চতুর্থ অধ্যায়ঃ তাফসীর শাস্ত্রের পদ্ধতি ও সাহাবা তাবেঈনের বিরোধ মীমাংসা
কুরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তাফসীরকাররা পদ্ধতির দিক থেকে কয়েক দলে ভাগ হয়ে পড়েছেন।
একদল হচ্ছেন, “মুহাদ্দিস-মুফাসসির”। তাঁরা আয়াতের অর্থ ও তাৎপর্য খুজতে সে ধরনের যত ঘটনা থাকতে পারে, সবই বিনা বিচারে জড়ো করা প্রয়োজন ভাবেন-হোক তা সসুত্র বা সুত্রহীন হাদীস, কিংবা তাবেঈ বর্ণিত অপ্রাসংগিক ঘটনা অথবা ইয়াহুদী বর্ণিত এমন সব ঘটনা, যার সত্যাসত্য নির্ণয়ের কোন ভিত্তিই নেই।
২। দ্বিতীয় দল হচ্ছেন, “মুতাকাল্লেমীন-মুফাসসির’। আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ব্যাখ্যা দান তাঁরা প্রয়োজনীয় ভাবেন। অবশ্য তাঁরা তত্ত্ব পর্যন্ত যেতে রাজী নন, আল্লাহর অমর্যাদা হয় ভেবে। তাফসীরেও তাঁরা এ নীতি বহাল রেখেছেন। মানে, যে আয়াতের সাধারণ অর্থ আল্লাহর অমর্যাদাকর ভেবেছেন, ব্যাখ্যা ঘুরিয়ে নিয়েছেন, আর যারা সেই সোজা অর্থ করে গেছেন, তাঁদের সমালোচনা করেছেন।
৩। তৃতীয় দল হচ্ছেন, “ফকীহ-মুফাসসির”। এদের ব্যাখ্যা পদ্ধতি হল এই, আয়াত থেকে তাঁরা হুকুম আহ্কাম খুঁজে বের করবেন। আার সে ব্যাপারে যে যেই সিদ্ধান্তে পৌঁছবেন, তার সপক্ষে ও তা থেকে আর যে যা করেছে বা করতে পারে, তার বিপক্ষে যুক্তি প্রমাণ জড়ো করে যাবেন।
৪। চতুর্থ দল হচ্ছেন, “লোগাতী-মুফাসসির”। তাঁদের রীতি হচ্ছে, কুরআনের ব্যাকরণ ও ভাষাতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা। তাঁরা যে আয়াত সম্পর্কে যে মত গ্রহণ করবেন, তার সমর্থনে আরবী ভাষা ও সাহিত্যে যত উদাহরণ থাকতে পারে, সব জড়ো করেন। তার আবশ্যকতা আদৌ আর না-ই থঅকে।
৫। পঞ্চম দল হচ্ছেন, “আদবী-মুফাসসির”। তাঁদের কাজ হচ্ছে, কুরআনে অলংকার ও সমালোচনা শাস্ত্রের মানদন্ডে কোথায় কোকন রহস্য লূকিয়ে আছে, তা খুজে বের করা। সে সবকে যতভাবে যতখানি খুলে মেলে জোরালো করে তুলে ধরা যায়, তার প্রাণান্ত সাধনা করছেন তাঁরা।
৬। ষষ্ঠ দল হচ্ছেন, “কারী-মুফাসসির”। কুরআনের নানা ধরনের কিরাত বা পাঠদানরীতি নিয়েই তাঁদের মাথা-ব্যাথা বেশী। বস্তুত, তাঁরা কেবল এ বিষয়ের বিভিন্ন উস্তাদদের থেকে বর্ণিত কিরাতই উদ্ধৃত করেন। অবশ্য বিভিন্ন পঠনরীতি সুক্ষ্মাতি সুক্ষ্ম ব্যাপার নিয়ে হাংগামা সৃষ্টিও বৈধ মনে করেন না।
৭। সপ্তম হচ্ছেন, “সূফী-মুফাসসির”। সূফীরা কুরআনের আদ্যাত্মিক ও চারিত্রিক সূত্রগুলোর খোঁজে ব্যস্ত থাকেন। যেখানেই এ ধরনের কিছু দেখতে পান, সেটুকু ব্যাখ্যা করাই তাদের কাছে তাফসীরকারের একমাত্র দায়িত্ব বিবেচিত।
সারকথা, ব্যাখ্যা-শাস্ত্রের মাঠটি বড়ই প্রশস্ত। প্রত্যেক মুসলিম কুরআন বুঝা ও তা নিয়ে গবেষণা করা ফরয মনে করে। তাই ব্যাখ্যাকারের সংখ্যা সংখ্যা নগণ্য হবার নয়। অথচ এরা একভাবে কুরআন বুঝা বা বুঝবার চেষ্টা না করে যার যা মনে এসেছে প্রত্যেকে আলাদা পথ বেছে নয়েছে। আর নিজ প্রতিভা ও পান্ডিত্যের চূড়ান্তি রূপ ফলাও করার প্রয়াস পেয়েছে। নিজ মত ও মবলম্বীদের সহায়তাকে অন্যতম কর্ব্য ভেবেছে। এভাবে এ শাস্ত্রে এত প্রশস্ততা দেখা দিলে যা বলে শেষ করা যায় না। এমনকি তাফসীর গ্রন্ঞে যদি সব গণ্য করা হয়, তা হলে স্বীকার করতে হয় যে, তা গুণেও শেষ করা কঠিন।
জামে তাফসীর:
কিছুলোক এসব তাফসীর গ্রন্থ একত্র করার চেষ্টা করেছেন। কেউ তা আরবীতে লিখেছেন, কেউ আবার ফার্সীতে। কেউ সংক্ষেপে লিখেছেন, কেউ আবর বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। এতেও তাফসীরের সংখ্যা বেড়ে গেছে। আল্লাহ আমাকে কুরআন ব্যাখ্যার বড়রক বুঝ দান করেছেন।
আমার সামনে এর সবগুলো গ্রন্থই রয়েছে। শুধু তাই নয়, এ সবের মূলনীতি ও কর্মপন্থাও আমার জানা রয়েছে। আমি স্বাধীনভাবে এগুলো নিয়ে অধ্যায়ন ও গবেষণা চালিয়েছি। এ সব তাফসীরের অধ্যায়ন ও গবেষণা আমাকে এ শাস্ত্রের একজন গবেষক ও বিশারদের মর্যাদা দিয়েছে।
এখন পর্যন্ত যে সব তাফসীরকারদের কথা বলছি, তা বর্ণনার সূত্র ধরে আমার কাছে পৌঁছেছে। এ ছাড়া প্রত্যক্ষবাবেও কিছু তাফসীরের জ্ঞান আমি লাভ করছি। সত্য বলতে কি এ শাস্ত্রে আমি মূল থেকেই প্রেরণা লাভ করেছি। আর তা এরূপ এক সৌভাগ্যের ব্যাপারে, যার কৃতজ্ঞতা আদায় করে শেষ করা মানুষের সাধ্যাতীত ব্যাপার। তাই এ পুস্তকে তাফসীরের বিভিন্ন ধরন ও তদ্সংশ্লিষ্ট ব্যাপারগুলোর ওপরে কিছু আলোচনা করা দরকার মনে করি।