তৃতীয় পরিচ্ছেদঃ পঞ্চ হলমের আয়াত এর পুনরাবৃত্তির কল্যাণকর দিক
কুরআনের রীতিতে একটি লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে এই, তাতে একই মর্মের আয়াতের বারংবার বিভিন্ন স্থানে পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয়েছে। তা যে বিশেষ কোন ব্যাপারে তা নয় প্রায় সব ব্যাপারেই ঘটেছে। অধিকাংশ লোকের মনে এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, এরূপ করা হল কেন? একটা ব্যাপার এক স্থানে বলেই শেষ করা হল না কেন?
মূলত, এর ভেতরে বড় রকমের কলা কৌশল ও কল্যাণকর ব্যাপার নিহিত রয়েছে। যেমন, আমরা যদি কাউকে কিছু শেখাতে বা বোঝাতে চাই, তার জন্যে দু’টি পথই হতে পারে। একটি পথ এই, যদি আমার বলার উদ্দেশ্য শুধু শ্রোতাকে একটি নতুন খবর শুনিয়ে দেয়াই হয়, তাহলে কেবল একবার তাকে তা বলেই শেষ করব। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য যদি হয় এই যে, একটি বিষয় শ্রোতার মাথায় এমনভাবে ঢুকিয়ে দেব, যেন সে তার সারবত্তা ও সৌন্দর্য বুঝতে পারে এবং তার গোটা চিন্তাধারা সেই রঙে রংগিযে ওঠে, আর তার সব কার্যকলাপ তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে বারংবার বুঝিয়ে বলা ছাড়া পথ নেই।
একটা ভাল কবিতার কথা ধরুন। আমরা কবিতাটি একবার শুনি। তার মর্ম, জানতে পারি। তা থেকে রস গ্রহণ করি। তথাপি বারংবার সেটা শুনতে চাই আর প্রত্যেকবারই নতুনভাবে স্বাদ পাই। এতেই বুঝা যায় পুনরাবৃত্তি আনন্দও দেয়। মন ও মগজে তার ঘর বেঁধে দেয়। কুরআনেও পুনরাবৃত্তির দ্বারা এ লক্ষ্য অর্জন করা হয়েছে।
মূলত, কুরআন অবতীর্ণের উদ্দেশ্য ছিল দু’টি। কিছু ব্যাপার এমন রয়েছে, সেগুলো শুধু জানিয়ে দেয়াই যথেষ্ট মনে করা হয়েছে। আবার কিছু ব্যাপার এমনও আছে, যেগুলো মন ও মগজে বসিয়ে দেয়াই উদ্দেশ্য ছিল। তাই প্রথমোক্ত ব্যাপারগুলো একবার বলেই শেষ করা হয়েছে। শেষোক্ত ব্যাপারগুলো বারংবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হয়েছে। যে সব বিধি বিধানের আয়াতের পুনরুল্লেখ ঘটেনি, সেগুলো শুধু জানিয়ে দেয়াই লক্ষ্য ছিল। মন ও মগজে স্থায়ীভাবে এঁকে দেয়া উদ্দেশ্য ছিল না। অবশ্য এটা আলাদা কথা যে, শরীয়ত সেগুলোও একবার মাত্র পড়ে বুঝে নেয়াকেই যথেষ্ট মনে করে না। বরংবার পাঠের নির্দেশ দেয়।
কুরআনের একই ব্যাপারে পুনরাবৃত্তি ঘটলেও একই বাক্যের যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেদিকে যথেষ্ট খেয়াল রাখা হয়েছে। বস্তুত প্রতিবারেই নয়া বাক্য নতুন রীতিতে উত্থাপন করা হয়েছে, যেন তাতে আকর্ষণ বাড়ে এবং মানব প্রকৃতি একঘেঁয়েমি অনুভব না করে। একই বাক্য যদি বারংবার বলা হত, তাহলে তাতে স্বভাব এরূপ অভ্যস্ত হয়ে পড়ত যে, কোন আকর্ষণ খুঁজে পেত না। কিন্তু বাক্যের রূপ ও ধরন ধারণ বদলে যাওয়ায় প্রত্যেকবারই স্বভাব নতুন আকর্ষণ লাভ করে। ফলে মন সেদিকে বারংবার নিবিষ্ট হয় এবং কথাটি পুরোমাত্রায় অন্তরে ঠাঁই করে নেয়।
মর্ম বিক্ষিপ্তকরণ
এখানে আরেকটি প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, একই সুরার ভেতরে সব ব্যাপারগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে কেন? কেন সে গুলো ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হয়নি। মানে, শুরুতে আল্লাহর নিদর্শন ও প্রশংসা বর্ণনা করতঃ তারপর ঘটনাগুলোর উল্লেখ করা হত। এরপর অবিশ্বাসীদের সাথে যুক্তি তর্কের অবতারণা করা হত। এভঅওেব সবগুলো একের পর এক করে সাজানো হত।
এ প্রশ্ন যথাযথ বটে। এটাও ঠিক যে, আল্লাহর জন্যে করাও কঠিন ছিল না। তিনি চাইলে সবই ধারাবাহিকভাবে বলতে পারতেন। তবে এ কথাও সত্য যে, আল্লাহর সব কিছু ভেতরে কোন না কোন কলা কৌশল ও মংগলময় উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। আর সেটা তারাই বুঝতে পারে, যাদের নিকটে রসূল আসে আর যাদের কাছে এ বাণী পাঠানো হয়। কুরআন যেহেতু রসূলে আরবী (স) এর ওপরে অবতীর্ণ হযেছে, আর আরববাসীর কাছে পৌঁছেছে, তাই তাদের ভাষা ও বর্ণনারীতি সামনে রেখেই তা রচিত হয়েছে, যেন তাদের প্রকৃতি তথা মন মগজের সাথে পুরোপুরি খাপ খায়। কুরআনের আয়াত ‘লাওলা ফুচ্ছেলাত আয়াতুহূ আ’জমীউন ওয়া আরাবীয়্যূন’ ঠিক এ স্যত্যটির দিকেই ইংগিত করা হয়েছে।
মূলকথা হচ্ছে এই, কুরআন অবতীর্ণের সময়ে আরববাসীর কছে ঐশী কিংবা মানবীয় কান গ্রন্থই ছিল না। আজ আরব সাহিত্যিকরা যে ধারাবাহিকতা ও রীতি নীতির ওপরে জোর দিচ্ছে, সে যুগের আরবদের কাছে তা ছিল অপরিজ্ঞাত। যে সব করি ইসলামের যুগে ছিল না, তাদের লেখা কিংবা হযরত (স) ও হযরত উমর (রা) এর চিঠি যদি অধ্যায়ন করা হয়, তাহলে এ সত্য আপনা থেকেই ধরা দেয়।
তাই কুরআনের ঘটনা বিন্যাসের ব্যাপারে যদি তৎকালীন আরবদের অজানা কোন পন্থা অনুসরণ করা হত, তা শুনে তারা হতভম্ব হয়ে যেত। ফলে তাদের বুদ্ধি এরূপ বিপর্যস্ত হত যে, সরল সহজ কথা বুঝতেও তাদের অসুবিধা হত। অথচ কুরআন তো শুধু তাদের কিছু জানিয়েই ক্ষান্ত হবার ছিল না; পরন্তু তাদের মন ও মগজে তার কথাগুলো বসিযে দেয়াই উদ্দেশ্য ছিল। আর সে উদ্দেশ্য সাজানো গুঝানো কথার চাইতে আকস্মিক কথা দ্বারাই বেশী সফল হবার ছিল। নাটকীয় বর্ণনাই শ্রোতার বিচ্তকে অধিকতর আকৃষ্ট করে বলেই কুরআন সে পথ বেছে নিয়েছে।