চতুর্দশ অধ্যায়
উস্তাদ আল হুদাইবির ব্যক্তিত্বকে সরকার কিংবা তার দোশরগণ কোনভাবেই ক্ষুন্ন কিংবা ব্যাহত করতে পারেনি। তার সম্মান ও সম্ভ্রমের প্রভাব প্রথম থেকেই ইখওয়ানের ওপর পড়ে অত্যন্ত প্রগাঢ়ভাবে। জামাল আবদুন নাসের সিন্ধী ও তার সাথীদের সাহায্যে অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে গিয়ে দারুণভাবে ব্যর্থ হয়। আল্লাহর নিরপত্তা ও তত্বাবধানের মোকাবিলায় কি কারো কোন জোর-জবরদস্তি চলতে পারে। বাইয়াত গ্রহণকারীগণ জেনে বুঝে আল্লাহকে সাক্ষী রেখেই মুর্শিদে আ’মের হাতে হাত রেখেছেন। কপটতার কূটকৌশল ও দুরভিসন্ধীর দ্বারা কি এ বাইয়াতের গ্রন্থি ছিন্ন হতে পারে। এ বিদ্রোহাত্মক আচরণ ইখওয়ানের শক্তি হ্রাসের পরিবর্তে তা আরো বৃদ্ধি করে। আমাদের এবং বিদ্রোহীদের মাঝে একটা মস্তবড় ফারাক রয়েছে আমরা সর্বোতভাবে তাদের হিতাকাংখী ও কল্যাণকামী। অথচ তারা আমাদের সর্বনাশ সাধনে তৎপর। কল্যাণের পতাকাবাহী এবং শিরকের প্রচারক কখনো সমান হতে পারে না। আমরা তাদের স্থায়িত্ব কামনা করতাম আর তারা ছিল আমাদের ধ্বংসের প্রত্যাশী। লতাপাতা ও খড়কুটো তো পানির স্রোতের সাথে ভেসে যায় বটে। কিন্তু পানি সরে যাওয়ার পর সেখানে আবার দেখা দেয় সবুজের সমারোহ। আর পারিপার্শ্বিকতায় বসন্তের ভরা যৌবনের আমেজ এনে দেয়। নিসন্দেহে এতে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে এমনসব লোকদের জন্য যাদের অন্তর (দৃষ্টিশক্তি) রয়েছে।
ঐতিহাসিক ঘটনা
মানবেতিহাসে এমন কিছু ঘটনা সংঘটিত হয়েছে যা দেখে দর্শক তাকে সুবিন্যস্ত পরিকল্পনার ফল বলে মনে করে অথচ তা কিন্তু আকস্মিকভাবেই সংঘটিত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ ফরাসী বিপ্লবের ঘটনাবলী নিয়ে চিন্তা করুন। বাস্তীল জেলখানা ভেংগে ফেলার ঘটনা কোন পূর্ব পরিকল্পনার পলে বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করেনি। ঐ সময় শহী জুলুম চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছিলো। এবং জনসাধারণের মন-মানসে এরূপ একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, বাস্তীলের কারাগার আযাদীর বধ্যভূমি। মানুষের মনে এর বিরুদ্ধে প্রচন্ড ক্ষোভ ও উত্তেজনা ধূমায়িত হয়েছিল। রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে জনসাধারণের ঘৃণা ও ক্রোধ চরমে পৌছলে জনগণ সর্বপ্রথম ঐ জেলখানা ধ্বংস করে। এই ঘটনা মূলত ফরাসী বিপ্লবের পথ সুগম করে। কিন্তু এটা ছিল একটা আকস্মিক ঘটনা।
অনুরূপভাবে মিসরে সামরিক অভ্যুত্থানের পর ১৯৫৪ সালে আবেদীন প্রাসাদের মধ্যে ছাত্রদের যে মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাও কোন পরিকল্পনার ফল ছিল না। প্রকৃত ব্যাপার ছিল এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অনুভব করলো যে, সামরিক সরকার দেশ ও জাতির স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে উদ্যত হয়েছে। ছাত্ররা স্বভাবগতভাবেই স্বাধীনতা প্রিয় হয়ে থাকে এবং সকল প্রকার অন্যায় নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন তাদের অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অতএব ছাত্ররা তাদের মনোভাব প্রকাশের জন্য বিক্ষোভ মিছিল করে। ইতিপূর্বেও মিসরের ইতিহাসে বহুবার এরূপ বিক্ষোভ হয়েছিল। জামাল আবদুন নাসের মনে করে যে, তার ক্ষমতার মসনদ উল্টে দেয়ার জন্যই এই বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। তাই তিনি দেশ মাতৃকার ভবিষ্যত প্রজন্মের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। এরূপ পাশবিক ও বর্বরভাবে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হয় যে, তার তুলনা মেলা ভার। বিশ জন ঘটনাস্থলেই নিহত হয় এবং শত শত আহত হয়। এভাবে শাসকগোষ্ঠী জাতির বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করে।
জেনারেল নাজীবের সাথে নাসের
পন্থীদের দুর্ব্যবহার
জনসাধারণ মনে করে যে, এসব ঘটনা সম্পূর্ণ ঠান্ডা মাথার পূর্ব পরিকল্পনার ফল। নাসের মনে করে যে, এসব বিক্ষোভের পশ্চাতে নাজীবের হাত সক্রিয় রয়েছে। দুই সামরিক নেতার মধ্যে তখন দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে উঠে। এ সম্পর্কে সর্বস্তরের জনগণ সম্পূর্ণভাবে ওয়াকেফহাল ছিল। সাইয়েদ নাজীবের স্মৃতিকথাও ইতিমধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে পরিস্ফূট হয়ে উঠেছে। সেখান থেকেও বিস্তারিত ঘটনা জেনে নেয়া যেতে পারে। এটা বাস্তব যে, মুহাম্মদ নাজীব ছিলেন বহু মৌলিক মানবিক গুণাবলীর অধিকারী। তার মধ্যে ছিল বুঝাপড়া করার গুণ। তিনি ছিলেন একনায়কত্ব, কঠোরতাও জুলুম-নির্যাতনের প্রতি অত্যন্ত পরাঙ্মুখ। এ কারণেই তার প্রতি ইখওয়ানের আগ্রহ ছিল। আর সে কারণেই তারা ছিল তার সফলতার প্রত্যাশী। তার কৃতকার্যতা দেশ ও জাতির জন্যও হতো অধিকতর কল্যাণকর।
জামাল আবদুন নাসের এসব বিক্ষোভ সমাবেশকে ষড়যন্ত্রমূলক বলে অভিহীত করেন।
নাসেরের সমর্থক সৈন্যরা জেনারেল নাজীবকে অপহরণ করে কায়রোর বাইরে নিয়ে গালি ও নির্দয় মার পিঠ দ্বারা তাকে সমাদর কারে। জালিমরা তার সাথে কি জুলুম ও অপমানজনক আচরণ করেন তার বিস্তারিত বিবরণ কোন কোন অফিসার নিজেই তার আত্মকথায় বর্ণনা করেছেন।
নাজীবের অন্তরে ইখওয়ানের প্রতি সম্মান ও মমত্ববোধ ছিল। কেননা তিনি স্বচক্ষে ইখওয়ানের ইসলাম প্রীতি ও সংগঠনের নীতি পদ্ধতির প্রতি চরম আনুগত্যের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ইতিপূর্বে বর্ণিত মিছিলের বর্ণনা হয়তো পড়ে থাকবেন। উক্ত মিছিলে লক্ষ লক্ষ লোক অংশগ্রহণ করেছিল। যারা সরকারের কোন পদক্ষেপেই পশ্চাৎপদও ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু আবদুল কাদের আওদা শহীদের একটি ইংগীতেই ছত্রভঙ্গ করে দেয়। মুহাম্মদ নাজীব এ ঘটনার নাসেরের মত হতভম্ব হয়ে হিংসাতুর ও বিদ্বেষপরায়ণ হওয়ার পরিবর্তে আবদুল কাদের আওদা ও ইখওয়ানের প্রশংসা গুণগ্রাহীতে পরিণত হন। তিনি চাচ্ছিলেন, জাতির মধ্যে এমনসব ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হওয়া উচিত যারা মানুষের আবেগ অনুভূতির নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। যাতে এই আবেগ ও স্পৃহাকে দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজে লাগানো যায়। আমি একজন সচেতন মিসরীয় নাগরিক হিসেবে এ ঘটনার বাস্তবতা কোন রকম কম বেশী না করে অকপটে তুলে ধরলাম। আমি আমার মতামত কারো ওপর চাপিয়ে দিতে চাই না। যার ইচ্ছা সে এ কথাকে মেনে নিক আবার যে না চায় মেনে না চলুক।
ইখওয়ান ও আযাদ অফিসার-এর প্রথম পরিচয়
আযাদ অফিসার-এর সাথে ইখওয়ানের প্রথম পরিচয় হয় ইংরেজদের বিরুদ্ধে সুয়েজ খাল নিয়ে বিরোধের সময়। মিসরীয় সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইখওয়ানী মুজাহিদগণও সম্মুখ সমরে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। উস্তাদ হাসান আল আসমাভী মরহুম ইখওয়ানী সেনাদলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। প্রথম পারস্পরিক পরিচয় হয়েছিল তাঁর ও জামাল আবদুল আবদুন নাসেরের। গোড়ার দিকে এই সম্পর্ক ছিল গোপনীয়। ক্রমশ ইখওয়ান ও আযাদ অফিসার-এর মাঝে অধিকতর নৈকট্য এং প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়ে যায়। উস্তাদ আসমাভী ছিলেন এ সম্পর্কের ক্ষেত্রে মূল যোগসূত্র ও সেতুবন্ধন।
উস্তাদ হাসান আল আসমাভী মরহুমের বর্ণনা-যা আমি নিজেও স্বীকার করি তা হচ্ছে, নাসেরের সাথে তার সম্পর্ক ছিল খুবই গভীর। আর তিনি তার সাথে অধিকাংশ সময়ই সাক্ষাত করতে যেতেন। আযাদ অফিসার-এর ব্যাপারে তার অনুযোগ ছিল যে, একদিকে তাদের সাধারণ জ্ঞান ছিল অত্যন্ত কম অন্যদিকে কোন উপযুক্ত ও কাজের লোকের সাথে ছিল না কোন পরিচয়। আর না জানতো কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি তাদের সম্বন্ধে তেমন কিছু। নাসের নিজে এদেরকে “উপস্থিত আত্মাসমূহের জলসা” এবং “ভূত প্রেতের কাহিনী বর্ণনাকারী আসর” থেকে রিক্রুট করেছিলেন। কখনো কখনো তিনি তাদের অবস্থা দেখে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েতেন। কিন্তু তারপর সে মনে করে যে, এরূপ নির্বোধ এবং পূর্ণ অনুগত লোকজনই তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সর্বোত্তম প্রমাণীত হতে পারে।
একটা মজার অভিজ্ঞতা
উস্তাদ আসমাভীর বর্ণনার সাথে আমি আরও কিছু সংযোজন করতে চাই। ব্যক্তিগতভাবে আমার একবার একটা চিত্তাকর্ষক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। মুহতারাম ভাই আলহাজ্জ মুহাম্মাদ জাওদ (আল্লাহ তাকে সুস্থতা দান করুন) একদা আমাকে তার বাড়ীতে দাওয়াত করেন। আমি উস্তদ আল বাহী আল খাওলীর সাথে তার বাড়ীতে উপস্থিত হই। সেখানে আমরা আযাদ অফিসার-এর সাতজন সদস্যকে উপস্থিত পেলাম। আমি তাদের মধ্য থেকে ইবরাহীম তাহাবী ও আহমাদ তোয়াইমা ব্যতীত অন্য কাউকেই চিনতাম না। সেখানে আমাদের পৌঁছার পর আত্মাসমূহকে হাজির করার কাজ শুরু হয়। আমি তো এ দৃশ্য দেখে অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। একজন মোরাকাবায় (আধ্যাত্মিক ধ্যান) মগ্ন হয়েছিল। সে আত্মাসমূহকে হাজির করেছিল। এভাবে একটা শোরগোল ও হৈ চৈ সৃষ্টি হয়েছিল। এই কর্কশ ও বিরক্তিকর শব্দে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর মুরাকিব (ধ্যানমগ্ন ব্যক্তি) একটি অন্ধকার কামরার মধ্যে প্রবেশ করে। আমার মনে হচ্ছিলো, সম্পূর্ণ বুঝে শুনে ঠান্ডা মস্তিষ্কে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক এ অভিনয় করা হচ্ছিলো, সম্পূর্ণ বুঝে শুনে ঠান্ডা মস্তিষ্কে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক এ অভিনয় করা হচ্ছিল। মুরাকিব এমন বিড় বিড় করতে শুরু করলো যেন উপস্থিত আত্মাসমূহের মধ্য থেকে কোন একটি আত্মা তার প্রতি কথা ইলহাম করছে। এটা কি কাজ ছিল? এটা মুলত ছিল জেনারেল মুহাম্মদ নাজীব এবং উস্তাদ হাসান আল হুদাইবি এই দুইজনের ওপর ব্যক্তিগত আক্রমণ।
এ সময় ইখওয়ান ও আযাদ অফিসার-এর মধ্যে পারস্পরিক অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এমনকি কখনো কখনো একে অন্যের প্রোগ্রামেও সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করতো। কিন্তু ১৯৪৮ সালে আযাদ অফিসার ইখওয়ান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। এজন্য তারা কোন প্রকার বিরোধিতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়নি। বরং তাদের যুক্তি ছিল এই যে, ইখওয়ানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য এতই কড়া মানদন্ড রয়েছে যে, পুরোপুরিভাবে উতরে যাওয়া সকলের সাধ্য-সামর্থের কথা নয়।
নাসের কাপুরুষ না বীর পুরুষ
সুয়েজখাল যুদ্ধের সময়ে ময়দান থেকে পালিয়ে নাসের প্রায়ই ইখওয়ানের নিকট গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করতো। (এটা ১৯৪৮ সালে সংঘটিত লড়াইয়ের কথা ইস্রাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়)। তথাপি সে নির্দোষ লোকদের ওপর সকল প্রকার ঘৃণ্য অভিযোগ আরোপ করার ব্যাপারে ছিল অত্যন্ত কঠোর। পরে সে যখন ইখওয়ানকে ধ্বংস করার কর্মসূচী প্রণয়ন করে এবং নির্যাতনের একশেষ করে ছাড়ে তখন দেশী ও বিদেশী প্রচার যন্ত্রসমূহ তার বীরত্বের এমন গীত গাইতে থাকে যে, তার নিকট প্রকৃতপক্ষে ইখওয়ানকে নিস্পিষ্ট করার কাজকে অত্যন্ত গৌরবজনক এবং কৃতিত্বপূর্ণ বলে বোধ হতে থাকে। এ মহতী কাজের জন্য তার অহংবোধ উপচে পড়ছিল। অবশ্য এটা “বীরত্ব” ই ছিল। কারণ ইখওয়ানের নওজোয়ানদেগরকে জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দী করে তাদের ওপর শক্তি পরীক্ষা করা হয়।
জীবনপাত করার পুরষ্কার
কায়রোতে যে অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটে তার ফলে শহরে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই অগ্নি সংযোগের পর আযাদ অফিসার হাত বোমা, অস্ত্রশস্ত্র এবং যাবতীয় আগ্নেয়াস্ত্রের ভান্ডার যা বিভিন্ন বাড়ীতে তাদের তত্বাবধানে সংরক্ষিত ছিল। সমস্তই কায়রোর বাইরে স্থানান্তর করে ফেলা হলো। একাজও আবার করা হয় অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে। আল আসমাভী এ দায়িত্ব সম্পন্ন করেন। এ কাজ ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তথাপি ইখওয়ানের এই সাথী সকল প্রকার বিপদাশঙ্কা উপেক্ষা করে অত্যন্ত বিপজ্জনক মুহূর্তে এই অফিসারদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। হাসান আল আসমাভী মরহুমের পিতার কায়রোর বাইরে ছিল একটি মস্তবড় প্রাসাদ ও কৃষি খামার। এই ফার্মেই মুনীরুদ্দৌলা মরহুম এবং সালেহ আবু রাকীক (আল্লাহ তায়ালা তাদের দীর্ঘজীবি করুন)-এর ট্রাকযোগে এসব অস্ত্রশস্ত্র স্থানান্তর করা হয়।
১৯৫২ সালের মার্চ মাসের গোড়ার দিকে আবদুন নাসের এবং অন্যান্য কতিপয় আযাদ অফিসার বিপ্লব সাধনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। তখন তারা বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের অব্যবহিত পূর্বে মরহুমের সাথে দীর্ঘ সময় মতামত বিনিময় করেন। পরিশেষে তাদের পরামর্শের আলোকে নীল নকশা প্রণীত হয়— বিপ্লবের পর।
বিপ্লবী সরকার আসমাভী সাহেবের খেদমতের প্রতিদান এভাবে প্রদান করে যে, জানুয়ারী মাসে যখন কোন ইখওয়ান নেতাকে গ্রেফতার করা হয় তখন তার সাথে এই চার্জশিটও দেয়া হয় যে, আসমাভী ফার্মে এত বিপুল পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ আটক করা হয়েছে যা দিয়ে কায়রো শহরকে দশবার ধ্বংস করা যায়। এই চার্জশীট তৈরী করেছিলেন নাসের সাহেব। এসব অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে তাঁর চেয়ে বেশী জানতো না। আসমাভী এসব লোকের জীবন রক্ষার জন্য এতবড় বিপদের ঝুঁকি নিয়ে ছিলেন। কিন্তু এই নির্লজ্জ লোকগুলোর মন-মানসিকতার প্রতি লক্ষ্য করুন! যে এই সম্মানিত ব্যক্তিটিকে কি পুরুষ্কার দেয়া হলো।
আপনারা বিস্মিত হবেন। কিন্তু এতে বিস্ময়ের কিছুই ছিল না। যে-ই নাসেরের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে অবহিত তার জন্য েএতে বিস্ময়ের কোন কারণ নেই। নাসের ছিল বিচ্ছু আর বিচ্ছুর কাজই হচ্ছে দংশন করা। নাসের বিপ্লবী কাউন্সিলেও তার সংগী সাথীদেরকে এভাবে এক এক করে খতম করেছে। বিশ্বাস ভঙ্গ ও নির্লজ্জতা ছিল তার কাছে উন্নত চরিত্র ও মহৎগুণের পরিচায়ক। আসমাভী মরহুমের বিরুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলার অভিযোগ আরোপ করে নাসের ইখওয়ানের ওপর হস্তক্ষেপ করার পথ সুগম করে।
ক্ষমতার লোভ ও সেনাবাহিনী
উস্তাদ হাসান আল আসমাভী বর্ণনা করেছেন যে, আযাদ অফিসার-এর সাথে তার এই মর্মে মতৈক্য কয়েছিল যে, বিপ্লব সফলতা লাভ করলে আলী মাহেরের নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠিত হবে। তারা দেশে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার বহাল করবে এবং সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাবে।
সামরিক বিপ্লব সম্পর্কে ইখওয়ানের মধ্যে দুই প্রকার দৃষ্টিভংগি ছিল। কেউ কেউ ছিলেন বিপ্লবের বিরোধী, কিন্তু অন্য’মত পোষণকারীদের সংখ্যা ছিল অধিক।
অতএব ফায়সালা হয় যে, বিপ্লব সেনাবাহিনীর সাহায্যেই সাধিত হবে। কিন্তু পরক্ষণেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। আসলে আল্লাহরই কার্যকর হয়। সেনাবাহিনী একবার জাতির ঘাড়ে চেপে বসলে আর তাদেরকে হটানো সহজসাধ্য থাকে না। এ সত্যই বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছিল মিসরে।
নাসের সম্পর্কে প্রথমেই কতিপয় ব্যক্তি মন্তব্য করেছিলেন যে, সে একনায়কসূলভ মেজাজের অধিকারী। সফলতার সুযোগে সে নিজের শাহেন শাহী কায়েম করে বসবে। এ অনুমান সম্পূর্ণ সত্য হয়ে দেখা দিয়েছিল কিন্তু কোন কোন বন্ধুর সুধারণা শুধুমাত্র খোশ খেয়াল বলে প্রমাণিত হলো। নাসের কোন ব্যাপারেই তার মতের বিরুদ্ধে কারো কোন কথা শুনতে আদৌ প্রস্তুত ছিল না। বিপ্লব সফল হওয়ার প্রথম দিনই তিনি ফায়সালা করেন যে, সংগীদের সবাইকে এক এক করে রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এই কাজ তিনি তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত রাখেন।
রক্তই আর্তনাদ করে বলে দেবে খুনীর বাহুর পরিচয়
প্রথম দিকে আযাদ অফিসার সরকারের পরিবর্তনকে বিপ্লব না বলে আন্দোলন বলে অভিহীত করতো। কিন্তু ১৯৫২ সালের আগস্ট মাসে নাসের আলী মাহেরকে তার প্রতিরোধের শিকার বানায় এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আন্দোলনের পরিবর্তে “বিপ্লব” বলা হতে থাকে। আলী মাহেরকে পদচ্যূত করা হয় এবং তার স্থানে জেনারেল নাজীবকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পদে অভিষিক্ত করা হয়। নাসের প্রথম থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল যে, নাজীবকে সরানোর জন্য অনুকুল পরিবেশ তৈরী করতে হবে। যা কার্যত করাও হয়েছিল এবং তার প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছিল। বৃটিশ দূতাবাসে মিষ্টার ইভান্সের সাথে আমাদের সাক্ষাতের সূচনা হয়েছিল এভাবে যে, দূতাবাসের ইচ্ছা ও বিপ্লবের সরকারী ঐকমত্যে আমাদের বন্ধু মুনীরুদ্দৌলা এবং সালেহ আবু রাকীক মিস্টার ইভান্সের সাথে মিলিত হন। মুর্শিদে আ’মের নির্দেশক্রমে উস্তাদ হাসান আল আসমাভী নাসেরকে আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে সবিস্তারে অবহিত করেন। নারেস ও আবদুল হাকীম আ’মের উভয়েই এই সংলাপকে সাদর আভ্যর্থনা জানান। পরবর্তী সময়ে মিষ্টার ইভান্স আবার মুর্শিদে আ’মের সংগে দেখা করার জন্য আবেদন জানায়। এমনকি তার সাথে মিলিত হওয়ার জন্য তার খেদমতে উপস্থিত হন। হাসান আল আসমাভী নাসেরকে এই সাক্ষাতের খবরও দিয়েছিলেন।
আমাদের এসব সাক্ষাতকে যে বিদ্রোহ ও জাতীয় বৈঈমানী নামে অভিহীত করা হয় তা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। কিন্তু নাসেরের েএসব অভিযোগ ফলাও করে যতই রটানো হতে থাকে জনগণ ততই তার অসত্যতা সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত হতে থাকে, সে তলোয়ার পরীক্ষা করতে থাকে আর আমরা আত্মার পরীক্ষা দিতে থাকি। তার অসির ভাষা নিশ্চুপ হয়ে পড়লেও তার রক্তরঞ্চিত হাত চিৎকার করে বলছে ওগো প্রাচৗ ও প্রতীচ্রের অধিবাসীগণ! তোমাদের মধ্যে কে এখনো এমন আছ যে প্রকৃত সত্যের সন্ধান পাওনি। শোন! মিথ্যার মিথ্যা হওয়াটা প্রমানিত হয়ে গেছে।
বিপ্লবের পর আযাদ অফিসার-এর কারো কারো সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। খান আল খলিলে আমাদের সাথী আলহাজ্জ মুহাম্মাদ জাওদার চাউলের দোকান ছিল। এখানে প্রায় প্রতিদিনই আমাদের পারস্পরিক দেখা সাক্ষাত হতো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিঃল যে, নাসের ইখওয়ানের ওপর যে কোন সময় হস্তক্ষেপ করে বসবে। তথাপি আমার সযত্ন প্রয়াস ছিল যে কোন উপায়ে এই সংঘাত প্রশমিত হয়ে যাক। নাসেরের ব্যাপারে ইখওয়ানের কোন কোন সাথীর দৃষ্টিভংগী ছিল অত্যন্ত কঠোর। তারা ধারণা করছিলো যে, আমিও নাসেরের প্রতি আকৃষ্ট। েএজন্য আমার ওপর তাদের কিচুটা সন্দেহ ছিল। কিন্তু সত্য কথা বলতে কি তার সম্পর্কে আমার ধারণা কখনো ভালো ছিল না। আন্দোলনের স্বার্থের কথা চিন্তা করেই আমি চাচ্ছিলাম যে অপেক্ষাকৃত কোন উত্তম ও সমঝোতামূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক। আমার একান্ত আকাংখা ছিল যে, নাসের একান্তই যদি ইখওয়ানের বিরুদ্ধে কোন দমননীতি গ্রহণ করতে চায় তাহলে অন্যান্য দলসমূহকে সে যেভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে তেমনি আমাদের ওপরও নিষেধাক্ষা যেন আরোপ করে। কারণ আমাদের দাওয়াতী কাজতো বন্ধ হয়ে যাওয়ার নয়।
সেই সময়ে নাসের আরো একটি চক্রান্ত করে। আবদুর রহমান সিন্ধীর কথা আপনারা পড়ে এসেছেন। নাসের তার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করার পূর্বে এক চাল চালতে চায়। আযাদ অফিসার-এর সাহায্যে একটা প্রস্তাব প্রণয়ন করেন এবং তার ওপর ইখওয়ানের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কয়েকজনের স্বাক্ষরও যুক্ত করা হয়। চুক্তিনামার বিষয়বস্তু ছিল, মুর্শিদে আ’মকে নেতৃত্বের পদ থেকে অপসারিত করতে হবে। যদিও তা হোক একান্ত সাময়িকভাবে ও অল্প সময়ের জন্য। এই সন্ধিচুক্তির ব্যাপারে নাসেরের প্রত্যাশা ছিল যে, এতে সকল সদস্যই বরখাস্ত করবেন। কিন্তু তার এই অনুমান ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। আমার নিকটও বার বার এই দস্তাবেজ নিয়ে আসা হয় এবং নানাভাবে অনুরোধ করা হয় যে, এতে সই কর দাও। কিন্তু আমি সর্বদাই কঠোরভাবে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করি। আমি আল্লাহর নামে যে বাইয়াত করেছিলাম তা কিভাবে ভংগ করতে পারি। আর এটা কি করে হতে পারে?
আমি একজন ইখওয়ান হিসেবেই বেঁচে থাকতে চাই এবং এই পরিচয় নিয়েই মৃত্যুর পথে পাড়ি জমাতে চাই। কিয়ামতের দিন যেন দাওয়াতে ইসলামীর নগণ্য একজন কর্মীরূপে উপস্থিত হতে পারি। তাই আমার প্রত্যাশা। এটাই আমার আকাংখা্
যে সময় এ প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা চলছিলো তখন আমাদের নওজোয়অন সাথী ভাই আকেফ জেলখানায় ছিলেন। আমি জানতে পারলাম যে আকেফ ভাইক সামরিক কারাগারে অত্যন্ত পাশবিকভাবে নির্যাতনের শিকার বানানো হয়েছে। ফলে তিনি গুরুতর আহত হয়ে পড়েছেন। একদিকে সালাতুল আসরের পর আলহাজ্জ মুহাম্মাদ জাওদার দোকানে আযাদ অফিসার-এর অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য মুহাম্মাদ আবদুর রহমান নাসিরের সাথে সাক্ষাত হয়ে যায়। নামায শেষে তিনি যখন মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসেন তখন আমি তার কাছে এ ব্যাপারে নালিশ করলাম। আল্লাহ ও নামাযের কসম করে তিনি আমাকে সান্ত্বনা দিলেন যে, আকেফের ওপর কোন প্রকার জুলুম ও নির্যাতন করা হয়নি। তার গলে কুরআন মজীদ ঝুলছিল। তিনি কুরআন মাথার ওপর রেখে শপথ করে বলেন যে, আকেফের জুলুমের খবর একেবারেই মিথ্যা, তার এরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার পর আমি মনে করলাম যে, খবরটি সম্ভবত ভুল। ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে আমাকেও গ্রেফতার করে সামরিক কয়েদখানায় আটক করা হয়। আমি বন্ধুপ্রতীম আকেফের যে অবস্থা নিজ চোখে দেখতে পেলাম তা ছিল হৃদয়বিদারক। আমার চোখ থেকে অজ্ঞাতেই নেমে আসে অশ্রুর বন্যা। তার সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। কিন্তু আমি আল্লাহর লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করি এই জন্য যে, সত্যের কাফেলায় এই তেজোদীপ্ত যুবক এতসব জুলুম নিপীড়নকে অত্যন্ত শান্ত চিত্তে অনমনীয়ভাবে ও হাসিমুখে বরণ করেছিলেন। তার কোন কথায় ও আচরণে আমি কোন প্রকার আতঙ্ক ও নিরুৎসাহের লক্ষ্যণ দেখতে পাইনি। এই মোহকে কেউ কোনক্রমেই অবদমিত করতে পারে না, পারবে না।
নাসেরের ইখওয়ানুল মুসলিমুনে যোগদানৎ
জামাল আবদুন নাসের আমার স্বাভাব প্রকৃতি ও কোমল হৃদয় হওয়া সম্পর্কে সম্যাক পরিজ্ঞাত ছিল। তথাপি সে আমাকে তার প্রতিশোধের শিকার বানায়। আমি ইতিপূর্বে একটি প্রস্তাবের উল্লেখ করেছি যাতে মুর্শিদে আ’ম-এর পদচ্যুতির ষড়যন্ত্রও ছিল্ আমি তাতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছিলাম। ১৯৫৪ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর নাসের আমাকে তার বাড়ীতে ডেকে পাঠায়। সেখানে পৌঁছার পর সেই কুখ্যাত প্রস্তাবাবলী পুনরায় আমার সম্মুখে পেশ করা হয়। আমি তাতে স্বাক্ষর করতে সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করি। এটাই ছিল মূল কারণ যার ফলে আমাকে সুদীর্ঘ পনেরো বছর বন্দী এবং পরবর্তী সময় অতিরিক্ত আরো দু’বছর নজর বন্দীর শাস্তি ভোগ করতে হয়।
জামাল আবদুন নাসের ইকওয়ানের রুকুনিয়াত তথা সদস্যপদও গ্রণ করেছিলেন। সুধী পাঠকগণকে আমি এ প্রসংগে ভাই জেনারেল সালাহ শাদী বিরচিত গ্রন্থ “ইতিহাসের পাতা” থেকে এ বিষয়ে কিচুটা আলোকপাত করতে চাই।
জেনারেল সালাহর বক্তব্য অনুসারে নারেস সম্ভাব্য সকল উপায়ে তথ্য সংগ্রহ করতে আগ্রহী ছিল। নিজের এই আকাংখার পরিতৃপ্তির জন্য সে ইখওয়ানের আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করে।
ইখওয়ানের সাথে তার সম্পর্ক তিন পর্যায়ে গড়ে ওঠেছিল-সামরিক দায়িত্ব পালনের জন্য নাসেরকে সুদান পাঠানো হয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে আসার পর সামরিক অফিসার আবদুল মুনয়েম আবদুর রউফের সাথে তার সাক্ষাত ঘটে। এই অফিসার ছিলেন ইখওয়ানের সদস্য। তিনি নাসেরকে আবদুর রহমান সিন্ধীর নিকট নিয়ে আসেন (এটা ছিল অদ্ভূত ব্যাপার যে নাসেরের প্রথম সাক্ষাত ইখওযানের এমন এক লোকের সাথে হয় যার নিষ্ঠার ভান্ড শীঘ্রই ফেটে পড়ে। পাঠকগণ সে ঘটনা ইতিপূর্বেই পড়েছেন।)
১৯৪৪ সালে মেজর মাহমুদ লাবীব মরহুমের সাথে নাসেরের সাক্ষাত হয়। তিনি তাকে ইখওয়ানের পয়গামের সাথে উত্তমরূপে পরিচিত করে দেন এবং কর্মনীতি ব্যাখ্যা করে শুনান।
তৃতীয পর্যায়ে শুরু হয় ১৯৫০ সালের শেষের দিকে। তখন উস্তাদ মেজর মাহমুদ লাবীব গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। অতএব আমি জেনারেল (জেনারেল সালাহ শাদী) নাসের ও অপর অফিসার সালাহ সালেমকে সাথে নিয়ে ইখওয়ানের ঐ ভাইয়ের নিকট গমন করি। তিনি ছিলেন সেনাবাতিনীর মধ্যে ইখওয়ানের আন্দোলনের দায়িত্বশীল। ১৯৫০ সালের শেষের দিকে মরহুম হাসান আল আসমাভীর দপ্তরে এই সাক্ষাতকার অনুষ্ঠিত হয়।
সামরিক বাহিনীর অফিসার ও জোয়ানদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক ছিলেন জনাব মেজর মাহমুদ লাবীব মরহুমের সাথে। ১৯৪৬ সাল থেকেই জামাল আবদুন নাসের তার সমর্থন সেনাদেরকে একান্ত সংগোপনে তার সাথে মিলাতে শুরু করে। বাহ্যত সে তাদের বিশ্বস্ততা ও আস্থা অর্জন করেন এবংনিজের কাজ জারী রাখেন। প্রথম দিকে নাসেরের ব্যাপারে আমার মতামত ছিল এই যে, তিনি অত্যন্ত স্বল্পভাষী এবং দায়িত্বপালনকারী জাগ্রত বিবেক সেনা অফিসার। আলসাগ্ মাহমুদ লাবীবের জীবদ্দশায় সে ইখওয়ানের নিকটে এসে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার ইনতিকালের পর এ সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়। এই সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকে। অস্ত্রশস্ত্র ও ক্রয় ও সরবরাহ এবং অন্যান্য জরুরী সাজসরঞ্জাম যা ফিরিঙ্গি সেনাদের মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন ছিল –তখনই সংগ্রহ করা হয়। খরিদকৃত অস্ত্রশস্ত্রের মজুদ জামাল আবদুন নাসের এবং মাজদী হাসানইনের বাড়ীতে রাখা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময় এ আশাঙ্কায় যে, গোপনীয়তা ফাঁশ হয়ে গেলে এই দুইজন সামরিক অফিসারের ওপরই মুসিবত এসে পড়বে তাই এসব অস্ত্রশস্ত্র আসমাভী ফার্মের সুপ্রশস্ত গ্যারেজে স্থানান্তর করা হয়।
ভাই সালাহ শাদী তার এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে খুবই বিস্ময় ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে, সমস্ত গোলাবারুদ ইখওয়ান তাদের জীবন বিপন্ন করে বিপ্লবের জন্য সংগ্রহ করেছিল এবং আযাদ অফিসারদেরকে বিপদ থেকে রক্ষার জন্য নিজেদের ফার্মে গুদামজাত করেছিল –এ বিষয়কেই ইখওয়ানের ওপর দোষারোপের কারণ এবং তাদের শায়েস্তা করার উপলক্ষ বানানো হয়েছিল। কোন কৃতজ্ঞজন উপকার কর্তাদের ধ্বংস করে তার ইহসানের পুরস্কার দিতে পারে না।
ফারুকের দেশ ত্যাগ
ইখওয়ান ও স্বাধীনতাকামী অফিসারদের মাঝে বিপ্লব সংগঠিত করার পূর্বে কয়েকদফা সাক্ষাত হয়। আলহাজ্জ সালাহ আবু রাকীকের বাড়ীতে অনুষ্ঠিত এসব আলোচনা বৈঠকে স্বাধীনতাকামী অফিসারদের প্রতিনিধিত্ব করতেন জামাল আবদুন নাসের। পক্ষান্তরে ইখওয়ানের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করতেন হাসান আসমাভী মরহুম এবং জেনারেল সালাহ শাদী। নাসেরের ঐকান্তিক অনুরোধ ছিল নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই বিপ্লব সংগঠিত করা হোক। ইত্যবসরে এক বিস্ময়কর ঘটনা সংঘঠিত হয় যার প্রতি সকলেই বিস্ময় বিষ্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে দেখে। তা হচ্ছে, আমেরিকান দূতাবাস শাহ ফারুককে অনুপ্রাণীত করে যেন তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করেন। সে জন্য তাদের পরামর্শ ছিল এই যে, শাহ ফারুক দেশ থেকে চলে যাবেন এবং সেখানেই জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো নিজের সঞ্চিত ধন-সম্পদের সাহায্যে নিশ্চিন্ত কাটিয়ে দিবেন। তথাপি শাহ বিপ্লবের পূর্বে দেশের বাইরে পাড়ি জমাতে পারেননি। বিপ্লবের ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর মহামান্য বাদশাহর কোন বিচার ছাড়াই নিরাপদে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও নাসেরের হাত ছিল সক্রিয়। ১৯৫২ সালের ২০শে জুলাই নাসেরের সাথে মুর্শিদে আ’ম আল হুদাইবি (র)-এর সাক্ষাত হয়। নাসেরের কোন কোন কার্যকলাপে মুর্শিদে আ’ম অষন্তোষ ব্যক্ত করেন। তখন সে নীরবে সবকিছু হজম করতে থাকে। কিন্তু পরে ১৯৫৪ সালের ১৩ই জানুয়ারী তারিখে বিপ্লবী কাউন্সিল ইখওয়ানের ওপর যখন নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেয় তখন তার পশ্চাতে নাসেরের তীব্র ঘৃণা ও ক্রোধ ছিলো। পরে ঘটনাপ্রবাহ যতদূর গড়িয়েছিল তা সকলেরই জানা রয়েছে।
আসল চেহারা
নাসের ছিল সেনা কর্মকর্তাগণের মধ্যে অত্যন্ত কর্মঠ ও সদা তৎপর কর্মী। তার প্রয়াস প্রচেষ্টার ফলে অধিকাংশ লোক তার প্রতি ছিল দুর্বল। কিছু সংখ্যক লোক ছিল তার অন্ধ বিশ্বাসী। দুই জন লেকের মেধা ও বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা আমি সর্বদাই করে থাকি। তারা দুইজন প্রথম দৃষ্টিতেই তাঁকে বুঝতে পেরেছিলেন। উভয়েই নাসেরের দুরভিসন্ধি ও কূটকৌশল যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই দুই ব্যক্তি হচ্ছেন যথাক্রমে ইখওয়ানের মুর্শিদে আ’ম সাইয়েদ হাসান আল হুদাইবি ও ওয়াফদ পার্টির নেতা ফুয়াদ সিরাজ উদ্দীন। আবদুন নাসের শাহেন শাহী লাভের স্বপ্ন দেখছিলো। সে শুধুমাত্র মিসরের ওপরই তার আধিপত্য বিস্তার করতে চাচ্ছিলো না। বরং এতদঞ্চলের সবগুলো দেশের ওপরই তিনি তার কর্তৃত্ব করার অভিলাষ পোষণ করছিলেন। সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ যদিও সে দেখতে পায়নি। কিন্তু তার জন্য সে মিসরের সমস্ত উপায় উপকরণ জাতির সমূদয় যোগ্যতা ও ক্ষমতা এমনকি মিসরীয় সেনাবাহিনী তথা সবকিছুকে জলাঞ্জলী দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি।
কৃতকর্মের ফলশ্রুতি ও নাসের
আমাদেরকে বিপ্লবের শত্রু মনে করা হয়। এটা ছিল একেবারেই মিথ্যা। আল্লাহ তায়ালার অপার অনুগ্রহ ইখওয়ানের সযত্ন প্রয়াস প্রচেষ্টা এবং ঐকান্তিক কুরবানীর বদৌলতেই মূলত বিপ্লবের পথ সুগম হয়। যদি আমাদের সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা সমন্বিত রূপ লাভ না করতো তাহলে নাসের ও তার সংগীদের নাম নিশানাও মিসরের ইতিহাসে পরিলক্ষিত হতো না। মিসর ও মিসরের বাইরের অন্যান্য দেশের সমস্ত প্রচার ও গণমাধ্যম নাসেরের অনুপম ব্যক্তিত্ব ও কৃতিত্বের গুণগান প্রচার করতে লাগলো। তার ভাবমূর্তি এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হলো বাস্তবতার সাথে যার দূরতম সম্পর্কও ছিল না। এই ব্যক্তির নেতৃত্ব মিসরের মর্যাদাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে এবং সকল ক্ষেত্রেই অপমান ও অনগ্রসরতাই আমাদের ললাট লিপি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত সুয়েজ খাল লড়াইয়ের উল্রেখ করা হয় অত্যন্ত গর্ব ভরে। আল্লাহর শোকর যে, তাতে মিসরই বিজয় লাভ করে। তথাপি বিশ্লেষক এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারীগণ এ সত্য সম্পর্কে অনবহিত ছিল না যে, ১৯৫৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেণ্ট আইসেন হাওয়ার বিশ্বরাজনীতিতে সর্বক্ষেত্র আমেরিকার প্রভাব বলয় সৃষ্টির জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার প্রভাব প্রতিষ্ঠার পথে বৃটেন ও ফ্রান্সের উপনিবেশবাদী শক্তি ছিল একটি অন্তরায়। আমেরিকার আকাংখা ছিল হাত ছাড়া করিয়ে দেয়া যাতে সৃষ্ট শূন্যতা আমেরিকা পূরণ করতে পারে। ফলাফলও তাই হলো। এই যুদ্ধে নাসেরের কৃতকার্যতার নিগূঢ় রহস্য উপরোক্ত কার্যকারণের মধ্যে নিহিত ছিল।
১৯৬৭ সালের অপমানজনক পরাজয় নাসেরের নেতৃত্বের উপহার স্বরূপ আমাদের ললাট লিপি হয়ে দাঁড়ায়। সেই অপমানের কথা কি আমরা কোন দিন তুলে যেতে পারি? মিসরের কৃতিসন্তান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিগণকে যে পন্থায় বেইজ্জত করা হয় এবং মিসরের গৌরবজনক ইতিহাসকে যেভাবে কলঙ্কিত করা হয় তাকি কোন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মিসরীয় ভুলে যেতে পারে? আমরা কি নাসেরের গৃহীত এ সমস্ত ন্যাক্কারজনক কৃতিকলাপ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারি- সে তার সংগীদের থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যা করেছিল?
এরূপ জঘন্য তৎপরতার পরও তার জন্য কি গৌরবজনক কোন কৃতিত্ব অবশিষ্ট থেকে যায়? আমি তো তার মধ্যে এমন কোন বিষয় দেখতে পাই না যার কারণে তাকে একজন উচ্চ পর্যায়ের নেতা মনে করা যেতে পারে। তবে হাঁ তার প্রতি যেসব বীরত্বগাথা আরোপ করা হয় তাতে কেউ প্রতারিত হতে পারে। এসব স্রষ্টা এমন সব লোক যারা কোন আন্দোলনে কোন দিন অংশগ্রহণ করেনি। এমনকি মিসরের জাতীয় বিপ্ললবেও তাদের কোন অবদান নেই।
বিক্রয়যোগ্য সম্পদ নাকি শিষ্টাচার
মিথ্যা প্রচার প্রপাগান্ডাকারীগণ পয়সার ক্রীতদাস এবং বিক্রয়যোগ্য সম্পদ। তারা সম্মান, গৌরব ও কীর্তিগাথার এমন সব স্মরণীয় কৃতিত্ব রচনা করে। বিক্রয়ের জন্য বাজারজাত করে বাস্তবে যার কোন অস্তিত্বও কোন দিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাদের এই কাল্পনিক মূর্তিখানা তাদেরকে মহার্ঘ্য বিনিময় প্রদান করে। তারা হাজার হাজার পাউন্ড পুরস্কার লাভ করে এবং যার ফলে এসব শিল্পী কোন বামনকে আসমানে পৌঁছায়। মিসরের অপমানের জন্য আবদুন নাসেরই দায়ী। সে আগে ও পরে সবসময়ই ইসলামী পুনর্জাগরণ এবং ইসলামী আন্দোলনের দুশমন ছিলো। তার কীর্তিকলাপ ইসলামী আন্দোলনের কাজকে কয়েক বছর পিছনে ঠেলে দিয়েছে।
জামাল আবদুন নাসের ইখওয়ানের ওপর এমন সব অত্যাচার চালান যার কল্পনাও কর যায় না।
ছেলেকে বাধ্য করা হতো পিতাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করতে এবং তাদের মুখে থুথু নিক্ষেপ করতে। কারাবন্দীদের সহোদর ভাইকে ডেকে এন বাধ্য করা হতো তাদের ভাইদের মুখের ওপর চপেটাঘাত করতে। অথবা কিল ঘুষি মারতে।
জেলখানার অফিসাররা এমন অনুভূতিহীন ও নির্লজ্জ যে, এটা তাদের চিত্ত বিনোদনের উপকরণ ছিল। আপনি কি কখনো কল্পনা করেছেন যে, মানুষ কখনো এতটা বিবেকহীন হতে পারে?
এই জালিমরা ইখওয়ানের পর্দাশীলা ও পুন্যাত্মা মহিলাদের ছবি অঙ্কন করেছে। অংকন শিল্পীরা তাদের নগ্ন বক্ষ প্রদর্শন করেছে। এমনকি তাদের সম্মুখে মদের বেতাল রেখে এসব চিত্র অংকন করে। তাদের এক হাতে শরাবের পেয়ালা আর অন্য হাতে সিগারেট দেখানো হয়েছে।
আপনি একটু ভেবে দেখুন। যদি কোন মানুষ এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় (আমি আল্লাহ তায়ালার সমীপে দোয়া করছি কোন মানুষকে যেন এমন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে না হয়) তাহলে তার অবস্থা কি দাঁড়াবে? কোন আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন লোকের কন্যা, ভগ্নি অথবা স্ত্রীকে তারই চোখের সামনে বিবস্ত্র করে ফেলা হবে তার সরকারী কুকুররা নির্লজ্জভাবে তাদের উজ্জত আবরু লুণ্ঠন করবে তাহলে কি সেই ব্যক্তি এমন জীবনের তুলনায় মৃত্যুকে অগ্রাধিকার দেবে না? এরূপ অসহ্য অপমানের মোকাবেলায় একজন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ অবশ্যই চাইবে তার দেহ ছিন্নভিন্ন করা হোক তার দেহের মাংস থেঁতলে দেয়া হোক কিন্তু তার স্ত্রী ও মা বোনের সাথে এ আচরণ করা হোক। এত কিছু সত্ত্বেও মিসরে এমন লোক আছে যারা নাসেরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
আমি কখনো কারো কোন অনিষ্ট কামনা করি না। কিন্তু নাসেরের প্রশংসাকারীদের একটু চিন্তা করে দেখা উচিত যে, তাদের ওপর যদি এরূপ বিপর্যয় এসে পড়ে তাহলে তাদের সিদ্ধান্ত কেমন হবে? এটা সত্য যে, সামরিক বন্দীশালায় ইখওয়ানের সাথীদের মধ্যে আমার ওপর সর্বাপেক্ষা কম নির্যাতন চালানো হয়েছে। তারপরও লক্ষ্য কুন আমার সাথে তারা কিরুপ আচরণ করেছে। তাহলে সহজে অনুমান করা যাবে যে, অন্যান্য ভাইদের সাথে আরো কতবেশী অত্যাচার করা হয়েছে।
আমাকে জেলখানার ২৪নং সেলে বন্দী করা হয়। কিছুক্ষণ পর কারাগারের নাপিত আমার চুল কাটতে আসে। আমি আমার মস্তক তার সামনে অবনত করে দিলাম যেন সে সহজে তার কার্য সমাধা করতে পারে। কিন্তু আল্লাহর সেই বান্দা আমার গালে সজোরে চপেটাঘাত করে বলে “কুত্তার বাচ্চা! নীচে মাটির ওপর নেমে বস্!” সে আমার মাথা মুন্ডন করলে আমি দেখতে পাই যে কারা অফিসারগণ লম্বা চওড়া এবং উৎকট দুর্গন্ধযুক্ত রশি নিয়ে আমার কুঠরীতে এসে হাজির হয় এবং আমাকে উঠে দাঁড়াবার নির্দেশ দেয়। আমার উরুদেশ থেকে বক্ষ পর্যন্ত সেই দড়ি আমার শরীরের চারদিকে পেঁচিয়ে শক্তভাবে বাঁধা হয়। অনন্তর আমাকে একটি চেয়ারের ওপর দাঁড় করানো হয় এবং রশির এক মাথা ছাদের খুঁটির সাথে বেঁধে আমার পায়ের নীচে থেকে চেয়ারে সরিয়ে ফেলা হয়। ফলে আমি ছাদ ও মাটির মাঝে রশিতে বাঁধা অবস্থায় ঝুলতে থাকি। আমার ওপর অত্যন্ত অশ্রাব্য গালি ও কোঁড়ার বৃষ্টি বর্ষিত হতে থাকে। দুঃখে ও ব্যথায় আমার অবস্থা কাহিল করা হয়ে পড়ে। তবুও আমি উহ্ পর্যন্ত করি না। কারণ এই হিংস্র নরপশুরা আমার আত্মচীৎকারে মজা পেতো। আর আমিও চাচ্ছিলাম না যে, তারা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করুক। আমার শরীর যখন পুরোপুরি অবশ হয়ে গেল তখন তারা আমার শরীরের এক জায়গায় কোঁড়ার আঘাতে জর্জরিত করতে আরম্ভ করলো। এক স্থানের পরিবর্তে শরীরের বিভিন্ন অংশে কোঁড়ার আঘা করার জন্য আমি তাদের অনুরোধ করি। কিন্তু তা করতে তারা অস্বীকার করলো।
এই মুহূর্তে আমার নিজের জীবনে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো। এটা ছিল ১৯৩৩ সালের কথা, আমি আমার পুত্র আবেদকে কোন কোন বিষয় পড়াতাম। আমার হাতে থাকতো একটা রোলার সে কোন ভুল করলে আমি উক্ত রোলার দ্বারা তার উপর প্রহার করতাম। একধারে ভুল ভ্রান্তি করতে থাকলে একই জায়গায় মারতে থাকতাম। সে কাঁদতো এবং একই স্থানে বার বার মারার পরিবর্তে শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রহার করার আবেদন জানাতো। কিন্তু আমি বলতাম না তা হবে না। পাঠকদের জন্য এই ঘটনা হয়তো তেমন কোন গুরুত্বের দাবী রাখে না। কিন্তু আমার নিজের জন্য এত বড় শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত রয়েছে। অবশ্য এটা সত্য যে, আমি আমার সন্তানের কল্যাণ ও মঙ্গল চিন্তায়ই শিক্ষামূলকভাবে তাকে শাস্তি দিতাম। কিন্তু তথাপি আল্লাহ তায়ালা আমার জন্য অনুরূপ শাস্তি নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, আমার ওপর জুলুমকারীরাও শাস্তি থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারবে না। দুনিয়াতেও নিশ্চিতই তাদের শাস্তি পেতে হবে আবার আখেরাতের শান্তিও তাদের জন্য স্থির নিশ্চিত।
নিসন্দেহে দুঃখের পর রয়েছে সুখ
আল ওযাহতি জেলখানায় আমাদের বিশেষ স্বাধীনতা ছিল। সেখানে আমরা জেলখানার ভিতর একটা ছোট কৃষি ক্ষেত্র তৈরী করে নিয়েছিলাম। সেখানে আমরা শালগম, বীট, গাজর, মূলা, খরবুজা, তরমুজ এবং অন্যান্য ফল ও সবজির চাষ করতাম। সেখানে আমরা ছোট আকারের একটি মুরগীর খামারও তৈরী করে ফেলেছিলাম। যেখানে আমি মুরগী ও খরগোশ পালতাম। কুরবানীর ঈদদোপলক্ষে জনাব মুহাম্মাদ হামেদ আবুন নাসের আমাদের জন্য বকরী নিয়ে আসেন। অনন্তর আমরা জেলখানাতেই কুরবানী করি। এই কয়েদখানায় আমরা জুমা ও দুই ঈদের নামায ছাড়াও দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাযই জামায়াতের সাথে আদায় করতাম। মংগলবারের দারসে কুরআন যা ইমাম শহীদ হাসানুল বান্নার সময় থেকেই ইখওয়ানের কর্মসূচীর বাধ্যতামূলক অংশে পরিণত হয়েছিল –জেলখানাতেও যথা নিয়মে সে ধারা অব্যাহত থাকে। কয়েকটি বিষয়ে বিষয়ভিত্তিক বক্তৃতা নিয়মিত চলছিলো। এই কারণে আমাদের প্রত্যাশা ছিল যেন আমাদের পুরো বন্দী জীবন এই জেলখানাতেই অতিবাহিত করি। যদিও এখানে গ্রীষ্ম ও শীতকালে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া বিরাজ করতো। উদাহরণ স্বরূপ গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ছায়াতে বায়ান্ন ডিগ্রী পর্যন্ত পৌঁছে যেতো এবং শীতকালে হিমাঙ্কের ছয় ডিগ্রী নীচে নেমে যেতো। এতদ্ব্যাতীত এই জেলখানায় বহু বিষাক্ত সাপ বিচরণ করতো। আপনি শুনে আশ্চর্য হবেন যে, এই বিষাক্ত সাপ সময়ে সময়ে কয়েদীদেরকে দংশন পর্যন্ত করে বসতো। কিন্তু আমাদের অবস্থান কালে আল্লাহ তায়ালা সমস্ত ইখওয়ানীকে সম্পূর্ণ নিরাপদ রাখেন। আবদুন নাসের আমাদের জেলের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হয়ে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে। তারপর তাৎক্ষণিক নির্দেশে আমাদেরকে বিভিন্ন জেলখানায় পাঠিয়ে ছড়িয়ে দেয়া হয়। বছরের পর বছর অতীতের গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে লাগলো। আর আমিও আমার প্রিয় জীবনের সুদীর্ঘ সতেরটি বছর জেলখানার চার দেয়ালের মধ্যে অতিবাহিত করলাম। অত্যাচারের যে ষ্টীমরোলার আমার ওপর পরিচালিত হয় সে জন্য আফসোস নেই। বরং আমার শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরা আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাতের সম্মুখে সদা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। কারণ তিনিই তো আমাকে এসব অত্যাচার উৎপীড়ন সহ্য করার শক্তি ও সাহস যুগিয়েছেন এবং দৃঢ় পদ থাকার সৌভাগ্য দান করেছেন। আমাদের প্রতিপক্ষ চেষ্টা করেছে যেন আমাদের মথা তাদের সামনে নত হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর শুকরিয়া যে এ শির কোন তাগুতের সামনে অবনত হয়নি। যদি কোন ব্যক্তি তার দুশমনের সম্মুখে মস্তক উন্নত রেখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে তাহলে সেটা তার জন্য সেই অবস্থায় চেয়ে সহস্র গুণে শ্রেয় যে সে তার পায়ের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে মৃত্যুর হিমশীতল পেয়ালা পান করবে। কবির ভাষায়:
আমি সময়ের দাবী ও যুগের চাহিদার পাথরের ওপর
কখনো সিজদাবনত হবো না।
মৃত্যুকে সহস্যে বরণ করে নিতে পারি তথাপি কোন মূল্যে
ঈমান কখনো বিক্রি করবো না।
আসমা বিনতে আবি বকর (রা) মুসলিম সমাজে বংশ পরম্পরায় আবর্তিত হয়ে চলে আসছেন। আর এসব ঘটনা প্রবাহে বড়ই হিকমত রয়েছে। হযরত আসমা (রা) তার বৃদ্ধ বয়সে তার মহাপ্রাণ পুত্র আবদুল্লাহ বিন জুবাইর (রা)-কে হাজ্জাজের মোকাবিলায় শৌর্য বীর্য ও বীরত্বের শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেছিলেন:
“ইজ্জাতের সাথে তলোয়ারের আঘাত খেয়ে জান কুরবান করে দেয়া দুশমনের সামনে অপমানের সাথে চাবুকের আঘাতে জর্জরিত হওয়া থেকে হাজার গুণে শ্রেয়।”
ওগো মু’মিন বান্দাহ –তুমিই সৌভাগ্যবান আবার তুমিই হতভাগা
আমার স্মৃতিকথার মধ্যে কিছু মজর সরস ঘটনাবলীও সংরক্ষিত রয়েছে। একবার আমি কানার জেলখানায় বন্দী ছিলাম। এই জেলখানায় অবস্থান করেছিলো একজন অপরাধী। তার নাম ছিল হিজাযী। এই দাগী আসামী বহুবার জেলখানায় এসেছে। এবারে তাকে আশি বছরের শাস্তির কথা শুনানো হয়েছে। জেলখানার সকল ছোট বড় কয়েদী এবং কারারক্ষীগণ তার দুষ্কর্মে অতিষ্ঠ ছিল। সে কাউকে কোন প্রকার তোয়াক্কা করতো না। এমনকি সে প্রত্যেককে সবার সামনে অপমাণিত করে খুবই আনন্দ বোধ করতো। একদিন সে আমার নিকট আগমন করে এবং অত্যন্ত সম্মানের সাথে কথাবার্তা কলতে থাকে। আলোচনা প্রসংগে উম্মেকুলসুমেরসেই নাতিয়া সংগীত যা সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসায় গেয়েছিল- এর উল্লেখ করা হয়। জানি না এই ব্যক্তি আমাকে সম্মান করতো কেন? সে জানতে পেরেছে যে, উম্মে কুলসুমের গান যা রেডিওতে মাঝেমধ্যে প্রচারিত হয়ে থাকে –এর আমি খুবই গুণগ্রাহী ও ভক্ত। এ প্রসংগে কথাবার্তা হলো।
রাত্রিবেলায় আমি হাসপাতালের খাটের ওপর শয্যা করলে অচিরেই নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লাম। নিদ্রিত অবস্থায় আমার মনে হচ্ছিলো উম্মে কুলসুমের গান যেন আমার কর্ণকুহরে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। হঠাৎ আমার চোখ খুলে যায় এবং আমি প্রকৃতই উম্মে কুলসুমের আওয়াজ শুনতে পাই।
আসমা বিনতে আবি বকর (রা)-এর শ্রেষ্ঠত্বের কাহিনী মুসলিম জাতির মধ্যে পুরুষনাক্রমে চলে আসছে। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে বড় রহস্য। বৃদ্ধ বয়সে হযরত আসমা (রা) তাঁর মহান সন্তান আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরকে হাজ্জাজের বিরুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের উপদেশ দিয়েছিলেন।
আপনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন যে এসব তথাকথিত আদালতের সামনে ইখওয়ানদের পেশ করা হতে থাকলো। তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও পেশ করা হতো। ইখওয়ানের আহত স্থানসমূহ থেকে তখনও রক্ত প্রবাহিত হতে থাকতো এবং নির্যাতনের সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ তাদের শরীরে দেখা যেতো। এমতাবস্থায় মনগড়া ও বানোয়াট স্বীকারোক্তিসমূহকে ভিত্তি করে ফায়সালা প্রদান করা হতো। আফসোস! বিষয়টি যদি এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটতো! এরপরও কোন কয়েদী যদি আদালতে পেশকৃত জবানবন্দী অস্বীকার করতো তাহলে তাকে আদালত জেলখানায় ফেরত পাঠিয়ে দিতো যেন আরো নির্যাতন চালিয়ে তাকে স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি সমর্থন করতে বাধ্য করা হয়।
জামাল সালেমের পরিণতি
জামাল সালেম যিনি তথাকথিত এসব আদালতের প্রধান ছিলেন। তিনি আসামীদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে ও কথায় কথায় তাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আদালতের অপর দু’জন সদস্য এই বিচার প্রহসন চলাকালীন সময়ে সম্পূর্ণ চুপচাপ বসে থাকতেন। এই জামাল সালেমের পরিণতিও হয়েছিল অত্যন্ত বিস্ময়কর। সামরিক উর্দি খুলে এখন তিনি সাদা বেসামরিক পোশাক পরিধান করেছেন। পরেছেন গেরুয়া রংগের আবা ও আলখেল্লা। দিনের অধিকাংশ সময় মসজিদে ও সাইয়েদা যয়নাবে অতিবাহিত করেন।
সে কি সভ্যই তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত ছিল। তিনি কি তার কৃত পাপরাশী থেকে তওবা করে নিয়েছিলেন। নিসন্দেহে আল্লাহর রহমত অতিব সুবিস্তৃত। যে কেউই তার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করতে চাইবে সে কোন সংকীর্ণতার শিকার হবে না। অবশ্য তার তওবা হতে হবে খাঁটি ও অকৃত্রিম। এরূপ তাওবাতে অসংখ্য কবিরা গুনাহও মাফ হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালার ক্ষমার তুলনায় কোন গুনাহই বড় নয়। আমি এ ব্যক্তির ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণীর পুনরাবৃত্তি করছি। তিনি বলেছেন: তোমরা তোমাদের মৃতদের গুণাবলী বর্ণনা করে তাদেরকে স্মরণ করো। আমাদের উচিত তাদেরকে আল্লাহর ইনসাফের ওপর ছেড়ে দেয়। কারণ তিনি সর্বাপেক্ষা অধিক ন্যায় ও সুবিচারের নিশ্চয়তা বিধানকারী।