ব্যর্থতার কারণসমূহ
মানবজাতির মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে জাতীয় সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মহাসনদের ব্যর্থতার মূল্যায়ন করার পর এখন আমরা এই মৌলিক প্রশ্নে আসছি যে, শেষ পর্যন্ত মানবজাতি নিজেদের অধিকার সংরক্ষণে কোন সন্তোষজনক ব্যবস্থা নির্ধারণে এখন পর্যন্ত কেন সফল হতে পারেনি এবং এ প্রসঙ্গে তাদের চিন্তাধারা এবং দৃষ্টিভঙ্গীর অকৃতকার্যতা এবং বুদ্ধিবৃত্তি ও চেতনা শক্তির ব্যর্থতার মূল কারণসমূহ কি?
উপরোক্ত প্রশ্নের সুস্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ জবাব আমরা কুরআন মজীদে পেয়ে যাচ্ছি। কুরআনে হাকীম আমাদের বলে দিচ্ছে যে, এই সমস্ত অপ্রীতিকর অবস্থার কারণ মাত্র একটি। তোমরা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সত্তার স্থান ও মর্যাদার পরিবর্তন করে দিয়েছ এবং যেসব মনগড়া প্রভুদের নিজেদের আনুগত্যের কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে নিয়েছ তারাই আজ তোমাদের ঘাড় মটকাচ্ছে এবং তোমাদের অধিকারসমূহ পদদলিত করছে। কুরআন বলে যে, মানবজাতির সর্বপ্রথম চুক্তি তাদের সৃষ্টিকর্তা ও অধিপতি এবং এই বিশ্বজগতের প্রকৃত শাহেনশাহ ও শাসকের সাথে হয়েছিল এবং এই চুক্তির আলোকে আল্লাহ তাআলাকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মেনে নিয়ে প্রত্যেকের নিকট হতে এ শপথ গ্রহণ করা হয়েছিল যে, তাঁকে ছাড়া আর কাউকে আইনদাতা ও প্রতিপালক হিসেবে মান্য করা যাবে না এবং তাঁর সত্তা, গুণাবলী অথবা ক্ষমতায় কাউকে অংশীদারও সাব্যস্ত করা যাবে না। এই শপথ ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ মানবজাতিকে নিজের প্রতিনিধি(খলীফা)নিয়োগ করে এবং একটি জীবন ব্যবস্থা দান করে স্বীয় রাজ্যে প্রেরণ করেন, যেখানে তাদের সমস্ত ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত বিষয় ঐ জীবন ব্যবস্থা অনুযায়ী এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীর পক্ষ হতে সময়ে সময়ে নিজের নবীগণ, আসমানী কিতাবসমূহ ও সহীফার মাধ্যমে প্রাপ্ত নির্দেশনার অধীনে পরিচালনা করার ছিল।
এই চুক্তিতে-বার বার যার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, যা ক্রমাগত নবায়িতও হয়ে আসছিল এবং যা আখেরী জামানার নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ আকারে নাযিল করে এবং যে কোন প্রকারের বিকৃতি হতে নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা করে কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য পথ প্রদর্শনের স্থায়ী ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়েছে। এই চুক্তিপত্রে সর্বময় কর্তৃত্বের মালিকের অধিকার ও এখতিয়ার, তাঁর রাজত্বের সীমারেখা, তাঁর সাথে মানুষের সম্পর্কের ধরন, পৃথিবীতে মানুষের মর্যাদা, তার জীবনের উদ্দেশ্য, উদ্দেশ্য লাভের উপায়-উপকরণ, সাফল্য ও ব্যর্থতার মাপকাঠি, মানুষ ও মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনের কর্মক্ষেত্র, খোদায়ী রাজত্বে তাঁর বান্দাদের সামগ্রিক বিষয়ে তত্ত্বাবধানকারী কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার সীমারেখা, ব্যক্তির মৌলিক অধিকার, আনুগত্যের সীমা ও শর্তাবলী এবং আখিরাতে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারীর সামনে ব্যক্তির প্রতিটি কাজের জবাবদিহির পর আমলনামা অনুযায়ী পুরস্কার অথবা শাস্তিলাভের এমন সুস্পষ্ট বক্তব্য পেশ করা হয়েছে যে, তার আলোকে জীবনের সঠিক পথ পরিষ্কার ও উদ্ভাসিত হয়ে তোমাদের সামনে এসে গেছে। এখন যে কোন ব্যক্তি এ পথ অবলম্বন করবে-যাকে কুরআন মাজীদ সিরাতুল মুস্তাকিম(সরল ও সুদৃঢ় পথ) ও সাওয়াউস-সাবীল(সমতল ও ভারসাম্যপূর্ণ রাজপথ) নামে নামকরণ করেছে-সে এই পার্থিব জগতেও সাফল্য লাভ করবে এবং আখেরাতেও কৃতকার্য হয়ে জান্নাতের চিরসুখ লাভে সক্ষম হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এই রাস্তা ত্যাগ করে নিজের কল্পনাপ্রসূত অন্য কোন পথ বের করতে চাইবে, সে দুনিয়া ও আখেরাতে উভয় স্থানে ব্যর্থ ও অকৃতকার্য হয়ে দোযখের অনন্ত শাস্তির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে।
সমস্ত কুরআন মাজীদ এই সিরাতুল মুস্তাকীম ও সাওয়াউস সাবীল সুনির্দিষ্ট করার জন্য নাযিল হয়েছে এবং তাওরাত, জাবূর ও ইনজীলও জীবনের এই রাজপথ আলোকিত করে তোলার জন্যই নাযিল হয়েছিল। আদি পিতা হযরত আদম(আ) হতে সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ(সা) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলগণও একটিমাত্র পয়গাম নিয়েই আসতে থাকেনঃ হে আল্লাহর বান্দাগণ! বান্দাদেরকে নিজেদের প্রভু বানিওনা, তোমরা কেবলমাত্র একজন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সত্তার সীমাহীন, চিরস্থায়ী, সামগ্রিক এবং সৃষ্টিলোকের প্রতিটি অণুর উপর পরিব্যাপ্ত কর্তৃত্বের অধীনে জীবন যাপন করছ, তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন প্রতিপালক, কোন একচ্ছত্র শাসক ও অধিপতি, কোন মালিক-মোখতার এবং কোন রিযিকদাতা নেই। কুরআন মজীদে এক একজন নবীর কার্যক্রম পাঠ করলে দেখা যায় তাদের মিশন ছিল একটিই। তা হচ্ছেঃ নিজ নিজ যুগের শাদ্দাদ, ফেরাউন ও নমরুদের সার্বভৌমত্বের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে এবং আল্লাহর বান্দাদের তাদের দাসত্বের কবল হতে মুক্ত করে আহকামুল হাকিমীন(রাজাধিরাজ) এর সাথে তাদের দাসত্বের সম্পর্ক স্থাপন।
সর্বময় কৃতিত্বের অধিকারী এই একক সত্তার সাথে কৃত চুক্তির আনুগত্য এবং তার বিদ্রোহী হওয়ার পরিণতিতে মানব জীবনের উপর যে ব্যাপক ও সামগ্রিক প্রভাব প্রতিফলিত হয় তার বিস্তারিত পর্যালোচনা করার পূর্বে দেখা যাক যে, সেই সর্বপ্রথম প্রতিশ্রুতি কি ছিল যা আল্লাত তাআলা তাঁর বান্দাদের নিকট হতে গ্রহণ করেছিলেন।
وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِن بَنِي آدَمَ مِن ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ ۖ قَالُوا بَلَىٰ ۛ شَهِدْنَا ۛ أَن تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَٰذَا غَافِلِينَ [٧:١٧٢]
أَوْ تَقُولُوا إِنَّمَا أَشْرَكَ آبَاؤُنَا مِن قَبْلُ وَكُنَّا ذُرِّيَّةً مِّن بَعْدِهِمْ ۖ أَفَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ الْمُبْطِلُونَ [٧:١٧٣]
“স্মরণ কর! তোমার প্রতিপালক আদম সন্তানের পৃষ্ঠদেশ হতে তাদের বংশধর বের করেন এবং তাদের নিকট হতে নিজেদের সম্পর্কে সাক্ষ্য গ্রহণ করেনঃ আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলল, নিশ্চয়ই, আমরা সাক্ষী রইলাম। এই স্বীকারোক্তি গ্রহণ এইজন্য যে, তোমরা যেন কিয়ামতের দিন না বলঃ আমাদের পূর্বপুরুষরাই তো আমাদের পূর্বে শেরেক করেছে, আর আমরা তো তাদের পরবর্তী বংশধর। তবে কি পথভ্রষ্টদের কৃতকর্মের জন্য তুমি আমাদের ধ্বংস করবে”। (সূরা আরাফ: আয়াত ১৭২-১৭৩)।
পৃথিবীতে মানবজীবনের সূচনার পূর্বে গৃহীত এই প্রতিশ্রুতিতে নিম্নোক্ত দফাগুলি খুবই সুস্পষ্টঃ
১. আল্লাহ তাআলাকে নিজের একমাত্র প্রভু হিসেবে মানার স্বীকৃতি।
২. আদিকাল হতে অনাদিকাল পর্যন্ত জন্মগ্রহণকারী সকল মানুষের নিকট হতে পৃথক পৃথকভাবে আল্লাহর সাথে বিশ্বস্ততার শপথ এবং এই শপথের অনুকূলে স্বয়ং তাদের সাক্ষ্য।
৩. শেরেক তথা অন্য কাউকে খোদা মানা বা আল্লাহর সাথে শরীক বানানো হতে বিরত থাকার দৃঢ় অঙ্গীকার।
৪. বাপ-দাদা পূর্ব পুরুষদের আকীদা-বিশ্বাস ও কার্যকলাপকে ওজর হিসেবে পেশ করে শেরেকের দায় দায়িত্ব হতে রক্ষা পাওয়ার সুযোগের অবসান।
৫. কিয়ামাতের দিন নিজের পার্থিব জীবনের প্রতিটি কাজের জবাবদিহি।
সর্বপ্রথম এই প্রতিশ্রুতি গ্রহণের পর আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে তা বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে থাকেন, যাতে তারা হেদায়াতের পথ ত্যাগ করে পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত না হয় এবং নিজেদের ঘাড়ে অন্য কারো গোলামীর পিঞ্জির পেঁচিয়ে অপমান ও অধঃপতনের অতল গহবরে পতিত না হয়। মানুষের কাছ হতে সামগ্রিকভাবে যে প্রতিশ্রুতি আদায় করা হয়েছিল তার নবায়ন ও স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য আদিষ্ট বা দায়িত্বপ্রাপ্ত আম্বিয়ায়ে কেরামের নিকট হতে আবার পৃথক পৃথক প্রতিশ্রুতিও নেওয়া হয়। অথচ তাঁরা মানুষ হিসেবে সর্বপ্রথম গৃহীত প্রতিশ্রুতিতেও শরীক ছিলেন, কিন্তু তাঁদের মর্যাদাপূর্ণ পদ এবং এই পদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের অনুভূতি জাগ্রত করার জন্য ‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক ও পরিচালক’ তাঁদের নিকট হতে স্বতন্ত্রভাবে আনুগত্যের শপথ নেন।
“স্মরণ কর যখন আল্লাহ নবীগণের নিকট হতে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছিলেনঃ আজ আমি তোমাদের কিতাব ও হেকমত যা কিছু দান করেছি-কাল যদি অন্য কোন রাসূল তোমাদের নিকট রক্ষিত শিক্ষার সত্যতা প্রতিপাদন করে তোমাদের কাছে আসে তবে তোমরা তার উপর ঈমান আনবে এবং তার সাহায্য করবে। একথা বলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি স্বীকার করলে এবং এ সম্পর্কে আমার অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে? তারা বলল, হ্যা আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেন, তবে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী থাকলাম। এরপর যারা(নিজেদের প্রতিশ্রুতি থেকে) ফিরে যাবে তারাই ফাসেক।”(সূরা আল ইমরানঃ ৮১-৮২)।
খেলাফত ও নব্যূয়তের পদের অনবরত নবায়ন হতে থাকে। আল্লাহ তাআলা এক একজন নবী পাঠিয়ে তাঁর মাধ্যমে সমসাময়িক কালের উম্মাতকে নতুন করে ঐ প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে থাকেন।
“হে নবী! স্মরণ কর সেই প্রতিশ্রুতির কথা যা আমরা সকল নবীর নিকট হতে গ্রহণ করেছিলাম, তোমার নিকট হতেও এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মরিয়ম-পুত্র ঈসার নিকট হতেও, তাদের নিকট হতে গ্রহণ করেছিলাম সুদৃঢ় অঙ্গীকার। যাতে সত্যবাদী লোকদের নিকট(তাদের প্রতিপালক) তাদের সত্যবাদিতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আর তিনি কাফেরদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন”।(সূরা আল আহযাবঃ ৭-৮)।
নবীগণের নিকট হতে তিনি শুধু এই অঙ্গীকারই গ্রহণ করেননি যে, তাঁরা আল্লাহ তাআলাকে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী মানবেন এবং অন্য কারো দাসত্ব গ্রহণ করবেন না, বরং তাঁদের নিকট হতে এই প্রতিশ্রুতিও গ্রহণ করেন যে, তাঁরা পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করবেন, তাঁর বান্দাগণকে সেইসব বিদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতকদের কবল হতেও মুক্ত করবেন যারা বিদ্রোহের পথ অবলম্বন করে এবং আল্লাহর রাজত্বে নিজেদের স্বৈরশাসন কায়েম করে তাঁর প্রজাদের নিজেদের প্রজায় এবং তাঁর বান্দাদের নিজেদের গোলামে পরিণত করে তাঁদেরকে গোলামীর শৃংখলে বন্দী করে নিয়েছিল এবং তাদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত আজাদী হতে বঞ্চিত করে নিজেদের অনুগত বানানোর চেষ্টা করেছে। নবীগণকে তাদের মিশন সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিয়ে কুরআন মজীদ বলছেঃ “আল্লাহ তোমাদের জন্য সেই দ্বীন বিধিবদ্ধ করেছেন যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে, আর যা আমরা ওহী করেছি তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই বলে যে, তোমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে মতভেদ কর না।”(সূরা শূরাঃ ১৩)।
এই নবীগণ যেসব জাতির পথ প্রদর্শনের জন্য আদিষ্ট ছিলেন সেসব জাতির নিকট হতেও আল্লাহ তাআলা আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন এবং তাদেরকে তাদের কথা ও স্বীকারোক্তি স্মরণ করিয়ে দিলেন। বনী ঈসরাইলকে সম্বোধন করে তিনি বলেনঃ “আল্লাহ বনী ইসরাঈলের নিকট হতে প্রতিশ্রুতি নিলেন এবং তাদের মধ্য হতে বারজন নেতা নিযুক্ত করেছিলাম, আর আল্লাহ বলেছিলেনঃ আমি তোমাদের সংগেই আছি। তোমরা যদি নামায কায়েম কর, যাকাত দাও, আমার রাসূলগণের উপর ঈমান আন ও তাদের সম্মান কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান কর তবে তোমাদের গুনাহ অবশ্যই মাফ করে দেব এবং নিশ্চয়ই তোমাদের জান্নাতে দাখিল করব যার পাদদেশ দিয়ে নদী প্রবাহিত। এরপরও কেউ কুফরী করলে সে সরল পথ হারাবে।”(সূরা মাইদাঃ ১২)।
একই প্রতিশ্রুতি অন্যত্র এভাবে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছেঃ “স্মরণ কর যখন আমরা ইসরাঈল সন্তানদের নিকট হতে প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করবে না, মাতা-পিতা, আত্মীয় স্বজন, ইয়াতীম ও গরীবদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে এবং মানুষের সাথে ভদ্রতা সহকারে কথা বলবে, নামায কায়েম করবে ও যাকাত দিবে। কিন্তু অল্পসংখ্যক লোক ব্যতীত তোমরা বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। যখন তোমাদের নিকট হতে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছিলাম যে, তোমরা পরস্পর রক্তপাত করবে না এবং আপনজনদের দেশ হতে বহিষ্কার করবে না, অতঃপর তোমরা তা স্বীকার করেছিলে এবং এই বিষয়ে তোমরাই সাক্ষী”।(সূরা বাকারাঃ ৮৩-৮৪)।
উপরোক্ত আয়াতগুলিতে শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলাকে নিজেদের প্রভু হিসেবে মানার স্বীকারোক্তিই নয়, বরং নবীগণের মাধ্যমে প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান অনুসরণেরও প্রতিশ্রুতি লওয়া হয়েছিল। এসব আয়াত হতে আরো জানা যায় যে, আমিব্য়ায়ে কেরাম একই দাওয়াত নিয়ে আবির্ভুত হতে থাকেন। এই নামায, রোযা, যাকাত, আল্লাহর পথে সম্পদ ব্যয়, পিতামাতা, আত্মীয় স্বজন, ইয়াতীম ও দরিদ্রদের সাথে সদ্ব্যবহার, সত্যভাষণ, মানুষের জীবনের মর্যাদাবোধ এবং লোকদের অত্যাচার নির্যাতনের শিকারে পরিণত করা থেকে বিরত থাকার উপদেশ কেবলমাত্র মুহাম্মাদ(সা) এর উম্মাতকেই দেওয়া হয়নি, পূর্বেকার উম্মাতগণকেই এই উপদেশ দেওয়া হয়েছিল এবং আল্লাহ তাআলা মানব সমাজকে নৈতিক ভিত্তির উপর গড়ে তোলার জন্য সর্বদা একই জীবন ব্যবস্থার অনুসরণের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন। বনী ইসরাঈলকে সূরা বাকারা ৬৩ ও ৯৫, আল ইমরান ১৮৭ এবং নিসা ১৫৪-৫৫ আয়াতসমূহেও আল্লাহর সাথে কৃত প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এখন হযরত ঈসা(আ) এর উম্মাত সম্পর্কে নিম্নোক্ত বাণীসমূহ প্রণিধানযোগ্যঃ
“অনুরূপভাবে আমরা সেই সব লোকের নিকট হতেও প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছি যারা বলেছিল, আমরা নাসারা(খৃস্টান)। কিন্তু তাদেরকেও যে শিক্ষা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার বিরাট অংশ তারা ভুলে গেছে”।(সূরা মাইদা: ১৪)।
পূর্বকালের উম্মাতগণের নিকট হতে নেওয়া প্রতিশ্রুতি, এসব উম্মাতের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং তাদের ধ্বংসাত্মক পরিণতির বিবরণ শুনানোর পর কুরআন মাজীদ আখেরী জামানার নবীর উম্মাতকে সম্বোধন করে বলেঃ
“আল্লাহ তাআলা তোমাদের (মুসলমানদের) যে নিআমত(দীন) দান করেছেন তা স্মরণ রাখ এবং তিনি তোমাদের নিকট হতে যে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন তা ভুলে যেও না। অর্থাৎ তোমাদের এই কথা যে, আমরা শুনলাম ও আনুগত্য করলাম এবং আল্লাহকে ভয় কর। অন্তরসমূহে যা কিছু আছে তা আল্লাহ সম্যক জ্ঞাত।”(সূরা মাইদাঃ৭)।
প্রত্যেক উম্মাতকে পৃথক পৃথকভাবে তাদের প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে সর্বপ্রথম প্রতিশ্রুতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে গোটা মানব গোষ্ঠীকে সম্বোধন করে বলেনঃ
“হে মানব সন্তান! আমি কি তোমাদের নির্দেশ দিইনি যে, তোমরা শয়তানের দাসত্ব কর না, কারণ সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন; আর আমারই দাসত্ব কর, এটাই সরল পথ।” (সূরা ইয়াসীনঃ ৬০-৬১)।
মানবজাতিকে তাদের প্রতিশ্রুতির জিম্মাদারির অনুভূতি জাগ্রত করার সাথে সাথে কুরআন মাজীদ প্রতিশ্রুতির অনুসরণ ও তার বিরুদ্ধাচরণের পরিণতিও সুস্পষ্ট করে সামনে তুলে ধরেছে, যাতে মানুষ এই ভুলের শিকার না হয় যে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য তাদের গ্রেফতার করা হবে না এবং এই উদাসীনতায় লিপ্ত না হয় যে, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলে তারা আর কি পাবে। আল্লাহ তাআলা প্রতিশ্রুতি পালনকারীদের মহান পুরস্কারের সুসংবাদ এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারীদের মর্মন্তুদ শাস্তির দুঃসংবাদ শুনিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে নিজ বান্দাদের সঙ্গে স্বয়ং একটি সুদৃঢ় প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হচ্ছেন। “হ্যাঁ, যে ব্যক্তিই নিজ প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবে এবং নোংরামি হতে দূরে থাকবে সে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হবে। কারণ মুত্তাকীগণকে আল্লাহ পছন্দ করেন। আর যারা আল্লাহর পথে কৃত প্রতিশ্রুতি ও নিজেদের শপথকে তুচ্ছ মূল্যে বিক্রয় করে-আখেরাতে তাদের কোন অংশ নাই।”(সূরা আল ইমরানঃ ৭৬-৭৭)।
“যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পরে তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক আল্লাহ অক্ষুণ্ন রাখতে আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং দুনিয়ায় অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।”(সূরা বাকারাঃ ২৮)।
এই একই কথা সামান্য শাব্দিক পার্থক্য সহকারে সূরা রাদের ২৫ নং আয়াতেও বলা হয়েছে। প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারীর মর্যাদার পার্থক্য এবং তাদের সাথে নিজের ভিন্নরূপ আচরণের কারণ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
“তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের উপর যা নাযিল হয়েছে তা যে ব্যক্তি সত্য বলে জানে সে আর অন্ধ ব্যক্তি কি এক সমান হতে পারে? কেবল বিবেকবান লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে। তাদের নীতি এই যে, তারা আল্লাহকে প্রদত্ত অঙ্গীকার রক্ষা করে এবং প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে না।”(সূরা রা’দঃ ১৯-২০)।
কুরআন পাকের আয়াত থেকে প্রতিভাত হয় যে, হযরত আদম(আ) হতে মানব গোষ্ঠীর সর্বশেষ সদস্য পর্যন্ত একে একে আমাদের মধ্যকার প্রত্যেক ব্যক্তি প্রথম প্রতিশ্রুতি এবং তারপর প্রত্যেক নবীর মাধ্যমে উক্ত প্রতিশ্রুতির নবায়নের অধীনে নিজের স্রষ্টা ও মালিকের সাথে এই চুক্তিতে আবদ্ধ যে, তিনি ছাড়া আর কাউকে তারা নিজেদের রব ও প্রতিপালক হিসেবে গ্রহণ করবে না, তিনি ছাড়া আর কারো সামনে আনুগত্যের মস্তক অবনত করবে না, তিনি ছাড়া আর কাউকে একচ্ছত্র অধিপতি ও শাসক হিসেবে স্বীকার করবে না এবং এই একচ্ছত্র অধিপতির পক্ষ হতে আম্বিায়ায়ে কেরামের মাধ্যমে যে পথ-নির্দেশ ও আইন-বিধান তারা লাভ করতে থেকেছে এবং এখন নবীগণের শেষ ব্যক্তিত্ব হযরত মুহাম্মাদ(সা) এর মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রাপ্ত হয়েছে এবং যা কিয়ামত পর্যন্ত সুরক্ষিত করে দেওয়া হয়েছে- সেই অনুযায়ী তারা নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের নির্মাণ ও পুনর্গঠন করবে। তাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি যদি খোদায়ী দাবী করে তবে তার দাবী তার মুখের উপর ছুঁড়ে মারবে এবং তাদের সাথে ঠিক সেরূপ ব্যবহার করা হবে যেরূপ ব্যবহার বিদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতকদের সাথে করা হয়ে থাকে। সে নিজেও আল্লাহর আনুগত্য করবে এবং অন্যদেরও তাঁর আনুগত্য কবুলের দাওয়াত দেবে। জীবনের কোন ব্যাপারেই সে তার প্রতিপালক, তাঁর প্রেরিত নবী-রসূল এবং তাদের আইনের আনুগত্যকারী সমসাময়িক কর্তৃত্ব সম্পন্ন লোকদের ছাড়া আর কারো কথা মানবে না এবং শেরেক হতে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে।
আল্লাহ তাআলার সাথে কৃত প্রথম প্রতিশ্রুতি এবং তার নবায়নকারী চুক্তিসমূহের বিশ্লেষণের পর এখন দেখা যাক যে, আল্লাহ তাআলাকে একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে মেনে নেওয়ার অথবা তাঁর একচ্ছত্র ক্ষমতা অস্বীকার করার কি পরিণতি মানবজীবনে দেখা দেয় এবং শুধুমাত্র এই একটি মাত্র সিদ্ধান্তের দ্বারা সত্য মিথ্যার দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে পেতে কোথায় গিয়ে পৌছে এবং আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের মহান পদে সমাসীন মানুষ- যারা নিজেদের স্রষ্টার পর এই পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্তা- নিজেদের মহত্ব ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়ে অধ:পতনের কোন অতল ও অন্ধকার গহবরে পতিত হয়।
আল্লাহ তায়ালার সাথে কৃত প্রতিশ্রুতির অধীনে কেবলমাত্র তাঁকে একচ্ছত্র অধিপতি হিসাবে মেনে নিলে এবং তাঁর ইবাদত-বন্দেগী ও দাসত্বের চুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকলে নিম্নোক্ত ফলাফলসমূহ সরাসরি আমাদের সামনে প্রতিভাত হয়।
১. রাষ্ট্র কোন সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে নয়, বরং মানুষ ও তার স্রষ্টার মধ্যে অনুষ্ঠিত চুক্তির মাধ্যমে অস্তিত্ব লাভ করেছে।
২. এই চুক্তির আলোকে রব কেবল একজনই অবশিষ্ট তাঁর বান্দা।
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ
অর্থ: “বস্তুত সার্বভৌমত্বের ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্যই নয়” ( সূরা ইউসুফ : ৪০)।
أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ
অর্থ: সাবধান! সৃষ্টি তাঁরই এবং হুকুম ও চলবে তাঁর”। (সূরা আরাফ- আয়াত: ৫৪ )।
৩. তাঁর ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বে কোন অংশীদার নাই এবং তাঁর কোন সমকক্ষও নাই।
وَلَمْ يَكُن لَّهُ شَرِيكٌ فِي الْمُلْكِ
অর্থ: “বাদশাহীর ব্যাপারে তাঁর কোন শরীক নাই” ( বনী ইসরাঈল- ১১১)।
وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا
অর্থ: তিনি তাঁর রাজ্য শাসনে কাউকেও শরীক করেন না- সূরা কাহফ: ২৬।
وَلَا تَدْعُ مَعَ اللَّهِ إِلَٰهًا آخَرَ ۘ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ
-আল্লাহ ছাড়া অপর কাউকে ইলাহ ডেকনা, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই- সূরা কাসাস : ৮৮।
৪. এই শাসন কর্তৃত্ব চিরস্থায়ী এবং সর্ব ব্যাপক। এই বিশ্ব জাহানের একটি অণুও তাঁর কর্তৃত্বের বাইরে নয়।
لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا وَمَا تَحْتَ الثَّرَىٰ [٢٠:٦]
অর্থ: যা আছে আকাশ মন্ডলীতে, পৃথিবীতে, এই দুইয়ের মধ্যবর্তী স্থানে ও ভূখন্ডে এসব কিছুর মালিকানাই তাঁর (সূরা ত্বাহা : ৬)।
وَلَهُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ كُلٌّ لَّهُ قَانِتُونَ [٣٠:٢٦]
অর্থ: আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা সবই তাঁর। সকলেই তাঁর আজ্ঞাবহ। সূরা রূম: ২৬।
৫. আমাদের এই পৃথিবী এবং এর বাইরের গোটা বিশ্বজগত একই রাজ্য একই রাজত্ব।
تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ [٦٧:١]
অর্থ: মহা মান্বিত তিনি- সর্বময় কর্তৃত্ব যাঁর করায়ত্ব। তিনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। সূরা মুলক : ১ ।
وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ
অর্থ: তাঁর রাজত্ব আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীময় পরিব্যপ্ত। সূরা বাকারা: ২৫৫।
৬. মানুষ এই পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি এবং এই হিসাবে সে স্রষ্টার পর এই বিশ্বের সর্বাপেক্ষা মহান ও সম্মানিত সত্তা।
وَهُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ الْأَرْضِ
অর্থ: তিনিই এই দুনিয়ায় তোমাদেরকে প্রতিনিধি করেছেন- সূরা আনআম: ১৬৫।
وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَىٰ كَثِيرٍ مِّمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا [١٧:٧٠]
অর্থ: আমরা আদম সন্তানদের মর্যাদা দান করেছি এবং তাদের স্থলে ও সমুদ্রে চলাচলের বাহন দিয়েছি, তাদের উত্তর রিযিক দান করেছি এবং আমরা যাদের সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের উপর এদেরকে শ্রেষ্টত্ব দান করেছি।- সূরা বনী ইসরাঈল: ৭০।
৭. একক কর্তৃত্ব ও একক রাজত্বে যৌক্তিক পরিণতি হচ্ছে মানবতার অখন্ডতা। সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী একই শাসকের প্রজা এবং একই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে সকল মানুষ সমান। বর্ণ, গোত্র, ভাষা ও আঞ্চলিক সমস্ত পার্থক্য ও সমস্ত স্বাতন্ত্র্য ভিত্তিহীন।
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَىٰ وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا
অর্থ: হে মানব জাতি! আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী হতে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা পরষ্পরের সাথে পরিচিত হত পার- সূরা হুজুরাত: ১৩।
إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ
অর্থ: আল্লাহর কাছে দ্বীন তো শুধুমাত্র ইসলাম। – সূরা আল ইমরান : ১৯।
এটা কেবল মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সা: এর পেশকৃত দীন নয়, বরং সকল আম্বিয়া কেরাম একই দীনের দাওয়াত দিতে থাকেন এবং তাঁরা সকলে ছিলেন মুসলমান।
قُولُوا آمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنزِلَ إِلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَىٰ وَعِيسَىٰ وَمَا أُوتِيَ النَّبِيُّونَ مِن رَّبِّهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ [٢:١٣٦]
অর্থ: তোমরা (মুসলমানগণ) বল, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহতে এবং যা নাযিল হয়েছে আমাদের নিকট, ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার বংশধরদের প্রতি এবং যা তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে মূসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীগণকে দেওয়া হয়েছে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে। আমরা তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য করিনা এবং আমরা তাঁর নিকট আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম)- সূরা বাকারা : ১৩৬।
৯. একই জীবনবিধান- মানব জাতির জন্য ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত দিক থেকে একই আচরণবিধি গঠনের জন্য মজবুত ও গভীর ভিত্তি সমূহ সরবরাহ করেছে। প্রকৃতগত যোগ্যতার পার্থক্য, ঝোঁক-প্রবণতা ও রুচির পার্থক্য, দায়িত্ব ও কর্তব্যের বৈচিত্র সত্ত্বেও উদ্দেশ্য-লক্ষ্যের ঐক্য এবং আচরণ বিধি গঠনের মৌলিক অনুভূতি ও কার্যকারণের ঐক্য মানুষকে চিন্তা ও কর্মের দিক থেকে একই রং -এ রঞ্জিত করেছে, আল্লাহ তায়ালা যার নামকরণ করেছেন ‘সিবগাতুল্লাহ’।
صِبْغَةَ اللَّهِ ۖ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ صِبْغَةً ۖ وَنَحْنُ لَهُ عَابِدُونَ [٢:١٣٨]
অর্থ: আল্লাহর রং ধারণ কর, তাঁর রং- এর চেয়ে উত্তম রং আর কার হতে পারে। আর আমরা তাঁরই ইবাদতকারী- সূরা বাকারা: ১৩৮।
১০. মানবজাতির এই জীবন বিধান উন্নততর নৈতিক ও আত্মিক মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্টিত। তাই তা স্বার্থের সংঘাত, শ্রেণীবৈষম্যের অস্তিত্ব এবং ব্যক্তিক ও সামষ্টিক জীবনে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সম্ভাবনা সম্পূর্ণ খতম করে দিয়ে সমস্ত মানুষের মধ্যে পূর্ণ মানসিক ঐক্য ও বাস্তব সহযোগিতার মজবুত সম্পর্ক গড়ে তোলে- যা ছিনতাই, লুটতরাজ, শোষণ এবং লোভ লালসার শিকড় কেটে দিয়ে মানুষের মধ্যে পারষ্পরিক সহমর্মিতা ও নি:স্বার্থতার প্রাণশক্তি জাগরিত করে। এভাবে তা বৈষয়িক স্বার্থের উপর ভিত্তিশীল শ্রেণীগুলোর সংগঠিত হওয়ার সম্ভাবনা খতম করে একটি শ্রেণীহীন সমাজ অস্তিত্বে আনয়ন করে। নৈতিকতা হচ্ছে এই জীবন ব্যবস্থার প্রাণ ও ভিত্তি প্রস্তর। কুরআন মজীদ এই নৈতিকতাকে মহানবী সা: এর সর্বশ্রেষ্ট গুণবৈশিষ্ট্য ঘোষণা করেছে।
وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ [٦٨:٤]
অর্থ: তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রে অধিষ্টিত। সূরা: কালাম: ৪।
لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ
অর্থ: তোমাদের জন্য আল্লাহর রসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। সূরা আহযাব : ২১।
১১. এই জীবন ব্যবস্থায় মানবজাতির জন্য প্রতিযোগিতার একটি ময়দানের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে, যাতে চেষ্টা সাধনার আগ্রহ এবং অন্যদের অতিক্রম করে সামনে অগ্রসর হয়ে যাওয়ার স্বভাবসুলভ আকাংখা মানুষকে তার ব্যক্তিগত যোগ্যতার স্ফূরণ এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধনে সাহায্য প্রদান করতে পারে। কিন্তু প্রতিযোগিতার এই আগ্রহকে বৈষয়িক উপকরণ লাভ এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ ও লালসা পূরণের এমন সব উত্তেজক বিষয় থেকে পবিত্র করা হয়েছে যা মানুষকে মানুষের শত্রুতে পরিণত করে তাকে পশুত্বের নীচ পর্যায়ে নামিয়ে দেয়। এখানে প্রতিযোগিতা হচ্ছে ‘তাকওয়ার’, অর্থাৎ আত্মার পবিত্রতা ও উচ্চতর নৈতিকতা, মন-মগজের পূর্ণ একাগ্রতা এবং ব্যক্তিত্বের পূর্ণ সমর্পণের সাথে আল্লাহর বিধানের আনুগত্য। এখানে বড়ত্বের অর্থ এই নয় যে, কোন ব্যক্তির তার প্রতিপক্ষের তুলনায় অধিক সম্পদের অধিকারী হয়ে যাওয়া, সুউচ্চ ও সুপ্রশস্ত অট্টালিকায় বসবাস করা এবং সেইসব জীবনোপকরণের মালিক হওয়া যা থেকে লাখো মানুষ বঞ্চিত। বরং আসল বড়ত্ব হচ্ছে- নিজের উত্তম কার্যকলাপ ও আনুগত্যের উৎকৃষ্ট রেকর্ডের ভিত্তিতে আল্লাহর দরবারে সম্মানের পাত্র বিবেচিত হওয়া এবং অন্যদের তুলনায় উত্তম প্রতিদান ও পুরষ্কারের অধিকারী হওয়া।
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
অর্থ: মূলত: তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক পরহেযগার। – সূরা হুজুরাত : ১৩।
এটাই হলো আল্লাহ তাআলার প্রতিষ্ঠিত মর্যাদার মাপকাঠি। মানব সমাজে এখন অপরদের উপর প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হলে তা কেবল সৎকাজ ও পরহেজগারীর ময়দানে অগ্রবর্তী হওয়ার মাধ্যমে। সম্মান, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের অন্য মাপকাঠির আল্লাহ তাআলারকাছে কোন গুরুত্ব নেই।
১২. আল্লাহর নির্ধারিত জীবন বিধান নামেমাত্র সুন্দর নৈতিক মূলনীতির কোন প্রাণহীন সংকলন নয়। তার বাস্তবায়নের জন্য এর পশ্চাতে একটি মজবুত ও শক্তিশালী সংস্থা রয়েছে এবং এই বাস্তবায়নকারী শক্তি এর আসল প্রাণ।
মহান আল্লাহর বাণী:
فَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ [٩٩:٧]وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ [٩٩:٨]
অর্থ: ক্বেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা সে দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও সে দেখতে পাবে। – সূরা যিলযাল: ৭,৮।
إِنَّا أَنذَرْنَاكُمْ عَذَابًا قَرِيبًا يَوْمَ يَنظُرُ الْمَرْءُ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ
অর্থ: আমরা তোমাদেরকে আসন্ন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করেছি, সেদিন মানুষ তার কৃতকর্ম চাক্ষুস দেখতে পাবে এবং কাফেররা বলবে, হায়! আমি যদি মাটি হতাম। – সূরা নাবা : ৪০।
إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ
অর্থ: আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমাদের তাঁর নিকটই ফিরে যেতে হবে। -সূরা বাকারা: ১৫৬।
আখেরাতের জবাবদিহির এই অনুভূতি মানব জীবনে দায়িত্ববোধের উপাদান প্রবিষ্ট করে তাকে লাগামহীন হওয়া থেকে রক্ষা করে এবং সে নিজের প্রবৃত্তির ইংগিতে পরিচালিত হওয়ার পরিবর্তে নিজের প্রতিটি কাজে তার মালিকের সন্তোষ এবং তাঁর সামনে নিজের সৌভাগ্য ও কৃতকার্যতার খেয়াল রাখে।
১৩. আল্লাহ তাআলার রাজ্যে পূর্ণরূপে আইনের রাজত্ব বিদ্যমান। বান্দার কাজ শুধু এই আইনের আনুগত্য করা এবং প্রতিনিধি (খলীফা) হিসাবে তা বাস্তবায়ন করা। তাদের মধ্যে কারও, এমনকি কোন নবীরও আল্লাহর বিধানে কোনরূপ সংশোধন ও রহিতকরণ অথবা হ্রাসবৃদ্ধির অধিকার নেই। এর আনুগত্য করা যেমন একজন সাধারণ মানুষের জন্য অপরিহার্য, অনুরূপভাবে আল্লাহর নবীও তার অনুসরণ করতে বাধ্য। আইনের শাসনের এই ধারণা আল্লাহর দীন ব্যতীত আর কোথাও পাওয়া যাবে না।
إِنَّا أَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ
অর্থ: আমরা তোমার নিকট এই গ্রন্থ সত্য সহকারে নাযিল করেছি, যাতে তুমি লোকদের মাঝে সেই সত্য জ্ঞান অনুসারে ফায়সালা করতে পার যা আল্লাহ তোমাকে দান করেছেন- সূরা নিসা : ১০৫।
قُلْ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أُبَدِّلَهُ مِن تِلْقَاءِ نَفْسِي ۖ إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَىٰ إِلَيَّ ۖ إِنِّي أَخَافُ إِنْ عَصَيْتُ رَبِّي عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ
অর্থ: হে মুহাম্মাদ! বল, নিজের পক্ষ থেকে তাতে কোনরূপ পরিবর্তন করার অধিকার আমার নেই। আমি তো কেবল সেই ওহীর অনুসরণ করি যা আমার উপর নাযিল করা হয়। আমি আমার প্রতিপালকের অবাধ্যাচরণ করলে এব ভয়ংকর এক দিনের শাস্তির ভয় আমার রয়েছে। – সূরা ইউনুস : ১৫।
১৪. আল্লাহ তাআলার চিরস্থায়ী, হস্তান্তর অযোগ্য ও অপরিবর্তনীয় একচ্ছত্র ক্ষমতার অনুরূপ তাঁর পক্ষ থেকে নির্ধারিত মানুষের মৌলিক অধিকার সমূহও স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়। তার পরিবর্তন বা বাতিলকরণের অধিকার কারো নেই। এই নিরাপদ ও সুনিশ্চিত অধিকার সমূহ ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে এক শক্তিশালী সম্পর্ক কায়েম করে এবং পারষ্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিবর্তে উভয়কে পরষ্পরের সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক বানিয়ে দেয়। আল্লাহ তাআলার আইনসমূহ ভবিষ্যতে পরিবর্তন হওয়ার নয়। তিনি যেসব ক্ষেত্রে মানুষকে স্বাধীনতা দান করেছেন তাতে অন্য কারো হস্তক্ষেপের এখতিয়ার নাই এবং যেসব ব্যাপারে সুষ্পষ্ট বিধান দিয়েছেন সে ক্ষেত্রে অপর কারো আইন প্রণয়নের অধিকার নাই।
وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَعَدْلًا ۚ لَّا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ
অর্থ: তোমার প্রতিপালকের কথা সততা ও ন্যায় ইনসাফের দিক থেকে পূর্ণাংগ, তাঁর বিধানের কোন পরিবর্তন নাই। -সূরা আনআম : ১১৫।
لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ
অর্থ: আল্লাহর তৈরী কাঠামো পরিবর্তন করা যায় না। এটা সম্পূর্ণ সত্য সঠিক দীন। – সূরা রূম : ৩০।
وَلَن تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّهِ تَبْدِيلًا
অর্থ: তুমি আল্লাহর নিয়মে কোন পরিবর্তন পাবে না। সূরা আহযাব : ৬২।
وَلَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِ اللَّهِ
অর্থ: আল্লাহর বাণী (বিধান) পরিবর্তনের অধিকার কারো নেই। -সূরা আনআম :৩৪।
আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান একটি স্থায়ী সংবিধানের মর্যাদা রাখে। যার কোন একটি ধারাও কিয়ামত পর্যন্ত পরিবর্তন হতে পারে না।
আল্লাহ তাআলার সাথে কৃত স্থায়ী চুক্তির এসব পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা করলে আপনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর বন্দেগীর শপথ গ্রহণ করে মানব জাতির প্রতি বিরাট করুণা করেছেন। এই অংগীকার মূলত মানবজাতির স্বাধীনতার মহাসনদ, যার মাধ্যমে মানুষের উপর থেকে মানুষের প্রভূত্ব খতম করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা যে মানুষকে সর্বোত্তম অবয়বে সৃষ্টি করেছেন:
وَصَوَّرَكُمْ فَأَحْسَنَ صُوَرَكُمْ
অর্থ: তিনি তোমাদের চমতকার আকৃতি দান করেছেন- (৪০ : ৬৪)
لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ [٩٥:٤]
অর্থ: আমরা তো মানুষকে সুন্দরতম গঠনে সৃষ্টি করেছি- (৯৫ : ৪)
যাকে জ্ঞান ভান্ডার দান করা হয়েছে।
وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا
অর্থ: এবং তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন-( ২ : ৩১)।
যার সেবার জন্য সৃষ্টিলোকের সবকিছু নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয়েছে।
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ سَخَّرَ لَكُم مَّا فِي الْأَرْضِ وَالْفُلْكَ تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِأَمْرِهِ
অর্থ: তুমি কি লক্ষ্য কর না যে, আল্লাহ তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা সবই এবং তাঁর নির্দেশে সমুদ্রে বিচরণশীল নৌযানসমূহও ( ২২: ৬৫) এবং যার মধ্যে নিজের রূহ থেকে ফুঁকে দিয়ে ফেরেশতাদের সিজদা লাভের পাত্র বানানো হয়েছে।
وَنَفَخْتُ فِيهِ مِن رُّوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ
অর্থ: এবং তাতে যখন আমার রূহ সঞ্চার করব তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হবে- (১৫: ২৯)।
সেই মানুষ স্বয়ং নিজের মত মানুষের অথবা নিজের সেবায় নিয়োজিত অন্যান্য সৃষ্টির সামনে সিজদাবনত হবে এবং আল্লাহ প্রদত্ত মহত্ব ও মর্যাদাকে জলাঞ্জলি দিয়ে অপমান ও অধ:পতনের অতল গহবরে নিমজ্জিত হবে- এটা আল্লাহর কাছে খুবই অপছন্দনীয়। তিনি মানুষকে স্বয়ং তার স্বার্থে এ কথা পুন:পুন স্মরণ করিয়ে দেন যে, তৌহিদের আকীদায়ই রয়েছে তোমাদের জন্য সম্মান ও মর্যাদা এবং সম্ভ্রম, মাহাত্ম্য, গাম্ভীর্য ও গৌরব। তোমরা তা থেকে চুল পরিমাণ বিচ্যুত হলে ধ্বংস ও বিপর্যয় অনিবার্য। তাই কুরআন মজীদ দুটি বিষয়ের উপর বিশেষ জোর দিয়েছে: (এক) আল্লাহর একত্ব এবং (দুই) মানুষের বন্দেগীর ধরণ। সে এই মৌলিক সম্পর্ককে বিভিন্ন স্টাইলে বর্ণনা করেছে এবং মানুষকে অন্য কোন মানুষের সামনে অথবা কোন জিনিসের সামনে সিজদাবনত হতে নিষেধ করেছে।
কুরআন বলে:
১. তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদের ডাক তারা তোমাদের মতই বান্দা- সূরা আরাফ : ১৯৪।
২. তিনিই আল্লাহ তোমাদের প্রতিপালক, সার্বভৌমত্ব তাঁরই। তোমরা তাঁর পরিবর্তে যাদের ডাক তারা তো খেজুর বীচির আবরণের (তুচ্ছাতিতুচ্ছ বস্তুরও) মালিক নয়। – সূরা ফাতির : ১৩।
৩. আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীতে যদি দুজন ইলাহ হত তবে উভয়ের ব্যবস্থাপনা বিপর্যস্ত হয়ে যেত। -সূরা আম্বিয়া : ২২।
৪. তাঁর সাথে অপর কোন ইলাহ নাই, যদি থাকত তবে প্রত্যেক ইলাহ নিজ নিজ সৃষ্টি নিয়ে পৃথক হয়ে যেত এবং একে অপরের উপর আধিপত্য বিস্তার করত।- সূরা মুমিনুন : ৯১।
৫. বল ( হে মুহাম্মাদ) তাদের বক্তব্য অনুযায়ী যদি তাঁর সাথে আরও ইলাহ থাকত তবে তারা আরশের মালিকের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উপয় অন্বেষণ করত। – সূরা বনী ইসরাঈল: ৪২।
৬. আল্লাহ একটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। এক ব্যক্তির মালিক অনেকজন – যারা পরষ্পর শত্রু ভাবাপন্ন এবং অপর এক ব্যক্তির মালিক একজন। এই দুই জনের অবস্থা কি সমান। – সূরা যুমার : ২৯।
প্রভূত্বের দাবীদারদের আসল চেহারা তুলে ধরার জন্য এবং মানব বিবেককে এগুলোর প্রভাবমুক্ত করার উদ্দেশ্য কুরআন পাকের নিম্নোক্ত বক্তব্য অনুধাবনযোগ্য।
“হে মানুষ! একটি উপমা দেওয়া হচ্ছে, মনোযোগ সহকারে তা শোন। তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ডাক তারা তো কখনও একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, এই উদ্দেশ্যে তারা সকলে একত্র হলেও। আর মাছি তাদের নিকট থেকে যদি কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায় তবে তাও তারা এদের নিকট থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম নয়। অন্বেষক ও অন্বেষিত কতই না দূর্বল। – সূরা হজ্জ্ব : ৭৩।
এখন বলুন, আল্লাহর গোলামদের পৃথিবীর কোন বড় থেকে বৃহত্তর শক্তি কি নিজেদের গোলাম বানাতে পারে? আছে কি এমন কোন সার্বভৌম শক্তি যে তাদের মাথা নিজের সামনে অবনত করার জন্য বাধ্য করতে পারে?
(উর্দূ শের ***)
একটি সিজদা যাকে মনে কর বোঝা
অথচ তা দিয়ে অসংখ্য প্রভু
অমান্য করা সোজা। – ইকবাল।
আল্লাহ তাআলাকে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হিসাবে স্বীকার করে নেওয়ার এই যৌক্তিক পরিণতি এবং তা থেকে অস্তিত্ব লাভকারী মানব সমাজের একটি মোটামুটি চিত্র দেখে নেওয়ার পর এখন সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী আল্রাহকে না মানার কারণে এবং তাঁর সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি লংঘন করার ক্ষেত্রে যে পরিণতি ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং আজ আমাদের দৃষ্টির সামনে সুষ্পষ্টভাবে যা প্রতিভাত হচ্ছে তার মূল্যায়ন করে দেখুন।
১. মানুষ আল্লাহর সাথে কৃত চুক্তি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করার সাথে সাথে এই প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে যে, তারা নিজেদের অধিকার সমূহের, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব লাভের ও শাসক শ্রেণীর ক্ষমতার বৈধতার সার্টিফিকেট পাবে কোথায়? কোন্ সংবিধানের বরাতে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যেকার সম্পর্ক নিধারিত হবে? এই প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে তাকে প্রকৃত চুক্তির স্থলে সামাজিক চুক্তির নামে একটি কাল্পনিক চুক্তি দাঁড় করাতে হয়।
২. আসল চুক্তি মানুষের নিকট থেকে নিজেদের স্রষ্টা ও মালিককে প্রভূ হিসাবে মেনে নেওয়ার শপথ নিয়েছিল। মনগড়া চুক্তি তাদেরকে নিজেদেরই মত মানুষের সামনে মাথা নত হতে বাধ্য করে এবং এভাবে মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্বের সূচনা হয়।
৩. আসল চুক্তি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কেবল একজন মাত্র সত্তাকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু মনগড়া চুক্তি হাজারো সর্বময় ক্ষমতার মালিক অস্তিত্বে আনয়ন করে যাদের হাতে প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারীর সমস্ত অধিকার ও এখতিয়ার অর্পণ করা হয় এবং এক খোদার দাসত্বের পরিবর্তে মানুষকে নিজেদের মনগড়া প্রভূদের দাসত্বের জিঞ্জির গলায় ঝুলাতে হয়েছে।
৪. কর্তৃত্বের ঐক্য রাষ্ট্রীয় ঐক্যের জন্ম দিয়েছিল। এখন কর্তৃত্বের সংখ্যাধিক্য দুনিয়াকে হাজারো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্টে বিভক্ত করে মানবতার ঐক্যকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছে।
৫. আল্লাহ তাআলার কর্তৃত্ব চিরস্থায়ী সর্বব্যাপী। এখন সাময়িক ও সীমিত কর্তৃত্বের অধিকারী অস্তিত্ব লাভ করেছে এবং এরা যখন নিজ নিজ ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য ও নিজেদের রাজ্যসীমা বর্ধিত করার জন্য হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করল তখন থেকে অন্যায়-অত্যাচার ও বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলার সূচনা হল। মানুষের মনগড়া এই প্রভূরা পরষ্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ল। তাদের উক্ত সংঘাত, ক্ষমতার লালসা, বিলাসিতা ও শোষণ মানব জগতের শান্তি ও নিরাপত্তা বিনাশ করছে।
৬. মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে এই দুনিয়ায় মর্যাদা ও মাহাত্মের উচ্চতম স্থানে অধিষ্টিত ছিল এবং সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে স্বীকৃত ছিল। কিন্তু এখন সে তারই মত মানুষের প্রভুত্বের অধীনে সৃষ্টির নিকৃষ্টতম জীবে পরিণত হয়েছে। তার কানাকড়িও মূল্য নাই, কোন সর্বময় ক্ষমতার মালিক তাকে হিংস্র জন্তুর কবলে নিক্ষেপ করে তামাশা উপভোগ করছে, কেউ তাকে আগুনের লেলিহান শিখায় নিক্ষেপ করে বহুৎসব করছে, কেউ তাকে গ্যাস চেম্বারের ইন্ধন বানিয়েছে, কেউ তার কাঁধে কলুর ঘানির জোয়াল চাপিয়েছে, কেউ তার ঘাড়ের উপর নিজের ক্ষমতার মসনদ স্থাপন করে তাকে ভারবাহী পশুতে পরিণত করেছে, কেউ তার গলায় কুকুরের শিকল বেঁধে ভেড়া-বকরীর মত হাটে-বাজারে নিয়ে তাকে বিক্রি করেছে, কেউ তার মাথায় আণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছে, কেউ মহাসাগরের অথৈ জলে ডুবিয়ে দিয়েছে এবং আজও তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে যে, তাদের মধ্যে কে প্রতি সেকেন্ডে হাজার হাজার আদম সন্তান ধবংস করতে সক্ষম। মোট কথা এসব কৃত্রিম প্রভুরা মানবজাতির জীবনকে দূর্বিসহ করে তুলেছে, তাদের হাতে না তাদের জীবন নিরাপদ, না তাদের সম্পদ, না মান সম্মান। তারা এমন এক শাস্তিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে যা থেকে মুক্তি লাভের পথ তাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।
৭. আল্লাহ তাআলা মানুষকে মর্যাদাগত দিক থেকে সমান ঘোষণা করেছেন। এখন বর্ণ, গোত্র, ভাষা, ভৌগোলিক অবস্থান এবং অন্যান্য বৈশিষ্টের উপর ভিত্তিশীল দলবদ্ধতা তাকে বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত করে দিয়েছে এবং তার জাতীয় স্বার্থের ব্যাপ্তি ও সংরক্ষণ চিন্তা যথারীতি একটি মতবাদের রূপ ধারণ করে জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছে, যা ক্ষুদ্র ও দূর্বল জাতিগুলোকে শক্তিমান জাতিসমূহের গোলামে পরিণত করেছে।
এই জাতীয়তাবাদের জরায়ু থেকে হিটলারের নাজিবাদ, মুসোলিনীর ফ্যাসীবাদ এবং আমেরিকা ও বৃটেনের সাম্রাজ্যবাদের দৈত্য জন্মলাভ করে এবং তাদের বিজয় ও আধিপত্য প্রথমে গোটা দুনিয়াকে উপনিবেশিক ব্যবস্থার শৃঙ্খলে বন্দী করে এবং তারপর স্বার্থের সংঘাত তাকে পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধের জাহান্নামে নিক্ষেপ করে।
৮. আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে গোটা মানবজাতিকে একই জীবন বিধান দান করা হয়েছিল। এখন মানুষ নিজের জীবন বিধান নিজেই রচনা করতে বসে গেছে। ফতে নিত্য নতুন পরষ্পর বিপরীত ও গুরুতর দর্শন ও মতবাদ আত্মপ্রকাশ করে, কিন্তু তার মধ্যে কোনটিই গোটা মানবজাতির জন্য গ্রহণযোগ্য ছিল না। কারণ তার উপর বিষে স্বার্থ, বিশেষ ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক অবস্থা, বিশেষ পরিবেশ এবং সবচেয়ে অগ্রসর হয়ে সীমিত জ্ঞান-বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার ছাপ বিদ্যমান ছিল। এসব দর্শন ও মতবাদের আধিক্য মানব বিবেককে এতটা বিভ্রান্ত করে যে, জীবন-সহজ পথ তাদের দৃষ্টি থেকে উবে গেছে।
প্লেটো ও হেগেলের আদর্শবাদ, জনস্টুয়ার্টমিলের ব্যক্তিবাদ, বেনথামের উপযোগবাদ এবং কার্ল মার্কসের সাম্যবাদ থেকে নিয়ে গডউইন ও ক্রোপটকিনের নৈরাজ্যবাদ পর্যন্ত স্থান-কালের গন্ডিতে আবদ্ধ হাজারো মতবাদ এবং সেগুলোর হাজারো রকম ব্যাখ্যার স্তুপ মানুষকে বাকশক্তিহীন করে দিয়েছে এবং তাকে বিভিন্নরূপ মানসিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বন্দী করে কেবল অন্যদের থেকে বিছিন্নই করে দেয়নি, বরং পরষ্পর শত্রু বানিয়ে দিয়েছে।
৯. মানব রচিত জীবন ব্যবস্থা যেহেতু কোন অভিন্ন উদ্দেশ্য ও নৈতিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তিশীল ছিল না, তাই চরিত্র ও আচরণের ঐক্যেরও কোন সম্ভাবনা অবশিষ্ট থাকল না। প্রত্যেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষমতাসীন সরকার নিজ নিজ রাষ্ট্রে নিজ জাতীয় স্বার্থ পূরণের জন্য একজ বিশেষ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার অধীন নাগরিকদের সে আচরণের ছাঁচে ঢালল যে, তারা নিজ দেশের জন্য তো উত্তম নাগরিক প্রমাণিত হয়, কিন্তু দেশের সীমার বাইরে অবশিষ্ট মানব জগতের জন্য ডাকাত, দস্যু, হন্তা ও গুন্ডার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এভাবে মানব জাতির মাঝে বিশ্বভ্রাতৃত্বের কোন ভিত্তি অবশিষ্ট থাকল না। সকলে একে অপরের জানমাল, ইজ্জত-আব্রু, দেশ-জাতি, দেশীয় উপায়-উপকরণ এবং রাষ্ট্র ও সরকারের দুশমন হয়ে গেল। আক্বীদা-বিশ্বাস, চিন্তা চেতনা, উদ্দেশ্য-লক্ষ্য, মানসিক ঝোঁক প্রবণতা এবং আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার কেন্দ্রীয় অনৈক্য তাদের সকলকে পরষ্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে গোটা মানব দুনিয়াকে বিরোধ, মতভেদ, মানসিক চাপ, ও শত্রুতার লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে দিয়েছে।
১০. আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা উন্নততর নৈতিক শিক্ষার উপর ভিত্তিশীল ছিল। খোদাদ্রোহী মানুষ নৈতিকতাকে তাকে তুলে রেখে দিয়ে বস্তুগত স্বার্থকে তার ভিত্তি বানায় এই স্বার্থপূজা একই দেশে বসবাসকারী জনগণকে পরষ্পরের শত্রুতে পরিণত করেছে। তাদের মধ্যে নি:স্বার্থপরতা,সহানুভূতি, সহযোগিতা ও কল্যাণকামিতার পরিবর্তে স্বার্থপরতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার ঝেঁকপ্রবণতা স্থান করে নেয়। ঐ স্বার্থপরতা একদিকে শত্রুতামূলক লুটপাট এবং অন্যদিকে সুসংগঠিত প্রতিরক্ষার জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর জন্ম দেয় এবং তারপর এই শ্রেণীসমূহের ঠান্ডা ও উত্তাপ লড়াই মানুষকে মানুষের রক্ত পিপাসু বানিয়ে জগতের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনাশ করে দেয়। এই শ্রেণী সংগ্রাম যথারীতি একটি দর্শন হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং এই দর্শনের আলোকে বিরোধী শ্রেণীর লোকদের জীবন সংহার একটি ছোয়াবের কাজে পরিণত হয়েছে এবং এই শ্রেণী সংগ্রামে নিহত হওয়া শহীদের মর্যাদা (!) হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
১১. আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থার আলোকে প্রতিযোগিতার আসল ময়দান ছিল ‘তাকওয়া’ । কিন্তু এখন বিলাস ব্যসনের উপকরণের প্রাচুর্য লাভের এবং প্রবৃত্তির লালসা পূরণ ও বর্ধিত করার উপায় -উপকরণ অর্জনের চেষ্টা সাধনা তাকওয়ার স্থান দখল করে নিয়েছে। প্রতিযোগিতার এই ময়দান প্রতিটি মানুষকে নিজের নফসের গোলাম বানিয়ে দিয়ে তাকে অযাচিত সম্পদ লাভের মাতলামিতে নিমজ্জিত করেছে। হারাম-হালাল ও বৈধ-অবৈধের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে এবং বড়ত্বের মানদন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে- অন্যের তুলনায় কোন ব্যক্তির নিকট এই দুনিয়ায় আরাম আয়েশের জীবপন যাপনের জন্য কি পরিমাণ সম্পদের প্রাচুর্য বর্তমান আছে। এই চিন্তাধারা মানুষকে স্বার্থপরতা ও প্রবৃত্তিপূজার রাস্তায় তুলে তাকে সমাজের অপরাপর সদস্যের জন্য একটি নেকড়ে বাঘে পরিণত করেছে।
১২. মানবরচিত সমস্ত জীবন ব্যবস্থার একটি সাধারণ দূর্বলতা এই যে, তাদের নৈতিক মূলনীতির পেছনে কোন কার্যকর শক্তি নাই। তারা প্রথমত নৈতিক মূল্যবোধের সেই গুরুত্বই দেয় না- ওহী ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থায় তার য গুরুত্ব রয়েছে। সভ্য সামাজিক জীবনের জন্য যদিও কিছু নৈতিক মূলনীতি নির্ধারণ করা হয়েছে কিন্তু তা সম্পূর্ণ নিস্প্রাণ ও নির্জীব প্রমাণিত হয়েছে। কারণ এসব মূলনীতি মেনে চলতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার মত কোন শক্তি বর্তমান ছিল না। আখেরাতের বিশ্বাস বর্জন মানুষকে দায়িত্বহীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত করে ফেলেছে। তারা কেবল এই পার্থিব জীবনকেই সবকিছু মনে করে নিয়েছে এবং নিজেদের কার্যাবলী সম্পর্কে কোনরূপ জবাবদিহির অনুভূতিশূন্য হয়ে বলগাহীন হয়ে গেছে। সামাজিক জীবনে “সকলের স্বার্থে” তারা যদিও কিছু নৈতিক মূল্যবোধের অনুসারী, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনকে তারা নিজেদের এসব মূল্যবোধের বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত মনে করে এবং এই পরিমন্ডলে তাদের জীবন পশুর পর্যায়ে নেমে এসেছে।
১৩. আল্লাহর রাজত্বে ছিল আইনের শাসন, মানুষের কায়েম করা রাজত্বে “শাসকের মর্জি” আইনের মর্যাদা লাভ করে। প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী সত্তার মর্জির প্রকাশ একটি স্থায়ী ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী সংবিধানের আকারে ঘটেছে, যার প্রয়োগ ছিল সামগ্রিক এবং স্থান-কালের বন্ধনের উর্ধ্বে। কিন্তু মানুষের নিজস্ব আবিষ্কৃত সর্বময় কর্তার মর্জির কোন স্থায়িত্ব নাই। তা ক্ষণে এই, ক্ষণে অন্য কিছু। তার প্রয়োগ একটি নির্দিষ্ট কাল ও নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ। এর মধ্যে কালের পরিক্রমায় সংশোধন হেতে থাকে এবং সর্বময় কর্তার পরিবর্তনের সাথে সাথে বার বার পরিবর্তন হতে থাকে। তাই মানব রচিত জীবন বিধানে “আইনের রাজত্বের” ধারণা একটি প্রতারণা মাত্র।
১৪. আল্রাহ প্রদত্ত মৌলিক অধিকার সমূহ ছিল স্থায়ী ও পরিবর্তনের অযোগ্য। কিন্তু মানব রচিত সংবিধানের অস্থায়িত্ব আল্লাহ প্রদত্ত মৌলিক অধিকার সমূহকেও অস্থায়ী বানিয়ে দিয়েছে এবং তাকে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মাঝে একটি স্থায়ী বিবাদ ও দ্বন্দ্বের বিষয়ে পরিণত করে রেখে দিয়েছে। এখন এসব অধিকার প্রাণান্তকর সংগ্রামের মাধ্যমেই অর্জন করা যায়, কিন্তু কোন স্বৈরাচারীর এক আঘাতেই তা কাঁচের চুরির ন্যায় চোখের পলকে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। এই হল সেই মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক পরিণতি যা প্রকৃত ক্ষমতার মালিকের সাথে দাসত্বের সম্পর্ক ছিন্ন করার কারণে এবং নিজেদের মত মানুষকে সর্বময় ক্ষমতার মালিক বানানোর অপরাধে এই দুনিয়ায় তাদের ভোগ করতে হচ্ছে। তারা আল্লাহর বিধানের আনুগত্য থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এবং তাঁর রাজত্বে নিজেদের মর্জিমত স্বাধীন জীবন যাপনের জন্য নিজেদের একচ্ছত্র কর্তৃত্বের অধিকারী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সে কি কাংখিত স্বাধীনতা লাভ করতে এবং একচ্ছত্র অধিপতি হতে পেরেছে? নিজের মর্জি মাফিক জীবন যাপনের সুযোগ কি পেয়েছে? বরং বিপরীত ফল এই দাঁড়িয়েছে যে, সে এক আল্লাহকে ত্যাগ করে নিজের মতই মানুষের মাথায় একচ্ছত্র অধিপতির রাজমুকুট স্থাপন করতে, তার সামনে নিজের মস্তক অবনত করতে, তার অনুকূলে নিজের সমস্ত স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার ত্যাগ করতে, খেলাফতের পদের সাথে সংশ্লিষ্ট উচ্চতর মর্যাদা ও মাহাত্ম্য থেকে হাত গুটিয়ে নিতে এবং নিজের জান-মাল, ইজ্জত -আবরু, উপায়-উপকরণ, মানসিক ও দৈহিক শক্তি সমূহ অসহায়ভাবে তার হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রভুদের দাসত্ব করতে গিয়ে সে নিকৃষ্ট পরাধীনতা, অসম্মান, অপমান, হতাশা ও নিরাশা ব্যতীত আর কিছুই লাভ করতে পারেনি।
মানুষের আবিষ্কৃত এই প্রভুদের মধ্যে এমন কে আছে যে,
(আরবী***)
অর্থ: কে আছে আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী- (৪১ : ১৫)। এবং
(আরবী***)
আমিই তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিপালক-(৭৯: ২৪)। এর শ্লোগান দিয়ে ࢨিজের এবং অন্য সকলের উপর নির্যাতনের স্টীমরোলার চালায়নি এবং নিজের তুচ্ছ ও নিকৃষ্ট বাসনা পূরণার্থে হাজারো পরিবার বিরাণ করেনি?
সত্য কথা এই যে, মানুষকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকার হিসাবে সৃষ্টিই করা হয়নি। তার কাজ হল দাসত্ব, প্রভুত্ব নয়। তার স্রষ্টা তার দাসত্বের বৈশিষ্ট্য তার মেজাজ ও স্বভাবের মধ্যে গচ্ছিত রেখে দিয়েছেন।
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ [٥١:٥٦]
অর্থ: আমি জিন-ইনসানকে কেবলমাত্র আমার দাসত্বের জন্যই সৃষ্টি করেছি- ( আয যারিয়াত : ৫৬)।
এখানে দাসত্ব ( ইবাদত) অর্থ কেবলমাত্র নামায-রোযা, তাসবীহ-তাহলীলই নয়, বরং এই ধরণের ইবাদতের সাথে সাথে তার মধ্যে এই অর্থও অন্তর্ভূক্ত রয়েছে যে, মানুষ ও জিনকে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো পূজা-উপাসনা, আনুগত্য-অনুসরণ ও প্রার্থনার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। তাদের কাজ- অন্য কারো সামনে অবনত হওয়া, অপর কারো নির্দেশ মান্য করা, ভয় করা, অন্য কারো রচিত বিধানের আনুগত্য করা, অন্য কাউকে নিজের ভাগ্যের নির্মাতা বা বিপর্যয়কারী মনে করা এবং কারো হুজুরে দোয়ার জন্য হাত প্রসারিত করে দেওয়া নয়। জীবনের সার্বিক ব্যাপারে কেবলমাত্র এক আল্লাহর পূর্ণ আনুগত্য ও অনুবর্তন এবং তাঁর বিধান বাস্তবায়ন করার নামই ইবাদত।
মানুষকে মনমস্তিষ্কের সার্বিক যোগ্যতা ও দৈহিক শক্তি এক আল্লাহর ইবাদতের দাবীসমূহ পূরণের জন্য দেওয়া হয়েছে। ইবাদতের এই বৈশিষ্ট্য উপেক্ষা করা স্বয়ং মানুষের নিজের সত্তা ও নিজের স্বভাব-প্রকৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নামান্তর। এর অবশ্যম্ভাবী ফল এই দাঁড়ায় যে, সে নিজেই খোদায়ী দাবী করে বসে অথবা কোন কৃত্রিম খোদার সামনে নিজের মাথা নত করে দেয়। মানুষ যখনই বিদ্রোহের এই পথে পা বাড়ায় তখনই সে অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। আল্লাহ তাআলা যেহেতু গোটা মানবজাতিকে একই প্রকৃতিতে তৈরী করেছেন, তাই কতেকের দন্ডমুন্ডের কর্তা বনে যাওয়া এবং কতেকের দাসানুদাস বনে যাওয়া উভয়ই প্রকৃতি বিরোধী। দন্ডমুন্ডের কর্তা রাজা বাদশা বা একনায়ক হিসাবে কোন ব্যক্তিই হোক অথবা পার্লামেন্টের আকারে নির্বাচিত সদস্যদের সমষ্টিই হোক অথবা কোন একটি রাষ্ট্রের নাগরিকগণই হোক অথবা সামগ্রিকভাবে গোটা দুনিয়ার জনগণই হোক, যে কোন অবস্থায় অন্যায়-অত্যাচারের প্রাদুর্ভাব ঘটবেই। কারণ মানুষের সার্বভৌমত্ব যে কোন ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আকারে এমন এক সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীকে অস্তিত্বে আনয়ন করে যা প্রকৃত সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীর বিকল্প হতে পারে না এবং এটাই ‘পৃথিবীর বুকে বিপর্যয় সৃষ্টির’ ( ফাসাদ ফিল আরদে) মূল শিকড়।
উক্ত বিপর্যয়ের কারণ এই যে, আল্লাহ তাআলা তো স্বয়ং অস্তিত্বমান সত্তা। নিজের অবিলীয়মান মর্যাদা, নিজের সৃষ্টি ক্ষমতা, নিজের সুশৃঙ্খল প্রতিপালন ব্যবস্থা এবং নিজের অন্যান্য সীমাহীন দৃষ্টান্তহীন গুণাবলীর কারণে সর্বময় ক্ষমতার মালিক, তাঁর কর্তৃত্ব কারো দয়ার দান নয়, বরং তাঁর সত্তারই অংশ। তিনি স্বয়ং কোন জিনিসের বা কোন আশ্রয়ের মুখাপেক্ষী নন। তিনি কারও নিকট থেকে কিছু নেন না এবং তাঁর রাজত্ব সৃষ্টির প্রতিটি বিন্দু পর্যন্ত পরিব্যপ্ত। সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী, কিন্তু তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন। তাই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারীর পদ কেবল তাঁর জন্য শোভা পায়। কিন্তু তিনি ব্যতীত যে কেউ নিজের সার্বভৌমত্ব ও রাজত্বের দাবী নিয়ে উত্থিত হয় সে উপরোক্ত কোন গুণেরই বাহক নয়, সে তার ক্ষমতা-যোগ্যতা, জ্ঞানবুদ্ধি আবেগ অনুভূতি, প্রয়োজন, কামনা-বাসনা ও ইচ্ছা- আকাংখার প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতার দিক থেকে সাধারণ মানুষেরই অনুরূপ। এখন প্রশ্ন হল, সে এই সীমাবদ্ধতা ও মানবিক দূর্বলতা সত্বেও অন্যদের উপর নিজের প্রাধান্য কিভাবে বিস্তার করতে পারে, নিজের শাসন-কর্তৃত্বের প্রকাশ কিভাবে করতে পারে এবং তাদেরকে নিজের আনুগত্য ও পরাধীনতার নাগপাশে কিভাবে বন্দী করতে পারে? এর মাত্র একটি পথই আছে এবং তা এই যে, নিজেকে বড় বানানোর জন্য সে নিজের কর্তৃত্বাধীনে বসবাসকারী জনগণের নিকট থেকেই রাজত্বের কর্তৃত্ব, অধিকার, আনুকূল্য,ধনসম্পদ, ঐশ্বর্য এবং নিজের জীবনের নিরাপত্তা থেকে নিয়ে ক্ষমতার সিংহাসনের নিরাপত্তা পর্যন্ত প্রয়োজন পূর্ণকারী উপায়-উপকরণ পর্যায়ক্রমে নিজের কব্জায় নিয়ে নেয়, অত:পর এই ক্ষমতা এখতিয়ারও উপায় উপাদান সুসংগঠিত করে আরও অধিক ক্ষমতা ও উপায় উপকরণ অর্জনে ব্যবহার করে। এরপর যখন দেশী উপায় উপাদান তার কামনা বাসনা ও প্রয়োজন পূরণের জন্য পর্যাপ্ত না হয় তখন প্রতিবেশীদের ঘাড়ে সওয়ার হয়, তাদের মানবীয় ও বৈষয়িক উপায় উপকরণ কুক্ষিগত করে এবং এভাবে নিজের ক্ষমতার পরিসর বিস্তৃত করার অব্যাহত সংঘাতে লিপ্ত হয়। এই পথে যে শক্তি তার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় সেগুলোকে সর্বশক্তি নিয়োগ করে নির্মূল করে অথবা নিজে ধ্বংস হয়। এছাড়া তার অন্য কোন পথ থাকে না। কেননা কুরআন মজীদের পেশকৃত উদাহরণ মোতাবেক সে নিজে তো একটি মাছি বানাতে অথবা তার কব্জা থেকে কোন জিনিসমুক্ত করতে পর্যন্ত সক্ষম নয়। তার সমস্ত রাজ ব্যবসা চলে অন্যের থেকে ছিনিয়ে নেয়া ক্ষমতা ও উপায়-উপকরণের সাহায্যে। এই ক্ষমতা ও উপায়-উপকরণ যে অনুপাতে শোষিত হয়ে তার কব্জায় এসে যায় সেই হারে তার একচ্ছত্র ক্ষমতা, তার প্রভাব প্রতিপত্তি, তার রাজ প্রাসাদের প্রশস্ততা ও উচ্চতা , তার উপায়-উপাদানের প্রাচুর্য ও তার ক্ষমতার পরিসর বর্ধিত হতে থাকে এবং ঠিক সেই অনুপাতে তার ক্ষমতার জিঞ্জিরে বন্দী মানুষ নিজেদের স্বাধীনতা, অধিকার, উপার্জনের উপায় উপকরণ এবং নিজেদের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য থেকে বঞ্চিত হতে থাকে।
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এই প্রকৃতির রাজত্ব জেঁকে বসে আছে। দুনিয়ার পরাশক্তিগুলোর বিশ্ব রাজনীতিও এই পদ্ধতিতেই চলছে। মানুষ যখন এবং যেখানে আল্লাহর বন্দেগী থেকে মুক্ত হয়ে নিজের রাজত্ব চালিয়েছে তার পরিণাম ফল একই হয়েছে-অত্যাচার, অবিরত অত্যাচার। অত্যাচার ছাড়া মানুষের সার্বভৌমত্বের কোন কল্পনাই করা যায় না।
এই রোগের চিকিৎসা না মানব রচিত কোন সংবিধানের মাধ্যমে সম্ভব আর না মানবীয় সার্বভৌমত্বের ধারণার উপর ভিত্তিশীল কোনও রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্ভব। এই রোগ থেকে মুক্তি একটি মাত্র পথই আছে। তা হল, মানুষ সরাসরি আল্লাহর সার্বভৌমত্তের অধিকার স্বীকার করে নিয়ে নিজের বন্দেগীর মর্যাদায় ফিরে আসবে। সে না খোদা হওয়ার চেষ্ঠা করবে, আর না অন্যকে খোদা হয়ে নিজেদের উপর চেপে বসার সুযোগ দেবে।