দশম অধ্যায়
যে সময় সামরিক জেলখানায় বন্দী ছিলাম তখন আমাদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নির্দেশ দেয়া হতো যেন আমরা উম্মে কুলসুমের গান তারই সূরে সমস্বরে গাই। সাধারণত আমাদের সেই জঘন্য গানটি বলা হতো যাতে নাসেরের মহত্ব ও কৃতিত্ব এবং ফেরাউনের প্রশংসা করা হয়েছিলো। “হে জামাল। হে মিসরের কৃতিসন্তান” । ওগো দেশ প্রেমের আদর্শ। এ সময় জেলখানার সুউচ্চ ছাদের উপর সর্বাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত সৈনিক আমাদের সারির প্রতি তাক করে সদা প্রস্তুত দাঁড়িয়ে থাকতো। যেন আমাদের মধ্য থেকে কেউ নির্দেশ পালন না করার ধৃষ্ঠতা দেখালে তাকে উড়িয়ে দিতে পারে। এসব নাটকের একটিতে একজন অফিসার মুর্শিদে আ’ম আল হুদাইবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট গিয়ে অত্যন্ত ক্রোধ ভরে আদেশ করেন “মাটির ওপর সজোরে পদাঘাত করো”। মুর্শিদে আ’ম এ নির্বোধের ন্যায় নির্দেশের প্রতি অত্যন্ত নির্ভীকতা ও তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে বললেনঃ “আমি মাটির উপর পদাঘাত করলে তাতে কি পেট্রোল কিংবা তরমুজ খরমুজ বেরিয়ে আসবে।” এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে এমন নির্ভীকতাপূর্ণ জবাব দেয়া নিশ্চিত মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানানোর সমান। এটা সব মানুষের কাজ নয়। কিন্তু এতটুকু বলে রাখা সুধী পাঠকগণের সান্ত্বনার জন্য যথেষ্ট যে, এরূপ জবাব দাতা ছিলেন হাসান ইসমাঈল আল হুদাইবি।
আল্লাহ সর্বোত্তম নিরাপত্তা দাতা
আত্মমর্যাদাবোধ, সাহসিকতা ও দৃঢ়তা বিপদের ঝুঁকিকে অন্তরে স্থান না দেয়া আর মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন কেউ চাইলে হাসান আল হুদাই-বির নিকট থেকে শিখে নিতে পারে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহ তায়ালার অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যে তারই ইচ্ছা ব্যতীত একটা পাতাও নড়তে পারে না। আল্লাহ তায়ালার এ দুনিয়াতে মানুষের জন্য দু’টো দিনই রয়েছে, একটি হচ্ছে সেই দিন যেদিন তার জীবনের শুভ সূচনা হয়। আর অপরটি হচ্ছে সেইদিন যেদিন তার মৃত্যু লিখে দেয়া হয়েছে। অতএব একজন সত্যনিষ্ঠ নিবেদিত প্রাণ মু’মীন ব্যক্তির ভয় কিসের। তার জানা আছে যে, যতদিন তার হায়াত রয়েছে দুনিয়ার সমস্ত শক্তি মিলেও তাকে মেরে ফেলতে পারে না। আবার যখন তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসবে তখন কেউ সে মৃত্যুকে হটিয়ে দিতে পারবে না। আর না পাওয়া যাবে পালিয়ে আত্মরক্ষা করার মতো কোন নিরাপদ জায়গা।
হাসান আল হুদাইবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহিকে সাদাতের শাসনামলের প্রথম দিকে যখন মুক্তি দেয়া হয় তখন অগণিত লোক আগমন করেন যারা বিভিন্ন ব্যাপারে এবং তাঁর সংকলন সম্পর্কে মতানৈক প্রকাশ করেছিলেন। তাঁরা এসে তাঁর খেদমতে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এ সাক্ষাতকারও স্মরণীয় এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের অধিকারী। মুর্শিদে আ’ম মরহুমের মহান ব্যক্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠ কৃতিত্বের স্বাক্ষর এতে পরিদৃষ্ট হয় যে, তিনি এসব পূর্বতন বিরোধীদেরকে অত্যন্ত হাঁসিমুখে স্বাগত জানান। এখন যেহেতু এসব লোকের নিকট সত্য সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়ে গিয়েছে সে জন্য তিনি যারপর নাই আনন্দিত হয়েছিলেন। তিনি তাদের পূর্বের কোন আচরণের প্রতি অংগুলি নির্দেশ করেননি। কিংবা তাদেরকে লজ্জিত ও অপমানিত করেননি।
সর্বক্ষণ বেগবান
ইখওয়ানুল মুসলিমুনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। কিন্তু হাসান আল হুদাইবি যথারীতি মুর্শিদে আ’ম হিসেবে পরিচিত রইলেন। এরূপ মনে করা যেতে পারে যে, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পত্র-পত্রিকায় ইখওয়ানের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল ঠিকই কিন্তু কার্যত সকল কর্মতৎপরতা অব্যাহত ছিল। ইখওয়ান ছোট বড় সকল ব্যাপারেই দিক নির্দেশনা গ্রহণের জন্য মুর্শিদে আ’ম-এর নিকট যেতো। এ তথাকথিত আইনগত নিষেধাজ্ঞা কি করে হকের দাওয়াতের রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে? প্রচার প্রচারণা ছাড়াও তো কাজ হতে পারে। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তার জন্য মহব্বত, একজন মুসলিমের অপর মুসলিমের সাথে মিলিত হওয়া, তেলাওয়াত ও দারসে কুরআনের জন্য বসা, নবীর জীবন চরিত, ফিকাহ ও তাফসীরের সমাবেশের ব্যবস্থা করা, দেশ ও দেশবাসীর কুশলাদি সম্পর্কে অবগত হওয়া ইত্যাকার কর্মকান্ডের মধ্যে কোনটি এমন যেটাকে আপনি বেআইনি ও অবৈধ বলতে পারেন। দেশের শাসনতন্ত্রই এসব কাজের স্বাধীনতা দিয়ে থাকে। শান্তি-শৃংখলা বিধানকারীগণ তাদের নির্বুদ্ধিতা ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগীর কারণে এ বিষয়গুলোকে বেআইনি এবং জননিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ ঘোঘণা করলে তা অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা।
সসম্মানে মুক্তি দান
ইখওয়ানের কোন কর্মসূচী দ্বারা দেশের শান্তি-শৃংখলা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কোন আশংকা নেই। তথাপি বর্তমান অবস্থা হলো জননিরাপত্তার নামে পুলিশ ইখওয়ানের ডজনে ডজনে কর্মীকে গ্রেফতার করে থাকে এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সপ্তাহের পর সপ্তাহ এবং মাসের পর মাস তাদের আতিথেয়তার দায়িত্ব পালন করে। কত আন্তরিকতাপূর্ণ আতিথেয়তাই না দেখিয়ে থাকেন ইখওয়ানের এসব মেহমানদের! আল্লাহ তাদের হিদায়াত নসীব করুন। কিছুদিন জিজ্ঞাসাবাদের পর যখন সেইসব গ্রেফতারকৃতদের আদালতে পেশ করা হয় তখন আদালত চার্জশীট দেখা মাত্রই “অভিযুক্ত” দের মুক্তিদানের নির্দেশ প্রদান করে। যে ভিত্তিহীন অভিযোগের প্রেক্ষিতে এ লোকগুলোকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে সরকারী মেহমান হিসেবে রেখে দেয়া হয় তা শুনামাত্রই আদালত মুর্হূর্তের মধ্যে তাদের মুক্তির ফায়সালা শুনিয়ে দেন।
নাসেরকে কাফের ঘোষণা করার ব্যাপারে
হাসান আল হুদাইবির ভূমিকা
জামাল আবদুন নাসেরের কুখ্যাত শাসনামলে কারাগারে আমাদের ওপর যখন নির্যাতন নিপীড়নের পাহাড় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছিলো তখন কোন যুবক বন্দী এ বর্ণনাতীত জুলুম-নিপীড়নের পরাকাষ্ঠা দেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, নাসেরকে কাফের মনে করতে হবে। তাঁরা বেশ কিছুদিন গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন এবং অবশেষে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, নাসের যে নিকৃষ্টতম শাস্তি ও নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিচ্ছে তা এমন কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় যার অন্তরে তিল পরিমাণ ঈমানও বিদ্যমান আছে। এসব যুবক যাদের রাতও কাটতো নানা প্রকার শাস্তির মধ্যদিয়ে আর দিনও অতিবাহিত হতো বিভিন্ন পরীক্ষার মধ্যে। নাসেরের কাফের হওয়ার ব্যাপারে তাদের মনে কনো প্রকার সন্দেহ সংশয় ছিল না। আমাদের উপর পরিচালিত অত্যাচারের যে ষ্টীমরোলারের বিবরণ বিশ্ববাসীর দৃষ্টিগোচর হয়েছে তা প্রকৃত অবস্থার তুলনায় ছিল খুবই সামান্য। উপরোক্ত ইখওয়ানীদের অন্তরে এ চিন্তাধারা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, নাসের মুসলিম নয়। লিমান তারার কয়েদখানায় এ ধারণা অত্যন্ত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। কারাগারের অভ্যন্তরেই মুর্শিদে আ’ম যখন এ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হন তখন তিনি এ মতামতের নেতৃস্থানীয় ইখওয়ানী যুবকদেরকে তাঁর নিকট ডেকে পাঠান এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের সাথে আলোচনা করেন। অধিবেশনের সমাপ্তিতে মনে হচ্ছিল যে যুবকগণ তাদের মতামত থেকে প্রত্যাবর্তন করেছে এবং মুর্শিদে আ’ম-এর সম্মানে আপাতত নীরবতা অবলম্বন করেছিল সত্য কিন্তু তাদের চিন্তাধারায় কোনরূপ পরিবর্তন আসেনি। বাইরে এসে তারা পুনরায় কঠোরভাবে সে মতামতের সমর্থনেই সোচ্ছার হয়ে ওঠেন। মুর্শিদে আ’ম বুঝতে পারলেন যে, তারা তাদের এ দৃষ্টিভংগী পরিবর্তন করবে না। অতএব তিনি তাঁর প্রখ্যাত গ্রন্থ “দুয়া’ত লা কুজাত” (সত্য পথের আহবানকারী মাত্র ফতোয়া দাতা নয়) লিখেন ও তা প্রকাশ করেন।
মুর্শিদ মরহুমের উপরোল্লিখিত প্রকাশনা দাওয়াতে হকের কর্মী ও সদস্যগণ এবং ইসলামী বিপ্লবের পতাকাবাহী লোকদের জন্য বড়ই উপকারী ও দিক নির্দেশক গ্রন্থ। এ গ্রন্থের সংকলনে তার গুণমুগ্ধ ও পরম শ্রদ্ধার পাত্র উস্তাদ মামুন আল হুদাইবি (জজ আপিল কোর্ট) এবং উস্তাদ মুস্তফা মাশহুর প্রমুখ সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেন। মুর্শিদে আ’ম কাফের ফতোয়া দেয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না। আর তিনি যা বর্ণনা করেছিলেন তাই ছিল সত্য ও যথার্থ।
কালেমার স্বীকৃতি প্রদানকারী কোন ব্যক্তির উপর কুফরের ফতোয়া দেয়া কিংবা তাকে কাফের মনে করা কোন মা’মুলী কথা নয়। কোন মুসলিম অত্যাচার-উৎপীড়ন, পাশবিকতা-নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার যত চরমেই গিয়ে উপনিত হোক না কেন, তাকে কাফের বলা জায়েজ নেই। এ বিষয়ে রাসূল (সা)- এর কাছ থেকে এত অধিক সংখ্যক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তন্মধ্যে একটি হাদীসের বর্ণনাকারী হচ্ছে মুয়ায বিন জাবাল (রা) তিনি বলেছেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ (সা) –এর সওয়ারীতে তাঁর পশ্চাতে উপবিষ্ট ছিলাম। ইত্যবসরে তিনি সম্বোধন করলেনঃ “হে মুয়ায। আমি আরজ করলাম, “লাব্বাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক।” রসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ “তোমার কি জানা আছে যে, আল্লাহর বান্দাদের উপর এবং বান্দার আল্লাহর উপর কি কি অধিকার রয়েছে?” আমি প্রত্যুত্তরে আরজ করলাম, “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা)-ই ভাল জানেন।” তিনি বলতে লাগলেন, বান্দাহর ওপর আল্লাহর অধিকার হচ্ছে, তারা একনিষ্ঠভাবে তারই আনুগত্য করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। পক্ষান্তরে আল্লাহ তায়ালার ওপর বান্দার অধিকার হচ্ছে, যারা তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে না। তিনি তাদেরকে আযাব থেকে নিরাপদ রাখবেন।” আমি আরজ করলাম, “হে আল্লাহর রাসূল (সা)। লোকদেরকে কি এ সুসংবাদ শুনিয়ে দেবো?” জবাবে রাসূল (সা) বললেন, “না, তাহলে তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকবে।”
জামায়াতুত তাকফীর ওয়াল হিজরাহ
কাফের বলে অভিহিত করা কোন মা’মুলী ব্যাপার নয়। পরবর্তী কালে মিসরে এমন দ্বীনি জা’মায়াতও আত্মপ্রকাশ করে যার নামই “জামায়াতুত তাকফীর ও হিজরাহ” রাখা হয়। এ জামায়াত মাযহাবী আবেগ বশত যে ভূমিকা গ্রহণ করে এবং তার যে ফলাফল প্রকাশ পায় তা কারো অজানা নয়। যা হোক এ ব্যাপারে আমি অদ্যাবধি নিশ্চিত নই যে, শেখ যাহাবী (ওয়াকফ বিষয়ক মন্ত্রী)-কে হত্যা করেছিল। অভিযোগ তো জামায়াতুত তাকফীরের ওপরই আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা করা কারসাজি ছিল তা আজও রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে।
সা’দাত কর্তৃক আলোচনার আহবান
ও তার ফলাফল
১৯৭৩ সালে শেখ সাইয়েদ সাবেক আমার কাছে আসেন এবং বলেন যে, মিষ্টার আহমদ তা’য়িমা (যিনি সা’দাতের ক্যাবিনেটের অন্যতম মন্ত্রী ছিলেন) তাঁর সাথে যোগাযোগ করেছেন। মন্ত্রী মহোদয় সাইয়েদ সাবেককে এ মর্মে অবহিত করেন যে, প্রেসিডেন্ট সা’দাত ইখওয়ানের গণ্যমান্য ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে সাক্ষাত করে দেশ ও জাতির সম্মুখে বিরাজমান সমস্যাবলীর সুষ্ঠু সমাধান কল্পে পারস্পরিক সহযোগিতার উপায় খুঁজে বের করতে চান। তাখনো রুশ উপদেষ্টাদেরকে মিসর ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়নি। তার অব্যবহিত পরই তাদেরকে মিসর ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। আমি এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালাম এবং মুর্শিদে আ’ম হাসান আল হুদাইবির খেদমতে উপস্থিত হয়ে সার্বিক পরিস্থিতি তার নিকট তুলে ধরলাম। তিনি তখন আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থান করছিলেন। তিনি বললেন, “উদ্যোগ খুবই উত্তম। তবে শর্ত হলো প্রেসিডেন্ট সাহেব ও তাঁর লোকদের নিয়ত সৎ হতে হবে।” এ আলোচনা চালানোর জন্য তিনি আমাকেই ইখওয়ানের প্রতিনিধিত্ব করার আদেশ দিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইখওয়ান নেতৃবৃন্দের তালিকা প্রণয়ন করে যেন তাকে দেয়া হয় এবং সরকারকেও যেন তা অবহিত করা হয়। আমি সাইয়েদ আহমদ তা’য়ীমাকে টেলিফোনে ইখওয়ানের সেইসব সদস্যদের তালিকা জানিয়ে দেই। যারা প্রেসিডেন্ট সাদাতের সাথে প্রস্তাবিত সাক্ষাতকারে ইখওয়ানের প্রতিনিধিত্বকারী ছিলেন। তিনি তা সাদরে গ্রহণ করেন কিন্তু এর পর পরই সরকারের পক্ষ থেকে পরিপূর্ণ নীরবতা পরিদৃষ্ট হতে থাকে। এর পশ্চাতে কি রহস্য লুকায়িত ছিল তা আল্লাহই ভাল জানেন।
সাইয়েদ সাবেকের সাথে আল আজহারে আমার আকস্মিকভাবে সাক্ষাত হয়ে যায়। আমি তাঁকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলতে লাগলেন যে, মুহতারাম প্রেসিডেন্ট ও তাঁর এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলতে লাগলেন যে, মুহতারাম প্রেসিডেন্ট ও তাঁকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলতে লাগলেন যে, মুহতারাম প্রেসিডেন্ট ও তাঁর লোকজনের সিদ্ধান্ত হলো আপাতত কিছুদিনের জন্য এ সাক্ষাতকার মুলতবী রাখতে হবে। একথা শুনে আমি তাঁকে বললাম। যদি তাই হয়ে থাকে তবে এ ব্যাপারে আমাদের অবহিত করলেন না কেন? যেহেতু আপনিই আমাদের কাছে খবর নিয়ে গিয়েছিলেন তাই এর ফলাফল সম্পর্কে আমাদেরকে অবহিত করার দায়িত্ব আপনারই ছিল। মনে করুন এখানে হঠাৎ আপনার সাথে যদি আমার এভাবে সাক্ষাত না হতো এবং আমি ঘটনাক্রমে আপনাকে জিজ্ঞেস করে জানতে না চাইতাম তাহলে আপনি আমাকে সম্পূর্ণ অন্ধকারের মধ্যেই রাখতেন। যাই হোক, পরে আমি চিন্তা করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, বেচারা সাইয়েদ সাবেকও নিশ্চয়ই কোন অসহায় অবস্থার শিকার হয়ে থাকবেন। সম্ভবত তাকে নীরব থাকারই নির্দেশ প্রদান করা হয়ে থাকবে। ঘটনা যাই হোক না কেন আল্লাহই তা ভাল জানেন।
সম্ভাবনাসমুহ
আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম আর কল্পনার টানা পোড়নে ভুগতে থাকলাম যে, সা’দাত এটা কি খেলা শুরু করেছে? এক এক করে বেশ কটি সম্ভাবনা মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল। যেমনঃ
১- সে কি বাস্তবিকই দেখতে চায় যে, ইখওয়ান দেশ ও জাতির কল্যাণে সহযোগিতা করে কি না? হয়তো বা তাই।
২- সে কি এই অভিনয়ের মাধ্যমে জানতে চায় যে, ইখওয়ানের প্রকৃত নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তি কে কে? এও হতে পারে। যদিও আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয় ছিল যে, ইখওয়ানের নেতৃত্বের ব্যাপারে তারা যথাযথভাবেই অবহিত রয়েছে। যেমন অন্য একটি ঘটনা বর্ণনা প্রসংগে যথাস্থানে তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।
৩- এরূপ প্রহসনমূলক আচরণ দ্বারা সে কি আমাদের অভ্যন্তরীন সংহতি এবং পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয় অবগত হতে এবং এভাবে আমাদের মধ্যে দুর্বলতা ও ফাটল সৃষ্টি হয়েছে কি না কিংবা আমরা আল্লাহর যে কালেমার উপর ঐক্যবদ্ধ হয়েছি এখনো তার ওপর অবিচল, দৃঢ়তা ও সংহতি বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছি কি না জানতে চায়? এমনটি হওয়ারও যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
৪- প্রকৃতই সে কোন ফলদায়ক পরিণতিতে উপনীত হতে চাচ্ছিল। কিন্তু পরে সে তার মনোভাব পরিবর্তন করে ফেলেছে কিংবা তার মতামত বদলে দেয়া হয়েছে, তাই বা কে জানে?
৫- সেকি ইখওয়ানের অবস্থান এবং জনগণের মাঝে তাদের শক্তি ও প্রভাব পরিমাণ করতে চাচ্ছিলো? হয়তো তাই হবে।
৬-এ পর্যায় সে কি জনসাধারণের সহযোগিতা লাভ করতে চাচ্ছিলো? কেননা ইখওয়ান ছাড়া জনগণের হযোগিতা লাভ করা আর কোন উপায়েই সম্ভব নয়? এমনটি হওয়াও তো একেবারে অসম্ভব নয়।
৭- সে কি ইখওয়ানের ওপর পুনরায় হস্তক্ষেপ করার জন্য কোন নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করার প্রয়াস পাচ্ছিলো? হয়তো এর কোন একটা অনুমান যথার্থ হবে। আমার তো এমনও মনে হয় যে, সে সকল ক্ষেত্রেই ইখওয়ানকে পেয়েছিল নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত। এ জন্যই সে তাদের সহযোগিতা লাভ করার জন্য সুচিন্তিতভাবে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু পরে তার উপদেষ্টারা এবং সে নিজেও এ সংকল্প বাদ দিয়ে থাকবে যে, ইখওয়ানকে সাথে নেয়ার পর ইসলামী শরীয়াত প্রবর্তন করা ব্যতীত গত্যন্তর থাকবে না। আর এরা শরীয়াতের ব্যাপারে অতিমাত্রায় ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে।
আমি আরো ভাবতে থাকলাম যে, হয়তো বা কোন সময় আবেগ বশত অকস্মাৎ মস্মানিত প্রেসিডেন্টের অন্তরে এ ধারণা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে থাকবে। তারপর আবার তিনি সম্বিত ফিরে পেয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে থাকবেন। কি জিনিস তার সামনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে? সারকথা হলো, প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ-ই অবগত নন। সে যাই হোক গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, ইখওয়ান বিশেষত মুর্শিদে আ’ম আল হুদাইবি (র) তার পক্ষ থেকে এমন সকল প্রস্তাব স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত ছিলেন যাতে প্রাণপ্রিয় দেশমাতৃকার মংগল নিহিত রয়েছে। আমার কল্যাণকর সকল কাজে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করার জন্য সদা প্রস্তুত এবং এটাকে আমরা আমাদের নৈতিক কর্তব্য বলে মনে করে থাকি।
ইখওয়ানের লিখিত ভূমিকা
দ্বিতীয়বার মিষ্টর উসমান আহমদ উসমান গৃহায়ন বিষয়ক মন্ত্রী আমাদের সাথে মিলিত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমি আমার তিনজন গণ্যমান্য সাথী জনাব ডাক্তার আহমদ আল সালাত, আলহাজ্জ হুসনী আবদুল বাকী এবং আলহাজ্জ সালেহ আবু রাকীককে সংগে নিয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে দেখা করতে যাই। মন্ত্রী বাহাদুর অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে আমাদের সাথে মিলিত হওয়ার পর বলতে লাগলেন, “আমার মনে হয়, আপনারা মাননীয় প্রেসিডেন্টের খেদমতে দেশ ও জাতির কল্যাণার্থে আপনাদের সংস্কার কর্মসূচী লিখিত আকারে পেশ করলে সেটাই ভাল হয়। মাননীয় প্রেসিডেন্ট মনোযোগ সহকারে আপনাদের দৃষ্টিভংগী হৃদয়ংগম করবেন এবং এভাবে প্রকৃত কল্যাণের কোন পন্থা হয়তো বেরিয়ে আসবে।”
অনন্তর আমরা আমাদের মতামত ফুলস্কেপ কাগজের পূর্ণ নয় পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করে আহমদ উসমানের নিকট সোপর্দ করি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই খসড়া কর্মসূচী প্রেসিডেন্টের খেদমতে নিয়ে যান। তার কিছুদিন পরই ভাইস প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ হুসনী মোবারক (বর্তমান প্রেসিডেন্ট)-এর সাথে দেখা করার জন্য আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। মিসরুল জাদিদাস্থ তাঁর বাসভবনে কয়েকবার তার সাথে আমার ব্যক্তিগত সাক্ষাত হয় এবং কয়েক দফা সাক্ষাতের সময় উস্তাদ মুস্তফা মাশহুরও আমার সাফে ছিলেন। এ সকল সাক্ষাতকারের সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট সাহেব আমাদের উপস্থাপিত প্রস্তাবাবলীর কোন কোন দিকের ওপর বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ জানার ইচ্ছা ব্যক্ত করতে থাকেন। এরপর আবার দীর্ঘ নীরবতা দেখা যায় এবং সাক্ষাতকারসমূহের ধারাবাহিকতা কোন ফলাফল ব্যতীতই বন্ধ হয়ে যায়।
ইখওয়ানের গুরুত্ব ও দেশপ্রেম
এরূপ নীরবতা ও অচলাবস্থার কারণ কি ছিল? তা আমি জানতাম না, যা হোক আমার একটা কথা জানা ছিল যা আমি অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে ব্যক্ত করতে পারি যে, রাজনেতিক ময়দানে ইখওয়ানের অবস্থান এবং সর্বসাধারণের নিকট তাদের স্বীকৃতি সম্পর্কে আমাদের দেশের কর্ণধারগণ খুব ভালভাবেই অবগত রয়েছেন। তা না হলে এরূপ তামাশা ও অভিনয় করার কি প্রয়োজন তাদের? আজ সাক্ষাতের জন্য ব্যাকুলতা আবার কাল কোন প্রকার ফলাফল ব্যতীত তা শেষ করা। আরো একটি কথা যা আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, তা হচ্ছে, বিগত দিনগুলোতে বর্তমান সময়ে এবং অনাগতকালেও ইখওয়ান তার প্রিয় দেশমাতৃকার মংগল ও কল্যাণ কামনায় সদা সচেষ্ট থাকবে। ইখওয়ান কখনো কোন রকম পক্ষপাতিত্ব ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগীর শিকার হয়নি। কোথাও কোন দল যদি আমাদের সাথে দেশ ও জাতির উন্নতি সমৃদ্ধির জন্য আলোচনা ও মত বিনিময়ের সদিচ্ছা প্রকাশ করে তা হলে তারা সেজন্য আমাদেরকে সদা প্রস্তুত পাবে। অনমনীয়তা ও হঠকারিতা আমাদের কর্মনীতি নয়। পারস্পরিক আলাপ আলোচনা ও বুঝাপড়া এবং দেশপ্রেম আমাদের কর্মনীতি নয়। পারস্পরিক আলাপ আলোচনা ও বুঝাপড়া এবং দেশপ্রেম আমাদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এসব সংলাপের মাধ্যমে একটা বিষয় দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ইখওয়ানের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা, দেশদ্রোহিতা ও প্রতারণার যেসব ভিত্তিহীন অভিযোগ অব্যাহতভাবে লাগানো হচ্ছে তাতে সত্যতা ও বাস্তবতার লেশমাত্র ছিল না। আমরা যদি সত্যিই অবিশ্বাসী হতাম তবে আর আমাদেরকে আলাপ-আলোচনার জন্য আহবান জানানোর কি অর্থ? অভিযোগ আরোপকারীগণ যখনই ইখওয়ানের ওপর আক্রমণ চালান তখন নির্ভরযোগ্য কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ ব্যতীতই তাদেরকে সবরকম “পদবী” তে ভূষিত করতে থাকেন।
তাদের লজ্জা শরমের যেমন বালাই নেই তেমনি আল্লাহ ভীতির ব্যাপারেও তারা হয়ে গেছে সম্পূর্ণ বেপরোয়া। আমরা মাঝে মধ্যেই তাদের এরূপ বিষাক্ত তীরের অসহায় শিকার হয়ে থাকি। আমরাও জানি যে, এসব কূটকৌশল আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতেই থাকবে। সাথে সাথে আমরা অত্যাচারীদেরকেও দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিযে দিতে চাই যে, শীগ্রই তাদের পরিণতি তারা ভোগ করতে বাধ্য হবে। আল্লাহর ওয়াদা মূর্ত হয়ে দেখা দেবে। (আরবি************) “আর জালেমরা শীগ্রই জানতে পারবে যে, তারা কোন্ পরিণামের সম্মুখীন হচ্ছে।” –সূরা আশ শুয়ারাঃ ২২৭
প্রধান মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত
মিষ্টার ফুয়াদ মহীউদ্দীন মরহুম ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে আমাকে তার সাথে সাক্ষাতের জন্য ডেকে পাঠান। মরহুম তখন প্রধান মন্ত্রী ছিলেন। তার সে সময়কার ব্যক্তিগত সচিব একনও বেঁচে আছেন। তিনি এসব ঘটনা প্রবাহের সত্যতা নিরূপন করতে পারেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে দীর্ঘায়ু দান করুন। আমি যথা সময়ে উজীরে আজনের দপ্তরে গিয়ে পৌঁছলাম। আমার ধারণা ছিল, প্রধান মন্ত্রী আমাকে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার জন্য ডেকে থাকবেন। প্রায় আধা ঘন্টা ব্যাপী আলোচনা চললো। এ দীর্ঘ সময়ে মহামান্য উজীর আমাকে শুধু মাত্র এতটুকু জিজ্ঞেস করলেন যে, আসন্ন নির্বাচনে ইখওয়ান কাকে সমর্থন করবে। তাদের পক্ষ থেকে কে প্রার্থী হবেন এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। আমি আরজ করলাম, ইখওয়ান এখনো পর্যন্ত কারো সাথে ঐক্য চুক্তিতে আবদ্ধ হয়নি। এ ছাড়া তিনিও আর কিছু জানতে চাননি এবং আমিও কিছু বলিনি।
আমি চলে আসতে উদ্যত হলে তিনি বললেন, আমাদের মধ্যে এরূপ পারস্পরিক সাক্ষাত ও মত বিনিময় হতে থাকবে। আমি তাতে আনন্দই প্রকাশ করলাম। সত্য কথা বলতে কি মরহুমের বেশ কিছু মহৎগুণ ছিল। তিনি ছিলেন একাধারে কোমল হৃদয়, দয়াদ্রচিত্ত এবং অন্যদের কথা শান্ত মনে শ্রবণ করার মত গুণের অধিকারী। আমার আকংখা ছিল যে, এ ধরনের সাক্ষাত ও মত বিনিময়ের সুযোগ অব্যাহত থাকুক। বিশেষ করে যতদিন পর্যন্ত দু’পক্ষই একে অন্যের কথা শুনতে ও বুঝতে প্রস্তুত থাকবে। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস। আকস্মিম মৃত্যুর হিমশীতল হাতছানি মরহুমকে বেশী অবকাশ দেয়নি। আল্লাহ তাঁর ওপর রহম করুন এবং আমাদের সকলকেও তার অফুরন্ত অনুকম্পা লাভে ধন্য করুন।
ক্ষমতার মসনদে সমাশীন কর্তৃপক্ষ যদি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পারতেন এবং বুঝতে পারতেন যে, এ ধরনের সমঝোতা পূর্ণ আলাপ আলোচনায় উপকারী ও ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং এভাবে জনসাধারণের সহযোগিতা লাভের সহজ সোপান গড়ে উঠছে তাহলে তাদের এক সাথে বসার এবং মতামত বিনিময়ের গুরুত্ব অবশ্যই উপলব্ধি করা উচিত। মখোমুখি বসে খোলাখুলি কথাবার্তা দ্বারা অনেক ভুল বুঝাবুঝি দূর হয়ে যায় এবং বাহ্যিক অনেক কঠিন সমস্যারও সহজ সমাধান বেরিয়ে আসে। রকমারী মতামত পোষণকারী ব্যক্তি কিংবা দলের পক্ষে এটা অত্যন্ত কল্যাণকরও যে তারা কোন প্রকার মধ্যস্থতা ব্যতীতই একে অন্যের সাথে সত্য সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলবে এবং নিজ নিজ দৃষ্টিভংগী প্রতিপক্ষকে অবহিত করতে চেষ্টা করবে।
রটানো নির্দেশ
যখনই আমি ইখওয়ানের ইতিহাস আমার স্মৃতির পাতায় রোমন্থন করি তখনই তার পুরো চিত্র আমার দৃষ্টির সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ১৯৫৪ সালের জানুয়ারী মাসেই ইখওয়ানকে ধরপাকড় শুরু হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসেই আমাকে গ্রেফতার করা হয়।
সকাল আনুমানিক দশটার দিকে আমাদেরকে আমাদের কারাগারের সেল থেকে বের করে আনা হতো যেন আমরা কিছু সময় রোদ পোহাতে পারি। এটা হতো সরকারী প্যারেড এর মতই এবং এর সমস্ত পর্যায়ই ছিল যান্ত্রিক নিয়মের। আজও সেসব শব্দ আমার কানে প্রতিধ্বনিত হয়ে থাকে এবং আমার দৃষ্টির সামনে সেসব দৃশ্য এখনও বার বার ভেসে ওঠে। আমাকে এমনভাবে বসানো হতো যে আমার সম্মুখে পশ্চাতে ও ডানে বামে দু’দু মিটার ব্যবধানে ইখওয়ানীরা বসা থাকতো। যখন আমরা সকলেই উপবিষ্ট হতাম তখন একজন অফিসার আমাদের সামনে এরূপ আসন গেড়ে বসার ব্যাপারে জেল ম্যানুয়েল-এর বিধি-বিধান পড়তে শুরু করতো। মনে হতো যেন সে “তিলাওয়াত” করছে। কথাবার্তা বলা ছিল নিষিদ্ধ। ফিশ ফিশ ও কানাকানি করা ছিল অপরাধ। চোখ, হাত কিংবা মাথার সাহায্যে কাউকে কোন প্রকার ইশারা করা ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোনরূপ নড়চড়ার আদৌ কোন অনুমতি ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে আমাদেরকে রোদ পোহানোর অনুমতি দেয়া হতো। যেহেতু আমাদেরকে জেলখানার পৃথক পৃথক সেলে আবদ্ধ করে রাখা হতো। সেহেতু এই সুযোগে আমাদেরকে পারস্পরিক মতামত বিনিময়ের সুযোগ গ্রহণ কঠোরভাবে নিষেধ করা হতো। কিন্তু বিবেকের এই অন্ধরা কি বুঝতে পারতো যে হৃদয়ের গভীর কন্দরে জাগ্রত অনুভূতি কোন প্রকান নড়াচড়া ও ইংগিত ইশারা ছাড়াই অন্যের হৃদয়ে সাড়া জাগাতে পারে। আমরা সাধারণত যে কোন তথ্য একে অন্যকে অবহিত করার ইচ্ছা করতাম অথবা জানার আকাংখা পোষণ করতাম তার সবটাই আমরা এ অবসরে করে ফেলতে পারতাম।
আমীরুল উমারা
সময় কত দ্রুত অতিবাহিত হয়। নাসেরের দুঃশাসন কাল আসলো এবং আমাদের মাথার ওপর দিয়ে অতিবাহিতও হয়ে গলো। তখন আমরা বার বার আমাদের মাথা দিয়েছি কিন্তু বিপদ সঙ্কুল প্রেমের কঠিন হৃদয় অভিযাত্রীদল প্রতিবন্ধকতার সকল প্রান্তর অতিক্রম করে সর্বদা লক্ষ্য পানে অগ্রগামী হতে থাকে। নাসেরের পরে শুরু হয় সাদাতের শাসনকাল। আমার চোখের সামনে সাদাতের উসকে দেয়া সাম্প্রদায়িকতার আগুন ঘুরপাক খাচ্ছিল। সাদাত তার নিজের বিশেষ স্বার্থের জন্য মুসলিম ও কিবতি সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত লাগিয়ে দিয়েছিল। আমরা সবসময় এ ধরনের ঘৃণা বিদ্বেষের বিরোধিতা করেছি। ইসলামী দলসমূহ একটা ঐক্য জোট গঠন করেছিল। এ সংগঠনের সদস্যদের সহযোগিতায় তৎকালিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জেনারেল নববী ইসমাঈল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সবরকম সযত্ন প্রয়াসে সাহায্য করেন। নানা প্রকার আবেদন নিবেদন করতে থাকেন। আমি ছিলাম ঐ সংগঠনের প্রধান। অতএব এক বিশেষ অধিবেশনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আমাকে “আমীরুল উমারা” উপাধিতে ভূষিত করেন। উক্ত অধিবেশনে উস্তাদ মুহাম্মাদ আল গাযালী, জনাব সালাহ আবু ইসমাঈল, উস্তাদ ইবরাহীম শরফ প্রমুখ স্বনাম ধন্য ও বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গও উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রী মহোদয় অত্যন্ত সুচিন্তিত হৃদ্যতা পূর্ণ পরিবেশে আমাকে এ উপাধি প্রদান করেন। কেননা তিনি কার্যত এটা খুব ভালভাবেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন যে, আমরা সাম্প্রদায়িক দাংগার কট্টর বিরোধী এবং তা নির্মূল করার জন্য সর্বাত্মক এবং ফলপ্রসু উদ্যেগ গ্রহণ করেছিলাম। সরকার প্রথমে এ উত্তেজনার আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা তাদের নির্বুদ্ধিতা উপলব্ধি করলো এবং বুঝতে পারলো যে, এ দাবানল প্রশমিত করা এখন তাদের সাধ্যাতীত। যদি এ পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনা না যেতো তাহলে তা সারা দেশকে জ্বালিয়ে শেষ করে দিতো।
মিথ্যার কোন ভিত্তি থাকে না
এটা অত্যন্ত বিষ্মিয়ের ব্যাপার যে, প্রেসিডেন্ট সাদাত প্রথম দিকে এ উত্তেজনার অনল প্রজ্জলিত করে ফলাও করে প্রচার করতে থকেন যে, এর নটের গুরু আমি (ওমর তিলমেসানী) ১৯৮০ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট অধিবেশনে জ্বালাময়ী বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে তিনি বলেনঃ “আমি খুব ভাল করেই জানি যে, এই অনাকাংখিত পরিস্থিতি ওমর তিলমেসানীরই সৃষ্টি……… এই অভিনব ধারণা উদ্ভাবনের জন্য পার্লামেন্ট সদস্যগণ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত হাততালি দিতে থামেন যেন প্রেসিডেন্ট কোন জটিল বিষয়ের সমাধান হাস্যরসের মধ্যে দিয়েই করে ফেলেছেন। এসব নির্বোধ ও জ্ঞানপাপীদের সামনে এ বক্তৃতা পেশ করার সময় প্রেসিডেন্ট একথাও বললেন যে, “ইসলামী দলগুলোর ঐক্যজোট অবশ্য এ বিপর্যয় রোধ করার জন্য উল্লেখযোগ্য ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। সে জন্য আমরা তাদের নিকট আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।”
এটা ঠিক বুঝা যাচ্ছিল না যে, প্রেসিডেন্ট তখন সময়ের নিষ্ঠুর বাস্তবতা ভুলে গিয়েছিলেন নাকি। একথা জেনেও না জানার ভান করছিলেন যে, এ অধমই আলোচ্য সংগঠনটির সভাপতি ছিলেন। হতে পারে যে, তিনি পার্লামেন্ট সদস্যগণকে এমন নির্বোধ ও দুর্বল মস্তিষ্কের অধিকারী মনে করেছিলেন যে, মুর্হূতের মধ্যেই তারা তার প্রথমোক্ত কথাটি একেবারেই ভুলে গিয়েছিলেন। খুব বেশী ঢাকা-ঢোল পিটাতে যারা অভ্যস্ত, অন্যের পদলেহনও করতে যারা গর্ববোধ করে দায়িত্বহীন কথাবার্তা বলাই যাদের স্থায়ী অভ্যাস তারা খুব শীগ্রই ভুলে যায়। কথায় বলেঃ মিথ্যার কোন ভিত্তি থাকে না।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, তাঁর এই দ্বিতীয় উক্তির পরও পার্লামেন্ট সদস্যগণ হাততালি দিতে থাকেন। আল্লাহ তায়ালাই ভাল জানেন এ জাতির এসব প্রতিনিধির করতালি দেয়ার রোগে পেয়ে বসেছে না তারা মনে করে যে মহামান্য রাষ্ট্রপতির পবিত্র মুখ থেকে যা কিছুই নিঃসৃত হয় তার সবটাই ভূয়সী প্রশংসার যোগ্য।
নিজের দিকে একটু তাকিয়ে আত্মমর্যাদা
উপলব্ধি করতে চেষ্টা করুন
সাদাত সাহেবের হত্যাকান্ডের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয় এবং অন্য সমস্ত মন্ত্রণালয়ের দপ্তরসমূহ দুর্ভোদ্য দুর্গের ন্যায় সুরক্ষিত এবং সশস্ত্র প্রহরা মোতায়েন করা হয়। ইত্যবসরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জেনারেল নববী ইসমাঈল আমাকে তারঁ সাথে সাক্ষাতের জন্য ডেকে পাঠান। নিরাপত্তা প্রহরীগণ বার কয়েক আমার মত একজন বয়োবৃদ্ধ ব্যাক্তির দেহ তল্লাশী করেন যাতে আমার কাছে কোন অস্ত্রশস্ত্র না থাকে। এতখানি সতর্ক হওয়া সত্ত্বেও এ লোকদের স্নায়ুতে এমন ভয়ভীতি চেপে বসছিল যে, দু’ দু’জন মেশিনগানধারী সশস্ত্র নওজোয়ান পূর্ণ সতর্কতাবস্থায় প্রহরারত ছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দপ্তরকে যুদ্ধের ঘাঁটি বলে মনে হচ্ছিল।
আমাদের দুঃসাহসী বীর ও অত্যন্ত মূল্যবান বন্ধু জনাব কামলুদ্দিন সানানিরী ইতিমধ্যেই জিন্দানখানার দুঃসহ অত্যচার নির্যাতনের অসহায় শিকার হয়ে শাহাদাতের সুধা পান করেছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী নিজেও এ নির্যাতনে অংশীদার ছিলেন। এ ব্যাপারে পত্র-পত্রিকায়ও সংবাদ প্রকাশিত হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আমাকে স্বাগত জানান এবং আমাকে অবহিত করেন যে, কামাল সানানিরী জেলখানায় আত্মহত্যা করেছেন।
এর চেয়ে ডাহা মিথ্যা আর কি হতে পারে। ইখওয়ানের একজন সাধারণ কর্মীও কোনদিন আত্মহত্যার কল্পনাকে তার মনে স্থান দেয়নি। কামাল তো ছিলেন একজন অতিবড় আলেম, সাহসী মুজাহিদ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আমাকে এও বলেন যে, আমি চাইলে তিনি আমাকে কাসরুল আইনি কারাগারে পাঠিয়ে দিতে পারেন। (মুর্শিদে আ’ম তখনও নজর বন্দী ছিলেন এবং তুলনামূলকভাবে অধিকতর নিকৃষ্ট জেল তুররায় রাখা হয়েছিল। জেলখানা থেকেই তাঁর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়েছিল।) আমি তাঁকে বললামঃ “আমার জন্য সব জায়গা একই রকম যেখানে ইচ্ছ পাঠিয়ে দাও।” (কাসরুল আইনি হাসপাতালে কোন কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও নজর বন্দী ছিলেন।)
সেদিন আসরের নামাযের পর জেলখানায় আমার নিকট জনৈক অফিসার আগমন করেন এবং কাসরুল আইনির বন্দীশালায় আমাকে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে বহু সংখ্যক নেতা এবং মিসরের জ্ঞানীগুণী ও পন্ডিতদের সাথে আমার সাক্ষাতের সুযোগ হয়। নববী। ইসমাঈলের সীমালংঘনমূলক যে আচরণের কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি তার সমস্ত দায় দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হবে। কিন্তু আমি সর্বদা মানুষের সাথে ইনসাফই করে থাকি। যার মধ্যে যে গুণ রয়েছে তা স্বীকৃতি প্রদানে আমি কখনো কার্পণ্য করি না। আমি যখন বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পাই তার কয়েক মাস পর তৎকালীন জনৈক মন্ত্রীর সাথে আমার সাক্ষাত হয়। তিনি আজও জীবিত রয়েছেন। তিনি আমাকে অবহিত করেন যে, আমার গ্রেফতারীর বিষয়টি যখন সংসদে আলোচনার জন্য উত্থাপিত হয় তখন নববী ইসমাঈল তার তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত নীরবতা অবলম্বন করেননি। যতক্ষণ স্বয়ং সাদাত অত্যন্ত অসন্তোষ প্রকাশ করে তাঁকে চুপ করার নির্দেশ প্রদান করেন।
আতিথেয়তার পরীক্ষা
লীমানতারা জেলখানা অনেকবারই আমাদের বাসস্থান হয়েছে। এ ধরপাকড়ের সময়ও আমাকে উক্ত কারাগারেই রাখা হয়েছিল। জিন্দানখানার দারোগা অধিকাংশ সময়ই আমার নিকট আগমন করতো। তিনি অত্যন্ত নিরহংকার ও সাদাসিদে মানুষ ছিলেন। তিনি সর্বদা আমাকে অবহিত করতেন যে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব নববী ইসমাঈলের পক্ষ থেকে এ মর্মে বার বার নির্দেশ আসা অব্যাহত রয়েছে যেন আপনার সার্বিক আরাম আয়েশের প্রতি আমি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখি। ইতিপূর্বে আমি কখনো এ কয়েদখানায় এত আরাম-আয়েশ উপভোগ করার সুযোগ পাইনি। কিংবা তা কল্পনাও করতে পারিনি। প্রথম দিকে তো নির্মমতার ষ্টীমরোলার চালানো হতো। আর আমরা সেজন্য মানসিকভাবে তৈরী থাকতাম। এখন আপ্যায়ণ-আতিথেয়তাও মুসিবত হয়ে দেখা দিয়েছে। কর্মকর্তাগণ সদাসর্বদা ছায়ার মত এমনভাবে আমার সাথে সাথে থাকতো যে শেষ পর্যন্ত আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যেতে লাগলো।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে যখন আমার সাক্ষাত হয় তখন আমি তার নিকট অত্যন্ত কঠোরভাবে অভিযোগ করি যে, জেলগারদে কয়েদীদের সাথে এখনো পর্যন্ত পশুসুলভ বর্বর আচরণ করা হচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ আমি তার নিকট বর্ণনা করলাম যে, আমার কামরার নীচের কামরার বন্দীদের উপর মধ্যরাতে অত্যাচার ও মারপিট শুরু হয়ে যায়। একাধারে সকাল পর্যন্ত এ হৃদয় বিদারক দৃশ্য অব্যাহত রাখা হয়। অত্যাচারিত দুঃখী মানুষদের করুণ আর্তনাদ ও আহাজারী শুনে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসতে চায়। মন্ত্রী বাহাদুর একথা শুনে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন এভাবে যে, “শাস্তি প্রদান তো নিষিদ্ধ। তথাপি জেলখানায় দাগী আসামীদেরকে শিক্ষামূলকভাবে ও সংশোধনের উদ্দেশ্যে কিছু কিছু শাস্তি দেয়া হয়ে থাকে।” এ হতভাগা বন্দীদেরকে তাদের হাত পা বেঁধে কারাভ্যন্তরে তাদের কৃত অপরাধের জন্য চাবুক মেরে শাস্তি প্রদান করা হয়। আমি মন্ত্রী মহোদয়কে আর কিই বা বলতাম। তিনি যা বলছিলেন বাস্তবের সাথে তার লেশমাত্র সম্পর্ক ছিল না । আমি খুব ভাল করেই জানতাম যে, শিক্ষামূলক শাস্তির বিধান জেল ম্যানুয়েল থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। আর যখন তা রহিত হয়েছিল না তখনো তার নিয়ম ছিল অপরাধিদেরকে দিনের বেলা শাস্তি প্রদান করা দুপুর রাতে নয়।
ইখওয়ানের প্রতি নাসেরের শত্রুতা
আমার আজও মনে আছে যে, জামাল আবদুন নাসের সেই সব সংবাদপত্র সাময়িকী একত্রিত করেছিলেন যাতে ইখওয়ানের লিখকগণ মুসলিম শাসকদের কাছে ইসলামী শরীয়াত কার্যকরী করার দাবী জানিয়েছিলেন। এসব রচনা ও প্রবন্ধ এতদঞ্চলের বিভিন্ন শাসকদের কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল এবং সকলকে এরূপ পদক্ষেপের বিপজ্জনক পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করে দেয়া হয়েছিল। এমনিতে জামাল আবদুন নাসের শুধু মাত্র মিসরেই ইখওয়ান নিধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। বরং অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে তিনি ইখওয়ানের হত্যা, এবং অত্যাচার- উৎপীড়নের ব্যবস্থা পাকা পোক্ত করেছিলেন।
নাসের মস্কোতে গিয়ে অত্যন্ত গর্বের সাথে ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি একরাতে বিশ হাজার ইখওয়ানীকে গ্রেফতার করে কারাগারে বন্দী করেছেন। আমি নাসেরের এ জঘন্য ঘোষণাকে এজন্য রেকর্ড করিয়ে দিতে চাই যাতে ইতিহাসের এই আমানত ইতিহাসের নিকটই সোপর্দ হয়ে যায়।
তাঁর অত্যাচার ও জুলুম নিপীড়নের কাহিনী কারো অজানা নয়। আর আমরা তো এখনো পর্যন্ত তার জুলুম-নির্যাতন ভুলে যেতে পারিনি। এতদসত্ত্বেও আমি আমার মনে কোন প্রতিশোধ স্পৃহা পোষণ করি না। আমি সকল গোনাহগার মুসলিমের জন্য আল্লাহ তায়ালার সমীপে তার রহমতের দোয়া করে থাকি। নাসেরের জন্যও তাই। আমি মহান আল্লাহর নিকট মাগফিরাতের দোয়াই করছি।
আমি সকল নিষ্ঠাবান মুসলিমকে এ মর্মে উপদেশ প্রদান করতে চাই যে, জালেমদের বিরুদ্ধে বদ দোয়া করার পরিবর্তে তাদের কিভাবে জুলুম থেকে বিরত রাখা যায় সেই চিন্তা করুন।
নাসেরের আসল চেহারা কারো কাছে গোপন নেই। প্রচার-প্রপাগান্ডার সাহায্যে তিনি তার যে ইমেজ তৈরী করেছিলেন বাস্তব থেকে তা বহু দূরে।
তিনি শাহ ফারুকের বিলাসবহুল জীবন ও ব্যয় বাহুল্যের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তার বক্তব্যের সমর্থনে প্রমাণ হিসেবে শাহের বিলাসী প্রমোদ তরীর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন। যা হোক কে না জানে যে, ঐ প্রমোদ তরীই অধিকতর সাজ-সরঞ্জামে সুসজ্জিত করার পর নাসের সাহেবের বিলাসী জিন্দেগীর শোভা বর্ধন করার জন্য অবিরাম ব্যবহৃত হয়েছে। নাসেরের আত্ময়ীস্বজন পরিবার পরিজন ও সাথী সংগীদের সকলেই তার সাথে এই জাহাজে আরোহণ করেই মিসর থেকে ইউরোপে যাতায়াত করতো।
নাসেরের শাসনামলের আরো একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, জ্ঞানী গুণী এবং বিদগ্ধ পন্ডিতগণ ও বিভিন্ন বিষয় ব্যুৎপত্তি সম্পন্ন ব্যক্তিদের পরিবর্তে তার অনুগত নির্বোধ অশিক্ষিত লোকদেরকে সকল ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার গ্রদান করা হতো।
মুহাম্মদ আলী পাশার বংশধরগণ এবং তাদের অঢেল বিত্ত-বৈভবের বিরুদ্ধে নাসেরের তীব্র সমালোচনা সম্পর্কে কে না জানে? তিনি তাদের অলংকার ও মণি মুক্তার ব্যাপারে কতকি অশালীন কটূক্তি করেছিলেন এবং মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করেছিলেন তার কোন ইয়াত্তা নেই। ভাগ্যের পরিহাস! দেখুন এই বিপ্লবী ক্ষমতার দন্ড নিজ হাতে তুলে নিয়েই এসব সম্পদ ও অলংকারাদি সরকারের অনুকূলে নয় বরং নাসেরের পরিবারের অনুকূলে জব্দ করে নেয়া হয়। অনন্তর এগুলোর যে মারাত্মক অপব্যবহার হয় সে সম্পর্কে মিসরের ইতিহাসের প্রতিটা ছাত্রই সম্যকরূপে পরিজ্ঞাত আছে।
শাহ তো রাজতন্ত্রের প্রতীক ছিলেন। কিন্তু নাসের বিপ্লব ও স্যোসালিজমের নামে শাহ অপেক্ষাও অনেক বেশী লুটপাট করেন। আবার সমালোচকদের মুখও তিনি নির্মমভাবে বন্ধ করে দেন।