তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট ও শারীরিক সৌন্দর্যঃ
রসূল সাল্লালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন চারিত্রিক বৈশিষ্ট ও শারীরিক সৌন্দার্যের অধিকারী ছিলেন, যা বলে শেষ করা যাবে না। এসব কারণে তাঁর প্রতি মন আপনা থেকেই নিবেদিত হয়ে যেতো। ফলে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং মর্যাদা বিধানে মানুষ এমন নিবেদিত চিত্ততার পরিচয় দিতো যার উদাহরণ দুনিয়ার অন্য কোন ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রেই পেশ করা সম্ভ্ নয়। তাঁর বন্ধু ও সহচররা তাঁকে প্রাণের চেয়ে বেশী ভালোবাসতেন। তারা চাইতেন যে, যদি প্রয়োজন হয় তবে নিজের মাথা কাচিয়ে দেবেন তবু রসূল সাল্লালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহ মোবারকে একটি আঁচড়ও যেন না লাগে। এ ধরণের ভালবাসার কারণ ছিলো এই যে,স্বভাবসম্মত যেসব গুণের প্রতি মনপ্রাণ উজাড় করে দেয়ার ইচ্ছা জাগে সেসব গুণের সমাবেশ তাঁর মদ্যে এতো বেশী ছিলো যে, অন্য কারো মধ্যেই সে রকম ছিলো না। নিচে আমরা বিনয়ের সাথে রসূল সাল্লালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৈান্দর্য সম্পর্কিথ সারকথা উল্লেখ করছি।
প্রিয় নবীর দৈহিক গঠন প্রকৃতি
হিজরতের সময়ে প্রিয় নবী সাল্লালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে মাবাদ খোযাইয়ার তাঁবুতে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর মদীনার পথে রওয়ান হযে যান। তাঁর চলে যাওয়ার পর উম্মে মাবাদ স্বামীর কাছে রসূল সাল্লালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে পরিচয় তুলে ধরেন তা ছিলো এরূপ। চমকানো রং, উজ্বল চেহারা, সুন্দর গঠন, সটান সোজাও নয়, আবার ঝুঁকে পড়াও নয়, অসাধারণ সৌন্দর্যের পাশাপাশি চিত্তাকর্ষক দৈহিক গঠন, সুর্মারাঙ্গা চোখ, লম্বা পলক, ঋজু কন্ঠস্বর, লম্বা ঘাড়, সাদা কালো চোখ, সুর্মাকালো তার পলক, সুক্ষ এবং পরস্পর সম্পৃক্ত ভ্রু, চমকানো কালো চুল, চুপচাপ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন,কথা বলার সময়ে আকর্ষনীয়, দূর থেকে দেখে মনে হয় সবার চেয়ে উজ্বল ও সৌন্দর্যপূর্ণ, কছে থেকে দেখে মনে হয় সুমহান এবং প্রিয় সুন্দর, কথার মিষ্টিতা, প্রকাশভঙ্গি সুস্পষ্ট, কথঅ খূব সংক্ষিপ্ত ও নয় আবার দীর্য়ায়িত ও নয়,কথা বলার সময় মনে হয় যেন, মুক্তো ঝরছে,মাঝারি উচ্চতা সম্পন্ন, বেঁটেও নয় লম্বাও নয় যে, দেখে খারাপ মনে হবে। সহচররা তাঁকে ঘিরে যদি কিছু বলে, তবে তিনি সেকথা গভীর মনযোগের সাথে শোনেন। তিনি কোন আদেশ করলে সাথে সাথে তার সে আদেশ পালন করেন, সহচররা তাঁর অত্যন্ত অনুগত এবং তাঁর প্রতি গভীর সম্মান ও শ্রদ্ধার মনোভাব পোষণ করেন, কেউ উদ্ধত ও দুর্বিনীত নয়, কেউ বাহুল্য কথাও বলেন ন। ১[যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ-৫৪]
হযরত আলী (রা.)রসূল সাল্লালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৈশিষ্ট্ বর্ণনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন যে, তিনি অস্বাভাবিক লম্বা ছিলেন ন, আবার বেঁটেও ছিলেন ন। তিনি ছিলেন মাঝারি ধরণের গঠন বৈশিষ্টসম্পন্ন। তাঁর চুল কোকড়ানো ও ছিলো না, আবার খাড়াও ছিলো না-ছিলো উভয়ের মাঝামাঝি ধরাণের ছিলো।তাঁর কপোল মাংসলও ছিলো আবার শুকনোও ছিলো না বরং উভয়ের মাঝামাঝি ধরণের ছিলো। তাঁর কপাল ছিল প্রশস্ত, গায়ের রং ছিলো গোলাপী গৌর এর মিশ্ররূপ। চোখ সুর্মারাঙ্গা লালচে, ঘন পল্বব বিশিষ্ট। বুকের ওপর নাভি থেকে হালকা চুলের রেখা, দেহের অন্য অংশ লোমশূন্য। হাত পা মংসল। চলার সময় স্পন্দিত ভঙ্তিতে পা তুলতেন। তাঁকে হেটে যেতে দেখে মনে হতে তিনি যেন ওপর থেকে নিচে যাচ্ছেন।কোন দিকে লক্ষ্য করলে পুরো মনোযোগের সাথেই লক্ষ্য করতেন। উভয় কাঁধের মাঝখানে তাঁর মোহর নবুয়ত ছিলো। তিনি ছিলেন সকল নবীর শেষ নবী। তিনি ছিলেন সর্বাধিক দানশীল। সর্বাধিক সাহসী, সর্বাধিক সত্যবাদী, সর্বাধিক অঙ্গীকার পালনকারী, সর্বাধিক কোমল প্রা ণ এবং সর্বাধিক আভিজাত্য সম্প্ন্ন। হঠাৎ করে কেউ তাঁকে দেখলে ভীতি-বিহবণ হয়ে পড়তো, পরিচিতি কেউ তাঁর সামনে গেলে ভালোবাসায় ব্যাকুল হতো। তাঁর গুণ বৈশিষ্ট বর্ণনাকারীকে বলতে হতো যে, আমি তাঁর আগে এবং তার পরে তার মতো অন্য কাউকে দেখিনি।২[ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-৪০১,৪০২ তিরমিযি শরহে তোহফাতুল আহওয়াদি, চতুর্থ খন্ড পৃ-৩০৩]
হযরত আলী (রা.)-এর অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, তাঁর মাথা ছিলো বড়, জোড়ার হাড় ছিলো ভারি, বুকের মাঝখানে লোমের হালকা রেখা ছিলো তিনি চলার সময়ে এমনভঅবে চলতেন, তখন মনে হতো কেউ যেন উঁচু থেকে নীচুতে অবতরণ করছে। ৩[ তিরমিযি , শরহে তোহফাতুল আওয়াজি, ৪র্থ খন্ড, পৃ-৩০৩]
হযরত জাবের ইবনে ছুমুরা (রা.) বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেশী ছিলো চওড়া, চোখ ছিলো লালচে, পায়ের গোড়ালী ছিলো সরু ধরণের। ৪[সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ-২৫৮]
হযরত আবু তোফায়ের বলেন, তিন ছিলে গৌর রং এর, চেহারা ছিলো মোলায়েম। তাঁর উচ্চতা ছিলো মাঝামাঝি ধরণের। ৫[সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ-২৫৮]
হযরত আনাস ইবনে মালেক বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতের তালু ছিলো প্রশস্ত, রং ছিলো চমকদার, একেবারে সাদাও ছিলো ন, একেবারে গম-এর রং ও ছিলো না। ওফাতের সময় পর্যন্ত তাঁর মাথা এবং চেহারার বিশটি চুলও সাদা হয়নি। ৬[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৫০২] শুধ কানের কয়েকটি লোম সাদা হয়েছিলো, এছাড়া মাথার কয়েকটি চুল ও সাদ হয়ে গিয়েছিলো।৭[সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ-৫০২]
হযরত আবু হোযায়ফা বলেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নীচের ঠোঁট সংলগ্ন দাড়ি সাদা দেখেছি। ৮[সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ-৫০২,৫০২]
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে বাছার (রা.) বলেন,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নীচের ঠোঁটেন সংলগ্ন দাড়িতে কয়েকটি সাদা হয়ে গিয়েছিলো।৯[ঐ পৃ-৫০২]
হযরত বারা বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মাঝারি ধরণে উচ্চতা সম্পন্ন। উভয় কাঁধের মাঝখানে দুরত্ব ছিলো। মাধার চুল ছিলো উভয় কানের লতিকা পর্যন্ত। আমি তাঁকে লাল পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখেছি। কখনো কোন জিনিস তাঁর চেয়ে অধিক সৌন্দর্যসম্পন্ন দেখেনি। ১০[ঐ পৃষ্টা ৫০২]
তিনি প্রথমে আহলে কেতাবদের মতো চুল আঁচড়াতে পছন্দ করতেন। একারণে আঁচড়ালে সিঁথি করতেন না, কিন্তু পরবর্তীতে সিঁথি করতেন।১১[ঐ পৃষ্টা ৫০২]
হযরত বারা ইবনে আযেব (রা.) বলেন, তাঁর চেহার ছিলো সবচেয়ে সুন্দর এবং তাঁর চেহারা ছিলো সকলেন চেয়ে উৎকৃষ্ট। ১২[ঐ প্রথম পৃষ্টা ৫০২ সহীহ মুসলিম ২য় খন্ড, পৃ-২৫৮]
হযরত বারা ইবনে আযেব (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারা কি তলোয়ারের মতো ছিলো? তিনি বললেন, না বরং তাঁর চেহারা ছিলো চাঁদের মতো। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চেহারা ছিলো গোলাকার। ১৩[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৫০২,সহীহ মুসলিম ২য় খন্ড, পৃ-২৫৯]
রবি বিনতে মোয়াওয়েয (রা.) বলেন, তোমরা যদি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে দেখতে, তখন মনে হতো যে, যেন উদিত সূর্যকে দেখছো। ১৪[মোসনাদে দারেমী, মেশকাত, ২য় খন্ড, পৃ-৫১৭]
হযরত জাবের ইবনে ছামুরা বলেন, এক চাঁদনী রাতে আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখছিলাম। সেই সময় তাঁর পরিধানে ছিলো লাল পোশাক। আমি একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি এবং একবার চাঁদের প্রতি তাকাচ্ছিলাম। অবশেষে আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, আমর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চাঁদের চেয়ে অধিক সুন্দর। ১৫[শামায়েলে তিরমিযি, দারেমী, মেলকাত দ্বিতীয় খন্ড, পৃ-৫১৫]
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়ে অধিক সুন্দর কোন মানুষ কিন্তু আমি দেখিনি। মনে হতো, সূর্য যেন তাঁর চেহারায় জ্বলজ্বল করছে। আমি তাঁর চেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন কাউকে দেখিনি। তিনি হাঁটতে শুরু করলে যমিন যেন তাঁর পায়ে সঙ্কচিত হয়ে আসতো। হাঁটার সময়ে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম, কিন্তু তিন থাকতেন নির্বিকার। ১৬[জামে তিরমিযি, শরহে তোহফাতুল আহওয়াযি, ৪র্থ খন্ড, পৃ-৩০৬, মেশকাত ২য় খন্ড, পৃ-৫১৮]
হযরত কা’ব ইবনে মালেক (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন খুশী হতেন, তখন তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠতো। দেখে মনে হতো যেন, এক টুকরো চাঁদ। ১৭[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৫০২]
একবার তিনি হযরত আয়েশার (রা.) কাছে অবস্থান করছিলেন্ ঘর্মাক্ত হয়ে ওঠার পর তাঁর চেহারা আরো উজ্জাল সুন্দর দেখাচ্ছিলো। এ অবস্থা দেখে হযরত আয়ো (রা.) আবু কোবায়েবের হাজলির এই কবিতা আবৃত্তি করলেন।১৮[রহমতুল লিল আলামীন, ২য় খন্ড, পৃ-১৭২]
‘তাঁর চেহারায় তাকিয়ে দেখতে পেলাম
চমকানো মেঘ যেন চমকায় অবিরাম।’
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তাঁকে দেখে এই কবিতা আবৃত্তি করতেন।১৯[খোলাসাতুস সিয়ার পৃ-২০]
‘ভালোর পথে দেন দাওয়াত পূরণ করেন অঙ্গীকার
চতুর্দশীর চাঁদ, লুকোচুরি খেলে যেন অন্ধকার।’
হযরত ওমর (রা.) তাঁর সম্পর্কে যোহাইর-এর কবিতা আবৃত্তি করতেন। এ কবিতা হরম ইবনে ছিনাল সম্পর্কে লেখা হয়েছিলো।২০[ করতেন।১৯[খোলাসাতুস সিয়ার পৃ-২০]
‘মানুষ যদি না হতেন এই আল্লাহর প্রিয়জন
চতুর্দশীর রাত তিনি করতেন তবে রওশন।’
তিনি যখন ক্রোধান্বিত হতেন, তখন তাঁর চেহারা লাল হয়ে যেতো, মনে হতো উভয় কপালে আঙ্গুরের দান যেন নিংড়ে দেয়া হয়েছে। ২১[ মেশকাত ১ম খন্ড, পৃ-২২ তিরমিযি আরওয়াবুল কদর, ২য় খন্ড, পৃ-৩৫]
হযরর জাবের ইবনে ছামুরা বলেন,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হাসতেন মৃদু হাসতেন, তাঁর চোখ দেখে মনে হতো যেন সুর্মা লাগানো, অথচ সুর্ম লাগানো ছিলো না। ২২[ জামে তিরমিযি শরহে তোহফাতুল আহওয়াযি, ৪র্থ খন্ড, পৃ-৩০৬]
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনের দুটি দাঁত পৃথক পৃথক ছিলো । তাঁর কথঅ বলার সময় উভয় দাঁতের মদ্যে থেকে আলোকআভা বিচ্ছুরিত হতো। ২৩[তিরমিযি, মেশকাত, ২য় খন্ড, পৃ-৫১৮]
তাঁর গ্রীবা ছিলো রৌপ্যের নির্মিত পাত্রের মত পরিচ্ছন্ন, চোখের পলক ছিলো দীর্ঘ, দাড়ি ছিরো ঘন, ললাট প্রশস্ত, ভ্রু পৃথক, নাসিকা উন্নত, নাভি থেকে বক্ষ পর্যন্ত হালকা লোমের রেখা বাহুতে কিছু লোম ছিলো। পেট এবং বুক ছিলো সমান্তরাঁল, বুক প্রশস্ত, হাতের তালু প্রশস্ত। পথ চলার সময় তিনি কিছুটা ঝুঁকে পথ চলতেন।মধ্যম গতিতে তিনি পথ চলতেন। ২৪[খোলাসাতুস সিয়ার, পৃ-১৯-২০]
হযরত আনাস (রা.) বলেন, আমি এমন কোন রেশম দেখিনি, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতের তালুর চেয়ে বেশী নরম ছিলো। এমন কোন মেশক আম্বর শুকিনি যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুগন্ধির চেয়ে অধিক সুবাসিত ছিলো। ২৫[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, ৫০৩, সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ-২৫৮]
হযরত আবু যোহায়রা (রা.) বলেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাত আমার ওপর রেখেছিলাম। সেই সময় আমি অনুভব করলাম যে,অ সেই হাত বরফের চেয়ে বেশী ঠান্ডা এবং মেশকের চেয়ে বেশী খুশবুদার। ২৬[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড পৃ-৫০২
কিশোর বয়স্ক হযরত জাবের ইবনে ছামুরা (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কপালে হাত রেখেছিলেন, এতে আমি এমন শীতলতা ও সুবাস অনুভব করলাম যে, মনে হলো, তিনি তাঁর পবিত্র হাত আত্তাবের আতর দান থেকে বের করেছেন। ২৭[সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ-২৫৮]
হযরত আনাস (রা)বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘাম ছিলো মুক্তোর মতো। হযরত উম্মে সুলইম (রা.) বলেন, এই ঘমেই ছিলো সবচেয়ে উত্তম খুশবু। ২৮[সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ-২৫৬]
হযর জাবের (রা) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন রাস্তা দিয়ে পথ চলার পর অন্য কেউ সেই পথে, সেই রাস্তা দিয়ে গেলে বুঝতে পারতো যে, তিনি এ পথে দিয়ে গমন করেছিলেন। ২৯[ দায়েমী মেশকাত, ২য় খন্ড, পৃ-১৭]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উভয় কাঁধের মাঝামাঝি জায়গায় ছিলো মোহরে নবুয়ত। কবুতরের ডিমের মতো দেখতে এই মোহরে নবুয়তের রং ছিলো তাঁর দেহ বর্ণের মতো। এটি বাম কাঁধের নরম হাড়ের পাশে অবস্থিত ছিল। ৩০[সহীহ মুসলিম ২য় খন্ড, পৃ-২৫৯-২৬০]
চারিত্রিক বৈশিষ্ট
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় কথঅ বলতেন। অসঙ্কোচ, অনাড়ষ্ট, দ্ব্যর্থবোধক, অর্থপূর্ণ কথা। তিনি দূর্লভ বৈশিষ্ট এবং আরবের সকল ভাষার জ্ঞান লাভ করেছিলেন। এ কারণে তিনি যে কোন গোত্রের সাথে সেই গোত্রের ভাষা ও পরিভাষায় কথা বলতেন। বেদুইনদের মতো দৃঢ়তাব্যঞ্জক বাকভঙ্গি, সম্বোধন প্রকৃতি এবং শহরের নাগরিক জীবনের বিশুদ্ধ ভাষা ছিলো তার আয়ত্বধীন। উপরন্তু ছিলো ওহীভিত্তিক আল্লাহর সাহায্য।
সহিঞ্চুতা, ধৈর্য ও ক্ষমতাশীলতার গুণবৈশিষ্ট তার মধ্যে ছিলো। এসবই ছিলো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহপাক তেকে পাওয়া। সাধারণত সকল ধৈর্যশীল ও সহিঞ্চুতার অধিকারী মানুষের মধ্যেই কোন না কোন ক্রটি দেখা যায় কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট এমন উন্নত ও সুন্দর ছিলো যে, তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুদের উদ্যোগ আয়োজন এবং তাঁকে কষ্ট দেয়ার জন্যে দুর্বৃত্তদের তৎপরতা যতো বেড়েছে, তাঁর ধৈর্যও তাতো বেড়েছে।
হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, প্রিয় নবীকে দু’টি কাজের মধ্যে একটি বেছে নিতে বলা হলে তিনি সহজ কাজটিই নিতেন। পাপের সাথে সম্পৃক্ত কাজ থেকে তিনি দূরে থাকতেন। তিনি কখনো নিজের জন্যে কারো কাঝ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। তবে, আল্লাহর সম্মান ক্ষুণ্ন করা হলে তিনি আল্লাহর জন্যে প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন। ৩১[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৫০৩]
তিনি ক্রোধ ও দুর্বিনীত ব্যবস্থা থেকে দূরে ছিলেন। সকলের প্রতি সহজেই তিনি রাযি হয়ে যেতেন। তাঁর দান ও দয়াশীলতা পরিমাপ করা ছিলো অসম্ভব। দারিদ্রের আশঙ্কা থেকে মুক্ত মানসিকতা নিয়ে তিনি দান খায়রাত করতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সবার চেয়ে দানশীল। তাঁর দানশীলতা রমযান মাস হতে হযরত জিবরাঈল (আ.)-এর সাথে সাথে সময় অধিক বেড়ে যেতো। রমযান মাসে প্রতি রাতে হযরত জিবরাঈল (আ.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন। তিনি কল্যাণ ও দানশীলতায় পরিপূর্ণ বাতাতের চেয়ে অগ্রণী ছিলেন। ৩২[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৫১৭]
হযরত জাবের (রা.) বলেন, কখনোই এমন হয়নি যে, কেউ তাঁর কাছে কিছু চেয়েছে অথচ তিনি তা দিতে অস্মমতি জানিয়েছেন। ৩৩[সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৫১৭]
বীরত্ব ও বাহাদুরির ক্ষেত্রে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্থান ছিলো সাবর ওপরে। তিনি ছিলেন সকলেন চেয়ে শ্রেষ্ঠ বীর। কঠিন পরিস্থিতিতে বিশিষ্ট বীর পুরুষদের যখন পদস্থলন হয়ে যেতো, সেই সময়েও রসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অটল দৃঢ়তায় টিকে থাকতেন। তিনি সেই সুকঠিন সময়েও পশ্চাদপসারণ না করে সামনে এগিয়ে যেতেন। তাঁর দৃঢ়চিত্তারয় এতটুকু বিচলিত ভাব আসত না। হযরত আলী (রা.) বলেন, যে সময় যুদ্ধের বিভীষিকা দেখা যেতো এবং সুকঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো সে সময়ে আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামমের ছত্র ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করতাম। তাঁর চেয়ে বেশী দৃঢ়তার সাথে অন্য কেউ শত্রুর মোকাবেলা করতে সক্ষম হতো না। ৩৪[শাফী, কাজী আয়ায, ১ম খন্ড, পৃ-৮৯, ছেহাহ]
হযরত আনাস (রা.) বলেন, একরাতে মদীনাবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। সবাই আওয়ায় লক্ষ্য করে ছুটতে শুরু করলো্।পথে নবীজীর সাথে দেখা হলো। তিনি কোলাহল লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলেন। সেই সময় তিনি হযরত আবু তালহার (রা.) একটি ঘোড়ার খালি পিঠে সওয়ার হয়েছিলেন। তাঁর গলায় তরবারি ঝুলানো ছিলো। তিনি লোকদের বলছিলেন, ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না। ৩৫[সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ-২৫২, সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৪০৭]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সর্বাধিক লাজুক প্রকৃতির। তিনি সাধারণত মাটির দিকে দৃষ্টি রাখতেন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বললেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন পর্দানসীন কুমারী মেয়ের চেয়ে অধিক লজ্জাশীল। কোন কিছু তাঁর পছন্দ না হলে চেহারা দেখেই বোঝা যেতো। ৩৬[সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ-২৫২, সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৪০৭] কারো চেহারার প্রতি তিনি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকতেন না। দৃষ্টি নিচু রাখতেন এবং ওপরের দিকের চেয়ে নীচের দিকেই বেশী সময় তাকিয়ে থাকতেন। সাধারণত তাকানোর সময় নিচু দৃষ্টিতে তাকাতেন। লজ্জাশীলতা ও আত্মসম্মান বোধ এতো প্রবল ছিলো যে, কারো মুখের ওপর সরাসরি অপ্রিয় কথা বলতেন না। কারো ব্যাপারে কোন অপ্রিয় কথা তাঁর কাছে পৌঁছুলে সেই লোকের নাম উল্লেখ করে তাকে বিব্রত করতেন না। বরং এভাবে বলতেন যে, কিছু লোক এভাবে বলাবলি করছে। বিখ্যাত আবর কবি ফারাযদাক-এর কবিতয়ি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই বৈশিষ্ট চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
‘লজ্জাশীল তিনি তাই দৃষ্টি নত তাঁর
তাঁকে দেখে চোখের নযর নত যে সবার
তাঁর সাথে কথা বলা সম্ভব হয় তখন
অধরে তাঁর মৃদু হাসি ফোটে যখন।’
তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশী ন্যায়পরায়ন পাক পবিত্র, সত্যবাদী এবং বিশিষ্ট আমানতদার। বন্ধু শত্রু সকলেই এটা স্বীকার করতেন। নবুয়ত লাভের আগে তাঁকে ‘আল-আমিন’ উপাধি দেয়া হয়েছিলো। আইয়ামে জাহেলিয়াতে তাঁর কাছে বিচার –ফয়সালার জন্যে বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষই হাযির হতো। তিরমিযি শরীফে হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, একবার আবু জেহেল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললো, আমরা তো আপনাকে মিথ্যঅবাদী বলি না, কিন্তু আপনি যা কিছু প্রচার করছেন, তাকে মিথ্যা বলি। একথার পর আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাযিল করেন। ‘তারা তোমাকে তো মিথ্যাবাদী বলে না, বরং সীমা লংঘনকারীগণ আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করে।৩৭[মেশকাত,২য় খন্ড, পৃ-৫২১](আনআম, আয়াত-৩৩)
সম্রাট হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, সেই নবী যেসব কথা বলেন, সেই সব কথা বলার আগে তাকে মিথ্যাবাদী বলে অভিহিত করার মত কোন ঘটনা ঘটেছিলো কি? আবু সুফিয়ান বললেন, ‘না’।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন অতি বিনয়ী ও নিরহংকার। বাদশাহদের সম্মানে তাদের সেবক ও গুণগ্রাহীরা যেরকম বিনায়বনত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্মানে সাহাবাদের সেভাবে দাঁড়াতে নিষেধ করতেন। তিনি মিসকিন গরীবদের সেবা এবং ফকিরদের সাথে উঠাবসা করতেন। ক্রীতদাসদেরও নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতেন। সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে সাধারণ মানুষের মতোই বসতেন।
হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, তিনি নিজের জুতো নিজেই সেলাই করতেন। নিজের কাপড় নিজেই সেলাই করতেন। ঘরের সাধারণ কাজ কর্ম নিজের হাতে করতেন। তিনি ছিলেন অন্য সব সাধারণ মানুষের মতোই একজন মানুষ। নিজের ব্যবহৃত কাপড়ের উকুন থাকলে তিনি নিজে তা বের করতেন, নিজ হাতে বকরি দোহন করতেন, নিজের কাজ নিজেই করতেন। ৩৮[মেশকাত , ২য় খন্ড, পৃ-৫২০]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অঙ্গীকার পালনে ছিলেন অগ্রণী। তিনি আত্মীয়স্বজনের প্রতি অতিমাত্রায় খেয়াল রাখতেন। মানুষের সাথে সহৃদয়তা ও আন্তরিকতার সাথে মেলামেশা করতেন। বিনয় ও নম্রতায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তাঁর চরিত্র ছিলো অনন্য সুন্দর। অসচ্চরিত্রতার এক বিন্দুও তাঁর মধ্যে ছিলো না। স্বভাবগতভাবেই তিনি কখনো অশালীন কথা বলতেন না। অনিচ্ছাকৃতভাবেও তিনি কখনো অশালীন কথা বলেননি। কাউকে কখনো অভিশাপ দিতেন না। বাজারে গেলে উচ্ছস্বরে চিল্লাচিল্লি করতেন না। মন্দের বদলা তিনি মন্দ দিয়ে দিতেন না। বরং তিনি মন্দের জন্যে দায়ী লোককেও ক্ষমা করে দিতেন। কেউ তার পেছনে আসতে শুরু করলে তাকে পেছনে ফেলে চলে আসতেন না। পানাহারের ক্ষেত্রে দাসীবাদীদের চেয়ে নিজেকে পৃথক মনে করতেন না। তাঁর খাদেমের কাজও তিনি করে দিতেন। খাদেমের প্রতি তিনি কখনো বিরক্তি প্রকাশ করেননি। কোন কাজ করা না করা প্রসঙ্গে কখনো তাঁর খাদেমের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেননি। তিনি গরীব মিসকিনদের ভালোবাসতেন। তাদের সাথে উঠাবসা করতেন এবং জানাযায় হাযির হতেন। কোন গরীবকে তার দারিদ্রের কারণে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন না। একবার তিনি সফরে ছিলেন। সেই সময় একটি বকরি যবাই করার পরামর্শ হয়। একজন বললেন,যবাই করার দায়িত্ব আমার, অন্যজন বললেন, চামড়া ছাড়ানোর দায়িত্ব আমার। তৃতীয় জন বললেন, রান্নার দায়িত্ব আমি পালন করবো। এসব কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কাঠ সংগ্রহ করার দায়িত্ব আমি পালন করবো। সাহাবারা বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমরা আমরা আপনার কাজ করে দেবো। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাযি হলেন না। তিনি বললেন, আমি জানি, তোমরা আমার কাজ করে দেবে, কিন্তু আমি চাই না যে, আমি তোমাদের চাইতে নিজেকে পৃথক অবস্থানে রেখে স্বাতন্ত্রতা অর্জন করবো। কেননা আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের মধ্যে বন্ধুদের নিজেকে পৃথক করে প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা পছন্দ করেন না। এরপর তিনি লাকড়ি জমা করতে চলে গেলেন।৩৯[খোলাছাতুস সিয়ার, পৃ-২৩]
আসুন, এবার হেন্দ ইবনে আবু হালার যবানীতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গুণ বৈশিষ্ট শ্রবন করি। হেন্দ তাঁর এক দীর্ঘ বর্ণনায় বলেন, প্রিয় নবী গভীর চিন্তায় চিন্তিত ছিলে। সব সময় চিন্তা-ভাবনা করতেন। কথার শুরু ও শেষে সুস্পষ্ট উচ্চারণ করতেন। অস্পষ্ট উচ্চারণে কোন কথা বলতেন না। অর্থবহ দ্ব্যর্থহীন কথা বলতেন, সেই কথায় কোন বাহুল্য থকত না। তিনি ছিলেন নরম মেযাজের অধিকারী। সামান্য পরিমাণ নেয়ামত হলেও তার অমর্যদা করতেন না। কোন কিছুর নিন্দা সমালোচনা করতেন না। পানাহারের জিনিসের সমালোচনা করতেন না। সত্য ও ন্যায়ের পরিপন্থী কোন আচরণ কারো দ্বারা প্রকাশিত হরে তার প্রতি তিনি বিরক্ত হতেন। সেই লোকের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ না করা পর্যন্ত নিবৃত্ত হতেন না। তবে, তাঁর মন ছিলো উদার। নিজের জন্যে কারো ওপর ক্রদ্ধ হতেন না এবং কারো কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন না। কারো প্রতি ইশার করতে হাতের পুরো তালু ব্যবহার করতেন। বিস্ময়ের সময় হাত ওল্টাতেন। ক্রদ্ধ হলে অন্য দিকে মুখ ফেরাতেন এবং খুশী হলে দৃষ্টি নিচু করতেন। অধিকাংশ সময়েই তিনি মৃদু হাসতে। মৃদু হাসির সময় দাঁতের কিয়দংশ ঝকমক করতো।
অর্থহীন কথা থেকে বিরত থাকতেন। সাথীদের একত্রিত করে রাখার চেষ্টা করতেন, পৃথক করার চেষ্টা করতেন না। সকল সম্প্রদায়ের সম্মানিত লোকদের সম্মান করতেন। সম্মানিত লোককেই নেতা নিযুক্ত করতেন। মানুষের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকতেন।
সাহাবাদের খবরাখবর নিতেন। তাদের কুশল জিজ্ঞাসা করতেন। ভালো জিনিসের প্রশংসা এবং খারাপ জিনিসের সমালোচনা করতেন। সব বিয়য়েই মধ্যপন্থা পছন্দ করতেন। কোন বিষয়ে অমনোযোগী থাকা ছিলো তাঁর অপছন্দ। যে কোন অবস্থার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতেন। সত্য ও ন্যায় থেকে দূরে থাকা পছন্দ করতেন না। অসত্য থেকে দূরে থাকতেন। তার সন্নিকটে যারা থাকতেন, তারা ছিলেন সবচেয়ে ভালো মানুষ। ওদের মধ্যে তারাই ছিলেন তার কাছে ভালো, যারা ছিলেন পরোপকারী। তাঁর কাছে ওদের মর্যাদাই ছিলো অধিক অর্থাৎ তার দৃষ্টিতে তারাই ছিলেন সর্বোত্তম, যারা ছিলেন অন্যের দুঃখে কাতর, স্বভাবতই গম্ভীর এবং অন্যের সাহয্যকারী।
তিনি উঠতে বসতে সর্বদাই আল্লাহকে স্মরণ করতেন। তাঁর বসার জন্যে নির্ধারিত কোন জায়গা ছিলো না। কোন জনসমাবেশ গেলে যেখানে জায়গা খালি পেতেন সেখানেই বসতেন। উপস্থিত সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখতেন। কারো মনে একথা জাগত না যে, অমুককে আমার চেয়ে বেশী মর্যাদা দেয়া হচ্ছে এবং এজন্যে তার মনে কোন ক্ষোভ বা দুঃখ সৃষ্টি হতো না। কেউ কোন প্রয়োজনে তাঁর কাছে বসলে বা দাঁড়ালে সেই লোকের প্রয়োজন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করতেন। তার ধৈর্যের কোন বিচ্যুতি দেখা যেত না। কেউ তাঁর কাছে কোন কিছু চাইলে তিনি অকাতরে দান করতেন। প্রার্থিত বস্তু প্রদান অথবা ভালো কথা বলে তাকে খুশী না করা পর্যন্ত প্রার্থীকে বিদায় করতেন না। তিনি নিজের উন্নত চরিত্র বৈশিষ্টের মাধ্যমে সবাইকে সন্তুষ্ট করতেন। তিনি ছিলেন সকলের জন্যে পিতৃতুল্য। তাঁর দৃষ্টিতে সবাই ছিলো সমান। কারো শ্রেষ্ঠত্ব বা মর্যাদার আধিক্য নির্ণিত হলে সেটা তাকওয়ার ভিত্তিতে নির্ণিত হতো। তাঁর মজলিস বা সমাবেশ ছিলো জ্ঞান, ধৈর্য, লজ্জাশীলতা ও আমানতদারীর মজলিস। সেখানে কেউ উচ্চস্বরে কথা বলতো না, কারো মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হতো না। তাকওয়ার ভিত্তিতে সকলেই সকলের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করতো। বায়োজ্যেষ্ঠকে সবাই সম্মান এবং ছোটকে স্নেহ করতো। কারো কোন প্রয়োজন দেখা দিলে সেই প্রয়োজন পূরণ করা হতো। অপরিচিত লোককে অবজ্ঞা বা উপেক্ষা করা হতো না, বরং তার সাথে পরিচিত হয়ে আন্তরিকতা প্রকাশ করা হতো।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারায় সবসময় স্মিতভাব বিরাজ করতো। তিনি ছিলেন নরম মেজাযের। রুক্ষতা ছিলো তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ। বেশী জোরে কথা বলতেন না। অশালীন কোন কথা তাঁর মুখে উচ্চারিত হতো না। কারো প্রতি রুষ্ট হলেও তাকে ধমক দিয়ে কথা বলতেন না। কারো প্রশংসা করার সময়ে অতি মাত্রায় প্রশংসা করতেন না। যে জিনিসের প্রতি আগ্রহী না হতেন, সেটা সহজেই ভুলে থাকতেন। কোন ব্যাপরেই কেউ তাঁর কাছে হতাশ হতেন না। তিনটি বিষয় থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত রাখতেন। এগুলে হচ্ছে, (১) অহঙ্কার, (২) কোন জিনিসের বাহুল্য এবং (৩) অর্থহীন কথা। আর তিনটি বিষয় থেকে লোকদের নিরাপদ রাখতেন। এগুলো হচ্ছে, (১) পরের নিন্দা (২) কাউকে লজ্জা দেয়া এবং (৩) অন্যের দোষ প্রকাশ করা।
তিনি এমন কথাই শুধু মুখে আনতেন যে কথায় সওয়াব লাভের আশা থাকতো। তিনি যখন কথা বলতেন, তখন তার সাহাবীরা এমনভাবে মাথা নিচু করে বসতেন যে, দেখে মনে হতো তাদের মাথার ওপর চড়ুই পাখী বসে আছে।সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কথা শেষ করে নীরব হলে সাহাবারা নিজেদের মধ্যে কথা বলতেন। কোন সাহাবী প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বাহুল্য কোন কথা বলতেন না। কোন সাহাবী প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন কথা বলতে শুরু করলে উপস্থিত অন্য সবাই মনোযোগ দিয়ে সেকথা শুনতেন। কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত নীরবতা বজায় থাকতো। যে কথা শুনে সাহাবারা হাসতেন, সে কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হাসতেন। যে কথা শুনে সাহবারা অবাক হতেন, সে কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ও অবাক হতেন। অপরিচিত লোক কথা বলার ক্ষেত্রে অসংযমী হলে নবী ধৈর্য হারাতেন না। তিনি বলতেন, কাউকে পরমুখাপেক্ষী দেখলে তার প্রয়োজন পূরণ করে দাও। ইহসানের পারিশ্রমিক ছাড়া অন্য কারো প্রশংসা কোন ব্যাপারেই তাঁর পছন্দনীয় ছিলো না। ৪০[শাফা, কাযী আয়ায, ১ম খন্ড, ১২১-১২৬ শামায়েলে তিরমিযি।]
হযরত খারেজা ইবনে যায়েদ (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মজলিসে সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদাশীল ছিলেন। পোশাক পরিধানে তিনি ছিলেন শালীন। অধিকাংশ সময় নীরবতা পালন করতেন। বিনা প্রয়োজনে কথা বলতেন না। যে ব্যক্তি অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতো, তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন তিনি যখন হাসতেন, মৃদু হাসতেন, সুস্পষ্টভাবে কথা বরতেন, ফালতু ও অপ্রয়োজনীয় কথা বলতেন না। সাহাবারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে উচ্চ স্বরে হাসতেন না, তাঁরা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপস্থিতিতে হাসি সংযত রাখতেন এবং মৃদু হাসতেন। ৪১[১৬ই রমযান ১৪০৪ হিজরী মোতাবেক ১৭ই রমযান ১৯৮৪ ইং]
মোটকথা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তুলনাহীন গুণবৈশিষ্টের অধিকারী একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ ছিলেন। রব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালা তাঁকে অতুলনীয় বৈশিষ্ট দান করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় নবীর সম্মানে বলেছেন, ‘ইন্নাকা লা আলা কুলুকিন আযীম’, অর্থাৎ নিসন্দেহে আপনি সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।
এটি ছিলো এমন তুলনাবিহীন গুন যার কারণে মানুষ তার প্রতি ছুটে আসতে। তাঁর প্রতি মানুষের মনে ভালোবাসা ছিলো বদ্ধ মূল। তাঁর নেতৃত্ব এমন অবিসম্বাদিত ছিলো যে,মানুষ ছিলো তাঁর প্রতি নিবেদিত প্রাণ।
মানবীয় গুণাবলীর সর্বোত্তম বৈশিষ্টের কারণে তাঁর স্বজাতির রুক্ষ্ণতা, একেবারে নমনীয়তায় পরিবর্তিত হয়েছিলো। পরিশেষে মানুষ দলে দলে আল্লাহর মনোনীত দ্বীনের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে ধন্য হয়েছিলো।
স্মরণ রাকতে হবে যে, ইতিপূর্বে আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে সকল গুণাবলী আলোচনা করেছিলাম সেসব ছিলো তার অসাধারণ ও অতুলনীয় গুণাবলীর সামান্য রেখাচিত্র। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর গুণাবলী এতো ব্যাপক ও বিস্তৃত ছিলো যে, সেসব গুণাবলীর আলোচনা করে শেষ করা সম্ভব নয় এবং তাঁর চরিত্র বৈশিষ্টের ব্যাপকতা ও গভীরতা নিরূপণ করাও সম্ভব নয়।
মানবেতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ নিরূপণ কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। পূর্ণতার শ্রেষ্ঠতম আদর্শ এ মহান মানুষের পরিচয় এই যে, তিনি মানবতার সর্বোচ্চ চূড়ায় সমাসীন ছিলেন। তিনি মহান রব্বুল আলামীনের পবিত্র আলোক আভায় এমনভাবে আলোকিত ছিলেন যে, কোরআনে করিমকে তাঁর চরিত্রের পরিচয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর চরিত্র বৈশিষ্ট্য ছিলো পবিত্র কোরআনেরই বাস্তব ও পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন।
‘হে আল্লাহ তায়ালা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর এবং তাঁর পরিবারর-পরিজনের ওপর তুমি শান্তি ও বরকত নাযিল করো, যেমন শান্তি ও বরকত নাযিল করেছিলে হযরত ইবরাহিম (আ.)ও তাঁর পরিবারর-পরিজনের ওপর। নিশ্চ তুমি প্রশংসা ও মর্যাদার অধিকারী।
সে ব্যক্তির জন্যে ততোটুকুই (পুরস্কার) রয়েছে যতোটুকু সে
(এ দুনিয়ায়) করে এসেছে, আবার (শাস্তিও) তার
জন্যে তাতোটুকু রয়েছে, যতোটুকু অন্যায় সে
করেছে, (অতএব) হে আমাদের মালিক,
যদি আমর কিছু ভুলে যািই , কোথায়ও
যদি আমরা কোনো ভুল করে বসি,
তার জন্যে তুমি আমাদের পাকাড়াও করো না।