ভূমিকা
১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে রুশো বলেছিলেন, “মানুষ স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেও সে আজ সর্বত্র শৃঙ্খলে বন্দী।”
এর প্রায় দুইশত বছর পর ১৯৪৭ খৃ. আমেরিকার হার্ভার্ড্ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাকলোয়েন চার্লস সমসাময়িক কালের মানুষের দুরবস্থা সম্পর্কে পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেন, “আমার মতে ইতিহাসের কোনো যুগেই কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের পক্ষ হতে এত কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়নি, প্রশাসনের সামনে বিচার বিভাগ কখনও এতটা অসহায়ত্ব বোধ করেনি, এই বিপদ অনুভব করা এবং তার প্রতিকারের ব্যবস্থা সম্পর্কে পূর্বে কখনও চিন্তা করার এতটা তীব্র প্রয়োজন দেখা দেয়নি-যতটা আজ দেখা দিয়েছে” (Mcllwain Chareles, Howard, “Constitutionalism”, Great Seal Books, New York, B 1947, P 140)।
পুনশ্চ মাত্র ২৩ বছর পর ১৯৭০ খৃ. মানুষের মৌলিক অধিকার যেসব বিপদের সম্মুখীন তার মূল্যায়ন করতে গিয়ে রবার্ট ডেবী তাঁর দুশ্চিন্তার কথা নিম্নোক্ত বাক্যে প্রকাশ করেনঃ
“প্রায় দুইশত বছর পূর্বেকার এক বৈপ্লবিক সংঘাতের কথা, যা আজকের দ্বন্দ্ব সংঘাতের চেয়ে ভিন্নতর কিছু ছিলনা, উল্লেখ করে টমাস পেইন নিজের সমসাময়িক লোকদের অন্ধ চোখগুলোকে একটি তিক্ত সত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি বলেন, “ স্বাধীনতা পৃথিবীর আনাচে কানাচে থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, এই পলাতককে ধর এবং মানবতার জন্য সময়মতো একটি আশ্রয়স্থল নির্মাণ কর। আজ হাজারো বেদনাপূর্ণ কথা, হাজারো প্রচার ও ঘোষণাপত্রের পরও স্বাধীনতা এখনও রূপকথার পাখি। আমেরিকাই হোক অথবা রাশিয়া, পর্তুগাল, এঙ্গোলা, ইংল্যান্ড, রোডেশিয়া বা বোস্টনই হোক কোথাও তার নাম নিশানাও নাই” (Deway, Robert E, Freedom, The Macmillon Company, 1970, P. 347)।
মানুষের বঞ্চনার ও ভাগ্য বিড়ম্বনার এই সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আমরা যখন মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত জাতিসংঘ কমিশনের এবং অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক প্রতিবেদনসমূহ, পত্র-পত্রিকা ও পুস্তক-পুস্তিকার সরবরাহকৃত তখ্যবালী, বিভিন্ন দেশে সংঘটিত ঘটনাবলী এবং এই বিষয়ের উপর সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করি তখন এই তিক্ত ও অনস্বীকার্য্ সত্য উত্থিত হয়ে সামনে আসে যে, ফরাসী বিপ্লব, ইংল্যান্ডের একচ্ছত্র রাজতন্ত্রের অবসান এবং সংসদীয় ব্যবস্থার প্রাধান্য, আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা, আমেরিকার সংবিধানে মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভূক্তি, ইউরোপ-আমেরিকায় মৌলিক অধিকারের পক্ষে সুশৃঙ্খল আন্দোলনসমূহ, রাশিয়ার রক্তাক্ত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র সত্ত্বেও আজকের মানুষও রুশোর যুগের মানুষের মত সর্বত্র পরাধীনতা শৃঙ্খলে আবদ্ধ এবং পূর্বে প্রফেসর ম্যাকলোয়েন মানুষের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ হতে যে বিপদের আশংকা করেছিলেন তা কেবল মারাত্মক আকারই ধারণ করেনি, বরং যতই দিন যাচ্ছে তা আরও অধিক মারাত্মক হচ্ছে। বর্তমানে পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশেরও অধিক জনবসতি সমাজতন্ত্রের একনায়কত্ববাদী ব্যবস্থার নিগড়ে বন্দী, যেখানে মানুষের মূল্য ও মর্যাদা একটি প্রাণহীন হাতুড়ি ও কাস্তের মত উৎপাদনের একটি উপাদানের চেয়ে বেশি নয়। তার নিকট হতে কথা বলার, লেখনী, বক্তৃতা, বিবৃতি, জনসমাবেশ, সংগঠন এবং মতবাদ ও বিশ্বাসের যাবতীয় স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন সে রাষ্ট্রের একজন বেতনভুক্ত কর্মচারী মাত্র এবং তার অধিকারসমূহ সংরক্ষণের জন্য আইনসভা ও বিচার বিভাগের নামে যেসব সংস্থা কায়েম করা হয়েছে তা রাষ্ট্র নামক তার প্রভুর শাসক গোষ্ঠীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। সংবাদপত্র ও সংবাদসংস্থা, রাজনৈতিক মঞ্চ, সর্বপ্রকার প্রচার মাধ্যম, সাহিত্যিক, কবি ও বুদ্ধিজীবি সবই তার মুঠোর মধ্যে। ব্যক্তি দলীয় শৃংখলের শক্ত নিগড়ে বন্দী। তার অবাধ্য হওয়ার চিন্তাটুকুই তার অস্তিত্বকে প্রকম্পিত করার জন্য যথেষ্ট। মোটকথা এই সমাজে ব্যক্তির মাথা গোঁজার কোনো আশ্রয় নেই।
এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তৃত জনবসতি নিয়ে গঠিত দেশসমূহের অবস্থা আরও হৃদয়বিদারক। এদিক থেকেও তাদের দুঃখ দুর্দশা আরও মর্মান্তিক যে, এসব দেশের জনগোষ্ঠী ঔপনিবেশিক যুগের শাসনের যাঁতাকল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এবং বিদেশী প্রভুদের গোলামীর জোয়াল নিজেদের কাঁধ থেকে নিক্ষেপ করার জন্য জানমালের সীমাহীন কোরবানি স্বীকার করে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ লাভ করেছিল, কিন্তু স্বাধীনতার সূর্য্য তখনও পূর্ণ আলোকে উদ্ভাসিত না হতেই তাদের মাথার উপর একনায়কত্বের দৈত্য চেপে বসতে লাগল এবং দেখতে দেখতে তা এক এক করে তাদের নাগরিক স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারগুলো গ্রাস করতে লাগল। লাল ও সাদা সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের এজেন্টদের মাধ্যমে তাদের ঘাড়ে চেপে বসল এবং তারা নিজেদের স্বার্থের হেফাজত ও তা আদায়ের জন্য তথাকথিত লৌহমানবদের হাত এতটা শক্তিশালী করে যে, তাদের স্টীমরোলারের চাপে সদ্যপ্রসূত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান মৃত্যুর দ্বারে পৌছে গেল। আইনের প্রয়োগ ছেলেখেলায় পরিণত হল, আইনের শাসন চিরবিদায় নিল, আইনসভা, বিচারবিভাগ, তথ্যমাধ্যম, রাজনৈতিক তৎপরতা, প্রচারমাধ্যম সবই প্রশাসনের মর্জির অনুগত হয়ে গেল। সমাজতান্ত্রিক দর্শন যেহেতু শাসকগোষ্ঠীকে সীমাহীন ক্ষমতা দান করে দেশের সবকিছুর হর্তাকর্তা বানিয়ে দেয় তাই তা এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার সমস্ত স্বাধীন দেশগুলোর ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও ক্ষমতালোভী গোষ্ঠীর মুখরোচক শ্লোগানে পরিণত হল।
তারা ভাত কাপড় বাসস্থানের ব্যবস্থা করার শ্লোগান এবং বাইরের আগ্রাসন প্রতিহতকরণ, দেশীয় শত্রুর মূলোৎপাটন, বাইরের এজেন্টদের চক্রান্ত নস্যাৎ করতে এবং পুঁজিপতি, ভূ-স্বামী ও গণদুশমনদের নিশ্চিহ্ন করার নামে একদিকে নিজেদের ক্ষমতার পরিসর বৃদ্ধি করতে থাকে এবং অপরদিকে সশস্ত্র পুলিশ, বিভিন্ন ধরনের সশস্ত্র বাহিনী, গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানসমূহ, নির্যাতনের আধুনিক সরঞ্জামাদি, কলাকৌশল ও নিজেদের প্রোপাগান্ডা প্রচারের উপায়সমূহের প্রসার ঘটাতে থাকে। তারা মৌলিক অধিকারের রক্ষাকবচ আইন পরিষদ, বিচার বিভাগ ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও নেতৃবৃন্দের শক্তি ও প্রভাব খর্ব করতে এবং আইনের গোটা কাঠামোকে বশীভূত করতে থাকে। দেশের ভাগ্যাহত জনগণকে সামরিক শাসন, জরুরী অবস্থা ঘোষণা, নিবর্তনমূলক আইন প্রবর্তন এবং আগামী দিনের রহিত, বাতিল এবং নিত্য নতুন সংশোধনের শিকার সংবিধানের শৃংখলে এমনভাবে বন্দী করে নেয়া হয়েছে যে, মৌলিক অধিকারের পরিভাষাই তাদের জন্য অর্থহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব দেশে এই নাটকীয় অভিনয়- নাটকীয় দৃশ্য ও সংলাপের আকারে বারবার অভিনীত হচ্ছে এবং এখন পর্য্নত এর যবনিকাপাত হয়নি।
বৃটেন, আমেরিকা এবং ফ্রান্সের মত কয়েকটি দেশের সীমিত জনগোষ্ঠী বাহ্যত সুখে সম্পদে আছে মনে হলেও মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে তাদের অবস্থাও ঈর্ষা করার মত নয়। এসব দেশের বুদ্ধিজীবি-সমাজ প্রশাসনের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা এবং আইন পরিষদ ও বিচার বিভাগের প্রভাব অব্যাহতভাবে ক্ষুণ্ন হওয়া সম্পর্কে গভীর উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছেন। আর. ডেবী এসব দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেনঃ
“যে স্বাধীনতা ও অধিকারকে শিল্প সমৃদ্ধ সমাজের সূচনা ও তার প্রাথমিক স্তরসমূহে গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হত এবং যেগুলো ঐ সমাজকে উন্নত স্তর পর্য্ন্ত পৌছাতে সাহায্য করেছিল –এখন তা ঐতিহ্যগত যৌক্তিকতা ও অর্থবহতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চিন্তার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও বিবেকের স্বাধীনতা- বিভিন্ন মতবাদ ও দর্শনের সমালোচনার মাধ্যমে সেগুলোর ক্রমবিকাশ ও সংরক্ষণে প্রভূত সাহায্য করে। একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত বস্তুবাদী ও তাত্ত্বিক সভ্যতাকে একটি অধিক গঠনমূলক ও যুক্তিপূর্ণ সভ্যতায় রূপান্তর করাই ছিল এই সমালোচনার উদ্দেশ্য। কিন্তু স্বাধীনভাবে ব্যক্তিগত মতবিনিময়ের পরিবর্তে ঐসব অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য যখন সংস্থাসমূহ অস্তিত্ব লাভ করে তখন গোটা সমাজের যে পরিণতি হল-ঐ স্বাধীনতা ও অধিকারেরও সেই পরিণতি হল (যা ঐ সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিল)। পরিণতিই যেন উদ্দেশ্যকে নির্বাপিত করে দিল।(ঐ ৩২২ পৃ.)।
সি.ডি. কারনিশ একই সত্যের প্রকাশ নিম্নোক্ত বাক্যে করেছেনঃ “পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের দেশগুলোর সর্বশেষ মূ্ল্যায়ণ করলে পরিষ্কার জানা যায় যে, উভয়ের মধ্যে দূর্লংঘ ব্যবধান রয়েছে, স্বাধীন ও পরাধীন দেশগুলোর নামমাত্র শ্রেণীবিভাগ বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে সমর্থন করা যায়না। উভয় ব্যবস্থার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আমলাতান্ত্রিক সৃষ্ট জটিলতা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যেতে পারে এবং সমস্ত সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর নিয়ন্ত্রণের জন্য সাধারণ শ্রমিক শ্রেণী, নির্বাক ভোক্তা ও শক্তিশালী প্রযুক্তিবিদদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দূর্লংঘ ব্যবধানও দেখা যেতে পারে। বর্তমান শ্রমিক সমাজ এবং আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রে জীবনযাত্রার মান সেই পুরাতন চিত্র তুলে ধরেছে যে, স্বাধীনতা অসম্ভব। যে কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন না হয়ে পারেনা। এর অস্তিত্ব সমাজতান্ত্রিক ও অসমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে সমানভাবে বিপদে জর্জরিত এবং ব্যক্তিগত সামাজিক গ্রুপসমূহ ও সামগ্রিকভাবে গোটা সমাজকে এর প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। (Kerning C.D. Marxism Communism and Western Society, Herder & Herder, New York 1972, Vol 4, P. 32).
একই লেখক আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকদের অসহায়ত্বের চিত্র অংকন করতে গিয়ে বলেন, “একজন নাগরিক যে উদার ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা পেতে পারে তাও সে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পূর্ণরূপে ব্যবহার করতে পারেনা। শিক্ষার সুযোগ সুবিধা সকলের জন্য সমান নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত চিন্তাপ্রসূত হওয়ার পরিবর্তে আবেগপ্রসূত ও আদর্শিক বিকৃতির প্রভাবাধীনে হয়ে থাকে, অধিকাংশ সময় সিদ্ধান্তের পেছনে স্বার্থ লুকায়িত থাকে, সুস্পষ্টভাবে বিকল্প সিদ্ধান্তের নির্দেশ করা হয়না এবং প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তালাবদ্ধ রুমে হয়ে থাকে। অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য সর্বত্র প্রতিটি ব্যক্তির রুজি রোজগারের পলিসি গ্রহণ করা হলেও যেখানের সমস্যা সেখানেই থেকে যায়। রাষ্ট্র ও সরকার, রাজনৈতিক দলসমূহ, অর্থনীতি ও উল্লেখযোগ্য সমস্ত প্রতিষ্ঠানের উপর আমলাতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে জনসাধারণ সরকারী বিষয়াদিতে অংশগ্রহণ ও মত প্রকাশ থেকে বঞ্চিত ও অসহায় হয়ে পড়েছে” (ঐ, পৃ. ৩২)।
মৌলিক অধিকারসমূহের হেফাজতের কথা বলতে গিয়ে সি.ডি. কারনিগ আমাদের বলেন, “ আজ এই মৌলিক অধিকারসমূহের কোনো সুনিশ্চিত আইনগত মর্যাদা নেই। স্বয়ং অধিকারসমূহ সম্পর্কে বলা যায় যে, এর অধিকাংশই সংশ্লিষ্ট দেশ নির্ধারণ করে থাকে, যেমন কোনো দেশে নাগরিকদের মর্যাদা। এ কারণে প্রতিটি দেশের মৌলিক অধিকারসমূহের দফাসমূহ ভিন্নতর। সিদ্ধান্তকারী গুরুত্ব এই কথার উপর দেওয়া হয় যে, মৌলিক অধিকারসমূহ কিভাবে সংবিধানের আওতাভুক্ত করা হল। তা কি জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের সম্পূর্ণ উর্ধ্বে থাকবে, নাকি তাতে রাষ্ট্রের(ও তার আইন পরিষদের) হস্তক্ষেপ চলবে।(ঐ, পৃ. ৫৭)।
ডক্টর ক্যানেথ এ ম্যাগিল জনগণের উপর কার্য্যকর নিয়ন্ত্রণের দিক থেকে ভারসাম্যপ্রিয় গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে কোনো পার্থক্য লক্ষ্য করেননা। তিনি বলেন, “ভারসাম্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উভয় ক্ষেত্রে শ্রমিক সংগঠনগুলোর নিয়ন্ত্রণ তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমলাতান্ত্রিক গোষ্ঠীর হাতে সোপর্দ করা হয়েছে। নীতি নির্ধারকদের অধিক ক্ষমতা দান করে উপরোক্ত দুই ব্যবস্থায় নামমাত্র গণতন্ত্রের চর্চা পূর্ণ হতে পারে যাতে তারা নীতি বাস্তবায়নকারীদের উপর অধিক নিয়ন্ত্রণ লাভ করতে পারে।”(Megill Kennith A, The New Democratic Society, The Free Press, New York 1970, F. 104)।
এই ব্যাপারটি কেবল কর্মচারীদের উপর নিয়ন্ত্রণ পর্য্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়, গোটা সমাজই তার নিয়ন্ত্রণভুক্ত। পাশ্চাত্য জগত প্রশাসন বিভাগকে আইন কানুনের গন্ডীর বন্ধনে রাখার জন্য সমালোচনা ও পরামর্শ এবং আইন প্রনয়ণের মৌলিক দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য আইন পরিষদ ও আইনের শাসন বহাল রাখার জন্য বিচার বিভাগ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছিল তার সবই প্রশাসন বিভাগের নিকট পরাজিত হয়ে নিজ নিজ প্রভাব প্রতিপত্তি হারাতে বসেছে। সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান আইন পরিষদের নিয়ন্ত্রণ থেকে কার্য্যত প্রশাসনকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন নিজের মর্জিমতো সিদ্ধান্তের উপর বিচার বিভাগের সীলমোহর লাগানোর জন্য সে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেনা। বিচার বিভাগ তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে সে তার ক্ষমতা খর্ব করে নিজের সিদ্ধান্ত কার্য্যকর করার পথ সমতল করে নেয়।
সিডি কারনিগ এ অবস্থার উপর আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, “আমাদের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী সংস্থা-সরকারী যন্ত্র ও অন্যান্য প্রশাসনিক বিভাগের উপর (যার গুরুত্ব অব্যাহতভাবে বেড়ে চলছে) গণতান্ত্রিক প্রকৃতির কার্য্যকর নিয়ন্ত্রণ লাভের জন্য অপর্যাপ্ত ও অযোগ্য প্রমাণিত হয়েছে। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পর্যায়ের বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের উপরও আমলাতন্ত্রের হস্তক্ষেপ ধীরে ধীরে বেড়েই চলছে এবং এর নিয়ন্ত্রণ অংশীদার ও সদস্যগণের হাত থেকে চলে গেছে। সাথে সাথে একথাও মনে রাখতে হবে যে, মনোবিজ্ঞানের উন্নতির ফলশ্রুতিতে মনমানসিকতাকে নিজের মর্জিমাফিক ঢালাই করার জন্য নিত্য নতুন পন্থা ও সাধারণ প্রচার মাধ্যম, সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের কৌশলগত শক্তিকে সরকারগুলো এবং প্রাইভেট সংস্থা নিজ নিজ উদ্দেশ্যে সমানভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে।”
ড. কেনেথ এ ম্যাগিন ব্যক্তির মৌলিক অধিকারসমূহ এবং জনগণের শাসনের দৃষ্টিকোণ থেকে দুনিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর কয়েকটি শব্দে অত্যন্ত পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেনঃ স্টালিনের অনুসারীগণ এবং নিয়ন্ত্রিক গণতন্ত্র প্রিয় যুবকরা জনগণের শাসনের বুনিয়াদী ঐতিহ্য শেষ করে দিয়ে গণতন্ত্রকে রাজনৈতিক দলগুলোর শাসনে পরিণত করেছে। এই শাসন বহুদলীয় ব্যবস্থার অনুকরণেই হোক অথবা একদলীয় ব্যবস্থার আকারে-জনগণের স্থান পার্টি দখল করে নিয়েছে, আবার পার্টির মধ্যেও সেসব লোক যাদের দলের উপর কার্য্যকর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
পাশ্চাত্য চিন্তাবিদগণের উপরোক্ত পর্যালোচনা এ সত্যের দিকে ইঙ্গিত করে যে, ব্যক্তির সম্মান, মর্যাদা ও পজিশন সম্পর্কে আগ্রহ পোষণকারী লোকেরা দুনিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি চরম অসন্তুষ্ট, ব্যাকুল ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। পাশ্চাত্যে আজ এই প্রশ্ন গভীর আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে যে, একচ্ছত্র রাজতন্ত্রকে তো নির্বাচিত সংসদ ও ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে বশীভূত করা হয়েছিল, কিন্তু নির্বাচিত সংসদের গর্ভ থেকে যে একচ্ছত্র শাসন ব্যবস্থা জন্মলাভ করেছে তাকে কিভাবে বশীভুত করা যায়? এই যে প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রশাসন ব্যবস্থার উপর কার্য্যকর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য অস্তিত্ব দান করা হয়েছিল সেগুলোকে শেষ পর্য্যন্ত একনায়ককেন্ত্রিক ক্ষমতা ছাড়া আর কিই বা বাকী থাকে? ফরাসী চিন্তাবিদ বার্টান্ড ডি. জোভেনিল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার কঠিন বিপদ সম্পর্কে এভাবে সতর্ক করেছেনঃ “যে কোনো প্রকার ক্ষমতা কোনো এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত করাটা অত্যন্ত বিপদজনক। এই ক্ষমতা জনসাধারণের কল্যাণে ব্যবহৃত হওয়ার পরিবর্তে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহারের খুবই সম্ভাবনা রয়েছে।”(Bertrand De Jouvenel, Soveriegnty, Cambridge University Press, London 1957, P. 94).
প্রশ্ন হলো, ক্ষমতা যে পরিমাণ কেন্দ্রীভূত হয়েছে এবং আরো দ্রুত যেভাবে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে তা প্রতিহত করার উপায় কি? আইনসভা, স্বাধীন বিচার বিভাগ, সংবাদপত্র ও রাজনৈতিক দলের আকারে যেসব উপায় বিদ্যমান ছিল তা সবই প্রশাসনের অধীনস্থ হয়ে পড়েছে, এগুলোকে নতুন জীবন দেয়ার জন্য এবং প্রশাসন বিভাগের গ্রাস হতে মুক্ত করার মত শক্তি কোথায় পাওয়া যাবে? যে শাসন বিভাগ স্বীয় কর্মক্ষেত্র বর্ধিত করতে করতে নাগরিকদের শয়নকক্ষ পর্য্যন্ত পৌছে গেছে এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ, নিবীর্য্করণ ও সন্তানসংখ্যা নির্ধারণের মত বিষয়েও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ব্যবহার করে তাদের পারিবারিক জীবনের একান্ত গোপনীয় এলাকা পর্য্যন্ত স্বীয় নিয়ন্ত্রণভুক্ত করে ফেলেছে-তাকে পূর্বের সীমিত পরিসরে ধাক্কা মেরে ফিরিয়ে আনা যাবে কিভাবে? এই সেই জটিল গ্রন্থি যার জট পাকাচ্ছেন পাশ্চাত্যের পন্ডিতগণ, প্রাচ্যের পন্ডিতগণের দ্বারা নয়। মনে হয় যেন মানুষের রাজনৈতিক চিন্তার উন্নতি ঐখানে পৌছে থেমে গেছে। কারণ তার উর্বর মস্তিষ্ক জীবনের প্রতিটি শাখায় নিজের জৌলুস দেখাচ্ছে, কিন্তু কার্লমার্ক্সের সমাজতান্ত্রিক মতবাদের পর প্রায় দেড়শত বছর ধরে পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ এই ময়দানে কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেননি। রাজনৈতিক জীবনের নতুন সংগঠন সম্পর্কে তাদের পক্ষ হতে কোনো মতবাদ সামনে আসতে পারেনি। এই সুদীর্ঘকালে তারা আমাদের যে রাজনৈতিক সাহিত্য উপহার দিয়েছেন তা হয় বর্তমান ব্যবস্থার সমর্থনে অথবা তার সমালোচনায় লেখা হয়েছে। রাজনৈতিক জীবনে পরিবর্তনের কোনো নতুন পরিকল্পনা, নতুন কাঠামো, কোনো নতুন দর্শন বা মতবাদ তারা পেশ করতে সক্ষম হননি। মজার কথা এই যে, তারা বর্তমানের প্রতিও অসন্তুষ্ট।
এই হতবুদ্ধিকর অবস্থার মূল্যায়ন যখন আমরা ইসলামের আলোকে করে থাকি তখন এর আসল ও বুনিয়াদী একটি কারণই দৃষ্টিগোচর হয়। তা এই যে, মানুষ তার প্রতিটি রাজনৈতিক পরীক্ষায় অনবরত একটি ভুলের পুনরাবৃত্তি করছে। সে সর্বোচ্চ ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সত্তাকে চিনতে পারেনি এবং আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতিকে নিজের প্রকৃত সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে নেওয়ার পরিবর্তে নিজেদের মতোই কোনো এক ব্যক্তি বা কতিপয় ব্যক্তিকে সর্বময় কর্তৃত্বের উচ্চতম পদে অধিষ্ঠিত করে মানুষের মাঝে শাসক ও শাসিতে দুইটি শ্রেণী সৃষ্টি করেছে। সে রাজার সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের স্বাদ আস্বাদন করার পর এই সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব সংসদের নিকট হস্তান্তর করে। সংসদ তার নৈপূণ্য প্রদর্শনপূর্বক তাকে সংবিধানের সীমা ও শর্তের আওতায় বন্দী করে আয়ত্বে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু সংসদ ও প্রশাসন পরস্পর গাঁটছড়া বেঁধে সংবিধানকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলল এবং রাস্তার পাথর যখন সরে গেল বা পিছলে গেল তখন প্রশাসন সুযোগমত প্রশাসন ও বিচারবিভাগ কে অধীনস্থ করে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দখল করে নিল। মোটকথা এই সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব এ হাত হতে ঐ হাতে স্থানান্তরিত হতে থাকে, কিন্তু শাসক ও শাসিতের মধ্যকার মৌলিক সম্পর্ক দূরীভূত হতে পারল না।
ইসলামের নিকট মুক্তির একমাত্র পথ এই যে, মানুষ এদিক ওদিকের সমস্ত পথ পরিহার করে সরাসরি বিশ্বস্রষ্টাকে নিজেদের সর্বময় ও সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের অধিকারী স্বীকার করে নেবে এবং মানুষের উপর থেকে মানুষের কর্তৃত্বকে সমূলে উৎপাটন করে ফেলে দেবে, আল্লাহ নির্ধারিত অধিকারসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে এবং রাজনীতিসহ জীবনের সার্বিক ব্যাপারে তাঁর বিধানেরই অনুসরণ করবে। কুরআন মজীদ মুক্তির এই পথের নাম দিয়েছে “সিরাতুল মোস্তাকীম” এবং “সাওয়াউস সাবীল।” এই সাওয়াউস সাবীলের ব্যাখ্যা মাওলানা মওদূদী(রহ) এর মুখে শুনুনঃ
‘সাওয়াউস সাবীল’ ‘মধ্যম ও সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজপথ।’ এর অন্তর্নিহিত পূর্ণাঙ্গ ভাবধারা উপলব্ধি করার জন্য নিম্নলিখিত কথাগুলি বিশেষভাবে অনুধাবন করা আবশ্যক।
প্রথম কথা এই যে, মানুষ তার নিজ সত্তার দিক দিয়ে একটি ছোট জগত, তার মধ্যে অসংখ্য শক্তি, যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতা বিদ্যমান। তার আছে বাসনা, কামনা-লালসা, ভাবাবেগ ও ঝোঁক প্রবণতা। দেহ ও মনের আছে অসংখ্য দাবী, আত্মা, প্রাণ ও স্বভাবে আছে অসংখ্য জিজ্ঞাসা। এই সকল ব্যক্তিদের পারস্পরিক সম্মিলনে যে সমাজ জীবন গড়ে উঠে, তাও অসীম ও অসংখ্য জটিল সম্পর্ক সম্বন্ধের সমন্বয়ে গঠিত। সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রমবিকাশ লাভের সঙ্গে সঙ্গে এর জটিলতা ও সূক্ষ্মতা অধিক বৃদ্ধি পায়। এতদ্ব্যতীত দুনিয়ায় যে জীবন সামগ্রী মানুষের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে তা ব্যবহার করা এবং মানবীয় সংস্কৃতিতে তা প্রয়োগ করার প্রশ্নও ব্যক্তিগত ও সামগ্রিকভাবে অসংখ্য শাখা প্রশাখার সমস্যা সৃষ্টি করে।
মানুষ নিজের দুর্বলতার কারণে এই গোটা জীবন ক্ষেত্রের উপর একই সময় পূর্ণ সামঞ্জস্য ও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারেনা। তাই মানুষ নিজের জন্য জীবনের কোনো পথ নিজেই রচনা করতে পারেনা, যাতে তার অন্তর্নিহিত যাবতীয় শক্তি সামর্থের সাথে পূর্ণ ইনসাফ করা হবে, তার সমস্ত কামনা বাসনার সঠিক হক পুরোপুরি আদায় করা হবে, তার যাবতীয় ঝোঁক প্রবণতা ও আবেগ উচ্ছাসে পূর্ণ ভারসাম্য স্থাপিত হবে, তার আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক যাবতীয় দাবী যথাযথরূপে পূর্ণ হবে, তার সামগ্রিক জীবনের সমস্ত সমস্যার দিকে পুরোপুরি লক্ষ্য করা হবে ও সেই সবের এক সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাধান করা এবং বাস্তব জিনিসগুলিকেও ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক জীবনে সুবিচার, ইনসাফ ও সত্য দৃষ্টি সহকারে ব্যবহার করা হবে। বস্তুত মানুষ নিজেই যখন নিজের পথ-প্রদর্শক ও আইনপ্রণেতা হয়ে বসে, তখন নিগূঢ় সত্যের অসংখ্য দিকের মধ্য হতে কোন একটি দিক, জীবনের অসংখ্য প্রয়োজনের মধ্য হতে কোন একটি প্রয়োজন, সমাধানযোগ্য কোন একটি সমস্যা, তার মগজের উপর এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করে বসে যে, ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় সে অপরাপর দিক, প্রয়োজন ও সমস্যাগুলির সাথে সুস্পষ্ট নাইনসাফী করা শুরু করে। এরূপে কোন মত জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার ফলে জীবনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং সামঞ্জস্যহীনতার এক চরম পর্যায়ের দিকে বাঁকাভাবে তা চলতে শুরু করে। তারপর এই বক্রগতি যখন শেষসীমায় পৌছে মানুষের জন্য সহ্যাতীত হয়ে যায় তখন জীবনের যেসব দিক-প্রয়োজন ও সমস্যার সাথে ইতিপূর্বে অবিচার করা হয়েছে, তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং তাদের প্রতিও ইনসাফ করার জন্য জোর দাবী জানাতে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইনসাফ হয়না। কেননা পূর্বানুরূপ সামঞ্জস্যহীন কর্মনীতি আবার শুরু হয়ে যায়। পূর্বে যে সবের উপর অবিচার করা হয়েছে, সামঞ্জস্যহীন কর্মনীতির ফলে যেসব ভাবধারাকে দাবিয়ে ও দমিয়ে রাখা হয়েছে তাই আবার লোকদের মগজের উপর প্রচন্ড আধিপত্য বিস্তার করে বসে এবং তাকে নিজের বিশেষ দাবি অনুযায়ী বিশেষ একটি দিকে গতিবান করে তুলতে চেষ্টা করে। তখন অন্যান্য দিক, প্রয়োজন ও সমস্যাগুলির সাথে পূর্বানুরূপ আবার নাইনসাফী শুরু হয়ে যায়। এর ফলে মানুষের জীবন কখনো সঠিক ও সোজা পথে নির্লিপ্তভাবে চলার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেনা। সামুদ্রিক তরঙ্গের ঘাত প্রতিঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ হওয়াই হয় তার একমাত্র ভাগ্যলিপি। মানুষ নিজের জন্য যত পথ ও পন্থাই রচনা করেছে তা সবই বাঁকা, উঁচুনিচু সমন্বিত। ভুল দিক হতে গতি শুরু হয় এবং ভুল দিকে গিয়েই তা সমাপ্তি লাভ করে এবং সেখান থেকে আবার অন্য কোন ভুল দিকে ঘুরে যায়।
এইসব অসংখ্য বাঁকা ও ভ্রান্ত পথের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত এমন একটি পথ একান্তই আবশ্যক যাতে মানুষের সমস্ত শক্তি ও বাসনার প্রতি, সমস্ত ভালবাসা ও ঝোঁক প্রবণতার প্রতি, তার রূহ ও দেহের সমস্ত দাবি দাওয়ার প্রতি ও জীবনের সমগ্র বাসনার প্রতি পূর্ণ ইনসাফ করা হবে; যাতে কোন প্রকার বক্রতা, বিশেষ কোন দিকের প্রতি অযথা গুরুত্ব আরোপ ও অপর দিকগুলির প্রতি অবিচার ও জুলুম করা হবেনা। বস্তুত মানব জীবনের সুষ্ঠ ও সুন্দর বিকাশ এবং এর সাফল্য ও সার্থকতা লাভের জন্য তা একান্তই জরুরী। মানুষের মূল প্রকৃতিই এ পথের সন্ধানে উন্মুখ, বিভিন্ন বাঁকা টেরা পথ হতে বারবার বিদ্রোহ ঘোষণা করার মূল কারণ এই যে, মানব প্রকৃতি এই সঠিক ও ঋজু পথের সন্ধানেই পাগলপারা হয়ে ছুটে। কিন্তু মানুষ নিজেই এই রাজপথ জানতে ও চিনতে পারেনা, কেবল খোদা এই দিকে মানুষকে পথনির্দেশ দান করতে পারেন। ঠিক এই উদ্দেশ্যেই আল্লাহ তাঁর রাসূলকে পাঠিয়েছেন, মানুষকে এই সঠিক নির্ভূল রাজপথের দিকে পরিচালিত করাই হচ্ছে তাঁর একমাত্র কাজ। কুরআন এই পথকে ‘সাওয়াউস-সাবীল’ ও ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ বলে অভিহিত করছে। দুনিয়ার এই জীবন হতে শুরু করে পরকালের দ্বিতীয় পর্যায়ের জীবন পর্য্যন্ত অসংখ্য বাঁকা টেরা পথের মাঝখান দিয়ে তা সরল রেখার মত ঋজু হয়ে চলে গিয়েছে। তাই এই পথে যে চলবে, সে এখানে নির্ভুল পথে পথিক এবং পরকালে পূর্ণ স্বার্থক ও সাফল্যমন্ডিত হবে। আর যে এই পথ হারাবে সে এখানেও বিভ্রান্ত, পথভ্রষ্ট ও ভুল পথের যাত্রী; আর পরকালে তাকে অনিবার্য্যরূপে জাহান্নামে প্রবেশ করতে হবে। কেননা জীবনের সমস্ত বাঁকা টেরা পথই জাহান্নামে গিয়ে শেষ হয়েছে। বর্তমান কালের কোন কোন অজ্ঞ দার্শনিক মানব জীবনকে ক্রমাগতভাবে একটি সীমান্ত হতে বিপরীত দিকের সীমান্ত পর্য্যন্ত ধাক্কা খেতে দেখে এই ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে, দ্বান্ধিক কার্য্যক্রম(Dialectical Process) মানবজীবনের ক্রমবিকাশের স্বাভাবিক পন্থা, স্বভাবসম্মত পন্থা। তারা নিজেদের নির্বুদ্ধিতার জন্য বুঝে নিয়েছেন যে, প্র্রথমে এক চরমপন্থী দাবী(Thesis) তাকে এক দিকের শেষ প্রান্তে নিয়ে যাবে, এর জওয়াবে অপর একটি অনুরূপ চরমপন্থী দাবী(Antithesis) তাকে বিপরীত দিকের শেষ সীমান্তে নিয়ে পৌছাবে, তারপর উভয়ের সংমিশ্রণে জীবন-বিকাশের(Synthesis)পথ বের হবে। এটাই হচ্ছে মানুষের ক্রমবিকাশ লাভের একমাত্র পথ।
অথচ প্রকৃতপক্ষে এটা ক্রমবিকাশ লাভের কোন পথ নয়, হতভাগার গলাধাক্কা খাওয়ামাত্র। বরং মানবজীবনের সঠিক বিকাশের পথে তা বারবার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। প্রত্যেকটি চরমপন্থী দাবী জীবনকে তার কোন একটি দিকে ঘুরিয়ে দেয় এবং তাকে কঠিনভাবে টেনে নিয়ে যায়। এইভাবে যখন ‘সাওয়াউস সাবিল’ হতে তা বহু দূরে চলে যায়, তখন স্বয়ং জীবনেরই অপরাপর কতগুলি নিগূঢ় তত্ত্ব যার প্রতি আজ পর্য্যন্ত অবিচার করা হচ্ছিল তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে দেয় এবং বিদ্রোহ একটি প্রতিবাদীর রূপ ধারণ করে তাকে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। ফলে ‘সাওয়াউস সাবিল’ ‘সত্য সঠিক রাজপথ’ নিকটবর্তী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উক্ত পরস্পর সাংঘর্ষিক দাবীসমূহের মধ্যে সন্ধি ও সমঝোতা হতে শুরু হয়। এই সংমিশ্রণের ফলে মানুষ জীবনের পক্ষে বিশেষ উপকারী ও কল্যাণকর জিনিসসমূহ অস্তিত্ব লাভ করে। কিন্তু সেখানে যখন ‘সাওয়াউস সাবীলের’ চিহ্ন ও নিদর্শন প্রদর্শনকারী আলো বর্তমান থাকেনা, আর না থাকে এর উপর দৃঢ়ভাবে দাঁড় করিয়ে রাখার মত ঈমান, তখন সে প্রতিবাদী জীবনকে সে স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেয়না, বরং পূর্ণ শক্তিতে তাকে দ্বিতীয় দিকের শেষ পর্যায় পর্য্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। ফলে জীবনের অন্য ধরনের কিছু নিগুঢ় তত্ত্ব উপেক্ষিত হতে শুরু হয় ও অপর একটি বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এই দৃষ্টিহীন দার্শনিকদের পর্য্যন্ত কুরআনের আলোকচ্ছটা যদি বিচ্ছুরিত হতে পারত এবং তারা যদি সাওয়াউস সাবীল প্রত্যক্ষ করতে পারতেন তবে জানতে পারতেন যে, মানুষের জন্য এ সাওয়াউস সাবীলই হচ্ছে ক্রমবিকাশের সঠিক পথ। বক্র পথে এক সীমান্ত হতে অপর সীমান্ত পর্য্যন্ত ধাক্কা খেয়ে ফেরা মানুষের জন্য কোনক্রমেই কল্যাণের পথ হতে পারেনা।(তাফহীমুল কুরআন, সূরা মায়েদার ৩৫ নং টীকা)।
মানুষ শত শত বছর ধরে ধারণা-অনুমান, কল্পনা ও মতবাদের যেসব ভ্রান্তির মধ্যে ধাক্কা খেয়ে দিগ্বিদিক ঘুরপাক খাচ্ছে তারা যদি তা হতে বের হয়ে সাওয়াউস সাবীলের দিকে ফিরে আসত এবং ঘোষণা করে দিত যে, “শাসন ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো নয়” তবে সে সমস্ত শৃঙ্খল মুহুর্তের মধ্যে কেটে ফেলতে পারত যা দিয়ে তার স্বগোত্রীয়রা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দী করে রেখেছে। এটাই অত্র গন্থের পয়গাম এবং এটাই মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চিত ও নির্ভরযোগ্য প্রতিভু।
আমার পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার এবং আমি এজন্য আল্লাহ তাআলার যে পরিমাণ কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করি তা কমই হবে যে, এ গ্রন্থ রচনায় আমি দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবিদের সাহায্য-সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভে সক্ষম হয়েছি। জনাব আলতাফ গাওহার গ্রন্থখানি রচনায় শুধু অনুপ্রেরণা দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং তিনি আমাকে তাঁর মায়কাস এসোসিয়েটস প্রতিষ্ঠানের তথ্য গবেষনা বিভাগের সাথে সংযুক্ত করে আর্থিক আনুকূল্যেরও ব্যবস্থা করে দেন। আলোচ্য বিষয়ের ব্যাপকতা, গুরুত্ব এবং নিজের জ্ঞানের দৈন্যতা ও পুঁজির অভাবের কথা চিন্তা করে আমি বারবার পশ্চাদপসরণের পথ খুঁজছিলাম আর তিনি অনবরত পিছু ধাওয়া করে আমাকে এ কাজে ব্যস্ত রেখেছেন। পদে পদে তিনি আমার সাহস যুগিয়েছেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে উপকৃত করেছেন।বিশিষ্ট আইনজ্ঞ জনাব খালিদ ইসহাক –যিনি নিজের সরল প্রকৃতি, ভদ্রতা, উদারতা, অগাধ জ্ঞান ও মৌলিক অধিকার অর্জন ও তা সংরক্ষণের আন্দোলন প্রচেষ্টায় স্মরণীয় অবদানের কারণে নিজেই একটি গ্রন্থের বিষয়বস্তু হয়ে আছেন- তিনি শুধু আমার সাহায্যকারী ও পথপ্রদর্শকই ছিলেননা, বরং নিজের বিরাট পাঠ্যাগার ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে প্রয়োজনীয় পুস্তকাদি অন্বেষণের শ্রম থেকেও আমাকে বাঁচিয়েছেন।গ্রন্থখানি তাঁর পাঠাগারে বসেই রচিত এবং তিনি এর রচনাকার্য্য সমাপ্তির ব্যাপারে অসীম আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি নিজের মূল্যবান সময়ের একটি বড় অংশ সংশ্লিষ্ট পুস্তক নির্বাচন, তার অনুসন্ধান, মতবিনিময় এবং বিভিন্ন অধ্যায় সম্পর্কে আলোচনায় ব্যয় করেন।
বর্তমান যুগের মহান চিন্তাবিদ ও ইসলামের মুখপাত্র মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী(রহ) নিজের শত ব্যস্ততা এবং স্বাস্থ্যের অবনতি সত্ত্বেও পান্ডুলিপিখানা পাঠ করে এবং ‘পেশ কালাম’ লিখে দিয়ে আমার কাজের মূল্য ও মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং আমাকে তাঁর স্নেহ ও ভালবাসায় সিক্ত করেছেন। মাওলানা মুহতারামের একটি পরোক্ষ অনুগ্রহ এই যে, তাঁর সুবিখ্যাত তাফসীর ‘‘তাফহীমুল কুরআন’’ আমাকে ইসলামের প্রাণশক্তি সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে। এই গ্রন্থে উদ্ধৃত অধিকাংশ আয়াতের তরজমাও তাফহীমুল কুরআন থেকেই নেয়া হয়েছে।
পাকিস্তান আন্দোলনের স্বনামধন্য রাহবার এবং আইন সম্পর্কিত বিষয় সম্বন্ধে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিবিদ এবং জাতীয় পরিষদ সদস্য মাওলানা জাফর আহমাদ আনসারীও নিজের অসুস্থতা ও চরম ব্যস্ততা সত্ত্বেও গ্রন্থের গোটা পান্ডুলিপি অধ্যয়ন করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদান করেন। মাওলানার অনুগ্রহ এবং গ্রন্থের প্রতি আগ্রহের অনুমান এই ঘটনা থেকেও করা যায় যে, তিনি রাত জেগে কোন কোন অধ্যায় অধ্যয়ন করেছেন। প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক এবং ফাড়ান পত্রিকার সম্পাদক জনাব মাহেরুল কাদেরী ভাষাগত ও বাচনভঙ্গির দিকে লক্ষ্য রেখে পান্ডুলিপিখানা পাঠ করেছেন এবং নিজের সন্তোষ প্রকাশ করে আমার সাহস বাড়িয়ে দিয়েছেন। সাবেক এটর্নি জেনারেল জনাব শরীফউদ্দীন পীরজাদাও পান্ডুলিপির কোন কোন অংশ পাঠ করে নিজের সন্তোষ প্রকাশ করেন।
ইসলামিক রিসার্চ একাডেমীর পরিচালক সাইয়েদ মুনাওয়ার হাসান সাহেব, খালিদ ইসহাক সাহেবের পাঠাগারের আরবী ও ইসলামিয়াত বিভাগের ইনচার্জ জনাব তাহের আল মক্কী এবং করাচীর দৈনিক জাসারাতের নিউজ এডিটর জনাব কাশাশ সিদ্দিকীর প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ। তাঁরা পর্যায়ক্রমে আমাকে পুস্তাকাদি সংগ্রহ, আরবী কিতাব থেকে সাহায্য গ্রহণ এবং উদ্ধৃতিসমূহের তরজমা করে দিয়ে এবং প্রুফ রিডিং এ আমার সাহায্য করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁদের সকলকে মহান পুরস্কারে ভূষিত করুন এবং এ কাজে তাদের নিস্বার্থ সহযোগিতার বরকতে আমার প্রচেষ্টা কবুল করুন।
অবস্থার নাজুকতা দেখুন। ‘মৌলিক অধিকার’ বিষয়ের উপর প্রথমবারের মত লেখার খেয়াল আসে ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে সেই সময়ে যখন আমাকে সমস্ত মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে যিন্দানখানায় নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আর আজ তার শেষ লাইনও যিন্দানখানার লৌহযবনিকার অন্তরালে বসে লিখছি যখন আমি সমস্ত মৌলিক অধিকার বঞ্চিত এবং দেশের ‘কর্ণধারগণ’ আমাকে ডি.পি.আর. এর লৌহশৃঙ্খল পরিয়ে রেখেছেন। পাঠকগণের কাছে আমার আবেদন এই যে, গ্রন্থখানিতে কোনো ভুলত্রুটি দৃষ্টিগোচর হলে তা আমার অযোগ্যতা ও জ্ঞানের দৈন্যতার কারণেই হয়েছে মনে করবেন এবং সে সম্পর্কে আমাকে অবহিত করবেন। তাদের নিকট আমার আরও আবেদন এই যে, তারা যেন দোয়া করেন যাতে এই গ্রন্থখানি আমার পার্থিব সম্মান লাভের উপায় হয় এবং পরকালীন মুক্তির উপকরণ হয়।
سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُونَوَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَوَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
“তারা যা আরোপ করে তা হতে তোমার প্রতিপালক পবিত্র ও মহান, যিনি সমস্ত সম্মানের অধিকারী। শান্তি বর্ষিত হোক রাসূলগণের উপর। সমস্ত প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।”(আস সাফফাতঃ ১৮০-১৮২)।
২৭ রমযানুল মুবারক, ১৩৯৬ হিজরী মুহাম্মাদ সালাহুদ্দীন ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬ খৃ. (কেন্দ্রীয় কারাগার, করাচী)।