অধিকারের পাশ্চাত্য ধারণা
মানুষের মৌলিক অধিকারের বিষয়টি মূলত এ জগতে মানুষের মর্যাদা, তার অস্তিত্বের উদ্দেশ্য, সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে তার সম্পর্কের ধরন এবং স্বয়ং এ বিশ্বজগতের সৃষ্টি এবং তার সূচনা ও পরিণতির তাৎপর্য্ কে সঠিকভাবে উপলব্ধি করার সাথে সংশ্লিষ্ট। মানুষের অধিকারগুলো কি? উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর ততক্ষণ পর্য্ন্ত সম্ভব নয় যতোক্ষণ পর্য্ন্ত এই সিদ্ধান্তে পৌছা যাবেনা যে, পৃথিবীতে শেষ পর্য্ন্ত মানুষের মর্যাদা কি? অর্থাৎ অধিকারের প্রশ্ন মর্যাদার সাথে সংশ্লিষ্ট। মানুষের মর্যাদা অবগত না হয়ে বা এ সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তে না পৌছে আমরা তার অধিকারগুলো চিহ্নিত করতে পারিনা।
মানব জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর সমাধানের পথনির্দেশ আমরা কেবল ওহীভিত্তিক ধর্মগুলো হতে পেতে পারতাম। কারণ আমাদের নিকট জ্ঞানের অন্য কোনো নির্ভরযোগ্য উপায় বর্তমান ছিলনা। কিন্তু মানুষ যখন ওহীর মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞানকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তির সহায়তায় এসব প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের চেষ্টা করে তখন এখান হতেই ধারণা-অনুমান ও কল্পনার ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হওয়ার এবং অজ্ঞতার মরিচীকায় হোঁচটের পর হোঁচট খাওয়ার সূচনা হয়। এসব প্রশ্নের উত্তর ইন্দ্রিয়ের উপর ভিত্তিশীল অভিজ্ঞতা ও পর্য্যবেক্ষণের আওতার অনেক দূরে ছিল। লিখিত ইতিহাস-যা এই পৃথিবীতে মানব জীবনের সূচনার লাখো বছর পরে অস্তিত্ত্ব লাভ করেছে-এসব সত্য পর্য্ন্ত পৌছতে নিজের রেকর্ডে কোনো তথ্য পেশ করতে অক্ষম ছিল। এই গভীর অন্ধকারে ওহীর আলো হতে বঞ্চিত এবং সত্যের সাথে অপরিচিত জ্ঞান যখন ফিকির-ফন্দী ও চাতুরীর দ্বারা জীবনের জটিল সমস্যাগুলোর জট খুলতে চেষ্টা করে তখন সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে কঠিন মুহুর্তটি সামনে এলো যে, কোথা থেকে আলোচনার সূচনা করা যায়? জ্ঞান-বুদ্ধির সামনে যেহেতু গ্রহণযোগ্য স্বতঃসিদ্ধসমূহ ছিলনা যেগুলির ভিত্তিতে তারা যুক্তিপ্রমাণ দাঁড় করাতে পারত, তাই বাধ্য হয়ে তাদেরকে সূচনাবিন্দু হিসেবে স্বকগোলকল্পিত থিসিস, আদর্শ ও তত্ত্ব কায়েম করে তার উপর আলোচনার ভিত্তি রাখতে হয়। বুদ্ধিতো এভাবে একটি অনির্ভরযোগ্য বিশ্বাস ও কল্পনার উপর ভিত্তিশীল আলোচনার পথ অবলম্বন করে নিজের সমস্যা দূর করলো, কিন্তু সে মানবজাতির সামনে উদ্ভূত সমস্যাবলীর কোনো সন্তোষজনক সমাধান খুঁজে বের করায় সাফল্য লাভ করতে পারল না। তার পেশকৃত অস্পষ্টতা, অসংলগ্নতা, স্ববিরোধিতা এবং গুরুতর চিন্তা ও মতবাদের বোঝা এই সমস্যাগুলোকে আরো জটিল করে তুলল। আর এভাবে মানবতা অজ্ঞতা আর নির্বুদ্ধিতার আবর্তে ফেঁসে যেতে থাকে। কুরআন মজীদ জ্ঞান বুদ্ধির এই দৈন্যদশার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেঃ
وَإِن تُطِعْ أَكْثَرَ مَن فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۚ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ [٦:١١٦]
“আর(হে মুহাম্মাদ) যদি তুমি দুনিয়ার অধিকাংশ লোকের কথামত চল তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্যূত করবে। তারা তো শুধু অনুমানের অনুসরণ করে। তারা কেবল অনুমানভিত্তিক কথা বলে।”(সূরা ৬, আনআম: আয়াত ১১৬)।
قُلْ هَلْ عِندَكُم مِّنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنَا ۖ إِن تَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ أَنتُمْ إِلَّا تَخْرُصُونَ [٦:١٤٨]
“(তাদের) বল, তোমাদের নিকট কি কোনো জ্ঞান আছে? থাকলে তা আমাদের সামনে পেশ কর। তোমরা শুধু কল্পনারই অনুসরণ কর এবং শুধু মিথ্যাই বল।”(আনআমঃ ১৪৮)।
জ্ঞানের পরিভ্রমণ যেহেতু অজ্ঞতার অন্ধকারে শুরু হয়েছিল তাই তার কল্পিত প্লটসমূহের ভিত্তি নেই। তা অনুমানে সামনে অগ্রসর হয় এবং সমাধানের প্রচেষ্টায় নিত্য নতুন জটিলতার সৃষ্টি করতে থাকে। সে মানবজাতির মৌলিক অধিকারসমূহের বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করলে সে ক্ষেত্রেও তাকে অনুমিতি ও মতবাদের আশ্রয় নিতে হয়। মৌলিক অধিকারসমূহের ব্যাপারে সর্বপ্রথম যে প্রশ্ন দেখা দেয় তা এই যে, এসব অধিকারের শেষ পর্য্ন্ত বৈধতা কি? কিসের ভিত্তিতে মানুষের জন্য কতিপয় অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হবে আর স্বীকার করে নেওয়া হলেও তা কোন্ কর্তৃপক্ষের নির্দেশের প্রেক্ষিতে? এসব অধিকার শেষ পর্য্ন্ত কার কাছ হতে প্রদত্ত?
জ্ঞান বুদ্ধি বহুত চিন্তা ভাবনার পর উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর এই খুঁজে নেয় যে, স্বয়ং প্রকৃতি মানুষকে কতিপয় অধিকার প্রদান করেছে তাই তা স্বীকার করে নেওয়া উচিত। এই মতবাদকে ‘প্রকৃতি প্রদত্ত অধিকারের মতবাদ’ নাম দেওয়া যায়। এর বিরুদ্ধে আপত্তি উঠল যে, এই পরিভাষা অস্পষ্ট, সুস্পষ্ট নয়। স্বয়ং ‘প্রকৃতি’ শব্দের আজ পর্য্ন্ত কোনো সুস্পষ্ট ও সর্বসম্মত অর্থ পেশ করা সম্ভব হয়নি। তাই প্রাকৃতিক অধিকারসমূহ কিভাবে নির্ধারিত হবে? সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ এই ছিল যে, এসব অধিকারের আইনগত মর্যাদা কি? অধিকারের ধারণা তো সমাজে তার অনুমোদনের দ্বারাই করা যেতে পারে। সমাজের অনুমোদন ব্যতীত আবার অধিকারের প্রশ্ন কেমন?
তখন এসব অধিকারের আইনগত মর্যাদাদানের জন্য এবং সমাজের অনুমোদন লাভের জন্য ‘সামাজিক চুক্তি’ মতবাদ আবিষ্কার করা হল এবং দাবী করা হল যে, রাষ্ট্রের অস্তিত্ত্ব যেহেতু এই চুক্তির ফলশ্রুতি তাই শাসন কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা ও নাগরিকদের অধিকারের আসল উৎস এটাই। অধিকারের জন্য একটি আইনগত বৈধতা সরবরাহের প্রয়োজন এভাবে পূরণ করা হল। কিন্তু এই চুক্তির ঐতিহাসিক মর্যাদা কি? জে.ডব্লিউ.গফ এর মুখে শুনুনঃ “ব্লাকস্টোন ও পেলী হতে মেইন ও তার অনুসারীদের পর্য্ন্ত গোটা ঐতিহাসিক চিন্তাগোষ্ঠীর বক্তব্য হল এবং আজ তা সম্পূর্ণ স্পষ্ট ও অনস্বীকার্য্য যে, এটা এক ঐতিহাসিক সত্য যে, রাষ্ট্রসমূহ ও সরকারসমূহ স্বেচ্ছায় কোনো চুক্তির মাধ্যমে অস্তিত্ব লাভ করেনি, বরং প্রাকৃতিকভাবে একটি বংশ বা গোত্রের আকারে প্রাথমিকভাবে দলবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”(J.W. Gough, The Social Contract, Clarendon Press, Oxford 1967, P.4)।
প্রফেসর ইলিয়াস বলেনঃ “সামাজিক চুক্তি মতবাদ কি পুরোটাই অনৈতিহাসিক? এটা কি সম্পূর্ণই কল্পকাহিনী? এটা কি সামগ্রিকভাবে ভিত্তিহীন এবং শুধু তাত্ত্বিক? এসব প্রশ্নের সবসময় ইতিবাচক উত্তর দেওয়া হয়েছে এবং আজ পর্য্ন্ত কেউ বলেনি য, ‘না’। এই গোটা মতবাদ যখন আরো বিস্ময়কর রূপ ধারণ করে যখন বলা হয়, এটা তো ততই পুরাতন যত পুরাতন ধারণা-অনুমান ও কল্পনাবিলাস। তাই অনৈতিহাসিক হওয়া সত্ত্বেও এর নিজস্ব ইতিহাস আছে। অনৈতিহাসিক বলতে আমরা বুঝাতে চাচ্ছি যে, মানবজাতির গোটা রাজনৈতিক ইতিহাসে আমরা এমন কোনো একটি ঘটনা অথবা এমন একটি উদাহরণও পাচ্ছিনা যেখানে রাষ্ট্র গঠনের জন্য সামাজিক চুক্তির সাহায্য নেওয়া হয়েছিল।(Ilyas Ahmad, The Social Contract and the Islamic State, Urdu Publishing House, Allahabad 1944, p1)।
প্রশ্ন হচ্ছে-যে মতবাদ এতটা ভিত্তিহীন, যার অবস্থা একটি কল্পকাহিনীর অধিক নয় এবং স্বয়ং পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণ যাকে সর্বসম্মতভাবে অনৈতিহাসিক সাব্যস্ত করেছেন তাকে এতটা গুরুত্ব কেন দেওয়া হলো এবং তার ভিত্তির উপর অধিকারের ধারণার গোটা ইমারত কেন নির্মাণ হল? এর কারণ স্বয়ং পাশ্চাত্যবাসীদের মুখেই শোনা যাকঃ “এই মতবাদ ১৬শ ও ১৭শ শতকে ঠিক সেই সময়ে আত্মপ্রকাশ করে যখন রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের ব্যক্তি ও সমাজের পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যাখ্যার জন্য এরূপ একটি মতবাদের প্রয়োজন হয়েছিল।(Gaius Ezejiofor, Protection of Human Rights under the Law, London 1964, p.3)।
এই চুক্তিটি আসলে নিজ মতবাদকে বৈধতা প্রদানের অথবা আইনগত ভিত্তি সরবরাহের প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষিতে ‘আবিষ্কার’ করা হয়েছে। জে ডব্লউ গফ এ চুক্তির আসল গুরুত্ব সম্পর্কে লিখেছেনঃ “এই মতবাদ অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক পরিণামফলের বাহক। সামাজিক চুক্রি শর্তাবলী অথবা তার মিথ্যা বা সত্য হওয়ার প্রশ্নের থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেই মূলনীতি যাকে চুক্তির সমর্থকগণ উন্নত করার ও বহাল রাখার জন্য চেষ্টা চরিত্র করছেন।”(জে.ডব্লউ গফ, পূ.গ্র. পৃ.৬)।
“সামাজিরক চুক্তির পরিভাষাকে যদি বহাল রাখতেই হয় তবে তার সর্বোত্তম পন্থা হবে এই যে, তাকে চুক্তিতে পেশকৃত ধারণা অনুযায়ী রাজনৈতিক বিশ্বস্ততার সাথে সংশ্লিষ্ট মতবাদের একটি শব্দসংক্ষেপ মনে করতে হবে।”(ঐ, পৃ. ২৪৮)।
“একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে ‘সামাজিক চুক্তি’কে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। তার আধুনিক পতাকাবাহীগণ অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে নিজেদের এই দাবী পর্য্ন্ত সীমাবদ্ধ করে নিয়েছেন যে, এই চুক্তি হল রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি। এই দাবীও কয়েকটি আকার ধারণ করেছে। কেন্ট এর মতে এই দেওয়া যেতে পারে যে, ‘চুক্তিটি যেন ঐতিহাসেক দিক হতে কাল্পনিক, কিন্তু বুদ্ধির ধারণা হতে তা বৈধ। এর অর্থ আমাদের মতে এই যে, রাজনৈতিক অধিকার ও কর্তব্যসমূহ বিধিবদ্ধ ও সুসংবদ্ধ হওয়া উচিত।”(ঐ, পৃ. ২৪৪)।
উল্লেখিত উদ্ধৃতিসমূহ হতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সামাজিক চুক্তিকে একটি কাল্পনিক মতবাদ মনে করা সত্ত্বেও পাশ্চাত্যবাসী তা প্রত্যাখ্যান করতে প্রস্তুত নয় কেন। তারা এটা ত্যাগ করলে অধিকার ও কর্তব্যসমূহকে বিধিবদ্ধ করার সমর্থনে কোনো জিনিস তাদের নিকট অবশিষ্ট থাকেনা। এই অসহায় অবস্থার কথা সামনে রেখে স্যার আরনেস্ট বারকার সামাজিক চুক্তির সমর্থনে লিখেছেনঃ “এই মতবাদের সমর্থনে আজো অনেক কিছু বলা যায়। রাষ্ট্র-যা সমাজ হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি আইনানুগ সংস্থা যা মৌলিকভাবে চুক্তির ‘অনুমিতি’র উপরই প্রতিষ্ঠিত।”(ঐ, পৃ. ২৫০)।
এই চুক্তির আবিষ্কারের ফলে মৌলিক অধিকার ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার বৈধতা তো সরবরাহ হলো, কিন্তু এখন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এসে উপস্থিত হয়। সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ কে? রাষ্ট্র না জনগণ? অধিকার ও ক্ষমতার দিক দিয়ে এদের মধ্যে সর্বময় কর্তৃত্ব কে পাবে?
সামাজিক চুক্তিকেই ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে উপরোক্ত প্রশ্নের সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু নিজ নিজ যুগের দাবী ও বিশেষ প্রয়োজন সামনে রেখে হবস এর উদ্দেশ্য ছিল-স্টুয়ার্ট রাজাদের একচ্ছত্র শাসনের জন্য আইনগত বৈধতা সরবরাহ করা। অতএব তিনি সামাজিক চুক্তির পূর্বেকার বিশ্বের অবস্থার চিত্র নিজের প্রয়োজন মাফিক অংকন করেন। তিনি শাসকদেরকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সাব্যস্ত করে সমস্ত কর্তৃত্ব তাদের হাতে তুলে দেন এবং অসহায় ও ক্ষমতাহীন জনগণের জন্য বিনাবাক্য ব্যয়ে ও নিঃশর্তভাবে এসব শাসকের আনুগত্য বাধ্যতামূলক করে দেন।
১৬৮৮ খৃ. গৌরবময় বিপ্লব যখন একচ্ছত্র রাজতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল করে দিলো এবং অধিকার বিলের মাধ্যমে পার্লামেন্ট ও জনগণের অধিকার ও ক্ষমতা কিছুটা বর্ধিত হলে জন লক নতুন পরিস্থিতির বৈধতার জন্য এই সামাজিক চুক্তির একটি নতুন ব্যাখ্যা প্রদানের প্রয়োজন অনুভব করেন। অতএব তার কল্পনা বিশ্ব পরিস্থিতির সম্পূর্ণ ভিন্নতর চিত্র পেশ করে, যার মধ্যে মানবজাতির জীবন ‘একাকী, দারিদ্র্যপীড়িত, মানবেতর, পশুসুলভ ও সংক্ষিপ্ত’ ছিলনা, বরং হবস এর দাবীর বিপরীতে তা ছিল নিরাপদ, সুখ-সমৃদ্ধির, পারস্পরিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তার যুগ। তখন মানুষ স্বাধীনতা ও সাম্যের নীতিমালার উপর বড়ই সুখের ও আনন্দময় জীবনযাপন করছিল। লক এই প্রেক্ষাপটসহ সামাজিক চুক্তির নতুন ব্যাখ্যায় সর্বোচ্চ ক্ষমতা বাদশাহ ও জনগণের মধ্যে বন্টন করে দেন এবং জনগণকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেন তাদের সম্মতি ব্যতিরেকে কোনো রাজাই শাসন ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না।
ফরাসী চিন্তাবিদ রুশোর যুগ আসতে আসতে যেহেতু রাজা ও জনগণের মধ্যে অধিকার ও ক্ষমতার দ্বন্ধ নিজেদের ক্রমোন্নতির পর্যায়সমূহ অতিক্রম করে এক সিদ্ধান্তকর স্তরে প্রবেশ করেছিল, তাই গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে বলিষ্টতা দানের জন্য এবং একনায়কতন্ত্রী রাজত্বের সর্বশেষ আঘাত হানার জন্য সামাজিক চুক্তির আবারও একটি নতুন ব্যাখ্যা প্রদানের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। তাই রুশো তার যুগের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা এবং নতুন দাবীসমূহ সামনে রেখে বিশ্ব পরিস্থিতির বড়ই আকর্ষণীয় দৃশ্য তুলে ধরলেন এবং সামাজিক চুক্তির এমন ব্যাখ্যা দিলেন যা সর্বময় ক্ষমতার রাজমুকুট রাজার মাথা হতে তুলে নিয়ে জনগণের মাথায় স্থাপন করে।
সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারীর প্রশ্নটি যেহেতু রাষ্ট্র ও নাগরিকদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং তাদের অধিকার ও কর্তব্যসমূহের নির্ণয়ের সাথে সম্পর্কিত তাই হবল, লক এবং রুশো ছাড়াও অপরাপর সকল রাজনৈতিক চিন্তাবিদ, আইনবিদগণও এ সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। তাদের মধ্যে Grotius, Bodin, Austin, Bentham, Laski, T.H. Green এবং Dicey বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের সকলের সম্মিলিত চিন্তার ফলাফলের পর্যালোচনা করতে গিয়ে প্রফেসার ইলিয়াস আহমেদ বলেনঃ “রাজনৈতিক দর্শনে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বকে দ্বারে দ্বারে হুমড়ি খেতে দেখা যাচ্ছে। কখনও তা এক ব্যক্তি হতে মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয় এবং কখনও অসংখ্য ব্যক্তির হাতে, কখনও ব্যক্তির হাত হতে সমাজের হাতে, কখনও সংখ্যাগুরুদের কাছ হতে সংখ্যালঘুদের কাছে, কখনও সংখ্যালঘুদের কাছ হতে সংখ্যাগুরুদের কাছে, কখনও প্রশাসন হতে আইন পরিষদের কাছে, কখনও আইন পরিষদ হতে বিচার বিভাগের কাছে এবং অবশেষে সমাজের নিকট হতে পুনরায় রাষ্ট্রের অখন্ড দর্শনের দিকে।” (ইলিয়াস আহমাদ, Sovereignty-Islamic & Modern, The Allies Book Corporation, Karachi)।
প্রাকৃতিক অধিকার মতবাদ থেকে নিয়ে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের এই আলোচনা পর্য্ন্ত অধ্যয়ন করলে যে সত্য প্রতিভাত হয় তা এই যে, পাশ্চাত্যের সমস্ত কাজ ধারণা অনুমান এবং তার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত মতবাদের সহায়তায় চলছে। পাশ্চাত্যে যেহেতু মানুষের যথার্থ মূল্যায়ন ও মর্যাদা সম্পর্কে কোনো পরিষ্কার ধারণা বিদ্যমান নেই, তাই তার জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্ত মৌলিক বিষয়ে চিন্তাগত জটিলতা লক্ষ্য করা যায়। অন্যান্য বিষয়ের মত মৌলিক অধিকারসমূহ নির্ধারণের বিষয়টিও ঐ ত্রুটিপূর্ণ চিন্তাদর্শনের শিকার।
পাশ্চাত্য অধিকারসমূহ কোনো স্থায়ী মূল্য ও মর্যাদার বাহক নয়। তাদের কোনো স্থায়ী ও বিশ্বজনীন উৎস ও মানদন্ড ও নাই। সমস্ত উৎস হয় কাল্পনিক, অন্যায় আটকাদেশ আইন, ম্যাগনাকার্টা, অধিকার বিল, ফ্রান্সের মানবাধিকার সনদ এবং আমেরিকার আইনের দশটি সংশোধনীর মত দলীলের বান্ডিল, যার ধরন আঞ্চলিক এবং যা বৃটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকার বিশেষ রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার সৃষ্টি। এখানে মৌলিক অধিকারের ধারণা মানব চেতনার ক্রমোন্নতির সাথে সাথে উত্থিত হয় এবং এসব অধিকার জনসাধারণ ও বাদশাহ বা শাসকদের মধ্যে ক্ষমতা বন্টনের দীর্ঘ সংঘাতকালে অস্তিত্ব লাভকারী চুক্তিসমূহ, পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তসমূহ, ঘোষণাপত্র এবং রাজনৈতিক চিন্তাবিদগণের পেশকৃত মতবাদের পেট থেকে একে একে জন্ম নিয়েছে। এই সংঘাত যতই ভয়ংকর হতে থাকে অধিকারের পরিসরও ততই প্রশস্ত হতে থাকে। আজ যেগুলোকে মৌলিক অধিকার বলা হচ্ছে তা গতকাল পর্য্ন্ত মৌলিক অধিকার ছিলনা, আর যদিই বা ছিল তবে একটি আকাংখার পর্যায়ে ছিল, যার পেছনে কোনো বলবৎকারী শক্তি ছিলনা। এসব অধিকার তখনই অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে যখন দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধান তা মেনে নিয়েছে বৈধতার সনদ সরবরাহ করে।
এখন অধিকারের পাশ্চাত্য ধারণার আরেকটি দিক মূল্যায়ন করে দেখা যাক। পাশ্চাত্যবাসীরা যদিও নিজেদেরকে গোটা মানবজাতির জন্য পতাকাবাহী মনে করে কিন্তু তাদের কার্য্কলাপ এর বিপরীত। তাদের অধিকারের ধারণা তাদের জাতীয়তাবাদী মতবাদ ও গোত্রীয় স্বাতন্ত্র্যের উপর ভিত্তিশীল। তারা নিজস্ব সম্প্রদায় বা শ্বেতাঙ্গদের জন্য যেসব মৌলিক অধিকারের গ্যারান্টি চায়, অপরাপর সম্প্রদায় ও গোত্রকে সেসব অধিকারের হকদার মনে করেনা। ফ্রান্সের মানবাধিকার সনদকে যখন ১৯৭১ সালের আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয় তখন সাথে সাথে একথাও পরিষ্কার বলে দেয়া হয় যে, “যদিও উপনিবেশগুলো এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকায় ফ্রান্সের অধিকারভুক্ত দেশগুলো ফরাসী রাষ্ট্রের একটি অংশ কিন্তু এই আইন তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবেনা।”(Vyshinsky, Andrie Y., The Law of the Soviet State, The Macmillan Co., New York 1948, P. 555)।
এ থেকে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, যে সনদকে মানবাধিকার সনদ বলা হচ্ছে তা মূলত ফরাসী জনগণের অধিকারের সনদ। অপর কোনো জাতির এমনকি স্বয়ং ফরাসী দখলভুক্ত দেশসমূহের অধিবাসী অফরাসী জনগণের এসব অধিকার দাবীর কোনো সুযোগ নেই। অতএব রুশোর স্বদেশীরা আলজেরিয়া, ভিয়েতনাম ও অন্যান্য দখলীকৃত এলাকায় এসব অধিকার দাবীকারী জনগণের সাথে যেরূপ পাষন্ডের মত বর্বর আচরণ করছে তা বর্তমান কালের ইতিহাসের এক কৃষ্ঞতম অধ্যায় হয়ে আছে।
বৃটেনেরও এই একই অবস্থা। তার অলিখিত সংবিধানে বৃটিশ জনগণের যে সকল অধিকার স্বীকৃত তা ইংরেজ মনিবগণ নিজেদের উপনিবেশসমূহে স্বয়ং তাদেরই রচিত বিধানে অন্তর্ভুক্ত হতে দেয়নি। তাদের ম্যাগনাকারটা, তাদের অন্যায় আটকাদেশ বিরোধী আইন এবং তাদের অধিকার আইন ছিল তাদের জন্য সীমিত। অতএব তাদের ঐগুলোকেও মানবাধিকারের সনদ হিসেবে স্বীকার করাটা সম্পূর্ণ ভুল। এসব দলীলের মাধ্যমে প্রাপ্তব্য অধিকার শুধু বৃটেনের নাগরিকদের পর্য্ন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। অন্য কোনো জাতি স্বয়ং বৃটিশ শাসকগোষ্ঠীর নিকট এসব অধিকার দাবী করলে তাকে বিদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতক সাব্যস্ত করে জুলুম-নির্যাতন ও বর্বরতার শিকারে পরিণত করা হয়েছে। আজও দক্ষিণ আফ্রিকার কালো চামড়ার অধিবাসী এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের শাসিত সাদা চামড়ার অধিবাসীদের সাথে যে আচরণ করা হচ্ছে তা মানবাধিকার সম্পর্কে ইংরেজদের দ্বিমুখীপনার জ্বলন্ত প্রমাণ।
১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ যখন বর্ণবৈষম্যকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ সাব্যস্ত করার জন্য একটি প্রস্তাব অনুমোদন করে তখন তার চারজন বিরোধীর মধ্যে আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পর্তুগালের সাথে বৃটেনও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
আমেরিকার অবস্থা বৃটেন ও ফ্রান্স হতে ভিন্নতর নয়। আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক গোষ্ঠী ঐ মহাদেশের মূল বাসিন্দা রেড ইন্ডিয়ানদের গোটা সম্প্রদায়কেই দুনিয়ার বুক হতে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। নিজেদের নতুন বিশ্ব গড়ার ও তার উন্নতি সাধনের জন্য তারা আফ্রিকা মহাদেশের কৃষাঙ্গ অধিবাসীদের পশুর মত ধরে নিয়ে নিজেদের দাসে পরিণত করে এবং জাহাজ বোঝাই করে আমেরিকায় নিয়ে যায়। এসব গোলাম যথারীতি ক্রয় বিক্রয় হতো। আফ্রিকার যে উপকূল হতে তাদের জাহাজ বোঝাই করা হতো তার নামই হয়ে গেছে দাস উপকূল(Slave Coast)। এই আমদানীকৃত গোলামদের যে বংশধর এখনো অবশিষ্ট রয়ে গেছে তারা আজ পর্য্ন্ত সমান অধিকার লাভ করতে পারেনি। তারা যখনই আমেরিকার সংবিধানে প্রদত্ত ‘মানবাধিকার’ এর উল্লেখপূর্বক নিজেদের জন্য এসব অধিকার কার্য্কর করার দাবী জানিয়েছে তখনই তাদের অত্যন্ত নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে। এই বাস্তব চিত্র সম্পর্কে রবার্ট ডেবির ভৎসর্ণাপূর্ণ বাক্য লক্ষ্যণীয়ঃ “পাঁচ লাখ গোলাম এবং হাজার হাজার আমদানীকৃত শ্বেতাঙ্গ সেবকদের কলোনীতে বসে গোলামদের এক ধনবাদ মনিব টমাস জেফারসন কত বাহাড়ম্বর সহকারে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণার স্মৃতিচারণ করেছেন।”(R.E. Dewey, Freedom, P. 347)।
এই অভ্যন্তরীণ বর্ণবৈষম্যের কথা বাদ দিয়ে এখন বহির্বিশ্বে আমেরিকার ভূমিকার মূল্যায়ন করলে আরও ভয়ঙ্কর দৃশ্য সামনে আসে। হিরোশিমা, নাগাসাকি, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সর্বত্র আমেরিকার হাতে ‘মৌলিক মানবাধিকার’ পদদলিত করার হৃদয়বিদারক কাহিনীর বর্ণনা আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে।
এখন পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের চতূর্থ পতাকাবাহী কম্যুনিস্ট রাশিয়ার ভূমিকার প্রতি দৃষ্টিপাত করা যাক। এটা সেই সমাজতন্ত্রের দোলনা-মার্কিন ও বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও যেকোনো প্রকারের আধিপত্যবাদ হতে মুক্তিদানের পতাকা নিয়ে যার উত্থান হয়েছিল এবং যা মানবজাতিকে নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি ও প্রকৃত স্বাধীনতার সুখ আস্বাদন করানোর তরী বসিয়েছিল। প্রথম বারের মত সে যখন ক্ষমতাসীন হওয়ার সুযোগ পেল তখন তার রঙিন ঊষা পৌনে দুই কোটি মানুষের লাশের সুউচ্চ পাহাড়ের পর্দা ভেদ করে উদিত হল এবং তার আলোকরশ্মি পূর্ব ও পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়লে হাঙ্গেরী, পূর্ব জার্মানী, পোল্যান্ড, চেকোশ্লাভাকিয়া, দখলকৃত তুর্কিস্থান এবং সেসব এলাকায় রক্তের নদী প্রবাহিত হল যেখানে কমিউনিজম অনুপ্রবেশের সুযোগ পেল। রুশ সমাজতান্ত্রিক ও দার্শনিক প্রফেসর পিটিরিমি সরনিক রুশ বিপ্লবে মানুষের জীবননাশের বিস্তারিত বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেনঃ
“১৯১৮-২২ সালের বিপ্লবে সরাসরি সংঘর্ষে প্রায় ৬ লাখ লোক প্রাণ হারায়। প্রতি বছর গড়ে লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়। গৃহযুদ্ধে নিহত ও পরোক্ষ আক্রমণে নিহতদের যোগ করা হলে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় এক কোটি পঞ্চাশ লাখ হতে এক কোটি সত্তর লাখ।” (Soronik Pitirim A, The Crisis of Our Age, E.P. Duttan & Co., New York 1951, p. 229)।
লাল বিপ্লবের খুনী চেহারা দেখে যেসব লোক জীবন বাঁচানোর জন্য দেশ হতে পলায়ন করে তাদের যথারীতি সত্যিকার সংখ্যা বিশ লাখ।(Encyclo Britannica, 15th Ed., Vol 16, P. 71)।
এসব ঘটনা হতে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, পাশ্চাত্য দেশসমূহের অধিকারের ধারণা মানবীয় নয়, বরং গোত্রীয়, আঞ্চলিক, জাতীয়তাবাদী ও তাত্ত্বিক গোঁড়ামীর দোষে দুষ্ট। তারা নিজেদের জন্য যেসব অধিকার অত্যাবশ্যকীয় বলে মনে করে তাকে অন্যদের পর্য্ন্ত বিস্তারিত করাতো দূরে কথা-অন্যরা যাতে এসব অধিকার অর্জন করতে না পারে তার যথাসাধ্য চেষ্টা করে।