দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ কুরআনের দুর্বোধ্যতার কারণ ও সমাধান
জানা দরকার কুরআন খালেস ও সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। তাই আরববাসী খুব সহজেই নিজ বুঝ-ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিধান কুরআনের মর্ম বুঝে ফেলত। যার বর্ণনা কুরআনেই রয়েছে-
(আরবী*************)
তাছাড়া যেহেতু শরীয়ত প্রবর্তক (সঃ)-এর ইচ্ছা ছিল যেন মুতাশাবিহ্ দুর্জ্ঞেয় আঃয়াতের তাৎপর্য খোঁজার চেষ্টা করা না হয়, আল্লাহ্র গুণাবলী সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক না ওঠে এবং পূর্ণ কাহিনী শোনার দাবী কেউ না তোলে, তাই এসব ব্যাপারে খুব কমই প্রশ্ন উঠেছে। এ ব্যাপারে তাই বলাও হয়েছে কম হাদীস।
কিন্তু যখনই এ দল বিদায় নিলেন, ইসলামের ছায়াতলে অনারবরা ভীড় জমালো, তাদের মাতৃভাষা আরবী না হওয়ায় স্বভাবতই অনেক স্থানে কুরআনের সঠিক মর্ম অনুধাবন তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াল। তখনই আরবী অভিধান ও ব্যাকরণ নিয়ে ঘাটাঘাটির প্রয়োজন দেখা দিল।
বস্তুত এ ব্যাপারে কথা কাটাকাটির ধারা শুরু হয়ে গেল। তাফসীর গ্রন্থ লেখা শুরু হল। তাই প্রয়োজন দেখা দিল কুরআনের দুর্বোধ্য স্থানগুলো আলোচনা করা। সংগে সংগে উদাহরণও পেশ করা দরকার। তা হলে আর মূল প্রতিপাদ্য নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার সময়ে কথা বাড়াবার দরকার হবে না। সে সব স্থান বুঝাতেও কোন বেগ পেতে হবে না।
কালামুল্লাহ দুর্বোধ্য হওয়ার কারণসমূহ:
কুরআনের আয়াত কিংবা তার কোন স্থান বুঝতে কখনো এ জন্যে বেগ পেতে হয় যে, সেখানে ব্যবহৃত কোন শব্দ বা পরিভাষা প্রায় পরিত্যাজ্য বা কম ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেহেতু সে শব্দ বা পরিভাষার অর্থ সুস্পষ্ট নয়, তাই গোটা আয়াতের অর্থ বুঝাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ বিপদের প্রতিকারকল্পে দেখতে হবে যে, সাহাবা, তাবেঈন ও অতীতের আলেমরা সে শব্দ বা পরিভাষাটির অর্থ কি বুঝেছেন। এভাবে সেটার সঠিক অর্থ বুঝা যেতে পারে।
কুরআনের দুর্বোধ্যতা সৃষ্টির আরেকটি কারণ:
নাসিখ-মনসুখ সমস্যা অর্থাৎ কোন্ আয়াত পরে এসে আগের কোন্ আয়াত বাতিল করল, তা জানা থাকে না। তাই কুরআনের স্ববিরোধ পরিলক্ষিত হয়। ফলে সত্যিকারের তাৎপর্য বুঝার পথ থাকে না।
তেমনি শানে নুযূল অর্থাৎ আয়াতটি অবতীর্ণ হবার বিশেষ কারণটির প্রতি লক্ষ্য না থাকায়ও কোন আয়াতের তাৎপর্য ও তার মূল উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দুর্বোধ্যতার কয়েকটি কারণও এরূপ আছে যেগুলো মূলনীতি, ব্যাকরণ, বর্ণনা-নীতি ও ভাষা জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। এগুলো না জানার জন্যেও কুরআন দুর্বোধ্য মনে হয়।
*বস্তুত কিছু আয়াত এরূপ রয়েছে যার ভেতরে সম্পৃক্ত (মুযাফ) কিংবা গুনান্বিত )মওসুফ) বস্তু অনুল্লেখ (মাহযুফ) থাকে।
*কখনও এক শব্দের বদলে অন্য শব্দ, এক অক্ষরের বদলে অন্য অক্ষর, এক ক্রিয়ার বদলে অন্য ক্রিয়া এবং এক কর্তার বদলে অন্য কর্তা ব্যবহার করা হয়।
* কখনও এক বচনের স্থলে বহুবচন ও বহু বচনের স্থলে এক বচন ব্যবহার করা হয়।
* কখনও তৃতীয পুরুষের স্থলে মধ্যম পুরুষ, কখনও বা মধ্যম পুরুষের স্থলে তৃতীয় পুরুষ ব্যবহার করা হয়।
* কোথাও বাক্যের আগের অংশ পরে ও পরের অংশ আগে ব্যবহারের রীতি অবলম্বন করা হয়। কোথাও সর্বনাম অনির্দিষ্ট থাকে।
* কখনও একই শব্দ দ্বারা বিভিন্ন ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করা হয়। কোথাও পুনরুক্তি ও বিস্তারিত আলোচনার দ্বারা কাজ সারা হয়েছে। কোথাও আবার সংক্ষেপে ও ইংগিত বলা হয়েছে।
এসব যদি লক্ষ্য করা না হয়, তা হলে যথার্থ অর্থ অনুধাবন করা কঠিন হবেই।
এভাবে কুরআনের কোথাও বাক্যালংকার ও ব্যঞ্জনা দ্বারা কাজ নেয়া হয়েছে। স্থানে স্থানে ইংগিত-ইশারা, দুর্জ্ঞেয় শব্দ, আলংকরিক বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। এ সবের দিকেও লক্ষ্য রাখা দরকার।
সুতরাং যারা কুরআনের ব্যাখ্যাদানের মত সংকটপূর্ণ কাজে হাত দিতে চায় এবং গোড়াতেই এসব বুঝে নেয়া প্রয়োজন। এ সবের উপমা-উদাহরণগুলো যেন তারা দেখে নেয়। তাহলে এরূপ দুর্বোধ্য জায়গায় তারা বিস্তারিত আলোচনার স্থলে ইংগিত ইশারায় কাজ চালিয়ে যেতে পারবে।