দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ কুরআনের সূরাসমূহ বিভিন্ন আয়াতে বিভক্তি করওন ও তার রচনা রীতি
পাক কালমের ধরন-ধারনের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই, যেভাবে একটা কাসীদা, প্রশংসাসূচক কবিতা বিভিন্ন ধরনের কিতপয় চরণেভ বিভক্ত থাকে, তেমনি কুরআনের সূরাগুলোও বিভিন্ন ধরনের কতিপয় আয়াতে বিভিক্ত রয়েছে। বেশী হলে এই বলা যেতে পারে কুরআনের আয়াত ও কাসীদার চরণের ভেতরে কিছুটা পার্থক্য রাখা হয়েছে। অবশ্য উদ্দেশ্যের দিক থেকে এ ব্যাপারটি উভয় ক্ষেত্রেই সমান গুরুত্ব রাখে যে, পাঠক কিংবা শ্রোতাদের কেবল রসগ্রহণ ও চিত্ত বিনোদনের জন্যেই এগুলো পড়া বা শোনা উচিত নয়।
কুরআনের আয়াত ও কবিতার চরনের মধ্যে পার্থক্য:
কবিতার চরণ ও কুরআনের আয়াতের ভেতরে একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য হচ্ছে, এই, খলীল নাহভী (বৈয়াকরণিক) কবিতার জন্যে যে রীতি-নীতি ও ছন্দ অলংকার শর্ত করেছেন, কবিতায় সেগুলোর মেনে চলতে হয়। অন্য কবিতরা এ ব্যাপারে তাঁর থেকে শিখে নিয়েছিল। পক্ষান্তরে, কুরআনের আয়াতে যে ওজন ও ছন্দ নির্ধারিত হয়েছে, তা কবিতায় নির্ধারিত ছন্দ-স্পন্দনের বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ আলাদ ধরনের এবং অধিকতর প্রকৃতি সম্মত। কবিদের কৃত্রিম ও ধরা-বাঁধা রীতি নীতির সাথে এর কোনই সম্পর্ক নেই। কবিতা ও আয়াতের ভেতরে যে সব ঐক্যসূত্র রয়েছে, সেগুলো সাধারণ পর্যায়ের বৈ নয়। সে গুলো যাচাই করা কিংবা তা নিয়ে আলোচনা করা নির্থক। অবশ্য এ দুয়ের ভেতরকার পার্থক্য সৃষ্টিকারী ব্যাপারগুলো আলোচনা ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে।
কুরআন ও কবিতার ঐক্যসূত্র
ওপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনাটির এবারে বিশ্লেষণ দিচ্ছি। ছন্দোবদ্ধ ও অলংকারপূর্ণ কবিতা থেকে প্রত্যেক রসবোদ্ধাই রসগ্রহণ করতে পারে। তাতে বিশেষ এক ধরনের রসানুভূতি ও আকর্ষণ থাকে। যদি সেগুলোর কারণ খুঁজে দেখা হয়, তা হলে জানা যাবে যে, বাক্যের অংশগুলো পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ ও পরস্পর সম্পৃক্ত, সেরূপ প্রত্যেকটি বাক্যই শ্রোতার ওপরে প্রভাব বিস্তার করে। সংগে সংগে তার আরও শোনার আগ্রহ বাড়িযে দেয়। এ আগ্রহ ও অপেক্ষার মুহূর্তে যখনই সেরূপ আরও সাজানো বাক্য সামনে আসে, তখন সে খশীতে উথলে ওঠে। যদি সে চরণ ছন্দের সাথে অলংকারের দিক দিয়েও সমান সফল হয়, তাহলে তো কথাই নেই। সুতরাং কবিতায় আকর্ষণ ও আনন্দ লাভের রহস্যটি মানুষের জন্মগত সূত্রেই পাওয়া। বস্তুত কোন দেশের কোন জাতি এমন নেই, যারা রসবোদ্ধা ও রুচিবান মানুষ হয়েও কবিতা দ্বারা প্রভাবান্বিত হয় না।
মাত্রা ও ছন্দের গাঁথুনীর এ প্রাকৃতিক ও সার্বজনীন সম্পর্ক সত্ত্বেও সব এলাকায় সে সবের ধারণা এক নয়। বরং মাত্রার অংশ ছন্দের শর্তসমূহের ব্যাপারে প্রত্যেক জাতির ভিন্ন ধারণা ও দর্শন রয়েছে। তাই প্রত্যেক ভাষার কবিতা সৃষ্টির নিয়মনীতি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। আরবরা বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ খলীলের দেয়া নিয়ম নীতির অনুসারী। ভারতবাসী এ ব্যাপারে ঠিক তাদের রুটি ও রীতি অনুসারে আলাদা নিয়মকানুন রচে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, যুগ বদলের সাথে সাথে মাত্রা ও ছন্দের নিয়মও বদলে যাচ্ছে। যখন মাত্রা ছন্দের সব নিয়ম কানূন সামনে রাখা সম্ভব হবে, আর তার সব গুলোর ভেতরে কোন ঐক্যসূত্র খুঁজে দেখা যাবে, তখন দেখা যাবে, সেগুলোর ভেতরে কাল্পনিক ও আপেক্ষিক কোন সূত্র ছাড়া কিছুই মিলবে না।
আরবী ও ইরানী নীতি:
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আরবরা মাত্রা ও ছন্দের ব্যাপারে যতখানি স্বাধীনতা দেয়, ইরানীরা ঠিক ততখানিই কঠোরতা অবলম্বন করে। আরবদের কাছে কবিতার মাত্রার ক্ষেত্রে সামান্য এদিক ওদিক অন্যায় নয়। যেমন, তারা কবিতার মাত্রা “মাফাএলুন” ()***) এবং মুফতা এলুন’ (****) মুস্তাফ এলুন (***) এর স্থলে ব্যবহার বৈধ রাখে, আর বিনা দ্বিধায় তা অনুসরণ করে চলে। এমনকি তারা ‘ফাএলাতুন’ (***) ও ‘ফুলাতুন’ (***) কে সমান মাত্রা বলওতেও দ্বিধা করে না। এ ধরনের আরও বহু ছোট খাট ব্যাতিক্রমকে তারা কবিতার ক্ষেত্রে বৈধ মনে করে ও অবাধে তারা কবিতায় তা অনুসরণ করে চলে।
পক্ষান্তরে ইরানীরা মাত্রার বেলায় এরূপ ব্যাতিক্রম ন্যায় মনে করে না, এক্ষেত্রে কোনরূপ ত্রুটি বিচ্যতি ক্ষমতার যোগ্য মনে করে না। ছন্দের ক্ষেত্রেও ঠিক সেই অবস্থা। আরবদের কাছে ‘কবুর’। (****) শব্দের সাথে ‘মুনীর’ (***) শব্দের মিল ছন্দ পতন ঘটায় না। কিন্তু ইরানীদের বেলায় তা ঘটায়। আরব কবিরা হাসিল, (***) নাযিল (****) ইত্যাদি শব্দ একই মিলের মনে করে। কিন্তু ইরানীরা এ ব্যাপারে একমত নয়। আরববাসীর কাছে কোন শব্দের অর্থেক এক চরণে বাকী অর্ধেক অন্য চরণে ব্যবহার চলে। কিন্তু ইরানীরা এ ধরনের শব্দ ব্যবহার সর্বতোভাবে অবৈধ মনে করে।
মোটকথা, আরব আর ইরানীদের ভেতরে কবিতার রীতিনীতি নিয়ে যত বেশী মতানৈক্য রয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে তা বলতে হয়, এ দু’দেশের মাত্রা ও ছন্দের ঐক্যেসূত্র কাল্পনিক ও আপেক্ষিক ছাড়া আর কিছুই নয়।
ভারতীয় বাক্য রীতি
ভারতীয় কাব্য রীতি ইরানী ও আরবদের থেকে স্বতন্ত্র। তারা কবিতার জন্যে যে মাত্রা ঠিক করেছে, তা অক্ষরের সংখ্যার ভিত্তিতে। হোক সে হসন্ত যুক্ত কিংবা স্বরচিহ্ন যুক্ত। এ সত্ত্বেও এ মাত্রারীতি, রস সঞ্চার ও আকর্ষণ সৃষ্টি সমানেই করছে। আমি অনেক মুর্খ পল্লীবাসীকেও কবিতা রচনা করতে দেখেছি। তারা সুরের ওপরে ভিত্তি করে মিলিযে মিলিযে ছড়া গেঁথে যায়। আর তাকে এক বা একাধিক শব্দের কোরাস মিলাবার ছোট্য চরণ থাকে। এরাও যে মাত্রা ও ছন্দ ঠিক করে, তার ব্যাতিক্রম করে না। তারা নিজেদের কবিতা পাঠের ঢঙে ঠিক আরবদের কাসীদা পাঠের ঢঙ অনুসরণ করে। আর এতেই সবাই রস ও আনন্দ পায়। এভাবে প্রত্যেক সম্প্রদায় ও জাতি ভিন্ন ভিন্ন কাব্যরীতি অনুসরণ করছে। বাহ্যত সেগুলোর ভেতরে তারতম অনেক। তথাপি সবগুলো ভেতরে একটা মৌলিক ঐক্যসূত্র রয়েছে।
সংগীত-রীতি
কবিতার মত গানেও মানুষের আকর্ষণ স্বভাবতই রয়েছে। আর দুনিয়ার সব এলাকার মানুষই গানে আনন্দ লাভ করে। কিন্তু রীতিনীতির বেলায় এখানেও বিভিন্ন জাতির ভেতরে পার্থক্য দেখা যায়। গ্রীকরা সংগীত চর্চার জন্যে যে রীতির প্রবর্তন করেছে, ও যে মাত্রা নির্ধারিত করেছে, তারা তার নাম রেখেছে মাকামাত। মাকামাতকে সামগ্রিক বস্তু ধরে নিয়ে তা থেকে বিভিন্ন সুর ও রাগসৃষ্টি করে। এভাবে ক্রমাগত এগিয়ে সংগীতরীতি একটা স্বতন্ত্র ও ব্যাপক বিদ্যায় রূপ নিল।
পক্ষান্তরে, ভারতীয়রা নিজেদের সংগীত চর্চার জন্যে ছ’টি মূলনীতি ঠিক করেছে। তার নাম দিয়েছে রাগ। সে রাগ থেকে নানারূপ রাগীনী জন্ম নেয়। এভাবে ক্রমোন্নয়নের ধারা বেয়ে তারাও এটাকে একটা ব্যাপক ও স্বতন্ত্র বিদ্যায় পরিণত করল। আর তা গ্রীক সংগীত রীতি থেকে স্বতন্ত্র রূপ নিল। কিন্তু আমরা পল্লীবাসীদের দেখে বুঝতে পাই, তারা গ্রীক ও ভারতী দু’রাগকেই বাতিল করে দিয়ে নিজেদের রুচি ও মর্যী মোতাবেক স্বতন্ত্র সংগীত পদ্ধতি অনুসরণ করে চলছে। সব আইন কানুন ভেংগে চুরে তারা এক জগাখিচুরি হৈ-হুল্লা জুড়ে দেয়। অথচ তাতেও তারা গ্রীক ভারতী সংগীত শাস্ত্র অনুসারীদের চাইতে কোন অংশে কম আনন্দ পায় না।
যখন আরা এসব ব্যাপার সামনে রাখি আর সংগীত চর্চার নানা বিদ্যা ও সেগুলোর ভেতরকার ঐক্যসূত্র তালাশ করি, তখন জানতে পাই কাব্যের মত গানেরও সেই ঐক্য নেহাৎ কাল্পনিক ও আপেক্ষিক।
সারকথা, সংগীত-বিদ্যা হোক আর কাব্য-শাস্ত্র হোক, দুয়ের বিভিন্ন রীতির ভেতরে যে ঐক্যসূত্র রয়েছে সেটা হল সুর সৃষ্টি। আর তার সম্পর্ক সেই মাত্রা বা রাগের সাথে জড়িত, যা আমরা কবিতা ও গানের সব রীতির ভেতরে সমানে পাই। বস্তুত, গান ও কবিতার সেই মূল সুরই সব বিদ্যার ভেতরকার একমাত্র ঐক্যসূত্র। রুচি ও রসবোধের সম্পর্ক সেই সুরের রেশেই বাঁধা। আর তা অবশ্যই কোন রীতি নীতির রশিতে ধরা দেয় না।
কুরআনের বর্ণনারীতিতে চিরন্তন সৌন্দর্যের চয়ন:
বস্তুত আল্লাহ যখন এই মাটির মানুষের সাথে কথা বলতে চাইলেন, তখন সব কাব্য ও সংগীতের মূল ঐক্যসুর চিরন্তন সৌন্দর্যটি তিনি বেছে নিলেন এবং নানা দেশের নানান রীতি নীতি বর্জন করলেন যা সদা পরিবর্তনশীল। আদতে যুগে যুগে মানুষ সীমাবদ্ধ জ্ঞান যে রীতি গড়ে তোলে, তা তাদের ক্রমাগত মূর্খতার পরিচয় দিয়ে চলে। তাই তা ছেড়ে বাক্য, বাক্য বা সংগীতের সামগ্রিক সৌন্দর্য সমষ্টিকে এভাবে কাজে লাগানো যেন বর্ণনার প্রতিটির ক্ষেত্রেই যথাযথ ও সষমন্ডিত হয়ে ওঠে। সেটাই নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর ও সাড়ম্বর বর্ণনারীতি।
আয়াতের রচনারীতি:
যদিও কুরআনের আয়াতের মাত্রারীতি প্রচলিত সব রীতির থেকে আলাদা, তথাপি তা রীতি নীতি ছাড়া নয়। তার নিজস্ব বিশেষ নিয়মনীতি রয়েছে।
বস্তুত, কুরআনের বিভিন্ন সূরার ভেতরে যে রীতি অনুসরণ করা হয়েছে, সে সবের ভেতরকার সব রীতিগুলোর বৈশিষ্ট্যের মূল সূত্র ধরে নতুন এক রচনা রীতি নির্ধারিত করা চলে। কুরআনের মাত্রার জন্যে শ্বাস ও স্বরকে ভিত্তি করা হয়েছে। ‘বাহরে ত্বাবীল’(****) ও ‘বাহরে মদীদ’ (****) এর মত ধরা বাঁধা মাত্রার আশ্রয় নেয়া হয়নি। তেমনি ছন্দের জন্যেও সেই পন্থা অনুসরণ করা হয়নি যা আমরা কবিতায় দেখতে পাই। বরং একটি শ্বাস নিয়ে যে শব্দ নিঃশেষিত হয়, সেই শব্দটি কুরআনের আয়াতে ছন্দের গ্রন্থি হয়ে দেখা দেয়; হোক তা আমাদের পরিকল্পিত ছন্দরীতির প্রতিকূল। কুরাআনের মাত্রা ও ছন্দ রীতির এটাই চরম সংক্ষিপ্ত পরিচয়। অবশ্য এটা ব্যাখ্যাপ সাপেক্ষ বটে।
প্রকৃতিগত শ্বাস প্রশ্বাসের যাতায়াতই কুরআনের আয়াতের ছন্দ রীতি:
মূলত বুকের ভেতরে শ্বাস প্রশ্বাসের যাতায়াত চিরন্তরন ও প্রকৃতিগত ব্যাপার। যদিও শ্বাস বাড়ানো কমানো মানুষের ইচ্ছার ওপরে নির্ভরশীল তথাপি শ্বাসকে যদি স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে তার আসা যাওয়াটা একটা নির্ধারিত সময় অনুসরণ করে চলে। মানুষ যখন একবার শ্বাস টানে, তখন তার ভেতরে বিশেষ এক ধরনের প্রশ্বাস ক্রিয়া শুরু হয়। সেটা ধীরে ধীরে থেমে যায় এবং তখনই মানুষের দ্বিতীয়বার শ্বাস টানার প্রয়োজন হয়। শ্বাস প্রশ্বাসের এই আসা যাওয়ার নির্দষ্ট একটা সময় পেরিয়ে যায়। যদিও তা সুনির্দিষ্ট সময় নয়, সামান্য এদিক ওদিকও হয়ে থাকে, তথাপি এ বেশ –কমটা সীমার ভেতরেই থাকে।
সুতরাং বাক্য বা চরণের ভিত্তি যদি এই শ্বাস-প্রশ্বাসের ওপরে রাখা হয়, তাহলে বিভিন্ন চরণের ভেতরে দু’তিন শব্দের বেশী তারতম্য দেখা দেয় না। বরং অধিকতর খাঁটি কথা তো এই যে, কোন শব্দের এক চতুর্থাংশ কিংবা এক তৃতীয়াংশের বেশী তারতম্য কমই দেখা দেয়। আর এ সামান্য পার্থক্য এমন গুরুতর কিছু নয়, যার ফলে চরণটি রীতির সীমা লংঘন করে কিংবা মাত্রা হারিয়ে ফেলে।
বস্তুত এর ফলে ক্ষতি তো তেমন হয়ই না, পরন্তু রচনার ক্ষেত্রে বাড়ানো কমানোর স্বাধীনতা পাওয়া যায় ও আগ্ পিছ করার সুযোগ মেলে। যার ফলে নিয়ম নীতির ভেতর দিয়েও বাক্যের সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রাখার, এমনকি বাড়ানোরও সম্ভাবনা থাকে। (বলা বাহুল্য, কুরআন চৌদ্দশত বছর আগে আধুনিক মুক্ত ছন্দেরই প্রবর্তন করে গেছে। )
আয়াতের ওজন বা মাত্রা
বলা বাহুল্য, শ্বাসের এ সময়টিকেই কুরানের মাত্রার মানদন্ড করা হয়েছে। সেটাকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। দীর্ঘ, (****) মধ্যম, (**) ও হ্রস্ব, (***)। দীর্ঘ মাত্রার উদাহরণ হল সূরা নিসা, মধ্যম মাত্রার উদারহণ হল সূরা আরাফ ও আনআম এবং হ্রস্ব মাত্রার উদাহরণ হল সূরা শূরা ও সূরা দুখান।
কাফিয়া বা আয়াতের ছন্দ রীতি:
আয়াতের মাত্রার মতই তার ছন্দরীতির ভিত্তিও হল শ্বাসের সময়। শ্বাসটি যে শব্দে গিয়ে নিঃশিষিত হবে, আয়াতে ‘কাফিয়া’ সেটাই নির্ধারিত হবে। কেবল সুক্ষ্ম অনুভূতি সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারবে। শ্বাস গিয়ে ‘আলিফে’ই শেষ হোক কিংবা ‘ইয়া’য় হোক, সে বাক্যের শেষ অক্ষর ‘বা’ হোক কিংবা ‘জীম’, তথাপি সেই ‘কাফিয়া’ হয়ে রসানুভূতির উদ্রেবক করবে।
এই হিসেবেই ‘য়্যালামূন’ ‘মুমিনীন’ ও ‘মুস্তাকীম’ তিনটা ভিন্ন ধরনের শ্বব্দ হয়েও পরস্পর সম্পর্ক রাখে এবং পরস্পরের ‘কাফিয়া’ হয়ে দাঁড়ায়। আর ‘খুরুজ’, ‘মারাজ’ ‘তাওহীদ, তেবার, ফেরাক’, ‘এজাব’ ইত্যাদি পরস্পরের ভেতরে যতই পার্থক্য রাখুক, তথাপি নির্ধারিত রীতির ভেতরেই শামিল থাকছে।
আলিফ দ্বারা সৃষ্ট ছন্দ:
শেষে আলিফের সংযোজন ও “কাফিয়া” ছন্দের সৃষ্টি হয়। তেমনি, বাক্যের শেষে আলিফের সংযোজনও ‘কাফিয়া’ সৃষ্টি করে, হোক তার আগের অক্ষর বিভিন্ন। যেমন ‘কারীমা’, ‘হাদীসা’ ও ‘বাসিরা’। কারণ কুরআনের নির্ধারিত নীতিতে এরা এত দূরত্ব সত্ত্বেও ‘কাফিয়া’ সৃষ্টি করতে পারে।
পূর্বের অক্ষরের সমতাও অধিক শ্রুতি মধুর:
এরূপ অবস্থায় যদি পূর্ব অক্ষরের সতাও শর্ত করা হয়, তাহলে নীতির দিক থেকে অপ্রয়োজনীয় হলেও অধিকতর শ্রুতিমধুর হবে ঠিকই। সূরা মরিয়ম এবং সূরা ফুরকান তার সাক্ষর বয়ে চলছে। তেমনি যদি সব আয়াতেই একই অক্ষরে গিযে সমাপ্তির শর্ত লাগানো হয়, যেরূপ সূরা কেতালের আয়াতগুলো ‘মীম’ অক্ষরে ও সূরা রহমানের আয়াতগুলো ‘নূ’ অক্ষরে শেষ হয়েছে তাতেও রস সৃষ্টির মাত্রা বাড়বে।
এভাবে আয়াতের এক বিশেষ সমষ্টির পরে কোন আয়াতের বারংবার উল্লেখের ভেতরেও বিশেষ ধরনের এক রস সৃষ্টি হয়। যেমন, সূরা শূরা, রহমান, সরা কামার ও সূরা মুরসালাতের বর্ণনা রীতি।
সূরার প্রথম ও শেষ ‘কাফিয়া’ ছন্দের পরিবর্তন:
কখনও শ্রোতার রুচি লক্ষ্য করে কিংবা বাক্যের সৌন্দর্যানুভুতি সৃষ্টির জন্যে প্রথম ও শেষ আয়াতের কাফিয়ার ঢং বদলে দয়ো হয়। যেমন, সূরা মরিয়মের শেষে ‘ইদ্দা’ ও হাদ্দা, এবং সূরা ফুর্কানের শেষে ‘সালামা’ ও ‘কিরামা’ এবং সূরা ‘সোয়াদ’ এর শেষে ‘তীন’ ‘সাজেদীন’ ও মুনজেরীন এসেছে। অথচ এটা সর্বজনবিদিত যে এ সব আয়াতের প্রথম দিকের ছন্দরীতি (কাফিয়া) সম্পূর্ণ অন্য ধরনের।
কুরআনের ‘কাফিয়া” (ছন্দ) রীতি
ওপরে ওজন ও কাফিয়ার যে মানদন্ড বলে দেয়া হল, কুরআনের অধিকাংশ সূরাই এর ভিত্তিতে বিরচিত। যদি কোন আয়াতে এর ব্যতিক্রমে শেষ অক্ষরে কাফিয়া দেখা না যায়, তা হলে সেটাকে এমন বাক্যের সাথে মিলিয়ে দেয়া হয়, যার শেষে কাফিয়া বিদ্যমান রয়েছে। অবশ্য যে বাক্যটি বাড়ানো হয়, সেটাতে বিশেষ কোন বিধি নিষেধ থাকে না। কেবল আল্লাহর কোন নিদর্শন কিংবা সাধারণ সতর্কবাণী থাকে। কাফিয়া মিলানোর জন্যে সাধারণত নিম্ন ধরনের বাক্যের সংযোজন ঘটানো হয়:
(আরবী***************) (এবং তিনিই (আল্লাহ) বিজ্ঞতম ও সর্বজ্ঞ।
(আরবী***************) এবং আল্লাহ তা’আলা জ্ঞান বিজ্ঞানে অদ্বিতীয়।
(আরবী***************) এবং আল্লাহ তা’আলা তোমরা যা কিছু কর, সব খবরই রাখেন।
(আরবী***************) যেন তোমরা ভয় কর।
(আরবী***************)
নিশ্চয়ই এর ভেতরে জ্ঞানীদের জন্যে নিশ্চিত নিদর্শন রয়েছে। এভাবে কুরআন যেখানে সংকোচনের স্থলে সম্প্রসারণ নীতি অবলম্বন করেছে, সেখানেও এ পন্থা অনুসরণ করেছে।
(আরবী***************) এবং এ ব্যাপারে যারা খবর রাখে তাদের জিজ্ঞেস কর।
এভাবে আয়াতের ধারাবাহিকতায় কখনো ওলট পালট হয়েছে। কখনও আগ-পিচ করা হয়েছে। কখনও অক্ষর বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে। যেমন- (***) এর স্থলে (****)।
(***) এর স্থলে (****)
ছোট আয়াতের সাথে বড় আয়াতের সম মাত্রায় আনার রহস্য:
কুরআনে এ হিসেবে ওজনবিহীন কিছু আয়াত রয়েছে। কোন আয়াত তো সংক্ষিপ্ত, আর সাথেই রয়েছে লম্বা এক আয়াত। কিন্তু আদতে তাও মাত্রা ছাড়া নয়। কারণ এধরনের স্থানে হয় কাব্য বিন্যাসের এক বিশেষ ধারা অনুসৃত হয়েছে, নয় কোন প্রবাদ বাক্য গ্রহণ করা হয়েছে কিংবা একই বাব্যাংশের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। তাই ছোট আয়াতও অবশেষে বড় আয়াতের সমান মাত্রায় এসে গেছে।
কখনও শুরুর বাক্যাংশকে শেষের বাক্যাংশের তুলনা ছোট করা হয়েছে। তার ফলে বাক্যের সৌন্দর্য ও রস অনেকগুণ বেড়ে গেছে। যেমন:
(আরবী***************)
এধরনের সব আয়াতের শুরুর দু’ অংশ ছোট ও তৃতীয় অর্থাৎ শেষ অংশ বড় হয় শ্রোতা অজ্ঞাতেই পয়লা দু’অংশ এক আয়াত ধরে নেয় এবং শেষ অংশকে দ্বিতীয় পাল্লায় তুলে ওজন সমান করে নেয়।
তিন বাহু আয়াত:
এভাবে কখনও কখনও তিন যতিতেও বাক্য রচিত হয়ে। অর্থাৎ তিন যদি মিলে পূর্ণ এক চরণ ও চতুর্থ আয়াত একাই এক চরণ হয়। যেমন:
(আরবী***************)
এ আয়াতে তিনটি অংশ আর তিনটি মিলে একটি পূর্ণ ওজন সৃষ্টি করেছে এবং তার পরের আয়াত সমান ওজনে এসেছে:
(আরবী***************)
কিন্তু যারা এর রহস্য বোঝে না, তারা এভাবে দুটো আয়াত না ধরে ধারাবাহিক কয়েকটি আয়াত মনে করে থাকে। সুতরাং এই সুন্দর মিলের ব্যাপারটি তারা দেখে না।
দুই যতি আয়াত:
কখনও আয়াতে দু’টো যদি বা কাফিয়া নেয়। কবিতায় সাধারণত যে রূপ নেয়া হয়। যেমন:
(আরবী***************)
বড় আয়াতকে ছোট আয়াতের সম মাত্রায় ব্যবহারের রহস্য:
কখনও পাশাপাশি দু’টি আয়াতের একটি হয় লম্বা, অপরটি খাট। তা সত্ত্বেও দুয়ের ভেতরে ওজন ঠিকই থাকে। এ সমতার রহস্য মূলত আয়াত দুটোর বর্ণনারীতিতেই নিহত থাকে। মূল রহস্য হল এই, যখন ওজন কাফিয়াসহ কোন সুন্দর বাক্য সৃষ্টি হয়ে থাকে এক পাল্লায় আসে, আর অন্য পাল্লায় সহজ সাবলীল ও আকর্ষণীয় একবটি বাক্য বসে, সুরুচি তখন তাৎপ৮৮৮র দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বাক্যটিকেই মূল্য দেয় বেশী। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ সুযোগ থাকে যে, একটা কাফিয়া উপেক্ষা করে অন্য কাফিয়ায় গিয়ে ওজন শেষ করবে। সুস্থরুচির কেউ তখন এ দুয়ের ভেতরে আর অমিল অনুভব করবে না।
কিছু কিছু সূরাতে উল্লেখিত কাফিয়া মাত্রা আনা হয়নি:
এ আলোচনার গোড়াতেই এরূপ বিশ্লেষণ দেয়া হয়েছে যে, কিছু সূরায় এ রীতি অনুসৃত হয়েছে। কিন্তু কথাটা এ জন্যে বলা হয়েছে যে, কিছু আয়াতে আবার অন্য রীতি অনুসরণ করা হয়েছে। তাতে এ ধরনের কাফিয়া ও ওজন অনুসরণ করা হয়নি। বস্তুত, কতিপয় আয়াত সার্থক বক্তৃতা রীতি কিংবা পন্ডিতদের মুখনিসৃত প্রবাদ বাক্যের মতই বিশিষ্ট রীতিতে রচিত হয়েছে। নারীদের যে কাহিনী হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন, হয়ত আপনিও তা শুনছেন। তার কাফিয়ারও আপনি গুরুত্ব বুঝেছেন। তাতে অবশ্যই সেই ওজন ও কাফিয়া নেই, যা ওপরে বলে আসা হল।
কোন কোন সরায় বক্তৃতায় ঢঙ ছেড়ে পত্র রচনার রীতি অনুসরণ করা হয়েছে। তা নেহাৎ সরল ও সুস্পষ্ট। কোনরূপ অলংকারের ঝংকার সেখানে লক্ষ্য ছিল না। যেভাবে সবাই স্বাধীনভাবে পরস্পর আলাপ-আলোচনা করে, সরল সহজ কথাবার্তা চালায় ঠিক তেমনি যেখানে স্বভাবই কথা শেষ হয়, সেখানেই শেষ করে দেয়া হয়েছে। এ ধরনের বাকরীতিতে রস ও আকর্ষণ সৃষ্টির রহস্য হল এই, আরববাসী স্বভাবতই সেখঅনে থামত, যেখঅনে তাদের শ্বাস থেমে যেত। বলা বাহুল্য বাক্য তাদের শ্বাসের শেষ মীমায় গিয়ে থামত। তাই সে বাক্যে স্বভাবতই বিশেষ এক ধরনের সামঞ্জস্য ও মিল সৃষ্টি হত। সেক্ষেত্রে সব শর্ত ও রীতিনীতি মুক্ত হয়েও তাতে আকর্ষণ সৃষ্টিতে অসুবিধা হত না।
কুরআনের কোন কোন সূরায় ঠিক এই রীতিই অনুসরণ করা হয়েছে। এ রীতিতেই সে সব আয়াতগুলো লম্বা করা হয়েছে। সে যা-ই হোক আমি যতটুকু বুঝেছি, সবই বললাম। মূল সত্য তো কেবল আল্লাহই জানেন।