১১. ন্যায় বিচার লাভের অধিকার
ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাই ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্বের মূখ্য উদ্দেশ্য। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাঁর নবীকে নির্দেশ দিচ্ছেন এ কথা ঘোষণা করতে:
(আরবী***)
অর্থ: তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি” (সূরা শূরা:১৫)।
(আরবী***)
অর্থ: “বল, আমার প্রভূ আমাকে ন্যায় বিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন”(সূরা আরাফ:২৯)।
পৃথিবীতে মানব সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে নবী-রসুলদের প্রেরণ, আসমানী কিতাব সমূহের অবতরণ এবং মুসলমানদের রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির একক উদ্দেশ্য:
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ ۖ وَأَنزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ ۚ إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ [٥٧:٢٥]
“আমরা আমাদের রসুলগণকে প্রেরণ করেছি সুষ্পষ্ট নিদর্শনাবলীসহ এবং তাদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায় নীতি, যাতে মানুষ সুবিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আমি লৌহ দিয়েছি যাতে রয়েছে প্রচণ্ড শক্তি এবং মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ। আর আল্লাহ অবহিত হবেন যে, কারা না দেখেও তাঁর রসুলগণকে সাহায্য করে। আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী” (সূরা হাদীদ:২৫)।
মহানবী সা: কে এবং তাঁর পরের মুসলমানদের যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আদেশ দেওয়া হয়েছে তার মানদন্ডেরও পরিপূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে, যাতে এই ‘সুবিচার’- এর মর্ম নির্ধারণে এবং আল্লাহর অভিপ্রায়কে যথার্থভাবে অনুধাবন করতে কোন অষ্পষ্টতা না থাকে।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَىٰ أَنفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ ۚ إِن يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقِيرًا فَاللَّهُ أَوْلَىٰ بِهِمَا ۖ فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَىٰ أَن تَعْدِلُوا ۚ وَإِن تَلْوُوا أَوْ تُعْرِضُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا [٤:١٣٥]
অর্থ: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা সুবিচারের পতাকাবাহী এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে সাক্ষী হও, যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতা-মাতা এবং নিকট আত্মীয়ের বিপক্ষে হয়, পক্ষদ্বয় বিত্তবান হোক কিংবা বিত্তহীন। আল্লাহ উভয়েরই যোগ্যতম অভিভাবক। সুতরাং তোমরা সুবিচার প্রতিষ্ঠায় প্রবৃত্তির অনুগামী হবে না। যদি তোমরা পেঁচালো কথা বল অথবা পাশ কাটিয়ে যাও তাহলে স্মরণ রাখ আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে পরিপূর্ণ খোঁজখবর রাখেন” (সূরা নিসা:১৩৫)।
এই আয়াতে শুধুমাত্র সুবিচারের অর্থই স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়নি, বরং সুবিচার প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য শর্তাবলীও উল্লেখ করা হয়েছে। এর কোন একটি শর্ত বাদ পড়লে সুবিচার আর সুবিচার থাকবে না, তা অবিচারে পরিণত হবে। শর্তগুলো নিম্নরূপ:
১. সুবিচার শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠাই করবে না, বরং এর পতাকাও সমুন্নত রাখবে। যেখানেই ন্যায় বিচার ভুলুন্ঠিত হতে দেখবে সেখানে তা সমুন্নত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করবে।
২. মামলায় কোন পক্ষের হার-জিতের জন্য সাক্ষ্য নয়, বরং শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের জন্যই সাক্ষ্য দিবে। কেননা সত্য সাক্ষ্য ব্যতিরেকে সুবিচারের প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সত্য সাক্ষ্য দিলে যদি তোমাদের নিজেদের স্বার্থে আঘাত লাগে অথবা তোমাদের পিতা মাতার প্রতিকূলে যায় কিংবা নিকট আত্মীয়-পরিজনদের স্বার্থে আঘাত লাগে তবুও পরোয়া করবে না।
৩. সাক্ষ্যদানের সময় আত্মীয় সম্পর্ক ছাড়াও মামলার উভয় পক্ষের মর্যাদা এবং তাদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা এবং তাদের আর্থিক ও সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি ইত্যাদির প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ করবে না। কেননা তোমরা কারও জন্য আল্রাহর চেয়ে অধিক শুভাকাংখী হতে পার না। সাক্ষ্যদানের ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র স্থাপন করা হিতাকাংখা নয়, বরং তা ষ্পষ্ট জুলুম ও অনিষ্টকামিতা।
৪. সাক্ষ্যদানের সময় প্রকৃত ঘটনা যথার্থভাবে বর্ণনা করবে। এতে নিজের প্রবৃত্তি ও কামনা বাসনাকে মিশ্রিত করবে না। প্রবৃত্তি ঘটনার প্রকৃতরূপ বিকৃত করে দেয় এবং সাক্ষ্য গ্রহণকারী (বিচারক) ঘটনার গভীরে পৌঁছতে পারে না, আর এই জিনিস সুবিচার প্রতিষ্ঠায় বাধার সৃষ্টি করে।
৫. তোমরা যদি কোন পক্ষকে বাঁচানোর জন্য কিংবা শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে উল্টাপাল্টা কথা বল, কিছু তথ্য গোপন কর, নিজের পক্ষ থেকে কিছু তথ্য সংযোজন কর এবং নির্ভেজাল ও নিরপেক্ষ সাক্ষ্য থেকে পিছু হটে গিয়ে সুবিচারের পরিবর্তে অবিচার ও জুলুমের মাধ্যম হয়ে যাও তাহলে এ কথা ভালো করেই স্মরণ রাখ যে, তোমাদের আভ্যন্তরীণ অবস্থা আল্লাহর নিকট গোপন থাকবে না এবং তার সামনে হাযির হলে পর নিজেদের কৃত অপকর্মের শাস্তি থেকে রেহাই পাবে না।
অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী***)
অর্থ: “কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা সুবিচার করবে। এতো তাকওয়ার নিকটতর” (সূরা মায়িদা:৮)।
কুরআন মজীদের এই আয়াতের নিরিখে হযরত উমার ফারুক রা: কাযী শুরায়হ এর নামে একখানা ফরমান লিখেছিলেন:
“বিচার সভায় দরকষাকষি করবে না, কারো সাথে বিবাদে লিপ্ত হবে না। কোন ধরণের বিকিকিনি করবে এবং তুমি রাগান্বিত অবস্থায় দুই ব্যক্তির মধ্যে বিচারের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করবে না” (উমার ইবনুল খাত্তাব, পৃ. ৩০৭)।
মোট কথা আদালতের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে বাইরের ও ভেতরের যাবতীয় প্রভাব থেকে বিচারকের মুক্ত থাকা, যাতে তার কোন প্রভাব কার্যকর না হয়। আল্লাহ তাআলা বিচারকার্য অনুষ্ঠানের সময় তার পরিপূর্ণ হক আদায় করার তাকীদ দিয়েছেন। তিনি বলেন:
(আরবী***)
অর্থ: “তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে” (সূরা নিসা:৫৮)।
(আরবী***)
অর্থ: “তুমি তাদের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করলে সুবিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালোবাসেন” (সূরা মায়িদা: ৪২)।
(আরবী***)
অর্থ: “যখন তোমরা কথা বলবে তখন ন্যায্য কথাই বলবে—তোমার নিকট আত্মীয় হলেও” (সূরা আনআম: ১৫২)।
ন্যায়পরায়ণতার ক্ষেত্রে কুরআনুল করীম নিম্নোক্ত মূলনীতিও নির্ধারণ করে দিয়েছে:
(আরবী***)
“প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং যখমের বদলে অনুরূপ কিসাস ( যখম) ( সূরা মায়িদা: ৪৫)।
এই মৌলনীতি অন্যস্থানে নিম্নোক্ত বাক্যে বর্ণনা করা হয়েছে:
وَجَزَاءُ سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِّثْلُهَا ۖ فَمَنْ عَفَا وَأَصْلَحَ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ [٤٢:٤٠]وَلَمَنِ انتَصَرَ بَعْدَ ظُلْمِهِ فَأُولَٰئِكَ مَا عَلَيْهِم مِّن سَبِيلٍ [٤٢:٤١]إِنَّمَا السَّبِيلُ عَلَى الَّذِينَ يَظْلِمُونَ النَّاسَ وَيَبْغُونَ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ ۚ أُولَٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ [٤٢:٤٢]وَلَمَن صَبَرَ وَغَفَرَ إِنَّ ذَٰلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ [٤٢:٤٣]
অর্থ: “মন্দের প্রতিশোধ অনুরূপ মন্দ। অতএব যে ব্যক্তি ক্ষমা করে দেয় ও আপোষ-নিষ্পত্তি করে তার পুরষ্কার আল্লাহর কাছে মওজুদ আছে। আল্লাহ জালেমদের পসন্দ করেন না। তবে অত্যাচারিত হওয়ার পর যারা প্রতিশোধ নেয় তাদের তিরষ্কার করা যায় না। কেবল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে যারা মানুষের উপর জুলুম করে এবং ভূপৃষ্ঠে অন্যায় আচরণ করে বেড়ায়; তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। অবশ্য যারা ধৈর্যধারণ করে এবং ক্ষমা করে দেয় তা তো দৃঢ় সংকল্পেই বিষয়” (সূরা শূরা:৪০-৪৩)।
এই আয়াতে ন্যায় বিচারের জন্য “যেমন কর্ম তেমন ফল”-এ খাঁটি নীতিমালা পেশ করার সাথে সাথে মজলুমকে তার প্রতিশোধের বেলায় অন্যায় আচরণ থেকে বিরত থাকার এবং ক্ষমা করে দেওয়ার উতসাহিৎও করা হয়েছে। অর্থাৎ সে যদি তার ক্ষতির সমপরিমাণ প্রতিশোধ গ্রহণ করে তবে তা হবে প্রকৃত ন্যায় বিচার। ক্ষতির চাইতে পরিমাণে বেশী প্রতিশোধ নিলে তা জুলুম হিসেবে গণ্য হবে। আর আল্লাহ তো জালেমদের আদৌ পসন্দ করেন না। যদি অত্যাচারিত ব্যক্তি ক্ষমা ও উদারতার পথ অবলম্বন করে তবে তা হবে তার জন্য উন্নত মানসিকতা ও উদারতার পরিচায়ক, সর্বোপরি আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয় কাজ।
(আরবী***)
অর্থ: “আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনদের দানের নির্দেশ এবং তিনি নিষেধ করছেন অশ্লীলতা, অসৎ কাজ ও সীমালংঘন”(সূরা নাহল:৯০)।
তবে ইহসান (অনুকম্পা প্রদর্শন) সম্পূর্ণই একটি ব্যক্তিগত বিষয়। ইসলামী রাষ্ট্রের বিচার বিভাগের কাজ হল-আইনগত প্রতিকার প্রার্থনা করা হলে ন্যায়নীতি অনুযায়ী বিচার মীমাংসা করা। অবশ্য ফরিয়াদী ইচ্ছা করলে তার প্রতিপক্ষের উপর থেকে তার দাবী প্রত্যাহার করে নিতে এবং তার এই অনুকম্পা প্রদর্শণের প্রতিদান আল্লাহর কাছে পেতে পারে। সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুষ্পষ্ট নির্দেশ হচ্ছে এই:
(আরবী***)
অর্থ: “আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুযায়ী যারা মীমাংসা করে না তারাই কাফের…তারাই জালেম…তারাই সত্যত্যাগী” (সূরা মায়িদা: ৪৪-৪৭)।
এই নির্দেশ মোতাবেক মীমাংসাকারী কোন ব্যক্তি হোক কিংবা সালিশ, পঞ্চায়েত হোক কিংবা যথারীতি আদালত-তাদের কাজ হচ্ছে আল্লাহর কিতাব ও তাঁররসুলের সুন্নাত অনুসারে বিচারকার্য নিষ্পন্ন করা। রসূলে করীম সা: ইরশাদ করেন:
“ন্যায় পরায়ণ শাসকের একদিন ষাট বছরের ইবাদতের চাইতে উত্তম।”
অধিকন্তু তিনি আরও ইরশাদ করেন:
“সৃষ্টিকুলের মধ্যে আল্লাহর সর্বাপেক্ষা প্রিয় হচ্ছে ন্যায়পরায়ণ শাসক, আর ঘৃণিত হচ্ছে জালেম শাসক” ( মুসনাদে আহমাদ)।
মহানবী সা: ও তার পরবর্তী খুলাফায়ে রাশেদীন কুরআন মজীদে বর্ণিত বিধিমালা যেভাবে অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করেছেন ইতিপূর্বের পৃষ্ঠাগুলোতে তার দৃষ্টান্তসমূহ গোচরীভূত হয়েছে। রসুলুল্লাহ সা: স্বয়ং নিজকে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্রতিপক্ষের সামনে পেশ করেছেন। হযরত উমার রা: ও হযরত আলী রা: তাদের খিলাফতকালে প্রতিপক্ষের সাথে একই অবস্থানে আদালতে হাযির হয়েছেন। হযরত উমার রা: তাঁর পুত্রের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেন। তিনি নিজকে প্রতিশোধ গ্রহণার্থে প্রতিপক্ষের সামনে পেশ করেছেন, সাধারণ নাগরিকদের অভিযোগে গভর্ণরদের শাস্তি দিয়েছেন এবং ন্যায়বিচার লাভের পথের যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা অপসারিত করে প্রতিকার প্রাপ্তিকে অত্যন্ত সহজলভ্য করেছেন।
হযরত আবু বাকর রা: হযরত উমার রা:-কে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করে প্রশাসনিক বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করে দেন। হযরত উমার রা: সেটাকে যথারীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান করেন এবং নিজে আদালতের কাঠগড়ায় হাযির হয়ে শাসন বিভাগের উপর বিচার বিভাগের প্রাধান্য কার্যত প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পরে মুসলমানদের সমগ্র ইতিহাসে এই ব্যবস্থাই বহাল থাকে। অনায়াসে সুবিচার পাওয়াই ছিল এই ব্যবস্থার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এতে না ছিল কোর্ট ফি, না ছিল উকীলের পারিতোষিক। উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত এই ব্যবস্থাই বহাল ছিল এবং যেসব মুসলিম রাষ্ট্র ঔপনিবেশিক থাবার হাত থেকে মুক্ত ছিল সেখানে অদ্যাবধি এই ব্যবস্থাই বর্তমান রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ সৌদি আরবের কথা বলা যেতে পারে। এখনও সেখানে ধনী গরীব নির্বিশেষে সকলের জন্য সমানভাবে ও বিনামূল্যে আইনগত প্রতিকার প্রার্থনার ব্যবস্থা রয়েছে। সত্য কথা হল ইসলাম ব্যতীত পৃথিবীতে এমন কোন ‘বিচার ব্যবস্থা’ নেই যে ন্যায় বিচারকে ব্যবসায়ের পণ্যে পরিণত করে “আইনের দৃষ্টিতে সমতা” এবং “সকলের সাথে সমান সুবিচার” এর গগন বিদারী শ্লোগানকে অর্থহীন করে দেয়নি। বর্তমানে কতজন লোক আছেন যারা হাইকোর্ট-সুপ্রীম কোর্টের ফি এবং সেখানে মামলা পরিচালনার জন্য উকীল-ব্যারিস্টারের দাবীকৃত মোটা অংকের ফি আদায় করার শক্তি রাখে? যদি তারা সামর্থহীনই হয়ে থাকে তবে তাদের জন্য কি সর্বোচ্চ বিচারালয়ের দরজাসমূহ কার্যত: বন্ধ হয়ে যায়নি? তারা কি সুবিচার প্রাপ্তির সহজলভ্য উপায় থেকে বঞ্চিত হয়ে বিত্তবানদের মোকাবিলায় আইনের নিরাপত্তা ও তার সহায়তা থেকে স্বয়ং বঞ্চিত হয়ে পড়েনি?
ইসলামী রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা এই ব্যবসায়িক পণ্য সুলভ চিন্তাধারা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এখানে আদালতে বিচারকার্য পরিচালনার যাবতীয় খরচ সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র বহন করে। ফরিয়াদীর জন্য আদালতের দ্বারস্থ হওয়ায়ই যথেষ্ট। এক আদালতের রায়ে সন্তুষ্ট না হতে পারলে সে হাইকোর্ট ( আদালতে আলিয়া) এবং সুপ্রীম কোর্ট (আদালতে উযমা) পর্যন্ত যেতে পারবে। এখানে বিরাট অংকের অর্থের বোঝা কারো উপর চাপানো হয় না। কেননা এরূপ বোঝা চাপানো হলে তা হবে তার জন্য আরেক জুলুম। কারণ একদিকে সে জুলুমের প্রতিকার প্রার্থনা সহ আসবে আবার অপরদিকে আর্থিক অস্থিরতার বোঝাও একত্রে তাকে বহন করতে হবে।
তাছাড়া এই আর্থিক বোঝা আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার ব্যাপারে গরীব ও বিত্তহীন লোকদের উৎসাহ বিনষ্ট করে দেয় এবং বিত্তবানদের তাদের উপর প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগ দিয়ে অন্যায়-অবিচারের ক্ষেত্রে অধিকতর দু:সাহসী বানিয়ে দেয়।
ইসলাম ধনী-গরীব, উঁচু-নিচু, পরাক্রমশালী ও প্রভাবহীন সকলকে আদালতের সামনে সমান মর্যাদা দান করে ‘আইনের চোখে সবাই সমান’ নীতিকে এর প্রকৃত প্রাণশক্তি সহ কার্যকর যোগ্য এবং ন্যায়বিচারের মৌলিক অধিকারকে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সহজলভ্য করে দিয়েছে।
১২. অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অধিকার
সূরা ফাতিহার দোয়াসূচক আয়াতগুলোর পরে যখন আমরা সূরা বাকারা থেকে তিলাওয়াত শুরু করি তখন প্রাথমিক আয়াতগুলোতেই কুরআনুল করীম এবং তার ঈমান আনয়নকারীদের নিম্নোক্ত গুণাবলী সম্পর্কে আলোচনা দেখতে পাই:
الم [٢:١]ذَٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ ۛ فِيهِ ۛ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ [٢:٢]الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ [٢:٣]
অর্থ: “আলিফ-লাম-মীম। এতো আল্লাহর কিতাব, এতে কোন সন্দেহ নেই। এটা সেই মুত্তাকীদের জন্য পথ নির্দেশ যারা অদৃশ্যে ঈমান রাখে, নামায কায়েম করে এবং আমি তাদের যে জীবিকা দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে” (সূরা বাকারা:১-৩)।
এসব আয়াত সম্পর্কে চিন্তা করলে পরিষ্কার দিবালোকের ন্যায় অনুভব করা যায় যে, আল্লাহর কিতাবের উপর এবং এতে বর্ণনাকৃত অদৃশ্য বিষয়াদি যেমন- আল্লাহর অস্তিত্ব, তাকদীর, বিশ্বলোক সৃষ্টি, আদম সৃষ্টি, বেহেশত দোযখ, পরকাল, জিন, ফেরেশতা, ইত্যাদির উপর ঈমান আনয়নের সাথে সাথেই মানুষের উপর দুটো অধিকার অনিবার্য হয়ে পড়ে। আল্লাহ এবং বান্দার মধ্যেকার সম্পর্কের গন্ডিতে সর্বপ্রথম অধিকার হচ্ছে-বান্দা তার মাথা শুধুমাত্র আল্লাহর সামনে অবনত করবে এবং নামায কায়েমের মাধ্যমে নিজের দাসত্ব এবং আল্লাহর প্রভুত্বের স্বীকৃতি প্রদানের জন্য প্রত্যেহ পাঁচবার পড়া নিজের অপরিহার্য দায়িত্বে পরিণত করে নেবে।
নামাযের পরপরই ঈমানদারদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হচ্ছে হক্কুল ইবাদ সম্পর্কিত অধিকার আদায়- যার নাম ‘ইনফাক’ (অর্থ ব্যয়)। অর্থাত আল্লাহর দেওয়া ধন সম্পদ দ্বারা অভাবী ও দারিদ্রক্লিষ্টদের লালন পালন। অধিকারের এই ক্রমবিন্যাস শুধু এই একটি মাত্র আয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং কুরআনের কোন কোন স্থানে অভাবীদের অভাব মোচনে উদাসীনতা ও শৈথিল্য প্রদর্শন করলে নামাযীর নামায অর্থহীন বলে ঘোষনা করা হয়েছে। এই পর্যায়ে সূরা মাউনের উল্লেখ করা যায়:
“তুমি কি তাকে দেখেছ, যে আখেরাতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে? সে তো ঐ ব্যক্তি যে ইয়াতিমকে ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেয় এবং অভাবগ্রস্তকে আহার্যদানে উৎসাহিত করে না। সুতরাং দূর্ভোগ সেই নামাযীদের জন্য যারা তাদের নামায সম্পর্কে উদাসীন, যারা লোক দেখানোর জন্য নামায পড়ে এবং গৃহস্থালীর নিত্য প্রয়োজনীয় ছোটখাটো জিনিস সাহায্যদানে বিরত থাকে।”
এই সূরার প্রথম ইতিপূর্বে সূরা বাকারায় বর্ণিত সত্যকে এক ভিন্নতর আঙ্গিকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করছে। যে ব্যক্তি অদৃশ্যের উপর (অর্থাৎ আখেরাতের প্রতিদান ও শাস্তির প্রতি) ঈমান রাখে না তার দ্বার না আল্লাহর হক নামায সঠিকভাবে আদায় হতে পারে না সে নিজের ধন সম্পদ ব্যয় করে তার ভাইদের অভাব মোচন করতে এগিয়ে আসে। নামায পড়লেও চরম শৈথিল্য ও উদাসীনতার সাথে এবং তা কেবল প্রদর্শনীমূলক। আর আল্লাহর দেওয়া ধন সম্পদের উপর অজগর হয়ে বসে থাকে, অনাথ অসহায় ইয়াতীমকে ঘাড় ধরে বিতাড়িত করে, অভাবীদের নিজে তো পানাহার করায়ই না, এমনকি অন্যদেরও এ বিষয়ে উৎসাহিত করে না। কোন অভাবী ব্যক্তি যদি মামুলী কোন জিনিসও চায় তবে তা দিতে সাফ অস্বীকার করে। এই প্রকারের কর্মপন্থা অবলম্বনকারীদের অত্যন্ত কঠোরভাবে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে যে, তোমাদের এই নামায কোন কাজে আসবে না,তা তোমাদের মুখের উপর নিক্ষেপ করা হবে এবং আল্লাহর সৃষ্টির অধিকার আদায় না করার অপরাধে তোমরা যে ধ্বংসের মুখোমুখি হবে- এই নামায তোমাদেরকে তা থেকে বাঁচাতে পারবে না।
এ হচ্ছে ইসলামে মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার গুরুত্ব এবং তার সমাধানের জন্য সর্বশক্তিমান আল্রাহর পক্ষ থেকে মুসলমানদের প্রদত্ত উপদেশের ধরণ। কুরআন মজীদে ত্রিশের অধিক স্থানে নামায কায়েমের নির্দেশদানের সাথে সাথে যাকাত আদায়ের উল্লেখ রয়েছে। এবং সত্তরের অধিক স্থানে সম্পদ ব্যয়ের কথা এসেছে। দূর্ভাগ্যক্রমে মুসলমানরা না জানি কিসের ভিত্তিতে ‘ইসলামের স্তম্ভ’ শিরোনামের অধীনে ক্রমানুসারে যাকাতকে পঞ্চম নম্বরে রেখে দিয়েছে। অথচ বাস্তব সত্য এই যে, স্বয়ং কুরআন মজীদ যাকাতকে ঈমান ও নামাযের পরে তৃতীয় স্তরে রেখেছে। গুরুত্বের দিক দিয়ে রোযা ও হজ্জ এর পরে এসেছে।
ইসলামে আর্থিক সমস্যার গুরুত্বের ভূমিকা স্বরূপ এই আলোচনার পর এখন লক্ষণীয় এই যে, মানুষকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রদানের জন্য আল্লাহর দীনে সম্পদ ব্যয়ের উপর কতটা জোর দেওয়া হয়েছে, এ জন্য কি কি উপায় অবলম্বন করা হয়েছে এবং এই প্রসঙ্গে ইসলামী রাষ্ট্রের উপর কি কি দায়িত্ব আরোপিত হয়। সম্পদ ব্যয়ের বিধানসমূহ এবং এ সম্পর্কে অনুপ্রেরণাদান সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত লক্ষণীয়।
(আরবী***)
অর্থ: “আর যাদের (মুসলমানদের) সম্পদে নির্ধারিত হক রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের” (সূরা মাআরিজ:১৯)।
(আরবী***)
অর্থ: “আর তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও”( সূরা মুযযাম্মিল:২০)।
সূরা বাকারায় “তোমরা তোমাদের মুখ পূর্ব বা পশ্চিমে ফিরাবে এতে পূণ্য নেই” বলে ইরশাদ হচ্ছে:
وَآتَى الْمَالَ عَلَىٰ حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ
অর্থ: “(নেকী এই যে) আল্লাহর ভালবাসায় নিজের প্রিয় সম্পদ নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, অভাবী, পর্যটক, সাহায্যপ্রার্থীগণকে এবং দাসমুক্তির জন্য খরচ করা, নামায কায়েম ও যাকাত আদায় করা” ( সূরা বাকারা: ১৭৭)।
এই আয়াতে বিধানসমূহের ক্রমিকদাতার প্রতি লক্ষ্য করুন। এখানে ঈমানের যেসব শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে প্রিয় সম্পদ খরচের কথা নামায কায়েমের আগে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সূরায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে:
يَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنفِقُونَ ۖ قُلْ مَا أَنفَقْتُم مِّنْ خَيْرٍ فَلِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۗ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ [٢:٢١٥]
অর্থ: “লোকেরা কি ব্যয় করবে সে সম্বন্ধে তোমাকে জিজ্ঞেস করে। বল, তোমরা যে সম্পদই ব্যয় কর তা (নিজেদের) পিতা মাতা, আত্মীয়স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্থ ও মুসাফিরদের জন্য (সূরা বাকারা:২১৫)।
সম্পদ ব্যয় করার প্রতি অস্বাভাবিক জোর দেওয়ার কারণ সম্পর্কে কুরআনুল করীমের ভাষ্য:
(আরবী***)
অর্থ: “যাতে তোমাদের মধ্যেকার বিত্তবানদের মাঝেই সম্পদ আবর্তন না করে” ( সূরা হাশর: ৭)।
অত:পর ব্যয় করার দরুন ধন সম্পদ ঘাটতি হওয়ার এবং দরিদ্র হয়ে যাওয়ার যে ভয় অন্তরে লেগে আছে তা থেকে মন মগজকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ইরশাদ হচ্ছে:
لَّيْسَ عَلَيْكَ هُدَاهُمْ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَن يَشَاءُ ۗ وَمَا تُنفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فَلِأَنفُسِكُمْ ۚ وَمَا تُنفِقُونَ إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ ۚ وَمَا تُنفِقُوا مِنْ خَيْرٍ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنتُمْ لَا تُظْلَمُونَ [٢:٢٧٢]
অর্থ: “যে ধন সম্পদ তোমরা ব্যয় কর তা তোমাদের নিজেদের কল্যাণের জন্যই এবং তোমরা তো শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই ব্যয় করে থাক। যে সম্পদ তোমরা ব্যয় কর তার পুরষ্কার তোমাদেরকে পুরোপুরিভাবে প্রদান করা হবে এবং তোমরা সামান্য পরিমাণও প্রবঞ্চনার শিকার হবে না” ( সূরা বাকারা:২৭২)।
الَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوَالَهُم بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ سِرًّا وَعَلَانِيَةً فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ [٢:٢٧٤]
অর্থ: “ (যারা দিবারাত্র গোপনে ও প্রকাশ্যে নিজেদের সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তার পুরষ্কার পাবে তাদের প্রতিপালকের নিকট)। তাদের জন্য না আছে কোন ভয়, আ না আছে দুশ্চিন্তা”( সূরা বাকারা: ২৭৪)।
কুরআন মজীদ আমাদের বলে যে, ধনসম্পদ ব্যয় (দান) করলে কমে না, বরং বাড়ে, এটা ক্ষতির নয়, বরং সম্পূর্ণ লাভের পণ্য। এটা গ্রহণকারীর প্রতি নয়, বরং দাতার নিজের উপর অনুগ্রহ। কেননা চক্রবৃদ্ধিহারে এর লাভ তার কাছেই ফিরে আসবে। আর আখেরাতে আল্রাহর সন্তুষ্টি ও নিজের সৌভাগ্যের উপায় হয়ে চিরস্থায়ী শাস্তির সেই মহাপুরষ্কারের যোগ্য করে দিবে, যা অর্জন করাই মুসলমানদের জীবনের আসল উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখলে তা দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানে ধ্বংস বরবাদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এই বিষয়বস্তু সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াতের তরজমা উল্লেখ করা হল:
১.“আর (মুমিনগণ) আল্লাহর ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অভাবগ্রস্থ, ইয়াতীম ও বন্দীদের আহার্য দান করে এবং বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় আমরা তোমাদের আহার করাচ্ছি, আমরা তোমাদের কাছে প্রতিদান আশা করি না; কৃতজ্ঞতাও নয়। আমরা আশংকা করি আমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে এক ভয়ংকর দিনের যা হবে কঠিন বিপদে পূর্ণ ও দীর্ঘ। আল্লাহ তাদেরকে রক্ষা করবেন সেদিনের অনিষ্ট হতে এবং তাদেরকে দান করবেন উৎফুল্লতা ও আনন্দ” (সূলা দাহর:৮-১১)।
২. “যারা নিজেদের ধন সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তা একটি শস্যবীজতুল্য যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে একশত শস্যদানা। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বহু গুণে বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ” (সূরা বাকারা: ২৬১)।
৩. “যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নিজেদের আন্তরিক ঐকান্তিকতার সাথে ধন সম্পদ ব্যয় করে তাদের উপমা কোন উচ্চভূমিতে অবস্থিত একটি উদ্যান, যাতে মুষলধারে বৃষ্টি হয়, ফলে তার ফলমূল দ্বিগুণ জন্মে। যদি মুষলধারে বৃষ্টি না হয় তবে লঘু বৃষ্টিই যথেষ্ট” ( সূরা বাকারা: ২৬৫)।
৪. “কে সে,যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান করবে? তিনি তার জন্য তা বহু গুণে বৃদ্ধি করবেন। আর আল্লাহ (জীবিকা) সংকুচিত সম্প্রসারিত করেন এবং তার দিকেই তোমরা ফিরে যাবে” ( সূরা বাকারা: ২৪৫)।
৫. “যারা সোনা রূপা পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও। যে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দিয়ে তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে। (সেদিন বলা হবে) এতো সেই সোনা রূপা যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করে রেখেছিলে” (সূরা তওবা:৩৪-৩৫)।
৬. “আল্লাহ যাদেরকে আপন কৃপায় প্রাচুর্য দান করেছেন তারা তা ব্যয় করার ক্ষেত্রে কৃপণতা অবলম্বন করাকে যেন তাদের জন্য কল্যাণকর মনে না করে, বরং তা তাদের জন্য সম্পূর্ণই অনিষ্টকর। যাতে তারা কৃপণতা করছে তাই কিয়ামতের দিন বেড়ি হিসাবে গলায় পরিয়ে দেওয়া হবে” ( সূরা আল ইমরান: ১৮০)।
৭. “যে ধন সম্পদ সঞ্চয় করে এবং তা বারবার গণনা করে যে, তার অর্থ সম্পদ তাকে অমর করে রাখবে; কখনও নয়, সে অবশ্যই হৃদয়গ্রাসী প্রজ্জ্বলিত আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে” ( সূরা হুমাযাহ ২-৪)।
ধন সম্পদ ব্যয় করার প্রতি অসাধারণ তাকীদ দেওয়ার এবং কৃপণতা পরিহার করার উপদেশ দেওয়ার সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের জন্য ব্যয়ের ভারসাম্যপূর্ণ পন্থাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন যাতে তারা প্রান্তিকতার শিকার না হয়।
(আরবী***)
অর্থ: “হে আদম সন্তান! প্রত্যেক নামাযের সময় সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান কর, পানাহার কর এবং অপচয় কর না। তিনি অপচয়কারীদের পসন্দ করেন না” ( সূরা আরাফ: ৩১)।
এখানে সৌন্দর্যমন্ডিত হওয়ার অর্থ উপযুক্ত পোশাক যা শুধুমাত্র গোপন অংগ-প্রত্যংগসমূহ আবৃত করার প্রয়োজনই পূরণ করবে না, বরং এগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নও হতে হবে। তাছাড়া পানাহারের যে স্বাভাবিক চাহিদা রয়েছে তাও পূর্ণ করতে হবে। অবশ্য পোশাক-পরিচ্ছদ ও পানাহার সামগ্রী ও অন্যান্য জীবনোকরণের ব্যাপারে অপব্যয় করা যাবে যাবে না। কেননা আল্লাহ তাঁর দেওয়া সম্পদের অপব্যবহার পসন্দ করেন না। এই আয়াতের পরপরই কৃচ্ছতাসাধন ও বৈরাগ্য পরিহার করার আদেশ দিয়ে বলা হয়েছে:
“(হে মুহাম্মাদ) বল, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যে সব শোভার বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে? বল পার্থিব জীবনে বিশেষ করে কিয়ামত দিবসে এই সমস্ত তাদের জন্যই যারা ঈমান এনেছে” (আরাফ: ৩২)।
এই সাধারণ বিধান ও নির্দেশ দেওয়ার সাথে সাথে সমাজের সদস্যদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং তাদের সুখ সাচ্ছন্দ্যের জন্য ইসলাম যে বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে তা সংক্ষেপে নিম্নে উল্লেখ করা হল:
১. সমাজের প্রতিটি সদস্যকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে পূর্ণরূপে ও ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যাতে সে অন্যের গলগ্রহ না হয়।
২. (আরবী***) “মানুষ তাই পায় যার জন্য সে শ্রমসাধনা করে” (সূরা নাজম:৩৯) অর্থাত মানুষ তার চেষ্টার বিনিময় পাবেই।
৩. হালাল-হারাম ও জায়েয নাজায়েযের সীমা নির্ধারণ করে চেষ্টা সাধনা ও কর্মের ক্ষেত্র বা গন্ডি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সূদ-ঘুষ, শরাব, জুয়া, চুরি, লাম্পট্যপনা, কদর্য ও চরিত্রবিধ্বংসী জিনিসপত্রের আমদানী, নিষিদ্ধ দ্রব্যাদির ব্যবসা, ভেজাল, ওজনে কম দেওয়া, চোরাচালান, মজুতদারী এবং এই জাতীয় অন্যান্য ততপরতার উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে সমাজ থেকে লুটপাট ও নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপের মূলোৎপাটন করা হয়েছে এবং অর্থনৈতিক পোষণের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
৪. অর্জিত সম্পদ শরীআতের নিষিদ্ধ খাতসমূহে ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা, অপব্যয়ের নিষেধাজ্ঞা, বিলাসব্যসন ও ভোবাদিতার নিষেধাজ্ঞা এবং সম্পদ ধ্বংস করার নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে তা ভুল পথে ব্যয়িত হওয়া রূদ্ধ করা হয়েছে। তার সঠিক গতি তার প্রকৃত হকদারের দিকে ফিরিয়ে দিয়ে তাদেরকে অধিকার বঞ্চিত হওয়া থেকে রক্ষা করা হয়েছে।
৫. প্রত্যেক ব্যক্তির উপার্জনে অপরের অংশ নির্ধারণ করে একে সমষ্টিগতভাবে লালন পালন ব্যবস্থার সহায়ক শক্তিতে পরিণত করা হয়েছে। শরীআতের দৃষ্টিতে তার নির্ধারিত দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো নিম্নরূপ:
ক. অত্যাবশ্যকীয় ভরণপোষণ: পিতা মাতা, স্ত্রী, পুত্র, পরিজন, দাদা, দাদী, নানা, নানী, নাতি নানী, পৌত্র পৌত্রী, ভাই বোন, ফুফু ভাইঝি এবং রক্ত সম্পর্কীয় নিকট আত্মীয় স্বজনের ভরণপোষণ।
খ. কুরআন মজীদে নির্দেশিত অভাবী ব্যক্তিদের সাহায্যের জন্য যাকাত আদায়। যাকাতের অর্থ দ্বারা ফকীর, মিসকীন ও যাকাতের অর্থ আদায়কারীদের প্রয়োজন মেটানো হবে। নওমুসলিমের সাহায্য করতে হবে। দুস্থ অথবা মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে ব্যয় হবে, আল্রাহর রাস্তায় জিহাদকারী, ছাত্র এবং অন্যান্য অভাবগ্রস্থদের অভাব মোচনে ব্যয় হবে। আর যেসব পথিকের কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই তাদের মদদ করা হবে।
গ. অধিক সম্পদ ব্যয়: বংশের লোকজন ও নিকট আত্মীয়-স্বজনের তত্ত্বাবধান। যাকাত আদায়ের পরও বিত্তবানদের দায়িত্ব রয়েছে। তারা দুস্থ ও অভাবীদের সাহায্যদানের জন্য দান খয়রাত করবে। মহানবী সা: বলেন: “যাকাত ছাড়াও তোমাদের সম্পদে আরও অধিকার রয়েছে” (মুসনাদে দারিমী, তিরমিযী ও মুসলিম)।
হাদীসের রাবী হযরত ফাতিমা বিনতে কায়স রা: থেকে বর্ণিত আছে যে, রসূলে করীম সা: এই জায়গায় সূরা বাকারার সেই আয়াত তিলাওয়াত করেছেন যেখানে বলা হয়েছে:
“পূর্ব ও পশ্চিমদিকে তোমাদের মুখ ফিরানোতে কোন পূণ্য নেই। বরং আসল পূণ্য এই যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের প্রিয়বস্তু খরচ করবে” ( দ্র. আয়াত ১৭৭- সূরা বাকারা)।
এই প্রসঙ্গে কুরআন মজীদে এই নির্দেশও রয়েছে যে, নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ অন্য অভাবীকে দিয়ে দাও” ( সূরা বাকারা:২১৯)।
অতিরিক্ত সম্পদ ব্যয় করার তিনটি খাত অপরিহার্য গণ্য করা হয়েছে। এক সেই মুসাফির যে পানাহার প্রার্থী হয়; দুই সেই অভাবী যে ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে দেয়; তিন সেই বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি যে অত্যন্ত কঠিন ও অস্বাভাবিক অবস্থার শিকার হয়েছে। যেমন ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত, উলংগ, তীব্র শীত কিংবা প্রচন্ড গরম অথবা বৃষ্টিজনিত বিপদ থেকে বাঁচার প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাবী, কিংবা অসুখ-বিসুখের দরুন ঔষধ ও পথ্যের মুখাপেক্ষী।
অক্ষম ও দূর্ভিক্ষ পীড়িত ব্যক্তির কুরআন নির্দেশিত অধিকার নিম্নোক্ত আয়াতগুলোতে লক্ষণীয়।
“অন্ধের জন্য কোন দোষ নেই, খঞ্জের জন্য কোন দোষ নেই, রুগ্নের জন্য কোন দোষ নেই এবং তোমাদের নিজেদের জন্যও দোষ নেই আহার করা নিজেদের ঘরে অথবা তোমাদের পিতৃগণের ঘরে, অথবা তোমাদের মায়েদের ঘরে, খালাদের ঘরে অথবা সেই ঘরে যার চাবির মালিক তোমরা, কিংবা তোমাদের বন্ধুদের ঘরে” ( সূরা নূর: ৬১)।
এই আয়াতের আলোকে অন্ধ, খঞ্জ, রোগাক্রান্ত এবং এমন সব অপারগ ব্যক্তির জন্য যারা উপার্জনে একেবারেই অসমর্থ প্রত্যেক মুসলমানের ঘরের দরজা খোলা রয়েছে। তারা যেখানে ইচ্ছা খাদ্য প্রার্থনা করতে পারে। কুরআন মজীদ একজন সাধারণ লোকের জন্যও একটি নয়, বরং অনেক দরজা খুলে দিয়েছে। সে নিজের ঘর ছাড়া মাতা পিতা, দাদা দাদী, ভাই বোন, চাচা ফুফু, মামা খালা, অথবা বন্ধু-বান্ধব মহলে কিংবা যারা তাকে ঘরের চাবি দিয়েছে তাদের যে কোন একজনের ঘরে বিনা দ্বিধায় আহার্য গ্রহণ করতে পারে, যেমনটি পারে সে তার নিজের ঘরে। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় কোন ব্যক্তির জন্যই ক্ষুধার্ত, বস্ত্রহীন, মাথা গোঁজার ঠাঁই এবং স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত থাকার কোন সম্ভাবনা নেই।
ঘ. ধারকর্য দেওয়া: বিত্তশালীদের প্রতি ইসলামের নির্দেশ এই যে, তারা যেন প্রয়োজনের সময় খোলা মনে অভাবীদের ঋণ দেয় এবং কোন জিনিস ধার চাইলে তা দিতে যেন অসম্মত না হয়। কোন মানুষের জন্য শোভনীয় নয় যে, তার ভাই তার নিকটে ঋণ চাইতে এলে ঋণ দেওয়ার সামর্থ থাকা সত্ত্বেও সে তাকে তা দিতে অস্বীকার করে (কানযুল উম্মাল, ৩য় খন্ড, হাদীস ৩৫৮১)।
“ঋণ দেওয়া দান খয়রাত তুল্য” ( তাবারানীর আল মুজামুস সগীর, পৃষ্ঠা ৮০)।
ইতিপূর্বে সূরা মাঊনের উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে মামুলী ধরণের নিত্যপ্রয়োজনীয় ক্ষুদ্র বস্তু ধার দিতে অস্বীকারকারীকে কঠোর শাস্তির হুমকি দেওয়া হয়েছে।
ঙ. উত্তরাধিকার স্বত্ব, অসীয়ত, মোহরের আকারে ও তালাকের ক্ষেত্রে স্ত্রী, পুত্র, পরিজনের জন্য নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত ভরণপোষণ ইত্যাদি, উত্তরাধিকার আইনের আওতায় কোন ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তি তার মৃত্যুর পরে শরীআতের নির্ধারিত ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টিত হয়ে যাবে এবং মৃতের পরিত্যক্ত সম্পদের এক তৃতীয়াংশ তার অসিয়ত পূরণের জন্য থাকবে। সে যাদের জন্য অসিয়াত করে যাবে তারা এই এক তৃতীয়াংশ থেকে অংশ পাবে।
কোন মানুষের উপার্জিত সম্পদে তার অধীনস্থদের ভরণ পোষণ, নিকট আত্মীয়-স্বজন সমাজের সাধারণ অভাবগ্রস্ত লোক এবং ওয়ারিশদের অর্থনৈতিক অধিকারগুলোর বিস্তারিত হিসাব করে দেখলে তা (মাল) হাজারো ব্যক্তি পর্যন্ত গিয়ে গড়াবে। এই ভাবে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় প্রত্যেকের উপার্জন এমন একটি দানের প্রস্রবণ পরিণত হয় যা থেকে অগণিত মানুষ পিপাসা নিবারণ করতে পারে এবং সে নিজেও অন্যের প্রস্রবণ থেকে তৃষ্ণা মেটাতে পারে।
সেখানে এ ধরণের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বর্তমান রয়েছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তি অন্যান্য শত শত ব্যক্তিকে সামাল দিতে থাকে এবং তারা পরষ্পরের আশ্রয়ে পরিণত হয়ে যায় সেখানকার অবস্থা অনুমান করে দেখুন যে, কতজন এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে যারা প্রকৃতপক্ষে অন্ন বস্ত্র বাসস্থান চিকিতসার মৌলিক চাহিদা পূরণ হওয়া থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে।
ইসলামে সমষ্টিগত ভরণপোষণের পন্থা এই নয় যে, রাষ্ট্র সমস্ত সম্পদের মালিকানা নিজের কুক্ষিগত করে জাতির প্রতিটি সদস্যকে নিজের বেতনভূক্ত কর্মচারীতে পরিণত করে এবং তাদের সর্বপ্রকার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করে তাদের নিকট থেকে ইচ্ছামাফিক কাজ আদায় করে নেবে এবং জোরপূর্বক আদায়কৃত শ্রমের বিনিময়ে তাদেরকে ক্রীতদাসের মত ভাত, কাপড়, চিকিৎসা এবং মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে দেবে। পক্ষান্তরে এখানে সর্বসাধারণের ভরণপোষণ সামাজিক সুবিচারের (সোস্যাল জাস্টিস) এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যে, প্রত্যেক মানুষ শরীআতের নির্ধারিত সীমায় অবস্থান করে অধিকতর সম্পদ উপার্জন করতে পারবে, নিজের প্রয়োজনে ন্যূনতম ব্যয় করবে এবং প্রয়োজন পূরণের পরে যা কিছু উদ্বৃত্ত থাকবে সমাজের দু:স্থ ও অভাবী লোকদেরকে তা হস্তান্তর করে তাদের জীবনের মানোন্নয়নে সাহায্য করবে, যাতে এই কার্যক্রমের বদৌলতে পর্যায়ক্রমে সামাজিক বৈষম্যের প্রাচীর খতম হয়ে যায় এবং সামাজিক ভারসাম্য ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। নবী করীম সা: এই ধরণের অর্থনৈতিক প্রচেষ্টাকে জিহাদ আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন: “আল্লাহর জন্য দান খয়রাতের প্রচেষ্টা তাঁর পথে জিহাদ করার মতই” ( ইবনে তাইমিয়া, সিয়াসাতে শরীআ, উর্দু অনু. পৃ. ১১১)।
অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও কর্তব্যের পূর্বে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও দায়িত্বের কিছুটা সবিস্তার আলোচনার এ জন্য প্রয়োজন ছিল যে, ইসলামে অন্যান্য মৌলিক অধিকারের মত অর্থনৈতিক নিরাপত্তা লাভের এই অধিকারটিরও শুধুমাত্র ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের পারষ্পরিক সম্পর্কের চৌহদ্দি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়, বরং এক ব্যক্তি থেকে নিয়ে বংশ, পরিবার, গোত্র, ছোটবড় সংঘসমূহ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সরকার পর্যন্ত সকলের উপর নিজ নিজ উপায় উপকরণ ও যোগ্যতার পরিমাণ অনুপাতে অর্পিত হয়ে থাকে। এই ব্যাপারে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মূল্যায়ন করা যাক।
রাষ্ট্রের সর্বপ্রথম দায়িত্ব এই যে, সমাজে অবৈধ উপার্জনের সমস্ত উৎস বন্ধ করা, হালাল উপার্জনের পথ সম্প্রসারিত করা এবং নিজের অর্থনৈতিক ও শিক্ষা সম্পর্কিত পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রত্যেক নাগরিককে হালাল উপার্জনের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগদান করে অর্থনৈতিক প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণের যোগ্য করে তোলা।
রাষ্ট্রের দ্বিতীয় দায়িত্ব হচ্ছে, সে জনগণকে আল্লাহর নির্দেশিত অধিকার সমূহ আদায়ের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে, কোন ছেলে পিতার ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে অস্বীকার করলে আইন প্রয়োগ করে তাকে এই দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা, কোন স্বামী তার স্ত্রীর ভরণপোষণ, তার মোহর কিংবা সন্তানদের প্রাপ্য আদায়ে অস্বীকৃত হলে তাকে এইসব অধিকার আদায়ে বাধ্য করা। মোটকথা যার যে অধিকার প্রাপ্য হয় তা আদায়ের নিশ্চয়তা বিধান করা।
রাষ্ট্রের তৃতীয় দায়িত্ব হচ্ছে, যাকাতের বিধান কায়েম করে যাকাত দাতাদের নিকট থেকে যাকাত আদায় করে প্রাপকদের কাছে পৌঁছানো, কিংবা তাদের কল্যাণ ও হিতার্থে আদায়কৃত অর্থ ব্যয় করা।
রাষ্ট্রের চতুর্থ দায়িত্ব হচ্ছে, যার কোন তত্ত্বাবধায়ক নেই তার তত্ত্বাবধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করা।
নবী করীম সা: বলেছেন: “যার কোন অভিভাবক নেই, আল্লাহ ও তাঁর রসূল তার অভিভাবক” (তিরমিযী)।
এভাবে তিনি মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ এবং তার রেখে যাওয়া অসহায় সন্তান সন্তুতির লালন পালনের দায়িত্বও ইসলামী সরকারের উপর ন্যস্ত করে দিয়েছেন। তিনি বলেন: “যে মুসলমান ব্যক্তি ঋণ রেখে মৃত্যুবরণ করেছে তা পরিশোধের দায়িত্ব আমার উপর এবং তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির মালিক হবে তার ওয়ারিসগণ” ( বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ)।
“যে ব্যক্তি ধন সম্পদ রেখে গেল তা তার পরিবারের সদস্যদের জন্যই। আর যে ব্যক্তি কাউকে নি:সম্বল রেখে গেল তার দায়িত্ব আমার উপর” (তিরমিযী, আবু দাউদ)।
হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা: কে ইয়ামানের গভর্ণর হিসেবে পাঠানোর সময় মহানবী সা: ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দায়িত্ব প্রসঙ্গে এই নীতিমালা বর্ণনা করেন: “তাদের জানিয়ে দেবে যে, আল্লাহ তাদের সম্পদে যাকাত নির্ধারণ করেছেন যা তাদের মধ্যকার বিত্তশালীদের থেকে আদায় করা হবে এবং তাদের অভাবীদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হবে” (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ)।
এই অর্থনৈতিক নিরাপত্তা শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট নয়; অমুসলিম নাগরিকরাও এতে সমান অংশীদার। হযরত উমার রা: এক ইহুদীকে ভিক্ষা করতে দেখে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। প্রথমে তিনি তাকে ব্যক্তিগতভাবে কিছু দান করেন, অত:পর বায়তুল মালের কোষাধ্যক্ষকে ডেকে এনে তার এবং তার মত অন্যান্য অভাবীদের দৈনিক ভাতা নির্ধারণের নির্দেশ দেন এবং বলেন:
“আল্লাহর শপথ! আমরা তাদের যৌবনকালে ( অর্থাৎ কর্মক্ষম থাকাকালে) তাদের থেকে জিযয়া আদায় করে ভোগ করব এবং তাদের বার্ধক্যে তাদেরকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেব- এটা কখনও সুবিচার হতে পারে না” ( ড. নাজাতুল্লাহ সিদ্দিকী, ইসলাম কা নাযরিয়ায়ে মিলকিয়াত, ১৯৬৮ খৃ. ২য় খন্ড, পৃ. ১১০)।
হযরত উমার রা: তাঁর খিলাফতকালে নাগরিকদের অর্থনৈতিক অধিকার প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত প্রয়োজনগুলো পূরণের দায়িত্ব সরকারের উপর অর্পণ করেন:
১. ভরণপোষণের প্রয়োজনীয় সামগ্রী,
২. শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন পোশাক,
৩. যাতায়াত, হজ্জ, এবং যুদ্ধের বাহন-(হামেদ আল আনসারী, ইসলাম কা নিযামে হুকুমাত, দিল্লী ১৯৫৬ খৃ. ৩৯৮)।
তাঁর শাসনামলে সাধারণ নাগরিক থেকে সদ্যজাত শিশু পর্যন্ত সকলেই বায়তুল মাল থেকে নির্ধারিত ভাতা পেত। এভাবে তাদেরকে অর্থ কষ্টের শোচনীয় অবস্থা থেকে পুরোপুরিভাবে মুক্তি দিয়েছিলেন। বায়তুল মালের এরূপ ব্যবহার হযরত উসমান রা: ও হযরত আলী রা:-র খিলাফতকালেও অব্যাহত থাকে।
আজকের ইসলামী রাষ্ট্র উক্ত মূলনীতির ভিত্তিতে নিজের উপায় উপকরণ ও নাগরিকদের ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখে অর্থনৈতিক অধিকার নির্ধারণ করতে পারে। ইসলাম রাষ্ট্রকে এই এখতিয়ারও দান করে করেছে যে, যদি সাধারণ নাগরিকের করসমূহ সামগ্রিক কল্যাণ ও জনগণের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পূরণে যথেষ্ট না হয় তাহলে সে অতিরিক্ত কর ধার্য করে তাদের জন্য উপায়-উপকরণের ব্যবস্থা করতে পারে।১
১. বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন “ইসলাম কা নযরিয়ায়ে মিলকিয়াত” ড. মুহাম্মাদ নাজাতুল্লাহ সিদ্দীকী; ‘ইসলাম মে আদলে ইজতিমায়ী’, ‘সায়্যিদ কুতুব শহীদ’- ড. মুহাম্মাদ নাজাতুল্লাহ সিদ্দীকী; ‘ইসলাম আওর জাদীদ মাআনী নযরিয়াত’ মাওলানা আবুল আলা মওদুদী, ‘ইসলাম কা ইকতিসাদী নিযাম’; মাওলানা হিফযুর রহমান, ইসলাম কা ইকতিসাদী নিযাম, এবং ইসলাম কা নিযামে হুকুমাত, মাওলানা হামেদ আল আনসারী গাযী।
অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ইসলামী রাষ্ট্রের মেজাজ, ভূমিকা এবং তার দায়িত্বানুভূতি হযরত উমার রা: এক ভাষণে এবং হযরত উমার ইবনে আবদুল আযীয রহ: এর এক সরকারী পত্রের দর্পণে লক্ষ্য করা যেতে পারে। হযরত উমার রা: জাতীয় সম্পদ বণ্টন প্রসঙ্গে নিজের জিম্মাদারীর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন:
“আল্লাহর শপথ! আমি যদি জীবিত থাকি তাহলে ‘সানআর পার্বত্য অঞ্চলে মেষচালকও স্বস্থানে বসে তার অংশ পেয়ে যাবে তার চেহারায় বিষন্নতার ছাপ ব্যতিরেকে (তাঁর এ কথার তাৎপর্য এই যে, নিজের অধিকার লাভের জন্য তাকে দৌড়ঝাপ করতে হবে না যাতে সে অবসর হতে পারে)” (কিতাবুল খারাজ, পৃ. ২১২)।
হযরত উমার ইবনে আবদুল আযীয রহ: এবং ইরাকের গভর্ণর আবদুল হামীদ ইবনে আবদুর রহমানের মধ্যে বাইতুল মালে জনগণের অর্থনৈতিক অধিকার সম্পর্কে নিম্নলিখিত পত্র বিনিময় হয়েছিল:
হযরত উমার ইবনে আবদুল আযীয রহ: ইরাকের গভর্ণর আবদুল হামীদ ইবনে আবদুর রহমানকে লিখেন: “জনগণকে তাদের ভাতা দিয়ে দাও।” এই চিঠির জবাবে আবদুল হামীদ লিখেন, “আমি জনগণের নির্ধারিত ভাতা পরিশোধ করেছি এবং তারপরও বায়তুল মালে অর্থ উদ্বৃত্ব রয়েছে।” তদুত্তরে উমার ইবনে আবদুল আযীয রহ: লিখলেন: “এখন ঋণগ্রস্ত লোকদের তালাশ কর, তারা কোন অপব্যয় কিংবা অসৎ কাজের জন্যে ঐ ঋণ গ্রহণ না করে থাকলে বায়তুল মালের উদ্বৃত্ত তহবিল থেকে তাদের ঋণের পরিশোধের ব্যবস্থা কর।”
এর জবাবে আবদুল হামীদ খলীফাকে লিখলেন: “আমি এরূপ ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের ঋণও পরিশোধ করে দিয়েছি। অথচ এখনও বায়তুল মালে যথেষ্ট অর্থ অবশিষ্ট আছে। জবাবে উমার ইবনে আবদুল আযীয লিখলেন: “এখন এমন অবিবাহিত যুবকদের তালাশ কর, যারা নি:সম্বল এবং তারা পছন্দ করে যে, তুমি তাদের বিবাহের ব্যবস্থা করে দাও। তাহলে তুমি তাদের বিবাহের ব্যবস্থা করে দাও এবং তাদের দায়িত্বে অবশ্য দেয় মোহর আদায় করে দাও।” জবাবে আবদুল হামীদ লিখলেন: “আমি তালাশ করে যত অবিবাহিত যুবক পেয়েছি তাদের বিবাহের বন্দোবস্ত করে দিয়েছি। তা সত্ত্বেও বায়তুল মালে প্রচুর অর্থ মজুদ রয়েছে।”
জবাবে উমার ইবনে আবদুল আযীয রহ: লিখলেন: এখন এমন লোক তালাশ কর যাদের উপর জিযয়া ধার্য করা হয়েছে এবং তাদের জমি চাষাবাদ করতে পারছে না। এসব জিম্মিদের এতটা পরিমাণ ঋণ দাও যাতে তারা তাদের ভূমি সঠিকভাবে চাষাবাদ করতে পারে। কেননা তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক এক দুই বছরের জন্য নয়” ( কিতাবুল আমওয়াল, ১ম খন্ড, পৃ. ৪১৪)।
১৩. পাপাচার থেকে বেঁচে থাকার অধিকার
ইসলাম তার রাষ্ট্রীয় সীমার মধ্যে বসবাসকারী নাগরিকদের এই অধিকার দিয়েছে যে, তারা এমন আদেশ অমান্য করতে পারবে যা পালন করলে পাপাচারে লিপ্ত হতে হয়। এই ধরণের আনুগত্যে অস্বীকৃতি ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ নয়, বরং এই ধরণের নির্দেশ পালন অপরাধকর্মে সাহায্য করার শামিল। কেননা পাপাচারের নির্দেশদাতা খোদ সর্বশক্তিমান আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবে। তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করা যেতে পারে। আদালত কেবল আনুগত্যে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী আইনগত নিরাপত্তাই বিধান করবে না, বরং সাথে সাথে পাপাচারের নির্দেশদাতার যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবে। এই প্রসঙ্গে কুরআন মজীদের অনুশাসন এবং নবী করীম সা: এর হাদীস সমূহ আমরা ‘আনুগত্যের সীমা’ শিরোনামের অধীনে সবিস্তারে আলোচনা করেছি। তার সারসংক্ষেপ নিম্নে বর্ণিত দুটি হাদীসে পাওয়া যাবে।
“সৃষ্টিকর্তার নাফরমানীতে কোন সৃষ্টির আনুগত্য নেই” ( কানযুল উম্মাল, ৬ খন্ড, পৃ. ৬৭, হাদীস ১৪৮৭৫)।
আল্লাহ ও রসূলের নাফরমানীর আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত শাসকদের নির্দেশ পালন করা জরুরী। তবে যদি সে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের অবাধ্যতামূলক নির্দেশ দেয় তখন তার নির্দেশ মানবে না এবং শুনবে না” (বুখারী)।
১৪. সংগঠন ও সভা -সমাবেশ করার অধিকার
ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ‘আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার’ ( ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধ) এর মৌলিক শর্তের অধীনে নাগরিকগণ ‘সংগঠন’ কায়েম ও সভা সমাবেশ করার অধিকার লাভ করবে। কুরআন মজীদে মুসলিম জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য এই একটি আয়াতেই পূর্ণরূপে প্রকাশ করা হয়েছে :
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ ۗ
“তোমরা সর্বোত্তম জাতি, মানব জাতির হেদায়াত ও সংশোধনের জন্য তোমাদের আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে, তোমরা ন্যায়ের আদেশ দেবে, অন্যায়ের প্রতিরোধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে” ( সূরা আল ইমরান:১১০)।
এ হচ্ছে সমগ্র উম্মাতের সামষ্টিক দায়িত্ব। কিন্তু সমস্ত মুসলমান যদি সম্মিলিতভাবে একাগ্রচিত্তে মনোযোগের সাথে আগ্রহভাবে এই দায়িত্ব পালন না করে তাহলে অন্তত: তাদের মধ্যে এমন একটি প্রাণবন্ত ও দায়িত্বশীল দল বর্তমান থাকা উচিত যারা এই কাজের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করে দেবে। সুতরাং ইরশাদ হচ্ছে:
وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ ۚ
“তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল অবশ্যই থাকা উচিত যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎ কাজের নির্দেশ দিবে ও অসৎ কাজের প্রতিরোধ করবে” (সূরা আল ইমরান:১০৪)।
যদি ইসলামী রাষ্ট্রে কতিপয় লোক ‘ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধ’-এর এই দায়িত্ব পালনের জন্য নিজেদের কোন সুশৃঙ্খল সংগঠনের সদস্য করে নিতে চায় এবং এই লক্ষ্য অর্জনে তারা সাংগঠনিক প্রয়োজনীয়তা অথবা জনসাধারণের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির জন্যে ঐক্যবদ্ধ হতে চায় তাহলে তাদের সেই অধিকার থাকবে। নিজেদের ন্যায় সংগত অধিকারের সংরক্ষণ, অভিযোগ খন্ডন এবং সমস্যার সমাধানের জন্য প্রতিষ্ঠিত সংগঠন এবং সেই সংগঠনের সভা-সমাবেশের উপরও এই নীতি কার্যকর হবে। তবে শর্ত এই যে, কল্যাণের বিস্তার ও অকল্যাণের প্রতিরোধ করাই সেই সাংগঠনিক তৎপরতা ও সভা সমাবেশের মূল লক্ষ্য হতে হবে।
১৫. রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের অধিকার
ইসলামের খিলাফত ( রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া) যেহেতু কোন বিশেষ ব্যক্তি, দল, বংশ, গোত্র কিংবা শ্রেণীকে নয়; বরং সামষ্টিকভাবে গোটা মুসলিম উম্মাহকে দান করা হয়েছে ,তাই ‘খলীফাতুল্লাহ’ ( আল্লাহর প্রতিনিধি) হওয়ার কারণে প্রত্যেক মুসলমানের রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের পরিপূর্ণ অধিকার রয়েছে। তাই ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য কুরআন মজীদ নিম্নোক্ত নীতিমালা স্থির করেছে:
(আরবী***)
অর্থ: “মুসলমানদের যাবতীয় কার্যকলাপ পারষ্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে চলবে’ ( সূরা শূরা: ৩৮)।
স্বয়ং নবী করীম সা: ওহীর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত লাভের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এবং কারও সাথে পরামর্শ গ্রহণের মুখাপেক্ষী না হওয়া সত্ত্বেও এই নির্দেশ পেয়েছেন:
(আরবী***)
অর্থ: “হে নবী! কাজে কর্মে তাদের (মুসলমানদের) সাথে পরামর্শ কর” ( সূরা আল ইমরান: ১৫৯)।
শূরার এই অর্থের মধ্যে ইসলামী রাষ্ট্রের নিম্নোক্ত রাজনৈতিক নীতিমালা অন্তর্ভূক্ত রয়েছে:
১.ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান (আমীর) এবং তার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যবৃন্দ সাধারণ নাগরিকের স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন।
২. জনসাধারণের জনপ্রতিনিধিদের সমালোচনা, তাদের সাথে মতপার্থক্য ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে।
৩. দেশের সার্বিক অবস্থা ও সমস্যাবলী যথার্থভাবে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরতে হবে যাতে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং নির্ভুল পরামর্শ দিতে সক্ষম হয়।
৪. জনগণ যাকে চাইবে সে-ই সরকার পরিচালনা করবে এবং যাকে তারা চাইবে না তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে।
১৬.স্থানান্তর গমন ও বসবাসের স্বাধীনতা
ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের তার পসন্দ মাফিক যে কোন স্থানে বসবাস করার, রাষ্ট্রীয় সীমানার ভেতরে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় দেশের বাইরে যে কোন অঞ্চলে যাতায়াত করার স্বাধীনতা রয়েছে। কুরআন মজীদে সাধারণ নাগরিকদের তাদের ঘরবাড়ী থেকে উচ্ছেদ করাকে চরম অন্যায় বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বণী ইসরাঈলের বিশ্বাসঘাতকতা এবং তাদের ঘরবাড়ী থেকে উচ্ছেদ করাকে চরম অন্যায় বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বনী ইসরাঈলের বিশ্বাসঘাতকতা এবং তাদের অপকর্মের বর্ণনা প্রসংগে ইরশাদ হচ্ছে:
ثُمَّ أَنتُمْ هَٰؤُلَاءِ تَقْتُلُونَ أَنفُسَكُمْ وَتُخْرِجُونَ فَرِيقًا مِّنكُم مِّن دِيَارِهِمْ تَظَاهَرُونَ عَلَيْهِم بِالْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَإِن يَأْتُوكُمْ أُسَارَىٰ تُفَادُوهُمْ وَهُوَ مُحَرَّمٌ عَلَيْكُمْ إِخْرَاجُهُمْ ۚ
অর্থ: “তোমরা তোমাদের সমগোত্রীয় কিছুসংখ্যক লোককে তাদের বসতি থেকে উচ্ছেদ করেছ, অন্যায়ভাবে তাদের বিরুদ্ধে পরষ্পরের পৃষ্ঠপোষকতা করেছ এবং তারা যখন যুদ্ধবন্ধীরূপে তোমাদের সামনে উপস্থিত হয় তখন তোমরা তাদের থেকে মুক্তিপণ আদায় কর, অথচ তাদের বসতি থেকে বহিস্কৃত করাই তোমাদের জন্য হারাম ছিল” ( সূরা বাকারা:৮৫)।
অনুরূপভাবে বাসস্থান ত্যাগ ও স্থানান্তর গমনের স্বাধীনতাও আল্লাহ তাঁর বান্দাদের দান করেছেন।
ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী***)
অর্থ: “আল্লাহর জমীনে কি প্রশস্ত ছিল না যেথায় তোমরা হিজরত করতে পারতে?” ( সূরা নিসা: ৯৭)।
(আরবী***)
অর্থ: “যে কেউ আল্লাহর পথে হিজরত করলে সে দুনিয়ায় বহু আশ্রয়স্থল এবং প্রাচুর্য লাভ করতে পারবে” (সূরা নিসা:১০০)।
ইসলাম কেবল বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ও দেশদ্রোহীদের জন্য বসতি থেকে উচ্ছেদের শাস্তি নির্ধারণ করেছে। কোন অবস্থায়ই সাধারণ নাগরিকদের এই শাস্তি দেওয়া যায় না। সূরা মায়িদায় আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের জন্য মৃত্যুদন্ড, শুলীবিদ্ধ করা এবং হাত পা কর্তনের শাস্তির সাথে নিম্নোক্ত শাস্তির কথাও ঘোষণা করা হয়েছে:
(আরবী***)
অর্থ: “অথবা তাদেরকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে” (সূরা মায়িদা: ৩৩)।
হযরত আলী রা:-র খিলাফতকালে খারিজী সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ ও অরাজকতা চরম আকার ধারণ করেছিল। কিন্তু তিনি তাদেরকে স্বাধীনভাবে চলাফেরা এবং ইচ্ছামত যেখানে সেখানে বসবাস করার অধিকার দিলেন। এক রাষ্ট্রীয় ফরমানে এই অধিকারের নিশ্চয়তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন:
“তোমরা স্বাধীন, তোমরা মুক্ত, যেথায় ইচ্ছা বসবাস করতে পারবে। অবশ্য আমাদের ও তোমাদের মধ্যে এই প্রতিশ্রুতি থাকল যে, তোমরা অবৈধ পন্থায় কারো রক্ত প্রবাহিত করতে পারবে না, বিপর্যয় সৃষ্টি করবে না, এবং কারো প্রতি অন্যায়-অত্যাচার চালাবে না। যদি উক্ত বিষয়াদির একটিও তোমাদের দ্বারা সংঘটিত হয় তবে আমি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করব” (ইসলাহী, ইসলামী রিয়াসাত, সিরিজ ৪, পৃ. ৩৪)।
১৭. পারিতোষিক ও বিনিময় লাভের অধিকার
ইসলামী রাষ্ট্রে শ্রমিক, চাষী এবং অন্যান্য শ্রমজীবীকে কেউ বিনা পারিশ্রমিকে খাটাতে পারবে না। তাদের শ্রমের ন্যায়সংগত পারিতোষিক তাদের দিতেই হবে। তাদের আর্থিক কিংবা দৈহিক ক্ষতিপূরণ করতে হবে। সামর্থের বাইরে তাদের উপর কাজের বোঝা চাপানো যাবে না, সর্বোপরি তাদের সাথে সৌজন্যমূলক আচরণ করতে হবে। সাথে সাথে কুরআন মজীদ শ্রমিকদের উপর এই দায়িত্ব অর্পণ করেছে যে, সে যেন তার চুক্তিকৃত মঞ্জুরীর বিনিময়ে উত্তম সেবা দান করে। তার পরিপূর্ণ শক্তি সামর্থ অর্পিত কাজে ব্যয় করতে হবে। তার তহবিলে যেসব আসবাবপত্র অর্পণ করা হবে সেগুলোকে আমানত মনে করে ব্যবহার করবে এবং একে তুচ্ছ মনে করা, চুরি, অবৈধ ব্যবহার কিংবা অন্য কোন পন্থায় বিনষ্ট করা যাবে না। একজন সৎকর্মশীল শ্রমিক সম্পর্কে কুরআন মজীদে ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী***)
অর্থ: “যে তোমার মজুর হিসাবে উত্তম হবে সে হল শক্তিশালী, বিশ্বস্ত” ( সূরা কাসাস: ২৬)।
হযরত শোআইব আ: হযরত মুসা আ:-কে চাকুরীর শর্তাবলী শোনানোর পরে একজন মালিক হিসাবে তাঁর দায়দায়িত্ব সম্পর্কে এই নিশ্চয়তা প্রদান করেছিলেন:
(আরবী***)
অর্থ: “আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আল্লাহর মর্জি তুমি আমাকে সদাচারী পাবে” (সূরা কাসাস:২৭)।
অর্থাত যেসব শর্তাবলী স্থিরিকৃত হয়েছে তা আমি যথাযথভাবে অনুসরণ করব। তার চাইতে অধিক শ্রম তোমার কাছে চাইব না এবং যে পারিতোষিক নির্ধারণ করা হয়েছে তার পুরোটাই পরিশোধ করব। এ ব্যাপারে তুমি আমাকে খাঁটি ও সদাচারী পাবে।
নবী করীম সা: শ্রমজীবীদের যেসব অধিকার নির্ধারণ করেছেন তন্মধ্যে সর্বপ্রথম অধিকার এই যে, “তাকে শুধু পূর্ণ মজুরীই প্রদান করা যথেষ্ট নয়, বরং যতটা সম্ভব ত্বরিৎ মজুরী পরিশোধ করবে। তিনি বলেছেন: “শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার মজুরী দিয়ে দাও” (বায়হাকী, ইবনে মাজা)।
আরেক হাদীসে উল্লেখ আছে যে, নবী করীম সা: ইরশাদ করেন: “কিয়ামতের দিন আল্লাহ তিন ব্যক্তির উপর অসন্তুষ্ট হবে: ১) যে ব্যক্তি আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করে তা ভঙ্গ করেছে, ২) যে ব্যক্তি কোন স্বাধীন লোককে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করেছে এবং ৩) যে ব্যক্তি শ্রমিক নিয়োগ করে তার কাছ থেকে পুরো কাজ আদায় করে নেয় অথচ মজুরী প্রদান করে না” (বুখারী)।
খাদেমে রসূল হযরত আনাস রা: বলেন: “রসূলে করীম সা: কোন কোন শ্রমিকের মজুরী কম দেননি” ( বুখারী)।
‘কাজের পারিতোষিক নির্ধারণ ব্যতিরেকে কোন শ্রমিককে কাজে নিয়োগ করবে না” (বায়হাকী, কিতাবুল ইজারা)।
অর্থাৎ শ্রমিকের বেতন যতক্ষণ পর্যন্ত স্থিরিকৃত না হবে এবং সন্তুষ্ট মনে সে তা গ্রহণ না করবে ততক্ষণ বলপূর্বক তাকে কাজে নিয়োগ করা যাবে না।
রসূলে করীম সা: শ্রমিককে মজুরীদান করার পরেও তাকে লাভের অংশ দেওয়ার জন্যও উপদেশ দিয়েছেন। ‘কর্মচারীদের তাদের কাজের লভ্যাংশ দাও। কেননা আল্লাহর শ্রমিকদের বঞ্চিত করা যায় না’ (মুসনাদে আহমাদ)।
মশহুর ফিকহ গ্রন্থ ‘হিদায়া’তে শ্রমিকের লভ্যাংশের কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ‘পূঁজিপতি তার মূলধন বা পুঁজি খাটানোর কারণে এবং শ্রমিক তার শ্রমের বিনিময়ে লাভের হকদার হয়ে থাকে’ (হিদায়া, কিতাবুল মুদারাবাহ)।
মজুরী ও কাজের শর্তাবলী নির্ধারণ প্রসঙ্গে নবী করীম সা: নিম্নোক্ত ‘নীতি’ নির্দিষ্ট করেছেন:
শ্রমিকদেরকে দেশে প্রচলিত রীতি অনুসারে উপযুক্ত আহার্য ও পোশাক পরিচ্ছদ দিতে হবে এবং তাদের উপর সামর্থ অনুসারে কাজের দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে (মুওয়াত্তা ইমাম মালিক)।
অর্থাৎ মজুরীর পরিমাণ এরূপ হবে যেন তা কোন দেশ ও যুগের স্বাভাবিক অবস্থা ও চাহিদা অনুযায়ী যুক্তিসংগত হয় এবং উপার্জনকারী তার উপার্জন দ্বারা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ অন্যান্য চাহিদাসমূহ পূরণ করতে পারে।
এক কথায় মালিক তার লালন পালনের পরিপূর্ণ যিম্মাদার।
একই সঙ্গে তিনি মালিক পক্ষের উপর এই বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছেন যে, মালিক তাদের ভরণপোষণের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করার অজুহাতে কর্মচারীদের উপর অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দিতে পারবে না। প্রখ্যাত ইসলামী রাষ্ট্রতত্ত্ববিধ আল মাওয়ারদী এই প্রসঙ্গে সরকারের দায়িত্ব বর্ণনা করেন: “সরকারী সুপারভাইজারের উচিত-যদি কোন পুরুষ অথবা নারী শ্রমিকের প্রতি অন্যায় আচরণ করা হয় তখন তিনি মালিককে এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন এবং তাদের সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ নিতে নিষেধ করবেন। অনুরূপভাবে মালিক তার ভারবাহী পশুকে যথারীতি আহার্য না দেয় কিংবা এদের থেকে সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ নেয় তাহলে তিনি তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন” ( আহকামুস সুলতানিয়্যা, পৃ. ২৪৪)।
হযরত উমার রা:-র অভ্যাস ছিল যে, “তিনি প্রত্যেক শনিবার মদীনার আশে পাশে তদারকি করতেন এবং কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কাজে নিয়োজিত দেখলে তার কাজের বোঝা লাঘব করে দিতেন” (মুওয়াত্তা ইমাম মালিক)।
আব্বাসী খলীফা আবু জাফর মানসূরের রাজত্বকালের একটি ঘটনা ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, মদীনার কাযী মুহাম্মাদ ইবনে ইমরান সমন জারী করে তাঁকে বাগদাদ থেকে মদীনায় তার আদালতে তলব করেন এবং উট রক্ষকদের সেই পরিমাণ বিনিময় প্রদান করেন যেই পরিমাণ হজ্জের মওসুমে আসবাবপত্র বহনের জন্য নির্ধারিত হয়েছিল, আমি জমিতে বীজ বপন করেছিলাম, সিরীয় বাহিনী এখান দিয়ে যাওয়ার সময় সেই ক্ষেতের ফসল পদতলে পিষে নষ্ট করে দেয়। তখন তিনি সেই কৃষককে বায়তুল মাল থেকে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ দশ হাজার দিরহাম দান করেছিলেন (কিতাবুল খারাজ, পৃ. ২৭৭)।
মালিকানা সত্বের বিনিময় সম্পর্কে এই কথা ‘মালিকানার অধিকার’ শিরোনামের অধীনে প্রথমেই আলোচিত হয়েছে যে, ইসলামী রাষ্ট্রে কোন ব্যক্তির বৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ ন্যায়সঙ্গত বিনিময় প্রদান ব্যতীত রাষ্ট্র তার মালিকানা অধিগ্রহণ করতে পারে না। সরকার জনহিতকর কার্যক্রম বাস্তবায়নের স্বার্থে তা মালিক থেকে বলপ্রয়োগে হাসিল করতে পারে, কিন্তু বল প্রয়োগে অর্জিত অধিকার ব্যবহার করতে গিয়ে সে মালিককে বিনিময় মূল্য প্রাপ্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না।