তৃতীয় পর্যায়ঃ হোনায়েনের যুদ্ধ
এটা ছিলো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়তী জীবনের শেষ পর্যায়। প্রায় তেইশ বছরের শ্রম সাধনায় তিনি যে কষ্ট করেছিলেন তাঁর জীবনের এই পর্যায় ছিলো সেই স্বীকৃতি।
এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে মক্কা বিজয় ছিলো নবী (সাঃ) এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। এ বিজয়ের ফলে পরিস্থিতির যুগান্তকারী পরিবর্তন হয় এবং আরবের পরিবেশ পরিস্থিতিতে পরিবর্তন দেখা দেয়। এ বিজয় ছিলো পূর্বাপর সময়ের মধ্যে সেতুবন্ধন। আরব জনগণের দৃষ্টিতে কোরায়াশ ছিলো দ্বীনের হেফাজতকারী ও সাহায্যকারী। সমগ্র আরব ছিলো এ ক্ষেত্রে তাদের অধীনস্থ। কোরায়শদের পরাজয়ের অর্থ হচ্ছে এই যে, সমগ্র আরব ভূখন্ড মূর্তিপূজা সমূলে উৎপাটিত হয়েছে চিরদিনের জন্যে।
উল্লিখিত শেষ পর্যায়টি দুইভাগে বিভক্ত। এক. মোজাহাদ ও যুদ্ধ। দুই. ইসলাম গ্রহণের জন্যে বিভিন্ন কওম ও গোত্রের ছুটে আসা। এ উভয় অবস্থা পরস্পরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
হোনায়েনের যুদ্ধ
আকস্মিক অভিযানে মক্কা বিজয় সংঘটিত হয়েছিলো। এতে আরবের জনগণ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো। প্রতিবেশী গোত্রসমূহের মধ্যে এ অপ্রতাশিত অভিযানের মোকবেলা করার শক্তি ছিলো না। এ কারণে শক্তিশালী অহংকারী উচ্ছৃঙ্খল কিছু গোত্রসমূহ এবং বনু বেলালের কিছু লোক শামিল হয়েছিলো। এসব গোত্রের সম্পর্ক ছিলো কাইসে আইলানের সাথে। মুসলমানদের কাছে আত্মসমর্পণ করা তারা আত্মমর্যাদার পরিপন্থী মনে করছিলো। তাই তারা মালেক ইবনে আওফ নসরীর কাছে গিয়ে মুসলমানদের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত নিলো।
শত্রুদের রওয়ানা এবং আওতাস-এ উপস্থিতি
সিদ্ধান্তের পর মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করতে মালেক ইবনে আওফের নেতৃত্বে সকল সমবেত সকল অমুসলিম রওয়ানা হলো। তারা তাদের পরিবার-পরিজন এবং পশুপাল নিজেদের সঙ্গে নিয়ে চললো। আওতাস প্রান্তরে তারা উপস্থিত হলো। আওতাস হচ্ছে হোনায়েনের কাছে বনু হাওয়ানে এলাকার একটি প্রান্তর। কিন্তু এ প্রান্তর হোনায়েন থেকে পৃথক। হোনয়েন একটি পৃথক প্রান্তর। এটি যুল মাজাজ-এর সন্নিকটে অবস্থিত। সেখান থেকে আরাফাত হয়ে মক্কার দূরত্ব দশ মাইলের বেশী। ১[ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড,পৃ.২৭,৪২]
শত্রুদের সৈন্য সমাবেশ
আওতাস-এর অরতরণের পর লোকেরা কমান্ডার মালেক ইবনে আওফের সামনে হাযির হলো। এদের মধ্যে প্রবীণ সমর বিশারদ দুরাইদ ইবনে ছোম্মাও ছিলো। এই লোকটি বয়সের ভারে ছিলো ন্যুজ। বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিলো তার। এক সময় সে ছিলো বীর যোদ্ধা। এখন অভিজ্ঞতা বর্ণনা এবং সে আলোকে পরামর্শ দেয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। সে মালেককে জিজ্ঞাসা করলো যে, তোমরা কোন প্রান্তরে রয়েছো? তাকে বলা হলো, আওতাস প্রান্তরে। সে বললো, এটা সৈন্য সমাবেশের উপযুক্ত জায়গা। কিন্তু গাধা, উট, ঘোড়ার ডাকাডাকি, শিশু সন্তানের কান্না মেয়েদের গলার আওয়ায পাচ্ছি। তাকে জানানো হলো যে, কমান্ডার মালেক ইবনে আওফ সৈন্যাদের সাথে তাদের পরিবার-পরিজন এবং পশুপালও নিয়ে এসেছে। দুরাইদ এর কারণ জানতে চাইলে তাকে বলা হলো যে, প্রত্যেক যোদ্ধা তার কাছে মজুদ স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এবং পশুপালের আকর্ষণে বীরত্বের সাথে লড়াই করবে।
মালেক ইবনে আওফের এ জবাব শুনে দুরাইদ বললো, আল্লাহর কসম, তুমি ভেড়ার রাখাল। পরাজিত ব্যক্তিকে কোন কিছু কি ধরে রাখতে পারে? দেখো, যুদ্ধে যদি তুমি জয়ী হও, তবে তলোয়ার এবং বর্শা দ্বারাই উপকৃত হবে। আর যদি পরাজিত হও তবে অপমানিত হবে। কারণ পরাজিত যোদ্ধার স্ত্রী, পুত্র, পরিবার এবং পশুপাল কিছুই নিরাপদ থকবে না। দুরইদ বিভিন্ন গোত্রের সর্দারদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো। সব কথা শোনার পর কমান্ডারকে বললো, হে মালেক, তুমি বনু হাওয়াযেন গোত্রের পরিবার-পরিজন ও পশুদল নিয়ে এসে ভাল কাজ করোনি। তাদেরকে নিজ জিন এলাকর নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দাও। পেরে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তোমরা বে-দ্বীনের সাথে লড়াই করো। যদি তুমি জয়লাভ করো তবে পেছনের যারা থাকবে তারা এসে তোমাদের সথে মিলিত হব্। যদি পরাজিত হও, তবে ওরা নিরাপদ থাকবে।
কমান্ডার মালেক ইবনে আওফ এ পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে বললো, খোদার কসম, আমি তা করতে পারি না। তুমি বুড়ো হয়েছো তোমার বুদ্ধিও বুড়ো হয়ে গেছে। হয়তো হাওয়াযেন গোত্র আমার আনুগত্য করবে আমি তলোয়ারের ওপর হেলান দিয়ে আত্মহত্যা করবো। মোটকথা, দুরাইদের নাম বা তার পরামর্শ এ যুদ্ধে শামিল হোক, এটা মালেক পছন্দ করলো না। হাওয়াজেন গোত্রের লোকেরা বললো, আমরা তোমার আনুগত্যে অটল রয়েছি। দুরাইদ বললো, আমি এ যুদ্ধের সাথে নাই। এ যুদ্ধের কোন দায়দায়িত্ব আমার নাই। হায়, আজ যদি আমি জওয়ান হতাম, যদি আমার ছুটোছুটি করার মতো বয়স থাকতো, তাবে আমি লম্বা পশমের মাঝারি সাইজের বকরির মতো ঘোড়ার নেতৃত্ব করতাম
শত্রুদের গুপ্তচর
মুসলমানদের খবর সংগ্রহে মালেক ইবনে আওফ দু’জন গুপ্তচর পাঠালো। তারা গন্তব্যে পৌঁছার আগেই ফিরে এলো। তারা ছিলো চলৎশক্তিহীন। কমান্ডারের কাছে তাদের হাযির করার পর কমান্ডার বললো, তোমাদের সর্বনাশ হোক, এ অবস্থা হলো কেন? তারা বললো, আমরা কয়েকটি চিত্রল ঘোড়া এবং মানুষ দেখেছি, এরপরই আমাদের এ অবস্থা হয়েছে।
একদিকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শত্রুদের নান রকম খবর পাচ্ছিলেন। তিনি আবু হাদরাদ আসলামিকে বললেন, তুমি যাও, শত্রুদের মাঝে গিয়ে অবস্থান করে তাদের খবরাখবর এনে দাও। তিনি তাই করলেন।
মক্কা থেকে হোনায়েনের পথ যাত্রা
অষ্টম হিজরীর ৬ই শাওয়াল রোববরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে হোনায়েনের উদ্দেশ্যে রওয়ান হলেন। এটা ছিলো তাঁর মক্কায় আগমনের উনিশতম দিন। তাঁর সঙ্গে ছিল ১২ হাজার সৈন্য। এদের মধ্যে ১০ হাজার মদীন থেকে মক্কায় এসেছিলেন, বাকি ২ হাজার মক্কা থেকে রওয়ান হন। মক্কার ২ হাজারের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন নও মুসলিম। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফওয়ান ইবনে উমাইয়ার কাছ থেকে অস্ত্রসহ একশত বর্ম ধার নিলেন। আত্তাব ইবনে আছিদকে মক্কার গভর্ণর নিযুক্ত করলেন।
দুপুরের পরে একজন সাহাবী এসে বললেন, আমি অমুক পাহাড়ে উঠে দেখেছি বনু হাওয়াযেন সপরিবারে যুদ্ধ করতে এসেছে। তারা নিজেদের পশুপালও সঙ্গে এনেছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেসে বললেন, ইনশা আল্লাহ আগামীকাল এগুলো মুসলমানদের গনীমতের মাল হবে। রাতের বেলা হযরত আনাস ইবনে মারছাদ প্রহরীর দায়িত্ব পালন করলেন।
পথে সাহাবারা যাতে আনওয়াত নামে একটি কূল গাছ দেখলেন। মক্কার মোশরেকরা এ গাছের সাথে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র ঝুলিয়ে রাখতো। এর পাশে পশু যবাই করতো এবং এর নীচে মেলা বসাতো। কয়েকজন সহযোদ্ধা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, ওদের যেমন যাতে-আনওয়াত নামে গাছ রয়েছে আপনি আমাদের জন্যেও ওরকম একটি গাছ তৈরী করে দিন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহু আকবর, সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তোমরাতো সেই রকম কথা বলেছো , যে রকম কথা হযরত মুসার কওম তাঁকে বলেছিলো। তারা বলেছিলো, ‘এজআল লানা এলাহান কামা লাহুম আলেহাতুন।’ অর্থাৎ আমাদের জন্যে একজন মাবুদ বানিয়ে দিন, যেমন ওদের জন্যে মাবুদ রয়েছে। তোমরা তো দেখছি পূর্ববর্তীদের তরিকার ওপরই উঠে পড়েছো। ৩[তিরমিযি, ফেতান, মোসনাদে আহমদ ৫ম খন্ড, ২৮১]
কিছু লোক সৈন্য সংখ্যার আধিক্য দেখে বললেন, আমরা আজ কিছুতেই পরাজিত হব না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথাটিও পছন্দ করলেন না।
মুসলমানদের আকস্মিক হামলাঃ
১০ই শাওয়াল মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ইসলামী বাহিনী হোনয়েনে পৌঁছুলো। মালেক ইবনে আওফ আগেই এ জায়গায় পৌঁছে রাতের অন্ধকারে তার সৈন্যদের বিভিন্ন স্থানে গোপনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিলো। তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো যে, মুসলমানরা আসা মাত্র তাদের ওপর তীর নিক্ষেপ করবে এবং কিছুক্ষণ পর একজোটে হামলা করবে।
এদিকে খুব প্রত্যুষে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৈন্যদের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করলেন। খুব ভোরে মুসলিম সৈন্যরা হোনায়েনের প্রান্তরে পদার্পন করলেন। শত্রুসৈন্য সম্পর্কে তারা কিছুই জানতেন না। শত্রুরা যে ওঁৎ পেতে রয়েছে এ সম্পর্কে অনবহিত মুসলমান সৈন্যরা নিশ্চিন্তে অবস্থান নেয়ার সময় হঠাৎ করে তাদের ওপর তীরবৃষ্টি শুরু হলো। কিছুক্ষণ পরই শত্রুরা একযোগে মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। মুসলমানরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করলেন। এটা ছিলো সুস্পষ্ট পরাজয়। নও মুসলিম আবু সুফিয়ান বললেন, ওরা সমুদ্রপারে না গিয়ে থামবে না। জাবালা অথবা কালদা ইবনে জোনায়েদ বললো, দেখো আজ যাদু বাতিল হয়ে গেছে। ইবনে ইসহাক এটা বর্ণনা করেছেন। বারা ইবনে আযেব বলেন, সহীহ বোখারীতে উল্লেখ রয়েছে যে, বনু হাওয়াযেন ছিলো তীরন্দাজ, আমরা হামলা করলে তারা পালিয়ে গেলো। এরপর আমরা গনীমতের মাল সংগ্রহ করতে লাগলাম। ইতিমধ্যে শত্রুরা তীর বৃষ্টি দিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। ৪[সহীহ বোখারী, ইয়ওমে হোনায়েন অধ্যায়]
সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, হযরত আনাস বলেন, আমরা মক্কা জয় করেছি। পরে হোনায়েনে অভিযান চালিয়েছি। মোশরেকরা চমৎকার সারিবদ্ধভাবে এসেছিলো। অমন সুশৃঙ্খল অবস্থা আমি কখনো দেখিনি। প্রথম সওয়ারদের সারি, এরপর পদব্রজীদের সারি, তাদের পেছনে মহিলারা এর পেছনে পেছনে ভেড়া বকরি, তারপর পশুপাল। আমরা সংখ্যায় ছিলাম অনেক। আমাদের সৈন্যদের ডানদিকে ছিলেন হযরত খালেদ (রা.)। কিন্তু আমাদের সওয়ার আমাদের পেছনে আত্মগোপন করতে লাগরেন, কিছুক্ষণ পর তারা পলায়ন করলেন। আরবরাও পলায়ন করলো। ওরাও পলায়ন করলো, যাদের সম্পর্কে তোমরা জানো। ৫[ফতহুর বারী, ৮ম খন্ড, পৃ.৮]
সাহবারা ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডানদিকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, হে লোক সকল, তোমরা আমার দিকে এসো, আমি আবদুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদ। সেই সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কয়েকজন মোহজেরে এবং তাঁর বংশের সাহাবারা ছাড়া অন্য কেউ ছিলো না। ৬[ ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুযায়ী তাদের সংখ্যা চিলো নয় বা দশজন। নবীজি বলেন, আল্লাহ রসূলের সাথে বারোজন দৃঢ়পদ ছিলেন। সাহাবার নিরাপদে আশ্রয়ের জন্য চলে গিয়েছিলেন। আল্লাহর রসূলের সঙ্গে আশিজন দৃঢ়ভাবে অবস্থান করেন। আমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিনি। তিরমিযি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর বর্ণিত হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি দেখলাম, নিজের লোকেরা হোনায়েনের দিনে পৃষ্ট করলো। আল্লাহর রসূলের সাথে একশ জন সাহাবীও ছিলেন না।]
সেই নাযুক সময়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নযিরবিহীন বীরত্ব ও সাহসিকাতার পরিচয় দিলেন। তিনি শত্রুদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন এবং উচ্চস্বরে বলছিলেন, আনান্নবিউল লা কাযেব আনা ইবনু আবদুল মোত্তালেব অর্থাৎ আমি নবী, আমি মিথ্যাবাদী নই, আমি আবদুল মোত্তালেবের পুত্র।
সেই সময় আবু সুফিয়ান এবং হযরত আব্বাস রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খচ্চর ধরে রেখেছিলেন যাতে করে খচ্চর সামনের দিকে ছুটে যেতে না পারে। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর চাচা হযরত আব্বাসকে বললেন, লোকদের যেন তিনি উচ্চস্বরে ডাকতে শুর করেন। হযরত আব্বাসের ছিলো দরাজ গলা। হযরত আব্বাস বলেন, আমি উচ্চ কন্ঠে ডাকলাম, কোথায় তোমরা বৃক্ষওয়ালা, বাইয়াতে রেদওয়ানওয়ালা। সাহাবার আমার কন্ঠ শুনে এমনভাবে ছুটে আসতে শুরু করলেন যেমন গাভীর আওয়ায শুনে বাছুর ছুটে আসে। সাহাবারা বললেন, আমরা আসছি। ৭[সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ-১০০]
সাহাবারা ছুটে আসতে শুরু করলে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চারিদিকে একশত সাহাবী সমবেত হলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শত্রুর মোকাবেলা করলেন। যুদ্ধ শুরু হলো।
এরপর আনসারদের ডাকা হলো। ক্রমে বনু হারেস ইবনে খাযরাজের মধ্যে এই ডাক সীমিত হয়ে পড়লো। এদিকে সাহাবারা রণাঙ্গণ থেকে যেভাবে দ্রুত চলে গিয়েছিলেন, তেমনি দ্রুত ফিরে আসতে লাগলেন। দেখতে দেখতে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রণাঙ্গনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার চুলো গরম হয়েছে। এরপর একমুঠো ধুলো তুলো ‘শাহাতুল উজুহ’ বলে শত্রুদের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করলেন। এর অর্থ হচ্ছে চেহারা বিগড়ে যাক। নিক্ষিপ্ত ধুলোর ফলে প্রত্যেক শত্রুর চোখ ধুলি ধুসরিত হলো। তারা পৃষ্ট প্রদর্শন করে প্রাণ নিয়ে পালাতে শুরু করলো।
শত্রুদের পরাজয়
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধুলো নিক্ষেপের পরই যুদ্ধের চেহারা পাল্টে গেলো শত্রুরা পরাজিত হলো। ছাকিফা গোত্রের ৭০ জন কাফের নিহত হলো। তাদের নিয়ে আসা অস্ত্র ধন-সম্পদ, রসদ, সামগ্রী, নারী, শিশু, পশুপাল সবকিছু মুসলমানদের হস্তগত হলো।
আল্লাহ রব্বুল আলামীন এ সম্পর্কে বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে সাহায্য করেছেন বহু ক্ষেত্রে এবং বিশেষ করে হোনায়নের যুদ্ধের দিনে, যখন তোমাদেরকে উৎফুল্ল করেছিলো তোমাদের সংখ্যাধিক্যে এবং তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি এবং বিস্তৃত হওয়া সত্তেও পৃথিবী তোমদের জন্যে সঙ্কুচিত হয়েছিলো এবং পরে তোমরা পৃষ্ট প্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে, অতপর আল্লাহ তায়ালা তাঁর কাছ থেকে তাঁর রসূল এবং মোমেনদের ওপর প্রশান্তি বর্ষণ করেন এবং এমন এক সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করেন যা তোমরা দেখতে পাওনি এবং তিনি কাফেরদের শাস্তি প্রদান করেন। এটা কাফেরদের কর্মফল।‘(সূরা তাওবা, আয়াত ২৫-২৬)
শত্রুদের গমন পথে ধাওয়াঃ
উভয় পক্ষে কিছুক্ষণ মোকাবেলার পরই মোশরেকরা পলায়নের পথ ধরলো। পরাজয়ের পর একদল শত্রু তায়েফের পথে অগ্রসর হলো। একদল নাখলার দিকে এবং একদল আওতাসের পথে অগ্রসর হলো। উভয় পক্ষের সংঘর্ষে সাহাবাদের মধ্যে হযরত আবু আমের আশআরী (র.)শাহদাত বরণ করেন। তিনি একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন।
একদল সহাবী নাখলার পথে গমনকারী অমুসলিমদের ধাওয়া করলেন। দুরাইন ইবনে ছোম্মাকে পাকড়াও করা হলো। হযরত রাবিয়া ইবনে রফি তাকে হত্যা করলেন।
পরাজিত শত্রুদের সবচেয়ে বড় দল তায়েফের দিকে অগ্রসর হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গনীমতের মাল জমা করার পর তায়েফের পথে রওয়ানা হলেন।
গনীমত
গনীমতের মালের বিবরণ নিম্মরূপ। যুদ্ধবন্দী ৬ হাজার, উট ২৪ হাজার। বকরি ৪০ হাজারের বেশী। চাঁদি ৪ হাজার উকিয়া। অর্থাৎ ১ লাখ ৬০ হাজার দিরহাম। এর ওজন ৬ কুইন্টালের চেয়ে কয়েক কিলো কম। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমুদয় মালামাল জমা করার নির্দেশে দিলেন। যেরানা নামক জায়গায় সমুদয় সম্পদ একত্রিত করে হযরত মাসউ ইবনে আমর গেফারী (রা.)-এর নিয়ন্ত্রণে রাখলেন। তায়েফ যুদ্ধ থেকে অবসর না পাওয়া পর্যন্ত এগুলো বন্ট করা হয়নি।
বন্দীদের মধ্যে শায়মা বিনতে হারেস সাদিয়াও ছিলেন। ইনি ছিলেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দূধবোন। তাঁকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে এসে তাঁর পরিচয় দেয়ার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি চিহ্নের দ্বারা তাকে চিনতে পারেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে যথেষ্ট সম্মান করেন। নিজের চাদর বিছিয়ে তাকে বসতে দেন। সাদিয়ার মতামত অনুসারে তার প্রতি অনুগ্রহ দেখিয়ে তিনি তাকে নিজের গোত্রের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেন।
তায়েফের যুদ্ধ
এ যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে হোনায়েনের যুদ্ধেরই অংশ। হাওয়াযেন ও ছাকিফ গোত্র পরাজিত লোকদের অধিকাংশই তাদের কমান্ডার মালেক ইবনে আওফ নসরীর সাথে তায়েফে চলে গিয়ে আত্মগোপন করেছিলো তাই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফের পথে রওয়ান হলেন।
প্রথমে খালিদ ইবনে ওলীদের নেতৃত্বে এক হাজার সৈন্য পাঠানো হয়, এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রওয়ান হন। পথে নাখলা, ইমানিয়া এবং মনযিল অতিক্রম করেন। লিয়াহ নামক জায়গায় মালেক ইবনে আওফের একটি দুর্গ ছিলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশে সেই দুর্গ ধ্বংস করে দেয়া হয়। এরপর সফর অব্যাহত রেখে তয়েফ পৌঁছার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফ দুর্গ অবরোধ করেন।
অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী হয়। সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আনাসের (রা.) বর্ণনা অনুযায়ী এই অবরোধ ৪০ দিন স্থায়ী হয়। কোন কোন সীরাত রচয়িতা ২০ দিন বলেও উল্লেখ করেছেন। কেউ ১০, কেউ ১৫ আবার কেউ ১৮ দিন উল্লেখ করেছেন। ৮[ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড,পৃ-৪৫]
অবরোধকালে উভয় পক্ষের মধ্যে তীর ও পাথর নিক্ষেপ করা হয়। মুসলমানদের প্রথম অবরোধকালে তাদের ওপর লাগাতার তীর নিক্ষেপ করা হয়। প্রথম অবস্থায় মুসলমানরা অবরোধ শুরু করলে দূর্গের ভেতর থেকে তাদের ওপর এতো বেশী তীর নিক্ষেপ করা হয়েছিলো যে মনে হয়েছিলো পঙ্গপাল ছায়া বিস্তার করেছে। এতে কয়েকজন মুসলমান আহত এবং ১২ জন শহীদ হন। ফলে মুসলমানরা তাঁবু সরিয়ে কিছুটা দূরে নিয়ে যান।
এর পরিস্থিতি মোকাবেলায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ যন্ত্র স্থাপন করেন এবং দূর্গ লক্ষ্যে করে কয়েকটি গোলা নিক্ষেপ করেন। এতে দেয়ালে ফাটল ধরে ছিদ্র হয়ে যায়। সাহাবারা সেই ছিদ্র দিয়ে তাদের প্র্রতি পাথর নিক্ষেপ করেন। কিন্তু শত্রুদের পক্ষ থেকে বৃষ্টির মতো তীর নিক্ষেপ করা হয়, এতে কয়েকজন মুসলমান শহীদ হন।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শত্রুদের কাবু করতে কৌশল হিসাবে আঙ্গুর গাছ কেটে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। এতে বিচলিত ছকিফ গোত্র আল্লাহ তায়ালা এবং আত্মীয়তার সম্পর্কের দোহাই দিয়ে এ কাজ থেকে বিরত থাকার আবেদন জানালো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা মঞ্জুর করলেন।
অবরোধের সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা করলো যে, ক্রীতদাস দূর্গ থেকে নেমে আমাদের কাছে আসবে, সে মুক্ত। এতে ত্রিশজন লোক দূর্গ থেকে এসে মুসলমানদের সাথে শামিল হয়। ৯[সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-২৬০]
আগত ক্রীতদাসদের মধ্যে হযরত আবু বকরাহও ছিলেন। দুর্গের দেয়ালে উঠে ঘূর্ণায়মান চরকার মাধ্যমে তিনি নীচের দিকে ঝুলে পড়েন এবং মুসলমানদের কাছে এস আত্মসমর্পণ করেন। আবরবী ভাষায় ঘারাবিকে বকরাহ বলা হয়। এ কারণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগন্তুক এ ক্রীতদাসের উপাধি দিলেন আবু বকরাহ। কথঅ অনুযায়ী মুসলমানের কাছে এস আত্মসমর্পণকারী ক্রীতদাসদের রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুক্ত করে দিলেন এবং তাদেরকে ত্রিশজন সহাবীর দায়িত্বে দিয়ে বললেন, তাদেরকে প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে দাও। এ ঘটনা দুর্গের শত্রুদের জন্যে বড়োই মারাত্মক হয়ে দাঁড়ালো।
অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়লো এবং শত্রদের আত্মসমর্পণের কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। তারা বছরের খাদ্য দুর্গের ভেতরে মজুদ করে রেখেছিলো। এ সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নওফেল বিনে মাবিয়া দয়লির সাথে পরামর্শ করেন। নওফেল বলেন, শৃগাল তার গর্তে গিয়ে ঢুকেছে। যদি আপনি অবরোধ দীর্ঘায়িত করেন, তবে তাদের পাকড়াও করতে পারবেন। আর যদি ফিরে যান, তবে তারা আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। একথা শুনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবরোধ অবসানের সিদ্ধান্ত নিলেন। হযরত ওমর (রা.) সাহাবাদের মধ্যে ঘোষণা প্রচার করলেন যে, ইনশা আল্লাহ আগামীকাল আমরা ফিরে যাব । সহাবারা এ ঘোষণার সমালোচনা করলেন। তারা বললেন, এটা কেমন কথা? তায়েফ জয় না করে আমরা ফিলে যাব? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহবাদের ভিন্নমত শুনে বললেন, আচ্ছা কাল সকালে যুদ্ধে চলো। পরদিন সাহাবারা যুদ্ধে গেলেন, কিন্তু আঘাত খেয়ে ফিরে আসা ছাড়া অন্য কোন লাভ হলো না। এ অবস্থা দেখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ইনশা আল্লাহ আগামী আমরা ফিরে যাবো। সর্বস্তরের সাহাবারা এ সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। তারা চুপচাপ জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে শুরু করলেন। এ অবস্থা দেখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃদু হাসতে লাগলেন।
সাহবায়ে কেরাম ফিরে যাওয়ার পথে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আয়েবুনা তায়েবুন আবেদুনা লেরাব্বেনা হামেদুন।’ অর্থাৎ তোমরা প্রত্যাবর্তনকারী, তওবাকারী, এবাদাতগুজার এবং তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রশংসা করতে থাকো।
সাহাবারা বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ছাকিফের লোকদের জন্যে বদদোয়া করুন। তিনি বললেন, হে আল্লাহ তায়ালা ছাকিফকে হেদায়াত করুন এবং তাদের নিয়ে আসুন।
যেরানায় গনীমতের মাল বন্টন
তায়েফ থেকে অবরোধ তুলে আসার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জেরানায় সঞ্চিত গনীমতের মাল ভাগ বাটোয়ারা করা থেকে বিরত থাকলেন। এ দেরীর কারণ ছিলো এই যে, তিনি চাচ্ছিলেন, হাওয়াযেন গোত্রের লোকেরা ফিরে এসে তওবা করলে তিনি তাদের সবকিছু ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু অপেক্ষা করার পরও কেউ আসল না। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গনীমতের মাল বন্টন করতে শুরু করলেন। বিভিন্ন গোত্রের সর্দার এবং মক্কার নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিগণ গনীমতের মাল পাওয়ার আশায় উন্মুখ ছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সকল নবদীক্ষিত মুসলমানদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণে গনীমতের মাল প্রদান করলেন। ১০[ যাতে তারা ইসলামের ওপর দৃঢ় থাকে]
আবু সুফিয়ান ইবনে হারবকে ৪০ উকিয়া অর্থাৎ প্রায় ৬ কিলো রূপা অর্থাৎ চাঁদি এবং একশত উট দেয়া হলো। আবু সুফিয়ান বললেন, আমার পুত্র ইয়াযিদ? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়াযিদকেও অনুরূপ প্রদান করলেন। আবু সুফিয়ান বললেন, আমার পুত্র মুয়াবিয়া? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকেও অনুরূপ প্রদান করলেন। মোটকথা একমাত্র আবু সুফিয়ান এবং তার দুই পুত্রকে প্রদান করা হলো ১৮ কিলো চাঁদি এবং তিনশত উট।
হারেছ ইবনে কালদাকে একশত উট দেয়া হল। কোরায়শ এবং কোরায়শ নয় এমন সকর গোত্রীয় নেতাকে কাউকে একশত, কাউকে পঞ্চাচ এবং কাউকে চল্লিশটি করে উট দেয়া হলো। লোকদের মধ্যে এ খবর ছড়িয়ে পড়লো যে, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এতো এতো দান করেন যে, তিনি দারিদ্রের আশঙ্কা করেন না। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বেদুইনরা এসে আল্লাহর রসূলকে ঘিরে ধরলো এবং তাঁকে একটি গাছের কাছে নিয়ে গেলো। তাদের ভিড়ের চোটে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাদর গাছের মধ্যে থেকে গেলো। তিনি বললেন, হে লোক সকল আমার চাদর দিয়ে দাও।
সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রান রয়েছে, যদি তোহামার বৃক্ষরাজির সংখ্যার সমান চতুষ্পদ জন্তুও আমার কাছে থাকে, তবুও আমি সব বন্টন করে দেবো। এরপর তোমরা দেখবে, আমি কৃপণ নই, ভীত নই, মিথ্যাবাদী নই। ১১[আশশেফা, কাযী অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ-৮৬]
এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নিজের উটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং তার কয়েকটি লোম তুলে নিয়ে দেখিয়ে বললেন, হে লোক সকর, তোমাদের ‘ফাঈ’ মালামালের মধ্যে থেকে আমার জন্যে কিছু নেই। এমনকি এই যে উটের পশম দেখছো, এই পরিমাণও নেই শুধুমাত্র খুমুস রয়েছে, অর্থাৎ যুদ্ধলব্ধ সম্পদের মাথাপিছু বন্টনে এক পঞ্চামাংশের অংশ বিশেষ সেই খুমুস ও তোমাদের দিকে ফিরিয়ে দেয়া হয়।
নবদীক্ষিত মুসলমানদের দেয়া হলো, যাদেরকে কোরআনে ‘মোয়াল্লেফাতুল কুলুব’ বলা হয়েছে। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত যায়েদ ইবনে ছাবেতকে বললেন, তিনি যেন গনীমতের মাল এবং সৈন্যদের এক জায়গায় করে বন্টনের হিসাব করেন। তিনি তাই করলেন। এতে প্রত্যেক সৈন্যের ভাগে চারটি উট এবং ৪০টি বকরি পড়লো। বিশিষ্ট যোদ্ধারা পেলেন ১২টি করে উট এবং ১২টি করে বকরি।
এ বন্টনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেন। কেননা, পৃথিবীতে বহু লোক এমন রয়েছে যারা নিজের বিবেকের পথে নয় বরং পেটের পথে চলে। পশুর সামনে একমুঠো তাজা ঘাস ঝুলিয়ে পিছনে সরে গিয়ে তাকে যেমন নিরাপদ ঠিকানায় নিয়ে যাওয়া যায় তেমনি উল্লিখিত সম্পদ বন্টনের দ্বারা নবদীক্ষিত মুসলমানদের মন জয়ের চেষ্ট করা হয়েছে, যাতে তারা ঈমান শেখার সুযোগ পায় এবং ইসলামের প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত হয়। ১২[ মোঃ গাযালী, ফেকহুস সিরাহ, পৃ-২৯৮-২৯৯]
আনসারদের মানসিক অবস্থা
যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বিতরণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রাজনৈতিক কৌশল প্রথমে বোঝা যায়নি। এ কারণে কিছু লোক সমালোচনা করছিলেন। বিশেষত আনসারদের মন খারাপ হয়েছিলো। কেননা তাদেরকে কিছুই দেয়া হয়নি। অথচ সঙ্কটকারে তাদের ডাকা হয়েছিলো এবং তারা দ্রুত হাযির হয়েছিলেন। তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে দাঁড়িয়ে এমনভাবে যুদ্ধ করেছিলেন যে, দৃশ্যমান পরাজয় বিজয়ে পরিণত হয়েছিলো। কিন্তু গনীমতের মাল বন্টনের ক্ষেত্রে তারা লক্ষ্য করলেন যে, সঙ্কটের সময় পলায়নাকরীদের হাত পরিপূর্ণ, অথচ তাদের হাত খালি। ১৩[একই গ্রন্থ একই পৃষ্টা}
ইবনে ইসহাক আবু সাইদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোরয়েশ এবং আরবের গোত্রীয় নেতাদের অধিক দান করলেন অথচ আনসারদের কিছুই দিলেন না, তখন তাদের মন খারাপ হয়ে গেলো। তারা নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা করলেন। কেউ কেউ প্রকাশ্যেই বলে ফেললেন, আল্লাহর কসম, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কওমের সাথে মিশে গেছেন। হযরত সা’দ ইবনে ওবাদা (রা.)রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ব্যাপারে আপনি যা করেছেন, এতে আনসাররা খুশি হয়নি। তারা সমালোচনা করছে। তারা বলছে, আপনি শুধু নিজের কওমের মধ্যেই সম্পদ বন্টন করেছেন। আবর গোত্রদের বিশেষভাবে দান করেছেন। অতচ আনাসরদের কিছুই দেননি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, হো সা’দ, এ সম্পর্কে তোমার অভিমত কি? তিনি বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমিও তো আমার কওমেরই একজন। প্রিয় নবী বললেন, যাও তোমার কওমের লোকদের এক জায়গায় একত্রিত করো। সা’দ তাই করলেন। কয়েকজন মোহজের এলেন, তাদেরও বসতে দেয়া হলো। অন্য কিছু লোক এলো, তাদের ফিরিয়ে দেয়া হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এরপর জানানো হলো যে, ওরা হাযির হয়েছেন। তিনি তখন তাদের কাছে গেলেন।
আল্লাহ যথোচিত প্রশংসা করার পর প্রিয়নবী বললেন, ‘হে আনসাররা, তোমাদের অসন্তোষ তোমাদের সমালোচনার কারণ কি? আমি কি তোমদের কাছে এমন অবস্থায় যাইনি যখন তোমরা পথভ্রষ্ট ছিলে? আল্লাহ তায়ালা এরপর তোমাদের হেদায়াত দিলেন। তোমরা ছিলে পরমুখাপেক্ষি, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন। তোমাদের পরস্পর অন্তর জোড়া লাগিয়ে দিয়েছেন। এসব কি ঠিক নয়? তারা বললেন, হাঁ, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আপনি ঠিক বলেছেন। আমাদের ওপর আল্লাহ তায়াল এবং তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনেক দয়া। তিনি বললেন, আনসাররা জবাব দিচ্ছ না কেন? তারা বললেন আমরা কি জবাব দেবো? আল্লাহ তায়াল এবং তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনেক বড় দয়া আমাদের ওপর। তিনি বললেন, যদি তোমরা ইচ্ছা করো তবে একথা বলতে পারো যে, আপনি আমাদের কাছে এমন সময়ে এসেছিলেন যখন আপনাকে অবিশ্বাস করা হয়েছিল, সে সময় আমরা আপনার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আপনাকে বন্ধুহীন নিঃসঙ্গ অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হয়েছিল, সে সময় আমরা আপনাকে সাহায্য করেছি। আপনাকে উপেক্ষা করা হয়েছিল, আমরা আপনাকে ঠিকানা দিয়েছি। আপনি মোহতাজ ছিলেন, আমরা আপনার দুঃখ লাঘব করেছি।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আনসাররা, তোমরা দুনিয়ায় তুচ্ছ একটা জিনিসের জন্যে মনে মনে নাখোশ হয়েছো। সেই জিনিসের মাধ্যমে আমি কিছু লোকের মনে প্রবোধ দিয়েছি, যেন তারা মুসলমান হয়ে যায়। তোমাদেরকে তোমাদের গৃহীত ইসলামের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। হে আনসাররা, তোমরা কি এতে খুশি নও যে, অন্যরা উট বকরি নিয়ে ঘরে ফিরবে আর তোমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ফিরবে? সেই যাতে-পাকের শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, যদি হিজরতের ঘটনা ঘটতো, তবে আমিও একজন আনসার হতাম। যদি সব লোক এক পথে চলে, আর অন্য পথে চলে, তবে আমি আনসারদের পথেই চলবো। হে আল্লাহ তায়াল, আনসারদের ওপর, তাদের সন্তানদের ওপর এবং তাদের পৌত্র-পোত্রীদের প্রতি রহমত করুন।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভাষণ শুনে লোকেরা এতোবেশী কান্নাকাটি করলেন যে, তাদের দাড়ি ভিজে গেলো। তারা বলতে লাগলেন, আমাদের অংশে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থাকবেন, এতে আমরা সন্তুষ্ট। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফিরে গেলেন এবং সাহবারা নিজ নিজ জায়গায় চলে গেলেন। ১৪[ ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ-৪৯৯-৫০০, সহীহ বোখারী ২য় খন্ড, পৃ-৬২০-৬২১[
হাওয়াযেন প্রতিনিধি দলের আগমন
গনীমতের মালামাল বন্টনের পর হাওয়াযেন গোত্রের একদল প্রতিনিধি মুসলমান হয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এলেন। তারা ছিলেন চৌদ্দজন। যোহায়ের ইবনে ছুরাদ ছিলেন তাদের নেতা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেজায়ী চাচা আবু বারকানও তাদের মধ্যে ছিলেন। তারা এসে যুদ্ধবন্ধী এবং মালামাল ফেরত চাইলেন। তারা এমনভাবে কথা বললেন যে, সকলের মন নরম হয়ে গেলো।১৫[ইবনে ইসহাক বলেন, প্রতিনিধিদলের গোত্রের ৯ জন নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন। তারা ইসলাম গ্রহণ করেন, বাইয়াত করেন এবং আল্লাহ-রসূলের সাথে কথা বলেন। তারা বলেন, যে, হে আল্লাহর রসূল, আপনি যাদের বন্দী করেছেন, এদের মধ্যে আমাদের মা বোন রয়েছেন, ফুফু খালা রয়েছেন। এটা আমাদের কওমের জন্যে অবমননাকর। (ফতহুল বারী ৮ম খন্ড, পৃ-৩৩)। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মা বোন ইত্যাদির দ্বারা আল্লাহর রসূলের রেজায়ী মা-খালা-ফুফু-বোন বুঝানো হয়েছে। প্রতিনিধি দলের পক্ষে কথা বলছিলেন যোবায়ের ইবনে ছুরাদ। আবু বারকানের মধ্য মতভেদ হয়েছে। কেউ কেউ আবু মারওয়ান এবং আবু ছারওয়ান বলে উল্লেখ করেছেন]। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমাদের সাথে যেসব লোক রয়েছে, তোমরা তাদের দেখতে পাচ্ছো। সত্য কথা আমি বেশী পছন্দ করি। সত্যি করে বলো, তোমরা নিজের সন্তান-সন্তনিকে বেশী ভালোবাসো নাকি ধন-সম্পদ?
তারা বললেন, পারিবারিক মর্যাদার মূ্ল্যই আমাদের কাছে বেশী। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ঠিক আছে, আমি যোহরের নামায আদায়ের পর তোমরা উঠে বলবে যে, আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মোমেনীনদের পক্ষে সুপারিশকারী এবং মোমেনীনদের রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে সুপারিশকারী বানাচ্ছি। কাজেই আমাদের কয়েদীদের ফিরিয়ে দিন।
যোহরের নামাযের পর তারা সেকথা বললেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমার নিজের এবং বনু আবুদল মোত্তালেবের অংশ তোমাদের জন্যে । আমি এখনই অন্য লোকদের জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছি। সাথে সথে আনসার এবং মোহাজেররা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আমাদের যা কিছু রয়েছে, সেইসবও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যে। এরপর আকরা ইবনে হাবেস উঠে দাঁড়িয়ে বললো, যা কিছু আমার এবং বনু তামিমের রয়েছে সেসব আপনার জন্যে নয়। উত্তায়না বিন হিস্ন বললো, যা কিছু আমার এবং বনু ফাজরাদের রয়েছে সেসব আপনার জন্যে নয়। আব্বাস ইবনে মায়দাস বললো, যা কিছু আমার এবং বনু সালিমের সেসবও আপনাদের জন্যে নয়। বনু সালিম গোত্রের লোকের দাঁড়িয়ে বললো, জ্বী না; বরং যা কিছূ আমাদের রয়েছে, সেসবই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যে। একথা শুনে আব্বাস ইবনে মারদাস বললো, তোমরা আমাকে অপমান করেছো।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, দেখো ওরা মুসলমান হয়ে এসেছে। এ কারণে আমি তাদের বন্দীদের বন্টনে দেরী করেছি। কাজেই যাদের কাছে বন্দী রয়েছে তারা যেন ফিরিয়ে দেয়। এটা খুব ভালো হবে। যে ব্যক্তি নিজের প্রাপ্য অংশ রাখতে চায়, সেও যেন কয়েদীদের ফিরিযে দেয়। ভবিষ্যতে যখান ‘ফাঈ’- এর মাল পাওয়া যাবে, এর বিনিময়ে তাদের ছযগুন দেয়া হবে। লোকেরা বললো, আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যে সব কিছু সানন্দে দিতে রাযি আছি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি জানতে পারিনি-কারা রাযি , কারা কারা নারায।
এরপর বললেন, আপনারা বরং ফিরে যান, আপনাদের নেতাকে পাঠিয়ে দিন। এরপর সাহাবারা বন্দী শিশু ও মহিলাদের ফেরত দিলেন। উয়াইনা ইবনে হাসানের ভাগে একজন বৃদ্ধা পড়েছিলেন, তিনি তাকে ফিরিয়ে দিতে রাযি হলেন না, পরে তিনিও ফেরত দিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক বন্দীকে একখানি করে কিবতি চাদর উপহার দিয়ে বিদায় করলেন।
ওমরাহ এবং মদীনায় প্রত্যাবর্তন
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গনীমতের মাল বন্টন শেষে যেরানা থেকে ওমরাহর জন্যে এহরাম বাঁধেন এবং ওমরাহ আদায় করেন। এরপর আত্তাব ইবনে আছিদকে মক্কার গভর্নর করেন।।
মোহাম্মদ গাযালী বলেন, এই বিজয়ের সময় যখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর মাথায় ফতহে আযিমের মুকুট পরালেন, এই সময়ে এবং আট বছর আগে এই শহরে আসার সময়ের মধ্যে কতো ব্যবধান।
তিনি এই শহরে এমনভাবে এসেছিলেন যে, তিনি ছিলেন নিরাপত্তার প্রত্যাশী। সেই সময় তিনি ছিলেন অচেনা, অপরিচিত, সংশয় ছিলো তাঁর মনে। সে সময় স্থানীয় অধিবাসীরা তাঁকে মর্যাদা দিয়েছিলো আশ্রয় দিয়েছিলো, সাহায্য করেছিলো, তিনি যে নূর সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তারা সেই নূরের আনুগত্য করেছিলো। শুধু তাই নয় তার জন্যেই তারা অন্যদের সব রকমের শত্রুতা তুচ্ছ মনে করেছিলো। আট বছর আগে এই মদীনায় হিজরত করার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিলো তারাই আজ পুনরায় সম্বর্ধনা দিচ্ছে। আজ মক্কা তাঁর করতলগত, তাঁর নিয়ন্ত্রণে। মক্কার জনগণ তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মূর্খতা দয়াল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পদতলে বিসর্জন দিয়েছে। তিনি তাদের অতীত দিনের সকল অন্যায় ক্ষমা করে দিয়ে তাদেরকে ইসলামের মাধ্যমে গৌরব ও সাফল্য দান করেছেন।
আল্লাহ তায়াল কোরআনে হাকিমে বলেন, ‘নিশ্চয় যে ব্যক্তি সত্যবাদিতা এবং ধৈর্য অবলম্বন করে, তবে আল্লাহ তায়ালা পুন্যশীলদের বিনিময় নষ্ট করেন না। ’১৬[ ফেকহুস সিরাহ পৃ-৩০৬, মক্কা বিজয় এবং তায়েফের যুদ্ধ বিস্তারিত জানার জন্যে দেখুন যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ-১৬০-২০১,ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ-৩৮৯-৫০১, সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৬১২-৬২৩, ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড, পৃ-৩-৮৫]
মক্কা বিজয়ের পরবর্তী ছারিয়্যাসমূহ
এই দীর্ঘ এবং সফল সফরের পর মদীনায় ফিরে এসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় বেশ কিছুকাল অবস্থান করেন। এ সময়ে তিনি বিভিন্ন প্রতিনিধিদলকে অভ্যর্থনা জানান, প্রশাসন পরিচালনার জন্যে কর্মকর্তা প্রেরণ করেন এবং দ্বীনের প্রচারের জন্যে দাঈ প্রেরণ করেন।
এছাড়া, যারা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হওয়ার পরও তা মেনে নিতে পারেননি, বরং নানাভাবে ঔদ্ধত্য ও হঠকারিতার পরিচয় দিচ্ছিলো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মোকাবেলা করেন। নিচে সেসব বিবরণ উল্লেখ করা যাচ্ছে।
যাকাতের জন্যে তহশিলদার প্রেরণ
ইতিপূর্বের আলোচনায় এট স্পষ্ট হয়েছে যে, মক্কা বিজয়ের পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৮ম হিজরীর শেষদিকে মদীনায় ফিরে আসেন। নবম হিজরীতে মহররমের চাঁদ ওঠার পর পরই নবী মোস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন গোত্র থেকে যাকাত আদায়ের জন্যে তহশীলদার প্রেরণ করেন। নিচে তাদের তালিকা দেয়া হলো।
তহশীলদারের নামগোত্রের কাছে পাঠানো হয়
১উয়ইনা ইবনে হাসানবনু তামিম
২ইয়াযিদ ইবনে হোসাইনআসলাম ও গেফার
৩ওব্বাদ ইবনে বশীর আশহালিসোলাইম ও মুযাইনা
৪রাফে ইবনে মাকিছযুহাইনা
৫আমর ইবনুল আসবনু ফাযারাহ
৬যাহহাক ইবনে সুফিয়ানবনু কেলাব
৭ বশীর ইবনে সুফিয়ানবনু কা’ব
৮ইবনুল লুতবিয়াহ আযদিবনু যাবিয়ান
৯মোহজের ইবনে আবু উমাইয়াসনআ শহর
১০যিয়াদ ইবনে লবিদহাদরামাউত
১১আদী ইবনে হাতেমতাঈ এবং বনু আছাদ
১২মালেক ইবনে নোয়ইরাহবনু হানযালা
১৩যবরকান ইবনে বদরবনু সা’দ এর একটি অংশ
১৪কাইস ইবনে আসেমবনু সা’দ এর অন্য অংশ
১৫আলা ইবনে হাদরামিবাহরাইন
১৬আলী ইবনে আবু তালেবনাযরান
এসকল সাহাবাকে তহশীলদারের দায়িত্ব দিয়ে নবম হিজরীর মহররম মাসে প্রেরণ করা হয়। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট এলাকার গোত্রের লোকের ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। মহররম মাসের প্রথম দিকে অনোকে এবং পরে অনেকে রওয়ানা হয়ে যান। এর দ্বারা হোদায়বিয়ার সন্ধির পরে ইসলামের দাওয়াতের সাফল্যের ব্যাপকাত সম্পর্কে ধারণা করা যায়। মক্কা বিজয়ের পর দলে দলে লোক ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে শুরু করেন।
এ সময়কার কয়েকটি ছারিয়্যা
বিভিন্ন গোত্রের কাছে যাকাত আদায়ের জন্যে তহশীলদার প্রেরণ করা হয়। কিন্তু জাযিরাতুল আরবের বিভিন্ন এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা সত্তেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখঅ দেয়। সেসব দমনে সৈন্য প্রেরণ করা হয়। নীচে এমন কিছু ছারিয়্যার বিবরণ উল্লেখ করা যাচ্ছে।
(১) ছারিয়্যা উয়াইনা ইবনে হাসান ফাজারি
নবম হিজরীর মহররম মাস
উয়াইনাকে ৫০ জন সওয়ারের নেতৃত্ব দিয়ে বনু তামিম গোত্রের কাছে প্রেরণ করা হয়। কারণ হচ্ছে যে, বনু তামিম বিভিন্ন গোত্রকে উস্কানি দিয়ে জিযিয়া আদায় থেকে বিরত রেখিছিলো। এ অভিযানে কোন মোহাজের বা আনসার ছিল না।
উয়াইনাকে ইবনে হানান রাত্রিকালে পথ চলতেন এবং দিনের বেলায় আত্মগোপন করে থাকতেন। এভাবে চলার পর নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে বনু তামিম গোত্রের লোকদের ধাওয়া করলেন। তারা ঊর্ধশ্বাসে ছুটে পালালো। তবে, ১১জন পুরুষ ২১জন নারী এবং ৩০টি শিশুকে মুসলমানরা গ্রেফতার করলেন। এদের মদীনায় নিয়ে এনে রামলা বিনতে হারেসের ঘরে আটক রাখা হলো।
পরে বন্দীদের মুক্তির ব্যাপারে আলোচনা করতে বনু তামিম গোত্রের ১০ জন সর্দার এলেন। তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরের দরজায় গিয়ে এভাবে হাক দিলেন হে মোহাম্মদ, আমাদের কাছে আসুন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাইরে এলেন। তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জড়িয়ে ধরে কথা বলতে লাগলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সঙ্গে কাটালেন। ইতিমধ্যে যোহরের নামাযের সময় হলো। তিনি নামায পড়ালেন। নামায শেষে মসজিদের আঙ্গিনায় বসলেন। বনু তামিমের সর্দাররা নিজেদের গর্ব অহংকার প্রকাশক বিতর্কের ইচ্ছা প্রকাশ করে তাদের বক্তা আতা ইবনে হাজেবকে সামনে এগিয়ে দিলেন। তিনি বক্তৃতা করলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার মোকাবেলার জন্যে খতীব ইসলাম হযরত ছাবেত ইবনে কায়েস শাম্মাসকে আদেশ দিলেন। তিনি জবাবী বক্তৃতা দিলেন। বনু তামিম সর্দাররা এরপর তাদের গোত্রের কবি জায়কাল ইবনে বদরকে সামনে এগিয়ে দিলেন। তিনি অহংকার প্রকাশক কিছু কবিতা আবৃতি করলেন। শায়েরে ইসলাম হযরত হাস্সান ইবনে ছাবেত তার জবাব দিলেন।
উভয় বক্তা ও কবি বক্তৃতা ও কবিতা আবৃতি শেষ করলে আকরা ইবনে হাবেছ বললেন, ওদের বক্তা আমাদের বক্তার চেয়ে জোরালো বক্তৃতা এবং ওদের কবি আমাদের কবির চেয়ে ভালো কবিতা আবৃত্তি করেছেন। ওদের বক্তা এবং কবির আওয়ায আমদের বক্তা ও কবির আওয়াযের চেয়ে বুলন্দ। এরপর আগন্তুক বনু তামিম সর্দাররা ইসলাম গ্রহণ করেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে দাসী উপহার প্রদান করেন এবং বন্দি নারী ও শিশুদের ফিরিয়ে দেন। ১[ যুদ্ধ বিষয়ে বিশারদ লেখকরা বর্ণনা করেছেন যে, নবম হিজরীর মহররম মাসে এ ঘটনা ঘটে। এতে বোঝা যায় যে, আকরা ইবনে হাবেছ সে সময়েই মুসলমান হন। কিন্তু সীরাত রচয়িতরা লিখেছেন, আল্লাহর রসূল বনু হাওয়াযেন গোত্রের বন্দীদের ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলেছিলেন। তখন আকরা ইবনে হাবেছ বলেন, আমি এবং বনু তামিম ফিরিয়ে দেব না। এ দ্বারা বোঝা যায় যে, আকরা ইবনে হারেছ নবম হিজরীর মহররম মাসের আগেই মুসলমান হয়েছিলেন।]
২. ছারিয়্যা কুতবাহ ইবনে আমের
নবম হিজরীর সফর মাস
এই ছারিয়্যা তোরবার কাছে তাবালা এলাকায় খাশআম গোত্রের একটি শাখার দিকে রওয়ান হয়েছিলো। কোতবা ২০ জন লোকের সমন্বয়ে যাত্রা করেন। ১০টি ছিলো উট। পর্যায়ক্রমে সেসব উটে এরা সওয়ার হন। মুসরমানরা আকস্মিক হামলা করেন। এতে প্রচন্ড সংঘর্ষ শুরু হয়। উভয় পক্ষে বেশ কয়েকজন আহত হয়। কোতবা অন্য কয়েকজন সঙ্গীসহ নিহত হন। তবুও মুসলমানর ভেড়া, বকরি এবং শিশুদের মদীনায় নিয়ে আসেন।
৩. ছারিয়্যা যাহহাক ইবনে সুফিয়ান কেলাবী
নবম হিজরীর রবিউল আউয়াল মাস
এই ছারিয়্যা বনু কেলাব গোত্রকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্যে রওয়ানা করা হয়েছিলো। কিন্তু তারা ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে যুদ্ধ শুরু হয়। মুসলামনরা তাদের পরাজিত করে তদের একজন লোককে হত্যা করেন।
৪. ছারিয়্যা আলকামা ইবনে মজবের মাদলাযি
নবম হিজরীর রবিউল আউয়াল মাস
আলকামাকে তিনশত সৈন্যের সেনাপতির দায়িত্ব দিয়ে জেদ্দা উপকূলের দিকে প্রেরণ করা হয়। কারণ ছিলো এই যে, কিছু সংখ্যক হাবশী জেদ্দা উপকূলের কাছে সমবেত হয়েছিলো। তারা মক্কার জনগণের ওপর ডাকাতি রাহাজানি করতে চাচ্ছিলো। আলকামা সমুদ্রে অভিযান চালিয়ে একটি দ্বীপ পর্যন্ত অগ্রসর হন। হাবশীরা মুসলমানদের আগমন সংবাদ পেয়ে পলায়ন করে। ২[ ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড, পৃ-৫৯[
৫. ছারিয়্যা আলী ইবনে আবু তালেব
নবম হিজরীর রবিউল আউয়াল মাস
হযরত আলী (রা.)-কে তাঈ গোত্রের কালাস বা কলিসা নামের একটি মূর্তি ভাঙ্গার জন্যে প্রেরণ করা হয়েছিলো। হযরত আলীর নেতৃত্বে একশত উট এবং পঞ্চাশটি ঘোড়াসহ দেড়শত সৈন্য রওয়ান হন। তারা সাদা কালো পতাকা বহন করেন। ফজরের সময় মুসলমানরা হাতেম তাঈয়ের মহল্লায় হামলা চালিয়ে কালাস মূর্তি ভেঙ্গে ফেলে। এরপর বহু লোক, চতুষ্পদ জন্তু এবং ভেড়া,বকরি আটক করা হয়। এসব বন্দীর মধ্যে হাতেম তাঈয়ের কন্যাও ছিলেন। হাতেমের পুত্র আদী ইবনে হাতেম সিরিয়ার পথে পালিয়ে যায়। মুসলমানরা কালাস মূর্তির ঘরে তিনটি তলোয়ার এবং তিনটি বর্ম পান। ফেরার পথে গনীমতের মাল বন্ট করা হয়। হাতেম তাঈয়ের কন্যাকে কারো ভাগে দেয়া হয়নি।
মদীনায় পৌঁছার পর হাতেম তাঈয়ের কন্যা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে দয়ার আবেদন জানিয়ে বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, এখানে যে আসতে পারতো, সে আজ নিখোঁজ। পিতা মারা গেছেন। আমি বৃদ্ধা। খেদমত করার শক্তি নাই। আপনি আমার প্রতি দয়া করুন, আল্লাহ তায়ালা আপনাকে দয়া করবেন। নবী মোস্তাফা জিজ্ঞেস করলেন, তোমার জন্যে কে আসতে পারতো? বললেন, আমার ভাই আদী ইবনে হাতেম। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে লোক-যে আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে পালিয়ে গেছে। একথা বলে নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চলে গেলেন। তিনদিন একই প্রশ্নোত্তর হলো। তৃতীয় দিন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দয়া করে হাতেমের মেয়েকে আযাদ করে দিলেন। সে সময় সেখানে একজন সাহাবী ছিলেন, সম্ভবত হযরত আলী, তিনি মহিলাকে বললেন, দয়াল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সওয়ারীর জন্যেও আবেদন জানাও। মহিলা তাই করলেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাতেমের কন্যার জন্যে সওয়ারীর ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দিলেন।
হাতেমের কন্যা মদীনা থেকে ছাড়া পেয়ে সোজা সিরিয়ায় চলে যান। ভাইদের সথে দেখা করে তিনি বলেন, দয়াল নবী এমন দয়া দেখিয়েছেন, যে দয়া তোমার বাবাও দেখাতে পারতেন না। তাঁর কাছে তুমি ভয় এবং আশার সাথে যাও। এরপর আদী ইবনে হাতেম মদীনায় গিয়ে সরাসরি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে দেখা করলেন। নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে সামনে বসিয়ে বললেন, তুমি কোথায় পালাচ্ছ? আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল থেকে পালাচ্ছ? যদি তাই হয়ে থাকে তবে বলো আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য কোন উপাস্যের কথা তুমি কি জানো? তিনি বললেন, জানি না। নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, শোনো ইহুদীদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ রয়েছে, খৃষ্টানরা হচ্ছে পথভ্রষ্ট। আদী বললেন, তবে আমি একজন একরোখা মুসলমান। একথা শুনে নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারা খুশীতে চিকচিক করে উঠলো। তিনি হাতেমের পুত্রকে একজন আনসারীর বাড়ীতে রাখলেন। এরপর আদী ইবনে হাতেম সকাল বিকাল নবী মোস্তফার কাছে হাযির হতেন। ৩[যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ-২০৫]
ইবনে ইসহাক আদী ইবনে হাতেম থেকে বর্ণানা করেছেন, নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ঘরে তাঁর সামনে আদী ইবনে হাতেমকে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আদী ইবনে হাতেম, তুমি কি পুরোহিত ছিলে না? আদী বলেন, আমি বলেছিলাম জ্বী তাই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কি তোমার কওমের গনীমতের মাল এক চতুর্থাংশ গ্রহণ করতে না? আমি বলেছিলাম, জ্বী হাঁ তাই। তিনি বললেন, অথচ এটা তোমাদের দ্বীনে হালাল নয়। আমি বললাম, হাঁ তাই। সেই সময়েই আমি বুঝেছিলাম যে, তিনি হাদী বরহক, তিনি আল্লাহর প্রেরিত রসূল। কারণ, তিনি এমন বিষয় আমাকে বলেছেন, যা তার পক্ষে জানা স্বাভাবিক ছিলো না। ৪[ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ-৫৮১]
মোসনাদে আহমদ-এর বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হে আদী, ইসলাম গ্রহণ করো শান্তিতে থাকবে। আমি বললাম, আমি তো একটা দ্বীন অনুসরণ করি। তিনি বললেন, তোমার দ্বীন সম্পর্কে আমি তোমার চেয়ে বেশী জানি। আমি বললাম, আপনি আমার দ্বীন সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশী জানেন? তিনি বললেন, হাঁ। এটা কি ঠিক নয় যে, তুমি পুরোহিত ? তুমি তোমার কওমের গনীমতের মাল এক চতুর্থাংশ ভোগ-ব্যবহার করো? আমি বললাম, হাঁ, তাই। নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটা তো তোমাদের ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে হালাল নয়। নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একথায় আমার মাথা নত হয়ে গেলো। ৫[ মোসনাদে আহমদ, সপ্তম খন্ড, পৃ-২৫৮-২৭৮]
সহীহ বোখারী শরীফে হযরত আদী ইবনে হাতেম থেকে বর্ণিত আছে যে, আমি নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সামনে বসেছিলাম। এমন সময় একজন লোক এসে তার ক্ষুধার্ত অবস্থার কথা জানালো। অন্য একজন এসে ডাকতি রাহাযানির অভিযোগ করলো। নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আদী, তুমি হীরা শহর দেখেছো? যদি তোমার আয়ু বেশী হয়, বেশীদিন বাঁচো, তবে দেখতে পাবে যে, ঘোড়ার পিঠে চড়ে একজন মহিলা হীরা থেকে আসবে এবং কাবাঘর তাওয়াফ করবে। এ সময়ে আল্লাহর ভয় ছাড়া তার অন্য কোন ভয় থাকবে না। যদি তুমি দীর্ঘজীবী হও, তবে তোমরা কেসরার ধনভান্ডার অধিকর করবে। যদি তুমি দীর্ঘজীবী হও, তবে দেখবে, আঁচল ভরে সোনা বিতরণের জন্যে নেয়া হবে, কিন্তু গ্রহণ করার লোক পাওয়া যাবে না। সেই বর্ণনা শেষে রয়েছে যে, আদী বলেন, আমি দেখেছি, হাওদাজে চড়ে আসা একজন মহিলা হীরা থেকে এসে কারাঘর তাওয়াফ করেছে কিন্তু আল্লাহ ছাড়া তার অন্য কারো ভয় ছিলো না। কেসরার ধন ভান্ডার যার জয় করেছিলেন, আমি নিজেই ছিলাম তাদের মধ্যে একজন। তোমরা যদি দীর্ঘজীবী হও, তবে আবুল কাসেমের সেই কথার সত্যতার প্রমাণও পাবে। তিনি যে বলেছেন, আঁচল ভরে বিতরণের জন্যে সোনা নেয়া হবে, কিন্তুতা গ্রহণের লোক পাওয়া যাবে না। ৬[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৫০৭]