তৃতীয় অধ্যায়
নির্বাপিত প্রেমাগ্নি আলোহীন
কেউ কেউ প্রথম থেকেই ইখওয়ানের ওপর এই অপবাদ আরোপ করতে থাকে যে, তারা নতুন দ্বীনের ভিত্তি স্থাপন করেছে। কিছুদিন পর ইখওয়ানের শত্রুরা তাদের ওপর ক্ষমতার লোভ এবং রাজনীতি করার অভিযোগও উত্থাপন করে। তারা ইখওয়ানের ঘোষণাপত্র ও কর্মপদ্ধতি না দেখেই এই ফতোয়া জারী করে বসে যে, এরা সন্ত্রাস ও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বিপ্লব করতে চায়। অথচ প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে এই যে, ইখওয়ান অনৈসলামিক আইন-কানুন মেনে নেয় না। বরং তার পরিবর্তে শরীয়াতের আইন-কানুন বাস্তবায়িত করতে চায়। কিন্তু এই উদ্দেশ্যে তাদের কর্মনীতি হচ্ছে প্রচলিত আইনের গন্ডির মধ্যে থেকেই জনসাধারণকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব সাধন করা।
ইখওয়ান একটা ব্যাপক আন্দোলনের নাম। আমাদের এই সংগঠনে যুবকদেরকে শারিরীক ব্যায়াম, অনুশীলন ও সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়ারও ব্যবস্থা ছিল। কথায় অতিরঞ্জন সৃষ্টিকারী ব্যক্তিগণ এই প্রোগ্রামকে “গোপন প্রক্রিয়া” নামে অভিহিত করে এবং প্রচার করতে থাকে যে, এটা সরকারকে গদিচ্যুত করার পূর্বপ্রস্তুতি মাত্র। অথচ আমাদের উদ্দেশ্য গতি পরিবর্তনের এবং মন্ত্রীদের হত্যা করা কখনো ছিল না। আর এখনো নেই। ইমাম হাসানুল বান্নার বিচক্ষণ ও সুতীক্ষ্ম দৃষ্টি দেখতে পেয়েছিল যে, ইসরামী ভূখণ্ড ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাঈল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সমগ্র মিল্লাতের জন্য বড় লজ্জাকর ও দুঃখজনক। যা থেকে রক্ষা পাওয়ার শুধু একটা মাত্র উপায়ই রয়েছে। তাহলো আমাদেরকে বাহুবল সঞ্চয় করতে হবে। মিসরের ওপর ছিল ইংরেজ আধিপত্যবাদীদের দখল। সমগ্র ইসরামী জাহানের নেতৃত্ব প্রদান ও পথপ্রদর্শনের জন্য যে দেশ আলোর দিশারীর মর্যাদা রাখে তাকে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের ছোবল মুক্ত করাই ছিল সময়ের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দাবী। এসব কারণ সম্মুখে রেখে তিনি যুব সমাজকে তৈরী করার ফয়সালা করেন। কিন্তু আফসোস শত আফসোস! এই উত্তম কাজটিকেই ষড়যন্ত্র এবং বিদ্রোহের বিশেষণে বিশেষিত করা হয়। এই দুঃসাহসিক পদক্ষেপ একাধারে ক্রুশেড, ইহুদী ও কম্যুনিষ্ট শক্তিত্রয় ঠান্ডা মাথায় কি করে বরদাশত করতে পারে। তারা মুসলিম শাসকদের মস্তিষ্কে এই বিষ ভরে দেয় যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন তাদের নেতৃত্বের জন্য বিপজ্জনক। এই সরলমমনা শাসকরা তাদের ফাঁদে পা দেয় এবং তাদের প্রণীত বিভ্রান্তিকর রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে ইখওয়ানদের নির্মূল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
কালের দুর্যোগ ও সময়ের দুর্বিপাক
অনিষ্টকামীদের প্রজ্জলিত অনল তার লেলিহান শিখা নিয়ে দাউ দাউ করে জ্বলছিলো। আমাদের কোন কোন নিবেদিত প্রাণ নওজোয়ানও সেই দাবানলের অসহায় শিকার হয়ে পড়ে। এবং এই শিখা তার বিভৎস রূপ নিয়ে আরো বিস্তার লাভ করে। সরকারের সীমালংঘন তো দিন দিন বেড়েই চলছিলো। তথাপি ইখওয়ান কখনো তাদের সবরের লাগাম হাত থেকে ছেড়ে দেয়নি। কতিপয় সরল প্রাণ যুবক সরকারের উপদেষ্টা খাযেনদারকে হত্রা করে। এই দুর্ঘটনা সংগঠিত হওয়ার পর ইখওয়ান নেতৃবৃন্দ এ খবর জানতে পারে। ঘটনার বিবরণ ছিল এরূপ যে, কিছু কিছু যুবক ইংরেজ সেনাদের বিরুদ্ধে সদা কর্মচঞ্চল থাকতো। যাতে এভাবে তাদের মনে দেশবাসীর অশ্বস্তি ও অশান্তির অনুভূীত সৃষ্টি করে। মিসর থেকে চলে যেতে বাধ্য করা সম্ভব হয়। ইতিমধ্যে কতিপয় যুবক বন্দী হয়। মিষ্টার খাযেনদার মরহুম (বিচার বিভাগীয় উপদেষ্টা) তাদেরকে দশ বছরের কারাদন্ড প্রদান করেন। এই অন্যায় ও অবিচারমূলক রায়েল প্রেক্ষিতে গ্রেফতার কৃত নওজোয়অনদের উত্তেজিত সংগীগণ খাযেনদারকে হত্যা করে।
এই সময়েই আরো একটি ঘটনা সংগঠিত হয় যা এই যুবকদের আবেগকে উত্তেজিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আলেকজান্দ্রিয়ার আনতুনিয়াদিস বাগানে দু’জন যুবকের লাশ পাওয়া যায়। এ দুই লাশের একটু তূরে আহত এবং মৃতপ্রায় অপর এক ব্যক্তিকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। প্রথম দিকে পুলিশ ঘোষণা করে যে, হত্যাকারীর কোন পাত্তা পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই আহত যুবক হাসপাতালে নীত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে ওঠে এবং পরে সে প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করে। তার বর্ণনা মোতাবেক কানাদী নামক এক বিত্তশালী ঠিকাদার অর্ধ রাতের পর তাকে সাথে নিয়ে ঐ বাগানে যায়। কিছুক্ষণ সে তার সাথ কাটায়। তারপরই সে তাকে মারতে আমর্ভ করে। তাকে মৃত মনে করে ঠিকাদার অত্যন্ত সংগোপনে সেখান থেকে কেটে পড়ে। পূর্বোক্ত দু’জন হত্যাকান্ডের কোন তথ্য পাওয়া গেল না। কিন্তু তৃতীয় যুবকের মোকদ্দমায় ঠিকাদার কানাদীকে আট বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়।
ইখওয়ানের তারুণ্যদ্দীপ্ত যুবকগণ উভয় ঘটনার তুলনা করে। এক দিকে ছিল দু’টি হত্যার মোকদ্দমা এবং একটা হত্যার মোটিভ সংক্রান্ত কেস। এতে অপরাধীর আট বছরের সাজা হয় অথচ অপর দিকে কেউ আহত বা নিহত না হলেও খাযেনদার সাহেব যুবকদের প্রত্যেককে দশ বছরের সাজা ফরমান শুনিয়ে দেয়। এতে যুবকদের তাজা রক্তে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং তারা খাজেনদার মরহুমকে হত্যা করে বসে। একদিকে যেমন জনগণ পত্র-পত্রিকায় এই হত্যাকাণ্ডের খবর পড়ে বিস্ময় বোধ করে অন্যদিকে ইখওয়ান নেতৃবৃন্দও এই দুঃখজনক ঘটনার খবর সংবাদ পত্রের মাধ্যমেই জানতে পারেন।
তুমিই বলো এ কেমন কথা
আন্দোলনের দুশমনরা সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিল। এই ঘটনাকে অজুহাত বানিয়ে তারা ইখওয়ানের বিরুদ্ধে জঘন্য প্রকৃতির যুদ্ধ শুরু করে। হাসানুল বান্না শহীদ তো লোকদের সাথে প্রথম সাক্ষাতেই দাওয়াতের মৌলিক উদ্দেশ্য সমূহ বর্ণনা করতেন। মুসলিমদের ওপর যেখানেই অত্যাচার-অবিচার চালানো হতো তিনি তাতেই কঁকিয়ে উঠতেন। মুসলিম মিল্লাত খেলাফতের নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হয়ে গেছে এ ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত আফসোস করতেন। তার দৃষ্টিভংগী ছিল এই যে, যদিও কোন কোন ওসমানীয় খলিফা বিচ্যুতির পথ অবলম্বন করেছিলো তবুও তার অর্থ এই ছিল না যে, খেলাফত ব্যবস্থাকেই সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। তিনি ছিলেন ইসরামী খেলাফত ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনের পতাকাবাহী। এমন ব্যক্তি তার অনুসারীদেরকে হত্যার ও লুন্ঠনের অনুমতি কিভাবে দিতে পারেন?
প্রবৃত্তির অনুসারীগণ যেসব যুক্তি-তর্ক পেশ করে থাকেন তা যদি মেনে নেয়া যায় তাহলে সে ক্ষেত্রে ইসলাম নিকৃষ্টতম ধর্মের রূপ পরিগ্রহ করে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ওসমানীয় খলিফাগণ ভ্রান্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। এ জন্য খিলাফত ব্যবস্থাই সমস্ত অকল্যাণের উৎস। ইসলামের দুশমনরা মুসলিমদের অবস্থা দেখে আমাদের অন্যায় অপকর্মগুলোকে ইসরামের খাতায় জমা করেন। কিন্তু মুসলমানরা যা করে তা ইসলাম নয় বরং মুসলমানদের যা করা উচিত সেটাই প্রকৃত ইসলাম। এক ব্যক্তি নিরপেক্ষভাবে ইসরাম সম্পর্কে অধ্যয়ন করেন। তিনি মুসলিমদের দেখেননি। তিনি ইসলামের যথার্থতার স্বীকৃতি দিয়ে মুসলিম হয়ে যান। তিনি যখন মুসলিমদের সাথে এসে মিলিত হন তখন দুঃখ করে বলতে থাকেন: আমি যে ইসলামের কথা বইয়ের পাতায় পড়েছিলাম তাতো ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু। আমি যদি এই মুসলিমদের প্রথমেই দেখতাম তা হলে হয়তো ইসলাম কবুল করতাম না।
ইখওয়ানে যোগদানের পর
আমার মনে পড়ে ইখওয়ানের কাফেলায় শামিল হওয়ার কয়েক বছর পর শহীদ ইমাম আমাকে দলের ওয়াকীল (সহকজারী মুর্শিদে আ’ম)-এর দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান। আমি আল্লাহর নাম করে তাকে বললাম যে, আমি এই গুরুদায়িত্ব পালনের যোগ্য নই। তাই তা গ্রহণ করা অবিশ্বস্ততার পরিচায়ক হবে। সেই সময় মুর্শিদে আ’ম আমাকে এ পরামর্শও প্রদান করেন য, আমি যেন আমার দপ্তর স্থানান্তর করে কায়রোতে নিয়ে আসি। কিন্তু আমি আরজ করলাম যে, আমার প্রাকটিশ আমার ছোট মফস্বল শহরেই ভালভাবেই চলছে এবং তা দ্বারা আমি হালাল রিজিক উপার্জন করে আসছি। কোন কোন লোককে একথাও বলতে শুনা গেছে যে, ইখওয়ানের বদৌলতেই আমি আমার পেশায় সফলকাম হয়েছি। আমি এতটুকু বলতে চাই যে, আমার অমনোযোগী স্বভাব প্রকৃতি ও শিক্ষা দীক্ষার কারণে আমি কখনো দুনিয়ার জীবন এবং বস্তুগত সুযোগ সুবিধা লাভের জন্র কোন সৃষ্টির সাহায্য গ্রহণ করিনি। আল্লাহর অনুগ্রহ সর্বদা আমাকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছে। মুর্শিদে আ’ম-এর দৃষ্টিভংগীও সান্নিধ্য এবং ইখওয়ানের একান্ত মহব্বত ও সহচার্য্যের জন্যও আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। আল্লাহ তায়ালা তাঁদের সকলকে আমার সাথে উত্তম ব্যবহারের জন্য সর্বোত্তম বিনিময় দান করুন।
ঘৃণা ও ভালবাসা সবই একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে
ইখওয়ানের সাথে সম্পর্ক ও বিশ্বস্ততার কারণ হাসানুল বান্না কিংবা হাসান আল হুদাইবির সাথে সম্পর্কিত নয়। আমরা আল্লাহর নাম নিয়েই তাঁরই সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে একে অপরের সাথে একই সূত্রে গ্রথিত হয়ে আন্দোলনের ময়দানে এসে সমবেত হয়েছি। হাসানুল বান্না এবং হাসান আল হুদাইবি এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ দ্বারা তাঁদের ব্যক্তিসত্তা কিংবা ব্যক্তিত্বের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া বুঝায় না। বরং তা আল্লাহর হাতে বাইয়াতেরই নামান্তর। নবী আকরাম মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে যেসব লোক বাইয়াত গ্রহণ করেছিলেন তাও ছিল আল্লাহ তায়ালার হাতে বাইয়াত গ্রহণ। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
(আরবী***************)
“নিশ্চয়ই যেসব লোক (হে নবী) আপনার হাতে বাইয়াত নিয়ে থাকে তারা মূলত আল্লাহ তায়ালার সাথেই বাইয়াতে আবদ্ধ হয়ে থাকে; তা৭দের হাতের ওপর রয়েছে আল্লাহর হাত।” –আল ফাতহ” ১০
যেসব লোক ইখওয়ানের ওপর দোষারোপ করে থাকে যে, আমরা হাসানুল বান্নার পুতঃপবিত্রতার প্রবক্তা তাদেরকে আল্লাহ তায়ালার কাছে তারা কি জবাব দিবেন তা ঠিক করে নেয়া উচিত। আমরা আল্লাহ আল মালেকুল কুদ্দুস ব্যতীত অন্য কারো পবিত্রতা বর্ণনার পক্ষপাতি নই। হাসানুল বান্না এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত হাসান আল হুদাইবি-এর সাথে আমরা গভীর মহ্বত রাখি ও আন্তরিক ভালবাসা পোষণ করি। কেননা তারা দু’জনই আমাদরে চক্ষু খুলে দিয়েছেন এবং ইসরামের আলোর সাথে আমাদেরকে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন। যেসব মহত ব্যক্তিত্ব এই আকিদা-বিশ্বাসের মর্মকথা আমাদের সম্মুখে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন তাঁদের সাথে আমরা ঐকান্তিক সম্পর্ক রাখব না? তাঁদের সাথে আমাদের মহব্বত তো আল্লাহরই নির্দেশ মোতাবেক এবং তারই সন্তুষ্টিলাভের জন্য। কিন্তু আমরা তাঁদেরকে আমাদেরই মত সাধারণ মানুষ মনে করে থাকি এবং তাঁদের পবিত্রতা বর্ণনার পক্ষপাতি নই কখনো।
প্রথম মুর্শিদে আ’ম-এর সাথে একজন মুরীদ ও শাগরেদ হিসেবে আমি সময় কাটিয়েছি এবং তাঁর নিকট থেকে অনেক কিছু শিখেছি। ইমাম আমাদেরকে আমাদের হাত ধরে মানবতার উন্নত স্তরে উন্নীত করেছেন এবং ইসলামের দস্তরখানের ওপর এনে বসিয়েছেন। এটা ছিল সেই সময়ের কথা যখন মুসলিমগণ ইসলাম ছেড়ে ভিখারীদের মত প্রত্যেক দস্তরখান থেকে উচ্চিষ্ট আহরণ করে ফিরছিলো। আল্লাহ তায়ালা তার দ্বীনের খেদমতের জন্য এমন লোকদের মনোনীত করে থাকেন যারা এ কাজের যোগ্যতা সম্পন্ন।
(আরবী************)
“এটাতো আল্লাহর অনুগ্রহ ও মেহেরবানী তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করে থাকেন।” –আল হাদীদ” ২১
আমার কর্মপন্থা আমীরি নয় ফকীরি
ইমাম শহীদ এমন বুদ্ধিমত্তার সাথে ও সুকৌশলে আমাদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন যে, দুনিয়া, এবং এর চাকচিক্য আমাদেরকে আকর্ষণ করতে পারে না। এই পৃথিবী নশ্বর ও ক্ষণস্থায়ী এবং এই জীবন টলটলায়মান- যে কোন মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। এমন দুনিয়ার সাথে কি আর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। আর এই জীবনের আশঙ্কায় ও দুশ্চিন্তায় অযথা হাহুতাশ করে কি লাভ। আল্লাহ তায়ালার নিকট যা কিছু রয়েছে তাই উত্তম ও চিরস্থায়ী। ইখওয়ান সাধারণত নিম্ন আয়ের লোকদের সমষ্টি ছিল। তথাপি তারা তাদের সংগঠনকে নিয়মিত আর্থিক সহায়তা প্রদান করতো। পাঁচ কুরুশ থেকে আরম্ভ করে পাঁচ পাউন্ড পর্যন্ত প্রতি মাসে বিভিন্ন ইখওয়ান সংগঠনকে নিয়মিত এয়ানত দিতো। অবশ্য কিছু সংখ্যক ভাই এমনও ছিলেন যাদেরকে আল্লাহ পর্যাপ্ত রিযিক দিয়েছিলেন। তাঁরা এর চেয়েও অধিক পরিমাণ এয়ানত পেশ করতো।
এক পর্যায়ে ইখওয়ানের বায়তুলমাল সম্পাদকের সম্মানও আমি লাভ করেছি। যদি কখনো বায়তুলমালে একশত পঞ্চাশ কুরুশ পরিমাণ অর্থ সঞ্চিত হতো তখন আমি মনে করতাম যে, আমাদের সংগঠন খুব সম্পদশালী হয়ে গেছে। আপনারা শুনে আশ্চর্য হবেন য, এই অর্থ দ্বারাই সংগঠনে সমস্ত কাজ চলতো। দ্বীনের সম্পদ যার হাতে এসে যায় সে কি দারিদ্র্যের কোন পরোয়া করে। অফিসে সংগঠনের যে টেলিফোন ছিল কোন ব্যক্তিগত কাজের জন্য তা ব্যবহার করার কোন অনুমতি ছিল না। যতক্ষণ না তিন তারিফঅ প্রদান করতো।
কোন সদস্য যখন কোন দাওয়াতী কাজে কোথাও যেতো তখন তার সফর খরচের জন্য তাঁকে তিন তারিফা দিতাম। ….. তা থেকে ছয় মিলিমা যাওয়ার জন্য এবং ছয় মিলিমা আসার জন্য কিংবা মিনি বাসের ভাড়া ও তিন মিলিমা ডাল রুটির জন্য। কি স্মরণীয় সময় ছিল সেটা!!
গ্রন্থকীট নয় গ্রন্থকার
ইখওয়ানুল মুসলিমুন আমাদেরকে একটা প্রাণবন্দ জীবন দান করেছিল। এই আন্দোলনের সাথে একাত্ম হওয়ার পর আমরা যেন জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যেল সাথে পরিচিত হয়ে উঠি। পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যে আমরা আমাদেরকে সর্বাধিক সৌভাগ্যবান মনে করতে থাকি। পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ এবং একজনের অন্যজনের হৃদয় জয় করার প্রেরণা সবসময় তুঙ্গে থাকতো। আন্দোলনের কাজ আরো ব্যাপক করা ছাড়া আর কোন চিন্তা আমাদের মনে স্থান পেতো না। আমি ওকালতীর কাজকর্ম শেষ করে সালাতুল আসরের পর ইখওয়ানের অফিসে চলে আসতাম এবং এশার পর পর্যন্ত আন্দোলনের কাজে ব্যস্ত থাকতাম। এটা তো বর্ণনা করার কোন অপেক্ষাই রাখে না যে, এই খেদমত হতো নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং এর বিনিময় কোন বস্তুগত সুবিধা লাভ করা কখনো উদ্দেশ্য হতো না।
কোন কোন লোক ধন-সম্পদকেই সবকিছু মনে করে। আমি ধন-সম্পদের গুরুত্ব অস্বীকার করি না। বিশেষত সেই সময় থেকে যখন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম-এর এই হাদীস পড়ার সুযোগ পাই-
(আরবী**************)
“হালাল উপায়ে উপার্জিত সম্পদই সর্বোত্তম সম্পদ। যা একজন সৎমানুষের হাতে এসে পৌঁছে।”
এবং তার এই কথা যে- (আরবী*************)
“মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পাতবে নিজের পোষ্যদর এমন অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে সচ্ছল রেখে যাওয়া উত্তম।”
এ হাদীসগুলো থেকে হালাল মালের গুরুত্ব অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তারপরও আমাদের এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, কাজের লোক পাওয়া গেলে ধন-সম্পদও পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে ধন-সম্পদের প্রাচুর্য দিয়ে কর্মঠ লোক খরিদ করা যায় না। মাল নষ্ট হয় গেলে তা পুনরায় উপার্জন করা যায়। কিন্তু কর্মী বাহিনী ধ্বংস হয়ে গেলে সে ক্ষতি পূরণ করা যায় না। আত্মমর্যাদা বিক্রি হয়ে গেলে সবকিছুই হারিয়ে যায়। আমাদের অবস্থা হচ্ছে আমরা আত্মমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে ধন-সম্পদ চাই। আবার অনেকের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তারা অর্থবিত্তের পূজারী। অর্থ-সম্পদ হালাল উপায়ে অর্জিত হচ্ছে না হারাম উপায়ে তাদের কাছে এর কোন গুরুত্ব নেই। তাদের উদ্দেশ্য শুধু সিন্ধুক ভর্তি করা। যেসব লোকের এরূপ মনমানসিকতা থাকে তারা সব মানুষকে একই পাল্লায় ওজন করে। তারা কল্পনাও করতে পারে না যে, কোন মানুষ কোন বিনিময় ছাড়াও কোন কাজ করতে পারে।
ইখওয়ানের ওপর আল্লাহ তায়ালার বড়ই ইহসান রয়েছে যে, তারা মনের সম্পদকে কখনো শরীরের সম্পদের বিনিময়ে কুরবানী করে না। তাদের উদ্দেশ্য তাদের আন্দোলনের সফলতা ও আত্মমর্যাদার সংরক্ষণ। যদিও আমি আমার নিজরে সম্পর্কই কথাবার্তা বলে আসছি তথাপি আমার দৃঢ় বিশ্বাস ইখওয়ানের প্রত্যেক সদস্যই এই মানদন্ডে পুরোপুরি উদরে যাকে। আমাদের দাওয়াত বৈষয়িক উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। আমাদের দাওয়াত আল্লাহর পথের দিকে মানুষকে আহ্বান করা।
আমীর–উমরাহ ও মন্ত্রীর দরবারেও বে–নিয়াজী
কারাবার থেকে মুক্তিলাভ করার পর সাদাতের শাসনামলে আমি কোন কাজে প্রধান মন্ত্রীর সাথে দেখা করতে যাই। তিনি মা’শাআল্লাহ এখনো বেঁচে আছেন। আলোচনা চলাকালে মন্ত্রীর প্রবর আর্থিক বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেন। তিনি বলতে লাগলেন, সরকার মিসরের সমস্ত পত্রিকা ও সাময়িকীকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে আসছে এবং মুজাল্লাহতুদ দা’ওয়াহ একটা ইসলামী পত্রিকা হিসেবে এই সহযোগিতা পাওয়ার সর্বাধিক হকদার। এতেই আমার বুঝতে বাঁকী থাকলো না যে, জনাব কি উদ্দেশ্য হাসিলের মতলব এঁটেছেন। তবুও আমি আমার ধৈর্য শক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখলাম এবং সাদামাটা ভাষায় আরজ করলাম “জনাব এসব আলোচনা থাক। এটা আমাদের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়।” অবশেষে সাক্ষাতের পালা সমাপ্ত হয় এবং আমি তার দপ্তর থেকে নিরাপদে ফিরে আসি।
সত্য পথের আহবায়ক আল্লাহর দ্বারের ভিক্ষুক
একবার মিসরের একটা দ্বীনি পত্রিকা একটা জলসার ব্যবস্থা করে। এই পত্রিকা এখনো চালু আছে। পত্রিকার অফিসে অনুষ্ঠিতব্য এই অধিবেশনে আমাকে বক্তব্য রাখার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিলো। নির্দিষ্ট দিনে যথা সময়ে আমি সমাবেশে গিয়ে উপস্থিত হই। বিরতির সময় প্রাতৃদিত প্রয়োহনে ও অযু করার জন্য টয়লেটে যাই। অযু শেষে আমি গোসলখানা থেকে বের হচ্ছিলাম। সেই সময় পত্রিকার একজন কর্মচারীকে বাইরে অপেক্ষামান দেখতে পাই। তিনি আমার দিকে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “জনাব স্বাক্ষর করে দিন।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কিসের কাগজ আর দস্তখতই বা কি জন্য।” তিনি বললেন, “এটা আপনার জলসায় তাশরীফ নিয়ে আসার বিনিময়।” আমি বলে উঠলাম, “আমি যদি জানতাম দাওয়াত ইলাল্লাহ-এর কাজের জন্য তোমরা পারিশ্রমিক দিয়ে থাক তা হলে আমি কখনো এখানে আস্তাম না।” তিনি বলনে, “এটা তো শুধু সফর খরচ।” আমি বললাম “আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি। ইখওয়ান এই কাজের জন্যই এ গাড়ি দিয়ে রেখেছে।” তিনি আবারো বললেন, “কিন্তু এই পারিশ্রমিক তো সব লোকই নিয়ে থাকে।” আমি তাকে বিনীতভাবে বললাম, “আমি কিন্তু ঐসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত নই। বরং আমি তো আল্লাহর দরবারের একজন ভিক্ষুক।” আমি সেই বন্ধুর কাছে আমার অপারগতা ব্যক্ত করলে তিনি বিস্মিত ও হতবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। অতপর আমি ফিরে আসি এবং তিনি বিফলমনোরথ হয়ে কাগজ হাতে তার দপ্তরের দিকে চলে যান।
আমার লিখা হয়ে থাকে খুবই সাদামাঠা ভাষায়। কারণ, আমি কোন সাহিত্যিক বা কলমজীবী নই। তাতরপরও কেন জানিনা অনেক লোক আমার নিকট কিছুনা কিছু লেখার অনুরোধ জানান। কোন কোন পত্রিকাও উপযুক্ত সম্মানির বিনিময়ে আমাকে তাদের পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে বলে। আমি তা অস্বীকার করেছি। কেননা প্রথমত, আমি কোন সাংবাদিক নই। দ্বিতীযত, আমি একজন দায়ী। একজন দায়ী-ইলাল্লাহর কথা সঠিক বা বে-ঠিক যাই হোক না কেন পারিশ্রমিক গ্রহণ তার পক্ষে মোটেই সমীচীন নয়। যে সমস্ত দায়ী কোন প্রকার আর্থিক বিনিময় ছাড়া খালেছ আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দাওয়াতী কাজে নিয়োজিত থাকে তারা সম্মান লাভ করে এবং তাদের কথাও আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের জন নিবদ্ধ থাকে। বিনিময় গ্রহণের পর তো আপনাকে লক্ষ্য করতে হবে পত্রিকার মালিক এবং পাঠকগণ কি প্রত্যাশা করেন? অথচ একজন সত্য পথের আহবায়ক শুধু তার দাওয়াতের দাবী ও চাহিদা কি তাই দেখে থাকেন।
মংগলবারের দারস ও উহার প্রেক্ষিত
মংগলবারের দারসের পোগ্রাম ছিল নওজোয়ানদের ট্রেনিং ও প্রশিক্ষণ প্রদানের একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ইমাম শহীদ যখন মংগলবারের এই দারস শুরু করেন তখন অল্প সংখ্যক লোক তাতে হাজির হতো। কিন্তু এখন এই দারস ইখওয়ানের কর্মসূচীর অত্যাবশ্যকীয় অংশে পরিণত হয়েছে। ইলমিয়াতুল জাদিদার মারকাজে আ’মে অনুষ্ঠিত এই মজলিশে মুর্শিদে আ’ম প্রতি মংগলবার মাগরিব থেকে এশা পর্যন্ত দারস পেশ করতেন। মাগরিবের পূর্বেই বিপুল সংখ্যক যুবক ও গণ্যমান্য ব্যক্তি মারকাজে এসে সমবেত হতো। শ্রোতাগণ শুধুমাত্র কায়রো থেকেই নয় বরং দূরের ও কাছের অন্যান্য জিলা থেকেও এসে জড়ো হতো। সকলের চেহারাই হাঁসি খুশী এবংদিল ও দিমাগ শান্ত ও পরিতৃপ্ত। ইমাম মাগরিবের জামায়অতে ইমামতির দায়িত্ব পালন করার পর মারকাজের উন্মুক্ত আঙ্গিনায় বসে দারস শুরু করতেন। এ দারসে শত শত নয় বরং হাজার হাজার লোক অত্যন্ত উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে এসে অংশ গ্রহণ করতো। মরকাজের বারান্দা, ব্যালকনি এবং আশেপাশের বিলিংয়ের ছাগদ উপস্থিত শ্রোতা দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে যেতো। মনে হতো যেন এই পবিত্র মাহফিলকে ফেরেশতাগণ পরিবেষ্টিত করে রেখেছেন, রহমতের ছায়া পড়ছে বেং শাস্তির বারিপাত হচ্ছে। কোন প্রকার শোরগোল, হৈ হুল্লোড় ও বিশৃংখলা দেখা যেতো না। প্রতিটি মানুষ মন-মস্তিস্ক এবং চোখ-কাণ দিয়ে নসীহতের প্রতি মনোযোগী হতো। ইমামের মুখ থেকে হীরা ও মোতি ঝরে পড়তো যা কুড়িয়ে মানুষ তাদের মনের মনিকোঠায় সঞ্চিত করতো। দেখে মনে হতো যেন প্রত্যেক শ্রোতা হাসানুল বান্নাকে ছোট বেলা থেকেই জানে কিংবা কমপক্ষে বছরের পর বছর তার সাথে থাকার সুযোগ লাভ করেছে।
মাহফিলে অংশগ্রহণকারী শ্রোতা নতুন পুরাতন যাই হোক না কেন সবাই যেন আত্মমগ্ন হয়ে যেতো। মনে হতো যেন তারা তাদের হারানো সম্পদ পেয়ে গেছে যার অন্বেষণে তারা সমগ্র পৃথিবীময় তন্ন তনত্ন করে খুঁজেছে কিন্তু পায়নি অথচ এানে এসে তা পেয়ে গেছে। হাসানুল বান্নার আকৃতিতে আল্লাহ তায়াল তার মনের চাহিদা পূরণের যথাযথ ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মুখ থেকে নিঃসৃত কথাবার্তা মানুষের অন্তরে গিয়ে প্রভাব সৃষ্টি করতো। এমতাবস্থায় এশার আযান শুরু হয়ে যেতো। আযান চলাকালে ইমাম শহীদ চুপ করে থাকতেন। তারপর পুনরায় তার ভাষণ চলতে থাকতো যা অল্প সময়ের মধ্যেই সমাপ্ত হয়ে যেতো। শ্রোতাদের মধ্যে আকাংকা তাকতো যেন বক্তৃতা সকাল পর্যন্ত চলতে থাকে।
ইসলামের শত্রুগণ মিসরে ভেতরে বিলম্বে সতর্ক হয় কিন্তু মিসরের বাহিরে তাৎক্ষণিক বিপদের ঘন্টাধ্বনি বেজে ওঠে। বাতিল এই আন্দোলনের মধ্যে তাদের জন্য নিশ্চিত মৃত্যু দেখতে পাচ্ছিলো। তাই তারা ইখওয়ানুল মুসলিমুনের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করতে শুরু করে। দুশমনরা এই আন্দোলনকে নির্মূল করতে পারেনি।
সত্য তথাপি তাদের শয়তানী ফন্দি ও কৌশল এবং তাগুতি অত্যাচার-উৎপীড়ন দ্বারা তার গতি ব্যহত করার ক্ষেত্রে কামিয়াব হয়েছে। ইখওয়ান জেলখানার মধ্যেও মঙ্গলবারের দারস ব্যহত হতে দেয়নি। এই দারস বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। তথাপি এই দারস জারী আছে এবং থাকবে। এটা ইখয়ানর উত্তরাধিকার যা এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষে হস্তান্তরিত হয়ে আসছে। এটা সত্যের এমনএক পতাকা যা একজন মুজাহিদের হাত থেকে অন্য মুজাহিদের হাতে সোপর্দ করা হচ্ছে। (আরবী****) “সকল কাজের পরিণতি তো আল্লাহ তায়ালার দিকেই প্রত্যাবর্তিত হয়ে থাকে।”
মঙ্গলবারের দারসে কুরআনের ধারা খুবই নমনীয়ভাবে শুরু করা হয়েছিল। ইমাম শহীদের সাগরেদ ও ভক্তগণ সাবাতিয়ায় তার গৃহে হাজির হতো এবং একটা প্রশস্ত হল রুমে চাটাইয়ের ওপর আসন গ্রহণ করতো। রেল স্টেশনের অনতিদূরেই ছিল তাঁর বাসগৃহ। উপস্থিত লোকদের সংখ্যা শুধু কয়েক ডজনেই সীমাবদ্ধ থাকতো। সমাগত মেহমানদের সামনে ছোট ছোট কাপ রেখে দেয়া হতো এবং সকলকে চা দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। ইমাম ছিলেন খুবই উদার ও দানশীল অন্তরের অধিকারী। কিন্তু তার আর্থিক উপায় উপকরণ ছিল সীমাবদ্ধ। এটা ছিল মঙ্গলবারের দারসের প্রাথমিক যুগ।
সেই যুগে কতিপয় ব্যক্তি চাটাইয়ের ওপর বসতো এবং ইমাম তাদের সামনে ঈমান সঞ্জীবনী দারস পেশ করতেন। এই দৃশ্যের তুলনা যদি হিলমিয়াস্থ মারকাজে আ’ম-এর সাথে করা হয় তাহলে বিবেক-বুদ্ধি স্তম্ভিত হয়ে যায়। এই শতাব্দিরই চল্লিশের দশকে হাসানুল বান্না শহীদকে যারা জানতো তাদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত নগণ্য কিন্তু পঞ্চাশের দশকের সেই হাসানুল বান্নাই সারা দেশে ছোট বড় সকলের নিকট আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ান। এই সময়েও তিনি সুনাম ও সুখ্যাতি থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করেন। তিনি নম্রতা ও শিষ্টাচারের চাদর তার শরীরে জড়িয়ে রেখেছিলেন। এতে তার সৌন্দর্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। যতই তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে ততই তার বিনয় ও নম্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
দরবেশের দরবার
ইমাম কয়েকবারই আমাকে তার সফরসঙ্গী হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। রেল ভ্রমণের সুযোগ আসলে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, সফর আমার পয়সায় করতে হবে নাকি তোমার খরচে? যদি আমার পকেট অনুমতি দিতো তাহলে আমি সবিনয়ে নিবেদন করতাম, “সফরের যাবতীয় খরচ আমিই বহন করবো।” অতপর আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর টিকেট কিনে নিয়ে আসতাম এবং যথা সময়ে আমা সফরে উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতাম।
যদি আমার অবস্থা ভাল না হতো তাহলে অকপটে আরজ করতাম, “জনাব সফর আপনার দায়িত্বে করতে হবে।” তখন তিনি তৃতীয় শ্রেণীর টিকেট ক্রয় করতেন। সফর কালীন সময়ে আমি মাথধা ঝুঁকিয়ে নীপের দিকে তাকিয়ে থাকতাম এবং এই চেষ্টা চলতে থাকতো যেন আমাদের কোন পরিচিত ব্যক্তি আমাদিগকে থার্ড ক্লাস কমপার্টমেন্টে দেখে না ফেলে। মুর্শিদে আ’ম ঈষৎ হেসে আমার দিকে তাকাতেন কিন্তু মুখে কোন কথা বলতেন না। এটা প্রাথমিক পর্যায়ের কথা। তখনো পর্যন্ত কলিজার খুনের সংমিশ্রণে অশ্রু ব হনের পালা আসেনি। প্রেম যখন ভালবাসার রীতিনীতি শিকিয়ে দিল তখন আর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর মধ্যে কোন পার্থক্য রইলো না।
আমরা মনে করতাম যে, আমি শহীদ ইমামের মনের খুবই নিকটবর্তী। আমি কখনো তার সম্মুখে কোন অভিযোগ পেশ করিনি।কিংবা কোন ভাইয়ের বিরুদ্ধেও নালিশ করিনি। সত্য কথা বলতে কি আমি কোন দিন কোন ইখওয়ানী ভাইয়ের সাথে মতভেদ করেছি বলেও মনে পড়ে না। সাধারণ ও বিশেষ কোন বিপদ মুসিবতের ব্যাপারেও আমার কর্মপদ্ধতি ছিল এই যে, তা ইমামের সামনে তুলে ধরে তাকে পেরেশান করা সমীচীন নয়। তিনি আমাকে যখনই কোন কাজের নির্দেশ দিতেন আমি তৎক্ষনাত তা সম্পাদন করতাম। কখনো কখনো কোন আদেশ কার্যকর করতে গিয়ে বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো এবং বস্তুগত উপকরণ ব্যয় করতে হতো। তথাপি নির্দেশ পালনে যে মজা পেতাম তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
আমার পূর্বে ইখওয়ানের সদস্যদের মধ্যে কেউ উকীল ছিল না। আমার ইখওয়ানে যোগদানের পর কায়রো কিংবা কায়রোর বাইরে কোথাও ইখওয়ানের কোন কেস হলে আমিই তা পরিচালনা করতাম। প্রথমে আমার যাতায়াত শাবীনুল কানাতির ও কায়রোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ইখওয়ানের সাথে কাজ শুরু করার পর আমি মিসরের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত গিয়েছি। কখনো মুর্শিদে আ’ম-এর সাথে একযোগে সফরের সৌভাগ্য হতো আবার কখনো তার প্রতিনিধি হিসেবে সফরে যেতে হতো। আমি যদিও সহকারী মুর্শিদ ছিলাম না। তথাপি ইমাম তার পক্ষ থেকে আমাকে নির্দেশ দিতেন যাও অমুক শহরের জলসায় আমার প্রতিনিধিত্ব করে এসো। এটা কেমন ঈমান সঞ্জীবনী এবং সাহস সঞ্চয়কারী পরিবেশ ছিল। আমি হৃদয় মনে যা উপলব্ধি করি তা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাই না। যদি পেতাম তাহলে মনের কথা মনের মত ব্যক্ত করতাম।