চতুর্থ পরিচ্ছেদঃ কুরআনের অনন্যতা ও বিস্ময়কর দিক
যদি প্রশ্ন করা হয়, কুরআনে ওজন ও কাফিয়াই যখন অনুসরণ করা হল, তখন আরবের কবিত সমাজে প্রচলিত রীতি অনুসরণ করল না কেন? তাতো কুরআনের বর্ণনার রীতির চাইতে বেশী আকর্ষণীয় ছিল। জবাব হচ্ছে এই, আকর্ষণটা আপেক্ষিপ ব্যাপার। দেশ ও জাতির পার্থক্যে তাতেও পার্থক্য দেখা দেয়। আর প্রশ্নকারীর কথা সত্যতা মেনেও বলা চলে, হযরত (স) নিরক্ষর বলে খ্যাত ছিলেন। সেখানে আরবী সাহিত্যে সম্পূর্ণ এক নয়া রীতি আমদানী করা তাঁর জন্যে যেমনি বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল, তেমনি তাঁর নবূওতেরও একটা উজ্জ্বল প্রমাণ ছিল। পক্ষান্তরে যদি কুরআন আরব কবিদের অনুসুরণ করত, তাহলে কবিদের কাজ্যে ও কুরআনে আরববাসী কোন পার্থক্য সৃষ্টি করত না। ফলে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যের অভাবে কুরআন তাদের প্রভাবিত করতে পারত না।
তাই দেখতে পাই, উঁচু দরের সাহিত্যক আলংকরিত সমসাময়িকদের ওপরে কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বিস্তরের জন্যে সম্পূর্ণ নয়া পথ গড়ে নেন। আর দাবী করেন, এ রীতিতে কেউ লিখতে পারে না। বস্তুত সবাই তার অনন্যতা স্বীকার করে নেয়। সহজেই তার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেয়। পক্ষান্তরে যদি প্রাচীন প্রচলিত রীতিতে কিছু লিখৈ এরূপ দাবী করে, তাহলে দু’ একজন সূক্ষ্ম সমালোচক ভিন্ন কেউ তার দাবীর সারবতা সহজে উপলব্ধি করে না। তাই তার শ্রেষ্ঠত্বও সহজে মেনে নেয় না। ঠিক এ রহস্যটিই কুরআনে পথনির্দেশ করেছে। তাই কুরআন সম্পূর্ণ এক নতুন পথ আবিষ্কার করে তার শ্রেষ্ঠত্বের সামনে সকলকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করেছে।
কুরআনের বিস্ময়কর দিক
যদি প্রশ্ন করা হয়, কুরআন বিস্ময়কর হল কি করে? জবাবে বলব, বিভিন্ন কারণে।
১। একটা হচ্ছে, কুরআনের অনন্য ও বিশিষ্ট রচনা রীতি। আরবরা বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের প্রতিভার দাপট দেখাত। আর সেগুলোতেই তারা শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা চালাত। তা ছিল কবিতা, বক্তৃতা, পত্রাবলী ও বাক ধারার ক্ষেত্র। এ চারটি ছাড়া তাদের অন্য পথ ছিল না। নতুন পথ রচনারও শক্তি ছিল না। ঠিক সে অবস্থায় আরবে নিরক্ষর নামে খ্যাত হযরত মুহাম্মদ (স) সম্পূর্ণ এক নয়া রচনা রীতি আবিষ্কার করে দিযে অবশ্যই বিস্ময়ের সঞ্চার করেছেন।
২। তারপর বিনা লেখাপড়ার আগে কোন জানাশোনা ছাড়াই অতীতের জাতিগুলোর সঠিক বিধি বিধান ও তাদের সর্বজন স্বীকৃত অবস্থার বর্ণনা করা কি আশ্চ৮৮৮র ব্যার নয়?
৩। তেমনি ভবিষ্যতে কি হবে না হবে, সে সম্পর্কে অক্ষরে অক্ষরে সঠিক খবর দেয়া বিস্ময়কর নয় কি? শুধু বিস্ময়কর নয়; বরং বিস্ময়ের এটা ধারাবাহিক ব্যবস্থা বটে। যাতে করে যুগে যুগে সে সব ভবিষ্যদ্বাণীর সফলতা দেখে মানুষ বিস্ময় অর্জন করে চলে।
৪। তাছাড়া কুরানের আলংকারিক শ্রেষ্ঠত্বও এটা পরম বিস্ময়। এ শ্রেষ্ঠত্ব এমন যে, কোন মানুষ তার নাগাল পায় না। আমরা যেহেতু আরবী ভাষা ও সাহিত্যের আদি পর্ব থেকে অনেক পরে এসেছি, তাই আরবী ভাষার সৌন্দর্য সম্পর্কে আমাদের ধারণা কম। ফলে আমরা না তার গভীরতায় পৌছতে পারি, না তার মূল্যায়ন আমাদের দ্বারা সম্ভব। অবশ্য এতটুকু বলা চলে যে, কুরআনের মত এতখানি উন্নয়ন ও চিত্তাকর্যক বাকবিন্যাস ও শব্দের এরূপ স্বতঃস্ফূর্ত ও অবাধ প্রয়োগ প্রাচীন ও নবীন আরবী সাহিত্য রসিকই উপলব্ধি করতে পারেন। সে জন্যে যতখানি সূক্ষ্ম রসবোধ ও সুস্থ সাহিত্য রসিকই উপলব্ধি করতে পারেন। সে জন্যে যতখানি সূক্ষ্ম রসবোধ ও সুস্থ বিচার শক্তি থাকা দরকার, তা উঁচুদরের কবি সাহিত্যিক ছাড়া কারুর ভেতরে থাকে না।
কুরআনের আকেরটি বিস্ময় দিক হল এই, যদিও তার বর্ণনা রীতি ও প্রকাশ ভংগী প্রতি মুহূর্তে গতিশীল, পরিবর্তনশীল, তথঅপি তার নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত রীতিতেই কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। বস্তুত কুরআনের মর্ম নিদর্শন ও অবদান সংশ্লিষ্ট হোক, কিংবা ঘটনা বা বিতর্কমূলক হোক, কখনও গতানুগতিক বর্ণনা একাধিক স্থানে ব্যবহৃত হয়নি। একটি ব্যাপারে যতবারই বলা হয়েছে, আলাদা রূপ দিয়ে নতুন ভংগীতে বলা হযেছে। প্রত্যেক স্থানেই বর্ণনার অনন্য সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রয়েছে। সেখানে কারুর হাত দেবারই কল্পনা অচল।
এ আলোচনাও যদি কারুর সত্য উপলব্ধির সহায়ক না হয়, তাহলে সে যেন সূরা আরাফ, সূরা হুদ ও সূরা শূরার যে সব জায়গায় আগেকার নবীদের অবস্থা ও ঘটনাবলী বর্ণনা করা হয়েছে, সেগুলো দেখে নেয়। তারপর তার সূরা ‘সাফ্ফাত’ এর কাহিনীগুলো এবং সূরা ‘যারিয়াত’ পড়ে দেখা উচিত। এভাবে যখন সে এক ব্যাপারকে বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখবে, কখনই তার কাছে মূল সত্যটি সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে।
তেমনি যেখানে পাপীর শাস্তি পূণ্রবানের পুরস্কারের উল্লেখ রয়েছে, সেখানেও সম্পর্ণ নতুন নতুন ভংগীতে বর্ণনা করা হয়েছে। জাহান্নামীদের সাথে যে সব জায়গায় বিতর্ক ও বাদানুবাদের উল্লেখ রয়েছে, সে সব জায়গায়ও নতুন নতুন বর্ণনা রীতি অনুসরণ করা হয়েছে। যে যা হোক, এ ধরনের উদাহরণ দু’একটাই নয় বরং গোটা কুরআেই এতে ভরপুর রয়েছে। তা আলোচনা সময় সাপেক্ষ।
অলংকার প্রয়োগ:
কুরআনে অনাড়ম্বর সাড়ম্বর দু’ধরনের বর্ণনাই বিদ্যমান। যেখানে যেরূপ প্রযৈাজন দেখা দিয়েছে, তাই করা হয়েছে। এরূপ ব্যবহারের বিস্তারিত তথ্য জানতে হলে অলংকারশাস্ত্র পড়া দরকার। রূপক বাক্য কিংবা ইংগিতময় বাক্য সম্পর্কে জানতে হলেও সেটা দেখা দরকার। কুরআন তার শ্রোতাদের অযোগ্যতা ও অলংকারশাস্ত্রে অজ্ঞতা সম্পর্কে অবহিত থেকেও এরূপ আশ্চর্য সতর্কতার সাথে সে সব অনুসরণ করেছে যে, সব ধরনের লোকই তা সমানভাবে গ্রহণ করতে পেরেছে। এভাবে সব দিক সমানে রক্ষা এরূপ অনুপম রচনা সৃষ্টি সত্যিই বিস্ময়কর বটে।
(আরবী***************)
উপসংহার
মোটকথা, এর এসব দিক ছাড়াও আরেকটি বিস্ময়কর দিক রয়েছে, যা শরীয়তরে গূঢ় রহস্য সম্পর্কে যারা অনবহিত, যাদের পক্ষে বুঝা সহজ নয়। তা হচ্ছে স্বয়ং কুরআনের সামগ্রিক রূপ ও তার বর্ণিত মর্মগুলো। তার ব্যাপ্তি, গভীরতা, সার্বজনীনতা ও অকাট্যতা-সব কিছুই তার শ্রেষ্ঠত্বের বড় দলীল। আর এগুলোই প্রমাণ করে, কুরআন বান্দার পথ প্রদর্শনের জন্যে আল্লাহর অবতীর্ণ গ্রন্থ বৈ নয়।
কোন বিদ্যাবিশারদ এবং বিজ্ঞ ডাক্তার যখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিখ্যাত কোন গ্রন্থ অধ্যায়ন করেন, আর তাতে রোগের কারণ ও লক্ষ্য সম্পর্কে বিজ্ঞতাপূর্ণ বিশ্লেষণ দেখতে পান এবং ঔষধের বর্ণনা ও তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত আলোচনার ওপরে নজর ফেলেন, তখন তিনি এ সিদ্ধান্তে পৌছতে বাধ্য হন যে, এ গ্রন্থ রচয়িতা একজন বিচক্ষণ ডাক্তার চিকিৎসা-বিজ্ঞানী। পক্ষান্তরে, একজন সাধারণ লোক তা দেখে কিছুই অনুমান করতে পারে না।
কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝার অবস্থাটি ঠিক তেমনি ব্যাপার। তত্ত্বোপলব্ধির ক্ষমতা নেই এমন সাধারণ স্তরের কেউ কখনো কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝতে পারে না। পক্ষান্তরে, শরীয়ত তথা বিধি-বিধঅনের রহস্যে অভিজ্ঞ ব্যক্তি যেহেতু ব্যক্তি ও সমাজ সংস্কারের জন্যে কতটুকু কিসের প্রয়োজন তা জানে, তাই তখন সে কুরআনের অধ্যয়ন করে সংগে সংগে বুঝে ফেলে যে, এ সবের মর্ম অভিজ্ঞানের সেই উচ্চতম শীর্ষে প্রতিষ্ঠিত, যেখানে মানুষের প্রবেশাধিকার নেই আদৌ। সুতরাং সে কুরআনের বিস্ময়কর শক্তি ও তার আল্লাহর বাণী হওয়ার ব্যাপারটি স্বতঃস্ফূত ভাবে মেনে নিতে বাধ্য হয়।
(আরবী***************)