দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ নাসিখ মানসুখ সমস্যা
কুরআন বুঝবার যে সব কঠিন ব্যাপার নিয়ে অনেক বিতর্ক ঘটে গেছে, সে সব ব্যাপারে মতানৈক্যও অনেক দেখা দিয়েছে, তার ভেতরে ‘নাসিখ’ ও ‘মানসুখ’ আয়াতের পরিচয় অন্যতম।
নাসিখ ও মানসুখ আয়াত নির্ধারণের ব্যাপারে সবচাইতে মুশকিলের ব্যাপার হচ্ছে পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালের তাফসীলকারদের পরিভাষার তারতম্য সৃষ্টি। সাহাবা ও তাবেঈনরা ‘নসখ’ শব্দটি যে অর্থে ব্যবহার করেছেন, পরবর্তীকালের তাফসীরকাররা সে অর্থে ব্যবহার করেন নি।
পূর্ববর্তীদের মতে নসখের অর্থ
এ ব্যাপারে সাহাবা ও তাবেঈনদের সব বক্তব্য যাচাই করলে বুঝা যায় যে, তাঁরা ‘নসখ’ শব্দটির আভিধানিক ও মূল অর্থ গ্রহণ করতেন, অর্থাৎ ‘একটি বস্তুকে অন্য বস্তু দ্বারা লোপ করে দেয়া। ’ অথচ এরূপ অর্থে ব্যবহার করাটা মূলনীতি- নির্ধারক আলেমদের ব্যবহারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। মূলনীতি নির্ধারক আলেমদের মতে ‘নসখ’ অর্থ হচ্ছে, ‘কোন এক আয়াতের কোন হুকুম অন্য আয়াতের আরেকটি হুকুম দ্বারা বাতিল করে দেয়া। ’
বস্তুত মূলনীতি- নির্ধারকদের কাছে ‘নসখ’-এর বিভিন্ন পন্থা হতে পারে। একটি পন্থা হচ্ছে এই।
*কোন একটি কাজের চূড়ান্ত সময় নির্ধারণ করে দেয়া হলে সেই নির্ধারিত সময়ের পরে কাজটি আপনা থেকেই বাতিল হয়ে যাবে। আরেকটি পন্থা হচ্ছে এই, বিশ্লেষণের সাহায্যে যে ব্যাপারটি পরে বুঝা যায়, তার দ্বারা পূর্ববর্তী বস্তুটি মনসুখ বা বাতিল হয়ে যায়।
‘নসখ’ বলতে তারা এ অর্থও বুঝে থাকেন।
যে, বিশ্লেষণ দ্বারা যদি আয়াতে বর্ণিত কোন শর্ত বা বাধ্যবাধকতা নিষ্প্রয়োজন প্রমাণিত হয় সেটা নেহায়াৎ আকস্মিক মনে হয়।
*কিংবা কোন ব্যাপক বিধানকে বিশেষ করে দেওয়া হয়।
*অথবা এমন কোন রহস্য আবিস্কৃত হয়, যার ফলে মূল বিধান ও কল্পিত বিধানের ভিতরে পার্থক্য ধরা পড়ে, বা মূর্খতাজনিত কোন সংস্কার কিংবা পূর্ববর্তীকারে বিধানগুলো ‘মনসুখ’ বুঝা যাবে।
পূর্ববর্তীদের মতে মানসূখ আয়াতের সংখ্যা
পূর্বর্তী (সাহাবা ও তাবেঈন) তাফসীরকাররা ‘নসখ’ শব্দটিকে যেভাবে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ব্যবহার করেছেন, তাতে এ বিতর্কটি বেশ ব্যাপক হয়ে ওঠে। সে ধারা অনুসরণ করে জ্ঞানের পরীক্ষার ক্ষেত্রও প্রশস্ত হয়ে যায়। তার অনিবর্য ফল দাঁড়ায় মতানৈক্যের প্রসারতা। বস্তুত তাদের সব মতগুলো যদি সামনে রাখা হয়, তা হলে ‘মনসূখ’ আয়াতের সংখ্যা পাঁচ শতেরও উপরে চলে যায়। বরং সে বিভিন্ন মতগুলো যদি বেশী সময় নিয়ে যাচাই করা যায়, তা হলে বুঝা যাবে যে, ‘মনসূখ’ আয়াত সংখ্যা।
পরবর্তীদের মতে মনসূখ আয়াতের সংখ্যা
পরবর্তীকালের (মূতাআখখিরিন) তাফসীরকাররা নসখ শব্দটি যে অর্থে ব্যবহার করেছেন, সেই বিবেচনায় অবশ্য মনসুখ আয়াতের সংখ্যা অনেক কম হয়। বিশেষ করে আমরা তার যে ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছি, সে হিসাবে তার সংখ্যা কয়েকটি মাত্র আয়াতের বেশী নয়। শায়খ জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রঃ) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ইতকানে কতিপয় তাফসীরকার আলেমের অনুসৃত অর্থের বিশ্লেষণ দানের পর তিনি মূতাআখ্খিরীনদের ধারামতে মনসুখ আয়াতের বর্ণনায় ইবনে আরাবীর অনুসরণ করেছেন। এ ভাবে তিনি প্রায় বিশটি আয়াত উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু আমার মতে এগুলোর ভেতরেও এমন কিছু আয়াত রয়েছে, যেগুলোকে মনসুখ বলে আখ্যায়িত করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়।
ইবনূল আরাবীর ব্যাখ্যা:
নিম্নে ই্নুল আরবীর ব্যাখ্যার একটি অংশ সমালোচনাসহ তুলে দেয়া হল।
(১) ইবনে আরাবীর মতে সূরা বাকারার নিম্নের আয়াতটি মনসুখ হয়েছে।
(আরবী*******************)
“আল্লাহ তাআলা তোমাদের মৃত্যুপথ যাত্রীদের জন্যে ওসীয়তের বিধান করবেন। ” (সূরা বাকারা-১৮০)
একটি অভিমতের আলোকে মীরাসের আয়াত এসে এটা মনসুখ করেছে। আরেকটি মতে বলা হয়েছে, ওয়ারিসের জন্যে ওসীয়াত সম্পর্কিত হাদীসই একে মনসুখ করেছে। তৃতীয় অভিমত এই, ইজমা (সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত) অনুসারে হয়েছে। আমার মতে নিম্নের আয়াত উক্ত আয়াটির নাসিখ (বিলোপকারী)”
(আরবী*******************)
“আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের ভেতরে ওসীয়তের বিধান প্রবর্তন করলেন। ”
আরেক কথা, ওসীয়তের হাদীস সেটাকে বিলোপ না করে বরং সুস্পষ্ট করে দিয়েছে।
২। সূরা বাকারার আরেকটি আয়াত- (আরবী***********************০
“যাদের রোযা রাখার ক্ষমতা আছে, তারাও রোযার বদলে মিসকীন খাওয়াতে পারে….। ” (সূরা বাকারা ১৮৪)
একটি মত এই নিম্নের আয়াত উপরোক্ত আয়াতটির নাসিখ:
(আরবী*****************)
“তোমাদের যার সামনেই রোযার মাস হাযির হবে, সেই রোযা রাখবে। ” (সূরা বাকারা ১৮৫)
কিন্তু আরেকটি মত আছে, এটি ‘মুহকাম’ আয়াত।
আমার মতে এর আরেকটি দিক রয়েছে। তা হচ্ছে এই, এ আয়াত অনুসারে যারা খানা খাওয়াবার ক্ষমতা রাখে, তাদের ওপরে ‘ফিদিয়াহ্’ দান ওয়াজিব। ‘ফিদিয়া্’ দ্বারা এখানে মিসকীন খাওবার অর্থ নেয়া হয়েছে। এখানে ‘মারজার (নাম) আগে যমীর (সর্বনাম) এ জন্যে নেয়া হযেছে যে, মর্তবার দিক থেকে অগ্রগণ্য বুঝাবে। আর যমীর পুংবাচক নেয়ার করণ হল যে, ‘ফিদিয়াহ’ শব্দ দ্বারা এখানে ‘তাআম’ অর্থ নেয়া হয়েছে। এবং ‘তাআম’ দ্বারা সদকায়ে ফিতর বুঝানো হয়েছে। কারণ রোযার হুকুমের সংগে সংগেই সদকায়ে ফিতরের হুকুম দেয়া হল। যেরূপ এর পরক্ষণেই আরেক আয়াতে (ওয়ালিতুকাব্বেরুল্লাহা আলা’মা হাদাকুম) ঈদের নামাযের তাকবীরেরর উল্লেখ রয়েছে, এও ঠিক তেমনি ব্যাপার।
৩। সূরা বাকারার তৃতীয় আয়াত : (আরবী*******************)
“পূর্ববর্তী উম্মতদের ওপর যেভাবে রোযা ফরয করা হয়েছিল, তোমাদের ওপরেও সেভাবে রোযা ফরয করা হল। ” (সূরা বাকারা ১৮৩)
এ আয়াত মানসুখ হল নিম্নের আয়াতের দ্বারা:
(আরবী******************)
“রমযানের রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী সংগম বৈধ করা হল….” (সূরা বাকারা ১৮৭)
কারণ, এ আয়াতে তামছীল (উদাহরণ) রয়েছে। আর তা চাচ্ছে যে, পূর্বেকার ফরয বর্তমান শরীয়ত অনুসারেও ফরয হবার সংগে সংগে এর নিয়ম নীতিও সেরূপ হয়ে গেছে। সুতরাং যে সব কাজ রোযার রাতে পূর্ব-শরীয়াতে হারাম ছিল যথা, ঘুমিয়ে
উঠে খাওয়া বা স্ত্রী সহবাস, তা এখনও হারাম ছিল্। কিন্তু সে হুজুমের বিলোপকারী হল উপরোক্ত আয়াত।
এ হল ইবনুল আরাবীর উধ্দৃতি। ইবনুল আরাবী আরেকটি মতও উল্লেখ করেছেন। তা এই উক্ত আয়াতের মর্ম মূলের অনূসৃত কার্য সুন্নাত দ্বারা বাতিল প্রমাণিত হয়েছে।
অবশ্য, আমার মত তা নয়। কারণ আয়াতে রোযা ফরয হবার ব্যাপারে অতীতের শরীয়াতকে যে উদাহরণ পেশ করা হয়েছে, তার সম্পর্ক শুধু ফরয হবার ব্যাপারেই। তাই এর দ্বারা আরবে শরীয়তাত নাযিল হবার আগে যে প্রচলন ছিল, সেটাই বদলে দেয় উদ্দেশ্য ছিল। আমি বহু খুজেও এমন দলীল পেলাম না যাতে প্রমাণ হতে পারে যে, রাসূল (সঃ) আগে এরূপ কোন হুকুম দিয়েছিলেন। আর সেরূপ যদি কোন হুকুম তিনি দিয়েও থেকে থাকেন, সেটাকেও বেশী বললে সুন্নাত পর্যন্ত বলা যেতে পারে।
৪। সূরা বাকারার আরেকটি আয়াত:
(আরবী******************)
“তারা তোমাকে মর্যাদার মাসগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন করছে। বলে দাও, সে সব মাসে রক্তারক্তি মহাপাপ… ইত্যাদি। ” (সূরা বাকারা ২১৭)
নিম্নের আয়াতিট এসে এ আয়াতটিকে বিলোপ করেছে:
(আরবী********************)
“মুশরিকদের যখন যেখানে পাও, হত্যা কর…. ইত্যাদি। ” (সূরা তওবা ৩৬)
কিন্তু, আমার মতে আয়াতটি হত্যাকে হারাম করার বদলে জায়েযের প্রমাণ দেয়। এটার ভঙ্গিটি ঠিক তেমনি, যেমনি কোন একটি কারণকে স্বীকার করে নিয়ে সেটাকে গ্রহণ করায় যে, অসুবিধা দেখা দিতে পারে, সেটা তৎসংগে বলে দেয়া। সুতরাং আয়াতিটর অর্থ দাঁড়াবে এই: নিষিদ্ধ মাসগুলোয় হত্যা ও রক্তপাত অত্যন্ত বড় পাপের কাজ বটে। কিন্তু তার চাইতেও মারাত্মক পাপ হচ্ছে ফিতনা- ফাসাদ সৃষ্টি করা। সুতরাং ফিতনা-ফাসাদ বন্ধ করার জন্যে প্রয়োজনে নিষিদ্ধ মাসেও হত্যা কার্য চলতে পারে। এ আয়াতের বর্ণনা ভঙ্গি এরূপ মর্ম বুঝা যায়।
৫। সূরা বাকারার অপর একটি আয়াত: (আরবী****************)
“তোমাদের যারা মৃত্যুপথগামী, তারা স্ত্রীতের এক বছরের ভরণপোষণের জন্যে ওসীয়ত করে যাবে। ” (সূরা বাকারা ২৪০)
এ আয়াতটি মনসুখ হয়েছে পরবর্তী চার মাস দশদিন ইদ্দত ধার্যকারী আয়াত দ্বারা এবং ওসীয়াতের হুকুম মনসুখ হয়েছে মীরাসের হুকুম দ্বারা। অবশ্য সুকন্যা (থাকার ব্যবসত্থা) সম্পর্কিত হুকুম একদলের নিকট মনসুখ হয়নি। অপর দলের নিকটে ‘লা-সুকনা হাদীস এসে মনসুখ করেছে। যেহেতু সব মুফাসসির এর আয়াতের মনসুখ হবার ব্যাপারে একমত, তাই আমিও মনসূখ মনে করি। কিন্ত এও বলা যেতে পারে যে, আয়াতটি মুমূর্ষের জন্যে ওসীয়ত জায়েয ও মুস্তাহাবা বলে প্রমাণ করেছে। এবং নারীর জন্যে এ আয়াত অনুসরণের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এ অভিমত হচ্ছে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর। আয়াতটিতেও এ ব্যাখ্যার সমর্থন সুস্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়।
৬। সূরা বাকারার অন্য এক আয়াত: (আরবী*****************)
“এবং তোমাদের মনে যা আছে তা প্রকাশ কর আর গোপনই কর, আল্লাহর কাছে তারও হিসাব দিতে হবে। ” (সূরা বাকারা ২৮৬)
কিন্তু আমার কাছে প্রথম আয়াতটি দ্বারা সাধারণ হুকুম দেবার পরে দ্বিতীয় আয়াতটি দ্বারা সেটার একটি বিশেষ দিক বুঝানো হয়েছে। কারণ আয়াতে ‘মাফী আন্ফুসিকুম দ্বারা অন্তরের সারল্য বা কুটিলতা বুঝায়। আর তা অন্তরের বিশেষ অবস্থা বৈ নয়। এ থেকে স্বতঃষ্ফূর্ত হয়ে যে সব ভাব জেগে ওঠে, সেগুলো বুঝায় না। কার যে ব্যাপারে মানুষের কোন হাতই নেই, সে ব্যাপারে তাকে দায়ী করার কোন প্রশ্নই ওঠে না।
[দুই] সূরা আল-ইমরান
৭। সূরা আল-ইমরানের নিম্নে আয়াতটি (আরবী********************)
“আল্লাহকে যতখানি ভয় করা উচিত ঠিক ততখানিই ভয় কর ইত্যাদি। ”
নীচের আয়াতটি এসে মনসূখ করেছে বলে বলা হয়: (সূরা আল ইমরান ১০২)
(আরবী*********************)
“অতঃপর আল্লাহকে তোমার সাধ্যমত ভয় কর। ” (সূরা তাবগুবন-১৬)
আরেকটি মত এও বলেছে যে, আয়তটি মনসুখ নয়, মুহকাম।
এটা অন্য কথা যে, গোটা সূরা আল ইমরানে যদি কোন আয়াতকে মনসূখ বলা যায়, তা এটাই। আমার ধারণা, পয়লা আয়াতে ‘হাজ্জা তুকাতিহী’ দ্বারা শির্ক, কুফর এবং এ ধরনের ভ্রান্ত বিশ্বাসগুলো (থেকে বিমক্তি) বুঝানো হয়েছে। মর্ম এই, বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এ সবের কোন ঠাই নেই। আর দ্বিতীয় আয়াতে যে ‘মাস্তাতা’তুম বলেছে, তার সম্পর্ক কাজের সাথে, বিশ্বাসের বেলায় নয়, কাজের বেলায়। যেমন, ওযু করার সামর্থ্য যে রাখে না, সে তায়াম্মুম করে নিবে। দাঁড়িয়ে যে নামায পড়তে অক্ষম, সে বসে পড়ৃক। এ ধরনের সমর্থনে নীচের আয়াতটি দেখতে পাই:
(আরবী*******************)
(কিছুতেই অমুসলিম হয়ে মরণ বরণ করো না। )
সুতরাং দু’টো আয়াতই যার যার জায়গায় বিশিষ্ট রূপ নিয়ে আছে। কেউ নাসিখও নয়, মনসূখও নয়।
[তিন] সূরা নিসা
৮. সূরা ‘নিসা’র নিম্নের আয়াত: (আরবী********************)
“যারা তোমাদের দাসত্বের অধীনে আছে, তাদেরকে সম্পদের অংশীদার কর। ” (সূরা নিসা ৩৩)
মনসুখ হয়েছে সূরা আনফালের নীচের আয়াত দ্বারা:
(আরবী****************)
“সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে বংশধরই বিবেচ্য। তাদের একদল আরেক দলের উপরে স্থান পায়। ” (সূরা আন ফাল ৭৫)
আমার মতের, আয়াতের বাহ্যিক অর্থ অনুসারে ‘মীরাস’ কেবল হাকিকী মাওয়ালীর জন্য-প্রতিশ্রুত। মাওয়ালী মীরাসের বদলে বখশিষ ও দানদক্ষিণার অধিকারী। সুতরাং এখানে বিলোপের প্রশ্নই আসে না।
৯। এ সূরার আরেকটি আয়াত: (আরবী***********************)
“যখন বন্টনের ব্যাপারে আসে….. ইত্যাদি। ” (সূরা নিসা-৮)
এ আয়াত সম্পর্কে একটি মত তো মনসুখের। অপরটি না মনসূখের। তাদের মতে এ মানুষ এ কাজে অবহেলা দেখাচ্ছে মাত্র। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন: এ আয়াত মনসুখ তো নয়। তবে ওয়াজিবের স্থলে মুস্তাহাবের প্রমাণ দেয়। আমার কাছে ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর মতটিই ঠিক মনে হয়।
১০। এ সূরারই অন্য আয়াত:
(আরবী*********************)
“যে সব নারী ব্যভিচারে লিপ্ত হয়… ইত্যাদি। ” (সূরা নিসা-২৫)
বলা হয়, ওপরের এ আয়তটি সূরা নূরের আয়াত দ্বারা বাতিল হয়েছে। কিন্তু আমার মতে এ আয়াতও বাতিল হয়নি। বরং তাতে বিশেষ একটা সীমা পর্যন্ত ঢিল দেয়া হয়েছে। যখনই সে সীমায় পৌঁছে গেল, তখনই রসূল (সঃ) মূল হুকুমটি ব্যাখ্যা করে দিলেন। সুতরাং একে তানসীখ (বাতিলকরণ) বলা যেতে পারে না।
[চার] সূরা মায়েদা:
১১. এ সূরার নিম্নের আয়াত: (আরবী**********************)
“মর্যাদার মাসগুলোর রক্তারক্তি হালাল করোনা…. ইত্যাদি। ” (সূরা মায়েদা-২)
বলা হয়, যে আয়াতে মর্যাদার মাসগুলোতে হত্যাক৮৮৮র অনুমোদন দেয়া হয়েছে, সে আয়াত এসে এ আয়াত বাতিল করেছে। কিন্তু আমার মতে কুরআন মজীদে এমন কোন আয়াত নেই, যার দ্বারা এ আয়াত বাতিল হতে পারে। এমনকি সহীহ্ হাদীস বা সুন্নাতে রসূল দ্বারাও এর অন্য ব্যাখ্যা দান করা হয়নি। সুতরাং এ আয়াতের অর্থ এই হবে, ‘যে হত্যাকার্য নিষিদ্ধ, যদি তা মর্যাদার মাসে ঘটে, তার জঘন্যতার মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ’ যেমন হযরত (সঃ)-ও এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘তোমাদের ধন ও শোনিত যতখানি মর্যাদার ততখানি মর্যাদ রয়েছে এ মর্যাদার মাসের, এ মর্যাদার দেশের। ’
এর অর্থ এ নয় যে, অন্য মাসের অন্য দিনে কোথাও মুসলমানদের জানমাল কোন মর্যাদা রাখে না। এর মর্ম হল এই, সর্ব অবস্থায়ই তা পবিত্র। তবে এসব মাসের দিনগুলোতে তার মর্যাদার মাত্রা আরও বেশী।
১২. আয়াত : (আরবী*********************)
“তোমার কাছে এলে হয় তাদের বিচার কর, নতুবা বিরত থাক…. ইত্যাদি। (সূরা মায়েদা ৪২)
মনসুখ হয়েছে নীচের আয়াত দ্বারা” (আরবী**************************)
“তাহাদের শাসন কর আল্লাহর বিধান অনুসারে….. ইত্যাদি। ” (সূরা মায়েদা ৪৯)
কিন্তু আমার কাছে দ্বিতীয় আয়াতটির মর্ম এই ‘যখন আপনি যিম্মীদের কোন ব্যাপারে ফয়সালা করার মনস্থ করেন, তখন আপনার জন্যে প্রয়োজন হল ঐশীগ্রন্থ অনুসারে ফয়সালা করা। তারা কি চায়, সে পরোয়া আপনি করবেন না। মোট কথা, অমুসলিমদের ব্রাপার হলে আমরা তাদের নেতাদের ওপরে ছেড়ে দেব, যেন তারা তাদের বিধান অনুসারে মীমাংসা করে, নতুবা যদি আমরাই মীমাংসা করি, তা হলে আল্লাহর বিধান অনুসারেই করব সুতরাং কোন আয়াতই বাতিল নয়। বরং দুটোই দু’ধরনের হুকুম নিয়ে এসেছি।
১৩. আয়াত : (আরবী************************)
“অথবা তোমাদের ছাড়া আর দু’জন ইত্যদি। ” (সূরা মায়েদা ১০৬)
মনসুখ হয়েছে এ আয়াত দ্বারা : (আরবী********************)
“তোমাদেরই দু’জন বিশ্বস্ত লোক সাক্ষী পেশ করবে—ইত্যাদি। ” (সূরা তালাক-২)
আমার মতে, মূল সত্য হল এই, ইমাম আহমদ শুধু আয়াতের বাহ্যিক শব্দার্থ দেখে যা কিছু বলেছেন। কারণ তাঁর এ মতের সমর্থন কেউ করেননি। অন্যদের কাছে আয়াত দু’টো পরস্পরের ব্যাখ্যা স্বরূপ এসেছে। পয়লা আয়াতটির মর্ম হল এই, ‘এমন দু’হন লোক হওয়া চাই যারা তোমাদের আত্মীয় নয়। ’ সুতরাং অন্য যে কোন দু’জন মুসলিম হলেও হল। আর দ্বিতীয় আয়াতে ‘মিনকুম’ দ্বারা গোটা মুসলিম জাতি বুঝিয়েছে। সুতরাং দুটো আয়াতে মোটেও বিরোধ নেই। তাই এখানে নাসিখ-মনসুখের প্রশ্নই ওঠে না।
[পাঁচ] সূরা আনফাল:
১৪. আয়াত : আরবী************************)
“যদি তোমাদের মধ্যে বিশজন ধৈর্যশীল হয়, তাহলে দু’শজনের ওপর জয়ী হবে…. ইত্যাদি। (সূরা আনফাল-৬৫)
আয়াতটি তার পরবর্তী আয়াত দ্বারা মনসুখ হয়েছে। এ আয়াত সম্পর্কে তাঁরা যা বলেছেন, আমারও বক্তব্য তাই।
[ছয়] সূরা বারাআত:
(আরবী*****************)
“সংখ্যা শক্তিতে হালকা হও বা ভারী হও, জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে সবাই জিহাদে নাম… ইত্যাদি। ”
এর নাসিখ আয়াত হল এই: (আরবী*****************
অর্থাৎ তোমাদের দুর্বল, রুগ্ন অন্ধ ইত্যাদি জিহাদে অংশ গ্রহণ না করলে কোন অন্যায় নেই। (সূরা ফাতাহ-) (সূরা তাওবা- ৯১)
সুতরাং এ দু’আয়াত বিশেষ কারণে অক্ষম ব্যক্তিদের অব্যাহিত দিয়েছে। তাই ওপরের আয়াতটি মানসুখ হল।
কিন্তু আমার মতে এ আয়াতকে মনসুখ মনে করা ঠিক নয়। কারণ, এর সম্পর্ক হল জিহাদের উপকরণের সাথে, ব্যক্তির সাথে নয়। বস্তুত ‘খিফাফান’ শব্দের অর্থ হল ন্যূনতম জিহাদের উপকরণ। তা সামান্য যানবাহনই হোক কিংবা সেবক-সেবিকা হোক অথবা কোনরূপ সমরোপণ হোক। আর ‘ছিকালান’ বলতে জিহাদের সর্বাধিক সৈন্য ও যানবাহন বুঝায়। এবং যে দু’আয়াতকে এর নাসিখ বলা হয়, সে দু’টোর সম্পর্ক হল অক্ষম লোকের সাথে। সুতরাং এ দু’টো পয়লা আয়াতটির নাসিখ হতে পারে না। কমপক্ষে এটা বলা চলে যে, এখানে নাসিখ সুনির্দিষ্ট নয়।
[সাত] সূরা নূর
১৬। আয়াত (আরবী*********************)
“ব্যাভিচারী ব্যভিচারিণী ছাড়া বিয়ে করবে না। …. ইত্যদি। ” (সূরা নূর-৩)
ইবনে আরাবীর মতে নিম্নের আয়াত দ্বারা মনসুখ হয়েছে:
(আরবী*********************)
আমার মতে, এখানেও ইমাম আহমদ (রঃ) শুধু আয়াতের বাহ্যিক অর্থের ওপরে নির্ভর করেছেন। অন্যদের কাছে এ আয়াত মনসুখ নয়। কারণ এ কথা সর্ববাদীসম্মত যে, কবীরা গুনাহ্ যে করে, সে-ই কেবল যেনাকারিণীর ‘কুফু’ (সপর্যায়ের) হতে পারে। কিংবা তার জন্যেই যেনাকারিণী বিয়ে করা চলে। অপর যে আয়াতে হারাম বলা হয়েছে, তার সম্পর্কে যেনা ও শিরক্ দু’টোর সাথেই। সুতরাং এ আয়াতও নাসিখ হতে পারে না। তাছাড়া যে আয়াতকে নাসিখ ধরা হয়, তার সম্পর্ক রয়েছে সাধারণ হুকুমের সাথে। এবং কোন সাধারণ হুকুম বিশেষ ধরনের হুকুম দ্বারা বাতিল হতে পারে না। এ হিসেবেও নসখ ঠিক নয়।
১৭. আয়াত: সূরা নূর (আরবী*******************)
“এটা এ জন্যে যে, তোমাদের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে তোমাদের অধনদের ব্যাপারে… ইত্যাদি। ” (সূরা নূর০৫৮)
এ আয়াত সম্পর্কে মতানৈক্য রয়েছে অনেক। কিছু লোক এটাকে ‘মনসুখ’ মনে করে। কিছু লোক আবার তা মনে করে না। বরং মুসলমানরা এটা কার্যকরী করার ব্যাপারে ঔদাসীন্য দেখাচ্ছে। ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ আয়াতকে মনসুখ মনে করেন না বরং তাঁর বক্তব্যই সবচাইতে সঠিক। কারণ তাঁর সমর্থনে জোরালো যুক্তি ও কারণ বর্তমান রয়েছে। সুতরাং এ মতটির ওপরে নির্ভর করা যেতে পারে।
[আট] সূরা আয্যাব
১৮। আয়াত: (আরবী**************)
“তোমার জন্যে এর পরে সেই নারী বৈধ নয়… ইত্যাদি। ” (আহ্যাব ৫২)
এ আয়াত নীচের আয়াত দ্বারা মানসুখ হয়েছে। (আরবী*******************)
“নিশ্চয়ই আমি বৈধ করেছি তোমার স্ত্রীদের…ইত্যাদি। ” (সূরা আহখাব ৫০)
আমার মতে আলোচ্য আয়াতটির তিলাওয়াতই মনসুখ হয়ে গেছে। এটাই সত্য ও সঠিক কথা।
[নয়] সূরা মুজাদালা
১৯। আয়াত: (আরবী*********************)
“যখন তোমরা রসূলের সাথে বিশেষ পরামর্শ করবে, আগে নজরানা দিবে… ইত্যাদি। ”
ইবনে আরাবী (রাঃ)-এর মতে এর পরবর্তী আয়াতটি এটাকে বাতিল করে দিয়েছে। এখানে আমিও ইবনে আরাবীর মত সমর্থন করি।
[দশ] সূরা মুমতাহিনা
২০: আয়াত: (আরবী**************)
“ঈমান ও কুফরীর ব্যবধানের জন্য যাদের স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হল, তাদের খরচ আদায় কর…. ইত্যাদি। ” (সূরা মুমতাহিনা-১১)
একটি মত অনুসারে এ আয়াত ‘সায়িফ’-এর আয়াত দ্বারা মুনসুখ করা হয়েছে। আরেকটি মতে এ আয়াত মানসুখ করা হয়েছে গনীমতের আয়াত দ্বারা। তৃতীয় দলের মত হচ্ছে, এ আয়াত আদৌ মানসুখ হয়নি। এটি মাহকাম আয়াত। আমার কাছে আয়াতটি তো মুহ্কাম, কিন্তু এর হুকুম সাধারণ (আম) নয়। এর সম্পর্ক হল মুসলমানদের দুর্বল অবস্থার সাথে সংযুক্ত কাফিররা যখন সবল ও শক্তিশালী ছিল, সে সময়ের জন্যে এ আয়াত।
[এগার] সূরা মুয্যাম্মিল
২১। আয়াত: (আরবী*********************)
‘প্রায় রাতই জেগে কাটাও… ইত্যাদি। ’
এ আয়াতকে এ সূরার শেষের আয়াত দ্বারা মানসুখ করা হয়েছে। মানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের হুকুম এসে একে মানসুখ করেছে। কিন্তু আমার মতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের দিয়ে একে মানসুখ করা ঠিক নয়। মূল সত্য হল এই, সূরার শুরুতে রাত জাগার যে হুকুম রয়েছে, তা মুস্তাহাবে মুআক্কাদা ছিল পরের আয়াত এসে তাকীদ বাতিল করে শুদু মুস্তাহাব বাকী রেখেছে।
আল্লামা সূয়ূতীও ইবনে আরাবীর অনুসৃত অভিমত সমর্থন করতে গিয়ে বলেছেন, কেবল উপরের আয়াতটুকুই মনসুখ হয়েছে। যদিও তার ভেতরে কিছু আয়াতের তানসীখ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে, কিন্তু এসব আয়াত ছাড়া আর কোন আয়াতের তানসীখ দাবী করা একবারেই ভিত্তিহীন। বেশী খাটি কথা তো সেগুলোও মানসুখ নয়। এ হিসেবে মনসুখ আয়াতের সংক্যা আরও কমে যায়।
উপরের আলোচনায় সুস্পষ্ট হয়েছে যে, আমার কাছে পাঁচটি আয়াতের বেশী মানসুখ নয়। তাই কেবল পাঁচটি; আলোচ্য আয়াতের তানসীখই দাবী করা যেতে পারে।