প্রথম অধ্যায়ঃ পঞ্চ ইলম
কুরআনে যে সব জ্ঞান ও উপদেশপূর্ন তত্ব বর্নিত হয়েছে, তা পাঁচ ভাগে ভাগ করা চলে।
(১) ইসমুল আহকাম বা সবংবিধান জ্ঞানঃ
অর্থাৎ উপাসনা, কায়-কারবার, ঘর-সংসার, রাজনীতি কিংবা অর্থনীতি যে কোন ক্ষেত্রে ওয়াযিব (অবশ্য করণীয়) মনদুব (প্রশংসনীয়) মুবাহ (বৈধ), মাকরুহ (অপছন্দনীয়) এবং হারাম (অবশ্য পরিত্যাজ্য) বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞান। এ জ্ঞান যারা সম্যক ও সবিস্তারে অর্জন করে, তাদের ফকীহ (আইনজ্ঞ) বলা হয়।
(২) ইলমুল জদল (মুখসামা) বা ন্যায় শাস্ত্র জ্ঞানঃ
অর্থাৎ ইয়াহুদী, নাসারা মুশরিক ও মুনাফিক এ চারটি পথভ্রষ্ট দলের সাথে বিতর্কে পারদর্শিতা লাভের জন্যে প্রয়জনীয় জ্ঞান। এ জ্ঞানের বিশ্লেষণ দানের দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা হলেন মুতাকাল্লিমীন।
(৩) ইলমুত তাযকীর বি-আলা-ইলাল্লাহ বা স্রষ্ঠা তত্ত্ব জ্ঞানঃ
অর্থাৎ আল্লাহর অবদান ও নিদর্শন সম্পর্কিত জ্ঞান। এতে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি রহস্য এবং দৈনন্দিন জীবনে প্রাপ্ত বান্দার অভিজ্ঞান, পরস্ত্র স্রষ্টার সর্বাবিধ গুনাবলীর পরিচয় সম্পর্কিত বর্ণনা গুলো রয়েছে।
(৪) ইলমুত তাযকীর বি আইয়্যামিল্লাহ বা সৃষ্টি-তত্ত্ব জ্ঞানঃ
অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্ট বস্তুর অবস্থা সম্পর্কিত জ্ঞান। এতে অনুগতদের পুরস্কার ও অবাধ্যদের শাস্তি সম্পর্কিত বর্ণোনাগুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
(৫) ইলমুত তাযকীর বিল-মাউত বা পরকাল-জ্ঞানঃ
অর্থাৎ মৃত্যু ও তার পরবর্তীকালের অবস্থা সম্পর্কিত জ্ঞান। এতে পুনরুত্থান, একত্রীকরণ, হিসাব-নিকাশ ও বেহেশত-দোযখ সম্পর্কিত বর্ণনা হুলো এসে যায়। এসব ব্যাপারে যাঁরা সবাইকে কুরআন ও হাদীস থেকে বাণী আয়ত্ত করে থাকেন, তাঁদেরকে ওয়ায়েয বা সতর্ককারী বলা হয়।
কুরআনের বর্ণনা রীতিঃ কুরআন পাক এসব জ্ঞান দানের ব্যাপারে সেকালের আরবদের রীতি অনুসরণ করেছে। পরবর্তীকালে আরবদের বর্ণনা রীতির সাথে তার মিল নেই কোথাও। বস্তুত সংবিধান সম্পর্কিত আয়াত বর্ণনার বেলায় সংক্ষেপিকরণের দিকে দীইষ্টী দেয়া হয়েছে। তাতে নীতি নির্ধারকদের মতো অহেতুক চুললেরা বিশ্লেষণ ও মীমাংসার দায়ে বর্ণনাকে দীর্ঘতর করা হয়নি।
ইলমুল মুখাসামা সম্পর্কিত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তাআলা সর্ব বাদীসম্মত নীতি ও কলুয়াণকর উপদেশের সহজ সরল পন্থা অবলম্বন করেছেন। তর্ক বিশারদের মত যিক্তির মারপ্যাচে ধাপে ধাপে এগোবার দরাজ পথ অনুসরণ করেননি। এমনকি অধুনা প্রবন্ধকারদের মত বিভিল্ল কথার গাঁথুনী রচনা করে একটি কথা বুঝাতে সময় ব্যয় করেন নি। পরন্তু বান্দাদের জন্যে যখন যেখানে যা যতটুকু প্রয়োজন ভেবেছেন, এমনকি আগ-পর ধারাবাহিকতার তোয়াক্কা না রেখে তা বলে গেছেন।
অবতরণ কার্য-কারন ও ব্যাখ্যাকারঃ সাধারণ তাফসীওকারদের রীতি হল এই- যখনই তাঁরা কোন আয়াতের ব্যাখ্যা করতে যান, হোক তা মুখাসামা কিংবা আহকাম সম্পর্কিত, তার সাথে আবশ্যই তাঁরা কোন না কোন ঘটনা বা কাহিনী জুড়ে দেন। এবং তারা ভাবেন, এ কাহিনী বা ঘটনাতিই আয়াতটির অবতরনের একমাত্র কারণ। অথচ এ কথা সর্ববাদি সম্মত যে, কুরআন শুধু মানুষের শিক্ষা ও সব্যতা দান ও তাদের কুসংস্কার ও কুকার্য থেকে উদ্ধার করার জন্যে অবতীর্ণ হয়েছে। তার তার বিভিন্ন ধরণের আয়াত অবতীর্ণ হবার ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে। যেমন- মুখাসামার আয়াতগুলো এসেছে ভ্রান্ত বিশ্বাস বা কুসংস্কার দের করারা জন্যে তেমনি আহকামের আয়ারগুলো মানুষের কার্যিধারার ভুলগুলো শুধরে দেবার জন্যে নাযিল হয়েছে। তাদের ভেতরকার জুলুম নিপীড়নের স্রোত বন্ধ করাই সেগুলোর উদ্দেশ্য। আর তাযকীর বি-আলা ইল্লাহ ও বি-আইয়্যাইল্লাহ সম্পর্কিত আয়াতগুলো নাযিলের মূলে রয়েছে আল্লাহর নিদর্শন ও অবদান গুলোর ব্যাপারে মানুষের উপেক্ষা ও ঔদাসীন্য। এমনিকি, নিজেদের কার্যকলাপের ভাল-মন্দ বা শুভ-অশুভ সম্পর্কে তারা অজ্ঞ। তেমনি অজ্ঞ তারা মৃত্যুর পরবর্তী অধ্যায় সম্পর্কে। তাই এ সবের আলোকপাত করে কতগুলো আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে।
বস্তুত ব্যাখ্যাকাররা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ নিয়ে যতখানি মাথা ঘামিয়ে থাকেন, তা নিষ্প্রয়োজন। কারণ তার তাত’পর্য \কে ভিত্তি করে কুরআন অবতীর্ণ হয়নি। অবশ্য যে সব আয়াতে হযরত কিংবা তাঁর পূর্ববর্তী কালের কোন ঘটনা সম্পর্কে ইংগিত দান করা হয়েছে, সেগুলোর ব্যাখ্যা প্রসংগে সে সব ঘটনার উল্লেখ প্রয়োজন। কারণ শ্রোতারা সে আয়াতের মর্ম বুঝতে গিয়ে ইংগিতময় ঘটনাটুকু না জানা পর্যন্ত পতিতৃপ্ত হতে পারে না। তাই প্রয়োজন হচ্ছে এই আলোচ্য ইলমগুলো এরূপ রীতিতে বিশ্লেষণ করা যেনতাতে পেয়াসংগিক খুটিনাটি ব্যাপার ও ঘটনাবলী বর্ণনার আবশ্যকতা দেখা না দেয়।