ঈমানিয়াত
যে সব বিষয়ে ঈমান আনা জরুরী
(আরবী****)
৪. হযরত ওমর (রা) থেকে বর্ণিত। আগন্তুক (যিনি প্রকৃতপক্ষে জিবরাইল (আ ) ছিলেন এবং মানুষের রূপ ধারণ করে রাসূল (সা) এর কাছে এসেছিলেন। ) রাসূল (সা) কে জিজ্ঞেস করলো, ঈমান কি বলুন। তিনি বললেন, তুমি আল্লাহ তায়ালাকে ও আখিরাতকে সত্য জানবে ও সত্য বলে বিশ্বাস করবে, আর এটাও বিশ্বাস করবে যে, পৃথিবীতে যা কিছুই ঘটবে, আল্লাহর পক্ষ থেকেই ঘটে, চাই তা ভালো হোক বা মন্দ হোক। এটাই ঈমান। (মুসলিম)
এটি একটি দীর্ঘ হাদীসের অংশ। এটি হাদীসে জিবরাইল নামে খ্যাত। একদিন হযরত জিবরাইল (আ ) মানুষের আকার ধারণ করে রাসূল (সা) এর কাছে এলেন এবং ইসলাম কি, ঈমান কি, ইহসান কাকে বলে ও কেয়ামত কবে হবে জিজ্ঞেস করেন। রাসূল (সা) প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেন। এগুলোর মধ্য থেকে ঈমান সংক্রান্ত প্রশ্ন ও তার উত্তর এখানে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
ব্যাখাঃ ঈমানের আসল অর্থ হলো কারো উপর বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করা এবং সে কারণে তার কথাকে সত্য বলে মান্য করা। মানুষ তখনই কারো কথাকে সত্য বলে গ্রহণ করে। যখন তার সত্যবাদিতা সম্পর্কে অটল-বিশ্বাস রাখে। বিশ্বাস ও আস্থাই হলো ঈমানের মুল কথা। আল্লাহর পক্ষ থেকে রসূলগণের মাধ্যমে যা যা এসেছে, তার সব কটিকে সত্য বলে গ্রহণ করা মুমিন হওয়ার জন্য অপরিহার্য।
এগুলোর মধ্য থেকে ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলো এই হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। পৃথক পৃথক ভাবে এগুলোর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা নিম্নে দেয়া গেলঃ-
১। আল্লাহর প্রতি ঈমানঃ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার অর্থ হলো, তিনি অনাদি ও অনন্ত কাল ধরে ছিলেন, আছেন ও থাকবেন। তিনি একাই সমগ্র বিশ্বজগতকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি একাই সমগ্র বিশ্ব জগতের একক ও সর্বময় পরিচালক ও শাসক বলে বিশ্বাস করতে হবে। আরো বিশ্বাস করতে হবে যে, এ বিশ্বজগতের সৃষ্টিতে এবং এর শাসন ও পরিচালনায় তার কোন অংশীদার নেই। তিনি সব রকমের ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা থেকে মুক্ত ও পবিত্র। তিনি যাবতীয় সদগুণাবলীর অধিকারী এবং সমস্ত কল্যাণ ও মহত্বের উৎস।
২। ফিরিশতাদের উপর ঈমান আনাঃ এর অর্থ ফিরিশতাদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করা এবং স্বীকার করা যে তারা অত্যন্ত পবিত্র ও নিষ্পাপ, তারা আল্লাহর হুকুম অমান্য করেন না। সদা সর্বদা আল্লাহর এবাদত করেন। অনুগত গোলামের মত মনিবের প্রতিটি হুকুম বাস্তবায়নের জন্য তার দরবারে অনবরত হাত বেধে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং পৃথিবীর সকল সৎকর্মশীল ও পুণ্যবানের জন্য দোয়া করতে থাকেন।
৩। কিতাবের উপর ঈমান আনাঃ এর অর্থ আল্লাহ তায়ালা স্বীয় নবী ও রসূলগণের মাধ্যমে সময়ে সময়ে আদেশ, নিষেধ ও উপদেশ সম্বলিত যে সব গ্রন্থ পাঠিয়েছেন, সে সব গ্রন্থকে সত্য বলে বিশ্বাস করতে হবে। এগুলোর মধ্যে সর্বশেষ গ্রন্থ কোরআন শরীফ। পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীরা নিজেদের কিতাবগুলোকে বিকৃত করে ফেলেছে, সেহেতু আল্লাহ তায়ালা সর্বশেষ মুহাম্মাদ (সা) এর মাধ্যমে সর্বশেষ গ্রন্থও প্রেরণ করেছেন। এই গ্রন্থ সুস্পষ্ট, অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন। এত কোন ত্রুটি বিচ্যুতি বা অসম্পূর্ণতা নেই। এ গ্রন্থ সর্ব প্রকারের বিকৃতি থেকে মুক্ত। এখন এরই কিতাব ছাড়া পৃথিবীতে এমন আর কোন কিতাব নেই, যার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে পৌছা যায়।
৪। রসূলগণের উপর ঈমান আনার তাৎপর্যঃ এর অর্থ যতজন নবী ও রাসূল আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত হয়েছেন, তাদের সকলের সম্পর্কে বিশ্বাস করা যে, তারা সবাই সত্যবাদী। তারা আল্লাহর বার্তাকে অবিকলভাবে ও কোন রকম হেরফের এবং কমবেশি না করেই মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। সর্বশেষ নবী ও রাসূল হচ্ছেন মুহাম্মাদ (সা)। এখন একমাত্র তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণেই মানুষের মুক্তি ও পরিত্রাণ নিহিত।
৫। আখিরাতের ওপর ঈমানঃ এর অর্থ হলো এ কথা বিশ্বাস করা যে, এমন একটি দিনের আগমন অবধারিত। যেদিন সকল মানুষের জীবনের কৃতকর্মের বিচার হবে। যার কাজ ভালো ও সন্তোষজনক হবে, সে পুরস্কৃত হবে। আর যার কাজ অসন্তোষজনক হবে, সে পাবে কঠিন শাস্তি। শাস্তিও হবে সীমাহীন, পুরস্কারও হবে অনন্তকাল ব্যাপী।
৬। তকদীরের ওপর ঈমান আনাঃ এর অর্থ এই মর্মে বিশ্বাস রাখা যে, পৃথিবীতে যা কিছু হচ্ছে বা ঘটবে, কেবলমাত্র আল্লাহর হুকুমেই ঘটবে। এখানে কেবল তারই হুকুম চলে। এমন কখনো হয় না যে, আল্লাহ চান এক রকম, আর বিশ্বজগত চলছে অন্যভাবে। ভালো মন্দ এবং সুপথগামিতা ও বিপথগামিতার ব্যাপারে আল্লাহর একটা অকাট্য বিধান রয়েছে, যা তিনি আগে থেকেই বানিয়ে রেখেছেন। আল্লাহর কৃতজ্ঞ ও শোকর-গুজার বান্দাদের ওপর যখনই কোন বিপদ মুসিবত, সমস্যা সংকট ও পরীক্ষা আসে, তাদের প্রতিপালকের আদেশেই আসে এবং আগে থেকেই নির্ধারিত নিয়ম ও বিধান অনুসারেই আসে।
আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার তাৎপর্যঃ
(আরবী***************)
৫। হযরত মুয়ায বিন জাবাল (রা) বলেনঃ কোন এক সফরে আমি রাসূল (সা) এর পেছনে উটের ওপর বসা ছিলাম। আমার ও তাঁর মাঝে ঘোড়ার জিনের (কাঠের তৈরী আসন) পেছনের অংশটি ছাড়া আর কোন ব্যবধান ছিলনা। তিনি বললেন“মুয়ায বিন জাবাল!আমি (আগের মতই) বললাম ইয়া রাসুলুল্লাহ, ভৃত্য উপস্থিত। এবারও তিনি কিছুই বললেন না। আবার কিছুদূর যাওয়ার পর তিনি ডাকলেন মুয়ায বিন জাবাল। আমি এবারও বললাম ইয়া রাসুলুল্লাহ , ভৃত্য উপস্থিত। তিনি বললেনঃ তুমি কি জান, বান্দাদের ওপর আল্লাহর হক (প্রাপ্য) কি? আমি বললাম আল্লাহ ও তার রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন বান্দাদের ওপর আল্লাহর হক এই যে, তারা কেবল তাঁরই হুকুম পালন করবে এবং হুকুম পালনে অন্য কাউকে শরীক করবে না। আরো কিছুদূর চলার পর তিনি বললেন হে মুয়ায! আমি আমি বললাম হে রাসূলুল্লাহ, ভৃত্য উপস্থিত, আপনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবো ও আনুগত্য করবো। তিনি বললেন, তুমি কি জান আল্লাহর ওপর বান্দার হক (প্রাপ্য) কি? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহর ওপর তাঁর অনুগত বান্দাদের হক এই যে, তিনি যেন তাদেরকে আযাব না দেন। (বোখারী ও মুসলিম)
হযরত মুয়াযের বর্ণনার সারমর্ম হলো, তিনি রাসূল (সা) এর এত কাছে বসেছিলেন যে, কথা শুনতে ও শুনাতে কোনই অসুবিধা হচ্ছিল না। রাসূল (সা) এর কথা তিনি খুব সহজেই শুনতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু যে কথাটা রাসূলুল্লাহ (সা) বলতে চাইছিলেন তা এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তিনি তাকে তিনবার ডাকলেন এবং কিছুই বললেন না। এর উদ্দেশ্য ছিল এই যে, মুয়ায যেন গভীর মনোযোগ দিয়ে কথাটা শোনেন এবং কথাটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা ভালোভাবে উপলব্ধি করেন। এরপর রাসূল (সা) যা বললেন, তা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, আল্লাহর একত্ব তথা তাওহীদ অত্যন্ত জরুরী এবং তা জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাতে সক্ষম। যে জিনিস আল্লাহর গযব থেকে নিষ্কৃতি দেয় ও জান্নাতের হকদার বানায়, বান্দার কাছে তার চেয়ে মূল্যবান জিনিস আর কি হতে পারে?*
(আরবী**************)
৬. রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞেস করলেনঃ (আবুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দলকে) তোমরা জান, একমাত্র আল্লাহর ওপর ঈমান আনয়নের অর্থ কি? তারা বললো আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন। রাসূল (সা) বললেনঃ এর অর্থ হলো, এই মর্মে সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর রাসূল, আর নামায যথাযথভাবে আদায় করা, যাকাত দেয়া ও রমযানের রোযা রাখা। (মেশকাত) (আরবী**********)
৭. হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) যখনই কোন ভাষণ দিতেন, একথাটা অবশ্যই বলতেন যে, যার ভেতরে আমানতদারী নেই, তার ভেতরে ঈমান নেই, আর যে ব্যক্তি ওয়াদা রক্ষা করাকে গুরুত্ব দেয় না, তার কাছে দ্বীনদারী নেই। (মেশকাত)
রাসূলুল্লাহ (সা) এর এ উক্তির তাৎপর্য এই যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর হক ও বান্দার হক আদায় করে না, সে পরিপক্ব ঈমানের অধিকারী নয়। আর যে ব্যক্তি কোন বিষয়ে ওয়াদা করে অথচ সেই ওয়াদা পূরণ করে না, সে দীনদারীর ন্যায় মহামূল্যবান সম্পদ ও নেয়ামত থেকে বঞ্চিত। যার অন্তরে ঈমানের শেকড় দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল থাকে, সে সকল হক বা অধিকার আদায়ে বিশ্বস্ত হয়ে থাকে। এই বিশ্বস্ততাই আমানতদারী। কোন হক বা অধিকার আদায়ে সে অবহেলা করে না। অনুরূপভাবে, যে ব্যক্তির ভেতরে দ্বীনদারী থাকবে, সে মৃত্যু পর্যন্ত ওয়াদা পালন করবে। মনে রাখা দরকার যে, সবচেয়ে বড় হক বা অধিকার হচ্ছে আল্লাহর, তাঁর রাসূলের এবং তাঁর কিতাবের। আল আল্লাহর হক ও বান্দার হক কি কি, তার পুরো তালিকা আল্লাহ তায়ালা কোরআন মজীদেই দিয়ে রেখেছেন। আরো মনে রাখতে হবে যে, মানুষ আল্লাহ তায়ালার সাথে তাঁর প্রেরিত নবীর সাতে ও নবীর আনীত দ্বীনের সাথে যে ওয়াদা করে, সেটাই সবচেয়ে বড় ওয়াদা। সুতরাং ওয়াদা পালনের ক্ষেত্রে এই ওয়াদা সবচেয়ে অগ্রগণ্য।
(আরবী**********)
৮. হযরত আমর ইবনে আবাসা (রা) বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে জিজ্ঞেস করলাম, ঈমান কি? তিনি বললেন ঈমান হচ্ছে সবর ও সামাহাতের আর এক নাম। (মুসলিম)
অর্থাৎ ঈমান হলো, আল্লাহর পথ অবলম্বন করা, এই পথে যত বিপদ মুসিবত আসুক, তা সহ্য করা এবং আল্লাহর সাহায্যের আশা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া। একেই বলা হয় সবর। আর নিজের উপার্জিত সম্পদ থেকে যত বেশী পরিমাণে সম্ভব আল্লাহর অসহায় ও পরমুখাপেক্ষী বান্দাদের ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ব্যয় করা এবং ব্যয় করে তৃপ্তি ও আনন্দ অনুভব করা। আরবীতে একেই বলে সামাহাত। অবশ্যই সামাহাত বিনম্র আচরণ, মহানুভবতা ও উদারতা অর্থেরও ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।
ঈমানের পূর্ণতা লাভের উপায়
(আরবী********)
৯. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্যই বন্ধুত্ব করে, আল্লাহর জন্যই শত্রুতা পোষণ করে, আল্লাহর জন্যই দান করে এবং আল্লাহর জন্যই দান থেকে বিরত থাকে, সে নিজের ঈমানকে পূর্ণতা দান করে। (বোখারী, আবু উমামা থেকে বর্ণিত)
এ হাদীসের মর্মার্থ এই যে, ঈমানদার বান্দা নিজের আত্মশুদ্ধি ও আত্নগঠনের জন্য অবিরাম চেষ্টা সাধনা চালাতে চালাতে অবশেষে এ পর্যায়ে উপনীত হয়ে যে, সে যখন কারো সাথে প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপন করে, তখন তা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই করে এবং আল্লাহর অর্জিত হয় এমনভাবেই করে। আবার কারো সাথে যদি সম্পর্কচ্ছেদ করে ও শত্রুতার মনোভাব পোষণ করে, তবে তাও আল্লাহকে খুশী করার জন্যই করে এবং আল্লাহ খুশী হন এমনভাবেই করে। অনুরূপভাবে, কাউকে দান করলেও তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দান করে এবং আল্লাহ যাকে ও যেভাবে দান করলে খুশী হন সেইভাবে দান করে। আর কাউকে দান করা থেকে বিরত থাকলে তাও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করে এবং আল্লাহর বিধান অনুসারে যেখানে ও যাকে দান করা সংগত নয় সেখানে দান করে না। মোটকথা, সে একমাত্র আল্লাহর দ্বীনের খাতিরে ও দ্বীনের মাপকাঠি দিয়ে মেপেই কাউকে ভালোবাসে বা ঘৃণা করে। তার ভালোবাসা ও শত্রুতা, অনুরাগ ও বিরাগ, নিজের কোন ব্যক্তিগত ও পার্থিব স্বার্থ উদ্ধারের জন্য হয় না, বরং কেবলমাত্র আল্লাহ ও তার দ্বীনের জন্য হয়ে থাকে। এরকম অবস্থায় কেউ যখন পৌঁছে যায়, তখন বুঝবে তার ঈমান পূর্ণতা লাভ করেছে।
ঈমানের প্রকৃত স্বাদ কখন পাওয়া যায়?
(আরবী**********)
১০. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ সেই ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ লাভ করে, যে আল্লাহকে নিজের একমাত্র প্রভু হিসাবে, ইসলামকে নিজের একমাত্র জীবন বিধান হিসাবে ও মুহাম্মাদ (সা) কে নিজের রাসূল হিসাবে মেনে নিয়ে খুশী ও পরিতৃপ্ত হয়। (বোখারীও মুসলিম, আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত)
অর্থাৎ নিজেকে আল্লাহর দাসত্বে সমর্পণ করে, ইসলামী শরীয়তের অনুকরণ ও অনুসরণ করে এবং আল্লাহর রাসূলের পরিপূর্ণ আনুগত্য করে পূর্ণ আত্মতৃপ্তি ও আনন্দ অনুভব করে। আর এই মর্মে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্তুষ্ট হয় যে, জীবনে আল্লাহ ছাড়া আর কারো দাসত্ব ও গোলামী কবুল করবো না। সর্বাবস্থায় ইসলামের ওপর চলবো এবং রাসূলুল্লাহ(সা) ছাড়া আর কারো নেতৃত্ব মানবো না। যে ব্যক্তি এই পর্যায়ে পৌঁছে যায়, বুঝতে হবে সে ঈমানের প্রকৃত স্বাদ পেয়েছে।
রাসূলের প্রতি ঈমান আনার তাৎপর্য
সর্বোত্তম কথা ও সর্বোত্তম আদর্শ
(আরবী*****************)
১১. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আল্লাহর কিতাবই শ্রেষ্ঠ বাণী এবং মুহাম্মদ (সা) এর আদর্শই শ্রেষ্ঠ আদর্শ(যার অনুসরণ করতে হবে। ) (মুসলিম)
কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ না করা রাসূলের সুন্নাত
(আরবী**********************)
১২. হযরত আনাস (রা) বলেন রাসূল (সা) আমাকে বলেছেনঃ প্রিয় বৎস, তুমি যদি এভাবে জীবন যাপন করতে পার যে, তোমার মনে কারো বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও অশুভ কামনা নেই, তাহলে তাই কর। এটাই আমার সুন্নাত বা নীতি। (অর্থাৎ আমি কারো প্রতি বিদ্বেষ, ঘৃণা বা অশুভ কামনা পোষণ করিনা। ) যে ব্যক্তি আমার নীতিকে ভালোবাসে, নিঃসন্দেহে সে আমাকে ভালোবাসে। আর যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে, সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে। (মুসলিম)
দুনিয়া ত্যাগ তথা বৈরাগ্যবাদ রাসূলের নীতি নয়
(আরবী*****************************)
১৩. একবার তিন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা) এবাদত বন্দেগী সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের লক্ষে তাঁর স্ত্রীদের কাছে এল। যখন তাদেরকে জানানো হলো, রাসূলুল্লাহ (সা) কেমন এবাদত বন্দেগী করেন, তখন তাঁরা তাঁর সামনে নিজেদের এবাদত বন্দেগীকে অত্যন্ত কম ও নগণ্য মনে করলো।
তারা মনে মনে বললোঃ রাসূল(সা) এর সামনে আমরা কোথায় ? তাঁরতো আগেও কোন গুনাহ ছিল না, পরেও কোন গুনাহ হবে না। (আর আমরা তো নিষ্পাপ নই। কাজেই আমাদের বেশী করে এবাদত বন্দেগী করা উচিত। ) এরপর তাদের একজন বললোঃ আমি সব সময় নফল এবাদত করে পুরো রাত কাটিয়ে দেব। আর একজন বললো আমি সব সময় নফল রোযা রাখবো, দিনের বেলা কখনো পানাহার করবো না। আর একজন বললোঃ আমি সব সময় নারীদেরকে এড়িয়ে চলবো, কখনো বিয়ে করবো না। রাসূল (সা) (যখন এ সব জানতে পারলেন তখন ) তাদের কাছে গেলেন এবং বললেন, তোমরাই কি এসব কথা বলছিলে? তারপর তিনি বললেন শোন, আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে বেশী ভয় করি এবং তাঁর অবাধ্যতা বেশী এড়িয়ে চলি। অথচ আমি কখনো (নফল) রোযা রাখি, আবার কখনো রাখিনা। রাত্রে আমি কখনো নফল পড়ি, আবার কখনো ঘুমাই। আর আমি বিয়েও করেছি। (কাজেই আমার রীতিনীতি অনুসরণ করাতেই তোমাদের কল্যাণ নিহিত। ) যে ব্যক্তি আমার রীতিনীতির গুরুত্ব দেয় না ও উপেক্ষা করে, তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। (মুসলিম) , আনাস (রা) থেকে বর্ণিত)
আল্লাহ ভীতির প্রকৃত পরিচয়
(আরবী*******************)
১৪. একবার রাসূল(সা) একটি কাজ নিষিদ্ধ করে দিলেন। পরে আবার তার অনুমতি দিলেন, কিন্তু এরপরও কিছু লোক সেই কাজ থেকে বিরত থাকতে থাকতে লাগলো। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের এই মানসিকতার কথা জানতে পেরে একটা ভাষণ দিলেন। (সেই ভাষণে) প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন কিছু লোক আমি যে কাজ করি, তা থেকে বিরত থাকছে কেন?আল্লাহর কসম, আমি আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে তাদের চেয়ে বেশী জ্ঞান রাখি এবং আল্লাহ তায়ালাকে তাদের চেয়ে বেশী ভয় করি। (বোখারী ও মুসলিম, আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত)
ইহুদী ও খৃষ্টানদের অনুসরণের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি
(আরবী***************************)
১৫. হযরত জাবের (রা) বলেনঃ একবার হযরত ওমর (রা) রাসুলুল্লাহ (সা) এর কাছে এলেন এবং বললেনঃ আমরা ইহুদীদের কাছে থেকে এমন এমন বাণী শুনি, যা আমারে কাছে ভালো লাগে। আপনি কেমন মনে করেন, যদি আমরা তাদের সেই সব বাণী থেকে কিছু কিছু লিখে রাখি? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ ইহুদী ও খৃষ্টানরা যে গোমরাহীতে লিপ্ত হয়েছে, তোমারাও সেই গোমারাহীতে লিপ্ত হতে চাও নাকি? আমি তোমাদের কাছে থেকে এমন উজ্জ্বল নিখুঁত ও সহজ বিধান নিয়ে এসেছি যে, এমনকি আজ যদি স্বয়ং মূসাও (আ ) বেঁচে থাকতেন, তবে তিনিও আমার এই বিধান অনুসরণ না করে পারতেন না। (মুসলিম)
ইহুদী খৃষ্টানরা তাদের কাছে অবতীর্ণ ধর্মগ্রন্থ তাওরাত ও ইঞ্জিলকে বিকৃত করে ফেলেছিল। তবে পুরোপুরি বিকৃত করতে পারেনি। তাতে কিছু কিছু ভালো কথাও অবশিষ্ট ছিল। মুসলমানরা সে সব কথা শুনতো এবং তা তাদের কাছে ভালো লাগতো। রাসূল (সা) যদি সেই সব বাণী লিখে রাখার অনুমতি দিতেন, তা হলে ইসলামের নিদারুণ ক্ষতি হয়ে যেত। পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে, তার কিছু না কিছু ভালো কথা আছে। তাই বলে যার নিজ বাড়িতে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার পানির ঝর্ণা বিদ্যমান, অন্যের ঘোলা পানির চৌবাচ্চার কাছে ঝর্ণা দেয়া তার শোভা পায় না। হযরত ওমরকে রাসূল (সা) যে জবাব দিলেন, তা থেকে এই কথাটিই সুস্পষ্ট হয়ে বেরিয়ে এসেছে।
প্রকৃত ঈমানের দাবী
(আরবী********************)
১৬. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ কোন ব্যক্তি যতক্ষণ (কাঙ্ক্ষিত মানে উত্তীর্ণ) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ তার ইচ্ছা ও মনে ঝোঁক আমার আনীত বিধানের (তথা কোরআনের) অনুসারী না হয়। (মেশকাত)
অর্থাৎ রাসূল (সা) এর ওপর ঈমান আনার দাবী হলো, নিজের কামনা বাসনা, ইচ্ছা ও মনের ঝোঁক প্রবণতাকে রাসূলের আনীত বিধানের অনুগত করে দিতে হবে এবং নিজের খেয়াল খুশী ও খায়েশের বাগডোর ও নিয়ন্ত্রণভার কোরআনের হাতে দিয়ে দিতে হবে। এটা না করতে পারলে রাসূল(সা) এর ওপর ঈমান আনার দাবী নিরর্থক হয়ে পড়বে।
ঈমানের মাপকাঠি
(আরবী****************************)
১৭. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যতক্ষণ আমি তোমাদের কাছে তোমাদের বাবা, সন্তান ও অন্য সকল মানুষের চেয়ে প্রিয় না হব, ততক্ষণ তোমরা মুমিন হতে পারবে না। (বোখারীও মুসলিম, হযরত আনাস থেকে বর্ণিত) রাসূল (সা) এর এ উক্তির মর্মার্থ এই যে, মানুষ প্রকৃত মুমিন তখনই হয়, যখন তার মনে রাসূল ও তার আনীত দ্বীন ঈমানের ভালোবাসা অন্য সমস্ত ভালোবাসা ও স্নেহ মমতার চেয়ে প্রবল হয়। সন্তানের স্নেহ মমতা মানুষকে একদিকে যেতে বলে, বাবার প্রতি ভালোবাসা অন্য একদিকে চলতে প্ররোচনা দেয়, আর রাসূল (সা) দাবী জানান অন্য এক পথে চলার। এমতাবস্থায় যে ব্যক্তি অন্য সমস্ত স্নেহ, মমতা ভালোবাসার দাবী প্রত্যাখ্যান করে একমাত্র রাসূল (সা) এর আদিষ্ট পথে চলতে প্রস্তুত ও বদ্ধপরিকর হয়, বুঝতে হবে সেই ব্যক্তিই পাক্কা মুমিন, সেই রাসূল (সা) কে যথাযথভাবে ভালোবাসে। এই মানের ঈমানদারই ইসলামের প্রয়োজন। এ ধরনের দুরন্ত মুমিনেরাই পৃথিবীতে নতুন ইতিহাস গড়ে। কাঁচা ও দুর্বল ঈমান নিয়ে কেউ পিতা, ভাই, স্ত্রী ও সন্তানের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে ইসলামের পথে চলতে পারে না।
আল্লাহ ও রাসূলের ভালোবাসার প্রকৃত স্বরূপ
(আরবী*****************)
১৮. হযরত আবদুর রহমান বিন আবি কিরাদ বলেনঃ একদিন রাসুলুল্লাহ (সা) ওযু করলেন। তখন তাঁর কিছু সাহাবী তার ওযুর পানি হাতে নিয়ে নিজেদের মুখমণ্ডলে মাখাতে লাগলেন। তা দেখে রাসূল (সা) বললেন কিসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তোমরা এ কাজ করলে? তারা বললেন আল্লাহ ও তার রাসূলের ভালোবাসা। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলকে ভালোবাসে অথবা আল্লাহ ও রাসূলের ভালোবাসা পেয়ে আনন্দ ও তৃপ্তি লাভ করতে চায়, তার উচিত যখন কথা বলবে সত্য বলবে, যখন তার কাছে আমানত রাখা হবে, তখন আমানত হিসাবে রক্ষিত জিনিস অক্ষতভাবে মালিককে ফিরিয়ে দেবে এবং প্রতিবেশীদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে। (মেশকাত)
রাসূলুল্লাহ (সা) এর ওযু করা পানি হাতে নিয়ে বরকতের উদ্দেশ্যে মুখে মাখানোর কারণ ছিল রাসূলের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধ। এটা কোন মন্দ কাজ ছিল না যে, তার জন্য রাসূল (সা) তাদেরকে তিরস্কার করবেন। তবে তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিলেন যে, সর্বোচ্চ ভালোবাসা এই যে, আল্লাহ ও রাসূল যা কিছু হুকুম দিয়েছেন, তা বাস্তবায়িত করা, তিনি যে দ্বীন এনেছেন, তাকে নিজের জীবন ব্যবস্থায় পরিণত করা। রাসূলের অনুকরণ অনুসরণই হলো রাসূল প্রীতির সর্বোচ্চ ও সর্বোৎকৃষ্ট রূপ যদি তা যথার্থ আন্তরিক ও রাসূলের প্রতি হৃদয়ের টান সহকারে করা হয়।
রাসূল প্রীতির ঝুঁকি
(আরবী******************)
১৯. হযরত আবদুল্লাহ (রা) বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে এল এবং সে রাসূল (সা) কে বললোঃ আমি আপনাকে ভালোবাসি। তিনি বললেনঃ তুমি যে কথাটা বললে, তা নিয়ে আরো একটু চিন্তাভাবনা কর। এরপরও সে তিনবার বললো যে, আল্লাহর কসম, আমি আপনাকে ভালোবাসি। রাসূল (সা) বললেন তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাক, তাহলে দারিদ্রের মুখোমুখি হবার জন্য প্রস্তুত হও। কেননা যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে, তার কাছে অভাব ও ক্ষুধা স্রোতের পানির চেয়েও দ্রুতবেগে আসে। (তিরমিযি)
কাউকে ভালোবাসার অর্থ এটাই হয়ে থাকে যে, সে যা পছন্দ করে তাই পছন্দ করতে হবে এবং সে যা অপছন্দ করে তা অপছন্দ করতে হবে, প্রিয় ব্যক্তি যে পথে চলে সেই পথে চলতে হবে। তার নৈকট্য, ভালোবাসা ও সন্তুষ্টির খাতিরে সমস্ত প্রিয় বস্তু কুরবানী করতে হবে ও কুরবানী করতে প্রস্তুত থাকতে হবে।
রাসূল (সা) কে ভালোবাসা ও প্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে গ্রহণ করার অর্থ হলো, তিনি যে পথে চলেছেন, সে পথের যাবতীয় চিহ্ন ও রূপরেখা সঠিকভাবে জেনে ও মেনে সেই পথে চলতে হবে। যে পথে চলতে গিয়ে তিনি আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন, দুঃখকষ্ট ও মুসিবত ভোগ করেছেন, শত আঘাত ও মুসিবত সহ্য করেও সেই পথে ছলার হিম্মত ও সাহস অর্জন করতে হবে। এই পথে কখনো হেরা গুহারও সাক্ষাত মিলবে, বদর হুনায়েনের মুখোমুখি হতে হবে।
আল্লাহর দ্বীন অনুসারে চলতে গেলে অভাব ও ক্ষুধার মুখোমুখি হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। আর অর্থনৈতিক আঘাতটাই যে সবচেয়ে দুঃসহ আঘাত, তা সবাই জানে। এ আঘাতের মোকাবিলা কেবল আল্লাহর ওপর ভরসা ও আল্লাহর ভালোবাসার অস্ত্র দিয়েই করা সম্ভব। প্রকৃত মুমিন ব্যক্তি এরকম পরিস্থিতিতে ভাবে যে, আমার অভিভাবক তো স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা, সুতরাং আমি অসহায় নই। আমিতো তার দাস। দাসের একমাত্র কাজ হলো মনিবকে খুশি করা ও তার ইচ্ছা পূরণ করা। আমি যার কাজে নিয়োজিত, তিনি দয়ালু ও ন্যায়বিচারক। সুতরাং আমার শ্রম বৃথা যেতে পারে না। তার এ ধরনের চিন্তা সমস্ত বিপদ মুসিবতকে সহজ করে দেয় এবং শয়তানের যাবতীয় অস্ত্রকে ভোতা করে দেয়।
কোরআন শরীফের ওপর ঈমান আনার তাৎপর্য
(আরবী***********************************)
২০. হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের অনুসরণ করবে, সে দুনিয়াতেও গোমরাহ হবেনা, আখিরাতেও বঞ্চনার শিকার হবে না। এরপর তিনি নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করলেনঃ (আরবী****************************)
যে ব্যক্তি আমার নির্দেশ মেনে চলবে। সে দুনিয়াতেও গোমরাহ হবে না, আখিরাতেও দুর্ভাগ্যের শিকার হবে না। (মেশকাত)
কোরআনের বিষয়সমূহ
(আরবী**************)
২১.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ পবিত্র কোরআনে পাঁচটি জিনিস আছেঃ হালাল, হারাম, মুহকা, মুতাশাবিহ ও উদাহরণ। তোমরা হালালকে হালাল মানো। হারামকে হারাম মানো। মহকামের (যে অংশে আকীদা, এবাদাত, আমল আখলাক, আইন কানুন ইত্যাদির শিক্ষা দেয়া হয়েছে) ওপর আমল কর। মুতাশাবিহের (যে অংশে অদৃশ্য বিষয় তথা বেহেশত, দোযখ, আরশ ইত্যাদির বিবরণ রয়েছে) ওপর বিশ্বাস রাখো। (অর্থাৎ অদৃশ্য বিষয়গুলো নিয়ে কোন প্রশ্ন বা বিতর্ক না তুলে হুবহু যা বলা হয়েছে তাই মেনে নাও। ) এবং উদাহরণ (অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর শিক্ষামূলক কাহিনী) থেকে শিক্ষা গ্রহণ কর। (মেশকাত)
(আরবী***************************)
২২. হযরত জাবের (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ তায়ালা কিছু কাজ ফরজ করেছেন। সেগুলোকে তোমরা নষ্ট করো না। কিছু কাজ হারাম করেছেন, সেগুলোকে লঙ্ঘন করো না। কিছু সীমা নির্ধারণ করেছেন, সেগুলো অতিক্রম করো না। কিছু জিনিস সম্পর্কে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে নীরবতা অবলম্বন করেছেন, তোমরা সেগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করো না। (মেশকাত)
(আরবী***********************************)
২৩. হযরত যিয়াদ বিন লাবিদ (রা) বলেন একবার রাসূলুল্লাহ (সা) একটা ভয়ংকর জিনিসের উল্লেখ করে বললেন। এমন অবস্থা ঘটবে তখন, যখন ইসলামের জ্ঞান নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আমি বললাম, হে রাসূলুল্লাহ (সা) ইসলামের জ্ঞান কিভাবে নিশ্চিহ্ন হবে? আমরা তো কোরআন নিজেরাও পড়ছি। আমাদের সন্তানদেরকেও শেখাচ্ছি এবং আমাদের সন্তানরাও তাদের সন্তানদেরকে শেখাতে থাকবে। রাসূল (সা) বললেনঃ ওহে যিয়াদ, আমি তো তোমাকে মদিনার সবচেয়ে বুদ্ধিমান লোক মনে করতাম। তুমি কি দেখতে পাওনা, ইহুদী ও খৃষ্টানরা তাওরাত ও ইনজিল কত তেলাওয়াত (আবৃত্তি) করে। কিন্তু তার শিক্ষা অনুযায়ী একটুও কাজ করে না? (ইবনে মাজা)
তকদীরের প্রতি ঈমান আনার তাৎপর্য
আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরণা লাভ
(আরবী*************************************)
২৪. হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেনঃ তোমাদের প্রত্যেকের দোযখ ও বেহেশত নির্ধারিত হয়ে আছে। লোকেরা বললো, হে রাসূলুল্লাহ, তাহলে আমরা আমাদের নিজ নিজ নির্ধারিত ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে কাজ কর্ম ছেড়ে দেই না কেন? রাসূল (সা) বললেনঃ না। কাজ করে যাও। কেননা যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। তার জন্য সেই কাজই সহজ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি সৌভাগ্যশালী, তাকে সৌভাগ্যজনক ও বেহেশতে যাওয়ার উপযোগী কাজ করার সামর্থ্য দান করা হয়। আর যে ব্যক্তি হতভাগা ও জাহান্নামী, তাকে জাহান্নামে যাওয়ার উপযোগী কাজ করার সামর্থ্য দেয়া হয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) সূরা ওয়াল্লাইল এর এই আয়াত কটি পড়লেনঃ যে ব্যক্তি সম্পদ ব্যয় করে, আল্লাহকে ভয় করে এবং সর্বোত্তম বাণীর স্বীকৃতি দেয় (অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণ করে) তাকে আমি উত্তম জীবন যাপনের (অর্থাৎ জান্নাতবাসের উপযোগী জীবন যাপনের) ক্ষমতা দেব। আর যে ব্যক্তি সম্পদ ব্যয়ে কার্পণ্য করে, (আল্লাহ সম্পর্কে) বেপরোয়া হয় এবং উত্তম জীবন যাপনকে প্রত্যাখ্যান করে, তাকে আমি কষ্টদায়ক জীবন যাপনের (অর্থাৎ জাহান্নামের উপযোগী জীবন যাপনের) ক্ষমতা যোগাবো। (বোখারী, মুসলিম)
ব্যাখ্যা: মানুষ কোন কোন কাজের দরুন দোযখের উপযুক্তে এবং কোন কোন কাজের দ্বারা জান্নাতের উপযুক্ত হবে, সেটা আল্লাহ তায়ালা আগে থেকেই নির্ধারিত করে রেখেছেন। এই পূর্ব নির্ধারিত ব্যবস্থার নামই তাকদীর বা অদৃষ্ট। এই তাকদীর বা অদৃষ্ট কোরআনেও বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং হাদীসেও রাসূলুল্লাহ (সা) সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এরপর মানুষ জাহান্নামের পথে চলা পছন্দ করবে, না জান্নাতের পথে, সে ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন। দুটোর মধ্য থেকে যে কোন একটা অবলম্বন করা তারই দায়িত্ব। কারণ আল্লাহ তায়ালা তাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং জীবন চলার পথ নির্ধারণে তাকে স্বাধীন ছেড়ে দিয়েছেন। এই স্বাধীনতাই তাকে দোযখের শাস্তি ভোগ করাবে। অথবা এর বদৌলতেই সে জান্নাতের অধিকারী হবে। কিন্তু অনেকের বুদ্ধি এতই বক্র ও ভোঁতা যে, নিজের দায়দায়িত্ব আল্লাহর ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেকে অক্ষম মনে করে এবং ভাবে যে, সে যা কিছুই করছে, আল্লাহ তাকে দিয়ে তা জোরপূর্বক করাচ্ছেন। সুতরাং তার আর কোন দায়দায়িত্ব নেই।
তকদীরের অর্থ
(আরবী***************************)
২৫. হযরত আবু খুযামা (রা) তার বাবার কাছ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি (আবু খুযামার বাবা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে জিজ্ঞেস করলাম যে, হে রাসূলুল্লাহ। আমরা আমাদের রোগব্যাধির চিকিৎসার জন্য যে দোয়া তাবিজ ও ঔষধ ব্যবহার করি এবং বিপদ মুসিবত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করি, এগুলো কি আল্লাহর তাকদীরকে (নির্ধারিত ব্যবস্থা) ঠেকাতে পারে? তিনি জবাব দিলেন যে, এ সব ব্যবস্থাও তো আল্লাহর তাকদীরেরই অন্তর্ভুক্ত(তিরমিযি)
রাসূলুল্লাহর (সা) জবাবের সারমর্ম এই যে, মহান আল্লাহ আমাদের জন্য এই সব রোগব্যাধি নির্ধারিত করেছেন। সেই আল্লাহই এও স্থির করেছেন যে, এসব রোগব্যাধি অমুক ঔষধ বা চেষ্টা তদবির দ্বারা দূর করা যায়। আল্লাহ তায়ালা রোগের ও স্রষ্টা এবং তা দূর করার ঔষধেরও স্রষ্টা। সবকিছুই আল্লাহর নির্ধারিত নিয়ম নীতি ও বিধিবিধানের আওতাধীন।
তাকদীর আগে থেকেই নির্ধারিত
(আরবী*************************************)
২৬. হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। একদিন যখন আমি রাসূলুল্লাহ (সা) এর পেছনে বাহ জন্তুর পিঠে বসে ছিলাম। তখন তিনি বললেন, হে বালক, আমি তোমাকে কয়েকটা কথা বলছি। (মনোযোগ দিয়ে শোন) তুমি আল্লাহকে স্মরণ রাখ, তাহলে আল্লাহ তোমাকে স্মরণ রাখবেন। তুমি আল্লাহকে স্মরণ রাখ, তাহলে আল্লাহকে তোমার সামনেই পাবে। যখন কিছু চাইবে, তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। যখন কোন বিপদে সাহায্য চাইতে হয়, তখন আল্লাহর সাহায্য চাও। আর জেনে রাখ, সমগ্র মানব জাতিও যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে তোমার কোন উপকার করতে চায়, তবে ততটুকুই উপকার করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তোমার ভাগ্য লিপিতে লিখে রেখেছেন। (অর্থাৎ কারো কাছে দেয়ার মত যখন কিছু নেই, তখন কোথা থেকে দেবে? সব কিছু তো আল্লাহর। তিনি যতটুকু কাউকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন, ততটুকুই সে পায় তা সে যার মাধ্যমেই পাক) আর যদি সমগ্র মানবজাতি একত্র হয়ে তোমার কোন ক্ষতি করতে চায়, তবে তারাও ততটুকুই ক্ষতি করতে পারে, যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য নির্ধারিত করে রেখেছেন। (সুতরাং তোমার একমাত্র আল্লাহর ওপরই নির্ভরশীল হওয়া উচিত এবং একমাত্র আল্লাহকেই নিজের সাহায্যকারী মেনে নেয়া উচিত। ) (মেশকাত)
যদি এমন হতো বলা অনুচিত
(আরবী******************************)
২৭. হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ দুর্বল মুমিনের চেয়ে শক্তিশালী ও সবল মুমিন আল্লাহর কাছে বেশী প্রিয় ও উত্তম। তবে উভয়ের ভেতরেই কল্যাণ আছে। তুমি (আখিরাতের জন্য) উপকারী বস্তুর প্রত্যাশী হও। নিজের সমস্যা সংকটে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও এবং সাহস হারিও না। আর তোমার ওপর কোন বিপদ মুসিবত এলে এভাবে করো না যে, যদি অমুক কাজটি করতাম তাহলে এমন হতো। বরং এভাবে চিন্তা কর যে, আল্লাহ এ রকমই নির্ধারণ করেছেন এবং যা চেয়েছেন তাই করেছেন। কেননা যদি শব্দটা শয়তানের অপতৎপরতার দরজা খুলে দেয়। (মেশকাত)
ব্যাখ্যা: এই হাদীসের প্রথমাংশের মর্ম এই যে, যে ব্যক্তির দৈহিক ও মেধাগত ক্ষমতা বেশী, সে যদি আল্লাহর পথে সকল শক্তি নিয়োগ ও ব্যয় করে, তাহলে তার হাতে ইসলামের কাজ অনেক বেশী হবে। পক্ষান্তরে যার স্বাস্থ্য খারাপ। কিংবা যার চিন্তাগত ও মেধাগত ক্ষমতা কম। সে আল্লাহর পথে সকল শক্তি ব্যয় করলেও প্রথমোক্ত ব্যক্তির মত অত বেশী কাজ সে করতে পারবে না, তা সহজেই বোধগম্য। তাই দ্বিতীয় ব্যক্তির চাইতে তার পুরস্কার বেশীই প্রাপ্য হওয়ার কথা। অবশ্য দুজনই যেহেতু একই পথ আল্লাহর পথের পথিক। তাই এই দুর্বল মুমিনকে অল্প কাজ করার জন্য পুরস্কার বা প্রতিদান থেকে বঞ্চিত করা হবে না। আসলে শক্তিশালী মুমিনকে এই বলে উদ্দীপিত করা হচ্ছে যে, তোমাকে যে শক্তি দেয়া হয়েছে, তার কদর কর, এই শক্তি কাজে লাগিয়ে যত অগ্রগতি অর্জন করতে পার, অর্জন কর। কেননা দুর্বলতা এসে যাওয়ার পর মানুষ কিছু করতে চাইলেও করতে পারেনা। হাদীসের শেষাংশের মর্মার্থ এই যে, মুমিন নিজের মেধা ক্ষমতা ও দক্ষতার ওপর নির্ভর করে না। বরং সর্বাবস্থায় শুধু আল্লাহর ওপর নির্ভর করে। তার ওপর যখন মুসিবত আসে, তখন তার মন এভাবে চিন্তা করে যে, এই মুসিবত আমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এসেছে। এটা তো আমার প্রশিক্ষণেরই একটি অংশ। এতে করে তার বিপদ মুসিবত, তার তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আখিরাতের প্রতি ঈমান আনার তাৎপর্য
কেয়ামতের আযাব থেকে মুক্তি
(আরবী*********************************)
২৮.হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আমি কিভাবে নিশ্চিন্ত থাকতে ও আরাম আয়েশের জীবন যাপন করতে পারি যখন শিঙ্গা মুখে নিয়ে কান লাগিয়ে কপাল ঝুঁকিয়ে ইসরাফিল (আ) অপেক্ষায় আছেন, কখন ফুঁক দেয়ার আদেশ দেয়া হবে? (শিঙ্গা হলো বিউগল। যা দ্বারা সেনাবাহিনীকে শত্রুর সংবাদ জানিয়ে সতর্ক করা হয়। কিংবা তাদেরকে সমবেত হবার জন্য তা বাজানো হয়। কেয়ামতের বিউগলের প্রকৃত স্বরূপ একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। ) লোকেরা বললোঃ হে রাসূল!এমতাবস্থায় আপনি আমাদেরকে কি নির্দেশ দিচ্ছেন? তিনি বললেন তোমরা পড় আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি সর্বোত্তম অভিভাবক ও কার্যনির্বাহী। (হাসবুনাল্লাহ ওয়া নিমাল ওয়াকীল) , (তিরমিযী, আবু সাঈদ খুদরী রা)
রাসূলুল্লাহ (সা) এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তাঁর যে অস্থিরতা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ফুটে উঠেছে, তা বুঝতে পেরে সাহাবায়ে কেরাম স্বভাবতই আরো বেশী বিচলিত ও পেরেশান হলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন যে, আপনার অবস্থা যখন এই, তখন আমাদের কি উপায় হবে? আমাদেরকে বলে দিন, আমরা কি করলে সেদিন মুক্তি পাব ও সফল হবো। তিনি বললেন, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ। তাঁর অভিভাবকত্বে জীবন যাপন কর ও তাঁর আনুগত্য কর। যারা তাঁকে যথেষ্ট মনে করে ও তার ওপর নির্ভর করে তারাই সফল হবে।
(আরবী********************************)
২৯.হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলূল্লাহ (সা) বলেছেন যে ব্যক্তি কেয়ামতকে চাক্ষুষ ঘটনার আকারে দেখতে অভিলাষী, সে যেন তাকভীর, ইনফিতার ও ইনশিকাক এই তিনটে সূরা পড়ে। এই তিনটে সূরায় কেয়ামতের এমন নিখুঁত ছবি আঁকা হয়েছে যে, তা মনমগজে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করে। (তিরমিযী, ইবনে উমার রা)
(আরবী*****************************************)
৩০. হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) আয়াত (আরবী****) সেদিন পৃথিবী তার সমস্ত অবস্থা জানাবে পড়লেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞেস করলেনঃ জান, সমস্ত অবস্থা জানানোর অর্থ কি? তাঁরা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, পৃথিবী কেয়ামতের দিন সাক্ষ্য দিবে যে, অমুক নারী বা পুরুষ অমুক দিন অমুক সময়ে তার পিঠের ওপর অমুক ভালো বা মন্দ কাজ করেছে। এই হলো এ আয়াতের মর্ম। মানুষের কৃত কর্মকে আয়াতে অবস্থা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (তিরমিযি)
আল্লাহর সামনে উপস্থিতি
(আরবী**************************************)
৩১. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ তোমাদের মধ্য থেকে প্রত্যেক ব্যক্তির সংগে আল্লাহ সরাসরি কথা বলবেন। (হিসাব নেবেন) সেখানে তার জন্য কোন সুপারিশকারীও থাকবে না। কোন পর্দাও থাকবে না। যার আড়ালে সে লুকাতে পারবে। সে ডান দিকে তাকাবে (কোন সুপারিশকারী ও সাহায্যকারী আছে কিনা খুঁজে দেখার জন্য)। কিন্তু সেখানে নিজের কৃতকর্ম ছাড়া আর কিছু দেখবে না। তারপর বাম দিকে তাকাবে, সেখানেও নিজের কৃতকর্ম ছাড়া আর কিছু দেখবে না। তারপর সামনের দিকে তাকাবে, সেদিকে কেবল (সর্ব প্রকারের ভয়ংকর আযাবের দৃশ্য সমেত) দোযখ দেখবে। সুতরাং ওহে লোক সকল, দোযখ থেকে বাচার চেষ্টা কর, একটা খেজুরের অর্ধেক দান করে হলেও। (বোখারী ও মুসলিম, আলী(রা) বর্ণিত)
এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবায়ে কেরামকে আল্লাহর পথে দান করার বিষয়টি শিক্ষা দিচ্ছিলেন। তাই শুধু এই বিষয়েরই উপদেশ দিলেন। তিনি বললেন, কারো কাছে যদি একটা খেজুর থাকে এবং সে তারই অর্ধেক দেয়, তবে আল্লাহর চোখে তাও মূল্যবান। আল্লাহ সম্পদ কম না বেশী তা দেখেন না। তিনি দেখেন যে ব্যক্তি সম্পদ দান করছে তার আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা কতখানি।
মোনাফেকির ভয়াবহ পরিণাম
(আরবী*****************************************)
৩২. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেনঃ কেয়ামতের দিন এক বান্দা আল্লাহর সামনে হাজির হবে। আল্লাহ তায়ালা তাকে বলবেন হে অমুক, আমি কি তোমাকে সম্মান ও মর্যাদা দান করিনি! আমি কি তোমাকে স্ত্রী দেইনি?তোমার কর্তৃতে কি উট ও ঘোড়া দেইনি? আমি কি তোমাকে অবকাশ দেইনি যে, শাসন চালাবে ও জনগণের কাছ থেকে কর খাজনা আদায় করবে? সে এই সব নিয়ামত স্বীকার করবে। পুনরায় আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন। তুমি কি বিশ্বাস করতে যে, একদিন তোমাকে আমার সামনে উপস্থিতি হতে হবে? সে বলবে না। তখন আল্লাহ তাকে বলবেন দুনিয়াতে তুমি যেমন আমাকে ভুলে ছিলে, তেমনি আজ আমি তোমাকে ভুলে থাকবো।
এরপর অনুরুপ আরো একজন (কেয়ামত অস্বীকারকারী) আল্লাহর দরবারে আসবে। তাকেও অনুরুপ জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তারপর তৃতীয় আর একজন আসবে। আল্লাহ পূর্বোক্ত দুজনকে (কাফের) যেরূপ জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন, তদ্রূপ তাকেও করবেন। তৃতীয় ব্যক্তি বলবেঃ হে আমার প্রতিপালক, আমি তোমার ওপর, তোমার কিতাবের ওপর এবং তোমার রসূলগণের ওপর ঈমান এনেছিলাম। আমি নামায পড়তাম, রোযা রাখতাম এবং তোমার পথে সম্পদ ব্যয় করতাম। রাসূল (সা) বলেন, এভাবে সে যথাসাধ্য উৎসাহ উদ্যমের সাথে নিজের আরো বহু ভালো কাজের উল্লেখ করবে। তখন আল্লাহ বলবেন যথেষ্ট হয়েছে। এবার আসো। আমি এক্ষুনি তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষী ডাকছি। সে মনে মনে ভাববে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়, এমন কে আছে? অতঃপর তার মুখকে সিল মেরে বন্ধ করে দেয়া হবে। (কেননা ঐ মুখ দিয়ে সে দুনিয়াতে যেমন রাসূল (সা) ও মুমিনদের সামনে চরম নির্লজ্জতা ও ধৃষ্টতার সাথে নিজের মিথ্যা পরহেজগারী ও সততার ঢোল পিটাতো। তেমনি কেয়ামতের দিন আল্লাহর সামনেও মিথ্যা বলতে কুণ্ঠিত হবে না) অতঃপর তার উরু, গোশত ও হাড্ডিগুলোকে তার কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। এসব জিনিস তার প্রতিটি কাজের প্রকৃত স্বরূপ বর্ণনা করবে ও তার ধোঁকাবাজির মুখোশ খুলে দেবে। এভাবে আল্লাহ তার মিথ্যা বুলি আওড়ানোর দরজা বন্ধ করে দেবেন। রাসূল (সা) বলেনঃ এ হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে দুনিয়াতে মোনাফেকি করে বেড়াতো এবং আল্লাহর ক্রোধভাজন ছিল। (মুসলিম, আবু হুরায়রা(রা) বর্ণিত):
(আরবী************************************)
৩৩.হযরত আয়েশা বর্ণনা করেন যে, আমি রাসূল (সা) কে কোন কোন নামাযে এভাবে দোয়া করতে শুনেছিঃ হে আল্লাহ, আমার কাছ থেকে সহজ হিসাব নিও। আমি জিজ্ঞেস করলাম! হে আল্লাহর নবী সহজ হিসাব নেয়ার অর্থ কি? রাসূল (সা) বললেন, সহজ হিসাব এই যে, আল্লাহ তার বান্দার আমলনামার ওপর নযর বুলাবেন এবং তার মন্দ কাজগুলোকে ক্ষমা করবেন। হে আয়েশা, যার প্রতিটা কাজের খুঁটিনাটি ও সুক্ষ্নাতিসুক্ষ হিসাব নেয়া হবে, তার ভালাই হবে না। (মুসনাদে আহমাদ)
পবিত্র কোরআনে ও বিভিন্ন হাদীসে সুস্পষ্টভাবে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, যারা আল্লাহর পথে চলে, বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এবং সংগ্রাম করতে করতে তাদের আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন তাদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দেবেন এবং সৎকাজের মূল্যায়ন করে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
কেয়ামত মুমিনের জন্য হালকা হবে
(আরবী*********************************)
৩৪. আবু সাঈদ খুদরী(রা) বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ (সা) এর দরবারে উপস্থিত হলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম, কেয়ামত সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ঐ দিনের কথা চিন্তা কর যেদিন মানুষ হিসাব কিতাবের জন্য বিশ্ব প্রতিপালকের সামনে দণ্ডায়মান হবে। সেই কেয়ামতের দিন কোন ব্যক্তি দণ্ডায়মান থাকতে পারবে? (যখন একদিন হাজার বছরের সমান হবে) রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন (সেদিনের দুঃসহ কষ্ট অপরাধী ও খোদাদ্রোহীদের জন্য। তাদের কাছে একদিন তাজার বছরের মত মনে হবে। কেননা বিপদাপন্ন মানুষের দিন দীর্ঘ অনুভূত হয়। কোনভাবেই তা শেষ হতে চায়না। ) মুমিনদের জন্য সেদিন হবে হালকা। শুধু হালকাই নয়, ফরজ নামাজের মত আনন্দ ও খুশীর ব্যাপার। (মেশকাত)
মুমিনের কল্পনাতীত পুরস্কার
(আরবী*********************************)
৩৫. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আমি আমার সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও পুণ্যবান বান্দাদের জন্য এমন সব নেয়ামত প্রস্তুত করে রেখেছি, যা কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শোনেনি এবং কোন মানুষের হৃদয় কল্পনাও করতে পারেনি। মনে চাইলে তোমরা এ আয়াতটি পড়তে পার কেউ জানে না, পুণ্যবান বান্দাদের জন্য কত আনন্দ লুকিয়ে রাখা হয়েছে, যা পরকালে পাওয়া যাবে। (বোখারী, মুসলিম)
বেহেশতের একটুখানি জায়গাও মূল্যবান
(আরবী*********************************)
৩৬. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ জান্নাতে একটা ছড়ি রাখবার মত জায়গাও সমগ্র পৃথিবী ও পৃথিবীর যাবতীয় সহায় সম্পদের চেয়ে উত্তম। (বোখারী, মুসলিম)
ছড়ি রাখার মত জায়গা দ্বারা সেই অতিক্ষুদ্র জায়গা বুঝানো হয়েছে, যেখানে মানুষ কোন রকমে নিজের বিছানা বিছয়ে পড়ে থাকে। অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীন অনুসারে চলতে গিয়ে কারো দুনিয়া যদি নষ্ট হয়ে যায়। সমস্ত সহায় সম্পদ খোয়া যায় এবং তার পরিবর্তে জান্নাতের অতি সামান্য একটু জায়গাও পেয়ে যায়। তবে তাও তার জন্য একটা বিরাট প্রাপ্তি। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার জিনিস কুরবানী দেয়ার প্রতিদান স্বরূপ আল্লাহ তাকে এমন জিনিস দিলেন, যা চিরস্থায়ী অক্ষয়।
দুনিয়া ও আখিরাতের সুখ দুখের তুলনা
(আরবী************************************************)
৩৭. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, কেয়ামতের দিন দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী এমন এক ব্যক্তিকে ডাকা হবে, যার দোযখে যাওয়া অবধারিত হয়ে গেছে। তাকে দোযখে ফেলে দেয়া হবে। যখন আগুন তার সমস্ত শরীরকে দগ্ধ করবে, তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি কি কখনো সচ্ছলতা ও প্রাচুর্য দেখেছ? তুমি কি সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও আরাম আয়েশ উপভোগ করেছ? সে বলবে, হে আমার প্রভু, তোমার কসম, কখনো নয়। এরপর এমন একজনকে ডাকা হবে যে, জান্নাতের অধিবাসী হবে। কিন্তু পৃথিবীতে সে ছিল চরম অসচ্ছলতা ও শোচনীয়তম অভাব অনটনের শিকার। সে যখন জান্নাতের সুখ ও আরাম আয়েশে বিভোর হবে, তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি কি কখনো দারিদ্র ও অভাব অনটন দেখেছ? তোমার ওপর কি কখনো দুঃখ কষ্টের দিন অতিবাহিত হয়েছে? সে বলবে না, হে আমার প্রতিপালক, আমি কখনো অভাব অনটনের মুখ দেখিনি। কখনো পরমুখাপেক্ষী হইনি এবং আমি কষ্টের কোন যুগ কখনো দেখিনি। (মুসলিম)
জান্নাত ও জাহান্নামের আসল পার্থক্য
(আরবী***********************************)
৩৮.রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন প্রবৃত্তির লালসা জাহান্নামকে এবং অনাকাংখিত দুঃখ কষ্ট জান্নাতকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। (বোখারী, মুসলিম)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তির পূজা করবে এবং দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সুখ ও আনন্দ লাভের চেষ্টায় মত্ত হবে, তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আর যে ব্যক্তি জান্নাতের অভিলাষী হবে, সে দ্বীনের খাতিরে কাঁটা ছাড়ানো পথ অবলম্বন করতেও দ্বিধা করবে না এবং আল্লাহর জন্য নিজের প্রবৃত্তিকে পরাজিত করে তাকে যে কোন কঠিন পরিশ্রম ও অবাঞ্ছিত কষ্টকর পন্থা অবলম্বনে বাধ্য করবে। এই কষ্টকর ঘাটি অতিক্রম না করে চির সুখের আবাস জান্নাতে পৌছার কোনই সুযোগ নেই।
জান্নাত ও জাহান্নাম সম্পর্কে সচেতনতা
(আরবী***************************)
৩৯. রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আমি জাহান্নামের মত এমন ভয়ংকর আর কোন জিনিস দেখিনি, যা থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য পলায়নপর মানুষ ঘুমিয়ে থাকে। আর জান্নাতের মত এত ভালো জিনিস আর দেখিনি। যার অভিলাষ পোষণকারী ঘুমিয়ে থাকে। (তিরমিযি)
এর তাৎপর্য এই যে, কোন ভয়ংকর জিনিস দেখার পর মানুষের চোখে ঘুম থাকে না। সে ঐ জিনিসের কাছ থেকে দূরে পালায়। যতক্ষণ তা থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত না হয় ততক্ষণ সে ঘুমায়না।
অনুরুপ কেউ যদি কোন ভালো জিনিসের অভিলাষী হয়, তবে তা অর্জন না করা পর্যন্ত সে ঘুমায়ওনা, বিশ্রামও নেয়না। দুনিয়ার একটা সাধারণ ভালো ও মন্দ জিনিসের ব্যাপারে যখন মানুষের অবস্থা এরূপ, তখন সবচেয়ে উৎকৃষ্ট জিনিস জান্নাতের অভিলাষী কিভাবে ঘুমায়?আর সবচেয়ে খারাপ জিনিস জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষার চিন্তা করে না কেন? যে ব্যক্তি কোন জিনিসের আশংকা করে, সে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে না। আর কোন ভালো জিনিস অর্জনের তীব্র আকাংখা যার থাকে, সে তা অর্জন না করে বিশ্রাম নিতে পারে না।
বিদয়াতকারী হাউজে কাউসারের পানি পাবে না
(আরবী*******************************************)
৪০.রাসূলুল্লাহ (সা) (স্বীয় উম্মতকে সম্বোধন করে) বলেছেন আমি তোমাদের সবার আগে হাউজে কাউসারে পৌঁছে তোমাদেরকে অভ্যর্থনা জানাবো এবং তোমাদেরকে পানি পান করানোর ব্যবস্থা করবো। যে ব্যক্তি আমার কাছে আসবে, সে পানি পান করবে। আর যে ব্যক্তি সেই পানি পান করবে, তার আর কখনো পিপাসা লাগবে না। তবে এমন কিছু লোকও আমার কাছে আসবে, যাদেরকে আমি চিনবো এবং তারাও আমাদেরকে চিনবে। কিন্তু তাদেরকে আমার কাছে আসতে দেয়া হবে না। তখন আমি বলবো, ওরা আমার লোক। (ওদেরকে আমার কাছে আসতে দাও। ) জবাবে আমাকে বলা হবে, আপনি জানেন না। আপনার ইন্তিকালের পর তারা ইসলামের কত নতুন জিনিস (বিদআত ) ঢুকিয়েছে। একথা শুনে আমি বলবো দূর হয়ে যাক, দূর হয়ে যাক, যারা আমার পর ইসলামের কাঠামোতে পরিবর্তন সাধন করেছে। (বোখারী, মুসলিম, সাহল ইবনে সাদ থেকে বর্ণিত)
এ হাদীসের ভিতরে চমকপ্রদ সুসংবাদও আছে। আবার ভয়াবহ দুঃসংবাদও। সুসংবাদ এই যে, যারা রাসুলুল্লাহ (সা) এর আনিত দ্বীনকে কোন কমবেশী না করে হুবহু গ্রহণ করেছে ও তদনুসারে কাজ করেছে, তাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা) হাউজে কাউসারে অভ্যর্থনা জানাবেন। আর যারা জেনে বুঝে ইসলামের ভেতরে ইসলামের অংশ আখ্যায়িত করে এমন সব নতুন জিনিস ঢুকাবে, যা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক, তারা রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে পৌছতে পারবে না এবং হাউজে কাউসারের পানি পান করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
রাসূলের শাফায়াত পাওয়ার শর্ত
(আরবী***************************)
৪১. হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ কেয়ামতের দিন আমার শাফায়াত বা সুপারিশ লাভের সৌভাগ্য সেই ব্যক্তি সর্বাধিক অর্জন করবে যে অন্তরের পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও একাগ্রতা সহকারে বলবেঃ আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। (বোখারী)
রাসূল (সা) এর এ উক্তি শাব্দিক দিক দিয়ে খুবই চোট হলেও মর্মগত দিক দিয়ে খুবই ব্যাপক। অর্থাৎ যে ব্যক্তি তাওহীদকে গ্রহণ করেনি, ইসলামকে কবুল করেনি এবং শেরকের নোংরামিতে পড়েই রয়েছে। সে রাসূলুল্লাহর (সা) শাফায়াত লাভ করবে না। অনুরূপভাবে, যে ব্যক্তি মুখ দিয়ে তো কলেমা পড়লো এবং দৃশ্যত ইসলামে প্রবেশ করলো, কিন্তু মন থেকে তাকে সঠিক বলে বিশ্বাস করলো না। সেও রাসূলুল্লাহর (সা) শাফায়াত থেকে বঞ্চিত থাকবে। রাসূল (সা) শুধু তাদের জন্য শাফায়াত করবেন, যারা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ঈমান আনবে এবং তাওহীদের সত্যতা ও অকাট্যতায় অবিচল প্রত্যয় পোষণ করবে। যেমন অন্য এক হাদীসে (আরবী****) তার অন্তর দৃঢ় প্রত্যয়শীল থাকবে, কথাটা এসেছে। এই সাথে এ কথাও স্পষ্ট হওয়া দরকার যে, বিশ্বাস মানুষকে কাজে উদ্বুদ্ধ করে। নিজের শিশু সন্তান কুয়ায় পড়ে গেছে এই খবর কোন ব্যক্তিই যখনই পায় এবং এই খবরে যখনই তার পূর্ণ বিশ্বাস জন্মে, তখনই সে প্রবল উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে সন্তানের প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছুটে যায়। একনিষ্ঠ ঈমানের অবস্থাও তদ্রূপ। এ ঈমান মানুষের ভেতর পরকালীন মুক্তির ভাবনা জাগায় এবং কাজে উদ্বুদ্ধ করে।
কেয়ামতের দিন আত্নীয়তার বন্ধন নিষ্ফল
(আরবী***********************************)
৪২. হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত (যখন সূরা শুয়ারার আয়াত (আরবী*****) তোমার নিকটতম আত্মীয়গণকে সতর্ক কর নাযিল হলো, তখন) কোরাইশ জনগণকে সমবেত করে রাসূল (সা) বললেন হে কোরাইশ, নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করার চিন্তা কর। আমি তোমাদের কাছ থেকে আল্লাহর আযাব এতটুকুও হঠাতে পারবোনা। হে আবদ মানাফের বংশধর, আমি তোমাদের ওপর থেকে আল্লাহর আযাব একটুও হঠাতে পারবোনা। হে আবদুল মুত্তালিবের ছেলে আব্বাস, (রাসূলের আপন চাচা) আমি আল্লাহর আযাবকে তোমাদের ওপর থেকে একটুও হঠাতে পারবোনা। হে সুফিয়া (রা) (রাসুলের আপন ফুফু) আমি তোমাকে আল্লাহর আযাব থেকে একটুও রক্ষা করতে পারবোনা। হে আমার মেয়ে ফাতেমা, তুমি আমার অর্থ সম্পদ থেকে যত চাও দিতে পারি। কিন্তু আল্লাহর আযাব থেকে তোমাকে রেহাই দিতে পারবো না। (কাজেই নিজেকে রক্ষা করার ভাবনা নিজেই কর। কেননা পরকালে প্রত্যেকের নিজের ঈমান, আমল চাড়া আর কিছুই কাজে আসবে না। ) (বোখারী, মুসলিম)
রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্নসাতের ভয়াবহ পরিণাম
(আরবী************************************)
৪৩.হযরত আবু হুরায়রা (রা) বলেনঃ একদিন রাসুলুল্লাহ (সা) আমাদের সামনে ভাষণ দিলেন। সেই ভাষণে তিনি গনিমতের মালের (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) চুরি সংক্রান্ত বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পেশ করলেন। তারপর বললেনঃ আমি তোমাদের কাউকে কেয়ামতের দিন এমন অবস্থায় দেখতে চাইনা যে, তার ঘাড়ের ওপর একটা উট উচ্চস্বরে চিৎকার করছে। আর সে বলছে হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে সাহায্য করুন। (অর্থাৎ আমার গুনাহর এই শোচনীয় পরিণতি থেকে আমাকে রক্ষা করুন) তখন আমি বলবো, আমি তোমাকে একটুও সাহায্য করতে পারবো না। আমি তো তোমাকে দুনিয়ায় থাকতেই এ কথা জানিয়ে দিয়েছি। আমি তোমাদের কাউকে কেয়ামতের দিন এমন অবস্থায় দেখতে চাইনা যে, তার ঘাড়ের ওপর একটা ঘোড়া চিহি চিহি করছে। আর সে বলছেঃ হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে সাহায্য করুন। আমি বলবো আমি তোমাকে কোনই সাহায্য করতে পারবো না আমি তো তোমাকে দুনিয়ায় থাকতেই প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে এসেছি। আমি তোমাদের কাউকে কেয়ামতের দিন এমন অবস্থায় দেখতে চাইনা যে, তার ঘাড়ের ওপর একটা ছাগল ব্যা ভ্যা করছে। আর সে বলছে, হে রাসূলুল্লাহ, আমাকে সাহায্য করুন। আমি তাকে জবাব দেবো যে, আমি তোমার জন্য এখানে কিছুই করতে পারবো না। আমি তো তোমাকে দুনিয়ায় থাকতেই সমস্ত বিধি জানিয়ে দিয়েছি। আমি তোমাদের কাউকে কেয়ামতের দিন এমন অবস্থায় দেকতে চাই না যে তার ঘাড়ের ওপর একজন মানুষ চড়াও হয়ে বসে চিৎকার করছে। আর সে বলছে, হে রাসূলুল্লাহ, আমাকে সাহায্য করুন। আমি বলবো, আমি তোমাকে এখন কোন সাহায্য করতে পারবোনা। আমি তো তোমাকে দুনিয়ায় থাকতেই প্রয়োজনীয় নির্দেশ পৌঁছে দিয়েছি। আমি তোমাদের কাউকে কেয়ামতের দিন এমন অবস্থায় দেখতে চাইনা যে, তার ঘাড়ের ওপর কাপড়ের টুকরো উড়ছে। আর সে বলছেঃ হে রাসূলুল্লাহ, আমাকে সাহায্য করুন। আমি তখন বলবো যে, আমি তোমার জন্য এখন কিছুই করতে পারবো না। আমি তোমাকে দুনিয়ায় থাকতেই সাবধান করে এসেছি। আমি তোমাদের কাউকে কেয়ামতের দিন এ অবস্থায় দেখতে চাই না যে, তার ঘাড়ের ওপর সোনরুপা চাপানো রয়েছে এবং সে বলছেঃ হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে সাহায্য করুন। আমি তার জবাবে বলবো, আমি তোমার গুনাহর পরিণতিকে একটুকুও হঠাতে পারবোনা। আমি তোমাকে দুনিয়ায় থাকতেই এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পৌছিয়ে দিয়ে এসেছি। (বোখারী, মুসলিম)
পশুরি কথা বলা ও কাপড়ের টুকরো উড়তে থাকা ইত্যাদির অর্থ হলো, গনিমতের মাল চুরির সংক্রান্ত এ সব অপকর্ম ও অপরাধ কেয়ামতের দিন লুকানো সম্ভব হবে না। প্রত্যেকটি পাপ চিৎকার করে করে বলতে থাকবে যে, সে অপরাধী। আর এটা শুধু গনিমতের মাল চুরির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং প্রত্যেক বড় বড় গুনাহর অবস্থা এ রকমই। আল্লাহর অমন ভয়ংকর পরিণতি থেকে প্রত্যেক মুসলমানকে রক্ষা করুন এবং খারাপ সময় আসার আগে তওবা করার তৌফিক দিন।