প্রথম পরিচ্ছেদঃ আয়াতের মুখাসামা
কুরআন পাকে মুশরিক (অংশীবাদী) ইয়াহুদী ও মুনাফিক (ভন্ড-মুসলিম) এ চার দলের ধারণা ও কার্যকলাপের অযৌক্তিকতা বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলো দু ধরণের।
১। শুধু তাদের ভ্রান্ত ধারণাগুলো তুলে ধরে সেগুলোর পরিণোতি দেখানো হয়েছে এবং সেগুলোকে খারাপ বলে ধারণা দেয়া হয়েছে।
২। তাদের সন্দেহ গুলোর উল্লেখ করে যুক্তি ও উপমা-উপদেশের সাহায্যে সেগুলোর অবসান ঘটানো হয়েছে।
মুশরিকদের ধর্ম বিশ্বাসঃ
মুশরিকরা নিজদের ‘হানিফ’ (সঠিক পথানুসারী) বলে প্রচার করত এবং হযরত ইব্রাহীম (আঃ)- এর ধর্মানুসারীদেরই ‘হানিফ’ বলা হত। ইব্রাহীম ধর্মের নির্দেশগুলো নীচে দেয়া হলঃ
১। কা’বা ঘরে হজ্জ পর্ব উদযাপন।
২। কা’বার দিকে ফিতে উপাসনা করা।
৩। নসব (বংশ-ধারা) কিংবা রাযা’আত (স্তন্য পান) দ্বারা যেসব নারী হারামের পর্যায়ে পড়ে, তাদের বিয়ে হারাম বলে গ্রহণ করা।
৪। স্ত্রী-সহবাসে গোসল ফরজ হওয়া।
৫। খাতনা করা।
৬। মর্যাদার মাসগুলোকে ও কা’বার পবিত্রতাকে যথাযথ পর্যাদা দান করা।
৭। কুরবানী করা।
৮। জীব যবেহ করে খাওয়া।
৯। হজ্জের মওসুমে কুরাবানী করে আল্লাহর নৈকট্য কামনা।
১০। প্রাকৃতি সম্মত কার্যাবলী সম্পাদন।
মূলত দীন-ই-ইবরাহীমে ওযু, নামায, সূর্যোদয় থেকে রোযা, ইয়াতীম ও মিসকীনের সদকা, বিপদে সহায়তা ও আত্মীয়-স্বজনদের সাহায্য করার বিধানও ছিল। সেগুলো পালন করাকে তার একদিক গৌরবজনক ও প্রশংসানীয় বলে ভাবত।
মুশরিকরা এগুলোকে এমনভাবে বেমালুম হজম করেছে যে, মনে হয় কোন দিনই এসব সে ধর্মে ছিল না। এভাবে হত্যা, চুরি, যিনা, সুদ ও আত্মসাৎ ইত্যাদি ইবরাহীম ধর্মে হারাম ছিল। এগুলো অনুসরণ করা নিন্দনীয় ও ধিকৃত কাজ ছিল। কিন্তু মুশরিকরা প্রকাশ্যে এগুলোকরে চলল। এমনকি মনে যা চায় তাই করে চলল।
ইবরাহীম ধর্মের মুল বিশ্বাস সমুহ ও মুশরিক দলঃ
একক আল্লাহর বিশ্বাস এবং এ ও বিশ্বাস করা যে তিনিই আসমান-যমীনের স্রষ্ঠা, বড় বড় ঘটনা ও ব্যাপারের মুল উদ্গাতা ও নিয়ন্তা, নবী প্রেরণ ও বান্দাদের কর্মফল দাতা এবং যে কোন বিবর্তন-বিপর্যয় তাঁরই ইংগিতে দেখা যায়। ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর ঘনিষ্ঠ বান্দা বলে বিশ্বাস করা এবং তাঁদের সম্মানের পাত্র ভাবা- এসব বিশ্বাসেই সে ধর্মে বর্তমান ছিল। সে ধর্মের নিদর্শনগুলো থেকেও তা বুঝা যায়।
কিন্তু মুশরিকরা এসব মূল বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এমন সব সংশয়ের ঘুন ধরিয়ে দিয়েছিল, যেগুলো জন্ম নিয়েছিল সে সবের অসম্ভাব্যতা ও সুর্বোধ্যতা বোধ থেকে। এর ফলে তাদে যে বিভ্রান্তি দেখা দিল, তাতে নীচের ব্যাপারগুলোর আত্মপ্রকাশ করলঃ
শিরক (অংশীবাদ) তাশবীহ (উপমা-কামনা), তাহরীক (বিকৃতি) পরকাল অস্বীকার, শেষ নবীর নবুওতকে অসম্ভব ভাবা, জুলুম ও ব্যাভিচারের ব্যাপ্তি কুসংস্কারের অনুসরণ, ইবাদতের বিলোপ ঘটান ইত্যাদি। এসবের বিশ্লেষণ নিম্নে দেয়া হলঃ
(১) শিরক
শিরক অর্থ হচ্ছে এই যে, যে সব গুলাবলী কেবল আল্লাহর জন্যেই নির্দিষ্ট, সে সব গুণে অন্য কাউকে গুণান্বিত ভাবা। যেমন, কাউকে পৃথিবীতে যা-ইচ্ছা তাই করার অধিকারী ভাবা, যেরুপ আল্লাহ ‘কুন ফায়াকুন’ দ্বারা করে থাকেন। কিংবা কাউকে এরূপ মৌল জ্ঞানের অধিকারী ভাবা; যা ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য হয়ে দলীল-প্রমাণ, স্বপ্ন-ইলহাম বা জ্ঞানানুশীলদের মাধ্যমে অর্জিত হয়নি। রুগ্নদের রোগ মুক্তির কিংবা কাউকে অভিশপ্ত করার ক্ষমতা ও অসন্তুষ্ট হয়ে কাউকে রুগ্ন দরিদ্র কিংবা হতভাগ্য করা এবং কাহার ওপরে দয়াবান হওয়ায় তার স্বচ্ছলতা, স্বাস্থ্য ও শুভ পরিণাম দেখা দেওয়া- এ সবই আল্লাহর খাস গুন। এসব গুনে অন্য কাউকে গুণাম্বিত কিংবা এতেও কাহার অংশ আছে বলে ভাবা শিরক।
এ মুশরিকরাও সৃষ্টির কাজে কিংবা সৃষ্টির ব্যাপারে নিয়ন্তা হিসেবে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক ভাবত না। তারা এ বিশ্বাসও রাখত যে, আল্লাহ যখন কিছু করতে চান, তা আটকে রাখার ক্ষমতা কারুর নেই। বরং তারা শুধু বিশেষ ব্যাপারে বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়ে শিরক করত। তারা ভাবত, যেভাবে কোন বাদশাহ নিজের কোন আপনজন কিংবা দরবারের কোন আমীরকে দেশের কোন এলাকার শাসনভার দিয়ে ছোট-খাট ব্যাপারে তাঁকে কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতা দিয়ে থাকেন যেন সে বাদশাহর অবর্তমানে নিজ মত ও সিদ্ধান্র অনুসারে কাজ করতে পারে, এও তেমনি ব্যাপার মাত্র।
এ কথা সুস্পষ্ট যে, বাদশাহর পক্ষে ছোট-খাট, খুঁটি-নাটি ব্যাপারে নজর দেয়া সম্ভবপর নয়। সুতারাং এমন সব ব্যাপারে নিজ প্রেরিত ব্যক্তিদের কিংবা নিজ শাসন প্রতিভু ও আমীরদের অধিকার দিয়ে দিতেন। তারা যেভাবে ভাল মনে করত, কাজ করে যেত। বস্তুত এভাবে তিনি সে এলাকার সব প্রজাদের সেই শাসনকর্তার কর্তৃত্বাধীনে ছেড়ে দিতেন। সেখানকার চাকর-বাকর কিংবা প্রজাদের ব্যাপারে শাসকদের সুপারিশই গ্রহণ করতেন। ঠিক তেমনই আল্লাহ পাক ও নিজ বান্দাদের কাউকে কাউকে নিজ প্রভুত্বের খিলাফত দান করে থাকেন। সে মতে সেই বান্দাদের খুশী ও অখুশী দুয়েরই প্রভাব প্রজাদের ওপরে পড়ে থাকে। এ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তারা তাদের নৈকট্য লাভের ও সন্তুষ্টি অর্জনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ফলে যেন তারা মুল প্রভুর দরবারেও স্বীকৃতি লাভের উপযগী হতে পারে। আর দাবী-দাওয়া ও প্রয়োজন মেটাবার ব্যাপারে সে সব বিশেষ বান্দাদের সুপারিশ তাঁর সকাশে মঞ্জুরি লাভের উপযোগী হয়।
এসব কারণেই তারা সে সব খাস বান্দাদের সকাশে মাথা নত করে সিজদা দান বৈধ ভাবত। তাদের নামে কিছু উতসর্গ বা কুরবানী করা, তাদের নামে শপথ করা, বিপদে আপদে ও বিশেষ বিশেষ কাজে তাদের সাহায্য প্রার্থনা করা। এমন সব ধরনের তাদের খোদায়ী অধিকার ও ক্ষমতার তারা স্বীকৃতি দিত। এমনকি তারা সে সব বিশেষ বান্দাদের পাথর, লোহা কিংবা বিভিন্ন ধাতুর প্রতিমা বানিয়ে নিত। এ মুর্খরা ক্রমে ক্রমে এসব মূর্তিকেই প্রকৃত ইলাহ বলে ভাবল। তা থেকে বিরাট এক বিভ্রান্তির সূত্রপাত ঘটোল।
(২) তাশবীহঃ
তাশবীহ অর্থ হচ্ছে, মানুষ বা তার গুণাবলীকে আল্লাহর সাথে সংযুক্ত করা। যেমন তাদের দিশ্বাস ছিল, ফেরেশতারা আল্লাহর সন্তান। তাদের এ-ও বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহ স্বয়ং পছন্দ না করলেও কোন কোন পাপীদের জন্য বিশেষ বান্দাদের সুপারিশ গ্রহণ করতে বাধ্য হন। যেমন, অনেক সময় মনঃপুত না হলেও বাদশাহ আমীর-উমরাদের সুপারিশ গ্রহণ করে থাকেন। এভাবে তারা আল্লাহর জ্ঞান দঈশন ইত্যাদিএ অসীমত্ব উপলব্ধি করতে ব্যররথ হয়ে নিজেদের সসীম ক্ষমতা ও ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের অনুরূপ ভাবত যার ফলে তারা নিরাকার আল্লাহর নিজেদের মত একটা আকার কল্পনা করে নিত। আর সে দেহের অবস্থিতির জন্যে স্থানও নির্দিষ্ট করে ভাবত।
(৩) তাহরীফ
তাহরীফের মূল বিশ্লেষণ হল এইঃ হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধররা বেশ কিছুকাল ধতে হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর ধর্মে স্থির ছিল। অবশেষে তাদের ভেতরে আমর ইবনে হাই মালউন জন্ম নিল। সে তাদের জন্যে বিভিন্ন ধরনের প্রতিমা গড়ে সেগুলোর পুজাকেও ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করে দিল। তাদের জন্যে সে ১। বাহীরা, ২। সাঈবা, ৩। হাম। কিংবা তীরের সাহায্যে লটারী ব্যবস্থা প্রবর্তন করল। এ দুষ্কার্য শেষ নবী (সাঃ) এর আবির্ভাবের প্রায় তিনশ বছর আগে ঘটল। মুশরিকরা এ সব কাজের জন্যে বাপ-দাদার অনুসৃত কার্যের দলীল পেশ করত। সেগুলোকে তারা তাদের অন্যতম অকাট্য দলীল ভাবত।
(৪) রসূল ও পরকাল সম্পর্কে মুশরিক দল
যদিও আগেকার নরীরাও পুনরুত্থান ও হিসাব-নিকাশ গ্রহণ সম্পর্কে বলে গেছেন, কিন্তু তা শেষ নবী (সাঃ) এর মত বিস্তারিত ভাবে বিশ্লেষন সহকারে বলে যান নি। এ কারণের মুশরিকরা এ ধরণের বিশ্বাসের সাথে অপরিচিত ছিল এবং পুনরুত্থান হিসাব-নিকাশকে দুর্বোধ্য ভাবত।
এভাবে যদিও তারা হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর ওপরেও বিশ্বাস রাখত; কিন্তু যেহেতু তাঁরাও ব্যক্তি বিশেষ ছিলেন এবং তাঁদের ব্যক্তিত্বও নবুওতের ধারাবাহিক জ্যোতির মাঝে এক-একটি ছেদ বলে মনে হত, তাই তারা দ্বিধা ও সন্দেহের মধ্যে পরে যেত। তারা যেহেতু এভাবে যুগে যুগে মানুষের ভেতর থেকে ভিন্ন ভিন্ন নবী পাঠাবার ভেতরে আল্লাহর হিকমতের চাহিদাকে অনুধাবন করতে ব্যররথ হয়েছিল এবং দুত প্রেরক ও দূতের ভেতর সামঞ্জস্য ও উপমা খুজতে অভ্যস্ত ছিল, তার তারা নবুওতের সত্যিকারের ধারণা থেকে বঞ্চিত ছিল। এমনকি তারা নবীর মানুষ হওয়াটা অসম্ভব ভাবত। ফলে তারা এ ব্যাপারে অনেক আবোল-তাবোল সন্দেহ ও প্রশ্নের সৃষ্টি করত। যেমন, নবীর আবার খানা-পিনার দরকার হবে কেন? ফেরেশতাদের আল্লাহ কেন নবী বানালেন না? মানুষের কাছে যদি ওহী আসে তো প্রত্যেকের কাছেই তা আলাদাভাবে আসে না কেন? এভাবে আরো বহু নির্ব্দধিতার কথা তারা বলত। সেগুলো তাদের বিশ্বাসেরই অংশ হয়ে দাঁড়াল।
টীকাঃ ১। যে প্রানীর দুধ দেব-দেবীর নামে উতসর্গ করা হয়। ২। যে প্রাণী দেব-দেবীর নামে ছেড়ে দেয়া হয়। ৩। যে উটের পিঠে সাওয়ার হওয়ার উপযুক্ত হয়েছে তাকে মুক্ত করা।
মুশরিকদের নমুনাঃ
এর পরেও যদি মুশরিকদের প্রকৃত অবস্থা, তাদের ভ্রাবত বিশ্বাস ও কার্যাবলী সম্পর্কে সঠিক ধারণা জন্মাতে কারো অসুবিধা থেকে থাকে সে যেন বর্তমান যুগের মুর্খ জনসাধারণের ধ্যান-ধারণা ও কার্যকালাপের সুষ্পষ্ট ভ্রান্তিগুলো থেকেও সেকালের মুশিরিকদের অবস্থা মোটামুটি অনুধাবন করা যাবে।
তারা আজ ওলীদের ব্যাপারে কিরুপ ধারণা নিয়ে চলছে। যদিও তারা অতীতের ওলীদের অস্তিত্ব স্বীকার করে, তথাপ তারা এ যুগে ওলীর আবির্ভাবকে অসম্ভব মনে করে। এরা বিভিন্ন কবর ও দরগায় যায়। সেখানে তারা নানা ধরনের মুশরিকী কাজ অনুসরণ করে। লক্ষ্য করুণ, তাদের ভেতরে তাশবীহ ও তাহরীফ কতভাবে ঠাঁই পেয়েছে একটি সহীহ হাদীসে আছে- “তোমরাও অতীতের জাতিগুলোর বিভ্রান্ত কার্যধারা অনুসরণ করবে। ” বস্তুত বিভ্রান্ত জাতিফুলোর খারাপ কাজ ও কুসংস্কাররের একটিও এমন নেই, যা মুসলমানেরা আজ অনুসরণ না করছে। আল্লাহ সবাইকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করুন।
মোটকথা, শুধু আরবেরই নয়, বরং গোটা দুনিয়াটারই অবস্থা এরূপ ছিল। তাই আল্লাহ তা’আলা নিতান্ত দয়াপরবশ হয়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে আরবদের মাঝে পাঠালেন। এবং তাঁকে আবার দ্বীন-ঈ-ইবরাহীমের প্রতিষ্ঠা ও প্রচারের জন্যে বিয়োগ করলেন। সংগে সংগে কুরআন পাক এই মুশরিকদের সাথে যুক্তির যুদ্ধে অবতীর্ণ হল। আর এ যুক্তি অবতারণার ক্ষেত্রে সেগুলোই তুলে ধরল, যে ইবরাহীমী ধর্মের স্বীকৃত সত্য নিদর্শনরূপে তখনো বেঁচে ছিল। উদ্দেশ্য, যেন তাদের কাছে প্রামাণ্য যুক্তি হিসেবে তা প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং কোনরূপে অস্বীকার করতে না পারে।
শিরকের জবাবঃ
বস্তুত কুরআন পাকে তাদের অংশীবাদী বিশ্বাসের জবাবে চারটি ধারায় দেয়া হয়েছে,
প্রথম তাদের কাছে তাদের ধ্যান-ধারণাগুলোর সমর্থনের দলীল দাবী করা হল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করা হল যে তাদের এসব বিশ্বাস মূলত তাদের পূর্ব পুরুষদের বিশ্বাসের পরিপন্থী। অথচ তাদের দাবী হচ্ছে, পূর্ব-পুরুষদেরই তারা অনুসরণ করছে।
দ্বিতীয় ধারায় তাদের বুঝানো হল, যে সব বান্দাদের তারা আল্লাহর সাথে শরীক করেছে, তাদের ও আল্লাহর ভেতরে কোনরূপ সমতা ও তুলনা কলে না। পরন্তু আল্লাহ তা’আলাই চরম মর্যাদা লাভের একমাত্র অধিকারী, কোন বান্দা নয়।
তৃতীয় ধারায় তাদের বলে দেয়া হল, অতীতের সব নবীরাও একত্ববাদের বিশ্বাসী ছিলেন। কুরআনে তা এভাবে বর্ণনা করা হল- “(হে রাসুল!) আমি আপনার আগেও যে নবীদের পাঠিয়েছি, তাদের কাছে এ বাণীও পাঠিয়েছিলাম যে, আমি ব্যতিত অন্য কোন উপাস্য নেই। তাই শুধু আমারই উপাসনা কর।
চতুর্থ ধারায় তাদের প্রতিমা পূজার অসারতা বুঝানো হল। তাদের বলা হল, যে পাথর খন্ডের তারা পূজা করছে, আসলে তা মর্যাদার বিচারে মানুষের চেয়েও অনেক নগন্য ও দুর্বল। সেক্ষেত্রে তা কি করে আল্লাহর মর্যাদা লাভ করতে পারে? অবশ্য এ ধারাটি শুধু সে দলের জন্য প্রযোজ্য ছিলো, যারা প্রতিমাকেই আল্লাহ ভেবে পূজা করত। যারা সেগুলোকে কোন এক অদেখা শক্তির প্রতিভু বলে মনে করত তাদের জন্যে নয়।
তাশবীহর জবাবঃ
প্রথমত, তাদের থেকেও তাদের দাবীর সমর্থনে যুক্তি ও প্রমাণ চাওয়া হল। এবং বলে দেয়া হল, তাদের এসব বিশ্বাস তাদের পূর্ব-পুরুষদের বিশ্বাসের বিরোধী। অথচ তারা জোর গলায় তাদেরই অনুসরণের দাবী করছে। আর বলছে, তারাও ‘তাশবীহ’ মেনে চলত।
দ্বিতীয়ত, তাদের বুঝানো হল, তাদের দলীল অনুসারে তো এটাও প্রমাণিত হয় যে, পিতা ও পুত্র একইরূপ হবে। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। তা হলে এটা কি করে অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াল যে, আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টি একইরূপ হবে?
তৃতীয়ত, তাদের এও বুঝিয়ে দেয়া হল, নিজেদের জন্য তারা কি করে ভাল ও বৈধ মনে করে? বস্তুত তারা নিজেরা তো মেয়ে পছন্দ করে না। সেটাকে তারা লজ্জা ও বিপদ ভাবে। অথচ আল্লাহ তা’আলার জন্যে মেয়ে কল্পনা করে এবং বলে যে, ফেরেশতারা আল্লাহর মেয়ে। “এটা কি করে হতে পারে যে, তোমাদের বেলায় পুত্র চাও, আর তোমাদের প্রভুর জন্য চাও কন্যা?” (কুরআন) এ জবাব তাদের জন্যে প্রযোজ্য, যারা কাল্পনিক ব্যাপারে উৎসাহী ছিল। আদতে মুশরিকদের ভেতরে ‘তাহরীফ’ কারীদের সংখ্যাই ছিল সর্বাধিক। বিভিন্ন ধারায় তাদের কার্যের জবাব দেওয়া হয়েছে।
তাহরীফের জবাবঃ
প্রথমত, তাদের বুঝানো হল, তারা যা কিছু বলেছে, তার মুলে কোনই সত্যতা নেই। সবই তাদের মনগড়া। এ ধরণের কোন কথা পূণ্যাত্মাদের কোন বর্ণনায় দেখা যায় না।
দ্বিতীয়ত, তাদের বলা হল, তারা যে সব বিশ্বাস পোষণ করেছে, তাও ভ্রান্ত ও অমূলক। কারণ এ সব শুধু সরল ও নির্বোধ লোকেদের সৃষ্টি ও আবিষ্কার। দীন-ধর্মের সাথে এ সবের কোনই যোগ নেই।
পরকালে অবিশ্বাসীদের জবাবঃ
যারা হাশর-নশর ও মরণের পরে পুনরুত্থানকে অসম্ভব ভাবত, তাদেরও বিভিন্নভাবে বুঝানো হয়েছে। বিভিন্ন পন্থায় তাদের সন্দেহ নিরসনের প্রয়াস চলেছে।
প্রথমত, সবার আগে তাদের দুনিয়ার অবস্থার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। পৃথিবী শুষ্ক ও শুন্য হয়ে যাবার পরে আবর সজীবও পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
পৃথিবীর এ বিবির্তন থেকে সহজেই বুঝা যায় যে, জীবন ফিরে পাওয়া কোন অসম্ভব ব্যাপার নয়। আল্লাহ যেভাবে মৃত পৃথিবীকে দ্বিতীয়বার জীবন দান করে থাকেন, তেমনিভাবে মৃত মানুষকেও দ্বিতীয়বার জীবন দান করতে পারেন।
দ্বিতীয়ত, তাদের বলা হয়, অতীতের জাতিগুলোর এটা সর্ববাদী সম্মত বিশ্বাস ছিল যে, মরণের পরে আবার জীবন লাভ করে হিসাব-নিকাশ দানের জন্যে তাদের আল্লাহর দরবারে হাযির হতে হবে। আর দুনিয়ার সন ধর্ম এ ব্যাপারে একমত হওয়ায় এটা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, মরণের পরে পূনর্জীবন লাভ অনস্বীকার্য সত্য।
হযরত সম্পর্কে সন্দেহের জবাবঃ
হযরতের রিসালাত সম্পঈকে তারা নানারূপ প্রশ্ন তুলত। তাদের সব প্রশ্ন ও সন্দেহের জবাব আলাদা করে দেয়া হয়েছে।
তাদের সবচাইতে বড় প্রশ্ন ছিল এই, কোন মানুষকে কি করে আল্লাহ তা’আলা নবী করতে পারেন? তার উত্তরে বলা হয়েছে, তাদের এ প্রশ্ন নেহাত ভিত্তিহীন। কারণ অতীতের সব নবীই মানুষ ছিলেন। এক আয়াত স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছে। “হে রসূল! আমি আপনার আগেও মানুষকেই নবী করে পাঠিয়েছি। তাদের কাছে আমি ওহী পাঠাতাম। আর যারা বেঈমান, তারাই বলে যে, আপনি আল্লাহর প্ররিত রসূল নন। তাদের বলে দিন, তোমাদের আর আমার ভেতরকার এ ব্যাপারে সাক্ষী হিসাবে স্বয়ং আল্লাহ ও ঐশীগ্রন্থ, পরিজ্ঞাত লোকগনই যথেষ্ট। ” (কুরআন)
তাদের সন্দেহের দ্বিতীয় জবাব এরূপে দেয়া হল, কুরআনে নবুওয়াত বলতে ওহী বোঝায়। যেমন এক আয়াতে আমাদের রসূলকে উপদেশ দেয়া হয়েছে, “হে রসূল! আপনি বলুন, আমি তোমাদেরই মত একজন মানুষ। অবশ্য আমার কাছে ওহী আসে।
তারপর ওহীর ব্যাখ্যা যে ভাবে দেয়া হয়েছে, তা অসম্ভব কিছু বলে মনে হতে পারে না।
তাদের অন্যান্য প্রশ্নের জবাব মোটামুটিভাবে দেয়া হয়েছে। তাদের এটা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, তাদের দাবী অনুসারে নবীদের মু’জিযা না দেখতে পাওয়া, তাদের পছন্দনীয় যোগ্য ব্যক্তি নবী না হওয়া, ফেরেশতাদের নবী না করা ও ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রত্যেকের কাছে ওহী না পাঠানো- এ সব কিছুই বিরাট এক মংগলময় উদ্দেখ্যে হয়েছে যা তাদের মুর্খতার জন্যই বোধগম্য হয়ে ওঠেনি।
জবাবের পুনরূক্তিতাঃ
যেহেতু কুরআনের সমনে ছিল মুশরিক দল, তাই এ সমস্যাগুলো বিভিন্ন ভাবে বারংবার নতুন নতুন ভংগিতে বর্ণনা করা হয়েছে। আর অন্যন্ত উচ্চাংগের আলংকারিক তাগাদার সাথে দাবীকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। সেজন্য বারংবার বলতেও দ্বিধা করেনি। তাছাড়া ঠিক যে, এ ধরণের মুর্খদের বুঝাবার জন্যে অসীম বিজ্ঞ প্রভুর উপদেশের ধরণ এরূপ হওয়াই দরকার- এ ধরণের অজ্ঞানদের বারংবার তাগাদা দিয়ে কথা বলেই চেতনা চাংগা করা প্রয়োজন হয়। “এটাই সর্বজ্ঞ ও সর্বজয়ী প্রভুর নির্ধারিত পন্থা। ”
ইয়াহুদীদের অবস্থাঃ
ইয়াহুদীরা তাওরাতে বিশ্বাসী বলে দাবী করত। তাদের বিভ্রান্তি ছিল এই, তারা তাওরাতের বিধি-নিষেধ অদল-বদল করে ফেলেছিল। পরিবর্তন বাক্যে যেমনি ঘটিয়েছিল, তেমনি ঘটিয়েছিল অর্থেও। অনেক আয়াত তারা লোপ করে দিয়েছিল অনেক আয়াত তারা আবার নিজেদের তরফ থেকে যুক্ত করেছিল। তাছাড়া তাওরাদের বিধি-নিষেধ পালনের ব্যাপারেও তারা অবহেলা করত অনেকে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ছিল তাদের ভেতরে চরম। তারা রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নবী হওয়াটাকে অসম্ভব বলে ঘোষনা করেছিল। তার সম্পর্কে তারা অনেক কুৎসা রটাত ও অশোভন আচরন করত। পরন্তু স্বয়ং আল্লাহ তা’আলার ব্যাপারেও তারা এ ধরণেরই অশোভন মন্তব্য করত। তাছাড়া তারা কার্পণ্য লালাসা, হিংসা ইত্যাদি নানা কলুষ চরিত্রের অধিকারী ছিল।
তাওরাতে তাহরীফঃ
ইয়াহুদীরা তাওরাতের শাব্দিক যে পরিবর্তন ঘটাত, তা মুল গ্রন্থে নয়, বতং ব্যাখ্যা গ্রন্থে। এ দীন লেখকের মত এটাই। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও এ কথা বলে গেছেন। আর অর্থগত যে পরিবর্তন ঘটাত তার স্বরূপ এই, আয়াতের যথার্থ অর্থ ছেড়ে খামখেয়ালী অর্থ কতে নিত। ইয়াহুদীরা তাওরাতে যে ধরণের তাহরীফ বা পরিবর্তন ঘটাত তার একটি উদাহরণ হচ্ছে এই যে কথাটি সাধারণ ভাবে বলা হয়েছে তারা সেটাকে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করত। যেমন, তাদের ধর্মে ফাসিক ও দ্বীনদার, কাফের ও মুনাফিকের ভেতরকার পারস্পরিক তফাতটুকু বলে দেইয়া হয়েছে। আর এ কথা বলা হতেছে, কাফিরদের (অবিশ্বাসী) কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে এবং তারা চিরতরে জাহান্নামে থাকবে। অবশ্য ফাসিক (পাপী) হয়ত নবীদের শাফায়াত পেয়ে মুক্তি লাভ করবে।
ধর্মানুসারীদের এ বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্যে সব ধর্মেই সে ধর্মের অনুসারীদের বিশেষ নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাওরাতে এ মর্যাদা ইয়াহুদী ও ইবরাহীমীদের ইঞ্জীলে নাসারাদের ও কুরআনে মুসলমানদের দেয়া হয়েছে। কিন্তু এসব গ্রন্থেই এ শব্দগুলোর দ্বারা শুধ্র আল্লাহ ও পরকালে যারা বিশ্বাস করে, স্ব স্ব পয়গম্বরের অনুবর্তী হয়ে চলে, স্ব স্ব শরীয়ত মেনে চলে, ধর্মীয় বিধি-নিষেধগুলো পালন করে, তাদেরই বুঝায়। এ সব শব্দ দ্বারা কোন বিশেষ দলকে বুঝানো হয়নি। কিন্তু ইয়াহুদী দল বুঝেছে যে জান্নাত শুধু ইয়াহুদী ও আবেরীদের জন্যে নির্দিষ্ট রয়েছে। নবীদের শাফাআত ও শুধু তাদেরই মিলবে। জাহান্নামে তারা গেলেও অল্পসময় কাটিয়েই মুক্তি পেয়ে যাবে। তারা সত্যিকারের আল্লাহ অ রসুলে বিশ্বাসী হোক বা না হোক। কিন্তু তাদের এ ধারণা নির্ভেজাল মুর্খতা ও বোকামীর পরিচায়ক বী নয়।
কুরআন যেহেতু সব ঐশীগ্রন্থ থেকে শ্রেষ্ঠ ও মহান, আর সব গ্রন্থের চাইতে অধিক বিশ্লেষণ রয়েছে এতে, আগের গ্রন্থগুলোর সব সন্দেহ ও প্রশ্ন এখানে দূর করা হয়েছে, তার এ ব্যাপারেও সব সন্দেহের নিরসন ঘটিয়েছে। “হ্যা, যারা পাপ করে এবং চারদিক থেকে ভ্রান্তি যাদের ঘিরে ফেলে, তারাই জাহান্নামী। সেখানে তারা স্থায়ীভাবে কাটাবে। ” (কুরআন)
এভাবে এটাও একটি চরম সত্য যে, সব ধর্মেই সে ধরনের বিধান নির্ধারিত হয়েছে যা সব যুগের দাবী মেটাবার জন্যে যথেষ্ট ছিল। বিভিন্ন ব্যাপারে বিধিনিষেধের ক্ষেত্রে বিশেষ যুগের বা সম্প্রদায়ের স্বভাব-প্রকৃতি লক্ষ্য রেখে করা হয়েছে। সে বিধান ও আইন-কানুনকে সত্য সঠিক জানার জন্যে তাএর শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
এখানে মুল ইদ্দেশ্য ছিল এই, এ সব বিধিবিধান যেখানে যাদের জন্যে রচিত হয়েছিল, এর সত্যতাও সে যুগের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তা চিরস্থায়ী বিধান ছিল না। শুধু সেকালের উম্মতদের জন্যেই তা কার্যকরী ছিল। অর্থাৎ অন্য নবী না আসা পর্যন্ত পূর্ববর্তী নবীর যুগ চলত। অবশ্য কোন ধর্মেরই মোলসত্ত্বায় কোন তফাৎ থাকে না। অথচ ইয়াহুদীরা এর অর্থ বুঝল অন্যরুপ। তারা ভাবল, ইয়াহুদী ধর্ম ওতার বিধি-বিধান কখনই বাতিক হতে পারে না। অথচ মূল অবস্থা হল এই, যখন কোন ধর্মকে অনুসরণ করতে বলা হয়, তা দ্বারা সেই খাস ধর্মের অনুসরণ মাত্র বুঝায় না; বরং তা দ্বারা ঈমান ও নেক আমল বুঝায়। কিন্তু ইয়াহুদীরা ধর্মের নির্দিষ্টতায় বিশ্বাসী হল এবং বুঝে নিল, হযরত ইয়াকুব (আঃ) শুধু ইয়াহুদী ধর্ম অনুসরণের কথায় বলে গেছেন।
এতো গেল ইয়াহুদীদের ধর্মগ্রন্থের মতলরবিকৃতি ঘটানোর পরিচয়। তারা আয়াতের কোনকোন শব্দ ও পরিভাষায়ও তাহরীফ সৃষ্টি করেছিল। যেমন, আল্লাহ তাআলা সব ধর্মেই নবী ও তাঁর অনুসারীদের আপন ও প্রিয়জন বলে সম্বোধন করেছেন। পক্ষান্তরে ধর্ম অস্বীকারকারীদের অভিশপ্ত ও অপছন্দনীয় বলে ঘোষনা করেছেন। এ ব্যাপারে সে সব শব্দই ব্যাবহার করা হয়েছে যা সেই সম্প্রদায়ের ভেতর দৈনন্দি জীবনের পরিভাষা হিদেবে ব্যাপকহারে প্রচলিত ছিল। সুতারাং কোথাও যদি ‘বন্ধু’ না বলে ‘বতস’ শব্দ ব্যবহার করে থাকে, তাতে বিস্মিত হবার কিছুই নেই।
কিন্তু ইয়াহুদীরা এ সত্য এড়িয়ে গেল। তারা বুঝে নিল, নৈকট্য ও বন্ধুত্বের মর্যাদা কেবল ইয়াহুদী, আবেরী ও ইসরাঈলীদের জন্যে নির্দিষ্ট রয়েছে। তারা এটা বুঝতে পারলনা যে, আল্লাহ তাআলার আনুগত্য ও তাঁর বিধি-বিধান মেনে নেয়াই সে মর্যাদা লাভের রক্ষা-কবচ।
এভাবে আরও অনেক ভ্রান্তিপূর্ণ আসার ব্যাখ্যা তাদের মনে বাসা বেঁধেছিল। সেগুলো স্তারা তাদের বাপ দাদা থেকে শিখিছে ও ইত্তরাধিকারসূত্রে অর্জন করেছে। কিন্তু কুরান সে সব ভুল ধারণার পূর্ণ অবসান ঘটিয়েছে।
কিতমানুল-আয়াত (বাক্য বিলোপ)
কিতমানে আয়াত বলতে তাদের মর্যী ও স্বার্থের বিরোধী আয়াতগুলোকে তাওরাত থেকে গোপন করে ফেলাকে বুঝায়। এর উদ্দেশ্য ছিল, তাদের আবহমান কাল থেকে পেয়ে আসা মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রাখা। সাধারণ লোক ধর্মনেতাদের ওপরে আস্থা রাখত। এ আস্থা যাতে কমে না যায় ও ধর্মগ্রন্থ তারা মানছে না- এটা যেন কেউ না বুঝেফেলে, এজন্যে তারা সেরূপ করত। এর কয়েকটি উদাহরণ নীচে দেয়া হলঃ
১। তাওরাতে যিনাকারের জন্যে পাথর মেরে উরিয়ে দেবার বিধান রয়েছে। কিন্তু, ইয়াহুদী ধর্মনেতাদের সর্বসম্মত মতে সে বিধান বদলে গেল। তার বদলে তারা কোড়া মারা ও মুখে কালি মাখার বিধান কৈরী করল। অথচ সর্বসাধারণ যদি এরূপ পরিবর্তনের খবর পেত, তাদের ওপরে আস্থা হারিয়ে ফেলত। তাই কোনরূপ অবমাননার ভয়ে তারা শেষ পর্যন্ত পাথর মারার সে আয়াতই গোপন করে ফেলল।
২। তাওরাতে এমন কিছু আয়াতও ছিল যাতে হযরত হাযিরা (রাঃ) হযরত ঈসমাঈল (আঃ) এর বংশধরদের জন্যেও নবুয়াত প্রাপ্তির সুসংবাদ ছিল। সে সব আয়াতে এমন জাতির খবরও দেয়া হয়েছিল, যারা আরবে কর্তিত্ব লাভ করবে। আরাফাতের পাহাড়গুলো তাদের বদৌলতে ‘লাব্বায়েক’ গুঞ্জনে মুখর হবে। সব দেশের লোক হজ্জ ও যিয়ারতের জন্যে সেখানে আসতে থাকবে।
ইয়াহুদীরা পয়লা তো সেগুলোর ব্যাখ্যা বিকৃত করার প্রয়াস পেল। তারা বলল, এসব আয়াতে নয়া একটা সম্প্রদায়ের খবর দেয়া হয়েছে মাত্র। তাদের আনুগত্য ও অনুসরণের কথা বলা হয় নি। অবশ্য এ কথা তাদের ভেতরে প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছিল। “মালহামাতুন কুতিবাত আলায়না” অর্থাৎ ইহা একটি যুদ্ধ যা আমাদের উপরে ফরজ হয়েছে। আমাদের ওপরে মুসলিমদের যে প্রাধান্য পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা তাওরাতের লিখিত ইয়াহুদীদের ওপরে কাফিরদের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা তাওরাতের লিখিত ইয়াহুদীদের ওপরে কাফিরদের প্রাধান্য লাভের বাস্তবায়ন ঘটে। কিন্তু যখন তারা দেখল, তাদের এ ব্যাখ্যায় কেউ নিরস্ত হচ্ছে না, তখন সে আয়াতকেই লুকিয়ে ফেলা ছাড়া তাদের উপায় ছিল না। তার একে অপরকে এ আয়াত গোপন করার পরামর্শ দিয়ে চলল। তারপর সবাই এ সিদ্ধান্ত নিল যে, সর্বসাদণ্যে এ আয়াত প্রকাশ করা হবে না। ‘আল্লাহর সকাশে দলীল পেশ করার জন্যে তোমরা কি আল্লাহর উদঘাটিত সত্যের বিরুদ্ধে কথা তৈরী করে নিচ্ছ। ”
কত বড় মূর্খতা! আল্লাহ তাআলার এত জোরের সাথে হযরত হাযিরা (রাঃ) ও হযরত ইসমাঈল (আঃ) এর বংশে নবী আবির্ভাবের ও নতুন সম্প্রদায়ের উদ্ভবের খবর দান শুধু খবরের খাতিরেই, আনুগত্য বা অনুসরনের জন্য নয়, এটা কি করে বুঝল? আদতে এ তো বোকামী ছিল না, ছিল বাড়াবাড়ি ও আল্লাহর নামে মিথ্যার বেসাতি চালানোর বিরাট কারসাজী।
ইফতিরার স্বরূপঃ
নিজের মনগড়া কথাকে আল্লাহর নামে চালানোই ইফতিরা। এর কারণ ছিল এই, ইয়াহুদী আলেম ও ধর্মনায়কদের ভেতরে বিশেষ এক ধরনের বাড়াবাড়ি ঠাঁই পেয়েছিল তারা ইস্তিহসান অর্থাৎ কল্যানপ্রসু ভেবে ধর্ম গ্রন্থে না থাকা সত্বেও কিছু বিধি-বিধান নিজেরা তৈরী করে নিল। সে মনগড়া বিধানকে তারা ঐশী-গ্রন্থের বিধানের মতই মেনে চলা অপরিহার্য ভাবত। তাছাড়া তারা ধর্মনায়কদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তকে ধর্মীয় বিধানের মতই অকাট্য দলীল বলে ভাবত। হযরত ঈসা (আঃ) এর নবুওত ও রিসালাত অস্বীকার করার জন্যে তাদের কাছে স্বীয় ধর্মনেতাদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কোন দলীলই ছিল না। আরও অনেক বিধান সম্পর্কেও এ কথা চলে।
মুসালাহার স্বরূপঃ
ধর্মীয় বিধানকে হাল্কা করে দেখা ও সে ব্যাপারে ব্যপরোয়া হয়ে চলাকে ‘মুসাহালা’ বলা হয়। তারা তাওরাতের বিধান সম্পর্কে এরূপ নীতিই অনুসরণ করত এবং কার্পণ্য ও লালসার মত নিকৃষ্ট চরিত্রে তারা নিমজ্জিত ছিল। বলা বাহুল্য, এসব কে-প্রবৃত্তির আরসাজী বৈ কিছুই ছিল না। কু-প্রবৃত্তি সবাইকে প্রভাবিত করে এবং সর্বদা খারাপ কাজে উস্কানি দেয়। তার দৌরাত্ব থেকে আল্লাহ যাকে রক্ষ করেন, সেই কেবল বাঁচতে পারে।
স্বেচ্ছাচার ও রিপুর লীলা খেলা সেই ঐশীগ্রন্থ প্রাপ্তদের ভেতরে সম্পূর্ণ এক নতুন মনোভাবের জন্ম দিল। তারাই আশ্রয় নিয়ে তারা আয়াতের অপব্যাখ্যা ও মনগড়া বিধানকে ধর্মীয় বিধানের মর্যাদা দিয়ে চালু করে দিল।
শেষ নবীর ব্যাপারে তাদের সন্দেহের স্বরূপঃ
শেষ নবী (সঃ) এর ব্যাপারে তাদের সামনে যে সব সন্দেহ ও সমস্যা দেখা দিয়েছিল, তার কারণ নিম্নে দেয়া হল-
১। নবীদের স্ত্রীর সংখ্যা একরূপ ছিল না। এশরনের ব্যক্তিগত কার্যকালাপ ও অভ্যাদের ক্ষেত্রে নবীদের স্বাতন্ত্র্য ও অনৈক্য দেখা যায়।
২। নবীদের শরীয়াত ও বাহ্যিক দৃষ্টিতে বেশ কিছু পৃথক মনে হয়। খুঁটিনাটি বিধি-বিধানের ব্যাপারে পরস্পরের ভেতর কমই ঐক্য দেখা যায়।
৩। বিভিন্ন নবীদের বেলায় আল্লাহ তায়ালার পন্থা ও কার্যধারা ভিন্ন ভিন্ন ছিল। যার ফলে নবীদের ব্যাহ্যিক অবস্থা এক ধরণের ছিল না।
৪। এ পর্যন্ত যত নবী এসেছিলেন, অধিকাংশই ইসরাঈল গোত্রের ছিলেন। শুধু হযরত (সঃ)- ই ছিলেন ইসমাঈল (আঃ)- এর গোত্রের।
একে তো অভ্যাস, কার্যধারা ওশ্রীয়তের ব্যাপারে পার্থক্য, তার ওপরে ইসমাইল বংশের হওয়ায় আমাদের রাসূল (সঃ) এর ওপরে ইয়াহুদীগণ আস্থা আনতে পারল না। তাঁর নবুওত সম্পর্কে তাদের মনে নানা সংশয় দেখা দিল।
রাসুলের দায়িত্বের সীমা রেখাঃ
অথচ ইয়াহুদীরা যে সব ব্যাপারে প্রভাবিত হল, নবূওতের সাথে তার কোনই যোগ নেই। কারণ রসূলের দায়িত্ব হচ্ছে শুধু মানুষের আত্মাকে কলুষমুক্ত করা এবং তাদের উপাসনা ও অভ্যাস সঠিক করে দেয়া। পাপ পুণ্যের বিধান তৈরী করা রসূলের দায়িত্ব নয়। রীতি-নীতি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের আলাদা থাকে। নবী কোন এক সম্প্রদায়ের ভেতরে আসেন। তিনি এসে তাদের রীতি-নীতি তুলে দিয়ে নতুন সামাজিক রীতি-নীতি প্রবর্তন করেন না; বরং তিনি সেগুলোর ভাল মন্দ বিবেচনা করেন। যেগুলো কল্যানকর ও আল্লাহর অভিপ্রেত মনে করেন, সেগুলোতে হাত দেন না। অন্যান্য গুলোও প্রয়োজনীয় সংশোধন সহকারে রেখে দেন। সুতারাং সামাজিক রীতি-নীতির এ পার্থক্যের সাথে নবূওতের তেমন যোগ থাকে না।
নবীদের শরীয়াতের যে অংশ তাযকীর বি আলাইল্লাহ ও তাযকীর বি আইয়্যামিল্লার সাথে যোগ রেখেই হয়ে থাকে। এ কারণেই নবীদের শরীয়াতের ব্যাহ্যিক তারতম্য দেখা দেয়। (স্থান, কাল ও পাত্রের তারতম্যের দরূন বহিরাবরণে এ তার তম্য দেখা দিতে বাধ্য। তবে শরীয়াতের মূল কথা সবই এক। )
শরীয়তের তারতম্যের মূলকথাঃ
এ তারতম্য হল ঠিক দুটো রোগীর বেলায় বিজ্ঞ ডাক্তার যেরূপ দুধরনের ব্যবস্থা দিয়ে থাকেন, তেমনি। একজনকে দেন তিনি ঠান্ডা ঔষধ, ঠান্ডা পথ্য। অথচ আরেকজনকে দেন গরম দাওয়াই, গরম পথ্য। কিন্তু এ উভয় অবস্থায়ই ডাক্তারের উদ্দেশ্য একই থাকে। তা হচ্ছে রোগ দূর করা ও রোগীকে নিরাময় করা। এছাড়া তো আর কিছুই নয়, এটা সম্ভব যে, বিজ্ঞ ডাক্তার ভিন্ন ভিন্ন দেশে সে দেশের প্রক্ররতি ও আবহাওয়া অনুসারে ঔষধ ওপথ্যের ব্যবস্থা করবেন। তেমনি মওসুম ও প্রকৃতি বদলের সাথে সাথে তিনি দাওয়াইও বদলে দিবেন। ঠিক তেমনি মূল ডাক্তার অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যখন চাইলেন যে, মানুষের আত্মিক ব্যাধির চিকিৎসা করবেন, তাদের মন মেজাজ ভাল করে দেবেন, আত্মাকে শিক্তিশালী ও সুস্থ করে তুলবেন, তখন স্বভাবতই তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের রীতি-নীতি ও অভ্যাস অনুসারে যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা দান করেছেন।
ইয়াহুদী আলেমদের নমুনাঃ
এ যুগে যদি আপনারা ইয়াহুদী আলেমদের নমুনা দেখতে চান, তাহলে নিজেদের সে সব আলেমদের দিকে লক্ষ্য করুন যারা পার্থিব স্বার্থের দাস হয়ে ভূল ভ্রান্ত কাজ অনুসরন করে চলেছে। এরাও নিজ কাজ অনুসরন করে চলেছে। এরাও নিজ রাসূলের অন্ধ অনুকরণে অভ্যস্ত এবং কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট বিধান থেকে মুখ ফিরিয়ে চলেছে। তারা কতিপয় পূরববর্তী আলেমের মনগড়া ফতোয়া মেনে চলেছে। আর পবিত্র শরীয়াত স্রষ্টা প্রভুর পুণ্য বাণীর ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। তারা মনগড়া হাদীস আর অপব্যাখ্যাকে নিজেদের পথ প্রদর্শক ইমাম নিযুক্ত করেছে।
ঈসায়ীদের ধর্মীয় বিশ্বাসঃ
তারা হযরত ঈসা (আঃ) এর রিসালাতের ওপরে ঈমান রাখত। কিন্তু তাদের বিভ্রান্তি ছিল এই, তারা আল্লাহ পাককে এমন তিন সত্তার সমন্বয় ভাবত, যারা বিভিন্ন দিক দিয়ে পরস্পর বিরোধী ছিল। অবশ্য কোন কোন ব্যাপারে তিনের ভতরে ঐক্যও বিদ্যমান ছিল। তারা এ তিন সত্তার নাম দিল “আকানীমে ছালাছা”। এ তিন আকানীমের একটি হচ্ছে ‘পিতৃ’ রূপ। নিছিক সৃষ্টির ভিত্তি হিসেবে এ সত্তা বিরাজ করছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ‘পুত্র’ রূপ। সৃষ্টির প্রথম সত্তা সেটি। তাই সৃষ্টিরই অন্যতম। তৃতীয়টি হচ্ছে ‘রুহুল কুদুস’ অর্থাৎ জ্ঞান বা বোধি সত্ত্বা।
ঈসায়ীদের বিশ্বাস ছিল, হযরত মসিহ ‘পুত্র’ রূপ ধারণ করে ধারায় এলেন। হযরত জিব্রাঈল (আঃ) যেভাবে মানুষের রূপ ধরে দুনিয়ায় আসেন, তেমনি তিন সত্তাই হযরত ঈসা (আঃ) এর রূপ ধরে প্রকাশ পেয়েছে। বস্তুত হযরত ঈসা (আঃ) ই আল্লাহ, আল্লাহর পুত্র এবং মানুষও। তাঁর ভেতরে ঐশ্বরিক ও মানবিক দুটি গুনই বর্তমান। তারা তাদের এ দাবীর সমর্থনে ইয়াহুদীদের বিভিন্ন আয়াত উদ্ধৃত করে থাকে। কারণ সে সব আয়াতে তাঁকে ‘পুত্র’ বলা হয়েছে এবং তিনি এমন সব কাজ নিজেই করেছেন বলে জাহির করেছেন, যেগুলো কেবল আল্লাহর জন্যেই নির্দিষ্ট।
জবাবঃ
প্রথম, যদি আমরা বর্তমান ইঞ্জীলকে যথাযথ ও অপরিবর্ত্নীয় বলে মেনে নেই, তথাপি তাতে যে ‘বতস’ সম্বোধন রয়েছে, তাতে আল্লাহর সোজাসুজি পুত্র বলে প্রমাণিত হয় না। কারণ প্রাচীনকালে প্রিয় আপনজনকে ‘বতস’ বলে সম্বোধন করার প্রচলন ছিল। সুতারাং এখানেও ‘বতস’ বলিতে তাই বুঝানো হয়েছে। ইয়াহুদীদের অন্যান্য আয়াতে এই ইঙ্গিত মেলে।
দ্বিতীয়ত, (তিনিও ঐশ্বরিক নিজেই কর্তা হওয়ায় বুঝা যায়, তিনিও ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী ও আল্লাহর পুত্র) হযরত ঈসা (আঃ) যে সব ঐশ্বরিক কাজের নিজেকে কর্তা বলেছেন, তা মূল ঘটনার বর্ণনা বৈ নয়। যেমন, কোন রাজদূত এসে খবর দেয়, “আমরা অমুক দেশ জ্য করেছি আর অমুক কিল্লার প্রতিটি ইট খসিয়ে ফেলেছি। ” আদতে এ সব কাজের মূল কর্তা হলেন রাজা এবং দূতের ক্ষমতা মুখপাত্রের ক্ষমতা মাত্র।
তাছাড়া এও হতে পারে, হযরত ঈসা (আঃ) এর ব্যাপারে ওহী নাযিলের ধারা এরূপ ছিল যে, ঐশ্বরিক সব সত্য ও সংবিধান তাঁরই ভেতরে আত্মপ্রকাশ করত। হযরত জিব্রাঈল (আঃ) মানুষরূপে আর ওহী নিয়ে আসতেন না। সুতারাং ওহী ধরণের সাথে সাথে হযরত ঈসা (আঃ)-এর কথাবার্তার ধরণ বদলে যেত! তিনি আল্লাহর হয়েই সব কথা বলতেন। আল্লাহর কাহকে নিজের কাজ বলেই প্রকাশ করতেন। এটা তো অত্যন্ত সহজ ও সুস্পষ্ট ব্যাপার।
কুরআনের মীমাংসাঃ
মোটকথা, কুরআন এসে ঈসায়ীদের এসব ভ্রান্ত ধারণার পূর্ণ নিরসন ঘটালো। কুরআন বলল, হযরত ঈসা (আঃ) আল্লাহর খাস বান্দা ও তাঁর আত্মা মাত্র। তাঁকে আল্লাহ হযরত মরিয়ম (আঃ)- এর উদরেই ঠাঁই দিলেন। আর রূহুল কুদুস অর্থাৎ হযরত জিব্রাঈল (আঃ)-এর মাধ্যমে তার আবির্ভাব সহায়তা করলেন। এছারা আরও কয়েকটি বৈশিষ্ট তাঁকে দেয়া হয়েছিল।
যদি ধরা হয়, আল্লাহ তাআলা স্বয়ং এরূপ এক আত্মরূপ ধারণ করেছিলেন, যা মূলত অন্য আত্মা থেকে পৃথক ছিল না আদৌ, এবং আমাদের সামনে তিনিই মানুষরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, তা হলে সামান্য চিন্তা করলেই পরিষ্কার হয়ে ধরা দেয় যে, তা নিতান্তই বাস্তব পরিপন্থী ব্যাপার। কারণ, সে অবস্থায় বান্দা আর মাবুদের সম্পর্ক স্থাপন করা চলে না। বরং সে সত্যটিকে ‘তাকভীম’ (প্রতিষ্ঠা) বা অনুরূপ শব্দ দ্বারা প্রকাশ করতে হয়। আর আল্লাহর শানে তা এমন অবমাননাকর ব্যাপার, যা থেকে তিনি অনেক উর্ধে রয়েছেন।
ঈসায়ীদের নমুনাঃ
যদি আপনারা এ সম্প্রদায়ের সঠিক নমুনা দেখচান, তা হলে অতীতের পূণ্যাত্মা ও আওলিয়াদের বংশধরদের দিকে লক্ষ্য করুন। দেখ্যুন তারা তাদের বাপ দাদাদের ক্কত রকমের খেতাব দিয়ে রেখেছে। সত্য বলতে কি, প্রকাশ্যে তো তাদের আল্লাহ বলছেন না। কিন্তু তাদের যে সব গুনাবলী ও ক্ষমতার দাবী তারা করে, তাতে কোন অংশেই তাদের আল্লাহ থেকে ছোট হতে দেয় না। শীঘ্রই এ জালিমরা ক্ররমফলে ভুগবে।
ইসায়ীদের এও একটা ভ্রান্ত ধারণা যে, হযরত ঈসা (আঃ) কে শুলি দেয়া হয়েছিল। অথচ এখানে তারা একটা ভ্রমের শিকার হয়েছিল এবং ঈসা (আঃ)-কে আকাশে তুলে নেয়ার ব্যাপারটিকে তারা হত্যা ভেবেছিল। যুগ যুগ ধরে তারা এ ভুলটি পোষণ করে আসছিল। কুরআন এসে তাদের এ ভুলটি ভেংগে দিল এবং জানিয়ে দিল, “ইয়াহুদীরা হযরত ঈসা (আঃ) কে হত্যা করেনি, শুলেও দেয়নি; বরং এ ব্যাপারে তারা ভ্রমে পড়েছিল। ”
আরেকটি ভ্রান্তির অপনোদনঃ
ইঞ্জিলে হযরত ঈসা (আঃ) কে শূলিতে চড়ানোর ব্যাপারে যে কথা স্বয়ং হযরত ঈসা (আঃ) এর নামে চালানো হয়, তার অর্থ এই নয় যে, সত্যিই তিনি নিহত হয়েছিলেন। বরং তা থেকে ইয়াহুদীদের এ নীচতার কথাই বুঝানো হয়েছে যে, তারা তাঁকে শূলিতে চড়িয়ে হত্যা করতে গিয়েছিল এটা স্বতন্ত্র কথা যে, আল্লাহ তাঁকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়েছেন।
এ ব্যাপারে ঈসা (আঃ) এর সহচর হাওয়ারীনদের যে বাণীর উদ্ধ্বৃতি দেয়া হয়, তার ভিত্তিও সন্দেহে ও ভ্রান্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত। আদতে কাউকে জীবিত অবস্থায় আকাশে তুলে নেয়া যায়, এটা বুঝবার ক্ষমতা তাদের ছিল না। কারণ এ ব্যাপারে আগে তারা কখনও দেখেনি শোনেওনি। তাই এর কল্পনাও তারা করতে পারত না। এয়ারা এ জন্যে হযরত ঈসা (আঃ) এর আকাশে ঊঠে যাওয়ার ব্যাপারটিকে হত্যাই ধরে নিয়েছিল।
ইঞ্জিলে যে ফরকালীতে আগমনজনিত সুসংবাদ রয়েছে, সে সম্পর্কেও ঈসায়ীরা ভ্রান্তির শিকার সেজেছে। তাদের বিশ্বাস এই, প্রতিশ্রুতি ফারকালীত মূলত হযরত ঈসা (আঃ)। নিহত হবার পরে তিনিই আবার হাওয়ারীনদের সাথে দেখা করার জন্যে ফিরে এসেছিলেন এবং তাদের পবিত্র ইঞ্জিলের অনুসারী থাকতে বলে গেছেন। তারা এও বলে, হযরত ঈসা (আঃ) ওসীয়ত করে গেছেন, ‘আমার পরে অনেক ভন্ড নবী আসবে। তাই যে ব্যক্তি এসে আমার কথা কলবে, তার কথা মেনে নিও আর যে আমার নামে তোমাদের ডাকবে না, তাকে আমল দিবে না। ’
কুরআন মাজীদ পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে, হযরত ঈসা (আঃ) এর ভবিষ্যদ্বাণীর ব্যক্তিটি হলেন আমাদেরই রাসূল (সঃ)। কিছুতেই তাতে হযরত ঈসা (আঃ) এর আত্মিক কিংবা দৈহিক পুনরাবির্ভাব বুঝায় না। কারণ ইঞ্জিলেও বলা হয়েছে, প্রতিশ্রুতি ফারকালীত কিছুকাল তোমাদের মাঝে থাকবেন এবং বিভিন্নরূপ শিক্ষা দান করবেন। মানুষের আত্মা ও চরিত্র সংশোধন করবেন। ভবিষ্যদ্বাণীতে যে বলা হয়েছে, তিনি এসে হযরত ঈসা (আঃ) এর নাম বল্বের, তার অর্থ এই যে, যে নবী আসবেন, তিনিও হযরত ঈসা (আঃ) র নবূওতের সত্যতা মেনে নিবেন। তার অর্থ এই নয় যে, ঈসা (আঃ) কে আল্লাহ কিংবা তাঁর পুত্র স্বীকার করবেন।
মুনাফিক ওতাদের মৌলিক বিশ্বাসঃ
যারা মুখে ইসলাম বলে অথচ মূলত মুসলমান নয়, তাদের বলা হয় মুনাফিক, তারা দু ধরনের। তাদের একদল ছিল, যারা মুখে ইসলামের কালেমা পাঠ করত, কিন্তু মনে প্রানে ছিল কাফির। অন্তরে তাদের যা ছিল, মুখে ঠিক তার বিপরীত বলত। তাদের সম্পর্কে কুরআন খবর দিয়েছে, ‘তারা জাহান্নামের নিম্নস্তরেই ঠাঁই পাবে। ’
কাজে মুনাফিকঃ
তাদের দ্বিতীয় দলটি বড়ই দুর্বল প্রকৃতি নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এরা মূলত বিশ্বাস ও অভ্যাসে নিজ সম্প্রদায়ের অনুগত ছিল। যখন গোটা সম্প্রদায় মুসলমান হল, তারাও মুসলমান হয়ে গেল। যদি তাদের সম্প্রদায় কাফির থাকত, তারাও তাই থাকত।
এ দলের ভিতরে তারাও শামিল ছিল, যারা দুনিয়ার সাধারণ সুখ সম্ভোগে ডেবে থাকাকে শ্রেয় ভাবত। দুনিয়ার মোহ তাদের এমন করে পেয়ে বসেছিল যে, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের ভালবাসা কক্ষনও তাদের অন্তরে ঠাঁই খুজে পেত না।
এ দলের ভেতরে এমন লোকও ছিল, যাদের অন্তরে লোভ লালসা, হিংসাদ্বেষ এরুপভাবে শিকড় গেড়ে বসেছিল যে, তার ইবাদত ও মুনাজাত থেকে আনন্দ আহরণের ক্ষমতাই হারিয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ ও তাদের ভিতরে তার কোন সম্পর্কই গড়ে ওঠতে পারেনি।
মিনাফিকদের ভেতর এরূপ ও একদল ছিল, যারা পার্থিব ব্যাপারে নিজিকে সর্বতোভাবে ডুবিয়ে রাখত। উপার্জন ও জীবিকা নিয়েই ব্যাস্ত থাকত। ফলে, পরকালের প্রস্তুতি নিয়ে ভাববার তাদের অবকাশই মিলতনা। যার ফলে মৌলিক বিশ্বাসের ব্যাপারে যথা, রাসূল (সঃ) সম্পর্কে ও তাদের ভেতরে নানা জল্পনা-কল্পনা ও সন্দেহ ঠাঁই নিত। কিন্তু তা এতদূর যেত না যে, ইসলাম থেকে বেরিয়ে গিয়ে খোলাখুলি বিরুদ্ধাচরণ করত।
মুনাফিকদের সন্দেহের কারণঃ
রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর নবূওতের ব্যাপারে মুনাফিকদের সন্দেহের কয়েকটি কারণ ছিল। সবচাইতে বড় কারণ ছিল, রাসূলও মানুষ ছিলেন। মানুষের মতই তাঁর নিত্য নৈমিত্তিক প্রয়োজন ও কার্যাদি ছিল। তাই সাধারণ মানুষ থেকে তাঁকে পৃথক করে দেখা তাদের জন্যে কঠিন চিল। তেমনি ইসলাম প্রচার, প্রসার ও ইসলামী রাজ্যের বিস্তার তাদের কাছে অন্যান্য রাজার রাজ্য বিস্তারের মতই মনে হত। তাই তারা এক রাসূলের শাসনক্ষমতা লাভ ও রাজ্য বিস্তারের সংগে এক বাদশাহ্র সিংহাসন লাভ ও রাজ্য বিস্তারের কোন পার্থক্য বুঝতে পারত না। রাসূল বলতে তারা বাদশাহর মতই একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তি ভাবত। তাই নবূওতের ওপরে তাদের বিশ্বাস দৃঢ় হবার বদলে সন্দেহই বেড়ে চলত।
মুনাফিকদের ভেতরে এরূপ একদল ছিল যে, মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তাদের কাফির আত্মীয় স্বজনদের মায়া ছাড়তে পারেনি। তাদের এ মায়া আত্মীয়-স্বজনদের সাহায্য করতে বাধ্য করত এবং তাদের উদ্দেশ্য সফল করে দিত। তারা এ কাজে ইসলামের কতটুকু ক্ষতি বৃদ্ধি হচ্ছে সে পরোয়া আদৌ করত না। পরন্তু তারা নিজ গোত্র ও আপনজনদের সাহাজ্য করতে গিয়ে জেনেশুনেই ইসলামের ক্ষতি সাধন করতে পিছপা হত না।
এ হিসেবে নেফাকী দু ধরনের ধরা যায়। প্রথম, মৌলিক বিশ্বাসে মুনাফিক, দ্বিতীয়, কার্যকালাপে মুনাফিক। রাসূল (সঃ) এর পরে মৌলিক বিশ্বাসে মুনাফিকদের চিনে বের করা মুশকিল। কারণ বিশ্বাসের ব্যাপারটি অদৃশ্য। অন্তরের খবর রাখা সম্ভবপর নয়। অবশ্য কার্যকলাপে মুনাফিকী সাধারণ ও ব্যাপক হয়ে ধরা দেয়। তাই খুব সহজেই সেটা চেনা যায়। আমাদের যুগে বিশেষত এ ধরণের মুনাফিক অসংখ্য।
রাসূল (সঃ) এক হাদীসে মূলত এ ধতনের মুনাফিকদের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ “তিনটি ব্যাপার এমন রয়েছে তা যাদের ভেতরে পাওয়া যাবে, তারা নিশ্চয় মুনাফিক। একটি হচ্ছে, কথা বললে মিথ্যা বলবে। দ্বিতীয়, ওয়াদা করলে খেলাফ করবে। তৃতীয়, তর্ক করলে গালিগালাজে নেমে যাবে। এরা বাহ্যত মুসলমান হলেও আসলে মুনাফিক। ” এই মর্মে আরও অনেক হাদীস রয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা কুরআন পাকে মুনাফিকদের চরিত্র ও কার্যকলাপের স্বরূপ তুলে ধরেছেন এবং মুনাফিকদের এ দু দল সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। বান্দারা যেন তাদের খবর তাখে এবং তাদের থেকে বেঁচে থাকে।
মুনাফিকের নমুনাঃ
এ যুগে যদি আপনি মুনাফিকের নমুনা দেখতে চান, তাহলে নেতা ও রাষ্ট্র নেতাদের মজলিশে যান। তাদের মোসাহেবদের তামাশা দেখুন। তারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির ওপরে নেতার সন্তুষ্টিকে স্থান দিতে ব্যস্ত থাকে। সত্য কথা তো এই, এ যুগে যারা আল্লাহর রাসূলের সব কথা জেনে শুনে মুনাফেকী করে এবং সে যুগে যারা হযরত (সঃ) এর ইচ্ছা অনিচ্ছা ও হুকুম আহকাম সরাসরি লাভ করে মুনাফিক হয়েছিল, এই দু দলের আদৌ পার্থক্য নেই।
এভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষারথীদের একটা দল রয়েছে যাদের অন্তরে নানারূপ অসংখ্য সন্দেহ পুঞ্জীভুত হয়ে ওঠে এবং পরকাল কে ভুলে রয়েছে। তারাও মুনাফিক থেকে কম নয়।
আমাদের করতব্যঃ
মুনাফিকদের এসব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আপনাদের করতব্য হচ্ছে এই, যখনই কুরআন পাঠ করতে বসবেন তখন কিছুতেই এ কথা ভাববেন না যে, এসব বিশেষ কালের কোন এক সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বলা হয়েছিল এবং রখন তাদের বিলোপ ঘটেছে। আল্লাহর রাসূলের এ হাদীস সামনে রাখবেন, “তোমরাও অতীতের জাতিগুলোকে অনুসরণ করে চলবে। ” নিশ্চিত বিশ্বাস রাখুন, পৃথিবীতে আজ এমন কোন অনাসৃষ্টি নেই, যার নমুনা আগে অবর্তমান ছিল। সুতারাং কাল যে কথা বলা হয়েছিল, তার সত্যতা আজও যথাযথ ভাবে বিদ্যমান রয়েছে। তাই কুরআনের আসল উদ্দেশ্য হল, দূর্ঘটনার মৌলিক কারন বলে দেয়া। তা না হলে বর্ণোনার বারংবার পুনরাবৃত্তির কোনই সার্থকতা নেই।
সে যা হোক, ওপরে চারটি বিভ্রান্ত দল যথাঃ মুশরিক, ইয়াহুদী ঈসায়ী ও মুনাফিকদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দান ও তাদের বিশ্বাসগুলোর যথাসম্ভব জবাব দান করা হল। এর ফলে ইনশাআল্লাহ ‘মুখাসামার আয়াতগুলি বুঝতে খুবই সুবিধা হবে।