আবিসিনিয়ায় প্রথম হিজরত
যুলুম অত্যাচার ও নির্যাতনের এ ধারা নবুয়তের চতুর্থ বছরের মাঝামাঝি বা শেষ দিকে শুরু হয়েছিল, প্রথমদিকে ছিলো মামুলি কিন্তু দিনে দিনে এর মাত্রা বেড়ে চললো, নবুয়তের পঞ্চম বছরের মাঝামাঝি সময়ে তা চরমে পৌছলো, মক্কায় অবস্থান করা মুসলমানদের জন্যে অসম্ভব হয়ে উঠলো, সেই সঙ্কটময় এবং অন্ধকার সময়ে সূরা কাহাফ নাযিল হলো, এতে পৌত্তলিকদের উত্থাপিত বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে, তাতে বর্ণিত তিনটি ঘটনায় আল্লাহর পক্ষ থেকে মোমেন বান্দাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইংগিত দেয়া হয়েছে, আসহাবে কাহাফের ঘটনায় এ শিক্ষা মজুদ রয়েছে যে, দ্বীন ঈমান যখন আশঙ্কার সম্মুখীন হয় তখন কুফুরী এবং যুলুম-অত্যাচারের কেন্দ্র থেকে সশরীরে হিজরত করতে হবে, আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা যখন ওদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে এবং ওরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের এবাদত করে তাদের কাছ থেকে তখন তোমরা গুহায় আশ্রয় গ্রহন কর, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্যে তাঁর দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের কাজকর্মকে ফলপ্রসূ করার ব্যবস্থা করবেন, (১৬, ১৮)।
হযরত মূসা (আ.) এবং হযরত খিযির (আ.) এর ঘটনা থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে, পরিণাম সব সময় প্রকাশ্য অবস্থা অনুযায়ী নির্ণীত হয় না, বরং কখনো কখনো প্রকাশ্য অবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীতও হয়ে থাকে, কাজেই এ ঘটনায় সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধ বর্তমানে যেসব যুলুম অত্যাচার হচ্ছে, তার পরিণাম হবে সম্পূর্ণ বিপরীত, এসব পৌত্তলিক ও উদ্ধত বিদ্রোহী ঈমান না আনলে একদিন তারা পরাজিত হয়ে বাধ্য হবে মুসলমানদের সামনে মাথা নত করতে এবং তাদের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য মুসলমানদের সামনে আত্মসমর্পণ করবে,।
যুলকারনাইনের ঘটনায় নীচে উল্লিখিত কয়েকটি শিক্ষার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে,
এক. যমীনের মালিকানা আল্লাহর, তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাকে চান তার অংশীদার করেন।
দুই. সাফল্য একমাত্র ঈমানের পরে রয়েছে কুফুরীর পথে নেই।
তিন. আল্লাহ তায়ালা মাঝে মাঝে বান্দাদের মধ্যে থেকে এমন মানুষদের উত্থান ঘটান যারা যুলুম ও উৎপীড়িত মানুষদের সেই কাফের ইয়াজুজ মাজুজদের কবল থেকে মুক্তি দেন।
চার. আল্লাহর পুণ্যশীল বান্দারা যমীনের অংশীদার হওয়ার সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত।
সূরা কাহাফের পর আল্লাহ তায়ালা সূরা ঝুমার নাযিল করেন, এতে হিজরতের প্রতি ইশারা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, আল্লাহর যমিন সংকীর্ণ নয়, আল্লাহ তায়ালা বলেন, বলো, হে আমার মোমেন বান্দারা, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ভয় কর, যারা এ দুনিয়ায় কল্যাণকর কাজ করে তাদের জন্য আছে কল্যাণ, প্রশস্ত আল্লাহর পৃথিবী, ধৈর্যশীলকে তো অপরিমিত পুরস্কার দেয়া হবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জানা ছিলো যে, হাবশার বাদশাহ আসহামা নাজ্জাশী একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক, তার রাজ্যে কারো ওপর কোন যুলুম অত্যাচার করা হয় না, এ কারণে আল্লাহর রাসূল মুসলমানদেরকে তাদের দ্বীনের হেফাজতের জন্য হাবশায় হিজরত করার আদেশ দিলেন, এরপর পরিকল্পিত কর্মসূচী অনুযায়ী রজব মাসে সাহাবায়ে কেরামের প্রথম দল হাবশার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন, এ দলে বারো জন পুরুষ এবং চারজন মহিলা ছিলেন, হযরত ওসমান (রা.) ছিলেন দলনেতা, তার সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কন্যা হযরত রোকাইয়া (রা.) ও ছিলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সম্পর্কে বলেন, হযরত ইবরাহীম (আ.) এবং হযরত লুত (আ.) এর পর আল্লাহর পথে হিজরতকারী এরা প্রথম দল (মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আমানুল্লাহ)।
রাতের অন্ধকারে চুপিসারে এরা গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হয়, কোরাইশদের জানতে না দেয়ার উদ্দেশ্যেই এ ধরনের সতর্কতার ব্যবস্থা করা হয় প্রথমে তারা লোহিত সাগরের শুরাইবা বন্দরের দিকে অগ্রসর হন, সৌভাগ্যক্রমে সেখানে দুটি বাণিজ্যিক নৌকা পাওয়া গিয়েছিলো, সেই নৌকায় আরোহণ করে তারা নিরাপদে হাবশায় গমন করেন, তারা চেল যাওয়ার পর কোরাইশরা তাদের যাওয়ার খবর পায়, তারা খবর পাওয়ার পরই সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত ছুটে যায়, কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম (রা.) আগেই চলে গিয়েছিলেন, এ কারণে তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে, ওদিকে মুসলমানরা হাবশায় পৌছে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন (রহমাতুল লিল আলামিন ১ম খন্ড, পৃ. ৬১ যাদুল মায়াদ ১ম খন্ড, পৃ. ২৪)।
সেই বছরই রমযান মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হারাম শরীফে গমন করেন, সেখানে নেতৃস্থানীয় কোরাইশরা সমবেত হয়েছিলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আকস্মিকভাবে উপস্থিত হয়ে সূরা নাজম তেলাওয়াত শুরু করেন, একত্রে এতো পৌত্তলিক এর আগে কখনও কোরআন শোনেনি, কেননা তাদের সিদ্ধান্ত ছিলো এ রকম যে, কখনো কোরআন শোনা যাবে না, কোরআনের ভাষায়, কাফেররা বলে, তোমরা এই কোরআন শ্রবণ করো না, এবং তা যখন তেলাওয়াত করা হয়, তখন শোরগোল করো যাতে, তোমরা জয়ী হতে পারো (২৬, ৪১)।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হঠাৎ করে মধুর স্বরে কোরআন তেলাওয়াত শুরু করলে পৌত্তলিকরা মোহিত হয়ে পড়ে তারা কোরআনের লালিত্য ভাষার মাধুর্যে ছিলো মুগ্ধ ও বিমোহিত, কারো মনে সে সময় অন্য কোন চিন্তাই আসেনি, সবাই এমনই অভিভূত হয়ে পড়েছিলো, সূরার শেষ দিকের এই আয়াত তিনি তেলাওয়াত করলেন, আল্লাহর জন্যে সেজদা করো এবং তার এবাদত করো, এই আয়াত পাঠ করার পরই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেজদায় চলে গেলেন, সাথে সাথে পৌত্তলিকরাও সেজদা করলো, সত্যের প্রভাব এবং মাধুর্য অমুসলিমদের অহংকার চূর্ণ করে দিয়েছিলো, তারা কেউই নিজের মধ্যে ছিলো না এ কারণে নিজের অজ্ঞাতেই সেজদায় নত হয়েছিল (সহীহ বোখারী শরীফে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে এ ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে)।
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তারা অবাক হয়ে গেলো, যে দ্বীনকে নিশ্চিহ্ন করতে তারা সর্বতোভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, সেই কাজেই তাদের নিয়োজিত হতে দেখে সেখানে অনুপস্থিত পৌত্তলিকরা তাদের তিরস্কার করলো, তিরস্কারের কবল থেকে রক্ষা পেতে তারা তখন বললো, মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মূর্তিগুলোর কথা সম্মানের সাথে উল্লেখ করছেন, নিজেদেরকে নির্দোষ প্রমাণ করতে তারা বললো, মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ওরা সব উচ্চমার্গের দেবী এবং তাদের শাফায়াতের আশা করা যেতে পারে।
অথচ এটা ছিল সুস্পষ্ট মিথ্যা কথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সেজদা করে তারা যে ভুল করেছিলো, তার একটা যুক্তিসঙ্গত ওযর পেশ করতে এ গল্প তৈরি করেছিলো। বলা বাহুল্য, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সব সময় মিথ্যাবাদী বলে রটনা করে, তাঁর বিরুদ্ধে নিন্দা কুৎসা রটায় তারা আত্মরক্ষার জন্য এ ধরনের বানোয়াট কথার আশ্রয় নেবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই (উল্লিখিত বর্ণনা সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণের পর বিশেষজ্ঞরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন)।
কোরাইশদের এই সেজদা করার খবর হাবসায় হিজরতকারী মুসলমানরাও পেয়েছিল, কিন্তু তারা ভুল খবর পেয়েছিলেন, তারা শুনেছেন যে, কোরাইশ নেতারা মুসলমান হয়ে গিয়েছে, এ খবর পাওয়ার পর শাওয়াল মাসে তারা মক্কায় ফিরে আসার জন্য হাবসা ত্যাগ করেন, মক্কা থেকে একদিনের দূরত্বে থাকার সময় তারা প্রকৃত খবর পেলেন, এরপর কেউ কেউ হাবসায় ফিরে গেলেন, আবার কেউ কেউ চুপিসারে অথবা কোরাইশদের কোন লোকের আশ্রিত হিসেবে মক্কায় প্রবেশ করেন (যাদুল মায়াদ, ১ম খন্ড, পৃ. ২৪, ২য় খন্ড, পৃ. ৪৪, হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৬৪)।
আবিসিনিয়ায় দ্বিতীয় হিজরত
এরপর সেই হিজরতকারী মোহাজেরদের উপর, বিশেষভাবে মুসলমানদের উপর সাধারণভাবে পৌত্তলিকদের অত্যাচার আরো বেড়ে গেল, পরিবারের অমুসলিমরা মুসলমানদের নানাভাবে কষ্ট দিতে লাগলো কেননা কোরাইশরা খবর পেয়েছিলো যে, নাজ্জাশী মুসলমানদের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করেছেন, এবং হাবসায় মুসলমানরা খুব ভালোভাবে দিন কাটিয়েছেন, এ খবর তাদের অন্তরজ্বালা বাড়িয়ে দিয়েছিলো, কোরাইশদের অত্যাচার নির্যাতন বাড়িয়ে যাওয়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুনরায় হাবসায় হিজরত করতে সাহাবাদের পরামর্শ দিলেন, তবে প্রথম বারের হিজরতের চেয়ে এটা ছিল কঠিন, কোরাইশ পৌত্তলিকরা এবারে ছিল সতর্ক, তাদের ফাকি দিয়ে মুসলমানরা অন্যত্র চলে গিয়ে নিরাপদে জীবন যাপন করবে এটা তারা ভাবতেই পারছিলো না, কিন্তু মুসলমানরা অমুসলমানদের চেয়ে অধিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেওয়ায় আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য হাবসায় যাওয়ার পথ সহজ করে দিলেন, ফলে হিজরতকারী মুসলমানরা কোরাইশদের নিয়ন্ত্রনে যাওয়ার আগেই হাবসার বাদশার কাছে পৌঁছে গেলেন, এবার বিরাশি বা তিরাশিজনের একটি দল হিজরত করনে, হযরত আম্মার (রা.) এর হিজরতের চেয়ে ভিন্ন ঘটনা, এ হিজরতে আঠারো উনিশজন মহিলা ছিল (যাদুল মায়াদ, ১ম খন্ড, পৃ. ১৪০, রহমাতুল লিল আলামিন ১ম খন্ড, পৃ. ৬০) আল্লামা মনসুরপুরী মহিলাদের সংখ্যা আঠারো বলে উল্লেখ করেছেন (রহমাতুল লিল আলামিন)।
আবিসিনিয়ায় কোরাইশদের ষড়যন্ত্র
মুসলমানরা জীবন ও ঈমান নিয়ে এক জায়গায় চলে গেছে এটা ছিলো কোরাইশদের জন্য মারাত্মক মনোবেদনার কারণ, অনেক আলোচনার পর তারা আমর ইবনুল আস এবং আবদুল্লাহ ইবনে রবিয়াকে এক গুরুত্বপূর্ণ মিশনে হাবসায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল।
এই দুজন তখনও ইসলাম গ্রহণ করেন নি, এরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছিলেন, হাবসার বাদশাহকে দেওয়ার জন্য কোরাইশরা এই দুজন দূতের জন্য মূল্যবান উপঢৌকন পাঠালো, এরা প্রথম বাদশাহকে উপঢৌকন দিলেন, এরপর সেসব যুক্তি এবং কারণ ব্যাখ্যা করলেন, যার ভিত্তিতে তারা মুসলমানদের জন্য মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান, তারা বললো, হে বাদশাহ, আপনার দেশে আমাদের কিছু নির্বোধ যুবক পালিয়ে এসেছে, তারা স্বজাতির ধর্ম বিশ্বাস পরিত্যাগ করেছে, কিন্তু আপনি যে ধর্মে বিশ্বাস পোষণ করেন সেই ধর্ম বিশ্বাসও তারা গ্রহণ করেনি, বরং তারা এক নব আবিস্কৃত ধর্ম বিশ্বাস গ্রহণ করেছ, এ ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে আমরাও কিছু জানিনা আপনারাও কিছু জানেন না, ওদের পিতা মাতা ও আত্মীয়স্বজন আমাদেরকে ওদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন, তারা চান না যে, আপনারা তাদের নির্বোধ লোকদের আমাদের সাথে ফিরিয়ে দেবেন, তারা নিজেদের লোকদের ভালো মন্দ সম্পর্কে ভালোভাবে বোঝেন, দরবারের সভাসদরাও চাচ্ছিলেন যে, বাদশাহ যেন মুসলমানদের ফিরিয়ে দেন।
নাজ্জাশী ভাবলেন যে, এ সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে সব দিক ভালভাবে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে, তিনি মুসলমানদের তার দরবারে ডেকে পাঠালেন, মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তারা নির্ভয়ে সত্য কথা বলবে, এতে পরিণাম যা হয় হবে, মুসলমানরা দরবারে আসার পর নাজ্জাশী জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা যে ধর্ম বিশ্বাসের কারণে নিজেদের স্বজাতীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছ সেটা কি? তোমরা তো আমার অনুসৃত ধর্ম বিশ্বাসে প্রবেশ করোনি, মুসলমানদের মুখপাত্র হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব (রা.) বলেন হে বাদশাহ, আমরা ছিলাম মূর্তি পূজায় লিপ্ত একটি মূর্খ জাতী, আমরা মৃত পশুর মাংস খেতাম, পাপ কাজে লিপ্ত থাকতাম, নিকটাত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম, প্রতিবেশীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম, আমাদের মধ্যে শক্তিশালীরা দুর্বলদের উপর অত্যাচার করতো, আমরা যখন এরূপ অবস্থায় ছিলাম, তখন আল্লাহ তায়ালা আমাদের মধ্যে একজনকে রসূলরূপে পাঠান, তাঁর উচ্চ বংশ মর্যাদা, সত্যবাদিতা, সচ্চরিত্রতা, আমানতদারী, ও বিশ্বস্ততা, সম্পর্কে আমরা আগে থেকেই জানতাম, তিনি আমাদেরকে আল্লাহর পথে ডেকে বুঝিয়েছেন যে, আমরা যেন এক অদ্বিতীয় কে মানি এবং তার ইবাদত করি, যেসব মূর্তি ও পাথরকে আমাদের পিতামহ পূজা করতেন সেসব যেন পরিত্যাগ করি, তিনি আমাদের সত্য বলা, আমানত আদায় করা, নিকটাত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক স্থাপন, পাপ না করা, রক্তপাত থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, অশ্লীল কাজে লিপ্ত, মিথ্যা বলা, এতিমের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করা এবং সতী পুণ্যশীলা মহিলার নামে অপবাদ না দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন, তিনি বলেছেন, আমরা যেন শুধু আল্লাহর ইবাদত করি, তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করি, তিনি আমাদের নামাজ আদায়, রোজা রাখা, যাকাত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, হযরত জাফর (রা.)ইসলামের এসব পরিচয় এভাবে তুলে দেওয়ার পর বললেন, আমরা সেই পয়গম্বরকে সত্য বলে মেনেছি, তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন, আনীত দ্বীনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও আনুগত্য করেছি, আমরা শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করেছি এবং তার সাথে অন্য কাউকে শরিক করেনি, সেই পয়গম্বর সেসব জিনিস নিষিদ্ধ বলেছেন, সেগুলোকে আমরা নিষিদ্ধ মনে করেছি, যেগুলোকে হালাল বা বৈধ বলেছেন, সেগুলোকে হালাল বলে মনে করেছি, এ সব কারণে স্বজাতীয় লোকেরা আমাদের ওপর নাখোশ হয়েছে, তারা আমাদের উপর অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে এবং পূর্ববর্তী ধর্মে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে, তারা চায়, আমরা যেন আল্লাহর ইবাদত পরিত্যাগ করে মূর্তিপূজার প্রতি ফিরে যাই, যেসব নোংরা জিনিস ইতিপূর্বে হারাম মনে করেছিলাম, সেসব কিছুকে যেন হালাল মনে করি, ওরা যখন আমাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা বহুলাংশে বাড়িয়ে, পৃথিবীকে আমাদের জন্য সঙ্কীর্ণ করে দিয়েছে এবং তারা আমাদের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন আমরা আপনার দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছি এবং অন্যদের তুলনায় আপনাকে প্রাধান্য দিয়ে আপনার আশ্রয়ে থাকা পছন্দ করেছি, আমরাও আশা পোষণ করেছি যে, আপনারা এখানে আমার উপর কোন প্রকার জুলুম অত্যাচার করা হবে না।
নাজ্জাশী বললেন, আমাকে তোমাদের রসূলের আনীত গ্রন্থ থেকে একটু পড়ে শোনাও।
হযরত জাফর (রা.) সূরা মরিয়মের প্রথম অংশের কয়েকটি আয়াত পাঠ করলেন, তা শুনে নাজ্জাশীর মন পরিবর্তন হলো, তিনি অবিরাম কাঁদতে থাকলো, তাঁর দাড়ি অশ্রুতে ভিজে গেলো, তাঁর ধর্মীয় উপদেষ্টারাও এতো বেশী কাঁদলেন যে, তাদের সামনে মেলে রাখা ধর্মীয় গ্রন্থের উপর অশ্রু গড়িয়ে পড়লো, নাজ্জাশী এরপর বললেন, এই বাণী হযরত মূসা (আ.) আনীত বাণী একই উৎস থেকে উৎসারিত, এরপর নাজ্জাশী আমর ইবনুল আস এবং আবদুল্লাহ ইবনে রবিয়াহকে বললেন, তোমরা চলে যাও, আমি ঐ সব লোককে তোমাদের হাতে তুলে দিতে পারবে না, এখানে তাদের কোন প্রকার কারসাজি আমি সহ্য করবো না।
বাদশাহর নির্দেশের পর কোরাইশদের উভয় প্রতিনিধি দরবার থেকে বেরিয়ে এলো, এরপর আমর ইবনুল আস আবদুল্লাহ ইবনে রবিয়াকে বললো, আগামীকাল ওদের বিরুদ্ধে বাদশাহর কাছে এমন কথা বলবো যে, ওদের সব চালাকি ছুটিয়ে দেব, আবদুল্লাহ ইবনে রবিয়া বললেন, না তার দরকার নেই, ওরা যদিও আমার ধর্ম বিশ্বাস পরিত্যাগ করেছি, কিন্তু ওরা তো আমার গোত্রের লোক, তবুও আমর ইবনুল আস তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন।
পরদিন আমর ইবনুল আস বাদশাহর দরবারে গিয়ে বললেন, হে বাদশাহ, ওরা ঈসা ইবনে মারিয়াম (রা) সম্পর্কে এক অদ্ভুত কথা বলে, এ কথা শুনে নাজ্জাশী পুনরায় মুসলমানদের ডেকে পাঠালেন, তিনি হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে মুসলমানদের মতামত জানতে চাইলেন, মুসলমানরা এবার ভয় পেয়ে গেলেন, তবু তারা ভাবলেন, আল্লাহর উপর ভরসা, যা হবার হবে, তারা কিন্তু সত্য কথা বলে।
নাজ্জাশীর প্রশ্নের জবাবে হযরত জাফর (রা.) বললেন, আমরা হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে সেই কথাই বলে থাকি, যা আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, তিনি বলেছেন, হযরত ঈসা (আ.) আল্লাহর বান্দা, তাঁর রসূল, তাঁর রূহ এবং তাঁর কালেমা, তাকে আল্লাহ তায়ালা কুমারী সতী সাধ্বী হযরত মরিয়ম (আ.) এর উপর ন্যস্ত করেছেন।
এ কথা শুনে নাজ্জাশী মাটি থেকে একটি কাঠের টুকরো তুলে নিয়ে বললেন, খোদার কসম, তোমরা যা কিছু বলেছ, হযরত ঈসা (আ.) এই কাঠের টুকরোর চেয়ে বেশী কিছু ছিল না, এ কথা শুনে ধর্মীয় উপদেষ্টাগণ হুঁ হুঁ শব্দ উচ্চারণ করে বিরক্তি প্রকাশ করলেন, বাদশাহ বললেন, তোমরা হুঁ হুঁ বললেও আমি যা বলছি এ কথা সত্য।
এরপর নাজ্জাশী মুসলমানদের বললেন, যাও, তোমরা আমার দেশে সম্পূর্ণ নিরাপদ, যারা তোমাদের উপর গালি দেয়, তাদের উপর জরিমানা ধার্য করা হবে, আমি চাইনা কেউ তোমাদের কষ্ট দিক, আর তার পরিবর্তে আমি সোনার পাহাড় লাভ করি।
এরপর নাজ্জাশী তার ভৃত্যদের বললেন, মক্কা থেকে আগত প্রতিনিধিদের আনীত উপঢৌকন তাদের ফিরিয়ে দাও, এগুলোর কোন প্রয়োজন নেই, আল্লাহর শপথ, তিনি যখন আমাকে আমার দেশে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তখন আমার কাছ থেকে কোন ঘুষ নেন নি, আমি কেন তাঁর পথে ঘুষ নেব, এছাড়া তিনি অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা আমার ব্যাপারে অন্য লোকদের কথা গ্রহণ করেন নি, আমি কেন আল্লাহর ব্যাপারে অন্য লোকদের কথা মানবো?
এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হযরত উম্মে সালমা (রা.) বলেন, কোরাইশদের উভয় প্রতিনিধি এরপর তাদের আনীত উপঢৌকনসহ অসম্মানজনকভাবে দেশে ফিরে এলো, আমরা নাজ্জাশীর দেশে একজন ভালো প্রতিবেশীর ছত্রছায়ায় অবস্থান করতে লাগলাম (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৩৪-৩৩৮)।
উল্লেখিত ঘটনার বর্ণনা ইবনে ইসহাক উল্লেখ করেছেন অন্যান্য সীরাত রচয়িতারা লিখেছেন, নাজ্জাশীর দরবারে হযরত আমর ইবনুল আস বদরের যুদ্ধের পর গিয়েছিলেন, কেউ কেউ উভয় বর্ণনার মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য লিখেছেন, মুসলমানদের ফিরিয়ে আনার জন্যে আমার ইবনুল আস নাজ্জাশীর দরবারে দুবার গিয়েছিলেন, কিন্তু বদরের যুদ্ধের পরে নাজ্জাশী এবং হযরত জাফরের মধ্যেকার কথোপকথনের যে বিবরণ ইবনে ইসহাক উল্লেখ করেছেন, সেটা হাবশায় মুসলমানদের হিজরতের পরবর্তী সময়ের কথোপকথনের অনুরূপ, তাছাড়া নাজ্জাশীর প্রশ্নের ধরন দেখে বোঝা যায় যে, তার সাথে মুসলমানদের কথাবার্তা একবারই হয়েছিলো আর সেটা হয়েছিলো হাবশায় মুসলমানদের হিজরতের পরপরই।
মোটকথা পৌত্তলিকদের কৌশল ব্যর্থ হলো, তারা বুঝতে পেরেছিলো যে, শত্রুতামূলক আচরণ যতোটা করার, সেটা নিজেদের সীমানার মধ্যেই করতে হবে, তবে, এসময় তারা একটা মারাত্মক বিষয় ভাবতে শুরু করলো, তারা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলে যে, এ বিপদ থেকে রক্ষা পেতে তাদের দুটি পথ খোলা রয়েছে, হয় শক্তি প্রয়োগে আল্লাহর রাসূলের দ্বীনি তাবলীগ বন্ধ করে দিতে হবে অথবা তার অস্তিত্বই নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে, কিন্তু দ্বিতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সহজ ছিল না, কারণ স্বয়ং আবু তালেব ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জিম্মাদার, তিনি পৌত্তলিকদের সঙ্কল্পের সামনে লৌহ যবনিকার মতো দাঁড়িয়েছিলেন, এমতাবস্থায় তারা পুনরায় আবু তালেবের সাথে কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করলো।
আবু তালেবের প্রতি হুমকি
এ প্রস্তাবের পর কোরাইশ নেতারা আবু তালেবের কাছে গিয়ে বললেন, হে আবু তালেব আপনি আমাদের মধ্যে মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী, আমরা আপনাকে বলেছিলাম যে, আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রকে ফিরিয়ে রাখুন, কিন্তু আপনি রাখেননি, আপনি মনে রাখবেন, আমাদের পিতা-পিতামহকে গালাগাল দেয়া হবে এটা সহ্য করতে পারব না, আমাদের বুদ্ধি বিবেক বিচার বিবেচনাকে নিবুদ্ধিতা বলা হবে এবং উপাস্যদের দোষ বের করা হবে, এটাও আমাদের সহ্য হবে না, আপনি তাকে বাধা দিন এবং বিরত রাখুন, যদি এতে ব্যর্থ হন, তবে আপনার এবং আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে এমন লড়াই বাধিয়ে দিব যে, এতে বহু প্রাণহানি ঘটবে।
এ হুমকিতে আবু তালেব প্রভাবিত হলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ডেকে বললেন, ভাতিজা, তোমার কওমের লোকেরা আমার কাছে এসে এসব কথা বলে গেছে, কাজেই, তুমি এবার আমার এবং তোমার নিজের প্রতি দয়া করো, তুমি এ বিষয়ে আমার ওপর এমন বোঝা চাপিও না, যা আমি বহন করতো পারবো না।
একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বুঝতে পারলেন যে, এবার তার চাচাও তাকে পরিত্যাগ করবে, তাকে সাহায্য করার ব্যাপারে তিনিও দুর্বল হয়ে পড়েছেন, এ কারণে তিনি বললেন, চাচাজান, আল্লাহর শপথ, যদি আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দিয়ে কেউ বলে একাজ ছেড়ে দাও, তবুও আমি তা ছাড়তে পারব না, হয়তো একাজের পূর্ণতা বিধান করে আমি একে জয়ী করবো অথবা এ কাজ করতে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যাব।
একথা বলে আবেগের আতিশয্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেঁদে ফেললেন, এরপর চলে যেতে লাগলেন, চাচা আবু তালেবের মন কেঁদে উঠলো, তিনি ভাতিজাকে ডেকে বললেন, যাও ভাতিজা, তুমি যা চাও, তাই করো, আল্লাহর শপথ, আমি কোন অবস্থায় কখনো তোমাকে ছাড়তে পারবো না (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ২৬৫, ২৬৬)।
খোদার শপথ তোমার কাছে যেতে ওরা, পারবে না তো দলে দলে,
যতদিন না দাফন হবো আমি মাটির তলে
বলতে থাকো তোমার কথা খোলাখুলি করো না আর কোন ভয়
দুচোখ তোমার শীতল হোক আর, খুশী হোক তোমার হৃদয় (মোখতারুস সীরাত, শেখ মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব নজদী, পৃ. ৬৮)।
আবু তালেবের কাছে পুনরায় কোরাইশ প্রতিনিধি দল
মারাত্মক রকমের হুমকি সত্ত্বেও কোরাইশরা যখন দেখলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন তারা বুঝতে পারলো যে, আবু তালেব তার ভ্রাতুষ্পুত্রকে পরিত্যাগ করতে পারবে না, বরং প্রয়োজনে তিনি কোরাইশদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন এবং শত্রুতার জন্যেও প্রস্তুত আছেন, এরূপ চিন্তা করে কোরাইশ নেতারা ওলীদ ইবনে মুগীরার পুত্র আম্মারকে সঙ্গে নিয়ে আবু তালেবের কাছে হাযির হয়ে বললো, হে আবু তালেব, আম্মারকে নিয়ে এলাম আম্মারা কোরাইশ বংশের সুদর্শন যুবক, আপনি ওকে গ্রহণ করুন সে আপনাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে আপনি ওকে নিজের পুত্র সন্তান হিসাবে গ্রহণ করুন, সে আপনার হবে আর আপনি নিজের ভাতিজা মোহাম্মাদকে আমাদের হাতে তুলে দিন, যে আপনা পিতা-পিতামহের দ্বীনের বিরোধিতা করছে, আপনার জাতিকে ছিন্নভিন্ন করছে এবং তাদের বুদ্ধিমত্তাকে নির্বুদ্ধিতা বলে অভিহিত করছে আমরা তাকে হত্যা করবো ব্যস এটা একজন লোকের পরিবর্তে একজন লোকের হিসাব হবে।
আবু তালেব বললেন, কি চমৎকার সওদা করতো তোমরা আমার কাছে এসেছো নিজেদের পুত্রকে তোমরা আমার কাছে নিয়ে এসেছো, আমি তাকে পানাহার করাবো লালন পালন করে বড় করবো, আর আমি নিজের পুত্রকে তোমাদের হাতে দিবো তোমরা তাকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করবে, আল্লাহর কসম, এটা হতে পারে নেই।
একথা শুনে নওফেল ইবনে মাতয়ামের পুত্র আদী বললেন, খোদার কসম, হে আবু তালেব, তোমরা সাথে তোমার কওম ইনসাফের কথা বলেছে এবং তুমি কল্যাণকর অবস্থা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছো, কিন্তু আমি লক্ষ্য করছি যে, তুমি তাদের কোন কথাই গ্রহন করতে চাচ্ছ না।
জবাবে আবু তালেব বললেন, খোদার শপথ, তোমরা আমার সাথে ইনসাফের কথা বলেনি, বরং তোমরাও আমার সঙ্গ ছেড়ে আমার বিরুদ্ধে লোকদের সাহায্য করতে উদ্যত হচ্ছে ঠিক আছে, যা ইচ্ছা করো (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, ২৬৬ ২৬৭)।
সীরাতে বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ করেও উল্লিখিত উভয় কথোপকথনের সময় জানা যায় না, কিন্তু সাক্ষ্য প্রমাণ এবং ইঙ্গিত ইশারা থেকে মনে হয়, উভয়ের মধ্যে পার্থক্য বেশী নয়, উভয় কথোপকথন ষষ্ঠ হিজরির মাঝামাঝি কোন এক সময়ে হয়েছিলো।
আল্লাহর রাসূলকে হত্যা করার হীন প্রস্তাব
কোরাইশ নেতাদের উল্লিখিত উভয় আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর তাদের আক্রোশ বেড়ে গেলো অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়লো সে সময় কোরাইশ নেতাদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মধ্যে আরো নতুন মাত্রা যোগ হলো তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার প্রস্তাব করলো, কিন্তু সেই সময়ে দুই বিশিষ্ট কোরাইশ নেতা হযরত হামযা (রা.) এবং হযরত ওমর (রা.)এর ইসলাম গ্রহণ ইসলামের শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিবর্তে বরং এই দুই বীর কেশরী আল্লাহর রাসূলের কাছে আত্মসমর্পণ করে ইসলামেরই শক্তি বাড়িয়ে দেন।
আল্লাহর রাসূলের প্রতি পৌত্তলিকদের অত্যাচার নির্যাতনের দুটি উদাহরণ পেশ করছি।
একদিন আবু লাহাবের পুত্র ওতাইবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললো, ওয়াননাজমে ইযা হাওয়া এবং ছুম্মা দানা ফাতাদাল্লারি, সাথে আমি কুফর করছি, সূরা নাজম এর দুটি আয়াতের অর্থ হচ্ছে, শপথ নক্ষত্রের যখন তা অস্তমিত হয়, অতঃপর সে তার নিকটবর্তী হলো অতি নিকটবর্তী, এরপর ওতাইবা আল্লাহর রসূলের ওপর অত্যাচার শুরু করলো, তাঁর জামা ছিড়ে দিল এবং পবিত্র চেহারা লক্ষ্য করে থুথু নিক্ষেপ করলো, কিন্তু থুথু তাঁর চেহারায় পড়েনি, সে সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বদদোয়া দিলেন, তিনি বলেছেন হে আল্লাহ তায়ালা ওর ওপর তোমার কুকুর সমূহের কুকুর হতে একটি কুকুর লেলিয়ে দাও, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বদদোয়া নাযিল হয়েছিলো, ওতবা একবার কোরাইশ বংশের কয়েকজন লোকের সাথে এক সফরে সিরিয়া যাচ্ছিল, যারকা নামক স্থানে তাঁরা একদা রাত্রি যাপনের জন্য তাঁবু স্থাপন করলো, সে সময় একটি বাঘকে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেল, ওতাইবা বাঘ দেখে বললো, হায়রে, আমার ধ্বংস অনিবার্য খোদার কসম, এই বাঘ আমাকে খাবে, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার উপর বদদোয়া করেছেন, দেখো আমি সিরিয়ায় রয়েছি, অথবা তিনি মক্কায় বসে আমাকে মেরে ফেলেছেন, সতর্কতা হিসাবে সফরসঙ্গীরা তখন ওতাইবাকে নিজেদের মাঝখানে রেখে শয়ন করলো, রাত্রিকালে বাঘ এলো, সবাইকে ডিঙ্গিয়ে ওতাইবার কাছে গেলো এবং তার ঘাড় মটকালো (মুখতাছারুছ সিয়ার, শেখ আবদুল্লাহ পৃ. ১৩৫, ১ম খন্ড, এস্তিয়ার দালায়েলূন নবুয়ত, আর ফওযুল আনফ)।
ওকবা ইবনে আবু মুঈত ছিলো একজন প্রখ্যাত পৌত্তলিক, একবার এক দুর্বৃত্ত নামাজে সেজদা দেয়ার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘাড় এতো জোরে পেঁচিয়ে ধরলো, মনে হচ্ছিলো যেন, তাঁর চোখ বেরিয়ে যাবে (ঐ, মুখতাছারুছ সিয়ার, পৃ. ১১৩)।
ইবনে ইসহাকের একটি বর্ণনায় কোরাইশদের চক্রান্ত সম্পর্কে জানা যায়, তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ক্রমাগত চক্রান্ত করেছিলো, উক্ত বর্ণনায় বলা হয়েছে যে একবার আবু জেহেল বলেছিলো, হে কোরাইশ ভাইয়েরা, আপনারা লক্ষ্য করছেন যে, মোহাম্মদ আমাদের ধর্মের সমালোচনা এবং আমাদের উপাস্যদের নিন্দা থেকে বিরত হচ্ছে না, আমাদের পিতা পিতামহকে অবিরাম গালমন্দ দিয়েই চলেছে, এ কারণে আমি আল্লাহর সাথে অঙ্গিকার করছি যে, আমি একটি ভারি পাথর নিয়ে বসে থাকবো, মোহাম্মদ যখন সেজদায় যাবে.তখন সেই পাথর দিয়ে মাথা চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেবো, এরপর যে কোন পরিস্থিতির জন্য আমি প্রস্তুত, ইচ্ছে হলে আপনারা আমাকে বান্ধবহীন অবস্থায় রাখবেন অথবা আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন, এরপর বনু আবদে মান্নাফ আমার সাথে যেরূপ ইচ্ছা ব্যবহার করবে, এতে আমার কোন পরোয়া নেই, কোরাইশরা এ প্রস্তাব শোনার পর বললো, কোন অবস্থায়ই আমরা তোমাকে বান্ধবহীন অবস্থায় ফেলে রাখবো না, তুমি যা করতে যাও, করতে পারো।
সকালে আবু জেহেল একটি ভারি পাথর নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অপেক্ষায় বসে থাকলো, কোরাইশরা একে একে সমবেত হয়ে আবু জেহেলের কর্মতৎপরতা দেখতে উৎকন্ঠিত হয়ে রইলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যথারীতি হাযির হয়ে নামায আদায় করতে শুরু করলেন তিনি যখন সেজদায় গেলেন তখন আবু জেহেল পাথর নিয়ে অগ্রসর হলো, কিন্তু পরক্ষণে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় ফিরে এলো, এবং তার হাত পাথরের সাথে যেন আটকে রইল, কোরাইশের কয়েকজন লোক তার কাছে এসে বললো আবুল হাকাম তোমার কি হয়েছে? সে বললো, আমি যে কথা রাতে বলেছিলাম সেটা করতে যাচ্ছিলাম কিন্তু কাছাকাছি পৌছুতেই দেখতে পেলাম, মোহাম্মাদ এবং আমার মাঝখানে একটি উট এসে দাঁড়িয়েছে খোদার কসম আমি কখনো অতো বড়, অতো লম্বা ঘাড় ও দাঁত বিশিষ্ট উট দেখিনি, উটটি আমার ওপর হামলা করতে চাচ্ছিলো।
ইবনে ইসহাক বলেন, আমাকে জানানো হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, উটের ছদ্মবেশে তিনি ছিলেন হযরত জিবরাঈল (আ.) আবু জেহেল যদি কাছে আসতো তবে তাকে পাকড়াও করা হতো (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ২৯৮ ২৯৯)।
এরপর আবু জেহেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে এমন ব্যবহার করছিলো যে সেটা দেখে হযরত হামযা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন সে সম্পর্কে কিছুক্ষণ পরে আলোচনা করা হবে।
কোরাইশের অন্যান্য দুর্বৃত্তরাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চাচ্ছিলো হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন যে একবার পৌত্তলিকরা কাবার সামনে বসেছিলো, আমিও সেখানে ছিলাম তারা আল্লাহর রাসূলের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বললো, এই লোকটি সম্পর্কে আমরা যেরূপ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছি তার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, প্রকৃতপক্ষে তার ব্যাপারে আমরা অতুলনীয় ধৈর্যধারণ করেছি এ আলোচনা চলার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত হলেন তিনি প্রথমে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করলেন এরপর কাবাঘর তাওয়াফ করার সময়ে পৌত্তলিকদের পাশ দিয়ে গেলেন, তারা খারাপ কথা বলে তাকে অপমান করলো, আল্লাহর রাসূলের চেহারায় সে অপমানের ছাপ ফুটে উঠলো তাওয়াফের মধ্যে পুনরায় তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলে তারা পুনরায় একইভাবে অপমানজনক কথা বললো, সে অপমানের প্রভাব আমি তার চেহারায় লক্ষ্য করলাম তৃতীয়বারও একই রকম ঘটনা ঘটলো এবার আল্লাহর রাসূলের ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেলো, তিনি থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, কোরাইশের লোকেরা শোনো, সেই আল্লাহর শপথ তার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, আমি তোমাদের কাছে কোরবানির পশু নিয়ে এসেছি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একথায় কোরাইশরা দারুণ প্রভাবিত হলো, তারা সবাই নীরব হয়ে গেলো, কঠোর প্রাণের লোকেরাও তার প্রতি নম্র নরম ভাষা ব্যবহার করতো লাগলো, তারা বলেছিলো, আবুল কাশেম, আপনি ফিরে যান, আল্লাহর শপথ আপনি তো কখনো নির্বোধ ছিলেন না।
পরদিনও কোরাইশরা একইভাবে সমবেত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রসঙ্গ আলোচনা করছিলো, এমন সময় তিনি এলেন, তিনি কাছে আসতেই তারা একযোগে তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, একজন তার চাদর গলায় জড়িয়ে শ্বাসরোধ করতে চাচ্ছিল, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তাকে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করছিলেন, তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, তোমরা কি এমন একজন বলছিলেন, তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করছো, যিনি বলেন যে, আমার প্রভু আল্লাহ? দুর্বৃত্তরা এরপর তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো, আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, কোরাইশদের অত্যাচারের ঘটনাসমুহের মধ্যে আমার দেখা এ ঘটনাটি ছিলো সবচেয়ে মারাত্মক (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ২৮৯-২৯০)।
সহীহ বোখারী শরীফে হযরত ওরওয়া ইবনে যোবায়ের (রা.) থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন, আমি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, যে পৌত্তলিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সবচেয়ে বর্বরোচিত যে ব্যবহার করেছিলো তার বিবরণ আমাকে বলুন, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবার হাতীমে নামায আদায় করছিলেন এমন সময় ওকবা ইবনে আবু মুঈত এসে হাযির হলো সে এসেই নিজের চাদর আল্লাহর রাসূলের গলায় পেঁচিয়ে তার শ্বাসরোধ করতে চাইলো, এমন সময় হযরত আবু বকর (রা.) এলেন এবং ওকবার দুই কাঁধ ধরে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন এরপর বললেন, তোমরা এমন একজন মানুষকে হত্যা করত চাও যিনি বলেন যে, আমার প্রভু আল্লাহ? (সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৪৪)।
হযরত আসমা (রা.) বলেন, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এ চিৎকার শুনতে পেলেন যে, তোমাদের সঙ্গীকে বাচাও এ চিৎকার শোনা মাত্র তিনি আমাদের কাছ থেকে দৌড়ে গেলেন তার মাথায় চারটি বেণী ছিলো, তিনি একথা বলতে বলতে ছুটে গেলেন যে, তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করত চাও যিনি বলেন যে, আমার প্রভু আল্লাহ? পৌত্তলিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ছেড়ে হযরত আবু বকরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, তিনি বাড়ী ফিরে আসার পর আমরা তার মথায় চুলের যেখানেই হাত দিচ্ছিলাম চুল আমাদের হাতে উঠে আসছিল।
হযরত হামযার ইসলাম গ্রহণ
মক্কার পরিবেশ এমনি ধরণের যুলুম অত্যাচারে আচ্ছন্ন থাকার সময়ে হঠাৎ করে আলোর ঝলক দেখা গেলো, হযরত হামযা (রা.) ইসলাম গ্রহন করলেন আল্লাহর রাসূলের নবুয়ত লাভের ষষ্ঠ বছরের জিলহজ্জ মাসে এ ঘটনা ঘটে।
হযরত হামযা (রা.) এর ইসলাম গ্রহণের কারণ ছিলো এই যে আবু জেহেল একদিন সাফা পাহাড়ের কাছাকাছি জায়গায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালমন্দ করে এবং তাকে কষ্ট দেয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নীরব রইলেন, কোন কথা বললেন না দুর্বৃত্ত আবু জেহেল এরপর আল্লাহর রাসূলের মাথায় এক টুকরো পাথর নিক্ষেপ করলো এতে মাথা ফেটে রক্ত বের হলো, আবু জেহেল এরপর কাবার সামনে কোরাইশদের মজলিশে গিয়ে বসলো আব্দুল্লাহ ইবনে জুদায়াণের একজন দাসী এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলো হযরত হামযা শিকার করে ফিরছিলেন সেই দাসী তাকে সব কথা শোনালো হযরত হামযা ক্রোধে অধীর হয়ে উঠলেন। তিনি ছিলেন কোরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী যুবক, তিনি দেরী না করে সামনে পা বাড়িয়ে বললেন, আবু জেহেলকে যেখানেই পাব সেখানেই আঘাত করব, এরপর তিনি সোজা কাবাঘরে প্রবেশ করে আবু জেহেলের সামনে গিয়ে বললেন, ওরে গুহ্যদ্বার দিয়ে বায়ু ত্যাগকারী তুই আমার ভাতিজাকে গালি দিচ্ছিস, অথচ আমিও তো তার প্রচারিত দ্বীনের অনুসারী, একথা বলে হাতের ধনুক দিয়ে আবু জেহেলের মাথায় এতো জোরে আঘাত করলেন যে, মাথায় মারাত্মক ধরনের জখমে হয়ে গেল, এ ঘটনার সাথে সাথে আবু জেহেলের গোত্র বানু মাখযুম এবং হযরত হামযা (রা.) এর গোত্র বানু হাশেমের লোকেরা পরস্পরের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে উঠলো, আবু জেহেল এই বলে সবাইকে থামিয়ে দিল যে, আবু আমারাকে কিছু বলো না, আমি তার ভাতিজাকে আসলেই খুবই খারাপ গালি দিয়েছিলাম(মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ মোহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব, পৃ. ৬৬, রহমাতুল লিল আলামিন, ১ম খন্ড, ৬৮, ইবনে হিশাম, ১১ ১ম খন্ড, পৃ. ২৯২)।
প্রথমদিকে নিজের আত্মীয়কে গালি দেয়ার ধৈর্যহারা হয়ে হযরত হামযা (রা.) রাসূল (সা.) এর প্রতি আকৃষ্ট হন, পরে আল্লাহ তায়ালা তার অন্তর খুলে দেন, তিনি ইসলামের বলিষ্ঠ প্রবক্তা হয়ে ওঠেন, তার কারণে মুসলমানরা যথেষ্ট শক্তি এবং স্বস্তি অনুভব করেন (মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আব্দুল্লাহ, পৃ. ১০১)।
হযরত ওমর (রা.) এর ইসলাম গ্রহন
যুলুম অত্যাচার নির্যাতনের কালোমেঘের সেই গম্ভীর পরিবেশে আলোর আরো একটি ঝলক ছিল হযরত ওমর (রা.) এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা, হযরত হামযা (রা.) এর ইসলাম গ্রহণের তিনদিন পর নবুয়তের ষষ্ঠ বছরের জিলহজ্জ মাসেই এ ঘটনা ঘটেছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার ইসলাম গ্রহণের জন্যে দেয়া করেছিলেন (তারীখে ওমর ইবনুল খাত্তাব, ইবনে জওযি, পৃ. ১১)।
ইমাম তিরমিযি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণনা করেছে এ ঘটনাকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন, ইমাম তিবরানি হযরত ইবনে মাসউদ এবং হযরত আনাস (রা.) থেকে এ ঘটনা বর্ণনা করেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়া করেছিলেন, হে আল্লাহ ওমর ইবনে খাত্তাব এবং আবু জেহেলের মধ্যে তোমার কাছে যে ব্যক্তি বেশী পছন্দনীয় তাকে ইসলাম গ্রহণের সুযোগ দাও এবং তার দ্বারা ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি করো।
আল্লাহ তায়ালা এ দোয়া কবুল করেন এবং হযরত ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন, উল্লিখিত দুজনের মধ্যে আল্লাহর কাছে হযরত ওমর (রা.) ছিলেন অধিক প্রিয় (তিরমিযি, মানাকেবে আবু হাফ ওমর ইবনে খাত্তাব ২য় খন্ড, পৃ. ২০৯)।
হযরত ওমর (রা.) এর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কিত সকল বর্ণনার ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ বিচারে প্রমাণিত হয় যে, তার মনে পর্যায়ক্রমে ইসলাম জায়গা করে নিয়েছিলো, সে বিষয়ে আলোকপাত করার আগে হযরত ওমর (রা.) এর মন মেজাজ ও ধ্যান ধারনার প্রতি সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত দেয়া জরুরী মনে করছি।
হযরত ওমর (রা.) তার রুক্ষ মেজাজ এবং কঠোর স্বভাবের জন্যে পরিচিত ছিলেন দীর্ঘকাল যাবত মুসলমানরা তার হাতে নানাভাবে নির্যাতন ভোগ করেন, মনে হয় তার মধ্যে বিপরীতধর্মী স্বভাবের সমন্বয় সাধিত হয়েছিলো, একদিকে তিনি নিজের পিতা পিতামহের আবিষ্কৃত রসম রেওয়াজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, খেলাধুলার প্রতিও তার যথেষ্ট আগ্রহ ছিল, অন্যদিকে ঈমান ও আকীদার প্রতি মুসলমানদের দৃঢ়টা এবং অত্যাচার নির্যাতনের মুখেও মুসলমানদের ধৈর্য সহিঞ্চুতা তিনি আগ্রহের দৃষ্টিতে দেখতেন, বুদ্ধি বিবেচনার মাধ্যমে তিনি মাঝে মাঝে ভাবতেন যে, ইসলাম ধর্মে যে বিষয়ে দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে সম্ভবত সেটা সত্য, অধিক পবিত্র ও উন্নত, এ কারণে হঠাৎ ক্ষেপে গেলেও শান্ত হয়ে যেতেন (হযরত ওমর সম্পর্কে এ পর্যালোচনামূলক মন্তব্য করেছেন ইমাম গাযযালী, ফেকহুছ সীরাত, পৃ. ৯২ ৯৩ দেখুন)।
হযরত ওমর (রা.)-এর ইসলামের গ্রহন সম্পর্কিত সকল বর্ণনার মূলকথা নিম্নরূপ,
একবার হযরত ওমর (রা.) কে বাইরে দিন কাটাতে হয়েছিলো, তিনি হারাম শরীফে গমন করেন এবং কাবাঘরে পর্দার ভেতরে প্রবেশ করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে সময় নামাজ আদায় করছিলেন, তিনি সূরা আল হাক্ক তেলাওয়াত করছিলেন হযরত ওমর (রা.) কোরআন শুনতে লাগলেন এবং কোরআনের রচনাশৈলীতে মুগ্ধ ও অভিভূত হলেন, মনে মনে বললেন এই ব্যক্তি দেখছি কবি, কোরাইশদের কথাই ঠিক, এমন সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তেলাওয়াত করলেন, নিশ্চয়ই এই কোরআন এক সম্মানিত রসূলের কাছে বহন করে আনা বার্তা, এটা কোন কবির রচনা নয়, তোমরা অল্পই বিশ্বাস করো, হযরত ওমর (রা, ) বলেন, আমি মনে মনে বললাম, এই ব্যক্তি দেখছি জ্যোতিষী, এমন সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তেলাওয়াত করলেন, এটা কোন গণকের কথা নয়, তোমরা অল্পই অনুধাবন করেন, এটি জগতসমূহের প্রতিপালকের কাছ থেকে অবতীর্ণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরার শেষ পর্যন্ত তেলাওয়াত করলেন।
হযরত ওমর (রা.) বলেন, সেই সময়ে আমার মনে ইসলাম রেখাপাত করে (তারীকে ওমর ইবনে খাত্তাব, ইবনে জওযি, পৃ. ৬, সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩২৬-৩৪৮), কিন্তু তখনো তার মনে পূর্ব-পুরুষদের ধর্মের প্রতি বিশ্বাস ও ভালবাসা ছিলো অটুট, এ কারণেই হৃদয়ের গোপন ও গভীরে ইসলামের প্রতি ভালোবাসার বীজ রোপিত হলেও ইসলামের বিরোধীতার প্রকাশ্য কাজকর্মে তিনি ছিলেন সোচ্চার।
তাঁর স্বভাবের কঠোরতা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে শত্রুতার অবস্থা এমন ছিলো যে, একদিন তলোয়ার হাতে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন, পথে নঈম ইবনে আবদুল্লাহ নাহহাম আদবীর (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৪৪) বনি যোহরা (তারীখে ওমর ইবনে খাত্তাব, আল জওযি, পৃ. ১৭) বনি মানজুমের (মুখতাছারুছ সীরাত, পৃ. ১০২) কোন এক লোকের সাথে তাঁর দেখা হলো, সেই লোক তাঁর রুক্ষ চেহারা দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ওমর, কোথায় যাচ্ছ? তিনি বলেন, মোহাম্মদ কে হত্যা করতে যাচ্ছি, সেই লোক বললেন, মোহাম্মদকে হত্যা করে বনু হাশেম এবং বনু যোহরার হাত থেকে কিভাবে রক্ষা পাবে? তিনি বললেন, মনে হয় তুমিও পূর্বপুরুষদের ধর্ম ছেড়ে বেদ্বীন হয়ে পড়েছো? সেই লোক বললেন, ওমর একটা বিস্ময়কর কথা শোনাচ্ছি, তোমার বোন এবং ভগ্নীপতিও তোমাদের দ্বীন ছেড়ে বেদ্বীন হয়ে গেছে, একথা শুনে হযরত ওমর ক্রোধে দিশেহারা হয়ে সোজা ভগ্নীপতির বাড়ী অভিমুখে রওনা হলেন, সেখানে গিয়ে দেখলেন, তারা হযরত খাব্বাব ইবনে আরতের কাছে সূরা তা-হা লেখা একটি সহীফা পাঠ করছেন, কোরআন শিক্ষা দেওয়ার জন্য হযরত খাব্বাব (রা.) সে বাড়ীতে যেতেন, হযরত ওমর এর পায়ের আওয়াজ শুনে সবাই নীরব হয়ে গেলেন, হযরত ওমরের বোন সূরা লেখা পাতাটি লুকিয়ে ফেললেন, কিন্তু ঘরের বাইরে হযরত ওমর খাব্বাব (রা.) এর কোরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ শুনেছিলেন, তিনি তাই জিজ্ঞাসা করলাম, কিসের আওয়াজ শুনছিলাম? তারা বললেন কই কিছু নাতো, আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলাম, হযরত ওমর (রা.) বললো, সম্ভবত তোমরা উভয়ে বেদ্বীন হয়ে গেছ, তার ভগ্নীপতি বললেন, আচ্ছা ওমর, সত্য যদি তোমাদের দ্বীন ছাড়া অন্য ধর্ম সত্য থাকে তখন কি হবে? হযরত ওমর (রা.) এ কথা শোনা মাত্র ভগ্নীপতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাকে মারাত্মকভাবে প্রহার করলেন, তাঁর বোন ছুটে গিয়ে স্বামীকে ভাইয়ের হাত থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন, এক সময় তাকে সরিয়ে দিলেন, হঠাৎ হযরত ওমর (রা.)তার বোন কে এতো জোরে চড় মারলেন যে তার চেহারা রক্তাক্ত হয়ে গেল, ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় রয়েছে যে , তাঁর মাথায় আঘাত লেগেছিলো, তার বোন ক্রুদ্ধভাবে বললেন, ওমর, যদি তোমাদের দ্বীন ছাড়া অন্য ধর্ম সত্য থাকে তখন কি হবে? আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, আর মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রাসূল, এ কথা শুনে হযরত ওমর (রা.) হতাশ হয়ে পড়লেন বোনের চেহারায় রক্ত দেখে তাঁর লজ্জাও হলো, তিনি বললেন, আচ্ছা, তোমরা যা পাঠ করছিলে, আমাকে একটু পড়তে দাওতো, তার বোন বললো, তুমি নাপাক, এই কিতাব শুধু পাক পবিত্র লোকই স্পর্শ করতে পারে, যাও গোসল করে এসো, হযরত ওমর গিয়ে গোসল করে এলেন, এরপর কিতাবের সেই বিশেষ অংশ হাতে নিয়ে বসলেন এবং পড়লেন, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, এরপর বললেন, এতো বড় পবিত্র নাম।
হযরত খাব্বাব (রা.) হযরত ওমর (রা.) মুখে এ কথা শুনে ভেতর থেকে বাইরে এলেন এবং বললেন, ওমর খুশি হও, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্রে যে দোয়া করেছিলেন এটা তারই ফল, এ সময়ে রাসূল (স.) সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী এক ঘরে অবস্থান করছিলেন।
একথা শুনে হযরত ওমর (রা.) তলোয়ার হাতে সেই ঘরের সামনে এসে দরোজায় কশাঘাত করলেন, একজন সাহাবী দরজায় উঁকি দিয়ে দেখলেন যে, তলোয়ার হাতে হযরত ওমর, আশে পাশে সবাই একত্রিত হলেন, হযরত হামজা (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন কি ব্যাপার? তাঁকে বলা হলো যে, ওমর এসেছেন, তিনি বললেন, ওমর এসেছে, দরজা খুলে দাও, যদি ভালোর জন্য এসে থাকে তবে ভালোই হবে, আর যদি খারাপ উদ্দেশ্যে এসে থাকে তাহলে তাহলে আমরা তার তলোয়ার দিয়ে তাকে শেষ করে দেব, এ দিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভিতরে ছিলেন, তাঁর উপর ওহী নাযিল হচ্ছিলো, ওহী নাযিল হওয়ার পর তিনি এদিকে কামরায় ওমরের কাছে এলেন এবং তাঁর পরিধানের পোশাক এবং তলোয়ারের একাংশ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, ওমর, তুমি কি ততক্ষণ পর্যন্ত বিরত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তোমার উপর ওলীদ ইবনে মুগীরার মত অবমাননাকর শাস্তি নাযিল না করবেন? হে আল্লাহ ওমর ইবনে খাত্তাবের দ্বারা দ্বীনের শক্তি ও সম্মান দান করো, একথা বলার সাথে সাথে হযরত ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করে নিলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে নিশ্চয়ই আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসূল, একথা শুনে ঘরের ভিতর যারা ছিলেন তারা এতো জোরে আল্লাহ আকবার ধ্বনি দিলেন যে, কাবাঘরের মধ্যে যারা ছিলেন, তারাও সেই আওয়াজ শুনতে পেলেন (তারীখে ওমর ইবনে খাত্তাব প. ৭, ১০, ১১, সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৪৩, ৩৪৪) আরবে কেউ তার মোকাবেলা করার সাহস পেতো না, এ কারণে তার ইসলাম গ্রহণের সংবাদে পৌত্তলিকদের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে গেলো, তারা মারাত্মক সঙ্কট এবং অবমাননার সম্মুখীন হলো, অন্য দিকে তার ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলমানদের গৌরব, শক্তি, মর্যাদা সাফল্য ও আনন্দ বেড়ে গেল, ইবনে ইসহাক তার সনদে হযরত ওমর (রা.) এর বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন যে, আমি যখন মুসলমান হলাম, তখন ভাবলাম, মক্কায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবচেয়ে বড় শত্রু কে? এরপর মনে মনে বললাম, সে হচ্ছে আবু জেহেল, এরপর আমি আবু জেহেলের বাড়ী গেলাম, ঘরের দরজায় করাঘাত করলে আবু জেহেল বেরিয়ে এলো, সে আমাকে দেখে বললো, স্বাগতম সুস্বাগতম কি কাজে এসেছ ওমর? আমি বললাম তোমাকে একথা জানাতে এসেছি যে, আমি আল্লাহ তায়ালা এবং তার রাসূল মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি, তিনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন তার ওপরও বিশ্বাস পোষণ করেছি এবং সত্য বলে স্বীকার করেছি তিনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন, তার ওপরও বিশ্বাস পোষণ করেছি এবং সত্য বলে স্বীকার করছি একথা শুনে আবু জেহেল দরোজা বন্ধ করে দিতে দিতে বললো, আল্লাহ তোমার মন্দ করুন এবং তুমি যা কিছু নিয়ে এসেছ, তারও মন্দ করুন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ২৪৯ ২৫০)।
ইমাম ইবনে জওযি হযরত ওমর ফারুক (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, কেউ যখন ইসলাম গ্রহণ করতো, তখন কোরাইশ কাফেররা তাদের পেছনে লেগে যেতো, তাকে নির্মমভাবে প্রহার করতো, প্রহৃত ব্যক্তিও প্রহার করতেন, আমি ইসলাম গ্রহণ করার পর আমার মামা আদী ইবনে হাশেমের কাছে গিয়ে তাকে জানালাম, তিনি কোন কথা না বলে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন, এরপর কোরাইশের একজন বিশিষ্ট লোকের কাছে গেলেন সম্ভবত আবু জেহেলের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, আমার মামা আদী কোরাইশের সেই লোককে খবর দেয়ার পর সেও ঘরের ভেতর ঢুকে গেলো (তারীখে ওমর ইবনে খাত্তাব পৃ. ৮)।
ইবনে হিশাম এবং ইবনে জওযি বর্ণনা করেছেন যে হযরত ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর জামিল ইবনে মোয়াম্মার মাহমির কাছে গেলেন কোন কথা প্রচারের ক্ষেত্রে কোরাইশদের মধ্যে এ লোক ছিল বিখ্যাত, হযরত ওমর (রা.)তাকে জানালেন যে, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি, একথা শোনার সাথে সাথে সে উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠলো, যে খাত্তাবের পুত্র বেদ্বীন হয়ে গেছে, হযরত ওমর (রা.)বললেন, তুমি মিথ্যা বলছো, আমি মুসলমান হয়েছি, মোটকথা, লোকেরা হযরত ওমরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, এবং তাকে প্রহার করতে লাগলো, হযরত ওমর প্রহৃত হচ্ছিলেন আবার নিজেও প্রহার করছিলেন, এক সময় সূর্য মাথার ওপর এলে ক্লান্ত হয়ে তিনি বসে পড়লেন, এরপর বললেন, যা খুশি করো আল্লাহর কসম, যদি আমরা সংখ্যায় তিনশজনও হতাম, তাহলে মক্কায় হয় তোমরা থাকতে অথবা আমরা থাকতাম (ঐ পৃ. ৮ ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৪৮ ৩৪৯)।
পৌত্তলিকরা এরপর হযরত ওমর (রা.) কে প্রাণে মেরে ফেলার জন্যে তারে বাড়ীতে চড়াও হলো, সহীহ বোখারীতে বর্ণিত আছে যে, হযরত ওমর (রা.) ভীত বিহ্বল হয়ে ঘরের ভেতর ছিলেন, এমন সময় আবু আমর আস ইবনে ওয়ায়েল ছাহমি এলেন, তিনি কারুকাজ করা ইয়েমেনী চাদর এবং রেশমি পোশাক পরিহিত ছিলেন, তিনি ছিলেন ছাহাম গোত্রের অধিবাসী, সেইকালে তিনি ছিলেন আমাদের মিত্র গোত্রের লোক, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার, এত হল্লা কিসের? হযরত ওমর (রা.) বললেন, আমি মুসলমান হয়েছি একারণে ওরা আমাকে মেরে ফেলতে চায়, আস বললেন, এটা সম্ভব নয় আস এর একথা শুনে আমি স্বস্থিবোধ করলাম, বহু লোক সে সময় আমার বাড়ীর আশে পাশে ভীর করে আছে, আস ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা সবাই কোথায় চলেছ? সবাই বললো, ওমর বেদ্বীন হয়ে গেছে, তার কাছে যাচ্ছি, আস বললেন, সেদিকে যাওয়ার কোন পথ নেই, একথা শুনে সবাই ফিরে চলে গেল (সহীহ বোখারী, ওমর ইবনে খাত্তাব অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ.৫৪৫), ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় রয়েছে যে, তারা এমনভাবে সমবেত হয়েছিল, মনে হচ্ছিলো যেন তারা একই পোশাকের মধ্যে সবাই প্রবেশ করছে (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৪৯)।
হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহণের পর পৌত্তলিকদের অবস্থা ছিলো এরূপ যে ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে, মুসলমানদের অবস্থার ধারণা এ ঘটনা থেকেই অনুমান করা যায়, মোজাহেদ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আমি ওমর ইবনে খাত্তাবকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, কি কারণে আপনার উপাধি ফারুক হয়েছে? তিনি বললেন, আমার ইসলাম গ্রহণের তিন দিন আগে হযরত হামযা (রা.) ইসলাম গ্রহন করেন, এরপর হযরত ওমর হযরত হামযার ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা করার পর বলেন, এরপর আমি ইসলাম গ্রহন করে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, মরে যাই বা বেচে থাকি, আমরা কি হক এর ওপর বিদ্যমান নেই? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কেন নয়? সেই সত্ত্বার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তোমরা বেচে থাকো, বা মরে যাও, নিশ্চয়ই তোমরা হক এর উপর রয়েছো, হযরত ওমর (রা.) বলেন, এরপর আমি বললাম, তাহলে আমরা কেন পালিয়ে বেড়াবো? সেই সত্তার শপথ, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, নিশ্চয়ই আমরা বাইরে বের হবো, এরপর আমরা দুই কাতারে বিভক্ত হয়ে মিছিল করে আল্লাহর রাসূলকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে বের হলাম, এক কাতারে ছিলেন হযরত হামযা, অন্য কাতারে আমি, আমাদের চলার পথে যাতার পেষা আটার মতো ধুলো উড়ছিলো, আমরা মসজিদে হারামে প্রবেশ করলাম, হযরত ওমর (রা.) বলেন কোরাইশরা আমাদের দেখে মনে এত বড় কষ্ট পেলো, যা ইতিপূর্বে পায়নি, সেই দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে ফারুক উপাধি দিলেন (তারীখে ওমর ইবনুল খাত্তাব, ইবনে জওযি, পৃ. ৬, ৭)।
হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, এর আগে আমরা কাবাঘরের কাছে নামায আদায়ে সক্ষম ছিলাম না (মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আব্দুল্লাহ পৃ. ১০৩)।
হযরত যোহায়ের ইবনে সেনান রূমী (রা.) বলেন, হযরত ওমর ফারুক (রা.) মুসলমান হওয়ার পর ইসলাম পর্দার বাইরে এলো, এবং ইসলামের দাওয়াত প্রকাশ্যে দেয়া শুরু হলো, আমরা কাবাঘরের সামনে গোল হয়ে বসতে লাগলাম এবং কাবাঘর তওয়াফ করতে লাগলাম, যারা আমাদের ওপর বাড়াবাড়ি করেছিলো, তাদের উপর প্রতিশোধ নিলাম এবং অত্যাচারের জবাব দিলাম (তারীখে ওমর ইবনুল খাত্তাব, ইবনে জওযি পৃ. ১৩)।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহণের পর থেকে পরবর্তীকালে আমরা শক্তিশালী এবং সম্মানিত ছিলাম (সহীহ বোখারী, বাবে ইসলাম ওমর ইবনে খাত্তাব, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৪৫)।
হযরত হামযা ইবনে আব্দুল মোত্তালেব এবং হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) এর ইসলাম গ্রহণের পর মুসলমানদের ওপর পাইকারি নির্যাতন কমে গেলো, বুদ্ধি বিবেচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যে পৌত্তলিকরা উদ্যোগী হলো, তারা চিন্তা করলো যে, ইসলামের দাওয়াত দেয়ার মাধ্যমে মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা পেতে চান সেই প্রাপ্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তা পূরণের মাধ্যমে তাকে হয়তো তার কাজ থেকে বিরত রাখা যাবে, কিন্তু তারা জানতো না রাসূলে খোদার দ্বীনের দাওয়াতের মোকাবেলায় সমগ্র বিশ্বজগতও সম্পূর্ণ মূল্যহীন, কাজেই, তাদের চেষ্টায় তারা স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হলো।
ইবনে ইসহাক ইয়াজিদ ইবনে যিয়াদের মাধ্যমে মোহাম্মাদ ইবনে কাব কারাযির এই বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন যে, আমাকে জানানো হয়েছে, কওমের নেতা ওতবা ইবনে রবিয়া স্বজাতীয়দের সামনে একদিন নতুন একটা প্রস্তাব দিল, সে সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে হারামের এক জায়গায় একাকী ছিলেন ওতবা বললো, মোহাম্মাদের সাথে আলোচনা করে এর ব্যবস্থা নাও, তার সামনে কয়েকটা প্রস্তাব পেশ করো, হয়তো তিনি কোন একটা প্রস্তাব মেনে নেবেন, তিনি যে দাবী করবেন, সেই দাবী আমরা পূরণ করবো, হামযা (রা.) এর ইসলাম গ্রহণের পর মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি দেখে তারা নিজেদের মধ্যে এ পরামর্শ করলো।
কোরাইশরা বললো, আবুল ওলীদ তুমি যাও, তুমি গিয়ে তার সাথে কথা বলো, এরপর ওতবা উঠে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বসলো, ওতবা বললো, ভাতিজা আমাদের কওমের মধ্যে তোমার যে মর্যাদা রয়েছে সে কথা সবাই জানে তুমি উচ্চ বংশের মানুষ তুমি এমন একটা বিষয় প্রচার করছো, যার কারণে কওমের মধ্যে বিভেদ বিশৃঙ্খলা ও অনৈক্য দেখা দিয়েছে তুমি কওমের নেতৃস্থানীয় লোকদের বুদ্ধিমত্তাকে নির্বুদ্ধিতা বলে অভিহিত করছো, তাদের উপাস্যকে নানাভাবে সমালোচনা করছো, তাদের ধর্ম বিশ্বাসকে বাতিল করে দিচ্ছো, তাদের পূর্ব পুরুষদের কাফের বলে অভিহিত করছো, আমার কথা শোনো আমি তোমাকে কয়েকটি প্রস্তাব দিচ্ছি তুমি এ প্রস্তাব সম্পর্কে চিন্তা কর হয়তো যে কোন একটা প্রস্তাব তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন বল আবুল ওলীদ আমি শুনবো।
ওতবা ওরফে ওলীদ বললো ভাতিজা তুমি যা প্রচার করছো যদি এর বিনিময়ে ধন-সম্পদ চাও তবে আমরা তোমাকে এতো এত ধন সম্পদ দেব যা তুমি হবে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি যদি তুমি মর্যাদা চাও তাও বলে আমরা তোমাকে আমাদের নেতা হিসাবে বরণ করে নেব, তোমাকে ছাড়া কোন ফয়সালা করা হবে না যদি তুমি বাদশাহ হতে চাও তাও বল আমরা তোমাকে বাদশাহ হিসাবে মেনে নেবো যদি তোমার কাছে আসা জিনিস জ্বীন ভূত হয়ে থাকে তাও বলো তুমি দখ অথচ তাড়াতে পারছো না আমরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করব, যত টাকা লাগে লাগুক আমরা তোমার চিকিৎসা করাবো, কখনো কখনো এমন হয় যে, জ্বীন ভূতেরা মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করে রাখে সে অবস্থায় মানুষের চিকিৎসার প্রয়োজন দেখা দেয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওতবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনর পর বললেন, আবুল ওলীদ তোমার কথা কি শেষ হয়েছে? আমার কথা শোনো, এরপর রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা হা-মীম সাজদার প্রথম থেকে তেলাওয়াত শুরু করলেন পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি, হা-মীম এই কেতাব দয়াময় পরম দয়ালুর কাছ থেকে অবতীর্ণ এটি এক কেতাব বিশদভাবে বিবৃত হয়েছে এর আয়াতসমূহ আরবী ভাষায় কোরআনরূপে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে, কিন্তু ওদের অধিকাংশই বিমুখ হয়েছে কাজেই ওরা শুনবে না ওরা বলে তুমি যার প্রতি আমাদের আহ্বান করছো সে বিষয়ে আমাদের অন্তর আবরণ আচ্ছাদিত, কানে আছে বধিরতা এবং তোমার ও আমাদের মধ্যে কাজ করে অন্তরাল সুতরাং তুমি তোমার কাজ করো, এবং আমরা আমাদের কাজ করি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তেলাওয়াত করে যাচ্ছিলেন আর ওতবা দুহাত পেছনের দিকে মাটিতে রেখে আরাম করে বসে শুনছিলো সেজদার আয়াত তেলাওয়াত করার পর রাসূল উঠে সেজদা করলেন এরপর বললেন আবুল ওলীদ তুমি কিছু শুনতে চেয়েছিলে আমি শুনিয়েছি এবার তুমি জানো আর তোমার কাজ জানে।
ওতবা উঠলো এবং নিজের সঙ্গীদের কাছে গেল তাকে দেখে তার সঙ্গীরা বলাবলি করতে লাগলো যে, খোদার কসম, আবুল ওলীদ যে চেহারা নিয়ে গিয়েছিলো সে চেহারা নিয়ে কিন্তু ফিরে আসছে না ওতবা বসার পর সঙ্গীরা জিজ্ঞাসা করলো যে কি খবর নিয়ে এসেছো? সে বলল খবর হচ্ছে আমি এমন কালাম শুনেছি যা অতীতে কোনদিনই শুনিনি, খোদার কসম সেটা কবিতাও নয় জাদুমন্ত্র ও নয়, তোমরা আমার কথা শোন, ওকে তার অবস্থার ওপর ছেড়ে দাও যে কালাম আমি শুনেছি ভবিষ্যতে এর মাধ্যমে বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটবে, এরপর যদি ওকে আরবের লোকেরা মেরে ফেলে তবে তোমাদের কাজ অন্য কেউ করবে যদি তিনি আরবের ওপর জয়লাভ করেন তবে তার সম্মান হবে তোমাদের সম্মান তার বাদশাহি হবে তোমাদের বাদশাহি তার অস্তিত্ব তোমাদের জন্য সৌভাগ্যরে কারণ হবে।
কোরাইশরা বললো আবুল ওলীদ সে কালামের যাদু তোমাকেও প্রভাবিত করেছে ওতবা বলল, তার ব্যাপারে আমি যা বুঝেছি বলেছি এখন তোমরা যা ভালো মনে করো তা করো (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ২৯৩-২৯৪)।
অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন যে, তবুও যদি ওরা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে বল আমি তো তোমাদেরকে সতর্ক করছি এক ধ্বংসকর শাস্তির যা আদ ও সামুদের শাস্তির অনুরূপ এই আয়াত তেলাওয়াতের সাথে সাথে ওতবা উঠে দাড়াল এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, আমি আপনাকে আল্লাহ এবং নিকট আত্মীয়দের দোহাই দিয়ে বলছি যে, আপনি এরূপ করবেন না ওতবা আশংকা করছিল যে ওরকম শাস্তি তার ওপর এসে না পড়ে এরপর সে উঠে তার সঙ্গীদের কাছে গিয়ে উল্লিখিত কথা বলল (তাফসীরে ইবনে কাসির, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃ. ১৫, ১৬০, ১৬১)।
বনু হাশেম ও বনু মোত্তালেবদের সাথে আবু তালেবের বৈঠক
ইতিমধ্যে পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে আবু তালেব তখনও ছিলেন শঙ্কিত, পৌত্তলিকদের পক্ষ থেকে তিনি তার ভ্রাতুষ্পুত্রের ব্যাপারে আশঙ্কা বোধ করছিলেন তিনি এযাবৎ সংঘটিত ঘটনাবলী পর্যালোচনা করছিলেন পৌত্তলিকরা তাকে মোকাবেলার হুমকি দিয়েছিল আম্মারা ইবনে ওলীদের বিনিময়ে তার ভ্রাতুষ্পুত্রকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করার প্রস্তাব করেছিল আবু জেহেল একটা ভারি পাথর দিয়ে তার ভাতিজার মস্তক চূর্ণ করার চেষ্টা করছিল ওকবা ইবনে আবু মুঈত গলায় চাদর পেঁচিয়ে তার ভাতিজাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করতে চেয়েছিল খাত্তাবের পুত্র খোলা তলোয়ার হাতে তাকে হত্যা করতে বেরিয়েছিল পর্যায়ক্রমে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার প্রতি লক্ষ্য করে আবু তালেব এমন গুরুতর বিপদের আশঙ্কা করলেন যে, তার বুক কেপে উঠলো।
তিনি ভালভাবে বুঝতে পারলেন যে, পৌত্তলিকরা তার ভ্রাতুষ্পুত্রকে হত্যা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এমতাবস্থায় কোন কাফের যদি তার ভাতিজার ওপর হঠাৎ করে হামলা চালায় তাহলে বিচ্ছিন্নভাবে হযরত হামযা বা হযরত ওমর বা অন্য কেউ কি তাকে রক্ষা করবে?
আবু তালেব এ আশঙ্কা অমূলক ছিল না কেননা পৌত্তলিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করতে সংকল্পবদ্ধ ছিল, তাদের এ সঙ্কল্পের প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লাহ তায়ালা বলেন, ওরা কি কোন ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে? আমিই তো সিদ্ধান্তকারী (৭৯, ৪৩)
প্রশ্ন হচ্ছে এ ধরনের পরিস্থিতিতে আবু তালেবের কি করা উচিত ? তিনি যখন দেখলেন যে পৌত্তলিকরা চারিদিক থেকে তার ভাতিজাকে নাজেহাল করতে উঠে লেগেছে তখন তিনি তার পিতামহের দুই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হাশেম এবং মোত্তালেবের বংশধরদের একত্রিত করলেন তিনি সেই সমাবেশে তার ভ্রাতুষ্পুত্রকে রক্ষার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানালেন, তিনি আবেগজড়িত কন্ঠে বললেন, যে দায়িত্ব এতদিন আমি একা পালন করেছি, এবার এসো আমরা সবাই মিলে সে দায়িত্ব পালন করি আবু তালেবের এ আহবানে তার দুই পূর্ব পুরুষের বংশধররা সাড়া দিলেন আবু তালেবের ভাই আবু লাহাব শুধু ভিন্নমত পোষণ করল, সে অস্বীকৃতি জানিয়ে পৌত্তলিকদের সাথে মিলিত হলো, (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ২৬৯, মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আবদুল্লাহ পৃ. ১০৬)।
সর্বাত্মক বয়কট
চার সপ্তাহ বা তার চেয়ে কম সময়ের ভেতর পৌত্তলিকরা চারটি বড় ধরনের ধাক্কা খেলো, হযরত হামযা এবং হযরত ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করা, সর্বোপরি বনু হাশেম এবং বনু মোত্তালেব একত্রিত হয়ে আল্লাহর রাসূলকে রক্ষার ব্যাপারে একমত হলো পৌত্তলিকরা এতে অস্থির হয়ে উঠলো অস্থির হবে না কেন, কারণ তারা বুঝতে পেরেছিলো যে এখন যদি মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার কোন পদক্ষেপ গ্রহন করে তাহলে তাকে রক্ষা করতে যে রক্তপাত হবে এতে মক্কার প্রান্তর লাল হয়ে যাবে তাদের নিজেদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো, এ কারণে আল্লাহর রাসূলকে হত্যা করার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে পৌত্তলিকরা অত্যাচার নির্যাতনের একটি নতুন পথ আবিষ্কার করলো, এটি ছিলো ইতিপূর্বে গৃহীত সব পদক্ষেপের চেয়ে আরো বেশী মারাত্মক।
ইবনে কাউয়েম লিখেছেন যে, বলা হয়ে থাকে এই দলিল মনসুর ইবনে একরামা ইবনে আমের ইবনে হাশেম লিখেছিলেন কারো কারো মতো নযর ইবনে হারেস লিখেছিল, কিন্তু সঠিক কথা হচ্ছে এই দলিল বোগাইজ ইবনে লিখেছিল এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য বদদোয়া করায় তার হাত অবশ হয়ে গিয়েছিল (যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৪৯)।
লেখার পর দলিল কাবাঘরে টাঙ্গিয়ে দেয়া হল, তাতে আবু লাহাব ব্যতীত বনু হাশেম এবং বনু মোত্তালেবের মুসলিম অমুসলিম নারী পুরুষ শিশু সবাই শাবে আবু তালেব নামক স্থানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন এটা ছিলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবী হিসাবে আবির্ভাবের সপ্তম বছরের ঘটনা।
শাবে আবু তালেবে তিন বছর
এ বয়কটে পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠলো, খাদ্যসামগ্রীর সরবরাহ বন্দ হয়ে গেল, যা ও বা মক্কায় আসতো পৌত্তলিকরা তাড়াতাড়ি সেগুলো কিনে নিতো, ফলে অবরুদ্ধ মুসলিম অমুসলিম কারো কাছে কোন কিছু স্বাভাবিক উপায়ে পৌছুতো না, তারা গাছের পাতা এবং চামড়া খেয়ে জীবন ধারণ করতেন ক্ষুধার কষ্ট এত মারাত্মক ছিল যে ক্ষুধার্ত নারী ও শিশুর কাতর কান্না শাবে আবু তালেব বা আবু তালেব ঘাটির বাইরে থেকে শোনা যেত তাদের কাছে কোন খাদ্যসামগ্রী পৌছার সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ যা কিছু পৌছুতো সে সব গোপনীয়ভাবেই পৌছাত, নিষিদ্ধ মাসসমূহ ছাড়া প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য তারা ঘাটির বাইরে বেরও হতেন না বাইরে থেকে মক্কায় আসা জিনিস কেনার চেষ্টা করেও অনেক সময় তারা সক্ষম হতেন না কারণ পৌত্তলিকরা সেসব জিনিসের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিত।
হাকিম ইবনে হাজাম ছিলেন হযরত খাদিজা (রা.) এর ভ্রাতুষ্পুত্র মাঝে মাঝে তিনি ফুফুর জন্য গম পাঠাতেন একবার গম পাঠানোর উদ্যোগ নিতেই আবু জেহেল বাধা দিল, কিন্তু আবুল বাখতারি হাকিম ইবনে হাজেমের পক্ষাবলম্বন করে গম পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিলেন।
এদিকে আবু তালেব সব সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে চিন্তায় ছিলেন রাতে সবাই শুয়ে পড়ার পর তিনি ভ্রাতুষ্পুত্রকে বলতেন যাও, তুমি এবার তোমার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়, তিনি একথা এ জন্যই বলতেন যাতে কোন গোপন আততায়ী থাকলে বুঝতে পারে যে, তিনি কোথায় শয়ন করেছেন এরপর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আবু তালেব তার প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রের শোয়ার স্থান বদলে দিতেন ভ্রাতুষ্পুত্রের বিছানায় নিজের পুত্র ভাই বা অন্য কাউকে শয়ন করাতেন রাত্রিকালে প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র আল্লাহর রাসূল মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্য কাটাতেন।
এ ধরনের কঠিন অবরোধ সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যান্য মুসলমান হজ্জের সময় বাইরে বের হতেন এবং হজ্জের উদ্দেশ্যে আসা লোকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিতেন, এ সময় আবু লাহাব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং মুসলমানদের সাথে যেরূপ আচরণ করতো, ইতোপূর্বে তা উল্লেখ করা হয়েছে, (আবু তালেবের মৃত্যু হয়েছিলো দলিল ছিন্ন করার ছয়মাস পর, সঠিক তথ্য হচ্ছে যে, তাঁর মৃত্যু রজব মাসে হয়েছিলো, যারা বলে যে, তার মৃত্যু রমজান মাসে হয়েছিলো, তারা এও বলে যে, তার মৃত্যু দলিল ছিন্ন করার ঘটনার আটমাস কয়েকদিন পর হয়েছিলো, উভয় অবস্থায় এটা প্রমাণিত হয় যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল মহররম মাসে)।
দলিল ছিন্ন করার ঘটনা
এ অবস্থায় পুরো তিন বছর কেটে যায়, এরপর নবুয়তের দশম বর্ষে মহররম মাসে দলিল ছিন্ন হওয়ার ঘটনা ঘটে, এতে অত্যাচার নির্যাতনের অবসান ঘটে, কোরাইশদের মধ্যকার কিছু লোক এ ব্যবস্থার বিরোধী থাকার তারা অবরোধ বাতিল করারও উদ্যোগ গ্রহণ করে।
এই অমানবিক অবরোধ সম্পর্কিত প্রণীত দলীল বিনষ্ট করার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বনু আমের ইবনে লুয়াই গোত্রের হেশাম ইবনে আমের নামক একজন ব্যক্তি, হেশাম রাত্রিকালে চুপিসারে খাদ্য দ্রব্য পাঠিয়ে আবু তালেব ঘাঁটির অসহায় লোকদের সাহায্য করতো, প্রথমে হেশাম যুহাইর ইবনে আবু উমাইয়া মাখযুমির কাছে যান, যুহাইয়ের মা আতেকা ছিলেন আবদুল মোত্তালেবের কন্যা, অর্থাৎ আবু তালেবের বোন, হেশাম তাকে বললেন, যুহাইর তুমি কি চাও যে, তোমরা মজা করে পানাহার করবে আর, অথচ তোমার মামা ও অন্যেরা ধুকে ধুকে মারা যাবে, তারা কি অবস্থায় রয়েছে সেটা কি তুমি কি জান না? যুহাইর বললো, আফসোস, আমি একা কি করতে পারি? যদি আমার সাথে আর কেউ এগিয়ে আসে তবে আমি দলিল বিনষ্ট করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি, হেশাম বললেন, অন্য একজন রয়েছেন, যুহাইর বললেন, তিনি কে? হেশাম বললেন, আমি, যুহাইর বললেন, আচ্ছা তবে তৃতীয় কাওকে খুঁজে বের করো, এ কথা শুনে হেশাম মোতায়ম ইবনে আদিরের কাছে গেলেন এবং বনু হাশেম ও বনু মোত্তালেবের অবস্থার কথা উল্লেখ করে তার সাহায্য চাইলেন, ওরা যে তাঁর নিকটাত্মীয় সে কথা বললেন, মোতয়াম বললেন, আমি একা কি করতে পারি? হেশাম বললেন আরো একজন আছেন, মোতয়াম জিজ্ঞাসা করলেন তিনি কে? হেশাম বললেন, আমি, মোতয়াম বললেন, আচ্ছা তৃতীয় একজন খুঁজে নাও, হেশাম বললেন সেটাও করেছি, মোতয়াম বললেন তিনি কে? হেশাম বললেন, তিনি বললেন যুহাইর ইবনে উমাইয়া, মোতায়ম বললেন, আচ্ছা চতুর্থ একজন তালাশ কর, এরপর হেশাম আবুল বখতিয়ারের কাছে গেলেন, এবং তার সাথে মোতায়ামের কাছে যেভাবে বলেছেন, সেভাবে বললেন, আবুল বখতিয়ার জানতে চাইলেন, এ ব্যাপারে সমর্থক কেউ আছে কি না? হেশাম বললেন হ্যাঁ আছে, এরপর তিনি যুহাইর ইবনে আবু উমাইয়া, মোতায়ম ইবনে আদি এবং নিজের কথা বললেন, আবুল বখতিয়ার বললেন, আচ্ছা তবে বিশ্বস্ত একজন লোক খোজ করো, এরপর জাময়া ইবনে আছওয়াদ ইবনে মোত্তালেব ইবনে আছাদের কাছে গেলেন, তার সাথে বনু হাশেম এবং বনু মোত্তালেবের দুরবস্থার বিষয়ে আলোচনা করে সাহায্য চাইলেন, তিনি জানতে চাইলেন অন্য কোন সহায়তাকারী আছে কি না? হেশাম বললেন হ্যাঁ আছে, এরপর সকলের নাম জানালেন, পরে উল্লেখিত সবাই হাজুন নামক জায়গায় একত্রিত হয়ে দলিল বিনষ্ট করার ব্যাপারে অঙ্গীকার বদ্ধ হলেন, যুহাইর বললেন, প্রথমে আমি কথা তুলবো।
সকাল বেলা নিয়মানুযায়ী সবাই মজলিসে একত্রিত হলো, যুহাইর দামী পোশাক পরিধান করে সেজে গুজে উপস্থিত হলো, প্রথমে কাবাঘর সাতবার তাওয়াফ করে সবাইকে সম্বোধন করে বললো, মক্কাবাসীরা শোন আমরা পানাহার করবো, পোশাক পরিধান করবো, আবু বনু হাশেম ধ্বংস হয়ে যাবে, তাদের কাছে কিছু বিক্রি করা হচ্ছে না, তাদের কাছ থেকে কেনাও হচ্ছে না খোদার কসম, এ ধরনের অমানবিক দলিল বিদ্যমান থাকা অবস্থায় আমি নীরব হয়ে থাকতে পারি না, আমি চাই এ দলিল বিনষ্ট করে ফেলা হোক।
আবু জেহেল এ কথা শুনে বলল, তুমি ভুল বলছো, খোদার কসম, এ দলিল ছিন্ন করা যাবে না।
জাময়া ইবনে আসওয়াদ বললেন, খোদার কম, তুমি ভুল বলছ, এ দলিল যখন লেখা হয়েছিল, তখনো আমি রাজি ছিলাম না, আমি এটা মানতে প্রস্তুত নাই এরপর মোতয়াম ইবনে আদী বললেন তোমরা দুজনে ঠিকই বলছো, আমরা এ দলিলে যা কিছু লেখা রয়েছে, তা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই।
হেশাম ইবনে আমরও এ ধরনের কথা বললেন।
এ অবস্থা দেখে আবু জেহেল বললো, হুহু বুঝেছি রাত্রিকালেই এ ধরনেরও ঐক্যমত্য হয়েছে এ পরামর্শ এখানে নয় বরং অন্য কোথাও করা হয়েছে।
সে সময় আবু তালেবও অদূরে উপস্থিত ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জানিয়েছিলেন যে, দলিল বিনষ্ট করতে আল্লাহ তায়ালা এক রকম পোকা পাঠিয়েছেন তারা যুলুম অত্যাচারের বিবরণসমূহ কেটে ছারখার করে ফেলেছে, শুধু যেখানে যেখানে আল্লাহর নাম রয়েছে সেসব অবশিষ্ট রয়েছে।
আবু তালেব কোরাইশদের বললেন, আমার ভাতিজা আমাকে আপনাদের কাছে এ কথা বলতে পাঠিয়েছেন যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে জানিয়েছেন যে, আপনাদের অঙ্গীকার পত্রটি আল্লাহ তায়ালা এক রকম পোকা পাঠিয়ে নষ্ট করে দিয়েছেন শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার নামটুকু সেখানে অবশিষ্ট আছে, এ কথা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হলে আমি তার ও আপনাদের মাঝ থেকে সরে দাঁড়াব এবং আপনারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন আর সত্য বলে প্রমাণিত হয় তাহলে বয়কটের মাধ্যমে আমাদের প্রতি যে অন্যায় আচরণ করেছেন তা থেকে বিরত থাকবেন এতে কোরাইশরা সম্মত হলো।
এ নিয়ে আবু জেহেল ও অন্যান্যদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক শেষ হলে মুতয়াম বিন আদী অঙ্গীকারপত্র ছিঁড়তে গিয়ে দেখলেন যে, আল্লাহর নাম লেখা অংশ বাদে বাকি অংশ সত্যি সত্যি পোকা খেয়ে ফেলেছে পরে অঙ্গীকারপত্র ছিড়ে ফেলা হলে বয়কটের অবসান হল এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) ও অন্য সকলে শাবে আবু তালিব থেকে বেরিয়ে এলেন, কাফেররা এ বিস্ময়কর নিদর্শনে আশ্চর্য হল, কিন্তু তাদের মনোভাবের কোন পরিবর্তন হল না, আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর যদি তারা কোন মোজেজা দেখে, তখন টালবাহানা করে এবং বলে এ তো যাদু।
আরবের পৌত্তলিকরা নবুয়তের বিস্ময়কর এ নিদর্শন থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিল এবং নিজেদের কুফুরীর পথে আরো কয়েক কদম অগ্রসর হলো (বয়কটের বিবরণ নিম্নোল্লিখিত গ্রন্থগুলো থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ২১৬, ৫৪৮ যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. ৪৬, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৩৫০-৩৫১, ৩৪৭, ৩৭৭, রহমাতুল লিল আলামিন, ১ম খন্ড, পৃ. ৭০ মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আবদুল্লাহ পৃ. ৬, ১০ ১১০, মুখতাছারুছ সীরাত মোহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব, পৃ. ৬৮, ৭৩)।
আবু তালেব সকাশে কোরাইশদের শেষ প্রতিনিধি দল
শাবে আবু তালেব থেকে বেরোবার পর রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুনরায় দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ শুরু করলেন, বয়কট শেষ হলেও পৌত্তলিক দুর্বৃত্তরা ইসলাম প্রচারে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যাচ্ছিল, এদিকে আবু তালেব তার ভাতিজাকে রক্ষা করার দীর্ঘকালীন প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন কিন্তু তিনি ছিলেন বয়সের ভারে ন্যুজ্ব তার বয়স আশি বছর ছাড়িয়ে গিয়েছিল, ক্রমাগত কয়েক বছর যাবত দুঃখ দুর্দশা বিপদ মুসিবতে তার স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল, বিশেষ করে গিরিবর্তে অবরোধ তার শক্তি সামর্থ্য নিঃশেষ করে দিয়েছিল, সেখান থেকে বেরোবার কয়েকমাস পরই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এ সময় পৌত্তলিকরা চিন্তা করলো যে, আবু তালেব দ্রুত অসুস্থ হচ্ছেন যে কোন সময় তার জীবনের দিন শেষ হতে পারে তার মৃত্যুর পর যদি আমরা তার ভাতিজার ওপর কোন বাড়াবাড়ি করি, তখন আমাদের দুর্নাম হবে, লোকে বলাবলি করবে যে, অভিভাবক নেই দেখে এখন সুযোগ নিচ্ছে, একারণে তারা আবু তালেবের জীবদ্দশাতেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে একটি ফয়সালায় উপনীত হতে চাচ্ছিলো এক্ষেত্রে ছাড় দিতে তারা রাজি ছিল না, নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার পর একটি প্রতিনিধিদল আবু তালেবের কাছে হাযির হল, এটা ছিল তার কাছে কোরাইশদের শেষ প্রতিনিধি দল।
ইবনে ইসহাক প্রমুখ বর্ণনা করেছেন যে, আবু তালেব অসুস্থ হয়ে পড়ার পর কোরাইশরা আশঙ্কা করেছিল যে, হঠাৎ করেই আবু তালেব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল যে, দেখ হামযা, ওমর মুসলমান হয়ে গেছে এবং মুহাম্মদের ধর্ম কোরাইশদের সব গোত্রে বিস্তার লাভ করেছে, কাজেই চল, আবু তালেবের কাছে যাই, তিনি যেন তার ভাতিজাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখেন, এতে আমরা তার ব্যাপারে একটা চুক্তিতে উপনীত হতে পারব, আমরা আশঙ্কা করছি যে, সাধারণ মানুষ ভবিষ্যতে মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কোন বাড়াবাড়ি করলে সাধারণ লোকেরা আমাদের সমালোচনা করবে তারা বলাবলি করবে আবু তালেব বেচে থাকতে কোন কিছু করার সাহস ছিলনা এখন সুযোগ পেয়েছে।
মোট কথা কোরাইশ প্রতিনিধি দল আবু তালেবের কাছে গিয়ে আলোচনা করলো, কোরাইশদের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও প্রতিনিধিদলে অন্তর্ভুক্ত ছিল, এরা হলো আবু জেহেল ইবনে হেশাম, উমাইয়া ইবনে খালফ, আবু সুফিয়ান ইবনে হারব এবং অন্যান্য সংখ্যায় এরা ছিল পঁচিশজন তারা বলল, হে আবু তালেব আমাদের কাছে আপনার যে মর্যাদা রয়েছে, সেটা আপনার অজানা নয়, বর্তমানে আপনি যে অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন, সেটাও আপনি জানেন আমরা আশঙ্কা করছি যে, আপনার জীবনের দিন দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে, আপনার ভাতিজার সাথে আমাদের বিরোধ আপনার অজানা নয়, আমরা চাই আপনি তাকে ডেকে তার সাথে আমাদের একটা সমঝোতার ব্যবস্থা করুন, আমরা তার সাথে কিছু অঙ্গীকারে আবদ্ধ হতে এবং তাকেও কিছু অঙ্গীকারে আবদ্ধ করতে চাই, আমরা তাকে তার দ্বীনের উপর ছেড়ে দেব, তিনিও যেন আমাদেরকে আমাদের দ্বীনের ওপর ছেড়ে দেন।
এ সব কথা শোনার পর আবু তালেব তার প্রিয় ভাতিজা মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ডেকে আনালেন, তিনি আসার পর বললেন দেখ ভাতিজা ওরা তোমার কওমের সম্মানিত লোক, তোমার জন্যই ওরা একত্রিত হয়েছে, তোমার কাছ থেকে ওরা কিছু অঙ্গীকার নিতে চায়, এরপর আবু তালেব ওদের উত্থাপিত প্রস্তাব পেশ করলেন যে ওরা চায়, তুমি তাদের ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না এবং ওরাও তোমার ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না।
একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোরাইশ প্রতিনিধিদলকে বললেন আপনারা বলুন আমি যদি এমন কোন কথা পেশ করি, যে কথা গ্রহন করলে আপনারা আরবের বাদশাহ হবেন এবং অনন্যারাও আপনাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তখন আপনারা কি করবেন? অন্য বর্ণণায় রয়েছে যে, তিনি আবু তালেবকে সম্বোধন করে বললেন, আমি তাদের কাছে এমন একটি কথার স্বীকারোক্তি চাই যদি সেই স্বীকারোক্তি করে, তবে সমগ্র আরব তাদের অধীনস্থ হবে এবং অন্যরাও তাদের যিযিয়া দেবে, বর্ণনায় রয়েছে তিনি বলেছেন চাচা আপনি ওদের একটা বিষয়ের প্রতি ডাকুন, এতে ওদের ভালো হবে, আবু তালেব জিজ্ঞাসা করলেন ওদের তুমি কোন বিষয়ের প্রতি ডাকতে চাও? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি ওদের এমন একটা বিষয়ের প্রতি ডাকতে চাই, যদি ওরা সেটা গ্রহণ করে, তবে সমগ্র আরব তাদের অনুগত হয়ে যাবে এবং অনারবের ওপরও তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, ইবনে ইসহাকের একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আপনারা শুধু একটি কথা মেনে নিন এর ফলে আপনার আরবের বাদশাহ হয়ে যাবেন এবং অনারব আপনাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
মোট কথা এই প্রস্তাব শোনার পর কোরাইশ প্রতিনিধিদল থমকে গেল, তারা অবাক হয়ে ভাবতে লাগল যে, মাত্র একটি কথা মেনে নিলে এত বড় লাভ যদি হয়, তবে সেটা কিভাবে উপেক্ষা করা যায়? আবু জেহেল বললো, বলো সেই কথা, তোমার পিতার শপথ, এ ধরনের কথা একটি কেন দশটি বললেও আমরা মানতে প্রস্তুত রয়েছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন আপনারা বলুন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নাই, অন্য সকলের আনুগত্য উপাসনা পরিত্যাগ করুন একথা শুনে কোরাইশরা হাতে তালি দিয়ে বলল, মোহাম্মাদ, আমরা এক খোদা মানব? আসলেই তোমার ব্যাপার স্যাপার বড় অদ্ভুত।
এরপর তারা একে অন্যকে বলল, খোদার কসম, এই লোক তোমাদের কোন কথাই মানতে রাজি নয়, কাজেই এসো আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের ধর্মবিশ্বাসের ওপর অটল থাকি, এরপর আল্লাহ ওর এবং আমাদের মধ্যে একটা ফয়সালা করে দেবেন একথা বলে তারা উঠে চলে গেল, এ ঘটনার পর ওদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাযিল করেন, শপথ উপদেশপূর্ণ কোরআনের তুমি অবশ্যই সত্যবাদী, কিন্তু কাফেররা ঔদ্ধত্য এবং বিরোধিতায় ডুবে আছে, এদের পূর্বে আমি কত জনগোষ্ঠী ধ্বংস করেছি, তখন ওরা আর্ত চিৎকার করছিল, কিন্তু তখন পরিত্রাণের কোন উপায় ছিল না, এরা বিস্ময় বোধ করছে যে, এদের কাছে এদেরই মধ্যে থেকে একজন সতর্ককারী আসলো এবং কাফেররা বললো, এতো এক যাদুকর, মিথ্যাবাদী, সে কি বহু ইলাহের পরিবর্তে এক ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? এটাতো এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার, ওদের প্রধানেরা সরে পড়ে এই বলে তোমরা চলে যাও এবং তোমাদের দেবতাগুলোর পূজায় অবিচল থাক, নিশ্চয়ই এই ব্যাপারটি উদ্দেশ্যমূলক, আমরা তো অন্য ধর্মাদর্শে এরূপ কথা শুনিনি, নিশ্চয়ই এটা একটি মনগড়া উক্তি মাত্র (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, ৭, ৪, ৪১৯, মুখতাছারুছ সীরাত শেখ আবদুল্লাহ পৃ. ৯১) (১-৭, ৩৮)।