মৌলিক অধিকারের রক্ষাকবচ
অধিকারের গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ধারণার পর্যালোচনা করার পর আমরা এখন দেখব যে, মৌলিক অধিকারসমূহ কার্য্কর করার জন্য উল্লেখিত দেশসমূহ যে রক্ষাব্যবস্থা চয়ন করেছে তা ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের জুলুম নির্যাতন থেকে নিরাপদ রাখার ক্ষেত্রে বাস্তবে কতটা কার্য্যকর ও সফল প্রমাণিত হয়েছে।
পাশ্চাত্যের আইন ব্যবস্থায় ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সংবিধানকে এসব অধিকার এর সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং তার বাস্তব প্রয়োগের একমাত্র পন্থা এই বলা হয় যে, এসব অধিকার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে বিচার বিভাগের মাধ্যমে অর্জনযোগ্য বানাতে হবে। এই অবস্থা বাহ্যত খুবই শক্তিশালী দৃষ্টিগোচর হয় এবং কোনো কোনো পাশ্চাত্য দেশে বিশেষতঃ বৃটেন, আমেরিকা ও ফ্রান্সে তা পূর্ণ সৌন্দর্য্য সহকারে কার্য্করও হচ্ছে। দুনিয়ার প্রায় সবগুলো দেশে ঐ সাংবিধানিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে এবং জনগণ তাদের মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে সংবিধানের পবিত্রতম আইনগত দলীলকে নিজেদের একমাত্র আশ্রয় মনে করে। কিন্তু আমরা যখন বিভিন্ন দেশের সংবিধানের মূল্যায়ন করি এবং ঐসব দেশে সংঘটিত ঘটনাবলী অধ্যয়ন করি তখন এই সত্য উদ্ভাসিত হয়ে সামনে আসে যে, যে সংবিধানকে মৌলিক অধিকারের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ মনে করা হচ্ছে স্বয়ং তা-ই রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ থেকে নিরাপদ নয়। আমেরিকা ও বৃটেনের লিখিত বা অলিখিত সংবিধানের আলোচনায় পরে আসছি। আপনি পৃথিবীর যে কোনো সংবিধান খুলে দেখুন-এর অভ্যন্তরভাগে ‘সাংবিধানিক সংশোধন’ নামে একটি পূর্ণ অনুচ্ছেদ দেখতে পাবেন-যার আশ্রয় নিয়ে ক্ষমতাসীন দল সংখ্যাগরিষ্টতার দাবীতে এবং কার্য্প্রণালীর মাধ্যমে সংবিধানে উদ্দেশ্য অনুযায়ী সংশোধন করার এবং তাকে নিজেদের আকাঙ্খা ও প্রয়োজন অনুযায়ী ঢেলে সাজানোর পূর্ণ সুযোগ পেয়ে যায়। এভাবে উপরোক্ত সংবিধান যা সাধারণতঃ কোনো সংখ্যাগরিষ্ট দলের দ্বারা বা প্রভাবাধীনে প্রণীত হয় তা সংশ্লিষ্ট দলকে একনায়কতন্ত্রের ধারায় রাজত্ব করার জন্য লাগামহীন ও সীমাহীন ক্ষমতার লাইসেন্স দেয়। এমনিতেই সংবিধান প্রণয়নের প্রাথমিক স্তরেই সংবিধান সুদৃঢ় করার সকল বন্ধন ঢিলা করার ব্যবস্থা করা হয়।
ডরোথি এই অবস্থার মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছেনঃ“সংবিধানসমূহ রাজনীতিজ্ঞদের দ্বারা রচিত হয়ে থাকে, যারা স্বীয় দলের দৃষ্টিভঙ্গী ও ঝোঁকপ্রবণতার প্রতি বিশ্বস্ততা প্রদর্শন করতে বাধ্য এবং কখনও কখনও মিশ্র সরকারের প্রয়োজনসমূহ ও সুবিধার দিকটিও এতে বিবেচনায় রাখা হয়।”(Dorothy Pickles, Democracy, Mathuen & Co., London 1970, P. 101)।
সাংবিধানিক সরকারের বুনিয়াদী দর্শন এই যে, শাসক গোষ্ঠীর ক্ষমতার গন্ডি নির্দেশ করে তাদেরকে ক্ষমতার আনুগত্য করতে বাধ্য করতে হবে। তারা যদি নিজেদের ধার্য্কৃত ক্ষমতার গন্ডি অতিক্রম করে তবে বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদেরকে এরূপ করা হতে বিরত রাখা হবে। কিন্তু আমরা দেখছি যে, বাস্তব অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। যে বিচার বিভাগের উপর শাসকগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জিম্মাধারী অর্পণ করা হয়েছে তাকেই শাসক গোষ্ঠী ও রাজনীতিজ্ঞদের রচিত সংবিধান ও তাদের প্রদত্ত ক্ষমতার অধীনে থেকে কাজ করতে হয়। তার নিজস্ব ক্ষমতার উৎস কি?- সেই সংবিধান যার প্রণয়নে তার নিজস্ব কোনো ভূমিকা থাকেনা এবং যা প্রতিনিয়ত শাসক গোষ্ঠীর হাতে সংশোধন, রহিতকরণ, সীমিতকরণ ও স্থগিতকরণের শিকার হতে থাকে। ক্ষমতাসীনদের কর্তৃত্বের উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ ছাড়া যে সংবিধানের নিজ অস্তিত্বের অন্য কোনো উদ্দেশ্য নাই তা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর মর্জিমাফিক এখতিয়ার অর্জন করে থাকে। কোনো ধারার সংশোধন, নতুন ধারার সংযোজন, কোনো ধারা বাতিল, জরুরী অবস্থা ঘোষণা এবং এর অধীনে অর্জিত ক্ষমতার প্রয়োগ, মৌলিক অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ধারার স্থগিত এবং নতুন বিধানের অতীত হতে কার্য্যকর ধারার মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী নিজেদের জন্য কার্য্প্রণালীর পন্থা বের করে নেয়। বিচারবিভাগ-যার এখতিয়ারসমূহ সংবিধানে কৃত সংশোধন ও রহিতকরণের মাধ্যমে সদা পরিবর্তিত হতে থাকে-তা শাসক গোষ্ঠীর যথেচ্ছ কার্য্কলাপের পথে বাধার সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়। কারণ তার উপর আইন পরিষদের প্রাধান্য স্বীকৃত এবং এই বিচার বিভাগের উপর ক্ষমতাসীন দল সংখ্যাগরিষ্টতার দোহাই পেরে প্রাধান্য বিস্তার করে আসছে। পাকিস্তানের সুপ্রীম কোর্ট সরকার বনাম যিয়াউর রহমানের মামলায় আদালতের এখতিয়ারের পরিমন্ডলের ব্যাখ্যা প্রদান করে তার রায়ে বলেছেঃ “একথা যেখানে যথার্থ যে, বিচার বিভাগীয় এখতিয়ারসমূহ বিলোপ করা যায়না-সেখানে এটাও এক বাস্তব সত্য যে, যেসব লোকের উপর সুবিচার ও ইনসাফ কায়েমের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে তাদের এখতিয়ারের গন্ডি আইনত সংবিধানেই সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। অতএব হাইকোর্ট ও সুপ্রীমকোর্টের এখতিয়ারসমূহের সীমা নির্দেশ করা সংবিধানেরই দায়িত্ব। অনুরূপভাবে কোন্ প্রকারের মোকদ্দমার ফয়সালা হাইকোর্ট ও সুপ্রীমকোর্টের পরিবর্তে ট্রাইবুনালে হবে তার ব্যাখ্যাও সংবিধানই দিতে পারে। এখতিয়ারসমূহের মধ্যে এই প্রকার সীমা নির্দেশের উপর কোনো আপত্তি তোলা যায়না। সত্য কথা এই যে, উপরোক্ত প্রকারের সীমা নির্দেশ বর্তমান না থাকলে বিচ্ছিন্নতা ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে। কারণ এর ফলে কেউই অবহিত থাকবে না যে, তার ক্ষমতা ও এখতিয়ারের গন্ডী কত দূর।”(PLD 1973, Supreme Court, P. 49 State Vs. Ziaur Rahman, P. 62)।
উপরোক্ত বক্তব্য হতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, এই সীমা নির্দেশ আইন প্রণেতাগণের, অন্য কথায় শাসক গোষ্ঠীর হাতে ন্যস্ত। তাই বিচার বিভাগ সেইসব এখতিয়ার মোতাবেক কাজ করতে বাধ্য যা শাসক গোষ্ঠী তাকে দান করে। এটা সেই তিক্ত সত্যেরই পরিণতি যে, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর যেসব কার্য্যক্রম সংবিধানের প্রাণশক্তিকে ও তার মৌলিক কাঠামোকে সম্পূর্ণ বিকৃত করে দিয়েছে তা অবিকল সংবিধান মোতাবেক সাব্যস্ত হয়ে থাকে। কারণ নিজস্ব কার্য্যক্রম বৈধ করার জন্য তারা সংবিধান সংশোধন করে আইনগত বৈধতা সৃষ্টি করে নেয় এবং এভাবে গতকাল পর্য্ন্ত যেসব পদক্ষেপ ছিল অবৈধ ও আইনবিরোধী তা আজ কেবল সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বৈধ ও আইনসিদ্ধ হয়ে গেল। এই সংশোধন বা পরিবর্তনের পথে কোথাও কোনো নৈতিক মূল্যবোধ অথবা ন্যায়বিচারের কোনো নীতিমালা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারেনা। বিচার বিভাগ কেবল প্রণীত আইনের অনুগত, কোনো নৈতিক মূল্যবোধের নয়। অতএব পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট বিগ্রেডিয়ার(অব.) এফ.বি. আলী ও কর্ণেল(অব.) আবদুল আলীম আফরীদির মোকদ্দমার রায় দিতে গিয়ে লিখেছেঃ “একথাও বলা হয়েছে যে, অর্ডিন্যান্স(অধ্যাদেশ)আইনের মর্যাদাই পেতে পারে না। কারণ নাগরিকদের কোনো কারণ ব্যতিরেকেই কোর্টের শুনানীর অধিকার হতে বঞ্চিত করাই তার উদ্দেশ্য। কিন্তু এই সাধারণ মূলনীতি গ্রহণ করা যায়না। ১৯২২ সালের আইনে এর সংজ্ঞা দেওয়া নাই। অতএব সাধারণভাবে স্বীকৃত অর্থের আলোকে আইন বলতে প্রণীত আইন বুঝায়। অর্থাৎ আইন জারিকারীর ইচ্ছা ও আকাংখার প্রথাসিদ্ধ ঘোষণা। আইনের রূপ ধারণ করার জন্য অনুকূল আইনের প্রমাণ থাকা অথবা নৈতিকতার উপর ভিত্তিশীল হওয়া প্রয়োজন-এরূপ কোনো শর্ত বিদ্যমান নেই। বিচারালয়সমূহ এ ধরনের কোনো উন্নত নৈতিক মূলনীতির কারণে আইনকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে না, আর না আইনের দার্শনিক মতবাদের ভিত্তিতে বিচারালয়সমূহ কার্য্ক্রম পরিচালনা করতে পারে-যেমন আদালত ইতোপূর্বে আসমা জিলানীর মোকদ্দমায় সবিস্তারে আলোচনা করেছে। এসব কারণের ভিত্তিতে মাননীয় প্রধান বিচারপতি, যিনি মূল সিদ্ধান্ত লিখেছেন, এটা গ্রহণ করতে অপারগ যে, যেসব অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে যুক্তিপ্রমাণ পেশ করা হয়েছে সেসব অধ্যাদেশ আইন ছিল না এবং তাই ছিল মৌলিক অধিকার নং-১ এর পরিপন্থী।”(PLD 1975, Supreme Court, P. 506, Re. State Vs. F.B. Ali & Others, P. 527-28)।
এখন যেখানে প্রণীত আইনের এই প্রাধান্য রয়েছে এবং স্বয়ং আইন আইনদাতার ইচ্ছা ও মর্জির প্রথাসিদ্ধ ঘোষণা মাত্র, সেখানে বিচারালয়সমূহ নাগরিকদের শুধু এতটুকুই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারে যতটুকু নিরাপত্তা দেওয়ার অনুমতি তাদেরকে প্রচলিত সংবিধান এবং শাসকগোষ্ঠীর জারিকৃত আইন দিয়েছে। এইসব বিধান বৈধ বা অবৈধ হওয়ার ফয়সালা কিভাবে করা যাবে? এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আসমা জিলানীর মামলায় সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হামিদুর রহমান তাঁর রায়ে বলেন, “আইনের কোনো সংজ্ঞা যদি অত্যাবশ্যকীয় হয়ই তবে বিচারকদের ক্ষেত্রে বলা যায় যে, তাদেরকে শুধু এতটুকুই দেখতে হবে যে, যে আইন কার্য্কর করার দাবী তার নিকট করা হচ্ছে তা এমন কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের রচিত যারা আইনত আইন প্রণয়নের অধিকারী এবং তা আইন যন্ত্রের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য। আমার মতে এই সংজ্ঞার মধ্যে আইনের বৈধতা ও তার কার্য্কারিতা উভয়ই এসে যায়”। (PLD 1972, Supreme Court, P. 139, Re. Asma Jilani Vs. Govt. of Punjab & Others, P. 159)।
সংবিধান রচনায় ও আইন প্রণয়নে শাসক শ্রেণীর প্রাধান্য থাকায় এবং তাদেরই হাতে বিচারালয়ের এখতিয়ার ও শুনানীর সময় নির্দিষ্ট হওয়ার দ্বারা একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সংবিধান ও আইন প্রণয়নকারীদের উপর আইনের সংরক্ষকদের(বিচার বিভাগের) প্রাধান্য ও নিয়ন্ত্রণ বাস্তবিকপক্ষে কতটুকু শক্তিশালী। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে মৌলিক অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট সাংবিধানিক ধারাগুলির যে করুণ পরিণতি হয়েছিল তা এসব অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের অক্ষমতা ও অসহায়ত্বের এক সুস্পষ্ট প্রমাণ। বাংলাদেশে শেখ মুজিব একদলীয় স্বৈরশাসন কায়েম করেন, বিরোধী দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে জেলে ঢুকান, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেন, জাতীয় পরিষদকে রাবার স্টাম্পে পরিণত করেন এবং বিচার বিভাগকে সংশ্লিষ্ট এখতিয়ার হতে বঞ্চিত করে মৌলিক অধিকারসমূহ বলবৎ করার ক্ষেত্রে তাকে শক্তিহীন করে দেন। তার এসব কার্য্যক্রম সংবিধান মোতাবেক সাব্যস্ত হল।
ভারতে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনে জয়লাভের শাস্তি হতে রেহাই পাওয়ার জন্য বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে চাইলে সংসদে ক্ষমতাসীন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যগণ সংবিধান সংশোধন করে তার আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করে দেন। আদালতের শুনানীর এখতিয়ার ছিনিয়ে নেওয়া হয়, বিরোধী দলগুলোর উপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয়, ইন্দিরার নির্বাচনী প্রতিপক্ষ ও হাইকোর্টের মামলায় জয়লাভকারী পক্ষ রাজনারায়ণ ও তার সমমনা সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে জেলে নিক্ষেপ করা হয়, জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে সমস্ত মৌলিক অধিকার স্থগিত করা হয় এবং এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে উচ্চবাচ্চকারী সংবাদপত্রগুলোর কন্ঠরোধ করে মৃত্যুর ঘাটে পৌছে দেওয়া হয়। এসব কিছু ঘটে যাওয়ার পর মিসেস ইন্দিরার উকিল মি. এ. কে. সেন দেশের সর্বোচ্চ কিন্তু ক্ষমতা বঞ্চিত আদালত সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িয়ে বলেনঃ “স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ধারণা কল্পনাপ্রসূত এবং তাকে আইনের মৌলিক অংশ বলা যায়না। নির্বাচন অবাধ ও স্বাধীনভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে রায় দেওয়ার অধিকার বিচার বিভাগের নাই”।(Kering,পূ. গ্র.,পৃ. ৫৮)।
এই পুরা খেলাটাই সংবিধানের অধীনে এবং তার প্রদত্ত এখতিয়ার অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট যেহেতু সংশোধিত সংবিধানের অধীনে রায় প্রদানে বাধ্য ছিল তাই সে ইন্দিরা গান্ধীকে সেই সমস্ত অপরাধ হতে বেকসুর খালাস প্রদান করে-ইতিপূর্বে হাইকোর্টে অসংশোধিত সংবিধানের অধীনে তাকে যেসব অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত এবং শাস্তিও দিয়েছিল।
পাকিস্তানে-যেখানে ৪র্থ সংবিধান বলবৎ রয়েছে-সংবিধান বলবৎ করার সাথে সাথে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে মৌলিক অধিকার স্থগিত করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে একটি অধ্যাদেশ জারী করে পুনরায় ৪র্থ ও ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে তাকে সীমিত করে দেওয়া হয়। জরুরী অবস্থা ঘোষণা, অধ্যাদেশ জারী এবং সংবিধানের সংশোধনও যেহেতু স্বয়ং সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত এখতিয়ারেরই অধীনে ছিল তাই এসব কাজই সংবিধান অনুযায়ী সাব্যস্ত হয়েছে। আর এগুলোর সংবিধান মোতাবেক হওয়ার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, শাসক গোষ্ঠীকে অন্তত আইন ও বিচার বিভাগের দৃষ্টিতে কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হচ্ছেনা।
এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য দেশের অবস্থাও তদ্রুপ, যেখানে সংবিধান মৌলিক অধিকারের সংরক্ষক হওয়ার পরিবর্তে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর একনায়কত্বের সংরক্ষক, তাদের নির্যাতনমূলক পদক্ষেপের পৃষ্ঠপোষক এবং তা তাদের জন্য সীমাহীন কর্তৃত্ব লাভের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থার পর্যালোচনা করতে গিয়ে সি.ভি. কারনিগ বলেনঃ “বিশ শতকে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের প্রশ্নে এতদূর বলা যায় যে, স্বয়ং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ এ প্রসঙ্গে নিজেদের অনির্ভরযোগ্য প্রমাণ করেছেন। সাধারণত সংখ্যাগরিষ্ঠ দল অহরহ কেবল মৌলিক অধিকারসমূহই পরিবর্তন করে ক্ষান্ত হয়নি, বরং গোটা সংবিধানকেই পরিবর্তন করে ছেড়েছে।” (Kering,পূ. গ্র.,পৃ. ৫৮)।
পৃথিবীর যে কোনো সংবিধান সংশোধনের বাধাহীন সুযোগ দেওয়ার সাথে সাথে ‘জরুরী অবস্থা’ শিরোনামের অধীনে শাসক শ্রেণীকে যে কর্তৃত্ব দান করে তা অবশিষ্ট অভাব পূর্ণ করে দেয়। জরুরী অবস্থার জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকা জরুরী নয়, শাসক শ্রেণী নিজেদের বিবেচনা ও পরিণামদর্শিতার ভিত্তিতে যখন ইচ্ছা তা ঘোষণা করতে পারে এবং তা ঘোষিত হওয়ার সাথে সাথে সংবিধান তাদেরকে নিজেদের বাধ্যবাধকতা থেকে একেবারে স্বাধীন ছেড়ে দেয়। তারা সংবিধান বর্তমান থাকতে সামরিক আইন জারি করতে পারে, বিচার বিভাগকে সার্বিক এখতিয়ার থেকে এবং জনগণকে সকল মৌলিক অধিকার হতে বঞ্চিত করতে পারে। দেশের সংবিধান ও আইন কোথাও তাদের হাত টেনে ধরতে পারেনা।
সংবিধানের এসব ত্রুটি এবং শাসক গোষ্ঠীর সামনে তার অসহায়ত্বের তুলনায় স্বয়ং তার অস্তিত্ত্বের প্রশ্নটি আরো করুণ। আমাদের আগামী দিনের পর্য্যবেক্ষণ এবং আমাদের পাকিস্তানীদের তিক্ত অভিজ্ঞতা এই যে, সরকারের পরিবর্তন, অন্তর্বিপ্লব, সামরিক বিদ্রোহ, বৈদেশিক আক্রমণ এবং রাজনৈতিক দলসমূহের অপরিণামদর্শী তীব্র মতবিরোধ ইত্যাদি সংবিধানকে উলটপালট করে রেখে দেয়। প্রত্যেক বিদায় গ্রহণকারীর সাথে তার বলবৎকৃত সংবিধানও কলংকচিহ্ন রেখে যায় এবং প্রত্যেক আগমনকারী সংবিধানের একটি নতুন খসড়াসহ আত্মপ্রকাশ করে। এই শেষোক্ত ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীও সংবিধানকে সেই একইরূপ আইনগত মর্যাদা দান করে যা তাদের পূর্বোক্ত ক্ষমতাসীনরা স্বীয় শাসনামলে দান করেছিল। আসমা জিলানীর মামলার রায়ে আন্তর্জাতিক আইনের বরাত দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সম্মানিত প্রধান বিচারপতি লিখেছেনঃ “আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে বিপ্লবী সরকার এবং নতুন সংবিধান-রাষ্ট্রের একটি আইনানুগ সরকার ও বৈধ সংবিধান। এজন্য একটি বিজয়ী বিপ্লব অথবা একটি সফল বিদ্রোহ সংবিধানে সরকার পরিবর্তনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পন্থা”।(PLD, পৃ. ১৫৩-৫৪)।
সরেজমিনের বাস্তব সাক্ষ্য এবং এই আন্তর্জাতিক আইন হতে অনুমান করা যায় যে, সংবিধানের সার্বিকভাবে সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা হওয়া সত্ত্বেও তা কতটা দুর্বল, অনিশ্চিত, অস্থায়ী ও ক্ষণভঙ্গুর আইনগত দলীল। সংবিধানেরই স্থায়িত্বের যেখানে নিজস্ব কোনো গ্যারান্টি বর্তমান নাই সেখানে আমরা সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের রক্ষাকবচ হিসেবে তার উপর কিভাবে ভরসা করতে পারি। যে সংবিধান অব্যাহতভাবে সংশোধনের শিকার তা কিভাবে অপরিবর্তনীয় ও অবিচ্ছেদ্য অধিকারের সংরক্ষক হতে পারে?
এ থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, মৌলিক অধিকারসমূহ অবিচ্ছেদ্য হওয়ার দাবী সঠিক নয়। এসব অধিকার নির্বাচন এবং তার বাস্তবায়নের একমাত্র মাধ্যম হল সংবিধান। সংবিধান ব্যতীত এসব অধিকারের কোনো আইনগত ভিত্তি অবশিষ্ট থাকেনা। আর সংবিধান এমন একটি কাঠের পুতুল যার লাগাম সরকারের মুষ্টিবদ্ধ, কখনও তা সংশোধনের শিকার হয়, কখনও বাতিল, কখনও সংযোজন, কখনও কিছু অংশ স্থগিত করা হয় এবং কখনো সরকারের পতনের সাথে সাথে স্বয়ং তারও পতন হয়। এই বিচিত্র অবস্থার মধ্যে মৌলিক অধিকারসমূহ কখনও সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ লাভ করে, কখনও সীমিত হয়, কখনও স্থগিত হয় এবং কখনও বাতিলকৃত সংবিধানে সাথে স্বয়ং বাতিল হয়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে কোনো দেশের জনগণ যদি বা তা অর্জনে সক্ষম হয়েও যায় তবে নানারূপ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ফাঁদে আটকা পড়ে তা প্রভাবহীন ও অকার্য্কর হয়ে যায়। নীতিগতভাবে আইনের উর্ধ্বে হলেও তার বাস্তবায়ন সর্বদা ‘আইন অনুযায়ী’ হয়ে থাকে এবং সংবিধানের মধ্যেই তাকে ‘যদি, কিন্তু, এই শর্তে যে, যদি না’ এবং এ ধরনের অন্যান্য বিভক্তি ও উপসর্গ যোগ করে আইনের অধীন করে দেওয়া হয় এবং এই আইন ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর মর্জি মোতাবেক ব্যবহৃত হয়। সি.ডি. কারনীগ বলেনঃ “মৌলিক অধিকারের শিকড় যদিও আধুনিক সংবিধানসমূহের খসড়ায় প্রোথিত থাকে কিন্তু তা সর্বদা ‘আইন অনুযায়ী ব্যাখ্যা’র শিকার হয়, অথচ স্বীয় প্রাণশক্তির দিক থেকে এটাকে হস্তক্ষেপের উর্ধ্বে এবং অলংঘনীয় মনে করা হয়।”(Kering,পূ. গ্র.,পৃ. ৫৬)।
যেসব মৌলিক অধিকারকে অবিচ্ছেদ্য, অলংঘনীয় ও হস্তক্ষেপের উর্ধ্বে সাব্যস্ত করা হয় কোনো জেলা প্রশাসকের জারীকৃত ১৪৪ ধারা তাকে স্থগিত করে দেয়। আইনের বাধ্যবাধকতার কি চমৎকারীত্ব! এই অবস্থায় সংবিধান দুর্লভ নাগরিকদের কোনোরূপ উপকার করতে অক্ষম।
সংবিধানের এই অসহায়ত্ব ও তার অস্থায়ীত্ব হতে পরিষ্কার জানা যায় যে, তা ‘মৌলিক অধিকারে’র কোনো নির্ভরযোগ্য সংরক্ষক নয় এবং তার প্রদত্ত গ্যারান্টির ভিত্তিতে এসব অধিকারকে অলংঘনীয় মনে করার কোনো অবকাশ নেই।
পৃথিবীর সংবিধানের কার্য্কারিতার বাস্তব ও সাধারণ চিত্র তুলে ধরার পর এখন বৃটেন ও আমেরিকার সেইসব সংবিধানের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যাক যাকে গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ নমুনা মনে করা হয় এবং বাহ্যত তা কার্য্কর করার ধরণটাও বেশ সন্তোষজনক দৃষ্টিগোচর হয়।
বৃটেনে মূলত কোনো লিখিত সংবিধান কার্য্কর নাই। তাই সেখানে অন্যান্য দেশের মত মৌলিক অধিকারের আইনগত রক্ষাব্যবস্থা নেই। বৃটিশ পার্লামেন্ট হচ্ছে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তার আইন প্রণয়নের ক্ষমতার উপর কোনো কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপিত নেই। দেশের কোনো বিচারালয় না তার অনুমোদিত কোনো আইন বাতিল করতে পারে আর না তা বলবৎ করার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। তথায় মৌলিক অধিকারের সংরক্ষক হচ্ছে দেশের সাধারণ আইন এবং তা অর্জনের জন্য সাধারণ বিচারালয়সমূহেরই শরণাপন্ন হওয়া যায়। কিন্তু লিখিত সংবিধান না থাকা সত্ত্বেও বৃটেনের নাগরিকরা মৌলিক অধিকারের বেলায় পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নাগরিকদের চেয়ে ভাল অবস্থায় আছে। তাই জেনিংস অত্যন্ত গর্বের সাথে বলেনঃ “বৃটেনে কোনো অধিকার আইন নেই। আমরা শুধু আইন অনুযায়ী স্বাধীনতার অধিকার ভোগ করি। আমাদের ধারণা এবং যার উপর আমাদের অটল বিশ্বাস রয়েছে যে, আমাদের কাজ এমন যে কোনো দেশের তুলনায় উত্তমরূপে পরিচালিত হচ্ছে যেখানে অধিকার আইন অথবা কোনো মানবাধিকার সনদ বিদ্যমান রয়েছ।(Jennings, Sir IVor, Approach to Self Government, Oxford, London, p. 20)।
কিন্তু এই সন্তোষ প্রকাশে ধীরে ধীরে ভাটা পড়ে যাচ্ছে এবং বৃটেনের আইনজ্ঞগণ মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য একটি লিখিত সংবিধানের প্রয়োজনীয়তার কথা গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছেন। টমাস পেইন সর্বপ্রথম এই প্রয়োজনীয়তার কথা অনুভব করেছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে তাঁর ‘মানবাধিকার’ শীর্ষক গ্রন্থে অত্যন্ত বিদ্রুপাত্মক সুরে লিখেছেনঃ “ উচ্চ স্বর বৃটিশ সংবিধান সম্পূর্ণত প্রতারণামাত্র। এর মূলত কোনো অস্তিত্ব নেই। একজন সদস্য বলে উঠেন, সংবিধান এই, অপরজন বলে উঠেন- না, ওটা নয়, এটা সংবিধান। আজ তা এক জিনিস, কাল তা অন্য জিনিস। এই সম্পর্কে আলোচনা অব্যাহত রাখলে শেষ পর্য্ন্ত প্রমাণিত হয় যে, এর কোথাও নামগন্ধও নেই।”(Fennesy R.R., “Burk, Paine and the rights of Man’’, Martiness Nijhaoff Hague 1965, p 179)।
বৃটেনের স্বনামধন্য পত্রিকায় Economist এর ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর সংখ্যায় মৌলিক অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট এক জরিপ রিপোর্ট লিখেছেঃ “আজ হতে বিশ বছর আগে এই দাবী বড়ই দৃষ্টিগোচত হতো যে, মৌলিক অধিকারের ব্যাপারে বৃটেন সর্বোত্তম।” এর সমর্থক আজও এ প্রমাণ পেশ করতে পারে যে, গর্ভপাত, তালাক এবং সাম্প্রদায়িক স্বাতন্ত্র্যের সাথে সংশ্লিষ্ট সংস্কার আইন অনুমোদন করার সময় নাগরিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে পার্লামেন্ট উত্তম রেকর্ড স্থাপন করেছে। কিন্তু এখন রক্ষণশীলগণ মালিকানা অধিকার সীমিতকরণ এবং শ্রমিক সংগঠনসমূহের সদস্যপদের আরোপিত বিধিনিষেধের দৃষ্টান্ত পেশ করবে। আবার লেবার পার্টির সমর্থকগণ রক্ষণশীল দলের অনুমোদিত অতীতে কার্য্যকর দেশত্যাগ আইন, বিশেষ অধিকার ও হরতালের অধিকারের উপর তাদের শিল্প সম্পর্ক আইনের আরোপকৃত বিধিনিষেধের দৃষ্টান্ত পেশ করবে। উপরন্তু অন্য কিছু দিকও বর্তমান রয়েছে যার মধ্যে দেশের আইন, আন্তর্জাতিক আইন, বরং মানবাধিকারের সাধারণ নীতিমালা সংক্রান্ত ইউরোপীয় কনোনেশনের সাথেও সংঘর্ষপূর্ণ। এর একটি উদাহরণতো সন্ত্রাস নিবর্তনমূলক আইনের অধীনে সন্দেহভাজন লোকদের আটকাদেশের এখতিয়ার। পার্লামেন্ট এই বিধান ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে অনুমোদন করে।”(পৃ. ২৪)।
এই রিপোর্ট অনুযায়ী পার্লামেন্ট এর উদারপন্থী সদস্য Allen Beith সংসদে একটি বিল পেশ করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল, এই রূঢ় বাস্তবতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা যে, বৃটেন ২৫ বছর পূর্বে মানবাধিকার সংক্রান্ত ইউরোপীয় কনোনেশনের যে দলীলে স্বাক্ষর করেছিল তা আজ পর্য্যন্ত বৃটিশ আইনের অংশে পরিণত হতে পারেনি।
বৃটেনে পার্লামেন্ট ও রাজার মধ্যে দীর্ঘ সংঘাতের পরিণতি এই দাঁড়ালো যে, সে দেশে রাজাকে তো সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীন করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তার স্থলে পার্লামেন্ট একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসেছে। কেননা তার আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপিত নেই। সংবিধানের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের এখতিয়ারের সীমা নির্দেশ করা। আজ এই দিকটি সম্পর্কেই সর্বাধিক দুশ্চিন্তা প্রকাশ করা হচ্ছে। Economist পত্রিকা বৃটেনের মৌলিক অধিকারের বিষয়টির মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছে যে, “একটি অধিকার আইন অনুমোদন করা যেতে পারে এবং তার সংরক্ষণের জন্য জুডিশিয়াল আদালতও কায়েম করা যেতে পারে-যার কোনো বিধানকে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী ঘোষণা করার এখতিয়ারও থাকবে। কিন্তু আসল সমস্যা তো এই যে, উক্ত এখতিয়ার থাকা সত্ত্বেও পার্লামেন্ট যদি কোনো বিধান বহির্ভুত আইন মঞ্জুর করে তবে বেচারা আদালত কি করতে পারবে? সে কি পার্লামেন্ট এর বিরুদ্ধে নিজের রায় কার্য্কর করতে পারবে? সে সর্বাধিক কোন বিধানকে বেআইনী ঘোষণা করতে পারে, কিন্তু পার্লামেন্ট এর সর্বময় প্রাধান্যের মজবুত ঐতিহ্যের কঠিন দেহের দেবতাকে ধ্বংস করা সহজ নয়।”(পৃ. ২৫)।
পর্যালোচক অবশেষে এই সিদ্ধান্তে পৌছেন যে, “কোনো সন্তোষজনক অধিকার আইনের(Bill of Rights) প্রবর্তন-রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং বিশেষত নির্বাচন ব্যবস্থা, তার মাধ্যমে উত্থিত শত্রুতামূলক জোটবদ্ধতার প্রভাব এবং সরকার ও পার্লামেন্ট এর পারস্পরিক সম্পর্কের উপর প্রতিফলিত প্রভাবের পরিবর্তনের উপর নির্ভরশীল। অন্য কথায়, কোন অধিকার আইনের পূর্বে একটি আইনগত দলীলের প্রয়োজন রয়েছে।”(পৃ. ২৫)।
ঐ রিপোর্টে জনমতের সাধারণ ঝোঁকের প্রতি আলোকপাত করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, ১৯৭০ দশকের শুরু হতে অধিকার আইনের দাবী ক্রমশ জোরদার হতে থাকে এবং ১৯৭৪ সাল হতে তা আরো অধিক জোরদার হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন অন্যান্য সরকারী বিভাগের সাথে শলা পরামর্শ করছে যে, বৃটেনে এ ধরনের আইন বলবৎযোগ্য ও পছন্দনীয় হবে কি?
বৃটেনকে যেহেতু গণতন্ত্রের সুতিকাগার মনে করা হয় এবং আমার পাকিস্তানীরাসহ পৃথিবীর অনেক দেশ-যেখানে সংসদীয় সরকারের প্রচলন রয়েছে-তার অনুকরণ করে থাকে, তাই অধিকার আইন দাবীর এই আন্দোলনে শরীকদারদের মতামতের উপরও একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করা সমীচীন হবে। এর ফলে আমরা অনুমান করতে পারব যে, স্বয়ং বৃটেনবাসী এখন তাদের সংবিধান সম্পর্কে কি বলে।
প্রসিদ্ধ আইনজ্ঞ D.W. Hanson মৌলিক অধিকারের মহাসনদ ম্যাগনাকার্টার বরাতে পার্লামেন্ট এর প্রাধান্যের উপর আলোকপাত করতে গিয়ে বলেনঃ “আইনের দৃষ্টিকোণ হতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই যে, Barrons তার বিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতাকে সাধারণ আইনের মূলনীতির আওতায় অর্পণ না করে বরং একটি রাজনৈতিক পন্থা অনুসরণ করেন, যার ফলে পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে লর্ডস ও সাধারণ সদস্যদের মাঝে রাজনৈতিক সমঝোতা অস্তিত্ব লাভ করে। এ কারণেই দ্বৈত রাজতন্ত্রের সমস্যা সমাধানের জন্য, যা সপ্তদশ শতকে জোরেশোরে উত্থিত হয়েছিল, আইনের প্রাধান্যের পরিবর্তে পার্লামেন্টের প্রাধান্যের মতবাদ গ্রহণ করা হল।” (D.W. Hanson, From Kingdom to Common-Wealth, Princeton, London 1970, p. 190)
পার্লামেন্টের এই প্রাধান্য মৌলিক অধিকারকে সাংবিধানিক পৃষ্ঠপোষকতা হতে বঞ্চিত করে কেবলমাত্র প্রথার (Customs)অনুগ্রহের উপর ছেড়ে দিয়েছে। প্রখ্যাত আইনজ্ঞ, প্রাক্তন বিচারক এবং বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রধান প্রফেসর হুড ফিলিপস বলেনঃ “সাধারণ অর্থে বৃটিশ সংবিধানে মৌলিক অধিকারের কোনো অস্তিত্ব নাই। ব্যক্তি স্বাধীনতার সাথে সংশ্লিষ্ট মূলনীতিকে পার্লামেন্ট একটি সাধারণ আইনের মাধ্যমে পরিবর্তন করতে পারে এবং যেসব অধিকারকে বহু সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে পার্লামেন্ট সেসব অধিকার কতটা সীমিত বা রহিত করতে পারবে তার কোন আইনগত সীমা নির্ধারিত নাই।”(Phillis O Hood, Reform of the Constitution, London 1970, p. 120)।
তিনি এই প্রসঙ্গে পার্লামেন্টের কার্য্ক্রমের দৃষ্টান্ত পেশ করে বলেন, ১ম মহাযু্দ্ধকালে Defence of the realm Act এবং ২য় বিশ্বযুদ্ধ কালে Emergency Powers Defence Act(১৯৩৫ সালে বলবৎ) অনুমোদন করে পার্লামেন্ট সরকারকে জাতীয় প্রতিরক্ষা ও জীবিকার সার্বিক দিক পরিবেষ্টন করার মত ব্যাপক এখতিয়ার দান করে-যার কোনো নজীর সংসদীয় ইতিহাসে বিরল। অতপর ১৯৪০ সালে আরো একটি আইন পাশ হয় যার উপর পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে আলোচনা ও বাকবিতন্ডা এবং রাজকীয় অনুমোদনের সমস্ত স্তর একই দিনে সমাপ্ত হয়। এই আইনের সাহায্যে নাগরিকদের জানমাল এবং সেবা রাজার নিকট সমর্পণ করে দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। ১৯২০ সালে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজকালীন সরকারকে জরুরী ক্ষমতা দানের জন্য একটি আইন পাশ করা হয় যার অধীনে আভ্যন্তরীণ বিশৃংখলা ও গোলযোগ চলাকালীন জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে নাগরিক স্বাধীনত স্থগিত করা হয়। বন্দর-শ্রমিক এবং পরিবহন ও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারীদের হরতাল ডাকাকালীন এই আইন কয়েকবার প্রয়োগ করা হয়েছে।
প্রফেসর ফিলিপস পার্লামেন্টের প্রাধান্যের জন্য অনমনীয়তা এবং লিখিত সংবিধানের অস্বীকৃতির আসল কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেনঃ “রাজনৈতিক খেলায় এটি ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল উভয়ের জন্য উপকারী। আজ এর মাধ্যমে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী, কাল তা বিরোধী দলীয় নেতার হাতে চলে যাবে। অথচ এ সম্পর্কে নাগরিকগণ হয় সংশ্লিষ্টহীন অথবা অনবহিত থেকে যাবে।”(ঐ, পৃ. ১৪৪)।
তিনি বৃটিশ সংবিধানের ব্যাপক মূল্যায়নের পর এই সিদ্ধান্তে পৌছেনঃ “এই দেশের জন্য একটি লিখিত সংবিধান প্রয়োজন। যার মধ্যে বিচার বিভাগের প্রাধান্য স্বীকৃত হবে। আমরা দেখেছি যে, আইন প্রণয়নের এখতিয়ারের কোনো সীমা নেই। পার্লামেন্ট এর সার্বিক তৎপরতা কার্য্ত সরকারই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সরকারের ক্ষমতার সময়কাল বেশ দীর্ঘ। এমন একটি উচ্চতর পরিষদের গঠন অত্যাবশ্যক যার খসড়া আইন প্রত্যাখ্যান করার অথবা কিছু কাল প্রতিহত করে রাখার এখতিয়ার থাকবে। আইন ও তার কার্য্কর গুরুত্বপূর্ণ শাখা অনিশ্চিত, ১৯৪৯ সালে জারীকৃত পার্লামেন্ট এ্যাক্টের মর্যাদা সংশয়পূর্ণ। প্রধানমন্ত্রীর হাতে সীমাহীন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেওয়ার কর্মপ্রণালী সুসংবদ্ধ করা প্রয়োজন। বিচার বিভাগের ক্ষমতা এবং বিচারকদের চাকরীর সাথে সংশ্লিষ্ট বিধানের উন্নতি সাধন করতে হবে এবং একটি নতুন মৌলিক অধিকার আইনের বিদ্যমানতা সময়ের দাবী।”(ঐ, পৃ. ১৪৪)।
স্যার ল্যাসলি স্কারম্যান নামক একজন বৃটিশ বিচারপতি নিজ দেশে মৌলিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের যবনিকা ছিন্ন করতে গিয়ে লিখেছেনঃ “বৃটিশ আইনের মানবাধিকারের কোনো পূর্ণাঙ্গ সংহিতা বর্তমান থাকলে – উত্তর আয়ারল্যান্ডে তল্লাশী ও অনুসন্ধানের যে নির্যাতনমূলক পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে-আপনার মতে কি তা সম্ভব ছিল?”(Scarman Sir Leslie, English Law- The New Dimensions, Stevens & Sons, London 1974, p. 18).
তিনি অধিকার আইন দাবী করতে গিয়ে বলেন, “যদি আমাদের আন্তর্জাতিক দায়িত্বানুযায়ী মানবাধিকারের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হয় তবে সাধারণ আইন হতে সরে গিয়ে আমাদেরকে অন্য কিছু উপায়-উপকরণ অনুসন্ধান করতে হবে। যে আইন ব্যবস্থা আইন পরিষদের অনুগ্রহের পাত্র হয়ে টিকে থাকে এবং যেখানে স্বয়ং এই আইন পরিষদও কয়েকটি ব্যতিক্রমিক অবস্থা ছাড়া প্রশাসনের দয়ার পাত্র-তা মৌলিক অধিকারের নিশ্চিত ও নির্ভরযোগ্য পৃষ্ঠপোষক হতে পারেনা এবং এই কারণে কেবল আইন প্রণয়নই কোন নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারেনা। যে জিনিসটি প্রয়োজন- তা হলো ‘কোনো বিধান’ আইন প্রণয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করুক। মৌলিক অধিকার আন্দোলন যা এখন একটি প্রয়োজনীয় বিষয়ই নয়, বরং আন্তর্জাতিক যিম্মাদারীর বিষয়ে পরিণত হয়েছে, আমাদের সংবিধানের ভারসাম্যহীনতাকে সম্পূর্ণরূপে উলঙ্গ করে তুলে ধরে এবং একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা প্রকাশ করে। এখন সমসাময়িক সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন কার্য্ সম্পাদনকারী সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে কোনরূপ রহিতকরণ, সংশোধন ও স্থগিতকরণ হতে নিরাপদ থাকবে এমন একটি অধিকার আইনের অবর্তমানে মৌলিক অধিকার সব সময়ই বিপদের সম্মুখীন হতে থাকবে।”(ঐ, পৃ. ৬৯)।
জে.জে. ক্রেইক হেন্ডারসন পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব ক্ষমতার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে বলেনঃ “বৃটেনে কোন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী পার্লামেন্টের কথা বলার পরিবর্তে একথা বলা অধিক যুক্তিসঙ্গত হবে যে, এখানে একটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কেবিনেট(মন্ত্রী পরিষদ) রয়েছে, যা উচ্চতর আইন পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের উপর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজেদের প্রশাসনিক ক্ষমতা ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার প্রয়োগ করে থাকে।”(Henderson J.J. Craik, Parliament-A Survey, George Allen & Unwin, London 1965, p. 89)।
তিনি মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে বর্তমান রক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেছেনঃ “প্রত্যেক ব্যক্তির উপর যদি নির্ভর করা যেত যে, সে সংবিধানের সৌন্দর্য্ ও ঐতিহ্যের প্রতি পুরোপুরি সম্মান প্রদর্শন করবে এবং সব সময় বুদ্ধিমত্তকে কাজে লাগাবে তাহলে আর সুদৃঢ় প্রশাসন এবং সমস্ত ক্ষমতাশক্তি অর্পণকারী নমনীয় সংবিধানের চেয়ে উত্তম কোনো জিনিস হতে পারেনা। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে কেউই এই বিষয়টিকে নিশ্চিত মনে করেনা। তাই কিছু গ্যারান্টির ব্যবস্থা করা অত্যাবশ্যক।(ঐ, পৃ. ৯৮)।
মৌলিক অধিকারের আইনগত রক্ষাব্যবস্থার জন্য বৃটেনে আজ যে আন্দোলন চলছে তার ভবিষ্যদ্বাণী হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর চার্লস হাওয়ার্ড ম্যাকলুইন ১৯৪৭ সালেই করেছিলেন।
তিনি বলেনঃ “ঐতিহ্যের নেতিবাচক প্রভাব যখন হতেই দুর্বল হচ্ছে একনায়কতন্ত্রের বিপদ ততই নিকটতর হচ্ছে। সেই সময় আর বেশি দূরে নয় যখন সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ঐতিহ্যের স্থান আইনকে গ্রহণ করতে হবে। তাহলে অতীতে যে সম্মান ও নিরাপত্তা সহজলভ্য ছিল তা অর্জিত হতে পারে। আইনের আকারে পার্লামেন্ট এর আজ যে সার্বভৌমত্ব রয়েছে তা সাধারণ নিয়মে পরিণত হলে এক ভয়ংকর একনায়কতন্ত্রের উত্থান ঘটবে।”(Mcllwail Charls Howard, Constitutionalism, p. 21)
আজ বৃটেনবাসী এই একনায়কত্বের সুস্পষ্ট উত্থান অনুভব করছে। তাই তারা লিখিত সংবিধান ও অধিকার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে এই একনায়কতন্ত্রের পথ বন্ধ করা যায় এবং তাকে বিচার বিভাগের অধীনে এনে কাবু করা যায়। এ এক অদ্ভূত ব্যাপার যে, কেবলমাত্র বৃটেনে নয়, বরং তার সমস্ত উপনিবেশ-কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার কোথাও মৌলিক অধিকারের কোনো আইনগত গ্যারান্টি নাই। কানাডায় ১৯৬০ সালে একটি অধিকার আইন অনুমোদিত হয়েছে, কিন্তু তা পার্লামেন্টের আইন প্রণয়নের এখতিয়ারের উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করেনা। তাতে ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে যে, কোন আইন এর পরিপন্থী হলেও বিচারালয় তার বাস্তবায়ন প্রতিহত করতে পারবেনা। কানাডার বিচারপতি বোরা লাসকিন নিম্নোক্ত বাক্যে এর ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।
“অধিকার আইন শুধুমাত্র আইনমন্ত্রীর পথ প্রদর্শনের জন্য যাতে তিনি আইন প্রণয়নের সময় তা সামনে রাখতে পারেন।”(Phillips O Hood, পূ.গ্র. পৃ. ১৪৩)।
প্রধানমন্ত্রী Lester Pearson অধিকার আইনকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেন, কিন্তু সফল হতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী Trudeau ১৯৬৯ সালে তা অনুমোদন করিয়েছিলেন কিন্তু তার অবস্থা ১৯৬০ সালের মতই থেকে যায়। ১৯৬৩ সালে নিউজিল্যান্ডের এটর্নি জেনারেল JR Hanan অধিকার আইন মঞ্জুর করানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু পার্লামেন্ট তা প্রত্যাখ্যান করে। অস্ট্রেলিয়ার অবস্থাও তাই।
বৃটেন ও তার উপনিবেশগুলোর নাগরিকগণ মৌলিক অধিকারের ব্যাপারে পার্লামেন্টের দয়ার পাত্র। তাদের একমাত্র আশ্রয় ঐতিহ্য ও প্রথার(Traditions & Customs) প্রতি সম্মান প্রদর্শন। সন্দেহ নাই যে, এসব ঐতিহ্যের শিকড় খুবই গভীরে প্রোথিত এবং কোন সরকার তা উপেক্ষা করার দুঃসাহস দেখাতে পারেনা। কিন্তু পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব ও বিচার বিভাগের ক্ষমতাহীনতার কারণে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের কোন আইনগত গ্যারান্টি বিদ্যমান নাই। আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের বিচারক উইলিয়াম ডগলাস এর ভাষায়ঃ “বৃটিশ আইন মূলত আত্মনিয়ন্ত্রণ এর সেই ঐতিহ্যের নাম যার ভিত্তিতে পার্লামেন্টের সদস্যগণ ও বৃটিশ শাসকগণ কার্য্ক্রম পরিচালনা করে আসছেন।(Willium Douglas O., বুন্য়াদী ইনসানী হুকুক কা মাসলা (উদূ অনু.), লাহোর ১৯৬৫ খৃ., পৃ. ১১৬)।
কিন্তু বৃটেনের বিচারকগণ, আইনজ্ঞগণ ও সাধারণ নাগরিকগণ এখণ শুধুমাত্র ‘আত্মনিয়ন্ত্রণ’ এর এই ঐতিহ্যকে মৌলিক অধিকারের কোন নির্ভরযোগ্য রক্ষক মনে করেন না। কারণ এ ঐতিহ্য এসব অধিকার স্থগিত, বাতিল বা সীমিত হওয়াকে প্রতিহত করতে পারেনা। পার্লামেন্ট ইচ্ছে করলেই এগুলি শেষ করে দিতে পারে এবং এই অবস্থায় কোথাও এর প্রতিকারের আবেদন করা যায়না।
বৃটেনের পরে এখন আমেরিকার সংবিধানের মূল্যায়ন করে দেখা যাক। উক্ত সংবিধানকে এই দিক হতে পৃথিবীর দৃষ্টান্তমূলক গণতান্ত্রিক সংবিধান মনে করা হয় যে, এতে বিচার বিভাগকে মৌলিক অধিকারের রক্ষক বানানো হয়েছে এবং তার আইন পরিষদের উপর প্রাধান্য রয়েছে। তা কংগ্রেসের মঞ্জুরকৃত আইনকে সংবিধানের পরিপন্থী সাব্যস্ত করে বাতিল করে দিতে পারে এবং তার বাস্তবায়ন প্রতিহত করতে পারে। কিন্তু বিচার বিভাগের এ সার্বভৌমত্ব থাকা সত্ত্বেও অন্তর্বিদ্রোহ, ষড়যন্ত্র অথবা বহিরাক্রমণের ক্ষেত্রে শাসন বিভাগ ও কংগ্রেস(আমেরিকার পার্লামেন্ট) ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যায়। সংবিধানের ১ নম্বর ধারার ৯ নম্বর সেকশানের ২ নং উপধারার অধীনে দেশে সামরিক আইন জারী করা যেতে পারে, মৌলিক অধিকার স্থগিত করা যেতে পারে এবং বিচারালায়সমূহের রিট আবেদনের শুনানির এখতিয়ার প্রত্যাহার করা যেতে পারে। উইলগি এই ধারার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছেনঃ “যুদ্ধাবস্থা চলাকালীন, আভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র অথবা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজকালীন অবস্থায় সামরিক আইন জারী করা হলে হাইকোর্টে রিট আবেদনের অধিকার এবং নাগরিক অধিকারের অন্যান্য সব গ্যারান্টি সাময়িকভাবে স্থগিত করা হবে।”(Willoughby W, Principles of the Constitutional Law of the United States, Baker voorthis & co., New York 1983, p. 677)
কংগ্রেস ১৯৫৪ সালে সংরক্ষণ আইন মঞ্জুর করে। এর অধীনে কোন কোন অবস্থায় যে কোন ব্যক্তিকে স্বয়ং নিজের বিরুদ্ধে স্বাক্ষী দিতে বাধ্য না করার সেই অধিকার হতে বঞ্চিত করা যায়-সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে শর্তহীনভাবে যার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। একই বছর গণসমাবেশ ও দল গঠনের স্বাধীনতার আইনগত গ্যারান্টি থাকা সত্ত্বেও আমেরিকায় কমিউনিষ্ট পার্টির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল এবং বিচার বিভাগের সার্বভৌমত্ব শাসন বিভাগের এই সিদ্ধান্তকে বেআইনী সাব্যস্ত করে পার্টিকে বহাল করার ব্যাপারে কোনরূপ সাহায্য করতে পারেনি।
প্রফেসর ম্যাকলুইন আমেরিকার সংবিধানে মৌলিক অধিকারের রক্ষা ব্যবস্থার পর্যালোচনা করে বলেনঃ “মানুষের যেসব অধিকার আমাদের নিকট অত্যন্ত প্রিয়-যেমন, চিন্তার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, অপরাধীদের একতরফা আটকাদেশ এবং নির্যাতনমূলক ও বেআইনী আচরণ হতে হেফাজত ইত্যাদি সমস্ত কিছু বিভিন্নরূপ বিপদে আক্রান্ত। যখনই রাষ্ট্রীয় সুবিধার দাবী সামনে আসে তখনই এসব কিছু বিপদগ্রস্ত হতে দেখা যায়। আমি প্রায়ই অনুভব করছি যে, আমরা এখন এসব অধিকার হতে হাত গুটিয়ে নেওয়ার এবং বিপদসমূহ উপেক্ষা করার বিশেষ বিপদের সম্মুখীন।”(Macllwain, পূ.গ্র. পৃ. ১৪০)।
এসব তথ্য হতে পরিষ্কার জানা যায় যে, আমেরিকাতেও মৌলিক অধিকার অবিচ্ছেদ্য নয়। আমেরিকা ও বৃটেনে কিছু সন্তোষজনক পরিস্থিতি দৃষ্টিগোচর হওয়ার আসল কারণসমূহ কি তা ডরোথির মুখে শুনুন। “সরকারের নিরাপত্তার একক ও সর্বশেষ পন্থা-সাংবিধানিক ব্যবস্থা দীর্ঘকাল যাবত সংবিধান অনুযায়ী কার্য্কর রয়েছে এবং পরিস্থিতি সব সময় তার অনুমতি দেয়না। বহিরাক্রমণ, যুদ্ধে পরাজয় এবং ক্ষতিকার তীব্র রাজনৈতিক মতবিরোধ ইত্যাদি সাংবিধানিক সরকারের উন্নতিকে বহু কঠিন বরং অসম্ভব করে তোলে। আমেরিকা ও বৃটেন উভয়ে এ দিক হতে বেশ সৌভাগ্যশালী যে, উভয় দেশ দীর্ঘকাল ধরে বহিরাক্রমণ হতে তুলনামূলক নিরাপদ রহিয়াছে এবং আভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা হতেও দেশ উভয় রাষ্ট্র মুক্তি লাভ করেছে।”(Dorothy Pickles, পূ.গ্র. পৃ. ১১৩)।
উপরোক্ত কথার অর্থ এই যে, আমেরিকা ও বৃটেনে মৌলিক অধিকারের হেফাজত তাদের সংবিধান ও ঐতিহ্যের পরিবর্তে অধিকতর সেই অনুকূল পরিস্থিতির কাছে ঋণী যা এই উভয় রাষ্ট্রে সহজলভ্য হয়েছে। যদি এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং উভয় দেশ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় বৈদেশিক আক্রমণ অথবা আভ্যন্তরীণ বিশৃংখলা ও অস্থিতিশীলতার শিকার হয়ে পড়ে তবে তাদের সংবিধান ও ঐতিহ্য তাদের নাগরিকদের কোনরূপ সাহায্য করতে সক্ষম হবে না। এই উভয় দেশের সংবিধানের স্থিতিশীলতা তাদের বিশেষ পরিস্থিতি এবং ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার উপর নির্ভরশীল। তাই যেসব দেশ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট উপেক্ষা করে তাদের সংবিধান নকল করেছে তারা কোনরূপ লাভবান হওয়ার পরিবর্তে বরং সংকটেই পতিত হয়েছে।
লর্ড এমিরি এর স্বীকারোক্তি করে বলেনঃ “ যেসব সংবিধান বৃটিশ সংবিধানের শুধু বাহ্যিক কাঠামো গ্রহণ করেছে তাদের অকার্য্কর হওয়ার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি একনায়কতন্তের উত্থান এবং একদলীয় ব্যবস্থা চেপে বসার আকারে প্রকাশিত হয়েছে।”(Amery L.S., Thoughts on the Constitution, Oxford 1956, p. 18)।
ফ্রান্সের একজন সংসদ সদস্যকে বৃটিশ সংবিধান অনুসরণ হতে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়ে Burke তাঁর চিঠিতে লিখেছেনঃ “ আমি বৃটিশ সংবিধানের প্রশংসা করলে এবং তা অধ্যয়নের পরামর্শ দিলে তার অর্থ এই নয় যে, তার বাহ্যিক অবয়ব এবং তার আওতায় কৃত ইতিবাচক ব্যবস্থাপনাসমূহ আপনার জন্য অথবা দুনিয়ার অন্য কোন দেশের জন্য অনুসরণীয় নমুনা বনে যাবে এবং আপনি তার হুবহু নকল করতে বসে যাবেন।”(Amery, পূ.গ্র., পৃ. ১৯)।
উপরোক্ত আলোচনার পর আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌছতে পারি যে, বৃটেন এবং আমেরিকার সংবিধানেও মৌলিক অধিকারের অবিচ্ছেদ্য হওয়ার গ্যারান্টি নেই। এর সাহায্যে যদি এসব দেশের নাগরিকগণের কিছু উপকারও হয়ে থাকে তবে তা তাদের পর্য্ন্তই সীমিত। অন্য কোন দেশ নিজেদের এখানে তাদের সংবিধানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চাইলে তার পরিণতি একনায়কতন্ত্রের আকারে প্রকাশ পাবে।
সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ সম্পর্কে আমরা আগেই বলে এসেছি যে, সেখানে অর্থনৈতিক অধিকার ব্যতীত অন্য কোনরূপ অধিকারের অস্তিত্ব নেই এবং সংবিধানে অন্য যেসব অধিকারের উল্লেখ আছে তা বিচার বিভাগের মাধ্যমে অর্জন করার মত নয়। তাই সেখানে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের মূলত কোন প্রশ্নই উঠে না। সমাজতান্ত্রিক সরকার নিজেই অধিকার নির্ধারণ করে থাকে এবং সে-ই তার বাস্তবায়নের সীমা নির্দেশ করে। যেন সে “নিজেই কুম্ভ, নিজেই কুম্ভকার এবং নিজেই কুম্ভকর্দ”। এর বাইরে না আছে কোন অধিকার না অধিকার কার্য্করকারী কর্তৃপক্ষ।
গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সংবিধানের উপরোক্ত পর্যালোচনা এই সত্যকে প্রতীয়মান করে তোলে যে, সংবিধান মৌলিক অধিকার হেফাজতের কোন শক্তিশালী গ্যারান্টি নয়। আমাদের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ সাক্ষ্য দেয় যে, মৌলিক অধিকার নির্ধারণ ও তার বাস্তব প্রয়োগের জন্য আমরা কেবলমাত্র লিখিত সংবিধানের উপর নির্ভর করতে পারি না। এসব সংবিধানের সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ত্রুটি এই যে, তার পেছনে কোন কার্যকরী শক্তি বর্তমান নাই যা শাসক গোষ্ঠীকে তার আরোপিত সীমারেখার অনুসারী বানাতে পারে এবং যা মৌলিক অধিকার হেফাজতের স্থায়ী ব্যবস্থা করতে পারে।