প্রথম পরিচ্ছেদঃ মুহাদ্দিস তাফসীরকারদের বর্ণনা প্রসংগ
তাফসীর শাস্ত্রের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বস্তু হল শানে নুযূল সমস্যা। অর্থাৎ যে ঘটনা উপলক্ষে আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে, তা বিচার-বিশ্লেষণ। আলোচনাটি বেশ দীর্ঘ ও বিশ্লেষণ সাপেক্ষ।
শানে নুযুল দু’প্রকার:
শানে নুযূল মূলত দু’ধরনের। এক ধরনের হচ্ছে যে ঘটনাগুলো, ছাড়া আয়াতের যথার্থ অর্থ জানা অসম্ভব। যেমন, হযরত (স)-এর সময়ে এমন কোন ঘটনা ঘটেছে, যাতে ঈমানদারের ঈমান ও মুনাফিকদের নিফাক প্রকাশ পেয়েছে। তাই তাদের দু’দলের পরিচয়ই আলাদাভাবে মিলে গেছে। যেমন উহুদ ও আহযাবের যুদ্ধে এক ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে আল্লাহ তা’আলা যে আয়াত নাযিল করেছেন, তাতে ঈমানদারদের প্রশংসা ও মুনাফিকদের নিন্দা করা হয়েছে, যেন উভয়ের কাজের ধারাটা সবার চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়, আর দু’দলকে যেন আলাদা করে চেনা যায়। এ ধরনের আয়াতে এরূপ অনেক ইঙ্গিত মেলে যার সম্পর্ক থাকা সংশ্লিষ্ট ঘটনার বিভিন্ন সূত্রের সাথে জড়িত। সে অবস্থায় সেই ঘটনাটি জানা ছাড়া আয়াতটির মর্ম অনুধাবন সম্ভব হয় না।
এরূপ ক্ষেত্রে তাফসীরকারদের অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় সেই ঘটনাটি সংক্ষেপে উল্লেখ করা, যেন পাঠকদের পক্ষে আয়াতের সূত্র জেনে মর্ম বুঝা সহজ হয়।
শানে-নুযূলের দ্বিতীয ধারণাটিতে আসে সে ঘটনাগুলো, যা উপলক্ষ করে আয়াত অবতীর্ণ হলেও আয়াতের মর্মর সাথে সে ঘটনার কোনই যোগ ছিল না। যে আয়াতে কোন সাধারণ হুকুম আহ্কাম থাকে সেগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলেই এ শ্রেণীর আওতাভুক্ত হয়ে দাঁড়ায় না। তাই এ ধরনের আয়াতের বেলায় শানে-নুযুল বর্ণনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় না। তথাপি আগেকার তাফসীরকারা এ ধরনের ঘটনার উল্লেখ ও প্রয়োজনীয় ভাবতেন। সম্ভবত কি ধরনের অবস্থার ওপরে এ হুকুমটি প্রযোজ্য, সেটা বোঝানোর জন্যেই তাঁরা তা করতেন।
সাহাবাদের ধারা:
আমার মতে, শানে-নুযূল সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝি সাহাবা ও তাবেঈনের বর্ণনারীতির পার্থক্যের দরুন দেখা দিয়েছে। তাঁরা শানে-নুযূল বর্ণনা উপলক্ষে সাধারণ ‘নাযালাতিল আয়াতূ ফী কাযা’ (এ ব্যাপারে আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে) কথাটি ব্যবহার করতেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে, তাঁরা এ কথাটি কেবল আয়াত সংশ্লিষ্ট বিশেষ ঘটনাটি সম্পর্কেই বলতেন না। বরং এ আয়াত যে সব ঘটনায় প্রযোজ্য, সেগুলো সম্পর্কেও এরূপ বলতেন। তাঁদের উদ্দ্যেশ্য থাকত, আয়াত দ্বারা যা যা বুঝা যেতে পারে, তারও উল্লেখ করা। তাঁরা এটা ভাবতেন না যে, ঘটনাটি আয়াতের আগে ঘটেছে না পরে আর তার সম্পর্ক বনী ইসরাঈলদের বর্ণনার সাথে রয়েছে, না জাহেলী কিংবা ইসলামী যুগের সাথে রয়েছে। এমন কি সে ঘটনাটি উল্লেখিত আয়াতের শর্তাবলীর সাথেঞ পুরোপুরি যোগ রাখে কিনা তাও তাঁরা ভাবতেন না।
এসব আলোচনায় জানা গেল, তাফসীর সম্পর্কিত বর্তমান আলোচ্য বস্তুটি কেবল রসূল (স)-এর হাদীস ও সাহাবাদের বর্ণনায়ই সীমাবদ্ধ নয়; পরন্তু সাহাবা ও তাবেঈনে ব্যক্তিগত মতামত গবেষণাও এর অন্তরভুক্ত হয়েছে। দ্বিতীয়, একই আয়াত প্রসঙ্গে বিভিন্ন ধরনের কয়েকটি ঘটনাই বর্ণিত রয়েছে, যেগুলোর আয়াতের হুকুমের সাথে পুরোপুরি সংশ্লিষ্ট থাকার প্রশ্ন নেই। এ দু’টো রহস্য সামনে থাকলে শানে-নুযুলের ব্যাপারে যত প্রশ্নই দেখা দিক না কেন, সামান্য খেয়াল করলেই সমাধান মিলে যাবে।
এ প্রসঙ্গে ঘটনার বিস্তারিত আলোচনার ব্যাপারটিও এসে যায়। কুরআন ঘটনার বিস্তারিত আলোচনা ছেড়ে শুধু সেদিকে ইংগিত দিয়ে চলে গেছে। তাফসীরকার যখন সেরূপ আয়াত নিয়ে লিখতে বসেন, তিনি গোটা কাহিনী খুজে ফিরেন। তখন তাঁরা ইয়াহুদীদের বর্ণনা কিংবা তাদের ইতিহাস গ্রন্থ হাতড়িয়ে পুরো ঘটনাটি সংগ্রহ করেন। অথচ কুরআনের প্রতিটি ইংগিতই বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না। অনেক আয়াতের মর্মই সংশ্লিষ্ট ঘটনার বিশ্লেষণ ছাড়া আয়অতের ইংগিত বুঝা যায় না, সেগুলোর উল্লেখ তাফসীরকারদের কর্তব্য বটে। কিন্তু যেগুলো সেরূপ নয়। যেমন বনী ইসরাঈলের গুরটি কি গাই ছিল, না বলদ কিংবা আসহাবে কাহাফ এর কুকুর লাল ছিল, না কালো, সম্পূর্ণ বাজে আলোচনা সাহাবারা এ ধরনের অহেতুক আলোচনাকে অন্যায় ও সময়ের অপচয় ভাবতেন।
এ ব্যাপারে দুটো প্রশ্ন সামনে থাকা চাই। এক তো কুরআনে বর্ণিত ঘটনাগুলোর কোনরূপ অনুমানের আশ্রয় নেয়া উচিত নয়। যেভাবে ঘটনা পাওয়া গেছে, সেভাবেই বলে দেয়া চাই। কিন্তু আগেকার তাফসীরকারদের একটি দল সম্পূর্ণ নয়া রীতি অনুসরণ করেছেন। তাঁরা কুরআনের ইংগিতকে সামনে রেখে তার আলেকে ঘটনাটি মোটামোটি ভাবে অনুমান করে সংশয়ের সাথে বলে দিতেন। তাঁদের এই রীতির পরিণাম দাঁড়ালো এ, পরবর্তীকালের তাফসীরকররা তাঁদের এই রীতির পরিণাম দাঁড়ালো এ পরবর্তীকালের তাফসীরকাররা তাঁদের সে সংশয়ের সূত্রটিকে ধরে ঘটনাটিকে নিশ্চিত বলে ধরে নিলেন।
এ পর্যন্ত যেহেতু বিভিন্ন ধরনের কথার জন্য ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা রীতি নির্ধারিত ছিল না, তাই সংশয়পূর্ণ ও নিশ্চিত কথাগুলো মিলে জগাখিচুড়ী হয়েছে। ফলে অনিশ্চিতকে নিশ্চিত ও নিশ্চিত কথাকে কখনো অনিশ্চিত ধরা হয়েছে।
বস্তুত ঘটনা লেখার এ ধারা অনির্ধারিত বর। ননা-পদ্ধতিও সত্য বস্তুতে সংশয় ইত্যাদি বলে দেয়, তাফসীরের এ অংশটিও ব্যক্তিগত গবেষনা ও এ অনুমান প্রয়োগ থেকে মুক্ত নয়। তাই এখানেও মাথা খাটানো ও তর্ক-বিতর্কের বিরাট সুযোগ রয়েছে। যারা এ কথাটি মনে রাখে, তাদের জন্যে তাফসীরকারদের মতানৈকের স্বরূপ বুঝা ও সে সম্পর্কে সঠিক কোন সিদ্ধান্তে সাহাবাদের চূড়ান্ত মীমাংসা নয়। বরং সেটাও গবেষণা সাপেক্ষ। গোটা ব্যাপারই সাহাবাদের তর্ক-বিতর্কের আর শংশয়-অনুমানের সমষ্টি মাত্র।
আমার মতে, ওযুর ব্যাপারে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের ভূমিকাটিও তদরূপ।
(আরবী****************)
এবং তোমাদের মাথা মুঝে ফেল ও পায়ের গিরা পর্যন্ত।
এ আয়াত সম্পর্কে তিনি বলেন- “আল্লাহর গ্রন্থ থেকে আমি শুধু মোছার নির্দেশ পেয়েছি। কিন্তু কেউ কেউ ধোয়া ছাড় কিছুই স্বীকার করে না। ”
বস্তুত হযরত ইবনে আব্বাসের এ কথা থেকে আমি যা বুঝেছি তা এই যে, তিনি পা মোছার মত পোষণ করেন না এবং সেটাকে ওযুর শর্তও ভাবে না। তাঁর মতেও পা ধোয়া প্রয়োজন। এখঅনে তিনি কেবল যে সমস্যাটির দিকে ইংগিত দিয়েছেন, যেটা আয়াতের বিন্যাস অনুসারে সাধারণত ধরা দিযেছে। তাই তিনি এরূপ কথা দ্বারা এ সমস্যাটি সম্পর্কে সমসাময়িক ব্যাখ্যা কাররা কি সমাধান দিতে চান, তাই জানতে চেয়েছেন। অথচ যারা তাঁর এ উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন এবং তাদের বর্ণনারীতি সম্পর্কে ধারণা রাখতেন না, তাঁরা এ কথাটিকে তারা তাঁর সিদ্ধান্ত ধরে নিয়ে পা ধোয়ার স্থলে মোছাকেই তাঁর মায্হাব বলে ঠিক করেছেন। অথচ এটা সত্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
ইহুদীদের বর্ণনা:
এ প্রসংগে ইয়াহুদীদের বর্ণনা আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। তাদের বর্ণনার ভিত্তিতে কুরআনের অনেক ঘটনার বিশ্লেষণ দেয়া হয়েছে। অথচ তাদের বর্ণনার সত্যাসত্য সম্পর্কে আমাদের চুপ থাকতেই হয়েছে। সুতরাং সংশ্লিষ্ট ঘটনার ব্যাপারে আমাদের দুটি ব্যাপার লক্ষ্য রাখতে হবে। কুরআনে ইংগিতময় ঘটনার যেগুলো সম্পর্কে আমাদের রসল (স)-এর কোন হাদীস মেলে না, আহলে কিতাবদের বর্ণনা বের করে সেগুলো বিশ্লেষণ করা আদৌ উচিত নয়। হাদীসে কিছু মিললেই সেটাই যথেষ্ট ভাবতে হবে। যেমন: (আরবী****************)
এবং অবশ্যই আমি সুলায়মানকে পরীক্ষা করেছি ও তার তখ্ত কাত করে ফেলে আবার সোজা করেছি। (সূরা ছদ-৩৭)
এ আয়াত প্রষংগে হযরত (স) থেকে বর্ণিত আছে য, একবার সুলায়মান (আ) কোন ব্যাপারে ইচ্ছা জ্ঞান করতে গিয়ে ‘ইনশা-আল্লাহ’ বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। সে কারণে আল্লাহ তা’আলা পাকড়াও করেন। অথচ ইয়াহুদীরা এব্যাপারে একটি পাথর ও একটি সাপের কাহিনী বর্ণনা করেছে। এরূপ ক্ষেত্রে হযরত (স) এর বর্ণনার মুকাবিলায় সে বর্ণনার কি বৈধতা থাকতে পারে?
দ্বিতীয়, ঘটনা বর্ণার ক্ষেত্রে এ বিখ্যাত প্রবাদটি মনে রাখা দরকার, ‘ততটুকুই চাই, যতটুকু প্রয়োজন। ’ মানে, কুরআনের ইশারার সাথে যতটুকু ঘটনা সংশ্লিষ্ট থাকে, ঠিক ততটুকু বর্ণনা করা উচিত। তাহলে যা বলা হবে, কুরআনেও তার সমর্থন মিলবে। অতিরিক্ত বিশ্লেষণ বর্জনীয়।
কুরআন নিজেই নিজের ব্যাখ্যা:
এখানে আরেকটি অত্যন্ত মজার ব্যাপার রয়েছে। তা হল এই, কুরআনে একই ঘটনা কোথাও সংক্ষেপে, কোথাও বা অপেক্ষাকৃত বিস্তারিত ভাবে বলা হয়েছে। যেমন ফেরেশতাদের আপত্তি সম্পর্কে একখানে বলা হয়েছে:
(আরবী************)
আল্লাহ বলেন, তোমরা যা জান না আমি তাও ভালভাবেই জানি। (সূরা বাকারা ৩০)
তারপর অপর এক আয়াতে বলা হল:
(আরবী************)
আমি তোমাদের বলি নাই যে, আকাশ ও পৃথিবীতে তোমাদের যত প্রকাশ্য ও গোপন কথা রয়েছে, সবই আমার জানা আছে। (সূরা বাকারা-৩৩)
এটা ঠিক আগের কথাটিই। তবে তফাৎ এতটুকু যে, আগের বার সংক্ষেপে ও এবার কিছুটা খুলে বলা হয়েছে। সুতরাং পয়লা আয়াতে যেটা বিশ্লেষণ সাপেক্ষ ছিল, দ্বিতীয় আয়াতে তা পূর্ণ হয়ে গেল। এভাবে দ্বিতীয় আয়াত যেন পয়লা আয়াতের তাফসীর হল।
এভাবে সূরা মরিয়মে হযরত ঈসা (আ)-এর কাহিনী সংক্ষেপে বলা হয়েছে। যেমন:
(আরবী************)
আর আমি তাকে মানুষের জন্যে নিজ নিদর্শন ও অনুগ্রহরূপ গড়েছি। এটা এভাবেই হওয়া আমার মর্যী ছিল। (সূরা মারয়াম-২১)
আর এ ঘটনাকেই সূরা আল ইমরানে খুলে বলা হয়েছে: (আরবী************)
এবং বনী ইসরাঈলদের কাছে নবী করে পাঠালাম, (সে বলল) আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর নিদর্শন নিয়ে এসেছি। (সূরা আল ইমরান-৪৯)
বস্তুত এ আয়াতে সুসংবাদটি খুলে বলা হল। পয়লা আয়াতে যেহেতু এ সংবাদটির সংক্ষেপে উল্লেখ ছিল, তাই তা থেকে আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, … দ্বিতীয় আয়াতের অর্থটি দাঁড়ায় এই:
(আরবী************)
আমি বনী ইসরাঈলের কাছে এ খবর দেবার রসূল পাঠিয়েছি, (যে বলবে) আমি আল্লাহর নিদর্শন অনুগ্রহ নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছি।
বস্তুত এ মর্মই সুসংবাদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লামা সূয়ূতী এর ব্যতিক্রমে অন্য একটি উহ্য কাজের সাথে এগুলোর সম্পর্ক জুড়ে দিয়ে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন: (আরবী************)
যখন আল্লাহ তাআলা তাঁকে বনী ইসরাঈলদের নিকট পাঠালেন, তিনি বললেন, আমি তোমাদের প্রভুর প্রেরিত পুরুষ। কারণ আমি তোমাদের জন্যে আল্লাহর নিদর্শন ও অনুগ্রহ নিয়ে এসেছি।
আমার মতে, আল্লামা সুয়ূতীর অভিমত ঠিক নয়। অবশ্য আল্লাহই জানেন কোন্টা সত্য।
দুর্বোধ্য শব্দের ব্যাখ্যা দানে সলফের মতানৈকের কারন ও তার সমাধানের উপায়
দুর্বোধ্য শব্দের ব্যাখ্যা:
কুরআনের ‘গরীব’ অর্থ অপেক্ষাকৃত অপরিচিত ও দুর্বোধ্য শব্দের ব্যাখ্যা সম্পর্কি ব্যাপারটিও মনোযোগ আকর্ষনের বস্তু। কারণ এর ভিত্তি দুটি বস্তুর ওপরে রয়েছে। এক তো আরবী অভিধানে এর অর্থ খুজে দেখা। দ্বিতীয়, বাক্যের আকার-ইংগিত ও অন্যা্য শব্দের যোগাযোগে এর অর্থ উদ্ধার করার প্রচেষ্টা চালানো। আর দুটো ব্যাপারই নিজের ব্যক্তিগত মত ও চিন্তাশক্তির প্রয়োগের ওপরে নির্ভরশী। সুতরাং এখানেও বুদ্ধি এসে মাঝখানে দাঁড়ায়। এখান থেকেই মতানৈক্যের সুযোগ দেখা দেয়।
এ ব্যাপারে দুটো সত্য স্মরণ রাখা দরকার। একটা এই, একই আরবী শব্দ বিভিন্ন অর্থে প্রয়োগ করা যেতে পারে। দ্বিতীয়, মানুষের বুদ্ধির পরিমাণ এক নয়। তাই যখন বিভিন্ন লোক বাক্যের আকার-ইংগিত ও অন্যান্য শব্দের সাথে রেখে শব্দের বিভিন্ন অর্থের একটাকে নির্ধারিত করে, তখন তারা জ্ঞানের পরিমাপের বিভিন্নতার দরুন স্বভাবতই ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছে। এ কারণে মতানৈক্য দেখা দেয়।
এ ক্ষেত্রে সাহাবী ও তাবেঈনদের ভেতরে মতানৈক্য দেখা দেবার কারণ এটাই। প্রত্যেকেই নতুন মত দিয়েছেন। তাই নিরপেক্ষ তাফসীরকারের প্রয়োজন হচ্ছে দুর্বোধ্য শব্দের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দু’বার দু’দিক থেকে বিচেনা করে দেখা। এক তো আরববাসী সে শব্দটিকে যত অর্থে ব্যবহার করেছে, সবগুলো দেখা চাই। আর ভেবে দেখা চাই যে, এর ভেতরে কোন্ অর্থটি এখানে অধিকতর প্রযোজ্য। দ্বিতীয়, বাক্যের আকার-ইংগিত দেখা দরকার কোন্ অর্থটি এখঅনে অধিকতর উপযোগী মনে হয়। তারপরে সঠিক ও উপযুক্ত শব্দটি বেছে নেয়া দরকার।
আমার সিদ্ধান্ত:
আমি এ ব্যাপারে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করেছি। সব পূর্ব শর্তগুলোর ওপরে গভীর দৃষ্টি দিযে প্রয়োগ স্থলে পুরো বিবেচনার সাহায্যে প্রাসংগিক সব ব্যাপার খতিয়ে দেখে তারপর নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। আর তা এতই সূক্ষ্ম ও যথাযথ হয়েছে যা পক্ষপাতদূষ্ট মনোভাব না থাকলে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। নীচে কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি: তা থেকে এর সত্যতা বুঝতে সুবিধা হবে। (আরবী************)
নিহত ব্যক্তির রক্তের বিনিময় গ্রহণ তোমাদের ওপরে ফরয হল। (সূরা বাকারা -১৭৮)
এখানে কিসাসের যে নির্দেশ রয়েছে, তার মূল রহস্য, হল এই, নিহত ব্যক্তি ও কিসাসের ভেতরে সামঞ্চস্য বিধান প্রয়োজন। এ আয়অতে ক্ষতি ও বিনিময়ের জন্যে শর্ত ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তাকেও কিসাসের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত ধরে নেয়া প্রয়োজন। (****) –এর ভেতরে এমনকি লিংগের যে শর্ত রযেছে, তাও যেন লোপ না পায়। এ লিংগের শর্ত লোপ কিংবা শব্দের সাধারণ অর্থকে অপ্রয়োজনীয় বলার জন্যে এমন ধরনের কোন হেরফেরের প্রয়োজন নেই, যা সামান্য চিন্তা করলেই অর্থহীন মনে হতে পারে।
(আরবী************)
জনসাধারণ আপনাকে কাছে চাঁদ নিয়ে প্রশ্ন করে? (সূরা বাকারা -১৮৯)
আমার গবেষণা মতে এখানে ‘ইহল্লাহ (চাঁদ) শব্দ দ্বারা ‘আশহুর’ (মাস) অর্থ নেয়া হয়েছে। কারণ এর পরেই যখন হজ্জের উল্লেখ এসেছে, তাতে এখঅনে হজ্জের মাস সম্পর্কেই প্রশ্ন করা হযেছে। তা জবাবে বলা হয়েছে:
(আরবী************)
এটা মানুষের সময়-জ্ঞানের ও হজ্জের উপায় স্বরূপ।
এখানে বিশেষ করে হজ্জের উল্লেখ আমার অনুসৃত অর্থের দিকে ইংগিত করে। তা না হলে শুধু সময়-নির্দেশক বলাই যথেষ্ট ছিল।
(আরবী************)
তিনিই আহলে কিতাবের ভেতর থেকে আল্লাহ্ দ্রোহীদের দেশ হতে নির্বাসিত করেছেন প্রথম হাসরের জন্যে। (সূরা হাশর০২)
এখানে আমার মতে (***) দ্বারা (প্রথম প্রেরিত সেনাদল) অর্থ নেয়া হয়েছে। দেখতে যদিও দুয়ের ভেতরে তেমন সাদৃশ্য মেলে না, কিন্তু অনুসরণ করলে দেখা যায়, কোন কোন স্থানে ‘হাশর’ শব্দ দ্বারা সেনাদল অর্থ নেয়া হযেছে। যেমন:
(আরবী************)
এবং মাদায়নে সেনাদল পাঠাও। (সূরা শুয়া’রা -৩৬)
অপর এক জায়গায় হযরত সুলায়মান (আ) সম্পর্কে বলা হয়েছে। (আরবী************)
এ বাক্যে ‘হাশর’ শব্দ সৈন্য সমাবেশের অর্থেই ববহৃত হয়েছে।
আলোচ্য যে, আয়াতটিতে আহলে কিতাবদের ভেতরকার কাফিরদের কথা বলা হয়েছে, মূলত তা বনু নজীরদের ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট। তাই আমার ধারণা যে, আমি যে অর্থ বলেছি এখানে সেটাই অধিকতর প্রযোজ্য।
নাসিখ-মনসূখ-এর ব্যাখ্যা দিতে পূর্ববর্তী ও পরবর্তীরেদ মতভেদ:
আয়াতের নাসিখ-মনসুখ প্রশ্নও কুরআন ব্যাখ্যার কঠিনতম সমস্যা। কারণ সেটার যদি সঠিক জ্ঞান না থাকে তাহলে আয়াতের মর্মোদ্ধার মুশকিল হতে বাধ্য। তাই এ ব্যাপারে যে সব জটিলতা রয়েছে, তা বুঝে নেয়া দরকার।
এখানে সর্বাগ্রে মনে রাখা দরকার যে, ‘নসখ’ শব্দটি বিভিন্ন দল ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন। সাহাবা ও তাবেঈন এক অর্থে, মুহাদ্দিসরা অন্য অর্থে এবং উসূলী (মূলনীতি নির্ধারক) আলেমরা আরেক অর্থে ব্যবহার করেছেন। একই শব্দের তিন অর্থ অবশ্যই জটিলতা সৃষ্টির ছিল; তাই হয়েছে।
সাহাবাদের প্রয়োগ বিধি:
সাহাবা ও তাবেঈন ‘নসখ’ শব্দটিকে প্রায়ই আভিধানিক অর্থে অর্থাৎ কোন কিছুর দুর করা বা লোপ করার অর্থে প্রয়োগ করেছেন। তাঁদের ব্যবহার অনুসারে ‘নসখ’ অর্থ দাঁড়ায় এই, আগের আয়াতের কোন নির্দেশ পরের আয়াত দ্বারা বাতিল করা এবং তার বিভিন্ন ধারা হতে পারে। হয়তো পরবর্তী আয়াত দ্বারা এটা ব্যাখ্যা করে বলে দেয়া যে, আগের আয়াতের নির্দেশটির সময় পার হয়ে গেছে। অথবা পরবর্তী আয়াতে এমন কোন কথা থাকে, যার ফলে আগের আয়াতের সাধারণ নির্দেশটির বদলে চিন্তাধারা অন্য দিকে চলে যায়। ফলে পয়লা আয়াতের হুকুমটি আপনা আপনিই বাতিল হয়ে যায়। তানসীখের কখনও এরূপ রীতিও দেখা যায়, পরবর্তী আয়াতে বিশেষভাবে কোন শর্তের ওপরে জোর দেয়ার ফলে আগের আয়াতের ব্যাপক নির্দেশটি সীমিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ নির্দশটিকে মনসূখ ধরা হয়। কখনও আবার পরবর্তী আয়াতের এরূপ তথ্য মেলে যাতে করে আগের আয়াতের একটা অস্পষ্ট অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। ফলে আগের অর্থটি মনসূখ হয়ে যায়।
এটা এমনি এক ক্ষেত্রে যে, মানবীয় বুদ্ধি প্রয়োগের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। যার ফলে দেখা দিয়েছে প্রচুর মতানৈক্য। যার ফলে মনসুখ আয়াত পাঁচশত পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
মনসুখ আয়াতের ব্যাপারে দ্বিতীয় স্বরণযোগ্য কথা হচ্ছে এই, সবকিছু নির্ভর করে ইতিহাস জানার ওপরে। কারণ সাহাবাদের ব্যবহারে ‘নসখ, যতরূপ অর্থ দিয়েছে, তা থেকে এটা নির্ধারণ করা মুশকিল য, কোন্টি সত্যিকারে মনসূখ, আর কোনটি নয়। তাই ‘মনসুখ’ আয়াত ঠিক রার জন্যে অতীতের ইতিহাস ঘাটতে হয়। কখনো অতীতের পূণ্যাত্মাদের সর্ববাদী সম্মত মতকে দলীল ঠিক করা হয়। সাধারণের কথা থাক- বড় বড় ফিকাহ্ বিদরা পর্যন্ত এ পথেই পা বাড়িয়েছেন। অথচ এ ধরনের ঐক্যমত বা ইজমার ওপরে নির্ভর করা ভুল। কারণ এ সম্ভাবনা থেকেই যায় যে, আয়াতের মর্ম ভুল বুঝা হয়েছিল। সে অবস্থায় ‘মনসুখের আর আস্থা কোথায়? স্থুল কথা, মনসুখ আয়াতের বিতর্কটি অনেক ঘোরালো ব্যাপার। এর শেষ প্রান্তে পৌছা কঠিন ব্যাপার।
মুহাদ্দিসদের পথ:
মুহাদ্দিসরা নিজেদের এক আলাদা পথ তৈরী করেছেন। এ ব্যাপারে তাঁরা কেবল আলোচ্য শ্রেণীগুলোকে যথেষ্ট ভাবেন নি। এ ছাড়া আরও বস্তু তাঁরা আমদানী করেন। যেমন সাহাবাদরে ভেতরে যদি কোন ব্যাপার নিয়ে বিতর্ক হল, সে ক্ষেত্রে কেই একটি আয়াত প্রমাণ বা উদাহরণ স্বরূপ উত্থাপন করলেন কিংবা স্বয়ং রসূল (স) সে আয়াতের কোন হুকুম পাঠ করে শুনালেন মুহাদ্দিসরা এ ধরনের সব জায়গাই উদ্ধৃত করেন। তাছাড়া আয়াতের ওপরে আলোকপাত করার মত যদি কোন হাদীস থাকে কিংবা রসূল (স) বা তাঁর সাহাবাদের কেউ আয়াতের বিশেষ কোন উচ্চারণ রীতি বা অর্থ বলে থাকেন এ প্রসংগে তাঁরা তাও টেনে নিয়ে আসেন।