মুতার যুদ্ধ
মুতা জর্দানের বালকা এলাকার নিকটবর্তী একটি জনপদ। এই জায়গা থেকে বায়তুল মাকদেসের দূরত্ব মাত্র দুই মানযিল। মুতার যুদ্ধ এখানেই সংঘটিত হয়েছিলো।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় মুসলমানরা যেসব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এ যুদ্ধ ছিলো সেসবের মধ্যে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী। এই যুদ্ধই খৃষ্টান অধ্যুষিত দেশসমূহ জয়ের পথ খুলে দেয়। অষ্টম হিজরীর জমাদিউল আউয়াল অর্থাৎ ৬২৯ খৃষ্টাব্দ বা সেপ্টেম্বর মাসে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
যুদ্ধের কারণ
এই অভিযানের কারণ এই যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হারেছ ইবনে ওমায়ের আযদীকে একখানি চিঠিসহ সবরায় গভর্ণরের কাছে প্রেরণ করেন। রোমের কায়সারের গবর্ণর শরহাবিল ইবনে আমর গাস্সানি সেই সময় বালক এলাকায় নিযুক্ত ছিলো। এই দুর্বৃত্ত রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দূতকে গ্রেফতার করে এবং শক্তভাবে বেঁধে হত্যা করে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, রাষ্ট্রদূত বা সাধারণ দূতদের হত্যা করা গুরুতর অপরাধ। এটা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল, এমনকি এমনকি এর চেয়েও গুরুতর মনে করা হয়।
এ কারণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রেরিত দূতের হত্যার খবর শোনার খুবই মর্মাহত হন। তিনি সেই এলাকায় মোতায়েনের জন্যে সৈন্যদের প্রস্তুতির নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী তিন হাজার সৈন্য তৈরী করা হয়।[ যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ১৫৫, ফতহুল বারী, ৭ম খন্ড, পৃ. ৫১১ ] খন্দরে যুদ্ধ চাড়া ইতিপূর্বে অন্য কোন যুদ্ধেই মুসলমানরা তিন হাজার সৈন্য সমাবেশ করেননি।
সেনানায়কদের প্রতি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়েদ ইবনে হারেচা (রা)-কে এই সেনাদলের সেনাপতি মনোনীত করেন। এরপর বলেন যে, যায়েদ যদি নিহত হন তবে জাফর এবং জায়র যদি নিহত হন, তবে আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা) সিপাহসালার নিযুক্ত হবেন।[ সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ. ৬১১]
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম সেনাদলের জন্যে সাদা পতাকা তৈরী করে তা হযরত যায়েদ ইবনে হারছার কাছে দেন।[ মুখতাছারুছ সিরাত শেখ আবদুল্লাহ পৃ. ৩২৭] সৈন্যদলকে তিনি ওসিয়ত করেন যে, হারেছ ইবনে ওমায়েরে হত্যাকান্ডের জায়গায় তারা যেন স্থানীয় লোকদের ইসলামের দাওয়াত দেন। যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে, তবে তো ভালো যদি ইসলাম গ্রহণ না করে তবে আল্লাহর দরবারে সাহায্য চাইবে এবং তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। তিনি আরো বলেন, আল্লাহর নাম নিয়ে আল্লাহর পথে, আল্লাহর সাথে কুফুরকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, খেয়ানত করবে না, কোন নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং গীর্জায় অবস্থানকারী দুনিয়া পরিত্যাগকারীকে হত্যা করবে না। খেজুর এবং অন্য কোন গাছ কাটবে না, কোন অট্টালিকা ধ্বংস করবে না। [রহমতুল লিল আলামীন, ২য় খন্ড, পৃ. ২৭১,]
ইসলামী বাহিনীর রওয়ানা
ইসলামী বাহিনী রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে সাধারণ মুসলমানরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মনোনীত সেনানায়কদের সালাম এবং বিদায়া জানান। সেই সময় অন্যতম সেনানায়ক হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহ (রা) কাঁদছিলেন। তাঁকে এ সময়ে কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ, দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ বা তোমারেদ সাথে সম্পর্কের কারণে আমি কাঁদছি না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাক কোরআনে একটি আয়াত তেলাওয়াত করতে শুনে জাহান্নামের ভয়ে আমি কাঁদছি জাহান্নারেম ভয়ে আমি কাঁদছি। সেই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তা অতিক্রম করবে, এটা তোমাদের প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত।’ (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৭১)
আমি জানি না যে, জাহান্নামে পেশ করার পর ফিরে আসব কিভাবে? মুসলমানরা বললেন, আল্লাহ তায়ালা সালামতির সাথে আপনাদের সঙ্গী হোন। আল্লাহ তায়ালা আপনাদের হেফাযত করুন এবং গনীমতের মালসহ আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনুন। হযরত আবদুল্লাহ তখন এই কবিতা আবৃত্তি করেন,
‘রহমানের কাছে মাগফেরাতের জন্যে
মগয বের করা তলোয়ারের আঘাতের জন্যে
বর্শা নিক্ষেপকারীর হাত, অন্ত্র কলিজা
চিরে ফেলা আঘাত করার শক্তি দানের জন্যে
সাহায্য চাই। আমার কবরে পাশ দিয়ে
যাবে যারা তারা বলবে এই সেই গাজী
যাকে আল্লাহ হেদায়াত দিয়েছেন এবং
যিনি হেদায়অত প্রাপ্ত
মুসলিম সৈন্যরা এরপর রওয়ানা হয়ে যান। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছানিয়াতুল অদা পর্যন্ত সেনাদলের সঙ্গে গিয়ে সৈন্যদের বিদায় জানান।[ ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ৩৭৩, ৩৭৪, যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ১৫৬, মুখতাছারুস সিরাত, পৃ. ৩২৭]
মুসলিম বাহিনীর সঙ্কট
উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে মুসলিম সৈন্যরা মাআন নামক এলাকায় পৌঁছুলেন। এ স্থান ছিলো হেজাজের সাথে সংশ্লিষ্ট জর্দানী এলাকায়। মুসলিম বাহিনী এখানে এসে অবস্থান নেন। মুসলিম গুপ্হচররা এসে খবর দিলেন যে, রোমের কায়সার বালকা অঞ্চলের মাআব এলাকায় এক লাখ রোমক সৈন্য সমাবেশ করে রেখেছে। এছাড়া তাদের পতাকাতলে লাখাম, জাজাম, বলকিন, বাহরা এবং বালা গোত্রের আরো এক লাখ সৈন্য সমবেত হয়েছিলো। উল্লিখিত শেষোক্ত এক লাখ ছিলো আরব গোত্রমূহের সমন্বিত সেনাদ।
মজলিসে শুরার বৈঠক
মুসলমানরা ধারণাই করতে পারেননি যে, তারা কোন দুর্ধর্ষ সেনাদলের সম্মখীন হবেন। দূরবর্তী এলাকায় তারা সত্যিই সঙ্কটজনক অবস্থার সম্মুখীন হলেন। তাদের সামনে এ প্রশ্ন মূর্ত হয়ে দেখা দিল যে, তারা কি তিন হাজার সৈন্যসহ দুই লাখ সৈন্যের সাথে মোকাবেলা করবেন? বিস্মিত চিন্তিত মুসলমানরা দুইরাত পর্যন্ত পরামর্শ করলেন। কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করলেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিঠি লিখে উদ্ভুত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হোক। এরপর তিনি হয়তো বাড়তি সৈন্য পাঠাবেন অথবা অন্য কোন নির্দেশ দেবেন। সেই নির্দেশ তখন পালন করা যাবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা.) দৃঢ়তার সাথে এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করলেন। তিনি বললেন, ‘হে লোক সকল, আপনার যা এড়াতে চাইছেন এটাতো সেই শাহাদাত, যার জন্য আপনারা বেরিয়েছেন। স্মরণ রাখবেন যে, শত্রুদের সাথে আমাদের মোকাবেলার মাপকাঠি সৈন্যদল, শক্তি এবং সংখ্যাধিক্যের নিরিখে বিচার্য নয়। আমরা সেই দ্বীনে জন্যই লড়াই করি, যে দ্বীন দ্বারা আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদেরকে গৌরাবান্বিত করেছেন। কাজেই সামনর দিকে চলুন। আমরা দুইটি কল্যাণের মধ্যে একটি অবশ্যই লাভ করবো। হয়তো আমরা জয়লাভ করবো অথবা শাহাদাত বরণ করে জীবন ধন্য হবে। অবশেষে আবদুল্লাহ ইববে রাওয়াহার মতামতের প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।
মুসলিম বাহিনীর অগ্রযাত্রা
মাআন নামক এলাকায় দুই রাত অতিবাহিত করার পর মুসলিম বাহিনী শত্রুদের প্রতি অগ্রসর হলেন। বালকার মাশারেফ নামক জায়গায় তারা হিরাক্লিয়াসের সৈন্যদের মুখোমুখি হলেন। শত্রুরা আরো এগিয়ে এলে মুসলমানরা মুতা নামক জায়গায় গিয়ে সমবেত হন। এরপর যুদ্ধের জন্য সৈন্যদের বিন্যস্ত করা হয়। ডানদিকে কোতাবা ইবনে কাতাদা আজরিকে এবং বামদিকে ওবাদা ইবনে মালেক আনসারী (রা.)-কে নিযুক্ত করা হয়।
সেনা নায়কদের শাহাদাত
মুতা নামক জায়গায় উভয় দলের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে অত্যন্ত তিক্ত লড়াই হয়। মাত্র তিন হাজার মুসলিম সৈন্য দুই লাখ অমুসলিম সৈন্যের সাথে এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। বিসম্ময়কর ছিলো এ যুদ্ধ। দুনিয়ার মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। ঈমানের বাহাদুরি চলতে থাকলে এ ধরণের বিস্ময়কর ঘটনাও ঘটে।
সর্বপ্রথম রসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় পাত্র হযরত যায়েদ ইবনে হারেছ (রা.)পতাকা গ্রহণ করেন। অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দিয়ে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। এ ধরনের বীরত্বের পরিচয় মুসলমান ব্যতীত অন্য করো ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়নি।
হযরত যায়েদ-এর শাহাদাতের পর পতাকা দুলে নেন হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব। তিনিও তুলনাহীন বীরত্বের পরিচয় দিয়ে লড়াই করতে থাকেন। তীব্র লড়াইয়ের এক পর্যায়ে তিনি নিজের সাদাকালো ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ে শত্রুদের ওপর আঘাত করতে থাকেন। শত্রুদের আঘাতে তাঁর ডানহাত কেটে গেলে তিনি বাঁ হাতে যুদ্ধ শুরু করেন। শাহাদাত বরণ করা পর্যন্ত এভাবে পতাকা ধরে রাখেন।
বলা হয়ে থাকে যে, একজন রোমক সৈন্য তরবারি দিয়ে তাকে এমন আঘাত করে যে, তার দেহ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে বেহেশতে দুটি পাখা দান করেছিলেন। সেই পাখার সাহায্যে তিনি জান্নাতে যেখানে ইচ্ছা উড়ে বেড়ান। এ কারণে তাঁর উপাধি ‘জাফর তাইয়ার’ এবং জাফর যুল জানাহাইন। তাইয়ার অর্থ উড্ডয়নকারী আর যুল জানাহাইন অর্থ দুই পাখাওয়ালা।
ইমাম বোখারী নাফে-এর মাধ্যমে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, মুতার যুদ্ধের দিনে হযরত জাফর শহীদ হওয়ার পর আমি তার দেতে আঘাতের চিহ্নগুলো গুণে দেখেছি। তাঁর দেহে তীর ও তলোয়ারের পঞ্চাশটি আঘাত ছিলো। এ সব আঘাতের একটিরও পেছনের দিকে ছিলো না।৬[ফতহুল বারী,৭ম খন্ড, পৃ.৫১২, উভয় বর্ণনায় সংখ্যার পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্য নিরসন এভাবে করা হয় যে, তীরের আঘাতের সংখ্যাসহ ৯০টি।]
অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে,আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, আমি মুতার যুদ্ধে মুসলমানদের সঙ্গে ছিলাম। জাফর ইবনে আবু তালেবকে সন্ধান করে নিহতদের মধ্যে তাদেরকে পেয়ে যাই। তাঁর দেহে বর্শা ও তীরের ৯০টির বেশী আঘাত দেখেছি।৭[একই গ্রন্থ একই পৃষ্টা], নাফে থেকে বর্ণিত রয়েছে ডে, ইবনে ওমরের বর্ণনায় এও আছে যে, আমি এসকল জখম লক্ষ্যে করেছি তাঁর দেহের সম্মুখভাগে।৮[ফহতুল বারী, ৭ম খন্ড, পৃ.৫১২,উভয় বর্ননায় সংখ্যার পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্য নিরসন এভাবে করা হয় যে, তীরের আঘাতের সংখ্যাসহ ৯০টি।]বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের মাধ্যমে হযরত জাফর (রা.)-এর শাহাদাত বরণের পর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা.) পতাকে গ্রহণ করে ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে সামনে অগ্রসর হন। কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর তিনি এ কবিতা আবৃতি করেন,
‘ওরে মন খুশী বেজার যেভাবে হোক
মোকাবেলা কর। যুদ্ধের আগুন জ্বেলেছে ওরা
বর্শা রেখছে খাড়া। জান্নাত থেকে
কেনরে তুই থকতে চাস দূরে?
এরপর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা.)বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকেন। তাঁর চাচাতো ভাই গোশত লেগে থাকা একটা হাড় তাঁর হাতে দেন। তিনি এক কামড় খেয়ে ছুঁড়ে ফেলেন। এরপর লড়াই করতে করতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
আল্লাহর তলোয়ার
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা শাহদাতের পর বনু আযলান গোত্রের ছাবেত ইবনে আরকাম একজন সাহাবী গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, হে মুসলমানরা, তোমারা উপযুক্ত একজনকে সেনাপতির দায়িত্ব দাও। সাহাবারা ছাবেতকেই সেনাপতির দায়িত্ব নিতে বললে তিনি বলেন, আমি একাজের উপযুক্ত নই। এরপর সাহাবারা হযরত খালেদ ইবনে ওলীদ (রা.) কে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। তিনি পতাকা গ্রহণের পর তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। সহীহ বোখারীতে স্বয়ং খালেদ ইবনে ওলীদ (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, মুতার যুদ্ধের দিনে আমার হাতে ৯টি তলোয়ার ভেঙ্গেছে। এরপর আমার হাতে একটি ইয়েমেনী ছোট তলোয়ার অবশিষ্ট ছিলো।৯[সহীহ বোখারী, মুতা যুদ্ধ অধ্যায় ২য় খন্ড, পৃ.৬১১]
অপর এক বর্ণনায় তাঁর যবানীতে এভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, মুতার যুদ্ধের দিনে আমার হাতে ৯টি তলোয়ার ভেঙ্গেছে। এরপর আমার হাতে একটি ইয়েমেনী ছোট তলোয়ার অবশিষ্ট ছিলো।১০[ঐ পৃষ্টা নং,৬১২]
এদিকে রসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম রণক্ষেত্রের খবর লোক মারফত পৌঁছার আগেই ওহীর মাধ্যমে পান। তিনি বলেন, যায়েদ পতাকা গ্রহণ করেছিলেন, তিনি শহীদ হন। এরপর জাফর পতাকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি শহীন হন। এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা পতাকা গ্রহণ করেছিলেন, তিনিও শহীন হন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লামের চোখ এ সময় অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, এরপর পতাকা গ্রহণ করেন আল্লাহর তলোয়ার সমূহের মধ্যে একটি তলোয়ার। তাঁর যুদ্ধের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের জয়যুক্ত করেন।১১[ঐ পৃষ্টা নং,৬১১]।
যুদ্বের সমাপ্তি
বীরত্ব, বাহাদুরি ও নিবেদিত চিত্ততা সত্তেও মুসলমানদের মাত্র তিন হাজার সৈন্য দুই লাখ অমুসলিম সৈন্যের সামানে টিকে থাকা ছিলো এক বিস্ময়কর ঘটনা। হযরত খলেদ ইবনে ওলীদ (রা.)এ সময়ে যে বীরত্বের পরিচয় দেন, ইতিহাসে তার তুলনা খঁজে পাওয়া যায় না।
এ যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কিত বর্ণনাসমূহে যথেষ্ট মতভেত রয়েছে। সকল বর্ণনা পাঠ করার পর জানা যায় যে, যুদ্ধের প্রথম দিন শেষ পর্যায়ে হযরত খালেদ (রা.)রোমক সৈন্যদের মোকাবেলায় অবিচল ছিলেন। তিনি সেই সময় এক নতুন যুদ্ধকৌশলের কথা ভাবছিলেন, যাতে রোমকদের প্রভাবিত করা যায়। সেই কৌশলের মাধ্যমে ধীরে ধীরে মুসলমানদের পিছিয়ে নেয়ায় ছিলো উদ্দেশ্য। তবে, কোন অবস্থায়ই রোমকরা যেন ধাওয়া করতে না পারে, সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে। কেননা রোমকরা ধাওয়া করলে তাদের কবল থেকে রক্ষা পাওয়া হবে খুবই কঠিন।
পরদিন সকালে হযরত খালেদ (রা.)সেনাদল রদবদল করে বিন্যাস্ত করলেন। ডানদিকের সৈন্যদেরকে বাঁদিকে এবং বাঁদিকের সৈন্যদের পেছনে নিয়ে গেলেন। এরূপ আদল বদলে দৃশ্য থেকে শত্রুরা বলাবলি করতে লাগলো যে, মুসলমানর সহায়ক সৈন্য পেয়েছে, তাদরে শক্তি পূর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সেনা বিন্যাস অদল বদল করে হযরত খালেদ (রা.) মুসলমানদের ধীরে ধীরে পিছিয়ে নিলেন। রোমক সৈন্যরা মুসলমানদের আক্রমণ করতে এগিয়ে গেলো না কারণ তারা তখন ভাবছিলো যে, মুসলমানরা ধোঁকা দিচ্ছে। তার মরুপ্রান্তরে নিয়ে পাল্টা হামলা করে পর্যদুস্ত করবে। এরূপ চিন্তা করে রোমক সৈন্যরা মুসলমানদের ধাওয়া না করে নিজেদের এলাকায় ফিরে গেলো। এদিকে মুসলমানরা পিছাতে পিছাতে মদীনায় গিয়ে পৌছালেন।১২[ফতহুল বারী, ৭ম খন্ড, পৃ.৫১৩,৫১৪,যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ.১৫৬।]
হতাহতের সংখ্যা
মুতার যুদ্ধে ১২ জন মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন। রোমকদের মধ্যে কতোসংখ্যক হতাহত হয়েছে তার বিবরণ জানা যায়নি। তবে যুদ্ধের বিবরণ পাঠে বোঝা যায় যে, তাদের বহু হতাহত হয়েছে। কেননা, একমাত্র হযরত খালেদের হাতেই ৯টি তলোয়ার ভেঙ্গেছিলো। এতেই শত্রু সৈন্যদের হতাহতের সংখ্যা সহজেই আন্দাজ করা যায়।
মুতার যুদ্ধের প্রভাব
যে প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে মুতা অভিযান পরিচালিত হয়েছিলো, সেটা সম্ভব না হলেও এ যুদ্ধের ফলে মুসলমানদের সুনাম সুখ্যাতি বহু দূর বিস্তার লাভ করে। সমগ্র আবর জগত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। কেননা, রোমকরা ছিলো সে সময়ের শ্রেষ্ঠ শক্তি। আবরব মনে করতো যে, রোমকদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হওয়া মানে আত্মহত্যার শামিল। কাজেই, উল্লোখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া তিনহাজার সৈন্য দুই লাখ সৈন্যের মোকাবেলায় সাহসিকতাপূর্ণ বিজয় গৌরব সহজ কথ নয়। আরবের জনগণ বুঝতে সক্ষম হয়েছিলো যে, ইতিপূর্বে পরিচিতি সকল শক্তির চেয়ে মুসলমানরা সম্পূর্ণ আলাদা। আল্লাহর সাহয্য মুসলমানদের সাথে রয়েছে। তাদের নেতা মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিঃসন্দহে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এ কারণেই দেখা যায় যে, মুসলমানদের চিরশত্রু জেদী ও অহংকারী হিসেবে পরিচিত বেশ কিছু সংখ্যক গোত্র মুতার যুদ্ধের পর ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। এসব গোত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গোত্র হচ্ছে, বনু ছালিম, আশজা, গাতফান, জিবান ও ফাজারাহ।
মুতার যুদ্ধের প্রাক্কালে রোমকদের সাথে যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হয়েছিলো এর ফলেই পরবর্তীকালে মুসলমানদের বিজয় গৌরব দূরদূরান্তে বিস্তার লাভ করে।
ছ্যারিয়্যা যাতে-ছালছেল
মুতার যুদ্ধে রোমক সৈন্যদের সাথে আরবদের বিভিন্ন গোত্রের সহযোগিতামূলক ভূমিকার কথা জেনে রসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন একটি পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী মনে করেন যাতে, রোমক ও আরবদের গোত্রগুলো মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের হাত প্রসিরিত করে এবং ভবিষ্যতেও মূসলমানদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার সৈন্য সমাবেশের চিন্তা না করে।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ উদ্দেশ্যে হযরত আমর ইবনু আস (রা.)-কে মনোনীত করেন। তাঁর দাদী ছিলেন বালা গোত্রের মহিলা। মুতার যুদ্বের পর অষ্টম হিজরীর জমাদিউস সানিতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আমর ইবনু আস (রা.)-কে প্রেরণ করেন। বলা হয়ে থাকে যে, গুপ্তচরদের মাধ্যমে খবর পাওয়া গেছে যে, বনু কাজাআ গোত্র হামলা করতে মদীনার উপকন্ঠে বহু সৈন্য প্রস্তুত করেছে। এসব কারনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমর ইবনুল আস (রা.)-কে প্রেরণ করেন।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, মুসলিম সেনাদল বলি, আজরা এবং বলকিন এলাকার লোকদের কাছে দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের কাছে যেন সাহয্য চান। মুসলিম সেনাদল রাত্রিকালে সফর করতেন এবং দিনের বেলা লুকিয়ে থাকতেন। শত্রুদের কাছাকাছি পৌঁছার পর জানা গেলো যে, শত্রুরা দল ভারি। হযরত আমর তখন রাফে ইবনে মাকিছ জাহনিকে সাহায্যের চিঠিসহ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রেরণ করেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুইশত সৈন্য হযরত আবু ওবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.)-এর নেতৃত্বে প্রেরণ করেন। এদের মধ্যে হযরত আবু বকর, হযরত ওমর সহ আনসার ও মোহাজেরদরে বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দও ছিলেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেনাপতি আবু ওবায়দা (রা.)-কে নির্দেশ দেন, তিনি যেন আমর ইবনুল আস এর সাথে মিলিত হয়ে উভয়ে মিলেমিশে কাজ করেন। কোন প্রকার মতানৈক্য যেন না করেন। আবু ওবায়দা অকূস্থলে যাওয়ার পর পুরো বাহিনীর অধিনায়কত্ব চান। কিন্তু হযরত আমর ইবনুল আস বললেন, অধিনায়ক তো আমি, আপনিতো সহায়ক সৈন্য নিয়ে এসেছেন। আবু ওবায়দা একথা মেনে নেন। এরপর নামাযের ইমামতিও সেনাদল প্রধান হযরত আমর ইবনুল আসই করতে থাকেন।
সহায়ক সেনাদল পৌঁছার পর কাজাআ এলাকায় পৌঁছেন এবং সেখান থেকে দূরবর্তী স্থানে যান। একপর্যায়ে শত্রুদের সাথে মোকাবেলা হওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু মুসলমানদের হামলার উদ্যেগের মুখে তারা দ্রুত পালিয়ে যায়।
এরপর আওফ ইবনে মালেক আশজায়ীকে দূত হিসেবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রেরণ করা হয়। তিনি মুসলমানদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন এবং অভিযানের বিবরণ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শোনান।
যাতে-ছালছেল ওয়দিউল কোরা প্রন্তরের সামনের একটি জায়গা। এটি মদীনা থেকে ১০ দিনের দূরত্বে অবস্থিত। ইবনে ইসহাক বলেন, মুসলমানরা জাজাম গোত্রের ছালাছেল নামের একটি জলাশয়ের পাশে অবতরণ করেন। তাই এ অভিযানের নাম করা হয় যাতে-ছালাছেল।১৩[ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ.৬২৩-৬২৬, যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ.১৫৭]
ছারিয়্যা খাজারাহ
অষ্টম হিজরীর শাবান মাস
এ অভিযানের কারণ ছিলো এই যে, নজদের অভ্যন্তরে মুহরিব গোত্রের এলাকার খাজরাহ নামের জায়গায় বনু গাতফান গোত্র সৈন্য সমাবেশ করছিলো। এদের দমন করতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পনেরজন সাহাবীকে হযরত আবু ওবায়দার নেতৃত্বে প্রেরণ করেন। এই সেনাদল শত্রুদের কয়েকজনকে হত্যা, কয়েকজনকে বন্দী এবং গনীমতের মাল লাভ করেন। এই অভিযানে প্রেরিত সেনাদল হযরত আবু ওবায়দার নেতৃত্বে পনের দিন মদীনার বাইরে অবস্থান করেন।১৪[রহমতুল লিল আলামীন ২য় খন্ড, পৃ.২৩৩, তালকীহুল ফুহুম পৃ.৩৩]।
সে বললো, (বিজয় লাভ করা (সত্বেও) আজ তোমাদের বিরুদ্ধে (আমার) কোন প্রতিশোধ নেই,আল্লাহ তায়ালা (অতীত আচরণের জন্য) তোমাদের ক্ষমা করে দিন, (কেননা তিনি সব দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
(সূরা ইউসুফঃ ৯২