সশস্ত্র সংঘাত
মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোরায়শদের ষড়যন্ত্র
ইতিপূর্বে মুসলমানদের ওপর মক্কার কাফেরদের যুলুম অত্যাচার সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। মুসলমানরা হিজরত করতে শুরু করলে কাফেররা তাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলো, সে সম্পর্কেও উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে কি এ ধরনের অত্যাচার নির্যাতনের ফলে কাফেরদের অর্থ-সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার মতো অপরাধও তারা করেছিলো। তাদের নির্বুদ্ধিতা না কমে বরং বেড়েই চলেছিলো। মুসলমানরা তাদের কবল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো এবং মদীনায় তারা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেযেছিলো এটা দেখে কাফেরদের ক্রোধ আরা বেড়ে গেলো। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তখনো ইসলামের ছদ্মদেশ ধারণ করেনি। মদীনায় আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ছিলো আনসারদের নেতা। কমক্কার পৌত্তলিকরা আবদুল্লাহকে হুমকিপূর্ণ একটি চিঠি লিখলো। সেই সময় মদীনায় আবদুল্লাহ যথেষ্ট প্রভাব পতিপত্তি ছিলো। এমনকি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি মদীনায় না যেতেন, মদীনাবাসীরা তাকে তাদেঁর বাদশাহ হিসাবে গ্রহন করতো। মক্কার পৌত্তলিকরা তাদের হুমকিপূর্ণ চিঠিতে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তাদের পৌত্তলিক সহযোগিদের উদ্দেশ্যে লিখরো যে, আপনারা আমাদের রোককে আশ্রয় দিয়েছেন, তাই আমরা কসম খেয়ে বলছি যে, হয়তো আপনারা তার সাথে লড়াই করুন অথবা তাকে মদীনা থেকে বের করে দিন। যদি না করেন তবে আমরা সর্বশক্তিতে আপনাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে যোদ্ধা পুরুষদের হত্যা এবং আপনাদের মহীলাদের সম্মান বিনষ্ট করবো।[আবু দাউদ, খবরুন নাযির অধ্যায়]
আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর সাথে পত্র বিনিময়
এই চিঠি পাওয়ার পরই আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মক্কার পৌত্তলিকদের নির্দেশ পালনের জন্যে প্রস্তুত হলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মনে আগে থেকেই প্রবল ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছিলো। কেননা তার মনে এ ধারণা বৃদ্ধমূল হয়েছিলো যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ইমদীনার রাজমুকুট তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন। মক্কার পৌত্তলিকদের চিঠি পাওয়ার পরই আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং মদীনার সহযোগিরা রসূলে মাকবুলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ খবর পেয়ে আবদুল্লাহর কাছে গিয়ে তাকে বললেন, কোরায়শদের হুমকিতে যথেষ্ঠ প্রভাবিত হয়েছো মনে হচ্ছে। শোনো, তোমরা নিজেরা নিজেদের যতো ক্ষতি করতে উদ্যত হয়েছো মক্কার কোরায়শরা তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পারবে না। তোমরা কি নিজেদের সন্তান এবং ভাইয়ের সাথে নিজেরাই যুদ্ধ করতে চাও? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ কথা শোনার পর যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত আবদুল্লাহর সহযোগিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। [আবু দাউদ, খবরুন নাযির অধ্যায়]
সমর্থক ও সহযোগিরা ছত্রবঙ্গ হওয়ায় আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তখনকার মতো যুদ্ধ থেকে বিরত হলো। কিন্তু কোরায়শদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত ছিলো। কেননা এই দুর্বৃত্ত মুসলমান ও কাফেরদের সাথে সংঘাতের কোন ক্ষেত্রেই নিজের জড়িত হওয়ার সুযোগকে হাতছাড়া করেনি। উপরন্তু মুসলমানদের বিরোধিতার শক্তি অর্জনের জন্যে ইহুদীদের সাথেও সে যোগাযোগ রক্ষা করতো যেন, প্রয়োজনের সময় ইহুদীরা তাকে সাহায্য করে। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার আগুন বার বার খোদাপ্রদত্ত কৌশলে নির্বাপিত করতেন [সহীহ বোখারী ২য় খন্ড, পৃ. ৬৫৫, ৬৫৬, ৯১৬, ৯২৪]।
মুসলমানদের জন্যে মসজিদে হারাম বন্ধ ঘোষণা
এরপর হযরত সা’দ বিন মা’য (রা.) ওমরাহ পালনের জন্য মক্কায় গিয়ে উমাইয়া ইবনে খালফের মেহমান হন। হযরত সা’দ (রা.) তখনও ইসলাম গ্রহন করেননি । তিনি উমাইয়াকে বললেন, আমি একটু নিরিবিলি কাবাঘর তওয়াফ করতে চাই। উমাইয়া দুপুরে হযরত সা’দকে নিয়ে বেরোলেন। তওয়াফের সময় আবু জেহেলের সাথে দেখা। নিবিষ্ট চিত্তে হযরত সা’দকে তওয়াফ করতে দেখে আবু জেহেল উমাইয়াকে বললো, আবু সফওয়ান, তোমার সঙ্গে আসা এই লোকটির পরিচয় কি? উমাইয়া বললো, এ হচ্ছে সা’দ ইবনে মা’য। আবু জেহের হযরত সা’দকে সরাসরি সম্বোধন করে বললো, আপনি বড় নিবিষ্ট মনে তওয়াফ করছেন দেখছি। অথচ আপনারা বেদ্বীনকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছেন। আপনারা তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন। খোদার কসম, আপনি যদি আবু সফওয়ানের মেহমান না হতেন, তবে আপনাকে নিরাপদে মদীনায় ফিরে যেতে দেয়া হতো না। একথা শুনে হযরত সা’দ (রা.) উচ্চস্বরে বললেন শোনো, তুমি যদি আমাকে তওয়াফ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করো, তবে আমি তোমার বাণিজ্য মদীনার কাছ দিয়ে যেতে দেবো না। সেটা কিন্তু তোমার জন্যে গুরুতর ব্যাপার হবে [বোখারী, কিতাবুল মাগাযি ২য় খন্ড, পৃ. ৫৬৩ ]।
মোহাজেরদের প্রতি কোরায়শদের হুমকি
কোরায়শরা মুসলমানদের খবর পাঠালো যে, তোমরা মনে করো না যে, মক্কা থেকে গিয়ে নিরাপদে থাকবে। বরং মদীনায় পৌছে আমরা তোমাদের সর্বনাশ করে ছাড়বো। [রহমাতুল লিল আলামীন, ১ম খন্ড, পৃ. ১১৬]
এটা শুধু হুমকি ছিলো না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নানা সূত্রে কোরায়শদের ষড়যন্ত্র এবং অসদুদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত হন। ফলে তিনি কখনো সারারাত জেগে কাটাতেন, আবার কখনো সাহাবায়ে কেরামের প্রহরাধীনে রাত্রি যাপন করতেন। সহীহ বোখারী শরীফে হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, মদীনা আসার পর এক সন্ধায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন কি যে ভালো হতো যদি আমার সাহাবাদের মধ্যে কোন নেককার সাহাবী আমার এখানে পাহারা দিতো। একথা বরার সাথে সাথে অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা গেলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন কে ওখানে? জবাব এলো সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস। বললেন, কি জন্য এসেছো? আগন্তক বললেন, হে আল্লাহ রসূল, আপনার নিরাপত্তা প্রশ্নে আমার মনে হঠাৎ একটা সংশয়ের ইদ্রেক হওয়ায় আমি আপনাকে পাহারা দিতে এসেছি। একথা শুনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জন্যে দোয়া করে শুয়ে পড়লেন। [মুসলিম, ২য় খন্ড, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের বৈশিষ্ট শীর্ষক অধ্যায় এবং বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ৪০৪]
মনে রাখতে হবে যে, পাহারার ব্যবস্থা বিশেষ কয়েকটি রাতের জন্যে নির্দিষ্ট ছিলো না। বরং অব্যাহতভাবেই তা রাখা হয়েছিলো। হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাত্রিকালে হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য পাহারার ব্যবস্থা করা হত। অতপর পবিত্র কোরআনের এই আয়াত নাযিল হলো- ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাকে মানুষদের থেকে হেফাযত রাখবেন।’ এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর প্রিয় নবী জানালায় মাথা বের করে বললেন, ‘হে লোকেরা তোমরা ফিরে যাও, আল্লাহ তায়ালা আমাকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন।’ [জামে তিরমিযি, আবওয়াত তাফসীর, ২য় খন্ড, পৃ. ১৩০ ]
নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্খা শুধুমাত্র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত সীমাব্দ্ধ ছিলো না। সকল মুসলমানের ক্ষেত্রেই ছিলো এটা প্রযোজ্য। হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবারা মদীনায় আসার পর আনসাররা তাদের আশ্রয় প্রদান করেন। এতে সমগ্র আরব তাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপে যায়। ফলে মদীনার আনসাররা অস্ত্র ছাড়া রাত্রি যাপন করতেন না এবং সকালেও তাদের কাছে অস্ত্র থাকতো।
যুদ্ধের অনুমতি
মদীনার মুসলমানদের অস্তিত্বের জন্যে অমুসলিমদের পক্ষ থেকে নিরাপত্তাহীনতা ছিলো বিশেষ হুমকি। অন্য কথায় বলা যায় যে, এটা ছিলো তাদের টিকে থাকা না থাকার জন্যে বিরাট চ্যালেঞ্জ। এর ফলে মুসলমানরা স্পষ্টভাবে বুঝে ফেলেছিলেন যে, কোরায়শরা মুসলমানদের ক্ষতি করার জন্যে সংকল্প থেকে বিরত হবে না। এমনি সময়ে আল্লাহ রব্বুল আলামীন মুসলমাদের যুদ্ধ করার অনুমতি দিলেন। তবে এ যুদ্ধকে ফরয বলে আখ্যায়িত করা হয়নি। এই সময়ে আল্লাহ তায়ালা কোরআনের এই আয়াত নাযিল করেন, ‘যাদের সাথে যুদ্ধ করা হচ্ছে, তাদেরকেও যুদ্ধের যুদ্ধের অনুমতি প্রদান করা যাচ্ছে। কেননা তারা মযলুম। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তাদের সাহায্য করতে সক্ষম।’
এই আয়াতের প্রেক্ষিতে এরপর আরো কয়েকটি আয়াত নাযিল হয়েছিলো। এই সকল আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছিলো যে, যুদ্ধ করার এই অনুমতি নিছক যুদ্ধের জন্যে নয় বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বাতিল বা মিথ্যার মূল উৎপাটন এবং সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। যেমন আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আমি ওদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দিবে, সৎকাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে, সকল কাজের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারে।’ (সূরা হজ্জ, আয়াত ৮১)
এই অনুমতি হিযরতের পর মদীনায় নাযিল হয়েছিলো, মক্কায় নয়। তবে নাযিলের সঠিক সময় নির্ধারণ করা মুশকিল।
যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়েছে, কন্তু পরিস্থিতি ছিলো পৌত্তলিক কোরায়শদের অনুকূলে। এ কারণে মুসলমানদের কিছু কৌশলের প্রয়োজন দেখা দেয়। মুসলমানরা নিজেদের নিয়ন্ত্রনের সীমানা কোরায়শদের বাণিজ্য কাফেলা পযন্ত বিস্তৃত করেন। মক্কা থেকে সিরিয়ার মধ্যবর্তী পথ ছিল এই সীমানা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের নিয়ন্ত্রন সীমানা বিস্তৃত করার জন্য দু’টি পরিকল্পনা গ্রহন করেন।
এক) মক্কা থেকে সিরিয়া ও মদীনার যাতায়াতকারী বাণিজ্য কাফেলার পথের পাশে যেসব গোত্রের, তাদের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি।
দুই) সেই পথে টহলদানকারী কাফেলা প্রেরণ।
প্রথম পরিকল্পনার আলোকে একথা গুরুত্বপূর্ণ যে, ইতিপূর্বে ইহুদীদের সাথে সম্পাদিত যে সকল চুক্তির কথা তুলে ধরা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখ রয়েছে যে, অনুরূপ একটি অনাক্রমণ চুক্তি জুহাইনা গোত্রের সাথেও সম্পাদিত হয়। এ গোত্র মদীনা থেকে তিন মনযিল অর্থাৎ ৫১ মাইল দূরে বাস করতো। এছাড়া আরো কয়েকটি গোত্রের সাথেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। সেসব চুক্তির বিষয়ে যথা সময়ে উল্লেখ করা হবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্থাপিত দ্বিতীয় পরিকল্পনা যুদ্ধ সম্পর্কিত, যে সব যে সব বিষয়ে আলোচনাও যথাস্থানে করা হবে।
ছারিয়্যা ও গোযওয়াহ [সীরাত রচয়িতাদের পরিভাষা অনুযায়ী ছারিয়্যা বলা হয় সেইসব সামরিক অভিযানকে, যাতে নবী করীম (সঃ) স্বয়ং অংশ গ্রহন করেননি। যুদ্ধ হোক বা না হোক। পক্ষান্তরে গোযওয়া বলা হয় সেই সব সামরিক অভিযানকে যেখানে নবী (সাঃ) নিজে অংশ গ্রহন করেছিলেন। যুদ্ধ হোক বা না হোক ]
পবিত্র কোরআনের আয়াতে যুদ্ধের অনুমতি প্রদানের পর উল্লিখিত উভয় পরিকল্পনার বাস্তবায়নের জন্যে মুসলমানদের পর্যায়ক্রমিক অভিযান শুরু হয়। অস্ত্র সজ্জিত কাফেলা টহল দিতে থাকে। এর উদ্দেশ্য ছিলো মদীনার আশপাশের রাস্তায় সাধারণভাবে এবং মক্কার আশপাশের রাস্তায় বিশেষভাবে লক্ষ্য রেখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। একই সাথে সেসব রাস্তার আশেপাশে বসতি স্থাপনকারী গোত্রসমূহের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। এর ফলে মদীনার পৌত্তলিক, ইহুদী এবং আশেপাশের বেদুইনদের মনে এ বিশ্বাস স্থাপন করা সম্ভব হবে যে, বর্তমানে মুসলমানেরা যথেষ্ট শক্তিশালী । অতীতের দুর্বলতা ও শক্তিহীনতা তারা কাটিয়ে উঠেছে। উপরন্তু এর মাধ্যমে কোরায়শদের ঔদ্ধত্বপূর্ণ সাহসিকতা সম্পর্কে তাদের ভীত করে দেয়া সম্ভব হবে। তাদের বুঝিয়ে দেয়া যাবে যে, তারা যেসব চিন্তা এবং ক্রোধ প্রকাশ করেছে, তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। নির্বুদ্ধিতার যে পাঁক কাদায় তারা গড়াগড়ি খাচ্ছে, তাতে তাদের অর্থনীতিকে হুমকির সন্মুখীন দেখে সন্ধি-সমঝোতার প্রতি তারা ঝুঁকে পড়বে। মুসলনাদের ঘরে প্রবেশ করে তাদের নিশেষ করা, আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করা এবং দুর্বল মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করার যেসব সঙ্কল্প তারা মনে মনে পোষণ করছে, সেসব থেকে তারা বিরত থাকবে। এর ফলে জাযিরাতুল আরবে তওহীদের দাওয়াতের কাজ মুসলমানরা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে করতে পারবে।
এসব ছারিয়্যা ও গোযওয়াহ সম্পর্কে নীচে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হচ্ছেঃ
এক) ছারিয়্যা সিফুল বাহার [ সিফুল বাহার অর্থাৎ সমুদ্র সৈকত ]
প্রথম হিজরীর রমযান মোতাবেক ৬২৩ খৃষ্টাব্দের মার্চ মাস।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত হামযা ইবনে আবদুল মোত্তালেব(রা.)-কে এর সেনানায়ক মনোনীত করেন। রাবেগ প্রান্তরে এই কাফেলা আবু সুফিয়ানের সঙ্গীদের সংখ্যা ছিলো দু’শো। উভয় পক্ষ পরস্পরের প্রতি তীর নিক্ষেপ করে কিন্তু ঘটনা যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়নি [রহমাতুল্লিল আলামীন] ।
এই ছারিয়্যায় মক্কার লোকদের মধ্যে তেকে দুই ব্যক্তি মুসলমানেদর সাথে এসে মিলিত হয়। এদের একজন হযরত মিকদাদ ইবনে আমর আল বাহরানী এবং অন্যজন ওতবা ইবনে গোজওয়ান আলমাজানি (রা. এই দুইহন গোপনে ইসলাম গ্রহন করেছিলেন। তারা পৌত্তলিকদের সাথে যোগ দেন এই উদ্দেশ্যে যে পথিমধ্যে মুসলমানদের সাথে সাক্ষাৎ হলে তাদের কাছে চলে যাবেন।
দুই) ছারিয়্যা খাররার [যাহফার নিকটবর্তী একটি জায়গার নাম]
প্রথম হিজরীর জিলকদ মোতাবেক ৬২৩ সালের মে মাস।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসকে এর আমীর নিযুক্ত করেন। তাঁর অধীনে বিশজন নিবেদিত প্রাণ মুসলমানকে কাফেরদের একটি কাফেলার সন্ধানে প্রেরন করেন। এই কাফেলা পদব্রজে রওয়ানা হয়েছিলো। এরা রাত্রিকালে সফর করতেন আর দিনে আত্মগোপন করে থাকতেন। পঞ্চম দিন সকালে এই কাফেলা খাররার পৌছে খবর পেল যে, কোরায়শদের বাণিজ্য কাফেলা একদিন আগে খাররার ত্যাগ করেছে।
এর পতাকা ছিলো সাদা এবং হযরত মেকদাদ ইবনে আমর (রা.) তা বহন করছিলেন।
তিন) গোযওয়াহ আবওয়া [ওদদান মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী একটি যায়গার নাম। রাবেগ থেকে যাওয়ার পথে ২৯ মাইল পর এই জায়গা পড়ে। আবওয়া ওদদানের নিকটবর্তী অন্য জায়গা]
দ্বিতীয় হিজরীর সফর মোতাবেক ৬২৩ সালের আগষ্ট।
এই অভিযানে সত্তরজন মোহাজের সমভিব্যহারে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গমন করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই সময়ে মদীনায় হযরত সা’দ ইবনে ওবাদা (রা.)-কে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিলো কোরায়শদের একটি বানিজ্য কাফেলার পথ রোধ করা। নবী (সাঃ) ওদদান পর্যন্ত পৌছেঁন। কিন্তু কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
এই অভিযানের প্রাক্কালে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনু জামরা গোত্রের সর্দার আমর ইবনে মাখশি জমিরির সাতে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করেন। চুক্তির বক্তব্য ছিলো এইরূপ, ‘বনু জামরার জন্যে মোহাম্মদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লেখা্ এরা নিজেদের জানমালের ব্যাপারে নিরাপদ থাকবে। এদের ওপর কেউ হামলা করলে সেই হামলার বিরুদ্ধে এদের সাহায্য করা হবে। অবশ্য এরা যদি আল্লাহর দ্বীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে তবে, এই অঙ্গিকার পালন করা হবে না। সমুদ্র যতোদিন তার সৈকতকে সিক্ত করবে, ততোদিন এই চুক্তির কার্যকারিতা অটুট থাকবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাদের সাহায্যের জন্যে ডাকবেন, তখন তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে।’ [ আললাওয়াহেবু লাদুন্নিয়া ১ম খন্ড, পৃ. ৭৫]
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অংশগ্রহন সম্বলিত এটি ছিলো প্রতম সামরিক অভিযান। মদীনার বাইরে পনের দিন কাটানোর পর তাঁরা ফিরে আসেন।
চার) গোযওয়ায়ে বুয়াত
দ্বিতীয় হিজরীর রবিউল আউয়াল মোতাবেক ৬২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস।
এই অভিযানে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুইশত সাহাবাসহ রওয়ানা হন্। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিলো কোরায়মদের বাণিজ্য কাফেলা ধাওয়া করা্ এই কাফেলায় উমাইয়া ইবনে খালাফসহ কোরায়শদের একশত লোক এবং উট ছিলো আড়াই হাজার। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোযওয়া এলাকায় অবস্থিত বুয়াত [বুয়াত এবং রিযভী জুনাইনায় পাহাড়ী এলাকার দুটি পাহাড়। মূলত এটি পাহাড়ের দুটি শাখা। মক্কা থেকে সিরিয়া যাওয়ার পথে পড়্ মদীনা থেকে ৪৮ মাইল দূরত্বে অবস্থিত ] নামক জায়গা পর্যন্ত পোছেন। কিন্তু কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এ অভিযানে পতাকার রং ছিলো সাদা যা বহন করছিলেন হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)।
এই অভিযানের প্রাক্কালে হযরত সা’দ ইবনে মায়া’য (রা.)-কে মদীনার আমীরনিযুক্ত করা হয়।
পাঁচ) গোযওয়া সফওয়ান
দ্বিতীয় হিজরীর রবিউল আউয়াল মোতাবেক ৬২৩ সালের সেপ্টেম্বর।
এই অভিযানের কারণ ছিলো এই যে, কারজ ইবনে জাবের ফাহারি নামে একজন পোত্তলিকের নেতৃত্বে একদল লোক মদীনার চারণভূমিতে হামলা করে কয়েকটি গবাদী পশু অপহরণ করে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্তরজন সাহাবাকে সঙ্গে নিয়ে লুটেরাদের ধাওয়া করেন। কিন্তু কারজ এবং তার সঙ্গীদের পাওয়া যায়নি। কোন প্রকার সংঘাত ছাড়াই তারা পিরে আসেন। এই যুদ্ধকে কেউ কেউ বদরের প্রথম যুদ্ধ বলে অবিহিত করেন। পতাকার রং ছিলো সাদা। হযরত আলী (রা.) তা বহন করছিলেন।
এই অভিযানের সময় মদীনার আমীর হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা(রা.)-কে নিযুক্ত করা হয়েছিলো।
ছয়) গোযওয়া যিল উশাইরা
দ্বিতীয় হিজরীর জমাদিউল আউয়াল এবং জমাদিউল সানি মোতাবেক ৬২৩ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর
এই অভিযানে রসূল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে দেড় থেকে দু’শ মোহাজের ছিলেন। এতে অংশগ্রহণের জন্য কাউকে বাধ্য করা হয়নি। সওয়ারীর জন্যে উটের সংখ্যা ছিলো মাত্র ত্রিশ। পালাক্রমে সবাই সওযার হয়েছিলেন। মক্কা থেকে সিরিয়া অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গেছে পৌত্তলিকদের এ ধরনের একটি কাফেলাকে ধাওয়া করতে এ অভিযান চালানো হয়। এই কাফেলায় কোরায়শদের প্রচুর মালামাল ছিলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই কাফেলাকে ধাওয়া করতে যুল উশাইরা [ উশাইয়া, ইয়ালবুর নিকটবর্তী একটি জায়গার নাম ] নামক জায়গা পর্যন্ত পৌ্ছেন। কিন্তু কয়েকদিন আগেই কাফেরা চলে গিয়েছিলো। এই কাফেলাই সিরিয়া থেকে ফেরার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের গ্রেফতার করার চেষ্টা চালান। কিন্তু তারা মক্কায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এই ঘটনার জের হিসাবে পরবর্তীকালে বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
এই অভিযানেও পতাকার রং ছিলো সাদা। হযরত হামযা (েরা.) পতাকা বহন করেন।
ইবনে ইসহাকের মতে এই অভিযানে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জমাদিউল আউয়ালের শেষ দিকে রওয়ানা হয়ে জমাদিউস সানিতে ফিরে আসেন। এ কারণে এই অভিযানের সঠিক সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে সীরাত রচয়িতাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।
এই অভিযানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনু মুদলাজ এবং তাদের মিত্র বনু জামরার সাথে অনাক্রমণ চুক্তি সম্পাদন করেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই অভিযানকালে মদীনার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব হযরত আবু সালমা ইবনে আবদুল আছাদ মাখযুমঅ (রা.) আনজাম দেন।
সাত) ছারিয়্যা নাখলাহ
দ্বিতীয় হিজরীর রজব মোতাবেক ৬২৪ সালের জানুয়ারী
এই অভিযানে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা,)-এর নেতৃত্বে বারোজন মোহাজেরের একটি দল প্রেরন করেন। প্রতি দুইজন সৈন্যের জন্য একটি উট ছিলো। সেনাপতির হাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একখানি চিঠি দেন এবং বলেন যে, দুইদিন সফর শেষ করে তা যেন পাঠ করা হয়। দুইদিন সফর শেষে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা.) টিঠিখানি খুলে পাঠ করেন। তাতে লেখা ছিলো যে, আমার এই চিঠি পাঠ করার পর তোমরা মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী স্থান নাখলাহ-এ অবতরণ করবে এবং সেখানে কোরায়শদের একটি কাফেলার জন্যে ওঁৎ পেতে থাকবে। পাশাপাশি খবরাখবর সম্পর্কে আমাকে অবহিত করবে।
হযরত আবদুল্লাহ (রা.) সঙ্গী সাহাবীদের চিঠির বক্তব্য সম্পর্কে জানিয়ে বলেন যে, কারো ওপর জোর-জবরদস্তি করছি না, শাহাদত যাদের প্রিয়, তারা যেতে পারে। আমি যদি একা থেকে যাই তবুও সামনে অগ্রসর হবো।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ(রা.)-এর বক্তব্য শোনার পর তাঁরা নাখলাহ অভিমুখে রওয়ানা হলেন। যাওয়ার পথ হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস(রা.) এবং ওতবা ইবনে গোজওয়ান (রা.)-এর উট উধাও হয়ে যায়। এই উটের পিঠে উভয় সাহাবী পালাক্রমে সফর করছিলেন। উট হারিয়ে যাওয়ার কারণে তারা উভয়ে পেছনে পড়ে যান।
সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা.) নাখলাহ গিয়ে পৌছালেন। সেখানে গিয়ে শুনলেন যে, সেই পথ দিয়ে কোরায়শদের একটি বাণিজ্য কাফেলা অতিক্রম করেছে। সেই কাফেলায় কিসমিস, চামড়া এবং অন্যান্য সামগ্রী রয়েছে। সেই কাফেলায় আবদুল্লাহ ইবনে মুগীরার দুই পুত্র ওসমান ও নওফেল এবং মুগীরার মুক্ত দাস আমর ইবনে হাযরামী ও হাকীম ইকনে কায়সান রয়েছে। মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলেন যে, কি করবেন্ সেদিন ছিলো রজব মাসের শেস দিন। যুদ্ধ নিষিদ্ধ অর্থাৎ মাহে হারামের অন্যতম মাস হচ্ছে রজব। যুদ্ধ যদি করা হয়, তবে হারাম মাসের অমর্যাদা করা হয়। এদিকে যদি হামলা না করা হয়, তবে কোরায়শদের এই কাফেলা মদীনার সীমানায় প্রবেশ করবে। পরামর্শের পর হামরা করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। সাহাবীরা কোরায়শদের বাণিজ্য কাফেলা অনুসরণ করেন এবং আমর ইবনে হাদমারিকে লক্ষ করে তীর নিক্ষেপ করেন। এতে আমর ধরাশায়ী হয়ে প্রাণ ত্যাগ করে। অন্যরা ওসমান এবং হাকিমকে গ্রেফতার করেন। নওফের পালিয়ে যায়। তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। অতপর সাহাবারা উভয় বন্দী এবং জিনিসপত্র নিয়ে মদীনায় হাযির হন। সাহাবারা প্রাপ্ত জিনিসের মধ্যে থেকে এক পঞ্চমাংশ গনিমত হিসাবে বের করে নিয়েছিলেন। [ সীরাত রচয়িতারা এরূপ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে, যুদ্ধলব্ধ সম্পদের এক পঞ্চমাংশ গণিমত হিসাবে গ্রহণ করা সম্বলিত পাক কোরআনের নির্দেশ বদর যুদ্ধের সময় নাযিল হয়েছিলো। সেই আয়াতের শানে নযুল পাঠে বুঝা যায় যে, সেই নির্দেশের আগে মুসলমানেরা গণিমতের নির্দেশ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। ] এটা ছিলো ইসলামের ইতিহাসে প্রথম গণিমতের মাল, প্রথম নিহত এবং প্রথম বন্দী। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব কথা শোনার পর বললেন, আমি তো তোমাদেরকে নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করতে বলিনি। তিনি আটককৃত মালামাল এবং বন্দীদের ব্যাপারে কোন রকম বাড়াবাড়ি হতে দেননি।
এই ঘটনায় অমুসলিমরা এ প্রোপাগান্ডার সুযোগ পায় যে, মুসলমানরা আল্লাহর হারাম করা মাসকে হালাল করে নিয়েছে। এ নিয়ে নানারকম অপপ্রচার চালানো হয়। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাযিল করে বলেন, ‘পৌত্তলিকরা যা কিছু করছে, সেসব তৎপরতা মুসলমানদের কাজের চেয়ে অনেক বেশি অপরাধমূলক এবং ন্যক্কারজনক।’
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা সম্পর্কে লোকে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে। বলো, তাতে যুদ্ধ করা ভীষন অন্যায়। কিন্তু আল্লাহর পথে বাধা দান করা, আল্লাহকে অস্বীকার করা, মসজিদুল হারামে বাধা দেয়া এবং তার বাসিন্দাকে তা থেকে বহিস্কার করা আল্লাহর কাছে তদপেক্ষা বড় অন্যায়। ফেতনা হত্যা অপেক্ষা ভীষন অন্যায়।’ ( সূরা বাকারা, আয়াত ২১৭ )
এই ওহির মাধ্যমে পরিস্কার হয়ে গেছে যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাফেরদের সমালোচনা নিরর্থক। কেননা পৌত্তলিকরা ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই এবং মুসলমানদের ওপর যুলুম অত্যাচারের মাধ্যমে সকল প্রকার নিষেধাজ্ঞা পয়মাল করে দিয়েছে। হিজরতকারী মুসলমানদের অর্থ-সম্পদ যখন কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং পয়গাম্বরকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, তখন কি মক্কার মর্যাদা অর্থাৎ শহরে হারামের কথা চিন্তা করা হয়েছিলো? এসব ষড়যন্ত্র কি মক্কার বাইরে কোথাও হয়েছিলো? যদি না হয়ে থাকে, তবে হঠাৎ করে মক্কার মর্যাদা নিয়ে এতো উচ্চবাচ্য কেন? প্রকৃতপক্ষে পৌত্তলিকদের প্রোপাগান্ডার ঝড় সুস্পস্ট নির্লজ্জতা এবং খোলাখুলি বেহায়াপনা থেকে উৎসারিত।
এই আয়াত নাযিল হওয়ায় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয় বন্দীকে মুক্তি দিয়ে নিহত ব্যক্তির হত্যার ক্ষতিপুরণও প্রদান করেন। [ উল্লিখিত গোজোয়া এবং ছারিয়্যা বিবরণ যেসব গ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে, যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৮৩-৮৫, ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৯১-৬০৫, রহমাতুল লিল আলামীন ১ম খন্ড. পৃ. ১১৫-১১৬, ২য় খন্ড. পৃ. ২১২১৫-২১৬, ৪৬৮-৪৭০।
উল্লিখিত গ্রন্থাবলীতে কিছুটা মতভেদ পরিলক্ষিত হয়েছে। আমি আল্লামা ইবনে কাইয়েম এবং আল্লামা মনসুরপরীর বিশ্লেষণ গ্রহন করেছি ]
বদর যুদ্ধের আগে সংঘটিত গোযওয়া এবং ছারিয়্যা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো। এ সকল ঘটনায় লুটতরাজ, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা ঘটেনি। তবে পৌত্তলিকদের পক্ষ থেকে প্রথম হামলার ঘটনা ঘটে। কুরয ইবনে জাবের ফাহরীর নেতৃত্বে এ হামলা চালানো হয়। এর আগেও পৌত্তলিকদের পক্ষ থেকে নানা ধরনের বাড়াবাড়ি করা হয়েছিলো।
এদিকে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা.)-এর নেতৃত্বে সংঘটিত ছারিয়্যর পর পৌত্তলিকদের মনে আতঙ্ক দেখা দেয়্ যে জালে আটকা পড়বে বলে তারা আশঙ্কা করে আসছিলো, সেই জালেই তারা আটকা পড়ে। তারা বুঝতে পেরেছিলো যে, মদীনার নেতৃত্ব অত্যন্ত জাগ্রত বিবেকসম্পন্ন। মদীনায় বসে কোরায়শদের বাণিজ্যিক তৎপরতার খবর রাখছে। মুসলমানরা ইচ্ছে করলে তিনশত মাইলের ব্যবধান পেরিয়ে ডিঙ্গিয়ে তাদের এলাকায় এসে যা খুশী তা করে যেতে পারে। হত্যা, লুটতরাজ ইত্যাদি সবই তাদের দ্বারা সম্ভব। এসব কিছু করেও তারা নিরাপদে মদীনায় ফিরে যেতে সক্ষম। পৌত্তলিকরা বুঝতে পেরেছিলো যে, সিরিয়ার বাণিজ্য নতুন বিপদের সন্মুখীন। কিন্তু তারা সবকিছু জেনে বুঝেও তারা নিজেদের নির্বুদ্ধিতা থেকে বিরত হয়নি। জুয়াইনা এবং বনু জামরার মতো সন্ধি সমঝোতা অর্থাৎ অনাক্রমণ চুক্তি সম্পাদনের পরিবর্তে তারা ক্রোধ প্রকাশের পথ অবলম্বন করে। মুসলমানদের ঘরে প্রবেশ করে তাদেরকে নিঃশেষ করে দেবার হুমকি বাস্তবায়নে তারা সচেষ্ট হয়ে উঠে। এই ক্রোধই তাদেরকে বদর প্রান্তরে সমবেত করেছিলো।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা.)- এর নেতৃত্বাধীন ছারিয়্যার ঘটনার অল্পকাল পরেই আল্লাহ রব্বুল আলামীন মুসলমানদের ওপর দ্বিতীয় হিজরীর শাবান মাসে জেহাদ ফরয করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা কয়েকটি আয়াত নাযিল করেন। যেমন ‘যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তোমরাও আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। কিন্তু সীমালংঘন করো না। আল্লাহ তায়ালা সীমালংঘনকারীদের ভালো বাসেন না। যেখানে তাদের পাবে, হত্যা করবে এবং যে স্থান থেকে তারা তোমাদেরকে বহিস্কার করেছে, তোমরাও সেই স্থান থেকে তাদেরকে বহিস্কার করবে। হত্যা করা ফেতনা অপেক্ষা উত্তম। মসজিদুল হারামের কাছে তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে না, যে পযর্ন্ত তারা সেখানে তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ না করে। যদি তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তবে তোমরাও তাদেরকে হত্যা করবে, এটাই কাফেরদের পারিণাম। যদি তারা বিরত হয়, তবে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে, যতক্ষন না হত্যা করা ফেতনা দূরীভূত হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়। যদি তারা বিরত হয়, তবে যালেমদের ছাড়া অন্য কাউকে আক্রমন করা চলবে না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ১৯০-৯৩)
প্রায় একই সময়ে একই ধরনের অন্য আয়াতও নাযিল হয়। এতে যুদ্ধের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করা হয়। যেমন ‘অতএব যখন তোমরা কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ মোকাবেলা কর, তখন তাদের গর্দানে আঘাত কর। পরিশেষে যখন তাদের তোমরাকে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত করবে, তখন ওদেরকে কষে বাঁধবে। অতপর হয় অনুকম্পা নয় মুক্তিপণ। তোমরা জেহাদ চালাবে, যতক্ষন না যুদ্ধ তার অস্ত্র নামিয়ে ফেলে। এটাই বিধান। এটা এ জন্যে যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে ওদের শাস্তি দিতে পারতেন কিন্ত তিনি চান তোমাদের একজনকে অপরের দ্বারা পরীক্ষা করতে। যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তিনি কখনো তাদের কর্ম বিনষ্ট করে দেন না। তিনি তাদেরকে সৎ পথে পরিচালিত করেন এবং তাদের অবস্থা ভাল করে দেন। তিনি তাদেরকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার কথা তিনি তাদের জানিয়েছেন। হে মোমেন! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্যে করো, আল্লাহও তোমাদেরকে সাহায্যে করবেন এবং তোমাদের অবস্হান দৃঢ় করবেন।’ ( সূরা মোহাম্মদ, আয়াত ৪-৭ )
পরে আল্লাহ তায়ালা ওসব লোকের সমালোচনা করেছেন, যাদের মন যুদ্ধের আদেশ শুনে কাঁপতে থশুরু করে। যেমন আল্লাহ তায়ারা বলেন, ‘অতপর যদি দ্ব্যর্থহীন কোন সূরা অবতীর্ণ হয় এবং ওতে জেহাদের কোন নির্দেশ থাকে, তুমি দেখবে যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, তারা মৃত্যু ভয়ে বিহব্বল মানুষের মতো তোমার দিকে তাকাচ্ছে। শোচনীয় পরিণাম ওদের। (সূরা মোহাম্মদ, আয়াত ২০ )
প্রকৃতপক্ষে জেহাদ করা ফরয হওযা, এ জন্যে তাগিদ দেয়া এবং তার প্রস্তুতির নির্দেশ ছিলো পরিস্থিতির সময়ের দাবী। সেই সময়ের অবস্থার প্রতি গভীর দৃষ্টি রাখা অর্থাৎ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষনকারী একজন সেনানায়কের জন্যে এটাই ছিলো স্বাভাবিক যে, তিনি সর্বাত্মক যুদ্ধ প্রস্তুতির নির্দেশ প্রদান করতেন। প্রকাশ্যে এবং গোপনীয় সব কিছু সম্পর্কে অবগত সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা কেন জেহাদের আদেশ দেবেন না? সেই সময়ের পরিস্থিতি হক বাতিলের মধ্যে অর্থাৎ সত্য মিথ্যার মধ্যে একটি রক্তক্ষয়ী সংঘাত দাবী করছিলো। যাতে করে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হতে পারে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা.)-এর আঘাত কাফেরদের ক্রোধের আগুনে ঘৃতাহুতির শামিল ছিলো।
কোরআনের আয়াত থেকে বোঝা যাচ্ছলিো যে, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সময় ঘনিয়ে এসেছে। এই সংঘর্ষে জয়লাভ হবে মুসলমানদের। লক্ষনীয় হলো, আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে, কাফেররা তোমাদেরকে যে জায়গা থেকে বের করে দিয়েছে, তোমরাও তাদেরকে সেই জায়গা থেকে বের করে দাও, এছাড়া বন্দীদের আটক এবং বিরোধীদের নির্মূল করে যুদ্ধকে একটি পরিণতি দান করার জন্যে মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া এটাও বলা হয়েছে যে, মুসলমানরা একটি বিজয়ী এবং সফলকাম জাতির অন্তর্ভুক্ত। এই ইঙ্গিত দ্বারা এটাই বোঝানো হয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা জয় লাভ করবে। একথা ইশারায় বলার কারণ হলো, আল্লাহর পথে যারা জেহাদ যারা অতিমাত্রায় আগ্রহী, তারা যেন বাস্তর ক্ষেত্রে আগ্রহের প্রমাণ দিতে পারে।
সেই সময়ে অর্থাৎ দ্বিতীয় হিজরীর শাবান মাতাবেক ৬১৪ হিজরীর ফেব্রুয়ারী মাসে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের এ মর্মে নির্দেশ প্রদান করেন যে, তারা যেন বায়তুর মোকদাসের পরিবর্তে কাবা ঘরকে কেবলা মনোনীত করে এবং নামাযের মধ্যে যেন কাবার দিকে রোক পরিবর্তন করা হয়। এই পরিবর্তনের ফলে মুসলমানদের ছদ্মবেশে ঘাপটি মেরে থাকা মোনাফেকরা চিহ্নিত হয়ে যায়। তারা মুসলমানদের কাছ থেকে পৃথক হয়ে পড়ে। ফলে মুসলমানরা বিশ্বাসঘাতক ও খেয়ানতকারীদের এই ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছে যে, এখন থেকে এক নতুন যূগের সুচনা হবে। মুসলমানরা নিজেদের কেবলা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে। শত্রুর কবলে কেবলা থাকবে এটা হবে বিস্মযের ব্যাপার। সেটি মুক্ত করতে সচেষ্ট হওয়া হবে মুসলমানদের ঈমানী দ্বায়ীত্ব।
পবিত্র কোরআনের এ সকল নির্দেশ এবং ইশারার পর মুসলমানদের মনে ঈমানী চেতনা বৃদ্ধি পায়। তারা জেহাদ ফি ছাবিলিল্লাহর প্রেরণায় উজ্জিবীত হয়ে পড়ে এবং তাদের মনে শত্রুদের সাথে সিদ্ধান্তমূলক যুদ্ধের আকাঙ্খা বহুগুণ বেড়ে যায়।