খন্দকের যুদ্ধ
এক বছরে বেশী সময় যাবত মুসলমানদের সামরিক তৎপরতা চালানোর ফলে জাজিরাতুল আরব তথা আরব উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। চারিদিকে মুসলমানদের প্রভাব প্রতিপত্তির বিস্তার ঘটে। এই সময়ে ইহুদীরা তাদের ঘৃণ্য আচরণ, ষড়যন্ত্র এবং বিশ্বাসঘাতকতরা কারণে নানা ধরনের অবমাননা ও অসম্মানের সম্মুখীন করে। কিন্তু তবু তাদের আক্কেল হয়নি, তারা কোন শিক্ষাও গ্রহণ করেনি। খয়বরে নির্বাসনের পর ইহুদীরা অপেক্ষায় থাকে যে, মুসলামনা এবং মূর্তিপূজদের মধ্যে যে সংঘাত চলছে, তার পরিণান কোথায় গিয়ে পৌঁছে, দেখা যাক। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই মুসলমাদের অনুকূলে যাচ্ছিলো, দূর দূরান্তে ইসলামের জয় জয়কার ছড়িয়ে পড়ছিলো। এসব দেখে ইহুদীরা হিংসায় জ্বলে-পুড়ে ছারখার হতে লাগলো। তারা নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করলো। মুসলনাদের ওপর সর্বশেষে আঘাত হানার জন্যে তারা প্রস্তুতি নিতে লাগলো। তারা মুসলমানদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাচ্ছিলো। কিন্তু সরাসরি সংঘাতের সংঘর্ষের সাহাস তাদের ছিলো না, এ কারণে উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে তারা এক ভয়ানক পরিকল্পনা গ্রহণ করলো।
ঘটনার বিবরণ এই, বনু নযির গোত্রের ২০ জন সর্দার ও নেতা মক্কায় কোরায়শদের কাছে হাযির হলো। তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে কোরায়শদের উদ্বুদ্ধ করে বললো যে, তারাও সর্বাত্মক সাহায্য করবে। কোরায়শরা রাজি হয়ে গেলো। ওহুদের যুদ্ধের সময় কোরায়শরা পরের বছর বদরের প্রান্তরে যুদ্ধ করবে বলেও করতে পারেনি। একারণে তারা ভাবলো যে, নতুন সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধঘ্যমে কোরায়শদের সুনাম সুখ্যাতিও বহাল রাখা যাবে, আর ইতিপূর্বে কৃত অঙ্গীকারও পূরণ করা যাবে।
ইহুদী প্রতিনিধিদল এরপর বনু গাতফানের কাছে গিয়ে তাদেরও কোরায়শদের মতোই যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করলো। তারাও প্রস্তুত হয়ে গেলো। এরপর ইহুদীদের এই প্রতিনিধিরা আরবের বিভিন্ন গোত্রের কাছে ঘুরে ঘুরে তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপাতে লাগলো এবং একটি যুদ্ধের জন্যে আহ্বান জানালো। এতে বহু লোক যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হলো। মোটকথা, ইহুদী রাজনীতিকরা সফলতার সাথে কাফেরদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধলো এবং বহু লোককে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর দাওয়াত এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করলো।
এরপর পরিকল্পিক কর্মসূচী অনুযায়ী দক্ষিণ দিক থেকে কোরায়শ, কেনানা এবং তোহামায় বসবাসকারী অন্যান্য নিত্র গোত্র মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হলো। এদের অধিনায়ক ছিলো কাফের নেতা আবু সুফিয়ান। সম্মিলিত স্যৈসংখ্যা ছিলো ৪ হাজার। এরা মাররাজ জাহরাহন পৌঁছালে বনু সালিম গোত্রের লোকেরাও তাদের সাথে শামিল হলো। এদিকে এই সময়ে পূর্ব দিকে থেকে সাতফান গোত্র, ফাজরাহ, মাররা এবং আশজাআ রওয়ানা হলো।
ফাজরাহ গোত্রের সেনানায়ক ছিলো উয়াইনা ইবনে হাসান। বনু মাররা গোত্রের সেনাপতি ছিলো হারেস ইবনে আওফ-এবং বনু আশজা- এর সেনাপতি ছিলো মাছারাহ ইবনে রাখিল এদের বনু আছাদ এবং অন্যান্য গোত্রের বহু লোকও জোটবদ্ধ হলো।
নির্দিষ্ট দিনে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচী মোতাবে এসকল লোক মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হলো। অল্পদিনের মধ্যেই মদীনার পাশে ১০ হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী সমবেত হলো। এর সৈন্য সংখ্যা হিসাব করলে এতো বড় ছিলো যে, মদীনার নারী শিশুসহ মোট সনসংখ্যাও তাদের সমান ছিলো না। এ বিরাট সেনাদল যদি হঠাৎ করে মদীনায় গিয়ে চড়াও হতো, তবে মুসলমানদের জন্যে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। এটাও বিচিত্র ছিলো না যে, মুসলমানদের তারা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিতো। কিন্তু মদীনায় মুসলমানদের নেতা ছিলেন অতন্ত জাগ্রত ও বিবেক সচেতন। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুযায়ী তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। বিভিন্ন গোত্রের সৈন্যরা মদীনা অভমুখে রওয়ানা হয়েছে এখবর যথাসময়ে ইসলামী রাষ্ট্রে তথ্য সরবরাহে নিযুক্ত গুপ্তচররা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবহিত করলেন।
এ খবর পাওয়ার সাথে সাথে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশিষ্ট সাহাবাদের সঙ্গে নিয়ে মজলিসে শূরার বৈঠকে বসে মদীনর প্রতিরক্ষার কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করতে লাগলেন। আলোচনা পর্যালোচনার পর হযরত সালমান ফারসী (রা)-এর একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করা হয়। হযরত সালমান (রা) তাঁর প্রস্তাব এভাবে পেশ করেছিলেন, হে আল্লাহর রসূল, পারস্যে আমাদের ঘেরাও করা হলে আমরা চারিদিকে পরিখা খনন করতাম।
এটা ছিলো সুচিন্তিত প্রতিরক্ষা প্রস্তাব। আরবের জনগণ এ ধরনের কৌশল সম্পর্কে অবহিত ছিলো না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ প্রস্তাব অনুমোদন করে অবিলম্বে খনন কাজ শুরু করলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই এ কাজ দেখা শোনা করতেন। তিনি নিজেও পরিখা খননে অংশগ্রহণ করেন। সহীহ বোখারী শরীফে হযরত ছহল ইবনে সা’দ (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে খন্দকে ছিলাম, লোকেরা খনন করছিলেন এবং আমরা কাঁধে মাটি বহন করে দূরে ফেলে আসছিলাম। এই সময়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, আখেরাতের জীবনই তো প্রকৃত জীবন। ওগো করুণাময়, আনসার আর মোহাজেরদের ক্ষমা করে দাও।[সহীহ বোখারী, পরিখা যুদ্ধ অধ্যায়, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৮৮]
অপর এক বর্ণনায় হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খন্দকের দিকে গমন করে দেখতে পেলেন যে, এক শীতের সকালে মোহাজের ও আনসাররা পরিখা খননের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের কাছে কোন ক্রীতদাস ছিলো না, যারা তাদের পরিবর্তে একাজ করে দিতো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের কষ্ট এবং ক্ষুধার্ত অবস্থা দেখে বললেন,
‘হে আল্লাহ, জীবন তো আখেরাতের জীবন সে নিশ্চয়
মোহাজের ও আনসারদের করো ক্ষমা ওগো দয়ামায়।’
আনসার এবং মোহাজেররা এর জবাবে বলেন,
যতোদিন আমাদের থাকবে হায়াত
মোহাম্মরেদ হাতে জেহাদের জন্যে করলাম বাইয়াত।’[বোখারী, ১ম খন্ড ৩৯৭, ২য় খন্ড, ৫৮৮।]
সহীহ বোখারী শরীফে হযরত বারা ইবনে আযেব (রা) থেকে বর্ণনা রয়েছে যে, আল্লাহর রসূলকে আমি দেখেছি, তিনি খন্দকের যুদ্ধে মাটি খনন করছেন। ধুলোবালিতে তাঁর দেহ আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলো। তাঁর চুল ছিলো অনেক। সেই অবস্থাতেই, তিনি মাটি খনন করছেন আর বলছেন,
‘তুমি বিনে হেদায়াত পেতাম না হে রাজাধিরাজ
দিতাম না যাকাত আর পড়তাম না নামায।
শান্তি দাও যেন আমাদে শক্ত থাকে মন লড়াই হলে অটল রেখো আমদের চরণ।
আমদের বিরুদ্ধে ওরা দিলো লোকদের উস্কানি
ফেতনাতে শির হবে না নত সেতো আমরা জানি।’
হযরত বারা’ বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষের কথাগুলো দৃড়তার সাথে উচ্চারণ করতেন। অন্যৗ এক বর্ণনায় কবিতার শেষ দুই লাইন এভাবে লেখা রয়েছে,
ওরা যদি যুলুম করে ফেতানায় ফেলতে চায়
আমরা হবো তারা, যারা মাথা না নোয়অয়।[ বোখারী ২য় খন্ড, পৃ. ৫৮৯]
মুসলমানরা একদিকে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে কাজ করছিলেন, অন্যদিকে প্রচন্ড ক্ষুধা সহ্য করছিলেন। সে কথা চিন্তা করলে বুক ধ্বক করে ওঠে। হযরত আনাস (রা) বলেন, পরিখা খননকারীদের কাছে কিছু যব নিয়ে আসা হতো এবং গরম করা কিছু চিকনাই নিয়ে আসা হতো। নীরস ও বিস্বাদ এ খাবারই তারা খেতেন।[ বোখারী ২য় খন্ড, পৃ. ৫৮৮]
আবু তালহা (রা) বলেন, আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ক্ষুধার কথা বললাম এবং পেটের কাপড় খুওল একটি পাথর দেখালাম, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পেটে দুটি পাথর আমাদের দেখালেন।[ জানে তিরমিযি, মেশকাত, ২য় খন্ড, পৃ. ৪৪৮]
পরিখা খননকালে নবুয়তের কয়েকটি নিদর্শনও প্রকাশ পেয়েছিলো। সহীহ বোখারীতে উল্লেখ রয়েছে যে, হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ক্ষুধায় কারত দেখে একটি বকররির বাচ্চা যাবাই করেন। তাঁর স্ত্রী এক সাআ (প্রায় আড়াই কেজি) যবের রুটি তৈরী করেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গোপনভাবে বলেন যে, আপনার কয়েকজন ঘনিষ্ট সাহাবাকে নিয়ে আমরা বাসায় একটু আসুন। কিন্তু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খনন কাজে নিয়োজিত সলল সাহাবাকে সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা হন। সাহাবাদের সংখ্যা ছিলো এক হাজার। অতপর সকল সাহাবা পেটভরে রুটি গোশত খেলেন উনুনের উপর গোশতের হাড়ি তখনো টগবগ করে ফুটছিলো। রুটি যতো তৈরী করা হচ্ছিলো, তার সবই পরিবেশন করা হচ্ছিলো, কিন্তু শেষ হচ্ছিলো না। একের পর এক রুটি তৈরী করা হচ্ছিলো।[ সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৮৮, ৪৮৯৮]
হযরত নোমান ইবনে বশীরের বোন খন্দরেক কাছে কিছু খেজুর নিয়ে এলেন। তিনি এনছিলেন এ জন্যে যে, তার ভাই এবং মামা খাবেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি খেজুরগুলো চেয়ে নিয়ে একটি পাপড় বিছিয়ে তার ওপর ছড়িয়ে দিলেন। এরপর খনন কাজে নিয়োজিত সাহাবাদের খেতে ডাকলেন। সাহাবারা ক্ষেতে শুরু করলেন। তারা যতো খাচ্ছিলেন খেজুর ততোই বাড়ছিলো। সবাই পেট ভরে খেয়ে কাজে চলে গেলেন, খেজুর তখানো বিছানো কাপড়ের বাইরে পড়ে যাচ্ছিলো।[ ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ২১৮]
উল্লিখিত দুইটি ঘটনার চেয়ে বিস্ময়কর একটি ঘটনা সেই সময় ঘটেছিলো। ইমাম বোখারী হযরত জাবের (রা) থেকে সেই ঘটনা বর্ণনা করেন। হযরত জাবের (রা) বলেন, আমরা পরিখা খনন করছিলামম হঠাৎ একটি বড় পাথর পড়লো। কিন্তু কিছুতেই সেটি আমরা নড়াতে পারছিলাম না। আমরা তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে একথা জানালাম। তিনি বললেন, আমি আসছি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেটে তখন পাথর বাঁধা। তিনি কোদাল দিয়ে পরিখার ভেতর সেই পাথরের ওপর আঘাত করলেন। সাথে সাথে সেই পাথর থুলোবালির স্তুপে পরিণত হলো।[ সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৮৮]
জযরত বারা ইবনে আযেব (রা) বলেন, পরিখা খননের সময় একটি বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালা। কোদাল দিয়ে আধাত করলো কোদাল ফিরে আসছিলো। এ ব্যাপারটি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমরা জানালাম। তিনি কোদাল হাতে নিয়ে এবং বিসমিল্লাহ বলে আঘাত করলেন। পাথরের একাংশ ভেঙ্গে গেলো। তিনি বললেন, ‘আল্লাহু আকবর, আমাকে শাম দেশ অর্থাৎ সিরিয়ার চাবি দেয়া হয়েছে। আল্লাহর শপথ, আমি এখন সেখানে লাল মহল দেখতে পাচ্ছি। এরপর দ্বিতীয় আঘাত করলেন। আরো একটি টুকরো বের হলো। তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ, আমি এখন মাদায়েনের শ্বেত মহল দেখতে পাচ্ছি। এরপার তৃতীয় আঘাত করে বললেন, বিসমিল্লাহ। এতে পাথরের বাকি অংশ কেটে গেলো। তিনি বললেন, আল্লাহু আকবর, আমাকে ইয়েমেনের চাবি দেয়া হয়েছে। আমি এখন সানআর ফটক দেখতে পাচ্ছি।[ সুনানে নাসাঈ, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৬]
ইবনে ইসহাক একই ধরনের বর্ণনা হযরত সালমান ফারসী (রা) থেকেও উল্লেখ করেছেন।
মদীনা শহর উত্তর দিকে খোলা, অন্য তিনদিকে পাহাড় পর্বত এবং খেজুর বাগানে ঘেরা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন বিচক্ষণ সমর বিশারদ ছিলেন। তিনি জানতেন যে, মদীনায় অমুসলিমরা হামলা করতে উত্তর দিক থেকেই আসবে। তাই তিনি শুধু উত্তরই পরিখা খনন করেন।[ ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ২১৯]
মুসলমানরা পরিখা খননের কাজ সমভাবে চালিয়ে যান। সারা দিন তারা খনন কাজ করনে, সন্ধায় ঘরে ফিরে যেতেন। কাফের বাহিনীর মদীনার উপকণ্ঠে আসার আগেই পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিখা খননের কাজ শেষ হয়ে যায়।[ ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ২২০. ২২১]
কোরায়শরা তাদের চার হাজার সৈন্যসহ এসে মদীনর রওমা, জারফ এবং জাগাবর মাঝামাঝি মাজমাউল আসয়াল তাঁবু স্থাপন করলো। অন্যদিকে গাতফান এবং তাদের নজদের মিত্ররা ৬ হাজার সৈন্যসহ এসে ওহুদের পূর্বদিকে জাম্ব নকমি এলাকায় তাঁবু স্থাপন করলো।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, মোমেনরা যখন সম্মিলিত বাহিনীকে দেখলো, তখন বলে উঠলো ‘এটা তো তাই, যা আল্লাহ ও তাঁর রসূল যার প্রতিশ্রুতি আমাদেরকে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল সত্যই বলেনছিলেন। আর এতে তাঁদের ঈমান আনুগত্য বৃদ্ধি পেলো।’ (সূরা আল আহযাব, আয়অত ২২)
কিন্তু মোনাফেক ও দুর্বলচিত্তের লোকদের দৃষ্টি ওদের ওপর পতিত হলে তারা ভয়ে কেঁপে উঠলো। আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন, ‘এবং মোনাফেকরা ও যাদের অন্তরে ছিলো, ব্যাধি, তারা বলছিলো, আল্লাহ এবং তাঁর রসূল আমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা প্রতারণ ব্যতীত কিছুই নয়।’ (সূরা আহযাব, আয়াত ১২)
অমুসলিমদের সম্মিলিত বাহিনীর সাথে মোকাবেলার জন্যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১০ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী প্রস্তুত করেন। তাঁরা সালাআ পাহাড়ের দিকে পিঠ রেখে দুর্গ অবরোধের রূপ গ্রহণ করেন। সামনে ছিলো খন্দ বা পরিখা। মুসলমানদের সাংকেতিক ভাষা ছিলো, হা-মীম, লা ইনছারুন। অর্থাৎ ওদের সাহায্য যেন না করা হয়। মদীনার দায়িত্ব আবদুল্লা ইবনে মাকতুমের ওপর ন্যস্ত করা হয়। নারী ও শিশুদের বিভিন্ন দুর্গ এবং সংরক্ষিত বাড়ীতে রাখা হয়।
বিধর্মীরা মদীনায় হামলা করে এসে দেখতে পেলো যে, এক সুগভীর প্রশস্ত পরিখা তাদের এবং মদীনর মধ্যে অন্তরায় হয়ে রয়েছে। ফলে তারা অবরোধ করে পড়ে থাকলো। তারা মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হওয়ার সময়ে এ ধরনের বাধার সম্মুখীন হওয়ার কথা ভাবেনি, এরূপ কোন মানসিক প্রস্তুমিও ছিলো না। তারা বলাবলি করছিলো যে, এ ধরনের প্রতিরক্ষা কৌশল তো আরবদের জন্যে সম্পূর্ণ নতুন। অভিনব এ প্রতিরক্ষা কৌশলের কথা যেহেতু চিন্তা করেনি, এ কারণে কাফেররা হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো।
পরিখার কাছে পৌছে বিধর্মীরা ক্রোধে দিশেহারা হয়ে পড়লো। তারা ভেবেছিলো যে, মুসলমানদের সহজেই কুপোকাত করে ফেলবে। এদিকে মুসলমানরা কাফেরদের গতিবিধির ওপর নযর রাখে এবং তাদেরকে পরিখার ধারে কাছে আসতে দিচ্ছিলো না। কাছে এলে তীর নিক্ষেপ করছিলো। ফলে বিধর্মীরা দারুণ বেকায়দায় পড়লো। তারা পরিখার কাছে আসার সাহস পাচ্ছিলো না, মাটি ফেলে পরিখা ভরাট করাও ছিলো অচিন্তনীয়।
কোরায়শ সৈন্যরা খন্দকের কাছে অবরোধ আরোপ করে বিনা লাভে অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করবে, তা কি করে হয়? এটা তাদের অভ্যাস ও মর্যাদার পরিপন্থী। তাদের মধ্যে কয়েকজনের একটি গ্রুপ একটি সংকীর্ণ জায়গা দিয়ে খন্দক বা পরিখা অতিক্রম করে। এরপর তাদের কেউ ঘোড়ায় চড়ে পরিখা ও সালায়ার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। এরা হচ্ছে আমর ইবনে আবদে ইকরামা ইবনে আবু জেহেল, যাররান ইবনে খাত্তাব প্রমুখ। হযরত আলী (রা) কয়েকজন মুসলমান সঙ্গে নিয়ে বেরোলেন। যে জায়গা দিয়ে তারা প্রবেশ করেছিলো সেই জায়গা নিয়ন্ত্রণে এনে তাদের প্রত্যাবর্তনের পথ বন্ধ করে দিলেন। এর ফলে আমর ইবনে আবদেউদ্দ মুখোমুখি তর্কযুদ্ধের জন্যে হযরত আলী (রা)-কে হুঙ্কার দিয়ে আহ্বান জানালো। শেরে খোদা হযরত আলী (রা) এমন এক কথা বললেন, যে, আমর ক্রোধান্ধ হয়ে ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামলো। পরে ঘোড়াকে হত্যা করে হযরত আলী (রা)-এর মুখোমুখি হাযির হলো। সে ছিলো বড় বীর। উভয়ের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ বেধে গেলো। একজন অন্যজনকে কাবু করতে হামলা চালাচ্ছিলো। পরিশেষে হযরত আলী (রা) তাকে শেষ করে দিলেন। অন্য মোশরেকরা পরিখার অপর প্রান্তে ছুটে পালালো। তারা ভীষণ ভয় পেয়েছিলো। আবু জেহেলের পুত্র ইকরামা নিজের বর্শা ফেলে রেখেই পালালো।
মোশরেকরা পরিখা অতিক্রমন অথবা পরিকা ভরাট করে রাস্তা তৈরীর সব রকম চেষ্টা করলো। কিন্তু মুসলমানরা তাদেরকে পরিখার কাছে আসতে দিচ্ছিলেন না। তাদের প্রতি তীল নিক্ষেপ অথবা বর্শা তাক করে এমনভাবে প্রতিহত করলেন যে, তাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো।
এ ধরনের প্রচন্ড মোকাবেলার কারণে সাহাবায়ে কেরামের কয়েক ওয়াক্ত নামায কাযা হয়ে গিয়েছিলো। বোখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত যাবের (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত ওমর (রা) খন্দকের দিনে এলেন এবং কাফেরদের কঠোর ভাষায় সমালোচনা করে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রসূল আজ আমি সূর্য ডুবু অবস্থায় নামায আদায় করেছি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আর আমি তো এখনো নামায আদায়ই করিনি। সাহাবারা এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লারেম ওযু করার পর ওযু করলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আছরের নামায আদায় করলেন। ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে। এরপর মাগরেবের নামায আদায় করলেন।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আছরের নামায কাযা পড়তে বাধ্য হওয়ায় মনে খুব কষ্ট পেলেন। তিনি পৌত্তলিকদের জন্যে বদদোয়া করলেন। সহীহ বোখারী শরীফে হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খন্দকের দিনে বললেন, হে আল্লাহ তায়ালা, সকল মোশরেকসহ তাদের ঘর এবং কবরকে আগুনে ভরে দিন। ওদের কারণে আমাদের আছরের নামায করতে হয়েছে, ইতিমধ্যে সূর্য ডুবে গেছে।[ সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৯০]
মোসনাদে আহমদ এবং মোসনাদে শাফেয়ীতে বর্ণিত রয়েছে যে, মোশরেকরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যোহর, আছর, মাগরেব এবং এশার নামায যথা সময়ে আদায় করতে দেয়নি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসব নামায একত্রে আদায় করেছিলেন। ইমাম নববী বলেন, উল্লিখিত হাদীসসমূহের বর্ণনার বৈপরীত্য সম্পর্কে বলা যায় যে, সবগুলো হাদীছের বক্তব্য যথার্থ। খন্দকের যুদ্ধ কয়েকদিন যাবত চলেছিলো, একদিন হয়েছে এক অবস্থা অন্য দিন অন্য অবস্থা।
এসব হাদীস থেকেই বোঝা যায় যে, মোশরেকরা পরিখা অতিক্রম করে মদীনায় হামলা করতে কয়েকদিন যাবত প্রাণপণ চেষ্ট করছিলো এবং মুসলমানরা সে চেষ্টা প্রতিহত করছিলেন। উভয় দলের মাঝখানে পরিখা অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। এ কারণে মুখোমুখি রক্তাক্ত সংঘর্ষের সুযোগ হয়নি। বরং পরস্পরের প্রতি তীর নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
তীর নিক্ষেপে উভয় পক্ষে কয়েকজন নিহত হয়েছে। তবে তাদের সংখ্যা ছিলো দশ। নিহত পৌত্তলিকদের মধ্যে দুই জন কি একজন তলোয়ারের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছে।
হযরত সা’দ ইবনে মায়ায (রা)-এর গায়ে একটি তীর বিদ্ধ হয়েছিলো। এতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। তাকে হাব্বান ইবনে আরকা নামে একজন পৌত্তলিক তীর নিক্ষেপ করেছিলো। এই লোকটি ছিলো কোরায়শ বংশোদ্ভূত। আহত হওয়ার পর হযরত সা’দ (রা) দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ তায়ালা তুমি তো জানো, যে কওমের লোকেরা তোমার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবিশ্বাস করেছে, তাদের বাড়ীঘর থেকে বের করে দিয়েছে, তাদের সাথে তোমার রাস্তায় জেহাদ করা আমার এতো প্রিয় যে, অন্য কোন কওমের সাথে জেহাদ করা এতো প্রিয় নয়। হে আল্লাহ তায়ালা, আমি মনে করি যে, তুমি আমদের ও ওদের মধ্যেকর যুদ্ধকে শেষ পর্যায়ে পৌছে দিয়েছো। হে আল্লাহ তায়ালা কোরায়শদের সাথে যুদ্ধ যদি বাকি থাকে, তবে সেই যুদ্ধের জন্যে আমাকে বাকি রাখো, যেন, আমি তাদের সাথে জেহাদ করতে পারি। যদি তুমি কাফেরদের সাথে আমার যুদ্ধ শেষ করে দিয়ে থাকো, তবে আমার এই আহত হওয়ার আঘাতের ঘা যেন না শুকায় এবং এই আঘাতকেই আমার মুত্যুর কারণ করো। [ সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৯১ ]দোয়ার শেষে তিন বলেন, ‘হে আল্লাহ তায়ালা, বনু কোরায়যার ব্যাপারে আমার চক্ষু শীতল না হওয়া পর্যন্ত যেন আমার মৃত্যু না হয়।’] ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ২২৭]
মোটকতা মুসলমানরা একদিকে যুদ্ধক্ষেত্রের সমস্যার সম্মুখীন ছিলো, অন্যদিকে ষড়যন্ত্র ও কুচেক্রের ঘৃণ্য তৎপরতা অব্যহত ছিলো। ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকারীরা মুসলমানদের দেহে বিষ ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিলো। বনু নাযির গোত্রের দুর্বৃত্তনেতা হুয়াই ইবনে আখতার বনু কোরায়যা গোত্রের লোকদের কাছে এসে তাদের সর্দার কা‘ব ইবনে আছাদের কাছে হাযির হলো। এই কা‘ব ইবনে আছাদই ছিলো বনু কো’রায়জার পক্ষ থেকে অঙ্গীকার সম্পাদনের মধ্যস্থতাকারী। এই লোকটি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে এ মর্মে চুক্তি করেছিলো যে, যুদ্ধের সময় তাঁকে সাহায্য করবে। ইতিপূর্বে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
হুয়াই এসে কা‘ব-এর দরজায় আওয়ায দিলো। হুয়াইকে দেখামাত্র কা‘ব দরজা খুলে দিলো। দরজা খোলার পর হুয়াই বললো, হে কা’ব আমি তোমার জন্যে যামানার সম্মান এবং উদ্বেলিত সমুত্র নিয়ে এসেছি। আমি সব কোরায়শ সর্দারসহ সব কোরয়শকে রুমার মাজউল আসয়ালে এনে সমবেত করেছি। বনু গাতফান গোত্রের লোকদেরকে তাদের সব সর্দারসহ ওহুদের নিকটবর্তী জামবে নকমিতে একত্রিত করেছি। তারা আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে যে, মোহাম্মদ ইবং তাঁর সঙ্গীদের পুরোপুরি নির্মুল না করে তারা সেই স্থান ত্যাগ করবে না।
কা’ব বললো, খোদার কসম, তুমি আমার যুগের অপমান এবং বৃষ্টিবর্ষণকারী মেঘ নিয়ে হাযির হয়েছ। সেই মেঘ থেকে শুধু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, গর্জন বেরোচ্ছে। কিন্তু ওতে ভালো কিছু অবশিষ্ট নেই। হুয়াই, তোমার জন্যে আফসোস, আমাকে আমার অবস্থার ওপর ছেড়ে দাও। আমি মোহাম্মদের মধ্যে সত্য এবং আনুগত্য ব্যতীত অন্য কিছু দেখিনি। কিন্তু হুয়াই কা’ব এর গায়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো, ছদ্ম আবেগে বুকে জড়িয়ে ধরে তার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রকাশ করতে লাগলো। এমনি করে এক সময় সে কা’বকেরিাজি করিয়েই ফেললো। তবে তাকে এ অঙ্গীকার করতে হলো যে, কোরায়শ যদি মোহাম্মদকে খতম না করেই ফিরে আসতে বাধ্য হয়, তবে আমিও তোমার সাথে তোমার দুর্গে প্রবেশ করবো। এরপর তোমার যে পরিণাম হবে আমি সেই পরিণাম মেনে নেব। হুয়াই এরএর প্র পৃতিশ্রুতির পর কা’ব ইবনে আছাদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ এবং মুসলমানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি লংঘন করে তাদের বিরুদ্ধে পৌত্তলিকদের পক্ষ থেকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করলো।[ ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ২২০, ২২১]
এরপর বনু কোরায়যার ইহুদীরা মুসলমানদের বিরদ্ধে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি নিতে লাগলো। ইবনে ইসহাক বলেছেন, হযরত সাফিয়্যা বিনতে আবদুল মোত্তালেব, হযরত হাস্সান ইবনে সাবেতের ফারে নামক দুর্গের ভেতর ছিলেন। হযরত হাস্সান মহিলা ও শিশুদের সঙ্গে সেখানেই ছিলেন। হযরত সাফিয়্যা (লা) বলেন, আমাদের কাছে দিয়ে একজন ইহুদী গেলো এবং দুর্গের চারিদিক ঘরতে লাগলো। এটা সেই সময়ের কথা, যখন বনু কোরায়যা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সম্পাদিত চুক্তি লংন করে তাঁর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলো।সেই সময় আমাদের এবং চুক্তি ভঙ্গকারী ইহুদীদের মধ্যে এমন কেউ ছিলো না যারা আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিত শত্রু বাহিনীর মোকাবেলায় ব্যস্ত রয়েছেন। আমাদের ওপর কেউ হামলা করলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের কাছে আসতে পারতেন না। এমন সময় আমি হাস্সানেনর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললা, হে হাস্সান, একজন ইহুদী দুর্গের চারিদিকে ঘুরঘুর করছে আমার সন্দেহ হচ্ছে যে, সে অন্য ইহুদীদের আমাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপাবে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবার অন্য কাজে এতা ব্যস্ত যে, এখানে আমাদের কাছে আসতে পারবেন না। কাজেই আপনি যান এবং তাকে হত্যা করুন। হযরত হাস্সান (রা) বললেন, আপনি তো জানেন যে, আমি ওরকম কাজের মানুষ নই। হযরত সাফিয়্যা (রা) এরপর ঘটনার বর্ণা দিয়ে বলেন, আমি কোমরে কাপড় বাঁধলাম। একটা কাঠ নিয়ে দুর্গের বাইরে ইহুদীর কাছে গিয়ে নির্মমভাবে প্রহার করে তাকে মেরে ফেললাম। এরপর দুর্গে ফিরে এস হাস্সানকে বললাম, যান সে লোকটির অস্ত্রশস্ত্র এবং অন্যান্য জিনিস খুলে নিন। লোকটি পুরুষ, এ কারণে আমি তার অস্ত্র খুলে নিইনি। হযরত হাস্সান (রা) বললেন, ওর অস্ত্র এবং জিনিসপত্রে আমর কোন প্রয়োজন নেই।১৮
মুসলমান নারী ও শিশুদের নিরাপত্তায় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফুফুর এই বীরত্বপূর্ণ কারেজ দারুণ প্রভাব পড়লো। ইহুদীরা মনে করলো যে, দুর্গের ভেতর মুসলমানদের সহায়ক সেনা ইউনিক রয়েছে। ইহুদীরা এ কারণে সেই দুর্গের কাছে অন্য কউকে পাঠাতে সাহসী হয়নি। অথচ সেখানে কোন সৈন্যই ছিলো না।
তবে মূর্তিপূজক কোরায়শ সৈন্যদের সাথে নিজেদের একাত্মতা প্রকাশের প্রমাণ দেয়ার জন্যে তারা তাদেরকে নিয়মিতভাবে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করছিলো। এক পর্যায়ে মুসলমানরা সেই রসদের মধ্য থেকে ২০টি উট কেড়ে নেয়।
মোটকথা ইহুদীদের অঙ্গীকার ভঙ্গের খবর পাওয়ার সাথে সাথে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে ব্যাপারে মনোযোগী হলেন। তিনি প্রথমে ব্যাপারটির সত্যতা যাচাই করতে চাইলেন, যাতে বনু কোরায়যার প্রকৃত ভূমিকা স্পষ্ট হয়। সম্পাদিত চুক্তি শর্ত লংঘনের প্রমাণ পাওয়া গেলে সেই আলোকে প্রয়োজনীয় সামররিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ জন্যে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কয়েকজন সাহাবাকে প্রেরণ করলেন। তারা হচ্ছেন হযরত সা‘দ ইবনে মায়া’য (রা), হযরত সা’দ ইবনে ওবাদা (রা) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা) এবং হযরত খাওয়াত ইবনে যোবায়ের (রা)। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা যাও, বনু কোরায়যা সম্পর্কে যেসব কথা শোনা যাচ্ছে, দেখে এসে আমাকে সে সব কথা ইশারায় জানাবে। আর যদি গুজব হয়ে থাকে, তবে ওদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির ওপর ওদের অবিচল থাকার কথা প্রকাশ্যে সবাইকে জানিয়ে দেবে।
সাহাবারা বনু কোরায়যা গোত্রের লোকদের কাছে গিয়ে লক্ষ্য করলেন যে, তারা আল্লাহর রসূল এবং মুসলমনদের সম্পর্কে অসম্মানজনক উক্তি করছে। তারা বলছে, আল্লাহর রসূল আবার কে? আমাদের এবং মোহাম্মদের মধ্যে কোন চুক্তি নেই। একথা শুনে সাহাবারা ফিরে এলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে ইশারায় শুধু বললেন, আদল এবং কারাহ। অর্থাৎ আদল এবং কারাহ গোত্রের লোকেরা মুসলিম প্রতিনিধিদলের সাথে যে রকম বিশ্বাসঘাতকা করেছিলো, বনু কোরায়যাও সেই ধরনের বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত রয়েছে।
১৮. ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ২২৮
ইশারায় বোঝাতে চাইলেও অন্য সাহাবারা বুঝে ফেললেন। ফলে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্মুখীন হলেন সকলেই।
প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের সামনে তখন জটিল অবস্থা। পেছনে রয়েছে বনু কোরায়যা গোত্র। তারা হামলা করলে সেই হামলা ঠেকানোর মতো কেউ নেই। সামনে রয়েছে কাফেরদের সম্মিলিত সেনাদল। ওদের প্রতি অমনোযোগী হওয়ারও উপায় নেই। মুসলমান নারী ও শিশুদের নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থা ছিলো না, তারা বিশ্বাসঘাতক ইহুদীদের নাগালের মধ্যে অবস্থান করছিলেন। এসব কারণে মুসলমানদের মানসিক অবস্তা খুবই নাযুক হয়ে পড়েছিলো। সে অবস্থার কথাই আল্লাহ তায়ালা এভাবে ব্যক্ত করেছেন, ‘যখন তোমাদের বিরুদ্ধে সমাগত হয়েছিলো উচ্চ অঞ্চল ও নিম্ন অঞ্চল থেকে, তোমাদের চক্ষু বিকশিত হয়েছিলো, তোমাদের প্রাণ হয়েছিলো কণ্ঠগত এবং তোমরা আল্লাহ তায়ালা সম্বন্ধে নানাবিধ ধারণা পোষণ করছিলে। তখন মোমেনরা পরীক্ষিত এবং তারা ভীষণভাপে প্রকম্পিত হয়েছিলো।’ (সূরা আহযাব, আয়াত ১০, ১১)
সেই সমেয়ে কিছুসংখ্যক মোনাফেকও সক্রিয় হয়ে উঠেছিলো। তারা বলাবলি করতেছিলো যে, মোহাম্মদ আমাদের সাথে ওয়াদা করেছিলেন, আমরা কায়সার কিসরার ধনভান্ডার ভোগ করবো অথচ এখানে এমন অবস্থা হয়েছে, পেশাব পায়খানার জন্যে বেরোলেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেরোতে হয়। কোন কোন মোনাফেক তাদের দলের নেতাদের কাছে গিয়ে বলছিলো যে, আমাদের ঘর শত্রুদের সামনে খোলা পড়ে আছে। নিজের ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্যে আমাদের অনুমতি প্রদান করুন। আমাদের ঘর তো শহরের বাইরে।
পরিস্থিতি এমন হয়েছিলো যে, বনু সালমা গোত্রের লোকদের মন টলটলায়মান হয়ে উঠলো। তারাপ পশ্চাদপসারণের কথা ভাবছিলো। এদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এবং মোনাফেকরা, যাদের অন্তরে ছিলো ব্যাধি, তারা বলছিলো, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল আমাদের যে প্রতিশ্রুতিহ দিয়েছিলেন, তা প্রতারণা ব্যতীত কিছুই নয় এবং ওদের এক দল বলেছিলো, হে ইয়াসরেববাসী, এখানে তোমাদের কোন স্থান নেই, তোমরা ফিরে চলো এবং ওদের মধ্যে এক দল নবীর কাছে অব্যাহতি প্রার্থনা করে বলছিরো, আমাদের বাড়ীঘর অরক্ষিত। আসলে এগুলো অরক্ষিত ছিলো না। প্রকৃতপক্ষে পলায়ন করাই ছিলো তাদের উদ্দেশ্য।’ (সূরা আহযাব আয়াত ১২, ১৩)
একদিকে এমনি অবস্থা অন্যদিকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলেন। তাঁকে এভাবে দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থাকতে দেখে সাহাবাদের মানসিক অস্থিরতা আরো বেড়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তরে নতুন চেতনা সঞ্চারিত হলো। তিনি আল্লাহু আকবর বলে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, হে মুসলমানরা, তোমরা আল্লাহর সাহায্য এবং বিজয়ের সুখবর শুনে নাও।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবেলার কর্মসূচী গ্রহণ করলেন। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একদল মুসলমানকে প্রেরণ করলেন। তিনি আশঙ্কা করছিলেন যে, মুসলমানদের অমনোযেগী দেখে ইহুদীরা মুসলিম নারী শিশুদের ওপর হঠাৎ করে হামলা না করে। কিন্তু এক্ষেত্রে একটি সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী ছিলো, যার মাধ্যমে শত্রুদের বিভিন্ন গ্রুপকে পরস্পর থেকে যেন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া যায়। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চিন্তা করলেন যে, বনু গাতফানের উভয় সর্দার উয়াইনা ইবনে হাচন ও হারেস ইবনে আওফের সাথে একটি মীমাংসা করবেন।
সেই মীমাংসার মাধ্যমে মদীনার এক তৃতীয়াংশ উৎপাদিত ফসল বনু গাতফানকে দেয়া হবে। যদি এরূপ সুবিধা দেয়া যায়, তাহলে ইহুদীরা ফিরে যাবে। পরিণামে মুসলমানরা কোরায়শ শত্রুদের সাথে ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পারবে। এ ধরনের একটি প্রস্তাব সম্পর্কে আলোচনাও করা হলো। কিন্তু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সা’দ ইবনে মায়া’য এবং সা’দ ইবনে ওবাদা নামক দুইজন বিশিষ্ট সাহাবীর সাথে আলোচনা করলেন, তখন তারা ভিন্ন মত প্রকাশ করলেন। তারা বললেন, হে আল্লাহর রসূল, যদি এই আদেশ আল্লাহ তায়ালা আপনাকে দিয়ে থাকেন, তবে আমরা নির্বিবাদে মেনে নেবো। কিন্তু আপনি যদি শুধু আমাদের কারণে এরূপ করতে চান তবে বলছি, আমাদের তার প্রয়োজন নেই। আমরা এবং ওরা যখন মূর্তিপূজা করতাম, তখন তো ওরা আতিথেয়তা এবং বেচাকেনা ছাড়া একটা শস্যদানাও আমাদের কাছে আশা করতে পারেনি। বর্তমানে আল্লাহ তায়ালা আমাদের সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন, এমতাবস্থায় আমরা নিজেদেরে ধন-সম্পদ তাদের দেব? আল্লাহর শপথ, আমরা তো তাদের দেবো শুধু আমাদের তলোয়ার। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয় সাহাবীর অভিমত যথার্থ বলে মন্তব্য করে বললেন, আমি ভেবেছিলাম, অন্যকথা। সমগ্র আরব ঐক্যবদ্ধভাবে তোমারেদ বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। একথা ভেবে শুধু তোমাদের জন্যেই আমি একাজ করতে চেয়েছিলাম।
এরপর আল্লাহর ইচ্ছায় শত্রুদলের ভাঙ্গন দেখা দিলো। তাদের ঐক্যে ফাটল দেখা দিলো। তাদের ধার ভোঁতা হয়ে গেলো। বনু গাতফান গোত্রের নাঈম ইবন মাসুদ ইবনে আমের আশজাঈ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে চুপিসারে এসে বললেন, হে আল্লাহর রসূল, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি কিন্তু একথা কওমের লোকদের কাফে প্রকাশথ করিনি। আপনি আমাকে কোন আদেশ করুন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ওদের বিরুদ্ধে কোন সামরিক ব্যবস্থা তো নিতে পারবে না তবে যতোটা পারো ওদের মধ্যে ফাটল ধরাও এবং মনোবল নষ্ট করো। যুদ্ধ তো হচ্ছে চালবাজি।
একতা শোনার পর হযরত নঈম (রা) দেরী না করে বনু কোরায়যার কাছে গেলেন। এক সময় ওদরে সাথে তার বেশ ঘনিষ্টতা ছিলো। তাদের কাছে গিয়ে বললেন, আপনারা জানেন আপনাদের প্রতি আমার ভালোবাসা আছে এবং আপনাদের সাথে বিশেষ সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। তারা বললো, জী হাঁ। নঈম বললেন, তহবে শুনুন, কোরায়শদের ব্যাপারে আপনাদের মতামত আমার চেয়ে ভিন্ন। এ এলাকা আপনারেদ নিজস্ব এলাকা। আপনাদের বাড়ীঘর, ধন-সম্পদ, পরিবার-পরিজন সব এখানে রয়েছে। আপনারা এসব ছেড়ে যেতে পারবেন না। কোরায়শ এবং গাতফান গোত্রের লোকেরা যুদ্ধ করতে এসেছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে, আপনারা তাদের প্রতি সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করবেন। এটা আপনারা কি করলেন? কোরায়শ এবং গাতফান গোত্রের কি আছে এখানে? বাড়ীঘর ধন-সম্পদ এবং পরিবার পরিজন কিছুই নেই। যদি তারা সুযোগ পায় তবে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। অন্যথায় বিছানা বেঁধে বিদায় নেবে। এরপর থাকবেন। আপনারা আর মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সেই সময় মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যেভাবে ইচ্ছা, সেভাবেই আপনাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। একথা শুনে বনু কোরায়যা চমকে উঠলো। তারা বললো, নঈম বলুনতো এখন কি করা যায়? নঈম বললেন, কোরায়শদের বলুন তারা যেন কিছু লোককে জামিন হিসাবে আপনাদের কাছে দেয়। যদি না দেয় তবে কিছুতেই তাদের সাথে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করবেন না। কোরায়যা গোত্রের লোকেরা বললো, আপনি যথার্থ ও যুক্তিপূর্ণ কথাই বলেছেন।
এরপর হযরত নঈম (রা) সোজা কোরায়শ নেতাদের কাছে গেলেন। তাদের বললেন, আপনাদের প্রতি আমার ভালোবাসা এবং আপনাদের কল্যাণ কামনায় আমার আন্তরিকতা আপনাদের অজানা নয়। নঈমের কথা শুনে তারা বললো, জ্বী হাঁ। হযরত নঈম বললেন, তবে শুনুন, ইহুদীরা মোহাম্মদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করার কারণে লজ্জিত। বর্তমানে তাদের মধ্যে এ মর্মে লিখিত চুক্তি হয়েছে যে, ইহুদীরা আপনাদের কাছ থেকে কিছু লোককে জানিম হিসাবে গ্রহণ করে মোহাম্মদের হাতে তুলে দেবে। এরপর তারা মোহাম্মদের সাথে নিজেদের সম্পর্ক পুনরায় পুর্নবিন্যাস করে নেবে। কাজেই ইহুদীরা যদি আপনাদের কাছে জামিনস্বরূপ কয়েকজন লোক চায়, তবে কিছুতেই দেবেন না। হযরত নঈম (রা)-এরপর বনু গাতফান গোত্রের লোকদের কাছে গিয়েও একই রকতের কথা বলে কোরায়শদের প্রতি তাদেরকে সন্দিহান করে তুললেন। ফলে গাতফান দিনের মাঝামাঝি রাতে কোরায়শরা ইহুদীরেদ খবর পাঠালো যে, আমাদের অবস্থান তেমন ভালো নয়। ঘোড়া উট মারা যাচ্ছে। কাজেই আসুন একযোগে মোহাম্মদের ওপর হামলা করি। আপনারা ওদিক থেকে হামলা করুন আমরা এদিক থেকে করছি। ইহুদীরা জবাব পাঠালো যে, আজ শনিবার আপনারা জানেন। অতীতে যারা এইদিন সম্পর্কে শরীয়তের নির্দেশ লংঘন করেছিলো, তারা কি ধরনের শাস্তি পেয়েছিলো। তাছাড়া আপনারা যতক্ষণ পর্যন্ত আপনাদের কিছু লোক জামিন স্বরূপ আমাদের কাফে না দেবেন, ততক্ষণ আমরা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করবো না। দূত ইহুদীদের জবাব শুনে এসে বলার পর কোরায়শ এবং গাতফান বললো, আল্লাহর শপথ, নঈম সত্য কথাই বলেছিলো। এরপর তারা ইহুদীদের খবর পাঠালো যে, খোদার কসম, আমরা জামিন স্বরূপ কোন লোক পাঠাতে পারব না। আপনারা এখনই আপনাদের অবস্থান থেকে হামলা করুন। আমরা এদিক থেকে হামলা করছি। একথা শুনে কোরায়জা গোত্রের লোকেরা বললো, নঈম তো সত্য কথাই বলেছে। এভাবে উভয় দলের মধ্যে অবিশ্বাস দেখা দিলো। দলের সৈন্যদের মধ্যেও হতাশা দেখা দিলো, জোটভুক্ত সৈন্যদের মধ্যেও ফাটল দেখা দিলো।
সেই সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং মুসলমানরা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দোয়ার জন্যে হাত তুললেন। মুসলমানরা এ দোয়া করছিলেন, ‘হে আল্লাহ তায়ালা, আমাদের হেফাযত করো এবং আমাদে বিপদ থেকে মুক্ত করো।’
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দোয়া করছিলেন, হে আল্লাহ তায়ালা তুমি কেতাব নাযিল করেছো, তুমি শীঘ্র হিসাব নেবে। ওই সৈন্যদের পরাজিত করো, হে আল্লাহ তায়ালাপ, ওদের পরাজিত করো এবং তাদের প্রকম্পিত করো।[বোখারী, কিতাবুল জেহাদ, ১ম খন্ড, পৃ. ৪১১, কিতাবুল মাগাযি, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৯০]
আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং নিবেদিত প্রাণ মুসলমানরেদ দোয়া কবুল করলেন। পৌত্তিলিকদের জোটে ভাঙ্গন ধরা এবং তাদের মধ্যে হতাশা ও পারস্পরিক অবিশ্বাস সৃষ্টির পর আল্লাহ তাদের ওপর ঝড়ো বাতাস পাঠিয়ে দিলেন। সেই বাতাস তাদের তাঁবু উল্টে দিলো। জিনিসপত্র তছনছ করে দিলো। তাঁবুর খুঁটি উপড়ে গেলো। কোন জিনিসই যথাস্থানে থাকলো না। সেই সাথে একদল ফেরেশতা আল্লাহ তায়ালা পাঠিয়ে দিলেন। এর ফলে কাফেরদের অন্তর থর থর কেঁপে উঠলো, তাদের মনে মুসলমানদের প্রবল প্রভাব রেখাপাত করলো।
সেই শীত ও ঝড়ো হাওয়ার রাতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত হোযায়ফা ইবনে ইয়ামানকে কাফেরদের খবর নিয়ে আসতে প্রেরণ করলেন। তিনি গিয়ে দেখেন যে, মোশরেকরা পলায়নের প্রস্তুকি নিচ্ছে। হযরত হোযায়ফা (রা) এসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খবর জানালেন। সকাল বেলা দেখা গেলো যে, গোটা ময়দান খালি। কোন প্রকার লাভ ছাড়াই শত্রু সৈন্যদের ফিরে যেতে আল্লাহ তায়ালা বাধ্য করেছেন। এমনি করে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলমানদের সাথে করা তাঁর ওয়াদা পূর্ণ করলেন। তিনি তাঁর প্রিয় বান্দদের সম্মান দিয়েছেন, তাদের সাহায্য করেছেন এবং কাফের সৈন্যদের পরাজিত করেছেন। কাফেরদের ফিরে যাওয়ার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় ফিরে এলেন।
সঠিক বর্ণনা মোতাবেক খন্দকের যুদ্ধ পঞ্চম হিজরীর শওয়াল মাসে সংঘটিত হয়েছিলো। পৌত্তলিকরা এক মাস বা এক মাসের কাছাকাছি সময় মুসলমানদের অবরোধ করে রেখেছিলো। সব কিছু পর্যালোচনা করলেন দেখা যায় যে, অবরোধের শুরু শওয়াল, আর শেষ হয়েছিলো জিলকদ মাসে। ইবনে সা’দ বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেদিন খন্দক থেকে ফিরে এসেছিলেন, সেদিন ছিলো বুধবার। জিলকদ মাস শেষ হতে তখনো সাত দিন বাকি।
খন্দক বা পরিখার যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে পরাজয়ের যুদ্ধ ছিলো না, বরং মুসলমানরা এ যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন। এ যুদ্ধে কোন রক্তাক্ত সংঘর্ষ তেমন হয়নি। তবুও এটি ইসলামের ইতিহাসে একটি সিদ্ধান্তমূলক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে পৌত্তলিকদের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গিয়েছিলো। এবং এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো যে, আরবের কোন শক্তিই মদীনায় বিকাশমান শক্তিরেক নিশেষ করে দিতে পারবে না। খন্দকের যুদ্ধে মোশরেকরা যতো সৈন্য সমাবেশ করেছিলো এর চেয়ে বেশী সৈন্য সমাবেশ করা তাদের পক্ষে ভবিষ্যতে সম্ভব হবে না এবং তখনো সম্ভব ছিলো না। এ কারণেই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খন্দকের যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে বলেছিলেন, এবার আমরা ওদের ওপর হামলা করবো, ওরা আর আমাদের ওপর হামলা করতে পারবে না। এবার আমাদের সৈন্য তাদের দিকে যাবে। (সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৯০)
বনু কোরায়যার যুদ্ধ
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খন্দক থেকে ফিরে আসার পর যোহরের নামাযের সময় হযরত উম্মে সালমার গৃহে এক পর্যায়ে অবস্থান করছিলেন। সেই সময় হযরত জিবরাঈল (আ.) এসে বললেন, হে আল্লাহর রসূল, আপনি অস্ত্র রেখে দিয়েছেন, অথচ ফেরেশতারা এখনো অস্ত্র রাখেনি। কওমের অনুসরণ করে আমিও আপনার কাফে এসেছি। উঠুন, আপনার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বনু কোরায়যার কাছে চলুন। আমি আগে আগে যাচ্ছি। ওদের দুর্গে কাঁপন এবং মনে ভয় ও আতঙ্ক ধরিয়ে দেব। একথা বলে হযরত জিবরাঈল (আ.) ফেরেশতাদের সাথে রওয়ানা হয়ে গেলেন।
এদিকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন সাহাবীকে দিয়ে ঘোষণা করালেন যে, যারা শুনতে পাচ্ছে এবং আনুগত্য করার মন যাদের রয়েছে তারা যেন আছরের নামায বনু কোরায়যায় গিয়ে আদায় করে। পরে মদীনর দেখাশোনার দায়িত্ব হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাকতুম (রা)-এর ওপর ন্যস্ত করে হযরত আলী (রা)-এর হাতে পতাকা দিয়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনু কোরায়যার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। হযরত আলী (রা) বনু কোরায়যার দুর্গের কাছে পৌঁছার পর সেই গোত্রের ইহুদীরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালাগাল দিতে শুরু করলো।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছুক্ষণ পরই মোহাজের ও আনসার সাহাবাদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে হাযির হলেন। প্রথমে তিনি আনা নামক একটি জলাশয়ের কাছে থামলেন। মুসলমানরাও যুদ্ধের ঘোষণা শুনে বনু কোরায়যা গোত্র অভিমুখে রওয়ানা হলেন। পথে আছরের নামাযের সময় হলো। কেউ কেউ বললেন, আমাদেরকে বনু কোরায়যায় গিয়ে আছরের নামায আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আমরা সেখানে গিয়েই নামায আদায় করবো। এরা আছরের নামায এশার নামাযের পর আদায় করলেন। অন্য কয়েকজন সাহাবা পথে আছরের নামাযের সময় হওয়ায় সেখানেই নামায আদিায় করলেন। তাঁরা বললেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের তাড়াতাড়ি পৌছার উপর গুরুত্ব দেয়ার জন্যেই বনু কোরায়যায় গিয়ে আছরের নামায আদায় করতে বলেছেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে এই প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে তিনি উভয় দলের কাউকেই সমালোচনা করেননি।
মোটকথা বিভিন্ন দলে বিভক্ত সাহাবায়ে কেরাম বনু কোরায়যায় পৌঁছে এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লারেম সাথে মিলিত হলেন। এরপর তাঁরা বনু কোরায়যার দুর্গসমীহ অবরোধ করলেন। সাহাবাদের সংখ্যা ছিলো তিন হাজার। তাঁদের সঙ্গে ত্রিশটি ঘোড়া ছিলো। অবরোধ কঠোররূপ ধারণ করলে ইহুদীদের সর্দাম কা’ব ইবনে আছাদগ সকল ইহুদীর সামনে তিনটি প্রস্তাব পেশ করলো।
এক) ইসেলাম গ্রহণের মাধ্যমে দ্বীনে মোহাম্মদীতে প্রবেশ এবং এর মাধ্যমে নিজেদের জানমাল ও পরিবার পরিজন রক্ষা করা। আল্লাহর শপথ, তোমাদের কাছে এটাতো স্পষ্ট হয়েছে যে, মোহাম্মদ পৃকৃতই নবী ও রসূল এবং এই তিনি হলেন সেই বনী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যার কথা তোমাদের কেতাবে উল্লেখ রয়েছে।
দুই) নিজ পরিবার পরিজনকে আপন হাতে হত্যা করা এবং তলোয়ার নিয়ে সর্বশক্তিতে মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া। এরপর হয় জয় অথবা পরাজিত হতে হবে। এমনও হতে পারে যে, যুদ্ধে সবাইকে নিহতও হতে হবে।
তিন) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবাদের ধোঁকা দিয়ে শনিবার দিন তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া। কারণ তাঁরা নিশ্চিত থাকবেন যে, আজকের দিনে কোন লড়াই হবে না।
কিছু ইহুদীরা উল্লিখিত তিনটি প্রস্তাবের একটিও গ্রহণ করলো না। এতে বিরক্ত হয়ে কা’ব ইবনে আছাদ বললেন, মাতৃগর্ভ থেকে জন্মলাভের পর তোমাদের কেউ বুদ্ধি-বিবেচনার সাথে একটি রাতও কাটাওনি।
তিনটি প্রস্তবই প্রত্যাখান করার পর বনু কোরায়যার সামনে একটি মাত্র পথই খোলা থাকে, সেটি হচ্ছে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে অস্ত্র সমর্পণ এবং নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্ব তাঁর হাতে তুলে দেয়া। কিন্তু অস্ত্র সমর্পণের আগে ইহুদীরা তাদের কিছুসংখ্যক মুসলমান মিত্রের সাথে আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করলো। তারা ভাবছিলো যে, এই আলোচনার মাধ্যমে মুসলমানদের কাছ থেকে অস্ত্র সমর্পণের পরিণতি সম্পর্কে হয়তো আভাস পাওয়া যাবে। এরূপ চিন্তা করে ইহুদীরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রস্তাব পাঠালো যে, দয়া করে আবু লোবাবাকে আমাদের কাছে প্রেরণ করুন। আমরা তাঁর সাথে কিচু পরামর্শ করতে চাই। আবু লোবাবা ছিলেন ইহুদীদের মিত্র। তাঁর বাগান এবং পরিবার পরিজনও ছিলো ইহুদীদের এলাকায়। হযরত আবু লোবাবা (রা) সেখানে পৌঁছার পর ইহুদী নারী ও শিশুরা তাঁর কাছে ছুটে এলো এবং হাউ মাউ করে কঁদতে লাগলো। এ অবস্থা দেখে তাঁর দুই চোখও অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। ইহুদীরা তাঁকে বললো, আবু লোবাবা আপনি কি চান যে, আমরা মোহাম্মদের ফয়সালা সাপেক্ষে অস্ত্র সমর্পণ করি? তিনি বললেন, হাঁ চাই। পরক্ষণে নিজের গলার প্রতি ইশারা করলেন। এই ইশারার অরাথ হচ্ছে যে, অস্ত্র সমর্পণ করতে পারো তবে অস্ত্র সমর্পণের পর তোমাদের যবাই করে দেয়া হবে। এইরূপ ইশারা করার সাথে সাথে হযরত আবু লোবাবার মনে পড়লো যে, তিনি আল্লাহ তায়ালা এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে খেয়অনত করেছেন। একথা মনে হওয়ার সাথে সাথে তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাফে ফিরে আসার পরিবর্তে সোজা মসজিদে নববীতে গিয়ে হাযির হলেন। এরপর মসজিদে নববীর একটি খুঁটির সাথে বেঁধে কসম করলেন যে, অন্য কেউ নয় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ই নিজের পবিত্র হাতে আমার এ বাঁধন খুলবেন। এছাড়া তিনি এ মর্মেও প্রতিজ্ঞা করলেন যে, ভবিষ্যতে কখনো বনু কোরায়যার ভূভন্ডে প্রবেশ করবেন না। এদিকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রেরিত দূত আবু লোবাবার দেরী দেখে নানা কথা ভাবছিলেন। পরে সবকিছু শোনার পর তিনি বললেন, সে যদি আমার কাফে ফিরে আসতো, তবে তার মাগফেরাতের জন্যে আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম। কিন্তু সে যখন এমন কাজই করেছে, এখন তো আমি তার বাঁধন ততক্ষণ খুলতে পারবো না, যতক্ষণ আল্লাহ তায়ালা তার তওবা কবুল না করেন।
এদিকে আবু লোবাবার ইশারা সত্তেও ইহুদীরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে অস্ত্র সমর্পণের সিদ্ধান্ত করলো। তারা ভাবলো যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তারা সেটাই মেনে নেবে। অথচ বনু কোরায়যা ইচ্ছা করলে দীর্ঘকাল যাবত অবরোধের শাস্তি ভোগ করতে পারতো। তাদে ছিলো পর্যাপ্ত খাদ্য-সামগ্রী, পানির কূফ এবং মযবুত দুর্গ। পক্ষান্তরে মুসলমানরা খোলা ময়দানে রক্ত জমে বরফ হওয়া শীত এবং ক্ষধায় কাতর ছিলেন। খন্দকেরও আগে থেকে একাধিক যুদ্ধের কারণে তারা শারীকির ও মানসিকভাবে ছিলেন ক্লান্ত। কিন্তু বনু কোরায়যার যুদ্ধ ছিলো প্রকৃতপক্ষে একটি স্নায়ুবিক যুদ্ধ। আল্লাহ তায়ালা ইহুদের মনে মুসলমানদের প্রভাব প্রবল করে দিয়েছিলেন। তাদের মনোবল নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। এদিকে হযরত আলী (রা)-এর এক ঘোষণায় তারা একেবারে ভেঙ্গে পড়লো। হযরত আলী (রা) এবং হযরত যোবায়ের ইবনে আওয়াম বনু কোরায়যা গোত্রের বসতি এলাকার দিকে এগিয়ে গেলেন। এরপর হযরত আলী (রা) বীর বিক্রমে ঘোষণা করলেন, ঈমানদার মোহাজেররা শোনো, তোমরা শোনো, আর দেরী নয়, আল্লাহর শপথ, এবার আমিও তাই পান করবো, হযরত হামযা (রা) যা পান করেছিলেন অথবা দুর্গ জয় করবো।
হযরত আলী (রা)-এর বীরত্বব্যঞ্জক এই প্রতিজ্ঞার কথা শুনে বনু কোরায়যা আর দেরী করলো না। তারা নিজেদেরকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে সমর্পণ করে বললো, আপনি যা ভালো মনে হয় তাই করুন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, পুরুষদের বেঁধে ফেলো। মোহাম্মদ ইবনে মোসলমা আনসারীর তত্ত্বাবধানে সকল পুরুষের হাত বেঁধে ফেলা হলো। নারী ও শিশুদের পৃথক করা হলো। আওস গোত্রের লোকেরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অনুনয় বিনয় শুরু করলো যে, বনু কায়নুকার সাথে আপনি যে ব্যবহার করেছেন, সেটাতো আপনার মনে আছে। বনু কায়নুকা ছিলো আমাদের ভাই খাযরাজের নিত্র। এরাও আমাদের মিত্র। কাজেই আপনি এদের প্রতি অনগ্রহ করুন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আপনাদের একজন লোক আপনাদের ব্যাপারে ফয়সালা দেবে এতে কি আপনারা খুশী হবেন? তারা বললো, হাঁ, হাঁ, অবশ্যই। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সা’দ ইবনে মায়া’য এ ব্যাপারে ফয়সালা দেবেন। আওস গোত্রের লোকেরা বললো, আমরা এতে সন্তুষ্ট।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর হযরত সা’দ ইবনে মায়া’যকে ডেকে পাঠালেন। তিনি ছিলেন মদীনায়। মুসলিম মোহাজেরদের সাথে তিনি আসতে পারেননি। খন্দরেক যুদ্ধের সময় এক শত্রু সৈন্যের তীর নিক্ষেপের ফলে তাঁর হাতের রগ কেটে গিয়েছিলো। একটি গাধার টিঠে তাঁকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে হাযির করা হলো। বনু কোরায়যা এলাকার তাঁর প্রবেশের সাথে সাথে ইহুদীরা তাকে ঘিরে ধরলো এবং বলতে লাগলো যে, হে সা’দ আপনার মিত্রদের প্রতি দয়া করুন, তাদের জন্যে কল্যাণকর ফয়সালা দিন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনাকে বিচারক মনোনীত করেছেন। হযরত সা’দ চুপ করে রইলেন, কোন জবাব দিলেন না। চারিদিক থেকে আবেদন-নিবেদনে অতিষ্ঠ হয়ে অবশেষে তিনি বললেন, এখন সময় এসেছে যে, সা’দ আল্লাহর ব্যাপারে কোন শক্তিধরের রক্তচক্ষুকে পরোয়া করে না। একথা শুনে কিছু লোক তখনই মদীনায় ছুটে গেলো এবং বন্দীদের মৃত্যুর ঘোষণা প্রচার করলো।
হযরত সা’দ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছাকাছি পৌঁছুলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদীদের বললেন, তোমাদের সর্দারের দিকে অগ্রসর হও। হযরত সা’দ (রা) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে হাযির হলে তিনি বললেন, হে সা’দ, ওরা তোমার ফয়সালা মেনে নিতে রাজি হয়েছে। হযরত সা’দ (রা) বললেন আমার ফয়সালা তাদের ওপর প্রযোজ্য হবে? সবাই বললো হাঁ, তিনি বললেন, মুসলমানদের ওপরও প্রযোজ্য হবে? তারা বললো, হাঁ। তিনি বললেন, যিনি এখানে উপস্থিত রয়েছেন তাঁর ওপরও প্রযোজ্য হবে? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি উঙ্গিত করেই তিনি একথা বলেছিলেন। কিন্তু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লারেম জৌলূসপূর্ণ চেহারার দিকে সরাসরি তাকাতে তাঁর সাহস হচ্ছিলো না। তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে একথা বলেছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাবে বললেন, জ্বী হাঁ। আমার ওপরও প্রযোজ্য হবে। হযরত সা’দ (রা) বললেন, তবে বলছি, ওদের ব্যাপিারে আমার ফয়সালা এই যে, পুরুষদের হত্যা করা হবে, মহিলা ও শিশুদের বন্দী করা হবে। তাদের ধন-সম্পদ বন্টন করে দেয়া হবে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি ওদের ব্যাপারে সেই ফয়সালাই দিয়েছ, যে ফয়সালা আল্লাহ তায়ালা সাত আসমানের উপর করে রেখেছিলেন।
হযরত সা’দ ইবনে মায়া’দ (রা) এর এই ফয়সালা ছিলো অত্যন্ত সুষ্ঠু ও ন্যায়ানুগ। কেননা বনু কোরায়যা মুসলমানদের জীবন মৃত্যুর ক্লান্তিলগ্নে যে ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো, সেটা তো ছিলোই, এছাড়া মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারুক বা না পারুক তারা ছিলো তাতে বদ্ধপরিকর। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে তারা দেড় হাজার তলোয়ার দুই হাজার বর্শা তিনশত বর্ম এবং পাঁচশত ঢাল মজুদ করেছিলো। বিজয়ের পর মুসলমানরা সেসব অস্ত্র উদ্ধার করেন।
এ ফয়সালার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশে বনু কোরায়যাকে মদীনায় হাযির করে বনু নাজ্জার গোত্রের হারেযের কন্যার বাড়ীতে তাদের আটক করে রাখা হয়। সেই মহিলা ছিলো বনু নাজ্জার গোত্রের হারেস নামক এক ব্যক্তির কন্যা। এরপর মদীনার বাজারে পরিখা খনন করা হয়। গভীর গর্ত বা পরিখা খননের পর তাহ বাঁধা ইহুদীদের দলে দলে নিয়ে আসা হয় এবং শিরশ্ছেদ করে সেই গর্তে ফেলে দেয়া হয়। পাইকারী হত্যাকান্ড শুরু হওয়ার পর কয়েকজন ইহুদী তাদের সর্দার কা’ব ইবনে আছাদকে বললো, আমাদের সাথে যে আচরণ করা হচ্ছে, এ ব্যাপারে আপনা পতিক্রিয়া কি? তিনি রূঢ়ভাবে বললেন, তোমরা কি কিছুই বোঝো না? দেখতে পাচ্ছো না যে যাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সে আর ফিরে আসছে না। নতুন করে ডেকে নেয়াও বন্ধ হচ্ছে না। হত্যা করা হচ্ছে, স্রেফ ডেকে নিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। মোদ্দকথা সকল হাত বাঁধা ইহুদীকে মদীনায় হত্যাক করা হয়। তাদের সংখ্যা ছিলো ছয় থেকে সাত শয়ের মাঝামাঝি।
এ তৎপরতার ফলে বিশ্বাসঘাতকতার এই বিষাক্ত সাপগুলোকে নিশ্চিহ্ন করা হয়। এরা মুসলমানদের সাথে পাকাপোক্ত অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছিলো। মুসলমানদের নির্মূল করতে তারা নাযূক সময়ে শত্রুদের সাথে সহযোগিতা করে মারাত্মক যুদ্ধাপরাধ করেছিলো। মৃত্যুদন্ডই ছিলো এ গুরুতর অপরাধের একমাত্র সাজা। তাদের প্রতি কোনই অবিচার করা হয়নি।
বনু কোরায়যার এই ধ্বংসের সাথে সাথে বনু নাযিরের শয়তান এবং খন্দরেক যুদ্ধের বড় অপরাধী হুয়াই ইবনে আখতাবও নিজের কর্মফলের চূড়ান্তে পৌঁছে যায়। এই লোকটি ছিলো উম্মুল মোমেনীন হযরত সাফিয়্যার (রা) পিতা। কোরায়শ ও বনু গাতফানের ফিরে যাওয়ার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলমানরা বনু কোরায়যাকে অবরোধ করেন। তারা অবরুদ্ধ হওয়ার পর হুয়াই ইবনে আখতাবও অবরুদ্ধ হয়। কেননা খন্দকের যুদ্ধের সময় এই লোকটি কা’ব ইবনে আছাদকে মুছলমানদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতায় উদ্বুদ্ধ করার সময়ে কথা দিয়েছিলো যে, তাদের বিপদকালে তাদের সঙ্গেই থাকবে। এখন সে কথা রক্ষা করছিলো। তাকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে হাযির করা হলে দেখা গেলো যে, তার পরিধানের পোশাক সবদিকে এক আঙ্গুল করে ছেঁড়া। সে এভাবে একারণেই ছিড়েছিলো যাতে, তার পোশাক শক্ত করে বাঁধলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে হাযির হয়ে সে বললো, শুনুন আপনাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা করার কারণে আমি অনুতপ্ত নই। তবে কথা হলো যে, আল্লাহর সাথে যারা লড়াই করে, তারা পরাজিত হয়। এরপর সবাইকে সম্বোধন করে বললো, হে লোক সকল, আল্লাহর ফয়সালায় কোন আক্ষেপ নেই। এটা তো কতদিরের লিখন এবং বড় ধরনের হত্যাকান্ড, যা কিনা আল্লাহ তায়ালা বনি ইসরাইলের জন্যে লিখে দিয়েছেন। এরপর সেও বসলো এবং তার শিরশ্ছেদ করা হলো।
এই ঘটনায় বনু কোরায়যার একজন মহিলাকেও হত্যা করা হয়। এই মহিলা খাল্লাদ ইবনে ছুয়াইদের ওপর গম পেশাইর চাক্কি ছুঁড়ে তাকে হত্যা করেছিলেন। সেই হত্যাকান্ডের বদলে তাকে হত্যা করা হয়।
রসূল আদেশ দিয়েছিলেন যে, যার নাভির নিচে জুল গজিয়েছে তাকেই যেন হত্যা করা হয়। আতিয়া কারাযির নাভির নীচে তখনো চুল গজায়নি, এ কারণে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো। পরে তিনি ইসলামের ছায়াতলে এসে জীবন ধন্য করেছিলেন।
হযরত ছাবেত ইবনে কয়েস আবেদন করলেন যে, যোবায়ের ইবনে বাতা এবং তার পরিবার-পরিজনকে তার হাতে হেবা করে দেয়া হোক। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই আবেদন মনজুর করেন। এরপর ছাবেত ইবনে কয়েস যোবায়েরকে বললেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাকে এবং তোমার পরিবার-পরিজনকে আমার হাতে তুলে দিয়েছেন। আমি তোমাদের আযাদ করে দিচ্ছি। এখন থেকে তোমরা মুক্ত। যোবায়ের ইবনে বাতা যখন খবর পেলো যে, তার স্বজাতীয়দের হত্যা করা হয়েছে, সে তখন হযরত ছাবেত ইবনে কয়েসকে বললো, ছাবেত তোমার প্রতি এক সময় আমি যে অনুগ্রহ করেছিলাম, তার দোহাই দিয়ে বলছি আমাকেও আমার বন্ধুদের কাছে পৌঁছে দাও। এরপর তাকে হত্যা করা হয়। যোবায়ের ইবনে বাতার পুত্র আবদুর রহমানকে হত্যা করা হযীন, আবদুর রহমান পরবর্তীকালে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। বনু নাজ্জার গোত্রের উম্মুল মানযার সালমা বিনতে কয়েস রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আবেদন জানালেন যে, সামোয়াল কারযির পুত্র রেফায়াকে যেন তা জন্যে হেবা করে দেয়া হয়। এই আবেদনও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গ্রহণ করেন এবং রেফায়াকে তার হাতে তুলে দেন। উম্মুল মানযার রেফায়াকে জীবিত রাখেন। পরবর্তী সময়ে রেফায়া ইসলাম গ্রহণ করেন।
সেই রাতে অস্ত্র সমর্পনের পূর্বে কয়েকজন লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, এতে তাদের জানমাল এবং পরিবার-পরিজনকে নিরাপত্তা প্রদান করা হয়। সেই রাতে আমর নামে একজন লোক বেরিয়ে আসে। এই লোকটি বনু কোরায়যার বিশ্বাসঘাতকতায় যোগদান করেনি। প্রহরীদের কমান্ডার হযরত মোহাম্মদ ইবনে মোসলমা (রা) তাকে চিনতে পারেন এবং চেনার পর ছেড়ে দেন। পরে এই লোকটি নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, তার আর কোন খবর পাওয়া যায়নি।
বনু কোরায়যার ধন-সম্পদ থেকে এক পঞ্চমাংশ বের করে রেখে বাকি সব কিছু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের মধ্যে বন্টন করে দেন। ঘোর সওয়ারদের তিন অংশ প্রদান করেন, এক অংশ তার নিজের জন্যে আর বাকি দুই অংশ ঘোড়ার জন্যে। পদব্রেজে আগমনকারীদের এক অংশ প্রদান করা হয়। কয়েদী এবং শিশুদের হযরত সা’দ ইবনে যায়েদ আনসারীর নেতৃত্বে নজদে পাঠিয়ে তাদের বিনিময়ে অস্ত্র এবং ঘোড়া ক্রয় করা হয়।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনু কোরায়যার মহিলাদের মধ্যে রায়হানা বিনতে আমর ইবনে খানাফাকে তাঁর নিজের জন্যে পছন্দ করেন। ইবনে ইসহাকের বর্ণনা মোতাবেক এই মহিলা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাত পর্যন্ত তাঁর কাছে ছিলো।[ ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ২৪৫]
কালবি বর্ণনা করেছেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রায়হানাকে মুক্ত করে দিয়ে তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজ্জ থেকে ফিরে আসার পর হযরত রায়হানা (রা) ইন্তেকাল করেন। তাঁকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়।[ তানকিহুল ফুহুম, পৃ. ১২]
বনু কোরায়যার ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর আল্লাহর নেক বান্দা হযরত সা’দ ইবনে মায়া’য (রা) এর দোয়া কবুল হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে। খন্দকের যুদ্ধের আলোচনার সময় সে কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হযত যা’দ এর (রা) যখম ফেটে যায়। সেই সময় তিনি মসজিদে নববীতে ছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানেই তাঁর জন্যে তাঁবু স্থাপন করেন যাতে করে, কাছে থেকে তাঁর সেবা শুশ্রুষা করা যায়। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, যখন ফেটে গিয়েছিলো। মসজিদে বনু শেফারের কয়েকটি তাঁবু ছিলো। তারা হযরত সা’দ এর রক্তপ্রবাহ দেখে চমকে উঠলো। তারা বললো, ওহে তাঁবুবাসীরা, এটা কি ব্যাপার? তোমাদের দিক থেকে আমাদের দিকে আসছে। লক্ষ্য করে দেখা গেলো যে, হযরত সা’দ এর রক্ত অবিরল ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। অবশেষে যখমের ফলেই হযরত সা’দ ইবনে মায়া’য ( রা) ইন্তেকাল করেন।[ সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৯১]
বোখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত জাবের (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সা’দ ইবনে মায়া’য (রা) –এর ইন্তেকালে রহমানের আরশ হেলে যায়।[ সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৩৬, মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ. ২৯৪, জামে তিরমিজি, ২য় খন্ড, পৃ. ২২৫]
ইমাম তিরমিযি হযরত আনাস (রা) থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করে সেটিকে সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন। সেই হাদীছে বর্ণিত রয়েছে যে, হযরত সা’দ এর জানাযা ওঠানোর পর লোকেরা বললো, তার জানাযা কতো হালকা। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ফেরেশতারা তার জানাযা বহন করছেন।[ জামে তিরমিযি ২য় খন্ড, পৃ. ২২৫]
বনু কোরায়জায় অবরোধের সময় একজন মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন। বনু কোরায়যার একজন মহিলা এই সাহাবীর প্রতি গম পেশাই চাক্কি বা যাঁতাকল নিক্ষেপ করেছিলো। এছাড়া হযরত আকাশার ভাই আবু ছানান ইবনে মোহসেন অবরোধকালে ইন্তেকাল করেন।
হযরত আবু লোবাবা (রা) ছয় রাত ক্রমাগতভাবে মসজিদে নববীর খুঁটির সাথে বাঁধা অবস্থায় অতিবাহিত করে। নামাযের সময় হলে তাঁ স্ত্রী এ সে খুলে দিতেন, এরপর নামায শেষে পুনরায় বেঁধে রাখতেন। ছয় দিন পর এক সকালে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ওহী আসে যে, আবু লোবাবার তওবা কবুল হয়েছে। সেই সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত উম্মে সালমার গৃহে অবস্থান করছিলেন। হযরত আবু লোবাবা (লা) বলেন, উম্মুল মোমেনীন হযরত উম্মে সালমা (রা) তাঁ ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আমাকে বললেন, হে আবু লোবাবা, সন্তুষ্ট হও, আল্লাহ তায়ালা তোমার তওবা কবুল করেছেন। একথা শুনে সাহাবারা তাঁর বাঁধন খুলে দিতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু রাজি হননি। তিনি বললেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাড়া আমার বাঁধন কেউ খুলবে না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামায আদায়ের জন্যে যাওয়ার সময় আবু লোবাবার বাঁধন খুলে দেন।
জেলকদ মাসে এই অবরোধের ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ ২৫৬ দিন পর্যন্ত অবরোধ কার্যকর থাকে।[ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ২৩৭,২৩৮ যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ জানার জন্য দেখুন, ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড ২৩৩-২৭৩, সহীহ বোখার, ২য় খন্ড পৃ. ৫৯০-৫৯১, যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৭২-৭৩, ৭৪, মুখতাছারুছ ছিয়ার শেখ আবদুল্লাহ, পৃ. ২৮৭,২৮৮, ২৮৯, ২৯০]
আল্লাহ তায়ালা বনু কোরায়যা ও খন্দকের যুদ্ধ সম্বন্ধে পবিত্র কোরআনের সূরা আহযাবে বহু সংখ্যক আয়াত নাযিল করেন। এতে উভয় যুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয়। মোমেন ও মোনাফেকদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়। শত্রুদের বিভিন্ন দলের মধ্যে বিভেদ এবং ভীরুতার কথা উল্লেখ করা হয়। আহলে কেতাবদের বিশ্বাসঘাতকতার পরিণামও ব্যাখ্যা করা হয়।