তৃতীয় পরিচ্ছেদঃ শানে নুযূল
কুরআন বুঝার ও তাফসীর করার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় মুশকিল বিষয় হল, ‘শানে- নুযূল’ সমম্পর্কি জ্ঞান। অর্থাৎ সঠিকভাবে কোন্ আয়াত কখন কি ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে, তা অবহিত থাকা। এখানেও সমস্যা হল এই শানে নুযূল বর্ণনার ক্ষেত্রে যে পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, সে সম্পর্কে পূর্ববর্তী (মুতাকাদ্দিমীন) ও পরবর্তীদের (মুতাআখ্খিরীন) ভেতরে মতানৈক্য সৃষ্টি হযেছে।
শানে নুযূল বর্ণনা করতে গিয়ে ‘নুযিলাত ফী কাযা’- (এ ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে) এরূপ বলা হয়। কিন্তু সাহাবা ও তাবেঈনদের সব ব্যক্তব্য যাচাই করলে জানা যায়, তাঁদের ভেতরে এরূপ কথা অন্য ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হত। অর্থাৎ এরূপ পরিভাষা যে কোন্ব্ উপলক্ষে হযরত )সঃ)-এর সময়ে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল, সে জন্যেই ব্যবহার করতেন না। উপরন্তু সে যুগে এ আয়াত দ্বারা যা কিছু বুঝানো হয়েছে, সব কিছুর জন্যে তাঁরা এরূপ পরিভাষা ব্যবহার করতেন। তা রাসূল (সঃ)-এর যুগেরই হোক কিংবা পরবর্তীকালের। এরূপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে তারা আয়াতের সব শর্তের সাথে সে ব্যাপারের সামঞ্জস্য অপরিহার্য ভাবতেন না। বরং আয়াতের হুকুম যে যে বস্তুর ব্যাপারে প্রযোজ্য হত, সবখানেই ব্যবহার করতেন।
তাছাড়া এরূপও ঘটেছে যে, রসূল (সঃ)-এর কাছে কখনও কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, কিংবা তার পবিত্র জীবনকালে কোন বিশেষ ঘটনা ঘটেছে, সে ব্যাপারে তিনি কুরআনের কোন আয়াত থেকে কোন হুকুম বের করে সংগে সংগে সে আয়াতটি পড়ে শুনালেন। সাহাবারা এরূপ ক্ষেত্রেও অনুরূপ পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। সে আয়াত সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাঁরা সেরূপ ঘটনা বিবৃত করে পরে বলতেন ‘নুযিলাত ফী কাযা’।
এমনকি তাঁরা এরূপ স্থলে ‘নুযিলাত ফী কাজা’ ছাড়াও অন্যরূপ বাক্যাংশ যেমন “ফা-আনযালাল্লাহু তা’আলা কওলাহু (তখনই আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করলেন) কিংবা ‘ফা-নাযালাত’ (তখনই অবতীর্ণ হল) ইত্যাদি ব্যবহার করতেন। এসবের দ্বারা তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল এই যে, রসূল (সঃ) এসব ব্যাপারে এ আয়াত থেকে মাসআলা বের করেছেন।
এছাড়া এও সম্ভব যে, তাঁরা যে যে স্থানে এরূপ ব্যবহার করতেন, হয়তো তাঁরা তা যথার্থ অর্থেই ব্যবহার করতেন। কারণ রসূল (সঃ)-এর কোন আয়াত থেকে হুকুম বের করা কিংবা কোন ব্যাপারে তাঁর খেয়াল কোন আয়াতের দিকে আকৃষ্ট হওয়া মূলত আল্লাহ্র ইংগিতেই হত। আল্লাহর ইংগিতও তো এক প্রকার ওহী। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সবখানেই অনুরূপ ভাষা ব্যবহার সব দিক থেকেই যথাযথ হয়েছে।
এরূপ ক্ষেত্রে কেউ যদি বলে যে, যেসব ব্যাপারে হযরত (সঃ) যে যে আয়াত পাঠ করেছেন, মূলত আল্লাহর তরফ থেকেই সে সব নাযিল হয়েছিল, তাও সঠিক মানতে হবে। আদতে কারণ যাই দেখান হোক না কেন, এ কথা সত্য যে, সাহাবারা ‘নূযিলাত ফী কাযা’ বাক্যাংশটি নাযিলের মূল ঘটনাটি ছাড়া অন্যক্ষেত্রেও ব্যবহার করতেন।
মুহাদ্দিসদের ধারা:
মুহাদ্দিসরা কুরআনের আয়াতের আলোচনা প্রসংগে এরূপ বহু কিছু ব্যাপার বর্ণনা করেন, যা শানে নুযুলের ভেতর শামিল নয়। যেমন, কোন কোনস সময়ে সাহাবারা পারস্পরিক বাদানুবাদ প্রমাণ হিসেবে কুরআনের আয়াত পেশ করতেন। কখনও তাঁরা উদাহরণ স্বরূপ কোন আয়াতের উল্লেখ করতেন। কিংবা নিজ দাবী উল্লেখ করতেন। কখনও সে আয়াত সংশ্লিষ্ট কোন হাদীসের সাথে উল্লেখ করতেন। মুহাদ্দিসরা এ সবকিছুই সে আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে বর্ণনা করে থাকেন। আর তার পেছনে কখও নাযিলের স্থান বলা হয়, কখনও অনিদিষ্টভাবে তাদের দিকে ইংগিত করা হয়, যাদের ব্যাপারে আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে। আবার কখনও কুরআনের শব্দগুলোর বিশুদ্ধ উচ্চারণ বের করা হয়, কোন সমযে সূরা ও আয়াতের ভেতরে সম্পর্ক স্থাপন করা হয়, আবার কখনও কুরআনের কোন হুকুমের ব্যাপারে রসূল (সঃ) কিভাবে কাজ নিতেন, তা বলে দেয়াই উদ্দেশ্য থাকত।
তাফসীরকারদের দায়িত্ব:
মুহাদ্দিসরা কোন আয়াত সম্পর্কে যা কিছু বর্ণনা করেন, তা একে তো শানে নুযুলের সাথে কোন সম্পর্ক রাখে না, তদুপরি তাফসীরকারদের জন্যে তা আলোচনা করা জরুরীও নয়্ তাফসীরকারীদের জন্যে শুধু দু’টি ব্যাপারে জ্ঞান থাকা দরকার একটি হল, আয়াত যে ঘটনার দিকে ইংগিত দেয়, তা জানা। কারণ তা না জেনে আয়াতের সঠিক অর্থ অনুধাবন সম্ভব নয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, যে ঘটনার জন্যে কোন সাধারণ হুকুম বিশেষ রূপ নিয়েছে, সেটি জানা। অর্থাৎ যে ঘটনার কারণে আয়াতের বাহ্যিক অর্থ ঘরে অন্য অর্থ প্রকাশ পায় তা না জেনে আয়াতের সঠিক মর্ম নির্ণয় করা অসম্ভব। এ দু’ধরনের ঘটনা ছাড়া আর সব ব্যাপার জানা তাফসীরকারের জন্যে প্রয়োজনীয় নয়।
এ প্রসঙ্গে অতীতের নবীদের কাহিনী ও ঘটনাবলী এসে যায়। কারণ অধিকাংশ কাহিনী অস্পষ্ট ও অনাবশ্যক। এ জন্যে তাঁদের কাহিনী হাদীসেও কম বর্ণিত হয়েছে। তাফসীরকারগন তাঁদের যে লম্বা-চওড়া কাহিনী বর্ণনা করেন, তা হাদীসের বদলে আহলে কিতাব আলেমদের থেকে পেয়ে থাকেন। এগুলে সম্পর্কে সহীহ্ বুখারীর এক রেওয়াতে আমাদের উপদেশ দেয়া হযেছে: আমরা সেগুলো সত্য বা মিথ্যা কিছুই বলবনা। এতে পরিষ্কার বুঝায়, সেগুলোর উপরে আমাদের গুরুত্ব না দেয়াই উচিত।
এছাড়া সাহাবী ও তাবেঈনদের সময়কার মুশ্রিক ও ইয়াহুদীদের ধর্মবিশ্বাস ও মুর্খতাজনিত রীতি-নীতি তুলে ধরার জন্যে অনেক ছোট-খাট ঘটনাও তাঁর বলে গেছেন। সে সব ঘটনা বলতে গিয়েও তাঁরা ‘নুযিলাত ফী কাযা’ বাক্যাংশ ব্যবহার করেছেন। অথচ তা বলার উদ্দেশ্য ছিল, এ ধরনেরই এক ব্যাপারে এ আয়াত নাযিল হয়েছিল।
সাহাবা ও তাবেঈনরা মুশরিক ও ইয়াহুদীদের বিশ্বাস ও রীতিনীতির যে সব ঘটনা উল্লেখ করতেন, তা শুধু কাহিনীর অবতারণার জন্যে নয়; বরং আয়াতটি কিরূপ ঘটনা উপলক্ষে নাযিল হয়েছিল, তার সঠিক চিত্র তুলে ধরার জন্যেই করতেন। এজন্যে তাদের বর্ণনায় স্ব-বিরোধ ও মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। প্রত্যেকটি বক্তব্য আলাদা পথের ইঙ্গিত দেয়। মূলত সবগুলোর উদ্দেশ্য ছিল এক। বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেন: যে ব্যক্তি একই আয়াত বিভিন্ন ব্যাপারে না লাগাতে পারে, সে ফকীহ হতে পারে না। এখানেও তিনি উপরের বর্ণিত রহস্যের দিকেই ইংগীত করেছেন।
কুরআনে এ ধরনের এমন বহু স্থান রয়েছে, যা থেকে একই সময় বিভিন্ন অবস্থা প্রকাশ পায়। এক অবস্থা তো পূণ্য ও সৌভাগ্যের, আরেকটি পাপ ও দুর্ভাগ্যের। সৌভাগ্যের অবস্থঅর সাথে কিছু সৌভাগ্যমূলক গুণের সমাবেশ থাকে, আর হতভাগ্যের অবস্থার সাথে কিছু দুর্ভাগ্যপূর্ণ দোষগুলো বর্ণিত হয়। কিন্তু দোষগুণ সম্পর্কিত বিধান বর্ণনাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। যেমন:
(আরবী***************)
“মানুষকে বাপ মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহারের উপদেশ দিলাম, যারা কষ্ট করে তাদের জন্ম দিয়েছে আর লালন-পালন করেছে। ” (সূরা আহকাফ-১৫)
এ আয়াতের পরে ভাল ও মন্দা দু’দলের অবস্থাই বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন: (আরবী*****************)
“যখন তাদের কাছে তোমাদের প্রভুর থেকে অবতীর্ণ বাণী শোনানো হত তখন তারা বলত, সব তো সেকেলে আর পচা কাহিনী। ” (সূরা নাহল-২৪)
(আরবী*****************)
“যারা আল্লাহভীরু তাদের কাছে যখন তোমাদের প্রবু থেকে অবতীর্ণ বাণী বলা হয়, তারা বলত, উত্তম বাণী” (সূরা নাহাল-৩০)
এ আয়াতের পরেও পূণ্যবান ও পাপী দু’দলেরই অবস্থার উল্লেখ করা হয়েছে। নিম্নের আয়াতগুলোকে এ ধরনের আয়ারেত অন্তর্ভুক্ত করা চাই।
(আরবী***************)
“আল্লাহ পাক পল্লীল উদাহরণ দিলেন, যেটা ছিল নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত। ” (সূরা নাহাল ১১২)
(আরবী*******************)
“সেই মহান প্রভুই তোমাদের একটি মাত্র সত্তা থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে স্ত্রীও পয়দা করেছেন যেন তা নিয়ে তৃপ্ত থাকতে পারে…..ইত্যাদি।
(আরবী****************)
“অবশ্যই ঈমানদাররা সফলকাম হয়েছে- তারাই সশঙ্ক চিত্তে নামাযে নিরত হয়। ” (সূরা মুমিন ১/২)
(আরবী***************)
“কথায় কথা শপথকারী লাঞ্ছনাদাতাদের আদৌ অনুসরণ করো না.. ইত্যাদি। ” (সূরা কলম-১০)
এ সব অবস্থায় এটা প্রয়োজন নয় যে, আয়াতে যে সব বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা হযেছে, তা যথাযথভাবে ব্যক্তি বিশেষের মিলবে। যেমন নিম্নের আয়াতে রয়েছে: (আরবী**********************)
“দানের উপমা হচ্ছে যেন একটি দানা থেকে সাতটি ছড়া ও প্রতি ছড়া থেকে শত দানা বের হল। ”
এ আয়াতে উদাহরণের জন্যে এমন একটা বীজের কথা বলা হয়েছে, যা থেকে সাতটি ছড়া এবং প্রতি ছড়া থেকে শত দানা বের হয়। কিন্তু তার অর্থ এ নয়, এরূপ দানাই মিলবে। এখানে শুধু বিনিময় ও সওয়াবের আধিক্যের চিত্র তুলে ধরারই উদ্দশ্য। এ ধরনের স্থানে সব বৈশিষ্ট্য কিংবা তার অধিকাংশ বর্তমান থাকা নেয়াতৎই অপ্রয়োজনীয় শর্ত।
কুরআনের কোথাও আরও এক ধরনের বর্ণনারীতি লক্ষ্যনীয়। অর্থাৎ আহ্কাম সম্পর্কে বর্ণনা যদি এমন কো স্থা এসে যায় যা সন্দেহের উদ্রেক করতে পারে, সেখানে তা দূরও করা হয়েছে। অথবা বর্ণিত বিধান সম্পর্কে যদি কোন স্বতঃষ্ফূর্ত প্রশ্ন দেখা যায়, আলোচনা প্রসংগে তার জবাবও দেয়া হয়েছে। এ ধরনের বর্ণনার উদ্দেশ্য শুধু এটাই হয়ে থাকে যে, বলে আসা কথাটি সুপ্রমাণিত করা। এ নয় যে, এরূপ আয়াত শুনে সত্যিই কেউ প্রশ্ন তুলেছিল। কিংবা আদতেই কেউ কোন সন্দেহ প্রকাশ করেছিল্
কিন্তু সাহাবাদের অভ্যাস ছিল এই, যখনই তাঁরা এ ধরনের আয়াত নিয়ে বাদানুবাদ চালাতেন, আগে প্রশ্ন দাঁড় করিয়ে নিতেন। তাঁরা প্রশ্নোত্তরের ধারায় আয়াতের মর্ম বলে যেতেন। বস্তুত এসব স্থানগুলো যদি তলিয়ে দেখা হয়, তাহলে জানা যায়, গোটা বাক্য একটি পূর্ণ বাক্য মাত্র। সেখানে নাযিলের ধারাবাহিকতা রেখে কোন অংশকে আগ-পিছ্ করার ফাঁক নেই। একটি সুবিন্যস্ত বাক্য; এর স্থান বদল কিংবা বাক্যের গাঁথুনি ভেংগে নেয়া রীতি বিরুদ্ধ বটে।
সাহাবাদের এও রীতি ছিল যে, কুরআনের আয়াতের মর্ম বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁরা আয়াতের আগ্-পিছ করতেও ছাড়তেন না। তার অর্থ এ নয় যে, নাযিলের সেটাই ধারাবাহিক রূপ বলে তাঁরা বিশ্বাস করতেন। এরূপ সাজানোর ক্ষেত্রে তাঁরা আয়াতের গুরুত্ব বিচার করতেন।
(আরবী******************)
“যারা সোনা-রূপা জমা করে… ইত্যাদি। ” সূরা তাওবা-৩৪)
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) উপরোক্ত আয়াত সম্পর্কে বলেছেন, যাকাতের আয়াতের আগে এটা নাযিল হয়েছিল। এ পর্যন্ত সোনা, রূপা জমা করা নিষিদ্ধ ছিল।
যাকাতের আয়াতে সম্পদের শুদ্ধিকরণ ব্যবস্থা হয়ে গেল। এরপর থেকে তা জমানো বৈধ হল।
অথচ সবাই জানে যে সূরা বারায়ারেত সবচেয়ে পরে অবতীর্ণ হয়েছে। এ আয়াতটি তারই অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে যাকাতের আয়াত তার অনেক আগে এসেছে। কিন্তু ইবনে উমর (রাঃ) এখানে আগ্-পিছ দাবী করেছেন, তা সাধারণ হুকুমের উপরে বিশেষ হুকুমের ভিত্তিতে।
মোটকথা, তাফসীরের জিম্মাদারী হচ্ছে এতটুকু যে, তারা এ সব বিভিন্ন পরিস্থিতির ভেতরে কেবল দুটি ব্যাপার খেয়াল রাখবে। প্রথম, যে সব যুদ্ধ ও ঘটনার দিকে আয়াতের ইংগিত রয়েছে এবং যে আয়ারেত মর্মোদ্ধার তা ছাড়া চলে না সেগুলোর বলে দেবে। দ্বিতীয় আয়াতে যদি এমন কোন বিশেষত শর্ত কিংবা রহস্য থেকে থাকে যা শানে নুযূল না বললে বুঝা যায় না, সেখানে শানে নুযূল বলা।
যদিও দ্বিতীয় শর্তটি তাফসীর বিষয়ক নয়-তাওজীহ্ বিষয়ক, তথাপি তাফসীর শাস্ত্রেও এর প্রয়োজন দেখা দেয়। তাই তাফসীরকারদের এটাও বলা কর্তব্য। তাওজীহ শাস্ত্র আলাদা এক বিষয়। তাতে বাক্যের এমন সব চুলচেরা বিশ্লেষণ থাকে, যাতে করে সে সম্পর্কে সব প্রশ্নের নিরসন ঘটে।
সারকথা:
ওপরের সব আলোচনার সার হল এই, আয়াত কখনো অস্পষ্ট মনে হয় এবং তার বাহ্যিক অর্থ যা প্রমাণ করতে চায়, তা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কখনো আবার আয়াতের মাঝে এরূপ অসংলগ্নতা দেখা যায় যাতে করে এক নবীশের পক্ষে তার অর্থ বুঝাই দায় হয়ে থাকে। কিংবা আয়াতের কোন বিশেষত্ব বা শর্ত তার মাথায় খেলে না। তাফসীরকার যখন সে সব স্থানে আলোচনা করবে, সব জটিলতা দূর করবে। এটাকেই বলা হয় তাওজীহ্ (বিশ্লেষণ)। যেমন এ আয়াতটি: (আরবী**************)
“হে হারুন-ভগ্নি’ সম্বোধন দ্বারা ফিলিস্তিনবাসী, হযরত ঈসা (আঃ)-এর জন্মের পরে হযরত মরিয়ম (রাঃ)-কে ডেকেছে। এখানে স্বভাবতই প্রশ্ন তোলা হয়েছে, হযরত ঈসা (আঃ) ও হযরত মুসা (আঃ)-এর ভেতরে তো কয়েক হাজার বছরের ব্যবধান রয়েছে। সেক্ষেত্রে কি করে হারুন মরিয়মের ভাই হলেন?
এ বিভ্রান্তির কারণ হচ্ছে, মূসা (আঃ)-এর ভাই হারুনকে মরিয়মের ভাই ভাবা। হযরত (সঃ) এ প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, এ আরেক হারুন যিনি মরিয়মের ভাই এবং হযরত হারুন (আঃ)এর নামের বরকাতের জন্যে তাঁর এ নাম রাখা হয়েছিল। বনী ইসরাঈলীদের রীতিই ছিল বুযুর্গদের নামে নাম রাখা।
এভাবে একটি আয়াত সম্পর্কে হযরত (সঃ) কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। কিয়ামতের দিন মানুষ পা শুন্যে তুলে ভয় করে চলবে কি করে? তিনি জবাব দিলেন, যে পবিত্র সত্তা মানুষকে দুনিয়ায় পায়ে ভর করে চলার ক্ষমতা দিয়েছিলেন, তিনিই তাদের সেখানে মাথায় ভর করে চলার শক্তি দেবেন।
একবার আদি ব্যাখ্যাবিদ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে দু’আয়াতের ভেতরে বাহ্যদৃষ্ট বিরোধ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হল যে, এক আয়াতের বলা হয়েছে, “একে অপরকে কোন প্রশ্ন করবে না” এবং দ্বিতীয় আয়াতে রয়েছৈ, “পরস্পর বাদানুবাদ হবে’- এ দুয়ের সমন্বয় কি করে সম্ভব?
তিনি জবাবে বললেন- পয়লা আয়াতে বিচার দিনের এবং দ্বিতীয়টিতে জান্নাতের কথা বলা হয়েছে। বিচার দিনে কারুর কিছু বলার হুঁশ থাকবে না এবং জান্নাতে পৌঁছে তবে আলাপের অবসর মিলবে। তখনই বাদানুবাদ চালাবে।
হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে একদিন প্রশ্ন করা হল, সাফা-মারওয়ায় দৌঁড়াদৌড়ি যদি ওয়াজিব হয়, তা হলে কুরআনে কেন ‘লা-জুনাহ’ (ক্ষতি নেই) বলা হল। তিনি জবাব দিলেন- ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও একদল লোক এড়িয়ে চলত। তাদের লক্ষ্য করেই বলা হয়েছে- হজ্জই যখন করছ, তখন এ ওয়াজিবটি পালন করলে কোন ক্ষতি নেই।
হযরত উমর (রাঃ) একবার হযরত (স)-কে প্রশ্ন করলেন, সদকার হুকুমের সাথে ‘ইন খিফতুম (যদি তোমরা ভয় পাও) শর্তটি কেন লাগল? হযরত (স) জবাব দিলেন- দাতারা তো দানে কষ্ট পায় না; বরং আনন্দ পায়। সুতরাং এখানে আল্লাহ্ এ শর্তটি বিশেষ উদ্দেশ্যে লাগান নি, এমনিই বলে দিয়েছেন।
মোদ্দাকথা, তাওজীহ্ সম্পর্কি উপমা-উদাহরণ খুঁজলে অসংখ্য মিলবে। এখানে আমার উদ্দেশ্য হল কেবল তাওজীহ্ সম্পর্কে সঠিক ধারণা জানানো।
এ প্রসংগে বুখারী, তিরমিযী ও হাকাম শানে নুযূল ও তাওজী সম্পর্কে যা কিছু লিখেছে, আমি পঞ্চম অধ্যায়ে সংক্ষেপে সেগুলো হযরত (স) কিংবা সাহাবা পর্যন্ত সংযোগ রক্ষা করে বলে দেয়া ভাল মনে করি। এতে দুধরনের উপকার হবে। এক তো এতটুকু জানা সব তাফসীরকারের জন্যে অপরিহার্য। যেমন অপরিহার্য কুরআনের কঠিন স্থানগুলো ব্যাখ্যার জন্যে আমি যে সবের উল্লেখ করেছি, সেগুলো জনা। দ্বিতীয়, এর ফলে এটা পরিষ্কার হবে যে, অধিকাংশ আয়াত বুঝার জন্যে শানে নুযূল দরকার হয় না। বস্তুত সে জন্যে কম ঘটনাই উল্লেখ করতে হয়।
এ কারণে তাফসীর শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য ও বিশুদ্ধতম গ্রন্থদ্বয়ের ভেতরে ঘটনার সমাবেশ কম রয়েছে। পক্ষান্তরে মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক, ওয়াকিদী ও কালবী এ ব্যাপারে বড় বেশী উদার হয়েছেন। প্রত্যেক আয়াত প্রসংগে কোন না কোন কাহিনী বলে দিয়েছেন। তার অধিকাংশই মুহাদ্দিসদের কাছে অশুদ্ধ বিবেচিত হয়েছে। কিংবা তাস সূত্র সন্দেহপূর্ণ। এ ধরনের সন্দেহপূর্ণ ও ভুল কাহিনী তাফসীর গ্রন্থের শর্ত করে নেয়া নির্ভেজাল ভ্রান্তি বটে। এ ধরনের ঘটনাগুলোকে কুরআন বুঝার ভিত্তি করে নেয়া আদতে নিজকে কুরআনের জ্ঞান থেকে বঞ্চিত রাখা বৈ আর কিছু নয়।