মুসলমানদের বিশেষ অধিকার
এ পর্যন্ত আমরা যেসব মৌলিক অধিকারের কথা আলোচনা করেছি জাতি- ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। এবার আমরা এমন কতগুলো অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করব যা কেবল মুসলমানদের বেলায় প্রযোজ্য। এই বিশেষত্বের কারণসমূহের উপরে আমরা ‘ইসলামে মৌলিক অধিকারের ধারণা’ শীর্ষক অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
ইসলাম আমাদেরকে মৌলিক অধিকারের যে ধারণা দিয়েছে সেই অনুসারে ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলমানদের জন্য কুরআন সুন্নাহর আলোকে নির্ধারিত অধিকারসমূহ মৌলিক হিসাবে গণ্য হবে। এই গুলোর মধ্যে উত্তরাধিকার, মালিকানা, ভরণপোষন, মোহর, বিবাহ, তালাক, খোলা, ক্রয় বিক্রয়, ব্যবসা বাণিজ্য এবং জীবনের সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য বিষয়াদি এর অন্তর্ভূক্ত-যা স্থায়ীভাবে ইসলামী শরীআত নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং যে গুলো আইন প্রণয়ন করে কোনক্রমেই সংশোধন ও রহিতকরণ করা যায় না।
এই অধিকার সমূহ ব্যতিরেকে ইসলামী রাষ্ট্রে যেখানে নাগরিক হিসাবে সবাই সমমর্যাদার অধিকারী সেখানে রাজনৈতিক অধিকারের (পলিটিক্যাল রাইটস) বেলায় মুসলিম-অমুসলিমের মধ্যে পার্থক্য কায়েম করা যাবে। যেহেতু অমুসলিমরা কুরআন সুন্নাহর উপর ঈমান রাখে না তাই তারা সেসব নীতিমালার ভিত্তিতে প্রভুভক্তির মৌলিক শর্তাবলী পূরণ করতে পারে না যার উপর রাষ্ট্রের গোটা প্রশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত। তদুপরি তারা এই নীতিমালার ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য মুসলমানদের ন্যায় সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকট প্রতিশ্রুতিবদ্ধও নয়। এই কারণেই ইসলাম সরাসরি তাদেরকে রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণ পদে এবং এমন সব জনগুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য যোগ্য বিবেচনা করেনি যেগুলোর সম্পর্ক রয়েছে নীতি নির্ধারণের কৌশলের সাথে। অবশ্য তারা এই পলিসিগুলোর বাস্তবায়নের দায়িত্বশীল কার্যক্রমে উচ্চপদে সমাসীন হতে পারবে। এই পর্যায়ে প্রখ্যাত মুসলিম রাষ্ট্রতত্ত্ববিধ আল মাওয়ারদী যিম্মীদের অবস্থান ও মর্যাদা সম্পর্কে লিখেছেন: ‘একজন যিম্মী (ওযীরে তানফীয) তথ্যমন্ত্রী হতে পারে, কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হতে পারে না। উভয় পদের এখতিয়ার সমূহের মধ্যে যেরূপ পার্থক্য আছে অনুরূপ উভয়ের শর্তাবলীতেও তারতম্য রয়েছে। নিম্নলিখিত চারটি বিষয়ে এই পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়।
১. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই বিধান জারী করতে পারেন এবং ফৌজদারী মামলার মীমাংসা করতে পারেন। এই ক্ষমতা তথ্য মন্ত্রীর নেই।
২. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ করতে পারেন, কিন্তু তথ্যমন্ত্রীর এই অধিকার নেই।
৩. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সমস্ত সামরিক ও যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা নিজেই করতে পারেন। তথ্য মন্ত্রীর এই অধিকার নেই।
৪. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরকারী কোষাগারের উপর এখতিয়ার আছে। তিনি সরকারের দাবীকৃত ট্যাক্স আদায় করতে পারেন এবং সরকারের অপরিহার্য দেয় পরিশোধ করতে পারেন। এই অধিকারও তথ্য মন্ত্রীর নেই।
এই শর্ত চতুষ্টয় ব্যতীত এমন কোন বিষয় নেই যা একজন যিম্মীর এই পদে অধিষ্টিত হওয়ার পথে প্রতিবন্ধক হতে পারে। ( আহকামুস সুলতানিয়া, পৃ.১০৫)।
ডক্টর হাসান ইবরাহীম হাসান মিসরীও আল মাওয়ারদীর সাথে একমত হয়ে লিখেন: “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা প্রধান মন্ত্রীত্বের পদের জন্য ‘নেতৃত্বের শর্তাবলী’ অপরিহার্য ( ড. হাসান ইবরাহীম হাসান, মুসলমানু কা নাযমে মুমালিকাত, উর্দু অনু. মুহাম্মাদ আলীমুল্লাহ সিদ্দীকী, দিল্লী ১৯৪৭ খৃ. ১৫৭)।
ইমাম ইবনে তায়মিয়া, নিযামুল মুলক তুসী এবং অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণও সর্বসম্মতিক্রমে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এই নীতির অধীনে ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলমানগণ নিম্ন লিখিত অধিকার সমূহ ভোগ করবে:
১. রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই মুসলমান হতে হবে।
২. মুসলমানদের ভোটেই তারা নির্বাচিত হবেন। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণও মুসলমানদের মধ্যেই সীমিত থাকবে।
৩. যেহেতু কুরআন মজীদে উলুল আমর ( সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ) এর সাথে ‘মিনকুম’ (তোমাদের মধ্য হতে) এর শর্ত আরোপ করা হয়েছে তাই সমস্ত দায়িত্বপূর্ণ পদ মুসলমানদের জন্যই নির্দিষ্ট থাকবে। তাহলে তারা কুরআন -সুন্নাহ মোতাবেক তাদের নীতি ও পলিসি নির্ধারণ করতে পারবে এবং আদেশদাতা হওয়ার কারণে সেগুলো মুসলমানদের সহযোগিতার মাধ্যমে কার্যকর করতে পারবে। এই নীতির অধীনে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি, আইন বিষয়ক মন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী (জাতীয় কোষাগারের ব্যবস্থাপক) এবং এই ধরণের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে মুসলমানদেরই নিয়োগ করতে হবে।
৪. কুরআন মজীদ যেহেতু ‘শুরা’র ক্ষেত্রে ‘বাইনাহুম’ (তাদের মধ্যে) শর্ত আরোপ করেছে
( আরবী***)
অর্থ: “তাদের সমস্ত কার্যকলাপ পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে নিষ্পন্ন হয়), তাই মজলিসে শূরা (পরামর্শ সভা) কিংবা জাতীয় সংসদের সাধারণ সদস্যবর্গকেও মুসলমানদের মধ্য থেকে নির্বাচন করতে হবে। এই সংসদ রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ও গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারক প্রতিষ্ঠান, সেখানে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সমস্ত বিষয়াদি মীমাংসিত হবে। তাই এখানে পরামর্শ দানের দাবী কেবল সেইসব লোকই পূরণ করতে পারে যারা শুধুমাত্র কুরআন-সুন্নাহর উপর ঈমানই রাখে না, বরং কুরআন- সুন্নাহর গভীর জ্ঞানে সমৃদ্ধ এবং কুরআন ও সুন্নাহর রেফারেন্স দিয়ে সমস্যাবলীর সমাধান পেশের বেলায় পরিপূর্ণ যোগ্যতার অধিকারী। এই অধিকার সমূহ ব্যতীত এমন আর কোন অধিকার নেই, যেখানে মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে কোন পার্থক্য করা বৈধ হতে পারে।
যিম্মীদের বিশেষ অধিকার
যিম্মীদের অধিকারসমূহ সম্পর্কে সর্বপ্রথম এই বিষয়টি পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন যে, ইসলামী রাষ্ট্র যেভাবে মুসলমানদের বেলায় কুরআন ও সুন্নাহ কর্তৃক নির্ধারিত অধিকার সমূহের প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে বাধ্য তেমনিভাবে যে যিম্মীদের ব্যাপারেও কুরআন -সুন্নাহর প্রতিষ্ঠিত সীমারেখার অনুসরণ করতে বাধ্য। অর্থাৎ যিম্মীদের অধিকারও অবিচ্ছেদ্য। এগুলো সংশোধন বা বাতিল করার অধিকার মুসলমানদের নেই।
ইসলামী রাষ্ট্র শরীআত নির্ধারিত অধিকার সমূহ হ্রাস করতে পারে না, তবে সে যিম্মীদের আরও অধিকার দিতে পারে, তবে শর্ত হচ্ছে তা যেন ইসলামী নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক না হয়। এর অর্থ এই যে, ইসলামী রাষ্ট্রে অধিকার নির্ধারণ এবং তা সংরক্ষণের দিক থেকে মুসলমানদের ও যিম্মীদের মর্যাদা সমান। উভয়ের অধিকারের গ্যারান্টি দিয়েছে কুরআন-সুন্নাহ। নিজেদের অধিকারের প্রশ্নে যে আইনগত ও বিচার বিভাগীয় নিরাপত্তা মুসলমানদের জন্য বিদ্যমান যিম্মীরাও সেই নিরাপত্তার অধিকারী, বরং যিম্মীদেরকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দানের ক্ষেত্রে মুসলমানদের উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র সময়ের দাবী ও প্রয়োজনের তাগিদে মুসলমানদের উপর অতিরিক্ত কর ধার্য করতে পারে, তাদের সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু সে চুক্তিবদ্ধ যিম্মীদের উপর চুক্তির শর্তাবলীর অতিরিক্ত কোন বোঝা চাপাতে পারে না। ইসলামী রাষ্ট্র যদি মুসলমানদের জান মালের নিরাপত্তা বিধানে অপারগ হয় এবং বৈদেশিক হামলার সময় তার কার্যকর প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করতে না পারে তাহলে সে মুসলমানদের থেকে আদায়কৃত কর ফেরতদানে বাধ্য থাকবে না। কিন্তু এরূপ অবস্থায় তাকে (ইসলামী রাষ্ট্রকে) যিম্মীদের কাছ থেকে জিযয়া বাবদ আদায়কৃত অর্থ ফেরত দিতেই হবে। যেমন ইয়ারমুকের যুদ্ধের সময় হযরত আবু উবায়দা রা: হিমস ও দামিশক ইত্যাদি এলাকার যিম্মীদেরকে তাদের দেওয়া জিযয়ার অর্থ তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানে অপারগতার ক্ষেত্রে ফেরত দিয়েছিলেন। ইসলামী আইন যিম্মীদেরকে তাদের মর্যাদা অনুসারে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছে।
১. চুক্তিবদ্ধ যিম্মী: যে সকল লোক কোন যুদ্ধ ব্যতিরেকে অথবা যুদ্ধ চলাকালে যিম্মী (আশ্রিত) হিসাবে বসবাস করতে সম্মত হয় এবং সন্ধিবদ্ধ অথবা চুক্তিবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে এসে যায়।
২. পরাজিত গোষ্ঠী: যারা শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করেছে এবং মুসলমানদের হাতে পরাজিত হয়েছে এবং যাদের উপর এখন ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ইসলামী আইন শাস্ত্রের পরিভাষায় এদেরকে ‘আহলুল আনাওয়া’ বলা হয়।
৩. যেসব লোক যুদ্ধ কিংবা সন্ধি ব্যতীত অন্য কোনভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েছে। যেমন উপমহাদেশের বিভক্তির ভিত্তিতে যেসব অমুসলিম নাগরিক পাকিস্তানের সীমানার আওতায় পড়েছে।
চুক্তিবদ্ধ যিম্মীদের সম্পর্কে শরীআতের মৌলিক বিধান এই যে, তাদের সাথে চুক্তির শর্তাবলী মাফিক আচরণ করতে হবে এবং যেসব শর্ত স্থির হয়েছে তা কঠোরভাবে পালন করতে হবে। সরকার পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও এই শর্তাবলী অপরিবর্তিত থাকবে। তাদের মর্যাদা স্থায়ী হবে। তবে হাঁ, যদি চুক্তিবদ্ধ যিম্মীগণ কোন প্রকার সংশোধন বা সংযোজন করতে চায় এবং তা পারষ্পরিক সম্মতিতে মীমাংসিত হয়, তবে ভিন্ন কথা। এই চুক্তিতে ইচ্ছামত পরিবর্তন করার এখতিয়ার কোন অবস্থাতেই ইসলামী রাষ্ট্রের নেই এবং একে একতরফাভাবে রহিত করা কিংবা বলপূর্বক যিম্মীদেরকে কিছু নতুন শর্তাবলী গ্রহণে বাধ্য করারও এখতিয়ার নেই। মহানবী সা: ইরশাদ করেন:
“সাবধান! যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ মানুষের উপর যুলুম করবে কিংবা তার অধিকার খর্ব করবে অথবা তার সাধ্যের বাইরে তার উপর বোঝা চাপাবে কিংবা তার অসম্মতিতে তার থেকে কোন জিনিস আদায় করবে-তার বিরুদ্ধে আমি নিজেই কিয়ামতের দিন দাবী উত্থাপন করব” ( আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ)।
অনুরুপভাবে অন্য এক হাদীসে মহানবী সা: বলেন: “তোমরা যদি কোন জাতির বিরুদ্ধে লড়াই করে তার উপর বিজয়ী হও আর সে জাতি তাদের নিজেদের ও ভবিষ্যত বংশধরদের প্রাণ রক্ষার জন্য তোমাদের খারাজ (কর) দিতে সম্মত হয় (অন্য হাদীসে আছে তোমাদের সাথে সোলেহনামা করে নেয়) তাহলে পরবর্তীতে নির্ধারিত খারাজের চাইতে একটি শস্য কণাও বেশি গ্রহণ করবে না। কেননা তোমাদের জন্য তা জায়েয হবে না” ( আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ)।
কাযী আবু ইউসুফ রহ: এই প্রসঙ্গে ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন: “তাদের নিকট থেকে সেই পরিমাণই গ্রহণ করা যাবে সন্ধি করার সময় যে পরিমাণের চুক্তি হয়েছিল এবং এর অতিরিক্ত কিছুই ধার্য করা যাবে না” (মওদুদী, ইসলামী রিয়াসাত, পৃ. ৫৭৮, কিতাবুল খারাজের বরাতে)।
পরাজিতরা ইসলামী রাষ্ট্রে নিম্নলিখিত অধিকার সমূহ ভোগ করতে পারবে:
১. জিযয়া প্রদানে সম্মত হওয়ার সাথে সাথে ইসলামী সরকারের উপর সব সময়ের জন্য চুক্তি রক্ষার দায়িত্বভার অর্পিত হবে এবং যিম্মীদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা মুসলমানদের উপর ফরয হয়ে যায়। তাদের সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা যাবে না এবং তাদেরকে দাসও বানানো যাবে না।
২. যিম্মীরা তাদের সম্পত্তি মালিকানা স্বত্বের ভিত্তিতে ইচ্ছামত ব্যবহার করতে পারবে। তাদের সম্পদ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে হস্তান্তর করতে পারবে। তারা নিজেদের মালামাল বেচাকেনা, হেবা (দান), বন্ধক ইত্যাদি সমস্ত অধিকার ভোগ করবে। ইসলামী রাষ্ট্র তাদেরকে উচ্ছেদ করতে পারে না।
৩. যিম্মীদের সামর্থের উপর ভিত্তি করে জিযয়া ধার্য করতে হবে। অর্থাত বিত্তবানদের উপর বেশি, মধ্যবিত্তেদের উপর তা চেয়ে কম এবং নিম্নবিত্তদের উপর আরও কম। যারা উপার্জনে অক্ষম এবং অন্যদের আশ্রয়ে জীবন যাপন করে তাদের জিযয়া মওকুফ করা হবে।
৪. কেবলমাত্র যুদ্ধক্ষম লোকদের উপর জিযয়া ধার্য করা হবে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অক্ষম, ধর্মযাজক, উপাসনালয়ের কর্মচারী, স্থায়ী রুগ্ন ব্যক্তি এবং দাসদের নিকট থেকে জিযয়া নেওয়া যাবে না।
৫. যিম্মীদের উপাসনালয়গুলো পূর্বাবস্থায় বহাল রাখা হবে। হযরত উমার রা:-র খিলাফত কালে কোন বিজিত অঞ্চলের কোন গির্জা বা মন্দির ধ্বংস করা হয়নি। কাযী আবু ইউসুফ রহ: লিখেছেন: “তাদেরকে তাদের স্বঅবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তা না ধ্বংস করা হয়েছে এবং না এগুলোর উপর কোন প্রকার আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে” (কিতাবুল খারাজ, পৃ. ৪১৭)
রসূলে করীম সা: ও খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে মুসলমানরা সরাসরি যিম্মীদের সাথে সম্পাদিত সমস্ত চুক্তিতে তাদের উপাসনালয়গুলোর রক্ষণাবেক্ষণের গ্যারান্টি দান করেন। পরবর্তী শাসকবর্গও এই নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করেন।
চুক্তিবদ্ধ যিম্মী ও পরাজিত যিম্মীদের এই বিশেষ অধিকার ছাড়া ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী তিন শ্রেণীর যিম্মীই নিম্নোক্ত অধিকারসমূহ ভোগ করতে পারবে:
১. ইসলামী ফৌজদারী আইন তো এমনিতেই মুসলমান ও যিম্মীদের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু মদ্যপানের ব্যাপারে যিম্মীরা এর ব্যতিক্রম। ইমাম মালিকের মাযহাব অনুসারে তারা ব্যভিচারের বেলায়ও ব্যতিক্রম। তিনি হযরত উমার রা: ও হযরত আলী রা:-র নিম্নোক্ত মীমাংসা প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করেছেন যে, তাদের মতে যিম্মী ব্যভিচার করলে তাকে তাদের সমাজে অর্পণ করতে হবে।
২. দেওয়ানী আইনও মুসলমান ও যিম্মীদের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। সম্পদের উপর অধিকার ও বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোন তফাত নেই। ব্যবসা বাণিজ্যের যেসব পন্থা মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ সেগুলো তাদের ক্ষেত্রেও নিষিদ্ধ। সূদী কারবার যেমনিভাবে মুসলমানদের জন্য হারাম তেমনিভাবে তা যিম্মীদের জন্য হারাম। অবশ্য মদ্যপান ও শূকর এর ব্যতিক্রম। যিম্মীরা মদ তৈরী করতে, পান করতে এবং নিজেদের মধ্যে ক্রয় বিক্রয় করতে পারবে। তারা শুকর পালন করতে, ভক্ষণ করতে এবং নিজেদের মধ্যে ক্রয় বিক্রয় করতে পারবে। যদি কোন মুসলমান কোন যিম্মীর মদ কিংবা শুকর নষ্ট করে তাহলে তাকে অবশ্যই জরিমানা দিতে হবে।
৩. চুক্তির বন্ধন (আকদুল যিম্মাহ) রক্ষা করা মুসলমানদের উপর স্থায়ী কর্তব্য। অর্থাত সে একবার চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর তা কখনও ভঙ্গ করতে পারে না। কিন্তু যিম্মীরা ইচ্ছা করলে চুক্তি ভঙ্গ করতে পারবে। যিম্মী যত বড় অপরাধই করুক না কেন মুসলমানদের চুক্তি রক্ষার বাধ্যবাধকতা বাতিল হবে না। এমনকি যিম্মীরা জিযয়া দিতে অস্বীকার করলে মুসলমান হত্যা করলে, নবী করীম সা: সম্পর্কে অসৌজন্যমূলক কথা বললে, মুসলমান নারীর হানহানি করলেও যিম্মা (দায়িত্ব) বলবৎ থাকবে। তারা উপরোক্ত অপরাধের আইনানুগ শাস্তি ভোগ করবে, কিন্তু যিম্মা (নিরাপত্তার গ্যারান্টি) থেকে বহিস্কৃত হবে না। শত্রুদের সাথে যোগসাজশ করলে এবং প্রকাশ্য বিদ্রোহ করে বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে এই দুই অবস্থায়ই যিম্মীচুক্তি রহিত হয়ে যাবে (মওদুদী, ইসলামী রিয়াসাত, পৃ. ৫৮৬)।
৪. যিম্মীদের ব্যক্তিগত ব্যাপারসমূহ তাদের নিজস্ব ‘ব্যক্তিগত আইন’ অনুসারে নিস্পত্তি হবে। যেমন তাদের মধ্যে যদি সাক্ষী ব্যতিরেকে বিবাহ, মোহর ব্যতিরেকে বিবাহ, ইদ্দত চলাকালে দ্বিতীয় বিবাহ, কিংবা মুহরিম মহিলাদের বিবাহ করা জাযেয থাকে তবে তা জায়েযই বিবেচিত হবে।
হযরত উমার ইবনে আবদুল আযীয রহ: এর একটি ফতোয়া প্রার্থনার জবাবে হাসান বসরী রহ: তাকে নিম্নোক্ত ফতোফা দিয়েছিলেন:
“তারা (যিম্মীরা) তো জিযয়া প্রদানের বিষয়টি এ জন্য কবুল করেছে যে, এর বিনিময়ে তাদের ধর্মবিশ্বাস মতে তাদেরকে জীবন যাপনের স্বাধীনতা দেওয়া হবে। আপনার কাজ তো পূর্ববর্তী নিয়ম অনুকরণ করা, কোন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা নয়” ( ঐ, পৃ. ৫৮৭)।
৫. যিম্মীরা তাদের নিজস্ব মহল্লা ও বসতিতে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি ও জাতীয় উৎসবাদি পালন করার ব্যাপারে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। তবে মুসলমানদের মহল্লায় প্রকাশ্যভাবে তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করার অনুমতি দেওয়া যাবে না। অবশ্য তাদের উপাসনালয়ে সব সময়েই পূজা পার্বণ ও অন্যান্য অনুষ্ঠানাদি পালনের ক্ষেত্রে তাদের এখতিয়ার দেওয়া হবে। সরকার এতে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
মুসলমানদের শহরসমূহে (ঐসব স্থান সমূহ যার ভূমি মুসলমানদের মালিকানাধীন এবং যেগুলোকে মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনের জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছে) যিম্মীদের প্রাচীন ইবাদতখানার ব্যাপারে মুসলমানরা কোন বিরোধ করতে পারবে না। যদি সেগুলো ভেংগে গিয়ে থাকে তাহলে যিম্মীরা তা নতুন করে নির্মাণের অধিকার পাবে। যে সব স্থান মুসলমানদের শহর নয় সেখানে তারা নতুন উপাসনাগৃহ নির্মাণের অনুমতি পাবে।
৬. যিম্মীরা নিজেদের ছেলে-মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ প্রতিষ্ঠা করার এবং নিজেদের মধ্যে স্ব-স্ব ধর্মের প্রচার করার পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। তারা তাদের ধর্মের সৌন্দর্য বর্ণনা করার ক্ষেত্রেও পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। অবশ্য তাদেরকে ইসলামের উপর বিদ্রোহাত্মক আক্রমণের অনুমতি দেওয়া যাবে না।
যিম্মীদের ব্যাপারে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, বর্তমান যুগের ইসলামী রাষ্ট্রে তাদেরকে নেতৃত্বের পদ কিভাবে দেওয়া হবে? স্থানীয় পরিষদের প্রতিনিধিত্ব করার পূর্ণ অধিকার দেওয়া যেতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরামর্শ সভায় অর্থাত সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি একটু জটিল। এই পর্যায়ে দুইটি পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে।
১. পৃথক নির্বাচনের ভিত্তিতে যিম্মীদেরকে জনসংখ্যার হার অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু পার্লামেন্টে তারা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে আইনের অধীন থাকতে বাধ্য থাকবে। অবশ্য যেসব ক্ষেত্রে স্বয়ং কুরআন -সুন্নাহ তাদেরকে কর্মের স্বাধীনতা প্রদান করেছে সে সম্পর্কিত বিষয়ে আইন প্রণয়ণে তারা নিশ্চতিই স্বাধীন মতামত পেশ করতে পারবে।
২. যিম্মীদের জন্য একটা পৃথক প্রতিনিধিত্বমুলক প্রতিষ্ঠান গঠন করা যেতে পারে, যেখানে তারা তাদের নিজস্ব বিসয়সমূহ নিজেদের অভিমত অনুসারে সমাধান করতে পারবে এবং সরকার তাদের সুপারিশমালা যথার্থভাবে কার্যকর করতে সহায়তা করবে। তারা তাদের নিজস্ব ব্যাপারে আইন তৈরী করতে পারবে অথবা প্রচলিত আইন কানুনে সংশোধন ও পরিমার্জনের অধিকারী হবে এবং তাদের প্রস্তাবসমূহ সরাসরি সরকারের অনুমোদনক্রমে আইনে পরিণত হবে। তারা সংসদীয় কার্যকলাপ এবং আইন সভার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে নিজেদের প্রস্তাব,অভিযোগ, আপত্তি ও সুপারিশমালা স্বাধীনভাবে পেশ করতে পারবে। সরকার ন্যায়ের দাবী অনুসারে তাদের বিষয়টি সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করবে এবং অভিযোগসমূহ দূর করবে।
এই সম্বন্ধে আমাদের নিকট ধরাবাধা কোন নীতিমালা নেই। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে যে কোন সংগত পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। ইসলামের অভিপ্রায় এই যে, সে একটি জীবনদর্শন হিসাবে হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চায় তাতে অমুসলিমরাও যেন কোথাও বাধার সম্মুখীন না হয় । সে কোন স্তরেই যেন বাধাদানকারী শক্তিতে পরিণত না হয়ে যায়। ইসলাম তার সীমানায় বসবাসকারী অমুসলিমদেরকে সম্ভাব্য সব রকমের নিরাপত্তা বিধানে বদ্ধপরিকর। তাদের সাথে সৌজন্য মূলক আচরণের প্রতি জোর দেয়। মুসলমানদের চেয়ে অধিক হারে তাদের অধিকার রক্ষায় পক্ষাপাতিত্ব করার নির্দেশ দেয়। ইসলাম তাদেরকে আপন করুনার শীতল পরশে নিয়ে নেয় এবং সুযোগ সুবিধা ও প্রাচুর্যে অংশীদার বানায়, কিন্তু তার পথে প্রতিবন্ধক হওয়ার অনুমতি দেয় না। এ জন্যেই সে তাদেরকে এমন উচ্চ পদমর্যাদা থেকে পৃথক রেখেছে যার সম্পর্ক রয়েছে শরীআতের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তথা এর আলোকে পলিসি ও আইন-কানুনের রূপরেখা প্রণয়ন এবং তার প্রয়োগের জন্য নেতৃত্ব ও পথ নির্দেশনার সাথে।