তৃতীয় অধ্যায়ঃ কুরআনের সুক্ষ্ম বাক্য গাথুনি, চমকপ্রদ ও আশ্চর্য বর্ণনারীতি
প্রথম পরিচ্ছেদঃ বাক-বিন্রাস ও বর্ণনা-বৈশিষ্ট্য
কুরআন অন্যান্য বই-এর পদ্ধতি অনুসারে বিষয়বস্তু বা তার শ্রেণী-ভাগ নিয়ে অধ্যায় ও পরিচ্ছেদ আকারে রচিত হয়নি। তাই যখন যে বিষযে যা চাই, অধ্যায় ও পরিচ্ছেদ-সূচী দেখে বের করার উপায় এতে নেই। কুরআনকে এক পত্রগ্রন্থ বলা চলে, কিংবা বলা চলে ফরমান-সমষ্টি। কোন বাদশাহ্ যেন প্রজাদের নামে বিশেষ অবস্থায় বিশেষ ফরমান জারী করেছেন। অবস্থা অনুসপারে তা বদলে নয়া ফরমান জারী করেছেন। এভঅবে বেশ কিছুকাল অনেকগুলো ফরমান জমে গেলে কেউ সেগুলো সংকলন করে গ্রন্থরূপ দিল। ঠিক তেমনি নিখিল সৃষ্টির বাদশাহ্ তাঁর প্রিয় রাসূলের কাছে বান্দাদের পথ প্রদর্শনের জন্যে বিভিন্ন সময়ে অবস্থা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন আয়াত ও সূরা পাঠিয়েছেন। হযরনত (স)-এর যুগেই সে সূরা গুলোকে গুছিয়ে সুরক্ষিত করা হল। কিন্ত সেগুলো জানানো হয়েছিল না। হযরত আবু বকর (রা) ও হযরত উমর (রা)-এর যুগে সে সূরা গুলেকে বিশেষ এক ধারাবাহিক রূপ দিয়ে গ্রন্থ আকারে সংকলন করা হল। তার নাম দেয়া হল ‘মাসহাফ’।
রসূল(স)-এর সাহাবাগণ সূরা গুলোকে চারভাগে সাজিয়ে চারটি নাম দিলেন।
১। সা্আ তুয়াল: এতে সব চাইতে বড় সূরাটি সাতটি স্থান পেয়েছে।
২। মিয়ূন: এতে শতাধিক কিংবা শত আয়াত বিশিষ্ট সূরা নেয়া হয়েছৈ।
৩। মাসানী : শতের কম আয়াত সম্বলিত সূরার সমাবেশ।
৪। মুফাস্সাল: ওপরের তিন শ্রেণীর ছাড়া বাকী সব সূরা।
হযরত উসমানের যুগে কুরআরন:
কুরআন যথারীতি না সাজানো পর্যন্ত এ ধারাবাহিকতা ও ভাগ ঠিক ছিল। কিন্তু যখন যথারীতি সংকলিত হল, তখন এত কিছুটা রদবদল ঘটেছে। আয়াতের মর্ম ও ব্যঞ্জনা অনুসারে মাসানীর তিন ভাগের দুভাগই মিয়ুনখন্ডের অন্তর্ভুক্ত হল। এভঅবে অন্যান্য অংশের অল্প-বিস্তর রদবদল হয়েছে। হযরত উসমান (রা) তাঁর খিলাফতের যুগে মাসহাফের কয়েকটি কপি করিয়ে দেশের বিভিন্ন অংশে পাঠিয়ে দেন, যেন সবাই এটাকে অনুসরণ করে ও অন্য আকার দানের চেষ্টা না করে।
কোরআনের শুরু ও শেষ শাহী ফরমানের রূপে
যেহেতু কুরআনের সূরাগুলো ঠিক বাদশাহর ফরমাননের রীতিতে রচিত , তাই তার শেষ ও শুরু ঠিক দলিল পত্রাকারে রয়েছে। যে ভাবে কোন দলীল-পত্র আল্লাহর প্রশংসা দিয়ে শুরু হয়, কোনটা লেখার উদ্দেশ্য দিয়ে শুরু হয়, কোনটিতে পত্রের লেখক ও প্রাপকের নাম শুরুতে থাকে, কোকন পত্র শিরোনাম ছাড়াই লেখা হয়। কোন পত্র হয় লম্বা, কোনটি সংক্ষেপ। ঠিক তেমনি আল্লাহর্ পাক কোন সূরা প্রশংসা দিয়ে আর কোনটি উদ্দেশ্যের ওপরে আলোকপাত করে শুরু করেছেন। যেমন:
(আরবী*****************)
‘এ হচ্ছে অনন্য গ্রন্থ। কোন সংশয়ের ফাঁক নেই এতে। সরল মানুষের পথ প্রদর্শক। ’ (সূরা বাকারা-২)
কিংবা (আরবী*****************)
এ সূরাটি আমিই নাযিল করেছি। আর আমিই ফরয করেছি। (সূরা নূর০১)
এ যেন ঠিক সাধারণ পত্র-রীতি। যথা (আরবী*****************)
এ সেই পত্র যার ওপরে অমুক আর অমুক একমত।
কিংবা (আরবী*****************)
এটা সেই দলীল যেটা অমুকে ওসীয়ত করে গেছে।
আমাদের হুযূর (স) হুদায়বিয়ার যে শপথ ও সন্ধিনামা লিপিবদ্ধ করেছিলেন, তার প্রারম্ভও এভাবে হয়েছিল: (আরবী*****************)
এ সেই শপথনামা যা মুহাম্মদ (স) সম্পাদন করল।
কোন কোন সূরা ঠিক পত্রের মত লেখক প্রাপকের নাম দিয়ে শুরু হয়েছে। যেমন:
(আরবী*****************)
‘এ সেই মহান মর্যাদাবান বিজ্ঞ শ্রেষ্ঠ আল্লাহ্ তাআলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ গ্রন্থ। ’ (সূরা জাছিয়াহ-২)
(আরবী*****************)
এ সেই গ্রন্থ, যার আয়াতগুলো মুহ্কাম করে আবার খুলে বর্ণনা করা হয়েছে। (সূরা হুদ-১)
কিংবা (আরবী*****************)
এতো সেই প্রভুর কাছ থেকে, এসেছে, যিনি বিজ্ঞতম ও সর্বজ্ঞ।
এ সব আয়াতের শুরুতে যে রীতি অনুসৃত হয়েছে, তা যেন কোন ফরমান বা উর্দ্ধতনের পত্রের সাথে সামঞ্জস্য রাখে। তাও এভাবে শুরু হয়:
‘মহামান্য খলীফার নির্দেশ জারী হল। ’ কিংবা ‘অমুক শহরের বাসিন্দাদের মহামান্য খলীফার নির্দেশ শুনানো হল। ’
হযরত (স) রোম-সম্রাট হেরাক্লিয়াসের কাছে যে পত্র লিখেছেন, তার প্রাম্ভও এভাবে হয়েছিল। :
(আরবী*****************)
আল্লাহর রসূল মুহাম্মদ (সঃ) এর পক্ষ থেকে রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াসের নামে।
কোন কোন সূরা পত্রের ঢঙে কোন শিরোনাম ছাড়াই অবতীর্ণ হয়েছে। যেমন:
(আরবী*****************)
আল্লাহ তায়ালা সে নারীদের কথা শুনেছেন যারা নিজ স্বামীকে নিয়ে ঝগড়া করেছে। (সূরা মুজাদালা-১)
(আরবী*****************)
হে রসূল! আপনি হালালকে হারাম করছেন কেন? (সূরা তাহরীম-১)
আরবদের বিশুদ্ধতম বাক্য কাসীদা আকারে লিপিবদ্ধ রয়েছে। কাসীদায় মূল বক্তব্যের আগে ভুমিকাস্বরূপ ‘তাশবীব’ লেখা হয়। তাশবীবের ভেতরে অদ্ভূত ও দুর্লভ চরণ, বিস্ময়কর ও ভয়াবহ ঘটনাবলী উল্লেখ করা অত্যন্ত প্রাচীন রীতি। কুরআনের কোন কোন সূরায় এ রীতিও অনুসৃত হয়েছে।
(আরবী*****************)
সূর্য যখন আঁধার কুন্ডলী ও তারকারাশি নিষ্প্রভ হবে… ইত্যাদি। (সূরা তাকবীর-১-২)
(আরবী*****************)
পূণ্য শ্রেণীবদ্ধতের সারি ও শয়তান বিতাড়কদের বিতাড়ন কাঁ৮৮৮র শপথ। (সূরা ছফফাত-১/২)
বিক্ষিপ্তকারী হওয়ার বিক্ষেপণ ও ভারি মেঘ বহনকারীর ভার বহন… ইত্যাদি। (সূরা জারিয়াত ১-২)
সূরার শেষ ফরমানের রূপে:
যে ভাবে পত্রের শেষে সারকথা বলে দেয়া হয়, কখনও মূল্যবান উপদেশ ও ওসীয়ত থাকে, কখনও উপসংহারে, পেছনের কথাগুলোর ওপরে জোর দেয়া হয়, কখনও তারেদ সতর্ক করে দেয়া হয় যারা পত্রোল্লিখিত বিধি-নিষেধের বিরোধিতা করতে চায়, তেমনি কুরআনের বিভিন্ন সূরায়, কখনও বা কঠোরভাবে কিছুর ওপরে জোর দানের আয়াত দিযে শেষ করা হয়েছে। কখনও আবার ঠিক এভাবেই সূরাও শুরু করা হয়েছে।
এ ধরনের যে সব সূরা শুরু করা হয়েছে, সেগুলোর ভেতরে কোথাও আবর এমন ধরনের আয়াত রয়েছে যা বিরাট কল্যাণকর। আর তাতে অত্যন্ত উত্তম ও আলংকারিতভাবে আল্লাহর প্রশংসা করা হয়েছে। ঠিক তেমনিভাবেই কোথাও আল্লাহ তায়ালার অবদান ও অনুগ্রহ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
যেমন, এক সূরা শুরু করা হয়েছে স্রষ্টা ও সৃষ্টির ভেতরের পার্থক্য ও বৈষম্যের কথা দিয়ে। মাঝখানে এ আয়াত রয়েছে:
(আরবী*****************)
বলে দাও, সব প্রশংসা শুধু আলআহ্রই প্রাপ্য। আর সেই বান্দাদের ওপরে আল্লাহর শাস্তি রয়েছে, যাদের তিতিন সম্মানিত করেছেন। যাদের তারা অংশীদার ঠিক করেছে, তিনি তাদের থেকে উত্তম। (সূরা নামল-৫৯)
এরপর ধারাবাহিক পাঁচটি আয়াতে এ বিষয়টিই অত্যন্ত উত্তম ও আলংকারিক রীতিতে বর্ণনা করা হয়েছে। আর এ রীতিই সূরা বাকারায় যেখানে বনী ইসরাঈলদের সাথে যুক্তি-তর্কের অবতারণা করা হয়েছে, সেখানে অনুসৃত হয়েছে। বিতর্কের সূচনা এভাবে করা হয়েছে: (আরবী*****************)
হে বনী ইসরাঈলগণ! আমার সে সব অবদান স্মরণ কর। (সূরা বাকরা-৪৮/১২২) ইত্যাদি আর এ বিতর্কের পরিসমাপ্তিও এ আয়াত দ্বারা করা হয়েছে। যে কথা দিয়ে বিতর্ক শুরু ঠিক তা দিয়েই তার সমাপ্তি ঘটানো চরম পান্ডিত্যের ওপরে নির্ভর করে।
এভাবে সূরা আল-ইমরানে আহলে কিতাবদরে সাথে বিতর্কের উদ্বোধন করা হয় এ আয়াত দিয়ে:
(আরবী*****************)
নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে ধর্ম শুধু ইসলাম। (সূরা আল ইমরান-১৯)
যেহেতু আহলে কিতাবদের থেকে ইসলামের স্বীকৃতিটাই আলোচ্য বিষয় ছিল, তাই বিতর্কের শুরুই করা হয়েছে মূল দাবী উত্থাপনের ভেতর দিয়ে যেন বিতর্কের মূল কথা ধারণায় জেগে থাকে। এর আলোকেই যেন বিতর্ক চলে এবং জবাবের বেলায়ও এ উদ্দেশ্যটি সামনে থাকে।