউ বিরত থাকেননি, কেউ পিছিয়ে থাকেননি। কৃপনতার চিন্তা কারো মনে আসেনি। বেশী বেশী যারা সদকা দিচ্ছিলেন, মোনাফেকরা তাদের খোঁটা দিচ্ছিলো যে, ওরা একটি দু’টি খেজুর দিয়ে কায়সারের দেশ জয় করতে চলেছে। কোরআনের সূরা তাওবায় এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মোমেনদের মধ্যে যারা স্বতস্ফূর্তভাবে সদকা দেয় এবং যারা নিজ শ্রম ব্যতীত কিছুই পায় না, তাদেরকে যারা দোষারোপ ও বিদ্রূপ করে, আল্লাহ তায়ালা তাদরে বিদ্রূপ করেন, ওদের জন্যে আছে মর্মন্তুদ শাস্তি।’
তবুকের পথে মুসলিম সেনাদল
বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে ইসলামী বাহিনী প্রস্তুত হলো। প্রিয় নবী এরপর মোহাম্মদ ইবনে মোসলামা মতান্তরে ছাবা ইবনে আরফাতাকে মদীনর গভর্নর নিযুক্ত করেন এবং পরিবার পরিজনের তত্ত্বাবধানের জন্যে হযরত আলীকে (রা.) মদীনায় অবস্থানের নির্দেশ দেন। কিন্তু মোনাফেকরা সমালোচনা করে। এর ফলে হযরত আলী (রা.) মদীনা থেকে বেরিয়ে পড়েন এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মিলিত হন। নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে পুনরায় মদীনায় ফেরত পাঠান তিনি বলেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তোমার সাথে আমার সম্পর্ক মূসা এবং হারুনের সম্পর্কের মতো। অবশ্য, আমার পরে কোন নব আসবে না।
নবী আল-আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ব্যবস্থাপনার পর উত্তরদিকে রওয়ান হন। নাসাঈ- এর বর্ণনা অনুযায়ী সেদিন ছিলো শনিবার। গন্তব্য ছিলো তবুক। মুসলিম সৈন্যদের সংখ্যা ছিলো ত্রিশ হাজার। ইতিপূর্বে এতো বড় সেনাদল তৈরী হয়নি। এতো বড় সৈন্যদলে জন্যে মুসলামানদের সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও পুরো সাজ-সজ্জা সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। যানবাহন এবং পাথেয় ছিলো অপ্রতুর। প্রতি আঠার জন সৈন্যের জন্যে ছিলো একটি উট, সেই উটে উক্ত আঠারো জন পর্যায়ক্রমে সওয়ার হতেন। খাদ্য সামগ্রীর অপ্রতুলতার কারণে অনেক সময় গাছের পাতা খেতে হচ্ছিলো এবং উটের সংখ্যা কম হওয়া সত্তেও ক্ষুধার প্রয়োজনে উট যবাই করতে হচ্ছিলো। এ সব কারণে এ বাহিনীর নাম হয়েছিলো ‘জায়েশ উছরত’ অর্থাৎ অভাব অনটনের বাহিনী।
তবুক যাওয়ার পথে ইসলামী বাহিনী ‘হেজ’ অর্থাৎ সামুদ জাতির অবস্থান এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন। সামুদ জাতি ‘ওয়াদিউল কোরার’ ভেতরে পাথর খুঁড়ে বাড়ী তৈরী করেছিলো। সাহাবায়ে কেরাম সেখানে কূপ থেকে পানি উত্তোলন করেন। পানি তুলে রওয়ানা হওয়ার সময় নবী আল-আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম , ‘তোমরা এ জায়গায় পানি পান করো না এবং সে পানি ওযুর জন্যেও ব্যবহার করো না। তোমরা সেই কূপ থেকে পানি নাও, যে কূপে হযরত সালেহ (আ.)-এর উটনী পান পান করতো।’
বোখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী আল-আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেজর অর্থাৎ দিয়ারে সামুদ অতিক্রমের সময় বলেলেন, সে যালিমদের অবস্থান স্থলে প্রবেশ করো না, তাদের ওপর যে বিপদ এসেছিলো সে বিপদ তোমাদরে ওপর যেন না আসে। তবে হাঁ, কাঁদতে কাঁদতে প্রবেশ করতে পারো। এরপর তিনি নিজের মাথা আবৃত করে দ্রুত সেই স্থান অতিক্রম করে গেলেন। ৬[ সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৬৩৭]
পথে পানির ভীষণ সমস্যা দেখা দিল। শেষ পর্যন্ত সাহাবারা নবী আল-আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আবেদন জানালেন। তিনি দোয়া করলেন। আল্লাহ তায়ালা মেঘ পাঠিয়ে দিলেন। প্রচুর বৃষ্টি হলো। সাহাবারা তৃপ্তির সাথে পানি পান করলেন এবং প্রয়োজনীয় পানি সংরক্ষণও করলেন।
তাবুকের কাছাকাছি পৌঁছার পর নবী আল-আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ইনশা -আল্লাহ আগামীকাল তোমরা তবুকের জলাশয়ের কাছে পৌঁছে যাবে। তবে চাশত-এর সময়ের আগে পৌঁছুতে পারবে না। যারা আগে পৌঁছুবে তারা যেন আমি না যাওয়া পর্যন্ত ওখানের পানিতে হাত না দেয়।
হযরত মায়া‘য (রা.) বলেন, তবুকে আমরা পৌঁছে দেখি আমাদের দু’জন সঙ্গী আগেই সেখানে পৌঁছলেন। ঝর্ণা থেকে অল্প অল্প পানি উঠছিলো। নবী আল-আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এখানের পানিতে হাত লাগিয়েছো? তারা বললো, হাঁ। নবী একথা শুনে আল্লাহ তায়ালা যা চেয়েছিলেন তাই বললেন। এরপর ঝর্ণা থেকে আজলার সামন্য পানি নিলেন। ধীরগতিতে আসা পানি হাতের তালুতে জমা হওয়ার পার সে পানি দিয়ে হাতমুখ ধুলেন তারপর সে পানিও ঝর্ণায় ফেলে দিলেন। এরপর ঝর্ণায় প্রচুর পানি উঠতে লাগলো। সাহাবারা তৃপ্তির সাথে সে পানি পান করলেন। এরপর নবী আমাকে বললেন, হে মায়া’য যদি তুমি দীর্ঘজীবী হও, তবে দেখতে পাবে যে, এখানে বাগান সজীব হেয় উঠেছে। ৭[মুসরিম শরীফ, ২য় খন্ড, পৃ-২৪৬]
তবুক যাওয়ার পথে মতান্তরে তবুক পৌঁছার পর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আজ রাতে প্রচন্ড ঝড় হবে, তোমরা কেউ উঠে দাঁড়াবে না। যাদের কাছে উট থাকবে তার উটের রশি শক্ত করে ধরে রাখবে। রাতে প্রচন্ড ঝড় হলো। একজন সাহাবী উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, ঝড়ের তান্ডব তাকে উড়িয়ে নিয়ে দুই পাহাড়ের মাঝখানে ফেলে দিয়েছিলো।১{ঐ]
এই সফরের সময় নবী যোহর ও আছরের নামায একত্রে এবং মাগরেবের ও এশার নামায একত্রে আদায় করতেন। জমে তাকদিম জমে তাখির দু’টোই করেছিলেন। জমে তাকদিম অর্থাৎ কখনো যোহর ও আছরের নামায যোহরের সময়েই আদায় করতেন এবং মাগরেব এশার নামায মাগরেবের সময়েই আদায় করতেন। জমে তাখির অর্থ কখনো যোহর ও আছরের নামায আছরের সময় আদায় করতেন। কখনো মাগরেব ও এশার নামায সময়ে আদায় করতেন।
তবুকে ইসলামী বাহিনী
ইসলামী বাহিনী তবু অবতরণের পর তাঁবু স্থাপন করলেন। তারা রোমক সৈন্যদের সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত ছিলেন। নবী আল-আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তেজস্বিনী ভাষায় সাহাবাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। সে ভাষণে তিনি দুনিয়া ও আখরাতের কল্যাণের জন্যে সাহাবাদের অনুপ্রাণিত করালেন, সুসংবাদ দিলেন। এই ভাষণে সৈন্যদের মনোবল বেড়ে গেলো। কোন কিছুর অভাবই তাদের মুখ্য মনে হলো না। অন্যদিকে রোম এবং তাদের বাহিনীর অবস্থার এমন হলো যে, তারা বিশাল মুসলিম বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে ভীত হয়ে পড়লো, সামনে এগিয়ে মোকাবেলা করার সাহস করতে পারল না। তারা নিজেদের শহরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লো। বিধর্মীদের এ পিছুটান মুসলামনদের জন্যে কল্যাণকর প্রমাণিত হলো। আরব এবং আরবের বাইরে মুসলানদের সামরিক শক্তির শ্রেষ্ঠত্বের আলোচনা হতে লাগলো। এ অভিযানে মুসলানরা যে রাজনৈতিক সাফল্য লাভ করে রোমকদের সাথে যুদ্ধ করলে সেই সাফল্য অর্জন সম্ভব হতো না।
বিস্তারিত বিবরণ এই যে, আায়েলার শাসনকর্তা ইয়াহানা ইবনে রওবা নবী আল-আমিনের কাছে এসে জিজিয়া আদয়ের শর্ত মেনে নিয়ে সন্ধি চুক্তি করলেন। জাররা এবং আজরুহ-এর অধিবাসীরাও হাযির হয়ে জিজিয়া দেয়ার শর্ত মেনে নিলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে একটি চুক্তিপত্র লিখে দিলেন, তারা সেটি কাছে রাখলো। আয়েলোর শাসনকর্তাকে লিখে দেয়া একটি চুক্তি বা সন্ধিপত্র ছিল নিম্মরূপ, পরম করুনাময় ও অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। এ শান্তি পরওয়ানা আল্লাহ এবং নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে ইয়াহনা ইবনে রওবা এবং আয়েলার অধিবাসীদের জন্যে লেখা হচ্ছে। জলেস্থলে তাদের কিশতি এবং কাফেলার জন্যে আল্লাহর জিম্মা এবং নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জিম্মা এবং এই জিম্মা সেইসব সিরীয় ও সমুদ্রের বাসিন্দাদের জন্যে যারা ইযাহনার সাথে থাকবে। তবে হাঁ, এদের মধ্যে যদি কেউ গোলমাল পাকায়, তবে তার অর্থ-সম্পদ তার জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে মোহাম্মদ পারবে না। এ ধরনের ব্যক্তির ধন-সম্পদ যে কেউ গ্রহণ করবে, সেটা গৃহীতার জন্যে বৈধ হবে। ওদের কোন কূপে অবতরণ এবং জলেস্থলে কোন পথে চলাচলের ক্ষেত্রে নিষেধ করা যাবে না।’
এছাড়া রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত খালেদ ইবনে ওলীদকে ৪২০ জন সৈন্যের একটি দল দিয়ে দওমাতুল জন্দলের শাসনকর্তা আকিদের –এর কাছে পাঠালেন। খালেদকে বলে দেয়া হলো যে, তুমি দেখবে যে, সে নীল গাভী শিকার করছে। হযরত খালেদ গেলেন। শাসনকর্তার দুর্গ যখন দেখা যাচ্ছিলো হঠাৎ একটি নীল গাভী বের হলো এবং দুর্গের দরজায় গুঁতো মারতে লাগলো। আকিদের সেই গাভী শিকারে বের হলেন। হযরত খালেদ (রা.) তাঁর সৈন্যসহ আকিদেরকে গ্রেফতার করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে নিয়ে এলেন। তিনি আকিদরে প্রাণ ভিক্ষা দিলেন এবং দুই হাজার উট, আটশত ক্রীতদাস, চারশত বর্ম এবং চারশত বর্শা পাওয়ার শর্তে চুক্তি করলেন।
আকিদের জিজিয়া দেয়ার পাওয়ার দেয়ার কথাও স্বীকার করলেন। নবী আকিদের-সাথে ইয়াহনাসহ দওমা, তবুক, আয়লা এবং তায়মার শর্তে সন্ধি স্থাপন করলেন।
এ অবস্থা দেখে রোমকদের ক্রীড়নক গোত্র সমূহ বুঝতে পারলো , রোমকদরে পায়ের তলায় আর মাটি নেই।এবার প্রভু বদল হয়ে গেছে। রোমকদের আনুগত্যের প্রয়োজন নেই, তাদরে কর্তৃত্বের দিন শেষ। এ কারণে তারাও মুসলামনদের মিত্র হয়ে গেলো। এমনি করে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা বিস্তৃত হয়ে রোমক সীমান্তের সাথে মিলিত হলো এবং রোমকদের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বহুলাংশে লোপ গেল।
মদীনায় প্রত্যাবর্তন
ইসলামী বাহিনী তবুক থেকে সফল ও বিজয়ীর বেশে ফিরে আসে। কোন সংঘর্ষ হয়নি। যুদ্ধের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা ছিলেন মোমেনীদের জন্যে যথেষ্ট। পথে এক জায়গায় একটি ঘাঁটিতে ১২জন মোনাফেক নবী আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার চেষ্টা করে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ছিলেন হযরত আম্মার (রা.)। তিনি উটের রশি ধরে এগুচ্ছিলেন। পেছনে হযরত হোযায়ফা ইবনে ইয়ামান (রা.)। তিনি উট হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। অন্য সাহাবারা তখন ছিলেন দূরে। মেনাফেক কুচক্রীরা এ সময়কে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে নাপাক ইচ্ছা চরিতার্থ করতে সামনে অগ্রসর হলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সফরসঙ্গী দুইজন সাহাবী মোনাফেকদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলেন। ১২জন মোনাফেক নিজেদের চেহারা ঢেকে অগ্রসর হচ্ছিল। প্রিয় নবী ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। তিনি হযরত হোযায়ফা পাঠালেন। হযরত হোযায়ফা পেছনের দিকে গিয়ে মোনাফেকদের বাহন উটগুলোকে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে লাগলেন। এই আঘাতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রভাবিত করলেন। তারা দ্রুত পেছনের দিকে গিয়ে সাহাবায়ে কেরামের সাথে মিশে গেলো। এর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের নাম প্রকাশ করে চক্রান্ত ফাঁস করে দিলেন। এ কারণ হযরত হোযায়ফাকে বলা হয় ‘রাযদান ’অর্থাৎ গোপনীয়তা রক্ষাকারী। এ ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অ হাম্মু বেমা লাম ইয়া নালু’ অর্থাৎ তারা এ কাজের জন্যে ইচ্ছা করেছিলো কিন্তু তারা তা করতে পারেনি।
সফরের শেষ পর্যায়ে নবী আল আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দূর থেকে মদীনা দেখে বললেন, ওই হচ্ছে তাবা ওই হচ্ছে ওহুদ। এটি সেই পাহাড় যে পাহাড় আমাকে ভালোবাসে এবং যে পাহাড়কে আমিও ভালোবাসি। এদিকে তার আগমন সংবাদ মদীনায় ছড়িয়ে পড়লে আবাল বৃদ্ধ বনিতা বেরিয়ে পড়ে বিপুল উষ্ণতায় তাঁকে অভ্যর্থনা জানালো। তারা তখন গাইছিলো ৯[এটি ইবনে কাইয়েমের কথা। ইতিপূর্বে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে] ‘আমাদের ওপর ছানিয়াতুল বেদা থেকে চতুর্দশীর চাঁদের উদয় হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহকে যারা ডাকার তারা ডাকবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত শোকর করা আমাদের জন্যে ওয়াজেব। ’
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তবুকের উদ্দেশ্যে রজব মাসে রওয়ানা হয়েছিলেন এবং রমযান মাসে ফিরে এসেছিলেন। এই সফরে পুরো ৫০ দিন সময় অতিবাহিত হয়েছিলো। তন্মধ্যে ২০দিন তিনি তবুকে ছিলেন আর ৩০দিন লেগেছিলো যাওয়া আসায়। জীবদ্দশায় সশরীরে উপস্থিত থেকে এটাই ছিলো নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেষ জেহাদ।
বিরোধীদের বিবরণ
তবুকের যুদ্ধ ছিলো বিশেষ অবস্থার কারণে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে কঠিন পরীক্ষা। এর মাধ্যমের ঈমানদার এবং অন্য লোকদের পার্থক্য প্রমাণিত হয়েছিলো। এ ধরণের কঠিন সময়ে আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদের পরীক্ষা করেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা সূরা আল-ইমরানের বলেন, ‘অসৎকে সৎ থেকে পৃথক না করা পর্যন্ত তোমরা যে অবস্থায় রয়েছো আল্লাহ তায়ালা মোমেনদের সে অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না। অদৃশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অবহিত করার নন। তবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূলদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন ’
এই যুদ্ধে সকল মোমেনীন সাদেকীন অংশগ্রহণ করেন এবং যুদ্ধে অনুপস্থিতি নেফাকের নিদর্শনরূপে বিবেচিত হয়। কেউ পেছনে থেকে গেলে তার সম্পর্কে নবী আল আমিনের কাছে উল্লেখ করা হলে তিনি বলেছিলেন, ওর কথা ছাড়ো। যদি তার মধ্যে কল্যাণ থাকে তবে আল্লাহ শীঘ্র তাকে তোমাদের কাছে পৌঁছে দেবেন আর যদি না থাকে তবে, অচিরেই তার থেকে তোমাদরে নাজাত দেবেন। মোটকথা এই যুদ্ধ থেকে দুই শ্রেণীর লোক দূরে ছিলো। এক শ্রেণীর লোক মা’যুর বা অক্ষম, অন্য শ্রেণী মোনাফেক। যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ঈমান আনার দাবীতে ছিলো মিথ্যা, তারাই ছিলো মোনাফেক, তারা মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে যুদ্ধে না যাওয়ার জন্যে ওযর খাড়া করেছিলো। এদের কেউ কেউ যুদ্ধে না যাওয়ার জন্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুমতিও নেয়নি। তবে এদর মধ্যে তিনজন ছিলেন পাক্কা মোমেন এবং ঈমানদার। তারা যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ ছাড়াই যুদ্ধ থেকে দূরে ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাদের তওবা কবুল করেন।
এ ঘটনার বিবরণ এই যে, যুদ্ধ থেকে নবী মুরসলিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভ্যাস মোতাবেক প্রথমে মসজিদে নববীতে গিয়ে দুই রাকাত নামায আদায় করলেন। এরপর তিনি সেখানে বসলেন। মোনফেকদের সংখ্যা ছিল ৮০ বা এর চেয়ে কিছু বেশী। ১০[ওয়াকেদী লিখেছেন, এই সংখ্যা মদীনার মোনাফেকদের । এছাড়া বনু গেফার এবং অন্যান্য গোত্রের মোনাফেকদের সংখ্যা ছিল ৮২। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার অনুসারীদের হিসাব এর মধ্যে ধরা হয়নি। তাদের সংখ্যাও ছিল অনেক। দেখুন ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড, পৃ-১১৯] তারা মসজিদের নববীতে এসে যুদ্ধে যেতে না পারার ওযর বর্ণনা এবং কসমের পর কসম করছিলো।
নবী মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বাইরে অভিব্যক্তি গ্রহণ করে বাইয়াত গ্রহণ করলেন, তাদের জন্যে মাগফেরাতের দোয়া করেন এবং তাদের ভেতরের অবস্থা আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিলেন।
তিনজন মোমেনীন সাদেকীনের প্রসঙ্গ বাকি থাকলো। এর হচ্ছেন কা’ব ইবনে মালেক মারারা ইবনে রবি এবং হেলাল ইবনে উমাইয়া। তারা সত্যতার সাথে বললেন, আমাদের যুদ্ধে না যাওয়ার মতো কোন কারণ ছিলো না। এ কথা শুনে নবী মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের বললেন, তারা যেন ওদের সাথে বাক্যলাপ না করেন। ফলে তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বয়কট করা হলো। চেনা মানুষ অচেনা হয়ে গেলেন, যমিন ভয়ানক হয়ে উঠলো, পৃথিবী তার প্রশস্ততা সত্তেও সংকীর্ণ হয়ে গেলো। তাদরে জীবন মারাত্মক সঙ্কটের সম্মুখীন হলো। কঠোরতা এমন বেড়ে গেলো যে, ৪০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা তাদের তওবা কবুল করলেন। সূরা তাওবার এই আয়াত নাযিল হলো ‘এবং তিনি ক্ষমা করলেন, অপর তিনজনকেও তাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছিলো, যে পর্যন্ত না পৃথিবী বিস্তৃত হওয়া সত্তেও যাদের জন্যে সঙ্কুচিত হয়েছিলো এবং তারা উপলদ্ধি করেছিলো যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন আশ্রয়স্থল নেই। পরে তিনি ওদের প্রতি অনুগ্রহ পরায়ণ হলেন, যাতে ওরা তওবা করে। আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ঘোষণায় সাধারণভাবে সকল মুসলামন এবং বিশেষভাবে উক্ত তিনজন সাহাবা অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। সাহাবারা ছুটোছুটি করে পরস্পরকে এ খবর দিতে লাগলেন। একে অন্যকে মিষ্টি খাওয়াতে লাগলেন, দান খয়রাত করতে লাগলেন। প্রকৃতপক্ষে এই আয়াত নাযিলের দিন ছিলো তাদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দ এবং সৌভাগ্যের দিন।
যেসব লোক অক্ষমতা ও অপারগতাহেতু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা দুর্বল যার পীড়িত তাদের অবিমিশ্র আনুগত্য থাকে। যারা সৎ কর্মপরায়ণ, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোন কারণ নেই। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালূ।’
এদের সম্পর্কে নবী মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনার কাছে পৌঁছে বলেছিলেন, ‘মদীনায় এমন কিছু লোক রয়েছে, তোমরা যেখানেই করেছো এবং যেখানেই গিয়েছো তারা তোমাদের সঙ্গে ছিলো। অপরাগতার কারণ অর্থাৎ সঙ্গত ওযরের কারণে তারা যুদ্ধে যেতে পারেনি।’ সাহাবারা বলেলেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তারা মদীনায় থেকে বুঝি আমাদের সঙ্গে ছিলেন? নবী মুরসালিন বললেন, ‘হাঁ, মদীনায় থেকে ও তারা তোমাদের সঙ্গে ছিলেন।’
এ যুদ্ধের প্রভাব
তবুক যুদ্ধ জাযিরাতুল আরবের ওপর মুসলমানদের প্রভাব বিস্তার এবং শক্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলো। জনসাধারণ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলো যে, এখন থেকে জাযিরাতুল আরবে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন শক্তির অস্তিত্ব থাকেবে না। পৌত্তলিক এবং মোনাফেকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অব্যাহত ষড়যন্ত্র চালিয়ে নিজেদের প্রত্যাশিত যে সুযোগের স্বপ্ন দেখছিলো সে স্বপ্নও ভেঙ্গে খান খান হয়ে গিয়েছিলো। কেননা তাদের আশা-আকাঙ্খার মূল কেন্দ্র ছিলো রোমক শক্তি। এ যুদ্ধের ফলে সে আশাও ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। এতে কাফের মোনাফেকদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। তারা সুস্পষ্ট ভাবে বুঝতে পেরেছিলো যে, ইসলাম থেকে পলায়ন বা নিস্কৃতি পাওয়ার কোন উপায় নেই।
এমতাবস্থায় মোনাফেকদের সাথে নরম ব্যবহার করার কোন প্রয়োজনীয়তা মুসলমানদের ছিলো না। মোনফেকদের সাথে কঠোর ব্যবহার করতে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিলেন। এমনকি তাদের দেয় দান-খয়রাত গ্রহণ, তাদর জানাযায় নামায আদায়, তাদরে জন্যে মাগফেরাতের দোয়া এবং তাদের কবর যেয়ারত করতে ও নিষেধ করা হলো। মসজিদের নামে তার ষড়যন্ত্রের যে আখড়া তৈরী করেছিলো, সেটিও ধ্বংষ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হলো। মোনাফেকদের সম্পর্কে এমন আয়ানত নাযিল হলো যে, এত তারা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে পড়লো। তাদের চিনতে আর কোন অসুবিধাই রইলো না।
তবুকের যুদ্ধের প্রভাব এ থেকেও বোঝা যায় যে, মক্ক বিজয়ের পর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদল মদীনায় আসতে শুরু করলেও এ যুদ্ধের পর সে সংখ্যা বহুগুন বেড়ে গেলো।১১[এ যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ যেসব গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে সেগুলোর নাম, ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ-৫১৫-৫৩৭, যাদুল মায়াদ তয় খন্ড, পৃ-২-১৩, সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৩১৩-৩৩৭, ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড, পৃ-১১০-১২৬ ও তাফসীর ফি যিলালিল কোরআন, সূরা তাওবা]
এই সম্পর্কে কোরআনের আয়াত
এই যুদ্ধ সম্পর্কে সূরা তাওবায় বহুসংখ্যক আয়াত নাযিল হয়েছিলো। কিছু হয়েছে যুদ্ধে রওয়ান হওয়ার আগে এবং কিছু কিছু মদীনায় ফিরে আসার পরে। এসব আয়াতে যুদ্ধের অবস্থা বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়েছিলো। মোনাফেকদের পর্দা উন্মোচন করে দেয়া হয়েছিলো। মোমেনীন এবং সাদেকীন যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং যারা করেননি, তাদের তওবা কবুল করার কথা বলা হয়েছে।
এই সময়ের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা
নবম হিজরীতে ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পন্ন বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিলো।
(১) তবুক থেকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফিরে আসার পর উওয়ায়মের আজলানি তার স্ত্রীর মধ্যে ‘লেআন’ হয়েছিলো। উল্লেখ্য স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া হয় অথচ সাক্ষী নেই, তাকে লেআন বলে।
(২) যেনাকারিনী একজন মহিলা নবী মুরসালিনের দরবারে এসে নিজের পাপের কথা স্বীকার করে শাস্তির আবেদন জানিয়েছিলেন। তাকে সন্তান প্রসবের পর আসতে বলা হয়েছিলো। সন্তানের দুধ ছাড়ানোর পর তাকে পাথর নিক্ষেপে হত্যা অর্থাৎ রজম করা হয়।
(৩) হাবশার সম্রাট আসহামা নাজ্জাশী ইন্তেকাল করেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার গায়েবানা জানাযা আদায় করেন।
(৪) নবী নন্দিনী উম্মে কুলসুম (রা.) ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালে প্রিয় নবী শোকে কাতর হয়ে পড়েন। তিনি হযরত ওসমানকে (রা.) বলেছিলেন, যদি আমার তৃতীয় কোন মেয়ে থাকতো তবে তাকেও আমি তোমার সাথে বিয়ে দিতাম।
(৫) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তবুক থেকে ফিরে আসার পর মোনাফেক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। নবী তার জন্যে মাগফেরাতের দোয়া করেন এবং হযরত ওমর (রা.)-এর নিষেধ সত্তেও তার জানাযার নামায আদায় করেন। এরপর কোরআনের আয়াত নাযিল হয় তাতে এবং হযরত ওমরা (রা.)-এর বক্তব্যের সমর্থনে মোনাফেকদের জানাযা নিষেধ করা হয়।
হযরত আবু বকরের (রা.) নেতৃত্বে হজ্জ পালন
নবম হিজরীতে যিলকদ বা যিলজ্জ মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিদ্দিকে আকবর হযরত আবু বকরকে (রা.) আমিরুল হজ্জ করে মক্কায় প্রেরণ করেন।
এরপর সূরা তাওবার প্রথামংশ নাযিল হয়। এতে মোশরেকদের সাথে কৃত অঙ্গীকার সমতার ভিত্তিতে শেষ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এ নির্দেশ আসার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলীকে (রা.) এ ঘোষণা প্রকাশের জন্যে প্রেরণ করেন। আরবদের মধ্যে অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে এটাই ছিলো রীতি। হযরত আবু বকরের (রা.) সাথে হযরত আলীর সাক্ষাৎ হয়েছিল দাজনান মতান্তরে আরজ প্রান্তরে। হযরত আবু বকর (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন তুমি আমীর না মামুর? হযরত আলী (রা.) বললেন, মামুর। এরপর উভযে সামনে অগ্রসর হন। এরপর উভয়ে সামনে অগ্রসর হন। হযরত আবু বকর লোকদের হজ্জ করান। ১০ই যিলহজ্জ অর্থাৎ কোরবানীনর দিনে হযরত আলী (রা.) হাজীদের পাশে দাঁড়িয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ অনুযায়ী ঘোষণা দেন। অর্থাৎ সকল প্রকার অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির সমাপ্তির কথা ঘোষণা করেন। চার মাসের সময় দেয়া হয়। যাদের সাথে কোন অঙ্গীকার ছিলো না, তাদেরকেও চার মাস সময় দেয়া হয় তবে মুসলমানদের সাথে যেসব মোশরেক অঙ্গীকার পালনে ক্রুটি করেনি এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে অন্যদের সাহায্যে করেনি, তাদের চুক্তিপত্র নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত বলবৎ রাখা হয়।
হযরত আবু বকর (রা.) কয়েকজন সাহাবাকে পাঠিয়ে এ ঘোষণা করান যে, ভবিষ্যতে কোন মোশরেক হজ্জ করতে এবং নগ্নাবস্থায় কেউ কাবাঘর তাওয়াফ করতে পারবে না।
এ ঘোষণা ছিলো প্রকৃতপক্ষে জাযিরাতুল আরব থেকে মূর্তি পূজার অবসানের চূড়ান্ত পদক্ষেপ। অর্থাৎ এ বছরের পর থেকে মূর্তি পূজার উদ্দেশ্যে আসার জন্যে কোন সুযোগই আর থাকলো না। ১[বিস্তারিত জানার জন্য দ্রষ্টব্য, সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-২২০, ৪৫১, ২য় খন্ড ৬২৬, ৬৭১, যাদুল মায়াদ ৩য় খন্ড, পৃ- ৫৪৩-৫৪৬, তাফসীর গ্রন্থাবলী সূরা বারাআতের প্রথামাংশ]