গ. ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য স্থাপন
নেতা (শাসক) নির্বাচনের কঠিন শর্তাবলী আরোপ করার পর ইসলাম শাসকের পদে আসীন হওয়া মাত্র ক্ষমতার ব্যবহারে ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণ ( Check & Balance) এমনভাবে আরোপ করেছে যে, সে না পারে শাসকোচিত আচরণ গ্রহণ করতে, আর না আছে তার শান-শওকত ও জাঁক-জমক প্রদর্শনের উপায়-উপকরণ অবলম্বণের সুযোগ। তার ক্ষমতা ও এখতিয়ারের সীমা ও শর্তাবলী লক্ষ্য করুন।
১. প্রতিনিধিত্বমূলক কর্তৃত্ব
ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার প্রধান তার পদাধিকার বলে দ্বৈত-প্রতিনিধিত্বমূলক দায়িত্ব পালন করে থাকেন। একদিকে তিনি রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকৃত অধিকারী আল্রাহ রব্বুল আলামীনের নির্দেশ অনুশাসন কার্যত জারী করার দায়িত্ব পালনের ভিত্তিতে পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি। অপরপক্ষে তিনি সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রকৃত প্রতিনিধিবর্গ অথবা খলীফাদের (মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফা) নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে তাদেরও প্রতিনিধি। যেহেতু ব্যক্তি হিসাবে প্রত্যেক মুসলমানকে খিলাফতের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং তার ইচ্ছার স্বাধীন প্রয়োগের মাধ্যমে কোন ব্যক্তিকে বেছে নিয়ে তার উপর নিজেদের দায়িত্বভার অর্পণ করে তাই তিনি তাদের সকলের প্রতিনিধি। এই দ্বৈত প্রতিনিধিত্বের অর্থ এই যে, রাষ্ট্র প্রধান তার কর্মকান্ডের জন্য একদিকে আল্লাহর কাছে এবং অন্যদিকে আল্লাহর বান্দাদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। তার এই দ্বৈত অবস্থান তার নিজের ইচ্ছা ও এখতিয়ারের ক্ষেত্র বহুলাংশে সীমিত করে দেয়। এটাই হচ্ছে সর্বপ্রথম ও সর্বাপেক্ষা বড় বাধ্যকতা যা শাসকের এখতিয়ারের উপর ইসলামী শরীআত আরোপ করেছে।
২. স্থায়ী সংবিধান
ইসলামী রাষ্ট্রে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের বড় ধরণের রক্ষাকবচ হচ্ছে সেই স্থায়ী ও চিরন্তন সংবিধান যা কুরআন ও সুন্নাহর আকারে আমাদের সামনে বর্তমান এবং যা (কোরআন ও সুন্নাহ) অধিকার ও কর্তব্যের সংশোধন ও বাতিলের অযোগ্য একটি নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে। মহান রব্বুল আলামীন শাসকের আইন প্রণয়নের ক্ষমতার উপর বাধ্যবাধকতা এবং সাধারণ নাগরিকের জন্য আনুগত্যের শর্ত নিরূপণ করে নির্দেশ দিয়েছেন:
(আরবী***)
অর্থ: “তোমাদের প্রতিপালকের তরফ থেকে তোমাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে তোমরা তার অনুসরণ কর এবং তাকে ব্যতীত অন্য অভিভাবকের অনুসরণ করো না” (সূরা আ’রাফ: ৩)।
যারা এই আদেশের চুল পরিমাণ লংঘন করবে তাদের সম্পর্কে এই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়েছে:
(আরবী***)
অর্থ: “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন (অর্থাৎ কুরআন) তদনুযায়ী যারা মীমাংসা করে না তারা কাফের… তারা যালেম… তারা ফাসেক (সত্য ত্যাগী)” (সূরা মায়িদা: ৪৪-৪৭)।
এখানে যে আইনের অনুসরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয় না, বরং একটি পবিত্র আমানত হিসাবে তা প্রত্যেক শাসকের নিকট হস্তান্তরিত হয়। এই কারণেই আল্লাহ অধিকার সমূহ কখনো সীমিত, স্থগিত, কিংবা রহিত হয় না, তা স্থায়ী ও অটুট এবং সরকারের হস্তক্ষেপ থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ।
৩. চিরন্তন শাসনের স্বরূপ
এই সংবিধান শুধুমাত্র শব্দ সম্ভারের লিখিত আকৃতিতে এবং সেগুলোর সমন্বয়ে গঠিত পুস্তকের আকারেই সংরক্ষিত নয়, বরং তা নিজস্ব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে পথনির্দেশ দানের জন্য একটি স্থায়ী অনুসরণযোগ্য নমুনাও আমাদের সামনে উপস্থাপন করে এবং মহানবী সা: এর পবিত্র সত্তায় দৈহিক রূপ লাভ করে নিজের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এমন পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে যে, কারোর পক্ষে এর শব্দাবলী নিয়ে তামাশা করার, নিজের খাহেশ মাফিক অর্থ বের করার এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিত্য নতুন পথ আবিষ্কারের কোন সুযোগ থাকে না। সেই সর্বশক্তিমান প্রভু যিনি নিজের নির্দেশ ব্যতিরেকে অন্য কারো অনুসরণ না করার কঠোর তাকিদ দিয়েছেন- তিনি তাঁর রসুল সা: সম্পর্কে ইরশাদ করেন:
(আরবী***)
অর্থ: “আমরা রসুল এই উদ্দেশ্যেই প্রেরণ করেছি যে, আল্লাহর নির্দেশে তার আনুগত্য করা হবে” (সূরা নিসা: ৬৪)।
আর এই আনুগত্যও জবরদস্তি ও বলপ্রয়োগে নয়,বরং পরিপূর্ণ মানসিক প্রস্তুতি এবং আন্তরিক আকর্ষণ সহকারে হতে হবে।
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا [٤:٦٥]
অর্থ: “কিন্তু না তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ তাদের নিজেদের বিবাদ বিসম্বাদের মীমাংসার ভার তোমার উপর সোপর্দ না করবে, অত:পর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকবে না এবং সর্বান্ত:করণে তা মেনে না নেয়”(সূরা নিসা:৬৫)।
এই নির্দেশের প্রেক্ষাপটে ইসলামী রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিক থেকে রাষ্ট্রপ্রধান পর্যন্ত সবার জন্য নেতৃত্ব, পথ নির্দেশ ও রাজত্ব করার মূল উৎস হচ্ছে মহানবী সা: এর পবিত্রতম ব্যক্তিত্ব। জীবনের প্রতিটি ব্যাপারে তার কর্ম পন্থা হবে করুআনের এই উপদেশের বাস্তব নমুনা।
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
অর্থ: “রসুল তোমাদের যা দেয় তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত থাক। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ শাস্তিদানে বড়ই কঠোর। (সূরা হাশর: ৭)।
(আরবী***)
অর্থ: “প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর রসুলের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ” (সূরা আহযাব:২১)।
রসুলে করীম সা: এর রাজত্বের বাস্তব নমুনা বর্তমান থাকাতে পৃথিবীর কোন ইসলামী রাষ্ট্রতা যে গোলার্ধেই অবস্থিত হোক, কোনক্রমেই এই বিষয়টি উপেক্ষা করতে পারে না যে, কোন বিষয়ে মহানবী সা: এর বক্তব্য অথবা কাজ কি ছিল এবং কুরআনের কোন্ নির্দেশের তিনি কি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। রাষ্ট্র পরিচালনার এই স্থায়ী নমুনা ইসলামী রাষ্ট্রে প্রত্যেক সরকার প্রধানকে মহানবী সা: এর অনুসরণ করতে বাধ্যগত করে দেয়। আর এই বাধ্যবাধকতাই ক্ষমতা ও এখতিয়ারের সীমা অতিক্রমের রাস্তা বন্ধ করে যুলুম -নির্যাতন ও বাড়াবাড়ির যে কোন সুযোগ খতম করে দেয়।
৪. বিচার বিভাগের প্রাধান্য
কুরআন-সুন্নাহর বিধান চিরন্তন হওয়ার তাৎপর্য এই যে, ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ ও আইন প্রণয়নকারী সংস্থা উভয়ের উপর বিচার বিভাগের প্রাধান্য বিদ্যমান। শাসন বিভাগ কুরআন ও সুন্নাহর বিরোধী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না এবং আইন বিভাগ (সংসদ) কুরআন-সুন্নাহর সাথে সামঞ্জস্যহীন কোন আইন প্রণয়ন করতে পারে না। বিচার বিভাগ সাধারণ নাগরিকের অধিকার সমূহের হেফাজতকারী। সে নাগরিক অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক আইনকে অকেজো ঘোষণা করে তাকে কার্যকর করতে বাধা দিতে পারে এবং শাসন বিভাগের জারীকৃত বিধান অকার্যকর গণ্য করে নাগরিকদের মজবুত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারে।
৫. আনুগত্যের সীমা
ইসলামী রাষ্ট্রে রাষ্ট্র প্রধানের আনুগত্য শর্তহীন নয়, বরং শর্তসাপেক্ষ। এই পর্যায়ে স্বয়ং সর্বশক্তিমান আল্লাহ নিম্নোক্ত নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছেন:
“হে মুমিনগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রসুলের এবং তাদের যারা তোমাদের মধ্যে কর্তৃত্বের অধিকারী। কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতবিরোধ হলে তা আল্লাহ ও রসুলের নিকট রুজু কর” (সূরা নিসা: ৫৯)।
এই আয়াতে ইসলামী রাষ্ট্রে আনুগত্যের যে শর্তাবলী ও সীমারেখা নিরূপিত হয়েছে তা নিম্নরূপ:
১. প্রকৃত আনুগত্য করতে হবে আল্লাহর এবং এই আনুগত্য রসূল সহ সমস্ত মুসলমানের উপর ফরয।
২. অতপর আনুগত্য করতে হবে রসুল সা: এর এবং প্রকৃতপক্ষে এটা কোন আলাদা আনুগত্য নয়, বরং আল্লাহর আনুগত্যেরই এক বাস্তব রূপ। রসুল সা: এর আনুগত্য ব্যতিরেকে আল্লাহর আনুগত্য করার কোন পথ আমাদের জন্য নেই। তাই কুরআনুল করীমের অন্য জায়গায় বলা হয়েছে:
“যে ব্যক্তি রসুলের আনুগত্যের ন্যায় এই দ্বিতীয় আনুগত্যের উঁচু-নিচ, সাধারণ নাগরিক ও সরকার প্রধান নির্বিশেষে সমস্ত মুসলমানের উপর ফরয।
৩. অত:পর আনুগত্য হচ্ছে সাহেবে আমর অর্থাৎ শাসনকর্তার প্রতি। কিন্তু এই আনুগত্য উপরোক্ত দুই সত্তার (আল্লাহ ও রসুলের) আনুগত্যের ন্যায় শর্তহীন নয়, বরং তা একটা মৌলিক শর্তের সাথে সম্পৃক্ত। তা হচ্ছে: স্বয়ং শাসনকর্তাও সাধারণ নাগরিকদের সাথে প্রথমোক্ত দুই সত্তার আনুগত্যের ব্যাপারে সমানভাবে অংশীদার।
৪. শাসনকর্তা ও সাধারণ মুসলমানের মধ্যে কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে আল্লাহর কিতাব ও রসুল সা: এর সুন্নাহ মোতাবেক মীমাংসা করতে হবে।
ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধানের এই মৌলিক দফার সঙ্গেই মুসলমানদের এই সুষ্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, তারা কোন নফসের দাস, বিপর্যয় সৃষ্টিকারী, স্বৈরাচারী যালিম এবং ‘আমর বিল মারুফ ও নাহী আনিল মুনকার’ ( সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ) এর পরিপন্থী কাজে লিপ্ত ব্যক্তির আনুগত্য কখনো করবে না। এই পর্যায়ে কুরআনুল করীমের কতিপয় আয়াত দ্রষ্টব্য।
“তুমি এমন ব্যক্তির আনুগত্য কর না যার অন্তরকে আমার যিকির থেকে গাফিল করে দিয়েছি, যে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে” (সূরা কাহফ :২৮)।
“এবং তোমরা সীমা লংঘনকারীদের আনুগত্য কর না- যারা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে এবং শান্তি স্থাপন করে না” ( সূরা শুআরা: ১৫১-১৫২)।
“তাদের মধ্যে যে পাপিষ্ট অথবা কাফের তার আনুগত্য কর না” ( সূরা দাহর: ২৪)।
“এবং অণুসরণ কর না তার যে কথায় কথায় শপথ করে, যে চরমভাবে লাঞ্ছিত, পশ্চাতে নিন্দাকারী, যে একের কথা অন্যের কাছে লাগিয়ে বেড়ায়, যে কল্যাণের কাজে বাধা দেয়, যে সীমা লংঘনকারী, পাপিষ্ঠ, রূঢ় স্বভাব, তদুপরি কুখ্যাত, সে ধন সম্পদ ও সন্তান সন্তুতিতে সমৃদ্ধশালী। তার কাছে আমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে শোনানো হলে সে বলে, এতো সেকালের রূপকথা মাত্র” (সূরা কালাম: ১০-১৫)।
রসূলে করীম সা:এর হাদীস সমূহ এই প্রসঙ্গে আনুগত্যের নীতিমালার বিস্তারিত ও সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছে। এর প্রতিটি দিক সম্পর্কে রয়েছে বর্ণনা, যাতে কোন প্রকার অষ্পষ্টতা ও জটিলতা অবশিষ্ট নেই। মহানবী সা: ইরশাদ করেন:
“নাফরমানী ও অবাধ্যতামূলক নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত মুসলমানদের উপর শাসকের আনুগত্য করা অপরিহার্য, চাই তা তাদের পছন্দ হোক কিংবা অপছন্দ হোক। তাদের অন্যায় নির্দেশ প্রদান করলে তখন তার কথা শোনা ও আনুগত্য করা যাবে না” ( বুখারী, মুসলিম)।
আমীর যখনই প্রথম দুই প্রকার আনুগত্য থেকে মুক্ত হয়ে নিজের মন মত কাজ করবে তখনই তার আনুগত্য পাওয়ার অধিকার রহিত হয়ে যাবে। এমন অবস্থায় মুসলমানদেরকে প্রকাশ্যভাবে তার আনুগত্যের পরিবর্তে তাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। এভাবে প্রকাশ্যে তাকে প্রত্যাখ্যান করা তাদের অপরিহার্য কর্তব্য। এই পর্যায়ে মহা নবী সা: এর ষ্পষ্ট নির্দেশ হচ্ছে:
“পাপ কাজে কোন আনুগত্য নেই। কেবলমাত্র সত কাজেই আনুগত্য” (বুখারী, মুসলিম)।
সেই ব্যক্তির জন্য কোন আনুগত্য নেই যে, আল্লাহর নাফরমান” ( আবু দাউদ, নাসাঈ)
“স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির আনুগত্য নেই” (বুখারী, মুসলিম)।
আনুগত্য পাওয়ার অধিকার বিলুপ্ত হওয়ার অর্থ হচ্ছে- শাসকের এখন আর নির্দেশ দানের অধিকার নেই। তার যাবতীয় এখতিয়ার রহিত হয়ে গেল। তার কোন আদেশেরই এখন আর আইনগত মর্যাদা নাই। তাকে অপসারিত করে অপর কাউকে নির্বাচন করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার এখতিয়ার মুসলমানদের রয়েছে। সে যদি বিদ্রোহ ও অবাধ্যতায় এতটা অগ্রসর হয়ে যায় যে, নামায পড়া ছেড়ে দিয়েছে তবে তার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করারও অনুমতি রয়েছে।
“তোমাদের উপর এমন লোকও শাসনকার্য পরিচালনা করবে যাদের কতক কাজ তোমরা ভালো দেখবে এবং কতক মন্দ। যারা তাদের মন্দ কাজের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করবে তারা দায়িত্বমুক্ত এবং যারা সেগুলো অপছন্দ করবে তারাও রেহাই পাবে। কিন্তু যেসব লোক তাতে সন্তুষ্ট এবং তার অনুসরণ করবে তারা অপরাধী হিসাবে গণ্য। সাহাবায়ে কিরাম আরয করলেন, হে আল্লাহর রসুল! যখন এমন শাসকের উদ্ভব হবে তখন আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করব না? তিনি বললেন: না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নামায কায়েম করবে” (মুসলিম)।
হযরত আবু বাকর সিদ্দীক রা: খিলাফতের মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরে এই আনুগত্যের সীমারেখা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁর ভাষণে বলেন: “যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও তাঁর রসুলের আনুগত্য করব ততক্ষণ তোমরা আমার আনুগত্য করবে। কিন্তু আমার থেকে এমন কোন আচরণ যদি প্রকাশ পায় যাতে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের নাফরমানী হয় তখন আমার আনুগত্য করা তোমাদের উপর জরুরী নয়”(আবু বাকর, পৃ.৮৬)।
হযরত উমার ফারুক রা: এক সমাবেশে ভাষণদানকালে বলেন, “শাসকের সর্বপ্রধান কর্তব্য হচ্ছে, জনসাধারণ আল্লাহর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করছে কি না তার প্রতি লক্ষ্য রাখা। আমি তোমাদেরকে আল্লাহর নির্দেশ পালনের আদেশ দেই এবং সে সব বিষয় থেকে বিরত রাখব যা থেকে আল্লাহ বিরত থাকতে বলেছেন। আমি চাই আল্লাহর নির্দেশ দূরের ও কাছের সকলে মেনে চলুক” (উমার ইবনুল খাত্তাব, ২৯৩)।
হযরত ফারুকে আযমের খিলাফতকালে ইরাক বিজয়ের পরে অনেক লোক ‘কুরআনে আহলে কিতাব নারীদের বিবাহ করার অনুমোদনের’ অধীনে খৃস্টান মেয়েদের বিবাহ করে। হযরত উমার রা: হুযায়ফা ইবনুল য়ামান রা: কে লিখে পাঠান, আমি এটা পছন্দ করি না। জবাবে তিনি (হুযায়ফা) লিখে পাঠান, এটা কি আপনার ব্যক্তিগত মত, না শরীআতের নির্দেশ? উমার রা: লিখলেন, এটা আমার ব্যক্তিগত মত। হুযায়ফা রা: লিখে জানান, আপনার ব্যক্তিগত মতের আনুগত্য করা আমার জন্য জরুরী নয়” (শিবলী নোমানী, আল ফারুক, করাচী ১৯৭০, পৃ. ৫১২)।
হযরত আলী রা: এক ভাষণে বলেছিলেন:
“আল্লাহর আনুগত্য করা অবস্থায় আমি তোমাদের যে নির্দেশ দেই তা পালন করা তোমাদের উপর ফরয, চাই তা তোমাদের পছন্দের হোক বা না হোক। আল্লাহর অবাধ্য অবস্থায় কোন নির্দেশ দিলে পাপ কাজে আমার কোন আনুগত্য নেই। আনুগত্য শুধুমাত্র ভালো কাজে, আনুগত্য শুধুমাত্র ভালো কাজে, আনুগত্য শুধুমাত্র ভালো কাজে” (কানযুল উম্মাল, ৫ খ. হাদীস নং ২৫৮৭)।
উলিল আমরের (শাসনের কর্তৃপক্ষের) এই শর্ত সাপেক্ষ আনুগত্যের দরুন আল্লাহ ও রসুলের নির্ধারিত অধিকারসমূহের উপর হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকার তাদের নেই। তাদের আনুগত্য সেই সময় পর্যন্ত অপরিহার্য যতক্ষণ তারা এই অধিকার সমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে এবং এর পরিপন্থী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করবে। শাসক এই নীতি লংঘন করলে জাতি তার আনুগত্য থেকে মুক্ত হয়ে যাবে এবং তাকে খিলাফতের আসন থেকে অপসারণের অধিকারী হবে। আনুগত্যের এই শর্তাবলী ও সীমারেখা শাসক শ্রেণীর মুকাবিলায় নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের এক মজবুত গ্যারান্টি দান করে।
৬. পারষ্পরিক পরামর্শের বাধ্যবাধকতা
উলুল আমরের (শাসন কর্তৃপক্ষের) উপর আরোপিত আরেকটি বাধ্যবাধকতা এই যে, তারা উম্মতের প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিগণের ( আহলুর রায়) সাথে পরামর্শ ব্যতিরেকে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে না। তারা যেভাবে মুসলমানদের পারষ্পরিক পরামর্শ ও সম্মতিতে নির্বাচিত হন ঠিক তেমনিভাবে কুরআনুল করীমের নিম্নোক্ত নির্দেশের আওতায় শাসনকার্যও পরামর্শের ভিত্তিতে পরিচালনা করতে বাধ্য।
“মুসলমানদের কার্যাবলী পারষ্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়”(সূরা শূরা: ৩৮)।
এই পারষ্পরিক পরামর্শ থেকে আল্লাহর রসুলকেও ব্যতিক্রম করা হয়নি। মহানবী সা: কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে:
“(হে রসুল!) কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর” (সূরা আলে ইমরান: ১৫৯)।
রসুলুল্লাহ সা: স্বয়ং নির্দেশদাতা ( শাসক) ছিলেন। তিনি সরাসরি আল্লাহর নির্দেশ লাভ করতেন। তাই তিনি কারো সাথে পরামর্শ করতে বাধ্য ছিলেন না। কিন্তু তাঁকে যেহেতু পরবর্তীকালের শাসকদের জন্য নমুনা হতে হবে তাই তাঁর মারফতে পারষ্পরিক পরামর্শ গ্রহণের ঐতিহ্য কায়েম করা হয়েছে। তিনি প্রায়ই ছোট বড় ব্যাপারে সাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করতেন। এই সুন্নাত স্বয়ং আল্লাহ তাআলার এতটা পছন্দনীয় ছিল যে, কোন কোন বিষয়ে আল্লাহ তাআলা রসুল সা: কে পথ নির্দেশ দেওয়ার পূর্বে সাহাবায়ে কিরামের অভিমতের অপেক্ষা করতেন এবং তাদের মধ্যে কারো মত পছন্দনীয় হলে ওহী নাযিলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সাহাবীর সম্মান ও হিম্মত বাড়িয়ে দিতেন এবং তাঁর মতের অনুকূলে অনুমোদন দিতেন। সুতরাং বদর যুদ্ধের বন্দীদের বিষয়, মুনাফিকের জানাযা প্রসঙ্গ, পর্দা, মাদক দ্রব্যের অবৈধতা, মাকামে ইবরাহীমকে মুসাল্লা ( নামাজের স্থান) বানানো এবং বিশ্রামকালীন বিনা অনুমতিতে ঘরে প্রবেশের নিষিদ্ধতা ইত্যাদি বিষয়ে হযরত উমার রা:-র অভিমত অনুসারে আয়াতসমূহ নাযিল হয়েছে। একবার রসুলে করীম সা: হযরত আবু বাকর রা: ও হযরত উমার রা: কে সম্বোধন করে বলেছিলেন:“কোন সমস্যা সমাধানে তোমরা দুইজন ঐক্যমতে পৌঁছলে আমি তাতে মতানৈক্য করব না” (মুসনাদে আহমাদ)
হযরত আলী রা: বলেন, “আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রসুল! আপনার পরে যদি এমন কোন সমস্যার উদ্ভব হয় যে সম্পর্কে কুরআনুল করীমে কিছু নাযিল হয়নি এবং আপনার থেকেও কোন কিছু শুনা যায় নি? তিনি বলেন: আমার উম্মাতের ইবাদতগুযার লোকদের একত্র কর এবং তাদের পারষ্পরিক পরামর্শের জন্য বিষয়টি উত্থাপন কর। কোন এক ব্যক্তির মতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর না” ( মওদুদী, ইসলামী রিয়াসত, পৃষ্ঠা. ৩৭৩)।
এই পরামর্শের গুরুত্ব ও তার প্রাণশক্তি সম্পর্কে রসুলে করীম সা: ইরশাদ করেন: “যে ব্যক্তি তার ভাইকে এমন কাজের পরামর্শ দেয়, যে সম্পর্কে সে জানে যে, সঠিক কথা এর বিপরীতে আছে- তবে সে প্রকৃতপক্ষে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল” ( আবু দাউদ)।
কুরআন মজীদের সুষ্পষ্ট নির্দেশ ও রসুল সা: এর সুন্নাতের পরে মুসলমানদের কোন আমীর পরামর্শ ব্যতিরেকে এক কদমও অগ্রসর হতে পারে না।
পরামর্শের এই বাধ্যবাধকতা একনায়কত্বের পথ রুদ্ধ করে দেয় এবং রাজনৈতিক জীবনে গণতান্ত্রিক প্রাণসত্তার উন্মেষ ঘটায়। এখানে আরও একটি মৌলিক বিষয় স্মরণে রাখা দরকার। ইসলামী ব্যবস্থায় শূরা বা পরামর্শ পরিষদের নীতিমালা সংখ্যাগরিষ্টের মতের উপর নয়, বরং সঠিক সিদ্ধান্তের উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাত যে মত কুরআন ও সুন্নাতের নিকটতর হবে কেবল তাই গ্রহণযোগ্য হবে এবং ইজমা কিংবা সংখ্যাগরিষ্টের মতের কোন ওজন বা গুরুত্ব নেই।
হযরত আবু বাকর সিদ্দীক রা: যাকাত দানে অস্বীকারকারীদের বিষয়ে প্রবীণ সাহাবীদের পরামর্শ নেন। তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ না করার পক্ষেই অধিকাংশের মত ছিল। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেন নি। কেননা তিনি উপলদ্ধি করেছিলেন যে, কুরআনের মর্মানুসারে জিহাদ ঘোষণার সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। পরিশেষে সকলেই তাঁর সাথে একমত হয়ে জিহাদে শরীক হয়েছিলেন। অনুরূপভাবে হযরত উমার রা: ইরাক ও সিরিয়ার বিজিত অঞ্চলসমূহের ভূমি মুজাহিদদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়ার পক্ষে সংখ্যাগরিষ্টের দাবীর বিরোধিতা করেন। হযরত বিলাল রা: ও হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রা: প্রমুখ সাহাবী অত্র ভূমি বন্টন করে দেওয়ার জন্য বারংবার চাপ সৃষ্টি করছিলেন। সমস্যা নিরসনের জন্য অধিবেশন ডাকা হল। অবশেষে হযরত উমার রা: সূরা হাশর এর আয়াত থেকে নিজের অভিমতের সপক্ষে দলীল উপস্থাপন করে নিজের রায়কে মানিয়ে নেন।
এসব নজির দ্বারা একথাও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, শাসকের উচ্চতর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা থাকা সত্তেও শুধুমাত্র ব্যক্তিগত অবহিতি ও সন্তুষ্টির ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোন কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, যতক্ষণ তার সঠিক সিদ্ধান্তের উপর সকলের অথবা সংখ্যাগরিষ্টের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত না হয়।
উলুল আমর (শাসনকর্তা) ও মজলিসে শুরার পারষ্পরিক সম্পর্ককে হযরত উমার রা: এই ভূমি বন্টন সম্পর্কিত সমস্যার সমাধানের জন্য আহুত অধিবেশনে নিম্নোক্ত ভাষায় ব্যক্ত করেন:
“আমি আপনাদের শুধু এজন্য কষ্ট দিচ্ছি যে, আমার কাঁধে আপনাদের বিষয়ে যে গুরুদায়িত্বভার অর্পণ করা হয়েছে তা পালনে আপনারা আমার হাত শক্তিশালী করবেন। আমি তো আপনাদের মতই একজন মানুষ। আজ আপনাদেরকে অধিকার নির্ধারণ করতে হবে। কেউ কেউ আমার সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন, আবার কেউ বা ঐক্যমত। আমি চাই না যে, আপনারা সর্বাবস্থায় আমার সিদ্ধান্তই কবুল করবেন। আপনাদের কাছে রয়েছে আল্রাহর কিতাব যা সত্য কথা বলে। আল্লাহর শপথ! আমি কাজে পরিণত করার উদ্দেশ্য যদি কোন কথা বলি তাহলে তাতে সত্যের অনুসরণ ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই” (কিতাবুল খারাজ, পৃ. ১৬১)।
সেই হযরত উমার ফারুক রা:-র বাণী: “পরামর্শ ব্যতিরেকে খিলাফত চলতে পারে না” ( কানযুল উম্মাল, ৫ খ, হাদীস ২৩৫৪)।
তিনি পারষ্পরিক পরামর্শের উপর জোর দিতে গিয়ে এতদূর পর্যন্ত বলেছেন, “যে ব্যক্তি মুসলমানদের সাথে পরামর্শ ব্যতিরেকে নিজের অথবা অন্য কারো নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার আহ্বান জানাবে তোমাদের জন্য তাকে হত্যা না করা বৈধ নয়” (ঐ, ৫ খ, হাদীস ২৫৭৭)।
হযরত উসমান রা:-র শাহাদাতের পরে কতিপয় লোক হযরত আলী রা:-কে খলীফা মনোনীত করতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তোমাদের এই ব্যাপারে কোন এখতিয়ার নেই। এটা করার অধিকার রয়েছে শুরার সদস্যবৃন্দের’ এবং বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের। আহলে শূরা ও আহলে বদর যাকে খলীফা বানাতে চাইবেন তিনিই খলীফা হবেন। সুতরাং আমরা একত্র হব এবং এই ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করে দেখব” ( ইবনে কুতাইবা, আল-ইমামা ওয়াস সিয়াসা, ১ খ, পৃ. ৪১)।
হযরত আবু মুসা আশআরী রা: এই পরামর্শকেই খিলাফত ও রাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, “ইমারত ( অর্থাত খিলাফত)হচ্ছে পরামর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত আর তলোয়ারের জোরে যা হাসিল করা তাই রাজতন্ত্র” ( তাবাকাতে ইবনে সা’দ, ৪ খ, পৃ. ১১৩)।
এই পারষ্পরিক পরামর্শের নীতি সংশ্লিষ্ট সকলের অভিমত প্রকাশের পরিপূর্ণ অধিকার সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে যাদের অধিকার ও স্বার্থ আলোচনাধীন। এই পরামর্শকে শুধুমাত্র শূরার (সংসদ) নির্বাচিত সদস্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি,বরং একজন সাধারণ নাগরিকও কুরআন সুন্নাহর দলীল পেশ করে শূরা ও রাষ্ট্র প্রধানের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করতে পারে। একজন বৃদ্ধ মহিলা নিজের এই অধিকার ব্যবহার করে হযরত উমার ফারুক রা: কে মোহরের পরিমাণ সীমিত করার ভুল সিদ্ধান্তের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন এবং তিনি তৎক্ষণাৎ তার নির্দেশ প্রত্যাহার করেন।
৭. উদ্দেশ্য ও অগ্রাধিকারের বাধ্যবাধকতা
শাসনকর্তার উপর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বাধ্যবাধকতা এই যে, তিনি রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং অধিকারের প্রাধান্যের ক্ষেত্রে কোন রদবদল করতে পারেন না।
কেননা এই রদবদল আমানতের ধারণার পরিপন্থী। তিনি শরীআতের বিধান মোতাবেক কিংবা শূরার সিদ্ধান্তে নির্ধারিত খাতসমূহেই বায়তুল মালে রক্ষিত সম্পদ ব্যবহার করতে বাধ্য। এতে তার ব্যক্তিগত প্রাপ্য কতটুকু তাও শূরার সিদ্ধান্ত অনুসারে নিরূপিত হবে। প্রথম খলীফার মনোনয়নের পরে তাঁর জীবিকা নির্বাহের প্রশ্ন উঠে। তিনি বাজারে কাপড় বিক্রি করার জন্য কাপড়ের থান কাঁধে করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমন সময় হযরত উমার রা: এসে তাঁকে বায়তুল মালের তত্ত্বাবধায়ক হযরত আবু উবায়দা রা:-র নিকট নিয়ে এলেন। তিনি (উমার) বেতন নির্ধারণের নীতিমালা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন:
“আমরা আপনার জন্য একজন সাধারণ মুহাজিরের স্বাভাবিক আয়ের পরিমাণ সামনে রেখে একটা ভাতা নির্ধারণ করেছি। তার পরিমাণ তাদের সর্বাপেক্ষা বিত্তবানের সমানও হবে না এবং তাদের সর্বাপেক্ষা দরিদ্র ব্যক্তিরও সমান হবে না” ( কানযুল উম্মাল, ৫খ. হাদী ২২৮০)।
খলীফাতুর রসুল হযরত আবু বাকর রা:-র জন্য এই ভাতার পরিমাণ নির্ধারিত হল বার্ষিক চার হাজার দিরহাম। মৃত্যু শয্যায় তিনি গ্রহণকৃত সমস্ত বেতন ভাতাদি বায়তুল মালে ফেরত দেবার ব্যবস্থা করে যান এবং তা ফেরত দেওয়াও হয়। হযরত উমার রা: বায়তুল মালে খলীফার প্রাপ্য বর্ণনা প্রসঙ্গে পরিষ্কার বলেন: এক জোড়া গ্রীষ্মকালীন পোশাক, একজোড়া শীতকালীন পোশাক এবং কুরায়শদের মধ্যবিত্ত এক ব্যক্তির জীবিকার সমান বেতন ভাতাদি আমার পরিবারের জন্য বৈধ। এছাড়া আল্লাহর সম্পদ থেকে কোন কিছুই আমার জন্য হালাল নয়। অত:পর আমি একজন সাধারণ মুসলমান” ( ইবনে কাছীর,আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭খ. পৃ. ১৩৪)।
তিনি বায়তুল মালের যিম্মাদারী প্রসঙ্গে এই মৌলিক নীতিমালা নির্ধারণ করেন, “আমি এই সম্পদের ব্যাপারে তিনটি বিষয় ছাড়া অন্য কিছুই সঠিক মনে করি না। ১) ন্যায়সঙ্গতভাবে গ্রহণ করতে হবে, ২) ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রদান করতে হবে, ৩) অন্যায়ভাবে ব্যয় হওয়া থেকে একে রক্ষা করতে হবে। তোমাদের সাথে আমার সম্পর্ক ইয়াতীমের সাথে তার অভিভাবকের সম্পর্কের মতই। আমি অভাবী না হলে তা থেকে কিছুই গ্রহণ করব না। যদি অভাবী হই তাহলে ন্যায়সঙ্গত পন্থায় ভোগ করব” (শিবলী নোমানী, আল-ফারুক,কিতাবুল খারাজের বরাতে)।
হযরত আলী রা: ও শায়খানের (হযরত আবু বাকর রা: ও হযরত উমার রা: সমপরিমাণ বেতন ভাতাদি গ্রহণ করতেন এবং অতিশয় অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন।
ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমরা গোড়াতেই আলোচনা করেছি। এর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করা।
(আরবী***)
অর্থ: “তোমরা দীন কায়েম কর এবং এতে মতভেদ কর না” (সূরা শূরা:১৩)।
ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বিক শক্তি এবং তার প্রতিটি নাগরিকের জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে:
(আরবী***)
“দীন সামগ্রিকভাবে আল্লাহর জন্য নিবেদিত হবে” (সূরা আনফাল:৩৯)।
শাসনকর্তা এই উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে অন্য কোন উদ্দেশ্য তার সামনে রাখতে পারেন না। নবী করীম সা: তাঁর স্থলাভিষিক্তদের এবং সমগ্র মুসলমানকে কঠোরভাবে সতর্ক করে বলেন: “যে ব্যক্তি আমাদের এই দীনে এমন কোন কথা আবিষ্কার করবে যা তার মূলের সাথে সম্পর্কহীন তার সে কথা প্রত্যাখ্যাত” (মিশকাত: বাবুল ইতিসাম বিল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ)।
“যে ব্যক্তি কোন বিদআত উদ্ভাবনকারীকে সম্মান দেখা সে যেন ইসলামকে ধ্বংস করতে সাহায্য করল” ( মিশকাত বাবুল ইতিসাম বিল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ)।
এই হচ্ছে সেসব বাধ্যবাধকতা যা ইসলামী রাষ্ট্রের শাসকের কর্তৃত্ব ও এখতিয়ারের উপর আরোপ করা হয়েছে। প্রতিনিধিত্বমূলক ক্ষমতার সাথে সাথে কুরআন, সুন্নাহ, শূরা, শর্তযুক্ত আনুগত্য এবং উদ্দেশ্য ও অগ্রাধিকারের বাধ্যবাধকতার মজবুত শৃঙ্খলে আবদ্ধ একজন শাসক মৌলিক অধিকার খর্ব করার প্রয়াস চালাতে পারে- এমন ধারণা কেউ করতে পারে কি?