ওহুদের যুদ্ধ
প্রতিশোধের জন্যে কোরায়শদের পস্তুতি
বদরের যুদ্ধে মক্কাবাসীদের পরাজয় ও অবমাননা এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের অনেকের নিহত হওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিলো। এ কারণে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রোধে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু নিহতদের জন্যে শোক প্রকাশ ও আহাযারি করতে কোরায়শ নেতারা নিহতদের আত্মীয়স্বজনকে নিষেধ করে দিয়েছিলো। যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ পরিশোধেও তাড়াহুড়ো করতে নিষেধ করা হয়। তাদের শোকের গভীরতা এবং মানসযন্ত্রণা তারা মুসলমানদের জানতে দিতে চাচ্ছিলো না। বদরের যুদ্ধের পর কাফেররা সম্মিলিতভাবে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে আরেকটি যুদ্ধ করে তারা নিজেদের মনের জ্বালা জুড়াবে। এই যুদ্ধে তাদের ক্রোধও প্রশমিত হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরপরই তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করলো। কোরায়শ নেতাদের মধ্যে এ যুদ্ধ প্রস্তুতিতে ইকরামা ইবনে আবি জেহেল, সফওয়ান ইবনে উমাইয়া, আবু সুফিয়ান ইবনে হরব এবং আবদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ ছিলো অগ্রগণ্য।
আবু সুফিয়ান যে কাফেলা বদর যুদ্ধের কারণ হয়েছিলো, সেই কাফেলা মালামালসহ আবু সুফিয়ান সরিয়ে নিতে সফল হয়েছিলো। সেই কাফেলার সমুদয় মালামাল যুদ্ধের জন্যে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। মালামালের মালিকদের বলা হয় যে, কোরায়শ বংশের লোকেরা, শোনো, মোহাম্মদ তোমাদেরকে কঠিন আঘাত হেনেছে। কাজেই তার সাথে যুদ্ধ করতে তোমরা তোমাদের এই মালামাল দিয়ে সহায়তা করো। তোমাদের নির্বাচিত সর্দারদের ওরা হত্যা করেছে। পুনরায় যুদ্ধ করলে হয়তো প্রতিশোধ গ্রহণে সক্ষম হবো। কোরায়শরা এ আবেদনে সাড়া দিয়ে নিজেদের সমুদয় মাল যুদ্ধের জন্যে দান করতে রাযি হয়। সেই মালামালের পরিমাণ ছিলো এক হাজার উট, এবং পঞ্চাশ হাজার দীনার। যুদ্ধের প্রস্ততির জন্যে উটগুলো বিক্রি করে দেয়া হয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ রব্বুল আলামীন এ আয়াত নাযিল করেন। ‘ আল্লাহর পথ থেকে লোকদের নিবৃত্ত করার জন্যে কাফেররা তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তারা ধন-সম্পদ ব্যয় করতেই থাকবে। অতপর সেটা তাদের মনস্তাপের কারণ হব। এরপর তারা পরাভূত হবে এবং যারা কুফুরী করে, তাদের জাহান্নামে একত্র করা হবে।’ ( সূরা আনফাল, আয়াত ৩,৬)
এরপর কোরায়শরা স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের জন্যে উদাত্ত আহব্বান জানালো। মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বিভিন্ন গোত্রের লোকদের উদ্বুদ্ধ করা হলো। সবাইকে কোরায়শদের পতাকাতলে সমবেত হতে বললো। নানা প্রকার লোভও দেখানো হলো। আবু ওযযা নামের একজন কবি বদরের যুদ্ধে বন্দী হয়েছিলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বিনা মুক্তিপণেই মুক্তি দিয়েছিলেন। তার কাছ থেকে এ মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়েছিলো যে, সে ভবিষ্যতে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোন কাজ করবে না। কিন্তু মক্কায় ফিরে আসার পর সফওয়ান ইবনে উমাইয়া তাকে বুঝালো যে, তুমি বিভিন্ন গোত্রের লোকদের কাছে যাও, তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষার কবিতার মাধ্যমে ক্ষেপিয়ে তোলো। আমি যদি যুদ্ধ থেকে ভালোভাবে ফিরে আসতে পারি তবে তোমাকে প্রচুর অর্থ-সম্পদ দেবো অথবা তোমার কন্যাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করবো। এ প্রলোভনে গলে গিয়ে আবু ওযযা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কৃত অঙ্গীকার ভেঙ্গে ভেললো। বিভিন্ন গোত্রে গিয়ে সে লোকদের উদ্দীপনায় কবিতার মাধ্যমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপাতে লাগলো। কোরায়শ নেতারা একইভাবে অন্য একজন কবি মোসাফা ইবনে আবদে মন্নাফ জুহামিকেও দলে টেনে এনছিলো। এমনিভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে কাফেরদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা বেড়ে চললো।
বছর পূর্ণ হতেই কোরায়শদের যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পূর্ন হলো। নিজেদের ঘনিষ্ঠ লোক ছাড়াও কোরায়শরদের মিত্র মিলে সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ালো তিন হাজার। কোরায়শ নেতারা কিছু সংখ্যক সুন্দরী মহীলাকেও যুদ্ধে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করলো। সে অনুযায়ী পনের জন সুন্দরীকেও যুদ্ধেক্ষেত্রে নেয়া হলো। এদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে নেয়ার যুক্তি দেখানো হলো, এদের নিরাপত্তা ও সম্মান রক্ষার প্রেরণায় যুদ্ধে বীরত্ব ও আত্মত্যাগের মানসিকতা বেশী কাজ করবে। যুদ্ধে তিন হাজার উট এবং দু’শো ঘোড়া নেয়ার জন্যে প্রস্তুত করা হলো। [অবশ্য ফাতহুল বারী গ্রন্থে ঘোড়ার সংখ্যা বলা হয়েছে একশত ( ৭তম খন্ড, ৩৪৬ পৃ.)]। ঘোড়াগুলোকে অধিকতর সক্রিয় রাখতে যুদ্ধক্ষেত্র পর্যন্ত পুরো পথ তাদের পিঠে কাউকে আরোহণ করানো হয়নি। এছাড়া নিরাপত্তামূলক অস্ত্রের মধ্যে তিন হাজার বর্মও অন্তর্ভুক্ত ছিলো।
আবু সুফিয়ান ছিলো সৈন্যদের সিপাহসালার। খালেদ ইবনে ওলীদকে সাহায্যকারী ঘোড় সওয়ার বাহিনীর নেতৃত্ব দেয়া হলো। ইকরামা ইবনে আবু জেহেলকে তার সহকারী নিযুক্ত করা হলো। নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী বনি আবদুদ দার গোত্রের কাছে যুদ্ধে পতাকা দেয়া হলো।
মদীনা অভিমুখে অমুসলিমদের যাত্রা
এ ধরনের প্রস্তুতির পর মক্কার এ বাহিনী মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হলো। মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে ক্রোধে তারা উন্মত্তপ্রায় হয়ে পড়েছিলো। যুদ্ধের রক্তপাত ও ভয়াবহতা থেকে তাদের ক্রোধের পরিমাণ আন্দায করা যায়।
হযরত আব্বাস (রা.) কোরায়শদের যুদ্ধ প্রস্তুতির প্রতি নযর রাখছিলেন। মদীনার দিকে রওয়ানা হওয়ার খবর জেনেই তিনি সমুদয় বিবরণ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবহিত করার জন্যে মদীনায় দ্রুত একজন দূত পাঠালেন।
হযরত আব্বাস (রা.)-এর প্রেরিত দূত মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী পাঁচশত কিলোমিটার পথের দূরত্ব মাত্র তিন দিনে অতিক্রম করলেন। মদীনার পৌছেই তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হযরত আব্বাস (রা.)-এর চিঠি প্রদান করলেন। প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই সময় মদীনার কোবা মসজিদে অবস্থান করছিলেন।
হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.) প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হযরত আব্বাস (রা.)-এর চিঠি পড়ে শোনালেন। চিঠির বক্তব্য হযরত উবাই (রা.)-কে গোপন রাখার নির্দেশ দিয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনসার ও মোহাজের নেতাদের সাথে জরুরী পরামর্শ করলেন।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরী ব্যবস্থা
যে কোন অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যে এরপর মদীনার মুসলমানরা অস্ত্র সঙ্গে রাখতে শুরু করলেন। এমনকি নামাযের সময়েও অস্ত্র দূরে সরিয়ে রাখা হতো না।
কয়েকজন আনসার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিরাপত্তা রক্ষায় নিযুক্ত করা হলো। এদের মধ্যে ছিলেন হযরত সা’দ ইবনে মায়া’য (রা.), উসায়েদ ইবনে খোযারের (রা.) এবং সা’দ ইবনে ওবাদা (রা.)। এরা সশস্ত্র অবস্থায় সারা রাত প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গৃহে পাহারায় থাকতেন।
মদীনার বিভিন্ন প্রবেশ পথেও বেশ কয়েকজন মুসলমানকে নিয়োগ করা হল। যে কোন ধরনের আকষ্মিক হামলা মোকাবেলায় এরা প্রস্তুত ছিলেন। ছোট ছোট কয়েকটি বাহিনীকে শত্রুদের গতিবিধির ওপর নযর রাখতে মদীনার বাইরের রাস্তায়ও নিযুক্ত করা হলো।
মদীনার সন্নিকটে কাফেরদের উপস্থিতি
মক্কার বাহিনী মদীনা অভিমুখে এগিয়ে চললো। আবওয়ার নামক জায়গায় পৌছার পর আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হেন্দ বিনতে ওতবা প্রস্তাব দিলো যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মা বিবি আমেনার কবর খুঁজে তাকে ছিন্ন ভিন্ন করা হোক। কিন্তু এ নারীর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে কোরায়শ নেতারা রাযি হলো না। তারা ভেবে দেখলো যে, এ কাজের পরিণাম হবে খুবই ভয়াবহ।
আবওয়া থেকে কাফেররা সফর অব্যাহত রাখলো। মদীনার কাছে পৌছে আকিক প্রান্তর অতিক্রম করলো। এরপর কিছুটা ডানে গিয়ে ওহুদ পর্বতের নিকটবর্তী নামক জায়গায় অবস্থান গ্রহণ করলো। আইনাইন মদীনার উত্তরে কানাত প্রান্তরের কাছে এটি উর্বর ভূমি। এটা তৃতীয় হিজরীর ৬ই শাওয়াল রোজ শুক্রবারের ঘটনা।
মজলিসে শুরার বৈঠক
অমুসলিমদের গতিবিধির পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর মুসলিম সংবাদ বাহকরা মদীনায় পৌছে দিচ্ছিলেন। তাদের অবস্থান গ্রহণের খবরও মদীনায় পৌছে গেলো। সেই সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মজলিসে শূরার বৈঠক আহব্বান করলেন। সেই বৈঠকে মদীনার প্রতিরক্ষা সম্পর্কে জরুরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার চিন্তা করা হচ্ছিলো। শুরুতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দেখা স্বপ্নের কথা সাহাবাদের জানালেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহর শপথ আমি একটা ভালো জিনিস দেখেছি। আমি দেখলাম কিছুসংখ্যক গাভীকে যবাই করা হচ্ছে। আমি দেখলাম আমার তরবারির ওপর পরাজয়ের কিছু চিহ্ন। আমি আরো দেখলাম যে, আমি আমার হাত একটি বর্মের ভেতর প্রবেশ করিয়েছি। অতপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গাভী যবাই করা হচ্ছে এ কথার ব্যাখ্যা করে বললেন, কয়েকজন সাহাবা শহীদ হবেন। তলোয়ারে পরাজয়ের চিহ্নের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বললেন যে, আমার পরিবারের কোন একজন শহীদ হবেন। নিরাপদ বর্মের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বললেন, এর অর্থ হচ্ছে মদীনা শহর।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অতপর আভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা কৌশল সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করলেন যে, মুসলমানরা শহর থেকে বের হবে না। তারা মদীনার ভেতরেই অবস্থান করবে। কাফেররা তাদের তাঁবুতে অবস্থান করতে থাকুক। যদি তারা মদীনায় প্রবেশ করে তাহলে মুসলমানরা মদীনার অলিগলিতে তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। মহিলারা ছাদের উপর থেকে তাদের ওপর আঘাত হানবে। এই অভিমতই ছিলো সঠিক। মোনাফেক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইও এই অভিমতের সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করলো। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অভিমতের সাথে এই মোনাফেক ঐকমত্য প্রকাশের কারণ এটা নয় যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অভিমত ও প্রতিরক্ষা কৌশল তার পছন্দ হয়েছিলো, বরং সে এ কারণেই পছন্দ করেছিলো যে, এতে একদিকে সে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকতে পারবে, অথচ কেউ সেটা বুঝতেও পারবে না। কিন্তু আল্লাহ রব্বুল আলামীনের ইচ্ছা ছিলো অন্যরকম। তিনি চেয়েছিলেন, প্রথমবারের মতো সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে চিহ্নত ও অপমানিত এবং মুসলমানিত্বের আবরণে তার কুফুরীর পর্দা উন্মোচিত হোক। এছাড়া মুসলমানরা নিজেদের সঙ্কটকালীন সময়ে জেনে নিক যে, তাদের আস্তিনে কতো বিষাক্ত সাপ লুকিয়ে আছে।
বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি- এমন কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবা ময়দানে গিয়ে কাফেরদের সাথে মোকাবেলা করার জন্যে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পরামর্শ দিলেন। তাঁরা জেহাদে অংশগ্রহণের জন্যে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করতে লাগলেন। কোন কোন সাহাবা বললেন, হে আল্লাহর রসূল, আমরা তো এই দিনের জন্যে আকাঙ্খা করছিলাম এবং আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে মোনাজাতও করছিলাম। আল্লাহ রব্বুল আলামীন আজ আমাদের সেই সুযোগ প্রদান করেছেন। আজ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ এসেছে। কাজেই হে আল্লাহর রসূল, আপনি শত্রুদের সামনে এগিয়ে চলুন, একথা মনে করবেন না যে, আমরা ভয় পাচ্ছি।
এ ধরনের উৎসাহ ও উদ্দিপনা প্রকাশকারীদের মধ্যে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা হযরত হামযা ইবনে আবদুল মোত্তালেবও ছিলেন। বদরের যুদ্ধে তিনি বিশেষ বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, সেই পবিত্র সত্ত্বার শপথ, যিনি আপনার ওপর কোরআন নাযিল করেছেন, মদীনার বাইরে কাফেরদের সাথে খোলা ময়দানে যুদ্ধ করার আগে আমি কোন আহার মুখে তুলবো না। [সীরাতে হালাবিয়াহ দ্বিতীয় খন্ড, পৃ. ১৪] ।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিকাংশ সাহাবার মতামতের প্রেক্ষিতে নিজ মতামত প্রত্যাহার করায়। শেষে সিদ্ধান্ত হলো যে, মদীনার বাইরে খোলা ময়দানেই কাফেরদের মোকাবেলা করা হবে।
ইসলামী বাহিনীর বিন্যাস ও যুদ্ধ যাত্রা
এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমার নামায পড়ালেন। নামায শেষে ওয়ায নসিহত করলেন। তিনি বললেন, ধৈর্য এবং দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যেমেই জয়লাভ করা সম্ভব হবে। সাথে সাথে মুসলমানদের নির্দেশ দিলেন তারা যেন শত্রুর মোকাবেলার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায়। একথা শোনার পর মুসলমানদের মনে আনন্দের স্রোত বয়ে যায়।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন আসরের নামায আদায় করলেন তখন দেখলেন যে, বেশ কিছু সংখ্যক লোক সমবেত হয়েছে। মদীনার উপকন্ঠ থেকেও কিছু লোক এসেছে। নামাযের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভেতরে প্রবেশ করলেন। হযরত আবু বকর এবং হযরত ওমর (রা.) তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাথায় পাগড়ি বাঁধলেন এবং পোশাক পরিধান করালেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিচে এবং ওপর বর্ম পরিধান করলেন, তলোয়ার সঙ্গে নিয়ে অন্যান্য অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সকলের সামনে হাযির হাযির হলেন।
সকলেই ছিলেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের প্রতীক্ষায়। হঠাৎ করে সা’দ ইবনে মায়া’য (রা.) এবং উসায়েদ ইবনে খুযায়ের (রা.) সাহাবাদের বললেন, আপনারা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জোর করে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে যাচ্ছেন। আপনারা তাঁকে বাধ্য করছেন। কাজেই বিষয়টি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ছেড়ে দিন। একথা শুনে সকলেই শরমিন্দা হলেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাইরে এলে তাঁর কাছে সবাই আরয করলেন যে, হে আল্লাহর রসূল, আমরা আপনার বিরোধিতা করছি, এটা ঠিক হয়নি। আপনি যা ভালো মনে করেন, তাই করুন। আপনি যদি আমাদের মদীনায় থাকাই সমীচীন মনে করেন তবে আমরা ওতেই রাযি। আপনি তাই করুন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কোন নবী যখন অস্ত্র পরিধান করে নেন, তখন তা খুলে ফেলা তাঁর জন্যে সমীচীন নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর এবং তাঁর শত্রুদের মধ্যে ফয়সালা না করে দেন। [মোসনাদে আহমদ, নাসাঈ, ইবনে ইসহাক]।
এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৈন্যদের এভাবে তিনভাগে ভাগ করলেন:
এক) মোহাজের বাহিনী। এই বাহিনীর পতাকা হযরত মসআব ইবনে ওমায়ের (রা.)-কে প্রদান করা হয় ।
দুই) আনসারদের আওস গোত্রের বাহিনী। হযরত উসায়েদ ইবনে খুযারের (রা.)-কে এই বাহিনীর নেতৃত্ব দেন।
তিন) খাযরাজ গোত্রের বাহিনী। হযরত হাব্বাব ইবনে মুনযের (রা.) এই বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করেন।
মুসলমানদের সৈন্য ছিলো সর্বসাকুল্যে এক হাজার। এদের মধ্যে একশত জন বর্ম পরিহিত এবং পঞ্চাশজন ঘোড় সওয়ার ছিলেন। [ইবনে কাইয়েম যাদুল মায়াদ গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডের ৯২ পৃষ্ঠায় একথা লিখেছেন। হাফেজ ইবনে হাজার বলেন, এটা ভূল। মূসা ইবনে ওকবা দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, ওহুদের যুদ্ধে কোন ঘোড়া ব্যবহার করা হয়নি। ওয়াদেরী লিখেছেন, মাত্র ২টি ঘোড়া ছিলো। একটি রসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে অন্যটি আবূ যোবদা (রা.)-এর কাছে ছিলো। ফতহুল বারী সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৫০] ।
অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, ঘোড় সওয়ার সৈন্য একজনও ছিলো না।
যুদ্ধ চলাকালে মদীনায় অবস্থানরত সাহাবীদের নামায পড়ানোর দায়িত্ব হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)-এর ওপর দিয়ে পরে মুসলিম সৈন্যদের রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ প্রদান দেয়া হয়। মুসলিম সৈন্যরা উত্তর দিকে রওয়ানা হন। হযরত সা’দ ইবনে মায়া’য (রা.) এবং হযরত সা’দ ইবনে ওবাদা (রা.) বর্ম পরিহিত অবস্থায় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে থাকা অবস্থায় যাচ্ছিলেন।
‘ছানিয়াতুল বিদা’ নামক স্থানে পৌছার পর একটি সৈন্যদল দেখা গেলো। এরা উৎকৃষ্ট অস্ত্রে সজ্জিত এবং পুরো সেনাবাহিনী থেকে পৃথক ছিলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে তারা বললো, তারা খাযরাজ গোত্রের মিত্র এবং [এই ঘটনা ইবনে সা’দ বর্ণনায় করেছেন। এই বর্ণনায় একথাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ওরা ছিলো বনি কায়নুকা গোত্রের ইহুদী। কিন্তু এ তথ্য সঠিক নয়। কেননা বনি কায়নুকা গোত্রের লোকদের বদর যুদ্ধের কিছুদিন পরই মদীনা থেকে বের করে দেয়া হয়] ইহুদী। কিন্তু তারা মক্কার কাফেরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে লড়াই করতে চায়। তাদের মুসলমান হওয়ার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানানো হলো যে, তারা মুসলমান হয়নি এবং হওয়ার ইচ্ছাও নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফেরদের বিরুদ্ধে ইহুদীদের সাহায্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালেন।
সৈন্যদল পরিদর্শন
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাইখান নামক জায়গায় পৌছে মুসলিম সৈন্যদের পরিদশর্ন করলেন। এই জায়গায় পরিদর্শন শেষে অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং যুদ্ধের জন্যে অনুপযোগিদের ফেরত পাঠানো হলো। যাদের ফেরত পাঠানো হয়েছিলো তাঁরা হলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.), হযরত ওসামা ইবনে যায়েদ (রা.), হযরত ওসায়েদ ইবনে যহির (রা.), যায়েদ ইবনে সাবেত (রা.), হযরত যায়েদ ইবনে আকরাম (রা.), হযরত ওসামা ইবনে আওস (রা.), হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.), হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা আনসারী (রা.) এবং হযরত সা’দ ইবনে হিব্বাব (রা.)। এই তালিকায় হযরত বারা ইবনে আযেব (রা.)-এর নামও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কিন্তু সহীহ বোখারীর মতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি ওহুদের যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন।
কম বয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও হযরত রাফে ইবনে খাদিজ (রা.) এবং হযরত সামুরা ইবনে জুন্দব (রা.)-কে জেহাদে অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়েছিলো। এর কারণ ছিলো এই যে, হযরত রাফে ইবনে খাদিজ (রা.) তীরন্দাজ হিসাবে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তাঁকে অনুমতি দেয়ার পর হযরত সামুরা ইবনে জুন্দব (রা.) বললেন, আমি তো রাফের চেয়ে অধিক শক্তিশালী। কুস্তিতে তাকে আমি আছড়ে দিতে পারি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একথা জানানোর হলে তিনি উভয়কে কুস্তি লড়ার আদেশ দিলেন। সেই কুস্তিতে হযরত সামুরা ইবনে জুন্দব (রা.) সত্যিই হযরত রাফেকে আছড়ে দিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত সামুরা (রা.)-কেও অংশগ্রহণের অনুমতি দিলেন।
ওহুদ ও মদীনার মাঝামাঝি স্থানে রাত্রিযাপন
শাইখান নামক জায়গাতেই সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে মাগরেব এবং এশার নামায আদায় করে রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত করলেন। মুসলমানদের তাঁবুর চারিদিকে পাহারাদারদের নেতা ছিলেন হযরত মোহাম্মদ ইবনে মাসলামা আনসারী (রা.)। তিনিই ইহুদী কা’ব ইবনে আশরাফের হত্যাকান্ডে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আর সাফওয়ান ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে কয়েস (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাহারায় নিযুক্ত ছিলেন।
মোনাফেকদের বিশ্বাসঘাতকতা
মোনাফেক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর দুরভিসন্ধি সফল হওয়ার কাছাকাছি ছিলো। তার ও তার সঙ্গীদের পিছুটান দেখে আওস গোত্রের বনু হারেসা এবং খাযরাজ গোত্রের বনু সালমার দলও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলো। তারা ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছিলো। কিন্তু আল্লাহ রব্বুল আলামীন এই দুই গোত্রের লোকদের মনে ঈমানী চেতনা জাগ্রত করে দেয়ায় তারা যুদ্ধের জন্যে সঙ্কল্পে অটল রইলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন, ‘যখন তোমাদের মধ্যেকার দু’টি দল ভীরুতার পরিচয় দেয়ার ইচ্ছা করেছিলো এবং আল্লাহ তায়ালা তোমাদের বন্ধু। মোমেনদের আল্লাহর ওপরই ভরসা করা উচিত।’
মোনাফেকরা মদীনায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে এমনি নাযুক পরিস্থিতিতে তাদের কর্তব্য সম্পর্কে হযরত জাবের (রা.)-এর পিতা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হারাম (রা.) সচেতন করতে চাইলেন। তিনি প্রত্যাবর্তন প্রত্যাশী মোনাফেকদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে তাদের পেছনে কিছুদূর গিয়ে বললেন, এখনো ফিরে চলো, আল্লাহর পথে লড়াই করো। কিন্তু তারা জবাব দিলো যে, যদি আমরা জানতাম যে, আপনারা যুদ্ধ করবেন তাহলে আমরা ফিরে যেতাম না। একথা শুনে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হারাম (রা.) বললেন, ওহে আল্লাহর শত্রুরা, তোমাদের ওপর আল্লাহর শাস্তি নাযিল হবে। ষ্মরণ রেখো, আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীকে তোমাদের মুখাপেক্ষি রাখবেন না।
সেই মোনাফেকদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাযিল করলেন, ‘এবং মোনাফেকদের জানবার জন্যে তাদের বলা হয়েছিলো’, এসো, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো অথবা প্রতিরোধ করো। তারা বললো, যদি যুদ্ধ জানতাম, তবে নিশ্চিতভাবে তোমাদের অনুসরণ করতাম। সেদিন তারা ঈমান অপেক্ষা কুফুরীর নিকটতর ছিলো। যা তাদের অন্তরে নেই, তা তারা মুখে বলে। যা তরা গোপন রাখে, আল্লাহ তায়ালা তা বিশেষভাবে অবহিত। (আলে ইমরান, আয়াত ১৬৭)
ওহুদের পাদদেশে
মোনাফেকদের ফিরে যাওয়ার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবশিষ্ট সাতশত মুসলমানকে সঙ্গে নিয়ে শত্রুদের দিকে অগ্রসর হলেন। শত্রুদের অবস্থান ছিলো ওহুদ পর্বতের উল্টো দিকে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের লক্ষ্য করে বললেন, বেশী ঘুরে গন্তব্যে যেতে হবে না, এমন পথের সন্ধান দিতে কেউ পারবে?
একথা শুনে হযরত আবু খাইছুমা (রা.) এগিয়ে এসে বললেন, একাজের জন্যে আমি হাযির রয়েছি, হে আল্লাহর রসূল। এরপর তিনি একটি সংক্ষিপ্ত পথ ধরে এগিয়ে চললেন। শত্রুদের পশ্চিম পাশে রেখে সেই পথ ধরে বনু হারেসা গোত্রের জমির ওপর দিয়ে মুসলমানরা এগিয়ে যাচ্ছিলো। এই পথে যাওয়ার সময় মরবা ইবনে কায়জা নামক এক ব্যক্তির বাগানের ওপর দিয়ে যাচ্ছিলো। এ লোকটি একদিকে ছিলো অন্ধ, অন্যদিকে মোনাফেক। মুসলমানদের আগমন অনুভব করে সে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে ধুলি নিক্ষেপ করতে শুরু করলো। এ সময়ে সে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলছিলো, আপনি যদি আল্লাহর রসূল হয়ে থাকেন, তবে মনে রাখবেন যে, আমার বাগানে আপনার আসার অনুমতি নেই। মুসলমানরা তাকে হত্যা করতে চাইলেন। প্রিয নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ওকে হত্যা করো না। সে মন এবং চোখ উভয় দিক থেকেই অন্ধ।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সামনে অগ্রসর হয়ে প্রান্তরের সীমায় অবস্থিত ওহুদ পাহাড়ের ঘাঁটিতে পৌছে সেখানেই শিবির স্থাপন করলেন। সামনে ছিলো মদীনা আর পেছনে ছিলো ওহুদের উঁচু পাহাড়। শত্রু বাহিনী তখন মুসলমান এবং মদীনার মাঝামাঝি অবস্থান করছিলো।
প্রতিরোধ পরিকল্পনা
এখানে পোছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৈন্যদের বিন্যস্ত ও সংগঠিত করলেন। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি সৈন্যদের কয়েকটি সারিতে বিভক্ত করলেন। তীরন্দাজদের একটি বাহিনী গঠন করলেন। এদের সংখ্যা ছিলো পঞ্চাশ। এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাবের ইবনে নোমান আনসারী (রা.)-কে এই বাহিনীর নেতৃত্ব দেয়া হলোঅ কানাত উপত্যকার দক্ষিণ দিকে অবস্থিত একটি গিরিপথে তাদের নিযুক্ত করা হলো। এই গিরিপথ মুসলিম বাহিনীর অবস্থান থেকে দেড়শত মিটার দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত ছিলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই তীরন্দাজদের নেতার উদ্দেশ্যে বলছিলেন, ‘তোমরা ঘোড় সওয়ার শত্রুদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করে তাদেরকে আমাদের কাছ থেকে ধূরে রাখবে। লক্ষ্য রাখবে তারা যেন পেছনের দিক থেকে আমাদের ওপর হামলা করতে না পারে। আমরা জয়লাভ করি অথবা পরাজিত হয়, উভয় অবস্থায়ই তোমারা নিজেদের অবস্থানে অবিচল থাকবে। তোমরা যেখানে অবস্থান নিয়েছো সেদিক থেকে যেন আমাদের ওপর কোন হামলা যেন আসতে না পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখবে। [ইবনে হিশাম, ২য় খন্য, পৃ. ৬৫-৬৬] । এরপর সকল তীরন্দাজকে লক্ষ্য করে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমাদের পেছনের দিক তোমরা হেফাযত করবে। যদি দেখো, আমরা মারা পড়ছি তবুও আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এসো না। যদি দেখো যে, আমরা গনীমতের মাল আহরণ করছি, তবুও আমাদের সাথে তোমরা অংশ নিও না।’ [ আহমদ তিবরানী হাকেম হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন। ফতহুল বারী সপ্তম খন্ডের ৩৫০ পৃ. দ্রষ্টব্য] ।
সহীহ বোখারীতে উল্লেখিত বক্তব্য অনুযায়ী জানা যায়, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, যদি তোমরা দেখো যে, আমাদেরকে চড়ুই পাখী ঠোকরাচ্ছে তবুও জায়গা ছাড়বে না- যদি আমি ডেকে না পাঠাই। যদি তোমরা দেখো যে, আমরা শত্রুদের পরাজিত করছি এবং এক সময়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছি, তবু নিজের জায়গা ছাড়বে না- যদি আমি ডেকে না পাঠাই। [সহীহ বোখারী, কিতাবুল জেহাদ, প্রথম খন্ড, পৃ. ৪২৬] ।
এমনি কঠোর সামরিক নির্দেশসহ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তীরন্দাজ সৈন্যদের নিযুক্ত করে গিরিপথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কারণ সেই পথের বিপরীত থেকে এসে শত্রুরা মুসলমানদের ওপর সহজেই হামলা করতে সক্ষম হতো।
বাকি সৈন্য থেকে হযরত মোনযের ইবনে আমর (রা.)-কে ডানদিকে এবং হযরত যোবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.) সহকারী হিসাবে মেকদাদ ইবনে আসওয়াদ (রা.)-কে নিযুক্ত করা হলো। হযরত যোবায়ের (রা.)-কে এই দায়িত্বও দেয়া হয়েছিলো যে, তিনি খালেদ ইবনে ওলীদের নেতৃত্বাধীন ঘোড় সওয়ারদের গতিরোধ করে রাখবেন। খালেদ কখনো ইসলাম গ্রহণ করেনি। এই শ্রেণী বিন্যাস ছাড়াও সম্মুখভাগে বিশিষ্ট ও নির্বাচিত সাহাবাদের মোতায়েন করা হয়েছিলো। এ সকল সাহাবার বীরত্ব সাহসিকতার খ্যাতি এতো বেশি ছিলো যে, তাদের এক একজনকে এক হাজার শত্রুর মোকাবেলায়ও যথেষ্ট মনে করা হতো।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেনা বিন্যাসের এ পরিকল্পনা ছিলো সূক্ষ্ম কোশল ও সামরিক প্রজ্ঞার পরিচায়ক। সামরিক নেতৃত্ব এবং সময় কৌশলে তাঁর নৈপুণ্য ও বিচক্ষণতার পরিচয় এতে পাওয়া যায়। এটাও প্রমাণিত হয় যে, সুযোগ্য ও দূরদর্শী কোন সেনানায়কই সমর কৌশলের ক্ষেত্রে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়ে শ্রেষ্ট সমর পরিকল্পনা প্রণয়নে সক্ষম হবেন না। শত্রু সৈন্যদের পরে এস নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের অবস্থানের জন্যে উৎকৃষ্ট স্থান নির্বাচন করছিলেন। পাহাড়ের সম্মুখভাগে অবস্থান গ্রহণ করে তিনি শত্রুদের হামলা থেকে পেছন দিক এবং ডান দিক নিরাপদ করলেন। বাম দিক থেকে শত্রুরা এসে যে জায়গায় পৌছে হামলা করবে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছিলো সেই যায়গায় তিনি সুদক্ষ তীরন্দাজ বাহিনী মোতায়েন করলেন। পেছনে উঁচু জায়গা বাছাই করে তিনি এটাই স্থির করলেন যে, যদি খোদা না করুন পরাজিত হলে পলায়নও করতে হবে না এবং শত্রুদের ধাওয়ার মুখে পড়ে নাজেহালও হতে হবে না বরং শিবিরে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ সম্ভব হবে। এমতাবস্থায় শত্রুরা শিবিরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের জন্যে হামলা চালালে তাদেরকে শোচনীয় বিপর্যয়ের সন্মূখীন হতে হবে। পক্ষান্তরে শত্রুদের এমন জায়গায় থাকতে বাধ্য করা হলো যে, তারা জয়লাভ করলেও জয়ের সুফল তেমন লাভ করতে পারবে না। আর মুসলমানরা জয়লাভ করলে কাফেররা মুসলমানদের ধাওয়া থেকে আত্মরক্ষায সমর্থ হবে না। পাশাপাশি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশিষ্ট সাহাবাদের একটি দলকে সন্মুখভাগে রেখে সামরিক সংখ্যার তাত্ত্বিক শূন্যতাও পূরণ করে দিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোসরা হিজরী সালের ৭ই শাওয়াল শনিবার সকালে সেনা বিন্যাসের এ গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করলেন।
দায়িত্বশীলদের উদ্দেশে রসূলুল্লাহ (স.)-এর বাণী
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর ঘোষণা করলেন যে, আমি আদেশ না দেয়া পর্যন্ত তোমরা যুদ্ধ শুরু করবে না। তিনি সেদিন দুটি বর্ম পরিধান করেছিলেন। সাহাবাদের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, শত্রুর সাথে মোকাবেলার সময় বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দেবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের মধ্যে উদ্দীপনা ও জেহাদী জযবা, জো’শ সৃষ্টি প্রাক্কালে একটি ধারালো তলোয়ার খাপমুক্ত করে বললেন, এই তলোয়ার খাপমুক্ত করে এর হক আদায় করতে পারবে এমন কে আছে? একথা শুনে কয়েকজন সাহাবা তলোয়ার নেযার জন্যে অগ্রসর হলেন। তাদের মধ্যে হযরত আলী ইবনে আবু তালেব, হযরত যোবায়ের ইবনে আওয়াম এবং ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-ও ছিলেন। হযরত আবু দোজনা সাম্মাক ইবনে খায়শা (রা.) সামনে অগ্রসর হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রসূল, এর হক কী? প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এই তরবারি দিয়ে শত্রুদের চেহারায় এমন আঘাত করবে যেন, সে চেহারা বাঁকা হয়ে যায়। হযরত আবু দোজনা (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রসূল, আমি এই তলোয়ার গ্রহণ করে এর হক আদায় করতে চাই। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তলোয়ার হযরত আবু দোজনা (রা.)-এর হাতে দিলেন।
হযরত আবু দোজনা (রা.) ছিলেন নিবেদিত প্রাণ সৈনিক। লড়াই-এর সময় বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করতেন। তাঁর কাছে একটি লাল পট্রি ছিলো। সেটি বেঁধে নিলে রোকে বুঝতো যে, এবার তিনি আমৃত্যু লড়াই করবেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেয়া তলোয়ার গ্রহণ করে তিনি মাথায় পট্রি বেঁধে মুসলমান ও কাফের সৈন্যদের মাঝখান দিয়ে বুক টান করে হাঁটতে লাগলেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এ ধরনের চলাচল আল্লাহ রব্বুর আলামীন পছন্দ করেন না, কিন্তু এই ক্ষেত্রে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য নয়।
মক্কা থেকে আগত সৈন্যদের বিন্যস্তকরণ
মোশরেকরা কাতারবন্দী করে সৈন্য সমাবেশ করলো। তাদের প্রধান ছিলো আবু সুফিয়ান। সৈন্যদের মাঝামাঝি জায়গায় সে নিজের কেন্দ্র তৈরী করলো। ডানদিকে ছিলো খালেদ ইবনে ওলীদ। বাঁ দিকে ছিলো ইকরামা ইবনে আবু জেহেল। পদাতিক সৈন্যদের নেতৃত্বে ছিলো সফওয়ান উমাইয়া। আর তীরন্দাজ সৈন্যদের মোকাবেলায় আবদুল্লাহ ইবনে রবিয়াকে নিযুক্ত করা হলো।
যুদ্ধের পতাকা বহন করছিলো বনু আবদুদ দারের একটি ছোট দল। বনু আবদে মানাফ কুসাই এর কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে মর্যাদা পরস্পরের মধ্যে বন্টনের সময় বনু আবদুদ দার এই মর্যাদা লাভ করে। গ্রন্থের প্রথমদিকে এ সম্পর্কে কেউ কোন প্রকার কলহ সৃষ্টিও করতে পারত না। কিন্তু আবু সুফিয়ান তাদের ষ্মরণ করে দিলো যে, বদরের যুদ্ধে নিশান বরদার নযর ইবনে হারেস গ্রেফতার হওয়ার পর কোরায়শদের কিরূপ পরিস্থিতির সন্মুখীন হয়েছিলো। সেকথা ষ্মরণ করিয়ে দেয়ার সাথে সাথে আবু সুফিয়ান নিশান বরদারদের ক্রোধের উদ্রেগক করার জন্যে বললো, হে বনু আবদুদ দার, বদরের যুদ্ধের দিনে আপনারাই আমাদের পতাকা বহন করছিলেন। কিস্তু সেই সময় কিরূপ পরিস্থিতির মোকাবেলা করা হয়েছিলো, সেটা আপনারা দেখেছেন। প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধের পতাকাই হচ্ছে যুদ্ধের প্রাণ। পতাকা পতিত হলে সাধারণ সৈন্যদের পদস্খলন ঘটে। এবার আপনারা হয় আমাদের পতাকা ভালোভাবে রক্ষা করবেন, অথবা একে বহন করা থেকে বিরত থাকবেন। আমরা নিজেরাই এটি বহনের ব্যবস্থা করবো। এই বক্তব্যের মধ্যে আবু সুফিয়ানের যে উদ্দেশ্য ছিলো, তা সফল হলো। তার জ্বালাময়ী কথা শুনে বনু আবদুদ দারের মনে প্রচন্ড ক্রোধের উদ্রেক হলো। আমরা পতাকা তোমাদের হাতে তুলে দেবো? আগামীকাল লড়াই শুরু হলে দেখে নিও, আমরা কি করি। পরদিন যুদ্ধ শুরু হলে বনু আবদুদ দারের প্রতিটি লোক দৃঢ়তা ও নিষ্ঠার সাথে পতাকা ধরে রাখলো। তবে শেষ পর্যন্ত একে একে সবাই জাহান্নামে পৌছে গেলো।
কোরায়শদের রাজনৈতিক চালবাজি
যুদ্ধ শুরুর কিছুক্ষণ আগে কোরায়শরা মুসলিম সেন্যদের মধ্যে ভাঙ্গন এবং পারস্পারিক কলহ সৃষ্টির চেষ্টা করলো। আবু সুফিয়ান আনসারদের কাছে পয়গাম পাঠালো যে, আপনারা যদি আমাদের এবং আমাদের চাচাতো ভাই মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাঝখান থেকে সরে যান, তবে আমরা আপনাদের প্রতি হামলা করবো না। কেননা আপনাদের সাথে লড়াই করার কোন প্রয়োজন আমাদের নেই। কিন্তু যে ঈমানের সামনে পাহাড়ও টিকতে পারে না তার সামনে এ ধরনের কূটনৈতিক চাল কিভাবে সফল হতে পার? আনসাররা আবু সুফিয়ানকে কঠোর ভাষায় জবাব পাঠিয়ে কিছু রূঢ় কথাও শুনিয়ে দিলেন।
পরস্পরের কাছাকাছি হওয়ার পর কোরায়শরা আরেকটি কূট চালের আশ্রয় নিলো। কাফের ক্রীড়নক ফাসেক আবু আমের মুসলমানদের সামনে হাযির হলো। এই লোকটির নাম আবদে আমর ইবনে সাইফী। তাকে রাহেব বলা হতো। কিন্তু রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নাম রেখেছিলেন ফাসেক। এই লোকটি আইয়ামে জাহেলিয়াতে আওস গোত্রের সরদার ছিলো। ইমলামের আবির্ভাবের পর ইসলাম তার গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিলো। সে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য শত্রুতা শুরু করলো। মদীনা থেকে বেরিয়ে সে মক্কায় কোরায়শদের কাছে পৌছেুলো এবং তাদেরকে যুদ্ধের জন্যে প্ররোচিত ও উদ্বুদ্ধ করলো। সে কাফেরদের এ মর্মেও নিশ্চয়তা প্রদান করলো যে, আমার কওমের যেসব গোত্র ইসলাম গ্রহণ করেছে, তারা যুদ্ধ ক্ষেত্রে আমাকে দেখে ছুটে আসবে।
মক্কাবাসীদের সাথে আবদে আমর নামের এই লোকটি প্রথমে মুসলমানদের সামনে এসে নিজের কাওমের লোকদের আহব্বান জানালো। নিজের পরিচয় প্রকাশ করে সে বললো, হে আওস গোত্রের লোকেরা, আমি আবু আমের। এই পরিচয় শোনে আওস গোত্রের লোকেরা বরলো, ওহে ফাসেক, আল্লাহ রব্বুল আলামীন তোমার চোখকে যেন খুশী নসীব না করেন। একথা শুনে আবু আমের বললো, ওহে আমার কওম, আমি চলে যাওয়ার পর খারাপ হয়ে গেছো। পরে যুদ্ধ শুরু হলে এই লোকটি কাফেরদের পক্ষে মুসলমানদের বিপক্ষে প্রাণপণ যুদ্ধ করছিলো। সে মুসলিম মোজাহেদদের প্রতি প্রচুর পাথর নিক্ষেপ করেছিলো।
এমনিভাবে কোরায়শদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির দ্বিতীয় চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। এর দ্বারা বোঝা যে, সংখ্যাধিক্য এবং প্রচুর অস্ত্রবল থাকা সত্বেও পৌত্তলিকদের মনে মুসলমানদের ভয় কতো প্রবল ছিলো এবং মুসলমানদের ব্যক্তিত্বের সামনে তারা নিজেদের কতো ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ মনে করতো।
অমুসলিম নারীদের ভূমিকা
কোরায়শ মহিলারাও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলো। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলো আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হেন্দা বিনতে এতবা। যুদ্ধরত সৈন্যদের মাঝে ঘুরে ঘুরে দফ বাজিয়ে এসব মহিলা সৈন্যদের উদ্দীপ্ত করে তুলছিলো। যুদ্ধের জন্যে অনুপ্রেরণা দেয়ার পাশাপাশি বর্শা নিক্ষেপ, তলোয়ার এবং তীর ব্যবহারে দক্ষতার পরিচয় দিতে বলছিলো। পতাকাবাহীদের লক্ষ্য করে তারা কবিতার ভাষায় বলছিলো,
‘দেখো বনু আবদুদ দার
দেখো তোমরাই উত্তর পুরুষের গৌরব
তলোয়ারের ব্যবহারে দক্ষতা দেখাও।’
নিজ কওমের লোকদের যুদ্ধের জন্যে উদ্বুদ্ধ করে কখনো বলছিলো,
‘যদি এগিয়ে যাও, তবে কোলাকুলি করবো
তোমাদের বুকে জড়িয়ে ধরবো।
নরম বিছানা সাজিয়ে দিবো
যদি পেছনে সরে যাও অভিমান করবো
দূরে চলে যাবো তোমাদের ছেড়ে।’
যুদ্ধের প্রথম ইন্ধন
এরপর উভয় দল মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো এবং যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। কোরায়শদের পক্ষ থেকে তালহা ইবনে আবু তালহা আবদারী সামনে এগিয়ে এলো। এক লোকটি কোরায়শদের মধ্যে শ্রেষ্ট বীর হিসাবে পরিগণিত ছিলো। মুসলমানরা তাকে বলতেন সেনাদলের কোলাব্যাঙ। উঠের পিঠে সওয়ার হয়ে তালহা তার সাথে মোকাবেলার জন্যে আহব্বান জানালো। তার অসাধারণ বীরত্বের কথা ভেবে সাধারণ মুসলমানরা ইতস্তত করছিলেন। হটাৎ হযরত যোবায়ের (রা.) সামনে অগ্রসর হয়ে চোখের পলকে বাঘের মত তালহার উটের ওপর লাফিয়ে উঠলেন। পরক্ষণে তালহাকে নিজের কাবুতে এনে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তালহাও নীচে পড়ে গেলো। হযরত যোবায়ের (রা.) তলোয়ার বের করে তালহাকে যবাই করে দিলেন।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত যোবায়ের (রা.)-এর অসীম সাহসিকতা দেখে আনন্দে অভিভূত হয়ে আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিলেন। মুসলমানরাও উচ্চস্বরে বলে উটলেন, নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর হযরত যোবায়ের (রা.)- এর প্রশংসা করে বললেন, ‘সকল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন ‘হাওয়ারী’ থাকে, আমার ‘হাওয়ারী’ হচ্ছে যোবায়ের। [সীরাতে হালবিয়া গ্রন্থের লেখক এর কথা লিখেছেন। হাদীস শরীফে হযরত যোবায়ের (রা.) সম্পর্কিত নবী (স.)- এর উক্তি অন্যত্র উল্লেখ করা হয়েছে] ।
সাধারণ যুদ্ধ শুরু ও কাফেরদের বিপর্যয়
এরপর চারদিকে যুদ্ধের দাবানল ছড়িয়ে পড়লো। সমগ্র ময়দানে চললো এলোপাতাড়ি হামলা, জবাবী হামলা। কোরায়শদের পতাকা রণক্ষেত্রের মাঝামাঝি জায়গায় ছিলো। বনু আবদুদ দার তাদের কমান্ডার তালহা ইবনে আবু তালহার হত্যাকান্ডের পর নিজেদের মধ্যে পর্যায়ক্রমে পতাকা বহন করছিলো। কিন্তু তারা একে একে সবাই নিহত হলো। তালহা নিহত হওয়ার পর তার ভাই ওসমান ইবনে আবু তালহা পতাকা হাতে তুলে নিলো এবং সামনে অগ্রসর হয়ে বললো,
‘পতাকা বহনকারীর কর্তব্য কঠিন
বর্শা রক্তাক্ত হোক বা ভেঙ্গে যাক’
হযরত হামযা ইবনে আবদুল মোত্তালেব (রা.) ওসমানের ওপর হামলা করলেন। হযরত হামযা (রা.) ওসমানের কাঁধে তলোয়ার দিয়ে এমন আঘাত করলেন যে, ওসমানের হাতসহ স্কন্ধ কেটে নাভির কাছে তরবারি পৌছে গেলো। তরবারি বের করার পর তার নাড়িভুড়ি দেখা যাচ্ছিলো।
ওসমানের হত্যাকান্ডের পর আবু সা’দ ইবনে আবু তালহা সামনে এগিয়ে এলো। হযরত সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.) তাঁর ওপর তীর নিক্ষেপ করলেন। সেই তীর তার গলায় বিদ্ধ হয়ে জিভ বেরিয়ে এলে আবু সা’দ সাথে সাথে ভবলীলা সাঙ্গ করলো। কোন কোন সীরাতুন নবী রচয়িতা লিখেছেন আবু সা’দ এগিয়ে এসে মোকাবেলা আহব্বান জানালে হযরত আলী (রা.) এগিয়ে গেলেন। উভয়ে একে অন্যের ওপর একবার করে আঘাত করলেও হযরত আলী (রা.) অক্ষতই রইলেন। কিন্তু আবু সা’দ নিহত হলো।
আবু সা’দ নিহত হওয়ার পর মোসাফা ইবনে আবু তালহা পতাকা তুলে নিল। কিন্তু হযরত আসেম ইবনে সাবেত ইবনে আবু আফলাহ (রা.) তীর নিক্ষেপ করে তাকে হত্যা করলেন।
মোসাফা নিহত হওয়ার পর তার ভাই অর্থাৎ তালহার পুত্র কেলাব ইবনে তালহা পতাকা বহন করে সামনে এগিয়ে এলো। হযরত যোবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.) তার সামনে গিয়ে হাযির হয়ে ক্ষণিকের মোকাবেলার পর তাকেও তার পিতার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
পরে পতাকা নিল মোসাফা ও কেবালের ভ্রাতুস্পুত্র জিলাস ইবনে আবু তালহা। হযরত তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ (রা.) বর্শা নিক্ষেপে তাকে হত্যা করলেন। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, জেলাসকে হযরত আসেম ইবনে ছাবেত ইবনে আফলাহ (রা.) তীর নিক্ষেপে হত্যা করেন।
একই পরিবারের ছয়জন পর্যায়ক্রমে নিহত হলো। এরা ছিলো আবু তালহা আবদুল্লাহ ইবনে ওসমান ইবনে আবদুদ দারের পুত্র ও পৌত্র। পৌত্তলিকদের পতাকা বহন ও রক্ষা করতে গিয়ে এরা সবাই প্রাণ হারায়।
এরপর বনু আবদুদ দার গোত্রের আরতাত ইবনে শুরাইবিল নামক আর একটি লোক পতাকা উঠিয়ে নেয়। কিন্তু হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.), মতান্তরে হযরত হামযা ইবনে আবদুল মোত্তালেব (রা.) তাকে হত্যা করেন। এরপর শুরাইহ ইবনে কারেয পতাকা তুলে ধরে। কিনাতু কুযমান তাকে হত্যা করে। কুযমান ছিলো মোনাফেক এবং ইসলামের পরিবর্তে মর্যাদা রক্ষার প্রেরণার যুদ্ধ করতে এসেছিলো।
শুরাইহর পর আবু যায়েদ আমর ইবনে আবদে মান্নাফ আবদারী পতাকা তুলে ধরে। কিন্তু কুযমান তাকেও হত্যা করে। তারপর শুরাহবিল ইবনে হাশেম আবদায়ীর এক পুত্র পতাকা তোল। কিন্তু কুযমানের হাতে সেও মারা যায়।
বনু আবদুদ দার গোত্রের এই দশ ব্যক্তি যারা পৌত্তলিকদের হাতে পতাকা তুলেছিলো তারা সবাই একে একে মারা গেলো। এরপর পতাকা তোলার মত কেউ জীবিত রইল না। কিন্তু সেই সময় মওয়াব নামে তাদের এক ক্রীতদাস পতাকা তুলে নিয়ে তার পূবর্বর্তী পতাকাবাহী মনিবদের চেয়ে অধিক বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে। শেষ পর্যন্ত একে একে তার দু’টি হাত কাটা যায়। কিন্তু হাঁটুর ওপর ভর করে বুক ও কাঁধের সাহায্যে পতাকা তুলে ধরে রাখে। অবশেষে কুযমানের হাতে সেও নিহত হয়। সেই সময় সে বলেছিলো, হে আল্লাহ, এখন তো আমি কোন ওযর অবশিষ্ট রাখিনি। ওই ক্রীতদাস অর্থাৎ মওয়াবই নিহত হওয়ার পর পতাকা মাটিতে পড়ে যায় এবং ওটা ওঠাতে পারে, এমন কেউ বেঁচে ছিলো না। এ কারণে পতাকা মাটিতেই পড়ে রইল।
একদিকে পোত্তলিকদের পতাকা বহনের জায়গায় যুদ্ধ চলছিলো, অন্যদিকে ময়দানের বিভিন্ন অংশে তুমুল যুদ্ধ চলছিলো। মুসলমানদের প্রাণে ঈমানের তেজ ছিলো শক্তিশালী। এ কারণে তারা কাফেরদের ওপর স্রোতের মত ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন। তারা উচ্চারণ করছিলেন ‘আমতে আমেত’ অর্থাৎ মরণ, মরণ।
হযরত আবু দোজানা (রা.) মাথায় লাল পট্রি বেঁধে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তলোয়ার হাতে নিয়ে সেই তলোয়ারের হক আদায় করছিলেন। তিনি লড়াই করতে করতে অনেক দূরে চলে যাচ্ছিলেন। তিনি যে বিধর্মীর সাথে লড়ছিলেন, তাকেই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিচ্ছিলেন। কাফেরদের কাতারের পর কাতার তিনি সাফ করে ফেললেন।
হযরত যোবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.) বলেন, আমি যখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তলোয়ার চেয়েছিলাম, তিনি আমাকে দেননি। এতে আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। মনে মনে ভাবলাম, আমি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফুফু হযরত সফিয়া (রা.)-এর সন্তান, আমি কোরায়শ বংশোদ্ভুত এবং তাঁর কাছে গিয়ে আবু দোজানার আগেই আমি তলোয়ার চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি আমাকে তলোয়ার দিলেন না, দিলেন আবু দোজানাকে। কাজেই আল্লাহর শপথ, আমি লক্ষ্য করবো, আবু দোজানা সেই তলোয়ার নিয়ে কি এমন বীরত্ব দেখায়। এরপর আমি আবু দোজানার পেছেনে লেগে রইলাম। আবু দোজানা প্রথমে মাথায় লাল পট্রি বাঁধলেন। এটা দেখে আনসাররা বললেন, আবু দোজানা মৃত্যুর পট্রি বের করে নিয়েছে। এরপর তিনি ময়দানের দিকে এই কবিতা আবৃত্তি করতে করতে অগ্রসর হলেন,
‘ঐ পাহাড়ের পাদদেশে আমি আমার বন্ধুর সাথে অঙ্গীকার করেছি।
কথনো আমি কাতারের পেছনে থাকবো না
সামনে গিয়ে আল্লাহ ও তাঁর তলোয়ার চালাতে থাকবো’
এই কবিতা আবৃত্তি করতে করতে আবু দোজানা যাকে সামনে পেতেন তাকেই হত্যা করতেন। একজন কাফের রণক্ষেত্রে ঘুরে ঘুরে আহত মুসলমানদের হত্যা করছিলো। এই লোকটি এবং হযরত আবু দোজানা (রা.) ক্রমেই নিকটতর হচ্ছিলো। আমি মনে মনে কামনা করলাম, আল্লাহ করুন উভয়ের মধ্যে যেন সংঘর্ষ বেধে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে গেলো। ওরা এত অন্যের ওপর হামলা করলো। প্রথমে মোশরেক লোকটি হযরত আবু দোজানা (রা.)-এর ওপর হামলা করলো। তিনি সেই হামলা ঢালের ওপর প্রতিরোধ করলেন। মোশরেকের তরবারি সেই ঢালে আটকে গেলো। এরপর হযরত আবু দোজানা (রা.) তরবারির এক আঘাতে পৌত্তলিককে জাহান্নামে ঠেলে দিলেন। [ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃ. ৫৮-৬৯] ।
এরপর হযরত আবু দোজানা (রা.) কাতারের পর কাতার ছিন্ন ভিন্ন করে সামনে এগিয়ে গেলেন। এক সময় কোরায়শী নারীদের নেত্রীর কাছে গিয়ে পৌছুলেন। তিনি জানতেন না যে, ওরা নারী। তিনি বলেছেন, আমি দেখলাম একজন লোক যোদ্ধাদের আরো বেশী সাহসিকতার পরিচয় দেয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করছে। আমি তাকে নিশানা করলাম। কিন্তু তলোয়ার দিয়ে হামলা করতে চাইলে সে মরণ চিৎকার দিয়ে উঠলো। এই চিৎকার শুনে হযরত আবু দোজানা (রা.) বুঝলেন যে, সে মহিলা। তিনি বলেন, আমি ভাবলাম, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তলোয়ার দিয়ে কোন মহিলাকে হত্যা করে এই তলোয়ার কলঙ্কিত করবো না।
এই মহীলা ছিলো হেন্দ বিনতে ওতবা। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী। হযরত যোবায়ের (রা.) বলেন, আমি দেখলাম, হযরত আবু দোজানা (রা) হেন্দের মাথার ওপর তরবারি উঠিয়ে পুনরায় নামিয়ে ফেললেন। আমি তখন বললাম, আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই ভালো জানেন। [ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃ. ৬৯] ।
এদিকে হযরত হামযা (রা.) ক্রুব্ধ ব্যাঘ্রের মতো লড়াই করছিলেন। তুলনাবিহীন বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে তিনি শত্রুদের ব্যুহ ভেদ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর সামনে বড় বড় বীর বাহাদুর কারবৈশাখীর ঝড়ে উড়ে যাওয়া পাতার মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছিলো। পৌত্তলিকদের নিশ্চিহ্ন করার ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালনে তিনি রনক্ষেত্রে কাফেরদের জন্যে ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন। কিছুসংখ্যক পৌত্তলিক এই অবস্থা দেখে তাঁর সামনে গিয়ে মোকাবেলা করার সাহস না পেরে ভীরু কাপুরুষদের মতো তাঁকে চুপিসারে আঘাত করলো। সেই আঘাতে সাইয়েদুশ শোহাদা হযরত হামযা (রা.) লুটিয়ে পড়লেন।
শেরে খোদা হযরত হামযা (রা.)-এর শাহাদাত
হযরত হামযা (রা.)-এর আততায়ীর নাম ছিলো ওয়াহশী ইবনে হারব। আমরা হযরত হামযা (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনা আততায়ীর ওয়াহশীর ভাষায় প্রকাশ করছি। মুসলমান হবার পর তিনি বলেন, আমি ছিলাম যোবায়ের ইবনে মোয়াত্তামের ক্রীতদাস। তার চাচা তুয়াইমা ইবনে আদী বদরের যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। কোরায়শরা ওহুদ যুদ্ধে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে যোবায়ের ইবনে মোয়াত্তাম আমাকে বললেন, যদি তুমি মোহাম্মদের চাচা হামযাকে আমার চাচার হত্যার প্রতিশোধস্বরূপ হত্যা করতে পারো, তবে তুমি মুক্তি পাবে। এই প্রস্তাব পাওয়ার পর কোরায়শদের সাথে ওহুদের যুদ্ধের জন্যে আমি রওয়ানা হলাম। আমি ছিলাম আবিসিনিয়ার অধিবাসী। আবিসিনিয়দের মতো আমিও ছিলাম বর্শা নিক্ষেপে সুদক্ষ। আমার নিক্ষিপ্ত বর্শা কম সময়েই লক্ষ্যভ্রষ্ট হতো। ব্যাপকভাবে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার পর আমি হযরত হামযা (রা.)-কে খুঁজতে শুরু করলাম। এক সময় তাঁকে দেখতেও পেলাম। তিনি জেদী উটের মতো সামনের লোকদের ছিন্নভিন্ন করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর সামনে কোন বাধাই টিকতে পারছিলো না। কেউ তাঁর সামনে দাঁড়াতেই পারছিলো না।
আল্লাহর শপথ, আমি হযরত হামযা (রা.)-এর ওপর হামলার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলাম এবং একটি পাথর অথবা বৃক্ষের আড়ালে ছিলাম, এমন সময় সাবা ইবনে আবদুল ওযযা আমাকে ডিঙ্গিয়ে তাঁর কাছে পৌছে গেলো। হযরত হামযা (রা.) হুঙ্কার দিয়ে সাবাকে বললেন, ওরে লজ্জাস্থানের চামড়া কর্তনকারীর সন্তান এই নে। একথা বলে তিনি সাবার ঘাড়ে এমনভাবে তরবারির আঘাত করলেন এবং তার মাথা এমনভাবে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো যেন তার ঘাড়ে মাথা ছিলোই না। আমি তখন বর্শা তুলে হযরত হামযা (রা.)-এর প্রতি নিক্ষেপ করলাম। বর্শা নাভির নীচে বিদ্ধ হয়ে দুই পায়ের মাঝখান দিয়ে পেছনে পৌছে গেলো। তিনি পড়ে গিয়ে উঠতে চাইলেন কিন্তু সক্ষম হননি। তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত আমি তাকে যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় রেখে দিলাম। এক সময় তিনি শেষে নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। আমি যখন তাঁর কাছে গিয়ে বর্শা বের করে কোরায়শদের মধ্যে গিয়ে বসে রইলাম। হযরত হামযা (রা.) ছাড়া অন্য কাউকে আঘাত করার ইচ্ছা ও প্রয়োজনই আমার ছিলো না। আমি মুক্তি পাওয়ার জন্যেই হযরত হামযা (রা.)-কে হত্যা করেছি। এরপর মক্কা ফিরে এসেই আমি মুক্তি লাভ করলাম। [ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃ. ৬৯-৭২। সহীহ বোখারী দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্টা ৫৮৩। তায়েফের যুদ্ধের পর ওয়াহশী ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত হামযা (রাঃ)-কে বর্শার আঘাতে হত্যা করেছিলেন, সেই বর্শা দিয়ে তিনি হযরত আবু বকর সিদ্দিকের (রাঃ) খেলাফতের সময়ে ইয়ামামার যুদ্ধে মোসায়লামা কাযযাবকে হত্যা করেন। রোমকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত ইয়ারমুকের যুদ্ধেও তিনি অংশ গ্রহণ করেন] ।
মুসলমানদের সাফল্য
শেরে থোদা শেরে রসূল হযরত হামযা (রা.)-এর শাহাদাতে মুসলমানদের মারাত্মক ও অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়। তা সত্বেও যুদ্ধে মুসলমানদের সাফল্যের লক্ষণ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। হযরত আবু বকর, হযরত ওমর, হযরত আলী, হযরত যোবায়ের, হযরত মসআব ইবনে ওমাইয়ের, হযরত তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ, হযরত সা’দ ইবনে মায়া’য, হযরত সা’দ ইবনে ওবাদা, হযরত সা’দ ইবনে রবি, হযরত নযর ইবনে আনাস (রা.) এমন বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে লড়াই করলেন যে, কাফেরদের পিলে চমকে গেলো, মনোবল ভেঙ্গে পড়লো, তাদের শক্তি সাহস শিথিল হয়ে গেলো।
বাসর শয্যা থেকে জেহাদের ময়দানে
নিবেদিত প্রাণ মোজাহেদদের মধ্যে একজন ছিলেন হযরত হানযালা (রা.)। তিনি আজ এক অনন্য গৌরবের সাথে জেহাদের ময়দানে হাযির হয়েছেন। তিনি ছিলেন আবু আমের রাহেবের পুত্র। পরে আবু আমের ফাসেক উপাধি পায়। তার পরিচয় ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত হানযালা (রা.) নতুন বিয়ে করেছিলেন। জেহাদের জন্যে যখন আহব্বান জানানো হচ্ছিলো, তখন তিনি ছিলেন বাসর শয্যায়। জেহাদের আহব্বান পাওয়ার সাথে সাথে তিনি জেহাদের জন্যে রওয়ানা হয়ে যান। যুদ্ধ ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর হযরত হানযালা (রা.) কাফেরদের ব্যুহ ভেদ করে তীব্র বেগে আবু সুফিয়ানের কাছে হাযির হন। কাফের সেনাপতিকে তিনি আঘাত করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর শাহাদাত নির্ধারিত রেখেছিলেন। আবু সুফিয়ান লক্ষ্য করে তলোয়ার তোলার সাথে সাথে শাদ্দাদ ইবনে আওস দেখে ফেলে এবং হযরত হানযালা (রা.)-এর ওপর আকষ্মিক হামলা চালায়। এমে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
তীরন্দাজদের কৃতিত্ব
জাবালে রুমাতে যেসকল তীরন্দাজকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দিষ্ট দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন তারা যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় ও সাফল্য নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মক্কায় অমুসলিমরা খালেদ ইবনে ওলীদের নেতৃত্বে এবং আবু আমের ফাসেক এর সহায়তায় ইসলামী ফৌজের বাম বাহু ভেঙ্গে মুসলমানদের পরাজিত করতে পর্যায়ক্রমে তিনবার হামলা চালায়। কিন্তু মুসলমানরা তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। তীর বর্ষণ করে তারা কোরায়শদেরকে ঝাঁঝরা করে দেয়। [দেখুন ফতহুল বারী, সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৪৬] ।
মোশরেকদের পরাজয়
কিছুক্ষণ যাবত তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। স্বল্পসংখ্যক মুসলমানের এ বাহিনী সমগ্র যুদ্ধক্ষেত্রে ছেয়ে থাকে। অবশষে পৌত্তলিকদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। তাদের মধ্যে পিছু হটার ভাবনা দেখা দেয়। তারা ডানে বামে সামনে পেছনে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তিন হাজার সৈন্যের মোকাবিলায় মুসলমানরা যুদ্ধ করছিলো। তারা ঈমান, একিন, বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে তলোয়ার চালনার জওহর প্রদর্শন করছিলেন।
মুসলমানদের অপ্রতিরোধ্য হামলার মুখে কাফেররা দিশেহারা হয়ে পড়লো। তারা কি করবে কিছুই স্থির করতে না পেরে পলায়ন শুরু করলো। যুদ্ধের পতাকাবাহীদের শোচনীয় পরিণতি দেখে কেউ আর পতাকা ধরে রাখতে সাহস পাচ্ছিলো না। তাদের মনোবল ভেঙ্গে গেলো। মুসলমানদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ, নিজেদের মর্যাদা ও সম্মান পুনদ্ধার ইত্যাদি যতো বড় বড় কথা তারা বলেছিলো, সব এলোমেলো হয়ে গেলো।
ইবনে ইসহাক লিখেছেন, আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের ওপর তাঁর সাহায্য নাযিল করেছেন এবং যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তা পূর্ণ করেছেন। মুসলমানরা তলোয়ারের মাধ্যমে পৌত্তলিকদের এমন কচুকাটা করলো যে, ওরা শিবির ছেড়েও দূরে পালিয়ে গেলো। মোটকথা তারা শোচনীয় পরাজয়ের সন্মুখীন হলো। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের (রা.) বলেন, তাঁর পিতা বলেছেন, আল্লাহর শপথ, আমি লক্ষ্য করেছি যে, হেন্দ বিনতে ওতবা এবং তার সঙ্গিনী মহিলাদের হাঁটু দেখা যাচ্ছে। তারা কাপড় তুলে ছুটে পালাচ্ছিলো। তাদের গ্রেফতার করার ব্যাপরে ছোট বড় কোন অন্তরায়ই ছিলো না। [ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা. ৭৭] ।
সহীহ বোখারীতে হযরত বারা ইবনে আযেব (রা.) থেকৈ বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, কাফেরদের সঙ্গে আমাদের মোকাবেলা হলে তাদের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে যায়। মহিলাদের দেখলাম, ওরা হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে দ্রুত পাহাড়ি এলাকায় পালিয়ে যাচ্ছে। তাদের পায়ের অধিকাংশ দেখা যাচ্ছিলো। [সহীহ বোখারী, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা. ৫৭৯] । এধরনের বিশৃঙ্খলা ও হট্রগোলের মধ্যে মুসলমানরা পৌত্তলিকদের ওপর তলোয়ার চালাচ্ছিলেন এবং মালামাল সংগ্রহ করে তাদের তাড়া করছিলেন।
তীরন্দাজদের আত্মঘাতী ভুল
স্বল্পসংখ্যক মুসলমান মক্কাবাসীদের বিরুদ্ধে যখন ইতিহাসের পাতায় এক বৈশিষ্টপূর্ণ বিজয় চিহ্নিত করছিলেন, ঠিক তখনই তীরন্দাজদের অধিকাংশ ব্যক্তি এক ভয়াবহ ভুল করে ফেললেন। অথচ মুসলমানদের সাফল্য এই যুদ্ধে বদরের যুদ্ধের চেয়ে কোন অংশে কম ছিলো না। কিন্তু তীরন্দাজদের এক ভয়াবহ ভুলে যুদ্ধের চিত্রই পরিবর্তিত হয়ে গেলো। মুসলমানরা মারাত্মক ক্ষতির সন্মুখীন হলেন। এই ভুলের কারণে বদরের যুদ্ধে অর্জিত মুসলমানদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়ে পড়েছিলো।
ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিজয় ও পরাজয় উভয় অবস্থাতেই তীরন্দাজদের স্বস্থানে অটল ও অবিচল থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ স্বত্তেও অন্য মুসলমানদের গনীমতের মালামাল সংগ্রহ করতে দেখে তীরন্দাজরা লোভ সামলাতে পারল না। এক অন্যকে বললেন, গনীমত, গনীমত। তোমাদের সঙ্গীরা জয়ী হয়েছে, এখন আর কিসের প্রতীক্ষা।
তীরন্দাজদের মধ্যে থেকে এ ধরনের আওয়ায ওঠার পর তাদের কমান্ডার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের (রা.) তাদেরকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ ষ্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, তোমরা কি ভুলে গেছো, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের কি আদেশ দিয়েছেন? কিন্তু অধিকাংশ তীরন্দাজ হযরত আবদুল্লাহর (রা.) কথার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করলেন না। তারা বললেন, আল্লাহর শপথ, আমরাও ওদের কাছে যাবো এবং কিছু গনীমতের কিছু মাল অবশ্যই করবো। [সহীহ বোখারীতে একথা হযরত বারা ইবনে আজেব (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে, পৃষ্ঠা ৮২৬ দেখুন] ।
এরপর চল্লিশজন তীরন্দাজ নিজেদের দায়িত্ব উপেক্ষা করে গনীমতের মাল সংগ্রহ শুরু করলেন। আর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাবের (রা.) এবং তাঁর নয়জন সঙ্গী পাহারায়ই নিযুক্ত রইলেন। তাঁরা দৃঢ় সংকল্পের সাথে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, এখান থেকে যাওয়ার জন্যে যদি নবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তখনই যাবো অথবা নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করবো।
শত্রুদের নিয়ন্ত্রণে মুসলিম সেনাদল
খালেদ ইবনে ওলীদ এই গিরিপথে এসে তিনবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছিলো। এবার এ সুবর্ণ সুযোগ সে হাতছাড়া করলো না। অল্পক্ষণের মধ্যে খালেদ আবদুল্লাহ ইবনে জাবের (রা.) এবং তাঁর সঙ্গীদের নিহত করে মুসলমানদের ওপর পেছনের দিক থেকে হামলা করলো। খালেদ ইবনে ওলীদের সঙ্গীরা উচ্চস্বরে শ্লোগান দিলো। এতো পরাজিত কাফেররা যুদ্ধক্ষেত্রের পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হলো এবং মুসলমানদের ওপর পুনোরোদ্যামে হামলা চালালো। এদিকে বনু হারেস গোত্রের আসরাহ বিনতে আকলামা নামের এক মহিলা কাফেরদের ধুলি ধুসরিত পতাকা উচ্চে তুলে ধরলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাফেররা তার চারদিকে জড়ো হতে শুরু করলো। একে অন্যকে ডেকে করলো। ফলে অল্পক্ষণের মধ্যেই কাফেররা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই শুরু করলো। মুসলমানরা তখন সামনে পেছনে উভয় দিক থেকেই ঘেরাও-এর মধ্যে পড়ে গেলো। মনে হয় যেন, যাঁতাকলের মাঝখানে তাদের অবস্থান।
আল্লাহর রসূলের কঠোর সিদ্ধান্ত ও সাহসী পদক্ষেপ
সেই সঙ্কট সন্ধিক্ষণে মাত্র নয়জন সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ছিলেন। তারা সাহাবীদের শৌর্যবীর্য এবং শত্রুদের তৎপরতা লক্ষ্য করছিলেন। [এর প্রমাণ এই আয়াত। এতে আল্লাহ পাক বলেন, রসূল তোমাদের পেছনে থেকে ডাকছিলেন] । হঠাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খালেদ ইবনে ওলীদের সওয়ারী দেখতে পেলেন। এরপর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে দু’টি পথ খোলা ছিলো। নয়জন সঙ্গীসহ নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া এবং শত্রুদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সাহাবাদের তাদের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেয়া। অথবা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিচ্ছিন্ন সাহাবাদের ডেকে একত্রিত করে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরী করে কাফেরদের ঘেরাও ছাড়িয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় যাওয়ার পথ করে নেয়া।
পরীক্ষার এহেন কঠিন সময়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তুলনাবিহীন বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দিলেন। জীবন রক্ষার জন্যে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে সাহাবাদের প্রাণ রক্ষার সিদ্ধান্ত নিলেন।
খালেদ ইবনে ওলীদের সওয়ারী এবং তার সঙ্গীদের দেখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের উচ্চস্বরে ডেকে বললেন, হে আল্লাহর বান্দারা, এদিকে আসো। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতেন এই আওয়ায মুসলমানদের কানে যাওয়ার আগে কাফেরদের কানে গিয়ে পৌছুবে। হলোও তাই, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আওয়ায শুনে কাফেররা বুঝতে পারলো যে, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখানেই রয়েছেন। এটা বোঝার পর একদল কাফের মুসলমানদের আগেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌছে গেলো। অন্যান্য কাফেররা দ্রুত মুসলমানদের ঘেরাও করতে লাগলো। এবার আমরা উভয় বাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কে পৃথক পৃথকভাবে আলোকপাত করবো।
মুসলমানদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা
কাফেরদের ঘেরাও-এর মধ্যে পড়ে যাওয়ার পর একদল মুসলমান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো। নিজের জীবন রক্ষার চিন্তাও তাদের মাঝে বড় হয়ে দেখা দিলো। ফলে তারা রণক্ষেত্র থেকে পলায়নের পথ ধরলো। পেছনে কি হচ্ছে, সে সম্পর্কে তারা কিছু জানতো না। এদের মধ্যেকার কয়েকজন মদীনায় গিয়ে উঠলেন, কয়েকজন পাহাড়ের ওপরে আশ্রয় নিলেন। অন্য একদল পেছনের দিকে গিয়ে কাফেরদের সাথে মিশে গেলেন। কে যে কাফের আর কে যে মুসলমান সেটা চিহ্নিত করা যাচ্ছিলো না। এর ফলে মুসলমানদের হাতে মুসলমানরা নিহত হতে লাগলো। সহীহ বোখারীতে হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, ওহুদের দিনে মোশরেকদের পরাজয় হয়েছিলো। এরপর ইবলিশ এস আওয়ায দিলো যে, ওহে আল্লাহর বান্দারা পেছনে যাও। এতে সামনের কতারের লোকেরা পেছনের দিকে গেলো এবং পরস্পর সম্পৃক্ত হয়ে পড়লো। হযরত হোযায়ফা (রা.) লক্ষ্য করলেন যে, তাঁর পিতা ইয়ামানের ওপর হামলা করছে। তিনি বললেন, ওহে আল্লাহর বান্দারা, এ হচ্ছে আমার পিতা। কিন্তু আল্লাহর শপথ, লোকেরা তার উপর থেকে হাত নামিয়ে নেয়নি। শেষ পর্যন্ত তারা তাকে মেরেই ফেললো। হযরত হোযায়ফা (রা.) তখন বললেন, আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদের মাগফেরাত করুন। হযরত ওরওয়া (রা.) বলেন, আল্লাহর শপথ, হযরত হোযায়ফা (রা.) সব সময় কল্যাণের ওপর অবিচল ছিলেন। এই অবস্থায় তিনি আল্লাহর সাথে গিয়ে মিলিত হন। [সহীহ বোখারী প্রথম খন্ড, ৫৩৯ পৃষ্ঠা, ফতহুল বারী সপ্তম খন্ড, ৩২৫১,৩৬২,৩৬৩ পৃষ্ঠা বোখারী ছাড়াও কোন কোন বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে, রসূলে করিম (স.) হযরত হোযায়ফা (রা.)-এর পিতার হত্যাকান্ডের ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হযরত হোযায়ফা (রা.) বললেন,আমি সেই ক্ষতিপূরণ মুসলমানদের উপর সদকা করে দিলাম। এ কারণে নবী করিম (স.)-এর কাচে হযরত হোযায়ফা (রা.)-এর গুরুত্ব ও মর্যাদা বেড়ে গিয়েছিলো। দেখুন শেষ আবদুল ওয়াহাব নাজদির লেখা মুখতাসারুল সিয়ার পৃ. ২৪৬] ।
মোট কথা এই দলের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থা দেখা দেয়। অনেকে ছিলেন বিষ্ময়াভিভূত। তার বুঝতে পারছিলেন না যে, কোন দিকে যাবেন। সেই সময় এক ব্যক্তি উচ্চস্বরে ঘোষণা করলো যে, মোহাম্মদকে হত্যা করা হয়েছে। এতে মুসলমানদের অবশিষ্ট মনোবলও নষ্ট হয়ে গেলো। কোন কোন মুসলমান এ ঘোষণা শোনার পর যুদ্ধ করা বন্ধ করে হতোদ্যম হয়ে হাতের অস্ত্র ছুঁড়ে ফেললেন। কিছু সংখ্যক মুসলমান এতোটুকু পর্যন্ত ভাবলো যে, মোনাফেক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে বলা হোক যে, আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করো।
এই লোকদের কাছ দিয়ে কিচুক্ষণ পর হযরত আনাস ইবনে নযর (রা.) যাচ্ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, বেশ কয়েকজন সাহাবী চুপচাপ বসে আছেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কার প্রতিক্ষায় রয়েছ? তারা জবাব দিলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করা হয়েছে। হযরত আনাস ইবনে নযর বললেন, তাহলে তোমরা বেঁচে থেকে কি করবে? ওঠো, যে কারণে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবন দিয়েছেন, সেই একই কারণে তোমরাও জীবন দাও। এরপর বললেন, হে আল্লাহ রব্বুল আলামীন, ওরা অর্থাৎ এই মুসলমানরা যা কিছু করেছে, তা থেকে আমি তোমার দরবারে পানাহ চাই। একথা বলে তিনি সামনের দিকে অগ্রসর হলেন। সামনে যাওয়ার পর হযরত সা’দ ইবনে মায়া’য (রা.) এর সাথে দেখা হলো। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, হে আবু ওমর কোথায় যাচ্ছেন? হযরত আনাস (রা.) বললেন, জান্নাতের সুবাসের কথা কি আব বলবো। হে সা’দ, ওহুদ পাহাড়ের ওপার থেকে জান্নাতের সুবাস অনুভব করছ্ একথা বলার পর হযরত আনাস (রা.)আরো সামনে এগিয়ে গেলেন এবং কাফেরদের সাথে লড়াই করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন। যুদ্ধোশেষে তাঁকে সনাক্ত করাই সম্ভব হচ্ছিলো না। তাঁর বোন তাঁকে আঙ্গুলের ফাঁক দেখে তাঁকে সনাক্ত করেছিলো। বর্শা, তীব্র ও তলোয়ার দিয়ে তাঁর পবিত্র দেহে আশিটি আঘাত করা হয়েছিলো। [যাদুল-মায়াদ। দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৯২-৯৩। সহীহ বোখারী, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৫৭৯] ।
হযরত ছাবেত ইবনে দাহদাহ (রা.) মুসলমানদের সম্বোধন করে বললেন, মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যদি হত্যা করা হয়েই থাকে, আল্লাহ রব্বুল আলামীন তো যিন্দা রয়েছেন। তিনি তো চিরঞ্জীব। তোমরা নিজেদের দ্বীনের জন্যে লড়ো। আল্লাহ রব্বুল আলামীন তোমাদেরকে বিজয় ও সাহয্যে দান করেছেন।
এই আহব্বান জানানোর পর একদল আনসার জেহাদের জন্যে পুনরায় প্রস্তুত হলেন। হযরত ছাবেত (রা.) তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে খালেদ ইবনে ওলীদের বাহিনীর ওপর হামলা করে লড়াই করতে করতে এক সময় খালেদ ইবনে ওলীদের হাতে নিহত হলেন। তাঁকে বর্শার আঘাতে হত্যা করা হয়। তাঁর মতোই তাঁর সঙ্গী আনসাররাও লড়াই করতে করতে শাহাদাত বরণ করেন। [আস সিরাতুল হালাবিয়াহ দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ২২] ।
একজন মোহাজের সাহাবী রক্তাক্ত একজন আনসার সাহাবীর কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। মোহাজের সাহাবী বললেন, ও ভাই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিহত হয়েছেন? আনসারী বললেন, মোহাম্মদ যদি নিহত হয়েই থাকেন, তবে তিনি তো আল্লাহর দ্বীন পৌছে দিয়েছেন। এখন সেই দ্বীনের হেফাযতের জন্যে লড়াই করা তোমাদের দায়িত্ব। [যাদুল-মায়াদ। দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৯৯] ।
এ ধরনের সাহস প্রদান এবং উদ্দীপনাময় কথায় ইসলামী বাহিনী চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। তারা অস্ত্র ফেলে দেয়া এবং মোনাফেক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মধ্যস্থতায় কাফের আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তার চাওয়ার পরিবর্তে অস্ত্র তুলে নিলেন। এরপর কাফেরদের দুর্ভেদ্য ঘেরাও ভেদ করে নিজেদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পোছে যাওয়ার পথ তৈরীর চেষ্টা করতে লাগলেন। এমন সময় খবর শোনা যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হত্যাকান্ডের খবর একটি ভিত্তিহীন গুজব। এতে মুসলমানদের সাহস ও মনোবল বহুগুণ বেড়ে যায় এবং তারা দুর্ধর্ষ লড়াইয়ের মাধ্যমে কাফেরদের বেষ্টনী ভেদ করে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থানের কাছে পৌছে যেতে সক্ষম হয়।
ইসলামী বাহিনীর তৃতীয় একটি দল একমাত্র রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিরাপত্তার কথা ভাবছিলেন। এরা কাফেরদের বেষ্টনীর খবর পাওয়ার পরই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে ছুটে গেলেন। এসকল সাহাবার মধ্যে ছিলেন হযরত আবু বকর (রা.), হযরত ওমর (রা.), হযরত আলী (রা.) প্রমুখ। যুদ্ধক্ষেত্রেও এরা ছিলেন প্রথম সারিতে, কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাশঙ্কা দেখা দেয়ায় তাঁরা তাঁর হেফাযতের জন্যে তাঁর কাছে ছুটে এলেন।
রসূলুল্লাহ (স.)-এর চারপাশে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ
সাহাবায়ে কেরাম কাফেরদের যাঁতাকলের মত বেষ্টনীতে এসে যখন পিষ্ট হচ্ছিলেন, সেই একই সময়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আশেপাশেও চলছিলো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কাফেরদের বেষ্টনীর শুরুতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চারপাশে মাত্র নয়জন সাহাবী ছিলেন। তিনি যখন মুসলমানদের উদ্দেশ্যে এই আহব্বান জানালেন যে, আমার দিকে এসো, আমি আল্লাহর রসূল। সেই আহব্বান মুসলমানদের আগেই কাফেরদের কানে পৌঁছেছিলো। এতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে চিনে ফেলেছিলো। কেননা সে সময় কাফেররা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছেই ছিলো। ফলে তারা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর হামলা করে বসলো। মুসলমানদের সমবেত হওয়ার আগেই তারা প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করলো। সে সময় সেই হামলা প্রতিরোধে নবী করিমের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চারিপাশে বিদ্যমান নয়জন সাহাবার সাথে কাফেরদের সংঘর্ষ হচ্ছিলো, সাহাবাদের সেই সংঘর্ষে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি অসামান্য ভালোবাসা বীরত্ব ও সাহসিকতা দুর্লভ পরিচয় ফুটে উঠে।
সহীহ মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে যে, ওহুদের দিনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক পর্যায়ে ঐ নয়জন সাহাবীর সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন সাতজন আনসার এবং দুইজন মোহাজের। আততায়ীরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খুব কাছে পৌছে যাওয়ার পর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, কে আছো, ওদেরকে আমার কাছ থেকে প্রতিরোধ করতে পারো? তার জন্যে জান্নাত রয়েছে। অথবা তিনি বলেছিলেন, সে ব্যক্তি জান্নাতে আমার সাথী হবে। এরপর একজন আনসার সাহাবী সামনে অগ্রসর হলেন এবং লড়াই করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন। মোশরেকরা এরপর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আরো কাছে পৌছে গেলো। প্রতিরোধ যুদ্ধে একে একে সাতজন আনসার সাহাবা শাহাদাত বরণ করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সঙ্গের দুইজন মোহাজের কোরায়শী সাহাবাকে বললেন, আমরা আমাদের সঙ্গীদের সাথে সুবিচার করিনি। [সহীহ মুসলিম, ওহুদ যুদ্ধ অধ্যায়। দ্বিতীয় খন্ড, পৃ. ১০৭] ।
উল্লিখিত সাতজান আনসার সাহাবার মধ্যে সর্বশেষ ছিলেন হযরত আম্মারা ইবনে ইয়াযিদ ইবনে সাকান (রা.)। লড়াই করতে করতে তিনিও ক্ষতবিক্ষত হয়ে এক সময় ঢলে পড়লেন। [পরক্ষণে রসূলে করিম (স.)-এর কাছে একদল সাহাবা এসে পৌছে গেলেন। তারা কাফেরদের হযরত আম্মারার (রা.) তাঁকে সরিয়ে দিলেন এবং হযরত আম্মারা (রা.)-কে রসূলে করিম (স.)-এর কাছে নিয়ে এলেন। নবী করিম (স.) তাঁকে নিজের উরুর উপর শুইতে দিলেন। সেই অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। প্রিয় নবীর (স.) চরণ ছোঁয়া অবস্থায় তার শাহাদাতকে কবির ভাষায় বলা যায়, ‘তোমার পায়ের ওপর যেন আমার মরণ হয়, এইতো আমার মনের আরযু, আর তো কিছুই নয়] ।
হযরত আম্মারা ইবনে ইয়াযিদের (রা.) ঢলে পড়ার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে মাত্র দুইজন কোরায়শী সাহাবা ছিলেন। বোখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু ওসমান (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সময় লড়াই করছিলেন, তার এই লড়াইয়ে তার সঙ্গে হযরত তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ (রা.) ব্যতীত অন্য কেউ ছিলেন না । [সহীহ বোখারী, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ৫২৭, দ্বিতীয় খন্ড পৃষ্ঠা ৫৮১] ।
সেই সময় ছিলো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের চরম সঙ্কটময় মুহূর্ত। আর কাফেরদের জন্যে সেটা ছিলো একটা সুবর্ণ সুযোগ। প্রকৃতপক্ষে কাফেররা সেই সুযোগ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে কোন অলসতাও করেনি। তারা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর সর্বাত্মক হামলা চালিয়ে তাঁকে শেষ করেই দিতে চেয়েছিলো। সেই সময়ে ওতবা ইবনে আবু ওয়াক্কাস রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাথর নিক্ষেপ করেছিলো। সেই আঘাতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন। তাঁর নীচের মাড়ির ডানদিকের ‘রোবায়ী দাঁত’ ভেঙ্গে গিয়েছিলো। [মুখের ভেতর উপরের ও নীচের মাড়ির সামনের উপর ও নীচের দু’টি দাঁতকে ছানারা বলা হয়। এর ডানের ও বামের দাঁতগুলোকে বরে রোবায়ী] । তাঁর নীচের ঠোঁট কেটে গিয়েছিলো। আবদুল্লাহ ইবনে শেহাব যুহরী সামনে অগ্রসর হয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কপালে আঘাত করলো। আবদুল্লাহ ইবনে কামআহ নামের এক দুর্বৃত্ত দুরাচার সামনে এসে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাঁধে তলোয়ারের এমন জোরে আঘাত করলো যে পরবর্তীকালে এক মাস পর্যন্ত তিনি সেই আঘাতের যন্ত্রণা অনুভব করেছিলেন। তবে আঘাত তাঁর দেহের লৌহবর্ম কাটতে পারেনি। দুর্বৃত্ত ইবনে কামআহ তরবারী তুলে প্রিয় নবীকে দ্বিতীয়বার আঘাত করলো। এ আঘাত ডান চোখের নীচের হাড়ে লাগলো এবং দু’টি কড়া চেহারায় বিঁধে গেলো। [লোহা বা পাথরের শিরাস্ত্রাণ। যুদ্ধ চলাকালে মাথা ও মুখমুন্ডল নিরাপদ রাখার জন্য এ ধরনের শিরস্ত্রাণ পরিধান করা হয়। শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া তলোয়ারের আঘাতে প্রিয় নবী (স.) চেহারায় ডানদিকে চোখের নীচে বিঁধে গিয়েছিলো, সোবহানাল্লাহ!] ।
সাথে সাথে সে দুর্বৃত্ত বললো, এই নাও, আমি কামআহ অর্থাৎ ভাঙ্গনকারীর পুত্র। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পবিত্র মুখমন্ডলের রক্ত মুছতে মুছতে বললেন, আল্লাহ তায়ালা তোকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলুন। [আল্লাহ রসূলে (স.)-এর এই দোয়া কবুল করেছিলেন। ইবনে আয়েজ বর্ণনা করেছেন, ইবনে কোম্মা যুদ্ধ শেষে ঘরে ফিরে যাওয়ার পর নিজের বকরির খোঁজে বেরোলো। দেখা গেল যে, তার বকরি একটি পাহাড়ে রয়েছে। সে বকরি নামিয়ে আনার জন্য পাহাড়ে উঠলো। হঠাৎ একটি পাহাড়ি বকরি শিং এর আঘাতে তাকে পাহাড়ের নিচে ফেলে দিল। ফতহুল বারী, সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠ, ৩৭৩। তিবরানীর বর্ণনায় রয়েছে যে, ইবনে কোম্মার ওপর একটি বকরি লেলিয়ে দিয়েছিলেন। সেই বকরি শিং এর আঘাতে ইবনে কোম্মাকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেললো। ফতহুল বারী সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৬৬] ।
সহীহ বোখারীতে বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রোবায়ী দাঁত ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং মাথায় আঘাত করা হয়। সেই সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার মুখমন্ডলে প্রবাহিত রক্ত মুছছিলেন আর বলছিলেন, সেই কওম কি করে সফল হতে পারবে, যারা নিজেদের নবীর চেহারা যখমী করে দিয়েছে। তাঁর দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছে। অথচ তিনি তাদেরকে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের পথে দাওয়াত দিচ্ছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একথা বলার পর আল্লাহ রব্বুল আলামীন এই আয়াত নাযিল করেন [সহি মোসলেম ২য় খন্ড, ১০৮ পৃষ্ঠা], ‘তিনি তাদের প্রতি ক্ষমাশীল হবেন অথবা তাদের শাস্তি দিবেন, এ বিষয়ে তোমার কিছু করার নেই, কারণ তারা যালেম।’ (আলে ইমরান, আয়াত ১২৮)
তিবরানীর বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেদিন বলেছিলেন, সেই কওমের ওপর আল্রঅহর কঠিন আযাব হোক, যারা নিজেদের নবীর চেহারা রক্তাক্ত করে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, হে আল্লাহ রব্বুল আলামীন, আমার কওমকে ক্ষমা করো, কেননা ওরা জানে না। [ফতহুর বারী, সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩২৩] ।
সহীহ মুসলিম শরীফেও এ বর্ণনা রয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বারবার বলছিলেন, হে পরওয়ারদেগার, আমার কওমকে ক্ষমা করে দাও, ওরা জানে না। [সহীহ মুসলিম, ওহুদ যুদ্ধ অধ্যায় দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ১০৮] ।
কাজী আয়াযের আশ শাফা গ্রন্থেও একথা উল্লেখ রয়েছে, হে আল্লাহ তায়ালা, আমার কওমকে হেদায়াত দাও, এরা জানে না। [কিতাবুশ শাফা তারিফে মোস্তাফা, প্রথম খন্ড পৃষ্ঠা ৮১] ।
নিঃসন্দেহে কাফেররা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রাণে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো। কিন্তু হযরত তালহা (রা.) এবং হযরত সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.) তুলনাবিহীন আত্মত্যাগ, অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসিকতার মাধ্যমে কাফেরদের প্রচেষ্ঠা ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। [সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃঃ ৪০৭] । এরা উভয়ে ছিলেন আরবের সুদক্ষ তীরন্দাজ। তারা তীর নিক্ষেপ করে করে কাফেরদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাচ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। হযরত সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাসের (রা.) দক্ষতা ও নৈপুণ্য এ থেকেই প্রমানিত হয় যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য কোন সাহাবীর ক্ষেত্রে কোন ব্যাপারেই পিতা মাতা উৎসর্গিত অর্থাৎ নিবেদিত হওয়ার কথা বলেননি। [সহীহ বোখারী, প্রথম খন্ড, ৪০৭ পৃষ্ঠা দ্বিতীয় খন্ড ৫৮০-৫৮১ পৃষ্ঠা] ।
হযরত তালহা (রা.)-কে বীরত্বের বিবরণ নাসাঈ শরীফে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়। সেই হাদীসে হযরত জাবের (রা.) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর কাফেরদের সেই সময়ের হামলার কথা উল্লেখ করেছেন, যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে মুষ্টিমেয় সাহাবী উপস্থিত ছিলেন। হযরত জাবের (রা.) বলেন, মোশরেকরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঘেরাও করে ফেললে তিনি বলেছিলেন, এদের সাথে লড়াই করার মতো কে আছ ? হযরত তালহা (রা.) তখন বললেন, আমি আছি। এরপর হযরত জাবের (রা.) বলেন, আনসারদের সামনে অগ্রসর হওয়া এবং একে একে শহীদ হওয়ার বিবরণ উল্লেখ করেন। সহীহ মুসলিম শরীফের বরাত দিয়ে ইতিপূর্বে আমরা সেই বিবরণ উল্লেখ করেছি।
হযরত জাবের (রা.) বলেন, আনসাররা শহীদ হওয়ার পর হযরত তালহা (রা.) সামনে এগিয়ে একাই এগারোজনের সামনে বীরত্বের পরিচয় দেন। এক সময় তাঁর হাতে জনৈক কাফেরের তরবারির আঘাত লাগে। এতে তাঁর একটি আঙ্গুল কেটে যায়। সাথে সাথে তিনি ‘ইস সি’ শব্দ উচ্চারণ করলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি যদি এখন বিসমিল্লাহ শব্দ উচ্চারণ করতে, তাহলে আল্লাহর ফেরেশতা সকলের সামনে তোমাকে উর্ধে তুলে নিয়ে যেতেন। হযরত জাবের (রা.) বলেন, এরপর আল্লাহ তায়ালা কাফেরদের অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন। [ফতহুল বারী, সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৬১, সুনানে নাসাঈ দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৫২,৫৩] ।
একাধিক গ্রন্থে হাকেমের বর্ণনায রয়েছে, ওহুদের দিনে তালহার দেহে উনচল্লিম বা পঁয়ত্রিশটি আঘাত লেগেছিলো। তাঁর শাহ্দাত আঙ্গুলসহ দু’টি আঙ্গুল নিস্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিলো। [ফতহুল বারী, সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৬১] ।
ইমাম বোখারী কায়েস ইবনে আবু হাজেম থেকে বর্ণনা করেছের যে, তিনি বলেন, আমি লক্ষ্য করলাম, তালহা (রা.)-এর হাত নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলো। এই হাত দ্বারা ওহুদের দিনে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রক্ষা করেছিলেন। [সহীহ বোখারী, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ৫২৭,৫৮১] ।
তিরমিযি শরীফে বর্ণনা করা হয়েছে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেদিন বলেছিলেন, যে ব্যক্তি কোন শহীদকে ভূপৃষ্ঠে চলাফেরা করা অবস্থায় দেখতে চায়, সে যেন তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহকে (রা.) দেখে। [তিরমিযি] ।
আবু দাউদ তায়ালেসী হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ওহুদের যুদ্ধের প্রসঙ্গে আলোচনার সময়ে বলতেন, সেদিনের যুদ্ধের একক কৃতিত্ব ছিলো তালহার। [ফতহুল বারী, সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৬১] । অর্থাৎ সেই যুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রক্ষা করার দায়িত্ব তিনিই সর্বাধিক পালন করেন। হযরত আবু বকর (রা.) হযরত তালহা (রা.) সম্পর্কে একথাও বলেছেন,
‘হে তালহা, তোমার জন্যে জান্নাতসমূহ ওয়াযেব হয়ে গেছে।
সেখানে তোমার নিবাসে রয়েছে অগনন ডাগর চোখের হুর। [মুখতাসার তারীখে দামেশক, সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠা ৮২, হাশিয়া শরহে যাজুরুজ যাহাব, পৃষ্ঠা ১১৪] ।
সেই সঙ্কট সন্ধিক্ষণে আল্লাহ রব্বুল আলামীন গায়েব থেকে সাহায্য প্রেরণ করেন। হযরত সা’দ (রা.) বলেন, আমি ওহুদের দিনে লক্ষ্য করেছি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সাদা পোশাক পরিহিত দু’জন লোক। এরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে বীরত্বের সাথে লড়াই করছিলেন। এর আগে বা পরে সেই দুইজন লোককে আমি কখনো দেখিনি। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, ওরা দু’জন ছিলেন হযরত জিবরাঈল (আ.) ও হযরত মিকাইল (আ.)। [বোখারী, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৫৮০] ।
নবীর পাশে সাহাবাদের সমবেত হওয়া
উল্লিখিত দুর্ঘটনা আকষ্মিকভাবে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ঘটে গিয়েছিলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্বাচিত সাহাবারা, যাঁরা যুদ্ধের শুরু থেকেই প্রথম কাতারে গিয়ে যুদ্ধ করছিলেন তাঁরা পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আহব্বান শোনার অল্পক্ষণের মধ্যেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ছুটে এসেছিলেন। তাঁরা চেষ্টা করছিলেন যাতে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। কিন্তু এসব সাহাবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌছার আগেই তিনি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। ততক্ষণে ছয়জন আনসার সাহাবা শহীদ হয়ে গেছেন, সপ্তম আনসার সাহাবা আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে ঢলে পড়েছেন। হযরত সা’দ (রা.) এবং হযরত তালহা (রা.) প্রাণপণ প্রচেষ্টায় কাফেরদের হামলা থেকে প্রিয় নবীকে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রক্ষার জন্যে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সাহাবারা এসেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে কাফেরদের সর্বাত্মক হামলার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিচ্ছিলেন। তাঁরা সেই সময় অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সেই সময় প্রথমে ছুটে এসেছিলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)।
ইবনে হাব্বান তাঁর সহীহ গ্রন্থে হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, ওহুদের দিনে সকল সাহাবা নবী (সঃ)-এর কাছ থেকে চলে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ তাঁর দেহরক্ষীরা ছাড়া অন্য সবাই যুদ্ধ করতে সামনের কাতারে চলে গিয়েছিলেন। কাফেরদের ঘেরাও-এর দুর্ঘটনার পর সর্বপ্রথম আমিই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে দেখি একজন লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রক্ষার জন্যে লড়াই করছেন। আমি মনে মনে বললাম, আপনার নাম তো তালহা (রা.)। আপনার ওপর আমার মা বাবা কোরবান হোক। এমন সময় হযরত আবু ওবায়দা ইবনে জাররাহ (রা.) দ্রুত ছুটে আমার কাছে এসে পৌছুলেন। আমরা উভয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে গেলাম। আমরা লক্ষ করলাম, হযরত তালহা (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে পড়ে আছেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাদের ভাইকে তোলো। সে নিজের জন্যে জান্নাত ওয়াযেব করে নিয়েছে। হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, আমরা পৌছে আরো দেখলাম, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তীক্ষ্ণ কড়া তাঁর চোখের নীচে গেঁথে গেছে। আমি সেগুলো বের করতে চাইলাম। আবু ওবায়দা (রা.) বললেন, আল্লাহর নামে শপথ নিচ্ছি ওগুলো আমাকে বের করতে দিন। এরপর তিনি দাঁত দিয়ে একটি কড়া কামড়ে ধরে ধীরে ধীরে বের করতে লাগলেন যাতে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যথা কম পান। শেষে পর্যন্ত একটি কড়া বের করলেন। এত হযরত আবু ওবায়দার নীচের মাড়ির একটি দাঁত পড়ে গেলো। দ্বিতীয় কড়াটি আমি বের করতে চাইলাম। কিন্তু আবু ওবায়দা (রা.) বললেন, আবু বকর (রা.) আপনাকে আল্লাহর শপথ দিচ্ছি, আমাকে বের করতে দিন। এরপর তিনি দ্বিতীয় কড়াটিও বের করলেন। এতে তাঁর নীচের মাড়ির আরেকটি দাঁত ভেঙ্গে গেলো। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাদের ভাই তালহাকে সামলাও। সে নিজের জন্যে জান্নাত ওয়াজেব করে নিয়েছে। হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, এরপর আমরা হযরত তালহা (রা.)-এর প্রতি মনোনিবেশ করলাম। তার দেহে আশিটির বেশী আঘাত লেগেছিলো। [যাদুল-মায়াদ, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৯৫] ।
হযরত তালহা (রা.) সেদিন কি রূপ বীরত্ব, আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছিলেন তা এতেই বোঝা যায়।
সেই সঙ্কটময় মুহূর্তে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিবেদিত প্রাণ সাহাবাদের একটি দল এসে পৌছুলেন। তাদের নাম হচ্ছে, হযরত আবু দোজানা, হযরত মসআব ইবনে ওমায়ের, হযরত আলী ইবনে আবু তালেব, হযরত সহল ইবনে হুনাইফ, হযরত মালেক ইবনে সানান (হযরত আবু সাঈদ খুদরী (র.)-এর পিতা) হযরত উম্মে আম্মারা নুসাইবা বিনতে কা’ব মাজেনা, হযরত কাতাদা ইবনে নো’মান, হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব, হযরত হাতেব ইবনে আবু বলতায়া এবং হযরত আবু তালহা (রা.)।
মুসলমানদের ওপর শত্রুদের প্রচন্ড আঘাত
এদিকে শত্রুদের সংখ্যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চারদিকে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। ফলে তাদের হামলাও বাড়ছিলো। এক পর্যায়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি গর্তের ভেতর পড়ে গিয়ে হাঁটুতে আঘাত পেলেন। আবু আমের ফাসেক শয়তানী প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে মুসলমানদের ক্ষতি করতে এ ধরনের কয়েকটি গর্ত খনন করেছিলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গর্তে পড়ে যাওয়ার পর হযরত আলী (রা.) প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত ধররেন এবং হযরত তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জড়িয়ে ধরে উপরে উঠিয়ে নিলেন।
নাফে ইবনে জাবির বলেন, আমি একজন মোহাজের সাহাবীকে বলতে শুনেছি, তিনি বলছিলেন, ওহুদের যুদ্ধে আমি হাযির ছিলাম। আমি লক্ষ্য করলাম, চারদিক থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর তীর নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। তিনি তীরের মাঝামাঝি রয়েছেন। কিস্তু নিক্ষিপ্ত সেইসব তীর সাহাবারা গ্রহন করছিলেন। আমি আরো লক্ষ্য করলাম যে, আবদুল্লাহ ইবনে শেহাব যুহরী বলছিলো, বলো, মোহাম্মদ কোথায়? এবার আমি থাকবো অথবা তিনি থাকবেন। অথচ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পাশেই ছিলেন। তাঁর কাছে সে সময় অন্য কেউ ছিলো না। ইবনে শেহাব এক সময় সামনে এগিয়ে গেলো। এতে সফওয়ান তাকে ধমক দিলো। জবাবে ইবনে শেহাব বললো, আল্লাহর শপথ, আমি তাকে দেখতে পাইনি। আমাদের দৃষ্টি থেকে তাকে হেফাযত করা হয়েছে। এরপর আমরা চারজন প্রতিজ্ঞা করে বেরুলাম যে, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করবো (নাউযুবিল্লাহ) । কিন্তু তাঁর ধারে কাছেও পৌছুতে পারলাম না। [যাদুল-মায়দ, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৯৭] ।
অভুতপূর্ব আত্মত্যাগ ও সাহসিকতা
সেই সময় মুসলমানরা এমন অসাধারণ বীরত্ব ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছিলেন যার উদাহরণ ইতিহাসে আর পাওয়া যায় না। হযরত আবু তালহা (রা.) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে বুক টান করে দাঁড়ালেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শত্রুদের নিক্ষিপ্ত তীর থেকে রক্ষা করতে হযরত আবু তালহা কিছুটা উঁচুতে দাঁড়ালেন। হযরত আনাস (রা.) বলেন, ওহুদের দিনে সাধারণ মুসলমানরা পরাজিত হয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে না এসে এদিক ওদিক ছুটে পালাচ্ছিলো। হযরত আবু তালহা (রা.) একটি ঢাল নিয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে প্রতিরোধ ব্যুহ হয়ে দাঁড়ালেন। তিনি ছিলেন দক্ষ তীরন্দাজ। নিপুণ হাতে তীর নিক্ষেপ করতেন। সেদিন তিনি দু’টি না যেন তিনটি ধনুক ভেঙ্গে ফেলেছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশ দিয়ে কোউ ধনুক নিয়ে যাওয়ার সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, এটি আবু তালহা (রা.)-কে দাও। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের প্রতি মাথা উঁচু করে তাকালে হযরত আবু তালহা (রা.) বলেন, আমার মা-বাবা আপনার উপর কোরবান হোন, আপনি মাথা উঁচু করে তাকাবেন না। খোদা না করুন, আপনার পবিত্র দেহে তীর বিদ্ধ হতে পারে। আমার বুক আপনার বুকের সমানে রয়েছে। [সহীহ বোখারী, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৯৭] ।
হযরত আনাস (রা.) থেকে আরো বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু তালহা (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিক থেকে একটি ঢাল দিয়ে প্রতিরোধ ব্যুহ রচনা করেন। হযরত আবু তালহা (রা.) ছিলেন দক্ষ তীরন্দাজ। তিনি তীর নিক্ষেপের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাথা উঁচু করে দেখতেন যে, তীর কোথায় গিয়ে বিদ্ধ হলো। [সহীহ বোখারী, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ৪০৬] ।
হযরত আবু দোজানা (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে এসে তাঁর দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন এবং নিজের পিঠকে ঢাল স্বরূপ পেতে দিলেন, তাঁর পিঠে এসে শত্রুদের নিক্ষিপ্ত তীর বিঁধেছিলো, কিন্তু তিনি একটুও নড়াচড়া করছিলেন না।
হযরত হাতেব ইবনে আবু বলতাআ (রা.) ওতবা ইবনে আব ওয়াক্কাসের পিছু নিলেন। ওতবা প্রচন্ড শক্তিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেহে তরবারি দিয়ে আঘাত করছিলো। হযরত হাতেব (রা.) ওতবার তরবারি এবং ঘোড়া কেড়ে নিয়ে তাকে হত্যা করলেন। হযরত সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.) নিজের ভাই ওতবাকে হত্যা করার সুযোগ খুঁজছিলেন। কিন্তু সেই সৌভাগ্য হযরত হাতেব (রা.) অর্জন করলেন।
হযরত সহল ইবনে হুনাইফও (রা.) বিশিষ্ট তীরন্দাজ ছিলেন। তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে মরণের বাইয়াত করেন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে বীর বিক্রমে লড়াই করেছিলেন।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও তীর নিক্ষেপ করছিলেন। হযরত কাতাদা ইবনে নো’মান (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ধনুক থেকে তীর নিক্ষেপ করেছিলেন। এতে ধনুকের একটি কোন ভেঙ্গে গিয়েছিলো। সেই ধনুক পরে হযরত কাতাদা ইবনে নো’মান (রা.) নিয়েছিলেন এবং তাঁর কাছেই ছিলো। সেদিন হযরত কাতাদা (রা.)-এর চোখে এমন আঘাত লেগেছিলো যে, চোখ চেহারার ওপর বেরিয়ে পড়েছিলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পবিত্র হাতে সেই চোখ ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দিলেন। পরবর্তী সময়ে দু’টি চোখের মধ্যে সেই চোখটিই বেশি সুন্দর দেখাতো। সেই চোখের দৃষ্টি ছিলো অধিক প্রখর।
হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) লড়াই করতে করতে মুখে প্রচন্ড আঘাত পেলেন। এতে তাঁর সামনের মাড়ির দাঁত ভেঙ্গে গেলো। তিনি বিশ বাইশটি আঘাত পেয়েছিলেন। পায়েও আঘাত লেগেছিলো। এতে তিনি খোঁড়া হয়ে গিয়েছিলেন।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, মালেক ইবনে মানানা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারার রক্ত চুষে পরিস্কার করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, থু থু ফেলে দাও। তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ আমি থু থু ফেলব না। এরপর মুখ ফিরিয়ে লড়াই করতে লাগলেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কেউ যদি কোন জান্নাতি মানুষকে দেখতে চায় তবে যেন মালেক ইবনে মানানাকে (রা.) দেখেভ এরপর তিনি লড়াই করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন।
ওহুদ যুদ্ধে মুসলমান মহিলাদের ভূমিকাও ছিলো অনন্য। মহিলা সাহাবী হযরত উম্মে আম্মার নুসাইবা বিনতে কা’ব (রা.) অসাধারণ সাহসিকতার পরিচয় দেন। তিনি কয়েকজন মুসলমানের সাথে লড়াই করতে করতে ইবনে কোম্মার সামনে গিয়ে পৌছেন। ইবসে কোম্মা তলোয়ার দিয়ে আঘাত করলে তাঁর কাঁধে যখম হয়। তিনিও নিজের তলোয়ার দিয়ে ইবনে কোম্মাকে কয়েকবার আঘাত করেন। কিন্তু ইবনে কোম্মা বর্ম পরিহিত থাকার কারণে কোন আঘাত তার দেখে লাগেনি। হযরত উম্মে আম্মারা লড়াই করতে করতে বারোটি আঘাত পান।
হযরত মসআব ইবনে ওমায়ের (রা.) অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দেন। তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ইবনে কোম্মা ও অন্যদের আঘাত প্রতিরোধ করেন। তাঁর হাতেই ছিলো ইসলামের পতাকা। শত্রু সৈন্যরা তাঁর ডান হাতে এমন আঘাত করে যে, তাঁর হাত কেটে যায়। তিনি তখন বাম হাতে ইসলামের পতাকা তুলে ধরেন। কিন্তু শত্রুদের হামলায় বাম হাতও কেটে যায়। তিনি তখন বাহু দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরেন। সেই অবস্থায় শাহাদাত বরন করেণ। তাঁর হত্যাকারী ছিলো আবদুল্লাহ ইবনে কোম্মা। এই দুর্বৃত্ত হযরত মসআব (রা.)-কে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মনে করেছিলো। হযরত মসআবের (রা.) চেহারা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারার সাথে কিছুটা মিল ছিলো। হযরত মসআবকে (রা.) হত্যা করার পর ইবনে কোম্মা কাফেরদের কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলেছিলো, মোহাম্মাদকে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হত্যা করা হয়েছে। [ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা, ৭৩, ৮০, ৮৩, যাওউল মায়াদ দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৯৭] ।
নবীর শাহাদাতের খবর ও তার প্রতিক্রিয়া
ইবনে কোম্মা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে দিলে, মুহুর্তের মধ্যে তা মুসলমান এবং কাফেরদের কাছে পৌছে গেলো। এটা ছিলো খুবই নাযুক মূহূর্ত। এত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে দূরে যুদ্ধরত সাহাবাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়লো। অনেকেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। সাহাবারা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লেন। চরম বিশৃঙ্কলা দেখা দিলো। তবে একটা লাভ হলো যে, কাফেরদের হামলা সাময়িকভাবে থেমে গেলো। কেননা তারা ভেবছিলো তাদের আসল উদ্দেশ্য পুরো হয়ে গেছে। বহুসংখ্যক মোশরেক মুসলমানদের ওপর হামলা বন্ধ করে দিয়ে শোহাদায়ে কেরামের লাশের ওপর মনের পৈশাচিক ঝাল মেটাচ্ছিলো। তারা শহীদদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে পেলছিলো।
মুসলমানদের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ
হযরত মসআব ইবনে ওমায়ের (রা.)-এর শাহাদাতের পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পতাকা হযরত আলী (রা.)-এর হাতে তুলে দিলেন। হযরত আলী (রা) বীরত্বের সাথে লড়াই করলেন। সেখানে উপস্থিত অন্য কয়েকজন সাহাবাও তুলনাবিহীন বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং পাল্টা আক্রমণাত্মক যুদ্ধ করলেন। বেশ কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর এ ধরনের সম্ভাবনা দেখা দিলো যে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাছে অবস্থানরত সাহাবাদের কাছে যাওয়ার জন্যে পথ তৈরী করে নেবেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের কাছে নিরাপদ আশ্রয় পাওয়ার জন্যে পা বাড়ালেন। এ সময়ে প্রথমে হযরত কা’ব ইনে মালেক (রা.) তাঁকে চিনে ফেললেন। আনন্দে চিৎকার করে তিনি বললেন, ওহে মুসলমানরা, তোমাদের জন্যে সুসংবাদ, তিনি হলেন আল্লাহর রসূল।নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে চুপ করার ইঈিত দিলেন, যাতে শত্রুরা তাকে চিনতে না পারে। কিন্তু মুসলমানরা সেই আওয়ায শুনে ফেলেছিলেন, ফলে অল্পক্ষণের মধ্যে সাহাবাগণ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাছে আসতে শুরু করলেন। অল্পক্ষণের মধ্যে ত্রিশজন সাহাবা হাযির হলেন।
এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাহাড়ের ঘাঁটিতে অর্থাৎ মুসলমানদের শিবিরের দিকে যেতে শুরু করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিবিরে গিয়ে পৌছুলে কাফেরদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে, এ কারণে কারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গতিপথ রুদ্ধ করতে প্রাণান্তকর প্রয়াস চালালো। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ সাহাবার বেষ্ঠনীর মধ্যে এগিয়ে চললেন। এ সময়ে ওসমান ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মুগিরা নামের এক দুর্বৃত্ত রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি অগ্রসর হতে হতে বললো, হয়তো আমি থাকবো অথবা তিনি থাকবেন। কিন্তু বেশীদূর অগ্রসর হতে পারল না। কেননা বাবু আমের ফাসেকের কনন করা একটা গর্তের মধ্যে তার ঘোড়া পড়ে গেলো। ইত্যবসরে হযরত হারেস (রা.) হুঙ্কার দিয়ে তার সামনে গিয়ে পায়ে তলোয়ারের প্রচন্ড আঘাত করে তাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেন। এরপর তার অস্ত্র খুলে নিয়ে হযরত হারেস (রা.) রসূলে করিমের কাছে এসে পৌছুলেন। এরই মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে জাবের নামের এক শত্রু সৈন্য হযরত হারেস (রা.)-এর কাঁধে তরোয়ার দিয়ে আঘাত করলো। কিন্তু মুসলমানরা তাঁকে ধরে ফেললেন। পরক্ষণে মাথায় লাল পট্রি পরিহিত হযরত আবু দোজানা (রা.) আবদুল্লাহ ইবনে জাবেরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তলোয়ারের আঘাতে তার শিরচ্ছেদ করলেন।
কুদরতের কারিশমা দেখুন, এই ধরনের জীবন-মরণ যুদ্ধের মধ্যেও মুসলমানদের চোখে ঘুম পাচ্ছিলো। পবিত্র কোরআনের বাণী অনুযায়ী এটা ছিলো আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদ্ত্ত প্রশান্তির নিদর্শন। হযরত আবু তালহা (রা.) বলেন, ওহুদের বিভীষিকাময় যুদ্ধের সময় যাদের ঘুম পাচ্ছিলো আমিও ছিলাম তাদের একজন । ঘুমের ঝোঁকে কয়েকবার আমার হাত থেকে তলোয়ার পড়ে গিয়েছিলো। অবস্থা এমন হয়েছিলো যে, তরবারি পড়ে যাচ্ছিলো, আর আমি তা তুলে নিচ্ছিলাম। একাধিক বার এরকম হয়েছিলো। [সহীহ বোখারী, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা, ৫৮২] ।
মোটকথা প্রাণপণ প্রচেষ্টায় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সীমিতসংখ্যক সাহাবা পাহাড়ের ঘাঁটিতে অবস্থিত মুসলমানদের শিবিরে গিয়ে পৌঁছুলেন। এতে খালেদ ইবনে ওলীদের রণকৌশল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রণকৌশলের সামনে ম্লান হয়ে গেলো।
উবাই ইবনে খালফের হত্যাকাণ্ড
ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘাঁটিতে পৌঁছার পর উবাই ইবনে খালফ একথা বলে সামনে অগ্রসর হলো যে, মুহাম্মদ কোথায়? হয়তো আমি থাকবো অথবা তিনি থাকবেন। সাহাবারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রসূল, আমরা কি তার ওপর হামলা করবো? রসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত হারেস (রা)- এর কাছ থেকে ছোট একটি বর্শা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলেন। এটা ছিলো ঠিক তেমনি, যেমন গায়ে মাছি বসলে উঠ একটুখানি ঝাঁকুনি দেয় এতে মাছি উড়ে যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর উবাই-এর মুখোমুখি গেলেন। ইবনে উমাইয়ের শিরস্ত্রাণ এবং বর্মের মাঝামাঝি জায়গায় একটু খানি জায়গা গলার কাছে খালি ছিলো। নবী সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই স্থান লক্ষ্য করে বর্শা নিক্ষেপ করলেন। এতে উবাই ঘোড়া থেকে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিয়ে স্বগোত্রীয়দের কাছে ফিরে গেলো।
তার গলার কাছে সামান্য ছিড়ে গিয়েছিল। আঘাতও তেমন ছিলো না। রক্তও বেরোয়নি। তবু সে চিৎকার করে বলতে লাগলো, আল্লাহর শপথ, মোহাম্মদ আমাকে হত্যা করেছেন। লোকেরা তাকে বললো, কি বাজে কবছো, তোমার আঘাত তো তেমন নয়। সামান্য আঁচড় লাগার মতো দেখা যাচ্ছে। উবাই বললো তিনি মক্কায় আমাকে বলেছিলেন, আমি তোমাকে হত্যা করবো।[ঘটনা ছিলো এই যে, মক্কায় রসূলে করিমের (সা) দেখা হলে উবাই গর্বভরে বলতো, হে মোহাম্মদ, আমার কাছে আওদ নামের একটি ঘোড়া রয়েছে। ওকে আমি প্রতিদিন তিন সাআ অর্থাৎ সাড়ে সাত কিলো খাবার খাওয়াচ্ছি, সেই ঘোড়ার পিঠে বসে আমি একদিন আপনাকে হত্যা করবো। জবাবে রসূলে করিম (সা) বলতেন, বরং উল্টোও হতে পারেব। ইনশাআল্লাহ আমিই তোকে হত্যা করবো।] কাজেই আল্লাহর শপথ, আমার প্রাণ চলে যাবে। পরিশেষে আল্লাহর এই চিহ্নিত দুশমন মক্কায় ফেরার পথে ছারফ নামক জায়গায় মারা গেলো।[ইবনে হিশাম দ্বিতীয় খণ্ড পৃষ্ঠা ৮৪। যাদল-মায়াদ দ্বিতীয় খণ্ড ৯৭] আবুল আসওয়াদ হযরত ওরওয়া (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, উবাই গাভীর মতো চিৎকার করতো আর বলতো, সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমর প্রাণ রয়েছে, আমি যে যন্ত্রণা অনুভব করছি, সেই কষ্ট ও যন্ত্রণা যদি যিল মাযাযের অধিবাসীরা অনুভব করতো, তাহলে তারা সবাই মরে যেতো।[মুখতাসার সীরাতুর রসূল। শেখ আবদুল্লাহ পৃষ্ঠা ২৫০]
হযরত তালহার আন্তরিকতা
পাহাড়ের দিকে নবী করিমের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে যাওয়ার সময়ে একটি উঁচু জায়গা দেখা গেলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপরে উঠতে পারছিলেন না, একে তো তাঁর দেহ ভারি হয়ে গিয়েছিলো, যেহেতু তিনি দুটো বর্ম পরিধান করেছিলেন। তাছাড়া তিনি ছিলেন মারাত্মকভাবে আহত। হযরত তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ (রা) নীটে বসে গেলেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাঁধে তুলে ওপরে উঠতে সহায়তা বরলেন। এতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই উঁচু জায়গা অতিক্রম করলেন। এরপর তিনি বললেন, তালহা নিজের জন্যে জান্ন্ত অবধারিত করে নিয়েছে।[ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৮৬]
শত্রদের সর্বশেষ হামলা
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘাঁটির ভেতরে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার পর শত্রুরা মুসলমানদের পরাস্ত করতে সর্বশেষ চেষ্টা চালালো। ইবনে ইসহাক বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘাঁটির ভেতরে চলে যাওয়ার পর আবু সুঠিয়ান এবং খালেদ ইবনে ওলীদের নেতৃত্বে একদল অমুসলিম ওপরে ওঠার চেষ্টা করলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়া করলেন, হে আল্লাহ তায়ালা, ওরা যেন ওপরে উঠতে না পারে। এরপর হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা) এবং একদল মোহাজের সাহাবা যুদ্ধ করে ওদের পাহাড়ের নীচে নামিয়ে দিলেন।[ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৮৬]
শত্রু সৈন্যদের কয়েকজন ওপরে উঠে এলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত সা’দ (রা)-কে বললেন, ওদের পেছনে ঠেলে দাও। হযরত সা’দ বললেন, আমি একাকী কিভাবে পারবো? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লঅম তিনবার কথাটি উচ্চারণ করলেন। পরে হযরত সা’দ (রা) তূন থেকে একটি তীর বের করে একজন শত্রুর প্রতি নিক্ষেপ করলেন। সেই দুর্বৃত্ত সেখানেই নিহত হলো। হযরত সা’দ (রা) বলেন, এরপর আমি সেই তীর নিক্ষেপ করলাম, এই লোকটিকে আমি চিনতাম। সে সেখানেই প্রাণ ত্যাগ করলো। সেই তীর নিক্ষেপে আরেকজনকে হত্যা করলাম। এরপর শত্রু সৈন্যরা নীচে নেমে গেলো। আমি বললাম, এটি হচ্ছে বরকতসম্পন্ন তীর। পরে আমি সেই তীর আমার তূনের মধ্যে রেখে দিলাম। ইতিমধ্যে শত্রুরা নীচে নেমে গেছে। পরবর্তীকালে এই তীর হযরত সা’দ (রা)-এর কাছে ছিলো। তাঁর পরে তাঁকে সন্তানরা সেটি সংরক্ষণ করেন।[যাদুল-মায়াদ দ্বিতীয়, খন্ড, পৃষ্ঠা ৯৫]
শহীদদের অঙ্গচ্ছেদন
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে এটা ছিলো শত্রু সৈন্যদের সর্বশেষ হামলা। তারা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থা সম্পর্কে তখনো স্পষ্ট কিছু বুঝতে পারেনি। তবে ধরেই নিয়েছিলো যে, তিনি নিহত হয়েছেন। এ করণে তহারা নিজেদের শিবিরে ফিরে গিয়ে মক্কায় ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলো। এ সময়ে কিছু মোশরেক নারী-পুরুষ শহীদদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কাটতে শুরু করলো। শহীদদের লজ্জাস্থান, কান, নাক, প্রভৃতি অঙ্গ কেটে ফেললো। কারো কারো পেট চিরে ফেললো। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হেন্দ বিনতে ওতবা হযরত হামযার (রা) বুক চিরে কলিজা বের করে চিবোতে লাগলো। গিলে ফেলার চেষ্টা করে না পারায় ফেলে দিলো। এছাড়া কর্তিত নাক ও কান দিয়ে মালা গেঁথে গলা এবং পায়ে মলের মতো পরিধান করলো।[ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৯০]
সর্বশেষ যুদ্ধের জন্যে মুসলমানদের উদ্যোগ
শেষদিকে এমন দু’টি ঘটনা ঘটলো, যা থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, নিবেদিত প্রাণ মুসলমানরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে কিরূপ দৃঢ় সংকল্প ছিলেন। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জনে জীবন বিসর্জন দিতে তাঁদের আগ্রহ যে ছিলো অপরিসীম, এ থেকে তাও বোঝা যায়।
প্রথম ঘটনা, হযরত কা’ব ইবনে মালেক বললেন, আমি ছিাম তাদের মধ্যে অন্যতম। আমি লক্ষ্য করলাম যে, মুসলমানদের হাতে শহীদদের অবমাননা হচ্ছে। আমি খানিকটা থেমে সামনে এগিয়ে গেলাম। লক্ষ্য করলাম যে, বর্ম পরিহিত বিশালদেহী একটি লোক শহীদদের লাশ অতিক্রম করছে। আর একজন মুসলমান এই লোকটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি উভয়ের প্রতি তাকালাম্ মনে মনে উভয়ের শক্তি পরিমাপ করলাম। আমার মনে হলো যে, কাফের লোকটির অস্ত্রশস্ত্র মুসলমানের অস্ত্রের চেয়ে ভালো। আমি উভয়ের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। এক সময়ে উভয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হলো। সেই মুসলমান ওই কাফেরকে তহবারি দিয়ে এমন আঘাত করেলেন যে, কাফের দ্বিখন্ডিত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। সেই মুখোশ পরিহিত মুসলমান নিজের মুখোশ খুললেন। এর পর বললেন, ও কা’ব, কেমন হলো কাজটা? আমি হচ্ছি আবু দোজানা।[আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা ১৭]
দ্বিতীয় ঘটনা, যুদ্ধ শেষে কিছুসংখ্যক মুসলিম যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে মদীনা পৌঁছুলেন। হযরত আনাস (রা) বলেন, আমি হযরত আয়েশা বিনতে আবু বকর (রা) এবং উম্মে সুলাইম (রা)-কে দেখলাম, তারা পায়ের গোড়ালির ওপর কাপড় তুলে টিছে পানির মশক বয়ে নিয়ে আসছেন এবং মুসলমানদের সেই পানি পান করাচ্ছেন।[সহীহ বোখারী। প্রথম খন্ড পৃ. ৪০৩, দ্বিতীয় খন্ড পৃষ্ঠা ৫৮১]
হযরত ওমর (রা) বলেন, ওহুদের দিনে হযরত উম্মে সালীত (রা) আমাদের জন্যে মশক ভর্তি করে পানি নিয়ে আসছিলেন।[সহীহ বোখারী। প্রথম খন্ড পৃ. ৪০৩]
পানি নিয়ে আগত মহিলাদের মধ্যে হযরত উম্মে আইমানও ছিলেন। তিনি পরাজিত মুসলমানদের মদীনায় প্রবেশ করতে দেখে তাদের মুখে ধুলি নিক্ষেপ করে বলছিলেন, এই নাও সূতা কাটার যন্ত্র, আর তোমাদের তলোয়ার আমাদের হাতে দাও।[সেকালে আরবের মেয়েরা টাকা দিয়ে সূতা কাটতো। আমাদের দেশের মেয়েদের হাতের চুড়ির মতোই সূতোর রকমারি অলঙ্কার অনেকে পরিধান করতো। এখানে আমাদে দেশীয় পরিভাষায় বলা যায়, এই চুড়ি তোমরা পরিধান করো, তলোয়ার আমাদে হাতে দাও।] এর পর তিনি দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে আহতদের পানি পান করাতে লাগলেন। হযরত উম্মে আইমান (রা)-এর প্রতি হেব্বান ইবনে আরকা নামক এক ব্যক্তি তীর নিক্ষেপ করলো। এতে উম্মে আইমান (রা) পড়ে গেলে তাঁর পর্দা খুলে গেলো। আল্লাহর দুশমন তা দেখে খিলখিল করে হাসলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যাপারটি লক্ষ্য করছিলেন। তাঁর খুব খারাপ লাগলো। তিনি হযরত সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা)-কে একটি তীর দিয়ে বললেন, এটি নিক্ষেপ করো। সা’দ তীর নিক্ষেপ করলেন। হযরত সা’দ (রা)-এর তীর হেব্বানের গলায় বিদ্ধ হলো এবং সে চিৎ হয়ে পড়ে গেলো। তার পর্দা খুলে গেলো। এতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একচোট হাসলেন। এরপর বললেন, সা’দ-উম্মে আইমানের বদলা গ্রহণ করেছে, আল্লাহ রব্বুল আলামীন তার দোয়া কবুল করুন।[আস সিরাতুল হালাবিয়া। দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ২২]
ঘাটিতে আশ্রয় গ্রহণ করার পর
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাহাড়ের ঘাঁটিতে আশ্রয় নেয়ার পর হযরত আলী (রা) তাঁর ঢালে করে মিহরাস থেকে পানি নিয়ে এলেন। মিহরাস হচ্ছে পাথরের তৈরী এক ধরনের কূয়া। বলা হয়ে থাকে যে, মেহরাম ওহুদের একটি ঝর্ণা। সেই পানি এনে হযরত আলী (রা) পান করতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দিলেন। কিন্তু কিছুটা গন্ধ অনুভব হওয়ায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই পানি পান না করে চেহারার ক্ষত ধুয়ে নিলেন এবং কিছুটা পানি মাথায় ঢাললেন। সেই সময়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লাম বলছিলেন, সেই ব্যক্তির উপর আল্লাহর কঠিন গযব, যে ব্যক্তি আল্লাহর রসূলের চেহারাকে রক্তাক্ত করেছে।[ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৮৫]
হযরত সাহল (রা) বলেন, আমি দেখেছি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারার রক্ত কে ধুয়েছেন পানি কে ঢেলেছেন এবং চিকিৎসা কে করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমা (রা) তাঁর ক্ষত ধুয়ে দিচ্ছিলেন। হযরত আলী (রা) পানি দিচ্ছিলেন। হযরত ফাতেমা (রা) লক্ষ্য করলেন যে, পানি ঢেলে দেয়ার পরও রক্ত ঝরছে, কিছুতেই রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। তখন তিনি চাটাই-এর একটি টুকরো নিয়ে আগুনে পুড়ে সে ছাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলেন। সাথে সাথে রক্ত বন্ধ হয়ে গেলো।[সহীহ বোখারী, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা, ৫৮৪]
এদিকে হযরত মোহাম্মদ ইবনে মোসলমা (রা) শীতল ও সুমিষ্ট পানি নিয়ে এলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই পানি পান করে তাঁর কল্যাণের জন্যে দোয়া করলেন। [আস সিরাতুল হালাবিয়া, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৩০]
যখমের যন্ত্রণার কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যোহরের নামায বসে আদায় করলেন। সাহাবায়ে কেরামও তাঁর পেছনে বসে নামায আদায় করলেন।[ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড পৃষ্ঠা ৮৭]
আবু সুফিয়ানের দম্ভ
মক্কার বিধর্মী পৌত্তলিকরা ফিরে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। আবু সুফিয়ান তখন ওহুদ পাহাড়ের উপর উঠে জিজ্ঞাসা করলো, তোমাদের মধ্যে কি মোহাম্মদ আছেন? কেউ কোন জবাব দিলেন না। সে আবার বললো, তোমাদে মধ্যে কি আবু কোহাফার পুত্র আছেন? কেউ কোন জবাব দিলেন না। সে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলো, তোমাদে মধ্যে কি ওমর ইবনে খাত্তাব আছেন? কেউ এবারও জবাব দিলেন না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাব দিতে নিষেধ করেছিলেন। আবু সুফিয়ান উল্লিখিত তিনজন ছাড়া অন্য কারো কথা জিজ্ঞাসা করলো না। কারণ, সে ভালো করেই জানতো যে, এই তিনজনের মাধ্যমেই ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটছে। কোন জবাব না পেয়ে আবু সুফিয়ান স্বগতোক্তি করলো, যাক এই তিনজন থেকেই রেহাই পাওয়া গেলো। একথা শুনে হযরত ওমর (রা) আত্মিসম্বরণ করতে পারলেন না, তিনি বললেন, ওরে, আল্লাহর দুশমন, তুমি যাদের নাম উচ্চারণ করেছো, তারা সবাই জীবিত আছেন। আল্লাহ তায়ালা তোমার অবমাননার আরো বীভৎস উপকরণ রেখেছেন। একথা শুনে আবু সুফিয়ান বললো, তোমাদে নিহত লোকদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে বীভৎস করা হয়েছে। আমি এসব করতে বলিনি। তবে এতে আমি নাখোশও নই। এরপর সে ধ্বনি দিলো, হোবালের জয় হোক!
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা জবাব দিচ্ছো না কেন? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, কি জবাব দেব? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বলো, আল্লাহ তয়ালা মহান এবং সর্ব শক্তিমান।
আবু সুফিয়ান উচ্চস্বরে বললো, আমাদের জন্যে ওযযা আছে, তোমাদে নেই।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা জবাব দিচ্ছো না কেন? সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন, কি জবাব দেবো? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বলো ‘আল্লাহু মালানা ওয়া-লা মাওলা লাকুম।’ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রভু তোমাদের কোন প্রভু নেই।
এরপর আবু সুফিয়ান বললো, কি চমৎকার কৃতিত্ব। আজ বদরের যুদ্ধের প্রতিশোধ গ্রহণের দিন। যুদ্ধ হচ্ছে একটা বলতি।[কখনো এক পক্ষ জয় লাভ করে কখনো অন্য পক্ষ। যেমন বালতি দিয়ে কখনো একজন টেনে পানি তোলে, কখনো অন্য জন তোলে।]
হযরত ওমর (রা) জবাবে বললেন, সমান নয়। আমাদে যারা নিহত হয়েছেন, তারা জান্নাতে রয়েছেন, আর তোমাদে যারা নিহত হয়েছে, তারা জাহান্নামে রয়েছে।
এরপর আবু সুফিয়ান বললো, ওহে ওমর, একটু কাছে আসো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যাও, দেখো কি বলে। হযরত ওমর (রা) এগিয়ে গেলেন। আবু সুফিয়ান বললো, ওহে ওমর, তোমাকে আল্লাহর নামে শপথ দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি, আমরা কি মোহাম্মদকে হত্যা করতে পেরেছি? হযরত ওমর (রা) বললেন, আল্লাহর শপথ, পারো নাই। বরং এখন তিনি তোমার কথা শুনছেন। আবু সুফিয়ান বললো, ওমর, তুমি আমার কাছে ইবনে কোম্মার চাইতেও অধিক সত্যবাদী ব্যক্তি।[ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৯৩-৯৪। যাদুল-মায়াদ দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৯৪। সহীহ বোখারী দ্বিতীয় খন্ড পৃষ্ঠা ৫৭৯]
আরেকটি বদরের সঙ্কল্প
ইবনে ইসহাক (রা) বলেন, আবু সুফিয়ান এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা ফিরে যাওয়ার সময় বললো, আগামী বছর বদর প্রান্তরে পুনরায় লড়াই করার প্রতিজ্ঞা রইলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন সাহাবীকে বললেন, বলে দাও, আচ্ছা, ঠিক আছে, তোমাদের এবং আমাদের মধ্যে একথাই রইলো।[ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৯৪]
শত্রুদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা)-কে কাফেরদের পেছনে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বললেন, ওদের পেছনে যাও। দেখো, ওরা কি করছে। ওদের পরবর্তী ইচ্ছা বা কি? যদি ওরা ঘোড়া ও উটের পিঠে সওয়ার হয়ে থাকে তবে বুঝতে হবে ওরা মক্কার দিকে যাচ্ছে। যদি ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে উট হাঁকিয়ে নিয়ে যায়, তবে বুঝতে হবে, ওরা মদীনায় আসছে। এরপর বললেন, সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, ওরা যদি মদীনার পথে রওয়ানা দিয়ে থাকে, তবে মদীনায় গিয়ে ওদের মোকাবেলা করবো। হযরত আলী (রা) বলেন, এরপর আমি কাফেরদের অনুসরণ করে লক্ষ্য করলাম, ওরা ঘোড়া ও উটের পিঠে সওয়ার হয়ে মক্কায় ফিরে যাচ্ছে।[ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৬৪। হাফেজ ইবনে হাজার ফতহুল বারী গ্রন্থের সপ্তম খন্ডের ৩৪৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, পৌত্তলিকদের ইচ্ছা সম্পর্কে জানার জন্য হযরত সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা) রওয়ানা হয়েছিলেন।]
শহীদ ও গাজীদের দেখাশোনা
কাফেরদের চলে যাওয়ার পর মুসলমানরা শহীদান এবং আহতদের খোঁজ নিতে শুরু করলেন। হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত (রা) বলেন, ওহুদের দিনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে সা’দ ইবনে রবির (রা) খোঁজ নিতে পাঠালেন। আমাকে বলে দিলেন যে, যদি সা’দকে পাওয়া যায় তবে তাকে আমার সালাম জানাবে এবং জিজ্ঞাসা করবে, সে এখন কেমন বোধ করছে। হযরত যায়েদ (রা) বলেন, আমি শহীদদের লাশের মধ্যে খুঁজে খুঁজে তাকে বের করলাম। কাছে গিয়ে দেখি মুমূর্ষ অবস্থায় কাতরাচ্ছেন। তাঁর দেহে বর্শা, তীর ও তলোয়ারে সত্তরটি আঘাত লেগেছিলো। আমি বললাম, হে সা’দ, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনাকে সালাম জানিয়েছেন এবং আপনি কেমন অনুভব করছেন সেকথা জানতে চেয়েছেন। হযরত সা’দ ইবনে রবি (রা) বললেন, আল্লাহর রসূলকে আমার সালাম। তাঁক কাছে বলবে যে, আমি জান্নাতের খুশবু পাচ্ছি। আমার আনসার ভাইদের বলবে যে, যদি তোমাদের একটি চোখের স্পন্দন বাকি থাকাতেও শত্রুরা আল্লাহর রসূলের কাছে পৌঁছুতে পারে, তবে আল্লাহর দরবারে তোমাদের কোন ওজর আপত্তি কাজে আসবে না। একথা বলার পর পরই তিনি ইন্তেকাল করলেন।[যাদুল-মায়াদ। দ্বিীতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৯৬]
আহতদের মধ্যে উসাইরামকেও দেখা গেলো। তাঁ নাম ছিলো আমর ইবনে সাবেত (রা)। তখনো তাঁর প্রাণ-স্পন্দন অবশিষ্ট ছিলো। ইতিপূর্বে তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি সে দাওয়াত গ্রহণ করেননি। অনেকে অবাক হয়ে বললেন, উসাইরাম এখানে এলো কিভাবে? আমরা তাকে তো ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি। কিন্তু তিনি তো গ্রহণ করেননি। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, আপনি কিভাবে এখানে এলেন? ইসলামের প্রতি ভালোবাসায় নাকি স্বজাতীয়দের শক্তি বৃদ্ধির জন্যে? তিনি বললেন, ইসলামের প্রতি ভালোবাসায় এসেছি। আমি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এবং তাঁর প্রিয় রসূলের প্রতি ঈমান এনেছি এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়অ সাল্লামের সমর্থনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। বর্তমানে যে অবস্থায় আছি, সেটা তো আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন। এরপরই তিনি ইন্তেকাল করলেন। তার সম্পর্কে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, সে জান্নাতীদে অন্তর্ভুক্ত। হযরত আবু হোরায় (রা) বলেন, অথচ তিন আল্লাহ হায়ালাজন জন্যে এক ওয়াক্ত নামাযও আদায় করেননি।[যাদুল-মায়াদ। দ্বিীতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৯৪, ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৯০] (ইসলাম গ্রহণের পর কোন নামাযের ওয়াক্ত হওয়ার আগেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন।)
আহতদের মধ্যে কোজমান নামে এক ব্যক্তিকেও পাওয়া গেলো। সে এই যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে লড়াই করেছিলো। সাত বা আটজন মোশরেককে হত্যা করেছিলো। তার দেহে ছিলো বহুসংখ্যক আঘাতে চিহ্ন। তাকে বনু যোফর মহল্লায় নিয়ে যাওয়া হলো। মুসলমানরা তাকে সুসংবাদ শোনালেন। সে বললো, আল্লাহর শপথ, আমিতো আমার গোত্রের সুনামের জন্যেই লড়াই করেছি। গোত্রের সুনাম রক্ষার চিন্তা না থাকলে আমি তো লড়াই করতাম না। জখমের যন্ত্রণা তীব্র হয়ে গেলে কোজমান নিজেকে যবাই করে আত্মহত্যা করে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তার প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হলে তিনি বললেন, সে তো জাহান্নামী। [যাদুল-মায়াদ। দ্বিীতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৯৭-৯৮, ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৮৮] এই ঘটনায় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি ভবিষ্যতবাণীর সত্যতা প্রমাণিত হলো।
আল্লাহর কালেমা বুলন্দের উদ্দেশ্য ছাড়া দেশের জন্যে বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে যারা যুদ্ধ করে, তাদের সকলের পরিণাম কোজমানের মতো হবে। এমনকি যদি তারা ইসলামের পতাকাতলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বা সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গী হয়ে যুদ্ধ করে, তবুও তাদের এই পরিণামের স্মুখীন হতে হবে।
নিহতদের মধ্যে বনু ছা‘লাম গোত্রের একজন ইহুদীও ছিলো। সে তা স্বগোত্রীয়দের বললো, আল্লাহর শপথ, তোমরা তো জানো যে, মোহাম্মদকে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য। ইহুদীরা বললো, আজ শনিবার। সেই ইহুদী বললো, তোমাদের জন্যে কোন শনিবার নেই। এরপর সেই হহুদী তলোয়ার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে রওয়ানা হলো। রওয়ানা হওয়ার সময় বললো, যদি আমি যুদ্ধে নিহত হই, তবে আমার অর্থ-সম্পদের মালিকানা মোহাম্মদের। তিনি যা চান, তাই করবেন। এরপর সে যুদ্ধক্ষেত্রে মুসলমানদের পক্ষে যুদ্ধ করতে করতে মারা গেলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব কথা শুনে বললেন, যে ছিলো একজন ভালো ইহুদী।[[ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৮৮]
এ সময়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও শহীদদের লাশ পরিদর্শন করতেলন এবং বললেন, আমি এদের জন্যে সাক্ষী থাকব। প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে আহত হয়, আল্লাহ তায়ালা তাকে কেয়ামতের দিন এমন অবস্থায় ওঠাবেন যে, তার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরতে থাকবে। সেই রক্তের রং তো রক্তের মতোই হবে, কিন্তু সেই রক্ত থেকে কস্তুরীর সুবাস নির্গত হবে।[ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৯৮]
কয়েকজন সাহাবা তাদের ঘনিষ্ঠ শহীদ সাহাবাদের লাশ মদীনায় স্থানান্তর করলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটা জানার পর সেই সব শহীদের লাশ শাহাদাত বরণের জায়গাতেই দাফন করার নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেন, শহীদদের অস্ত্র এবং পুস্তিনের পোশাক খুলে নিয়ে তাদেরকে বিনা গোসলে দাফন করো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই তিনজন সাহাবার লাশ একই কবরে দাফন করার নির্দেশ দিলেন। দুইজন সাহাবার লাশ একই কাফনে জড়িয়ে দাফন করারও নির্দেশ দিলেন। দুইজন সাহাবাকে একই কাফনে জড়ানোর পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করতেন যে, এই দুইজনের মধ্যে কোরআনে করিম কার বেশী মুখস্ত ছিলো? সাহাবারা যার প্রতি ইশারা করতেন তাকে বকরের নীচের দিকে রাখার জন্যে বলতেন। তিনি বলছিলেন, আমি কেয়ামতের দিন এদের সম্পের্কে সাক্ষ্য দেব। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম (লা) এবং ওমর ইবনে জামুহ (রা)-কে একই কবরে দাফন করা হলো। কেননা তাদের দু’জনের মধ্যে ছিলো ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব। [যাদুল-মায়াদ, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৯৮, সহীহ বোখারী, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৫৮৪] হযরত হানযালা (রা)-এর লাশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। সন্ধান করার পর এক জায়গায় পাওয়া গেলো, তার লাশ থেকে পানি ঝরছিলো। লাশ ছিলো মাটি থেকে কিছুটা উপরে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের বললেন, ফেরেশতাগণ তাকে গোসল করাচ্ছেন। এরপর বললেন, তাঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করো ব্যাপারটা কি? জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ঘটনা বললেন। সেই থেকে হানযালা (রা)-এর নাম হলো গাসিসুল মালায়েকা অর্থা এমন ব্যক্তি, যাকে ফেরেশতারা গোসল দিয়েছেন।[যাদুল-মায়াদ, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৯৪]
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চাচা হামযার অবস্থা দেখে খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফুফু হযরত সাফিয়্যা (রা) এলেন। তিনি হযরক হামযা (রা)-কে দেখতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইগি ওয়া সাল্লাম হযরত সাফিয়্যার পুত্র হযরত যোবায়ের (রা)-কে বললেন, ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও। তিনি যেন নিজ ভাই-এর অবস্থা দেখতে না পান। কিন্তু হযরত সাফিয়্যা (রা) বললেন, তা কেন? আমি জানি, আমার ভাইয়ের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে। হযরত হামযা (রা) আল্লাহর পথে ছিলেন। কাজেই যা কিছু হয়েছে, তা আমরা মেনে নিয়েছি। আমি সওয়াবের আশায় ইনশাআল্লাহ ছবর করবো। এরপর তিনি হামযা (রা)-এর কাছে এলেন, দেখলেন, ইন্নালিল্লাহ পড়লেন, তার জন্যে দোয়া করলেন। এবং মাগফেরাত কামনা করলেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ দিলেন যে, হযরত হামযা (রা)-কে আবদুল্লাহ ইবনে হাজাশের সাথে দাফন করো। তিনি হযরত হামযার (রা) ভ্রাতুষ্পুত্র এবং দুধভাই ছিলেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণনা করেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত হামযা (রা)-এর জন্যে যেভাবে কেঁদেছিলেন, তাঁকে অন্য কোন সময়েই ওরকম কাঁদতে দেখা যায়নি। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত হামযা (রা)-কে কেবলার দিকে রাখলেন এরপর তার জানাযার পাশে দাঁড়িয়ে এমনভাবে কাঁদলেন যে, আমরা তাঁর কান্নার হু হু শব্দ শুনতে পেলাম।[ইহা ইবনে শাজানের বর্ণনা। মুখতাসারুস সিয়ারু লিশ শাইখ আবদুল্লাহ, পৃষ্ঠা ৩৫৫ দেখুন,]
শহীদদের অবস্থা ছিলো বড়ই হৃদয়বিদারক। হযরত খাব্বাব ইবনে আরত (রা) বলেন, হযরত খাববাবের জন্যে কালো পাড় বিশিষ্ট একটি চাদর ছানা অন্য কোন কাফন পাওয়া যায়নি। এই চাদর মাথার দিক খালি হয়ে যেতো। শেষ পর্যন্ত পা খালি রেখে ইযখির[এক ধরনের সুগন্ধযুক্ত ঘাস। অনেক স্থানে এই ঘাস চায়ের সাথে মিশিয়ে রান্না করা হয়।] ঘাস দিয়ে পা ঢেকে দেয়া হয়।[মুসনাদে আহমদ, শেফাত, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৪০]
হযরত আবদুর রহমান ইবনে ওমায়ের (রা)-এর শাহাদাতের ঘটনা ঘটলো। তিনি ছিলেন আমার চেয়ে ভালো। একটি মাত্র চাদর দিয়ে তাঁকে কাফন দেয়া হলো। সেই চাদর দিয়ে তাঁর মাথা ঢেকে দেয়া হলে পা খুলে যেতো পা ঢেকে দেয়া হলে মাথা খুলে যেতো। তাঁর কাফনের এরূপ অবস্থার কথা হযরত খাব্বাব (রা) ও বর্ণা করেছেন। তবে এটুকু বেশী বর্ণনা করেছেন যে, তাঁর এই অবস্থা দেখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের বলতেন, চাদর দিয়ে তাঁর মাথা ঢেকে দাও এবং পায়ের উপর উখির ঘাস চাপিয়ে দাও।[সহীহ বোখারী, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৫৭৯-৫৮৪]
আল্লাহর দরবারে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দোয়া
ইমাম আহমদের বর্ণনায় রয়েছে, ওহুদের দিনে মোশরেকরা ফিরে যাওয়ার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের বললেন, তোমরা কাতারবন্দী হও, আমি আমার প্রতিপালকের কিছু প্রশংসা করবো। এরপর তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহ রব্বুল আলামীন, সকল প্রশংসা তোমারই জন্যে। তুমি যা প্রশস্ত করে দাও, তা কেউ সংকীর্ণ করতে পারে না। তুমি যা সংকীর্ণ করে দাও, কেউ তা প্রশস্ত করতে পারে না। তুমি যাকে পথভ্রষ্ট করে দাও, কেই তাকে হেদায়াত করতে পারে না, পক্ষান্তরে তুমি যাকে হেদায়াত দাও, কেউ তাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না। যে জিনিস তুমি আটক করে দাও, সে জিনিস কেউ দিতে পারে না। পক্ষান্তরে যে জিনিস তুমি দাও, কেউ তা আটক করতে পারে না। যে জিনিস তুমি দূরে সরিয়ে দাও, সে জিনিস কাছে আনতে পারে না পক্ষান্তরে যে জিনিস তুমি কাছে এনে দাও, সে জিনিম কেউ দূরে সরিয়ে দিতে পারে না। হে আল্লাহ রব্বুল আলামীন, আমাদের উপর তোমার বরকত, রহমত, ফযল ও রেযেক বিস্তৃত করো।
হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে স্থায়ী নেয়ামতের জন্যে আবেদন করছি, যে নেয়ামত কখনো শেষ হবে না। হে আল্লাহ তায়ালা, আমি তোমার কাছে দারিদ্রের দিনে সাহায্য এবং ভয়ের দিনে নিরাপত্তার আবেদন জানাচ্ছি। হে আল্লাহ, তুমি আমাদেরকে যা কিছু দিয়েছো, তার মন্দ থেকে, আর যা কিছু দাওনি তারও মন্দ থেকে আমি তোমার কাছে পানাহ চাই। হে আল্লাহ আমাদের ঈমানকে প্রয় করে দাও এবং আমাদের অন্তরকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে দাও। কুফুরী, ফাসেকী এবং নাফরমানীআমরা যেন পছন্ত না করি, সেই ব্যবস্থা করো এবং আমাদেরকে হেদায়াতপ্রাপ্ত লোকদের অন্তর্ভুক্ত করে দাও। হে আল্লাহ, আমাদের মুসলমান থাকা অবস্থায় মৃত্যু দাও এবং মুসলমান অবস্থায় পরকালে জীবিত করো। অবমাননা ও ফেত্না ফাসাদ থেকে আমাদের দূরে রেখো। তোমার সালেহীন বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে দাও। হে আল্লাহ, তুমি যে সকল কাফেরকে মেরে ফেলো, তাদের সাথে কঠোর ব্যবহাত করো ও আযাবে নিক্ষেপ করো যারা তোমার পয়গাম্বরকে মিথ্যাবাদী বলে এবং তোমার পথ থেকে ফিরিয়ে রাখে। হে আল্লাহ, সেসব কাফেরকেও মারো, যাদেরকে কেতাব দেয়া হয়েছে।’[বোখারী, আল আদাবুল মোফরাদ, মুসলাদে আহমদ,তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৩২৪।]
মদীনায় প্রত্যাবর্তন
শহীদদের দাফন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনার পথে রওয়ানা হলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে সাহাবারা যে ধরনের নিবেদিতচিত্ততা ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছিলেন, শহীদদের আত্মীয়স্বজনও একই ধরনের আত্মত্যাগ ও ধৈর্যের পরিচয় দিলেন।
মদীনায় যাওয়ার পথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হযরত হামনা বিনতে জাহাশ (রা)-এর সাক্ষাৎ হলো। তাঁর ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা) যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। হযরত হামনা শাহাদাতের খবর শুনে ইন্নালিল্লাহ পাঠ করলেন এবং ভাইয়ের জন্যে মাগফেরাতের দোয়া করলেন। এরপর তাকে তার মামা হযরত হামযা ইবনে আবদুল মোত্তালেব (রা)-এর শাহাদাদতের খবর দেয়া হলো। তিনি পুনরায় ইন্নালিল্লাহ পাঠ করলেন এবং মাগফেরাতের দোয়া করলেন। এরপর তাঁর স্বামী মসআব ইবনে ওমায়েরের (রা) শাহাদাতের খবর দেয়া হলো। একথা শুনে তিনি চিৎকার দিয়ে উঠে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, নারীর স্বামী তাঁর কাছে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।[ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড পৃষ্ঠা, ৯৮]
বনু দীনার গোত্রের এক মহিলার সাথে সাহাবাদের দেখা হলো। তার স্বামী, ভাই এবং পিতাও শহীদ হয়েছিলেন। এদের শাহাদাতের খবর তাকে জানানো হলো। তিনি শুনে বললেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কি খবর? তাঁকে বলা হলো যে, তিনি ভালো আছেন। মহিলা বললেন, তাঁকে আমি একটু দেখতে চাই। সাহাবার ইশারায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখিয়ে দিলেন। মহিলা সাথে সাথে ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন, ‘কুল্লু মুসিবাতিন বা’দুকা জালালুন’ অর্থাৎ আপনি বিদ্যমান থাকা অবস্থায় সকল বিপদই তুচ্ছ। [ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড পৃষ্ঠা, ৯৯] এই সময়ে হযরত সা’দ ইবনে মায়া’য (রা)-এর মা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ছুটে এলেন। সেই সময় হযারত সা’দ (রা) প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোড়ার লাগাম ধরে রেখেছিলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রসূল, এই হচ্ছে আমার মা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাকে মারহাবা। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই মহিলার সম্মানে ঘোড়া থামালেন। মহিলা কাছে এলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহিলার এক পুত্র হযরত আমর ইবনে মায়া’য এর শাহাদাতের খবর জানিয়ে তাঁকে ধৈর্য ধারণ করতে বললেন। মহিলা বললেন, আপনাকে ভালো অবস্থায় দেখার পর সকল বিপদ আমার কাছে তুচ্ছ। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহুদের শহীদদের জন্যে দোয়া করলেন এবং এবং বললেন, হে উম্মে সা’দ, তুমি খুশী হও। শহীদদের পরিবারে গিয়ে সুসংবাদ দাও যে, ওদের সকল শহীদ একত্রে জান্নাতে রয়েছে এবং নিজের পরিবার পরিজনের ব্যাপারে তাদের সাফায়াত কবুল করা হয়েছে। মহিলা বললেন, হে আল্লাহর রসূল, শহীদদের পরিবার পরিজনের জন্যে দোয়া করুন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আল্লাহ তায়ালা, ওদরে মনের শোকের যাতনা দূর করে দাও। ওদের মুসিবতের বিনিময় দাও এবং অন্য সবাইকে হেফাযক করো।[আস সিরাতুল হালাবিয়া, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৪৭।]
মদীনায় আল্লাহর রসূল
তৃতীয় হিজরীর ৭ই শাওয়াল রোবিবার বিকেলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় পৌঁছুলেন। ঘ েদিয়ে তাঁর তলোয়ার হযরত ফাতেমা (রা)-কে দিয়ে বললেন, এই তলোয়ারে লেগে থাকা রক্ত ধুয়ে দাও। আল্লাহর শপথ, এই তরবারি আজ আমার জন্যে সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। হযরত আলীও (রা) তাঁর দরবারি হযরত ফাতেমা (রা)-কে দিয়ে রক্ত ধুয়ে দিতে বললেন। আরো বললেন, আল্লাহর শপথ, এই তরবারি আমার জন্যে সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। এতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি যুদ্ধে বীরত্ব দেখিয়েছো তবে মনে রেখো, সুহায়েল ইবনে হুনাইফ এবং আবু দোজানা (রা) বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছে।[ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা, ১০০]
ওহুদের যুদ্ধে ৭০ জন মুসলমান শহীদ হয়েছেন। বর্ণনাকারীদের অধিকাংশই এই সংখ্যার ব্যাপারে একমত। শহীদদের মধ্যে ৬৫ জন ছিলেন আনসার। এদের মধ্যে ৪১ জন খাযরাজ গোত্র এবং ২৪ জন আওস গোত্র থেকে শহীদ হন। একজন ইহুদীও নিহত হয়েছিলো। আর মোহাজের শহীদ ছিলেন মাত্র চারজন। কোরায়শ কাফেরদের মধ্যে কতজন নিহত হয়েছিলো? ঐতিহাসিক ইবনে ইসজাকের মতে তাদের ২২ জন নিহত হয়েছিলো। কিন্তু যুদ্ধবিশারদ, সীরাত রচয়িতারা ওহুদ যুদ্ধের যে বিবরণ উল্লেখ করেছেন এবং বিভিন্ন পর্যায়ে নিহত হওয়ার যে বিবরণ দিয়েছেন তার আলোকে দেখা যায় যে, ২২ ব্যক্তি নয় বরং ৩৭ জন নিহত হয়েছিলো। আল্লাহ তায়ালাই এ সম্পর্কে ভালো জানেন।[ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা, ১২২ গোযযওয়ায়ে ওহুদ’ পৃঃ ১৮০]
মদীনায় জরুরী অবস্থা
ওহুদ থেকে ফিরে আসার পর তৃতীয় হিজরীর ৮ই সওয়াল রাতে মুসলমানরা জরুরী পরিস্থিতি অতিবাহিত করেন। তাঁরা সকলেই রণক্লান্ত হওয়া সত্তেও সারারাত মদীনার পথে পথে এবং মদীনার প্রবেশপথসমূহে কাটিয়ে দেন। হযরত রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশেষ হেফাযতের ব্যবস্থাতেও তাঁরা নিয়োজিত ছিলেন। কেননা নানাদিক থেকে তাঁরা আশঙ্কা বোধ করছিলেন।
হামরাউল আছাদের যুদ্ধ
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সারা রাত যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করেন।
তিনি এরূপ আশঙ্কা করছিলেন যে, যদি শত্রুরা এরূপ ভেবে থাকে যে, যুদ্ধের ময়দানে সংখ্যায় বেশী হয়েও আমরা কোন ফায়দা অর্জন করতে পারিনি, তবে নিশ্চয়ই তারা লজ্জিত হবে। এর ফলে তারা মক্কার পথ থেকে ফিরে এসে মদীনায় হামলা করতে পারে। এ কারণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিদ্ধান্ত নিলেন যে, মক্কার সৈন্যদের অনুসরণ করতে হবে।
সীরাত রচয়িতারা লিখেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহুদ যুদ্ধের পরদিন অর্থাৎ তৃতীয় হিজরীর ৮ই শাওয়াল সকালে ঘোষণা করলেন যে, শত্রুদের মোকাবেলার জন্যে রওয়া না হতে হবে, ওহুদের যুদ্ধে যারা শরিক হয়েছিলো তারাই শুধু আমাদের সাথে যেতে পারবে। মোনাফেক আবদুল্লাহ ইবনে উবাই অনুমতি চাইল, কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবে অনুমতি দিলেন না। শারীরিকভাবে আহত, স্বজন হারানোর শোকে কাতর, আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন মুযসলমানরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আহ্বানের সামনে মাথা নত করে দিলেন। হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা) ওহুদের যুদ্ধে হাযির হতে পারেননি। তিনি অনুমতি চাইলেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামেনে এসে বললেন, হে আল্লাহর রসূল, আমি সকল যুদ্ধে সঙ্গী থাকতে আগ্রহী। ওহুদের যুদ্ধে আমার কন্যাদের দেখাশোনার জন্যে আমার পিতা আমাকে রেখে গিয়েছিলেন, এ কারণে আমি যুদ্ধে যেতে পারিনি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে অনুমতি প্রদান করলেন। কর্মসূচী অনুযায়ী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা হলেন এবং মদীনা থেকে আট মাইল দূরে ‘হামরাউল আছাদ’ নামক স্থানে পৌঁছে শিবির স্থাপন করলেন।
এ সময়ে মা’বাদ ইবনে মা’বাদ খাজায়ী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হাযির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। এর আগে তিনি শেরেকের ওপর অটল ছিলেন। কিন্তু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কল্যাণ কামনা করতেন। খাযাআ এবং বনু হাশেম গোত্রের মধ্যে মৈত্রী চুক্তি বিদ্যমান ছিলো। এই চুক্তির কারণেই তিনি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিতকামী ছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তিনি বললেন, আপনি এবং আপনার সঙ্গীরা যুদ্ধের ময়দানে যেরূপ কষ্টের সম্মুখীন হয়েছেন, এতে আমি খুবই মর্মাহত হয়েছি। আমি মনে প্রাণে কামনা করেডিছলাম, আপনি যেন ভালো থাকেন। এ ধরনের সমবেদনা প্রকাশের পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মা’বাদ (রা)-কে বললেন, আবু সুফিয়ানের কাছে যাও এবং তার উদ্যম নষ্ট করে তাকে নিরুৎসাহিত করো।
মোশরেকরা পুনরায় মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হতে পারে বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে আশঙ্কা করেছিলেন, সেটাই সত্য হলো। মদীনা থেকে ছত্রিশ মাইল দূরবর্তী রওহা নামক জায়গায় পৌঁছে মোশরেকরা একে অন্যকে দোষারোপ করতে লাগলো। তারা একদল অন্য দলকে বলছিলো, তোমরা কিছুই করোনি। ওদের শক্তিহীন করার পরও ছেড়ে দিয়েছে। ওদের এতো বেশী মাথা এখনো বিদ্যমান রয়েছে, যা কিনা পুনরায় তোমাদের মাথা ব্যথার কারণ হবে। চলো ফিরে যাই, ওদেরকে সমূলে উৎপাটন করি।
যারা এ প্রস্তাব দিয়েছিলো, মনে হয় তারা উভয় পক্ষের শক্তি সম্পর্কে সঠিক অবহিত ছিলো না। এ কারণে দায়িত্বশীল একজন সফওয়ান ইবনে উমাইয়া এই অভিমতের বিরোধিতা করে বললো, তোমরা অমন করো না। আমি আশঙ্কা করছি যে, যেসকল মুসলমান ওহুদের যুদ্ধে অংশ নেয়নি. একার তারাও আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। কাজেই জয়লাভ আমরাই করেছি এরূপ আত্মপ্রসাদ নিয়ে মক্কায় ফিরে চলো। অন্যথায় মদীনার ওপর হামলা করলে বিপদে জড়িয়ে পড়বে। কিন্তু অধিকাংশ কাফের এ মতামত গ্রহণ করলো না এবং তারা মদীনার ওপর হামলা করার সিদ্ধান্তে অটল থাকলো। তারা মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হওয়ার আগেই মা’বাদ ইবনে মা’বাদ খাযায়ী সেখানে পৌঁছুলেন। আবু সুফিয়ান তখন জানত না যে, মা’বাদ ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন। সে জিজ্ঞাসা করলো, মা’বাদ, পেছনের খবর কি? মা’বাদ কৌশলের মাধ্যমে বললেন, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লা, তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে তোমাদে অনুসরণে বেরিয়ে পড়েছেন। তারা সংখ্যায় এত বেশী যে, এতো বড় সৈন্যদল এর আগে আমি কখনো দেখিনি। সবাই তোমাদের বিরুদ্ধে ক্রোধে জ্বলছেন। ওহুদের যুদ্ধে যারা যোগদান করেনি, এবার তারাও যোগদান করেছেন। তারা যুদ্ধে যা কিচু হারিয়েছেন, সে জন্যে লজ্জিত। বর্তমানে তোমাদের বিরুদ্ধে এমন ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছেন যে, আমি এ রকম ক্রোধের উদাহরণ ইতিপূর্বে দেখিনি।
আবু সুফিয়ান বললো, আরে ভাই, তুমি এসব কি বলছো?
মা’বাদ বললেন, হাঁ, সত্যি বলছি। আমার ধারণা তোমরা এখান থেকে চলে যাওয়ার আগেই ঘোড়ার দলটি দেখতে পাবে। সৈন্যদের অগ্রবর্তী দল এই টিলার পেছনে থেকে বেরিয়ে আসবে।
আবু সুফিয়ান বললো, আল্লাহর শপথ, আমরা শপথ নিয়েছি, ওদের ওপর পাল্টা হামলা করে তাদের নির্মূল করে দেবো।
মা’বাদ বললেন, অমন করো না। আমি তোমাদে ভালোর জন্যে বলছি।
এসব কথা শুনে কাফেরদের মনোবল ভেঙ্গে গেলো। তারা মক্কায় ফিরে যাওয়াই কল্যাণকর মনে করলো। তবে আবু সুফিয়ান মুসলিম বাহিনীকে নিরুৎসাহিত করতে এবং তাদের সাথে সংঘর্ষ এড়ানোর জন্যে একটা কৌশল অবলম্বন করলো। মদীনার পথে চলমান বনু আবদে কায়সের একটি কাফেলাপর লোকদের ডেকে আবু সুফিয়ান বললো, আপনারা কি মোহাম্মদের কাছে আমার একটি পয়গাম পৌঁছে দিতে পারবেন? যদি পৌঁছে দেন, তবে আমি কথা দিচ্ছি যে, আপনারা মক্কায় এলে ওকাযের বাজারে আপনাদের এতো বেশী কিসমিস দেবো, যতোটা এই উটনী বহন করতে পারে।
বনু আবদে কায়েসের লোকেরা আবু সুঠিয়ানের অনুরোধ রক্ষা করতে রাজি হলো।
আবু সুফিয়ান বললো, আপনারা মোহাম্মদকে বলবেন যে, আমরা তাকে এবং তার সঙ্গীদের নির্মূল করার উদ্দেশ্যে পাল্টা হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।
এই কাফেলার লোকদের কাছে এই খবর পেয়ে মুসলমানদের ঈমান আরো চাঙ্গা হয়ে উঠলো। তারা বললো, আল্লাহ তায়ালাই আমাদের জন্যে যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম কর্ম সম্পাদনকারী।
ঈমানের এই শক্তির কারণে মুসলমানরা আল্লাহর নেয়ামত এবং ফযলের সাথে মদীনার পথে রওয়ানা হলেন। কোন প্রকার অকল্যাণ তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। তারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের রেযামন্দির অনুসরণ করেছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা অপরিসীম রহস্যের অধিকারী। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোববার দিন, হামরাউল আছাদে গমন করেন। সোম, মঙ্গল ও বুধ অর্থাৎ তৃতীয় হিজরীর ৯, ১০ ও ১১ই শাওয়াল পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। এরপর তিনি মদীনায় ফিরে আসেন। মদীনায় ফিরে আসার আগেই আবু আযযা জুমাই তাঁর নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। এই লোকটি বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়েছিলো। কিন্তু দারিদ্র এবং কন্য সন্তানের সংখ্যাধিক্য থাকায় তাকে মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি দেয়া হয়েছিলো। তহবে সে অঙ্গীকার করেছিলো যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করবে না। কিন্তু সে কথা রাখেনি। কবিতার মাধ্যমে সে আল্লাহ, রসূল এবং সাহাবায়ে কেরামদের বিরুদ্ধে সাধারণ লোকদের উদ্দীপিত করতে থাকে। ইতিপূর্বে এ প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে। এরপর মুসলমানদের বিরুদ্ধে ওহুদের যুদ্ধেও অংশও নিয়েছে। এই লোকটিকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে হাযির করা হলো। সে বললো মোহাম্মদ, আমার ভুল ক্ষমা করে দাও। আমার ওপর দয়া করো। আমার কন্যা সন্তানদের কথা ভেবে আমাকে ছেড়ে দাও। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ আর করবো না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এখন আর এটা হতে পারে না যে, তুমি মক্কায় গিয়ে মুখমন্ডলে হাত বুলাতে বুলাতে বলবে, মোহাম্মদ আমি দ্বিতীয়বার ধোঁকা দিয়েছি। মোমেন এক গর্ত থেকে দু’বার দংশিত হয় না। এরপর রসূ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত যোবায়ের, মতান্তরে হযরত আসেম ইবনে ছাবেতকে নির্দেশ দিলেন এবং তারা সেই বেঈমাননের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন।
এমনি করে মক্কার অন্য একজন গুপ্তচরও নিহত হয়। তার নাম ছিলো মাবিয়া ইবনে মুগিরা ইবনে আবুল আস। সে ছিলো আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ানের নানা। ওহুদের দিনে মক্কার মোশরেকরা মক্কা ছেড়ে যাওয়ার পর এই লোকটি মদীনায় তার চাচাতোপ ভাই হযরত ওসমানের (র া) মাধ্যমে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই শর্তে তাকে নিরাপত্তা দেন যে, সে সর্বোচ্চ তিনদিন মদীনায় থাকতে পারবে। এরপরও যদি তাকে মদীনায় দেখা যায়, তবে হত্যা করা হবে। মুসলিম মোহাজেররা ওহুদের যুদ্ধে যাওয়ার পর মাবিয়া ইবনে মুগরা কোরায়শদের গুপ্তচর বৃত্তির জন্যে মদীনায় তিনদিনের পরও থেকে যায়। মুসলিম মোহাজেররা ফিরে আসার পর সে পলায়নের চেষ্ট করে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা এবং হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসেরকে নির্দেশ দেন। উভয় সাহাবী মাবিয়াকে তাড়া করে পাকড়াও করে হত্যা করেন।[ওহুদের যুদ্ধ এবং হামরাউল আছাদের বিস্তারিত বিবরণ যেসব গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে সেগুলো হচ্ছে, ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, ৬০-১২৯, যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড পৃ. ৯১-১০৯, ফতহুল বরী সপ্তম খন্ড, ৩৪৫-৩৭৭, মুখতাছারুস সিরাত ২৪২-২৫৭।]
ওহুদের যুদ্ধে জয়-পরাজয় সম্পর্কিত পর্যালোচনা
ওহুদের যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণের পর উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, যা কিছু আলোচিত হয়েছে, তার আলোকে জয় পরাজয় কিভাবে নির্ধারিত হবে? এ যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহের আলোকে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা যাবে কি যে, মুসলমানরা জয়লাভ করেছে অথবা পরাজিত হয়েছে? বাস্তবতাকে এবং যুদ্ধের ময়দান তাদের হাতেই এরকম ছিলো। প্রাণহানিও মুসলমানদের পক্ষেই বেশী হয়েছে এবং ভয়াবহভাবেই তা হয়েছে। মুসলমানদের একটি অংশ নিশ্চিতভাবে পরাজিত হয়ে পলায়ন করেছেন। সেই সময় যুদ্ধের গতি কাফেরদের পক্ষেই ছিলো। কিন্তু এতো কিছু সত্তেও এমন কিছু ব্যাপার রয়েছে, যার কারণে ওহুদের যুদ্ধে কাফেরদের জয় হয়েছে এমন কথা কিছুতেই বলা যায় না। মক্কার সৈন্যরা মুসলমানদের শিবির দখল করে নিতে পারেনি, এটা স্পষ্টতই জানা যায়। মদীনার সৈন্যদের এক বিরাট অংশ ভয়াবহ উথাল-পাথাল অবস্থা ও বিশৃঙ্খলা সত্তেও পলায়ন করেনি। তারা সীমাহীন সাহসিকতা ও দৃঢ়তার সাথে সিপাহসালার আযম রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে সমবেত হয়েছিলেন। মুসলমানদের সংখ্যা এতো কমেনি যে, মক্কার সৈন্যরা তাদের ধাওয়া করতে সক্ষম হবে। তাছাড়া একজন মুসলমানও কাফেরদের হাতে বন্দী হননি। কাফেররা কোন গনীমতেহর মালও হস্তগত করতে পারেনি। উপরন্তু কাফেররা মুসলমানদে সাথে তৃতীয় দফা লড়াই করতে প্রস্তুত হয়নি। অথচ মুসলিম বাহিনী তখনো তাদের শিবিরেই অবস্থানস করছিলেন। কাফেররা যুদ্ধক্ষেত্রে এক দিন ও অবস্থান করেনি। অথচ সেকালে বিজয়ীরা যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের শিবিরে কমপক্ষে তিন দিন অবস্থান করতো। এটাকে যুদ্ধ জয়ের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় নিদর্শন মনে করা হতো। বিজয় সংহত করার প্রমাণ দেয়াই ছিলো এর উদ্দেশ্য। কিন্তু কাফেররা চটপট যুদ্ধক্সেত্র থেকে পতিতাড়ি গুটিয়েছিলো। মদীনা প্রবেশ, অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন বা নাগরিকেদের গ্রেফতার করার মতো সাহসও তাদের হয়নি। অথচ ওহুদ প্রান্তর থেকে অল্প দূরেই ছিলো মদীনা নগরী। মদীনায় তখন নিরাপত্তার ব্যবস্থাও তেমন ছিলো না।
এসকল কতার সারমর্ম হলো, মক্কার কোরায়শ সৈন্যরা একটি সাময়িক সুযোগ পেয়ে মুসলমানদের হতচকিত করে দিতে পেরেছিলো বটে , কিন্তু মুসলিম বাহিনীকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর সবাইকে হত্যা বা বন্দী করে লাভবান হওয়ার অত্যাবশ্যকীয় সামরিক কৌশল তারা প্রয়োগ করতে পারেনি। পক্ষান্তরে মুসলিম সৈন্যরা সাময়িক ক্ষয়ক্ষতির সকল ধকল কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন। বিজয়ীদের এ ধরনের সাময়িক ক্ষতির সম্মুখীন হহেত হয়েছে এরত, উদাহরণ অনেক রয়েছে। কাজেই মুসলমানদের সাময়িক কষ্টকর অবস্থার কারণে ওহুযদের যুদ্ধে কাফেরদের কিছুতেই বিজয়ী মনে করা যায় না।
যুদ্ধের তৃতীয় দফা শুরু না করে আবু সুফিয়ানের মক্কার পথে দ্রুত পলায়ন দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, সে আশঙ্কা করছিলো যে, পুনরায় যুদ্ধ শুরু হলে তার সৈন্যদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি অবধারিত। হামরাউল আছাদ যুদ্ধে আবু সুফিয়ানের ভূমিকায় এরই প্রমাণ পাওয়া যায়।
এমতাবস্থায় ওহুদের যুদ্ধে কোন পক্ষের জয় পরায় হয়েছে, এ কথা না বলে একে একটি অমীমাংসিত যুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করতে পারি। উভয় পক্ষই নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে লাভবান ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন না করে এবং এবং নিজেদের শিবির শত্রুদের নিয়ন্ত্রণের জন্যে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে না রেখে যুদ্ধ বন্ধ করা হয়েছে। এ ধরনের যুদ্ধকেই বলা হয় অমীমাংসিত যুদ্ধ। এদিকে ইয্গিক করেই আল্লাহ তায়ালা রব্বুল আলামীন বলেন, ‘শত্রু সম্প্রদায়ের সন্ধানে তোমরা হতোদ্যম হয়ো না। যদি তোমরা যন্ত্রণা পাও, তবে তারাও তোমাদের মতো যন্ত্রণা পায় এবং আল্লাহর কাছে তোমরা যা আশা করো তারা তা করে না। আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা নেসা, আয়াত ১০৪)
এইা আয়াতে আল্লাহ রব্বুল আলামীন কষ্ট দেয়া এবং তা অনুভব করার ক্ষেত্রে এক বাহিনীকে অন্য বাহিনীর সাথে তুলনা করেছেন। এর অর্থ হচ্ছে, উভয় দলই সমান সমান অবস্থায় ছিলো এবং কেউ কারো ওপর জয়লাভ করেনি।
এ যুদ্ধ সম্পর্কে কোরআনের মূল্যায়ন
পরবর্তী সময়ে কোরআনে এই যুদ্ধের প্রতিটি দিকের ওপর আলোকপাত করা হয়। পর্যালোচনা করে এমন সব কারণ চহ্নিত করা হয়, সেসব কারণে মুসলমানদের এতোবড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। কোরআনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় যে, এই অভিযানে ঈমানদার এবং সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মতদের কি কি দুর্বলতা ছিলো। এই উম্মতকে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত হওয়ার স্বতন্ত্র মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এই উম্মতের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যেকার দুর্বলতা চিহ্নিত করা হয়।
এছাড়া পবিত্র কোরআন মোনাফেকদের ভূমিকা উল্লেখ করে তাদের অবস্থা খোলাখুলি প্রকাশ করেছে। তাদের অন্তকরণে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের বিরদ্ধে লুকিয়ে থাকা শত্রুতার প্রকাশ করে তাদের মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছে। সহজ সরল মুসলমানদের মধ্যে মোনাফেক এবং তাদের সাথী ইহুদীরা যেসব প্ররোচনা চালিয়েছে তাও তুলে ধরা হয়েছে। এরপর এই যুদ্ধের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্য তুলে ধরা হয়েছে।
এই যুদ্ধ সম্পর্কে সূরা আলে ইমরানের ৫০টি আয়াত নাযিল হয়েছে। সর্বাগ্রে যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘স্মরণ করো যখন তুমি তোমার পরিজনবর্গের কাছ হতে প্রত্যুষে বের হয়ে যুদ্ধের জন্যে মোমেনদের ঘাঁটি স্থাপন করছিলে এবং আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।’ (সূরা আলে এমরান, আয়াত ১২১)
পরিশেষে এই অভিযানের ফরাফল ও হেকমত সম্পর্কে সুবিন্যস্তভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন, ‘অসৎকে সৎ হতে পৃথক করা পর্যন্তহ তোমরা যে অবস্থায় রয়েছ, আল্লাহ তায়ালা মোমেনদের সেই অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না। অদৃশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তোমাদেরকে অবহিত করবার নন, তবে আল্লাহ তাঁর রসূলদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন। ‘সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের ওপর ঈমান আন। তোমরা ঈমান আনলে ও তাকওয়া অবলম্বন করে চললে তোমাদের জন্যে মহাপুরস্কার রয়েছে।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৭৯)
এই যুদ্ধে আল্লাহ সন্নিহিত হেকমত
আল্লামা ইবনে কাইয়েম উল্লিখিত বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা করেছেন।[যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৯৯-১০৮
(সাইয়েদ কুতুব শহীদ তার মহান তাফসীর ‘ফী যিলালির কোরআনে’- ও এ পর্যায়ে এক হৃদয়গ্রাহী আলোচনা পেশ করেছেন। বাংলা অনুবাদের ৪র্থ খন্ড দেখুন)]
ওলামায়ে কেরাম বলেন, ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের যে সঙ্কট ও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েডিছলো, এর মধ্যে আল্লাহর হেকমত লুকায়িত ছিলো। যেমন, মুলমানদের তাদের কাজের মন্দ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া। তীরন্দাজদের নিজেদের অবস্থানস্থলে অবিচল থাকার যে নির্দেশ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিয়েছিলেন, তারা তা লংঘন করেছে। এ কারণেই তাদের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। এছাড়া পয়গাম্বরের কাছে সেই সুন্নতের কথা প্রকাশ করাও উদ্দেশ্য যে, প্রথমে তারা পরীক্ষার সম্মুখীন হন, এরপর সফলতা লাভ করেন। যদি মুসলমানরা সব সময় জয়লাভ করতে থাকে, তাহলে ঈমানদারদের মধ্যে এমন লোকও প্রবেশ করবে, যারা প্রকৃত ঈমানদার নয়। এর ফলে সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর মধ্যে পার্থক্য করা সম্ভব হবে না। এদিকে যদি সব সময় পরাজয়ের সম্মখীন তারা হয়, তাহলে আল্লাহর নবীর আবির্ভাবের উদ্দেশ্যেই ব্যর্থ হয়ে যাবে। এ কারণে আল্লাহর হেকমতের কারণেই উভয়রকম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে সত্য মিথ্যার পার্থক্য নিরূপিত হতে পারে। কেননা মোনাফেকদের নেফাক মুসলমানদের মধ্যে লুকায়িত রয়েছে। এই ঘটনা প্রকাশ এবং কথা ও কাজের মাধ্যমে মোনাফেকদের পরিচয় পাওয়ার পর মুসলমানরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাদে ঘরের ভেতরেই শত্রু রয়েছে। এতে মুসলমানরা তাদের ব্যাপারে সতর্ক হন এবং মোকাবেলার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
একটা হেকমত এটাও ছিলো যে, অনেক সময় সাহায্য আসতে দেরী হলে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। মুসলমানরা পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার পর ধৈর্য ধারণ করেন। অথচ মোনাফেকদের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে যায় এবং তারা আহাযারি শুরু করে।
একটা হেকমত এটাও ছিলো যে, আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদের জন্যে মর্যাদার বাসস্থান জান্নাতে এমন কিছু শ্রেণী রেখেছেন যেসকল শ্রেণীতে স্বাভাবিক আসনের সওয়ারীর মাধ্যমে উন্নীত হওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে বিপদ-মুসিবতের কিছু উপকরণ তৈরী করে রাখা হয়েছে যাতে, ঈমানদাররা সেই মর্যাদার শ্রেণীতে উন্নীত হতে পারেন।
এছাড়া একটা হেকমত এটাও ছিলো যে, আউলিয়া অর্থাৎ আল্লাহর বন্ধদের জন্যে উচ্চতর মর্যাদা যে শাহাদাত, সেই মর্যাদা তাদের দান করা।
একটা হেকমত এটাও ছিলো যে, আল্লাহ রব্বুল আলামীন চন যে, তাঁর দুশমনরা ধ্বংস হোক, এ কারণে তাদের জন্যে ধ্বংসের উপকরণও সৃষ্টি করেছেন। কুফুরী, যুলুম, অত্যাচার এবং আউলিয়ায়ে কেরামকে কষ্ট দেয়ার ক্ষেত্রে তারা সীমাহীন ঔদ্ধত্য এবং বাড়াবাড়ির পরিচয় দিয়েছে। তাদের এসব আমলের পরিণামে ঈমানদারদের ধৈর্য সহিষ্ণুতায় খুশী হয়ে আল্লাহ পাক ঈমানদারদের পাকসাফ এবং কাফেরদের ধ্বংস করে দিয়েছেন।[ফতহুল বারী, ৭ম খন্ড, পৃ. ৩৪৭]
অহুদের পরবর্তী সামরিক অভিযান
মুসলমানদে সুখ্যাতির ওপর ওহুদের যুদ্ধের আপাতত পরায় গভীর প্রবাব বিস্তার করলো। ইসলামের শত্রুদের মনে তাদের প্রভাব হ্রাস পেলো। এর ফলে ঈমানদারদের আভ্যন্তরীণ ও বাইরের সমস্যা বেড়ে গেলো। মদীনার ওপর চারদিক থেকে হামলার আশঙ্কা বেড়ে গেলো। ইহুদী, মোনাফেক এবং বেদুইনরা প্রকাশ্য শত্রুতা শুরু করলো। সকল দলের পক্ষ থেকে মুসলমানদের কষ্ট দেয়ার চেষ্টা চলতে লাগলো। তারা এ ধরনের প্রত্যাশাও ব্যক্ত করলো যে, ইচ্ছ করলে তারা মুসলমানদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। ফলে ওহুদের যুদ্ধের পর দুই মাস যেতে না যেতেই বনু আছাদ গোত্রের লোকেরা মদীনায় হামলা করার উদ্যোগ গ্রহণ করলো। চতুর্থ হিজরীর সফর মাসে আদল এবং কারাহ গোত্রের লোকেরা এমন এ ষড়যন্ত্র করলো যে, দশজন সাহাবীকে শাহাদাত বরণ করতে হলো। সেই মাসেই বনু আমের গোত্রের নেতার এক প্রতারণার ফলে ৭০ জন সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। এই দুর্ঘটনা বীরে মাউনার দুর্ঘটনা নামে পরিচিত। এই সময়ে বনও নাযির গোত্রের লোকেরাও প্রকাশ্য শত্রুতা শুরু করলো। তারা চতুর্থ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শহীদ করার চেষ্টা করলো। এদিকে বনু গাতফান গোত্রের দুঃসাহস এতা বেড়ে গিয়েছিলো যে, তারা চতুর্থ হিজরীর জমাদিউল আউয়াল মাসে মদীনায় হামলা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করলো।
মোটকথা মুসলমানদের প্রভাব ওহুদের যুদ্ধে ক্ষুণ্ণ হয়েছিলো দার ফলে দীর্ঘকাল যাবত তারা ছিলো আশঙ্কার সম্মুখীন। কিন্তু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কর্মকুশলতার কারণে মুসলমানদের মর্যাদা ও প্রভাব ফিরে আসে। এক্ষেত্রে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রথম পদক্ষেপ ছিলো হামরাউল আছাদ পর্যন্ত মোশরেকদের ধাওয়া করার ঘটনা। এতে মুসলিম মোহাজেরদের সম্মান বহুলাংশ পুনরুজ্জীবিত হয়। এই সামরিক পতক্ষেপে ইসলামবিরোধী শক্তি বিশেষত মোনাফেকরা হতভম্ব হয়ে যায়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর পর্যায়ত্র, এমন ধরনের সামরিক তৎপরতা শুরু করেন যার দ্বারা মুসলমানরা শুধু পুর্বের হৃত মর্যাদা ফিরেই পায়নি বরং তা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। পরবর্তী পাতাগুলোতে সে বিষয়েই আলোকপাত করবো।
এক) ছারিয়া’য়ে আবু সালমা
ওহুদের যুদ্ধের পর মুসলমানদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম বনু আছাদ ইবনে খোজাইমা গোত্র মাথা তুলে দাঁড়ায়। এ সম্পর্কে মদীনায় খবর পৌছছে যে, খোয়াইলেদের দুই পুত্র তালহা এবং সালমা তার গোত্র এবং অন্যান্য সাথীদের নিয়ে বনু আছাদ গোত্রকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর হামলার আয়োজন করছিলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অল্প সময়ের মধ্যে দেড়শত আনসার ও মোহাজেরের সমন্বয়ে একটি বাহিনী তৈরী করেন। হযরত আবু সালমা (রা)-কে সেই বাহিনীর অধিনায়কত্ব প্রদান করা হয়। বনু আছাদ গোত্র হয়ে অভিযান শুরুর আগেই হযরত আবু সালমা (রা) তাদের ওপর এমন অতর্কিত হামলা করেন যে, তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। তাঁদের মুখোমুখি সংঘর্ষই অবতীর্ণ হতে হয়নি। মুসলমানরা তাদের উট এবং বররির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। গনীমতের মালসহ নিরাপদে তারা মদীনায় ফিরে আসেন। চতুর্থ হিজরীতে মহররমের চাঁদ উদয়ের রাতে মুসলমানরা যাত্র শুরু করেন। মদীনায় ফেরার পর হযরত আবু সালমা (রা) গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওহুদের যুদ্ধে তিনি আহত হয়েছিলেন সেই ক্ষতযন্ত্রণা বেড়ে যায় এবং কিছু দিন পরেই তিনি ইন্তেকাল করেন।[যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ১০৮]
আবদুল্লাহ বিন উনাইস (রা) মদীনার বাইরে ১৮দিন অবস্থানের পর মোহররমের ২৩ তারিখে প্রত্যাবর্তন করেন। আসার সময় তিনি খালেদকে হত্যা করে তার মাথা সঙ্গে নিয়ে আসেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে উপস্থিত হয়ে তিনি সেই মাথাটি তাঁর সামনে রাখলে তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হাতে একটি লাঠি দিয়ে বলেন, এটি কেয়ামতের দিন আমার ও তোমার মাঝে একটি নিদর্শন হয়ে থাকবে। যখন তাঁর মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলো তখন তিনি সেই লাঠিটিকে তাঁর লাশের সঙ্গে কবরে দিতে ওসিয়ত করেন।[ যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ১০৯। ইবনে হিশাম ২য় খঃ ৬১৯ ও ৬২০ পৃষ্ঠা।]
দুই) রাজীর ঘটনা
চতুর্থ হিজরীর সফর মাসে ‘আযল এবং কারা’ গোত্রের কয়েক ব্যক্তি রসূলুল্লা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে উপস্থি হয়ে অনুরোধ করে যে তাদের মধ্যে ইসলামের কিছু চর্চা হচ্ছে। কাজেই তাদের কোরআন ও দ্বীন শিক্ষাদানের জন্যে কয়েকজন সাহাবী (রা)-কে সেখানে পাঠানো দরকার। সেই মোতাবেক ইবনে ইসহাকের মতে ছয় এবং সহীহ্ বোখারীর মতে দশজন সাহাবাকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সঙ্গে পাঠান। ইবনে ইসহাকের মতে মুরশেদ ইবনে আবি মুরশেদ গানাভীকে এবং সহীহ বোখারীর বর্ণনা মতে আসেম বিন ওমর বিন খাত্তাবের নানা হযরত আসেম বিন সাবেকতে দলনেতা বানানো হয়। এরা যখন রাবেগ এবং জেদ্দাহর মধ্যবর্তী স্থানের হোযাইল গোত্রের ‘রাজী’ নামক ঝর্ণার কাছে পৌছুলেন তখন আযল এরবং কারার উল্লিখিত ব্যক্তিরা হোযাইল গোত্রের শাখা বানু লেহয়ানকে তাদের উপর হামলা চালাতে লেলিয়ে দেয়।
সেই গোত্রের একশত তীরন্দাজ সাহাবাদের তালাশ করতে থাকে।
তিন) আবদুল্লাহ ইবনে উনাইসের অভিযান
চতুর্থ হিজরীর মহররমের ৫ তারিখে মদীনায় খবর আসে যে, খালেদ ইবনে সুফিয়ান হুযালী মুসলমানদের ওপর হামলা করতে সৈন্য সংগ্রহ করছে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস (রা)-কে প্রেরণ করেন।
আবদুল্লা ইবনে উনাইস (রা) মদীনা থেকে ১৮ দিন বাইরে অবস্থান করেন। এসময় তারা হোজাইল গোত্রের একটি শাখা বনু লেহইয়ানকে তাঁদের ওপর লেলিয়ে দেয়। ফলে বনু লেহইয়ান গোত্রের প্রায় একশত তীরন্দাজ তাঁদের ওপর চড়াও হয়। সাহাবার একটি টীলার ওপর আশ্রয় নেন। তীরন্দাজরা তাঁদে ঘিরে ফেলে এবং বলে যে, আমরা তোমাদের সাধে অঙ্গীকার করছি যে, যদি তোমরা নীচে নেমে আসো তবে আমরা তোমাদের কাউকে হত্যা করবো না। ইবনে উনাইস (রা) অবতরণ করতে অস্বীকৃতি জানান এবং সঙ্গীদের নিয়ে তাদের সাথে যুদ্ধ শুরু করেন। তীব্র তীর বৃষ্টিতেহ সাতজন সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। বাকি তিনজন তখনো বেঁচেছিলেন। এঁরা হচ্ছেন হযরত খোয়েব (রা) হযরত যায়েদ ইবনে দাছানা এবং অন্য একজন, বনু লেহইয়ান গোত্রের তীরন্দাজরা তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে এদের নীচে নেমে আসার অনুরোধ জানান। অনন্যোপায় তিনজন সাহাবী নীচে নেমে আসেন। তাদের নিয়ন্ত্রণে পাওয়ার সাথে সাথে তারা সাহাবী তিনজনকে বেঁধে ফেলে। এতে উল্লিখিত তৃতীয় সাহাবী বললেন, তোমরা তো প্রথমেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছ, আমি তোমাদের সঙ্গে কিছুতেই যাব না। এতে তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এতেও ব্যর্থ হওয়ায় তারা তাঁকে হত্যা করে। হযরত খোবায়েব এবং হযরত যায়েদ ইবনে দাছানাকে মক্কায় নিয়ে বিক্রি করে দেয়। এই দুই সাহাবী বদরের দিনে মক্কায় কাফের সরদারদের হত্যা করেছিলেন। হযরত খোবায়েব (রা) কিছুদিন আটক থাকেন। মক্কার দুর্বৃত্তরা এরপর তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং হরম-এর বাইরে তানঈম নামক জায়গায় নিয়ে যায়। শূলীতে উঠানোর সময়ে তিনি বলেন, আমাকে ছেড়ে দাও। দুই রাকাত নামায আদায় করবো। পৌত্তলিকরা ছেড়ে দেয়। তিনি দুই রাকাত নামায আদায় করেন। ছালাম ফেরানোর পর তিনি বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, যদি আশঙ্কা না করতাম যে, তোমরা বলাবলি করবে, আমি যা কিছু করছি ভয়ের কারণে করছি, তবে নামায আরো কিছু দীর্ঘায়িত করতাম।’ এরপর বললেন, হে আল্লাহ তায়ালা, ওদেরকে গুণে নিন, এরপর ওদেরকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মারুন এবং ওদের একজনকেও ছাড়বেন না। হযরত খোবায়েব (রা) এরপর কবিতা আবৃত্তি করেন,
‘ওরা সবাই দলে দলে আমায় ঘিরে রাখলো।
গোত্রে গোত্রে জড়ো হলো, কেউ বাকি না থাকলো।
নারী শিশু থাকলো না কেউ এলো দলে দলে
আমায় ওরা নিয়ে এলো বড়ো গাছের তল্
স্বদেশে থেকে দূরে আজ আমি সহায়হীন
তোমার কাছেই ফরিয়াদ, রব্বুল আলামীন!
আরশের মালিক দিয়ো ধৈর্যশীল অন্তর
মনোদৈহিক সাহস আমায় দিয়ো প্রভু নিরন্তর।
বললো ওরা কাফের হতে, ঢের ভালো মরণ
অশ্রুবিহীন ডুকরে কাঁদে আমার দু‘নয়ন।
মুসলিম হয়ে মরতে যাচ্ছি আমার কিসের ভয়
আল্লাহর পথে মরবো যখন চাই না দিক নির্ণয়।
আল্লাহ পাকের খুশীর জন্যে আমার শাহাদাত।’
হযরতের খোবায়েরের (রা) কবিতা আকৃত্তি শেষ হলে আবু সুফিয়ান তাকে বললো, তুমি কি চাও যে, তোমার পরিকর্দে আমরা মোহাম্মদকে ধরে নিয়ে আসি, তাঁর শিরশ্ছেদ করি এবং তুমি তোমার পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে যাও? হযরত খোবায়ের (রা) দৃঢ়তার সাথে বললেন, আল্লাহর শপথ, পরিবারপরিজনের কাছে আমার থাকার বিনিময়ে মোহাম্মদ (সা)-এর পায়ে একটা কাঁটা বিঁধবে এবং তিনি যেখানে আছেন সেখানে বসেও সেই কাঁটা বিদ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা ভোগ করবেন, এটাও আমর পছন্দ নয়।
আল্লাহর দুশমন পৌত্তলিরা এরপর হযরত খোবায়েব (রা)-কে শুলীতে ঝুলায় এবং তার লাশ পাহারা দেয়ার জন্যে লোক নিয়োগ করে। হযরত আমর ইবনে উমাইয়া এসে রাত্রিকালে লাশ তুলে দাফন করেন। হযরত খোবায়েবকে (রা) ওকবা ইবনে হারেস হত্যা করেছিলো। বদরের যুদ্ধে তার বাবাকে হযরত খোবায়েব (রা) হত্যা করেছিলেন।
সহীহ বোখারী শরীফে উল্লেখ রয়েছে যে, হযরত খোবায়েব (রা) হচ্ছেন প্রথম বুজুর্গ, যিনি মৃত্যুদন্ডের পূর্বক্ষণে দুই রাকাত নামায আদায়ের রীতি প্রবর্তন করেন। কাফেরদের হাতে বন্দী থাকাকালে তাকে তাজা আঙ্গুর খেদে দেখা গেছে। অথচ সেই সময় মক্কায় খেজুরও পাওয়া যেতো না।
গ্রেফতারকৃত অপর সাহবী হযরত যায়েদ ইবনে দাছানা (রা)-কে সফওয়ান ইবনে উমাইয়া ক্রয় করে এবং তার পিতার হত্যার বদলে হত্যা করে।
হযরত আসেম (রা) এর আগেই কাফেরদের তীর বর্ষণে নিহত হয়েছিলেন। মক্কার কোরায়শরা হযরত আসেমের (রা) দেহের কোনো অংশ হলেও নিয়ে আসার জন্যে লোক পাঠালো। কেননা বদরের যুদ্ধে কাফেরদের একজন বিশিষ্ট নেতাকে তিনি হত্যা করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মৌমাছির ঝাঁক পাঠিয়ে তাঁর লাশ হেফাযক করেন। ফলে কাফেররা হযরত আসেম (রা)-এর পবিত্র লাশের সামান্য অংশও নিতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে হযরত আসেম (রা) আল্লাহর কাছে এ আবেদন করে রেখেছিলেন যে, তাকে যেন কোন মোশরেক স্পর্শ করতে না পারে এবং তিনও যেন কোন মোশরেককে স্পর্শ না করেন। পরবর্তী সময়ে এই ঘটনা শোনার পর হযরত ওমর (রা) প্রায়ই বলতেন, আল্লাহ রব্বুল আলামীন মোমেন বান্দার হেফাযত তার ইন্তেকালের পরেও ঠিক সেই রকমই করেন, যেমন করে থাকেন জীবদ্দশায়।[ ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ৬৯-৭৯, যাদুল মায়দ ২য় খন্ড, পৃ. ২০৯. সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৬৮, ৫৬৯ ৫৮৫]
চার) বীরে মাউনার মর্মন্তুদ ঘটনা
রাজিই এর ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সেই মাসেই ঘটেছিলো বীরে মাউনার ঘটনাও। রাজিঈ এর ঘটনার চেয়ে এ ঘটনাও কম মর্মন্তুদ নয়। এ ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই, আবু বারা আমের ইবনে মালেম মদীনায় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাযির হলো। সে ‘মালায়েকুল আসনা’ অর্থাৎ বর্শা খেলোয়ার উপাধিতে ভূষিত ছিলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হাযির হওয়ার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ইসলামের দাওয়াত দেন। কিন্তু সে ইসলাম গ্রহণ করেনি এবং ইসলাম যে তার অপছন্দ এ কথাও বলেনি। সে বললো, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আপনি যদি আপনার সাহাবাদেরকে নজদের অধিবাসীদের কাছে প্রেরণ করেন, তবে আমর বিশ্বাস, তারা ইসলামের দাওয়াত কবুল করবে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমার সাহাবাদের ব্যাপারে নজদের অধিবাসীদের আমার সন্দেহ হয়। আবু বারা বললো, তারা আমার আশ্রয়ে থাকবেন। একথার পর আল্লাহর রসূল ইবনে ইসহাকে বর্ণনা মোতাবেক ৪০ জন সাহাবাকে আবু বারা’র সাথে প্রেরণ করেন। ইমাম বোখারী সহীহ বোভারীতে যে ৭০ জন সাহাবীর কথা বলেছেন, সেই বর্ণনাই সত্য। সেই ৭০ জন সাহাবীর আমীর নিযুক্ত করা হয়েছিলো মুনযার ইবনে আমরকে। তিনি বনু সায়েদা গোত্রের অধিবাসী এবং মুতাকলির মউত উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। উল্লিখিত ৭০ জন সাহাবীর মধ্যে সকলেই ছিলেন ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে যথেষ্ট ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন এবং অত্যন্ত পরহেযগার। তাঁরা দিনের বেলায় কাঠ কেটে সেই টাকায় আহলে সোফফার অধিবাসীদের জন্যে খাবার ক্রয় করতেন, নিজেরা কোরআন পড়তেন এবং অন্যদেরও পড়াতেন। রাত্রিকালে কারা আল্লাহ রব্বুল আলামীনে সামনে মোনাজাত ও নামাযে কাটিয়ে দিতেন। পথ চলতে চলতে ইসলামের দাঈ এ ৭০ জন সাহাবা মাউনার জলাশয়ের কাছে গিয়ে পৌঁছুলেন। এই জলাশয় বনু আমের এবং হোররা বনি সালিমের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত। সেখানে পৌঁছার পর পরই সাহাবারা উম্মে সুলাইমের ভাই হারাম ইবনে মালহানের হাতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রেরিত চিঠি ইসলামের কট্টর দুশমন আমের ইবনে তোফায়েলের কাছে পাঠালেন। এই দুর্বৃত্ত রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র টিঠিখানি খুলেও দেখেনি বরং একজন লোককে ইশারা করলো। সেই লোকটি হযরত হারাম ইবনে মালহান (রা)-এর পেছন দিক থেকে এত জোরে বর্শা দিয়ে আঘাত করলো যে, বর্শার ফলা সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। রক্ত দেখে হযরত হারাম ইবনে মালহান (রা) বললেন, আল্লাহু আকবর, কাবার প্রভুর কসম, আমি কামিয়াব হয়ে গেছি।
এর কিছুক্ষণ পরই দুশমনে খোদা কট্টর, দুর্বৃত্ত, কাফের আমের ইবনে তোফায়েল অন্য সাহাবাদের ওপর হামলা করতে তার গোত্র বনি আমের-এর লোকদের আওয়ায দিলো। কিন্তু তারা আবু বারা’র আশ্রয়ের কারণে আমেরের ডাকে সাড়া দেয়নি। এদিক থেকে হতাশ হয়ে আমের বনি সালিম গোত্রের লোকদের আওয়ায দিলো। বনি সালিমের তিন শাখা আছিয়্যা বাআল এবং জাকোয়ান সে ডাকে সাড়া দিয়ে সাহাবায়ে কেরামকে এসে ঘেরাও করলো। প্রতুত্তরে সাহাবারাও লড়াই করলেন। কিন্তু তাঁরা প্রায় সবাই শহীদ হয়ে গেলেন। হযরত কা’ব ইবনে যায়েদ নাজ্জার (রা) শুধু জীবিত ছিলেন। তাঁকে শাহাদাতপ্রাপ্ত সাহাবাদের মধ্য থেকে আহত অবস্থায় তুলে নেয়া হয়। তিতন খন্দকের যুদ্ধ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। হযরত আমর ইবনে উমাইয়া জামারি একা হযরত মোনযার ইবনে ওকবা আমেরের (রা) উট চরাচ্ছিলেন। তারা ঘটনাস্থলে পাখীর উড্ডয়ন দেখে সেখানে পৌছালেন। হযরত মোনযার (রা) তার বন্ধদের সাথে লড়াই করতে করতে শহীদ হন। হযরত আমের ইবনে উমাইয়া জামারিকে বন্দী করা হয়। তিনি ছিলেন মোদার গোত্রের লোক। এই পরিচয় পাওয়ার পর আমের ইবনে তোফায়েল তাঁর কপালের উপরে দিকের কিছু চুল কেটে তার মায়ের পক্ষ থেকে তাকে মুক্ত করে দেয়। এই দুর্বৃত্তের মা একজন ক্রীতদাসকে মুক্ত করে দেবে বলে ইতিপূর্বে মানত করেছিলো।
হযরত আমর ইবনে উমাইয়া জামারি এই হৃদয় বিদারক খবর নিয়ে মদীনায় পৌছলেন। ৭০ জন বিশিষ্ট সাহাবার শাহাদাতের ঘটনা ওহুদের দুর্বিপাকের ঘটনাই স্মরণ করিয়ে দিরো। ওহুদের যুদ্ধে তো সংঘর্ষে উভয় পক্ষে হতাহত হওয়ার সুযোগ ছিলো, কিন্তু সরল প্রাণ সাহাবারা এখানে নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হন। হযরত আমর ইবনে উমাইয়া জামারি ফেরার পথে কানাত প্রান্তরের কাছে কারকারা নামক জায়গায় পৌঁছে একটি গাছের ছায়াতলে নেমে পড়েন। সেখানে বনু কেলাব গোত্রের দুইজন লোকও এসে হাযির হয়েছিলো। উভয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পর হযরত আমর ইবনে উমাইয়া উভয়কে হত্যা করেন। তাঁর ধারণা মতে তিনি সঙ্গীদের হত্যার প্রতিশোধ নিচ্ছেন। অথচ এই দুইজন লোকের কাছে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে নিরাপত্তামূলক চিঠি ছিলো। কিন্তু হযরত আমর সেকথা জানতেন না। মদীনায় এসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ ঘটনা জানানোর পর তিনি বললেন, তুমি এমন দুইজন লোককে হত্যা করেছো যাদের হত্যার ক্ষতিপূরণ আমাকে অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমান এবং তাদের ইহুদী মিত্রদের কাছে থেকে ক্ষতিপূরণের অর্থ সংগ্রহে মনোনিবেশ করেন।এই ঘটনার কারণেই বনু নাযিরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যে সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হবে।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বীরে মাউনা এবং রাজিঈ-এর ঘটনায় [ওয়াকেদী লিখেছেন, রাজিঈ এবং মাউনা উভয় ঘটনার খবর আল্লাহর রসূল একই রাতে পেয়েছিলেন।] এতো বেশী মর্মাহত হয়েছিলেন এবং এতো বেশী আঘাত পেয়েছিলেন, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।[ ইবনে সা’দ হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর রসূল (সা) বীরে মাউনার ঘটনায় যতোটা মর্মাহত এবং শোকাহত হন, অন্য কোন ঘটনায় ততোটা হননি। মুখতাছারুছ ছিরাত, শেখ আবদুল্লাহ পৃ. ২৬০] উভয় ঘটনার ব্যবধান ছিলো মাত্র কয়েক দিনের। যে সকল কউম ও গোত্র সাহাবায়ে কেরামের সাথে এ ধরনের নিষ্ঠুর বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একমাস যাবত তাদের উপর বদদোয়া করেছিলেন। সহীহ বোখারী শরীফে হযরত আনাস (র) থেকে বর্ণিত আছে যে, বীরে মাউনার যে সকল লোক সাহাবায়ে কেরামকে শহীদ করেছিলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের ওপর ত্রিশ দিন যাবত বদদোয়া করেন। ফজরের নামাযের পর তিনি বাআল, জাকওয়ান, লেহইয়ান এবং ইছাইয়ার জন্যে বদদোয়া করে বলতেন, আছিয়্যা গোত্রের লোকেরা আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূলের নাফরমানি করেছে। আল্লাহ তায়ালা এই সম্পর্কে তাঁর রসূলের মনোবেদনা দূর কবরতে কোরআনের আয়াত নাযিল করেন। সেই আয়াত পরবর্তী সময়ে মনসুখ অর্থাৎ রহিত হয়ে গেছে। কোরআনে পাকের সেই আঘাতের বক্তব্য ছিলো এই যে, আমাদের স্বজাতীয়দের জানিয়ে দাও যে, আমাদের প্রতিপালকের সাথে আমরা এমন অবস্থায় দেখা করেছি যে, তিনি আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং আমরাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট।
এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর থেকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদদোয়া দেয়া বন্ধ করেন।[ সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, ৫৮৬, ৫৮৭, ৫৮৮]
পাঁচ) বনু নাযিরের যুদ্ধ
ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইহুদীরা ইসলাম এবং মুসলমানের নামে জ্বলতো, পুড়তো। কিন্তু তারা বীর যোদ্ধা ছিলো না, ছিলো ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকারী। এ কারণে তারা যুদ্ধের পরিবর্তে ঘৃণা এবং শত্রুতা প্রকাশ করতো। তারা মুসলমানদের সাথে চুক্তি ও অঙ্গীকার সত্তেও তাদের কষ্ট দিতেও তাদের ওপর নির্যাতন চালাতে নানা প্রকার অজুহাত খুঁজে বেড়াতো। বনু কাইনুকা গোত্রের বহিষ্কার এবং কাব ইবনে আশরাফের হত্যাকান্ডের পর ইহুদীদের সাহস কমে যায়। তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে চুপচাপ থাকে। কিন্তু ওহুদের যুদ্ধের পর তাদের সাহস ফিরে আসে। তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য শত্রুতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা করতে শুরু করে। মদীনার মোনাফেকরা মক্কার মোশরেকদের সাথে গোপনে গাঁটছড়া বাঁধে এবং ইহুদীরা মোশরেকদের সহায়তা করতে থাকে।[সুনানে আবু দাউদ শরহে আওনুল মাবুদ ৩য় খন্ড, পৃ. ১১৬, ১১৭]
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব কিছু জেনেও ধৈর্য ধরেন। কিন্তু রাজিঈ এবং মাউনার দুর্ঘটনার পর তাদের সাহস বহুলাংশে বেড়ে যায় এবং তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শেষ করে দেয়ার কর্মসূচী গ্রহণ করে। ঘটনার বিবরণ এই, আল্লাহর রসূল হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কয়েকজন সাহাবাকে সঙ্গে নিয়ে ইহুদীদের কাছে গমন করেন। তাদের সাথে বনু কেলাবের নিহত দুই ব্যক্তির মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে আলোচনা করেন, যাদেরকে হযরত আমর ইবনে উমাইয়া জামারি ভুলক্রমে হত্যা করেছিলেন। ইহুদীদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী হত্যার উল্লিখিত ক্ষতিপূরণে মুসলমানদের সহায়তা করতে তারা বাধ্য ছিলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সেকথা বলা পর তারা বললো, হে আবুল কাসেম, আমরা তাই করবো। আপনি আপনার সঙ্গীদের নিয়ে এখানে করুন, আমরা ব্যবস্থা করছি। একথার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদীদের একটি দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে অপেক্ষা করছিলেন। হযরত আবু বকর (রা) হযরত ওমর (রা) হযরত আলী (রা) এবং অন্য কয়েকজন সাহাবা সেই সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ছিলেন।
ইহুদীরা একটু দূরে যাওয়ার পর তাদের তাঁধে শয়তান সওয়ার হলো। তাদের ভবিষ্যতে দুর্ভাগ্যকে শয়তান সৌভাগ্য হিসেবে দেখালো। ইহুদীরা নিজেদের মধ্যে কুপরামর্শ করলো যে, এই চমৎকার সুযোগ, চলো আমরা মোহাম্মদকে প্রাণে মেরে ফেলি। দেয়ালের ওপার থেকে ভারি চাক্কি ফেলে আল্লাহর রসূলকে মেরে ফেলতে কে রাযি আছে? এটা জানতে চাওয়ায় আমর ইবনে জাহাশ নামে একজন ইহুদী রাজি হলো। সালাম ইবনে মাশকাম নামের একজন ইহুদী বললো, সাবধান, অমন কাজ করো না। আল্লাহর কসম, তোমার ইচ্ছার খবর আল্লাহর রসূল পেয়ে যাবেন। আল্লাহ তায়ালাই তাঁকে খবর দেবেন। তাছাড়া মুসলমানদের সাথে আমাদের যে অঙ্গীকার রয়েছে, তাও লংঘন করা হবে। কিন্তু দুর্বৃত্ত স্বভাব দুর্ভাগা ইহুদীরা কোন কথাই কানে তুললো না তারা নিজেদের অসদুদ্দেশ্য বাস্তবাসয়নে অটল রইলো।
এদিকে রব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় রসূলের কাছে জিবরাইল (আ)-কে প্রেরণ করলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্রুত সেই জায়গা থেকে উঠে মদীনার পথে রওয়ানা হলেন। সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে অনুসরণ করে তাঁকে বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনি এতো দ্রুত চলে এলেন যে, আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, কুচক্রী ইহুদীদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সাহাবাদের অবহিত করলেন।
মদীনা ফিরে আসার পর রসীল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোহাম্মদ ইবনে মোসলেমকে বনু নাযির গোত্রের কাছে প্রেরণ করেন এবং তাদের এ নোটিশ দেন যে, তোমরা অবিলম্বে মদীনা থেকে বেরিয়ে যাও। এখানে তোমরা আমাদের সাথে থাকতে পারবে না। তোমাদের দশ দিনের ময় দেয়া যাচ্ছে। এরপর যাদের পাওয়া যাবে, তাদের শিরশ্ছেদ করা হবে। এই নোটিশ পাওয়ার পর ইহুদীরা বহিষ্কার হওয়া ব্যতীত অন্য কোন উপায় খুঁজে পেলো না। কয়েক দিনের সফরের প্রস্তুতি তারা শুরু করলো। কিন্ত মোনাফেক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইহুদীদের খবর পাঠালো যে, তোমরা নিজের জায়গায় অটল থাকো, বাড়ীঘর ছেড়ে যেয়ো না। আমর নিয়ন্ত্রণে ২ হাজার যোদ্ধা রয়েছে যারা তোমাদের দুর্গে প্রবেশ করবে। এরা তোমাদের সাথে বেরিয়ে যাবে। তোমাদের ব্যাপারে কারো হুমকিতে আমরা প্রভাবিত হব না। তোমাদের সাথে যুদ্ধ করা হলে আমরা তোমাদের সাহায্য করবো। এছাড়া বনু কোরায়যা এবং বনু গাতফান গোত্র তোমাদের মিত্র, তারাও তোমাদের সাহায্য করবে।
আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মোনাফেকের প্রেরিত এই খবরে ইহুদীরা চাঙ্গা হলো। তারাপ সিদ্ধান্ত নিলো যে, বহিষ্কৃত হওয়ার চেয়ে যুদ্ধ করবে। হইদী নেতা হুয়াই ইবনে আখতার আশা করেছিলো যে, মোনাফেক নেতা তার কথা রাখবে। তাই সে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে খবর পাঠালো যে, আমরা বাড়ীঘর ছেড়ে যাব না। আপনার যা করার, তা করুন।
মুসলমানদের জন্যে এই চ্যালেঞ্জ ছিলো নাযুক এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই পট পরিবর্তনের সময়ে শত্রুদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার পরিণতি সংশয়মুক্ত ছিলো না। বিপজ্জনক পরিস্থিতি যে কোন সময় সৃষ্টি হতে পারে। সমগ্র আরব ছিলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। মুসলমানদের দু’টি তাবলীগী প্রতিনিধিদলকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। বনু নাযির গোত্রের ইহুদীরা এতো বেশী শক্তিশালী ছিলো যে, তাদের অস্ত্র সমর্পণ করানো সহজ কাজ ছিলো না। এছাড়া তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ঝুঁকি নেয়াও ছিলো বিপজ্জনক। বীরে মাউনা এবং তার আগের মর্মান্তিক ঘটনার পর মুসলমানরা হত্যা, বিশ্বাসঘাতকতা ইত্যাদি অপরাধ সম্পর্কে অনেক বেশী সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। এ ধরনের অপরাধে মুসলমানরা মানসিকভাবে জর্জরিত এবং বিরক্ত ছিলেন। ফলে এ কারণে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, বনু নাযির যেহেতু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে, একারণে তাদের সাথে লড়াই করতেই হবে- পরিণাম যাই হোক না কেন। তাই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুয়াইন ইবনে আখাতারের পয়গাম পাওয়ার সাথে সাথে সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহু আকবর বলে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়ে যান। এ সময়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাকতুমকে মদীনার দেখাশোনার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। এরপর সাহাবায়ে কেরামসহ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনু নাযিরের বসতি এলাকা অভিমুখে রওয়ানা হন। হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা)-এর হাতে পতাকা দেয়া হয়েছিলো। বনু নাযিরের এলাকায় গিয়ে তাদের অবরোধ করা হয়।
এদিকে বনু নাযির তাদের দুর্গের ভেতর আশ্রয় নিয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। দুর্গদ্বার বন্ধ করে দিয়ে তারা তীর ও পাথর নিক্ষেপ করতে শুরু করে। ঘন খেজুরের বাগানগুলো তারা ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছিলো, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক সময় আদেশ দিলেন যে, খেজুর গাছগুলো কেটে পুড়ে ফেলা হোক। সেদিকে ইঙ্গিত করেই বিখ্যাত করিব হাসসান ইবনে ছাবেত (রা) লিখেছেন,
‘বনু লওয়াই সর্দারদের জন্যে সেতো মামুলী ব্যাপার
দাউ দাউ জ্বলবে অগ্নিশিখা বুয়াইবার বারিধার।’
বুয়াইবা ছিলো বনু নাযির গোত্রের খেজুরের বাগান ঘেরা এলাকা। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন, ‘তোমরা খেজুর গাছগুলো কেটেছ এবং যেগুলি কান্ডের উপর স্থির রেখে দিয়েছ সে তো আল্লাহরই অনুমতিক্রমে। এ কারণেই আল্লাহ রব্বুল আলামীন এ ঘটনার উদাহরণ পেশ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘এদের তুলনা শয়তান, যে মানুষকে বলে, কুফরী করো। তারপর যখন সে কুফুরী করে, শয়তান তখন বলে, তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, আমি জগতসমীহের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।’ (সূরা হাশর, আয়াত ১৬)
অবরোধ দীর্ঘায়িত হয়নি। ছয় সাত রাত, মতান্তরে পনেরো রাত। এই সময়ের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা ইহুদীদের মনে মুসলমানদের প্রবাব ফেলে দেন, তাদের মনোবল নষ্ট হয়ে যায়। তারা স্বেচ্ছায় অস্ত্র সমর্পণ করতে রাজি হয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলে পাঠায় যে, আমরা মদীনা ছেড়েগ চলে যেতে প্রস্তুত রয়েছি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদীদের প্রস্তাব অনুমোদন করেন। তিনি এটাও অনুমোদন করেন যে তারা অস্ত্র ব্যতীত অন্য জিনিসপত্র যতোটা সাথে নিয়ে যেতে পারে, নিয়ে যাবে এবং সপরিবারে মদীনা ত্যাগ করবে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে এ মর্মে অনুমোদন পাওয়ার পর বনু নাযির অস্ত্র সমর্পণ করে এবং নিজেদের হাতে ঘর দোর ভেঙ্গে প্রয়োজনীয় জিনিস বাঁধছাঁদা করতে থাকে। দরজা জানালা যতোটা সম্ভব সঙ্গে নেয়ার ব্যবস্থা করে। কেউ কেউ ছাদের কড়া এবং দেয়ালের খুঁটিও সঙ্গে নিয়ে যায়। এরপর নারী ও শিশুদের উটের পিঠে তুলে মদীনা ছেড়ে চলে যায়। অধিকাংশ ইহুদী খয়বরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এদের মধ্যে হুয়াই ইবনে আখতার এবং সালাম ইবনে আবুল হাকিক নামক বিশিষ্ট ইহুদীরা খয়বরে যায়। একদল সিরিয়ার পথে রওয়ানা দেয়। তবে ইয়ামিন ইবনে আমর এবং আবু সাঈদ ইবনে ওয়াহাব ইসলাম গ্রহণ করে। এ কারণে তাদের জিনিসপত্র মুসলমানরা স্পর্শও করেননি।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শর্তানুযায়ী বনু নাযির গোত্রের অস্ত্রশস্ত্র, জমি, ঘর ও বাগান, নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন। অস্ত্রের মধ্যে ৫০টি বর্ম, ৫০টি খুদ ৩৪০টি তরবারি ছিলো।
বনু নাযির গোত্রের বাগান, জমি, এবং ঘরদোর ছিলো শুধুমাত্র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মালিকানাধীন। নিজের জন্যে রাখা বা কাউকে দান করে দেয়ার ব্যাপারে তাঁর একক অধিকার ছিলো। এ কারণে গনীমতের মালের মতো এইসব সম্পদ থেকে তিনি এক পঞ্চামাংশ বের করে নেননি। কেননা আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় রসূল (সা)-কে এই সম্পদ ‘ফাঈ’ হিসাবে দান করেছেন। মুসলমনারা যুদ্ধ করে এই সম্পদ অর্জন করেননি। বিশেষ ক্ষমতা ও অধিকারের কারণে রসূল (সা) সেই সম্পদ শুধু প্রথম পর্যায়ে হিজরতকারী মোহাজেরদের প্রদান করেন। দুইজন আনসার সাহাবী আবু দোজানা এবং ছহল ইবনে হোনায়েফ (রা)-কে তাদের দারিদ্রের কারণে কিছু সম্পদ প্রদান করা হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের জন্যে সামান্য কিছু সম্পদ রেখে দেন। সেই সংরক্ষিত সম্পদ ব্যয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবন সঙ্গিনীদের সারা বছরের ব্যয় নির্বাহ করতেন।
বনু নাযিরের এই অভিযান ৬২৫ ঈসায়ী সালের ৪ঠা আগস্ট সংঘটিত হয়েছিলো। আল্লাহ তায়ালা এই ঘটনার প্রেক্ষিতে পুরো সূরা হাশর নাযিল করেন। এতে ইহুদীদের দুর্বৃত্তপনার পরিচয় তুলে ধরে মোনাফেকদের স্বরূপ উন্মোচন করা হয়।
‘ফাই’ এর নীতিমালা বর্ণনার পর মোহাজের ও আনসারদের প্রশংসা করা হয় এবং একথাও বলা হয় যে, বণকৌশলের প্রেক্ষিতে শত্রুদের গাছপালা কেটে ফেলা এবং ওতে আগুন ধরিয়ে দেয়া যায়। এ ধরনের কাজ যমিনে ফাছাদ সৃষ্টি করা নয়। এরপর ঈমানদারদের তাকওয়া অর্জন এবং আখেরাতের প্রস্তুতির তাকিদ দেয়া হয়। পরে আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর নিজের হামদ ছানা প্রকাশ এবং নিজের নাম ও গুণবৈশিষ্ট বর্ণনা করে সূরা সমপ্ত করেন।
তাই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেন, এই সূরাকে সূরায়ে বনূ নাযির বলাই সমীচীন।[ ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ১৮৩-১৮৭, যাদুল মায়দ ২য় খন্ড, পৃ. ২০৯, ১১০. সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৮৪, ৫৬৮]
ছয়) নজদের যুদ্ধ
বনু নাযিরের যুদ্ধে কোন প্রকার ত্যাগ তিতিক্ষা ছাড়াই মুসলমানরা প্রশংসনীয় সাফল্য লাভ করেছেন। এতে মদীনায় মুসলমানদের ক্ষমতা আরো মযবুত ও সংহত হয়। মোনাফেকরা হতাশ হয়ে যায় এবং তাদের মুখ কালো হয়ে ওঠে। তারা প্রকাশ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে কোন কাজ করতে সাহস পাচ্ছিলো না। এপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেইসব বেদুইনদের খবর নেয়ার জন্যে সচেষ্ট হন, যারা ওহুদের পর থেকেই মুসলমানদের কঠিন সমস্যায় ফেলে রেখেছিলো। ইসলামের দাঈ বা প্রচারকদের ওপর অত্যন্ত নৃশংসভাবে হামলা করে তাদের জীবন শেষ করে দিয়েছিলো। পরে তাদের সাহস এতো বেড়ে যায় যে, তারা মদীনায় হামলা করার ও চিন্তা করতে থাকে।
বনুনাযিরের যুদ্ধ শেষে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় অবস্থানের অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই খবর পেলেন যে, বনু গাতফানের বনু মাহারেব ও বনু ছালাবা গোত্র মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে বেদুইনদের সমবেত করতে শুরু করেছে। এই খবর পাওয়ার পরপরই রসূলুল্লা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নজওদ অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। নজদ এর প্রান্তর পেরিয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলমানরা বহুদূর অগ্রসর হন। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিলো কঠোর প্রাণ বেদুইনদের মনে ভয় ধরানো, যেন, তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে আগের মতো তৎপরতা পুনরাবৃত্তি করতে সাহসী না হয়।
লুতটরাজ, ডাকাতি, রাহাযানি, হঠকারিতা ইত্যাদিতে অভ্যস্ত ও অভিজ্ঞ বেদুনরা মুসলমানদের এ আকস্মিক অভিযানের খবর শোনামাত্রই ভীত হয়ে পালিয়ে গিয়ে পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। মুসলমানরা এসব লুটেরাদের ওপর প্রভাব বিস্তারের পর মদীনার পথে রওয়ান হন।
যুদ্ধ সম্পর্কে উল্লেখকারীরা এ পর্যায়ে নির্দিষ্ট একটি যুদ্ধের উল্লেখ করেছেন। চতুর্থ হিজরীর রেকা’ যুদ্ধ নামে অভিহিত করা হয়। যতোটা তথ্য প্রামণ পাওয়া যায় তাতে বোঝা যায় যে, সেই সময় নজদের ভেতরেই একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। কেননা মদীনার অবস্থা ছিলো কিছুটা সেই রকম। আবু সুফিয়ান ওহুদ যুদ্ধ থেকে ফিরে এস পরের বছর বদর প্রান্তরে যে যুদ্ধের হুমকি দিয়েছিলো, মুসলমানরা সেই হুমকির চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলো। সেই সময় আবার ঘনিয়ে আসছিলো। বেদুনদেরকে তাদের হঠকারিতা এবং স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে যেতে দিয়ে বদরের মতো অনুরূপ বড় ধরনের কোন যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে মদীনা খালি করে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ ছিলো না। বরং বদরের প্রান্তরে যেরকম ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো, সেই রকম যুদ্ধের জন্যে বেরোবার আগে বেদুনদের বাড়াবাড়ির ওপর আঘাত হানা দরকার, সেই আঘাতের কথা ভেবে ভবিষ্যতে তারা যেন মদীনার ওপর হামলা করার চিন্তা কখনো মনের কিনারায়ও আনতে না পারে।
চতুর্থ হিজরীতে রবিউস সানী বা জমাদিউল আউয়ালে যে যুদ্ধ হয়েছিলো, সেই যুদ্ধ যাতুর রেকা যুদ্ধ নয় বলেই মনে হয়। যতোটা তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে, এতে ওরকম যুদ্ধ সেই সময় হয়নি। কারণ যাতুর রেকা যুদ্ধে হযরত আবু হোরায়রা ( রা) এবং হযরত আবু মূসা আশয়ারী (রা) উপস্থিত ছিলেন। আবু হোরায়রা (রা) খয়বর যুদ্ধের অল্প কয়েকদিন আগে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আবু মুসা আশয়ারী (লা) খয়বরেই আল্লাহর রসূলের খেদমতে হাযির হয়েছিলেন।
৪র্থ হিজরীর বেশ কিছু কাল পরেই যে যাতুর রিকা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো, তার দ্বিতীয় প্রমাণ হচ্ছে এই যে, এতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাওফের নামায [যুদ্ধাবস্থার নামাযকে অওফের নামায বলা হয়। এই নামাযের একটা নিয়ম হচ্ছে এই যে, অর্ধসংখ্যক সৈন্য অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত অবস্থাতেই ইমামের পেছনে নামায পড়বেন, বাকী অর্ধেক সৈন্য অস্ত-সজ্জিত অবস্থায় শত্রুদের প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। এক রাকাত নামাযের পর দ্বিতীয় অর্ধেক ইমামের পেছনে চলে আসবেন এবং প্রথম অর্ধেক শত্রুদের প্রতি দৃষ্টি রাখার জন্য সামনে চলে যাবেন। ইমাম দ্বিতীয় রাকাত পুরো করে নেবেন এবং সেনাবাহিনীর উভয় দল নিজ নিজ নামায পালাক্রমে পুরো করে নেবেন। এর সঙ্গে সঙ্গতিশীল এই নামাযের আরো কয়েকটি নিয়ম রয়েছে, যা যুদ্ধের অবস্থার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে আদায় করা হয়ে থাকে। বিস্তারিত বিবরণ হাদীসের কেতাবসমূহে দেখুন।] আদায় করেছিলেন। খাওফের নামায সর্বপ্রথম আদায় করা হয় গাযওয়ায়ে আসফানে। আর গাযওয়ায়ে আসফান যে খন্দ যুদ্ধের পরে সংঘটিত হয়েছিলো, এতে কোন সন্দেহ নেই। খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো ৫ম হিজরীর শেষ ভাগে। প্রকৃতপক্ষে, গাযওয়ায়ে আসফান ছিলো হোদায়বিয়া সফরের একটি প্রাসঙ্গিক ঘটনা। আর হুদায়বিয়া সফর ছিলো ৬ষ্ঠ হিজরীর শেষ ভাগে। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খায়বর অভিমুখে রওয়ানা হয়েছিলেন। এই সূত্র থেকেও প্রমাণিত হচ্ছে যে, যাতুর রিকা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো খায়বারের যুদ্ধের পরেই।
সাত) বদরের দ্বিতীয় যুদ্ধ
মদীনার আশেপাশের শত্রুদের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে এবং বেদুইনদের দুর্বৃত্তপনা স্তব্ধ করে দেয়ার পর মুসলমানরা বড়ো দুশমন কোরায়শদের সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করলেন। কেননা খুব দ্রুত বছর শেষ হয়ে যাচ্ছিলো এবং ওহুদের সময়ে নির্ধারণ করা সময়ও খুব দ্রুত এগিয়ে আসছিলো। রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার কওমের সাথে যুদ্ধ করে হয়ে তাদের বুঝিয়ে দেয়া যে, মুসলমানরা দুর্বল নয়। এছাড়া এই যুদ্ধে হেদায়াতপ্রাপ্ত ও বিশ্ব স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারী দলই টিকে থাকার যোগ্য বিবেচিত হবে। পরিস্থিতিও থাকবে তাদেরই অনুকূলে।
চতুর্থ হিজরীর শাবান মাস অর্থাৎ ৬২৬ হিজরীর জানুয়ারী মাসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহার ওপর মদীনার দায়িত্বভার ন্যস্ত করে পরিকল্পিত যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বদর অভিমুখে রওয়ানা হন। তাঁর সাথে ছিলো দেড় হাজার মোজাহেদ এবং দশটি ঘোড়া। সেনাবাহিনীর পতাকা হযরত আলীর (রা) হাতে প্রদান করা হয়। বদরের প্রান্তরে পৌঁছে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলমানরা শত্রুর জন্যে অপেক্ষা করতে থাকেন।
অন্যদিকে আবু সুফিয়ান পঞ্চাশটি সওয়ারীসহ দুই হাজার পৌত্তলিক সৈন্যের এক দল নিয়ে মরওয়ানা হয় এবং মক্কা থেকে এক প্রান্তর দূরবর্তী মাররাজ জাহারানের মাজনা নামের বিখ্যাত জলাশয়ের তীরে তাঁবু স্থাপন করে। কিন্তু মক্কা থেকে রওয়ানা হওয়ার সময় থেকেই আবু সুফিয়ানের মন ছিলো ভীতবিহ্বল। ইতিপূর্বে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করে কি লাভ হয়েছে? আবু সুফিয়ান অতীত অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করতে লাগলো। মুসলমানদের বীরত্ব ও ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা ভেবে আবু সুফিয়ান এগোতে সাহস পাচ্ছিলো না। মাররাজ জাহরান নামক জায়গায় পৌঁছে তার মনোবল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেলো। সে মক্কায় ফিরে যাওয়র বাহানা খুঁজতে শুরু করলো। অবশেষে সঙ্গীদের সে বললো, শোনো সঙ্গীরা যুদ্ধ তো সেই সময় করা যায়, যখন প্রাচুর্য থাকে। ঘাস থাকে প্রচুর এতে পশুরা মনের সুখে ঘাস খাবে, আর তোমরা তাদের দুধ পান করবে। এবারতো শুষ্ক মৌসুম। কাজেই আমি ফিরে চললাম, তোমরাও ফিরে চলো।
কোরায়শ দলের সৈন্যদের সবাই যেন ভয়ে কাতর হয়ে পড়েছিলো। আবু সুফিয়ানের কথার পর নতুন করে যুক্তি দেখানো কারো পক্ষেই সম্ভব হলো না। মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করতে কারোই আগ্রহ রইল না। ফলে তারা সবাই ফিরে চললো।
এদিকে মুসলমানরা বদর প্রান্তরে আটদিন যাবত শত্রু সৈন্যের জন্যে অপেক্ষা করেন। এ সময় ব্যবসাপর জিনিস বিক্রি করে এক দিরহামকে দুই দিরহাম পরিণত করতে লাগলেন। আটদিন পর মনে আনন্দ নিয়ে বীরদর্পে মুসলমানরা মদীনায় ফিরে এলেন।
পরিস্থিতি সেই সময় পুরোপুরি মুসলমানদের অনুকূলে। এই যুদ্ধ প্রতিশ্রুত যুদ্ধ, বদরের দ্বিতীয় যুদ্ধ, বদরের আরেক যুদ্ধ তথা বদরের ছোট যুদ্ধ নামে পরিচিত।[ ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ২০৯. যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ১১২]
দওমাতুল জন্দলের যুদ্ধ
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদর থেকে ফিরে এসছেন। চারিদিকে শান্তি ও স্বস্তির পরিবেশ। সমগ্র এলাকায় ইসলামের জয় জয়াকার, প্রশান্তিময় ও স্নিগ্ধ সুরভিত অবস্থা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরবের শেষ সীমান্ত পর্যন্ত নযর দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। এটার প্রয়োজনও ছিলো। কেননা এর ফলে পরিস্থিতির ওপর মুসলমানদের সুদৃড় নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং শত্রুমিত্র সকলেই সেকথা বুঝতে পারবে এবং স্বীকার করবে।
বদরের ছোট যুদ্ধের পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছয় মাস যাবত শান্তি ও স্বস্তির সাথে মদীনায় অতিবাহিত করেন। এরপর তাঁকে জানানো হলো যে, সিরিয়ার নিকটবর্তী দাওমাতুল জন্দল এর আশে পাশে গোত্রমূহ পথ চলতি কাফেলাগুলোর ওপর ডাকাতি ও লটপাট করছে। মদীনায় হামলা করতে তারা এক বিরাট দলও প্রস্তুত করেছে। এসকল খবরের প্রেক্ষিতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাবা ইবনে আরফাতা গেফারীকে মদীনায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করে এক হাজার মুসলমানসহ রওয়ানা হলেন। পঞ্চম হিজরীর ২৫শে রবিউল আউয়াল এ ঘটনা ঘটে। পথ চিনিয়ে দেয়ার জন্যে বনু আযরা গোত্রের মাযকুর নামের একজন লোককে সঙ্গে নেয়া হয়।
এই অভিযানের সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্ত ছিলো এ রকম যে, তিনি রাতে সফর করতেন এবং দিনে লুকিয়ে থাকতেন। শত্রুদের ওপর আকস্মিক হামলা করার জন্যেই এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হয়। দাওমাতুল জন্দলে পৌঁছে জানা গেলো যে, তারা অন্যত্র সরে পড়েছে। তাদের পশুপাল এবং রাখালদের ওপর কবযা করা হলো। কিছুসংখ্যক পালিয়েও গেলো।
দওমাতুল জন্দলের অধিবাসীরাও যে যেদিকে পারলো পালিয়ে গেলো। মুসলমানরা দাওমাতুল জন্দল ময়দানে পৌঁছার পর স্থানীয় অধিবাসীদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করেন। আশেপাশের বিভিন্ন স্থানে সেনাদল প্রেরণ করা হয় কিন্তু কাউকে পাওয়া যায়নি। কয়েদিন পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় ফিরে আসেন। এই অভিযানেরর সময় উয়াইনা ইবনে হাচনের সাথে চুক্তি সম্পাদিত হয়। দওমাতুল জন্দল সিরিয়া সীমান্তের একটি শহর। এখান থেকে দামেশকের দুরত্ব পাঁচ এবং মদীনর দূরত্ব পনের রাত।
এ ধরনের সুচিন্তিত পদক্ষেপ এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ পরিকল্পনার ফলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের গৌরব শক্তি ও শান্তির আদর্শ দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। সমেয়র গতি মুসলমানদের দিকে আসে এবং আভ্যন্তরীণ ও বাইরের সমস্যা এ সঙ্কট কমে আসে। অথচ কিছুকাল উভয় ধরনের সমস্যা মুসলমানদের ঘিরে রেখেছিলো। এসকল সফল অভিযানের ফলে মোনাফেকরা নিশ্চুপ হয়ে যায়। ইহুদীদের একটি গোত্রকে বহিষ্কার করা হয়, অন্য গোত্র সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণের প্রতিশ্রুতি দেয়। কোরায়শদের শক্তিও হ্রাস পায়। সুলমানরা ইসলামের সুমহান শিক্ষার প্রচার এবং আল্লাহ রব্বুল আলামীনে দ্বীনের পয়গাম তাবলীগ করার সুযোগ লাভ করেন।