৬. একজনের কার্যকলাপের জন্য অপরজন দায়ী নয়
ইসলামী রাষ্ট্রে একজন নাগরিকের এই অধিকারও রয়েছে যে, তাকে অন্যের অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে পাকড়াও করা যায় না। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদ অলংঘনীয় বিধি নির্ধারণ করে দিয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী***)
অর্থ: প্রত্যেক ব্যক্তি যা অর্জন করে তা তার নিজের জন্যই। কেউ কারো বোঝা বহন করবে না”(সূরা আনআম: ১৬৪)।
সূরা ফাতির-এর ১৮ নং আয়াতেও এ কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সূরা বাকারায় ষ্পষ্ট নির্দেশ আছে:
(আরবী***)
অর্থ: “জালেমদের ব্যতীত অপর কারো উপর হস্তক্ষেপ করা চলবে না” (সূরা বাকারা:১৯৩)।
এই সমুদয় বিধিমালা থাকতে ইসলামী রাষ্ট্রে অপরাধীর পরিবর্তে তার পিতা পুত্র মা বোন অথবা অন্যান্য বন্ধু বান্ধবদের গ্রেফতার করা যায় না। এমন ধরণের উদাহরণ বিংশ শতাব্দীর উন্নত বিশ্বের নামমাত্র গণতান্ত্রিক দেশসমূহে আমরা দেখতে পাই। তবে ঔপনিবেশিক যুগের পূর্বেকার মুসলিম ইতিহাস তা থেকে পুরোপুরি শূন্য। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ একজন অত্যন্ত জালেম ও নির্দয় শাসক হিসাবে পরিচিত। কিন্তু তার সমস্ত খারাবি সত্ত্বেও প্রতিপক্ষের আত্মীয়-স্বজনদের প্রাণনাশের অপরাধ সংঘটিত হয়নি। তার রাজত্বকালের একটি মশহূর ঘটনা এই যে, তিনি কাতারী ইবনে ফুজাআহ নামক এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেন এবং বলেন, আমি তোকে হত্যা করেই ছাড়ব। কাতারী জিজ্ঞেস করল, কোন্ অপরাধে? হাজ্জাজ বললেন, তোমার ভাই আমার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছে। কাতারী বলল, “আমার কাছে আমীরুল মুমিনীনের লিখিত ফরমান আছে। আমার ভাইয়ের অপরাধে আপনি আমাকে পাকড়াও করবেন না।” হাজ্জাজ বললেন, সেই ফরমান কোথায়? আমাকে দেখাও।” কাতারী, “বলল, “আমার নিকট তো এর চাইতেও অবশ্য পালনীয় পত্র রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন: ওলা তাযিরু ওয়াযিরাতুন উইযরা উখরা ।অর্থ: “একজন অন্যজনের বোঝা বহন করবে না।” এই জবাব হাজ্জাজের মন:পুত হল এবং সহাস্য বদনে তাকে রেহাই দিলেন-(তারতূসী, সিরাজুল মুলূক, পৃ.৬৯)।
৭. অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অধিকার
ইসলাম নাগরিকদেরকে অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদ করার পূর্ণ অধিকার দিয়েছে। অত্যাচারীর সামনে মাথা নত না করার এবং তার অত্যাচারকে ঠান্ডা মাথায় বরদাশত না করাই ইসলামের শিক্ষা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:
لَّا يُحِبُّ اللَّهُ الْجَهْرَ بِالسُّوءِ مِنَ الْقَوْلِ إِلَّا مَن ظُلِمَ ۚ وَكَانَ اللَّهُ سَمِيعًا عَلِيمًا [٤:١٤٨]
“অশ্লীলভাষী হওয়া আল্লাহ পছন্দ করেন না; তবে যার উপর যুলুম করা হয়েছে তার কথা স্বতন্ত্র” (সূরা নিসা:১৪৮)।
অর্থাৎ অশ্লীলতা ও মন্দ কথার প্রচারণা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। কিন্তু অন্যায়- অবিচার যখন সীমা ছেড়ে যায়, ধৈর্য-সহিষ্ণুতার বাঁধ ভেঙ্গে যায়, সম্পূর্ণ অপারগ অবস্থা জবান থেকে মন্দ ও অশ্লীল কথা বেরিয়ে পড়ে তখন উচ্চতর নৈতিক শিক্ষা সত্ত্বেও আল্লাহর কাছে এই সর্বশেষ অবস্থা ক্ষমাযোগ্য। নির্যাতিত ব্যক্তির অধিকার আছে যে, সে অভিযোগবাক্য উচ্চারণ করতে পারবে এরূপ করতে গিয়ে যদি সে ভাবাবেগে কথাবার্তায় সৌজন্য রক্ষা করতে অপারগ হয়ে পড়ে তাহলে এজন্য সে অভিযুক্ত হবে না।
এই সম্পর্কে মশহূর হাদীস বর্ণিত আছে। “যে ব্যক্তি কোন জালেম শাসকের সামনে ন্যায্য কথা বলে তার জিহাদই সর্বোত্তম” ( আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজা, নাসাঈ, মুসনাদে আহমাদ)।
মানুষ যদি অত্যাচারীর অত্যাচার ও জুলুম দেখেও তাকে প্রতিহত না করে তাহলে আল্লাহর ব্যাপক শাস্তি তাদের উপর নাযিল হবে” ( আবু দাউদ, তিরমিযী)।
“তোমার ভাইকে সাহায্য কর, সে জালেম হোক কিংবা মজলুম। আরজ করা হল, হে আল্লাহর রসূল! সে মজলুম হলে তো আমরা তার সাহায্য করব, কিন্তু জালেম হলে মদদ করব কিভাবে? তিনি বলেন, তাকে জুলুম থেকে বিরত রাখ”(বুখারী)।
মহানবী সা: ছিলেন আপাদমস্তক রহমতের প্রতীক। তিনি কখনো কারো প্রতি সামান্য জুলুমও করেননি। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কারো অভিযোগ থাকলে তিনি তা উত্থাপনের সুযোগ দিতেন এবং প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য নিজকে পেশ করতেন।
একবার তিনি গণীমতের মাল বন্টন করছিলেন। ভিড়ের মধ্যে এক ব্যক্তি সামনে অগ্রসর হয়ে মুখ থুবড়ে তাঁর সম্মুখে পড়ে গেল। তাঁর হাতে তখন একখানা সরু কাষ্ঠখন্ড ছিল। তিনি তা দ্বারা তাকে মৃদু টোকা দিলেন। ঘটনাক্রমে লাঠির অগ্রভাগ তার মুখে লেগে রক্ত প্রবাহিত হতে লাগল। তখন তিনি বললেন, “আমার থেকে প্রতিশোধ নাও।” সে আরজ করল, ইয়া রসূলুল্লাহ! আমি ক্ষমা করে দিলাম” (আবু দাউদ)।
বদর যুদ্ধের সময় তিনি একটি ধনুকের সাহায্যে মুজাহিদীনের সারি সোজা করছিলেন। হযরত সাওয়াদ ইবনে গাযিয়াহ রা: লাইনের কিছুটা অগ্রভাগে ছিলেন। তিনি তীর দিয়ে টোকা দিয়ে তাকে সমানভাবে দাঁড়াতে বলেন। সাওয়াদ বলল, ইয়া রসূলুল্লাহ! আপনি তো আমাকে ব্যাথা দিলেন। অথচ আল্লাহ আপনাকে পাঠিয়েছেন ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে। সুতরাং আপনি আমাকে বদলা নেওয়ার অনুমতি দিন। রসূলে করীম সা: ততক্ষণাৎ তাঁর পেট মুবারক উন্মুক্ত করে বলেন, সাওয়াদ! তোমার বদলা নাও। সাওয়াদ দৌড়িয়ে এসে পবিত্র দেহের সাথে জড়িয়ে পড়ে পবিত্র উদরে চুম্বন করল। (হিফজুর রহমান, ইসলাম কা ইকতিসাদী নিযাম, পৃ. ৯২)।
একবার এক ব্যক্তি মহানবী সা: এর খিদমতে এসে তার কর্জ পরিশোধের তাগাদা দিতে শুরু করল। সে সভাস্থলে কঠোর কথা বলতে লাগল। তার সৌজন্য বিরুদ্ধ আচরণে সাহাবায়ে কিরাম ক্রোধান্বিত হন এবং তাকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ান। তিনি বললেন: তাকে বলতে দাও, তাকে বলতে দাও, পাওনাদার এরূপ ব্যবহার করতে পারে” (বুখারী)।
হযরত আবু বাকর রা: ও হযরত উমার রা: -র সেই সব ভাষণের কথা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি যাতে কোথাও অন্যায় ও জুলুম হতে দেখলে মানুষকে তা ততক্ষণাত প্রতিহত করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। হযরত আবু মূসা রা:-র বিরুদ্ধে অভিযোগের ঘটনা “ইজ্জত-আবরুর নিরাপত্তা” শিরোনামে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি এক ব্যক্তির মাথা মুন্ডন করিয়ে দিলেন। সে উক্ত চুলগুলো একত্র করে সোজা মদীনায় চলে আসে এবং হযরত উমারকে দেখা মাত্র চুলের গোছা তাঁর বক্ষ বরাবর ছুঁড়ে মারে এবং অত্যন্ত রাগতস্বরে বলে, দেখুন আল্লাহর শপথ! আগুন! হযরত উমাররা: বললেন, আল্লাহর শপথ! হাঁ আগুন! সে বলল,আমীরুল মুমিনীন! আমি অতিশয় বুলন্দ আওয়াযের অধিকারী এবং শত্রুর উপর চড়াওকারী বীর পুরুষ। আমার সাথে এরূপ ব্যবহার করা হয়েছে। আমাকে বিশটি চাবুক মারা হয়েছে এবং মাথার চুল মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হযরত উমার রা: তার ভদ্রতাবিবর্জিত আচরণে ক্ষুব্ধ না হয়ে তার সম্পর্কে উত্তম অভিমত ব্যক্ত করেন:
“আল্লাহর শপথ! যদি রাষ্ট্রের সমস্ত লোক তার মত দৃঢ়সংকল্প ও হিম্মতওয়ালা হয় তাহলে সেটা আমার কাছে সমস্ত গণীমতের মাল অপেক্ষা প্রিয় হবে যা আল্লাহ তাআলা আজ পর্যন্ত আমাদের দান করেছেন” ( উমার ইবনুল খাত্তাব, পৃ. ১৮৪)।
ইসলাম শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অধিকারই দেয়নি, বরং যদি এই প্রতিবাদ সত্য প্রমাণিত হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে জালেমের আনুগত্য প্রত্যাখান করার অধিকারও ইসলামে রয়েছে। এমনকি তাকে শাসন কর্তৃত্ব থেকে অপসারণও করা যাবে। কেননা শাসকের প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে জুলুমের অবসান ঘটানো এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। নেতৃত্বের পূর্বশর্ত হচ্ছে ন্যায় বিচার। কুরআনুল করীমে ইরশাদ হচ্ছে:
“(আল্লাহ যখন ইবরাহীমকে বললেন), আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা বানাচ্ছি। ইবরাহীম আরজ করল, আমার বংশধরদের মধ্য হতেও? আল্লাহ বললেন, আমার প্রতিশ্রুতি জালেমদের পৌঁছায় না” ( সূরা বাকারা: ১২৪)।
আল্লাহ পাক মুসলমানদের নির্দেশ দিচ্ছেন:
(আরবী***)
“তোমরা সীমা লংঘনকারীদের আনুগত্য করবে না” (সূরা শুআরা:১৫১)।
এই বিষয়বস্তুর নিরিখে অনেক আয়াত ও বহু সংখ্যক হাদীস “আনুগত্যের সীমারেখা” শিরোনামে পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাসমূহে আলোচনা করা হয়েছে। এতে সুষ্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে যে, ইসলামী রাষ্ট্রে জালেমদের বরদাশত করা হয় না। তাদের জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা শুধু অধিকারই নয়, বরং ফরয। এ ব্যাপারে গড়িমসি করলে সর্বশক্তিমান আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে।
৮. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকগণ কেবলমাত্র শাসকদের অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাকযুদ্ধই করবে না, বরং রাষ্ট্রীয় বিষয়সমূহ ও সমস্যাবলী সম্পর্কেও তারা স্বাধীন মত ব্যক্ত করবে। মুমিনদের গুণাবলী প্রসংগে কুরআন মজীদে ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী***)
“তারা সৎ কাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজে বাধা দেয়” (সূরা আলে ইমরান:১১০)।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যতিরেকে এই গুণ সৃষ্টি হতে পারে না। উক্ত আয়াত থেকে শুধুমাত্র এই স্বাধীনতার গ্যারান্টিই পাওয়া যাচ্ছে না, বরং সাথে সাথে তার বাস্তব প্রয়োগের ধরণ ও ভঙ্গীও নির্ধারিত হচ্ছে। তবে একজন মুসলমান শুধু সৎ ও ভালো কাজের প্রসারের জন্যই এই স্বাধীনতা দেওয়া যেতে পারে না। কেননা তা মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য। এদের সম্পর্কে বলা হয়েছে:
(আরবী***)
অর্থ: “তারা মন্দ কাজের নির্দেশ দেয় এবং ভালো কাজ থেকে বিরত রাখে” (সূরা তওবা ৬৭)।
বনী ইসরাঈলের অধ:পতনের একটি কারণ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদে এও বর্ণনা করা হয়েছে:
(আরবী***)
“তারা যেসব গর্হিত কাজ করত তা থেকে একে অন্যকে বারণ করত না” (সূরা মাইদা: ৭৯)।
মুসলমানদের এই অলসতা ও অবহেলা থেকে দূরে থাকার উপদেশ দিয়ে বলা হয়েছে:
(আরবী***)
অর্থ: “ যদি তোমরা পেঁচালো কথা বল অথবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে স্মরণ রেখ তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত“ (সূরা নিসা: ১৩৫)।
অর্থাৎ তোমরা যদি সত্য কথা বলতে পিছপা হও অথবা চাপের মুখে কিংবা সন্ত্রাসের ভয়ে অথবা লালসার বশবর্তী হয়ে পেঁচালো কথা বলে মুনাফিক সুলভ আচরণ অবলম্বন কর তাহলে জেনে রাখ দুনিয়ার শাস্তি থেকে রক্ষা পেলেও আখেরাতে কিন্তু এহেন অপরাধের শাস্তি থেকে রেহাই পাবে না। মহানবী সা: ইরশাদ করেন:
“আমার পরে এমন কতিপয় শাসকের আবির্ভাব হবে, যারা তাদের মিথ্যাচারে সহযোগিতা করবে এবং জুলুম ও স্বৈরাচারে মদদ যোগাবে। তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই এবং আমিও তাদের নই” (নাসাঈ, ব্যবসা বাণিজ্য অধ্যায়)।
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরামের মতামত নেওয়া এবং অভিমত প্রকাশের জন্য তাদের সাহসিকতার পরীক্ষা করা ছিল রসূলে করীম সা: এর পবিত্র অভ্যাস। এ ব্যাপারে অনেকগুলো উদাহরণ পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাসমূহে আলোচনা করা হয়েছে। উহুদের যুদ্ধের ব্যাপারে তাঁর এবং প্রবীণ সাহাবীদের মত ছিল এই যে, মদীনার অভ্যন্তরভাগে অবস্থান করে শত্রুর মুকাবিলা করতে হবে। কিন্তু হযরত হামযা রা: সহ যুবক সাহাবীদের অভিমত ছিল মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করা। তিনি দেখলেন বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করাই অধিকাংশের অভিমত, তাই তদনুযায়ী যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন এবং নিজে অস্ত্র সজ্জিত হওয়ার জন্য হুজরায় চলে যান। ইত্যবসরে প্রবীণ সাহাবীগণ যুবক সাহাবীদের তিরষ্কার করতে থাকেন এই বলে যে, তোমরা আল্লাহর রসূলের মতের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে তাঁকে কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছ। এই কথা শোনামাত্র নওজোয়ানেরা আবেগাপ্লুত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য হুজরার সামনে সমবেত হল। মহানবী সা: বাইরে এসে তাদের কাকুতি মিনতি শুনে বলেন, দৃঢ় সংকল্প ও প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পরে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন ব্যতিরেকে অস্ত্র সংবরণ করা নবীর জন্য শোভনীয় নয়। চল, মদীনার বাইরেই যুদ্ধ সংঘটিত হবে, (ইসলাম কা ইকতেসাদী নিযাম, পৃ. ৮৯)।
একবার তিনি গণীমতের মাল বণ্টন করছিলেন। জনৈক ব্যক্তি বলে ফেলল, গণীমতের বণ্টন আল্লাহর মর্জি মাফিক হচ্ছে না। কথাটা ছিল অত্যন্ত আপত্তিকর, কিন্তু তিনি ক্ষমা করে দিলেন। অন্য একজনের অভিযোগ এল, আপনি ন্যায়পরায়ণতার সাথে কাজ করেননি। মহানবী সা: মিষ্টি সুরে বললেন, আমি যদি ন্যায় বিচার না করি তাহলে করবে কে? অত:পর অভিযোগ উত্থাপনকারীকে কোন প্রকার জেরা করেন নি। হযরত যুবায়ের রা: ও জনৈক আনসারীর একটি বিবাদ মহানবী সা: এর খেদমতে পেশ করা হল। তিনি যুবায়েরের পক্ষে রায় দিলেন। আনসারী অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, আপনি তো আপনার ফুফাতো ভাইয়ের অনুকূলে রায় দিলেন। তিনি তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ উপেক্ষা করলেন এবং কিছুই বললেন না (কিতাবুল খারাজ, পৃ. ৫৩)।
কোন এক যুদ্ধে তিনি মুসলমানদের নির্দেশ দিলেন, অমুক অমুক স্থানে অবস্থান নিতে হবে এবং শিবির স্থাপন করতে হবে। একজন সাহাবী জানতে চাইলেন, এই আদেশ কি ওহীর মারফত না আপনার ব্যক্তিগত অভিমত থেকে? তিনি বললেন: “এ আমার ব্যক্তিগত অভিমত।” সাহাবী আরজ করেন, “এই স্থান তো উপযোগী নয়, বরং অমুক অমুক স্থান অধিকতর সুবিধাজনক হবে।” সুতরাং এই অভিমত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হল। ( শিবলী নোমানী, সীরাতুন নবী, ১ম খন্ড, পৃ. ২৯৫)।
হযরত আবু বাকর রা: তাঁর খিলাফতের উদ্বোধনী ভাষণে যথারীতি মতামত প্রকাশের আহবান জানান। হযরত উমার রা: খিলাফতের আসনে অভিষিক্ত হওয়ার পরে হযরত আবু উবায়দা রা: ও হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা: তাঁর কাছে একটি যৌথপত্র লিখেন। এই পত্রে খিলাফতের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং পরকালের জবাবদিহি সম্পর্কে সজাগ করে দেওয়া হয়েছিল। পত্রে তাঁরা লিখেছেন “আমরা আল্লাহর কাছে পানাহ চাচ্ছি যে, আপনি আমাদের লিখিত পত্রের প্রকৃত মর্যাদা দিবেন না। আমরা শুধুমাত্র আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধু ও হিতাকাঙ্খী হিসাবেই এই চিঠি লিখেছি।”।
হযরত উমার রা: তাদের উভয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এক দীর্ঘ উত্তর লিখেন: “আপনাদের উভয়ের লেখাই বিশ্বস্ততা ও সততায় পরিপূর্ণ। এই ধরণের পত্রের আমার খুবই প্রয়োজন। কাজেই আপনারা আমাকে পত্র লেখার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখবেন” (উমার ইবনুল খাত্তাব, পৃ. ৩০২)।
হযরত সাদ ইবনে উবাদাহ আনসারী রা: না আবু বাকর রা:-র হাতে বায়আত গ্রহণ করেছেন আর না হযরত উমার রা:-র হাতে। তিনি তাদের ইমামতিতে না নামায পড়তেন, না জুমুআ পড়তেন, আর না হজ্জ করতেন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ: তাঁর সম্পর্কে লিখেন: তাঁর কিছু সমর্থক পাওয়া গেলে তিনি ক্ষমতাসীনদের সাথে গোলমাল বাধিয়ে দিতেন। কিছু সংখ্যক লোক তাঁর সাথে যুদ্ধ করার জন্য বায়আত গ্রহণ করলে তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। হযরত আবু বাকর সিদ্দীক রা:-র ওফাত পর্যন্ত তিনি এই নীতিতে অবিচল ছিলেন। হযরত উমার রা: খলীফা হলে তিনি সিরিয়া চলে যান এবং সেখানেই ইন্তেকাল করেন (ইসলাহী, ইসলামী রিয়াসত, পৃ. ৩১)।
হযরত সাদ ইবনে উবাদাহ রা: এই নীতি অবলম্বন করা সত্ত্বেও হযরত আবু বাকর রা: এর কোন প্রতিবাদ করেননি, প্রতিবাদ করেননি হযরত উমার রা:-ও। কেননা বায়আত না করলেও তিনি কখনো বিদ্রোহাত্মক কর্মনীতি অবলম্বন করে কার্যত: কোন বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কাজ করেননি। হযরত উমার রা:-র আমলে মতামত প্রকাশের এতটা স্বাধীনতা ছিল যে, যে কোন লোক পথিমধ্যে কিংবা সভামঞ্চে যে কোন স্থানে তাঁকে বাঁধা দিতে পারত, তাঁর কাছে নিজের অভিযোগ পেশ করতে পারত, তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারত। মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সদা জাগ্রত রাখার জন্য তিনি অভিযোগকারীদের কথার প্রতি পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করতেন। মাঝখানে কেউ বাধা দিলে তিনি ভীষণ অসন্তুষ্ট হতেন এবং অভিযোগকারীকে তার বক্তব্য পেশের সুযোগ দিতেন, তার সাহস ও হিম্মত বুলন্দ করতেন এবং তার অভিযোগের তাতক্ষণিক সমাধান করে দিতেন।
হযরত আমর ইবনুল আস, মুগীরা ইবনে শো’বা, আবু মুসা আশআরী এবং সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা: প্রমূখ গভর্ণরদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ এলে সাধারণ মানুষের সামনে তা শুনতেন এবং তার তদন্ত করতেন। তিনি তাঁর শরীরের দুইখানা চাদরের হিসাব জনতার সমাবেশে দিতে কুন্ঠাবোধ করেননি এবং মোহরের পরিমাণ নির্ধারণী সিদ্ধান্ত প্রকাশ্য মজলিশে প্রত্যাহার করেন। তিনি প্রতিবাদকারিণী মহিলার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। কেননা তিনি তাঁকে সত্যপথে পরিচালিত করেছেন। একবার জনৈক ব্যক্তি সভাস্থলে দাঁড়িয়ে বলল, যদি আপনি বাঁকা পথে চলে তাহলে আমার এই তলোয়ার আপনাকে সোজা করবে। এই কথা শুনে তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলেন: আমি ভ্রান্ত পথে ধাবিত হলে আমাকে হেদায়াতের পথে আনার মত লোক এই জাতির মধ্যে রয়েছে। মোটকথা তাঁর সমগ্র খিলাফতকাল ‘মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা’ সম্পর্কিত অসংখ্য ঘটনায় ভরপুর। এই ঘটনাবলীর সর্বাপেক্ষা লক্ষ্যণীয় দিক এই যে, তিনি কখনো কোন প্রতিবাদকারী, সমালোচনাকারী ও অভিযোগকারীর মুখ বন্ধ করেন নি, তাদের কথা বার্তায় ক্ষিপ্ত হয়ে কখনো বলেননি যে, তুমি আমার সাথে অশিষ্ট কথা বলছ! তার এই দৃষ্টিভঙ্গীর কতিপয় উদাহরণ লক্ষণীয়:
এক ব্যক্তি সদর রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্বোধন করে বলে, “হে উমার! আল্লাহকে ভয় কর।” এই বাক্যটি সে কয়েকবার পুনরুক্তি করল। এতে জনৈক ব্যক্তি তাকে বাধা দিল, “চুপ থাক। তুমি তো আমীরুল মুমিনীনকে অনেক কথা শোনালে।” হযরত উমার তার কথায় তৎক্ষণাৎ হস্তক্ষেপ করে বলেন, “তাকে বাধা দিওনা। এই লোকেরা যদি আমাদের সম্পর্কে এরূপ কথা বলা বন্ধ করে দেয় তাহলে তাদের বেঁচে থেকে কি ফায়দা? আমরা যদি তাদের কথা গ্রহণ না করি তাহলে আমাদেরকে মঙ্গল ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত মনে করা উচিত এবং সে কথা আপনার লোকের মুখের উপর নিক্ষিপ্ত হওয়া বিচিত্র নয় (কিতাবুল খারাজ, পৃ. ১২৯)।
এক ব্যক্তি হযরত উমারের নিকট এসে আরজ করল, হে আমীরুল মুমিনীন! প্রত্যেক মন্দ কাজের খোলাখুলি সমালোচনা করা এবং আল্লাহর রাস্তায় কোন তিরষ্কারকারীর ভৎসনার পরোয়া না করা কিংবা আমার সার্বিক মনোযোগ নিজের আত্মসংশোধনের প্রতিই নিবন্ধ রাখা এগুলোর কোনটি আমার জন্য উত্তম? তিনি জবাব দিলেন:
“মুসলমানদের সামগ্রিক ব্যাপারে কোন ব্যক্তিকে কোন স্তরে দায়িত্বশীল বানানো হলে তাকে তো আল্লাহর পথে ভর্ৎসনাকারীর ভর্তসনাকে ভয় করা উচিত নয়। যার উপর এই দায়িত্ব অর্পিত হয়নি সে আত্মসংশোধনের চিন্তা- ফিকিরে মগ্ন থাকবে এবং তার শাসকদের শুভ কামনা করতে থাকবে (ঐ, পৃ. ১৩৩)।
এক মহিলা পথিমধ্যে উমার রা:-কে বলেন, “উমার! তোমার অবস্থা দেখে দু:খ হয়। আমি তোমাকে সেই সময়েও দেখেছি যখন তুমি ‘উমাইর’ (অল্প বয়ষ্ক) ছিলে এবং হাতে লাঠি নিয়ে ‘উকাযে’ দিনভর ছাগল চড়াতে। তারপর তোমার সেই যুগও দেখেছি যখন তোমাকে উমার বলে ডাকা হয়। আর এখন এই যুগও দেখছি যখন তুমি আমীরুল মুমিনীন হয়ে চলাফেরা করছ। নাগরিকদের ব্যাপারসমূহে ভয় কর এবং স্মরণ রাখ-যে ব্যক্তি আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করবে, আখেরাতের দূরের জগত নিজের অতি নিকটে মনে করবে এবং মৃত্যুকে ভয় করবে সে সর্বদা এই চিন্তায় মগ্ন থাকবে যে, আল্লাহর দেওয়া কোন সুযোগই যেন বৃথা না যায়।
জারূদ আবদী তখন হযরত উমারের সাথে ছিলেন। তিনি মহিলার বক্তব্য শুনে বলেন, আপনি আমীরুল মুমিনীনের সাথে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। হযরত উমার রা: সাথে সাথে তাকে বাধা দিয়ে বলেন, এই মহিলা যা বলতে চান তাঁকে তা বলতে দাও। তোমার হয়ত জানা নেই ইনি তো খাওলা বিনতে হাকীম রা: যাঁর কথা আল্লাহ পাক সপ্তাকাশের উপর থেকে শুনেছেন। সে ক্ষেত্রে উমারের সাধ্য কি যে, তার কথা না শুনে” (ইসলাহী, ইসলামী রিয়াসাত, পৃ. ৬২)।
সিরিয়া সফরকালে এক মজলিসে তিনি খালিদ ইবনে ওয়ালীদের পদচ্যুতির কারণ ব্যাখ্যা করছিলেন। এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, “হে উমার! আল্লাহর শপথ! আপনি ইনসাফ করেননি। আপনি মহানবী সা: এর নিয়োগকৃত কর্মকর্তাকে অপসারণ করেছেন। আপনি রসূলে করীম সা: এর উন্মুক্ত তরবারী খাপের মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন, আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন, আপনি নিজের চাচাতো ভাইয়ের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়েছেন।” হযরত উমার রা: নীরবে সবকিছু শুনতে থাকেন এবং প্রতিবাদকারীর কথা শেষ হওয়ার পর কোমল কন্ঠে বলেন, তোমার ভাইয়ের সাহায্যার্থে তোমার রাগ এসে গেছে (শিবলী, আল ফারুক, করাচী ১৯৭০ খৃ, পৃ. ৪৬৬)।
তাঁর সাধারণ ঘোষণা ছিল যে, “যখন কারো কোন প্রয়োজন পড়বে অথবা কাউকে জুলুম করা হবে কিংবা আমার কোন কথায় অসন্তুষ্ট হবে তখন তা আমাকে জানাবে। আমিও তো তোমাদের মধ্যেকারই একজন মানুষ” (উমার ইবনুল খাত্তাব, পৃ. ২৮৭)।
“আমি তোমাদের ও আল্লাহর মধ্যে অবস্থানকারী। তাঁর ও আমার মাঝে অন্য কেউ নেই। আল্লাহ আবেদনকারীর আবেদন শোনার দায়িত্ব আমার কাঁধে ন্যস্ত করেছেন। সুতরাং নিজেদের অভিযোগসমূহ আমার কাছে পৌঁছাও। কোন ব্যক্তি যদি আমার কাছে পৌঁছতে না পারে তাহলে যারা আমার নিকটে পৌঁছতে পারে তাদের কাছে অভিযোগ পেশ কর। আমি কোনরূপ হয়রানী ব্যতীত তার অধিকার তাকে দিয়ে দিব” ( ঐ, পৃ. ২৯১)।
হযরত উসমান রা: তো রাজনৈতিক মতপার্থক্য ব্যক্ত করার এতটা স্বাধীনতা দিয়েছিলেন যে, বিদ্রোহীদের শক্তি প্রয়োগে নির্মূল করার কিংবা তাদের বাকস্বাধীনতা স্তব্ধ করে দেওয়ার তুলনায় নিজের জীবন বিসর্জন দিলেন।
হযরত আলী রা:-ও বিরুদ্ধ মত প্রকাশকারীদের কখনো বল প্রয়োগে নির্মূল করেননি, বরং তার পূর্ণ অনুমতি দিয়েছিলেন। বায়তুল মাল থেকে যে অংশ তাদের প্রাপ্য ছিল তা তারা যথারীতি নিয়মিত পেত, কারও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত কিংবা রাষ্ট্রীয় ভাতা বন্ধ করা হয়নি। তিনি খারিজীদের উদ্দেশ্যে যে লিখিত ফরমান পাঠিয়েছিলেন তাতে লেখা ছিল: “তোমরা স্বাধীন। যেখা ইচ্ছা বসবাস করতে পার। অবশ্য তোমাদের ও আমাদের মাঝে এই প্রতিশ্রুতি থাকবে যে, অবৈধভাবে কারো রক্ত প্রবাহিত করবে না, অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে না এবং কারো উপর জুলুম ও নির্যাতন করবে না। যদি তোমরা উপরোক্ত বিষয়ের কোনটি করে বস তাহলে আমি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব” (ইসলাহী, ইসলামী রিয়াসত, পৃ. ৩৩)।
মত প্রকাশের এই স্বাধীনতা কেবল খোলাফায়ে রাশেদীনের আমল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর দৃষ্টতা আমরা মুসলিম ইতিহাসের সর্বযুগেই দেখতে পাই। তবে একথা সত্য যে, পরবর্তী কালের শাসকবৃন্দের মাঝে ভিন্নমত বরদাশত করার সেই প্রাণশক্তি অবশিষ্ট ছিল না যা খোলাফায়ে রাশেদীনের চরিত্রে আমরা দেখতে পাই। কিন্তু এই ব্যাপারে পতন সত্ত্বেও মতামত প্রকাশে সাহসিকতা এবং বিরুদ্ধ মতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের যে দৃষ্টান্ত আমাদের এখানে পাওয়া যায় তা এই কথারই প্রমাণ বহন করে যে, মুসলমানরা তাদের অধিকার থেকে কখনো সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত হয়নি।
উমাইয়া আমলের সর্বাপেক্ষা অত্যাচারী শাসক ছিলেন হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ। তিনি এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,“তুমি কি মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফকে চিন”। সে বলল, হাঁ চিনি, তাকে চিনব না কেন? হাজ্জাজ বললেন, তার চালচলন ও আচার ব্যবহার সম্পর্কে কিছু বল তো। সে উত্তর দিল, সে তো খুব মন্দ লোক, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিধান অমান্য করায় অদ্বিতীয়। হাজ্জাজের চেহারা ক্রোধে লাল হয়ে গেল। তিনি অত্যন্ত কর্কশ স্বরে বলেন, নরাধম! তুই জানিন সা যে, সে আমার ভাই? সে অত্যন্ত শান্তভাবে জবাব দিল, হাঁ আমি তা জানি। কিন্তু আপনি কি জানেন না যে, আল্লাহ আমার প্রতিপালক এবং আল্লাহর শপথ! আপনার ভাই আপনার কাছে যতটা প্রিয় আল্লাহ আমার নিকট তার চাইতে অধিকতর প্রিয় ও আরদ্ধ” (রঈস আহমাদ জাফরী, ইসলামী জমহুরিয়াত, লাহোর সং)।
একবার হারুনুর রশীদ হজ্জ করতে যান। তাওয়াফের সময় তাঁর প্রতি আবদুল্লাহ উমরীরর নজর পড়ল। তিনি আওয়াজ দিলেন, হে হারুন! হে হারুন! হারুনুর রশীদ একটু সামনে অগ্রসর হয়ে জবাব দিলেন, “শ্রদ্ধেয় চাচাজান, নরাধম হাজির।” আবদুল্লাহ উমরী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি বলতে পার হজ্জের উদ্দেশ্য আসা লোকদের সংখ্যা কত? হারুনুর রশীদ বললেন, “অসংখ্য, সঠিক হিসাব তো আল্লাহই ভালো জানেন।” আবদুল্লাহ উমরী বলেন, হে বৎস! এই বাস্তব সত্যকে উপলদ্ধি করতে চেষ্টা কর যে, সৃষ্টি জগতের প্রত্যেকেই শুধু তার নিজের কর্মকান্ড সম্পর্কে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করবে, আর তুমি একা সকলের জবাবদিহি করবে। একটু ভেবে দেখ বিচার দিবসে তোমার দশাটা কি হবে? এ কথা শুনে হারুনুর রশীদ বাষ্পরূদ্ধ হয়ে যান এবং আবদুল্লাহ উমরীকে কিছুই বললেন না (ঐ, পৃ. ১৬৪)।
কাযী আবু ইউসুফ (রহ:) তাঁর ‘কিতাবুল খারাজ’ গ্রন্থের ভূমিকায় এই খলীফা হারুনুর রশীদকে যেসব উপদেশ দিয়েছেন তা মতামত প্রকাশের সাহসিকতার ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব। খলীফা হারুনুর রশীদ একবার ভাষণ দিচ্ছিলেন, এক ব্যক্তি দাড়িয়ে বলল, আল্লাহর শপথ! আপনি জাতীয় সম্পদ বন্টনে সমতার নীতি গ্রহণ করেননি এবং ন্যায় বিচার ও ইনসাফের ভিত্তিতে কাজ করেন নি, বরং এর বিপরীতে অমুক অমুক মন্দ কাজ করেছেন। হারুনুর রশীদ তাকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিলেন। নামাযের পরে কাযী আবু ইউসুফকে ডাকা হল। হারুনুর রশীদ তাকে বললেন, আজ এই ব্যক্তি আমার সামনে এমন সব কথাবার্তা বলেছে যা ইতিপূর্বে কেউ বলেনি। সে সময় তিনি খুবই অগ্নিশর্মা ছিলেন। আর বন্দী লোকটি জল্লাদের মাঝখানে দাঁড়ানো ছিল।
কাযী সাহেব নবী করীম সা: এর উত্তম আদর্শ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের কর্মপদ্ধতি উপমা স্বরূপ পেশ করত: হিম্মতের সাথে বললেন: “আপনি একে শাস্তি দিতে পারেন না। রসূলে করীম সা: উসওয়ায়ে হাসানার উল্লেখ হতেই হারুনুর রশীদের ক্রোধ নির্বাপিত হয়ে গেল। তিনি ততক্ষণাত সেই ব্যক্তিকে মুক্তির নির্দেশ দিলেন ( কিতাবুল খারাজ, পৃ. ৫৩)।
মালিক শাহ সালজুকীর পুত্র সুলতান সানজার খোরাসানের শাসনকর্তা ছিলেন। ইমাম গাযালী রহ: তার সাথে দেখা করে তাকে সম্বোধন করে বলেন, “আফসোস! বড়ই পরিতাপের বিষয়! মুসলমানদের গর্দানসমূহ দু:খবেদনা ও দূর্দশায় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে আর তোমার ঘোড়াগুলোর গলদেশে সোনার মালা শোভা পাচ্ছে” ( আবুল হাসান আলী নদভী, তারীখে দাওয়াত ওয়া আযীমাত, লাখনৌ ১৯৭২ খৃ. ১ খ. পৃ. ১৮৭)।
শায়খুল ইসলাম ইয্যুদ্দীন ইবনে আবদুস সালামকে তাঁর এক বন্ধু পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, বাদশাহের হাতে চুমু খান, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এবং প্রমোশন সহ আপনাকে উচ্চপদে বহাল করা হবে। শায়খুল ইসলাম বললেন: “হে নরাধম! বাদশাহের হাত চুম্বন করা তো দূরের কথা, আমি এও পসন্দ করি না যে, বাদশাহ আমার হাত চুম্বন করুক। লোকসকল! তোমরা বসবাস কর এক জগতে আর আমি বাস করছি অন্য জগতে। আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে, আমি যা থেকে মুক্তি পেয়েছি তোমরা তাতে বন্দী” (ঐ, পৃ.৩৬৪)।
এই শায়খ ইয্যুদ্দীন ঠিক ঈদের দিন যখন উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল এবং লোকেরা ভুলুন্ঠিত হয়ে নযরানা পেশ করছিল, ভরা দরবারে বাদশাহকে সম্বোধন করে বললেন, “হে আইয়্যূব! যখন জিজ্ঞাসা করা হবে, আমি কি স্বাধীনভাবে সুরাপানের জন্য তোমাকে মিসরের রাজত্ব দান করেছিলাম তখন আল্লাহর সামনে কি জবাব দেবে? বাদশাহ জিজ্ঞাসা করলেন, ঘটনা কি তাই? শায়খ বুলন্দ আওয়াযে বলেন, হাঁ অমুক মদের দোকানে অবাধে মাদকদ্রব্য বিক্রী হচ্ছে এবং অন্যান্য অশ্লীল কার্য অহরহ হচ্ছে। আর তুমি এখানে বিলাস ব্যসনে লিপ্ত হয়ে আছো। বাদশাহ তৎক্ষণাৎ শরাবখানা বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। ( ঐ, পৃ. ৩৬৬)।
এ ধরণের শত সহস্র ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে বর্তমান, যেখানে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে অতীব বলিষ্ঠ ভাষায় এবং জনসভায় ও রাজদরবারে সত্যের বাণী সমুন্নত করা হয়েছিল। এক নায়ক শাসকবৃন্দ পর্যন্ত অত্যন্ত ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার সাথে তা শুনেন এবং এরূপ প্রতিবাদী কণ্ঠকে কোন শাস্তি দেননি।
আজকের গণতান্ত্রিক যুগে স্বয়ং জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত কতজন শাসক আছেন যারা প্রকাশ্য আদালতে এবং সাধারণ সভায় মানুষকে এরূপ প্রকাশ ভংগীতে সম্বোধন করার এবং নিজেদের বিরুদ্ধে অবাধ সমালোচনার অনুমতি দেবেন?
ইসলামে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমা নির্দেশ করতে গিয়ে আল্লামা শাওকানী রহ: লিখেছেন, “যারা ইমামের (নেতার) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ইচ্ছা রাখে শরীআত তাদের হত্যা করার অনুমোদন দেয় না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের ইচ্ছা ও সংকল্প বাস্তবায়নের জন্য কোন যুদ্ধে লিপ্ত না হয় কিংবা তার প্রস্তুতি শুরু না করে। কেননা রসূলে করীম সা: ইরশাদ করেছেন: “সে যখন বিদ্রোহ ঘোষণা করবে তখন তাকে হত্যা কর-(শাওকানী, নাইলুল আওতার, ৭খ. পৃ. ১৪০)।
কোন সম্প্রদায় যদি খারিজীদের ন্যায় বিদ্রোহাত্মক মতামত প্রকাশ করে তাহলে এর ভিত্তিতে তাদের কতল করা বৈধ হবে না। এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে, তারা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলে এবং মানুষের জান মালের ক্ষতি শুরু করলে সেই অবস্থায় তাদের কতল করা বৈধ হবে- (ঐ. পৃ. ১৩৬)।
এই সীমা নির্ধারণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী রাষ্ট্রে কেবল সন্দেহ ও সংশয়ের বশবর্তী হয়ে কঠিন থেকে কঠিনতর ভিন্নমত প্রকাশের উপর কোন শাস্তি দেওয়া যেতে পারে না, যতক্ষণ না কার্যত কোন বিদ্রোহমূলক তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। ইসলামী রাষ্ট্রে কোন সরকার স্বাধীন মতামত প্রকাশের উপর কোন কালাকানুন আরোপ করতে পারেনা। কেননা এর অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহ প্রদত্ত অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া এং স্বয়ং সর্বশক্তিমান আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত হওয়া।
৯. বিবেক ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা
ইসলামী রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিকের বিবেক ও ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতা রয়েছে। কুরআনুল করীমের সিদ্ধান্ত:
“দীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই। সত্য পথ ভ্রান্ত পথ হতে সুষ্পষ্ট হয়ে গেছে”( বাকারা: ২৫৬)।
অর্থাত সত্য পথ তো তাই যার দিকে ইসলাম মানবজাতিকে আহবান জানাচ্ছে এবং সত্য মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণের জন্য ভ্রান্ত ধারণাসমূহকে ছাটাই করে পৃথক করে দিয়েছে। এখন আল্লাহর অভিপ্রায় ও মুসলমানদের প্রচেষ্ঠা তো এটাই যে, সারা বিশ্ব যেন ইসলামের সত্যের আহবানকে গ্রহণ করে নেয়। কিন্তু এই ব্যাপারে কারও উপর বল প্রয়োগের কোন অবকাশ নেই। যার মনে চায় তা যুক্তি প্রমাণের ভিত্তিতে গ্রহণ করবে এবং যার মন চাইবে না তাকে তা গ্রহণ করার জন্য বাধ্য করা যাবে না। কুরআনুল করীমে মহানবী সা: কে সম্বোধন করে ইরশাদ হচ্ছে:
وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَآمَنَ مَن فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا ۚ أَفَأَنتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتَّىٰ يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ [١٠:٩٩]
অর্থ: “তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সকলেই ঈমান আনত, তবে কি তুমি মুমিন হওয়ার জন্য মানুষের উপর বল প্রয়োগ করবে” ( সূরা ইউনুস:৯৯)।
অন্যস্থানে রসূলে করীমের সত্যের দাওয়াত প্রসঙ্গে তার যিম্মাদারী বর্ণনা করতে গিয়ে ইরশাদ হয়েছে:
(আরবী***)
অর্থ: “অতএব তুমি উপদেশ দাও, তুমি তো একজন উপদেশ দাতা। তুমি তো ওদের কর্মনিয়ন্ত্রক নও” (সূরা গাশিয়াহ : ২১-২২)।
এই একই কথা সূরা কাফ এর ৪৫ নং আয়াতে, সূরা ইউনুসের ১০৮ নং আয়াতে, সূরা কাহফের ২৯ নং আয়াতে, সূরা আনআমের ১০৭ নং আয়াতে, সূরা আনকাবূতের ৪৬ নং আয়াতে এবং সূরা যুমারের ৪১ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
মানুষের হেদায়াত ও সুপথ প্রদর্শণের জন্য আল্লাহ যত নবী রসূল প্রেরণ করেছিলেন তাদের সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল যথারীতি সত্যের পয়গাম পৌঁছে দেওয়া। তাঁরা স্বয়ং তাদের মিশন সম্পর্কে বলেছেন:
(আরবী***)
স্পষ্টভাবে প্রচার করাই আমাদের দায়িত্ব” (ইয়াসীন: ১৭)।
অনুরূপভাবে রসূলে করীম সা:-কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে:
(আরবী***)
অর্থ: “ অনন্তর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তোমার দায়িত্ব তো কেবল স্পষ্টভাবে বানী পৌঁছিয়ে দেওয়া-(সূরা নাহল:৮২)।
সূরা শূরাতে রসুলুল্লাহ সা:-কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তিনি যেন দীনের প্রতি মিথ্যারোপকারী কাফের মুশরিকদের জানিয়ে দেন:
اللَّهُ رَبُّنَا وَرَبُّكُمْ ۖ لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ ۖ لَا حُجَّةَ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ
অর্থ: “আল্লাহই আমাদের প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। আমাদের কর্ম আমাদের জন্য এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের জন্য। আমাদেরও তোমাদের মধ্যে বিবাদ নেই” ( সূরা শূরা:১৫)।
সূরা কাফেরূনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই একই বিষয়ে নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছে:
“বল, হে কাফেরগণ! আমি তার ইবাদত করি না যার ইবাদত তোমরা কর এবং তোমরাও তাঁর ইবাদতকারী নও যাঁর ইবাদত আমি করি। আর আমি তার ইবাদতকারী নই যার ইবাদত তোমরা কর এবং তোমরাও তাঁর ইবাদতকারী নও যাঁর ইবাদত আমি করি। তোমাদের জন্য তোমাদের দীন আর আমার জন্য আমার দীন।”
এই পর্যায়ে হযরত উমার রা:-র গোলাম ওসাক রূমীর ঘটনাটি সহিষ্ণুতার উত্তম উদাহরণ হয়ে আছে। সে নিজেই বর্ণনা করছে, আমি হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব রা:-গোলাম ছিলাম। তিনি আমাকে প্রায়ই বলতেন, মুসলমান হয়ে যাও। যদি তুমি ইসলাম গ্রহণ কর তাহলে আমি তোমার উপর মুসলমানদের আমানতের কোন দায়িত্ব অর্পণ করব। কেননা অমুসলমানকে মুসলমানের আমানতের কার্যে নিয়োগ করা আমার জন্য সংগত নয়। কিন্তু আমি ইসলাম কবুল করি নাই। এরপরে তিনি বলতেন: লা ইকরাহা ফিদ্দীন। (দীনে কোন জবরদস্ত নেই)। পরিশেষে তাঁর ওফাতের পূর্বাহ্নে তিনি আমাকে মুক্ত করে দেন। এ সময় তিনি বলেন, “যেখানে মন চায় চলে যাও”-কিতাবুল আমওয়াল, ১ খ. পৃ. ১৫৪)।
হযরত সাদ ইবনে উবাদাহ আনসারী রা:-র ঘটনা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত খেলাফতের ব্যাপারে আপন মতামতের উপর অবিচল থাকেন। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে জবরদস্তিমূলক বায়আত না নিয়েছেন হযরত আবু বাকর রা: আর না উমার রা:। মুসলমানদের মধ্যে মতের বিভেদের স্বাধীনতা হামেশাই বিদ্যমান ছিল। খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে আমীর ও মজলিসে শূরার মীমাংসার ক্ষেত্রে অনেকেই মতবিরোধ করতেন এবং তাঁরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত স্থির না হওয়া পর্যন্ত আপন আপন অভিমতের উপর বহাল থাকতেন, কিন্তু আনুগত্য করতে আমীরের সিদ্ধান্তেরই। মিনায় হযরত উসমান রা:-র কসর নামায আদায় না করার ঘটনাটি এই বিষয়ের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অনেক সাহাবী তাই এই বিষয়টির তীব্র বিরোধিতা করেন। কিন্তু যখন তাঁর পেছনে নামায পড়েছেন তখন তাঁর অভিমত অনুসারে সকলে নামায আদায় করেন। আজ পর্যন্ত এই মতানৈক্য চলে আসছে-(ইসলাহী, ইসলামী রিয়াসত, পৃ. ২৯)।
হযরত উমার রা: বায়তুল মুকাদ্দাসের গির্জার এক কোণে নামায পড়েন। অত:পর তিনি ভাবলেন, মুসলমানরা আমার নামাযকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে ঈসায়ী (খৃস্টান)-দের হয়ত বহিষ্কার করে দিতে পারে। তাই তিনি একটা বিশেষ প্রতিজ্ঞা লিপি লিখে দূত মারফত পাঠিয়ে দেন। এই অংগীকার নামার আলোকে গির্জা খৃস্টানদের জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া হল। আর এই নিয়ম প্রবর্তন করা হল যে, এক সময়ে শুধুমাত্র একজন মুসলমান গির্জায় প্রবেশ করতে পারবে; তার বেশী নয়- ( মুহাম্মাদ হুসায়েন হায়কাল, উমার ফারূক, উর্দু অনু. পৃ. ৩০২)।
ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতার ব্যাপারে ইসলাম শুধুমাত্র এতটুকু নির্দেশই দেয়নি যে, তোমরা কারো উপর বল প্রয়োগ করবে না, বরং এ নির্দেশও দিয়েছে যে, কারো মনে কষ্ট দিও না তাদের উপাস্য দেব-দেবীকে গালমন্দ কর না। কুরআনুল করীমে ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী***)
অর্থ: “আল্লাহ ছাড়া তারা যাদের পূজা করে তাদের গালমন্দ কর না” (সূরা আনআম: ১০৮)।
ধর্মীয় তর্ক বিতর্কে অধিকাংশ লোক সাবধানতার আঁচল হাতছাড়া করে ফেলে, নিজেদের প্রতিপক্ষের আকীদা -বিশ্বাসকে তিরষ্কারের লক্ষ্যবস্তু বানায়। তাদের উপাস্যদের এবং তাদের ব্যক্তিত্ব ও সম্মানিত ব্যক্তিদের গালমন্দ করে। এই বিষয়ে মুসলমানদের কঠোভাবে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে:
(আরবী***)
অর্থ: “তোমরা উত্তম পন্থা ব্যতীত কিতাবধারীদের সাথে বাদানুবাদে লিপ্ত হবে না” (সূরা আনকাবূত:৪৬)।
এই একটি মাত্র শব্দ ‘আহসান’ (উত্তম) এর মধ্যে শরাফত, ভদ্রতা, নম্রতা, শালীনতা, ধৈর্য-সহিষ্ণুতা ইত্যাদি যাবতীয় গুণাবলী অন্তর্ভূক্ত। এই নির্দেশ শুধুমাত্র আহলে কিতাবের জন্যই নির্দিষ্ট নয়; বরং সমস্ত ধর্মবিশ্বাসীদের বেলায় প্রযোজ্য।
১০. সমান অধিকার
কুরআনুল করীম মানবগোষ্ঠীকে জন্মগতভাবে সমান মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে।
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَىٰ وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا ۚ إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ ۚ
অর্থ: “হে মানবজাতি! আমরা তোমাদের সকলকে এক পুরুষ ও এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি। পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন গোত্র ও বংশে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। আর তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকী” ( সূরা হুজুরাত:১৩)।
এই কথাটিই নিম্নোক্ত বাক্যে বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে মহানবী সা: এর মুখে উচ্চারিত হয়েছিল: “কোন অনারবের উপর কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, আর না আছে কোন আরবের উপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব, কোন কালোর উপর কোন সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নেই, আর না আছে সাদার উপর কোন কালোর শ্রেষ্ঠত্ব-তাকওয়া ছাড়া।” অর্থাৎ শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া।
“তোমরা সবাই আদমের সন্তান (বংশধর), আর আদম আ: মাটির তৈরী”-(বুখারী, মুসলিম)।
কুরআন মজীদ ও রসূলে করীমের এই বাণী সমূহের আলোকে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানায় বসবাসকারী সকল মানুষ আইনের চোখে সমান মর্যাদার অধিকারী। সামাজিক জীবনেও তাদের মধ্যে তাকওয়া (আল্লাহভীতি) ব্যতিরেকে শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণের কোন মানদন্ড নেই। রক্ত সম্পর্কের ভিত্তিতে ইসলাম সমগ্র মানব জাতিকে এক সমতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। আর ঈমান ও ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে মুসলমানদেরকে পরষ্পর ভাই ভাই হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ভাতৃত্ব স্থাপন করেছে। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী***)
অর্থ: “নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরষ্পর ভাই ভাই” ( সূরা হুজুরাত:১০)।
রসুলুল্লাহ সা: শুধুমাত্র মুসলমানদেরকেই নয়, দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে একে অন্যের ভাই বলে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন: “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, সকল মানুষ পরষ্পর ভাই ভাই”- ( আবু দাউদ, নামায অধ্যায়)।
নবী যুগ, খোলাফায়ে রাশেদীনের আমল এবং পরবর্তীকালে আমরা এমন অনেক উদাহরণ পাই যেখানে মনিব-গোলাম, শাসক-শাসিত, আমীর-ফকীর, মুসলিম-অমুসলিম, নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রে ইনসাফের বেলায় কঠোরভাবে সাম্যনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। অধিকার ও পারষ্পরিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে রসূলে করীম সা: হর হামেশা নিজেকে অপরের সমতুল্য মনে করতেন। অভিজাত কুরায়শ বংশের ফাতিমা নাম্নী এক নারী চুরি করে ধরা পড়ল। হযরত উসামা রা: তাকে মাফ করে দেওয়ার সুপারিশ করলে মহানবী সা: কঠোর ভাষায় বলেন
“হে উসামা! আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তির ব্যাপারে সুপারিশ করে অনধিকার চর্চা করছ? সাবধান! আর কখনও এরূপ ভুল করবে না।” অত:পর তিনি হযরত বিলাল রা: কে নির্দেশ দিলেন মসজিদে মুসলমানদের একত্র করতে। মুসলমানরা সমবেত হলে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেন: ‘তোমোদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহ এজন্যই ধ্বংস হয়েছে যে, তারা সাধারণ লোকদের ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী শাস্তি কার্যকর করত, কিন্তু বিশিষ্ট লোকদের কোন শাস্তি দিত না। সেই মহান সত্তার শপথ যাঁর মুঠোয় আমার জীবন! যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমাও এরূপ করত তবে আমি তারও হাত কাটতাম”(বুখারী, মুসলিম)।
মুসলমানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ ۖ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَىٰ أَلَّا تَعْدِلُوا ۚ اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَىٰ ۖ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ [٥:٨]
অর্থ: “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে; কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন কখনো সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা ন্যায় পরায়ণতা অবলম্বন করবে। এটা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জ্ঞাত” (সূরা মায়িদা:৮)।
যদিও নবী করীম সা: কখনো কারো প্রতি অন্যায় আচরণ করেননি কিন্তু তা সত্ত্বেও আল্লাহর এই নির্দেশ ইসলামী সমাজে কার্যত বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে তিনি এত অধিক সতর্ক ও যত্নবান ছিলেন যে, তিনি বারংবার লোকদের বলতেন, কারো সাথে অন্যায় আচরণ করা হয়ে থাকলে সে যেন আমার নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। তাঁর পবিত্র জীবনে এমন কতক ঘটনার সন্ধান মিলে যাতে তিনি নিজেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পেশ করেছিলেন। হযরত সাওয়াদ ইবনে উমার রা: বলেন, একবার আমি রঙীন পোশাক পরিধান করে মহানবী সা: এর খেদমতে হাযির হলাম। তিনি আমাকে দূর হও, দূর হও বলে ছড়ি দ্বারা টোকা দিলেন। আমি আরজ করলাম: “হে আল্লাহর রসূল! আমি এর প্রতিশোধ গ্রহণ করব। তিনি ততক্ষণাত পেট মুবারক আমার সামনে খুলে দিলেন” (রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড, পৃ. ২৬৫)।
এমনিবাবে বদরের যুদ্ধক্ষেত্রে হযরত সাওয়াদ ইবনে গাযিয়া রা -কে এক মজলিসে কথা প্রসঙ্গে হযরত উসায়দ ইবনে হুদায়র রা:কে এবং গণীমতের মাল বণ্টনকালে জনৈক সাহাবীকে ছড়ির অগ্রভাগ দিয়ে আঘাত করার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি নিজকে তাদের সামনে পেশ করেন” (মুহাম্মাদ হাফীযুল্লাহ, ইসলামী মাসাওয়াত, করাচী ১৯৭১ খৃ. পৃ. ৮৫)।
রসূলে করীম সা: এর প্রতিষ্ঠিত এসব উপমার বরাত দিয়ে হযরত উমার রা: মিসরের গভর্ণর হযরত আমর ইবনুল আস রা:-র এক অভিযোগের জবাব দিয়েছিলেন। অভিযোগটি এই: “হে আমীরুল মুমিনীন! মনে করুন, এক ব্যক্তি কোন এক অঞ্চলের শাসক এবং তিনি একজনকে শাস্তি দিচ্ছেন তাহলে আপনিও তার থেকে প্রতিশোধ নেবেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন: “সেই মহান সত্তার শপথ যাঁর নিয়ন্ত্রণে আমার জীবন! আমি তার থেকেও মযলুমের পক্ষে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য মানুষের সামনে পেশ করতেন” ( ইসলাহী, ইসলামী রিয়াসাত, পৃ. ৪২, কিতাবুল খারাজের বরাতে)।
সুতরাং তিনি তাঁর দশ বছরের খেলাফতকালে এই সাম্যনীতির বাস্তবায়নে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। জাবালা ইবনে আয়হাম গাসসানী যখন এক বেদুঈনকে চপেটাঘাত করার কিসাস থেকে বাঁচার জন্য এই দলীল পেশ করেছিল যে, ‘হে আমীরুল মুমিনীন! তা কিভাবে হতে পারে? সে তো নগণ্য এক ব্যক্তি, আর আমি হলাম বাদশাহ?” তখন উমার রা: বলেন, “ইসলাম তো আপনাদের দুইজনকে ভাই ভাই করে দিয়েছে। আপনি শুধুমাত্র তাকওয়ার বিচারে তার উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারেন, অন্য কোন পন্থায় নয়” ( উমার ইবনুল খাত্তাব, পৃ. ২৫৪)।
“তিনি (উমার) হযরত আবু মূসা আশআরী রা:, হযরত আমর ইবনুল আস রা:, তাঁর পুত্র মুহাম্মাদ, হিমসের গভর্ণর আবদুল্লাহ ইবনে করত রা: এবং বাহরাইনের গভর্ণর কুদামা ইবনে মাযউন রা:-র বিরুদ্ধে শাস্তি কার্যকর করে আইনের চোখে সাম্যের এমন উপমা স্থাপনা করলেন বিশ্বের ইতিহাসে যার নযীর বিরল” ( এই ঘটনার জন্য দ্র. তানতাবীর উমার ইবনুল খাত্তাব এবং শিবলীর আল ফারুক)।
হযরত যায়েদ ইবনে ছাবিত রা:-র আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় বিবাদী হিসাবে তাঁর উপস্থিতি, তাঁকে সম্মান প্রদর্শনে অসন্তোষ প্রকাশ এবং এ কথা বলা যে, “এটা তোমার প্রথম অন্যায়”, মামলার বাদী হযরত উবাই ইবনে কাব রা:-র সমপর্যায়ে বসা এবং সাক্ষ্য উপস্থিত না করে শপথের উপর সম্মতি প্রকাশ করা; অত:পর যায়দ ইবনে ছাবিত রা:-র পরামর্শক্রমে উবাই ইবনে কাবের ক্ষমা করার প্রতি রাগান্বিত হওয়া এবং এই কথা বলা যে, যায়েদ! যতক্ষণ পর্যন্ত একজন সাধারণ নাগরিক ও উমার তোমাদের কাছে সমান মর্যাদা সম্পন্ন না হবে ততক্ষণ তুমি বিচারকের পদের যোগ্য বিবেচিত হতে পারবে না।”
এ হচ্ছে ইসলামে বিচার বিভাগীয় সাম্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই ধরণের অপর একটি উপমা কায়েম করেন হযরত আলী রা: তাঁর খেলাফতকালে। লৌহবর্ম চুরির মামলায় ফরিয়াদী হিসাবে তিনি কাযী শুরায়হ এর আদালতে উপস্থিত হন। আসামী ছিল একজন যিম্মী। কাযী শুরায়হ হযরত আলী রা: কে সম্বোধন করে বলেন, “হে আবু তুরাব! আপনি প্রতিপক্ষের সামনাসামনি বসুন।” কাযী সাহেব বুঝতে পারলেন যে, এই কথাটি হযরত আলী রা:-র কাছে খারাপ লেগেছে। তিনি বলেন, “ওহে আবু তুরাব! সম্ভবত: আমার কথা আপনার নিকট অপসন্দনীয় হয়েছে, অথচ ইসলামের আইন ও আদালত সম্পর্কীয় সাম্যনীতির আবেদন হচ্ছে ফরিয়াদী ও আসামীর একই সমতলে বসা।”
হযরত আলী রা: বললেন, আমার প্রতিপক্ষের সমান স্তরে আমাকে উপবেশন করার নির্দেশ আমার কাছে অপ্রিয় মনে হয়নি, বরং আমার কাছে যা অপ্রিয় মনে হয়েছে তা এই যে, আপনি আমাকে উপনামে সম্বোধন করেছেন। এভাবে আমার প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় আমাকে সম্মান প্রদর্শন করেছেন। এটা তো আমার প্রতিপক্ষের সাথে আপনি ষ্পষ্ট অন্যায় করলেন” (ইসলাহী, ইসলামী রিয়াসাত, পৃ. ৪৫)।
হযরত উমার রা: পুরুষদেরকে নারীদের সাথে অবাধে ঘোরাফেরা করতে নিষেধ করেছিলেন। এক ব্যক্তিকে মহিলাদের সাথে নামায পড়তে দেখে তাকে চাবুক লাগালেন। সে বলল, “আল্লাহর শপথ! যদি আমি মন্দকাজ করে থাকি তাহলে আপনি এর আগে আমাকে তা জানাননি।”
তিনি বললেন, “তুমি কি আমার নসীহত করার সময় উপস্থিত ছিলে না? সে বলল, না।
তিনি তার সামনে চাবুকটি রেখে বললেন, “আমার কাছ থেকে প্রতিশোধ নাও।” সে বলল, “আজ নিচ্ছি না।” তিনি বললেন, “বেশ তাহলে ক্ষমা করে দাও।” সে বলল, “ক্ষমাও করছি না।” অত:পর উভয়ই একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। পরদিন সাক্ষাত করে সে হযরত উমার রা: কে মলীন চেহারায় দেখতে পেল। সে বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! সম্ভবত আমার কথায় আপনি বিব্রতবোধ করছেন? তিনি বললেন, হাঁ। সে বলল, “আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি” (মাওয়ারদী, আহকামুস সুলতানিয়া, উর্দু অনু. পৃ. ২২৫)।
কুরআনুল করীমে ফেরাউনের যে হীন অপকর্মের উল্লেখ আছে তার একটি ছিল এই যে, সে তার জাতিকে উঁচু-নীচু ও আশরাফ-আতরাফের বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে রেখেছিল। এদের মধ্যে এক শ্রেণীকে সে তার জুলুম নির্যাতন ও অত্যাচার অবিচারের যাঁতাকলে বেঁধে রাখত এবং তাদের অপমানিত ও লাঞ্ছিত করত।
(আরবী***)
অর্থ: “ফেরাউন দেশে (মিসরে) বিদ্রোহ করেছিল এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে তাদের একটি শ্রেণীকে সে হীনবল করে রেখেছিল” (সূরা কাসাস: ৪)।
এর বিপরীতে ইসলামের কৃতিত্ব এই যে, সে উঁচু নিচু এবং নিচুকে উঁচু করে সমাজে ভারসাম্য স্থাপন করেছে এবং মানুষের মাঝে সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে।
হযরত উমার রা_ কে যখন মক্কার গভর্ণর নাফে ইবনুল হারিস জানান, আমি মুক্তদাস ইবনুল বারাকে আমার স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ করে এসেছি, তখন তিনি তার যোগ্যতা ও গুণাবলীর কথা শুনে অত্যন্ত খুশী হয়ে বলেন, “কেন হবে না, আমাদের নবী সা: বলে গেছেন যে, আল্লাহ তাঁর এই কিতাবের বদৌলতে কতককে উপরে উঠাবেন এবং কতককে নীচে নামিয়ে দেবেন। (ইসলামী মাসাওয়াত, পৃ. ১০০)।