মৌলিক অধিকারের ইসলামী ধারণা
পূর্বোক্ত অধ্যায়ে আল্লাহ তাআলার সার্বভৌমত্ব, আল্লাহর সাথে মানুষের ইবাদত বন্দেগীর চুক্তি, দুনিয়াতে মানুষের খেলাফতের দায়িত্ব, আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থার অনুসরণ, আখেরাতে যাবতীয় কাজের জবাবদিহি এবং কাজকর্ম অনুযায়ী চিরস্থায়ী শান্তি অথবা শাস্তির আলোচনা থেকে ইসলামের মৌলিক অধিকারের ধারণা অনেকটা সুষ্পষ্ট হয়ে গেছে। তথাপি আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য এখন আমরা ঐতিহাসিক আইনগত ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর মূল্যায়ন করব।
ঐতিহাসিক দিক
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায়, এই পৃথিবীতে মানব-জাতির অস্তিত্ব যত প্রাচীন, ইসলামে মৌলিক অধিকারের ধারণাও তত প্রাচীন। মানুষের স্রষ্টা ও মালিক যেভাবে তার দৈহিক জীবনের জন্য আলো, বাতাস, পানি, খাদ্য সহ অন্যান্য অসংখ্য প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করেছেন, অনুরূপভাবে তার সামাজিক জীবন পরিচালনার জন্য একটি জীবন ব্যবস্থাও দান করেছিলেন তার জীবনের সুচনাকালেই। কুরআন মজীদ এই সত্যেরই সুষ্পষ্ট সাক্ষ্য প্রদান করে যে, মানুষকে এই দুনিয়ায় পাঠানো এবং খেলাফতের পদে সমাসীন করার পূর্বেই আল্লাহ তাআলা তাকে অধিকার ও কর্তব্যের চেতনাশক্তি দান করেছিলেন এবং জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করার সাথে সাথে জীবনের সৌজন্যবোধ ও আচরণবিধিও শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এই পৃথিবীতে পদার্পণকারী প্রথম মানব তাঁর জীবনের সূচনা অজ্ঞতার অন্ধকারে নয়, জ্ঞানের আলোতেই শুরু করেছিলেন।
(আরবী***)
অর্থ: এবং আল্লাহ আদমকে সব জিনিসের নাম শিখিয়ে দেন- সূরা বাকারা : ৩১।
এখানে কুল্লাহা শব্দ সম্পর্কে চিন্তা করুন। উক্ত শব্দ থেকে জানা যায়- এই জ্ঞান আংশিক ছিল না, বরং ছিল পূর্ণাঙ্গ। মানুষকে এই দুনিয়ায় যেসব জিনিসের সম্মুখীন হওয়ার ছিল তার সব কিছুর নাম তাঁকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নাম শিখিয়ে দেওয়ার অর্থ এই নয় যে, কেবল জিনিস সমূহের নাম শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল, বরং তার প্রভাব ও বৈশিষ্ট্য, উপকারিতা, ক্ষতি, ব্যবহারের পন্থা এবং তার সাথে মানুষের সম্পর্কের ধরণও পূর্ণরূপে জ্ঞাত করা হয়েছিল। জীবনের ক্রমোন্নতির সাথে সাথে মানুষ তার মৌলিক জ্ঞান ও গবেষণা-অনুসন্ধানের গঠন প্রকৃতির সাহায্যে জিনিসসমূহের জ্ঞানের পরিসর ব্যাপক ও প্রশস্ত করতে থাকে এবং এই প্রক্রিয়া এখনও পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।
মাওলানা মওদুদী মরহুম উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন:
“কোন বস্তুর নামের সাহায্যে মানুষ তার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে থাকে, এটাই মানুষের জ্ঞান লাভের পদ্ধতি। কাজেই মানুষের সমস্ত তথ্যজ্ঞান মূলত বস্তুর নামের সাথে জড়িত। তাই আদম আ: কে সমস্ত নাম শিখিয়ে দেওয়ার অর্থই ছিল-তাঁকে সমস্ত জিনিসের জ্ঞান দান করা হয়েছিল”। ( তাফহীমুল কুরআন, বাংলা অনুবাদ: আব্দুল মান্নান তালিব, খন্ড : ১, পৃষ্ঠা: ৬৩, টীকা: ৪২)।
বিভিন্ন জিনিসের ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার ও কর্তব্য কি তার পূর্ণ চেতনাও অপরিহার্যরূপে উক্ত জ্ঞানের মধ্যে শামিল ছিল। অতএব হযরত আদম আ: এর জীবনেই যখন অধিকারের প্রথম সমস্যা সৃষ্টি হল তখন সাথেই সাথেই এই সত্যও সুষ্পষ্ট হয়ে গেল যে, মানুষ কেবল নিজের ধারণা – অনুমান অথবা সংজ্ঞার ভিত্তিতে নয়, বরং আল্লাহ নির্ধারিত বিধানের কারণে এই অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের চেতনা সম্পন্ন ছিল। কাবীল যখন আল্লাহর দরবারে নিজের কোরবানী কবুল না হওয়ার পর হাবীলকে হত্যার হুমকী দিল তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন:
“তুমি যদি আমাকে হত্যা করতে হাত উঠাও তবে আমি তোমাকে হত্যা করতে হাত উঠাব না। আমি সারা জাহানের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি। আমি চাই যে, আমার ও তোমার গুনাহ তুমিই বহন কর এবং দোযখের বাসিন্দা হও। এটাই যালিমদের প্রতিদান” (সূরা মায়িদা : ২৯)।
উপরোক্ত আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, মানব জীবনের সম্মান ও নিরাপত্তা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা যে হেদায়েত দান করেছিলেন-হাবীলের সে সম্পর্কে জ্ঞান ছিল। সে জানত যে, এটা ছিল গুনাহর কাজ এবং এই অপরাধে অপরাধীকে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে। সে কেবল খোদাভীতির কারণে নিজের জান দিয়ে দিল, কিন্তু ভাইর প্রতি প্রতিশোধের হাত উঠানো ঠিক মনে করেনি।
হযরত আদম আ: কে আল্লাহ, আল্লাহর বান্দাহ এবং আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টি সম্পর্কে অধিকার ও কর্তব্য সম্বলিত যে বিধান দেওয়া হয়েছিল তা মানব জীবনের ক্রমোন্নতির বিভিন্ন পর্যায়ে সময়ের দাবী ও চাহিদা অনুযায়ী বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও প্রয়োজনীয় আইন কানুন সহ হযরত আদম আ: থেকে হযরত মুহাম্মাদ সা: পর্যন্ত আবির্ভূত নবীগণের মাধ্যমে মানবজাতি তার সঠিক পথ লাভের জন্য অব্যাহতভাবে পেতে থাকে। মানুষের সম্পর্কের পরিসর যত বিস্তৃত হতে থাকে তাকে সুশৃঙ্খল করার বিধানও নাযিল হতে থাকে। অবশেষে মহানবী মুহাম্মাদ সা: পর্যন্ত পৌঁছে মানব জাতির শিক্ষা প্রশিক্ষণের এই প্রক্রিয়া পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় এবং ঘোষণা করা হয়:
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
অর্থ: আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন মনোনীত করলাম- (মাইদা: ৩)।
এই যে দীন হযরত মুহাম্মাদ সা: পর্যন্ত এসে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে তার সূচনা কোথা থেকে হয়েছে? তার ইতিহাস স্বয়ং কুরআন থেকে জেনে জেনে নিন:
“আদম, নূহ, ইবরাহীমের বংশধর ও ইমরানের বংশধরকে আল্লাহ বিশ্ববাসীর উপর প্রাধান্য দিয়ে (রিসালাতের পদের জন্য) মনোনীত করেছেন। এরা একে অপরের বংশধর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ- )আলে ইমরান: ৩৩, ৩৪)।
হযরত আদম আ: থেকে মানব জাতির পথ প্রদর্শনের যে ধারা শুরু হয়েছিল তা কোনরূপ বিচ্ছিন্নতা ব্যতিরেকে একের পর এক নবীগণের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে অব্যাহত থাকে। কুরআন মজীদ আমাদের বলে দিচ্ছে যে, কথা শুধু এতটুকুই নয় যে, ঐশী শিক্ষা ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত ছিল, বরং তার চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ সত্য এই যে, সকল নবী রসূল কোনরূপ পার্থক্য ব্যতীত মানব জাতিকে একই দীন কবুলের আহবান জানান। তাদের মিশন ছিল একই, তাঁরা একই জীবন ব্যবস্থার পতাকাবাহী ছিলেন এবং এই জীবন ব্যবস্থা তাদের প্রণীত ছিল না, বরং তাদেরকে রিসালাতের পদে সমাসীনকারী সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ তাআলা কর্তৃক প্রদত্ত।
“তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দীন যার নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন নুহকে, আর যা আমরা ওহী করেছি তোমার নিকট এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম, ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে-এই বলে যে, তোমরা দীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে মতভেদ কর না”। (সূরা শূরা :১৩)।
এই দীন শুধুমাত্র আকীদা-বিশ্বাসের সংশোধন পর্যন্তই সীমিত ছিলনা, বরং আকীদা বিশ্বাস থেকে নিয়ে জীবনের সার্বিক বিষয়ের সংশোধন পর্যন্ত বিস্তারিত ছিল এবং তাতে জীবনের প্রতিটি বিভাগ সম্পর্কে ব্যাপক পথ নির্দেশ বর্তমান ছিল।
وَكَتَبْنَا لَهُ فِي الْأَلْوَاحِ مِن كُلِّ شَيْءٍ مَّوْعِظَةً وَتَفْصِيلًا لِّكُلِّ شَيْءٍ فَخُذْهَا بِقُوَّةٍ وَأْمُرْ قَوْمَكَ يَأْخُذُوا بِأَحْسَنِهَا ۚ
অর্থ: আমরা মূসাকে জীবনের সব বিষয়ে উপদেশ এবং প্রতিটি দিক সম্পর্কে ষ্পষ্ট নির্দেশ ফলকে লিখে দিয়েছিলাম এবং তাকে বলে দিয়েছিলাম, এগুলো শক্ত হাতে ধারণ কর এবং তোমার জাতিকে তার সর্বোত্তম তাৎপর্য গ্রহণের নির্দেশ দাও”- (সূরা আরাফ: ১৪৫)।
এখন খাঁটি অধিকার ও কর্তব্যের ভাষায় শুনুন যে, এই দীন এবং তার বিস্তারিত হেদায়েত কি ছিল?
“স্মরণ কর যখন আমরা ইসরাঈল সন্তানদের নিকট থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করবে না, মাতা- পিতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম ও গরীবদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে এবং মানুষের সাথে সদালাপ করবে, নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দিবে, কিন্তু স্বল্প সংখ্যক লোক ব্যতীত তোমরা বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলে। যখন আমরা তোমাদের নিকট থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম যে, তোমরা পরষ্পরের রক্তপাত করবে না এবং আপনজনদের স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করবে না”- সূরা বাকারা: ৮৩, ৮৪।
এই সূরা এক ব্যক্তির আসমান থেকে নিয়ে জমীন পর্যন্ত বিস্তৃত সমস্ত বিষয় সম্পর্কে ঐশী বিধান ও দিক নির্দেশনার প্রতি ইশারা করে বলা হয়েছে:
“যেসব লোক আল্রাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভংগ করে যে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়-তাদের জন্য রয়েছে অভিসম্পাত এবং তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্টি আবাস”- সূরা রাদ : ২৫)।
এই সম্বন্ধ ও সম্পর্কের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মাওলানা মওদূদী রহ: তাঁর বিখ্যাত তাফসীর গন্থে লিখেছেন:
“অর্থাৎ যেসব সম্পর্ক সম্বন্ধ স্থায়ী, শক্তিশালী, সুপ্রতিষ্টিত ও সুদৃঢ় করার উপর মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত কল্যাণ নির্ভরশীল এবং আল্লাহ তাআলা যেগুলোকে ত্রুটিমুক্ত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন-এরা তার উপর কুঠারাঘাত হানে। বস্তুত এই সংক্ষিপ্ত বাক্যটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থ ও ভাব প্রকাশ করে। মানুষের সাংস্কৃতিক ও নৈতিক চরিত্রের জগত-যা দুই ব্যক্তির পারষ্পরিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে বিশাল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আচর ব্যবহার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে-তা সবই এই একটি বাক্যের অন্তর্ভুক্ত। সম্পর্ক ছিন্ন করার অর্থ কেবলমাত্র মানবীয় সম্পর্ক ছিন্ন করাই নয়, বরং সঠিক ও বৈধ সম্পর্ক ছাড়া অন্য যত প্রকারের সম্পর্ক কায়েম করা হবে তার সবই এর অন্তর্ভূক্ত হবে। কারণ ভ্রান্ত ও অবৈধ সম্পর্কের পরিণতি ও সম্পর্কচ্ছেদের পরিণতি একই। অর্থাৎ এর পরিণতিতে মানুষের পারষ্পরিক সম্পর্ক খারাপ হয় এবং নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়”- তাফহীমুল কুরআন, বাংলা অনুবাদ: খন্ড ১, পৃ: ৫৮, টীকা ৩২।
কুরআন পাকের পেশকৃত মানবাধিকারের এই ইতিহাস থেকে সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিতহয় যে, ইসলামে মৌলিক অধিকারের ধারণা সর্বপ্রথম মানুষের সৃষ্টির দিন থেকেই বিদ্যমান। তা থেকে আরও জানা যায় যে, এসব অধিকারের উৎস কি? তা মানুষ ও তার স্বকপোল কল্পিত রাষ্ট্রের শাসক গোষ্টীর পারষ্পরিক দ্বন্ধ সংঘাত এবং তাদের মাঝে কৃত চুক্তির মাধ্যমে অস্তিত্ব লাভ করেনি, আর না কোন দার্শনিক রাজনীতিজ্ঞ অথবা আইনজ্ঞের গভীর চিন্তা প্রসূত, বরং স্বীয় সৃষ্টিকূলের জন্য তাদের স্রষ্টার এবং স্বীয় প্রজাদের জন্য তাদের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আল।রাহ তাআলা কর্তৃক প্রদত্ত। তা মানুষের সত্তার সাথে অবিচ্ছেদ্য তা মানব সৃষ্টির সাথে সাথে নির্ধারিত হয়ে গেছে। এসব অধিকারের সর্বশেষ এবং বিস্তারিত বিবরণ মহানবী সা: এর আনীত শরীআতে প্রদত্ত হয়েছে। এসব অধিকার স্থান কালের সীমার উর্ধ্বে। মানুষ যদি পৃথিবী থেকে উড়ে গিয়ে চাঁদে বসতি স্থাপন করে তবে তথায়ও এসব অধিকারের ধরণের মধ্যে কোন পরিবর্তন হবে না, স্থান কালের পরিবর্তনে যেমন মানুষের দৈহিক গঠন এবং তার প্রকৃতিগত প্রয়োজন সমূহের মধ্যে কোন পরিবর্তন হয় না তদ্রুপ অধিকার ও কর্তব্যের স্থায়ী বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কোন পরিবর্তন সূচীতও হয় না। এসব অধিকার পরিবর্তন অযোগ্য এবং একান্তই অবিচ্ছেদ্য রাষ্ট্রের কাজ অধিকার নির্ধারণ নয়, বরং নির্ধারিত অধিকারের বাস্তবায়ন।
পাশ্চাত্যবাসীগণের দাবী এই যে, মৌলিক অধিকারের ইতিহাস মাত্র তিন-চারশো বছরের পুরাতন। তারা এই সময়কালে নিজেদের এখানে প্রাণান্তকর সংগ্রাম ও চেষ্ঠা সাধনার মাধ্যমে যা কিছু অর্জন করেছে তার দ্বারা আজও গোটা দুনিয়া উপকৃত হচ্ছে। কিন্তু কুরআন মজীদ আমাদের সামনে যে ইতিহাস পেশ করছে তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রথম মানব যেদিন এই পৃথিবীতে পদার্পণ করেছেন সেদিন থেকে মৌলিক অধিকার তাঁর চেতনা ও অনুভূতির অংশ হয়ে আছে। এসব অধিকার নির্ধারণ ও অর্জন তাঁন নিজের অবদান নয়, বরং স্বয়ং একচ্ছত্র অধিপতি পর্যায়ক্রমে তাকে দান করেছেন। আজ পৃথিবীর যেখানেই এসব অধিকারের প্রতিধ্বনি শোনা যায় সেখানে ঐশী শিক্ষার আলোকরশ্মির দ্বারাই মৌলিক অধিকারের চেতনা জাগ্রত হয়েছে।
নরম্যান কাজিনস -এর “উই ট্রাস্ট ইন গড” (নিউ ইয়র্ক, ১৯৫৮ খৃ. সংস্করণ) শীর্ষক গ্রন্থে আমেরিকান সংবিধানের রচয়িতাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর বিস্তারিত আলোকপাত করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, বেনজামিন ফ্রাংকলিন, জর্জ ওয়াশিংটন, জন এডামস, টমাস জেফেরশন, জেমস মেডিশন, আলেকজান্ডার হ্যামিলটন, স্যামুয়েল এডাম, জন জে ও টমাস পেইন সকলেই খৃষ্টবাদের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন এবং তাদের চিন্তাধারার উপর তাদের বিশ্বাসের গভীর প্রভাব ছিল। জেমস মেডিশন ‘অধিকার’ – এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন:
“এখানে এক ব্যক্তির যে অধিকারই রয়েছে তা মূলত অপর ব্যক্তিগণের উপর খোদার পক্ষ থেকে আরোপিত হওয়ার মত কর্তব্য”- (পৃ: ১৭)।
অনুরূপভাবে বৃটেন ও ফ্রান্সের সংবিধানও যদি ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে অধ্যয়ন করা হয় তবে সেখানেও মৌলিক অধিকারের আসল উত্স ধর্মীয় শিক্ষা এবং বিশেষত ইউরোপের উপর ইসলামের গভীর প্রভাবের মধ্যে পাওয়া যায়।
কুরআন মজীদের পেশকৃত ইতিহাসের আয়নায় দেখা হলে প্রাকৃতিক অধিকার ও জন্মগত অধিকারের পরিভাষা ব্যবহারের অধিকার কেবল ইসলামেরই রয়েছে। কারণ এসব পরিভাষা সম্পর্কে পাশ্চাত্যের অধিকার সম্পর্কিত ধারণায় যে অষ্পষ্টতা বিদ্যমান রয়েছে তা এখানে বর্তমান নাই। ইসলাম এই প্রশ্নের সুষ্পষ্ট জবাব দেয় যে, এসব অধিকার কে নির্ধারণ করেছে। অন্যদিকে পাশ্চাত্যে প্রাকৃতিক অধিকারের মতবাদের পতাকাবাহীগণ বেনথাম ও অপরাপর আপত্তিকারীগণের এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারেনি যে, প্রকৃতি বলতে কি বুঝা যায়? এই অধিকার নির্ধারণকারী কর্তৃপক্ষ কে? অন্য কথায় এর পেছনে কি অনুমোদন আছে? ইসলাম অধিকারের প্রাকৃতিক দিক ও জন্মগত দিক সুষ্পষ্টভাবে পেশ করে উল্লেখিত ধরণের কোনো আপত্তির অবকাশ রাখেনি।
আইনগত দিক
এখন এসব অধিকারের আইনগত দিকের মূল্যায়ন করা যাক। এই প্রসঙ্গে একটি সাধারণ ভুল এই করা হয় যে, আমরা পাশ্চাত্যের পেশকৃত মৌলিক অধিকারের ধারণাকে মাপকাঠি হিসাবে সামনে রাখছি। অত:পর কুরআন ও হাদীস থেকে বেছে বেছে এমন সব অধিকারের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয় যা উল্লেখিত মানদন্ডে পুরোপুরি উত্তীর্ণ হয় এবং যা তার কার্যকর করার সীমিত গন্ডির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এরূপ চিন্তাধারার অবশ্যাম্ভাবী পরিণতি দাঁড়ায় এই যে, ইসলামের অধিকার ধারণা পাশ্চাত্যের অধিকার ধারণার অনুগামী হয়ে গৌণ বিবেচিত হয় এবং তার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য পূর্ণরূপে উদ্বাসিত হতে পারে না।
পাশ্চাত্যের মৌলিক অধিকারের পরিসর শুধুমাত্র ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে সীমিত। সেখানে ঐসব অধিকারকে মৌলিক অধিকার সাব্যস্ত করা হয় যা রাষ্ট্রের প্রশস্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বিপরীতে একজন সাধারণ নাগরিক লাভ করে থাকে। এগুলোর মর্যাদা প্রতিরক্ষামূলক ও আত্মরক্ষামূলক এবং তার মৌলিক উদ্দেশ্য ক্ষমতাহীন নাগরিকদেরকে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের অন্যায় অত্যাচার থেকে নিরাপদ রাখা। যে সংবিধানে এসব অধিকার অন্তর্ভূক্ত করা হয় তাতে নাগরিক ও রাষ্ট্রকে দুটি পৃথক পক্ষ দৃষ্টিগোচর হয়। সংবিধানকে তাদের মাঝে একজন সমঝোতাকারী বলে মনে হয় যার মধ্যে এক পক্ষের জন্য স্বীকৃত এখতিয়ারসমূহের এবং অপরপক্ষের জন্য স্বীকৃত অধিকার সমূহের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
পক্ষান্তরে ইসলামের সাধারণ নাগরিক ও তাদের রাষ্ট্রের শাসক গোষ্ঠী পরষ্পর প্রতিপক্ষ নয়, না নাগরিকদের অধিকার সমূহ শাসকগোষ্ঠীর স্বীকৃত আর না শাসক গোষ্ঠীর ক্ষমতা ও এখতিয়ার সমূহ নাগরিকদের মঞ্জুরকৃত। তাদের মধ্যে পারষ্পরিক সম্মতি ও ঐক্যমতের ভিত্তিতে রচিত এমন কোন আইনগ্রন্থও নাই যার মধ্যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুযায়ী অধিকার ও ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এই উভয় পক্ষই একই মর্যাদায় নিজেদের রব ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মহান আল্লাহর সাথে সাথে একটি অবশ্য পালনীয় চুক্তিতে আবদ্ধ। আল্লাহর খলীফা হিসাবে তাদের সকলের পদমর্যাদাও সমান। কারণ খেলাফত কোন বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে নয়, বরং সমষ্টিগতভাবে ( মিন হাইছিল জামাআতি) গোটা মুসলিম উম্মাহর উপর অর্পণ করা হয়েছে।
“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে আল্লাহ তাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেনই, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদের (মুমিনীন ও সালেহীনদের” ( সূরা নূর : ৫৫)।
উপরোক্ত আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, খেলাফতের প্রতিনিধিত্বমূলক কর্তৃত্ব সমষ্টিগতভাবে সমস্ত মুসলমানকে দেওয়া হয়েছে। এই কারণেই হযরত আবু বাকার সিদ্দীক রা: নিজেকে ‘আল্লাহর খলীফা’ খলীফাতুল্লাহ উপাধি গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিলেন। কারণ খেলাফত মূলত গোটা উম্মতকে দান করা হয়েছিল, তাদের বিশেষ কোন ব্যক্তিকে নয়। তাদের খেলাফতের অবস্থা এই ছিল যে, মুসলমানগণ নিজেদের মর্জি মোতাবেক তাদের খেলাফতের কর্তৃত্ব তাঁর উপর সোপর্দ করেন। খেলাফতের এই বৈশিষ্ট্যের দৃষ্টিকোণ থেকে হযরত উমার ফারূক রা: ‘আমীরুল মুমিনীন’ উপাধি গ্রহণ পছন্দ করেন এবং উক্ত পরিভাষা পরের খলীফায়ে রাশেদগণের উপাধি হিসাবে প্রচলিত থাকে।
মুসলমানদের আমীর এবং তার ইমারতের চতু:সীমায় বসবাসকারী নাগরিকগণ নিজ নিজ কর্মপরিসরে আল্রাহ নির্ধারিত সীমার আনুগত্য করতে বাধ্য। তাদের কর্তৃত্ব ও অধিকার পারষ্পরিকভাবে স্থিরীকৃত নয়, বরং প্রকৃত ক্ষমতার অধিকার মহান আল্লাহর স্থিরীকৃত। তারা উভয়ে কুরআন ও সুন্নাহর এমন এক পরিবর্তন অযোগ্য ও অপরিবর্তনীয় সংবিধানের অধীনে জীবন যাপন করতে বাধ্য যার কোন একটি দফাও তাদের মধ্যে নগণ্য ও উপেক্ষণীয় নয়। তাদের অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে কোন সংঘর্ষ নাই। এটা এমন দুটি পরষ্পর সংযুক্ত সীমা যার রেখা সমূহ কোথাও একে বেকে ছিন্ন করে না।
এই প্রেক্ষাপটে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্রে মৌলিক অধিকারের পরিসর অনেক ব্যাপক। দুনিয়ার সাধারণ সংবিধানগুলোর মত তা ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের পারষ্পরিক সম্পর্ক পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। কুরআনিক সংবিধানের প্রয়োগ ক্ষেত্র মানুষের গোটা জীবন পর্যন্ত বিস্তৃত। কুরআন মজীদ ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যেই নয়, আকীদা বিশ্বাস, ইবাদত বন্দেগী, চরিত্র নৈতিকতা, সমাজ সভ্যতা, অর্থনীতি, রাজনীতি, বিচার ব্যবস্থা, যুদ্ধ ও সন্ধি এবং জীবনের অপরাপর শাখায় পরিব্যপ্ত অসংখ্য বিষয় এমনভাবে সুসংগঠিত করে দিয়েছে যে, রাষ্ট্রের জন্য আইন প্রণয়নের খুব সীমিত সুযোগই আছে। আর এই সীমিত সুযোগের মধ্যেও স্বাধীনভাবে আইন প্রণয়ণের অনুমতি নাই, বরং এই শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, প্রতিটি আইন কুরআন হাদীসের বিধান ও তার প্রাণসত্তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
এখন আল্লাহর বিধান ও তাঁর রসুলের সুন্নাহ মানুষের জন্য যেসব অধিকার নির্ধারণ করেছে তা সংবিধানের অংশ হওয়ায়, রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উর্ধ্বে হওয়ায় এবং বিচার বিভাগের মাধ্যমে অর্জনযোগ্য হওয়ার কারণে কোনরূপ ব্যতিক্রম ছাড়াই সবগুলোই মৌলিক অধিকার হিসাবে গণ্য। এসব অধিকারের মধ্যে শুধুমাত্র জীবনের নিরাপত্তা, সম্মান সম্ভ্রমের নিরাপত্তা, মালিকানার নিরাপত্তা, ন্যায় বিচার লাভ, সমতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতার মত বিষয়গুলোই অন্তর্ভূক্ত নয়, বরং একটি নবজাত শিশুর দুধপানের সময়সীমা থেকে নিয়ে একজন নারীর মোহরের অধিকার পর্যন্ত সমস্ত অধিকার অন্তর্ভূক্ত-যা আল্লাহ ও তাঁর রসুল নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং যার মধ্যে কোনরূপ সংশোধনী আনয়নের এখতিয়ার কারো নেই। কুআন মজীদ মানুষের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর আরোপ হওয়ার মত বিধিনিষেধের জন্য “হুদুদুল্লাহ” ( আল্লাহ নির্ধারিত সীমা) পরিভাষা ব্যবহার করেছে। এই বাধ্যবাধকতা ব্যক্তি ও রাষ্ট্র উভয়ের উপর সমানভাবে আরোপিত হয়। আল্লাহ তাআলা যেসব জিনিস হালাল সাব্যস্ত করে তা থেকে উপকৃত হওয়ার অধিকার দিয়েছেন সেগুলোকে এখন কেউই হারাম সাব্যস্ত করতে পারবে না, এমনকি ইসলামী রাষ্ট্র বা গোটা জাতি একত্র হয়েও তা হারাম করতে পারবে না। এমনকি কোন ব্যক্তি নিজের ব্যক্তিগত জীবনের জন্যও তা হারাম করতে পারে না। এসব সীমারেখার আনুগত্য করা সম্পর্কে কুরআন পাকের নিম্নোক্ত হেদায়াতবাণী দেখা যেতে পারে। সূরা বাকারায় রোযা সম্পর্কিত বিধান সমূহ উল্লেখের পর বলা হয়েছে:
“এগুলো আল্রাহ নির্ধারিত সীমা, তার ধারে কাছেও যাবে না”-আয়াত নং-১৮৭।
ঈমানদার সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য সমূহ বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন: “আল্লাহর দিকে বারবার প্রত্যাবর্তনকারী (তওবাকারী) ইবাদতকারী, আল্লাহর প্রশংসাকারী, রোযা পালনকারী, রূকু ও সিজদাকারী, সৎকাজের নির্দেশ দানকারী, অসৎকাজে নিষেধকারী এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা সংরক্ষণকারী”- সূরা তওবা :১১২।
কুরআন মজীদ অতীব সুষ্পষ্ট বাক্যে বলে দিয়েছে যে, যেসব বিষয়ে আল্লাহর বিধান রয়েছে- সেই ক্ষেত্রে মানুষের আইন প্রণয়নের কোন এখতিয়ার নাই, হালাল হারাম ও জায়েয- নাজায়েয নির্ধারণের কোন অধিকারও তার নাই। তার কাজ কেবল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিধান অনুসরণ করা।
“তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট যা নাযিল করা হয়েছে-তোমরা তার অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকের অনুসরণ করো না”- সূরা- আরাফ :৩।
“আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুসারে যারা ফয়সালা করে না তারাই কাফের… যালেম… ফাসেক”- সূরা মায়িদা: ৪৪,৪৫,৪৭)।
হে মুমিনগণ আল্লাহ তোমাদের জন্য যেসব উৎকৃষ্ট জিনিস হালাল করেছেন তা তোমরা হারাম কর না এবং সীমা লংঘন কর না”- সূরা মায়িদা : ৮৭)।
“বল (হে নবী) তোমরা কি ভেবে দেখেছ আল্লাহ তোমাদের যে রিযিক দিয়েছেন তোমা যে তার কিছু হালাল ও কিছু হারাম করেছ? বল, আল্লাহ কি তোমাদের এরূপ অনুমতি দিয়েছেন, না তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করছ?”- সূরা ইউনুস: ৫৯।
“তোমাদের জিহবা এই যে মিথ্যা বিধান দেয়-এটা হালাল, এটা হারাম; এভাবে বিধান দিয়ে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ কর না”- সূরা নাহল : ১১৬।
আল্লাহ তায়ালা কেবল সাধারণ লোকদের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপরই বিধি নিষেধ আরোপ করেননি, বরং যেসব ব্যাপারে আল্লাহর বিধান বর্তমান আছে তার মধ্যে মহানবী সা: কেও নিজের মর্জি মত কোনরূপ সংশোধন আনয়নের অধিকার দান করেন নি।
“বল ( হে মুহাম্মাদ!) নিজের পক্ষ থেকে এই কিতাবে পরিবর্তন আনয়নের অধিকার আমার নেই। আমার প্রতি যা ওহী হয়- আমি কেবল তারই অনুসরণ করি। যদি আমি আমার প্রতিপালকের অবাধ্যাচরেণ করি তবে আমার আশংকা রয়েছে এক ভয়ংকর দিবসের শাস্তির শিকার হওয়ার”- সূরা ইউনুস: ১৫।
অতএব মহানবী সা: নিজের কোন কোন স্ত্রীর মনোতুষ্টির জন্য মধু না খাওয়ার শপথ করলে আল্লাহ তাআলা এজন্য তাঁর সমালোচনা করেন:
“হে নবী! আল্লাহ তোমার জন্য যে জিনিস হালাল করেছেন তুমি তা হারাম করছ কেন? ( তা কি এ জন্য যে,) তুমি তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি চাচ্ছ”- সূরা তাহরীম: ১১।
মহানবী সা: সাধারণ মুসলমানদের জন্য মধু হারাম করেননি। কারণ আল্লাহ পাকের হালালকৃত জিনিস হারাম করার কথা তো রসুলুল্লাহ সা: এর কল্পনায়ও আসতে পারে না। তিনি তা কেবল নিজের জন্যই নিষিদ্ধ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কার্যক্রম যেহেতু মুসলমানদের জন্য দলীল হওয়ার যোগ্য ছিল, তাই অনতিবিলম্বে তাঁকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হল, আল্লাহ পাক যে জিনিস হালাল সাব্যস্ত করেছেন তা আপনার নিজের জন্য হারাম করার এখতিয়ারও আপনার নেই।
একদিকে তো আল্লাহ তাআলার বিধান সম্পর্কে মহানবী সা: এর এখতিয়ারের ছিল এই অবস্থা, কিন্তু অপরদিকে কুরআন মজীদ একথাও সুষ্পষ্ট করে দেয় যে, যেসব ক্ষেত্রে সরাসরি আল্লাহর বিধান বর্তমান নেই অথবা তাঁর বিধানের ব্যাখ্যাদানের প্রয়োজন রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে আল্লাহর রসুলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং তাঁর মর্যাদা আল্লাহর বিধানেরই অনুরূপ। আল্লাহর রসূল যেহেতু এই দুনিয়াতে তাঁর রাজনৈতিক ও আইনগত সার্বভৌমত্বের প্রকাশক, তাই ভাষ্যকর ও আইন প্রণেতা হিসাবে তাঁর মর্যাদা নিম্নোক্ত আয়াত এভাবে নির্ধারণ করেছে:
مَّن يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ ۖ
অর্থ: “যে ব্যক্তি রসুলের আনুগত্য করে- সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল” (সূরা নিসা: ৮০)
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا
অর্থ: রসূল তোমাদের যা কিছু দেয় তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদের বিরত থাকতে বলে তা বর্জন কর”-(সূরা হাশর: ৭)।
আল্লাহর কুরআন ও রসুলের সুন্নাহর এই মর্যাদা ও অবস্থানের প্রতি দৃষ্টি রেখে ইসলামী রাষ্ট্রে কুরআন ও সুন্নাহর উপর ভিত্তিশীল সংবিধানের অধীনে মানুষের মৌলিক অধিকারের তালিকা প্রণয়ন করলে তাতে আল্লাহ ও তাঁর রসূল প্রদত্ত যাবতীয় অধিকার অন্তর্ভূক্ত হবে, তা জীবনের যে শাখার সাথেই সংশ্লিষ্ট হোক।
মৌলিক অধিকার( ফান্ডামেন্টাল রাইটস) ও আইনগত অধিকার (লিগ্যাল রাইটস) এর মধ্যে এছাড়া আর কি পার্থক্য হতে পারে যে, মৌলিক অধিকার বাতিলও করা যায় না এবং রহিতও করা যায় না। তা রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নের সাধারণ এখতিয়ারের আওতা বহির্ভূত। তা স্বয়ং সংবিধানে প্রদত্ত অস্বাভাবিক কর্মপন্থা ব্যতীত অন্য কোন পন্থায় সীমিত বা স্থগিত করা যায় না। তা (মৌলিক অধিকার) রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে এবং রাষ্ট্রের বিপরীতে নাগরিকগণকে নিরাপত্তা দান করে। কুরআন-সুন্নাহ প্রদত্ত এসব অধিকার বিচার বিভাগের মাধ্যমে অর্জন করা যায় এবং তার সাহায্যে প্রশাসন বিভাগকে অন্যায় অত্যাচার থেকে বিরত রাখা যায়। পক্ষান্তরে আইনগত অধিকার আইন প্রণয়নের সাধারণ সীমার আওতাভূক্ত এবং রাষ্ট্র যখন ইচ্ছা স্বীয় আইন প্রণয়ন ক্ষমতার মাধ্যমে তাতে সংশোধন আনতে পারে, হ্রাসবৃদ্ধি করতে পারে, অথবা বাতিল করতে পারে।
মৌলিক অধিকার ও আইনগত অধিকারের মধ্যকার এই পার্থক্য হৃদয়ঙ্গম করে চিন্তা করুন যে, কুরআন ও সুন্নাহ প্রদত্ত এমন প্রতিটি অধিকার- যা রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার আওতা বহির্ভূত, যা বিচার বিভাগের সাহায্যে অর্জনযোগ্য এবং যার সম্পর্কে স্বয়ং কুরআন ও সুন্নাহ রাষ্ট্রকে এমন কোন অস্বাভাবিক ক্ষমতা দান করেনি যার আশ্রয় নিয়ে সে বিশেষ অথবা জরুরী অবস্থার বাহানা দিয়ে উক্ত অধিকার বাতিল, সীমিত অথবা স্থগিত করতে পারে- তা কিসের ভিত্তিতে মৌলিক অধিকারের তালিকা বহির্ভূত রাখা যেতে পারে? শুধু এ জন্য যে, পাশ্চাত্য কেবলমাত্র ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে পারষ্পরিক সম্পর্কের সাথে সংশ্লিষ্ট অধিকার সমূহকে মৌলিক অধিকার গণ্য করে।এই যুক্তি তো পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণের জন্য দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু স্বয়ং মৌলিক অধিকারের প্রচলিত আইনতগত পরিভাষা ও তার তাৎপর্যের আলোকে এর কি ওজন আছে? যে অধিকার স্থির ও স্থায়ী বৈশিষ্ট্যে সম্পন্ন, রাষ্ট্র যা পরিবর্তন বা বাতিল করতে সক্ষম নয়, যা বিচার বিভাগের মাধ্যমে অর্জন করা যায়-তা আইনের যে কোনও ব্যাখ্যা অনুযায়ী অবশ্যই একটি মৌলিক অধিকার সাব্যস্ত হবে।
কোন দুগ্ধপোষ্য শিশুর মাকে যদি তালাক দেওয়া হয় তবে কুরআন মজীদ শিশু, তালাকপ্রাপ্তা নারী ও তালাকদাতা পুরুষের মধ্যে অধিকার ও কর্তব্যের নিম্নোক্ত ব্যবস্থা নির্ধারণ করে:
“যে পিতা তার সন্তানের দুধপানের সময়কাল পূর্ণ করতে চায়- সে ক্ষেত্রে মায়েরা পুরো দুই বছর নিজেদের সন্তানদের দুধ পান করাবে। এ অবস্থায় সন্তানের পিতাকে যথারীতি মায়েদের আহার ও পোশাকের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু কারো উপর তার সামর্থের অধিক বোঝা চাপানো উচিত নয়। কোন মাকে এজন্য কষ্ট দেওয়া যাবে না যে সন্তানটি তার। আবার কোন পিতাকেও এ জন্য কষ্ট দেওয়া যাবে না যে, এটা তারই সন্তান। দুধ দানকারীনীর এ অধিকার যেমন সন্তানের পিতার উপর আছে-তেমনি আছে তার ওয়ারিসদের উপরও। কিন্তু উভয় পক্ষ যদি পারষ্পরিক সম্মতি ও পরামর্শক্রমে দুধপান ছাড়াতে চায় তবে এতে তাদের কারো অন্যায় হবে না। আর তোমরা নিজেদের সন্তানদের অপর কোন স্ত্রীলোকের দুধ পান করাতে চাইলে তাতেও কোন দোষ নেই, অবশ্য যা কিছু মূল্য নির্ধারিত হবে তা যদি নিয়মিত আদায় কর”- সূরা বাকারা: ২৩৩।
উপরোক্ত আয়াতে এক নবজাতক শিশু, তারা মা ও তার পিতার জন্য যেসব অধিকার নির্ধারণ করা হয়েছে তা সবই মৌলিক অধিকারের আওতায় আসে। কারণ তা রাষ্ট্রের সংবিধানের একটি অংশ, মহান আল্লাহর হুকুমে নির্ধারিত, বিচার বিভাগের মাধ্যমে অর্জনযোগ্য এবং রাষ্ট্র সংবিধান লংঘন করে এ বিষয়ে স্বতন্ত্র কোন আইন রচনা করতে পারে না। কুরআন মজীদ একটি শিশুর জন্য দুধ পানের যে সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে রাষ্ট্র বা সরকারের তার মধ্যে এক দিনেরও হ্রাসবৃদ্ধি করার এখতিয়ার নাই। নিম্নোক্ত ঘটনা থেকে ইসলামী রাষ্ট্রে শিশুর মর্যাদা সম্পর্কে অনুমান করা যায়:
জুহায়না গোত্রের শাখা গামের গোত্রের একটি স্ত্রী লোক মহানবী সা: এর নিকট উপস্থিত হয়ে চারবার যেনার স্বীকারোক্তি করল এবং জানাল যে, সে এর ফলে গর্ভবতী হয়েছে। প্রথমবারের স্বীকারোক্তি শুনে রসুলুল্লাহ সা: তাঁকে বলেন- “ফিরে যা এবং আল্লাহর নিকট তওবা কর, ক্ষমা প্রার্থনা কর। কিন্তু সে বলল, হে আল্লাহর রসুল! আপনি কি আমাকেও মায়েযের ন্যায় ফিরিয়ে দিতে চান? আমি তো যেনার কারণে গর্ভবতী হয়েছি। তিনি বললেন: আচ্ছা তুমি যদি নাই মান তবে ফিরে যা সন্তান প্রসবের পর এসো। সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর সে শিশু সহ তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, এখন আমাকে পাক পবিত্র করুন। তিনি বললেন: ফিরে যাও, শিশু দুধ ছাড়ার পর এসো। দুধ ছাড়ার পর সে শিশু সহ আবার এলো এবং সাথে এক টুকরা রুটিও আনলো। তাঁর সামনে শিশুর হাতে রুটি দিয়ে সে বলল, হে আল্রাহর রসূল! এই শিশু এখন দুধ ছেড়েছে, দেখুন সে রুটি খাচ্ছে। মহানবী সা: শিশুর লালন পালনের ভার এক ব্যক্তির উপর অর্পণ করলেন এবং তাকে রজম ( পাথর নিক্ষেপে হত্যা) করার নির্দেশ দিলেন-(তাফহীমুল কুরআন, বাংলা অনু: ৯ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১২৩, ১৯৭৮ সালের সংস্করণ)।
পূর্বোক্ত ঘটনা থেকে জানা যায় যে, মহানবী সা: প্রথমত জীবনের নিরাপত্তার খাতিরে এবং দ্বিতীয়বার দুধপান কাল পূর্ণ হওয়ার লক্ষ্যে শাস্তি কার্যকরণ স্থগিত রাখেন। অত:পর তিনি যখন শিশুকে রুটি খেতে দেখে আশ্বস্ত হন যে, তার জীবন রক্ষার জন্য মায়ের দুধের প্রয়োজন নাই তখন শাস্তির দন্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেন। এই ঘটনায় দুটি মৌলিক অধিকার প্রভাবিত হত: (এক) জীবনের নিরাপত্তা, (দুই) দুধপানের নির্দিষ্ট সময়সীমার পূর্ণতা। মহানবী সা: এই দুটি অধিকারের দিকে লক্ষ্য রেখে যেনার মত মারাত্মক অপরাধের শাস্তি সাময়িকভাবে মুলতবী করে সুষ্পষ্ট করে দিলেন যে, ইসলামে সাধারণ নাগরিক তো কোথায় মায়ের পেটে বর্ধিত শিশু এবং দুধপানরত শিশুর অধিকারেরও কত গুরুত্ব ও মর্যাদা রয়েছে। রসুলুল্লাহ সা: এর সিদ্ধান্ত একটি আইনগত নজির এবং এখন একই ধরণের ঘটনায় ইসলামী রাষ্ট্রের ভিন্নরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নাই। তার আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রসুলুল্লাহ সা: এর উপরোক্ত সিদ্ধান্তের অনুগত থাকতে বাধ্য এবং এই বাধ্যবাধকতা শিশুর জন্মের অধিকার ও দুধপানের অধিকারকে পর্যন্ত মৌলিক অধিকারের তালিকাভূক্ত করেছে।
মহানবী সা: এর বিচারালয়ের এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আরও একটি অধিকার নির্দিষ্ট হয়। তা এই যে, অবৈধ সম্পর্কের পরিণতিতে জন্মগ্রহণকারী শিশুকে সম্পূর্ণ নির্দোষ মনে করতে হবে এবং ইসলামী রাষ্ট্র তার পিতা মাতাকে মৃত্যুদন্ড দিলে তার লালন পালন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে। শিশু জন্মের অধিকার ও দুধপানের অধিকার সহ লালন পালনের অধিকারও লাভ করে এবং তাকে ঘৃণার চোখে দেখা যাবে না, বরং সমাজে সে অন্যান্য শিশুর মত সমান মর্যাদার অধিকারী হবে।
এখন আরও একটি অধিকারের প্রতি লক্ষ্য করুন যাকে নৈতিক অধিকারের আওতাভূক্ত করা হয়, কিন্তু তাও মূলত মৌলিক অধিকার, আল্লাহ ও তাঁর রসুল তাকে এই অধিকার দিয়েছেন। মহান আল্লাহর বাণী:
“পিতা মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তোমাদের নিকট যদি তাদের কোন একজন অথবা উভয়ে বৃদ্ধাবস্থায় থাকে তবে তুমি তাদেরকে উহ! পর্যন্ত বলবে না, তাদের ভৎসনা করবে না, বরং তাদের সাথে বিশেষ মর্যাদা সহকারে কথা বলবে এবং বিনয় ও নম্রতা সহকারে তাদের সাথে বিশেষ মর্যাদা সহকারে তাদের সামনে নত হয়ে থাকবে; আর এই দোয়া করতে থাকবে: হে প্রভু! তাদের প্রতি অনুগ্রহ কর, যেমন করে তারা স্নেহ বাৎসল্য সহকারে আমার বাল্যকালে লালন-পালন করেছেন” বনী ইসরাঈল: ২৩-২৪।
উপরোক্ত আয়াতের ভিত্তিতে মহানবী সা: এর বিচারালয় থেকে দেওয়া দুটি সিদ্ধান্তের নজীর লক্ষনীয়:
১. এক ব্যক্তি মহানবী সা: এর দরবারে নিজ মাতা পিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করল যে, তার পিতা তার ধনসম্পদ ভোগ করছে। তিনি বলেন: তুমি এবং তোমার সম্পদ উভয়ের মালিক তোমার পিতা। অত:পর তিনি লোকটির পিতাকে নির্দেশ দেন, তুমি তার মাল কাজে লাগাও এবং সে যদি তাতে অসম্মত হয় তবে আমাকে জানাবে। আমি তার বিরুদ্ধে তোমাকে সাহায্য করব”- (আদালতে নববী কে ফায়সেল, আবদুল্লাহ কুরতবী, আদবিস্তান, লাহোর সং, ১৯৫৬খ্রি:, পৃ: ২৯০।
২. এক ব্যক্তি রসুলুল্লাহ সা: এর নিকট আবেদন করল, হে আল্লাহর রসুল! আমার পিতা আমার নিকট সম্পদ চাচ্ছেন। তিনি বলেন: তাকে দাও। সে বলল, তিনি চান যে, আমি মালিকানা ত্যাগ করি। তিনি নির্দেশ দিলেন: তুমি তার অনুকূলে মালিকানা ত্যাগ কর। হাদীসের রাবী বলেন, মহানবী সা: এই ব্যক্তিকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন: নিজ পিতা মাতার অবাধ্যাচরণ কর না। তারা যদি তোমার নিকট এরূপ দাবী করে যে, তুমি দুনিয়া ছেড়ে চলে যাও, তবে তুমি তাদের জন্য তাই কর” ( ঐ, পৃ: ২৯০)।
আল্লাহ তাআলার নির্দেশ এবং মহানবী সা: এর বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তের আলোকে ফকীহগণ পিতা মাতার অধিকার ও এখতিয়ার সমূহের বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, এগুলো কেবল নৈতিক উপদেশই নয়, বরং মৌলিক অধিকারও-যা কোন রাষ্ট্র বা সরকার নিজের আইন প্রণয়নের ক্ষমতাবলে পরিবর্তন করতে পারে না। সে সন্তানকে পিতামাতার ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা থেকে দায়মুক্ত করে দিতে পারে না।
এখন মোহরের বিষয়টি দেখুন। নিজ স্বামীর উপর স্ত্রীর অধিকার এই যে, স্বামী বিবাহের চুক্তিপত্র মোতাবেক স্ত্রীর মোহর পরিশোধ করতে বাধ্য। স্ত্রীর এই অধিকার স্বয়ং কুরআন মজীদ নির্ধারণ করেছে।
وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً ۚ فَإِن طِبْنَ لَكُمْ عَن شَيْءٍ مِّنْهُ نَفْسًا فَكُلُوهُ هَنِيئًا مَّرِيئًا [٤:٤]
অর্থ: “আর তোমরা নারীদের মোহর স্বত: প্রবৃত্ত হয়ে ( ফরজ মনে করে) পরিশোধ কর। অবশ্য সন্তুষ্ট মনে তারা মোহরের কিছু অংশ ছেড়ে দিলে তোমরা তা স্বাচ্ছন্দে ভোগ করবে”- সূরা নিসা: ৪)
দাম্পত্য জীবনের যে স্বাদ তোমরা তাদের থেকে আস্বাদন কর তার বিনিময়ে তাদের মোহর বাধ্যতামূলকভাবে পরিশোধ কর”- সূরা নিসা: ২৪)।
কুরআন মজীদ মোহরকে নারীদের এমন এক অধিকার সাব্যস্ত করেছে, যা পরিশোধ করা স্বামীর একান্ত কর্তব্য। অবশ্য স্ত্রী স্বেচ্ছায় এই দাবী ত্যাগ করলে স্বতন্ত্র কথা। ইসলামী রাষ্ট্রের অবশ্য এই এখতিয়ার নাই যে, সে কোনরূপ আইন প্রণয়ের মাধ্যমে নারীদের উক্ত অধিকার রহিত বা সীমিত করতে পারে। অতএব হযরত উমার ফারূক রা: যখন তাঁর খেলাফতকালে নারীদের মোহরের উপর বিধি নিষেধ আরোপ করে তা সীমিত করতে চাইলেন এবং ভাষণদানকালে বললেন: “নারীদের মোহরের পরিমাণ চল্লিশ উকিয়া রূপার অধিক ধার্য কর না- সে যত বড় সম্পদশালী লোকের কন্যাই হোক না কেন। যে অধিক মোহর দেবে আমি তার থেকে বাইতুল মালের জন্য অধিক অর্থ আদায় করব।”
তখন নারীদের কাতার থেকে দীর্ঘদেহী এক মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলেন- “ আপনার এই অধিকার নাই”। জিজ্ঞেস করা হল, তা কিভাবে? মহিলা বলেন, তা এজন্য যে, মহান আল্লাহ বলেন:
وَآتَيْتُمْ إِحْدَاهُنَّ قِنطَارًا فَلَا تَأْخُذُوا مِنْهُ شَيْئًا ۚ أَتَأْخُذُونَهُ بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُّبِينًا
“আর তোমরা যদি তাদের কাউকে প্রচুর সম্পদও দিয়ে থাক তবে তা থেকে কিছুই ফেরত নিও না। তোমরা কি মিথ্যা অপবাদ এবং প্রকাশ্য পাপাচারের মাধ্যমে তা গ্রহণ করবে?” (সূরা নিসা: ২০)।
এই উত্তর শুনে হযরত উমার ফারূক রা: বলেন, মহিলা যথার্থই বলেছেন, পুরুষ লোকটিই ভুল করেছে” (তানতাবী, উমার ইবনুল খাত্তাব, লাহোর ১৯৭১ খ্রি: পৃ: ৫৩১)।
অতএব সাথে সাথেই তিনি নিজের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেন। আইনের সাহায্যে তিনি যে অধিকার সীমিত করতে চাচ্ছিলেন, কুরআনের বিধান সামনে আসতেই তা থেকে বিরত থাকেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, ইসলামী রাষ্ট্রে নারীর মোহর লাভের অধিকার মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। তা রহিত, সীমিত বা স্থগিত করার কোন এখতিয়ার রাষ্ট্রের নাই।
অনুরূপভাবে কিসাব, রক্তপণ, খোরপোষ, উত্তরাধিকার, ওসিয়াত, বিবাহ ও তালাক এবং তাযীর ( দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি) ও মুহারিবাত ( যুদ্ধ) এর সাথে সংশ্লিষ্ট সেই সব অধিকারকে মৌলিক গণ্য করা হবে যা আল্লাহর কিতাব ও রসুলুল্লাহ সা: এর সুন্নাতের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে। শুধু এতটুকুই নয় যে, তার মধ্যে রদবদল করার এখতিয়ার ইসলামী রাষ্ট্রের নাই, বরং সে মহান আল্রাহর নির্দেশের ভিত্তিতে তা কার্যকর করতে বাধ্য। এখানে ঐসব অধিকারের মর্ম কেবল নিরাপত্তামূলক ( ডিফেনসিভ) ও আত্মরক্ষামূলকই ( প্রটেকটিভ) নয়, বরং ইতিবাচক ( পসেটিভ) এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব এই যে, সে তার যাবতীয় ক্ষমতা ও উপায়-উপকরণ কাজে লাগিয়ে তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে।
শরীআত যেসব ব্যাপারে কোন আইনবিধান নির্ধারিত করেনি কেবল সেসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করবে। যেমন বর্তমান আধুনিক রাষ্ট্র্ ইসলামের আইন প্রণয়নের নীতিমালা অনুযায়ী-নির্বাচন, সংসদের কার্যপ্রণালী, আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বানিজ্য, লেনদেন, জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেমন রেলওয়ে, বিদ্যুত, পরিবহন, গ্যাস ও পানি সরবরাহ, গৃহনির্মাণ,শিক্ষা ব্যবস্থা, শিল্প ও কারিগরি, মজুরী ও বেতন, সরকারী কর্মচারী, শ্রমিক ও কৃষকদের কল্যাণ প্রচেষ্ঠা এবং অনুরূপ অন্যান্য বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট বিধান রচনা করতে পারে। এসব আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত অধিকার সমূহকে আইনগত অধিকার ( লিগ্যাল রাইটস) বলা হবে। এসব বিধান স্থান কাল পাত্রভেদে এবং পরিবেশ পরিস্থিতির ধরণ অনুযায়ী রচনা করতে হবে। এই বিধান বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন রূপ হবে এবং তার দ্বারা বিভিন্নরূপ অধিকার নির্ধারিত হবে। যেমন পাকিস্তান ও বাংলাদেশে নাগরিকত্ব লাভের অধিকার পরষ্পর থেকে ভিন্ন রূপ হতে পারে। কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহ কর্তৃক নির্ধারিত বিধান স্থায়ী ও বিশ্বজনীন, স্থান কালের সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে, অবিচ্ছিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য, রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের উর্ধ্বে। পৃথিবীর যে এলাকায়ই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে সে এসব বিধান হুবহু কার্যকর করতে বাধ্য। তাই এসব অধিকার “মৌলিক অধিকারের” তালিকাভূক্ত হবে।
এখানে একটি যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন তোলা যায় এবং তা এই যে, মৌলিক অধিকারের এই ব্যাখ্যা কেবল মুসলমানদের জন্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে, যেসব লোক- আল্লাহ, কুরআন, আখেরাত ইত্যাদি বিশ্বাস করে না তারা এই ব্যাখ্যা কিভাবে গ্রহণ করতে পারে? এই অবস্থায় তাদের মৌলিক অধিকারের তালিকা কিরূপ হবে? ইসলামী রাষ্ট্রে তাদের এবং মুসলমানদের মৌলিক অধিকারের মধ্যে কি কোনরূপ পার্থক্য হবে?
এই যুক্তিসঙ্গত প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পূর্বে আমাদের উত্তমরূপে জানা দরকার যে, ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকদের অবস্থা ( পজিশন) কিরূপ হবে? ইসলামী রাষ্ট্র পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের মত কোন জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র নয়। এখানে কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের, বর্ণের ভাষাভাষীর বা আঞ্চলিক গোষ্টীর রাজত্ব নয়, এটা একটা আদর্শিক রাষ্ট্র। এর সর্বময় ক্ষমতার নিরংকুশ অধিকারী ও আইনদাতা হলেন এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ। তিনি কুরআন পাকের সুষ্পষ্ট বিধান ও দিকনির্দেশনার মাধ্যমে বলে দিয়েছেন যে, এই পৃথিবীর বুকে তাঁর কি ধরণের মানব সমাজ কাম্য। তিনি তাঁর রসুলের মাধ্যমে নিজের সার্ব ভৌমত্বের একটি বাস্তব নমুনাও আমাদের সামনে পেশ করেছেন। মুসলমানদের রাজত্ব যাকে পরিভাষাগতভাবে ‘খেলাফত’ বলা হয় তা একটি প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা যা প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারীর বিধান অনুযায়ী ও তাঁর নির্ধারিত সীমার মধ্যে অবস্থান করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিচালনা করতে আদিষ্ট। এই রাষ্ট্রের নাগরিকদের দ্বিবিধ মর্যাদা রয়েছে। একটি হল মানুষ হিসাবে এবং অপরটি হল মুসলিম ও অমুসলিম হিসাবে। তাদের প্রথম মর্যাদা সৃষ্টিগতভাবেই নির্ধারিত এবং দ্বিতীয় মর্যাদা তাদের স্বেচ্ছায় ঈমান আনা বা না আনার ভিত্তিতে। প্রথমোক্ত মর্যাদার ভিত্তিতে সকল মানুষ সমান, বংশ-বর্ণ-গোত্র-ভাষা ও ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে সকল পার্থক্য ভিত্তিহীন। আল্লাহর নিকট এগুলোর স্বতন্ত্র কোন মর্যাদা নাই। মহান আল্লাহর বাণী:
(আরবী***)
অর্থ: “তিনি তোমাদের একই জান থেকে সৃষ্টি করেছেন” (যুমার: ৬)। সূরা নিসার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে: “হে মানুষ! তোমরা নিজেদের প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদেরে একটি জীবন থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যিনি তাদের দুজন থেকে অসংখ্য নর নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন।”
অপর এক স্থানে বলা হয়েছে: “ এই যে তোমাদের জাতি তা তো একই জাতি এবং আমিই তোমাদের প্রতিপালক, অতএব আমার ইবাদত কর” -সূরা যুমার: ৯২।
আল্লাহ পাকের দৃষ্টিতে গোটা মানবজাতি একই উম্মত। তিনি যেহেতু মুসলিম অমুসলিম সকলের স্রষ্টা, মালিক ও রিযিকদাতা, তাই তিনি নিজের মানবীয় সৃষ্টির জন্য যেসব অধিকার নির্ধারণ করেছেন সে ব্যাপারে সকলে সমান মর্যাদার অধিকারী। তিনি অমুসলিমদের জান মাল ও ইজ্জত আব্রুর হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন। সৃষ্টিগত দিক থেকে সমতা বিধানের পর এখন আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে তাদের কর্মধারা ও চিন্তাধারার ভিত্তিতে যার জন্য স্বয়ং মানুষই দায়ী-দুইভাগে বিভক্ত ঘোষণা করেছেন:
“সূচনায় সমস্ত মানুষ ছিল একই জাতিভূক্ত (অত:পর এই অবস্থা অটুট থাকল না এবং তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হল)। অত:পর আল্লাহ নবীগণকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেন”- সূরা বাকারা : ২১৩।
“প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ ছিল একই জাতিভূক্ত, পরে তারা মতভেদ সৃষ্টি করে” – সূরা ইউনুস: ১৯।
মানবগোষ্ঠীর বিভক্তির কারণ তাদের অবাধ্যাচার ও বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপ। তারা আল্লাহর দেওয়া জীবন বিধান ত্যাগ করে নিজেরা মনগড়া মত ও পথ গড়ে তোলে এবং তার ভিত্তিতে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে এক জাতিকে হাজারো জাতিতে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। মানবজাতিকে পুনরায় একতার বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য আল্লাহ তাআলা আম্বিয়ায় কেরামের মাধ্যমে নিজের হেদায়াতবাণী প্রেরণ করেন। কিন্তু মানুষ নিজের দূর্ভাগ্যবশত: ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। আল্লাহ তাআলার সেই হেদায়েতের বাণী আজও কুরআন মজীদের আকারে মানব জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং এক জাতিতে পরিণত হওয়ার আহবান জানাচ্ছে। কুরআন কোন বিশেষ জাতি বা এলাকার জন্য নয়, বরং গোটা মানবজাতির পথ প্রদর্শনের জন্য নাযিল হয়েছে। একইভাবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ‘রহমাতুল-লিল-মুসলিমীন’ ( মুসলমানদের জন্য করুণাস্বরূপ) হিসাবে নয়, বরং ‘রহমাতুল-লিল- আলামীন’ ( বিশ্ববাসীর প্রতি করুণার আধার) করে পাঠানো হয়েছে। কুরআন মজীদ আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি ঈমানদারদের জন্য যেসব অধিকার নির্ধারণ করেছে তা মূলত গোটা মানব জাতির জন্য। কুরআনের দাওয়াত এই যে, প্রতিটি মানুষ আল্লাহর অনুগত দাস হয়ে এসব অধিকার লাভের যোগ্য হয়ে যাক এবং তাকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীতে সম্মানজনক জীবন যাপন করুক। মুসলমান কোন বিশেষ বংশ বা জাতির নাম নয়, ঈমানদার জনগোষ্ঠীর নাম। তাই পৃথিবীর যে কোন এলাকায় বসবাসকারী এবং যে কোন বর্ণ বা গোত্রের সাথে সম্পর্কিত মানুষ যখনই কলেমা তাইয়েবা পাঠ করে নিজের মুসলিম হওয়ার ঘোষণা দেয় তখনই ইসলামের গন্ডিতে প্রবেশ করে মুসলমানদের সমান অধিকার লাভ করে, যেগুলো আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদের জন্য নির্ধারণ করেছেন।
এখন যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলাকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং কুরআনকে নিজের জীবন বিধান ও দেশের সংবিধান হিসাবে গ্রহণ করেছে তার মর্যাদা এবং যে গ্রহণ করেনি তার মর্যাদা সম্পূর্ণ সমান হওয়া বিবেক-বুদ্ধির সুষ্পষ্ট পরিপন্থী। আমেরিকা, বৃটেন, রাশিয়া বা অন্য কোন দেশের সংবিধানের আনুগত্য করার শপথ গ্রহণকারী এবং তা প্রকাশ্যে অমান্যকারীর মর্যাদা কি এক হতে পারে? এভাবে প্রকাশ্যে সংবিধান অমান্যকারীকে তো সংশ্লিষ্ট দেশে বসবাসের অনুমতিই দেওয়া হয় না এবং তাকে বিশ্বাসঘাতক সাব্যস্ত করে ফাঁসি দেওয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। তাহলে ইসলামী রাষ্ট্রের নিকট এই আশা কেন করা হবে যে, যে ব্যক্তি তার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সত্তাকে “সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী” হিসাবে স্বীকৃতি দেয় না এবং তার সংবিধানকে নিজের সংবিধান হিসাবে গ্রহণ করে না- এরূপ ব্যক্তিকে তা মান্যকারীদের কাতারে অন্তর্ভূক্ত করে সমান মর্যাদা দিতে হবে? শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর কোন্ আইনগত বা নৈতিক ব্যবস্থা তার গ্রহণকারী ও প্রত্যাখানকারীকে সমান মর্যাদা দান করে? এই জটিলতা মূলত: ইসলামকে একটি ‘ধর্ম’ মনে করার এবং রাষ্ট্রীয় বিষয় সমূহের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক না থাকার ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী চিন্তাধারা থেকে সৃষ্ট। কিন্তু আল্লাহ তাআলাকে ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক এবং কুরআন ও সুন্নাহকে তার সংবিধান মেনে নেওয়ার পর এই দ্ব্যর্থবোধক প্রশ্নেরে কোন অবকাশ থাকে না যে, ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিম ও অমুসলিমগণ সমান মর্যাদার অধিকারী নয় কেন? আল্লাহকে মান্যকারী এবং তাঁকে বা তাঁর নিরংকুশ সার্বভৌমত্ব অস্বীকারকারীকে এক সমান মনে করা হয় না কেন?
ইসলামের এই দিকটি সমালোচিত হওয়ার পরিবর্তে প্রশংসিত হওয়ার যোগ্য যে, সে তার রাষ্ট্রীয় সীমার মধ্যে আল্লাহদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতকদের কেবল নিরাপদে বসবাসেরই সুযোগ দেয় না, বরং তাদেরকে মানবীয় অধিকারের বেলায় মুসলমানদের সমান মর্যাদা দান করে। তাদের মধ্যে পার্থক্য কেবল এতটুকু যে, মুসলমানগণকে আল্লাহ তাআলার রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেওয়ার ভিত্তিতে তার বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বশীল বানানো হয়েছে, পক্ষান্তরে অমুসলিমগণ তাঁর এই সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে না নেওয়ার কারণে তাদেরকে তার বাস্তবায়নের জিম্মাদারীতে অংশীদার বানানো হয়নি। তারা আল্লাহর উপর ঈমান আনলে সরাসরি এই জিম্মাদারীর সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার উপযুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু তারা যতক্ষণ ঈমান না আনবে ততক্ষণ তাদেরকে সেই নিরংকুশ সার্বভৌমত্বের মালিক কি করে নিজের বিধান ও পথ নির্দেশ বাস্তবায়নের জিম্মাদারীতে শরীক করতে পারেন?
(আরবী***)
অর্থ: “তবে কি যে ব্যক্তি মুমিন হয়েছে- সে পাপাচারীর ন্যায়? এরা সমান নয়”-সূরা সাজদা: ১৮।
অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে: “হে মুমিনগণ!তোমাদের আপনজন ব্যতীত অপর কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ কর না, তারা তোমাদের অনিষ্ট সাধণে ত্রুটি করবে না। যা তোমাদের বিপদে ফেলে তাই তারা কামনা করে”- সূরা আল ইমরান: ২৮)।
একই উপদেশ অত্যন্ত তাকিদ সহকারে পুনরায় উল্লেখ করা হয়েছে: “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের পিতাগণ ও ভাইগন যদি ঈমান অপেক্ষা কুফরকে অগ্রাধিকার দেয় তবে তাদেরকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ কর না। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করে তারাই যালেম”- সূরা তওবা: ২৩।
স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে এই পার্থক্য রেখা টেনেছেন। এর কারণ মুসলমানদের কোন গোত্রগত, ভৌগোলিক, জাতীয় বা ধর্মীয় গোষ্ঠীবদ্ধতা নয়। আল্লাহ তাআলার প্রকৃত ইচ্ছাই তাই। বরং মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে পৃথিবীতে এই উদ্দেশ্যে নিয়োগ করা হয়েছে যে, তারা আল্লাহর বাণী প্রতিটি মানুষের নিকট পৌঁছে দেবে এবং তারা ইসলামের গন্ডিতে প্রবেশ করে যে কোন প্রকারের দাসত্ব থেকে মুক্তিলাভ করবে এবং ঈমানদারদের জন্য নির্ধারিত যাবতীয় অধিকারে সমভাবে অংশীদার হবে পাশ্চাত্যবাসীদের মত তাদের চিন্তাধারা এরূপ নয় যে, জগতবাসী তাদের ধর্ম তো গ্রহণ করবে কিন্তু তাদের রাজনৈতিক বিজয় ও আধিপত্যে অংশীদার হতে পারবে না। অমুসলিমদের সম্পর্কে মুসলমানদের চিন্তাধারার একটি দৃষ্টান্ত দেখুন। রবীআ ইবনে আমের রা: কাদেসিয়ার যুদ্ধের পূর্বে পারস্য বীর রুস্তম ও তার সভাসদদের সম্বোধন করে বলেন:
“আল্লাহ তাআলা আমাদের এই উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছেন যে, তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী আমরা তাঁর বান্দাদের যাবতীয় প্রকারের গোলামী থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে লিপ্ত করব, পার্থিব জগতের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত থেকে মুক্ত করে পারলৌকিক জীবনের বিশালতায় পৌঁছিয়ে দেব এবং ধর্মীয় নির্যাতন ও বাড়াবাড়ি থেকে শৃঙ্খলমুক্ত করে ইসলামের ন্যায়-ইনসাফের ছায়াতলে নিয়ে আসব” ( সায়্যিদ কুতুব শহীদ, জাদাহ ওয়া মানযিল, উর্দু অনু: লাহোর ১৯৭১ খৃ: পৃ: ৩৯৭।
এই দাওয়াত সত্তেও কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের কুফরীর উপর অবিচল থাকে তবে সে নিজেই ইসলামী রাষ্ট্রে একজন জিম্মী হিসাবে বসবাসের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে। ইসলামী রাষ্ট্র তাকে ভীতি প্রদর্শন করে বা জোরপূর্বক ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করতে পারে না। কারণ এ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদের নির্দেশ হল: লা ইকরাহা ফিদ দীন। অর্থ: ধর্মে কোন জোর জবরদস্তি নাই। কিন্তু সাথে সাথে সে উপরে উল্লিখিত কুরআনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে মুসলমানদের সমান মর্যাদাও দিতে পারে না। কুরআন ও হাদীসে তাদের জন্য মানুষ হিসাবে এবং জিম্মী হিসাবে যেসব অধিকার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্র তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনে ও তার বাস্তবায়ন করতে বাধ্য। এখানে কারো ভ্রান্তির শিকার হওয়া উচিত নয় যে, জিম্মীদেরকে মুসলমানদের তুলনায় কোন নিম্নতর বা দ্বিতীয় স্তরের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত ব্যাপার এর সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রথমত ‘জিম্মী’ শব্দটি সম্পর্কে চিন্তা করে দেখতে হবে। এই পরিভাষা দ্বারা সেইসব লোকদের বুঝানো হয়েছে যাদের জানমাল, ইজ্জত-আব্রু এবং অন্যান্য সকল অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব মুসলমানরা নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র এমনিতেই প্রত্যেক নাগরিকের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য দায়িত্বশীল, কিন্তু অমুসলিমদের জন্য উপরোক্ত ধরণের একটি পরিভাষা ব্যবহার করে-যার মধ্যে স্বয়ং জিম্মাদারীর উপাদান বিদ্যমান রয়েছে- তাদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার দায়িত্বের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। তা কেবল পৃথিবীকে দেখানোর জন্য করা হয়নি বরং তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসুলের বিধান মূলত তাই। এই মাত্র আপনাদের দৃষ্টির সামনে দিয়ে সেই আয়াত অতিক্রম করেছে যাতে মুসলমানদের কাফেরদের থেকে পৃথক থাকতে এবং তাদেরকে নিজেদের অন্তরঙ্গ বন্ধু না বানাতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু এখন চিত্রের অপর পিঠ দেখুন। ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে সকলের সাথে সমান ব্যবহারের নির্দেশ দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন:
“হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় নীতির উপর অবিচল থাক এবং ইনসাফের সাক্ষ্যদাতা হও। কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা তোমাদের যেন কখনও সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না কর, সুবিচার করবে, তা তাকওয়ার সাথে সামঞ্জস্যশীল এবং আল্লাহকে ভয় করবে, তোমরা যা কিছু কর সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল”- সূরা মায়িদা: ৮।
“হে ঈমানদারগণ! ইনসাফের ধারক হও এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে সাক্ষী হও, যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতা মাতা ও আত্মীয় স্বজনের বিরুদ্ধে যায়, আর পক্ষদ্বয় ধনী কিংবা গরীব যাই হোক- তাদের সকলের অপেক্ষা আল্লাহর এই অধিকার অনেক বেশী যে, তোমরা তাঁর দিকেই অধিক লক্ষ্য রাখবে। অতএব নিজেদের নফসের খাহেশের বশর্বর্তী হয়ে ন্যায় বিচার থেকে বিরত থেক না” সূরা নিসা: ১৩৫।
আনসারদের বানূ যাফার গোত্রের তো’মা নামক এক ব্যক্তি এক আনসারীর লৌহ বর্ম চুরি করে। অত:পর শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়ার জ্য সে তা এক ইহুদীর নিকট গচ্ছিত রেখে তার উপর চুরির অপবাদ আরো করে। গোত্রের লোকেরাও তাকে বাঁচানোর জন্য একবাক্যে ইহুদীর উপর চুরির অপবাদ আরোপ করে। তারা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট তোমার ঈমানদার হওয়া এবং ইহুদীর মুশরিক হওয়ার ভিত্তিতে তার সাফাই গ্রহণ না করে তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে। সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ইহুদীর বিরুদ্ধে মামলার রায় প্রদানের পূর্ব মুহুর্তে আল্লাহ তাআলা তাঁর রসুলের উপর ওহী নাযিল করেন এবং ঘটনার মূল রহস্য তাঁর সামনে তুলে ধরা হল। আল্লাহ তাআলা নিরপরাধ ইহুদীর উপর মিথ্যা অভিযোগ আরোপকারী মুসলমানকে কঠোর সতর্কবাণী শুনিয়ে বলেন:
“ হে নবী! আমরা এই কিতাব পূর্ণ সত্যতা সহকারে তোমার উপর নাযিল করেছি- যেন আল্লাহ তোমাকে যে সত্য পথ দেখিয়েছেন তদনুসারে লোকদের মধ্যে ফায়সালা করতে পার। তুমি প্রতারক ও দূর্নীতিবাজদের সমর্থনে বিতর্ককারী হবে না।
তুমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও দয়াময়।
যারা নিজেদের সাথে প্রতারণ করে তুমি তাদের সাহায্য কর না। আল্লাহ প্রতারক ও পাপিষ্ঠদের পছন্দ করেন না। এরা মানুষের নিকট থেকে নিজেদের অপকর্ম লুকাতে পারে, কিন্তু আল্রাহর নিকট থেকে গোপন করতে পারে না। তিনি তো ঠিক সেই সময়ও তাদের সাথে থাকেন যখন তারা রাতের বেলা গোপনে আল্লাহর মর্জির বিরুদ্ধে পরামর্শ করে থাকে। এদের সমস্ত কাজই আল্লাহর আওতাধীন। হাঁ তোমরা এসব অপরাধীর পক্ষ সমর্থনে পার্থিব জীবনে তো খুব ঝগড়া করে নিলে, কিন্তু কিয়ামতের দিন এদের পক্ষে কে ঝগড়া করবে? সেখানে তাদের কে উকীল হবে?
কেউ যদি কোন পাপকাজ করে বসে অথবা নিজের উপর জুলুম করে এবং তারপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে তবে সে আল্লাহকে ক্ষমাকারী ও অনুগ্রহকারী পাবে।
কিন্তু যে ব্যক্তি পাপকাজ করবে- তার এই পাপকাজ তার জন্যই বিপদ হবে। আল্লাহ সবকিছু জানেন, তিনি প্রজ্ঞাময়।
আর যে ব্যক্তি নিজে অন্যায় বা পাপকাজ করে কোন নিরপরাধ ব্যক্তির উপর দোষ চাপায় সে মিথ্যা অপবাদ ও পাপের বোঝা বহন করে।
হে নবী! তোমার উপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তাদের একদল ভুল ধারণায় নিমজ্জিত করার ফয়সালা করেই ফেলেছিল, যদিও আসলে তারা নিজেদের ব্যতীত অপর কাউকে পথভ্রষ্ট করতে পারত না। আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব ও হিকমত নাযিল করেছেন এবং তোমাকে এমন জ্ঞান দান করেছেন যা তোমার জানা ছিল না। তোমার উপর রয়েছে আল্লাহর মহা অনুগ্রহ” (সূরা নিসা: ১০৫-১১৩)।
বক্তব্যের ধারাবাহিকতা এখনও অব্যাহত রয়েছে এবং সামনে অগ্রসর হয়ে বলে দেওয়া হয়েছে যে, লোকেরা সংগোপনে যে কানা ঘুষা করে তার অধিকাংশই কল্যাণকর কথা নয়, বরং ক্ষতিকর কথাই বলা হয়। উপরোক্ত আয়াত থেকে অনুমান করুন। একজন নিরপরাধ মানুষকে -সে মুসলিম বা অমুসলিম যাই হোক অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করা এবং তাকে যে অপরাধ সে করেনি তার শাস্তি দেওয়া আল্লাহর নিকট কত মারাত্মক অপরাধ এবং তিনি ওহী নাযিল করে কিভাবে এক মুসলমান ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে এক ইহুদীকে নিরপরাধ ঘোষণা করলেন। এখন দেখুন আল্লাহর রসুল এই জিম্মীদের ব্যাপারে কি বলেন। তিনি বলেন:
“সাবধান! যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ লোকদের উপর জুলুম করবে অথবা তাদের অধিকার খর্ব করবে অথবা তাদের উপর বোঝা ঢালবে অথবা তাদের অসম্মতিতে তাদের নিকট থেকে কিছু আদায় করবে-কিয়ামতের দিন এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমি নিজেই বাদী হব”- আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ।
অথচ এরূপ কথা তিনি মুসলিম নির্যাতিতের ক্ষেত্রে বলেননি যে, তিনি কিয়ামতের দিন আল্লাহর আদালতে তার অনুকূলে আরজি পেশ করবেন। কিন্তু জিম্মীর ব্যাপারে বলা হচ্ছে যে, মুসলমানরা তাদের উপর হস্তক্ষেপ করলে আমি তাদের পক্ষে আরজি পেশ করব। এখন চিন্তা করুন যাদের উকীল হবেন স্বয়ং নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-তাদের উপর কোন জুলুম করার চিন্তাও করা যায় কি?
হযরত আবু বাকর সিদ্দীক রা:-র খেলাফতকালে মুসলমানদের দূর্নাম গেয়ে ব্যঙ্গ কবিতা পাঠকারী এক নারীর দাঁত উপড়ে ফেলা হয়। তিনি এ কথা জানতে পেরে গভর্ণর মুহাজির ইবনে উমায়্যাকে লিখে পাঠান: “আমি জানতে পেরেছি যে, মুসলমানদের দূর্ণাম করে যে নারী ব্যঙ্গ কবিতা আবৃত্তি করে বেড়াত তার সামনের পাটির দাঁত তোমরা উপড়ে ফেলেছ। এই নারী যদি মুসলমান হয়ে থাকে তবে তার জন্য ভৎসনা ও তিরষ্কারই যথেষ্ট ছিল, তাকে নির্যাতনের চেয়ে হাল্কা শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল। আর যদি সে জিম্মী হয়ে থাকে তবে এ ক্ষেত্রে তার শিরক এর মত মহাপাপ যখন বরদাশত করা হচ্ছে-সেখানে মুসলমানদের দূর্ণাম আর কি ! আমি যদি এ ব্যাপারে পূর্বাহ্নে তোমাদের সতর্ক করে থাকতাম তবে তোমাদের ঐ শাস্তির প্রতিফল ভোগ করতে হত” ( ড: মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ, সিয়াসী ওয়াসীকাজাত, লাহোর ১৯৬০ খৃ:, পৃ: ২১৭।
দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমার ফারুক রা: অন্তিম শয্যায়ও জিম্মীদের সাথে সদাচরণ সম্পর্কে চিন্তা করেছেন। আততায়ীর তরবারীর আঘাতে চরমভাবে আহত হয়ে দূর্বল ও শ্রান্ত হয়ে পড়েছেন এবং এই সংকটকালে তিনি জিম্মীদের সম্পর্কে অসিয়াত করছেন:
“আমার পরে যিনি খলীফা হবেন আমি তাঁকে এই মর্মে অসিয়াত করছি যে, রসুলুল্লাহ সা: যেসব লোককে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তাদের সাথে কৃত চুক্তি মেনে চলতে হবে, তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাদের উপর সাধ্যাতীত বোঝা চাপানো যাবে না” ( আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, উর্দু অনু: করাচী ১৯৬৬ খৃ: পৃ: ৩৮৭)।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগেই নয়, বানু উমায়্যা, বানু আব্বাস, এবং তৎপরবর্তী মুসলিম শাসকগণের যুগেও অমুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিজেদের জানমাল ও ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা ভোগ করে আসছিল। এ কথার স্বীকৃতি দিয়ে প্রসিদ্ধ প্রাচ্যবিদ মন্টগোমারী ওয়াট লিখেছেন: “অমুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে ইসলামী রাষ্ট্র সামগ্রিকভাবে উত্তম আচরণ করেছে। তাদের সাথে সদাচরণ ছিল মুসলমানদের জন্য মহত্ব ও মর্যাদার বিষয়। খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে জিম্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল সরকারের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। প্রত্যেক অমুসলিম সংখ্যালঘু নাগরিক চুক্তি অনুযায়ী মাল অথবা নগদ অর্থের আকারে বার্ষিক জিযইয়া বাইতুল মালে জমা করত। এছাড়া তাদেরকে মাথাপিছু করও পরিশোধ করতে হত। এর পরিবর্তে তারা বহি:শত্রুর আক্রমণ থেকে নিরাপত্তা লাভ করত এবং তারা মুসলমানদের মতই আভ্যন্তরীণ অপরাধ থেকেও নিরাপদ থাকার সুযোগ লাভ করত। যেসব প্রদেশে জিম্মীদের বসবাস ছিল সেখানে তাদের থেকে জিযইয়া আদায় করা এবং মুসলমান ও জিম্মীদের মধ্যেকার বিবাদ মীমাংসা করা ছিল শাসকের অন্যতম দায়িত্ব। প্রত্যেক সংখ্যালঘু নিজ নিজ ব্যক্তিগত ও আভ্যন্তরীণ বিষয়ে ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাদের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ নির্ধারিত জিযইয়া ও ট্যাক্স আদায় এবং তাদের মধ্যে তাদের ধর্মীয বিধান কার্যকর করা সহ সমস্ত আভ্যন্তরীণ বিষয়ে দায়িত্বশীল ছিল” (Montgomery Watt W. The Majesty that was Islam, Sidwick & Jackson, London 1974, P. 47.
একই লেখক সামনে অগ্রসর হয়ে নিজের পাঠকদের বলছেন, “রসুলুল্লাহ সা: এর যুগে যেসব চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল তার সবগুলোতেই পরিষ্কার ভাষায় এই নিশ্চয়তা প্রদান করা হয় যে, প্রত্যেক জিম্মী সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে পারবে এবং এই স্বাধীনতা পরবর্তী কালেও অটুট থাকে। খৃস্টানদের গির্জা এবং ইহুদীদের মন্দিরও নিরাপদ ছিল। পরে এই ধারণাও ব্যক্ত করা হয়েছিল যে, তাদেরকে নিজ নিজ উপাসনালয় নির্মাণ করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু জিম্মীদের ক্ষেত্রে এ ধরণের অন্যান্য নতুন বিধান অনুযায়ী কখনও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি”- ( ঐ লেখক, ঐ গ্রন্থ)।
এই হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রে জিম্মীদের অবস্থা। তাদের অধিকার সমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট বিধান ও নজীর সমূহের বিস্তারিত বিবরণ সামনে আসছে। এখানে শুধু এতটুকু বলাই উদ্দেশ্য ছিল যে, জিম্মীদের ব্যাপারে ইসলামী রাষ্ট্রের চিন্তাধারা কি।
এখন মুসলিম ও অমুসলিমদের সমমর্যাদা সম্পর্কে বলা যায়। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদের সিদ্ধান্ত এই যে, ঈমান আনয়নকারী ও ঈমান প্রত্যাখানকারী সমান হতে পারে না। তাদের মধ্যে মানবতার সম্পর্ক অভিন্ন হওয়ার প্রেক্ষিতে তাদের মর্যাদা সমান হতে পারে। মানুষ হিসাবে মুসলমানরা যেসব অধিকার লাভ করে, অমুসলিমরাও তা লাভ করে থাকে। তাছাড়া এই অর্থেও তাদের উভয়ের মর্যাদা সমান যে, আল্লাহ ও তাঁর রসুল মুসলিম-অমুসলিম উভয়ের অধিকার নির্ধারণ করে দিয়েছেন। মুসলমানদের অধিকার যেভাবে অবিচ্ছেদ্য এবং হস্তক্ষেপের উর্ধ্বে, ঠিক সেভাবে অমুসলিমদের অধিকারও অবিচ্ছেদ্য এবং হস্তক্ষেপের উর্ধ্বে। রাষ্ট্র যদি মুসলমানদের কোন অধিকারের হ্রাস বৃদ্ধি করতে না পারে তবে অমুসলিমদের কুরআন ও সুন্নাহর বিধান ও খেলাফতে রাশেদার দৃষ্টান্ত পেশ করে বিচার বিভাগের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার অর্জন করতে পারে, তবে অমুসলিমরাও ঐসব উৎসের বরাত দিয়ে নিজেদের অধিকার অর্জন করতে পারে, তবে অমুসলিমরাও ঐসব উতসের বরাত নিজেদের অধিকার অর্জন করতে পারে।
ফাতেমী রাজবংশের রাজত্বকালে কতিপয় সরকারী উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সিনাই এলাকার খৃস্টান পাদ্রীদের ও ইহুদীদের মালিকানায় হস্তক্ষেপ করতে চাইলে এবং তাদের উপর কিছু কর আরোপ করলে তারা রাজদরবারে উপস্থিত হয়ে পূর্বেকার চুক্তিপত্রের কপিসমূহ পেশ করে আব্দুল মজীদ আল হাফেজের উযীর বাহরাম এবং জাফরের উযীর আল আব্বাস ও তালাইর নিকট থেকে নিজেদের অনুকুলে ডিক্রি লাভ করে। উক্ত চুক্তিপত্রে শাসকদের প্রতি নির্দেশ ছিল যে, তারা পূর্বেকার চুক্তিপত্রের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে এবং খেলাফতে রাশেদার যুগে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের কঠোরভাবে অনুসরণ করবে। সাথে সাথে এই নির্দেশও জারি করা হল যে, নতুনভাবে আরোপিত সকল প্রকারের কর প্রত্যাহার করতে হবে এবং খৃস্টান ও ইহুদীদের সার্বিক নিরাপত্তা ও তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা করতে হবে ( Stem SM. Fatimid Decrees, Faber and Faber, London 1964).
এই ধরণের নজীর আব্বাসী রাজবংশের আমলে এবং তাদের পরবর্তী যুগসমূহেও পাওয়া যায় যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাষ্ট্রের অন্যায় হস্তক্ষেপ থেকে মুসলিম, অমুসলিম সকলেই সমানভাবে নিরাপত্তা লাভ করত এবং এই নিরাপত্তার ব্যবস্থা সেই মহান সত্তা কর্তৃক প্রদত্ত যাঁর অস্তিত্ব বা সর্বময় কর্তৃত্ব অমুসলিমরা স্বীকার করে না। আইনের দৃষ্টিতে সমান হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম ও অমুসলিম নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে অবশ্যই একটা পার্থক্য আছে এবং সেই পার্থক্য হচ্ছে তাদের রাজনৈতিক অধিকারের। এর কারণ কোন স্বতন্ত্র ব্যবহার অর্থ ধর্মীয় গোঁড়ামী নয় বরং ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী সত্তার সাথে বিশ্বস্ততার সম্পর্কের ধরণের বিভিন্নতাই এর কারণ। ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থা যা আল্লাহ তাআলার সার্বভৌমত্ব এবং কিতাব ও সুন্নাহর সংবিধানের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, তা অমুসলিমরা সমর্থন করে না এবং তার প্রতি পূর্ণ বিশস্ত থাকার শপথও তারা করে না যা মুসলমানরা করে থাকে। যেহেতু মুসলমানরা ঈমান এনে এই অঙ্গীকার করে যে, তারা আল্লাহর যমীনে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব কায়েম করবে এবং তিনি ছাড়া অপর কারো সার্বভৌমত্ব কায়েম করবে এবং তিনি ছাড়া অপর কারো সার্বভৌমত্ব কেবল প্রত্যাখানই করবে না, বরং জীবনবাজি রেখে তা নির্মূল করবে, এজন্যই তারা আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিনিধিত্বমূলক কর্তৃত্বের ( ডেলিগেটেড পাওয়ার) অধিকারী হয়ে যায়। মানব জাতির মধ্যে যে ব্যক্তিই এই ধরণের অঙ্গীকার করে সে সরাসরি এই কর্তৃত্বে অংশীদার হওয়ার অধিকার লাভ করে। কিন্তু যে ব্যক্তি এই দায়িত্ব মাথায় নিতে প্রস্তুত নয় এবং মূলতই আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রবক্তা নয় তাকে কোন্ অধিকারের ভিত্তিতে এই কর্তৃত্বে অংশীদার করা হবে?
কোন কর্তৃপক্ষ কি এমন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নিকট নিজেদের কর্তৃত্ব অর্পণ করতে পারে যে বা যারা তাদের অস্তিত্ব বা কর্তৃত্বই স্বীকার করে না? মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে এই মৌলিক পার্থক্য সত্ত্বেও ইসলাম অমুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করেনি। অবশ্য তাদেরকে এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ বা নীতি নির্ধারণী পদের জন্য অযোগ্য সাব্যস্ত করেছে যাতে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য তারা সংবিধানের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার শপথ করতে পারে না এবং তা কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতার শর্তাবলীতে পূর্ণরূপে উত্তীর্ণ হয় না। তাদের এই অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখে ইসলামী রাষ্ট্রে মৌলিক অধিকার সমূহকে তিনটি পরিমন্ডলে বিভক্ত করতে হয়:
১. মুসলিম ও অমুসলিমদের অভিন্ন বা সাধারণ অধিকারসমূহ।
২. মুসলমানদের আপেক্ষিক বা অতিরিক্ত অধিকার সমূহ।
৩. অমুসলিমদের আপেক্ষিক বা অতিরিক্ত অধিকার সমূহ।
এর মধ্যে প্রথমোক্ত অধিকার সমূহের তালিকা দীর্ঘতর হবে। কারণ আল্লাহ তাআলা অধিকারের ক্ষেত্রে মানুষের সৃষ্টিগত অবস্থার উপরই অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। অবশিষ্ট দুই ধরণের অধিকারের তালিকায় এমন কতিপয় অধিকার অন্তর্ভূক্ত হবে তা মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যেকার পার্থক্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।