বদর যুদ্ধের পরবর্তী সামরিক তৎপরতা
বদরের যুদ্ধ ছিলো মুসলমান এবং মোশরেকদের মধ্যে প্রথম সশস্ত্র এবং সিদ্ধান্তমূলক সংঘর্ষ। এতে মুসলমানরা ‘ফতেহ মুবিন’ অর্থাৎ সুস্পষ্ট বিজয় লাভ করেন। সমগ্র আরব জাহান এই বিজয় প্রত্যক্ষ করেছে। এই যুদ্ধের ফলাফলে ওরাই মানসিক কষ্টে জর্জরিত ছিলো, যারা এই যুদ্ধের পরাজয়ের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরা ছিলো মোশরেক। এছাড়া অন্য একটি দল ছিলো, যারা মুসলমানদের বিজয় এবং উচ্চমর্যাদা অর্জনকে তাদের ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক অস্তিত্বের জন্য আশঙ্কার বিষয় বলে মনে করতো। এরা ছিলো ঈহুদী। মুসলমানরা বদরের যুদ্ধে জয়লাভ করলে এই দু’দল অর্থাৎ মোশরেক ও ঈহুদীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রোধে আক্রোশে ফেটে পড়ছিলো। যেমন আল্লাহ তায়ালা তায়ালা বলেন, ‘অবশ্য মোমেনদের প্রতি শত্রুতায় মানুষের মধ্যে ইহুদী ও মোশরেকদেরই তুমি সর্বাধিক উগ্র দেখবে।’ (সূরা মায়েদা, আয়াত ৮২)
কিস্তু মদীনার কিছু লোক এই উভয় দলের হিতাকাঙ্খী ছিলো। তাই তারা যখন লক্ষ্য করলো যে, নিজেদের সম্মান বজাই রাখার অন্য কোন পথ খোলা নেই, তখন তারা লোক দেখানো ইসলামে প্রবেশ করলো। এরা ছিলো আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তাঁর বন্ধু-বান্ধব। এরা মুসলমানদের প্রতি ইহুদী ও মোশরেকদের চেয়ে কম ক্রোধান্বিত ছিলো না।
এরা ছাড়া চতুর্থ একটি দলও ছিলো। তারা হলো আরব বেদুইন, তারা মদীনার আশে পাশে বসবাস করতো। ইসলাম বা কুফুরী কোনটির প্রতি তাদের কোন মনের টান ছিলো না। এরা ছিলো লুটেরা ও ডাকাত। বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের সাফল্যে এরাও মনে কষ্ট পেয়েছিল। তারা আশঙ্কা করেছিলো যে, মদীনায় একটি শক্তিশালী সরকার কায়েম হলে তাদের লুটতরাজের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে তাদের মনেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা জেগে উঠলো এবং হয়ে পড়লো মুসলমানদের দুশমন।
এভাবে করে মুসলমানরা চৌতুর্মুখী সমস্যার মুখোমুখি হয়ে পড়লো। তবে মুসলমানদের ব্যাপারে এই চারটি দলের প্রত্যেকেরই কমূপদ্ধতি ছিলো পৃথক। প্রত্যেক নিজেদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ পূরণের ভিন্ন ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছিলো। তারা ভাবছিলো যে, এতেই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে।
মদীনায় একদল শত্রু ইসলামের ছদ্মবেশ ধারণ করেলো। মুখে ইসলামের কথা বললেও আড়ালে অন্তরালে তারা ষড়যন্ত্র, কুটিলতা এবং পারস্পারিক ঝগড়া ফাসাদ সৃষ্টির পথ অবলম্বন করলো। ইহুদীদের একটি দল ইসলামের প্রতি তাদের শত্রুতা ও ক্রোধ খোলাখুলি ভাবে প্রকাশ করলো। এদিকে মক্কাবাসীরা কোমর ভাঙ্গা মারের প্রতিশোধ গ্রহণের হুমকি দিতে লাগলো। তারা খোলাখুলি প্রতিশোধ গ্রহনের হুমকির পাশাপাশি যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করলো। তারা যেন মুসলমানদের বলছিলো, ‘পেতে হবে এমন দিন, যেই দিন হবে সমুজ্জল, শুনতে পাবো বিলাপধ্বনি দেখবো চোখের জল।’
এক বছর পরে মক্কার কোরায়শরা যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়ে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হলো।
ইসলামের ইতিহাসে এই অভিযান ওহুদের যুদ্ধ নামে খ্যাত। ওই যুদ্ধ মুসলমানদের খ্যাতি ও গৌরবের ওপর কিছু বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
এ সকল আশঙ্কার মোকাবেলায় মুসলমানরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এগুলোর দ্বারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্ব, যোগ্যতা ও বৈশিষ্টের পরিচয় পাওয়া যায়। এছাড়া একথাও বোঝা যায় যে, মদীনায় নেতৃত্ব চারিদিকের বিপদ সম্পর্কে সদা জাগ্রত ও সতর্ক ছিলো। এমনকি শত্রুদের মোকাবেলায় একাধিক পরিকল্পনাও করা হয়েছিলো। এখানে আমরা সংক্ষেপে সে বিষয়ে আলোচনা করবো।
এক. বনু সালিমের সাথে যুদ্ধ
বদরের যুদ্ধের পর মদীনার তথ্য বিভাগ সর্বপ্রথম খবর পায় যে, গাতফান গোত্রের শাখা বনু সুলাইমের লোকেরা মদীনায় হামলা করতে সৈন্য সংগ্রহ করেছে। এই খবর পাওয়ার পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুইশত মোজাহেদ সমেত আকস্মিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং তাদের মনযিল কুদার নামক জায়গায় গিয়ে পৌছেন। [প্রকৃতপক্ষে কুদার হলো ধূসর রঙের একটি পাখী। কিন্তু এখানে বনু সালিম গোত্রের একটি আবাসস্থল বোঝানো হয়েছে। মক্কা থেকে সিরিয়া যাওয়ার পথে মহাসড়কে এটি অবস্থিত]
বনু সুলাইম গোত্র এ ধরনের আকস্মিক হামলার জন্যে প্রস্তুত ছিলো না। তারা হতবুদ্ধি হয়ে পলায়ন করলো। যাওয়ার সময় পাঁচশত উট রেখে গেলো। মুসলমানরা সেইসব উট অধিকার করে নিলো। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই উটের চার পঞ্চমাংশ ভাগ করে দিলেন। প্রত্যেকে দু’টি করে উট পেলেন। এই অভিযানে ইয়াসার নামে একজন ক্রীতদাসও মুসলমানদের হাতে আসে। একে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি বনু সালিমদের এলাকায় তিনদিন অবস্থানের পর মদীনায় ফিরে আসেন।
দ্বিতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে বদর যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার মাত্র ৭ দিন পর এই ঘটনা ঘটে। এই অভিযানের সময় সাবা ইবনে আরফাতা, মতান্তরে আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম(রা.)-কে মদীনায় ব্যবস্থাপনার দ্বায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
দুই) রসূল (স.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র
আল্লাহর রসূলকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র একবার ব্যর্থ এবং পরবর্তী কালে বদরের যুদ্ধেও পরাজিত হয়ে মোশরেকরা ক্রোধে আগুন হয়ে উঠেছিলো। সমগ্র মক্কা আল্লাহর রসূলের বিরুদ্ধে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিলো। অবশেষে দুই নরাধম যুবক সিদ্ধান্ত গ্রহন করলো যে, সকল প্রেরণার উৎস রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই শেষ করে দেবে।
বদরের যুদ্ধের কয়েকদিন পরের কথা। ওমায়ের ইবনে ওয়াহেব জুমহি নামে এক কোরায়শ দুস্কুতকারী ছিলো। এই দুবৃত্ত মক্কায় আল্লাহর রসূলকে নানাভাবে কষ্ট দিতো। তার পুত্র ওয়াহাব ইবনে ওমায়ের বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়েছিলো। এই ওমায়ের একদিন কাবার হাতীমে বসে সফওয়ান ইবনে উমাইয়ার সাথে আলাপ করছিলো। বদরের যুদ্ধে নিহতদের লাশ বদরের একটি নোংড়া কূয়োয় নিক্ষেপ করার দুঃখজনক ঘটনা সম্পর্কে তারা আলোচনা করছিলো। সফওয়ান বললো, ‘খোদার কসম, ওদের অনুপস্থিতিতে বেঁচে থাকার কোন স্বাধ নেই। জবাবে ওমায়ের বললো, খোদার কসম, তুমি সত্য কথা বলেছো। দেখো, আমি যদি ঋণগ্রস্ত না হতাম এবং আমার পরিবার পরিজনের চিন্তা না থাকতো, তাহলে আমি মদীনায় গিয়ে মোহাম্মদকে শেষ করে দিতাম। কিন্তু ঋণ পরিশোধেরও সামর্থ নেই, পরিবার পরিজনও আমার অবর্তমানে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবেঅ আর অজুহাত রয়েছে একটা। আমার সন্তান ওদের হাতে বন্দী।
সফওয়ান সব কথা শুনে মনে মনে ভাবলো, চমৎকার সুযোগ। ওমায়েরকে বললো, শোনো তোমার ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব আমার, তোমার পক্ষ থেকে তা আমি পরিশোধ করবো। আর তোমার পরিবারকে আমি নিজের পরিবারের মতো দেখবো, আজীবন তাদের দেখাশোনা আমি করবো, আমার কাছে কোন জিনিস থাকা অবস্থায় তারা পাবে না- এমন কখনো হবেনা।
ওমায়ের বললো, ঠিক আছে। তবে আমাদের একথা গোপন যেন গোপন থাকে। সফওয়ান বললো, হাঁ, গোপনই থাকবে।
এরপর ওমায়ের তার তরবারি ধারালো করে তাতে বিশ মেশালো। মদীনার দিকে রওয়ানা হয়ে এক সময় সে মদীনায় পৌছালো। মসজিদে নববীর সামনে সে তার উট বসাচ্ছিলো, এমন সময় হযরত ওমর ইবনে খাত্তাবের দৃষ্টি তার ওপর পড়লো। তিনি মুসলমানদের সমাবেশে বদরের যুদ্ধের মাধ্যেমে আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত সম্মান সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। ওমায়েরকে দেখা মাত্র তিনি বললেন, এই নরাধম আল্লাহর দুশমন, নিশ্চয়ই তুমি কোন খারাপ উদ্দেশ্যে এসেছো।
হযরত ওমর (রা.) এরপর আল্লাহর রসূলের সামনে গিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রসূল, আল্লাহর দুশমন ওমায়ের তরবারি ঝুলিয়ে এসেছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ওকে আমার কাছে নিয়ে এসো। ওমায়ের এলে হযরত ওমর (রা.) তার তলোয়ার তারই গলার কাছে চেপে ধরলেন। কয়েকজন আনসারকে বললেন, তোমরা আল্লাহর রসূলের কাছে ভেতরে যাও, সেখানে বসে থাক। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে এই খবিসেন তৎপরতা সম্পর্কে সজাগ থাকবে। কেননা এক বিশ্বাস করা যায় না। এরপর হযরত ওমর (রা.) ওমায়েরকে মসজিদের ভেতরে নিয়ে যান। হযরত ওমর (রা.) ওমায়েরকে যেভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন সেদিকে লক্ষ্য করে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ওকে ছেড়ে দাও ওমর। ওমায়েরকে বললেন, তুমি কাছে এসো। ওমায়ের আল্লাহর রসূলের কাছে এসে বললো, আপনাদের সকাল শুভ হোক। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এমন এক সম্বোধন শিক্ষা দিয়েছেন, যা তোমাদের কথা থেকে উত্তম। এটি হচ্ছে আসসালামু আলাইকুম। এটি বেহেশতীদের সম্বোধন।
এপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে ওমায়ের তুমি কেন এসেছ? সে বললো, আপনার কাছে যে বন্দী রয়েছে সে ব্যাপারে এসেছি। আপনারা আমার বন্দীর ব্যাপারে অনুগ্রহ করুন।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাহলে তোমার গলায় তরবারি কেন? সে বললো, আল্লাহ এই তরবারি নিপাত করুন। এটি কি আর আমাদের কোন কাজে আসবে?
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বরলেন, সত্যি করে বলো যে কেন এসেছ? সে বললো, বললাম তো, যুদ্ধবন্দী সম্পর্কে আলোচনার জন্যে এসেছি। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, না তা নয়। তুমি এবং সফওয়ান কাবার হাতীমে বসেছিলে এবং নিহত কোরায়শদের লাশ কূয়ায় ফেলার প্রসঙ্গে আফসোস করছিলে। এরপর তুমি বলেছিলে, আমি যদি ঋণগ্রস্ত না হতাম এবং আমার যদি পরিবার পরিজন না থাকতো, তবে আমি এখান থেকে যেতাম এবং মোহাম্মদকে হত্যা করতাম। একথা শোনার পর সফওয়ান তোমার ঋণ এবং পরিবার পরিজনের দায়িত্ব নিয়েছে। তবে শর্ত হচ্ছে যে, তুমি মোহাম্মদকে হত্যা করবে। কিন্তু মনে রেখো, আল্লাহ তায়ালা আমার এবং তোমাদের মধ্যে অন্তরায় হয়ে আছেন।
ওমায়ের বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রসূল। হে আল্লাহর রসূল, আপনি আমাদের কাছে আকাশের যে খবর নিয়ে আসতেন এবং আপনার ওপর যে ওহী নাযির হতো, সেসব আমরা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু এটাতো এমন ব্যাপার যে, আমি এবং সফওয়ান ছাড়া সেখানে অন্য কেউ উপস্থিত ছিলো না। কাজেই আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি যে, এই খবর আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ আপনাকে জানাননি। সেই আল্লাহর জন্যে যিনি আমাকে ইসলামের হেদায়েত দিয়েছেন এবং এই জায়গা পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন। একথা বলে ওমায়ের কালেমা তাইয়েবার সাক্ষ্য দিলেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমাদের ভাইকে দ্বীন শেখাও, কোরআন পড়াও এবং তার বন্দীকে মুক্ত করে দাও। [ ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৬৬০ ]।
এদিকে সফওয়ান মক্কায় বলে বেড়াচ্ছিলো যে, সুখবর শোনো কয়েকদিনের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটবে, যাতে আমরা বদরের দুঃখ কষ্ট ভুলে যাবো। সফওয়ান মদীনা থেকে আসা লোকদের কাছে প্রত্যাশিত খবর জানতে চাচ্ছিলো। অবশেষে একজনের কাছে খবর পেলো যে, ওমায়ের ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে গেছে। এ খবর শুনে সফওয়ান কসম খেয়ে বললো যে, ওমায়েরের সাথে কখনো কথা বলবে না এবং তার কোন উপকার করবে না । এদিকে ইসলাম গ্রহণের ওমায়ের মক্কায় এসে পৌছুলো এবং ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলো। তার আহব্বানে বহু লোক ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিলো। [ইবনে হিশাম,১ম খন্ড,৬৬১,৬৬২,৬৬৩]।
তিন) বনু কাইনুকার যুদ্ধ
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় আসার পর ইহুদীদের সাথে যে চুক্তি করেছিলেন, তার শর্তসমূহ ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপ্রাণ চেষ্টা করে মনে আশা করছিলেন যে, চুক্তির ধারাসমূহ বাস্তবায়িত হোক। ও কারণে মুসলমানদের তরফ থেকে চুক্তি লংঘিত হতে পারে, এ ধরনের সামান্যতম কোন পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়নি। কিন্তু ঐতিহাসিক বিচারে বিশ্বাসঘাতক ও খেয়ানতকারী ইহুদীরা খুব শীঘ্রই তাদের পুরনো ঐতিহ্যের দিকে এগিয়ে গেলো। তারা মুসলমানদের মধ্যে ষড়যন্ত্র বিস্তার, যুদ্ধের উস্কানি সৃষ্টি দাঙ্গাহাঙ্গামা সৃষ্টি এবং বিশৃঙ্খলা ছড়ানোর কাজে কোন প্রকার কার্পণ্য করেনি। এখানে একটি উদাহরণ উল্লেখ করা হচ্ছে।
ইহুদীদের বিশ্বাসঘাতকতা
ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন যে, শাশা ইবনে কায়েস নামে একজন ইহুদী ছিলো। এ লোকটি এতো বৃদ্ধ ছিলো যে, দেখে মনে হতো যে, এক পা তার কবরে চলে গেছে। মুসলমানদের প্রতি তার শত্রুতা ও ঘৃণা ঠছিলো সীমাহীন। একবার সে আওস এবং খাযরাজ গোত্রের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলো। সেখানে উভয় গোত্রের লোক বসে কথা বলছিলো। উভয়ের মধ্যে আগের মতো শত্রুতা নেই। বরং কি চমৎকার মিল মহব্বত দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থা দেখে বৃদ্ধ ইহুদীর মনে খুবই কষ্ট হলো। সে বলতে লাগলো, বাহরে বাহ, এখানে তো দেখছি বনু কাইলা পরিবারের অভিজাত ব্যক্তিবর্গ সমবেত হয়েছে। এই অভিজাতদের একত্রিত হওয়ার পর আমরা তো অপাংক্তেয় হয়ে পড়েছি। বৃদ্ধ ইহুদীর সঙ্গে একজন যুবক ছিলো। যুবকটিকে সে বললো, ওদের কাছে বলো, বুআস যুদ্ধের কথা এবং তারও আগের কিছু ঘটনা আলোচনা কর এবং যুদ্ধের বিষয়ে উভয় পক্ষে যেসব কবিতা আবৃত্তি করা হয়েছিলো, সে সব কবিতা কিছু কিছু ওদের শোনাও। সে ইহুদী তা-ই করলো। এরূপ করার ফলে আওস এবং খাযরাজ গোত্রের লোকদের মধ্যে আস্তে আস্তে কথা কাটাকাটি হতে লাগলো। উপস্থিত মুসলমানরা ঝগড়া শুরু করে এক অন্যের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব যাহির করতে লাগলেন। উবয় পক্ষের একজন করে প্রতিনিধি হাঁটু গেড়ে বসে নিজের গোত্রীয় সাফল্য সম্পর্কে বড় বড় কথা বলতে লাগলেন। একজন বললেন, যদি চাও, তবে আমরা সেই যুদ্ধ এখনো তাজা করে দিতে পারি। অর্থাৎ ইতপূর্বে সংঘটিত যুদ্ধের জন্যে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। একথা শুনে উভয় পক্ষ ক্ষেপে গেলো। বললো, চলো আমরা প্রস্তুত। হাবরা নামক জায়গায় যুদ্ধ হবে, চলো। অস্ত্র লও, অস্ত্র লও। উভয় পক্ষেরের মুসলমানেরা অস্ত্র নিয়ে হাবরা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হতে যাবে, এমন সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে খবর পৌছুলো। তিনি দ্রুত মোহাজের সাহাবাদের সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলেপৌছে বললেন, হে মুসলমানেরা, হায়, হায় আল্লাহ! আমার জীবদ্দশায়ই তোমরা জাহিলিয়াতে ফিরে যাচ্ছ? ইসলাম গ্রহণের পরও তোমাদের এই কাজ? ইসলামের মাধ্যমে তোমরা জাহিলিয়াতের রুসম-রেওয়ায থেকে মুক্ত হয়েছেো, কুফুরী থেকে মুক্তি লাভ করেছো, তোমাদের অন্তর পরস্পরের জন্যে সম্প্রীতিতে পূর্ণ হয়েছে।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা শুনে আনসার সাহাবারা বুঝতে পারলেন যে, তারা শয়তানের ধোঁকায় পড়েছেন। দুশমনের প্ররোচনার শিকার হয়েছেন। এসব ভেবে তারা কাঁদতে শুরু করলেন। আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোকেরা একে অন্যের গলা জড়িয়ে ধরলেন। এরপর আল্লাহর রসূলের আনুগত্যের মাধ্যমে এমনভাবে ঘরে ফিরলেন যে, আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের দুশমন ইহুদী শাশা ইবনে কায়াসের ষড়যন্ত্রের আগুন নিভিয়ে দিয়েছেন। [ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৫, ৫৫৬]।
মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টির জন্যে ইহুদীদের ঘৃণ্য ও অপচেষ্টার এটি একটি উদাহরণ। ইসলামের দাওয়াতের পথে ইহুদীদের বাধা সৃষ্টির পরিচয় এই ঘটনা থেকেই পাওয়া যায়। এ উদ্দেশ্যে ইহুদীরা নানা ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলো। তারা মিথ্যা প্রোপাগান্ডা করতো। সকালে মুসলমান হয়ে বিকেলে পুনরায় কাফের হয়ে যেতো। এটা এরা এজন্যেই করতো যে, এর ফলে দুর্বল চিত্তের মানুষদের মনে ইসলাম সম্পর্কে সন্দেহ ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করতে পারবে। কারো সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকলে সে যদি মুসলমান হতো, তাহলে টাকা-পয়সা দেয়া বন্ধ করে দিতো। আর টাকা পাওনা থাকলে সকাল-বিকাল তাগাদা দিয়ে তাকে অতিষ্ঠ করে তুলতো। সেই নয়া মুসলমান পাওনাদার হলে তার পাওনা আদায় করতো না বরং অন্যায়ভাবে সে টাকা আত্মসাৎ করতো। এরপরও যদি সেই মুসলমান টাকা চাইতেন, তখন কুচক্রী ইহুদী বলতো যে, তোমার পাওনা তো আমার ওপর ততোদিন পরিশোধের দায়িত্ব ছিলো যতোদিন তুমি পূর্ব পুরুষদের ধর্ম বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিলে। তুমি তোমার ধর্ম বিশ্বাস পরিবর্তন করেছো, কাজেই এখন তোমার এবং আমার মধ্যে কোন রকম সম্পর্ক থাকতে পারে না , থাকার কোন কারণও নেই। [তাফসীরকারকরা সূরা আলে ইমরানসহ বিভিন্ন সূরার তাফসীরে ইহুদীদের এ ধরণের ঘৃণ্য তৎপরতার ঘটনা উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে সাইয়েদ কুতুব শহীদের তাফসীর ফী যিলালিল কোরআনে এ বর্ণনা খুবই চিত্তাকর্ষক ]।
প্রকাশ থাকে যে, ইহুদীরা এ ধরনের কর্মকান্ড বদরের যুদ্ধের আগেই শুরু করে দিয়েছিলো। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-রে সাথে সম্পাদিত চুক্তি লংঘন করেই তারা এ সব করছিলো। কিন্তু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম ইহুদীদের হেদায়াত পাওয়ার আশায় সব কিছু নীরবে সয়ে যাচ্ছিলেন। আঞ্চলিক শান্তি এবং নিরাপত্তার পরিবেশ বজায় রাখার আকাঙ্খাও তাদের মনে বিদ্যামান ছিলো।
বনু কাইনুকার অঙ্গীকার ভঙ্গ
ইহুদীরা যখন লক্ষ্য করলো যে, বদরের প্রান্তরে আল্লাহ রব্বুল আলামীন মুসলমানদের বিরাট সাহায্যে করেছেন এবং তাদের মর্যাদা ও প্রভাব সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, তখন তারা ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুতা শুরু করলো। প্রকাশ্যে ঘোষণার মাধ্যমে বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করলো এবং মুসলমানদের কষ্ট দেয়ার জন্যে উঠে পড়ে লাগলো।
এদের মধ্যে সবচেয়ে হিংসুটে এবং দৃর্বৃত্ত ছিলো কা’ব ইবনে আশরাফ। তার সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হবে। তিনটি ইহুদী গোত্রের মধ্রে সবচেয়ে খারাপ ছিলো বনু কাইনুকা। এরা মদীনার ভেতরে থাকতো এবং তাদের মহল্লা তাদের নামেই পরিচিত ছিলো। এরা পেশায় ছিলো কর্মকার, স্বর্ণকার এবং থালাবাটি নির্মাতা। এ কারণে এদের কাছে সব সময় প্রচুর সমর সরঞ্জাম বিদ্যমান থাকতো। যুদ্ধ করার মতো বলদর্পী লোকের সংখ্যা তাদের মধ্যে ছিলো সাতশত। তারা ছিলো মদীনায় সবচেয়ে বাহাদুর ইহুদী গোত্র। এরাই সর্বপ্রথম মুসলমানদের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করে। ঘটনার বিবরণ এই,
আল্লাহ রব্বুল আলামীন যখন বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের সফলতা দান করলেন তখন ইহুদীদের শত্রুতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তারা তাদের দুর্বৃত্তপনা, ঘৃণ্য কার্যকালাপ এবং উস্কানিমূলক কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখে। মুসলমানরা বাজারে গেলে তারা তাদের প্রতি উপহাসমূলক মন্তব্য করতো এবং ঠাট্রা-বিদ্রূপ চালাতো সব সময়। এমনি করে মুসলমানদের মানসিকভাবে কষ্ট দিতো। তাদের ঔদ্ধত্য এমন সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো যে, তারা মুসলিম মহিলাদেরও উত্যক্ত করতো।
ক্রমে অবস্থা নাজুক হয়ে উঠলো। ইহুদীদের ঔদ্ধত্য ও হঠকারীতা সীমা ছাড়িয়ে গেলো। এ সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদীদের সমবেত করে একদিন ওয়ায নসিহত করে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। এছাড়া তাদের নিপীড়নমূলক কাজের মন্দ পরিণাম সম্পর্কেও সতর্ক করে দিলেন। কিন্তু এতে তাদের হীন ও ঘৃণ্য কার্যকলাপ বেড়ে গেলো।
আবু দাউদ প্রমূখ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদরের দিনে কোরায়শদের পরাজিত করেন। এরপর মদীনায় ফিরে এস বনু কাইনুকার বাজারে ইহুদীদের এক সমাবেশ আহব্বান করেন। সেই সমাবেশে তিনি বলেন, হে ইহুদী সম্প্রদায়, কোরায়শদের উপর যে রকম আঘাত পড়েছে, সে রকম আঘাত তোমাদের ওপর আসার আগেই তোমরা ইসলাম গ্রহন করো। তারা বললো, হে মোহাম্মদ, তুমি আমাদের ব্যাপারে ভুল ধারণা করছো। কোরায়শ গোত্রের আনাড়ি ও অনভিজ্ঞ লোকদের সাথে তোমাদের মোকাবেলা হয়েছে। এতেই তোমরা ধরাকে সরা জ্ঞান করেছো। তোমরা ওদের মেরেছো, সেটা পেরেছো ওরা আনাড়ি বলেই। আমাদের সাথে যদি তোমাদের যুদ্ধ হয়, তবে তোমরা বুঝতে পারবে যে, পুরুষ কাকে বলে। আমরা হচ্ছি বাহাদূর। তোমরা তো আমাদের কবলে পড়োনি। তাই আমাদের ব্যাপারে ভূল ধারণা করে বসে আছ । তাদের এ উক্তির জবাবে আল্লাহ রব্বুল আলামীন এই আয়াত নাযিল করেন।
‘যারা কুফুরী করে, তাদের বলো তোমরা শীঘ্রই পরাভূত হবে এবং তোমাদেরকে জাহান্নামে একত্র করা হবে। আর সেটা কতোই না নিকৃষ্ট আবাস্থল। দু’টি দলের পরস্পর সম্মুখীন হওয়ার মধ্যে তোমাদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। একদল আল্লাহর পথে সংগ্রাম করছিলো আন্য দলছিলো কাফের। ওরা তাদেরকে চোখের দেখায় দ্বিগুণ দেখছিলো। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা নিজ সাহায্য দ্বারা শক্তিশালী করেন। নিশ্চয় এত অর্ন্তদৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের জন্যে শিক্ষা রয়েছে।’ [সুনানে আবু দাউদ, ৩য় খন্ড, পৃ. ১১২, ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫২] (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১২-১৩)
মোটকথা, বনু কাইনুকা যে জবাব দিয়েছিলো তার অর্থ হচ্ছে সুস্পষ্ট যুদ্ধ ঘোষণা। কিন্তু রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্রোধ সম্বরণ এবং ধৈর্য ধারণ করেন। মুসলমানরাও ধৈর্য ধারণ করে ভবিষ্যতের অপেক্ষায় থাকেন।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদীদের ইসলামের দাওয়াত প্রদান এবং তাদের পরিণাম সম্পর্কে সমর্ক করার পর তাদের ঔদ্ধত্য আরো বেড়ে যায়। কয়েকদিন পরেই মদীনায় তারা সন্ত্রাসমূলক তৎপরতা শুরু করে। এর ফলে তারা নিজেরাই নিজেদের কবর খনন করে নেয়। জীবনের সকল পথ নিজেদের জন্যে বন্ধ করে ফেলে।
ইবনে হিশাম আবু আওন থেকে বর্ণনা করেছেন যে, একজন আবর মহিলা কাইনুকার বাজারে দুধ বিক্রি করতে আসে। দুধ বিক্রির পর সেই মহিলা কি এক প্রয়োজনে এক ইহুদী স্বর্ণকারের দোকানে বসে। ইহুদী তা চেহারা অনাবৃত করতে বলে কিন্তু মহিলা রাযি হয়নি। এতে স্বর্ণকার সেই মহিলার কাপড়ের একাংশ তার পিঠের সাথে গিট বেঁধে দেয়। মহিলা কিছুই বুঝতে পারেননি। মহিলা উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথে তার লজ্জাস্থান অনাবৃত হয়ে গেলো। এত ইহুদীরা খিল খিল করে হেসে উঠলো। মহিলা এভাবে অপমানিত হয়ে চিৎকার ও কান্নাকাটি শুরু করলেন। তার কান্না শুনে একজন মুসলমান কারণ জানতে চাইলেন। সব শুনে ক্রোধে অস্থির হয়ে তিনি সেই ইহুদীর উপর হামলা করে তাকে মেরে ফেললেন। ইহুদীরা যখন দেখলো যে, তাদের একজন লোককে মেরে ফেলা হয়েছে এবং মেরেছে তাদের শত্রু মুসলমান, তখন তারা সম্মিলিত হামলা করে সেই মুসলমানকেও মেরে ফেললো। নিহত মুসলমানের পরিবারবর্গ চিৎকার কান্নাকাটি শুরু করে ইহুদীদের বিরুদ্ধে সকল মুসলমানদের কাছে অভিযোগ করলেন। এর ফলে মুসলমান এবং বনু কাইনুকা গোত্রের ইহুদীদের মধ্যে যুদ্ধে সাজ সাজ রব পড়ে গেলো। [ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ৪৭,৪৮]।
অবরোধ, আত্মসমর্পণ ও বহিস্কার
এই ঘটনার পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধৈর্যের ভেঙ্গে গেলো। তিনি মদীনার ব্যাবস্থাপনার দায়িত্ব আবু লোবাবা ইবনে আবদুল মানযারকে অর্পণ করলেন। হযরত হামযা ইবনে আবদুল মোত্তালেবের হাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের পবিত্র হাতে মুসলমানদের পতাকা তুলে দিয়ে একদল মুসলমানকে সঙ্গে নিয়ে বনু কাইনুকা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। ইহুদীরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখে দুর্গের প্রধান ফটক বন্ধ করে দিলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুর্গের চারিদিকে অবরোধ করে রাখলেন। সেদিন ছিলো জুমার দিন। দোসরা হিজরীর শওয়াল মাসের ১৫ তারিখ। পনের দিন পর্যন্ত অর্থাৎ জিলকদ মাসের প্রথম দিন পর্যন্ত ১৫ দিন অবরোধ অব্যাহত রাখা হলো। এরপর আল্লাহ তায়ালা ইহুদীদের মনে মুসলমানদের প্রভাব বসিয়ে দিলেন। আল্লাহর নিয়ম এই যে, তিনি কোন কওমকে পরাজিত করতে চাইলে তাদের মনে প্রতিপক্ষের প্রভাব বসিয়ে দেন। বন কাইনুকা গোত্র এই শর্তে আত্মসমর্পণ করলো যে, তারা আল্লাহর রসূলের সিদ্ধান্ত মেনে নেবে। তাদের জানমাল, মহিলা ও শিশুদের ব্যাপারে আল্লাহর রসূলের দেয়া ফয়সালাই হবে চুড়ান্ত। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশে এরপর ইহুদীদের বেধে ফেলা হলো।
মাত্র একমাস আগে ইসলামের ছদ্মবেশ ধারণকারী মোনাফেক আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এ সময় ইহুদী প্রীতির নযির স্থাপন করলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কপট অনুনয়ে সে ইহুদীদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করলো। সে বললো, হে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমার মিত্রদের ব্যাপারে অনুগ্রহ করুন। উল্লেখ্য, বনু কাইনুকা ছিলো খাযরাজ গোত্রের মিত্র। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন সিদ্ধান্ত তখনো দেননি। মোনাফেক নেতা তার কথার পুনরাবৃত্তি করলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। দৃর্বৃত্ত মোনাফেক তখন আল্লাহর রসূলের জামার আস্তিনে হাত দিলো। তিনি এতে বিরক্ত হলেন, বললেন, আমাকে ছেড়ে দাও। কিন্তু মোনাফেক তার অনুরোধ অব্যাহত রাখলো। সে বললো, আপনি আমার মিত্রদের ব্যাপারে অনুগ্রহ ঘোষণা না করা পর্যন্ত আপনাকে ছাড়বো না। চারশত খালি দেহের যুবক এবং তিনশত বর্ম পরিহিত যুবক, যারা আমাকে নানা বিপদে থেকে উদ্ধার করেছে, আপনি তাদেরকে এক সকালেই মেরে ফেলবেন? আল্লাহর কসম, সময়ের আবর্তনের ভয়ে আমি অত্যন্ত ভীত।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবশেষে দৃশ্যত আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর কথা রাখলেন। তিনি ইহুদীদের প্রাণ রক্ষার ব্যবস্থা করলেন। তবে নির্দেশ দিলেন যে, তারা মদীনা বা মদীনার আশেপাশে থাকতে পারবে না। ইহুদীরা তখন যতোটা জিনিস সঙ্গে নেয়া সম্ভব ততোটা নিয়ে সিরিয়ার দিকে চলে গেলো। সেখানে কিছুদিনের মধ্যে বহু ইহুদী মৃত্যু বরণ করলো।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদীদের পরিত্যাক্ত ধন-সম্পদ বাজেয়াপ্ত করলেন। এর মধ্যে তিনটি কামান, দু’টি বর্ম, তিনটি তলোয়ার এবং তিনটি বর্শা নিজের জন্যে রাখলেন। অবশিষ্ট ধন-সম্পদ থেকে এক পঞ্চমাংশ বের করে দিলেন। গণিমতের মাল সংগ্রহের মোহাম্মদ ইবনে মাসলামার ওপর ন্যস্ত করা হয়। [যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, ৭১, ৯১ ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড পৃ. ৪৭, ৪৮, ৪৯] ।
চার) ছাভিকের যুদ্ধ
একদিকে সফওয়ান ইবনে উমাইয়া ইহুদী এবং মোনাফেকরা ষড়যন্ত্র লিপ্ত ছিলো। অন্যদিকে আবু সুফিয়ানও কার চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছিলো। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সে এমন কিছু করতে চাচ্ছিলো যাতে নিজ কাওমের ইযযত আবরু রক্ষা হতে পারে এবং নিজেদের শক্তির প্রকাশ ঘটানো যায়। আবু সুফিয়ান এ মর্মে প্রতিজ্ঞা করেছিলো যে, মোহাম্মদের সাথে যুদ্ধ না করা পর্যন্ত ফরয গোসল করবে না। এই প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্যে আবু সুফিয়ান দুইশত সওয়ারী নিয়ে রওয়ানা হয়ে কানাত প্রান্তরে অবস্থিত নাইব নামক পাহাড়ের পাদদেশে তাঁবু স্থাপন করলো। মদীনা থেকে এর দুরত্ব বারো মাইল। আবু সুফিয়ান মদীনায় সরাসরি হামলার সাহস করলো না। তবে সে এমন একটা কাজ করলো, যাকে খোলাখুলি ডাকাতি রাহাজানি বলে অবহিত করা যায়।
ঘটনার বিবরণ এই যে, রাতের অন্ধকারে আবু সুফিয়ান মদীনার উপকন্ঠে এসে হুয়াই ইবনে আকতারের কাছে গিয়ে তাকে দরজা খোলার অনুরোধ জানায়। হুয়াই পরিণাম আশঙ্কায় দরজা খুলতে অস্বীকার করে। আবু সুফিয়ান তখন বনু নাযিরের অন্য এক সর্দার সালাম ইবনে মাশকামের কাছে গমন করে। এ লোকটি ছিলো বনু নাযির গোত্রের কোষাধ্যক্ষ। আবু সুফিয়ান ভেতরে যাওয়ার অনুমতি চায়। সালাম ইবনে মাশকাম ভেতরে আসা অনুমতি প্রধান করে এবং আতিথেয়তা করে। আহার করায়, মদ পরিবেশন করে এবং মদীনার বিশদ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে। আবু সুফিয়ান এরপর দ্রুত তার সঙ্গীদের কাছে যায় এবং একদল সশস্ত্র লোক পাঠিয়ে মদীনার উপকন্ঠে আরিয নামক জায়গায় হামলা করায়। কোরায়শ গোত্রের এই দুর্বৃত্তরা সেখানে কয়েকটি খেজুর গাছ কেটে ফেলে এবং কয়েকটি গাছে আগুন ধরিয়েও দেয়। এরপর এজকজন আনসারী এবং তার মিত্রকে ফসলের ক্ষেতে পেয়ে হত্যা করে উর্দ্ধশ্বাসে মক্কামুখে পালিয়ে যায়।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ খবর পাওয়ার পর আবু সুফিয়ান এবং তার সঙ্গীদের দ্রুত ধাওয়া করেন। কিন্তু দুর্বৃত্তরা এর চেয়ে দ্রুত মক্কার পথে উর্ধশ্বাসে ছুটে পালিয়ে যায়। তারা বোঝা হালকা করার জন্যে বহু জিনিস পথে ফেল রেখে যায়। এসব জিনিস মুসলমানদের হস্তগত হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সঙ্গীরা আবু সুফিয়ানকে কারকারাতুল কুদার পর্যন্ত ধাওয়া করে ফিরে আসেন। মুসলমানরা ফেলে যাওয়া ছাতুসহ বিভিন্ন জিনিস তুলে নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন। এ অভিযানের নামকরণ করা হয় ছাভিকের যুদ্ধ। আরবী ভাষায় ছাভিক মানে ছাতু। বদরের যুদ্ধের মাত্র দুই মাস পরে দ্বিতীয় হিজরীর জিলহজ্জ মাসে এ ঘটনা ঘটে। এই অভিযানের সময় মদীনার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আবু লোবাবা ইবনে আবদুল মানযারের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছিলো। [যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৯০,৯১, ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৯৩] ।
পাঁচ) যি-আমরের যুদ্ধ
বদরের যুদ্ধের পর এই অভিযান ছিলো সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন। তৃতীয় হিজরীর মহরম মাসে এই অভিযান পরিচালিত হয়েছিলো। এর কারণ, মদীনার তথ্য বিভাগ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানায় যে, বনু ছালাবা এবং মোহারেব গোত্রের এক বিরাট দল মদীনায় হামলা করতে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। এ খবর পাওয়ার পর পরই রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিলেন। সওয়ারী এবং পায়ে হেটে লোকজনসহ চারশত মোজাহেদ সমন্বয়ে এবক অভিযান পরিচালিত হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই সময় হযরত ওসমান (রা.)-কে মদীনায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন।
পথে মোজাহেদরা বনু ছলাম গোত্রের জাব্বার নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে আল্লাহর রসূলের সামনে হাযির করেন। লোকটিকে তিনি ইসলামের দাওয়াত দেন। সে ইসলাম গ্রহণ করে । এরপর লোকটি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবাদের শত্রু এলাকা পর্যস্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়।
এদিকে শত্রুরা মুসলমানদের সামরিক অভিযানের খবর পেয়ে আশেপাশের পাহাড়ী এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখেন এবং মোজাহেদদের নিয়ে শত্রুদের অবস্থান স্থল পর্যন্ত পৌছেন। সেখানে একটি জায়গা ছিলো, এই জায়গা ‘যি-আমর’ পরিচিত। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে বেদুইনদের ওপর প্রভাব বিস্তার এবং মুসলমানদের শক্তি সম্পর্কে তাদের ধারণা দেয়ার জন্যে তৃতীয় হিজরীর সফর মাসের পরেও কিছু দিন সেখানে অতিবাহিত করে পরে মদীনায় ফিরে আসেন। [ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ৪৬, যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড পৃ. ৯১। বলা হয়ে থাকে যে, গাওয়াছ মাহারেবী নামে এক ব্যক্তি এই অভিযানের সময় আল্লাহর রসূলকে হত্যার চেষ্টা চালায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই অভিযানের সময় নয়, অন্য অভিযানের সময় এই চেষ্টা করা হয়েছিলো। দেখুন বোখারী ২য় খন্ড পৃ. ৫৯৩]।
ছয়) কা’ব ইবনে আশরাফের পরিণাম
ইহুদীদের মধ্যে এই লোকটি মুসলমানদের প্রচন্ড ঘৃণা করতো। মুসলমানদের প্রতি তার শত্রুতা এবং মুসলমানদের কাজকর্মে তার মসে যন্ত্রনা হতো সব সময়। এই লোকটি আল্লাহর রসূলকে কষ্ট দিতো এবং তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধের দাওয়াত দিয়ে বেড়াতো।
তাঈ গোত্রের বনু নাবহান শাখার সাথে তার সম্পর্ক ছিলো। তার মায়ের গোত্রের নাম ছিলো বনু নাযির। এই লোকটি ছিলো ধনী এবং প্রভাবশালী। আরবে তার দৈহিক সৌন্দর্যের সুমাম ছিলো। বিখ্যাত কবি হিসাবেও তার পরিচিতি ছিলো। এই লোকটির দুর্গ মদীনার দক্ষিণাংশে বনু নাযিরের গোত্রের জনপদের পেছনে।
বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় এবং কোরায়শ নেতাদের হত্যাকান্ডের খবর শোনার সাথে সাথে সে বলে উঠেছিলো, আসলেই কি এ রকম ঘটেছে? ওরা ছিলো আরবদের মধ্যে অভিজাত এবং লোকদের বাদশাহ। মোহাম্মদ যদি ওদের মেরেই থাকে, তাহলে পৃথিবীর অভ্যন্তরে ভাগ এর উপরিভাগ থেকে উত্তম হবে। অর্থাৎ বেঁচে থাকার চেয়ে আমাদের মরে যাওয়াই উত্তম।
নিশ্চিতভাবে মুসলমানদের বিজয়ের খবর পাওয়ার পর আল্লাহর শত্রু কা’ব ইবনে আশরাফ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং মুসলমানদের কুৎসা এবং ইসলামের শত্রুদের প্রশংসা শুরু করলো। এতেও তৃপ্ত হতে না পেরে সে মক্কায় কোরায়শদের কাছে পৌছে এবং মোত্তালেব ইবনে আবু অদাআ সাহমীর মেহমান হয়ে পৌত্তলিকদের মনে উত্তেজনার আগুন প্রজ্বলিত করার চেষ্টা করলো। আল্লাহর রসূলের বিরুদ্ধে কোরায়শদের যুদ্ধে প্ররোচিত করতে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করলো। নিহত কোরায়শদের প্রশংসামূলক কবিতা আবৃত্তি করলো। মক্কায় কা’ব এর অবস্থানকালে আবু সুফিয়ান তাকে জিজ্ঞাসা করলো যে, তোমার কাছে আমাদের মধ্যেকার কোন দ্বীন অধিক পছন্দীয়? এই উভয় দলের মধ্যে কারা হেদায়াত প্রাপ্ত? কা’ব ইবনে আশরাফ বললো, তোমরা মুসলমানদের চেয়ে অধিক হেদায়াত প্রাপ্ত এবং উত্তম। আল্লাহ তায়ালা এই সময় এই আয়াত নাযিল করেন।
‘তুমি কি তাদের দেখোনি, যাদেরকে কেতাবের এক অংশ দেয়া হয়েছিলো তারা ‘জিবত’ এবং ‘তাগুতে’র উপর ঈমান রাখে। তারা কাফেরদের সম্পর্কে বলে যে, এদেরই পথ মোমেনদের চেয়ে উৎকৃষ্টতর।’ (সূরা নেসা, আয়াত ৫১)
কা’ব ইবনে আশরাফ মক্কায় এসব কাজ করার পর মদীনায় ফিরে আসে। মদীনায় এসে সাহাবায়ে কেরামদের স্ত্রীদের সম্পর্কে ঘৃণ্য ধরনের কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করে। এছাড়া যা মুখে আসছিলো, তাই বলছিলো এমনি করে সে মুসলমানদের কষ্ট দিচ্ছিলো।
এমতাবস্থায় অতিষ্ঠ হয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা বললেন, কা’ব ইবনে আশরাফের সাথে বোঝাপড়ার মতো কে আছো? এই লোকটি আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূলকে কষ্ট দিয়েছে।
আল্লাহর রসূলের এই আহব্বানে সাড়া দিয়ে মোহাম্মদ ইবনে মাযলামা, ওব্বাদ ইবনে বশর, আবু নায়েলা ওরফে সালকান ইবনে সালামা, হারেস ইবনে আওস , আবু আব্বাস ইবনে জাবার (রা.) উঠে দাঁড়ালেন। আবু নায়েলা ওরফে সালকান ইবনে সালামা (রা.) ছিলেন কা’ব ইবনে আশরাফের দুধভাই। মোহাম্মদ ইবনে মাসলামা এই দলের নেতা মনোনীত হলেন।
কা’ব ইবনে আশরাফের হত্যাকান্ড সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনার মূল কথা এই যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বললেন, রসূলকে কষ্ট দিয়েছে। কা’ব ইবনে আশরাফের সাথে কে বোঝাপড়া করতে পারবে? এই কথা শোনার সাথে সাথে মোহাম্মদ ইবনে মাসলামা উঠে দাঁড়িয়ে আরয করলেন, আমি হাযির রয়েছি, হে আল্লাহর রসূল।
আপনি কি চান যে, আমি তাকে হত্যা করি? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হাঁ। তিনি বললেন, তবে আপনি আমাকে কিছু বলার অনুমতি দিন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হাঁ বলতে পারো।
পরে মোহাম্মদ ইবনে মাসলামা (রা.) কা’ব ইবনে আশরাফকে গিয়ে বললেন, ওই লোকটি আমাদের কাছে সাদকা চায়। প্রকৃতপক্ষে এই চাওয়া আমাদের কষ্টে ফেলে দিয়েছে।
কা’ব বরলো, আল্লাজহর শপথ, তোমরা আরো অতিষ্ঠ হবে।
মোহাম্মদ ইবনে মাসলামা (রা.) বললেন, আমরা তার অনুসরণ যখন করেই ফেলেছি, এমতাবস্থায় তাকে পরিত্যাগ করা সমীচীন মনে হয় না। এই অনুসরণের পরিণাম কি, সেটা দেখা আবশ্যক। সে যাই হোক, আমি আপনাদের কাছে এক ওয়াসক খাদ্যদ্রব্য ধার চাই।
কা’ব বললো, আমার কাছে কিছু জিনিস বন্ধক রাখো।
মোহাম্মদ ইবনে মাসলামা (রা.) বললেন, আপনি কি জিনিস পছন্দ করবেন? কা’ব বললো, তোমার নারীদের আমার কাছে বন্ধক রাখো।
মোহাম্মদ ইবনে মাসলামা (রা.) বললেন, সেটা কি করে সম্ভব, আপনি হলেন আরবের সবচেয়ে সুদর্শন পরুষ।
কা’ব বললো, তবে তোমার কন্যাদের বন্ধক রাখো।
মোহাম্মদ ইবনে মাসলামা (রা.) বললেন, সেটাই বা কি করে সম্ভব? এটা তো আমার জন্যে লজ্জার কারণ হবে। লোক বলাবলি করবে যে, অমুকে সামান্য কিছু খাদ্যের জন্যে নিজ কন্যাদের অমুকের কাছে বন্ধক রেখেছে। হবে হাঁ, আপনার কাছে আমি আমার অস্ত্র বন্ধক রাখতে পারি।
এরপর উভয়ের মধ্যে কথা হলো যে, মোহাম্মদ ইবনে মাসলামা তার অস্ত্র নিয়ে কা’ব ইনে আশরাফের কাছে নিয়ে আসবেন।
আবু নায়েলাও একই ধরনের কাজ করলেন। তিনি ছিলেন কা’ব এর দুধভাই। তিনি কা’ব এর কাছে এসে কিছুক্ষণ কবিতা নিয়ে আলোচনা করলেন। কিছু কবিতা শুনলেন কিছু শোনালেন। এরপর বললেন, ভাই একটা প্রয়োজনে আপনার কাছে এছেছিলাম। প্রয়োজনের কথা আপনাকে বলতে চাই, তবে বিষয়টি গোপনীয়। আপনাকে বলার পর আপনি সে কথা গোপন রাখবেন।
কা’ব বললো, হাঁ, তাই করবো।
আবু নায়েলা আল্লাহর রসূোলর প্রতি ইঙ্গিত করে বললো এই লোকটির আগমন আমাদের জন্যে পরীক্ষা হয়ে দেখা দিয়েছে। সমগ্র আরব আমাদের শত্রু হয়ে পড়ছে। আমাদের সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবার-পরিজন ধ্বংস হতে চলেছে। জীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। ছেলে-মেয়েরা দারুণ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছ্ আবু নায়েলা এরপর মোহাম্মদ ইবনে মাসলামার কন্ঠস্বরের মতোই কিছু বললেন। কথা বলার সময় আবু নায়েলা একথাও বললেন যে, আমার কিছু বন্ধু রয়েছে, তারাও আমার মতো ধারণাই পোষণ করে। ওদেরকে আমি আপনার কাছে নিয়ে আসতে চাই। আপনি ওদের কাছেও কিছু জিনিস বিক্রি করে ওদের প্রতি দয়া করুন।
মোহাম্মদ ইবনে মাসলামা এবং আবু নায়েলা কথার মাধ্যমে লক্ষ্যপথে সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কেননা আলোচনার পর কা’ব এর বাড়ীতে তাদের অস্ত্রসহ আসার কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
প্রাথমিক উদ্যোগ গ্রহনের পর তৃতীয় হিজরীর ১৪ই রবিউল আউয়াল চাঁদনী রাতে এই ছোট দল আল্লাহর রসূলের সামনে অভিন্ন উদ্দেশ্যে হাযির হলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাকিঈ গারকাদ পর্যন্ত তাদের সঙ্গ দিলেন। এরপর বললনে, যাও, বিসমিল্লাহ! হে আল্লাহ তায়ালা, ওদের সাহায্যে করুন। রসূল গৃহে ফিরে এসে নামায ও মোনাজাতে মশগুল হলেন।
এদিকে সাহাবারা বাড়ীর সামনে যাওয়ার পর আবু নায়েলা উচ্চস্বরে কা’বকে ডাক দিলেন। আওয়ায শুনে কা’ব উঠে দাঁড়ালে তার নব পরিণীতা বললো, এতো রাতে কোথায় যাচ্ছো? আমি এমন আওয়ায শুনছি যে, আওয়ায থেকে যেন রক্ত ঝরে পড়ছে।
কা’ব বললো, ওরাতো আমার ভাই মোহাম্মদ ইবনে মাসলামা এবং দুধভাই আবু নায়েলা। সম্ভ্রন্ত লোককে যদি বর্শার আঘাতের দিকেও ডাকা হয়, তবুও তারা সেই ডাকে সাড়া দেয়।
এরপর কা’ব বাইরে এলো। তার মাথা থেকে সুবাস ভেষে আসছিলো।
আবু নায়েলা তার সঙ্গীদের বলছিলেন, সে যখন আসবে আমি তখন তার মাথার চুল ধরে শুঁকাতে শুরু করবো। তোমরা যখন দেখবে যে, আমি তার মাথা ধরে নিয়ন্ত্রনে নিয়ে এসেছি, তোমরা তখন তার ওপর হামলা করে মেরে ফেলবে। কা’ব আসার পর কিছুক্ষণ বিভিন্ন প্রসঙ্গে আলোচনা হলো। এরপর আবু নায়েলা (রা.) বললেন, আজকের মতো এমন মন মাতানো সুবাসতো কখনো শুঁকিনি। একথা শুনে কা’বের মন অহংকারে ভরে উঠলো। সে বললো, আমার কাছে আরবের সবচেয়ে সুবাসিনী অধিক সুগন্ধ ব্যবহারকারী মহিলা আছে। সে বললো, হাঁ, হাঁ, অবশ্যই। আবু নায়েলা কা’ব এর মাথার চুলে হাত দিয়ে তার চুলে ঘ্রাণ নিলেন এবং সঙ্গীদেরও সে চুলের ঘাণ শুঁকতে দিলেন। খানিকক্ষণ পরে আবু নায়েলা (রা.) বললেন, আর একবার শুঁকতে চাই ভাই। কা’ব নিশ্চিতভাবে বললো, হাঁ হাঁ। আবু নায়েলা পুনরায় কা’ব এর মাথার চুলের ঘ্রাণ নিলেন। কা’ব তখন বেশ প্রফুল্ল এবং পুরোপুরি নিশ্চিন্ত।
আরো কিছুপথ হাঁটার পর আবু নায়েলা পুনরায় কা’ব ইবনে আশরাফের মাথার চুলের ঘ্রাণ নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। কা’ব বললো ঠিক আছে। একথা বলে খানিকটা ঝুঁকে পড়লে আবু নায়েলা কা’ব এর মাথা নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে সঙ্গীদের বললেন, এবার নাও আল্লাহর এই দুশমনকে। সাথে সাথে মোহাম্মদ ইবনে মাসলামা সক্রিয় হলেন এবং অস্ত্র তুলে এমন আঘাত করলেন যে, আল্লাহর দুশমন সেখানেই শেষ হয়। তার ওপরর হামলা করার পর সে এমন জোরে চিৎকার করলো যে, আশে পাশে হৈচৈ পড়ে গেল। সকল বাড়ীতে আলো জ্বালিয়ে সবাই উৎকন্ঠিত হলো। কিন্তু কিছুই হলো না।
কা’ব ইবনে আশরাফের ওপর হামলার সময়ে হযরত হারেস ইবনে আওস (রা.)-এর দেহে একজন সঙ্গীর তরবারির সামান্য আঘাত অসতর্কভাবে লেগে যায়। এতে তিনি আহত হন। তারঁ দেহ থেকে রক্ত ঝরছিলো। ফেরার পথে হোজরা আরিজ নামক জায়গায় পৌছার পর তারা লক্ষ্য করলেন, হারেস সঙ্গে নেই। তাঁরা তখন সেখানেই অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর হারেস এসে পৌছুলেন। হারেসকে সঙ্গে নিয়ে তারা বাকিঈ গারকাদ নামক জায়গায় পৌছুলেন এবং জোরে শোরে তকবির ধ্বনি দিলেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ও সেই তবকির ধ্বনি শুনতে পেলেন। এতে তিনি বুঝতে পারলেন যে, অভিযান সফল হয়েছ্ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিলেন। তিনি বললেন, ‘আফলাহাতিল উজুহ’ অর্থাৎ এই চেহারা গুলো কামিয়াব হোক। সাহাবারা বললেন, ‘ওয়া ওযাজহুকা ইয়া রসূলুল্লাহ’ অর্থাৎ আপনার চেহারাও, হে আল্লাহর রসূল। একথা বলার পর পরই অভিযানে অংশগ্রহনকারীরা কা’ব ইবনে আশরাফের কর্তিত মস্তক আল্লাহর রসূলের সামনে রেখে দিলেন। দুর্বৃত্ত নেতা কা’ব এর হত্যাকান্ডে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর প্রশংসা করলেন এবং হারেসের ক্ষতস্থানে থু থু লাগিয়ে দিলেন। এতে তিনি সুস্থ হয়ে গেলেন। এরপর সেই ক্ষতস্থানে আর কখনো ব্যাথা হয়নি। [এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ যে সব গ্রন্থাবলী থেকে গ্রহন করা হয়েছে সে গুলো হচ্ছে, ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ৫১,৫৭, সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৩৪১,৪২৫, ২য় খন্ড, ৫৭৭, সুনানে আবু দাউদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৪২, ৪৩,যাদুর মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ.৯১]।
ইহুদীরা কা’ব ইবনে আশরাফের হত্যাকান্ডের খবব পেয়ে দমে গেলো। তারা স্পষ্টত বুঝে ফেললো যে, শান্তি ভঙ্গের দায়ে যারা দায়ী হবে, যারা সম্পাদিত চুক্তি লংঘন করবে, তাদের সদুপদেশ দেয়ার পর যদি তারা ভালোভাবে না চলে, তাহলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগেও দ্বিধা করবেন না। এ কারণে তারা কা’ব ইবনে আশরাফের হত্যার খবর শুনেও কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। তারা নিজেদের চালচলনে এমন ভাব প্রকাশ করলো যে, তারা শান্তিরক্ষা চুক্তির শর্তাবলী মেনে চলছে। তারা শক্তি প্রদর্শনের কোন চেষ্টাও আর করেনি। বলা যায় যে, বিষাক্ত সাপ সুড়সুড় করে গর্তে প্রবেশ করলো। এভাবে মদীনার আব্যন্তরীণ শত্রুদের মাথা তোলার আশঙ্কা তিরোহিত হলো।
এর পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনার বাইরে আসা বিপদের হুমকি মোকাবেলার জন্যে সময় পেলেন।
সাত) বাহরানের যুদ্ধ
এটা ছিলো বড় ধরনের এক সামরিক অভিযান। এই অভিযানে তিনশত মোজাহেদ অংশগ্রহন করেন। এই বাহিনী নিয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তৃতীয় হিজরীর রবিউল আওয়াল মাসে বাহরান নামক এলাকা অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যান। এটি হেজাযের অন্তভুক্ত ফারাহ অঞ্চলের একটি যায়গা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সঙ্গী মোজাহেদরা রবিউস সানি এবং জমাদিউল আউয়াল এই দুই মাস সেখানেই অবস্থান করেন। এরপর তিনি মদীনায় ফিরে আসেন। তাকে কোন প্রকার লড়াই-এর সন্মুখীন হতে হয়নি। [ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ৫০,৫১, যাদর মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৯১। এই অভিযানের কারণ সম্পর্কে নানা কথা উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে, মদীনায় এ খবর পৌছে যে, বনু সালিম গোত্র মদীনা ও তার আশে পাশে হামলার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। এটাও বলা হয়ে থাকে যে, আল্লাহর রসূল কোরায়শদের একটি কাফেলার খোঁজে বেরিয়েছিলেন। ইবনে হিশাম এই কারণ উল্লেখ উল্লেখ করেছেন। ইবনে কাইয়েমও এই অভিমত প্রকাশ করেন। প্রথম কারণ আলোচিত হয়নি। অন্য কারণটিই বিশ্বাসযোগ্য। কেননা বনু সালিম গোত্র ফারা এলাকায় বসবাস করতো না বাস করতো নযদে। এই এলাকা ফারা থেকে বহু দূরে অবস্থিত]।
আট ) ছারিয়্যা যায়েদ ইবনে হারেছা
ওহুদ যুদ্ধের আগে এটি ছিলো মুসলমানদের শেষ সফল অভিযান। তৃতীয় হিজরীর জমুদিউস সানিতে এই অভিযান পরিচালিত হয়েছিলো। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এরূপ,
বদরের যুদ্ধের পর কোরায়শদের মনে শান্তি ছিলো না। এরপর গ্রীষ্মকাল এসে পড়লো। এসময়ই সিরিয়ায় বাণিজ্য কাফেলা পাঠানো হয়। বাণিজ্য কাফেলার নিরাপত্তার চিন্তাও তাদের মাথা ব্যাথার কারণ হলো। সেই বছর সিরিয়াগামী বাণিজ্য কাফেলার নেতা সফওয়ান ইবনে উমাইয়া কোরায়শদের বললো, মোহাম্মদ এবং তার সঙ্গীরা আমাদের বাণিজ্য অভিযানে ব্যবহৃত পথ বিপজ্জনক করে তুলেছে। বুঝতে পারছি না, তাদের সাথে কিভাবে মোকাবেলা করবো। ওরা সমুদ্র উপকূল ভিন্ন অন্য কোথাও যায় না। উপকূলবাসীরা তাদের সাথে ভাব জমিয়ে নিয়েছে। সাধারণ লোকেরা তাদের পক্ষে রয়েছে। বুঝতে পারছি না, আমরা কোন পথ অবলম্বন করবো। এদিকে, আমরা যদি ঘরে বসে থাকি, তরে পুঁজি মেষ হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত কিছুই বাকি থাকবে না। কেননা মক্কা আমাদের জীবিকার ব্যবস্থাই হচ্ছে দুই মৌসুমের ব্যবসায় ওপর-গ্রীষ্মকালে সিরিয়া আর শীতকালে আবিসিনিয়ার সাথে।
সফওয়ানের এ প্রশ্নের পর বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু হলো। আসওয়াদ ইবনে আবদুল মোত্তালেব সফওয়ানকে বললো, তুমি সমুদ্র উপকুলের পথ ছেড়ে ইরাকগামী পথ ধরে যেয়ো। এ পথ অনেক ঘোরা। নজদ হয়ে সিরিয়ায় যেতে হবে। মদীনার পূর্ব দিকের এই পথ সম্পর্কে কোরায়শরা ছিলো অনবহিত। আসওয়াদ ইবনে আবদুল মোত্তালেব সফওয়ানকে পরামর্শ দিলো যে, তুমি বকর ইবনে ওবায়েল গোত্রের সাথে সম্পর্কিত ফোরাত ইবনে হাইয়ানের সাথে যোগাযোগ করো। তাকে প্রস্তাবিত সফরে পথ প্রদর্শক হিসাবে রাখবে।
এই ব্যবস্থার পর কোরায়শদের বাণিজ্য কাফেলা সফওয়ান ইবনে উমাইয়ার নেতৃত্ব নতুন পথ ধরে অগ্রসর হলো। কিন্তু এই সফর পরিকল্পনার বিস্তারিত খবর মদীনায় পৌছে গেলো। কিভাবে পৌছুলো এই খবর? ঘটনা ছিলো এই- সালিত ইবনে নোমান নঈম ইবনে মাসুদের সাথে মদের আড্ডায় মিলিত হয়েছিলো। এদের মধ্যে প্রথমোক্ত ব্যক্তি অর্থাৎ ছালিত সেই সময় ইসলাম গ্রহন করেছিলেন কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তি অর্থাৎ নঈম তখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। তখনো পর্যন্ত মদ নিষিদ্ধ হয়নি। মদের আড্ডায় নঈম ছালিতের কাছে নেশার ঘোরে কোরায়শদের বাণিজ্য যাত্রার সব কথা প্রকাশ করে দেয়। ছালিত সাথে সাথে মদীনা রওয়ানা হয়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সব খবর প্রকাশ করে দেন।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ খবর পাওয়ার পর কোরায়শী কাফেলার ওপর অবিলম্বে হামলার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। একশত সওয়ারের একটি বাহিনী হযরত যায়েদ ইবনে হারেছা (রা.)-এর নেতৃত্বে প্রেরণ করা হয়। হযরত যায়েদ (রা.) দ্রুত গিয়ে কারদাহ নামক জায়গায় কাফেলার দেখা পেয়ে যান। তারা তখনই কেবল সেখানে পৌছেছিলো। একটি জলাশয়ের তীরে তাদের অবতরণের প্রাক্কালে আকষ্মিক হামলায় তারা হতবুদ্ধি হয়ে যায়। সফওয়ান ইবনে উমাইয়া এবং তার সঙ্গীরা পলায়ন ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতে পারেনি।
মুসলমানরা ফোরাত ইবনে হাইয়ানকে কাফেলার পথ প্রদর্শক নিযুক্ত করেন। অন্য দুইজন লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যবসায়ের বিভিন্ন মালামাল মুসলমানদের হস্তগত হয়। সেসব দ্রব্যের মূল্য ছিলো একলাখ দেরহামের কাছাকাছি।
মদিনায় পৌছার পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক পঞ্চমাংশ সম্পদ বের করে নেন। সম্পদ সমাগ্রী মোজাহেদদের মধ্যে ভাগ করে দয়ো হয়। আর ফোরাত ইবনে হাইয়ান রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। [ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ৫০,৫১, রহমতুল লিল আলামীন, ২য় খন্ড, পৃ. ২১৯]।
বদরের যুদ্ধের পর এটি ছিলো কোরায়শ কাফেরদের জন্যে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা। এর ফলে তাদের মানসেক যন্ত্রণা বহুগুণ বেড়ে যায়। তাদের সামনে তখন দুটি পথ খোলা ছিলো।
হয়তো সব ভুলে মুসলমানদের সাথে আপোষ মীমাংসা, অন্যথায় নতুন উদ্দীপনায় উজ্জীবিত হয়ে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তাদের শক্তি চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়া, যেন ভবিষ্যতে তারা পুনরায় মাথা তুলতে না পারে। মক্কার নেতৃস্থানীয় কোরায়শরা দ্বিতীয় পথটিই গ্রহণ করলো। বাণিজ্য অভিযানে সর্বস্ব হারানোর পর তাদের প্রতিশোধস্পৃহা বহুগুণ বেড়ে যায়। মুসলমানদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার জন্যে তাদের ঘরে প্রবেশ করে তাদের ওপর হামলা করার জন্যে কোরায়শরা সর্বাত্বক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করে। অতীতের ঘটনাবলী ছাড়াও বাণিজ্য অভিযান ব্যর্থ হওয়ার ক্ষোভও ওহুদের যুদ্ধের অন্যতম কারণ।