দুঃখ বেদনার বছর
আবু তালেবের ইন্তেকাল
আবু তালেবের অসুখ বেড়ে গেল এবং এক সময় তিনি ইন্তিকাল করলেন, আবু তালেব ঘাটিতে অবরোধ থেকে মুক্ত হওয়ার ছয়মাস পর নবুয়তের দশ বর্ষে রজব মাসে তার মৃত্যু হয়েছিল (সহীহ বোখারী আবু তালেবের কিসসা অধ্যায় ১ম খন্ড, পৃ. ৫৪৮) অন্য এক বর্ণনায় একথা উল্লেখ রয়েছে যে, বিবি খাদিজার ইন্তেকালের তিনদিন আগে রমযান মাসের তিনি ইন্তিকাল করেন।
সহীহ বোখারীতে হযরত মোসায়েব থেকে বর্ণিত আছে যে, আবু তালেবের ইন্তেকালের সময় ঘনিয়ে এলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছে যান সেখানে আবু জেহেলও উপস্থিত ছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন চাচাজান আপনি শুধু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলুন এই স্বীকারোক্তি করলেই আমি আল্লাহর কাছে আপনার জন্যে সুপারিশ করতে পারব, আবু জেহেল এবং আবদুল্লাহ ইবনে উমাইয়া বলল, আবু তালেব আপনি কি আবদুল মোত্তালেবের মিল্লাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন? এরপর এরা দুজন আবু তালেবের সাথে কথা বলতে লাগল, আবু তালেব শেষ কথা বলেছিলেন যে, আবদুল মোত্তালেবের মিল্লাতের উপর, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন আমাকে নিষেধ না করা পর্যন্ত আমি আপনারে জন্যে মাগফিরাতের দোয়া করতে থাকব, এরপর আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাযিল করেন আত্মীয়স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী এবং মোমেনদের জন্য সঙ্গত নয় যখন এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ওরা জাহান্নামী (১১৩, ৯)।
আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে নিম্নোক্ত আয়াতও নাযিল করেন, তুমি যাকে ভালোবাসো (সহীহ বোখারী আবু তালেবের কিসসা অধ্যায় ১ম খন্ড, পৃ. ৫৪৮) ইচ্ছা করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবে না, তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন এবং তিনিই ভালো জানেন সৎপথ অনুসারীদেরকে (৫৬, ২৮)।
আবু তালেব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কিরূপ সাহায্য সহযোগিতা করেছিলেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রকৃতপক্ষে মক্কায় কোরাইশ নেতা এবং নির্বোধ লোকদের ইসলামের ওপর হামলার মুখে তিনি ছিলেন একটি দুর্গের মত, কিন্তু তিনি নিজে তার পূর্ব পুরুষদের ধর্ম বিশ্বাসের ওপর অটল অবিচল ছিলেন এ কারণে বোখারীতে হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আপনি আপনার চাচার কি কাজে আসলেন? তিনি তো আপনাকে হেফাজত করতেন, আপনার জন্য অন্যদের সাথে ঝগড়া বিবাদ শত্রুতার ঝুঁকি নিতেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন তিনি জাহান্নামের সবচেয়ে গভীর গহ্বরে থাকতেন (সহীহ বোখারী আবু তালেবের কিসসা অধ্যায় ১ম খন্ড, পৃ. ৫৪৮)।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে একবার তার চাচার প্রসঙ্গ আলোচনা করা হলে তিনি বললেন, কেয়ামতের দিন আমার শাফায়ত হয়তো তার কিছু উপকারে আসবে, তাকে জাহান্নামের একটি উঁচু জায়গায় রাখা হবে, যা শুধু তার উভয় পায়ের হাঁটু পর্যন্ত পৌঁছুবে (সহীহ বোখারী আবু তালেবের কিসসা অধ্যায় ১ম খন্ড, পৃ. ৫৪৮)।
হযরত খাদিজা (রা.)-এর ইন্তেকাল
জনাব আবু তালেবের ইন্তেকালের দু, মাস অথবা শুধু তিন দিন পর উম্মুল মুমিমিন খাদিজাতুল কোবরা (রা.) ইহলোক ত্যাগ করেন, নবুয়তের দশম বর্ষের রমজান মাসে তাঁর ইন্তেকাল হয়েছিলো, সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৬৫ বছর, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স যখন ৫০শে পড়ছিলো, (রমজান মাসে ইন্তেকাল সম্পর্কে ইবনে জওযি তালকিহুল ফুহুম গ্রন্থের সপ্তম পাতায় এবং আল্লামা মনসুরপুরী তাঁর রহমাতুললিল আলামীন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য হযরত খাদিজা ছিলেন আল্লাহর একজন বিশিষ্ট নিয়ামত, সিকি শতাব্দী যাবত তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনসঙ্গী ছিলেন, এ সময় দুঃখ কষ্ট ও বিপদের সময় প্রিয় স্বামীর জন্য তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠতো, বিপদের সময় তিনি তোকে ভরসা দিতেন, তাবলীগে দ্বীনের ক্ষেত্রে তার সঙ্গী থাকতেন, নিজের জানমাল দিয়েও তার দুঃখকষ্ট দূর করতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে সময় মানুষ আমার কুফরি করেছিলো সে সময় খাদিজা আমার উপর ঈমান এনেছিলেন, যে সময় লোকেরা আমাকে অবিশ্বাস করেছিলো সে সময় খাদিজা আমাকে সত্যবাদী বলে গ্রহণ করেছেন, যে সময় লোকেরা আমাকে বঞ্চিত করেছিলো, সে সময় তিনি আমাকে নিজের ধন-সম্পদের অংশীদার করেছেন, তাঁর গর্ভ থেকে আল্লাহ আমাকে সন্তান দিয়েছেন, অন্য স্ত্রীদের গর্ভ থেকে আমাকে কোন সন্তান দেওয়া হয়নি, (মুসনাদে আহমদ ষষ্ট খন্ড, পৃ.১১৮)।
সহীহ বোখারীতে হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত জিবরাঈল (আ.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রসূল, দেখুন খাদিজা আসছেন, তাঁর কাছে একটি বরতন রয়েছে, সেই বরতনে আগুন, খাবার, অথবা পানীয় রয়েছে, তিনি আপনার কাছে এলে আপনি তাকে তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সালাম জানাবেন, এবং জান্নাতে একটি মতি মহলের সুসংবাদ দেবেন, সেই মহলে কোন শোরগোল থাকবে না, এবং ক্লান্তি ও অবসন্নতাও কাউকে গ্রাস করবে না, (সহীহ বোখারী, তাজবিজুল নবী অধ্যায় ১ম খন্ড, পৃ. ৫৩৯)।
দুঃখ, দুশ্চিন্তা ও মনোবেদনা
উল্লেখিত দু, টি দুর্ঘটনা কয়েক দিনের মধ্যেই সংগঠিত হয়েছিল, এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শোকে দুঃখে কাতর হয়ে পড়লেন, এছাড়া তাঁর স্বজাতীয়দের পক্ষ থেকেও নির্যাতন নিষ্পেষণ নিপীড়ন চলছিলো, কেননা আবু তালেবের ওফাতের পর তাদের সাহস বেড়ে গিয়েছিলো, তারা খোলাখুলিভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দিতে লাগলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপ অবস্থায় তায়েফ গেলেন, মনে মনে আশা করছিলেন যে, সেখানকার জনসাধারণ হয়তো তাঁর প্রচারিত দ্বীনের দাওয়াত কবুল করবে, তাঁকে আশ্রয় দেবে এবং তাঁর স্বজাতীয়দের বিরুধীতার মুখে তাঁকে সাহায্য করবে।
কিন্তু সেখানে কোন সাহায্যকারী বা আশ্রয়দাতা তো পাওয়াই গেলো না, বরং তাঁর উপর উল্টো তাঁর ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালানো হলো, তাঁর সাথে এমন দুর্ব্যবহার করা হলো যে, তাঁর কওমের লোকেরা এ যাবত ওরকম ব্যবহার করেনি, এ সম্পর্কিত বিবরণ পরে উল্লেখ করা যাবে।
এখানে একথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, মক্কার অধিবাসীরা যেভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওপর নির্যাতন নিপীড়ন চালিয়েছিলো, তাঁর বন্ধুদের ওপরও একই রকম অত্যাচার চালিয়েছিলো, আল্লাহর রসূলের প্রিয় সহচর হযরত আবু বকর (রা.) সেই অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে হাবসা অভিমুখে রওনা হলেন, মক্কার এক প্রভাবশালী ব্যক্তি ইবনে দাগানার সাথে পথে দেখা হলো, তিনি হযরত আবু বকর (রা.) কে নিজের আশ্রয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়ে মক্কায় ফিরিয়ে আনলেন, (আকবর শাহ নযীবাবাদী উল্লেখ করেছেন যে, এই ঘটনা সেই বছরেই ঘটেছিলো, দেখুন, তারীখে ইসলাম ১ম খন্ড ৩৭২-৩৭৩, বোখারী১ম খন্ড পৃ.৫৫২-৫৫৩)।
ইবনে ইসহাক উল্লেখ করেছেন যে, আবু তালেবের ইন্তেকালের পর কোরাইশরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর এতো বেশী নির্যাতন চালিয়েছিলো যা তাঁর জীবদ্দশায় চিন্তাও করতে পারে নি, কোরাইশের এক বেকুব সামনে এসে আল্লাহর রসূলের মাথায় মাটি নিক্ষেপ করলো, তাঁর এক মেয়ে ছুটে এসে সে মাটি পরিষ্কার করলো।
মাটি পরিষ্কার করার সময় তিনি শুধু কাঁদছিলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে সে সময় সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, তিনি বলছিলেন মা তুমি কেঁদো না, আল্লাহ তায়ালা তোমার আব্বাকে হেফাজত করবেন, এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথাও বলছিলেন যে, কোরাইশরা আমার সাথে এমন কোন খারাপ ব্যবহার করে নি যে, মা যাতে আমার খারাপ লেগেছে, এমন পরিস্থিতিতে আবু তালেব ইন্তেকাল করেন(ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড পৃ.৪১৬)।
পর্যায়ক্রমে এ ধরনের অত্যাচার নির্যাতনের কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই বছরের নাম রেখেছিলেন আমূল হোযন অর্থাৎ দুঃখের বছর, সেই বছরটিতে এ নামেই ইতিহাসে বিখ্যাত।
হযরত সাওদার সাথে বিবাহ
সেই বছর অর্থাৎ নবুয়তের দশম বর্ষে শওয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাওদা বিনতে জামআর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, হযরত সাওদা নবুয়তের প্রথম দিকেই মুসলমান হয়েছিলেন, দ্বিতীয় হিজরিতে তিনি হাবশায় হিজরতও করেছিলেন, তার স্বামীর নাম ছিল ছাকরান ইবনে আমর তিনিও প্রথম দিকে মুসলমান হন হযরত সাওদা তার সঙ্গে হাবশায় হিজরত করেন কিন্তু তিনি হাবশাতেই মতান্তরে মক্কায় ফেরার পথে ইন্তেকাল করেন এরপর হযরত সাওদার ইদ্দত শেষ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন হযরত খাদিজা (রা.) এর ওফাতের পর তিনিই ছিলেন আল্লাহর রাসূলের স্ত্রী কয়েক বছর পর তিনি নিজের পালা হযরত আয়েশাকে হেবা করে দেন (রহমাতুল লিল আলামিন ২য় খন্ড, পৃ. ১৬৫ তালকিহুল ফুহুম পৃ. ৬)।