প্রথম পর্যায়ঃ নতুন সমাজ ব্যবস্থা রূপায়ন
ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৬২২ঈসায়ী সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর মোতাবেক পহেলা হিজরির ১২ই রবিউল আওয়াল শুক্রবার বনু নাজ্জার গোত্রের হযরত আইয়ুব আনসারীর (রা.) এর বাড়ির সামনে এসে পৌছলেন, সে সময় তিনি বলছিলেন ইনশাল্লাহ এটিই হবে আমাদের মনযিল, এরপর তিনি হযরত আইয়ুব আনসারী (রা.)-এর গৃহে স্থানান্তরিত হন।
মসজিদে নববীর নির্মাণ
এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে নববীর নির্মাণ কাজ শুরু করেন, মসজিদ নির্মাণের জন্য সেই জায়গা নির্ধারণ করেন, যেখানে গিয়ে তাঁর উট যাত্রা বিরতি করলো, সেই জমির মালিক ছিল দুটি এতিম বালক, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে সেই জমিন ক্রয় করে মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু করেন, তিনি নিজেও মসজিদের জন্য ইট ও পাথর বহন করেছিলেন এবং আবৃত্তি করছিলেন,
আল্লাহুম্মা লা আইশা ইল্লা আইশান আখেরা, ফাগফির লিল আনসারে,
ওয়াল মোহাজেরে, হাযাল হামালু লা হামলা, খায়বারা,
হাযা আবারুর রাব্বিনা ওয়া আতহারা,
সাহাবারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাথে উচ্ছাসভরে আবৃত্তি করছিলেন:
রাঈনা কাদানা ওয়ান নাবিউ ইয়ামাল,
লাযাকা মিন্নাল আমানু ওয়াল মুদাল্লাল,
অর্থাৎ হে আল্লাহ তায়ালা, জীবনতো প্রকৃতপক্ষে আখিরাতের, আনসার ও মোহাজেরদের তুমি ক্ষমা করো, এই বোঝা খাইবারের বোঝা নয়, এই বোঝা প্রতিপালকের এবং পবিত্র বোঝা, যদি আমরা বসে থাকি, আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাজ করেন, তাহলে আমরা পথভ্রষ্টতার কাজ করার জন্য দায়ী হবো।
সেই জমিতে পৌত্তলিকদের কয়েকটি কবর ছিলো, কিছু অংশ ছিলো বিরান উঁচু নিচু, খেজুর ও অন্যান্য কয়েটি গাছও ছিলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৌত্তলিকদের কবর খুঁড়লেন, উঁচু নিচু জায়গা সমতল করলেন, খেজুর ও অন্যান্য গাছ কেটে কেবলার দিকে লাগিয়ে দিলেন, উল্লেখ্য সেই সময় কেবলার ছিলো বাইতুল মাকদেস।
মসজিদের দরজার দুটি বাহু ছিলো পাথরের, দেয়ালসমূহ কাচা ইট এবং কাদা দিয়ে গাথা হয়েছিলো, ছাদের উপর খেজুর শাখা ও পাতা বিছিয়ে দেওয়া হলো, তিনটি দরজা লাগানো হলো, কেবলার সামনের দেওয়াল থেকে পেছনের দেয়াল পর্যন্ত একশত হাত দৈর্ঘ্য ছিলো, প্রস্থ ছিলো এর চাইতে কম, বুনিয়াদ ছিলো প্রায় তিন হাত গভীর।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদের অদূরে কয়েকটি কাঁচা খর তৈরি করলেন, এসব ঘরের দেয়াল খেজুর পাতা ও শাখা দিয়ে তৈরি, এসব ঘর ছিলো প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহধর্মিণীর বাস গৃহ, এগুলো তৈরি হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু আইয়ূব আনসারীর ঘর থেকে এখানে এসে উঠলেন (সহীহ বোখারী শরীফে পৃ.৭১, ৫৫৫, ৫৬০, যাদুল মায়াদ দ্বিতীয় খন্ড, পৃ.৫৬)।
নির্মিত মসজিদ শুধু নামাজ আদায়ের জন্যই ছিলো না, বরং এটি ছিলো একটি বিশ্ববিদ্যালয়, এতে মুসলমানরা ইসলামের মূলনীতি ও হেদায়াত সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করতেন।
এটি এমনি এক মাহফিল ছিলো যে, এখানে গোত্রীয় সংঘাত ও ঘৃণা-বিদ্বেষ জর্জরিত বিভিন্ন গোত্রের মানুষ পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দের মধ্যে অবস্থান করতো, এই মসজিদ ছিলো এমন একটি কেন্দ্র যা কেন্দ্র থেকে নবগঠিত রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালিত হতো, এবং এখান থেকে বিভিন্ন অভিযানে লোক প্রেরণ করা হতো, এছাড়া এই মসজিদের অবস্থা ছিলো একটি সংসদের মত, এতে মজলিসে শুরা এবং মজলিসে এন্তেজামিয়ার অধিবেশন বসতো।
এছাড়া এই মসজিদ ছিলো সেইসব মোহাজেরিন এবং নিরাশ্রয় লোকদের আশ্রয়স্থল, যাদের বাড়িঘর, পরিবার-পরিজন কিছুই ছিলো না।
হিজরতের প্রথম পর্যায় থেকে আজানের প্রচলন শুরু হয়, এই আযান ছিলো এক অপূর্ব মধুর সংগীতের মত, সেই সঙ্গীতের সূর দিক দিগন্ত মুখরিত হয়ে উঠতো, এ ব্যাপারে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ (রা.) এর স্বপ্নাদেশ পাওয়ার ঘটনা উল্লেখ রয়েছে, বিস্তারিত জানতে তিরমিযি, সূনানে আবি দাউদ, মোসনাদে আহমদ এবং সহীহ ইবনে খোজায়মা গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।
মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে নববী নির্মাণের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্মেলন ও মিল মহব্বতের একটি কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন, একইভাবে তিনি মানব ইতিহাসের এক অসাধারণ কাজ সম্পন্ন করেন, এবং তা হচ্ছে আনসার ও মোহাজেরদের মধ্যকার ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি, আল্লামা ইবনে কাইয়েম লিখেছেন, অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আনাস ইবনে মালেকের গৃহে মোহাজের ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করেন, সে সময় মোট নব্বইজন সাহাবী উপস্থিত ছিলেন, অর্ধেক ছিলেন মোহাজের আর অর্ধেক ছিলেন আনসার, ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের মূল কথা ছিলো, একে অন্যের দুঃখে দুখী সুখে সুখী হবে, মৃত্যুর পর নিকটাত্মীয়দের পরিবর্তে একে অন্যের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে, উত্তরাধিকারী হওয়ার এ নিয়ম বদরের যুদ্ধ পর্যন্ত কার্যকর ছিলো, এরপর আল্লাহ তায়ালা কোরআনে কারীমের এই আয়াত নাযিল করেন, নিকটাত্মীয়রা একে অন্যের বেশী হকদার।
এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর আনসার মোহাজেরদের মধ্যকার সম্পত্তির ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার আইন শেষ হয়ে যায়, কিন্তু ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক অটুট থাকে, বলা হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধুমাত্র মোহাজেরদের মধ্যে আরকটি ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করেন, কিন্তু প্রথমে উল্লেখিত ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের সম্পর্কই প্রমাণিত রয়েছে, এমনিতেই বোঝা যায় যে, মোহাজেররা ইসলামী ভ্রাতৃত্ব, স্বদেশী ভ্রাতৃত্ব, ও আত্মীয়তার বন্ধনের কারণে পরস্পর ছিলেন খুব ঘনিষ্ঠ, অন্য কোন প্রকার ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কের তারা মুখাপেক্ষী ছিলেন না, কিন্তু মোহাজের এবং আনসারদের প্রসঙ্গ ছিলো ভিন্ন রকমের (যাদুল মায়াদ দ্বিতীয় খন্ড, পৃ.৫৬)।
এই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইমাম গাজ্জালী (রা.) লিখেছেন, জাহেলী যুগের রীতিনীতি অবসান ঘটানো ইসলামের সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং বর্ণ গোত্র আঞ্চলিকতার পার্থক্য মিটিয়ে দেওয়ায় ছিলো এ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের উদ্দেশ্য, এর ফলে এটাই বোঝানো হয়েছে যে, উঁচু নিচুর মানদণ্ড তাকওয়া ব্যতীত অন্য কিছুতেই নেই।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে শুধু অন্তঃসারশূন্য শব্দের আবরণ সজ্জিত করেননি, বরং এমন একটি অবশ্য করণীয় ও পালনীয় অঙ্গীকার রূপে আখ্যায়িত করেছিলেন, যার সাথে সম্পৃক্ত ছিলো জানমাল, এটা শুধুমাত্র মুখে মুখে উচ্চারিত এমন সালাম ও মোবারকবাদের প্রতি সীমাবদ্ধ না, যার কোন ফলাফল নেই, বরং এই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের সাথে আত্মত্যাগ পর দুঃখ-কাতরতা এবং সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির প্রেরণাও জাগরূক ছিলো, এ কারণে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন মদিনার নতুন সমাজকে দুর্লভ ও সমুজ্জ্বল কর্ম তৎপরতায় পরিপূর্ণ করে দিয়েছিলো (ফেকাহু সসিরাত পৃ.১৪০-১৪১)।
সহীহ বোখারী শরীফে বর্ণিত রয়েছে যে, মোহাজেররা মদিনায় আগমনের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) এবং হযরত সাদ ইবনে রবি (রা.) এর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করে দিয়েছিলেন, এরপর হযরত সাদ ইবনে রবি (রা.) হযরত আবদুর রহমান (রা.) কে বললেন, আনসারদের মধ্যে আমি সবচেয়ে ধনী আপনি আমার ধন সম্পদের অর্ধেক গ্রহন করুন, আমার দুজন স্ত্রী রয়েছে আপনি ওদের দেখুন, যাকে আপনার বেশী পছন্দ হয় তার কথা বলুন আমি তাকে তালাক দিব, ইদ্দত পূর্ণ হওয়ার পর আপনি তাকে বিবাহ করবেন, একথা শুনে হযরত আবদুর রহমান (রা.) বললেন, আল্লাহ তায়ালা আপনার পরিবার পরিজন এবং ধন সম্পদে বরকত দান করুন, আপনাদের এখানে বাজার কোথায়? তাকে বনু কাইনুকা বাজারের কথা জানানো হল, তিনি বাজার থেকে ফিরে আসার পর তার কাছে কিছু পনির এবং ঘি দেখা গেল, এরপর প্রতিদিন নিয়মিত তিনি বাজারে যাওয়া আসা করতেন, একদিন তিনি ফিরে আসার পর তার গায়ে হলুদের চিহ্ন দেখা গেল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কারণ জানতে চাইলেন, হযরত আবদুর রহমান (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি বিবাহ করেছি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, মোহরানা কত দিয়েছ? হযরত আবদুর রহমান বললেন সোয়া তোলা সোনা (সহীহ বোখারী মোহাজের ও আনসারদের ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৩)।
হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত রয়েছে যে, আনসাররা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আবেদন জানালেন, যে, আপনি আমাদের এবং আমাদের ভাইদের মধ্যে আমাদের মালিকানাধীন খেজুরের বাগানগুলো বণ্টন করে দিন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাজি হলেন না, আনসাররা তখন বললেন, তাহলে মোহাজেররা আমাদের বাগানে কাজ করুক, আমরা উৎপাদিত ফলের মধ্য থেকে তাদেরকে অংশ দেব, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এতে সম্মতি দিলেন, অতঃপর আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করলাম।
এর দ্বারা বোঝা যায় যে, আনসাররা কিভাবে মোহাজেরদের সম্মান করেছিলেন মোহাজের ভাইয়ের প্রতি আনসারদের ভালবাসা, সরল সহজ আন্তরিকতা এবং আত্মত্যাগের পরিচয়ও এতে পাওয়া যায় মোহাজেররা আনসারদের এ ধরনের (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৩১২) আচরণে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন, তারা আনসারদের কাছ থেকে কোন প্রকার বাড়তি সুবিধা গ্রহন করেননি, বরং ভঙ্গুর অর্থনীতি কিছুটা সজীব করে তুলতে যতোটা সাহায্য গ্রহন প্রয়োজন ততোটাই গ্রহন করেছিলেন।
আনসার ও মোহাজেরদের মধ্যকার এ ভ্রাতৃত্ব বন্ধন এক অনন্য রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার প্রমাণ, সেই সময় মুসলমানরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন, এই ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন ছিল তার একটি চমৎকার সমাধান।
ইসলামের প্রতি সহযোগিতার অঙ্গীকার
উল্লিখিত ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক ছাড়াও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের জন্য আরেকটি অঙ্গীকারনামা প্রণয়ন করেন, এর মাধ্যমে জাহেলী যুগের সকল দ্বন্দ্ব সংঘাত ও গোত্রীয় বিরোধের বুনিয়াদ ধ্বংস করে দেয়া হয়, এ ছাড়া জাহেলী যুগের রসম রেওয়াজের জন্যে কোন অবকাশই রাখা হয়নি, উক্ত অঙ্গীকারনামার দফাসমূহ ছিল এই,
এই লেখা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে কোরায়শী ইয়াসরেবী, তাদের অধীনস্থ এবং তাদের সাথে সংশ্লিষ্টদের এবং জেহাদে অংশগ্রহণকারী মোমেনীন ও মোসলেমীনদের মধ্যে সম্পাদিত হচ্ছে-
এক) এরা সবাই অন্য সকল মানুষের চাইতে একটি ভিন্ন জাতি।
দুই) কোরাইশ মোহাজেররা তাদের পূর্বতন রীতি অনুযায়ী পরস্পর মুক্তিপণ আদায় করবে, মোমেনদের মধ্যে সুবিচারমূলকভাবে কয়েদীদের ফিরিয়ে দেবে, আনসারদের সকল গোত্র অনুযায়ী ঈমানদারদের মধ্যে সুবিচারমূলকভাবে নিজ নিজ কয়েদীদের ফিদিয়া আদায় করবে।
তিন) ঈমানদাররা নিজেদের মধ্যকার কাউকে ফিদিয়া বা মুক্তিপণের ক্ষেত্রে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী দান ও উপঢৌকন থেকে বঞ্চিত করবে না।
চার) যারা বাড়াবাড়ি করবে, সকল সত্যনিষ্ঠ মুসলমান তাদের বিরোধিতা করবে, ঈমানদারদের মধ্য যারা যুলুম অত্যাচার পাপ, দাঙ্গা হাঙ্গামা বা ফেতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করবে, সকল মোমেন তাদের বিরোধীতা করবে।
পাঁচ) মোমেনরা সম্মিলিতভাবে অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে থাকবে অন্যায়কারী কোন মোমেনর সন্তান হলেও এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে না।
ছয়) কোন মোমেন অন্য মোমেনকে কোন কাফেরের হত্যার অভিযোগে হত্যা করবে না।
সাত) কোন মোমেন কোন কাফেরের সাহায্যের জন্য অন্য মোমেনের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হবে না।
আট) সকলেই থাকবে আল্লাহর জিম্মায়, একজন সাধারণ মানুষের কৃত অঙ্গীকারও সকল মানুষ পালনে বাধ্য থাকবে।
নয়) যে সকল ইহুদী আমাদের আদর্শে দীক্ষিত হবে, তাদের সাহায্য করা হবে তারা অন্যান্য মুসলমানের মতোই ব্যবহার পাবে তাদের ওপর কোন প্রকার যুলুম অত্যাচার করা হবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করা হবে না।
দশ) মুসলমানদের সমঝোতা হবে অভিন্ন কোন মুসলমান অন্য মুসলমানকে বাদ দিয়ে আল্লাহর পথে জেহাদে অন্যের সাথে আপোষ করবে না বরং সকলেই সাম্য ও সুবিচারের ভিত্তিতে চুক্তি বা সমঝোতার উপনীত হবে।
এগার) আল্লাহর পথে জেহাদ প্রবাহিত রক্তের ক্ষেত্রে সকল মুসলমানই অভিন্ন বিবেচিত হবে।
বার) কোন মুসলমানই কাফের কোরাইশদের কাউকে জানমালের নিরাপত্তা বা আশ্রয় দিতে পারবে না, কোন কাফেরের জানমালের নিরাপত্তা অথবা আশ্রয় দেয়ার জন্য কোন মোমেনের কাছে অনুরোধ জানাতে পারবে না।
তের) কোন ব্যক্তি যদি কোন মোমেনকে হত্যা করে এবং তার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে এর পরিবর্তে তার কাছ থেকে কেসাস আদায় করা হবে অর্থাৎ হত্যার অপরাধে অপরাধী হওয়ায় তাকেও হত্যা করা হবে তবে যদি নিহত ব্যক্তির আত্মীয় স্বজনকে হত্যাকারী ক্ষতিপূরণ দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারে তবে সে ক্ষেত্রে কেসাস করা হবে না।
চৌদ্দ) সকল মোমেন কোন বিষয়ে ঐক্যমত্যে উপনীত হলে অন্য কেউ তার বিরোধিতা করতে পারবে না।
পনের) কোন হাঙ্গামা সৃষ্টিকারী বা বেদয়াতীকে সাহায্য করা মোমেনর জন্য বৈধ বিবেচিত হবে না অশান্তি সৃষ্টিকারী কোন ব্যক্তিকে কেউ আশ্রয় দিতে পারবে না যদি কেউ আশ্রয় দেয় বা সাহায্য করে, তাহলে কেয়ামতের দিন তার উপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হবে ইহলৌকিক জীবনে তার ফরয ও নফল এবাদত কোনটাই কবুল হবে না।
ষোল) তোমাদের মধ্য যে কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে সেই বিষয় আল্লাহ তায়ালা এবং তার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ অনুযায়ী মীমাংসা করবে (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৫০৩)।
সমাজ ব্যবস্থার নয়া কাঠামো
এ দূরদর্শিতা এবং বুদ্ধিমত্তার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি নয়া সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেন, তবে সমাজের বাহ্যিক রূপ আল্লাহর রাসূলকে কেন্দ্র করেই বিকশিত ও পরিস্ফুটিত হয়েছিল, তার মোহনীয় ব্যক্তিত্বই ছিল সকল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু, তার শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, নৈতিক চরিত্র গঠনের উপাদান ভালবাসা ভ্রাতৃত্বের নমুনা এবাদত বন্দেগী ও আনুগত্য মুসলমানদের নব জীবন লাভে জন্য করে তুলেছিল।
একজন সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কোন ইসলাম উৎকৃষ্ট? অর্থাৎ ইসলামের মধ্যে কোন আমল উত্তম? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, তুমি অন্যদের খাবার খাওয়াবে এবং চেনা অচেনা সবাইকে সালাম করবে (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৬, ৯)।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় আসার পর আমি তার কাছে হাজির হলাম, তার পবিত্র চেহারা দেখেই আমি বুঝে ফেললাম যে, এই চেহারা কোন মিথ্যাবাদী মানুষের নয়, এরপর তিনি আমার সামনে প্রথম কথা এটাই বলেছিলেন যে, হে লোক সকল সালাম দিতে থাক, খাবার খাওয়াও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজা রাখ, রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন নামায পড়, জান্নাতে নিরাপদে প্রবেশ করবে(তিরমিযি ইবনে মাজা, দারেমী, মেশকাত ১ম খন্ড, পৃ.১৬৮)।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, সেই ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার প্রতিবেশী তার দুর্বৃত্তপনা এবং ধ্বংসকারিতা থেকে নিরাপদ না থাকে (সহীহ মুসলিম, মেশকাত ২য় খন্ড, পৃ. ৪২২)।
তিনি বলতেন, সেই ব্যক্তিই ভাল মুসলমান, যার মুখ এবং হাত থেকে মুসলমানরা নিরাপদ থাকে (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৬)।
তিনি বলতেন, তোমাদের মধ্যকার কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মোমেন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের জন্যে পছন্দ করা জিনিস নিজের ভাইয়ের জন্য পছন্দ না করবে (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৬)।
তিনি বলতেন, সকল মোমেন একজন মানুষের মত, যদি তার চোখে ব্যথা হয়, তবে সারা দেহে সেই কষ্ট অনুভূত হয় যদি মাথায় ব্যথা হয়, তবে সারা দেশে সেই ব্যথার কষ্ট অনুভূত হয় (মুসলিম মেশকাশ, ২য় খন্ড, পৃ. ৪২২)।
তিনি বলতেন, মোমেন মোমেনের জন্য ইমারত স্বরূপ এর এক অংশ অন্য অংশকে শক্তি প্রদান করে (বোখারী মুসলিম ও মেশকাত ২য় খন্ড, পৃ. ৪২২)।
তিনি বলতেন, নিজেদের মধ্য পরস্পর ঘৃণা বিদ্বেষ পোষণ করো না, শত্রুতা করো না, বিবাদ করো না, একে অন্যের দিকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করো না, আল্লাহর বান্দা এবং ভাই ভাই হয়ে থাক, কোন মুসলমানের জন্য এটা বৈধ নয় যে, নিজের ভাইকে তিনদিনের বেশী দুরে সরিয়ে রাখে (সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ. ৮৯৬)।
তিনি বলতেন, মুসলমান মুসলমানের ভাই, একজন মুসলমান যেন অন্য মুসলমানের ওপর যুলুম না করে এবং তাকে শত্রুর হাতে তুলে না দেয়, যে ব্যক্তি নিজের ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার প্রয়োজন পূরণ করবেন, যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দুঃখ দুশ্চিন্তা দূর করবে, আল্লাহ তায়ালা রোজ কেয়ামতে সেই ব্যক্তির দুঃখসমূহের মধ্যে একটি দুঃখ দূর করবেন, যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ গোপন করে রাখবে আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির দোষ গোপন রাখবেন (বোখারী মুসলিম ও মেশকাত ২য় খন্ড, পৃ. ৪২২)।
তিনি বলতেন, তোমরা যমিনের অধিবাসীদের ওপর দয়া কর, আকাশের মালিক তোমাদের ওপর দয়া করবেন(সুনানে আবু দাউদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৩৩৫, তিরমিযি ২য় খন্ড, পৃ. ১৪)।
তিনি বলতেন, সেই ব্যক্তি মোমেন নয়, যে ব্যক্তি নিজে পেট ভরে খায়, অথচ তার পাশে তার প্রতিবেশী অনাহারে থাকে (বায়হাকী, মেশকাত, ২য় খন্ড, পৃ.৪২৪)।
তিনি বলতেন, মুসলমানকে গালাগাল দেয়া ফাসেকের কাজ, মুসলমানের সাথে মারামারি কাটাকাটি করা কুফুরী (বোখারী ২য় খন্ড, পৃ. ৮৯৩)।
তিনি বলতেন, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলা সদকার অন্তর্ভুক্ত এই কাজ ঈমানের শাখাসমুহের একটি অন্যতম শাখা (বোখারী মুসলিম ও মেশকাত ১ম খন্ড, পৃ. ১২ ১৬৭)।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সদকা খয়রাতের তাকিদ দিতেন, এই সদকা খয়রাতের ফযিলত এত বেশী বলে বর্ণনা করতেন যে, আপনা থেকেই সেদিকে মন আকৃষ্ট হতো, তিনি বলতেন সদকা গুনাহসমূহকে নিভিয়ে দেয়, যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়(আহমদ, তিরমিযি, ইবনে মাজা মেশকাত ১ম খন্ড, পৃ. ১৪)।
তিনি বলতেন, যে মুসলমান কোন নগ্ন মুসলমানকে পোশাক পরিধান করায়, আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে সবুজ পোশাক পরিধান করাবেন, যে মুসলমান কোন ক্ষুধার্ত মুসলমানকে আহার করায়, আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে ফল খাওয়াবেন, যে মুসলমান কোন পিপাসিত মুসলমানকে পানি পান করায়, আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে ছিপি আটা শরাবান তহুরা পান করাবেন (আবু দাউদ, তিরমিযি মেশকাত, ১ম খন্ড, পৃ. ১৬৯)।
তিনি বলতেন, খেজুরের এক টুকরো দান করে হলেও আগুন থেকে আত্মরক্ষা কর, যদি সেইটুকু সামর্থ্যও না থাকে, তবে ভাল কথার মাধ্যমে আগুন থেকে আত্মরক্ষা কর (বোখারী ১ম খন্ড, ১৯০, ২য় খন্ড, ৮৯০)।
একই সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভিক্ষাবৃত্তি থেকে দূরে থাকার জন্য তাকিদ দিয়েছেন, তিনি ধৈর্য সহিষ্ণুতা এবং মিতব্যয়িতা শিক্ষা দিয়েছেন, ভিক্ষাবৃত্তিকে ভিক্ষুকের চেহারায় আঁচড় এবং অন্যান্য ধরনের জখম বলে আখ্যায়িত করেছেন (আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসাঈ, ইবনে মাজা, দারেমী মেশকাত দ্রষ্টব্য)।
তবে উল্লিখিত ধরনের অবমাননা থেকে তাদেরকে মুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন, যারা একান্ত নিরুপায় হয়েই ভিক্ষা করে।
তিনি একেক প্রকার এবাদতের বিভিন্ন রকম ফযিলতের কথা বর্ণনা করেছেন আল্লাহর কাছে সেইসব এবাদতের ভিন্ন ভিন্ন রকমের সওয়াবের কথা উল্লেখ করেছেন।
আকাশ থেকে তার কাছে যে ওহী আসতো, তিনি মুসলমানদেরকে সেই সম্পর্কে অবহিত করতেন এবং সেই আলোকে জীবন যাপনে সহায়তা করতেন, তিনি সেই ওহী মুসলমানদের পড়ে শোনাতেন এবং তার কাছ থেকে শোনার পর মুসলমানরা তাকে পুনরায় পড়ে শোনাত, এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে বুদ্ধিমত্তা বিচক্ষণতা ও চিন্তা চেতনা ছাড়াও দাওয়াতে হক এর পয়গাম্বরসূলভ দায়িত্বানুভূতি ও সচেতনতা সৃষ্টি হত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের জীবনধারায় বিস্ময়কর উন্নতির সোপান তৈরি করেন, মানুষের মধ্যকার খোদা প্রদত্ত যোগ্যতাকে উন্নত করেন, মানুষের কর্মপ্রণালী এবং চিন্তা চেতনায় মাধুর্যের সৃষ্টি হয় এমনকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষার কারণে সাহাবারা নবীদের পর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত হন, মানবেতিহাসে তারা আদর্শের চূড়ান্ত সীমায় উপনীত হন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি আদেশ অনুসরণ করতে চায়, সে যেন মৃত ব্যক্তিদের আদেশ অনুসরণ করে, কেননা জীবিত লোকদের ব্যাপারে ফেতনার আশঙ্কা বিদ্যমান রয়েছে।
সাহাবারা ছিলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথী, উম্মতে মোহাম্মদীর শ্রেষ্ঠ মানুষ, পূন্যপ্রাণ গভীর জ্ঞানের অধিকার এবং সর্বাধিক নিরহংকার, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই সকল মানুষকে তার প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বন্ধু ও সাথী এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে যোগ্য মানুষরূপে মনোনীত করেন, কাজেই তাদের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে জানা দরকার এবং তাদের অনুসরণ অনুকরণ ও আনুগত্য করা দরকার, তাদের চরিত্র মাধুর্য এবং জীবন চরিত যতটা সম্ভব আত্মস্থ করা দরকার, কেননা তারা ছিলেন হেদায়েতের ওপর, সিরাতুল মোস্তাকিমের ওপর (রাযীন, মেশকাত ১ম খন্ড, পৃ. ৩২)।
আমাদের পয়গাম্বর হযরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তম ও উন্নত আদর্শের এমন এক নমুনা ছিলেন যে, মন আপনা আপনি তার দিকে আকৃষ্ট হয়, জান কোরবান করার ইচ্ছা জাগে, এর ফলে তার পবিত্র মুখ নিঃসৃত কথা পালন করার জন্য সাহাবারা ছুটে যেতেন, হেদায়াত ও পথনির্দেশের জন্য তিনি যেসব কথা বলতেন সেই কথা যথাযথভাবে পালন করতে সাহাবাদের মধ্য যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত।
এ ধরনের প্রচেষ্টার কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় এমন একটি সমাজ গঠনে সক্ষম হলেন, যা ছিল ইতিহাসের আলোকে সর্বাধিক সফল সমাজ, তিনি সেই সমাজের সমস্যাসমূহের এমন সমাধান দিলেন যে, যারা অন্ধকারের আবর্তে হাত পা ছোড়াছুড়ি করছিল তারা স্বস্তি লাভ করল, সেই সমাজ উন্নত শিক্ষা ও আদর্শের মাধ্যমে যুগের সকর প্রতিকূলতা সরিয়ে ইতিহাসের ধারাই পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম হলো।
ইহুদীদের সাথে চুক্তি সম্পাদন
হিজরতের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের মধ্যে চিন্তা বিশ্বাস, রাজনীতি এবং ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে একটি নতুন সমাজের ভিত্তি স্থাপন করলেন, এরপর তিনি অমুসলিমদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চাচ্ছিলেন যে, সকল মানুষ সুখে শান্তিতে বসবাস করুক, মদিনা এবং আশেপাশের এলাকার মানুষ একটি সুস্থ প্রশাসনের আওতাভুক্ত হোক, তিনি উদারতা ও ন্যায়পরায়ণতার মাধ্যমে এমন আইন প্রণয়ন করলেন, বর্তমান সংঘাত বিক্ষুব্ধ বিশ্বে যার কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মদিনার নিকটবর্তী লোকেরা ছিল ইহুদী, গোপনে এরা মুসলমানদের সাথে শত্রুতা করলেও প্রকাশ্যে তার পরিচয় দেয়নি, এ কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সাথে একটি চুক্তিতে উপনীত হলেন, সেই চুক্তিতে ইহুদীদেরকে তাদের ধর্ম পালনে স্বাধীনতা এবং জানমালের নিরাপত্তা দেয়া হল, রাজনৈতিক হঠকারিতার কোন সুযোগ তাদের দেয়া হয়নি।
মুসলমানদের মধ্যকার পারস্পরিক চুক্তির আলোকেই ইহুদীদের সাথে চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছিল, চুক্তি দফাসমূহ ছিল নিম্নরূপ
এক. বনু আওফের ইহুদীরা মুসলমানদের সাথে মিলিত হয়ে একই উম্মত হিসাবে বিবেচিত হবে, ইহুদী ও মুসলমানরা নিজ নিজ দ্বীনের ওপর আমল করবে, বনু আওফ ছাড়া অন্যান্য ইহুদীরাও একই রকমের অধিকার লাভ করবে।
দুই. ইহুদীরা নিজেদের সমুদয় ব্যয়ের জন্য দায়ী হবে এবং মুসলমানরা নিজেদের ব্যয়ের জন্য পৃথক পৃথকভাবে দায়ী হবে।
তিন. এই চুক্তির আওতাভুক্তদের কোন অংশের সাথে যারা যুদ্ধ করবে সবাই সম্মিলিতভাবে তাদের সাথে প্রতিহত করবে।
চার. এই চুক্তির অংশীদাররা সকলেই পরস্পরের কল্যাণ কামনা করবে, তবে সেই কল্যাণ কামনা ও সহযোগিতা, ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে অন্যায়ের ওপর নয়।
পাঁচ. কোন ব্যক্তি তার মিত্রের কারণে অপরাধী হবেনা।
ছয়. মজলুমকে সাহায্য করা হবে।
সাত. যতদিন যাবত যুদ্ধ চলতে থাকবে ততদিন ইহুদীরাও মুসলিমদের সাথে যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করবে।
আট. এই চুক্তির অংশীদারদের জন্য মদিনায় দাঙ্গা হাঙ্গামা ও রক্তপাত নিষিদ্ধ থাকবে।
নয়. এই চুক্তির অন্তর্ভুক্তদের মধ্যে কোন নতুন সমস্যা দেখা দিলে বা ঝগড়া বিবাদ হলে আল্লাহর আইন অনুযায়ী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার মীমাংসা করবেন।
দশ. কোরাইশ এবং তাদের সাহায্যকারীদের আশ্রয় প্রদান করা হবে না।
এগার, ইয়াসরেবের ওপর কেউ হামলা করলে সেই হামলা মোকাবেলায় পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করবে সকল পক্ষ নিজ নিজ অংশের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করবে।
বার. এই চুক্তির মাধ্যমে কোন অত্যাচারী বা অপরাধীকে আশ্রয় দেয়া হবে না (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৫০৩, ৫০৪)।
এই চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর মদিনা এবং তার আশে পাশের এলাকা নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়, সেই রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল মদিনা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সেই রাষ্ট্রের মহানায়ক, এর মূল কর্তৃত্ব ছিল মুসলমানদের হাতে, এমনি করে মদিনা ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হল, শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরবর্তী সময়ে অন্যান্য গোত্রের সাথেও একই রকম চুক্তি করেন।