ঘ. নেতৃত্বের জবাবদিহি
সরকারের ধারণা, নেতৃত্বের পবিত্রতা এবং ক্ষমতা সীমিতকরণের সাথে সাথে ইসলাম রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তির জবাবদিহির প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। জবাবদিহির উপায় উপকরণ সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। এবার জবাবদিহির (Accountability) বিষয়টি মূর্তিতে পুনর্বার ঝালাই করা যাক। তাতে জানা যাবে যে, ইসলাম রাষ্ট্র ও সরকারের উপর একজন সাধারণ নাগরিককে কতটা কর্ত্রিত্ব দান করেছে এবং একে প্রকৃত অর্থে ইসলামী জামহুরিয়া বা ইসলামী সাধারণতন্ত্র বানিয়েছে।
১. আখেরাতের জবাবদিহি
শাসকের উপর নির্ধারিত সর্বপ্রথম জবাবদিহির বিষয় হচ্ছে পরকালের ভয়। এই ভয় সর্বদা তার মন মগজ ও স্নায়ুমন্ডলীতে কার্যকর প্রভাব বিস্তার করে রাখে। মহাজ্ঞানী, সর্বদ্রষ্টা, সর্বজ্ঞ, সব কিছুর প্রত্যক্ষকারী, সর্বত্র বিরাজমান মহান সত্তা আল্লাহ রব্বুল আলামীন আখেরাতে তার নিকট থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে হিসাব নিকাশ গ্রহণ করবেন। দুনিয়াতেও তিনি বান্দার অতি নিকটে অবস্থান করছেন। এই রব্বুল আলামীন তাকে বলে দিচ্ছেন: “যারা আমার সৎ পথের নির্দেশ অনুসরণ করবে তাদের কোন ভয় নেই, এবং তারা দু:খিতও হবে না। যারা তা প্রত্যখ্যান করে এবং আমার নিদর্শন সমূহ অস্বীকার করে তারাই দোযখী। সেখানে তারা স্থায়ী হবে” (সূরা বাকারা: ৩৮-৩৯)।
“আকাশ মন্ডলীর ও পৃথিবীর সকলকেই দয়াময়ের নিকট উপস্থিত হতে হবে বান্দারূপে” (সূরা মারইয়াম:৯৩)।
রসুলে করীম সা: এর বাণী: “তোমাদের প্রত্যেকেই রক্ষক ও পৃষ্ঠপোষক। আর তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পুরুষ (স্বামী) তার পরিবার পরিজনের কর্তা। তাকে তার পরিবার পরিজন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর ঘর সংসার এবং সন্তানের রক্ষক। তাকেও সন্তান সন্তুতি সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে” ( হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা:-র বর্ণনায় বুখারী, মুসলিম)।
“কোন ব্যক্তি মুসলমানদের সামষ্টিক কর্মকান্ডের দায়িত্বে নিয়োজিত থেকে তাতে প্রতারণা ও জালিয়াতি করলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন” (বুখারী, মুসলিম)।
“কোন ব্যক্তি মুসলিম জনগণের সর্ববিধ কার্যের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করার পর তাদের উন্নতি ও কল্যাণের ব্যবস্থা করে না এবং তাদের কাজকর্মের আঞ্জাম দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজেকে এমনভাবে নিয়োজিত করে না, যেভাবে সে আপন কর্মে নিয়োজিত থাকে-আল্লাহ তাকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন” ( তাবরানী, কিতাবুল খারাজ)।
আখেরাতের জবাবদিহির এই অনুভূতি এমন এক আভ্যন্তরীণ নিয়ামক শক্তি যা সর্বোতভাবে মানুষের সাথেই লেগে থাকে। নির্জনে ও প্রকাশ্যে কোথাও সে তার নাগাল ছাড়ে না এবং সর্বক্ষণ তার প্রকৃতি ও স্বভাবে আত্মসমালোচনার কাজ জাগ্রত রাখে। এই আভ্যন্তরীণ জবাবদিহির ধারণার বর্তমানে যদি কোন বাহ্যিক জবাবদিহি পয়দা নও হয় তবুও মানুষের পথভ্রষ্ট হওয়া এবং যুলুম ও অন্যায়ের পথে চলার কোন সম্ভাবনা অবশিষ্ট থাকে না। এই জবাবদিহির অনুভূতির অনিবার্য ফল এই ছিল যে, হযরত আবু বাকর রা:-র খিলাফতকালে হযরত উমার ফারুক রা: প্রধান বিচারপতির আসনে দুই বছর নিয়োজিত ছিলেন। অথচ তাঁর আদালতে একটি মোকদ্দমাও দায়ের করা হয়নি। কেননা সরকার প্রধানসহ সমাজের প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তিই তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব এমন নিখুঁতভাবে পালন করেছিলেন যার ফলে কোথাও অধিকার সম্পর্কে কোন অভিযোগ উঠেনি।
২. আদালতের মাধ্যমে জবাবদিহি
ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধানের আদালতের নিকট জবাবদিহি থেকে বাঁচার কোন রক্ষাকবচ নেই। একজন সাধারণ নাগরিকের মতই তাকে আদালতে তলব করা যাবে এবং একজন সাধারণ নাগরিক তার বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারে।
“একবার খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমার রা: এবং হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা:-র মাঝে কোন বিষয়ে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। হযরত উবাই রা: মদীনায় কাযী (বিচারক) হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত রা:-র আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন। আদালত থেকে হযরত উমার রা: কে হাজির হওয়ার সমন জারী করা হল। তিনি যথাসময়ে হাজির হলেন। কিন্তু বাদী বিবাদী কারো কাছেই সাক্ষী ছিলনা। আইন অনুসারে আদালতের সামনে হযরত উমার রা:-র শপথ করার কথা। হযরত উবাই রা: দেখলেন, হযরত উমার রা: শপথ করতে প্রস্তুত, এখন তিনি তার অভিযোগ তুলে নেন” (সারাখসী, আল মাবসূত, মিসর ১৩৩১ হি. ২২ খ. পৃ. ৭৪)।
হযরত আলী রা: বাজারে এক খৃস্টানকে তার বর্মখানি বিক্রি করতে দেখলে তিনি তাকে বলেন, এ বর্মটি আমার। খৃস্টান অস্বীকার করায় তিনি কাযী শুরাইহ রা: এর আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন। কাযী সাহেব হযরত আলী রা: র নিকট সাক্ষী তলব করেন। তিনি তা পেশ করতে অপারগ হন। কাজেই খৃস্টান ব্যক্তির পক্ষেই মামলার রায় দেওয়া হল। হযরত আলী রা: স্বয়ং এই রায় গ্রহণ করে বলেন, “শুরাইহ! তুমি সঠিক রায় দিয়েছ।” মামলার রায় শুনে খৃস্টান ব্যক্তি হতবাক হয়ে গেল। বাস্পরূদ্ধ কন্ঠে সে বলল, এতো পয়গম্বর সূলভ ন্যায় বিচার। আমীরুল মোমিনীনকেও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় এবং তাঁকে নিজের বিপক্ষে রায় শুনতে হয়। প্রকৃতপক্ষে বর্মটি আমীরুল মুমিনীনেরই। এটা তার উটের পিঠ থেকে পড়ে গিয়েছিল। আমি তা উঠিয়ে নিয়েছিলাম” ( ইবনে আসাকির, তাহযীব তারীখ, দামিশক ১৩৪৯ হি. ৬খ. পৃ. ৩০৬)।
উমাইয়া শাসনামলেও আদালতের এই মর্যাদা অক্ষুন্ন ছিল। উতবী বলেন, আমি মদীনার কাযী মুহাম্মাদ ইবনে ইমরানের নিকট বসা ছিলাম। এমন সময়ে খলীফা হিশাম ইবনে আবদুল মালিকের দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান উপদেষ্ঠা নিজের সাথে ইবরাহীম ইবনে মুহাম্মাদকে নিয়ে আগমন করেন এবং বললেন, আমীরুল মুমিনীন তার ও ইবরাহীমের মধ্যকার সংঘটিত এক বিবাদে আমাকে উকীল নিযুক্ত করে আপনার আদালতে পাঠিয়েছেন। কাযী সাহেব বলেন, খলীফা আপনাকে উকীল নিযুক্ত করে পাঠিয়েছেন তার প্রমাণ পেশ করুন। তিনি বলেন, আপনি ভাবছেন, আমি ভুল বলছি? কাযী সাহেব বিনম্রভাবে বলেন, কথাতো এটা নয়, কথা হচ্ছে আইনের।যতক্ষণ সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া না যাবে ততক্ষণ বিচার মীমাংসা করা যাবে না। তিনি ফিরে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে খলীফা হিশামকে অবহিত করেন। খলীফা স্বয়ং আদালতে হাজির হন এবং মামলার বিবরণী শুনানীর পর কাযী খলীফার বিপক্ষে রায় ঘোষণা করেন” (মাহদী মুহাম্মাদ মুরীদ, আল ইবহাসুস সিয়াসিয়া, তিতুয়ান ১৯৫১ খৃ. পৃ. ১৩২)।
“এই কাযী মুহাম্মাদ ইবনে ইমরানের আদালত থেকে খলীফা আবু জাফর আল মানসুরের নামে আরেকটি মামলার সমনজারি করা হয়েছিল। কতিপয় উপ মালিক তাদের অধিকার প্রসঙ্গে মামলা দায়ের করেছিল। কাযী সাহেব সমনে উল্লেখ করেছিলেন যে, হয় এসব লোকের অধিকার তাদের ফিরিয়ে দিন নতুবা আদালতের সামনে হাজির হোন। মসজিদে নববী সংলগ্ন আদালতের উন্মুক্ত চত্বরে খলীফা হাযির হলেন। মামলার শুনানীর পরে কাযী উট মালিকদের পক্ষে এবং খলীফার বিপক্ষে আদালতে রায় ঘোষণা করেন”(ঐ, পৃ.১৩২)
এসব উপমা দ্বারা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী রাষ্ট্রে একজন সাধারণ নাগরিক মামলা দায়ের করে সরকারের সর্বোচ্চ পদপর্যাদার অধিকারীকে অপরাধীর কাঠগড়ার দাঁড় করিয়ে নিজের অধিকার আদায় করতে পারে। সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের অধিকারী ব্যক্তিকেও তলব করার আদালতের এই এখতিয়ার শাসন বিভাগের উপর তাকে এতটা শক্তিশালী করে দিয়েছে যে, কেবলমাত্র আদালতে তলবের ‘ভয়’ই একটি কার্যকর মুহতাসিবের (সংশোধকের) ভূমিকা পালন করতে পারে এবং নাগরিকদের অধিকার বিপদগ্রস্থ হয় না।
৩. শূরার ( পরামর্শ সভা) মাধ্যমে জবাবদিহি
শূরার গুরুত্ব এবং তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা হয়েছে। এখানে কেবল তার জবাবদিহি মূলক দিকটির আলোচনা উদ্দেশ্য। কোন বিষয়ে শাসক শূরার কাছে পরামর্শ চাইলে শূরা সদস্যদের শুধু ব্যক্তিগত অভিমত দেওয়াই তাদের কাজ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের তত্বাবধান করাও তাদের মূল কাজ। তারা জাতির মগজও এবং চক্ষুও। তাদের সতর্ক দৃষ্টি শাসনকর্তাকে সীমালংঘন থেকে এবং বায়তুল মালের (জাতীয় সম্পদ) আত্মসাৎ থেকে বিরত রাখতে পারে। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক বিশেষ করে মুসলমানদের দায়িত্ব বরং আল্লাহ প্রদত্ত কর্তব্য এই যে, তারা সত্য কথা বলবে, কল্যাণের বিস্তার ঘটাবে, অসত কাজের প্রতিরোধ করবে এবং নিজের সমাজ দেহকে ন্যায়নিষ্ঠা ও ইনসাফের উপর কায়েম রাখার জন্য সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্ঠা চালাবে। তবে এই ফরযটি সর্বাপেক্ষা গুরুতরভাবে শূরা সদস্যদের উপর বর্তায়। কেননা তাদের তো এই কাজের জন্যই নির্বাচন করা হয়ে থাকে। মুসলমানদের সামগ্রিক ব্যাপারে দেখাশোনা প্রসঙ্গে বিশেষভাবে তারা আল্লাহ ও রাসূলের নিম্নোক্ত নির্দেশে সম্বোধিত:
“সতকর্মে ও খোদাভীতিমূলক কাজে তোমরা পরষ্পরকে সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালংঘনমূলক কাজে একে অন্যের সাহায্য করবে না” (সূরা মায়িদা:২)
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল” (সূরা আহযাব: ৭০)।
“মুমিন নারী পুরুষ পরষ্পরের বন্ধু! তারা সতকাজের নির্দেশ দেয় এবং অসৎ কার্য থেকে বিরত রাখে” (সূরা তওবা: ৭১)।
মহানবী সা: ইরশাদ করেন:
“তোমাদের কেউ যদি মন্দকাজ হতে দেখে সে যেন তা হাত দিয়ে (শক্তি প্রয়োগে) বন্ধ করে। যদি হাতের দ্বারা (সরাসরি) বাধা দেওয়া সম্ভব না হয় তবে মুখের ভাষায় বাধা দেবে। এও যদি সম্ভব না হয় তবে সে যেন মনে মনে পরিকল্পনা করে এবং বিরত রাখার ইচ্ছা পোষণ করে। আর এ হচ্ছে ঈমানের দূর্বলতম স্তর” (মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ)।
“অত্যাচারী শাসকের সম্মুখে ন্যায়বাক্য (সত্য কথা) বলাই সর্বোত্তম জিহাদ” ( আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ)।
“আমার পরে এমন কতিপয় (যালেম) শাসকের উদ্ভব হবে- যারা তাদের মিথ্যা কার্যকলাপে সহায়তা করবে এবং যুলুম নির্যাতনে তাদের মদদ যোগাবে, তারা আমার নয়, আমিও তাদের নই” (ইবনে মাজা)।
এক হিসাবে শাসনকর্তার উপরে শূরার কর্তৃত্ব রয়েছে। শাসনকর্তা শূরার পরামর্শ গ্রহণে বাধ্য। কিন্তু তলব করলেই কেবল শূরার সদস্যবৃন্দ পরামর্শ দেবেন তা নয়, বরং প্রয়োজন অনুভব করলেই তারা শাসনকর্তাকে পরামর্শ দিতে পারেন। আবার যখন চাইবেন বাধা দিতেও পারেন। জনসমক্ষে তার সমালোচনা করতে পারেন। এই অবস্থার প্রেক্ষাপটে শাসকের পক্ষে কোন বিষয়েই মনগড়া কিছু করার অবকাশ নেই এবং কারো অধিকার খর্ব করা কিংবা কোন হকদারকে নিজের রোষানলে আনারও অধিকার নেই।
৪. জনগণের কাছে জবাবদিহি
শাসনকর্তা ও শূরার সদস্যবৃন্দের নির্বাচনের পর ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকগণ রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মকান্ডের ভার তাদের উপর নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে খোদ হাত গুটিয়ে নেবে- এই অবকাশ ইসলামী রাষ্ট্র দর্শনে নেই। এমনকি পরবর্তীতে নির্বাচন পর্যন্ত তারা যাচেছ তাই করতে থাকবে এই সুযোগও নেই। রাষ্ট্র যেহেতু সেই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বাপেক্ষা কার্যকর ও পর্যাপ্ত উপায় উপকরণ সম্বলিত শক্তি যার জন্য উম্মতের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের জানমাল কোরবানী করেছে, তাই তারা তার রক্ষণাবেক্ষণ ও উদ্দেশ্য অর্জনের দিক দিয়ে তার কর্মতৎপরতার মূল্যায়নের দায়িত্ব থেকে মুহুর্তের জন্য গাফিল থাকতে পারে না। তাদের কেবল অন্ন বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যাপারই নয়, বরং ইকামতে দীনের বিষয়টি তার চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম সমাজের প্রত্যেক সদস্য না তার মালিকানাধীন সীমিত উপকরণ সমূহ নিজের আরাম-আয়েশ ও ভোগবিলাসে অপচয় করে আত্মসাৎকারী দুষ্কৃতিকারী হতে পারে,আর না সে অন্যকে এমন কাজের অনুমতিও দিতে পারে যে, সে মুসলমানদের জাতীয় সম্পদ ও উপায়-উপকরণ খেল তামাশা ও বিলাসিতার ক্ষেত্রে ইচ্ছা মাফিক খরচ করে অর্পিত আমানতের খেয়ানত করতে থাকবে। জনগণের সম্পদের হেফাজতের ব্যাপারে দায়িত্বশীলতার অনুভূতি উজ্জীবিতকারী একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
একবার হযরত উমার ফারুক রা: কোন এক মজলিসে ভাষন দিচ্ছিলেন। অনাড়ম্বর ও সাদাসিধা গোছের এই মানুষটির পরনে ছিল দুটো চাদর। হযরত সালমান ফারসী বলে উঠলেন, “হে সমবেত সুধী মন্ডলী! মনোযোগ দিয়ে শুনুন। আল্লাহর রহমত আপনাদের উপর বর্ষিত হোক। তিনি প্রতিবাদী কন্ঠে বললেন, আল্লাহর শপথ! আমার আপনার ভাষণ শুনব না, আল্লাহর শপথ, আমরা আপনার ভাষণ শুনব না। হযরত উমার রা: কোমল কন্ঠে বললেন, হে আবু আবদুল্লাহ! কেন, কি হয়েছে? অভিযোগ আসলো, প্রথমে বলুন, প্রত্যেকের অংশে একটি করে য়ামানী চাদর জুটেছিল। আর আপনি দুটো চাদর পরিধান করে এখানে কি করে তাশরীফ আনলেন? হযরত উমার রা: তাঁর পুত্রের সাক্ষ্য প্রদান করিয়ে উপস্থিত জনতাকে শান্ত করলেন। আসলে একটি চাদর তাঁর পুত্র তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। এবারে হযরত সালমান ফারসী রা: বললেন, হাঁ, এখন আপনার বক্তব্য পেশ করুন। আমরা শুনব এবং অনুসরণ করব” ( উমার ইবনুল খাত্তাব) পৃ. ৩১২)।
একই ভাবে হযরত উমার ফারুক রা: একবার জাতির সমালোচনা শক্তির মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, হে লোক সকল! আমি যদি কোন ব্যাপারে শিথিলতা দেখাই তাহলে তোমরা কি করবে? এ কথা শোনামাত্র হযরত বিশর ইবনে সা’দ দাড়িয়ে যান এবং খাপ থেকে তলোয়ার কোষমুক্ত করে বলেন, “আমরা আপনার গর্দান উড়িয়ে দেব”। হযরত উমার রা: ধমক দিয়ে বলেন, “আমার উদ্দেশ্যে তুমি এমন কথা উচ্চারণ করতে পারলে! তিনি বলেন, জি, হাঁ, আপনার উদ্দেশ্যেই। হযরত উমার ফারুক রা: অত্যন্ত খুশী হয়ে বলেন, আল্লাহর জন্য সব প্রশংসা ( আলহামদুলিল্লাহ), জাতির মধ্যে এমন ব্যক্তিত্ব রয়েছে যারা বাঁকা পথে চললে আমাকে সোজা করতে সক্ষম” ( আল ফারুক, পৃ. ৫১১)।
হযরত উসমান রা: ও হযরত আলী রা:-র ও এই কর্মনীতি ছিল। হযরত উসমান রা: -র প্রতি তো সমালোচনার তীরবৃষ্টি বর্ষিত হতে থাকে, কিন্তু তিনি উৎকোচ ( নাউযুবিল্লাহ) কিংবা ক্ষমতা প্রয়োগ করে কারও কন্ঠ রোধ করার চেষ্ঠা করেন নি। হযরত আলী রা:-কে খারিজীরা কত গালিগালাজ করেছে, এমনকি সামনাসামনি তাঁকে হত্যারও হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু তিনি তার প্রতিবাদ না করে বরং বলেন, মৌখিক বিরোধিতা এমন মারাত্মক অন্যায় নয় যার কারণে তাদের উপর হস্তক্ষেপ করা যেতে পারে’ ( আল মাবসূত, ১০ খ. পৃ.১৩৫)।
জবাবদিহির এই নানাবিধ উপায় উপকরণ সাথে সাথে একথাও খেয়াল রাখা উচিত যে, ইসলাম জবাবদিহির সীমারেখাকে শুধুমাত্র সরকারী কার্যক্রমের মধ্যেই সীমিত রাখেনি, বরং ব্যক্তিগত কর্মকান্ডকেও এতে শামিল করে দিয়েছে। ভালমন্দ ও ন্যায় অন্যায় সম্পর্কে ইসলামের মৌলনীতি হচ্ছে: যে জিনিসটি সমগ্র জনতার জন্য মন্দ তা ব্যক্তি বিশেষের জন্যও মন্দ। অপকর্ম প্রকাশ্যভাবে করলেও যেমন অপরাধ গোপনে করলেও তা অপরাধ হিসাবে গন্য। অপরাধ অপরাধই। জনসমক্ষে মদ্যপান, জুয়াখেলা ইত্যাদি পুলিশী হস্তক্ষেপযোগ্য অপরাধ হলে, কোন হোটেলের সংরক্ষিত কক্ষে কিংবা কোন ক্লাবের রুদ্ধদার কক্ষে অথবা স্বয়ং আপন ঘরের নিভৃত কোণে বসে এই অপকর্ম করলে তাও পুলিশী হস্তক্ষেপযোগ্য অপরাধ বিবেচিত হবে। শরীআতের বিধান যেহেতু মানব জীবনকে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত এই দুই ভাগে ভাগ করে নিজেকে কোন একটির মধ্যে সীমাবদ্ধ না করে বরং সম্পূর্ণ জীবনে পরিব্যাপ্ত করে রেখেছে।, তাই সে ব্যক্তিগত জীবনকে জবাবদিহির গন্ডি থেকে বের করে আত্মপূজার হাতে ধ্বংস হওয়ার খোলা অনুমতি দেয় নাই। এই মৌলনীতির ভিত্তিতে নবী করীম সা: খুলাফায়ে রাশেদীন এবং সাহাবায়ে কিরামের জীবন উন্মুক্ত পুস্তিকার মত বিশেষ ও সাধারণ সকলের সামনে সর্বত্র বিরাজমান ছিল।
ইসলামী সমাজের বুনিয়াদী দৃষ্টিভঙ্গী শাসন কর্তৃপক্ষের মর্যাদা, তার নির্বাচনের শর্তাবলী, তার এখতিয়ারের সীমাবদ্ধতা, তার আনুগত্যের সীমা এবং তার জবাবদিহির এসব উপায়-উপকরণের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে অনুধাবন করা যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্রে মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের ভিত কত মজবুত, সুদৃঢ় কার্যকর। যে মানব সম্প্রদায়ে এবং পৃথিবীর যে অঞ্চলে এসব গ্যারান্টি সহজলভ্য হবে তারা শান্তি ও নিরাপত্তা এবং সুখ্ স্বাচ্ছন্দের কতটা অতুলনীয় নিআমতের অধিকারী হয় তা ভেবে দেখার বিষয়।
ইসলামী ব্যবস্থা কি মাত্র ত্রিশ বছর প্রতিষ্ঠিত ছিল?
ইসলামে মৌলিক অধিকারের এসব গ্যারান্টির পর্যালোচনা করতে গিয়ে যে কোন পাঠকের মনে এ কথা স্বাভাবিকভাবেই উদয় হতে পারে যে, এতটা মজবুত ও সর্বাত্মক গ্যারান্টি বিদ্যমান থাকতে এই দু:খজনক পরিস্থিতির প্রাদুর্ভাব কিভাবে হল যার ফলে ইসলামের এই অতুলনীয় ইনসাফভিত্তিক ও সমতাভিত্তিক ব্যবস্থা খিলাফতে রাশেদা তিরিশ বছরের বেশী সময় টিকতে পারল না।
এই সংক্ষিপ্ত কালের পরেই গণতন্ত্রের প্রাণ শক্তি শেষ হয়ে গেল। রাজতন্ত্রে সদর্পে তার আসন গেড়ে বসল, খলীফা নির্বাচনে জাতির কোন কার্যকর ভূমিকা থাকল না। বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র নির্বাচিত খিলাফতের স্থান দখল করে নিল। বায়তুল মাল আর মুসলমানদের আমানত থাকল না। তা শাসক শ্রেণীর ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হল। সংসদীয় ব্যবস্থা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চিরতরে খতম হয়ে গেল। গোত্রপ্রীতি ও আঞ্চলিকতার উন্মেষ ঘটল। হত্যাযজ্ঞ, খুনখারাবি এবং অন্যায় অত্যাচারের যাবতীয় পন্থা প্রকটিত হল- যা দুনিয়ার অন্য কোন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় থাকা সম্ভব ছিল। বানু উমাইয়া বানু আব্বাস, ও ততপরবর্তী মুসলিম শাসনামলে অহরহ এরূপ অসংখ্য ঘটনা ঘটতে লাগল যাকে নিছক যুলুম ছাড়া আর কোন নামে আখ্যায়িত করা যায় না। পরিশেষে এই দু:খজনক পরিবর্তনের কি ব্যাখ্যা
দেওয়া যেতে পারে? এই পরিবর্তন দ্বারা কি এটাই প্রমাণিত হয় না যে, ইসলাম শুধুমাত্র তিরিশ বছর কার্যকর থাকতে পেরেছিল, তারপর তা ব্যর্থ হয়ে গেছে?
আপাত: দৃষ্টিতে এই প্রশ্নটি খুবই যুক্তিসঙ্গত এবং ঐতিহাসিক তথ্যাবলীর আলোকে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। কিন্তু এটা মূলত: একটা ভুল বুঝাবুঝির উপর ভিত্তিশীল। যারা ইসলাম ও মুসলমানদের কর্মপন্থাকে একই জিনিস মনে করে তাদের মধ্যে এই ধরণের প্রশ্ন উত্থিত হয়। অথচ সত্য কথা এই যে, ইসলাম স্বয়ং একটা পৃথক সত্তার নাম। এর নীতিমালা ও আইন কানুন স্বস্থানে দলীল। মুসলমানদের কার্যকলপ ইসলামের মানদন্ড নয়, বরং তাদের কর্মপন্থাকেও ইসলামের কষ্টিপাথরে যাচাই করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে যে, সে কোন স্তরের মুসলমান এবং নিজের মুসলমান হওয়ার দাবীতে কতটা সত্যবাদী। দুনিয়ার অন্যান্য জাতির সাথে মুসলমানদের তুলনা করা ঠিক নয়। তাদের পজিশন সঠিকভাবে উপলদ্ধি করলে মুসলমানদের কার্যকলাপকে ইসলামের ঘাড়ে চাপানোর কোন সুযোগ অবশিষ্ট থাকবে না।
পৃথিবীর অন্যান্য জাতি নিজ নিজ রাষ্ট্রে স্বয়ং সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। তাই তাদের রাজা-বাদশাদের জারীকৃত ফরমান, জাতীয় সংসদের প্রণীত আইন, শাসক গোষ্ঠীর জারীকৃত বিধান এবং আদালতের কৃত মীমাংসাকে সনদ ও দলীলরূপে গণ্য করা হয়। আমরা যেমন শাসনতন্ত্র সম্পর্কিত আলোচনায় সবিস্তারে বিশ্লেষণ করে এসেছি যে, তাদের কাছে কার্যত: শাসকের অভিপ্রায়ের অপর নাম আইন; আইন স্ব-মহিমায় উদ্ভাসিত কোন জিনিস নয় এবং রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এর অস্তিত্ব নেই। বলতে গেলে আইন তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার গোলাম। প্রচলিত আইন তাদের গথিপথে বাধা দিলে তারা তাকে রহিত করে কিংবা তদস্থলে সংশোধনী এনে অন্য আইন তৈরী করে নিজের পথ পরিষ্কার করে নেয়। পরে এই সংশোধিত অথবা নতুন আইনই দলীলের মর্যাদা পায়। পূর্বের আইন তিরোহিত অথবা অচল হয়ে যায়। আদালতেও এই আইনের কোন মর্যাদা অবশিষ্ট থাকে না। এখন থেকে নতুন আইনের বরাত দেওয়া হয়। অন্য কোন আইন প্রবর্তন না করা পর্যন্ত এই আইন বহাল থাকে। আইন প্রণয়নের এই তৎপরতা কেবল পুরো আইন ব্যবস্থাকেই অব্যাহত সংশোধন, রহিতকরণ, সীমিতকরণ ও মুলতবীকরণের চক্করে ব্যতিব্যস্ত রাখে না, বরং আইনকে কার্যকর ও অকার্যকর হওয়ার সনদও প্রদান করে এবং এই সার্বিক ততপরতায় কোন পর্যায়ই আইন প্রণয়নকারী আইন ভঙ্গকারী বিবেচিত হয় না। আদালত তাদের বাতিলকৃত আইন এক পাশে রেখে দেয় এবং তার জারীকৃত নতুন আইনের আওতায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করতে থাকে।
পক্ষান্তরে ইসলামে না আছে কোন মুসলিম প্রশাসকের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা, আর না আছে সামগ্রিকভাবে গোটা জাতির। তাদের আইন প্রণয়নের এখতিয়ার কুরআন-সুন্নাহর অনুশাসন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, ইসলামের পরিপন্থী আইন প্রবর্তন করেছে কিংবা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের হেদায়েতেরে বিপরীত আদর্শ প্রতিষ্ঠার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে তারা বিশ্বাসঘাতক, বিদ্রোহী ও আইন ভঙ্গকারী হিসাবে অভিহিত হয়েছে। তারা অন্যদের তুলনায় মুসলমানদের কাছে ঘৃণার পাত্র এবং প্রকৃতপক্ষে মুসলমানরা তাদের সাথে এই ধরণের আচরণই করে আসছেন। তাদের প্রবর্তিত আইন ও অধ্যাদেশ কখনই ইসলামী বিধি বিধানের অংশ হিসাবে বিবেচিত হয়নি। তাদের রচিত এই আইন কখনও দলীল হিসেবে স্বীকৃত হয়নি।
তাদের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব শরীআতের বিধানকে অণূ পরিমাণও পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়নি। কারণ এই আইন নিজের স্বাতন্ত্র বজায় রাখতে সক্ষম এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের উর্ধ্বে এর অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম। মুসলমানরা শুধুমাত্র শরীআতের বিধানের অনুসারী শাসকবর্গের সিদ্ধান্তকে নজীর হিসাবে নিয়েছে। তারা বানু উমাইয়ার মধ্যে কেবলমাত্র হযরত উমার ইবনে আব্দুল আযীয রহ: এর নির্দেশমালা ও মীমাংসা সমূহকে দলীল হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং বানু আব্বাসের কোন শাসককে এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত বলে স্বীকার করেন নি। মোঘল শাসকদের মধ্যে শুধুমাত্র বাদশাহ আওরংগযেব আলমগীরের পৃষ্ঠপোষকতায় সংকলিত “ফতোয়ায়ে আলমগীরী”-কে ফিকহের (আইনের) নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তার পূর্ববর্তী মহান পুরুষ আকবরের প্রবর্তিত দীনে ইলাহীকে তার যুগে রহিত করে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করা হয়। ইসলামের চৌদ্দশত বছরব্যাপী ইতিহাসে রাজা-বাদশাহও একনায়কদের রচিত আইন কানুনকে কখনো শাসনতান্ত্রিক মর্যাদাসম্পন্ন মনে করা হয়নি। অর্থাৎ জনগণের কাছে তাদের সৃষ্টি আইন শাসনতান্ত্রিক বিধান হিসাবে স্বীকৃতি পায়নি। পক্ষান্তরে ইমাম আবু হানীফা রহ. ইমাম মালিক রহ. ইমাম শাফিঈ রহ. ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ এর মত খেজুর পাতার মাদুরে উপবেশনকারীদের কুরআন সুন্নাহর ভিত্তিতে রচিত আইন সংকলন গ্রন্থসমূহ সার্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করে। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তাদের প্রণীত ফিকহগুলো আইনের মর্যাদা পেয়েছে এবং আজও সারা বিশ্বের মুসলমান প্রধানত এই চার মাযহাবের অনুসারী। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ উপমহাদেশে এই আইন (ফিকহ শাস্ত্র) আদালতের কানুন হিসাবে পরিগণিত ছিল এবং ব্রিটিশদের রাজত্বকালেও মুসলমানদের ব্যক্তিগত বিষয়াদিতে এই ফিকহ কার্যকর ছিল। মোট কথা ইতিহাসের কোন যুগেই শরীআতী আইন মুহুর্তের জন্যও রহিত কিংবা স্থগিত হয়নি। স্বয়ং বাদশাহ ছিলেন এই আইনের নিয়ন্ত্রণাধীন। তাদের সত্তা অর্থাৎ ব্যক্তিগত অভিমত কখনো আইনের উৎস হিসাবে মর্যাদা পায়নি। তাদের মধ্যে কেউ সম্রাট আকবরের ন্যায় শরীআতী আইনের মুকাবিলায় কোন “দীনে ইলাহী” আবিষ্কার করার এবং তা বল প্রয়োগে বাস্তবায়নের চেষ্ঠা করে শেষাবধি কৃতকার্য হতে পারেনি। তার (আকবরের) রচিত আইন তার মৃত্যুর সাথে সাথেই মৃত্যুবরণ করে। মুসলিম মিল্লাত একে কখনো শরীআতী আইনের সাথে যোগ করার অনুমতি দেয়নি।
খিলাফতে রাশেদার পরে প্রশাসনিক কাঠামোতে নি:সন্দেহে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি খিলাফত ও আমানত বিদায় নিল। প্রতিনিধিত্বমূলক কর্তৃত্ব ব্যক্তিগত (রাজতান্ত্রিক) কর্তৃত্বে পরিণত হল। অত:পর অন্যায়-অবিচার ও যুলুম নির্যাতনের সেই সুদীর্ঘ ধারার সূচনা হল যা ইতিহাসের কোন ছাত্রের দৃষ্টির অন্তরালে নয়। কিন্তু ইতিহাসের ঘটনাবলী থেকে শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত কিভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে যে, ইসলাম ব্যর্থ হয়েছে? ইতিহাসের রেকর্ড ইসলামের ব্যর্থতার নয়, বরং মুসলমানদের কোন গোষ্ঠীর আপত্তিকর বা লজ্জাকর কার্যক্রম শেষ পর্যন্ত ইসলামের ব্যর্থতা কিভাবে সাব্যস্ত করা যেতে পারে? আর এর দ্বারা কিভাবে প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের যে গ্যারান্টি প্রদান করেছে তা তিরিশ বছর পরে অকার্যকর হয়ে গেছে? পৃথিবীর প্রতিটি ধর্ম বিশ্বাস, মতবাদ, দৃষ্টিভঙ্গী, নীতিমালা, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের প্রভাবশীল বা প্রভাবহীন হওয়া মূলত: ঈমান ও আকীদার দৃঢ়তা ও তদনুযায়ী কাজ করার বাধ্যবাধকতার উপর নির্ভরশীল। এটা কোন ব্যবস্থা ও মতবাদের প্রভাব ও ফলাফলকে বাস্তবায়নের প্রথম শর্ত। মজবুত আকীদার মজবুতী ও বাস্তব কর্মের বাধ্যবাধকতার এই মৌলিক শর্ত পূরণ ব্যতিরেকে কোন ব্যবস্থা অথবা জীবনের মূলনীতি নিজের প্রভাবের প্রদর্শনী করতে পারে না। সত্য নিষ্ঠা সর্বোতভাবে জীবনের কেটি সর্বোত্তম নীতি। কিন্তু বাস্তবে সত্য কথন ব্যতিরেকে আমরা কি এর উপকারিতা ও কল্যাণ লাভ করতে পারি? যদি তা না হয় তাহলে- মিথ্যার প্রসার এবং অধিকাংশের সত্য বিমুখ হওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছা কি ঠিক হবে যে, সততার নীতি অকার্যকর ও প্রভাবহীন হয়ে গেছে, কেননা সংখ্যাগরিষ্ট জনতাকে সে তার অনুসারী রাখতে অপারগ হয়ে পড়েছে? আর তাই বলে কি আমরা সত্যকে ত্যাগ করার পরামর্শ দেব যে, মানব গোষ্ঠীর অধিকাংশই এর অনুসরণ করছে না? অথবা সত্য ত্যাগীরা কি তিরষ্কারযোগ্য ও অপরাধী সাব্যস্ত হবে না? প্রত্যেক হুশিয়ার ও সচেতন ব্যক্তি এই সংখ্যাগরিষ্টদের কি এই পরামর্শই প্রদান করবে না যে, বাহ্যত: মিথ্যা প্রভাবশালী প্রতীয়মান হলেও তা ত্যাগ করতে এবং সত্যকে গ্রহণ করে তাকে প্রভাবশালী বানাতে হবে?
মানুষের ঈমান এবং তার সচেতন সংকল্প ও কার্যক্রমই মূলত: নীতিমাল ও মতাদর্শকে প্রভাবশালী করার হাতিয়ার। এই ঈমান ও কর্মের মহামূল্যবান সম্পদ ব্যতিরেকে যে কোন নীতি ও মতাদর্শের শব্দ সম্ভারের সমষ্টি ছাড়া আর কোন মূল্য নেই। বৃটেনের অলিখিত সংবিধানকে একটি দৃষ্টান্তমূলক গণতান্ত্রিক সংবিধান মনে করা হয়। কিন্তু এই সংবিধানের শব্দ সম্ভারে কি স্বয়ং এই শক্তি ও প্রভাব আছে যে, তা আফ্রিকা অথবা এশিয়ার কোন রাষ্ট্রে বাস্তবায়িত করলে অনুরূপভাবে কার্যকর, উপকারী ও ফলপ্রসূ প্রমাণিত হবে, যেমনটি বৃটেনে ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়েছে? যদি তাই না হয় তবে ব্যর্থতার দায় দায়িত্ব কার কাঁধে চাপবে? সংবিধানের, না সেই জাতির ঘাড়ে চাপবে যারা নিজেদের কার্যকলাপ দ্বারা একে ব্যর্থ করে দিয়েছে?
কোন জীবন দর্শনের ব্যর্থতা ও তদনুযায়ী কার্যক্রম সম্পাদনে ব্যর্থতা দুটি পৃথক জিনিস যাকে পরষ্পরের সাথে একাকার করে ফেলা সমীচীন নয়। আমরা কোন ব্যবস্থার ব্যর্থতা শুধুমাত্র তখনই বলতে পারি যখন নিম্নের প্রশ্নগুলোর কোন একটির ইতিবাচক জবাব দেখতে পাব:
১. অভিজ্ঞতা কি একে ত্রুটিপূর্ণ ও অকেজো প্রমাণ করেছে?
২. মানুষের উন্নততর জ্ঞান ও চেতনা কি এর পেশকৃত নীতিমালা আবিষ্কার করতে পেরেছে?
৪. ইতিহাসের সুদীর্ঘ পরিক্রমা কি একে বাতিল্ এবং ব্যবহারের অনুপযোগী প্রমাণ করতে পেরেছে?
৫. এর অবয়ব কি এতটা বিকৃত হয়ে গেছে যে, বর্তমানে সঠিক ও ভুলকে পরষ্পর বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়?
ইসলামের ক্ষেত্রে উপরোক্ত কোন প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব দেওয়া যেতে পারে না। ইসলাম অনুশীলন ও অভিজ্ঞতার দ্বারা পৃথিবীর অন্যান্য জীবন ব্যবস্থার উপর নিজের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইসলামের বিপরীতে নতুন বা পুরাতন এমন কোন্ জীবন দর্শন আছে যা নিজের কার্যকারিতার তিরিশ বছর সময়সীমায় ন্যায় ইনসাফ, সাম্য ও কল্যাণের এমন মহান বিপ্লব সাধন করতে পেরেছে? এই বৈশিষ্ট্য কেবল ইসলামেরই রয়েছে যা দীর্ঘ ত্রিশ বছর ব্যাপী নিজেদের প্রাণশক্তি ও শিক্ষা ব্যবস্থা সহ কেবল প্রতিষ্ঠিতই থাকেনি, বরং নিজের পরিপূর্ণতার শীর্ষে উন্নীত হয়েছে। দুনিয়ার কোন জীবন দর্শনই যমীনের বুকে স্বীয় আদর্শসহ এক মুহুর্তের জন্য কার্যকর হতে পারেনি। কোন জীবন দর্শনের বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তিরিশ বছর সময়কাল কিছু কম নয়। এই পরীক্ষাকালীন সময়ে ইসলামের কোন্ নীতিমালাটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে? কোন দোষ বা ত্রুটি ধরা পড়ে থাকলে সেটা কি? বাস্তবে মানুষ কি এর চাইতে কোন উন্নত জীবন দর্শন আবিষ্কার করতে পেরেছে? আমরা এই পুস্তকে ইসলাম ও অন্যান্য জীবন দর্শনের মূল্যায়ন করে দেখিয়াছি যে, মানবিক জ্ঞান এ পর্যন্ত যা কিছু পেশ করতে পেরেছে ইসলামের তুলনায় তার অবস্থান কোথায়? ইসলামকে স্বয়ং তার আরোপিত শর্তাবলী মোতাবেক কার্যকর করা হয়েছে তখনই মুসলিম সমাজ ব্যবস্থায় খিলাফতে রাশেদার সামগ্রিক সৌন্দর্য পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে এবং ইসলাম তার আসল চেহারার সমুজ্জল হয়েছে। খিলাফতে রাশেদার পরে মুসলমানদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যে নিকৃষ্টতার সূত্রপাত হয়েছিল আমরা ইতিপূর্বে তার উল্লেখ করেছি। কিন্তু সর্বপ্রকার বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় সত্ত্বেও খিলাফতে রাশেদার প্রায় ষাট বছর পরে যখন হযরত উমার ইবন আবদুল আযীয রহ: সিংহাসনে অধিষ্টিত হন এবং তিনি রাজতন্ত্রের সব নিদর্শনের মুলোতৎপাটন করে ইসলামকে তা আসল প্রাণশক্তি সহ পুনরুজ্জীবিত করার দৃঢ় সংকল্প করলেন তখন গোটা সমাজের চেহারা পাল্টে গেল। ইসলামী বিপ্লব তার পূর্ণ দ্বীপ্তি সহ সম্পূর্ণ নতুনভাবে উজ্জীবিত হল এবং খিলাফতে রাশেদার যুগ ফিরে এল। এতে প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম ব্যর্থ হয়ে যায়নি, বরং মুসলমানরা এবং বিশেষ করে তাদের শাসকগোষ্ঠী তদনুযায়ী জীবন যাপন করতে আলস্য ও উদাসীনতার শিকার হয়ে পড়েছিল। তিনি দীর্ঘ ষাট বছর পর সংষ্কারের দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করলেন এবং ইসলামকে পরীক্ষা করলে পূর্ববৎ খাঁটি, বলিষ্ট এবং ফলাফলের দিক থেকে কার্যকর প্রমাণিত হল, যেমন খিলাফতে রাশেদার আমলে প্রমাণিত হয়েছিল। দীর্ঘ তের শত বছর পরে সায়্যিদ আহমাদ শহীদ রহ: যখন পেশোয়ারে নিজের স্বল্পস্থায়ী ইসলামী রাষ্ট্রে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন তখনও তা (ইসলাম) নিজের সার্বিক ব্যাপকতা ও পরিপূর্ণতাসহ বাস্তব রূপ লাভ করল এবং এর কোন বিধান অপ্রচলিত ও অকেজো প্রমাণিত হয়নি।
ইসলাম প্রসঙ্গে এরূপ ধারণা করা সংগত নয় যে, তার শিক্ষা বিকৃত হয়ে গেছে এবং সঠিক ও ভ্রান্তকে পৃথক করা সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআন তার প্রতি অক্ষরের বিশুদ্ধতাসহ সংরক্ষিত আছে। হযরত নবী করীম সা: এর পবিত্র জীবনের প্রতিটি ঘটনা, তার প্রতিটি কথা ও কাজ এমনভাবে সংরক্ষিত আছে যে, পৃথিবীর অন্য কোন ব্যক্তিত্বের এমন ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ অবস্থার বিবরণ বর্তমান নেই। খিলাফতে রাশেদার শাসনকাল দর্শণের ন্যায় ইতিহাসের পাতায় বিদ্যমান রয়েছে।
মুসলিম উম্মাহর মধ্যে আজ পর্যন্ত ইসলামী আইনের সংকলনের যত কাজ হয়েছে তা কোনরূপ হ্রাসবৃদ্ধি ছাড়াই সংরক্ষিত আছে। তাছাড়া জীবনের প্রতিটি শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং বর্তমান যুগের যাবতীয় সমস্যার সবিস্তার সমাধান ইসলামী সাহিত্যে বিদ্যমান আছে। কোন ব্যক্তি কোন বিষয়ে ইসলামের পথ নির্দেশ জানতে চাইলে তাকে উক্ত বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে কোন অসুবিধা হবে না। ইসলামের মৌলিক শিক্ষা এবং তার নীতিমালা ও আইনকানুন আজও আমাদের সামনে সম্পূর্ণ সুষ্পষ্ট আকারে বিদ্যমান রয়েছে। এর কোন অংশ বিকৃত এবং কোন দিক অষ্পষ্ট হয়ে যায়নি। যাকে আমরা ইসলাম বলে জানি তা যে কোন দোষ ত্রুটিমুক্ত রূপেই সুদীর্ঘ চৌদ্দশত বছর ধরে অব্যাহতভাবে ইতিহাসের রাজপথ বেয়ে আমাদের সাথে সাথেই চলে আসছে। এই সুদীর্ঘ সফরে মুসলমানরা কখনো ইসলামের অতি কাছাকাছি অবস্থান করেছিল আবার কখনো দূরে সরে পড়েছে। কিন্তু কখনো এরূপ হয়নি যে, ইসলাম মাত্র তিরিশ বছর টিকে ছিল। তবে বাস্তবিকপক্ষে এতটুকু বলা যায় যে, মুসলমানরা মনে প্রাণে একাগ্রতার সাথে তিরিশ বছর ইসলামের অনুসারে করেছে। পরবর্তীতে তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ত্রুটি প্রবেশ করতে থাকে এবং অধ:পতনের নানা রাস্তা খুলে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হল এই বিচ্যুতির ফলে ইসলামের বিশুদ্ধতায় কি প্রভাব পড়েছে? কি কারণে তা অকার্যকর প্রমাণিত হল? মুসলমানদের ইতিহাসে কোন রাজা-বাদশাহ ও শাসকদের বিদ্যমান থাকায় কি আজ সঠিক ইসলাম অনুযায়ী পথ চলতে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে? আমরা কি ওজর পেশের অধিকার রাখি যে, আমাদের ইতিহাসে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ও হাসান ইবনে সাব্বাহর ন্যায় লোক মাঝখানে এসে পড়ায় খেলাফতে রাশেদার সেই পারষ্পরিক সম্পর্কের সাথে আমীর-ওমরা ও রাজা-বাদশাহদের কার্যকলাপের কি সম্পর্ক আছে? মুসলমানরা তাদের সঙ্গে কখনো মানসিক পথ প্রদর্শনের সম্পর্ক স্থাপন করেনি। একজন সাধারণ মুসলমান তো তাদের নামও জানে না, তাদের জারীকৃত বিধান ও অধ্যাদেশ সমূহ আলোচনার যোগ্য মনে করে নি, কিংবা কোন প্রসঙ্গে তা বরাত হিসাবে উল্লেখেরও যোগ্য মনে করেনি। মুসলমানদের শিশুরা পর্যন্ত খুলাফায়ে রাশেদীন, প্রবীণ সাহাবায়ে কিরাম রা:, চার মাযহাবের চার ইমাম- আবু হানীফা রহ., মালিক রহ. শাফিঈ রহ. আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. ইমাম বুখারী রহ. ইমাম ইবনে তায়মিয়া রহ. ইমাম গাযালী রহ. শাহ ওয়ালীউল্লাহ রহ. সহ অন্যান্য মুসলিম চিন্তা নায়কদের নাম সম্পর্কে ভালো করেই অবগত। কেননা এইসব ব্যক্তিত্ব নবীযুগ থেকে আজ পর্যন্তকার ইসলামের ইতিহাসে মুসলমানদের তাদের ধর্মীয় উত্তরাধিকার স্থানান্তর করতে এবং ইসলামের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার সাথে গভীর সম্পর্ক রাখেন। তাদের বদৌলতে ইসলামের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক এক মুহুর্তের জন্যও বিচ্ছিন্ন হয়নি, আর না ইসলাম সমকালীন সমস্যার সমাধান পেশ করা থেকে পশ্চাৎপদ হয়েছে। সে তো প্রতিটি যুগেই মুসলমানদের জীবনের সামগ্রিক ব্যাপারে পরিপূর্ণভাবে পথ নির্দেশ দান করে সামনে অগ্রসর হচ্ছে।
আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে “ইসলাম তিরিশ বছরের অধিক চলতে পারেনি” এই অভিযোগের মূল্যায়ন করা যাক। এই আপত্তি শুধুমাত্র রাজনৈতিক ব্যবস্থার সীমা পর্যন্ত এবং তাও আবার আংশিকভাবে ঠিক। কিন্তু মুসলমানদের সাধারণ ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবন হামেশা ইসলামের অনুগতই ছিল। তাদের নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক,শিক্ষাগত, পারিবারিক,সাংস্কৃতিক ও বিচার বিভাগীয়….. জীবনে ইসলামের আইনই বলবৎ থাকে। তাদের রাজনৈতিক জীবনও ইসলাম থেকে একেবারে সম্পর্কহীন ছিল না।
ইসলামে ধর্ম ও রাজনীতি কখনো এমনভাবে পৃথক হয়নি যেভাবে ইউরোপে চার্চ ও রাষ্ট্র পরষ্পর আলাদা হয়ে গেছে। ইউরোপে চার্চের প্রাধান্য লোপ পেলে রাষ্ট্র ধর্মকে সামষ্টিক জীবন থেকে সম্পূর্ণরূপে নির্বাসিত করে তাকে ব্যক্তিগত জীবন পর্যন্ত সীমিত করে দিয়েছে। তখন থেকে রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা ধর্মীয় অনুশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকল না। ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের দর্শন একে ধর্মের বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে দিয়েছে।
পক্ষান্তরে ঔপনিবেশিক যুগের পূর্ব পর্যন্ত মুসলমানদের পুরো ইতিহাস খুঁজলেও এমন একটি উদাহরণ পাওয়া যাবে না যেখানে কোন বাদশাহ কিংবা শাসনকর্তা ইসলামী বিধানকে পূর্ণরূপে অকেজো করে স্বয়ং নিজের মস্তিষ্ক প্রসূত আইন বাস্তবায়ন করে থাকবে। মুসলিম রাজা-বাদশাহ্গণ ইসলামী আইনের বিপরীত আচরণ অবশ্যি করেছেন, কিন্তু আইনকে মসজিদ ও মাদরাসার দায়িত্বে অর্পণ করে তারা তা থেকে কখনো সম্পর্কহীন হননি। ইসলামী আইনই ছিল তাদের রাষ্ট্রীয় আইন এবং জীবনের সর্বস্তরে বিচার বিভাগীয় মীমাংসা শরীআত মোতাবেক সম্পন্ন হত। এই রাজা-বাদশাহদের সকলেই অত্যাচারী, স্বৈরাচারী ও বিলাস ব্যসনে আসক্ত ছিলেন না। এঁদের মধ্যে নাসিরুদ্দীন মাহমূদ এবং আওরঙ্গযেব আলমগীরের নামও উল্লেখযোগ্য। তাঁরা রাজকোষকে নিজেদের জন্য হারাম মনে করতেন এবং বৈধ উপায়ে জীবিকার্জনের জন্য নিজ হাতে টুপি সেলাই ও কুরআন শরীফ নকল করতেন।
তাদের অধিকাংশই ছিলেন ন্যায়পরায়ণ এবং আল্লাহ ও সৃষ্টির কাছে জবাবদিহির ভয়ে ভীত। তাদের কার্যকলাপে ইসলামের গভীর প্রভাব বিদ্যমান ছিল। নি:সন্দেহে তারা সমসাময়িক অমুসলিম শাসকদের চাইতে শ্রেষ্ঠতর ছিলেন। যেহেতু আমরা তাদেরকে খিলাফতে রাশেদার মানদন্ডে যাচাই করে থাকি তাই তারা আমাদের দৃষ্টিতে উত্তীর্ণ হন না। কিন্তু সমসাময়িক অমুসলিম শাসকবর্গ ও তাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে এঁদের ও এঁদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার তুলনা করলে তাদের পজিশন একেবারেই বদলে যায়।
উপরোক্ত আলোচনায় সুষ্পষ্টভাবে প্রতিভাত হচ্ছে যে, “ইসলাম তিরিশ বছরের বেশি টিকে থাকেনি” এরূপ অভিযোগ ঠিক নয়। অবশ্য এতটুকু বলা যেতে পারে যে, ত্রিশ বছর পরে মুসলিম উম্মাহ ইসলামকে তাদের বাস্তব জীবনে খিলাফতে রাশেদার সমতলে বহাল রাখতে পারেনি। কিন্তু আমরা অভিযোগকারীদের সামনে আমাদের এই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করতে চাই যে, আজ যদি ইসলামকে তার প্রকৃত অবয়বে বাস্তবায়নের দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা হয় তাহলে তাতে বাঁধা কিসের? স্বয়ং ইসলাম, না ক্ষমতালোভী ব্যক্তিবর্গের অসৎ উদ্দেশ্য?
পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদ এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত মুসলমানদের পক্ষ থেকে ইসলামের ব্যর্থতা সম্পর্কে আরো একটি আপত্তি উত্থাপন করা হয় যে, প্রথম যুগে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বিচার বিভাগীয় এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান সমূহ গড়ে উঠেনি অথবা তা এতটা পূর্ণাঙ্গ কাঠামো লাভ করতে পারেনি যে, তার উপর ভিত্তি করে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার কোন সুষ্পষ্ট কাঠামো সামনে আসতে পারে। ইসলামী সমাজ তার গঠনের দিক থেকে গোত্রীয় প্রকৃতির তুলনামূলক উন্নত সমাজ ছিল যেখানে গোত্রীয় নেতার স্থলে খলীফা কেন্দ্রীয় মর্যাদা লাভ করেছিলেন। ব্যক্তিগত ধরণের এই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দেশের কর্তৃত্ব এক ব্যক্তির হাতে ছিল যিনি মসজিদের বারান্দায় বসে রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মকান্ড আঞ্জাম দিতেন, গণীমতের মাল বণ্টন করতেন, প্রাদেশিক গর্ভণর ও সামরিক কমান্ডারদের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশ জারী করতেন, তাদের রিপোর্টসমূহ সংগ্রহ করতেন এবং তাদের চিঠিপত্রের জবাব লিখিয়ে দিতেন, তাদের প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণের ব্যবস্থা করে দিতেন, তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ লোকদের অভিযোগ সমূহ শুনতেন এবং তাদের দূর্দশা লাঘব করতেন, তাদের পারষ্পরিক ঝগড়া বিবাদের মীমাংসা করতেন,আইন বিষয়ক সমস্যার ক্ষেত্রে তাদের পথ নির্দেশ দিতেন। সাধারণ লোকেরা সরাসরি খলীফার কাছে যেতে পারত। তাই তারা তাদের ছোট বড় সমস্যা নিয়ে খলীফার দরবারে হাযির হত এবং তিনি তাদের সুষ্ঠু সমাধান দিতেন। এমনিভাবে খলীফার ব্যক্তিত্ব কেন্দ্রীয় মর্যাদা লাভ করে। ক্ষমতা বণ্টনের পরিবর্তে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার এই কার্য স্বায়ত্বশাসিত ও আধা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্ব তিরোহিত করে দেয়। খুলাফায়ে রাশেদীন যেহেতু অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, নির্মল চরিত্র, পবিত্র, নিরপেক্ষ ও আল্লাহ ভীতিতে পরিশোভিত রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন তাই তাদের শাসনামলে সমস্ত কর্মকান্ড যথার্থভাবে চলছিল। কিন্তু তাদের পরবর্তীতে যখন শাসকবর্গের মধ্যে সেই নি:স্বার্থপরতা, উন্নত চরিত্র ও পবিত্রতা বাকী থাকেনি তখন এ ব্যবস্থা- যা সুদৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পারেনি, অতি দ্রুত পতনের দিকে ধাবিত হল এবং তাতে নানা ধরণের ত্রুটি অনুপ্রবেশ করল। এমন অভিযোগ উত্থাপন অজ্ঞতার চাইতে পক্ষপাতিত্বের উপরই অধিক ভিত্তিশীল। আর উক্ত অভিযোগের আসল ক্রিয়াশীল শক্তি হচ্ছে পাশ্চাত্যের এই আকাংখা যে, মানবাধিকারের ধারণা, মানবাধিকার আদায়ের আন্দোলন এবং গণতন্ত্রের দর্শণের মত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান সমূহের প্রতিষ্ঠাতা যেন তারাই হতে পারে। অন্যথায় প্রকৃত সত্য এই যে, খিলাফতে রাশেদা বিশেষ করে হযরত উমার ফারুক রা: এর আমলে ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদসমূহ সুদৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো লাভ করে এবং উমাইয়া ও আব্বাসী রাজবংশের শাসনামলে এই প্রতিষ্ঠানসমূহ আরও বিস্তার লাভ করে।