নৈতিক দিক
ইসলামে মৌলিক অধিকারের ইতিহাস ও তার আইনগত অবস্থার পর্যালোচনা করার পর এখন এসব অধিকারের নৈতিক দিকের পর্যালোচনা করে দেখা যাক। আমরা আইনগত অধিকার বলতে কেবল সেই সব অধিকার বুঝি যা মানব রচিত আইনের অধীনে আসে, যা প্রশাসন বিভাগের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য এবং বিচার বিভাগের মাধ্যমে অর্জনযোগ্য। যেমন জানমালের নিরাপত্তা এবং সংগঠন ও সমাবেশের স্বাধীনতা ইত্যাদি। কিন্তু যেসব অধিকার প্রশাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতার গন্ডির বাইরে এবং যেগুলো বলবৎ করার দায়িত্ব মানুষের বিবেক ও সংজ্ঞার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তার সবগুলোই নৈতিক অধিকার। যেমন রুগীর সেবা শুশ্রুষা, সাহায্যের মুখাপেক্ষী লোকদের সাহায্য-সহযোগিতাদান, মেহমানদের আদর-যত্ন, প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার ইত্যাদি। আইনগত অধিকার বাস্তবায়নের পেছনে রাষ্ট্রীয় শক্তি বিদ্যমান থাকে, কিন্তু নৈতিক অধিকারের বাস্তবায়ন মানুষের আভ্যন্তরীণ অবস্থার উপর নির্ভরশীল। ইমাম গাযালী রহ: নৈতিকতার সংজ্ঞায় বলেন: “চরিত্র বা নৈতিকতা মানুষের আভ্যন্তরীণ বা আন্তরিক অবস্থার নাম”- (মাওলানা হিফজুর রহমান, আখলাক আওর ফালসাফায়ে আখলাক, দিল্লী ১৯৬৪ খৃ. পৃ. ৪৪০, ইয়াহ উলুমিদ দীন এর বরাতে, ৩ খ. পৃ. ৫৬।
মানুষের এই আভ্যন্তরীণ অবস্থা যেহেতু পর্যবেক্ষণের আওতা বহির্ভুত এবং ইন্দ্রিয় জ্ঞান ও বোধ শক্তির ক্ষমতা বহির্ভুত, তাই আইন তাকে নিজের কর্মক্ষেত্রের মধ্যে শামিল করেনি। আইন প্রণয়ন এবং আইনের বাস্তবায়নের পরিধি মানুষের কেবল বাহ্যিক ও পর্যবেক্ষণযোগ্য কার্যকলাপের সীমায় এসে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এসব কার্যকলাপের আভ্যন্তরণী অনুপ্রেরণাদায়ী শক্তি এবং এক ব্যক্তির মানসিক জীবনের গঠন ও নির্মাণে অংশগ্রহণকারী চিন্তা চেতনা, আকীদা বিশ্বাস ও ঝোঁক প্রবণতার সাথে আইনের কোন সম্পর্ক নেই। এগুলো হলো নৈতিকতার আলোচ্য বিষয় এবং এই পরিমন্ডলের আওতায় আসার মত মানবাধিকারসমূহ নির্ধারণও আইন প্রণেতাদের কাজ নয়, নৈতিকতার প্রশিক্ষকদের কাজ। মাওলানা হিফজুর রহমান আইনগত পরিমন্ডল ও নৈতিক পরিমন্ডলের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন:
“মানব রচিত বা নিরপেক্ষ আইনের প্রয়োগ কেবল ‘বাহ্যিক কর্মের’ উপর হয়ে থাকে, কিন্তু নৈতিক আইন কার্য ও তার কারণ উভয়ের উপর দৃষ্টি নিবন্ধ রাখে এবং তা উভয়ের উপর প্রযোজ্য হয়। এমনকি কোন কোন কার্যকলাপ বাহ্যিক দিক থেকে কল্যাণকর পরিণতির বাহক মনে হলেও নৈতিক বিধান তাকে এজন্য অমঙ্গলজনক বলে যে, তার কারণ ও পরিণতি অত্যন্ত নিকৃষ্ট। মানব রচিত বিধান বাহ্যিক শক্তিবলে কার্যকর হয়, অর্থাত শাসকগোষ্ঠী, সেনাবাহিনী, পুলিশ বিভাগ, জেল ও আধুনিক সংষ্কারের মাধ্যমে হয়ে থাকে। কিন্তু নৈতিক বিধান মানুষের আভ্যন্তরীণ শক্তি অর্থাৎ “সংজ্ঞা” বলবত করে থাকে। নিরপেক্ষ আইন মানুষকে কেবল সেইসব দায়িত্ব ও কর্তব্যের জন্যই দায়িত্বশীল বানায় যেগুলোর উপর সমাজ-সমষ্টির স্থায়িত্ব অধিকতর নির্ভরশীল। যেমন জানমালের নিরাপত্তা, মান সম্মানের হেফাজত ইত্যাদি। কিন্তু নৈতিক বিধান মানুষকে “দায়িত্ব-কর্তব্য” ও “যোগ্যতা” উভয়ের জন্য একযোগে দায়িত্বশীল সাব্যস্ত করে। কার্যকলাপ সত উদ্দেশ্য প্রণোদিত হওয়ার জন্য এবং তাকে উন্নতির সর্বশেষ ধাপে উন্নীত হওয়ার চেষ্ঠায় ব্রতী হওয়ার জন্য অভ্যস্ত করে তোলাই নৈতিক বিধানের লক্ষ্য” – (ঐ, পৃষ্ঠা. ২১৬)।
আমাদের ফকীহ্গন আইন ও নৈতিকতার মধ্যে বিরাজমান এই পার্থক্যের দিকে লক্ষ্য রেখে ইসলামেও অধিকার সমূহের আইনগত ও নৈতিক অবস্থার মধ্যে পার্থক্যরেখা টেনেছেন। আল্লামা সাইয়্যেদ সুলায়মান নদবী ‘আল্লাহর অধিকার’ ( হুকুকুল্লাহ) এবং ‘বান্দার অধিকারের’ (হুকুকুল ইবাদ) বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন: “স্রষ্টা এবং সৃষ্টি অথবা আল্লাহ এবং বান্দার মধ্যে যে সংযোগ সম্বন্ধ রয়েছে তার সম্পর্ক যদি কেবলমাত্র মানসিক শক্তি ও আন্তরিক অবস্থার সাথে সাথে আমাদের দেহ ও জীবন এবং ধন সম্পদের সাথেও হয়ে থাকে তবে তার নামই ‘ইবাদত’। মানুষের পরষ্পরের সাথে এবং মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির মাঝে যে সংযোগ-সম্বন্ধ রয়েছে তার ভিত্তিতে আমাদের উপর যেসব বিধান আরোপিত হয় তা যদি শুধুমাত্র আইনগত হয়ে থাকে তবে তার নাম মুআমালা বা লেনদেন ও আচার ব্যবহার। আর যদি তা আইনগত না হয়ে থাকে বরং আধ্যাত্মিক উপদেশ, আদান-প্রদান ও হেদায়েতের পর্যাভূক্ত হয়ে থাকে তবে তার নাম আখলাক বা নৈতিকতা”- ( সাইয়েদ সুলায়মান নদবী, সীরাতুন নবী, আজমগড় ১৯৩২ খৃ. ৪ খ. পৃ. ৩১৬।
আইনগত ও নৈতিক অধিকারের এই শ্রেণীবিভাগ আমরা ফিকহ এর গ্রন্থাবলীতে পেয়ে থাকি। কিন্তু তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উপেক্ষা করা হয় অথবা তাকে মূল প্রসঙ্গ থেকে কর্তন করে অন্য কোন শিরোনামের অধীনে স্থাপন করা হয় এবং এভাবে ইসলামে আইনগত ও নৈতিক অধিকারের মধ্যে যে পারষ্পরিক সম্পর্ক রয়েছে তা পুরাপুরি প্রতীয়মান হতে পারে না।
দুনিয়ার আইনের সাধারণ নীতিমালা ও নৈতিকতার নীতিমালা অনুযায়ী এই শ্রেণী বিভাগ তো ঠিকই আছে, কিন্তু আল্লাহ তাআলার সর্বময় ক্ষমতা এবং মানুষের প্রতিনিধিত্বের (খেলাফত) মর্যাদাকে সামনে রাখলে ইসলামে এই শ্রেণী বিভাগের ধরণ সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যায়। এখানে নৈতিক ও আইনগত অধিকার একই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীর নির্দেশে নির্ধারিত হয়। তাই এর মধ্যে একটি আইন রচনাকারী কর্তৃপক্ষের জারীকৃত আইন এবং নৈতিকতার একজন শিক্ষকের পেশকৃত নৈতিক নীতিমালাগত পার্থক্য নেই। তা কার্যকরযোগ্য এবং বলবৎ হওয়ার ভিত্তিতেও পরষ্পর পৃথক নয়। একজন মুসলমান তার প্রতিপালকের সাথে কৃত অংগীকারের অধীনে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের পূর্ণ আনুগত্য করতে বাধ্য।
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ [٦:١٦٢]
অর্থ: বল, আমার নামায, আমার যাবতীয় ইবাদত অনুষ্ঠান, আমার জীবন আমার মৃত্যু সবই আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জন্য”- সূরা আনআম: ১৬২।
إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَىٰ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُم بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ
অর্থ: “আল্লাহ মুমিনদের নিকট থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ তাদেরকে জান্নাত দানের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন”- সূরা তওবা: ১১১।
উপরোক্ত বক্তব্য ও স্বীকারোক্তির পর কোন মুসলমানের জন্য আল্লাহ নির্ধারিত অধিকার সমূহের কতককে আইনগত এবং কতককে নৈতিক অধিকার মনে করে সে সম্পর্কে ভিন্নতর দৃষ্টিভংগি গ্রহণ করার সুযোগ কিভাবে অবশিষ্ট থাকতে পারে? তার কাছে তো কুরআন মজীদের প্রতিটি বিধান আইনের মর্যাদা রাখে। সে আল্লাহ তাআলার প্রতিটি নির্দেশ এক সমান দায়িত্বানুভূতি নিয়ে কার্যে পরিণত করে। তার জন্য কেবল আইনগত অধিকার সমূহই দেয় (Due) ও অবশ্য পালনীয় (Binding) নয়, বরং নৈতিকতার অধীনে আগত সমস্ত অধিকারও একইভাবে দেয় ও অবশ্য পালনীয়। মানবরচিত নৈতিক ব্যবস্থা উত্তম ও অধমের একটি মাপকাঠি কায়েম করার সীমা পর্যন্ত পৌঁছে শেষ হয়ে যায় এবং তার বাস্তবায়নের দায়িত্ব মানুষের বিবেকের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। এই বাস্তবায়ন হয় স্বেচ্ছামূলক (Voluntary)কোন পর্যায়েই তা জবাবদিহিযোগ্য (Accountable) নয়। তা হয়ত সর্বাধিক সামাজিক চাপ(Social presure) প্রয়োগ করে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে, কিন্তু তা বাস্তবায়ন না করলে বিচার বিভাগীয় শুনানীর (Congnizable) বা শাস্তিযোগ্য (Punishable) অবশ্যই নয়। ইসলামেও কি নৈতিক অধিকার সমূহের এই একই অবস্থা? এ কথা পরিষ্কার যে, উক্ত প্রশ্নের জওয়াব হবে নেতিবাচক। মুসলমানদের তো আইন ও নৈতিকতার মধ্যকার স্বাতন্ত্র সত্বেও প্রতিটি জিনিসের কড়ায় গন্ডায় হিসাব দিতে হবে।
فَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ [٩٩:٧]
وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ [٩٩:٨]
অর্থ: “কেউ অণু পরিমাণ সৎকাজ করলে সে তা দেখতে পাবে। আর কেউ অণু পরিমাণ অসৎ কাজ করলে সে তা দেখতে পাবে”- সূরা যিলযাল :৭,৮।
অবস্থা যখন এই তখন ফকীহগণ অধিকার সমূহকে নৈতিক ও আইনগত ভিত্তির উপর শ্রেণী বিভাগ করেন কেন? তারা কিসের ভিত্তিতে এই স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন?
ইসলামে এই পার্থক্যের তাৎপর্য কেবল এতটুকু যে, ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক মুসলমান তার প্রতিপালকের প্রতিটি নির্দেশ পালনে বাধ্য এবং এই বাধ্যবাধকতা সম্পূর্ণ আইনগত প্রকৃতির। কারণ তাকে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী মহান আল্লাহর সামনে নিজের সমস্ত কার্যাবলীর জন্য জবাবদিহি করতে হবে এবং এই কার্যকলাপের ভিত্তিতে তাঁর আদালতে প্রতিদান ও শাস্তির ফয়সালা হয়ে থাকে। সে তথায় এই ওজর পেশ করতে পারবে না যে, অন্তর নিজের সত্তা ও নিজের এখতিয়ার সমূহের সীমা পর্যন্ত সে আল্লাহ নির্ধারিত বিধানসমূহ পালনে ও অধিকার সমূহ আদায়ে অপারগ ছিল। অবশ্য একজন নেতা বা শাসককে আল্লাহ তাআলা শুধুমাত্র সেইসব অধিকার কার্যকর করার জন্য দায়িত্বশীল বানিয়েছেন যেগুলো সে নিজের সীমিত জ্ঞানবুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়ের উপর ভিত্তিশীল উপলদ্ধি ও পর্যবেক্ষণের সীমা পর্যন্তই কার্যকর করতে পারে। এগুলো হল সেই সব অধিকার যাকে ইসলামে “আইনগত” বলা হয়। নৈতিক ও আইনগত অধিকারের এই শ্রেণী বিভাগ যেন রাষ্ট্রের এখতিয়ারের দৃষ্টিকোণ থেকে করা হয়েছে, কোন ব্যক্তির যিম্মাদারী ও জবাবদিহির দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। কোন ব্যক্তির জন্য সমস্ত অধিকারই তো আইনগত মর্যাদা সম্পন্ন। কিন্তু একজন শাসকের ক্ষমতা বা এখতিয়ার এবং তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের সীমারেখার দিক থেকে তা আইনগত ও নৈতিক-এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে যায়। অন্তত যেসব অধিকারকে আল্লাহ তাআলা মানব সমাজের ভারসাম্যপূর্ণ, ইনসাফপূর্ণ, নিরাপত্তাপূর্ণ, সংগতিশীল ও পবিত্র বানানোর জন্য অপরিহার্য সাব্যস্ত করেছেন সেগুলোকে তিনি নিজের প্রতিনিধিত্বমূলক ক্ষমতাসীনদের মাধ্যমে কার্যকর করার উপযোগী বানিয়ে দিয়েছেন এবং এই প্রসঙ্গে তাকে প্রয়োজনীয় বিধান ও এখতিয়ারও দেওয়া হয়েছে। যেসব অধিকারকে তিনি সমাজকে উন্নততর নৈতিক ভিত্তিসমূহের উপর নির্মাণ এবং এই উদ্দেশ্যের জন্য সমাজের সদস্যদের আচরণ ও চরিত্রকে সর্বোত্তমরূপে গঠনের জন্য জরুরী মনে করেছেন সেগুলোর পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের দায়িত্বশীল স্বয়ং প্রত্যেক ব্যক্তিকে সাব্যস্ত করেছেন এবং তার হিসাব নিকাশ লওয়ার ব্যাপারটি সরাসরি নিজের হাতে রেখেছেন। এখন আইনগত অধিকার সমূহ বাস্তবায়নের সীমা পর্যন্ত তো ব্যক্তি ও রাষ্ট্র উভয়কে মিলিতভাবে সর্বশক্তিমান আল্রাহর উচ্চতর আদালতে জবাবদিহি করতে হবে, কিন্তু যেসব অধিকার রাষ্ট্রের এখতিয়ারের বাইরে রাখা হয়েছে সেগুলো সম্পর্কেও ব্যক্তিকে একইভাবে জবাবদিহি করতে হবে এবং তার ক্ষেত্রে আইনগত ও নৈতিক অধিকারের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না।
যেমন ব্যক্তি ও প্রতিনিধিমূলক ক্ষমতাসীনের পারষ্পরিক সম্পর্কের গন্ডি পর্যন্ত অধিকারসমূহ তার বাহ্যিক প্রকাশ ও বাস্তবায়নের ভিত্তিতে আইনগত ও নৈতিক দুই পর্যায়ে বিভক্ত হয়ে যাবে, কিন্তু আল্লাহ ও বান্দার পারষ্পরিক সম্পর্কের গন্ডিতে এই শ্রেণী বিভাগ শেষ হয়ে যায় এবং সমস্ত অধিকার আইনগত বৈশিষ্ট্য লাভ করে। আল্লাহ তাআলা আইনগত অধিকার সমূহের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সেগুলোকে রাষ্ট্রের এখতিয়ারাধীনে সোপর্দ করেছেন, যাতে কোন ব্যক্তি নিজ দায়িত্বে এসব অধিকার আদায় না করলে রাষ্ট্র-বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগের সহায়তায় তা শক্তিবলে কার্যকর করতে পারে এবং কোন ব্যক্তির প্রাপ্য অধিকার যেন আত্মসাত অথবা আহত হতে না দেয়। কিন্তু রাষ্ট্র যেহেতু এই দায়িত্ব শুধু বাহ্যিক কর্মতৎপরতার সীমা পর্যন্তই পালন করতে পারে তাই তাকে নৈতিক অধিকারসমূহের বাস্তব প্রয়োগের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তির উপর এই দায়িত্ব পূর্ণমাত্রায় বহাল রয়েছে, তাকে সামান্যতম নৈতিক অধিকারের বাস্তবায়নের দায়িত্ব থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়নি। কোন বিবদমান ব্যাপারে রাষ্ট্র পক্ষদ্বয়ের মধ্যে ইনসাফ কায়েমের জন্য নিজের কোন সরাসরি জ্ঞানের পরিবর্তে বাদী ও বিবাদীর প্রদত্ত বিবরণ, স্বাক্ষীগণের সাক্ষ্য এবং পুলিশের রিপোর্টের উপর নির্ভর করতে বাধ্য। তার অবগত হওয়ার সমস্ত মাধ্যম শুধুমাত্র বাহ্যিক কার্যকলাপ পর্যন্তই বেষ্টন করতে পারে। মানুষের আভ্যন্তরীণ জগত পর্যন্ত তার পৌঁছার শক্তি নাই। অতএব এসব মানবিক দূর্বলতার দিকে লক্ষ্য রেখে মানবীয় রাষ্ট্রকে শুধুমাত্র বাহ্যিক তৎপরতার সাথে সংশ্লিষ্ট আইনগত অধিকার সমূহের বাস্তবায়নের জন্য জিম্মাদার বানানো হয়েছে এবং এসব অধিকারের বেলায়ও সর্বশেষ ও চূড়ান্ত ইনসাফ লাভের বিষয়টি আল্লাহ তাআলা নিজেরই আদালতের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। কারণ কোন বিষয়ে প্রকৃত তথ্যের গভীরে পৌঁছতে না পারার খুবই সম্ভাবনা রয়েছে এবং তার ফলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পূর্ণ বিশ্বস্ততা ও সৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হওয়া সত্ত্বেও পক্ষদ্বয়ের প্রতি সুবিচার নাও হতে পারে। মানবজাতির মধ্যে সবচেয়ে অধিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী ব্যক্তি স্বয়ং মহান নবী সা: বলেন:
“আমি একজন মানুষ, আমার সামনে যেসব লোক বিবাদ মীমাংসার জন্য উপস্থিত হয়, তাদের এক পক্ষের অপর পক্ষের তুলনায় অধিক বাকপটু হওয়াটা বিচিত্র নয় এবং আমি তার অনুকূলে রায় প্রদান করব এবং মনে করব এটাই সঠিক। অতএব যে ব্যক্তিকে আমি এভাবে তার ভাইয়ের অংশ দেব সে যেন তা থেকে কিছুই গ্রহণ না করে। কারণ তার জানা উচিত, আমি তাকে দোযখের একটি টুকরা দিচ্ছি” (আদালতে নববীকে ফায়সেলে, পৃ. ২১৭।
মহান আল্লাহর বাণী:
يَعْلَمُونَ ظَاهِرًا مِّنَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ عَنِ الْآخِرَةِ هُمْ غَافِلُونَ [٣٠:٧]
অর্থ: “মানুষ পার্থিব জীবনের কেবল বাহ্যিক দিকেরই জ্ঞান রাখে এবং আখেরাত সম্পর্কে তারা অলসতার শিকার” (সূরা রূম: ৭)।
হযরত উমার রা: মানবীয় রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের সীমা নির্দেশ করতে গিয়ে বলেন, “রিসালাত যুগে তোমাদেরকে ওহীর সাহায্যে অভিযুক্ত করা হত। কোন ব্যক্তি কিছু গোপন করলে তা ওহীর মাধ্যমে ফাঁস করে দেওয়া হত এবং কেউ প্রকৃত ঘটনার বিপরীত বর্ণনা দিলে তাকেও পাকড়াও করা হত। তোমাদের উত্তম চরিত্রের প্রকাশ ঘটানো উচিত। আল্লাহ পাক অন্তরের অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত। যে কেউ পংকিলতা ও নিকৃষ্টতার প্রকাশ ঘটাবে এবং দাবী করবে যে, তার অন্তরজগত পরিষ্কার আছে- আমরা তার কথায় বিশ্বাস করব না। আর যে ব্যক্তি সত্য কথা প্রকাশ করবে আমরা তাকে ভালোই মনে করব” ( উমার ইবনুল খাত্তাব, পৃ: ২৮৪।
অপর এক ভাষণে তিনি এই সত্য নিম্নোক্ত বাক্যে প্রকাশ করেন:
“শোন! কুরআন পড়লে কেবল আল্লাহর নিকট পুরষ্কার লাভের আশায় পড় এবং নিজের কাজ কর্মের মাধ্যমে তা অর্জনেরই সংকল্প কর। যখন ওহী নাযিল হত তখন আমরা পুরষ্কার লাভের উপায় জেনে নিতাম। কারণ মহানবী সা: আমাদের মাঝে বর্তমান ছিলেন। এখন ওহীর আগমনের ধারা বন্ধ হয়ে গেছে এবং রসুল সা: দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। এখন আমি তোমাদের সেইসব কথার মাধ্যমে চিনতে পারব যা আমি বলেছি। শোন! যে কেউ ন্যায়ের প্রকাশ ঘটাবে আমরা তাকে ন্যায় মনে করব এবং তার প্রশংসা করব। আর যে কেউ অন্যায়ের প্রকাশ ঘটাবে আমরা তার সম্পর্কে বিরূপ ধারণা রাখব এবং তাকে অপছন্দ করব” ( ঐ, পৃ: ২৮৬)।
অর্থাত আমরা যেগুলোকে আইনগত অধিকার বলি সেগুলোও অবগতির মাত্রা অনুযায়ীই কার্যকর হতে পারে। তার সর্বশেষ ও চূড়ান্ত ফয়সালা আল্লাহ তাআলার আদালতেই হবে। এ জন্যই যেসব অধিকার বাস্তবায়নের জন্য ইন্দ্রিয়ের উর্ধ্বের জ্ঞান ও অন্তরলোকের পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন সেগুলোকে স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই মানুষের সীমিত ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বাইরে রেখেছেন এবং মানুষকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দায়িত্বশীল বানিয়ে সিদ্ধান্তের ব্যাপারটি নিজের হাতে রেখেছেন। কেননা যে গোপন ও অদৃশ্য বিষয় পর্যন্ত মানুষের দৃষ্টি পৌঁছতে পারে না তা আল্লাহর সামনে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। এর কোন অন্তর্নিহিত তত্ব তাঁর সামনে লুকায়িত নেই। তিনি তাঁর পূর্ণ ও নির্ভুল জ্ঞানের সাহায্যে সমস্ত অধিকারের ঠিক ঠিক ফয়সালা করবেন এবং তাঁর আদালতে নৈতিক ও আইনগত কোনরূপ স্বাতন্ত্র অবশিষ্ট থাকবে না। মহান আল্লাহর বাণী:
أَوَلَا يَعْلَمُونَ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ [٢:٧٧]
অর্থ: “তারা কি জানে না যে, যা তারা গোপন রাখে অথবা প্রকাশ করে তা নিশ্চয়ই আল্লাহ জানেন” (সূরা বাকারা: ৭৭)।
وَلَا يَكْتُمُونَ اللَّهَ حَدِيثًا
অর্থ: “তারা আল্লাহ থেকে কোন কথাই গোপন করতে পারবে না” (সূরা নিসা: ৪২)।
(আরবী***)
অর্থ: আল্লাহ সবকিছুর সম্যক প্রত্যক্ষদর্শী( সূরা হজ্জ: ১৭)।
إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ
অর্থ: অন্তরে যা কিছু আছে সে সম্পর্কে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত ( সূরা আল ইমরান: ১১৯)।
আল্লাহ তাআলার নিকট যেহেতু মানুষের নিয়াত, কামনা বাসনা, ইচ্ছা-সংকল্প, চিন্তা চেতনা, আক্বীদা-বিশ্বাস মোট কথা কোন জিনিসই লুকায়িত নয়, মানুষের ভিতর ও বাহির তাঁর সামনে সম্পূর্ণ উদ্ভাসিত, তাই তাঁর আদালতে কোন অধিকার কেবলমাত্র “নৈতিক অধিকার” ই নয়, বরং সমস্ত অধিকার সম্পূর্ণতই “আইনগত প্রতিকার প্রার্থনার যাবতীয় প্রসিদ্ধ পন্থা অনুযায়ী হবে। তিনি ক্ষতিগ্রস্থদের ফরিয়াদ শ্রবণ করবে।
“যখন জীবন্ত প্রোথিত কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে- কি অপরাধে তাকে খুন করা হয়েছিল” ( সূরা তাকবীর: ৮,৯)।
কিরামান কাতিবীনের সংগৃহীত বিবরণ সমূহের মূল্যায়ন করা হবে।
“সম্মানিত লেখকদ্বয়, তারা জানে তোমরা যা কর” (সূরা ইনফিতার: ১১)।
যে জমীনের বুকে এসব কার্যকলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে তার সাক্ষ্যও গ্রহণ করা হবে।
“সেই দিন পৃথিবী তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে” (সূরা যিলযাল:৪)।
অপরাধীর নিজের মুখ ও হাত-পায়ের স্বাক্ষ্যও গ্রহণ করা হবে।
“সেদিন তাদের বিরুদ্ধে স্বাক্ষী দিবে তাদের মুখ, তাদের হাত ও তাদের পা তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে” ( সূরা নূর: ২৪)।
এভাবে আল্লাহ তাআলা নবীগণও অন্যান্যের জবানবন্দী গ্রহণ করে প্রমাণ করে দেবেন যে, সত্য তাদের নিকটে পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।
“নবীগণকে এবং অন্যান্য স্বাক্ষীগণকে উপস্থিত করা হবে”(সূরা যুমার: ৬৯)।
অবশেষ অপরাধী স্বয়ং স্বীকারোক্তি করবে যে, সত্যিই সে সংশ্লিষ্ট অপরাধে লিপ্ত হয়েছিল।
“তারা বলবে, অবশ্যই আমাদের নিকট সতর্ককারী এসেছিল, আমরা তাদের মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করেছিলাম এবং বলেছিলাম, আল্লাহ কিছুই নাযিল করেননি” (সূরা মুলক: ৯)।
অতএব তিনি স্বাক্ষ্য -প্রমাণ সম্পূর্ণ করার পর নিজের রায় ঘোষণা করবেন।
“লোকদের মাঝে ন্যায় বিচার করা হবে। অবশেষে অপরাধী স্বয়ং স্বীকারোক্তি করবে যে, সত্যিই সে সংশ্লিষ্ট অপরাধে লিপ্ত হয়েছিল।
“তারা বলবে, অবশ্যই আমাদের নিকট সতর্ককারী এসেছিল, আমরা তাদের মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করেছিলাম এবং বলেছিলাম, আল্লাহ কিছুই নাযিল করেননি” (সূরা মুলক: ৯)।
অতএব তিনি সাক্ষ্য প্রমাণ সম্পূর্ণ করার পর নিজের রায় ঘোষণা করবেন।
“লোকদের মাঝে ন্যায় বিচার করা হবে এবং তাদের উপর যুলুম করা হবে না। প্রত্যেকের কৃতকর্মের পূর্ণ প্রতিফল দেওয়া হবে” (সূরা যুমার: ৬৯,৭০)।
এখন বলুন, যে অধিকারসমূহের বিষয় এই সুমহান ও সর্বশেষ আদালতে আইনের সমস্ত প্রসিদ্ধ শর্তাবলী অনুযায়ী এইভাবে শুনানির আওতায় আসবে, সেগুলোকে আমরা কিসের ভিত্তিতে “নৈতিক অধিকার” বলতে পারি? আরও লক্ষ্য করুন যে, তথায় কি কি ধরণের নৈতিক অধিকার শুনানীর আওতায় আসবে? কুরআন মজীদের নির্দেশ:
وَإِذَا حُيِّيتُم بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا ۗ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ حَسِيبًا [٤:٨٦]
“তোমাদের যখন সালাম দেওয়া হয় তখন তোমরাও তা অপেক্ষা উত্তম শব্দে সালামের উত্তর দাও, অথবা (অন্তত) তার অনুরূপ উত্তর দাও। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী” (সূরা নিসা: ৮৬)।
উপরোক্ত আয়াতের শেষাংশ থেকে পরিষ্কার জানা যাচ্ছে, এটা কেবল নৈতিক উপদেশই নয়, বরং একটি নির্দেশ, একটি আইনগত নীতিমালা এবং স্বয়ং মহান আল্লাহর আদালতে এজন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পার্থিব জগতের কোন বিচারালয়ের জন্য এটা নির্ধারণ করা কঠিন ব্যাপার যে, সালামের জওয়াব যথাযোগ্যভাবে দেওয়া হয়েছে কি না। তাই তাকে এই নৈতিক অধিকার বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মহান আল্লাহর বিচারালয়ে স্বয়ং মুখ ও হাত স্বাক্ষী দিবে যে, সালামের উত্তর সঠিক পন্থায় দেওয়া হয়েছে কি না এবং অন্তরও সাক্ষী দেবে যে, এ সময় নিষ্ঠাপূর্ণ আবেগ বর্তমান ছিল, না ঠাট্টা-বিদ্রুপ ঘৃণা-বিদ্বেষ ও শত্রুতার মালিন্যে মনটা পূর্ণ ছিল?
এখন অধিকার সমূহের কিছুটা বিস্তারিত তালিকার প্রতি দৃষ্টিপাত করা যাক।
“হে মুহাম্মাদ! তাদের বল, এসো তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের উপর যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন তা তোমাদের পড়ে শুনাই।”
১. তোমরা তাঁর সাথে কোন শরীক করবে না।
২. পিতা মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে।
৩. দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা নিজেদের সন্তানদের হত্যা কর না, আমরা তোমাদেরও রিযিক দান করি এবং তাদেরও।
৪. প্রকাশ্যে হোক অথবা গোপনে অশ্লীল আচরণের নিকটেও যাবে না।
৫. আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতীত তাকে হত্যা করবে না। তোমাদের তিনি এই নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা বুঝে শুনে কাজ কর।
৬. ইয়াতীম বয়:প্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সদুদ্দেশ্যে ছাড়া তার সম্পদের নিকটবর্তী হবে না এবং
৭. পরিমাপ ও ওজন ন্যায়সংগতভাবে পূর্ণরূপে দেবে। আমরা কারও উপর তার সাধ্যাতীত বোঝা চাপাইও না।
৮. যখন তোমরা কথা বলবে তখন ন্যায্য কথা বলবে তা আপনজনদের সম্পর্কে হলেও।
৯. এবং আল্লাহকে প্রদত্ত অংগীকার পূর্ণ করবে। এভাবে আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিনে যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।
১০. অনন্তর তাঁর নির্দেশ এই যে, এটাই আমার সরল পথ, সুতরাং এর অনুসরণ করবে এবং ভিন্ন পথ অনুসরণ করবে না। করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। এভাবে আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা সাবধান হও” (সূরা আন আম: ১৫১-১৫৩)।
এই সমস্ত আকীদা-বিশ্বাস ও কার্যকলাপ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার আদালতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এই আদালতের এখতিয়ারের পরিমন্ডল ও শুনানীর ব্যাপকতা সম্পর্কে সূরা যিলযাল এ পরিষ্কার ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে:
“কেউ অণু পরিমাণ সৎ কাজ করলে তা সে দেখতে পাবে। কেউ অণু পরিমাণ অসৎ কাজ করলে সে তাও দেখতে পাবে”- ( যিল যাল : ৭-৮)।
উপরোক্ত আয়াত সমূহে শিরক, পিতা মাতার সাথে ব্যবহার, সন্তান হত্যা, নির্লজ্জতা, জীবনের নিরাপত্তা, ইয়াতীমের সম্পদ, ওজন-পরিমাপে বিশ্বস্ততা, সত্যকথন, আল্লাহর সাথে ইবাদাতের অংগীকার এবং তাঁর নির্ধারিত সরল পথে চলা সম্পর্কিত সার্বিক উপদেশ বক্তব্যের একই ধারায় এবং সমান জোরের সাথে অব্যাহত রয়েছে।
এখানে সর্ব প্রথম আল্লাহর অধিকারের কথা বলা হয়েছে এবং তা হল- তাঁর সাথে কোন কিছু শরীক কর না। শিরক এমন এক জঘন্য অপরাধ যা চূড়ান্তভাবেই ক্ষমার অযোগ্য। এ সম্পর্কে স্বয়ং কুরআনের ফয়সালা এই যে-
“আল্লাহ তাঁর সাথে শরীর করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। তা ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন এবং যে কেউ আল্লাহর সাথে শরীক করে সে এক ভয়ংকর পাপ করে”- সূরা নিসা: ৪৮)।
সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এই অধিকার বাস্তবায়নে দুনিয়ার বিচারালয় ও রাষ্ট্র শুধুমাত্র বাহ্যিক কার্যকলাপের সীমা পর্যন্তই নিজের শক্তি ব্যবহার করতে পারে। অতএব হযরত উমার রা: যখন জানতে পারলেন মহানবী সা: যে গাছটির ছায়ায় বসে বাইআতে রিদওয়ানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন, লোকেরা তার নিচে এসে নামায পড়ছে, তখন তিনি বিষয়টির মধ্যে শিরকের গন্ধ অনুভব করলেন এবং গাছটি শিকড় সহ উপড়ে ফেলে দিয়ে বলেন:
“হে লোকেরা! আমি তোমাদের দেখছি যে, তোমরা উযযার পূজায় লেগে গেছ। শোন! আজ থেকে আমি যেন শুনতে না পাই যে, কোনও ব্যক্তি এখানে এসে নামাযে মশগুল হচ্ছে। কারও সম্পর্কে এরূপ জানতে পারলে আমি তাকে হত্যা করাব, যেমন ধর্মত্যাগীদের হত্যা করা হয়”- ( উমার ইবনুল খাত্তাব, পৃ: ৪০৭।
কিন্তু যেখানে যে অবস্থা নাই এবং লাত, উযযা ও মানাত অন্তরের মধ্যে লুকিয়ে বসে আছে সেখানে শিরকের দরজা কে বন্ধ করবে? যদি তা বন্ধ করা কোন সরকারের জন্য সম্ভব না হয় তবে কি আল্লাহ তাআলার এই অধিকার কেবলমাত্র একটি “নৈতিক অধিকার” সাব্যস্ত হয়ে কোন “আইনগত অধিকারের” তুলনায় দ্বিতীয় পর্যায়ের অধিকার গণ্য হবে? কখনও নয়। এটা তো মানুষ ও আল্লাহর মধ্যে অনুষ্ঠিত অংগীকারের আলোকে সর্বপ্রধান ও সর্বপ্রথম অধিকার যা প্রত্যেক মানুষের উপর আরোপিত। আর অবশিষ্ট সমস্ত আইনগত ও নৈতিক অধিকার সমূহ ঐ একটি মাত্র অধিকার স্বীকার করে নেওয়া বা না নেওয়ার উপর নির্ভরশীল। এটাতো সেই অধিকার যা আদায় না করার অপরাধে আল্লাহ তাআলা শাস্তি দেওয়ার জন্য আখেরাতেরও অপেক্ষা করেননি, বরং এই দুনিয়ায় অনেক জাতিকে এমন কঠোর শাস্তি দিয়েছেন যা অন্যদের জন্য উপদেশ গ্রহণের বিষয় হয়ে আছে।
قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِن قَبْلُ ۚ كَانَ أَكْثَرُهُم مُّشْرِكِينَ [٣٠:٤٢]
অর্থ: “বল, তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং দেখ তোমাদের পূর্ববর্তীদের পরিণতি কি হয়েছে, তাদের অধিকাংশই ছিল মুশরিক”- (সূরা রূম : ৪২)।
অর্থাৎ যখন জাতিসমূহ সামগ্রিকভাবে শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং আম্বিয়ায় কেরামের কথায় কর্ণপাত করেনি, যাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে শিরক থেকে বিরত রাখার জন্য এবং তাদের মধ্যে আল্লাহর বিধান কার্যকর করার জন্য আদিষ্ট ছিলেন, তখন আল্লাহ তাআলা বিষয়টি সরাসরি নিজের হাতে নিয়ে নেন এবং আযাব নাযিল করে পৃথিবীর বুক থেকে তাদের অস্তিত্ব বিলীন করে দেন।
এই অধিকারের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন যেহেতু মানুষ ও তাদের প্রতিষ্ঠিত বড় থেকে বৃহত্তর প্রশাসনিক অথবা বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ারের বাইরে, তাই তা নিজের বাহ্যিক প্রদর্শনীর সীমা পর্যন্ত তো আইনগত অধিকারই সাব্যস্ত হবে। কিন্তু আকীদা-বিশ্বাস ও ঈমানের বাতেনী প্রকৃতির দিক থেকে মানব সমাজে একটি নৈতিক অধিকারই সাব্যস্ত হবে। অবশ্য আল্লাহর দরবারে এটা সর্বপ্রধান আইনগত অধিকারই সাব্যস্ত হবে যে সম্পর্কে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। কোন মুসলমানের এটাকে শুধুমাত্র “নৈতিক অধিকার” মনে করার কোন সুযোগ নাই।
এতো গেল শিরকের ব্যাপার। আল্লাহর রসুল সা: আমাদের বলেন যে, ইসলামে প্রতিটি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর এবং বড় থেকে বৃহত্তর অধিকারের এই একই মর্যাদা। মহানবী সা: বলেন:
“হে আয়িশা! নিজেকে বিশেষত সেই সব গুনাহ থেকে রক্ষার চেষ্ঠা কর যেগুলোকে তুচ্ছ ও সাধারণ মনে করা হয়। কারণ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এগুলোর জন্যও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে”(ইবনে মাজা, দারিমী, বায়হাকীর শুআবুল ঈমান, রাবী হযরত আয়েশা)।
মানুষ যেসব জিনিসকে তুচ্ছ মনে করে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না তার একটি উদাহরণ স্বয়ং কুরআন মজীদে দেখুন:
“তুমি কি সেই ব্যক্তিকে দেখেছ যে আখেরাতের শাস্তি ও পুরষ্কার মিথ্যা মনে করে? সে তো ঐ ব্যক্তি যে এতীমকে গলা ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেয় এবং অভাবগ্রস্থদের খাদ্যদানে উৎসাহিত করে না। অতএব দূর্ভোগ সেই নামাযীদের জন্য যারা নিজেদের নামাযে উদাসীন, যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে এবং গৃহস্থালীর নিত্য প্রয়োজনীয় ছোটখাট জিনিস প্রদানে বিরত থাকে”- (সূরা মাউন)।
এতীমদের সাথে দূর্ব্যবহার, মিসকীনদের আহার না দেওয়া এসবই নৈতিক প্রকৃতির অপরাধ। কিন্তু দেখুন, এই অপরাধে লিপ্ত ব্যক্তিদের আখেরাতের ধ্বংসাত্মক শাস্তির ভয় দেখানো হচ্ছে যে, এসব বিষয়কে তুচ্ছ মনে কর না। এর উপর তোমাদের ধ্বংস, মুক্তি ও আরাম আয়েশ নির্ভরশীল। আরও একটি উদাহরণ দেখুন:
“আর তোমরা সকলে আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে কাউকে শরীক কর না, পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার কর। নিকটাত্মীয়, এতীম ও অভাবগ্রস্থদের প্রতি সদয় ব্যবহার কর এবং প্রতিবেশী আত্মীয়দের প্রতি, অনাত্মীয় প্রতিবেশীর প্রতি, একত্রে চলার সাথীর প্রতি, পরিভ্রাজকের প্রতি এবং তোমাদের অধীনস্থ দাস দাসীদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন কর। নিশ্চিত জানিও আল্লাহ এমন ব্যক্তিকে কখনও পছন্দ করেন না যে নিজ ধারণায় অহংকারী ও গর্বিত। সেই সব লোককেও তিনি পছন্দ করেন না যারা নিজেরা কার্পণ্য করে এবং অন্যদেরও কার্পণ্যের পরামর্শ দেয় এবং আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের যা দান করেছেন তা লুকিয়ে রাখে। এরূপ অকৃতজ্ঞ লোকদের জন্য আমরা অপমানকর শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছি। আর সেইসব লোককেও আল্লাহ পছন্দ করেন না যারা নিজেদের ধন সম্পদ শুধু প্রদর্শনীর জন্য ব্যয় করে, আর আসলে তারা না আল্লাহর উপর ঈমান রাখে আর না আখেরাতের উপর। শয়তান যার সংগী হয়েছে তার ভাগ্যে খুব খারাপ সংগীই জুটেছে। তাদের উপর কি বিপদ ঘটত যদি তারা আল্লাহ ও আখেরাতের উপর ঈমান আনত এবং আল্লাহ যা কিছু দান করেছেন তা থেকে খরচ করত? আল্লাহ তাদের ভালোভাবে জানেন। আল্লাহ কারও প্রতি বিন্দু পরিমাণ যুলুম করেন না। কেউ অণু পরিমাণ সৎকাজ করলে আল্লাহ তা দ্বিগুণ করে দেন এবং নিজের পক্ষ থেকে মহা পুরষ্কার দান করেন। আমরা যখন প্রত্যেক উম্মাত থেকে একজন করে সাক্ষী হাযির করব এবং তোমাকে (হে মোহাম্মাদ) তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরূপে উপস্থিত করব তখন কি অবস্থা হবে? যারা কুফরী করেছে এবং রসুলের কথা মানেনি তারা সেদিন কামনা করবে, যদি তারা মাটির সাথে মিশে যেত! আর তারা আল্লাহর নিকট কোন কথাই গোপন করতে পারবে না” সূরা নিসা: ৩৬-৪২।
উপরোক্ত আয়াতগুলো “নৈতিক অধিকারের” সাথে সংশ্লিষ্ট, “কিন্তু আল্লাহ কারও উপর যুলম করেন না” থেকে শেষ আয়াত পর্যন্তকার বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করে দেখুন যে, এগুলো এমন সব অধিকার যে সম্পর্কে যথারীতি জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, যার জন্য পুরষ্কার অথবা শাস্তি দেওয়া হবে। এ সম্পর্কে সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে এবং যখন কোন কথা গোপন থাকবে না তখন সিদ্ধান্ত প্রদান করা হবে।
উপরোক্ত আয়াতগুলোতে সরাসরি বান্দাদের সম্বোধন করা হয়েছে এবং তাতে যেসব অধিকার আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে কোনটিকে আইনগত এবং কোনটিকে নৈতিক অধিকার সাব্যস্ত করার কোন অবকাশ নেই। সর্বময় ক্ষমতার মালিক আল্লাহ তাআলার ব্যক্ত অভিপ্রায় (Expressed will) হওয়ার কারণে এসব অধিকার আইনগত পর্যায়ের। আমরা কিসের ভিত্তিতে বলতে পারি যে, মহান আল্লাহ প্রদত্ত অমুক অধিকার তো আইনগত, কিন্তু অমুক অধিকার নৈতিক?
এই শ্রেণী বিভাগের জন্য বৈধতার কি কারণ আমাদের কাছে আছে? সর্বাধিক আমরা এতটুকু বলতে পারি যে, এসব অধিকার রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের উর্ধ্বে, কিন্তু তা কি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মহান আল্লাহর হস্তক্ষেপেরও উর্ধ্বে? যদি না হয় তবে আমরা তদনুযায়ী কাজ করা বা না করার ব্যাপারে কিভাবে স্বাধীন হতে পারি? স্বাধীনতা যখন অবশিষ্ট থাকল না এবং বিষয়টি বিবেক ও প্রজ্ঞা থেকেও অগ্রসর হয়ে তার অপরিহার্য অনুসরণ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে তখন তা কিভাবে নৈতিক অধিকার সাব্যস্ত হতে পারে? এতো সম্পূর্ণই আইনগত অধিকার। শুধুমাত্র এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগের ক্ষমতা অচল হওয়ায় সেগুলো মহান আল্লাহর নির্দেশ হওয়ার ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য সূচীত হয় না। আমরা এই দুনিয়ায় যদি মানবীয় বিচার ব্যবস্থা ও প্রশাসন ব্যবস্থার হাত থেকে রেহাই পেয়েও যাই তবুও মহান আল্লাহর আদালতে এ সম্পর্কে জবাবদিহি থেকে কিভাবে বাঁচতে পারি?
মানব জাতির মধ্যে যেসব মহান ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা নবুয়তের পদে সমাসীন করেন তাঁরা যেহেতু সীমিত জ্ঞান ও এখতিয়ারের অধিকারী মানুষের প্রভুত্বের অধীন নন,বরং সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীন, তাই তাদের সাথে এই জগতেই নৈতিক অধিকারের বেলায়ও আইনগত অধিকার কার্যকর করার পন্থাসমূহ অবলম্বন করা যায়। মহানবী সা:, যিনি নিজ প্রভুর দৃষ্টিতে নৈতিকতার উচ্চতম পর্যায়ে আসীন ছিলেন ( ওয়া ইন্নাকা লাআলা খুলুকিন আজীম) যখন তিনি এক বৈঠকে মক্কার নেতৃস্থানীয় লোকদের ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন তখন এক অন্ধ সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা:-র আগমন এবং তাঁর সম্বোধনে অনিহা প্রকাশ করলেও সাথে সাথে তাঁকে এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে মহান আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন: “সে ভ্রু কুঞ্চিত করল এবং মুখ ফিরিয়ে নিল। কারণ তার নিকট অন্ধ লোকটি এসেছে। তুমি কেমন করে জানবে- সে হয়ত পরিশুদ্ধ হত, অথবা উপদেশ গ্রহণ করত, ফলে উপদেশ তার উপকারে আসত। পক্ষান্তরে যে ভ্রুক্ষেপ করেনা তুমি তার প্রতি মনোযোগ দিয়েছ। অথচ সে পরিশুদ্ধ না হলে তোমার কোন দায়িত্ব নাই। অন্যপক্ষে যে তোমার নিকট ছুটে এল, আর সে সশংকচিত্ত, তুমি তাকে অবজ্ঞা করলে”- সূরা আবাসা: ১-১০।
স্বীয় রসুলের সাথে মহান আল্লাহর যেহেতু ওহীর মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগ ছিল, তাই একটি নৈতিক অধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য এই জগতেই জিজ্ঞাসাবাদের পন্থা অবলম্বন করা হয়। কিন্তু সাধারণ লোকদের ব্যাপার তা থেকে স্বতন্ত্র। তারা এখানে যেহেতু প্রতিনিধিত্বমূলক সার্বভৌমত্বের অধীন যাকে সীমিত জ্ঞান ও সামান্য তথ্যাভিজ্ঞ হওয়ার কারণে শুধুমাত্র আইনগত অধিকার সমূহ বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সকল মানুষ যখন কোন মধ্যবর্তী সম্পর্ক ছাড়াই সরাসরি নিজেদের প্রভুর সমীপে উপস্থিত হবে, তখন সেখানে নৈতিক ও আইনগত অধিকারের মধ্যেকার পার্থক্য খতম হয়ে যাবে এবং প্রতিটি অধিকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ইসলামে নৈতিকতার গুরুত্ব কতখানি এবং যেসব অধিকারকে আমরা “নৈতিক” বলি সেগুলোর নৈতিক অধিকারের সাধারণ পরিভাষা থেকে কতটা ভিন্নতর অর্থ রয়েছে এবং সর্বশেষ আদালতে পৌঁছে কিভাবে আইনগত অধিকার ও নৈতিক অধিকার পরষ্পর একাকার হয়ে একই বৈশিষ্ট্য লাভ করে।
আখেরাতে অধিকার সমূহের এই বৈশিষ্ট্য ধারণের কথা মনের মধ্যে গেঁথে রাখলে মানুষের মধ্যে উন্নততর নৈতিক আচরণের স্ফুরণ ঘটতে পারে এবং সে বাইরের কোন শক্তির চাপের কারণে নয়, বরং নিজ বিবেকের আভ্যন্তরীণ চাপ ও দায়িত্বানুভূতির অধীনে আল্লাহ তাআলার প্রতিটি হুকুমের আনুগত্য করবে বিনা বাক্যব্যয়ে এবং মানসিক প্রস্তুতি ও খোদার ভয় সহকারে এবং সে এসব বিধানকে নৈতিক ও আইনগত পরিপমন্ডলে বিভিক্ত করে না। এই শ্রেণী বিভাগ তো মূলত রাষ্ট্রের এখতিয়ার সমূহের সীমা নির্দেশের উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে, ব্যক্তিকে কোন্ কোন্ বিষয়ে আল্লাহ তাআলার পূর্ণ আনুগত্য থেকে কিছুটা রেহাই পাবে তা নির্ধারণের উদ্দেশ্য নয়। কুরআনের বিধান সমূহে আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, আচার-ব্যবহার এবং নৈতিকতার সাথে সংশ্লিষ্ট উপদেশ সমূহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বক্তব্যের একই ধারায় এমনভাবে সুসংবদ্ধ পাওয়া যায় যে, তাতে আচার আচরণের বাহ্যিক ও গোপন দিকগুলোর কোন পার্থক্য করার অবকাশ লক্ষ্য করা যায় না। কুরআন মজীদ মানুষকে “বাহ্যিক মানুষ” ও “অদৃশ্য মানুষ” এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করে নয়, বরং তাকে এমন এক পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসাবে সম্বোধন করে যার দৈহিক, মানসিক,অনুভূতিগত ও আধ্যাত্মিক জীবন একটি সুসংবদ্ধ অবিভাজ্য একক। এজন্য বলা হয়েছে:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ
অর্থ: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ কর”(সূরা বাকারা: ২০৮)।
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় মাওলানা সাইয়্যেদ মওদুদী লিখেছেন: অর্থাৎ কোন রকম ব্যতিক্রম ও সংরক্ষণ ছাড়াই নিজেদের পরিপূর্ণ জীবনকে ইসলামের অধীন করে দাও। তোমাদের চিন্তা-চেতনা, আদর্শ, মতবাদ, জ্ঞান বিজ্ঞান, রীতিনীতি, কাজকর্ম, আচার-ব্যবহার এবং তোমাদের সমগ্র প্রচেষ্টা ও কর্মের পরিসরকে পুরোপুরি ইসলামের অধীনে আন। তোমরা জীবনের কিছু অংশে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলবে আর কিছু অংশ ইসলামী অনুশাসনের বাইরে রাখবে- তা যেন না হয়”- (তাফহীমুল কুরআন, বাংলা অনু: ১ম খন্ড, পৃ: ১৮০, টীকা: ২২৬)।
গোটা মানবজাতির পরিপূর্ণ আনুগত্য আল্লাহর কাম্য। এই আনুগত্য যতটা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের কল্যাণের এবং মানব সমাজে বিশৃঙ্খলা ও বিচ্ছিন্নতার প্রতিরোধের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ছিল তার ব্যবস্থা আইন-কানুন ও রাষ্ট্রের কার্যকর শক্তির মাধ্যমে করা হয়েছে। কিন্তু আখেরাতে মানুষের মুক্তি এবং চিরস্থায়ী শান্তির ফয়সালা যে আইনের ভিত্তিতে হবে তা “নৈতিক বিধান”-ই। কারণ আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী ও আমলের ফযীলাত সবই উপরোক্ত আইনের অধীনে আসে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ইসলামে “আইনগত অধিকারের” উপর “নৈতিক বিধান ও অধিকারের” প্রাধান্য স্বীকৃত। কেননা আল্লাহ পাকের বিচারালয়ের আইন ব্যবস্থায় মূলত নৈতিক দিকের সামান্য ও অগ্রাধিকার থাকবে। তথ্যায় নৈতিক বিধানের মাধ্যমেই আমাদের ঈমান-আক্বীদা ও আমাদের ইবাদত বন্দেগীর ধরণ এবং আমাদের বাহ্যিক কার্যক্রমের অন্তর্নিহিত অবস্থা নির্ধারিত হবে। কোন ব্যক্তির মোনাফিক হওয়া সত্ত্বেও নিজের বাহ্যিকে আচরণের ভিত্তিতে মুসলমান গণ্য হওয়ার এবং মুসলমানদের নিকট থেকে ইসলাম প্রদত্ত অধিকার সমূহ আদায় করে নেওয়ার পুরোপুরি সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আল্লাহর আদালতে তাঁর ফয়সালা বাহ্যিক দিকের ভিত্তিতে নয়, বরং অন্তর্নিহিত দিকের ভিত্তিতে হবে এবং কুরআন পাকের নিম্নোক্ত সুষ্পষ্ট সিদ্ধান্ত মোতাবেক হবে:
إِنَّ اللَّهَ جَامِعُ الْمُنَافِقِينَ وَالْكَافِرِينَ فِي جَهَنَّمَ جَمِيعًا
অর্থ: “নিশ্চয়ই আল্লাহ মুনাফিকদের ও কাফেরদের জাহান্নামের মধ্যে একত্রে সমাবেশ করবেন” (সূরা নিসা: ১৪০)।
আর জাহান্নামেও তাদের বাসস্থান হবে একেবারে সর্বনিম্ন ও নিকৃষ্ট স্তরে।
إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَن تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا [٤:١٤٥]
অর্থ: “নিশ্চিত জান যে, মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্নস্তরে স্থান পাবে এবং তুমি তাদের কোন সাহায্যকারী পাবে না”- (সূরা নিসা: ১৪৫)।
এটা সেই সব লোকের পরিণতি যারা পৃথিবীতে নামায পড়ত, রোযাও রাখত, হজ্জও করত, জিহাদেও অংশগ্রহণ করত এবং আল্লাহর যিকিরে মশগুলও দৃস্টিগোচর হত। কিন্তু তাদের অন্তরের অবস্থা কি ছিল?
“এই মুনাফিকরা আল্লাহর সাথে প্রতারণা করছে, অথচ আল্লাহই তাদের ধোঁকায় নিক্ষেপ করে রেখেছেন। তারা নামায পড়তে উঠলে তাও আলস্য সহকারে, শুধু লোকদের দেখানোর উদ্দেশ্যে উঠত এবং আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করত। কুফর ও ঈমানের মাঝখানে দোদুল্যমান তাদের অবস্থা, না পূর্ণরূপে এদিকে আর না পূর্ণরূপে ওদিকে” (সূরা নিসা: ১৪৩)।
এই মুনাফিকরা তাদের আভ্যন্তরীণ অবস্থার ভিত্তিতে, যা সম্পূর্ণত নৈতিক প্রকৃতির, আল্লাহ পাকের আদালতের কঠোরতম শাস্তি ভোগ করবে এবং তাদের বাহ্যিক কার্যকলাপ, যার দরুণ তারা এই জগতে মুসলমানদের প্রদত্ত সমস্ত অধিকার ভোগ করছে, সেখানে তাদের কোন কাজে আসবে না। অথছ এই পার্থিব জগতে তাদের বাহ্যিক কার্যকলাপের কারণেই আল্লাহর রসুল পর্যন্ত তাদের কাফের ঘোষণার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। এমনকি মোনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে পর্যন্ত তিনি তার বাহ্যিক কার্যকলাপের ভিত্তিতে মুসলমানদের কাতারে শামিল হতে বাধা দিতেন না।
সমগ্র কুরআন মজীদ এবং বিশেষত কিয়ামত ও আখেরাত সম্পর্কিত আয়াত সমূহে আল্লাহ তাআলা মানুষের বাহ্যিক ও লোকচক্ষুর অন্তরালের জীবনকে নিজের সিদ্ধান্তের আসল ভিত্তি সাব্যস্ত করেছেন। এ থেকে সুষ্পষ্ট হয়ে যায় যে, আমরা এখানে যাকে “নৈতিকতা” বলি তার উপরই আমাদের মুক্তিলাভ নির্ভরশীল। ওখানে শুধু কার্যকলাপ নয়, বরং “সৎকার্য” আমাদের আসল পুঁজি হবে। আর এই “সত” শর্তটি যা এখানে সম্পূর্ণরূপে একটি নৈতিক ব্যাপার, তা ওখানে একান্তভাবেই আইনগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে আইনের উপর নৈতিকতার প্রাধান্য মহানবী সা: এর সেই হাদীস থেকেও অনুমান করা যায় যাতে তিনি তাঁর পৃথিবীতে আগমনের উদ্দেশ্য এবং নিজের সমস্ত দাওয়াত ও তাবলীগের মূল লক্ষ্যই বলেছেন: চরিত্র ও নৈতিকতার পূর্ণতা সাধন। রসুলে খোদা সা: বলেন:
(আরবী***)
অর্থ: “উত্তম চরিত্র-নৈতিকতার পূর্ণতা বিধানের জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি” (মুসনাদে আহমাদ) বায়হাকী, ইবনে সাদ)।
আর তা হচ্ছে সেই নৈতিকতা যার পেছনে আখেরাতে জবাবদিহির দায়িত্বানুভূতির মজবুত ক্রিয়াশীল শক্তি বিদ্যমান রয়েছে।
মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী মরহুম ইসলামে আইন ও নৈতিকতার মধ্যেকার এই সম্পর্কের ব্যাখ্যায় বলেন: “ইসলামের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রশস্ত দৃষ্টিতে দেখলে তার নৈতিক হেদায়াতও মূলত আইনগত বিধান। কারণ এজন্য আখেরাতে প্রতিদান ও শাস্তির ব্যবস্থা হবে, একজন মুসলমানের জীবনে যার মৌলিক গুরুত্ব রয়েছে। এই আখেরাত বিশ্বাসই সেই জিনিস যা কেবল নৈতিকতাকে আইনের মর্যাদাই দেয়নি, বরং পরিভাষায় যাকে আইন বলা হয় তারও পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। কুরআন মজীদের বাচনভঙ্গি সম্পর্কে আপনি চিন্তা করলে দেখতে পাবেন যে, তার প্রতিটি আইনগত ও নৈতিক নির্দেশের সাথে আল্লাহর ভয় ও আখেরাত চিন্তার বিষয় যুক্ত রয়েছে” (মুফতী শফী, ইসলাম কা নিযামে তাকসীমে দাওলাত, পৃ: ৪২)।