দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ পঞ্চ ইলমের পরিশিষ্ট তাযকীর বি আলাইল্লাহ
জেনে রাখা প্রয়োজন, কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে গোটা মানব জাতির সভ্যতা ও আত্মিক পবিত্রতা সৃষ্টির জন্যে। সে ক্ষেত্রে আরব-অনারব কিংবা শহুরে বা গেঁয়োর প্রশ্ন নেই। সুতারাং ঐশী-কৌশলের চাহিদা এটাই ছিল যে, আল্লাহর নিদর্শন স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যে শুধু সে সব ব্যাপারে আলোচনা করা হবে যা অধিকাংশ লোকের জানা থাকে। তাই ‘আলাইল্লাহর’ আলোচনার ধারায় অনুসন্ধান ও পর্যালোচনার ব্যাপারটি নির্দিষ্ট গন্ডিতে সীমাবধা রাখা হয়েছে এবং আল্লাহ তাআলার নাম ও গুনাবলীর এমন বর্ণনা দেয়া হয়েছে যা সাধারণ বুদ্ধির মানুষও সহজে অনুধাবন করতে পারে। সে জন্যে যেন ‘ইলমে কালাম’ কংবা খোদায়ী কলাকৌশলের তত্ত্ব অধ্যনের প্রয়োজন দেখা না দেয়।
আল্লাহর অস্তিত্ব
বস্তুত কুরআন আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে খুব সংক্ষেপে আলোচনা করেছে। প্রমাণের জন্য বিস্তারিত আলোচনার প্রয়াস নেই তাতে। কারণ আল্লাহর অস্তিত্বের ধারণাটি মানুষের ভেতরে ব্যাপক হয়ে আছে। পৃথিবীর ভেতরে এমন কোণ সুস্থ ও স্বাভাবিক দেশ বা জাতি নেই, যেখনে আল্লাহর অস্তিত্ব অশীকার করা হয়।
অবশ্য আল্লাহর গুণাবলীর প্রশ্নটি চিন্তা ভাবনা ও সাধনা ব্যতিরেকে সহজে বুঝে ফেলার নয়। সত্য বলতে কি, তার তত্ত্ববুঝ ও বুঝানো উভয়ই অসম্ভব। কিন্তু সব চাইতে মুশকিলের ব্যাপার হল এই, যদি আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কে কোনই ধারণা না নেয়া যায়, তাহলে পরিচয় লাভও সম্ভবপর নয়। অথচ সভ্যতা ও আত্মিক মার্জনা সৃষ্টির জন্যে সেই পরিচয়ই একমাত্র পথ। তারি আল্লাহর অপার লীলা সেই কঠিন পথটির এভাবে সমাধান ঘটীয়েছেন যে, মানুষের গুনাবলীর ভেতরে এম্ন কতগুলো গুন বেছে নিয়েছে যেগুলো সব মানুষেরই জানা আছে। সেই গুণগুলোকে খদার সূক্ষ্ম ও দুর্বোধ্য গুনাবলীর স্থলে এমনভাবে পেশ করা হয়েছে, যাতে করে অক্ষম মানুষ সে সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা নিতে পারে। অথচ সংগে সংগে বলে দেয়া হয়েছে, “এসবের কোন তুলনা নেই। ”
কারণ সীমাবদ্ধ গুনের মানুষ যেন আল্লাহর গুণকে অনুরূপ ভাবতে গিয়ে ভুল ধারণা ও মুর্খোতার শিকারে পরিণত না হয়।
এমন কতগুলো মানবীয় গুণও রয়েছে, তা যে শুধু আল্লাহর মর্যাদার অনুপযোগী তারি নয়; উপরন্তু সে সব যদি আল্লাহর সাথে সংযুক্ত করা হয় তা হলে মানুষ ভ্রান্ত ধারণা ও বিশাসের শিকার হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, সন্তান জন্ম নেয়া, কান্নাকাটি করা, শোকে অধীর হওয়া ইত্যাদি। তাই এসব মানবীয় গুনকে আল্লাহর সাথে সংযুক্ত করা নিষিধ করা হয়েছে। অবশ্য যে সব গুণের সংযোজন মৌল বিশ্বাসে বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তি না ঘটায়, আর যে সব গুণের সংযোজন ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করে, এ দুয়ের চেতর পার্থক্য সৃষ্টি করা এমন সূক্ষ্ম ও কঠিন ব্যাপার, যেখানে মানবীয় চিন্তা ওজ্ঞান পৌছুতে ব্যার্থ্য হয়। এ ক্ষেত্রটি অবশ্যই চুপ থাকার ও বিরত থাকার। সুতারাং এ প্রশ্নে নিজ খেয়ালখুশির মতামত পেশ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আল্লাহর নিদর্শন সমূহঃ
তেমনি আল্লাহর কুদরতের নিশানা ও তাঁর অবদানের ভেতর সেইগুলোই নির্বাচিত করা হয়েছে, যেগুলো শহুরে কিংবা গেয়োঁ,আরব কিংবা অনারব সবাই সমানভাবে বুঝতে পারে। এ কারণেই সে সব আধ্যাত্মিক অবদান শুধু আলেম ও ওলীদরবেশের জন্যে নির্দিষ্টো হয়ে আছে, সে সবের উল্লেখ করা হয়নি। আর যে সব দুর্লভ অবদান শুধু রাজা বাদশাহর জন্যে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, সেগুলোরও ইল্লেখ করা হয়নি। ফলে আলোচনার জন্যে যে গুলো বাছাই করা হয়েছে, তার ভিতরে আসমান যমীনের স্ররষ্টি লীলা, মেঘের বারিবির্ষণ ও নদী-নালা হয়ে তা মাটির বুকে প্রবাহিত হওয়া, তা থেকে নানা ধরনের ফুল-ফল জন্ম নেয়া কিংবা মানুষকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদান ইত্যাদি ব্যাপারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
তেমনি অনেক জায়গায় মানুষের অত্মিক ও চরিত্রিক ত্রুটি-বিচ্যুতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে এবং সতর্ক করা হয়েছে। আত্মিক বিচ্যুতি তাদের এই যে, সুখে ও দুঃখে তাদের কাজ ও স্বভাব এরূপ থাকে না। যখন তাদের বিপদ দেখা দেয়, তখন তারা একভাবে চলে, আর যখন বিপদ দূর হয়, তখন অন্যরূপ হয়ে যায়।
তাযককীরবি-আইয়্যামিল্লাহঃ
এভাবে অনুগত বান্দাদের পুরষ্কার ও বিদ্রোহী বান্দাদের শাস্তিদানের ব্যাপারে আল্লাহর তরফ থেকে যা কিছু দেখা দিয়েছিল, সেগুলোর ভেতরেও কুরআনে এমন সব ঘটনা বেছে নেয়া হয়েছে, যেগুলো মানুষ শুনতে আভ্যস্ত ছিল। মোটামুটিভাবে সেগুলো আগে থেকেই তারা শুনে আসছিল। যেমন, নূহ (আঃ) এর সম্প্রদায় ও আদ সামুদ সম্প্রদায়ের কাহিনী তারা পুরুষানুক্রমেই শুনে আসছিল। তেমনি হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও বনী ইসরাঈলী নবীদের কাহিনীগুলি আরবরা ইয়াহুদীদের সংস্পর্শে থেকে যুগ যুগ ধরে শুনছিল। বস্তুত কুরআনে সে সব ঘটনাই বারংবার বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে যেসব ঘটনা আরববাসী কমই শুনেছে কিংবা ইরান বা ভারতের যে সব ঐতিহাসিক কাহিনীর সাথে তাদের কোন সংশ্রব ছিল না, সেগুলোর উল্লেখ তাতে নেই।
কুরআনের ঘটনা বিন্যাসঃ
কুরআনে যেভাবে কোন নতুন ও অদ্ভুত ঘটনার সমাবেশ ঘটানো হয়নি, তেমনি সমগ্র ঘটনার চুলচেরা আলোচনাও পরিহার করা হয়েছে। বরং ঘটনাটির শুধু অংশটুকু নিরবাচন করা হয়েছে, উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য যেটুকুর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ ধরণের ঘটনাবলীর ভেতরে কৌশল ও কল্যানধর্মিতা হল এই যে, জনসাধরণ যখনই কোন নয়া ও অদ্ভুত কাহিনী শোনে কিংবা তাদের সামনে সবিস্তারে কাহিনীটি তুলে ধরা হয় তখনই তার কাহিনীর ভেতরে নিজেদের হারিয়ে ফেলে এবং কাহিনীটি বর্ণনার মূল উদ্দেশ্য বিলোপ হয়।
বিখ্যাত এক তাপস বলেছেন, যেদিন থেকে মানুষ কুরআনের ‘তাজবীদ’ (উচ্চারণ তত্ত্ব) শিখল, সেদিন থেকেই নামাযের ভেতরে তন্ময়তা হারিয়ে বসল। আর যখন থেকে ব্যাখ্যাদাতারা কুরআন ব্যাখ্যার সূক্ষাতিসূক্ষ তত্ত্ব ও দূর-দূরান্তের সম্ভাবনার আলোচনা শুরু করুল, ইলমে তাফসীর তখন থেকেই প্রায় লোপ পেল। কুরআনে কাহিনী বিন্যাসের ক্ষেত্রে এ সত্যটিই সামনে রাখা হয়েছে। কারণ যখনই মানুষ কাহিনী শোনার আনন্দে গা ভাসিয়ে দেয়, তখন তার মূল লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়। নিম্নের এরূপ ঘটনাবলী ও কাহিনীগুলো কুরআনে বারংবার বিভিন্ন পন্থায় উল্লেখ করা হয়েছে।
১। হযরত আদম (আঃ)-কে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করা, ফেরেশতাদের সিজদা দান ও শয়তানের অহমিকাপূর্ণ অস্বীকার এবং তার মালাউন (অভিশপ্ত) খেতাব লাভ ও আদমকে বিভ্রান্ত করার জন্য তার প্রয়াসের কাহিনী এসব এক ধরণের ঘটনাবলী।
২। হযরত নূহ (আঃ) হযরত হূদ (আঃ), হযরত ছালিহ (আঃ), হযরত লূত (আঃ) ও হযরত শুআয়ব (আঃ)-এর আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার ও সত্যের নির্দেশ ও অসত্যের প্রতিবাদের ব্যাপারে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের সাথে বিতর্ক ও বিরোধের ঘটনাবলী, সে সব সম্প্রদায়ের নানা ধরণের অমূলক সন্দেহের সৃষ্টি ও সত্যকে অস্বীকার করার কাহিনী, নবীদের পক্ষ থেকে তাদের সব সন্দেহের জবাব দানের বিবরন, সে সব হতভাগাদের উপরে আল্লাহর গযব নাজিলের ইতিবৃত্ত এবং আল্লাহর তরফ থেকে নবী ও তাঁদের অনুসারীদের সাহায্য ও সহায়তা লাভের কিসসা-এসব বিশেষ এক ধরণের কাহিনী।
৩। হযরত মূসা (আঃ) এবং ফিরআউন ও তার সাথীদের ভেতরে অনুষ্ঠিত ঘটনাবলী, হযরত মূসা (আঃ) ও বনী ইসরাঈলের ভেতরকার ব্যাপারগুলো, হযরত মূসা (আঃ) এর সাথে সে সম্পদায়ের বাড়াবাড়ি ও জবরদস্তি, সে হতভাগাদের ওপর আল্লাহর গযব নাযিল হবার সম্ভাবনা এবং হযরত মূসা (আঃ) এর কয়েকবার বিভিন্ন সময়ে তাদের সাহায্যে এঘিয়ে আলা এ সব বিশেষ এক ধরণের কাহিনী।
৪। হযরত দাউদ (আঃ) ও হযরত সুলায়মান (আঃ)-এর ইতিবৃত্ত, তাঁদের মর্তবা ও নির্দেশনের উল্লেখ, হযরত আইয়ু (আঃ) ও হযরত ইউনুস (আঃ)-এর পিবদ ও পরে তাঁদের ওপরে আল্লাহর অনুগ্রহ, হযরত যাকারিয়া (আঃ)-এর দোয়া আল্লাহর দরবার কবুল হবার বিবরণ, হযরত ঈসা (আঃ)-এর জন্মলাভের বিস্ময়কার ঘটনা ও তাঁর বাপ ছাড়া পয়দা হওয়ার ব্যাপার, মাত্রক্রোড়েই তাঁর কথাবার্তা বলা এবং তাঁর থেকে নানা ধরনের আলৌকিক ব্যাপারের প্রকাশ এক ধরনের কাহিনী। সেগুলোকে অবস্থাভেদে কখনও মোটামোটিভাবে, কখনও কিছুটা বিশদভাবে বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
নীচের কিস্সাগুলো কুরআনে কেবল দু-একবার বলেই শেষ করা হয়েছে:
১। হযরত ইদরীস (আঃ) কে আকাশে তুলে নেয়ার ঘটনা।
২। নবরূদের সাথে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর বিতর্ক, হত্যার পরে পাখিদের আবার জীবিত করার ঘটনা ও ইসমাঈল (আঃ)-এর আত্মদানের ইতিবৃত্ত।
৩। হযরত ইউসূফ (আঃ)-এর কিস্সা।
৪। হযরত মূসা (আঃ)-এর জন্মলাভ, তাঁকে নীল নদীতে ভাসিয়ে দেয়া, তাঁর একজন কিবতীকে হত্যা করা, তাঁর মাদায়েন সফর ও মাদায়েনে বিবাহ করা, গাছের উপরে আগুনের শিখা দেখা, সে আগুন থেকে কথা শুনতে পাওয়া, গাভী যবেহ করার বৃত্তান্ত।
৫। বিলকীসের কিস্সা, যুল-কারনায়নের কিস্সা, আসহাবের কাহাফের কিস্সা, পরস্পর কথোপকথনে লিপ্ত দুব্যক্তির কিস্সা, জন্নাতবাসীদের কিস্সা এবং আসহাবে ফীলের (গজারোহীদল) কিস্সা।
কাহিনীর উদ্দেশ্যে
এ সব কিস্সা-কাহিনী বর্ণনার উদ্দেশ্য লোকদের কাহিনীগুলো সঠিক ভাবে শুনিয়ে দেয়া নয়; বরং এ গুলো বর্ণনার মূল উদ্দেশ্য হল মানুষকে শির্ক ও মুশরিকের কিরূপ শোচনীয় পরিণতি দেখা দেয় এবং সে সবের জন্য কিভাবে আল্লাহর গযব নাযিল হয়, তা দেখানো। সঙ্গে সঙ্গে যেন তারা নিশ্চিত হতে পারে যে, আল্লাহ পাক তাঁর অনুগত খাঁটি বান্দাদের সর্বদা সহায়তা করে থাকেন।
তাযকিরার বিল-মউত:
কুরআনের এ অধ্যায়টিতে মৃত্যু ও তার পরবর্তীকালের ঘটনাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। মরণকালে মানুষ কিরূপে অসহায় হয়ে যায়, মরণের পরে কিভাবে বেহেশ্ত বা দোযখের পালা আসে, আযাবের ফেরেশতারা কেমন করে এসে থাকে ইত্যাদি। তাছাড়া কিয়ামতের নিদর্শন যথা, হযরত ঈসা (আঃ)-এর আকাশ থেকে অবতরণ এবং দাজ্জাল ও ইয়াজুজ-মাজুজের অভিযান সম্পর্কিত ঘটনাও রয়েছে। এ প্রসঙ্গে এও বলা হয়েছে, শিংগা কিথাবে ফু’কা হবে, পুণরুত্থঅন ও পূর্ণবিন্যাস কিভাবে ঘটবে, কিভাবে প্রশ্নোত্তর হবে, ইন্সাফের পালা কেমন করে স্থাপিত হবে এবং আমলনামা কি করে ডান বা বাম হাতে দেয়া হবে। তৎসংগে মুমিনরা যে জান্নাতে আর কাফিররা জাহান্নামে প্রবেশ করবে, তাও বলা হয়েছে। কি করে সর্বসাধারণ জাহান্নামীরা সেখানে তাদের নেতাদের সাথ ঝগড়া করবে, তারা কি করে একে অপরের ওপরে দোষ চাপাবে, একে অপরকে গালি দেবে, মুমিনদের কেমন করে আল্লাহর সাথে দেখা হবে, কাফিরদের কিরূপ কঠিন শাস্তি দেয়া হবে, তারও উল্লেখ রয়েছে।
এ অধ্যায়ে আযাবের জন্যে নির্মিত আগুণের কড়া ও শিকল, আর আযাবের বিভিন্ন ধারা যথা, হামীম, গাস্সাক, যক্কুম ইত্যাদির বর্ণনা রয়েছে। জান্নাত ও সেখানকার নানারূপ নিয়ামত ও সুখ-শান্তি যথা হুর ও কুসূর, দুধ ও শরবতের নহর, উপাদেয় ও রুচিকর আহার্য, উত্তম ও আকর্ষনীয় পোশাক-পরিচ্ছদ এবং সুন্দরী নারীদের বর্ণনা রয়েছে। জান্নাতবাসীদের পারস্পরিক চিত্তাকর্ষী সম্পর্ক ও সুমধুর আলাপনের চিত্র আঁকা হয়েছে। আর এ সব কাহিনীগুলো বিভিন্ন সূরায় ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে কোথাও ধারাবাহিক কোথাও বা এলোমেলোভাবে বলা হয়েছে। সূরা গুলোর আকৃতি-প্রকৃতি অনুসারে কোথাও সংক্ষেপে, কোথাও আবার ব্যাপ্তি সহকারে বলা হয়েছে। প্রত্যেক স্থানেই নতুন বর্ণনাভংগী অনুসৃত হয়েছে।
ইলমুল আহকাম সংবিধান পর্যালোচনা মূলতত্ত্ব:
সংবিধান (আহকাম) নিয়ে আলোচনা সর্বপ্রথম তত্ত্ব হল এই, আমাদের হযরত (সঃ) হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের ভেতর প্রেরিত হয়েছিলেন বলে তিনি ইবরাহীম (আঃ)-এর সংবিধানকেই যথাযথ রক্ষা করেছেন। প্রয়োজনে কোথাও হয়তো ব্যাপককে বিশেষ কিংবা নির্বিশেষকে সবিশেষ এবং কোথাও বাড়ানো বা কমানো হয়েছে।
দ্বিতীয় তত্ত্ব হল এই, আল্লাহ হযরত (সঃ)-এর সাহায্যে আরববাসীকে পবিত্র করতে চেয়েছিলেন এবং তাদের সাহায্যে অন্যান্য সব রাষ্ট্রের সংস্কার চেয়েছেন। সুতরাং ইসলামী সংবিধানের ভিত্তি আরবাসীর রীতি-নীতি ও অভ্যাসের ওপরে প্রতিষ্ঠিত করা অপরিহার্য ছিল।
বিকৃত মিল্লাতে ইবরামীর সংস্কার
বস্তুত যদি ইব্রাহীমী ধর্মের সংবিধান ও আরববাসীর রীতি-নীতি সামনে রেখে ইসলামী সংবিধান অধ্যয়ন করা হয়, তাহলে আমাদের রাসূল (সা) ইবরাহীমী ধর্মানুসারী আরববাসীদের ধর্মের যে সংস্কার ও রদবদলের জন্যে এসেছিলেন, তাঁর প্রতিটি বিধানের কারণ এবং প্রত্যেক বিধি নিষেধের কল্যাণ ধর্মিতা সুস্পস্ট হয়ে ধরা দেবে।
সারকথা ইবাদাত অর্থাত পবিত্রতা, নামাজ, রোজা, যাকাত, হজ্জ, যিকির পালনে বড়ধরনের বিপর্যয় ঘটেছিল। আর এই বিপর্যয়ের কারণ ও ছিল কয়েকটি। (১) ইবাদত পালন অলসতা অমনোযোয, (২) অজ্ঞতার কারণে ইবাদাতের পদ্ধতি নিয়ে পরস্পর বিবাদ। (৩) জাহেলী যুগের বিকৃতির অনুপ্রবেশ। এই সমস্ত কারণে মিল্লাতে ইবরাহীমীর মধ্যে যে সকল ত্রুটির সৃষ্টি হয়েছিল, কুরআন শরীফ সে গুলোর সংশোধান ও সংস্কার করল এবং সহজ-সরল ও দৃঢ় করল। ফলে মিল্লাতে ইব্রাহীমীর আদর্শগুলো সঠিক ও সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা লাভ করল।
ঠিক এভাবেই পারিবারিক ও সামাজিক জীবনেও নানা ধরনের কুসংস্কার, অন্যায় অনাচর জন্ম নিয়েছিল। তাই কুরআন তাদের সংশোধনের জন্য নীতিমালা দন করল ও বিধি-নিষেদ আরোপ করল এবং ছগিরা কবীরা গুনাহের সংজ্ঞা দিল, যাতে মানুষ ঐ সমস্ত পাপাচার থেকে নিজেদের কে দূরে রাখে।
কুরআনে নামাযের প্রশ্নটিও সংক্ষেপে সেরে দিয়েছে। শুধু ‘ইকামতে সালাত’-এর নির্দেশ জারি করেছেন। আমাদের হযরত (সঃ) মোটামুটি সেই নির্দেশের আলোকে মসজিদ গড়লেন, জামাআতে নামায ও নামাযের ওয়াক্ত ইত্যাদির নিয়ম প্রবর্তন করলেন। তেমনি যাকাতের বিধানটিও সংক্ষেপে বলা হল। আমাদের রাসূল (সঃ) তার ব্যাখ্যা দিলেন।
এভাবে কুরআনের বিভিন্ন সূরায় ভিন্ন ভিন্ন ব্যাপারে আলাদা আলাদা বিধান এসেছে। যেমন, সূরা বাকারায় রোযা ও হজ্জের, সূরা বাকারা, আনফাল ও অন্য কয়েকখানা জিহাদের, সূরা মায়েদা ও সূরা নূরে দন্ডবিধি, সূরা নিসায় মিরাসের(উত্তরাধিকার-সত্ত্ব) ও সূরা বাকারা, সূরা নিসা ও সূরা তালাকে বিবাহ বিচ্ছেদের বিধি-নিষেধগুলো এসেছে।
ইশারা-ইঙ্গিতবাহি আয়াতের ব্যাখ্যা দান:
এসব তো সার্বজনীন কল্যাণকর গোটা জাতির জন্যে প্রদত্ত বিধান। এর থেকে আরেকটু এগিযে দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে হযরত (সা)-কে প্রশ্ন করায় যে সব জবাব এসেছিল তাও বিদ্যমান। কিংবা মুমিনরা জান-মাল লুটিয়ে যে সব ত্যাগ দেখিয়েছে, মুনাফিকরা সে ক্ষেত্রে যেরূপ স্বার্থপরতা ও কার্পণ্যের পরিচয় দিয়েছে, তার বর্ণনা রয়েছে। এ প্রসংগে আল্লাহ মুমিনদের প্রশংসা ও মুনাফিকদের ভৎসনা করেছেন। হযরত (সঃ)- এর জীবদ্দশায় আল্লাহ তাআলা যে শত্রুদের হাত থেকে মুসলমানদের রক্ষা করেছিলেন, তাও দেখা যায়। আল্লাহ্ পাক এ সব ব্যাপারে উল্লেখ করতে গিযে মুসলমানদের ওপরে তাঁর ইহ্সান ও অবদানের কথা প্রকাশ করেছেন। এরূপও দেখা গেছে যে, মুসলমানদের ধমক দিয়ে সতর্ক করা হয়েছে, কিংবা ইঙ্গিতে-ইশারায় কিছু বলে দেওয়া হয়েছে। কোথাও বিশেষ ব্যাপারে বাধা-নিষেধের প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় তৎক্ষণাত আয়াতের সংশ্লিষ্ট সেই বিমেষ ঘটনাটি সংক্ষেপে বলে দেওয়া। রাসূলূল্লাহ (সঃ)-এর যুগে সংঘটিত বিশেষ যুদ্ধগুলোরও উল্লেখ কুরআনে আছে। সূরা আনফালে বদরের যুদ্ধ, সূরা আল ইমরানে ওহুদের যুদ্ধ, সূরা আহযাবে খন্দকের যুদ্ধ, সূরা ফাত্হে হুদায়বিয়ার সন্ধি, সলা হাশরে বনূ নযীরের যুদ্ধ ও সূরা বারাআতে মক্কা বিজয় ও তবুকের যুদ্দের উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী যেমন বিদায় হজ্জের উল্লেখ রয়েছে সূরা মায়েদায়, যয়নবের বিবাহের কাহিনী রয়েছে সূরা আহযাব ও সূরা তাহরীমে, মিথ্যা অপবাদের (হযরত আয়েশা (রাঃ) সম্পর্কিত) কাহিনী রয়েছে সূরা নূরে, জিনের সাথে রাসূলের )সা) সম্পর্কের কথা রয়েছে সূরা জিন ও আহ্কাফে, মসজিদে যেরারের (বিভেদমূলক) কথা রয়েছে সূরা বারাআতে এবং মিরাজের বর্ণনা মিলে সূরা বনী ইসরাঈলে।
এসব আয়াতে মূলত ‘আইয়্যামিল্লাহর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু যেহেতু এগুলোর তাৎপর্য বুঝা সংশ্লিষ্ট কাহিনীর ওপরে নির্ভর করে, তাই এগুলোকে ভিন্ন একটা শ্রেণী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাফসীরকাররা যেন এ ধলনের আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ঘটনাটি অবশ্যই উল্লেখ করেন।